খালের পারে অবস্থিত এ গ্রামটি ছাড়িয়ে আমরা কুরি মানসা শহরে এসে পৌঁছলাম। এখানে পৌঁছতেই আমার বাহন উটটি গেল মরে। উটের রাখাল এসে আমাকে এ খবর দিল। আমি মৃত উটটিকে দেখতে গিয়ে দেখি ইতিমধ্যে কাফ্রীরা তা যথারীতি খেয়ে ফেলেছে। আমি তখন আরেকটি উট কিনবার জন্য দুটি ছেলেকে পাঠালাম জাখারি। উট কিনে ফিরে আসবার অপেক্ষায় কুরি মানায় দু দিন থাকতে হলো।
সেখান থেকে মিমা শহরের বাইরে কয়েকটি কুপের পাশে এসে আমরা আস্তানা ফেললাম। সেখান থেকে এলাম তামবাতু। নদীর ধার থেকে তামবাকতুর দুরত্ব চার মাইল। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসী মাসুফা সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা মুখে ঘোমটা ব্যবহার করে। এদের শাসনকর্তার নাম ফারবা মুসা। তিনি যখন একজন মাসুফাঁকে একটি দলের আমীরের পদে নিয়োগ করলেন আমি ঠিক তখন তাঁর কাছেই উপস্থিত ছিলাম। তিনি তাকে রংকরা কাপড়ের আঙরাখা, পাগড়ীও পায়জামা উপহার দিয়ে। একটি ঢালের উপর বসতে আদেশ করলেন। তার দলের সরদাররা তখন তাকে মাথায় তুলে নিল। গারনাটার (গ্রানাডার) প্রতিভাবান কবি আবু ইসহাক আস্-সাহিলীর কবর এ শহরে অবস্থিত। এ কবি নিজের দেশে আততুবায়জিন (ছোট রঞ্জন পাত্র) নামে পরিচিত।৩১
তামবাকতু থেকে এক-কাঠের তৈরী একটি ছোট নৌকায় চড়ে নীল নদের পথে নিম্ন দিকে রওয়ানা হলাম। পথে প্রতি রাত্রে আমরা তীরবর্তী গ্রামে গিয়ে লবণ, মসলা ও পুঁতির পরিবর্তে মাংস মাখন প্রভৃতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সগ্রহ করে নিতাম। এমনি করে এমন একটি জায়গায় পৌঁছলাম যার নামটি আজ আমার স্মরণে নেই। সেখানকার শাসনকর্তা একজন চমৎকার লোক। তাঁর নাম ছিল হাজী ফারবা সুলায়মান। তিনি ছিলেন তাঁর সাহস ও শক্তির জন্য প্রসিদ্ধ। তাঁর ধনুকটি কেউ ব্যবহার করতে সাহস পেত না। তার মত বিশাল ও দীর্ঘকায় তোক আমি আর কোথাও চোখে দেখিনি। এ শহরে থাকতে একদিন আমার কিছু ভুট্টার প্রয়োজন হওয়ায় শাসনকর্তার কাছে গিয়ে। তাকে সালাম করলাম। সেদিন ছিল ফাতেহা দোয়াজ দাহাম। তিনি আমার হাত ধরে আমাকে তার দরবারে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাদের খেতে দেওয়া হল ডাকনু নামে এক প্রকার পানীয়। ভুট্টার ছাতু পানি দিয়ে গুলে মধু বা দুধ মিশিয়ে তৈরী সে পানীয়। শুধু পানি পান করে তারা অসুস্থ হয় বলে পানির পরিবর্তে এ জিনিষই পান করে। ভুট্টার অভাবে তারা পানির সঙ্গে মধু বা দুধ মিশিয়ে নেয়। তারপর এলো একটি কাঁচা তরমুজ। তার কিছুটা নিয়ে আমরা সদ্ব্যবহার করলাম। গায়ে পায়ে তথনও পরিপূর্ণতা লাভ করেনি এমন একটি বাচ্চা ছেলেকে কাছে ডেকে ফারবা সুলায়মান আমাকে বললেন, “অতিথি হিসাবে আপনাকে উপহার দিলাম। ছেলেটির ওপর নজর রাখবেন যেনো কখনো পালিয়ে না যায়।”
সেই ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে আমি চলে আসছিলাম। তিনি বললেন “একটু অপেক্ষা করুন, খেয়ে যাবেন।”
তখন তার একজন বাদী এসে হাজির হল সেখানে। দামেস্কের এক আরব বালিকা এই বাদী। আমার সঙ্গে সে আরবীতে কথা বলছিল এমন সময় সুলতানের বাড়ীর ভেতরে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। সুলতান বালিকাকে বাড়ীর ভেতর পাঠালেন কান্নার কারণ জানতে। সে ফিরে এসে খবর দিল এইমাত্র সুলতানের একটি কন্যা মারা গেছে। তাই শুনে তিনি বললেন, “কান্না আমি পছন্দ করিনে। আসুন আমরা নদীর পাড়ে যাই।”
তিনি নীলনদের তীরে তাঁর আরও যে সব বাড়ী রয়েছে সেখানে যাওয়ার কথা বলছিলেন। একটা ঘোড়া আনানো হলে তিনি আমাকে ঘোড়ায় আরোহণ করতে বললেন। কিন্তু আমি বললাম, “আপনি হেঁটে গেলে আমি ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারিনা।”
অতঃপর উভয়েই আমরা হেঁটে নদীর ধারে তার বাড়ীতে গিয়ে আহার করলাম। আহারের পর বিদায় নিয়ে চলে এলাম। কৃষ্ণকায় কাফ্রীদের ভেতর তার মত দয়ালু ও সৎ লোক আমি আর কোথাও পাইনি। তার দেওয়া সেই বালকটি আজও আমার সঙ্গে আছে।
সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে গগগা এসে পৌঁছলাম। নীলনদের তীরে কাফ্রী দেশের সবচেয়ে সুন্দর ও বড় শহর গগো(Gogo)। প্রচুর চাউল, দুধ ও মাছ এখানে পাওয়া যায়। এখানে ইনানী নামক এক প্রকার শসা পাওয়া যায় যার তুলনা কোথাও নাই। এখানকার অধিবাসীরা কড়ির সাহায্যে কেনাবেচা করে এবং মালীতেও ৩৩ অনুরূপ ব্যবস্থা প্রচলিত। প্রায় একমাস কাল সেখানে কাটিয়ে গাদামাসের একদল সওদাগরের সঙ্গে স্থলপথে আমরা তাগাদ্দার দিকে চলতে থাকি। তাদের দলের চালক ও নেতা ছিলেন উচিন নামে একজন হাজী। তাদের ভাষায় উচিন বলে নেকড়ে বাঘকে। আমার সঙ্গে আমার বাহন স্বরূপ একটি উট ছিল। আরেকটি মাদী উট ছিল আমার জিনিষপত্র বহনের জন্য। কিন্তু এক মঞ্জিল পার হয়ে যাবার পর মোটবাহী উটটি আর অগ্রসর হতে পারছিল না। তখন হাজী উচিন উটের পিঠের মালপত্র নামিয়ে সঙ্গীদের মধ্যে কিছু-কিছু করে ভাগ করে দিলেন। এবং তারাই তা ভাগাভাগি করে বইতে লাগল। দলের ভেতর তাদালার একজন মাগরাবিন ছিল। সে কিছুতেই তার অংশের বোঝা বহন করতে রাজী হল না। আমার সঙ্গী বালকটি একদিন তৃষ্ণার্ত হয়ে তার কাছে পানি চেয়েছিল, তাও সে দেয়নি।
অতঃপর আমরা বর্বর বার্দামাদের দেশে প্রবেশ করলাম। নিরাপত্তার জামিন ছাড়া। তাদের দেশে কেউ সফর করতে পারে না। এখানে পুরুষের চেয়ে কোনো নারীর জামিনের মূল্য অধিক। নিখুঁত সৌন্দর্যে ও দেহ সৌষ্ঠবে এখানকার নারীরা সর্বশ্রেষ্ঠ। তাদের গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল ফর্সা এবং তারা যথেষ্ট দৃঢ়কায়। তাদের সঙ্গে তুলনা চলতে পারে। এমন সবলকায় নারী আমি দুনিয়ার ৩৪ কোথাও দেখিনি। এখানে এসে অত্যধিক গরমে ও পিত্তাধিক্যে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। তখন পথ চলার গতি বাড়িয়ে আমরা তাগাদ্দা এসে পৌঁছলাম। তাগাদ্দার ঘরবাড়ী লাল পাথরে তৈরী। তাম্রখনির পাশ দিয়ে এখানে পানি আসে বলে পানির স্বাদ ও রং বিকৃত। সামান্য পরিমাণ গম ছাড়া আর কোনো খাদ্যশস্য এখানে জন্মে না। গম যা জন্মে তা দিয়ে ব্যবসায়ীদের ও বহিরাগতদের খাদ্যের প্রয়োজন মিটে। ব্যবসায় ছাড়া অধিবাসীদের আর কোনো পেশা নেই। প্রত্যেক বছর তারা মিশর গিয়ে সেখানকার সব রকম সুক্ষ্ম বস্ত্র ও অন্যান্য ব্যবহার্য দ্রব্য। আমদানী করে। তারা বিলাসিতা ও আরাম আয়াসে বাস করে এবং নিজেদের দাসদাসীর সংখ্যা নিয়ে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। মালী ও ইবালতানের অধিবাসীরাও তাই করে। তারা শিক্ষিতা কোনো বাদীকে কখনো বিক্রি করতে রাজী হয় না, বিক্রি করলেও অত্যন্ত উচ্চ মূল্য হাঁকে৩৫।