অথচ সারা দুনিয়ায় মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে রাখে, মারাকেশের শাসনক্ষমতা মারাকেশের জনগণের হাতেই রয়েছে। কিন্তু এর সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য স্বাধীনতাকামীদের হাতে তেমন কোন অস্ত্র ছিলো না, না ছিলো কোন প্রচার মাধ্যম।
পুরো ইহুদী ও খ্রিষ্টান দুনিয়া মারাকেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আসলে ফ্রান্সীয় ও স্পেনিশরা প্রতিশোধ নিচ্ছিলো সালাহউদ্দিন আইয়ূবীর কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছিলো খ্রিষ্টান পরাশক্তি। পারলে তো ওরা পুরো মুসলিম বিশ্বকে ধ্বংস করে দেয়।
আবদুল করীম তার মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে নেয়। এর মধ্যে একটা বিভাগ ছিলো চার স্তর বিশিষ্ট গোয়েন্দা বিভাগ। এক বছরের মধ্যে স্বাধীনতাকামীদের মোটামুটি সুশংখল একটা সেনাবাহিনী গড়ে উঠলো আবদুল করীমের নেতৃত্বে। তবে অস্ত্রবিহীন। মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিলো এই নিরস্ত্র। এজন্য প্রথম সমস্যা এবং প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালো অস্ত্রসহ। যার একমাত্র মাধ্যম ছিলো ছোট ছোট সেনা চৌকির ওপর গেরিলা হামলা চালানো।
এখন তোমাদের প্রধান কাজ হলো প্রশিক্ষণে শেখা যুদ্ধকৌশলের চর্ম। অনুশীলন করা এবং অস্ত্র সংগ্রহ করা। এজন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলে, দখলদার বাহিনীর ছোট ছোট সেনাক্যাম্পগুলোতে নৈশ হামলা চালানো। সে হামলা হবে গেরিলা পদ্ধতিতে এবং অতি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। মনে রাখতে হবে, এজন্য শহীদ হওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হামলা চালাতে হবে। আবদুল করীম একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করে বললো,
আত্মদানকারী একদল মুক্তিযোদ্ধাও প্রস্তুত হলে গেলো। এই দলের নাম রাখা শহীদ স্কোয়াড।
***
এক গোয়েন্দা রিপোর্টের মাধ্যমে আবদুল করীম জানতে পারলো, অমুক দিন অমুক ক্যাম্প পরিদর্শনে যাচ্ছেন স্পেনিশ জেনারেল সেলিষ্টার। তার সঙ্গে এক কমান্ডো দলও থাকবে। সে ক্যাম্পে প্রায় এক হাজার সেনা রয়েছে। যারা সব ধরনের আধুনিক অস্ত্রশস্তে সুসজ্জিত। এমন এক বাহিনীর ওপর রাতের বেলায়ও হামলা চালানোর অর্থ আত্মহত্যার জন্য নাম লেখানো। আর দিনের বেলায় তো কল্পনাও করা যায় না।
কিন্তু আবদুল করীম জেনারেল সেলিষ্টারের নাম শুনতেই তার রক্ত টগবগ করে উঠলো। প্রতিশোধ স্পৃহায় আবদুল করীম যেন উন্মত্ত হয়ে উঠলো। এই জেনারেলই তো তাকে অন্যায়ভাবে কয়েদখানায় ছুঁড়ে মেরেছিলো।
আবদুল করীম মুক্তিযোদ্ধাদের ডেকে বললো, যদি এই জেনারেলের পরিদর্শনের সময় হামলা করে এবং জেনারেলকেও খতম করে দেয়া যায়, তাহলে স্পেনিশদের পা টলে উঠবে।
মুক্তিযোদ্ধারা তো এমন হুকুমেরই অপেক্ষায় থাকতো সর্বক্ষণ। লড়তে লড়তে প্রাণ বিসর্জন দেয়াকে তো ওরা কিছুই মনে করতো না। ওরা তো পণই করে নিয়েছে, একজন সাম্রাজ্যবাদীও যদি মারাকেশে থাকে তাহলে এদেশে জীবনের কোন মূল্য থাকবে না। এর চেয়ে ভালো মারাকেশের জন্য জীবন দিয়ে দেয়া। ওরা হামলার জন্য টান টান উত্তেজনা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেলো।
সংখ্যায়ও ছিলো ওরা খুব নগণ্য। আবদুল করীম ওদেরকে ট্রেনিংই দিয়েছে এমনভাবে যে, স্বল্প সংখ্যক সেনা কয়েকগুণ বেশি শত্রুসেনার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনবে। আর বিজয় অর্জন করতে না পারলেও যথেষ্ট ক্ষতি করে নিজের অক্ষত ফিরে আসবে।
নির্দিষ্ট দিনে ওদিকে জেনারেল সেলিষ্টার সেনা ক্যাম্পে পৌঁছে গেলেন। এদিকে আবদুল করীম ও তার সংক্ষিপ্ত মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের কাছাকাছি এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেলো যেখানে ওদেরকে দেখার মতো কেউ ছিলো না। ওরা সেখানে ঘাপটি মেরে রইলো।
জেনারেল সেলিষ্টার মাত্র পরিদর্শন শুরু করেছেন এমন সময় মুক্তিযোদ্ধারা ধারালো লাঠি, বর্শা, তলোয়ার ও খঞ্জর নিয়ে ক্যাম্পের ওপর হামলে পড়লো। এমন অতর্কিত হামলায় স্পেনিশদের তত দিকবিদিক হারানোর অবস্থা হলো। ওরা প্রতিরোধের সবরকম চেষ্টা করলো। জবাবী হামলা চালালো। কিন্তু ওদের হামলায় কোন জোর উঠলো না। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারাও ওদেরকে সামলে উঠার সুযোগ দিলো না।
এ দিকে আবদুল করীম তো জেনারেল সেলিষ্টারকে খুঁজতে লাগলো। ওদিকে জেনারেল তার বডিগার্ড ও অফিসারদের পরিবেষ্টনে থেকে নিরাপদে পালাতে চেষ্টা করছিলেন।
হঠাৎ একবার আবদুল করীম তাকে দেখে ফেললো। সেনা অফিসার ও বডিগার্ডরা তাকে নিচ্ছিদ্র পরিবেষ্টনে নিয়ে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে ওরা মুক্তিবাহিনীর ওপর গুলি চালালো। অনবরত ষ্টেনগানও চালালো। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে আহত হলো। কয়েকজন শহীদ হলো। কিন্তু আবদুল করীমের দৃপ্ত কণ্ঠ বার বার গর্জে উঠতে লাগলো, জেনারেল সেলিষ্টাকে আমি জীবিত বা মৃত এখান থেকে নিয়ে যাবো।
আবারো গর্জে উঠলো আবদুল করীমের কণ্ঠ, মুক্তিবাহিনীর সব শহীদ হলেও আমি জেনারেল সেলিষ্টারকে ছাড়বো না।
এ ছিলো বিস্ময়কর ও এক অসম লড়াই। বর্শা, লাঠি ও তলোয়ার লড়ছিলো স্বয়ংক্রিয় ষ্টেনগান ও বিধ্বংসী গোলাবারুদের বিরুদ্ধে। ওদিকে ছিলো বহুযুদ্ধে অভিজ্ঞ দুর্ধর্ষ অপ্রতিরোধ্য আবেগ, বিশুদ্ধ চেতনা ও গগনবিদারী তাকবীর ধ্বনি ছাড়া শক্তিশারী কোন অস্ত্র ছিলো না।
ওরা অনবরত গোলা ও বোমার আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে জেনারেলকে ঘিরে রাখা পরিবেষ্টনী দেয়াল ভেঙ্গে ফেললো। ওদিকে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধ নিহত স্পেনিশদের রাইফেল, স্টেনগান, মেশিনগানসহ অনেক ধরণের অস্ত্র নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেলো। জেনারেলকে যারা এতক্ষণ দেয়ালের মতো নিরাপত্তা প্রাচীর হয়ে আগলে রেখেছিলো, তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। ক্রুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর সামনে কেউ দাঁড়াতে পারলো না। জেনারেলকে অক্ষত অবস্থায় আবদুল করীমের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো।