তখন রাত ন’টা। ৭ নং রেসকোর্স রোড থেকে একটা টেলিফোনে আমাকে অনুরোধ করা হল যেন অবিলম্বে নতুন প্রধানমন্ত্রী এবং বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী রাও-এর সঙ্গে দেখা করি। রাও আমায় বললেন, পারমাণবিক কার্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা বাজপেয়ীজিকে জানাতে, যাতে নতুন সরকারের কাছে এই গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপের মসৃণ হাতবদল ঘটে।
এর বছর দুয়েক পরে বাজপেয়ীজি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। ১৯৯৮ সালের ১৫ মার্চের মাঝরাতে আমি ওঁর কাছ থেকে একটা টেলিফোন পেলাম। জানালেন তিনি মন্ত্রীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করছিলেন এবং আমাকে তিনি তাঁর ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করতে চান। আমি জবাব দিয়েছিলাম যে, চিন্তা করার জন্য আমার কিছু সময়ের প্রয়োজন। তিনি পরদিন সকাল ন’টায় ওঁর সঙ্গে আমায় দেখা করতে বললেন। ফলে, ওই মাঝরাতে আমি আমার কিছু বন্ধু জড়ো করে ফেললাম এবং আমার ক্যাবিনেটে যোগ দেওয়া উচিত হবে কি না এ নিয়ে প্রায় ভোর ৩-টে অবধি আমাদের তর্কবিতর্ক চলল। সাধারণ মত হল, যেহেতু আমি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দুটো মিশনে সম্পূর্ণভাবে জড়িত এবং দুটোই অন্তিম পর্যায়ে ও সার্থকতার সম্মুখীন সুতরাং এই অবস্থায় ওগুলো ছেড়ে রাজনীতির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা আমার উচিত হবে না।
পরদিন, ৭ সফদরজং রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আমি পৌঁছেছিলাম। তিনি বসার ঘরে আমায় অভ্যর্থনা জানিয়ে প্রথমে ঘরে তৈরি মিষ্টি খেতে দিলেন। তারপর আমি তাঁকে বললাম, ‘আমি এবং আমার টিম দুটো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে খুব ব্যস্ত। একটা হল অগ্নি মিসাইল প্রক্রিয়া প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়টি হল ডিএই ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জি (Department of Atomic Energy)-র অংশীদারিত্বে একগুচ্ছ পরীক্ষার মাধ্যমে পারমাণবিক প্রক্রিয়া শেষ করা। আমি মনে করি এই দুটি কার্যক্রমে সম্পূর্ণভাবে আবিষ্ট থেকে আমি আমার দেশকে আরও বেশি কিছু নিবেদন করতে পারব। অনুগ্রহ করে আমায় কাজ চালানোর অনুমতি দিন।’
প্রত্যুত্তরে বাজপেয়ীজি বললেন, ‘আমি আপনার মনোভাবের প্রশংসা করি, আপনি এগিয়ে যান, ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।’ এরপর অনেক ঘটনা ঘটেছিল। ‘অগ্নি’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রক্রিয়ার অভিষেকের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল, পাঁচটি পারমাণবিক পরীক্ষা পরপর নির্বাচিত হয়েছিল এবং ভারতবর্ষ পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছিল। আমার ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার দরুন দুটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কার্যক্রমে নিজেকে নিবেদন করতে সক্ষম হয়েছিলাম যা দেশকে অভূতপূর্ব ফলদান করেছিল।
আমার জীবনের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এল ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে। আমাকে ভারত সরকারের মুখ্য বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা বা পিএসএ (প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইসার) হিসেবে নিযুক্ত করা হল, যা ক্যাবিনেট মন্ত্রী পদের সমকক্ষ। আমার টিমে ছিলেন ড. ওয়াই এস রাজন, বৈদ্যুতিন তথ্য বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ড. এম এস বিজয়রাঘবন যিনি আমার সঙ্গে TIFAC-এ কাজ করেছিলেন এবং আমার ব্যক্তিগত সচিব এইচ শেরিডন— আমি বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা থাকাকালীন যিনি আমার দপ্তরের আধিকারিক ছিলেন। যখন কর্মভার হাতে নিলাম তখন আমাদের কোনও দপ্তর ছিল না, কিন্তু আমরা পরে বানিয়ে নিয়েছিলাম। এরজন্য ডিআরডিও-কে ধন্যবাদ জানাই, বিশেষত ডিআরডিও-র অসামরিক কার্য এবং আবাসন বিভাগের মুখ্য নির্বাহিক কে এন রাই, ডিআরডিও-র আর অ্যান্ড ডি-র মুখ্য নিয়ন্ত্রক মেজর জেনারেল আর স্বামীনাথনের অক্লান্ত প্রচেষ্টার কথা বলতে হবে। ইন্ডিয়া ২০২০ ভিশন সরকার দ্বারা গৃহীত হয়েছে যদিও এই লেখার কর্মপ্রক্রিয়াকেন্দ্রিক পরিকল্পনার এগিয়ে দেবার ক্ষেত্রে প্রধান বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা দপ্তর যোগ্য মঞ্চ হয়ে উঠেছিল বলে আমি মনে করি। এই ভিশন বা স্বপ্ন প্রথম দেবগৌড়া সরকার থাকাকালীন পরিবেশিত হয়েছিল। এরপর আই কে গুজরাল প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং ১৯৯৮ সালে আবার বাজপেয়ী ফিরে এলেন। তিন সরকারই এই সুপারিশ বাস্তবায়িত করায় জোর দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানভবন অ্যানেক্সে আমাদের দপ্তর ছিল। সেটা একটা বিশাল বিল্ডিং যেখানে অসংখ্য তথ্যানুসন্ধান সংস্থা এবং কিছু সরকারি বিভাগও ছিল। শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ। সংলগ্ন বিজ্ঞানভবন অবশ্যই বিশালাকারের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য বিখ্যাত স্থল। অ্যানেক্সটি উপরাষ্ট্রপতির বাসভবনের ঠিক পাশেই ছিল, নর্থ ও সাউথ ব্লকের হইহট্টগোল ওখানে না থাকায় কাজ করার সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল।
যথারীতি ভ্রমণ আমার কার্যসূচির মধ্যে একটা বড় অংশ দখল করে ছিল। ২০০১ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর অল্পের জন্য হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে ফিরেছিলাম। ঝাড়খণ্ডের বোকারো স্টিল প্ল্যান্টে হেলিকপ্টার অবতরণ করার সময় দুর্ঘটনাটি ঘটে। আমরা অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছিলাম। লাফিয়ে নেমেই আমি বিমানচালক ও সহচালকের কাছে দৌড়ে গেছিলাম ও তাঁদের বলেছিলাম, ‘আমায় রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ, ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন।’ দু’জনের চোখে তখন জল। কিন্তু আমি তাঁদের বললাম, এরকম কখনও কখনও হয় তবে আমরা যা করতে পারি তা হল সমস্যা খুঁজে বার করা ও তার সমাধান করা। সেদিন সন্ধ্যায় আমার পাঁচটা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। আমায় সেখানে অভিভাষণ দিতে হয়েছিল। শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন বোকারো স্টিল প্ল্যান্টের বিশেষ দায়িত্বশীল পদাধিকারী, ইঞ্জিনিয়ার এবং কর্মীবৃন্দ এবং বোকারোর কিছু স্কুলের ছাত্রছাত্রী। বিমান দুর্ঘটনার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল— জাতীয় চ্যানেলগুলো খবরটা লুফে নিয়েছিল। যখন বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা হল, দেখলাম ঘটনাটি ওদেরকেও যেন নাড়িয়ে দিয়েছে। আমি ওদের সঙ্গে করমর্দন করলাম এবং নির্ভীকতার মন্ত্র উচ্চারণ করলাম, যা ওদের উৎফুল্ল করেছিল। সেটা ছিল নিতান্ত এক উদ্বুদ্ধ করার উপদেশ: