মাহমূদ! সম্পদের প্রাচুর্য, সুন্দরী নারী আর সুরম্য প্রাসাদ সৎ নেতৃত্বের জন্যে বড় বাধা। মানুষের বড় দুর্বলতা, এসবের মধ্যে কেউ নিজেকে আটকে ফেললে সে ভোগ-বিলাসিতার শিকলে বাঁধা পড়ে যায়, সে শয়তানের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। এখন তুমি পূর্ণ যুবক। তারুণ্য ও যৌবনের মিলন মোহনায় তুমি উপনীত। এ এক কঠিন ক্রান্তিকাল। অধিকাংশ মানুষ এই সময়ে লক্ষ্যচ্যুত হয়, জীবন ও কর্মের পরিণতি ভুলে যায়। তুমিও যদি এ সময়ে আরাম আয়েশ, রঙিন স্বপ্ন ও বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দাও, ভোগের গভীরে নিজেকে তলিয়ে দাও, তবে সেখান থেকে ফিরে আসা আর সম্ভব নয়। বিলাসী শরীরের তন্ত্ৰীগুলো মরে যায়, এই মরা মানুষ দিয়ে কি পৃথিবীর ইতিহাস গড়া যায়? এজন্য প্রয়োজন ত্যাগী মানুষ। জীবন্ত মানুষ। তোমাকে আমি আদর্শ মানুষরূপে দেখতে চাই।
এ সব কথা শুনে মাহমুদ বললো, আব্ব! আপনি আমাকে ওই বাগান বাড়িতে আর দেখবেন না। আমি আমার পূর্বসূরিদের উত্তরাধিকার কখনও বিস্মৃত হব না। আমার হৃদয়ে এ কথা গেঁথে নিয়েছি, আমি ময়দানের লোক, রণাঙ্গনের লড়াকু সৈনিক, যুদ্ধক্ষেত্র আমার আসল ঠিকানা।
তুমি যদি ইসলামের ঝাণ্ডা বুলন্দ করতে গিয়ে লড়াই করে শাহাদাত বরণ কর, তবে আমি তোমার তৈরি উদ্যানে তোমাকে সমাহিত করবো, তোমার কবরের চারপাশে বাহারী রঙের অগণন ফুলের সমারোহ ঘটাবো। এই বাহারী বাগানে চিরসুখে শুয়ে থাকবে। এ বাগান হবে তোমার চির সুখনিদ্রার ঠিকানা।
পিতার উপদেশ ও অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছিলেন শাহজাদা। সুবক্তগীনের কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছিল তার জীবনে। সতের বার ভারত আক্রমণের স্মৃতিবাহক সতেরো স্তম্ভের এখন আর কোন খোঁজ নেই। সুলতান মাহমুদের বাগান বাড়িরও কোন হদিস নেই। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় জীবন্ত হয় আছে সুলতান মাহমূদ ও তার ঐতিহাসিক ভারত অভিযান। এখনও পৌত্তলিক হিন্দুদের কাছে, মূর্তিপূজারীদের কাছে সুলতান মহাতঙ্ক, মূর্তিসংহারী, বিজয়ী অবয়ব। পৃথিবীর মানুষ তাকে স্মরণ করবে চিরকাল।
কিছুদিন আগে রাজা জয়পাল যখন পেশোয়ার হয়ে গজনীর দিকে যাচ্ছিল, তখন তার রাজকীয় জৌলুস ও জাকজমক দেখে পাহাড়-নদীও যেন কুর্নিশ করে তার চলার পথ করে দিতো। সাধারণ মানুষ জয়পালের হস্তিবাহিনী ও বিশাল অশ্বারোহী সৈন্যদের দেখে ভয়ে দূরে চলে যেতো। আর আজ গজনী থেকে পালিয়ে আসা রাজাকে দেখে পেশোয়ারের প্রজারা বিস্মিত হলো। তারা চিনতেই পারছিল না, এ লোক কি তাদের রাজা না এটা রাজার প্রেতাত্মা!
রাজার বিশাল সামরিক বাহিনী বিক্ষিপ্ত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে বেহাল অবস্থায় ফিরে আসে। যে সব হাতি রণসাজে মাথা উঁচু করে যুদ্ধযাত্রা করছিল, সেগুলোর মাথা ছিল ক্ষত বিক্ষত অবনমিত। এদের চলার গতি দেখে মনে হচ্ছিল, এরা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যাবে এখনই।
পেশোয়ারের রাজপ্রাসাদে রাজাকে অভ্যর্থনা জানাতে নাকারা বেজে উঠল। দুই সারিতে নিরাপত্তা রক্ষীরা দাঁড়িয়ে গেল দু’পাশে। রাজা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, এসব বাদ্য-বাজনা বন্ধ কর। একান্ত রক্ষীদের একজনকে বলল, “পণ্ডিত দু’টোকে এক্ষুনি আমার সামনে হাজির কর।”
পেশোয়ার রাজমহলে নেমে এলো মৃত্যুর বিভীষিকা। রাজমহলের বাসিন্দারা যেন সব মৃতবৎ। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। মাত্র দু’তিনজন হাঁক ডাক করছিল, এ পণ্ডিত কোথায়, কোথায় পণ্ডিত মহারাজ?”
রাজা একটি বদ্ধ কক্ষে রাগে, ক্ষোভে, অপমানে, আত্মগ্লানিতে টলছিল। = নিজের উরুতে নিজেই থাপ্পড় মারছিল আর দু’হাত কচলাচ্ছিল। কখন দু’পণ্ডিত ন তার খাস কামরায় প্রবেশ করে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছে সে দিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।
সবচেয়ে বড় পণ্ডিত বাটাণ্ডায় থাকতো। রাজা যখন গজনী আক্রমণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয় তখন পণ্ডিত মহারাজও লাহোর আগমন করে। এই পণ্ডিতই রাজাকে গজনী অভিযানের শুভক্ষণ বলে দিয়েছিল। পণ্ডিতরা রাজাকে এই নিশ্চয়তাও দিয়েছিল যে, পৃথিবীর কোন শক্তি তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম হবে না, রাজার বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
“মহারাজ! আমরা আপনার দরবারে হাজির হয়েছি”- বলল বড় পণ্ডিত। চকিতে রাজা ঘুরে দাঁড়াল। তার চেহারা অপমান, ব্যর্থতা আর ক্ষোভে পাণ্ডুর, গোস্বায় তার চোখ দুটি দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। সত্য আর মিথ্যার দোলাচলে দোদুল্যমান রাজার মন।
“তোমরা মিথ্যা বলেছিলে, না যে পুঁথি দেখে তোমরা শুভ দিন নির্ধারণ করেছিল ওগুলোতে মিথ্যা লেখা হয়েছে?” গম্ভীর আওয়াজে পণ্ডিতদের জিজ্ঞেস করল রাজা।
আমরাও মিথ্যা বলিনি, পুঁথির কথাও মিথ্যা নয়। তারকা কখনও মিথ্যা নির্দেশ দেয় না মহারাজ! এক পণ্ডিত বলল। আমরা আপনাকে এখনো শুভক্ষণটা হিসেব কষে দেখাতে পারব।
“তোমরা লক্ষবার হিসাব করোগে! কিন্তু আমার সামনে চরম অবমাননাকর পরাজয়ের বাস্তবতা বিদ্যমান। আমি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসেছি। ধ্বংস হয়ে গেছে আমার সেনাবাহিনী।
“তোমাদের ওসব ভবিষ্যদ্বাণীর কি হলো? তোমরাই আমাকে উদ্বুদ্ধ করে বলেছিলে, শুভ এই অভিযান। তোমরাই তো শোনালে আমাকে দেবতার আশীর্বাদের দৈববাণী। তোমরাই পণ্ডিতদের সাথে নিয়ে যেতে বলেছিলে এবং উপদেশ করেছিলে, লড়াই শুরু করার আগে এই মূর্তি আর কৃষ্ণ দেবতাকে সিপাইদের সামনে রেখে পূজা-অর্চনা করে লড়াই শুরু করতে। এসব করলে আমার সৈনিকরা পাহাড় ধসিয়ে দিতে সক্ষম হবে। তোমাদের কথামতো সব আয়োজনই আমি করেছিলাম। লড়াই শুরু করার আগে মূর্তি আর দেবতাদের পূজা-অর্চনা শুরু হলো, কিন্তু তা শেষ না হতেই মুসলিম সৈন্যরা আমাদের উপর ঝড়ের বেগে হামলা করল। প্রচণ্ড তুফানের মতো এসে ওরা সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে ফেলল, আমরা খড়কুটোর মতো পিষ্ট হতে লাগলাম। ওরা আমাদের দেবতা, অবতার আর মূর্তিগুলোকে ভেঙেচুরে মাটিতে মিশিয়ে দিল। তোমরা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে দেখে এসো, আমাদের দেবমূর্তিকে মুসলমানরা কিভাবে পায়ে পিষে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে!