তোমার বাবা মারা গিয়েছেন। তোমার ভাই এসেছিল কেন?
ওই আইবুড়োকে বিয়ের চাপ দিতে। ভাই আমাকে লোভ দিয়ে বলেছিল বিয়েতে রাজী হলে জলদি মুক্তির ব্যবস্থা করবে।
চীফ জাস্টিস কি তার রায় ফিরিয়ে নেবেন? কেন, তোমাকে তো ইসলাম অবমাননার দায়ে বন্দী করা হয়েছে বলল আরেক মহিলা।
ফ্লোরা সুযোগ বুঝে চীফ জাস্টিসের নিন্দাবাদ করে বলল, তোমরা এসব বিচারপতিকে ফেরেশতা জ্ঞান কর। কাজী সাহেব আমাকে যে দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, নারীরা প্রথম নযরেই তা বুঝে ফেলে। কাজীর ওই দৃষ্টির জবাব যথাযথভাবে আমি দিলে বাবার এই পরিণতি হত না এবং বন্দীও হতাম না। কাজী ও স্পেন আমীরগণ পর্দার অভ্যন্তরে নারী আর শরাবে ডুবে থাকবে, শান্তি আমার ভাগে আর সুফল ভোগ করবেন তারা।
সুন্দরী নারীর সৌন্দর্য-ই তার বড় অপরাধ। যৌবনই তোমার প্রধান অপরাধ। নজরকাড়া সৌন্দর্যও। স্পেন শাসক তোমাকে দেখামাত্রই তার হেরেমে নিয়ে নেবেন।
ওদিন হবে আমাদের জীবনের শেষ দিন।
এক্ষণে তোমার চিন্তা কি? কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে?
তোমাদেরকে বলতে চাই। আমি পলায়ন করব না। দেব না ধোকা। এতে শাস্তি পাবে তোমরা। নারী নারীকে ধোঁকা দেয় না। দিতে পারে না। তোমরা কিছুক্ষণের জন্য চলে গেলেও আমাকে এখানে পাবে। হ্যাঁ! আমি পালিয়ে গেলে যাব কোথায় তা পালানোর পরই ভেবে দেখব। সর্বান্ন তোমাদের তিনজনকে বলব, আমাকে তোমাদের আশ্রয় নিয়ে নাও।
***
প্রহরী তিন নারী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তারা ওকে চুপ চাপ দেখলেন। দেখলেন নিপ-নির্বিকার। সুতরাং ওরা যেমন একটা গা-ছাড়া ভাব দেখানো শুরু করলেন। ফ্লোরার খোদাপ্রদত্ত যাদুবলে আপনার মনগড়া অতীত কাহিনী শুনিয়ে সহানুভূতি পরায়ণ করে তুলেছিল।
পাঁচদিন পর পয়ত্রিশোর্ধ এক লোক এলেন। যৌবনপুষ্ট তার দেহ। মুখভর্তি দাড়ি। মাথায় পাগড়ী, চোখে ইলমের দূতি। চাল-চলন ও লেবাস-পোষাকে আলেম মনে হয়। হাতে দুটি কেতাব। তিনি দরজায় করাঘাত করলেন। প্রহরী দরজা খুলে দেয়। আলেম সাহেব সরকারী পরোয়ানা দেখান। ওতে লেখা, ইনি ফ্লোরাকে তালীম দেবেন এবং যথাযথ দীক্ষাও দেবেন।
তাকে ভেতরে ডেকে দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো এবং ফ্লোরার সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। ফ্লোরা তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। তৎক্ষণাৎ তার চেহারায় ঘৃণার কালো রেখা ফুটে ফুটে ওঠল। এতদসত্ত্বেও সে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে অভিনন্দন জানাল। আলেম সাহেব বললেন, শুনেছি তুমি নাকি আল্লাহ ও তার রসূলের নাফরমানি করেছ। যাচ্ছেতাই বলে গাল দিয়েছ। তোমাকে এর শাস্তি দেয়া ঠিক হয়নি। এক্ষেত্রে মূল অপরাধী তোমার বাবা, পরে তোমার মা। বসো৷ মন থেকে বন্দীদশার বেদনা মুছে ফেল, খোদা তায়ালাকে বক্রদৃষ্টিতে দেখার বয়স তোমার। রূপের গর্বে তুমি অন্ধ হয়ে গেছ। ধর্ম তোমার কাছে তাই ঠেকেছে বিরক্তির এক অধ্যায় হিসেবে। বলো আমার এই সন্দেহ অমূলক কি-না?
না। ফ্লোরা মনের কথা গোপন রেখে বললো, এই প্রথম কোনো পুরুষের মুখোমুখি হলাম, যে আমার সৌন্দর্যের অনুভূতি প্রকাশ করল। নিজকে কখনও খেলাঘরের ছোট্ট শিশুটি মনে করতাম– যুবতী নয়। আপনার কি মনে হয় বাচ্চা নই কি এখন?
হা! তুমি অবুঝ এখনো। এজন্যই বলেছি। তোমাকে শাস্তি দেয়া ঠিক হয়নি। তোমার বয়স কম দেখে কাজী সাহেব প্রথম শাস্তি দিতে চাননি। যা হবার হয়ে গেছে। তোমার শিক্ষাদীক্ষার ভার আমাকে দেয়া হয়েছে। সর্বান্তঃকরণে তুমি ইসলামকে মেনে নেবে তো?
ফ্লোরা অবুঝ নয়-সেয়ানার হাড়ি। দেহের চেয়ে তার মনের পরিপক্কতা বেশী। এই পরিপক্কতাবলে সে প্রতিবেশী এক যুবককে কুপোকাত করেছিল। পুরুষদের মাত করার কৌশল রপ্ত ছিল তার। ফ্লেরাকে সেই যুবকই পলায়ন করার সুযোগ করে দিয়েছিল। যদিও বেচারার প্রাণ হরণ করেছিল এই ফ্লোরা। কিন্তু এতো এক আলেম। যার কথার প্রতিটি ছত্র দ্বারা ধর্মানুরাগ টপকে পড়ছে। ফ্লোরা তার চোখে চোখ রাখল। ঠোঁটে এমন এক মুচকি হাসি টানল যাতে আলেমের দেহে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হল।
আমি ধর্ম গ্রহণ করব কি-না, তা নির্ভর করে এ কথার ওপর যে, প্রস্তাবকের গ্রহণযোগ্যতা কতখানি?
আলেম সাহেব এই অপ্রত্যাশিত কথায় চমকে উঠলেন।
ফ্লোরা বলল, আপনি দৈনিক আসলে গ্রহণ করতেও পারি। তবে শর্ত হচ্ছে, আমাকে নিরস ও কঠোর কথা বলতে পারবেন না। এ কথাও ভুলবেন না যে, আমি বন্দিনী। বিলকুল ওই বিহঙ্গের মত খাঁচায় আটকে যে আঁইটাই করে।
তুমি কি মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়াল দিতে চাও।
না। মুচকি হাসতে চাই। ধর্ম যদি আমার আবেগকে মেরে ফেলে তাহলে খুব সম্ভব আমি আপনার শিক্ষার প্রতি অনুকূল সাড়া দিতে পারব না।
তুমি কি আমার সাথে হাসি-খেলা করতে চাও?
আপনি আমার জরুরত পূরণ করলে আপনার বাদী হয়ে যাব, আপনার শিক্ষা আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিফলিত হবে।
আলেম সাহেবের মুখ থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসি বেরিয়ে এল, তুমি বড় বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমি তোমার শৈশব ফিরিয়ে আনব। এক্ষণে এসো শেখানোর পালা শুরু করা থাক। এসো বসবে।
***
স্পেন শাসক দ্বিতীয় আবদুর রহমানের শাহী হেকিম ছিলেন হুররাণী। ঐতিহাসিক বর্ণনায় তার পূর্ণ নাম অনুপস্থিত। সিরিয়ায় তার বাড়ী। স্পেনের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হলে তিনি এখানে আসেন। কর্ডোভায় ডাক্তারী পড়েন। অল্পদিনেই তার খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বড়ি ও সালসা বানিয়ে তিনি স্পেনে অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেন। রাজপ্রাসাদে এ খবর পৌঁছলে তিনি শাহী হেকিমের পদ অলংকৃত করেন। ইতিহাস বলছে, তিনি আলেমও ছিলেন। কিন্তু আবদুর রহমান তাকে নিছক হেকিম হিসেবে মূল্যায়ন করেন তার জ্ঞান গরিমায় প্রভাবিত হননি কোন দিনও।