এ প্রশ্নের জবাব ইতিহাসে এরূপ পাওয়া যায় যে, মুসা এবং তারেক একটি শহর বিজয় করে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছেন পথিমাঝে একটি ধ্বংস স্তূপ দেখতে পেলেন তার মাঝে একটা পিলার দাঁড়িয়ে ছিল তাতে লেখা হয়েছে, “হে আওলাদে ইসমাঈল! এ পর্যন্ত তোমরা পৌঁছেছ, এখান থেকে ফিরে যাও, তোমরা যদি আরো। সম্মুখে অগ্রসর হও তাহলে তোমাদের পরস্পরে গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে যা তোমাদের একতা ও শক্তিকে বিনষ্ট করে দেবে।”
মুসা গভীরভাবে লেখাগুলো পড়ে চিন্তামগ্ন হলেন তারপর সালারদের সাথে পরামর্শ করলেন, সকলে পরামর্শ দিলেন ফিরে যাওয়াই উত্তম। আমরা যে এলাকা বিজয় করেছি তা সুষ্ঠু সুন্দরভাবে পরিচালনা করা দরকার। যাতে স্পেনের মাঝে কোন বিশৃংখলা দেখা না দেয়। সুতরাং মুসা প্রত্যবর্তনের নির্দেশ দিলেন।
এছাড়া একটা সুস্পষ্ট কারণ পাওয়া যায় তাহলো, মুসা ফ্রান্সে অবস্থানকালে একদা দামেস্ক থেকে খলীফাতুল মুসলিমীন ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেকের বিশেষ দূত আবু নসর মুসার কাছে এ পয়গাম নিয়ে গেল,
“মুসা এবং তারেক আর সম্মুখে অগ্রসর না হয়ে তাৎক্ষণিক যেন দামেস্কে পৌঁছে এবং বিস্তারিত নির্দেশের জন্যে যেন খলীফার দরবারে হাজির হয়।”
“আমীরুল মু’মিনীন কি অবগত নন যে, আমি এবং তারেক যদি এখান থেকে চলে যায় তাহলে বিজিত স্পেন আমাদের হাত ছাড়া হতে পারে?”
মুসা আবু নসরকে লক্ষ্য করে বললেন।
আবু নসর : আমীরুল মুমিনীন কি অবগত আছেন আর কি অবগত নল তা আমি জানি না। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, মুসা এবং তারেক যেন দ্রুত দামেস্কে পৌঁছে।
ইতিপূর্বেও খলীফা মুসাকে দামেস্কে পৌঁছতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি এতো ব্যস্ত ছিলেন যে সে হুকুম তামিল করার সুযোগ পাননি। খলীফার সাথে মুসার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। ফলে তার গোস্বা হবার আশংকা ছিল না। কিন্তু খলীফা তার বিশেষ দূত মাধ্যমে কড়া নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন।
আবু নসর : ইবনে নুসাইর! যদি নিজের কল্যাণ চাও, তাহলে দ্রুত আমার সাথে দামেস্কের দিকে রওনা হও।
তারেক মুসার থেকে কিছুটা দূরে ছিলেন, মুসা তাৎক্ষণিক এক দ্রুতগামী কাসেদ তারেকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
তারেক সংবাদ পাওয়া মাত্র এসে উপস্থিত হলেন।
মুসা তাকে খলীফার পয়গামের খবর শুনিয়ে বললেন, আগামীকাল ফজরের পর রওনা হতে হবে।
তারেক : আমীরে মুহতারাম! এটা কি হতে পারেনা যে, আমীরুল মু’মিনীনের কাছে…
মুসা : ইবনে যিয়াদ! আমীরুল মুমিনীন কোন ওজন্ম-আপত্তি শুনবেন না। তার মেজাজ-মর্জি সম্পর্কে আমি অবগত।
আমার তারেক বেটা! যেতেই হবে। প্রত্যাবর্তনের মাঝেই আমাদের কল্যাণ। ..
তারেক : আমি কখনো নিজের কল্যাণের কথা চিন্তা করিনা বরং সব সময় সালতানাতে ইসলামীয়ার কল্যাণ-মঙ্গলের চিন্তা করি।
মুসা : তুমি আমার হুকুম অমান্য করেছিলে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমীরুল মু’মিনীন তার নির্দেশ অগ্রাহ্য করলে আদৌ ক্ষমা করবেন না। যাও… বেটা! যাবার প্রস্তুতি নাও। আমরা ফিরে আসব। ফ্রান্সের এ উঁচু পাহাড়ের চূড়া আমাদের প্রহর গুনবে।
মুসা এবং তারেক দামেস্কে যাবার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগলেন। তারা আদৌ কল্পনা করেন না যে তারা চির দিনের জন্যে যাচ্ছেন আর কোন দিন ফিরে আসবেন না। আর দামেস্কের কারাগার তাদের জন্যে প্রতিক্ষায় রয়েছে।
৭. তারেক ইবনে যিয়াদ
মুসা ইবনে নুসাইর বললেন, “জলজ প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি এত প্রখর হয় যে, নদী ও সমুদ্রের তলদেশের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর জিনিস দেখতে পারে কিন্তু তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে যে জাল পাতা হয় তা সে দেখতে পায় না। আমি দূরদর্শী ছিলাম কিন্তু সুলায়মানের ফাঁদে ফেঁসে গেছি।”
তারেক ইবনে যিয়াদ তো আমীরুল মু’মিনীমের হুকুম অমান্য করার জন্যেও তৈরী হয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু তার সাথে যেহেতু আমীরে মুসা ছিলেন তিনি তাকে বলেছিলেন, আমীরুল মু’মীনের হুকুম অমান্য করার কোন অবকাশ নেই। এছাড়া বার্তাবাহক আবু নসরও বলেছিলেন তাকে খলীফার শাস্তির হাত তেকে বাঁচার জন্যে। তারেক যখন মুসার আদেশ অমান্য করে ছিলেন তখন তিনি আযাদ ছিলেন আর এখন তিনি মুসার অধীনে।
খলীফার হুকুমের মাঝে যদি নমনীয়তা থাকত এবং তা অগ্রাহ্য করার যদি সামান্যতম সুযোগ থাকত তাহলে মুসা অবশ্যই জবাব দিতেন যে বর্তমানে গোটা স্পেন কজাতে, ফ্রান্স পদতলে এ অবস্থায় দামেস্কে যাওয়া সম্ভবপর হচ্ছে না। দামেস্কে গেলে পুরো বিজিত এলাকা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। এ জবাবের যেহেতু অবকাশ ছিল না তাই তিনি দামেস্কে ফিরে যাওয়াই উত্তম জ্ঞান করলেন।
ঐতিহাসিক গিবন লেখেন, মুসা তার ফৌজি বাহিনী নিয়ে ফ্রান্সের মধ্যভাগ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। সে সময় ফ্রান্সের বাদশাহ্ ছিল চার্লিস মার্টিন। দামেস্কে ‘ ফিরে যাবার ব্যাপারে যদি পয়গাম না পৌঁছত, তাহলে তারেক ও মুসা দু’বীর বাহাদুর ফ্রান্স বিজয় করেই ছাড়ত। আর আজকে ইউরোপের ধর্ম খৃস্টবাদের পরিবর্তে ইসলাম হত।
মুসা ইবনে নুসাইর যুদ্ধের ময়দানে যেমন অকুতভয় বীর বাহাদুর সিপাহসালার ছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে যুদ্ধ ময়দানের বাহিরে তিনি ছিলেন অত্যধিক বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ।
নওয়াব জুলকদর জং বাহাদুর তার খেলাফতে উন্দুলুসে লেখেছেন, ইসাবালা অবরোধের ঘটনা, ইসাবালার ফৌজ অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মুসলমানদের মুকাবালা করল কিন্তু মুসলমানদের বীরত্ব-সাহসীকতায় তারা ঘাবড়িয়ে সন্ধি প্রস্তাবে রাজি হলো। মুসলমানদেরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল অনেক মুসলমান হতাহত হয়েছিল। তাই মুসা ইবনে নুসাইর সন্ধি প্রস্তাবে সাড়া দিলেন। শহরের নেতৃস্থানীয় লোক মুসার কাছে এলে তিনি তার শর্ত পেশ করলে শহরবাসী মেনে নিল না। দ্বিতীয়বার আলোচনার তারিখ নির্ধারণ হলো দুদিন পরে। সে সময় মুসার দাড়ি ও মাথার চুল পূর্ণ সাদা। তকালে খেজাব সম্পর্কে কেবল মুসলমানরাই জ্ঞাত ছিল। কারণ খেজাব মুসলমানরাই তৈরী করেছে।