- বইয়ের নামঃ ভয়াল রসের সম্রাট এইচ পি লাভক্র্যাফট শ্রেষ্ঠ বারোটি রচনা
- লেখকের নামঃ এইচ পি লাভক্র্যাফট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রচনাবলী
ভয়াল রসের সম্রাট এইচ পি লাভক্র্যাফট শ্রেষ্ঠ বারোটি রচনা
অকাল তমসা
অকাল তমসা (THE SHADOW OUT OF TIME)
[লাভক্র্যাফটের শেষ জীবনের এই গল্পটির সঙ্গে একমাত্র অ্যাট দ্য মাউন্টেইনস অব ম্যাডনেস গল্পটিরই তুলনা করা যায়। এখানেও এসেছে লাভক্র্যাফটের প্রিয় থিম, মানুষের মনের অদল-বদল। কিন্তু তার সঙ্গে এই গল্পে এসেছে কথক পিসলির জীবন কাহিনি, আশা নিরাশায় দুলতে থাকা মানুষটি বোঝার চেষ্টা করছিল তার হারিয়ে যাওয়া বছরগুলির অর্থ। গল্পের শেষ চমকে লাভক্র্যাফট বুঝিয়ে দিয়েছেন এই বিশাল মহাবিশ্বে মানুষের স্থান কতই না নগণ্য।]
আমার নাম ন্যাথানিয়েল উইনগেট পিসলি। ছ-সাত বছর আগে যদি কেউ খবরের কাগজ বা বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল জার্নাল নিয়মিত ঘাঁটাঘাঁটি করে থাকেন তাহলে তাঁদের কাছে আমার নামটা চেনা-চেনা ঠেকতেও পারে। ১৯০৮ থেকে ১৯১৩ সাল অবধি আমার স্মৃতিবিলোপ তথা স্মৃতিবিভ্রাট নিয়ে ওই সময় কাগজে বিস্তর লেখালেখিও হয়েছিল। এ ছাড়া ম্যাসাচুসেটস শহরে ক্রমাগত ঘটতে-থাকা ভৌতিক, অদ্ভুত ঘটনার সঙ্গে ডাকিনীবিদ্যার যোগসাজশ নিয়েও লেখা হয়। যার সূত্রপাত ঘটে আমার বাড়িতে। আমি জানি, আমার এই উন্মাদনা আমার মধ্যে বংশানুক্রমিকভাবে আসেনি। বাইরের সমান্তরাল কোনও জগৎ থেকে হঠাৎ করে অন্ধকার কেন নেমে এল এই পৃথিবীর বুকে! আমার এই লেখা পড়তে পড়তে আপনিও যখন সেই উৎস সন্ধান করবেন, তখন এই তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই লেখার প্রথমদিকের অংশগুলো বাড়ি ফেরার পথে জাহাজের কেবিনে বসে লেখা। এইসব লেখাই আমি আমার মেজ ছেলে উইনগেট পিসলিকে দেব। উইনগেট এখন মিসকাটনিক ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির প্রফেসার। ও-ই আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য, যে আমার ওই স্মৃতিবিভ্রাটের সময় থেকে সবসময় আমার পাশে ছিল। শুধু তা-ই নয়, উইনগেট আমার সমস্ত কথা বিশ্বাস করেছিল, এবং আমার এই বিচিত্র কেসের সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করেছিল। আমি উইনগেটকে মুখেও বলতে পারতাম, কিন্তু আমার এলোমেলো কথা দিয়ে সবটা হয়তো বোঝানো সম্ভব নয়। এই লেখা পড়ে আসল সত্যিটা কী, সেটা ও ঠিক খুঁজে বের করবে। দুঃস্বপ্ন আর আতঙ্কের মধ্যে বাইশ বছর কাটানোর পর ১৯৩৫ সালের জুলাই মাসের ১৭-১৮ তারিখ নাগাদ একরাতে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় অবশেষে আমি খুঁজে পাই বহু যুগ ধরে সংরক্ষিত সেই প্রাচীন ভয়ংকর সূত্র। এই সূত্রের আসল সত্যি এতটাই ভয়ানক যে, আমার নিজেরই মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য মনে হয়। যদি সত্যিই এটা ঘটতে থাকে, তাহলে পৃথিবীর আসন্ন বিপদ প্রতিরোধের জন্য গোটা মনুষ্যজাতিকে প্রস্তুত থাকতে হবে। হয়তো সেই কারণেই আমি সব কিছু বিসর্জন দিয়ে সারাজীবন খুঁজে বেরিয়েছি সেই আদিম অজানা অপার্থিব শক্তির কারিগরকে। আমার ধারণা, সেই অভিশপ্ত বৃহস্পতিবার আমার যে নারকীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা আর কোনও জীবিত মানুষের হয়নি। সেই আতঙ্কের সময় আমি একা ছিলাম। আমার মানসিক সুস্থতা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যুক্তি আমার কাছে ছিল না। আর এখন আমি শুধু নিজের মানসিক সুস্থতা প্রমাণ করতেই নয়, সমস্ত মানুষকে সতর্ক করার জন্যই এটা লিখছি।
আমি আগেই বলেছি, আমার এই উন্মাদনা বংশানুক্রমিকভাবে আমার মধ্যে আসেনি। আমার বাবা জোনাথন আর মা হানা দুজনেই ছিলেন হ্যাঁভারহিল শহরের একেবারে আদ্যিকালের মানুষ। আমার জন্ম, লেখাপড়া সব কিছুই হ্যাঁভারহিলের গোল্ডেন হিলের কাছে বোর্ডম্যান স্ট্রিটের পৈতৃক বাড়িতে। ১৮৯৫ নাগাদ আমি মিসকাটনিক ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ঢুকি। তার আগে আর্কহ্যামের সঙ্গে আমার কস্মিনকালেও কোনও যোগাযোগ ছিল না। ১৮৯৬ সালে অ্যালিস সিজার বলে হ্যাঁভারহিলেরই একটি মেয়েকে বিয়ে করি। তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমাদের জীবন বছর তেরো বেশ ভালোভাবেই কাটছিল। প্রথমে ইউনিভার্সিটির সহকারী ও পরে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হলাম। এই সময়গুলো আমার কাজের চাপ এত বেড়ে গিয়েছিল যে, এইসব গুপ্তবিদ্যা, পরা-মনোবিজ্ঞান বা অপ-মনোবিজ্ঞান– কোনও কিছু নিয়েই মাথা ঘামাবার মতো অবস্থা আমার ছিল না।
তারপর এল সেই ভয়ংকর দিনটা। দিনটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমার মনে আছে। দিনটা ছিল, ১৪ মে, ১৯০৮–বৃহস্পতিবার। এই দিন থেকেই শুরু হল আমার মগজের যাবতীয় স্মৃতির ওলটপালট। ব্যাপারটা প্রথমে তেমনভাবে টের না পেলেও, পরে যখন হঠাৎ করে মৃদু আলোয় ঝড়ের গতিতে শেষ কয়েক ঘণ্টার সব দৃশ্য দেখতে লাগলাম, বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। এলোমেলো ওই দৃশ্যগুলো আমার মাথা পুরোপুরি ঘেঁটে দিল। হঠাৎ করেই যেন কোনও অশুভ ইঙ্গিত টের পেলাম। মাথায় যেন কেউ হাতুড়ি পিটতে লাগল। আর একটা জিনিস টের পেলাম, কেউ যেন আমার মগজের যাবতীয় চিন্তাভাবনাকে দখল করে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বেলা দশটা কুড়ি নাগাদ যখন আমি ক্লাস নিচ্ছি, হঠাৎ করেই চোখের সামনে বিদঘুটে কিছু অপরিচিত জ্যামিতিক আকার ভেসে উঠল। ক্লাসরুমটা মনে হল যেন অন্য কোনও একটা অদ্ভুত আকারের ঘর। এরপর অর্থনীতির ছ নম্বর অধ্যায় থেকে সরে গিয়ে ছাত্রদের খুব গুরুত্ব সহকারে কী বলেছিলাম, এখন মনে নেই। তবে ছাত্রদের চাউনি দেখে টের পেয়েছিলাম, তারা ভয়ে হতবাক হয়ে গেছে। এরপর আমি প্রায় অচেতনভাবে চেয়ারে বসে পড়ি। আমি নাকি এমন অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম যে, কেউ আমাকে চেয়ার থেকে টেনে তুলতে পারেনি। যেমন তারা পারেনি পাঁচ বছর চার মাস তেরো দিনে, দিনের আলোয় এই দুনিয়ার বিপর্যয় ঠেকাতে। এর পরের ঘটনাগুলো লোকের মুখে শুনেছিলাম। ২৭ নং ক্রেন স্ট্রিটের বাড়িতে আমাকে নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসা শুরু হলেও প্রায় সাড়ে ষোলো ঘণ্টা আমার কোনও হুঁশ ছিল না।