যুদ্ধের অবস্থা যখন চরম হতাশাজনক ঠিক এমন সময় সুলতান লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নীচে নেমে দু’রাকাত নফল নামায পড়লেন। এমনটি তিনি এবারই প্রথম করেননি। আরো বহু বার করেছেন এবং নামাযের পরই যুদ্ধের পরিস্থিতি বদলে যেতে দেখা গেছে। এবারও তিনি দু’রাকাত নামায পড়লেন। নামাযে তার দু’চোখ গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। সেনাপতি আবুল হাসান তার কাছেই দাঁড়ানো। সুলতান নামায শেষ করে সেনাপতি আবুল হাসানের হাত ধরে উচ্ছ্বাসের সাথে বললেন, “আবুল হাসান! বিজয় আমাদের!” তিনি আবুল হাসানকেও অশ্বারোহণ করার কথা বলে গযনী বাহিনীর পতাকা আরো উঁচু করে ধরার নির্দেশ দিয়ে নিজে সাধারণ সৈনিকের মতোই লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে গেলেন। সেনারা তখন চিৎকার দিয়ে একে অপরকে জানিয়ে দিলো, গযনীর যোদ্ধারা। সুলতান নিজে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছেন, এগিয়ে যাও, মুশরিকদের কেটে ফেলো।
অন্যান্য যুদ্ধের মতো সুলতান হাতে তরবারী নেয়ার পর যুদ্ধের কায়া বদলে গেল। ঐতিহাসিক ফরিশতা লিখেছেন, সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বের এই হামলা এতোটাই ভয়াবহ ছিলো যে, অল্পক্ষণের মধ্যে দুই রাজার সৈন্যদের মধ্যকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো এবং গযনীর কিছু সংখ্যক যোদ্ধা উভয় রাজার রক্ষণভাগে আক্রমণ করে তাদের ঝাণ্ডা গুঁড়িয়ে দিলো। ফলে উভয় রাজা জীবন বাঁচাতে রণাঙ্গন ছেড়ে পালালো। এরপর শুরু হলো উভয় রাজার সৈন্যদের কচুকাটা। কিছুক্ষণের মধ্যে পাঁচ হাজার হিন্দু সৈন্যের মরদেহ গযনী সেনাদের ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হতে লাগলো। কিছু সংখ্যক হিন্দু সেনা পালানোর চেষ্টা করলো কিন্তু গযনীর সিংহশাবকেরা তাদের পালাতে দিলো না। তরবারীর আঘাতে সবাইকে ধরাশায়ী করে ফেললো।
* * *
যুদ্ধরত অবস্থাতেও সুলতানের কাছে প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহর দুর্গ থেকে আসা হিন্দুদের মোকাবেলার পুনঃপুনঃ রিপোর্ট আসছিলো। এদিকের যুদ্ধ শেষ হলে সুলতান আবু আব্দুল্লাহর কাছে খবর পাঠালেন, তুমি যুদ্ধ করতে করতে ওদের না বুঝতে দিয়ে পিছিয়ে এসো। প্রধান সেনাপতি এই কৌশল অবলম্বন করলে সোমনাথ দুর্গের সৈন্যরা গযনী বাহিনীর উপর চাপ বৃদ্ধি করার লোভে অনেক খানি এগিয়ে এলো। এ পর্যায়ে সুলতান সেনাপতি আবু হাসানকে নির্দেশ দিলেন, তুমি দুর্গপ্রাচীর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে হিন্দুদের উপর পেছন দিক থেকে আক্রমণ করো। তখন দুর্গের ফটক বন্ধ ছিল।
গযনী বাহিনী যখন হিন্দুদের উপর পেছন দিক থেকে আক্রমণ করল, তখন তারা জানতে পারলো তাদের সহায়তার জন্যে রাজা ব্ৰহ্ম ও রাজা দেবআশ্রমের নেতৃত্বে যে দুটি সেনাদল এসেছিলো তাদের সবাই নিহত হয়েছে এবং তারা এখন গযনী বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে রয়েছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে হিন্দুদের মনোবল ভেঙ্গে গেল। ঝিমিয়ে পড়লো তাদের আক্রমণের তেজ। তখন হিন্দু সেনারা আত্মরক্ষার লড়াইয়ে লিপ্ত হলো এবং পিছিয়ে এসে দুর্গে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু গযনীর সেনারা তাদের পিছনে সরে যাওয়ার অবকাশ দিলো না। সামনে যাওয়া মাত্রই কচুকাটা করছিলো।
অপরদিকে গযনীর একদল প্রশিক্ষিত সৈনিক দুর্গ প্রাচীর ও ফটক ভাঙ্গার কাজে লেগে গেল। যেসব হিন্দু দুর্গপ্রাচীরের উপরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলো এরা চিৎকার শুরু করে দিলো, সোমনাথের সব সেনা মারা গেছে। মুহূর্তের মধ্যে সারা শহরে এখবর ছড়িয়ে পড়লো। এ খবর শুনে যেসব সেনা দুর্গের ভেতরে ছিল তারা দুর্গের পেছন তথা সমুদ্রপাড়ের ফটক খুলে নৌকা করে পালাতে শুরু করে দিলো। এ খবর সুলতান মাহমূদের কানে পৌঁছলে তিনি বললেন, ওপাশের সেনা ইউনিট যেন নৌকা কজা করে ওই ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে।
নির্দেশ পৌঁছা মাত্রই ওইপাশে কর্তব্যরত সেনা ইউনিট কিছু নৌকা কজা করে পলায়নপর হিন্দুসেনাদের উপর তীর বর্ষণ শুরু করলো আর কিছু সেনা নৌকায় আরোহণ করে সমুদ্রের দিকের ফটকে পৌঁছে গেল। ফটক ছিলো খোলা এবং সেখানে কোন নিরাপত্তারক্ষী ছিলো না। ফলে বিনা বাধায় তারা দুর্গে প্রবেশ করলো।
এদিকে তখন প্রধান দুই ফটক খুলে ফেলা হয়েছে। কারো কারো মতে শহরের চোরা গলিতে গযনী সেনাদের নাস্তানাবুদ করার জন্যে হিন্দুরাই দুর্গ ফটক খুলে দিয়েছিলো।
বস্তুত দুর্গে তখন গযনী সেনারা দলে দলে ঢুকে পড়েছে। শহরের অধিবাসীরা তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু সবাই কাটা পড়ছে। শহরের হিন্দুরা উপর থেকে তীর ছুঁড়ে অনেক গযনী সেনাকে আহত করেছে। বহু হিন্দু মহিলা ছাদের উপর থেকে গযনী সেনাদের উপর পাথর ছুঁড়ে হতাহত করেছে। এই অবস্থা দেখে কিছু সেনা কয়েকটি বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলে হিন্দুরা আতঙ্কিত হয়ে প্রতিরোধের আশা ত্যাগ করে আত্মরক্ষার জন্যে ছুটাছুটি শুরু করে। শহরের লোকদের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে সোমনাথের সকল প্রতিরোধ যোদ্ধা নিহত হয়েছে। যারা দুর্গের ভেতরে ছিলো তারাও সমুদ্র পথে পালিয়ে গেছে। এ খবর শোনার পর সাধারণ হিন্দুদের প্রতিরোধ যুদ্ধ থেমে যায়। তারা পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে যে যার মতো করে জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধ থেমে যায়।