ট্রেন আর সামনে বাড়লো না। যেখান থেকে এসেছিলো সেই ব্রন হলে ফিরে এলো। সঙ্গে সঙ্গে সারা এলাকায় খবর ছড়িয়ে পড়লো, গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আবদুল্লাহ ট্রেনে গুলি চালিয়েছে। প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিলো না এই দুই সাধাসিধে আফগান মুসলমান এধরনের ভয়াবহ কাজ করতে পারে। তারা বলতে লাগলো আমরা তো মোল্লা আবদুল্লাহর কাছ থেকে মাংস আনি। আর আমাদের ছেলে মেয়েরা গুল মুহাম্মদের আইস ক্রিমের জন্য পাগল। ভিনদেশী ও ভিন্ন ধর্মমতাবলম্বী এই দুজন তো সেখানকার প্রতিটি ঘরেরই প্রিয়পাত্র ছিলো।
কিন্তু ট্রেন থেকে যখন তারা মৃতদের লাশ ও আহতদের স্ট্রেচারে করে নামাতে দেখলো তখন তো সবাই রাগে ক্রোধে প্রতিশোেধর আগুনে জ্বলে উঠলো। যাদের কাছে রাইফেল পিস্তল ছিলো তারা এই বলে ঘটনাস্থলের দিকে দৌড়াতে লাগলো,
শালার দুই মুসলে (মুসলমান)! তোমরা এত বড় বেইমান নিমক হারাম।
প্রায় শতাধিক শহরবাসী সশস্ত্র হয়ে অস্ট্রেলিয়ান সেই বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিলো। সবাই মিলে তুর্কিদের ঘাটি ঘেরাও করে ফেললো। শহরের লোকেরা দাঁতে দাঁত পিষে পিষে বলতে লাগলো, গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আব্দুল্লাহকে যদি জীবিত পাওয়া যায় তাহলে দুটোকে কিমা বানিয়ে ফেলা হবে।
কিন্তু কিমা বানানোর জন্যতো আগে ওদেরকে সশরীরে ধরতে হবে। সমস্যা ছিলো এখানেই। দুই তুর্কির ঘাটিতে দুইশ এরও অধিক রাইফেল চারদিক থেকে ফায়ার করছিলো অনবরত। যখন কারো মাথা তুর্কিদের চোখে পড়তো তখনই সেই মাথা লক্ষ্য করে ফায়ার হতো। আর সঙ্গে সঙ্গে মাথাটি ঢলে পড়তো বা গায়েব হয়ে যেতো।
তুর্কিরা এবার দেখে দেখে এবং টার্গেট ঠিক করে গুলি চালাচ্ছিলো। কতজনের ঘেরাওয়ের মধ্যে তারা রয়েছে সেটাও তারা আন্দাজ করতে পারছিলো না। তারা উঁচু আওয়াজে যুদ্ধ সংগীত গাইতে শুরু করলো। তারপর আরম্ভ করলো কুরআন তেলাওয়াত। তাদের আওয়াজ এত জোরালো ছিলো যে, পাহাড়ি এলাকার দূরদূরান্ত পর্যন্ত তা শোনা যাচ্ছিলো। মাঝে মধ্যে তারা শ্লোগানও দিতে লাগলো। নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার।
ওদের মাথার ওপর পতপত করে উড়ছিলো চাঁদ তারা খচিত তুর্কি ঝান্ডা।
মাস জানুয়ারি হলেও দুনিয়ার এ অংশে এখন গরম শুরু হয়ে গিয়েছে। অবরোধকারীরা ক্রমেই তুর্কিদের গলার স্বরে স্বতস্ফূর্ততার অভাব লক্ষ্য করতে লাগলো। সবাই বুঝতে পারলো, তুর্কিরা পিপাসার্ত হয়ে পড়ছে এবং তাদের কাছে পানি নেই। প্রথমে তো তাদের গলার স্বরে দারুণ তাজা ভাবছিলো। সূর্যের তাপ যতই বাড়তে লাগলো তাজাভাব ততই হ্রাস পেতে লাগলো। এখন তাদের স্বর ভাঙ্গা ভাঙ্গা শুনাচ্ছিলো। কিন্তু তাদের রাইফেলের নল ছিলো তরতাজা। তাদের ছোঁড়া গুলিরও একটা নষ্ট হচ্ছিলো না, কেউ না কেউ নিহত বা আহত হচ্ছিলোই।
***
অস্ট্রেলিয়ান বাহিনীর কেউ কেউ তুর্কিদের ঝান্ডাটির দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলো- দেখো, গুলি লাগতে লাগতে পতাকাটির চারধার কেমন শতছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু মাঝখানে চাঁদ তারা অক্ষত আছে এবং বাতাসে পতপত করে উড়েই যাচ্ছে। ঝাণ্ডাধারী খুঁটিটাও অক্ষত।
একটুপর এই দলের সঙ্গে সেনা সাহায্য স্বরূপ আরো কিছু সৈনিক যোগ দিলো। সশস্ত্র শহরবাসীও ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এখন তারা হামলার কৌশল পাল্টে দিলো। পঞ্চাশজন অভিজ্ঞ নিশানাধারী সৈনিককে আড়াআড়িভাবে ছড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে বলা হলো, তারা যেন তুর্কিদের ঘাটিতে অনবরত ফায়ার করে যায়। যাতে ওরা মাথা উঠাতে না পারে। একশজনকে একত্রিত করে নির্দেশ দেয়া হলো, তারা ফায়ারও চালিয়ে যাবে এবং বিভিন্ন দিক দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে তুর্কি ঘাটিতে পৌঁছতে চেষ্টা করবে। তারপর সব এক সঙ্গে হামলে পড়বে।
শুরু হয়ে গেলো এই অপারেশন। গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আবদুল্লার মোর্চার আশ পাশের এলাকায় গুলি বৃষ্টি হতে লাগলো। পাথরে গুলি লেগে চার দিক পাথর গুঁড়ায় ঝাপসা হয়ে উঠলো। তখন আর তুর্কিদের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো না। ওদের ফায়ারও কমে এলো অনেকখানি।
অবশেষে একশজনের এই কমাণ্ডো দল দুই তুর্কির মোর্চার ওপর গিয়ে হামলে পড়লো। কিন্তু সেখানে জীবিত ছিলো শুধু মোল্লা আব্দুল্লাহ। গুল মুহাম্মদ শহীদ হয়ে গিয়েছিলো। তার দেহে ছয়টি গুলি লেগেছিলো। প্রথমে একটি গুলি তার বাহুতে লাগার পর আরেক হাত দিয়েই ফায়ার চালিয়ে যাচ্ছিলো গুল মুহাম্মদ।
মোল্লা আব্দুল্লাহ ফায়ার করতে পারছিলো না। কারণ, একটি গুলি তার গালের চোয়ালের হাড় ভেঙ্গে বের হয়ে গিয়েছে। আরেকটি গুলি তার খুপড়ির হাড় ভেঙ্গে বের হয়ে গেছে। তবে মাথার ভেতর দিক খতগ্রস্ত হয়নি। সেখান থেকে অঝোরধারায় রক্ত ঝরছিলো। তাকে স্ট্রেচারে করে পাহাড় থেকে নামানো হলো। আশংকা করা হচ্ছিলো লোকেরা তাকে দেখে তার ওপর হামলে পড়বে। কিন্তু তাকে দেখেই সমবেত জটলা দূরে সরে গেলো। তখন অনেকের চোখেমুখে বিস্ময়, মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধার ঝলক দেখা যাচ্ছিলো। কয়েকজন বলে উঠলো—
এদের মতো সত্যিকারের দেশ প্রেমিক বীর সাহসী আর কেউ কখনো দেখেনি এবং দেখবেও না হয়তো।
মোল্লা আব্দুল্লাহ হাসপাতাল শুয়ে শুয়ে কোনক্রমে মাথা উঠালো। ভেঙ্গে যাওয়া চোয়াল নিয়েও প্রাণবন্ত আওয়াজে বলে উঠলো