ইসাবালার প্রতিনিধি দল যখন দ্বিতীয়বার আসল, তখন মুসা দাড়ি ও মাথার চুলে খেজাব লাগিয়ে তা লাল বানিয়ে ছিলেন। প্রতিনিধি দলের লোকরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছিল যে মুসার সাদা কেশ লাল হলো কিভাবে। সন্ধির ব্যাপারে আলোচনা। হলে সিদ্ধান্ত না হয়ে আবার আলোচনায় বসার তারিখ ঠিক হয়।
কয়েকদিন পরে আবার উভয় পক্ষের মুলাকাত হলো। এ সময় তারা এসে দেখল মুসার দাড়ি ও মাথার কেশ কালো বর্ণ ধারণ করেছে। মুসার বয়স আশি বছরের কাছাকাছি ছিল। তিনি কিছুটা ঝুঁকে চলতেন। এবার তিনি একেবারে নওজোনের মত সোজা হয়ে চলতে লাগলেন। এবারও আলোচনা ব্যর্থ হলো।
মুসা অত্যন্ত কঠিন ও দৃঢ়তার সাথে শহরীদেরকে বললেন, এখন তাদের সাথে শহরের ভেতরে সাক্ষাৎ হবে এবং তাদের ফৌজের লাশের ওপর দিয়ে মুসলমানরা শহরে প্রবেশ করবে। এখন আমি নয় আমার তলোয়ার শর্ত ঠিক করবে।
প্রতিনিধি দল চলে গেল এবং তারা পরস্পরে পরামর্শ করতে লাগল, তাদের প্রধান তার সাথীদেরকে বলল, তাদের শর্ত মেনে নাও। মনে হয় ঐ সিপাহসালার মুসার কাছে হয়তো কোন অলৌকিক শক্তি রয়েছে। তোমরা লক্ষ্য কর নাই, সে কি পরিমাণ বৃদ্ধ ছিল? তার দাড়ি ও মাথার একটা চুলও কালো ছিল না, তারপর তার চুল লাল বর্ণ ধারণ করল আজ আবার সে চুলই কালো হয়ে গেছে। এখন সে নওজোয়ানের মত কথা-বার্তা ও চলা-ফেরা করছে। তাছাড়া এটাও লক্ষ্য কর মুসলমানরা দেখতে দেখতে পুরো মুলক কজা করে নিয়েছে।
মুসার তামাম শর্ত মেনে নেয়া হয়েছিল।
***
মুসা অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন খলীফার হুকুম তামিল করা উচিৎ। সুতরাং তিনি ও তারেক ইবনে যিয়াদ দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে টলেডোতে পৌঁছলেন। সালার মুগীছে রুমিও তাদের সাথে চললেন। মুসা তাকে যাবার জন্যে বলেননি।
আমীরে মুহতারাম! আমি কর্ডোভা বিজয় করেছি। কর্ডোভার গভর্নর অস্ত্র সমর্পণ করতে অস্বীকার করছিল। আমাদের ফৌজ অনেক হতাহত হয়েছিল। পরিশেষে গভর্নরকে গ্রেফতার করেছিলাম। আমীরুল মু’মিনীনের দরবারে পেশ করার জন্যে আপনি আপনার সাথে ত্রিশ হাজার কয়েদী ও অসংখ্য বাদী নিয়ে যাচ্ছেন। আমি শুধু একজন কয়েদী আমীরুল মু’মিনীনের সমীপে পেশ করব, এটা করার অধিকার আমার আছে কি? মুগীছে রুমী বললেন।
মুসা বললেন, এ অধিকার তোমার অবশ্যই রয়েছে। তারপর তাকে তাদের সাথে যাবার অনুমতি প্রদান করলেন।
টলেডোতে মুসা কয়েকদিন অবস্থান করতে চাইলেন। তাই একজন দ্রুতগামী কাসেদকে দামেস্কে এ পয়গাম দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন, মুসা এবং তারেক চলে আসছে। টলেডোতে মুসা তামাম তুহফা বেছে ঠিক করতে লাগলেন কোনগুলো খলীফার দরবারে পেশ করা হবে এবং কোনগুলো বায়তুল মালে রাখা হবে। এমনিভাবে কয়েদীর মাঝে কাকে খলীফার কাছে নেওয়া হবে তা নির্ধারণ করলেন।
জুলিয়ন ও আওপাস মুসার সাথে ছিলেন। আওপাস মেরীনাকে তালাশ করতে লাগলেন। তাদের দুজনের মধুর স্বপ্নছিল কিন্তু তা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিল রডারিক। তারেককে ইহুদী যাদুকরের লাশ হাদিয়া দেয়ার পর মেরিনা আত্মগোপন করেছিল। অনেক তালাশের পর আওপাস তার সন্ধান পেল। মেরীনার বাড়ী টলেডোতে ছিল কিন্তু সে তার বাড়ীতে না গিয়ে ছোট একটা উপাসনালয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সে সাদা কাপড় ধারণ করেছিল। মাথায় সাদা কাপড় বেঁধে রাখত। আওপাসকে দেখে তার ভেতর কোন পরিবর্তন বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো না।
আওপাস : এখানে কি করছ?
মেরীনা হালকাভাবে জবাব দিল, উপাসনা, খোদার কাছে পাপের মার্জনা প্রার্থনা করছি। তুমি এখানে কেন এসেছ?
আওপাস : তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবার জন্যে এসেছি মেরীনা!
এটা তোমার জায়গা নয়, তুমি শাহী মহলের একজন সদস্য।
ভর্ৎসনার সুরে মেরীনা বলল, শাহী মহল? ঐ মহল যার মাঝে আমার প্রেরণা, কুমারীত্ব, প্রেম-ভালবাসা কুরবানী হয়েছিল?
আওপাস : এখন সে মহলে রডারিক নয়। রডারিকের একজন সদস্যও নেই। এখন মুসলমানরা মসনদে আসনাসীন, সেখানে অন্যায়-অবিচারের লেশমাত্র নেই। কেউ শরাব পান করে না, করা হয় না কোন রমনীর ওপর অত্যাচার নিপীড়ন। মহল এখন সর্ব প্রকার পাপ পঙ্কিলতা হতে মুক্ত।
আমি অপবিত্র আওপাস! বাকী জীবন আমি আমার আত্মা পরিশুদ্ধির জন্যে প্রচেষ্টা করে যাব।
-আমি তোমাকে মুসলমানদের আমীরের কাছে নিয়ে যেতে চাই। আমি তাকে বলতে চাই, এ হলো সে রমনী যে রডারিককে পরাভূত করেছে।
– তারপর মুসলমানদের আমীর আমাকে ইনয়াম দেবে, তুমি এটা বলতে চাচ্ছ তো?
আওপাস! ইনয়াম ও ইকরামের জগৎ আমি পরিত্যাগ করে অন্য জগতে পৌঁছে গেছি। তার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র মোহ নেই।
আমীর মুসা ইবনে নুসাইর তোমাকে দেখতে চান। তিনি দামেস্কে চলে যাচ্ছেন। তোমার অন্তরে কি আমার প্রেম-ভালবাসা নেই? তোমাকে মহব্বতের দোহায় দিয়ে বলছি, আমার সাথে চল পরে আবার চলে এসো।
মহব্বতের দোহায় দেয়াতে সে আপাসের সাথে রওনা হলো।
ঐতিহাসিকরা লেখেন, মেরীনার মাঝে পূর্ণমাত্রায় পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। তার রূহানী শক্তি হয়েছিল জাগ্রত।
তারেক ইবনে যিয়াদ, জুলিয়ন ও আওপাস বিস্তারিতভাবে মুসাকে বলেছিলেন, মেরীনা কিভাবে রডারিককে পরাজিত করেছিল। সে মেরীনা এখন মুসা ইবনে নুসাইরের সম্মুখে দন্ডায়মান, তিনি মেরীনাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করছিলেন।