হাবীব বলল, এটা খলীফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেককে দেবে।
আবু নছর জিজ্ঞেস করল, এর মাঝে কি?
প্রতি উত্তরে হাবীব বলল, খলীফার পয়গামের জবাব। তুমি দ্রুত রওনা হয়ে যাও, দেরী করবে না।
আবু নছর সে সময়ই রওনা হয়ে গেল এবং প্রায় বিশ দিন পর দামেস্কে এসে পৌঁছুল। থলে খলীফার কাছে অর্পণ করল।
সুলায়মান আব্দুল আজীজের মাথা দেখে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লেন।
খলীফা হুকুম দিলেন, স্পেনের আমীরের মাথা কয়েদ খানাতে নিয়ে গিয়ে তার বাপ মুসার সম্মুখে রেখে দাও।
হুকুম তামীল করা হলো, আব্দুল আজীজের মাথা মুসার সম্মুখে রেখে দেয়া হলো। মুসা পূর্ব হতেই অনেক কষ্ঠ, নির্যাতন, নিপীড়নের কারণে অত্যন্ত কাতর ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। ছেলের মাথা দেখার সাথে সাথে বেঁহুশ হয়ে পড়লেন। তিনি যখন চেতনা ফিরে পেলেন তখন মাথা সেখানে ছিল না।
ঐ কয়েদ খানাতেই মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে ঐ খলীফার নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছিল। মুহাম্মদ ইবনে কাসেম মৃত্যুর একদিন পূর্বে বলে ছিলেন, তারা এক যুবককে ধ্বংস করল আর কেমন যুবকেইনা ধ্বংস করল? মুসা তার ছেলের মাথা দেখে বললেন, তারা এমন একজন ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, যে দিনে আদল ও ইনসাফ ও উন্নয়নমূলক কাজ করত আর রাতে করতো আল্লাহর ইবাদত। আমার ছেলে সারাদিন রোযা রাখত, আর সারা রাত নামাজ পড়ত।
সমরকন্দ বিজেতা কুতায়বা বিন মুসলিমকেও বাদশাহ হত্যা করেছিলেন। কয়েদ হওয়ার পূর্বে ইবনে মুসলিম বলেছিলেন, হে উম্মতে রাসূলে আরাবী! আমি তো তোমার উত্থানের জন্যে প্রচেষ্টাকারী ছিলাম এখন তোমাকে পতন থেকে কে বাঁচাবে?
স্পেনের আমীর আব্দুল আজীজের হত্যার পর মুসা ইবনে নুসাইর বেশি দিন জীবিত থাকতে পারেননি। তার এক দেড় বছর পরে সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকও ইন্তেকাল করেন।
এটা কাহিনী নয়। এটা একটা রোমাঞ্চকর ও ঈমান উদ্দীপক উপাখ্যানের পরিণাম। এ উপাখ্যানের সূচনা হয়েছিল ৫ রজব ৯২ হিজরী মুতাবেক ৯ জুলাই ৭১১ খৃষ্টাব্দে। যখন এক খ্রীষ্টান গভর্নর আফ্রিকা ও মিসরের আমীর মুসা ইবনে নুসাইরের দরবারে এ ফরিয়াদ নিয়ে এসেছিল যে, স্পেনের বাদশাহ্ রডারিক তার কুমারী কন্যার ইজ্জত হরণ করেছে আর সে এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে চায় যা মুসলমানদের সহযোগিতা ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়। মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদকে আহ্বান করলেন।
২. মিসর ও আফ্রিকার আমীর
“আমি আমার দুই বেটীকে তোমার কাছে পণ হিসেবে রাখছি, আমি অথবা মুগীছ যদি তোমার সৈন্যের সাথে ধোকাবাজী করি, তাহলে আমার দুই বেটীকে বর্বরদের কাছে সোপর্দ করে দেবে।”
বেশী দিন পূর্বের কথা নয়, তিন-চার বছর আগের ঘটনা। এক খ্রীষ্টান গভর্নরের আবেদনে মিসর ও আফ্রিকার আমীর মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদকে আহ্বান করেছিলেন। দামেস্কের বন্দীশালায় বসে বিগত দিনের প্রতিটি ঘটনা মুসা ইবনে নুসাইরের, মনে পড়ছিল। তার চোখের সামনে অতীত জীবনের ছবি স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠছিল। তিনি স্মরণ করতে চাচ্ছিলেন না তবুও স্মৃতির দলরা এসে ভিড় জমাচ্ছিল। অতীত দিনের কথা স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠার দরুণ তার ব্যথিত হৃদয় আরো ব্যথিত হচ্ছিল। তিনি তো পরিত্যক্ত ও গযব নিপতিত জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করছিলেন। তার মনে কোন প্রকার দুঃখ, পরিতাপ ও আফসোস ছিল না। তিনি আল্লাহর নাম ও দীনের পয়গাম আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ছিলেন। নিরাপরাধী হওয়ার পরও তিনি শাস্তি ভোগ করছেন এ ব্যাপারে তিনি আল্লাহর কাছে কোন অভিযোগ করেন না। তিনি জানেন, আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট নন। তিনি দুনিয়ার সাথে সর্বোপরি সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। তিনি মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গিয়ে ছিলেন যে, তাকে কয়েদ খানাতেই মৃত্যু বরণ করতে হবে এবং তাকে কোন এক অজ্ঞাত স্থানে দাফন করা হবে। হয়তো তার জানাযাও পড়া হবে না।
তিনি জানতেন না যে তাকে যেখানেই দাফন করা হোকনা কেন বা একেবারেই যদি দাফন নাও করা হয় বরং তার লাশ যদি সাগরে নিক্ষেপ করা হয় তবুও তার নাম ইসলামী ইতিহাসে আজীবন স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। যতদিন সূর্য তার আলোকরশ্মি দ্বারা পৃথিবীকে সতেজ রাখবে, চাঁদ-তারা রাতকে করবে আলোক উজ্জ্বল ততদিন মুসা ইবনে নুসাইরের নাম থাকবে অম্লান।
তারেক ইবনে যিয়াদ কোথায় আছেন? তার তা জানা ছিল না। খলীফা দুজনকেই দামেস্কে আহ্বান করেছিলেন। তারেকের ব্যাপারে তার ভীষণ চিন্তে হচ্ছিল যে, সে যুবক সিপাহসালার স্পেন বিজেতা তার সাথেও এরূপ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সেও হয়তো এ কয়েদখানারই কোন এক অন্ধকার কুঠিতে পড়ে মৃত্যুর। প্রহর গুনছে।
মুসা ইবনে নুসাইরকে কিরূপ নির্যাতন নিপীড়ন করা হচ্ছিল তা কিছু বর্ণনা করা হলো। এরূপ নিপীড়নের মাঝে তার ছেলের মাথা কেটে এনে তার সামনে রাখা। হয়েছিল।
চিন্তায় পরিক্ৰান্ত-পরিশ্রান্ত, বার্ধক্যে কাতর, লাঞ্ছনা ও কষ্টে অর্ধ মৃত মুসা ইবনে নুসাইরের ঐ দিনের কথা স্মরণ হলো যে দিন আফ্রিকার ছোট একটি রাজ্য সিওয়াস্তার (মরক্ক) গভর্নর জুলিয়ন তার কাছে এসেছিল। সে সময়ের তাবৎ দৃশ্য তার মানস পটে ভেসে উঠল। সেদিন মুসা উত্তর আফ্রিকার একটা শহর তানজেনিয়ায় ছিলেন। তখন মুসা মিশর ও উত্তর আফ্রিকার আমীর ছিলেন। তিনি মর্দে মুজাহিদ ও সিপাহ্ সালার এবং মানব জীবনোপকরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিনি কখনো আরামে বসে থাকতেন না, শহরে-শহরে, পল্লীতে-পল্লীতে ঘুরে ঘুরে রাজ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন।