এখান থেকে গেলাম ধ্বংসপ্রাপ্ত সুরে (Tyre)। সুর তখন ধ্বংস হয়ে গেলেও সেখানে একটি লোকালয় আছে। লোকালয়ের অধিকাংশ বাসিন্দা রিফুসার সম্প্রদায়ের লোক। সুর বা টায়ার শহরটি তার দুর্ভেদ্যতার জন্য প্রসিদ্ধ। শহরের তিনটি দিক সমুদ্রের দ্বারা আবৃত। দুটি প্রবেশপথের একটি সমুদ্রের দিকে, অপরটি স্থলের দিকে। স্থলের দিকে যে প্রবেশ পথটি রয়েছে সেটি পর-পর চারটি মাটির প্রাচীর দিয়ে আবৃত। সমুদ্রের দিকে প্রবেশপথটি দু’টি টাওয়ার বা সুউচ্চ মিনারের মধ্যস্থলে। এমন সুন্দর স্থাপত্যের নির্দশন দুনিয়ার আর কোথাও নেই। এর তিনটি দিক সমুদ্রের দ্বারা আবৃত। অপরদিকে দেওয়াল। দেওয়ালের নিচে জাহাজ যাতায়াতের পথ। পূর্বে এক টাওয়ার থেকে অপর টাওয়ার অবধি একটি লোহার শিকল ঝুলান ছিল। সে শিখলটি নিচু করে না দেওয়া পর্যন্ত যাতায়াতের কোন উপায় ছিল না। দ্বার রক্ষার ভার ন্যস্ত থাকত বিশ্বাসী পাহারাদারদের উপর। তাদের অজ্ঞাতে কেউ বাইরে যেতে বা ভেতরে আসতে পারত না।
আক্কাতেও এ-ধরনের একটি পোতাশ্রয় আছে। কিন্তু তার ভেতর শুধু ছোট জাহাজই প্রবেশ করতে পারে। সুর বা টায়ার থেকে এলাম সায়দা (Sidon)। ফলের জন্য প্রসিদ্ধ সুন্দর এ শহরটি সমুদ্রোপকূলে অবস্থিত। এখান থেকে কায়রোয় ডুমুর, কিসমিস ও জলপাই তেল চালান হয়।
অতঃপর আমি তাবারিয়া (Tiberias) (৪০) শহরে হাজির হই। এক কালে এটি একটি ঘদ্ধি বড় শহর ছিল। এর কয়েকটি স্মৃতিচিহ্ন মাত্র দাঁড়িয়ে আছে অতীত সুদিনের সাক্ষ্য বহন করে। এখানে নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক ব্যবস্থাযুক্ত অতি চমৎকার হামাম আছে। হামামের পানি বেশ গরম। তাবারিয়ার গ্যালিলির দরিয়া (Sea of galilee) নামে আঠার মাইল লম্বা ও নয় মাইল চওড়া একটি হ্রদ আছে। শহরের একটি মসজিদ ‘পয়গম্বরদের মসজিদ’ নামে পরিচিত। মসজিদে রহিয়াছে শোয়ব Jethss) যার কন্যা হজরত মুসার বিবি এবং সুলেমান, জুদা ও রিউবেনের সমাধি। তাবারিয়া থেকে আমরা গেলাম যে কূপে ইউসুফকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তা দেখতে। সেখানে গিয়ে কূপের পানি দ্বারা আমরা তৃষ্ণা নিবারণ করলাম। একটি ছোট মসজিদের চত্বরে বেশ বড় ও গভীর একটি কূপ। পানি ছিল বৃষ্টির কিন্তু কূপের রক্ষণাবেক্ষণ কারী বলল, কূপের মধ্যে একটি ঝরণাও আছে। সেখান থেকে আমরা বৈরুত গিয়ে হাজির হলাম। বৈরুত শহরটি ছোট্ট কিন্তু চমৎকার বাজার ও সুন্দর মসজিদ আছে এখানে। এখান থেকে ফল এবং লোহা চালান হয়ে মিসরে যায়।
বৈরুত থেকে আমরা রওয়ানা হলাম আবু ইয়াকুব ইউসুফের কবর জেয়ারতের জন্য। তিনি উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার একজন রাজা বলে পরিচিত। কারাফনূহ (৪১) নামক একটি জায়গায় এ কবরটি অবস্থিত। সমাধির ধারেই একটি মুসাফেরখানা আছে। মুসাফেররা এখানে আদরযত্ব পেয়ে তাকে। অনেকে বলে, সুলতান সালাহুদ্দিন এটি স্থাপন করেন। কিন্তু অপর লোকদের মতে এটির প্রতিষ্ঠাতা সুলতান নুরুউদ্দিন। কিংবদন্তী প্রচলিত আছে, সুলতান একবার স্বপ্নে দেখলেন আবু ইয়াকুবের দ্বারা তিনি উপকৃত হবেন। এজন্য আৰু ইয়াকুবকে তিনি কিছুদিনের জন্য নিজের কাছে এনে রাখেন। আবু ইয়াকুব এক রাত্রে সেখান থেকে একাকী পলায়ন করেন। পথে অসহ্য শীতের মধ্যে তিনি একটি গ্রামে এসে হাজির হন। সেই গ্রামের একটি দরিদ্র লোক তাকে আশ্রয় দেন এবং তাঁর অনুমতি নিয়ে একটি মুরগী জবাই করে রুটি আহার করতে দেন। আহারান্তে আবু ইয়াকুব গৃহস্বামীকে দোয়া করেন। গৃহস্বামীর কয়েকটি ছেলেমেয়ে ছিল। অচিরেই একটি মেয়ে বিবাহ হবে বলে স্থির হয়েছিল। কন্যার বিবাহে পিতার দান-দেহাজ দেওয়ার রীতি তখনও সেখানে প্রচলিত ছিল। এ-সব দান দেহারেজ অধিকাংশই হত তামার নির্মিত তৈজসপত্র। বিবাহের চুক্তির অঙ্গ স্বরূপ এসব দান-দেহাজের বস্তু নিয়ে সবাই গর্ববোধ করত। আৰু ইয়াকুব গৃহস্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কোন তামার তৈজসপত্র আছে কি?”
গৃহস্বামী বলল, “হ্যাঁ, আছে। আমার মেয়ের বিয়েতে দেহাজ দিবার জন্য কিছু তৈজসপত্র কেনা হয়েছে।”
সেগুলি কাছে আনা হলে আবু ইয়াকুব বললেন, “তোমার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আরও যতটা পার ধার করে আন।” গৃহস্বামী তাই করল এবং অতিথির সামনে সব এনে হাজির করল। তিনি তখন তার চারদিকে আগুন জ্বেলে একটি থলের ভেতর থেকে কিছু আরক বের করে সেগুলির উপর ছড়িয়ে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে সব পাত্র সোনার পাত্রে পরিণত হল। আবু ইয়াকুব সে সমস্ত একটি তালাবদ্ধ করে রেখে গেলেন। এবং দামাস্কে সুলতান নুরুউদ্দিনকে সে সবের কথা উল্লেখ করে বিদেশী মুসাফেরদের জন্য হাসপাতাল ও একটি মুসাফেরখানা স্থাপন করতে লিখলেন। তিনি ঐ সব তৈজসপত্রের মালিকদের সন্তুষ্ট করতে এবং উপরোক্ত গৃহস্বামীকে ভরণপোষণ করতেও আদেশ দিলেন। গৃহস্বামী নিজেই পত্রখানা নিয়ে সুলতানের কাছে গেল। অতঃপর সুলতান এসে সবাইকে সন্তুষ্ট করলেন। সুলতান আবু ইয়াকুবকে অনেক সন্ধান করেও। দেখা পেলেন না। অবশেষে দামেস্কে ফিরে গিয়ে ঐ নামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করলেন। এটি পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল।
অতঃপর আমি হাজির হলাম আত্রাবুলাস (Trpoli) শহরে। আত্রাবুলাস সিরিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর। নবনির্মিত এ শহরটি ছ’মাইল অভ্যন্তরে অবস্থিত। পুরাতন শহরটি সমুদ্রের তীরেই ছিল। এক সময়ে খ্রীস্টানরা শহরটি অধিকার করেছিল। অতঃপর সুলতান বেইবাস(৪২) এটি পুনরুদ্ধার করে ধ্বংস করেন এবং নতুন শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ শহরে অনেকগুলি সুন্দর হামাম আছে। একটি হামাম একজন শাসনকর্তার নামানুসারে সিন্দামুর নামে পরিচিত। তিনি অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিতেন। সে সম্বন্ধে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। একবার একজন স্ত্রীলোক এসে ফরিয়াদ জানাল, শাসনকর্তার একটি কর্মচারীর বিরুদ্ধে। স্ত্রীলোকটি দুধ বিক্রি করত। কিছু দুধ নিয়ে ঐ কর্মচারী খেয়ে ফেলেছে। স্ত্রীলোকটির কোন সাক্ষী ছিল না। কিন্তু তবু শাসনকর্তা তাকে তলব করে পাঠালেন এবং সে হাজির হলে তাকে দু’টুকুরা করে কেটে ফেললেন। তখন দেখা গেল লোকটির পাকস্থলীতে সত্যিই দুধ রয়েছে। তুকিস্তানের সুলতান বেবেক(৪৩) সম্বন্ধে এবং সুলতান কালাউনের অধীনে আইধারের শাসকর্তা আল আত্রিশ সম্বন্ধেও অনুরূপ কাহিনী প্রচলিত আছে।