তোমার প্রেম আমার রাগ রাগিণী সব কিছুকেই ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তোমাকে রাণী করার খাব আমাকে পাগল করে তুলেছিল। তোমার স্বামী আমাকে উন্মাদ বানিয়েছিল। আমি সকলের কাছে প্রবাদপ্রতীম ছিলাম। আমিই ইসলামী তাহযীব-তামাদুনের আমুল পরিবর্তন এনেছি। পুরুষের চুল বড়, দাড়ী খাটো এবং আমীর-ওমরাদের মেয়েদের পোশাক টেডি করেছি।
এলোগেইছ বলত, স্রেফ সৈন্য ও তলোয়ার দ্বারা বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়। সুলতানা বলল, জাতির অন্তরঙ্গ জীবন, অবসর সময় ও বিনোদনে বিস্মৃতি আনো তাহলে ওই জাতি তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়বে। হায়! যে জাতি এক সময় তলোয়ারের ছায়ায় ঘুমাত সে জাতি আবার মিউজিকের ধূম ধাড়াক্কায় মেতে উঠল।
আমি সামান্য সময়ের ব্যবধানে বুঝতে পারলাম তোমার হৃদয়ে আমার ঠাই নেই। তুমি আমার সাথে খেল-তামাশা ও অভিনয় করে যাচ্ছে। কিন্তু আমার হৃদয়ে গাথা তোমার প্রেমকে সহজে মেটাতে পারলাম না। কাজেই আমার জাতির শিরা-উপশিরায় খ্রিষ্টত্বের বিষ ঢুকিয়ে দিলাম।
স্বীকার করছি তোমাকে আমি প্রেমের নামে ধোকা দিতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার প্রেমে তোমার উম্মাতাল ভাব দেখে নিজেও ধোকায় জড়িয়ে গেছি এবং জীবনে এই প্রথম সেই ধোকাময় প্রেমের বাস্তবতা অনুধাবন করে অমৃতস্বাদ নিচ্ছি। আমি এলোগেইছকে বলেছিলাম, আমি তাকে ধোকা দিতে পারব না। প্রেমকে খেল তামাশার বস্তু মনে করে যিরাবের আবেগকে দলিত-মথিতও করতে পারব না।
আমার আবেগ আজো তথৈবচ, তোমার যৌবনে যা ছিল। তুমি চাইলে আজো যে কোন কোরবানী করতে প্রস্তুত। প্রেমের টান থাকা সত্ত্বেও তুমি যেমন অনেক কথা আমার কাছে গোপন রেখেছে সেভাবে আমিও অনেক কথা তোমার থেকে গোপন রেখেছি। সেগুলো আজ শুনে নাও…….. আমি যখন শুনলাম ফ্লোরা এক মুসলমান বাবার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও খ্রীস্টবাদের জন্য নিজেকে ওয়াকফ করেছে তখন তাকে খোর বড্ড শখ পয়দা হয় মনে।
স্পেনে দুধরনের গোয়েন্দা ছিল। কিছু রাজনীতির আর কিছু ফৌজি। ওদের মাধ্যমে আমি ফ্লোরার সন্ধান পাই। একবার শুনতে পাই, কর্ডোভা থেকে মাইল খানেক দূরে কোন এক গ্রামে এলোগেইছ ও ফ্লোরা অবস্থান করছে, তখন আমি রওয়ানা হয়ে যাই। ওই গ্রামে গিয়ে আমার লোক দ্বারা গোপনে এলোগেইছের কাছে খবর পাঠাই যে, ফ্লোরাসহ আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী আমি।
গ্রামবাসী আমাকে দেখল, কিন্তু কেউ ধারণাও করতে পারল না যে, আমি রাজ প্রাসাদের নামীদামী সঙ্গীতজ্ঞ।
***
সুলতানা কায়মনোবাক্যে যিরাবের কথা শুনে যাচ্ছিল। শরাবের পেগ-এ ঠোঁট ছোঁয়ানোর ফুরসৎ কৈ তার। যিরা বলে চলেছেন, আমাকে এক বিরান ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। টিতে মাকড়সার জাল বাসা বাঁধা। দেয়ালের চুন-সুড়কিগুলো খসে পোড়া ইটগুলো আমার দিকে তাকিয়ে যেন হাসছিল। মনে করেছিলাম আমাকে বুঝি হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু এলোগেইছের আচমকা আগমন আমার ভুল ভাঙ্গাল, হেরেমের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ এই দূর-সুদূরে আগমনের কষ্ট করতে গেল কেন তা জানতে পারি কি?
আমার প্রতি তার সন্দেহ ছিল। বললাম, তোমার হতবুদ্ধি খামাখা নয়। তোমাকে আমি কোনদিনও ধোকা দিয়েছি কি? ধোকা দিলে তুমি এখানে আসতে না দিলে কেউ এসে তোমাকে ও ফ্লোরাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেত। আমি তোমার মিশনের সহযাত্রী।
সে প্রশ্ন করল, কোন সে খায়েশ তোমাকে এখানে টেনে এনেছে? আমি বললাম, আমি ফ্লোরাকে দেখতে এসেছি। লোকেরা বলে, ফ্লোরা যিরাবের সঙ্গীতের চেয়ে আকর্ষণীয়। এলোগেইছ আমার সাথে আরো কিছু কথা বলার পর বুঝল আমি তার সাথে প্রতারণা করতে আসিনি। সে আমাকে আরেকটি ঘরে নিয়ে গেল। খানিকবাদে এক নওজোয়ান যুবতী এলে সৌন্দর্যে আমার চোখ ছানাবড়া। সুলতানা তুমিও যৌবনে সুন্দরী ছিলে খুব। এতে ফ্লোরা তোমার চেয়ে একধাপ এগিয়ে। খ্রীস্টানের বাচ্চীর চেহারা কেবল আকর্ষণীয়ই নয় যাদু ছিল তাতে। তার ঠোঁটের মদুকম্পন জমিনে কম্পন তুলত। ডাগর ডাগর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারত না কেউই।
এলোগেইছ ফ্লোরাকে বলল, ফ্লোরা! ইনি রাজ প্রাসাদকে হাতের ইশারায় নাচান এবং আমাদের মিশন সফল করার প্রধান রূপকার। ফ্লোরা অগ্রসর হয়ে আমার ডান হাত তার উভয় হাতের মাঝে পুরে নিল। প্রথমে চুমো পরে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করল। তাঁর পঙ্কবিম্ববৎ ওষ্ঠাধরের মুচকি হাসি আমার আপাদমস্তকে কাঁপন ধরাল। মনে হলো এ কোন দেহ নয় আত্মার প্রতিবিম্ব। সুলতানা। ফ্লোরা ফুল নয়– কলি। আমি ওকে বললাম, ফ্লোরা! তুমি এত নজর কাড়া সুন্দরী, তুমি কি না করতে পার। তুমি তোমার যৌবনকে এভাবে তিলে তিলে নিঃশেষ করছ কেন?
ফ্লোরা বলল, শুনেছিলাম তুমি বিশ্ববিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ। কিন্তু তোমার এতটুকু জানা নেই যে, কিছু একটা করতে হলে দৈহিক শক্তির দরকার নেই। মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তাধারা পরিপক্ক হলে আত্মিক বলে বলীয়ান হলে সেটাই যথেষ্ট। এলোগেইছ বলেছিল, মাদ্রিদ ও টলেডোর বিদ্রোহ ফ্লোরার চিন্তাধারার ফসল। এই ফ্লোরা বন্দীত্ব থেকে পালিয়েছিল। খ্রীস্টানরা বাজারে ও কাজীর দরবারে প্রকাশ্য যে ইসলাম বিরোধী প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল এর হাতে খড়ি ফ্লোরার মাধ্যমে।
ফ্লোরার এই ধর্মান্ধ খীস্টত্ব– প্রেম দেখে আমার চৈতন্যোদয় হলো। ভাবলাম, আমি একজন পুরুষ। মানুষ আমাকে মহাজ্ঞানী মনে করে আর আমি ঠিক ওদের নাচের পুতুল। এ সময় আমার ভেতরের লুকানো ধর্ম-মানুষটি আড়মোড়া দিয়ে জেগে ওঠে। লজ্জায়-অনুতাপে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। আমার চিন্তাজগতে বিপ্লবের বান ডাকল। ফ্লোরা ও এলোগেইছকে বললাম, তোমাদের সাথে আছি, কিন্তু মনে মনে কসম করলাম, ওদের সঙ্গ দেব না কোনদিনও।