কল্পগল্প সমগ্র

অঘটনবাজ

অঘটনবাজ ( The Man Who Could Work Miracles )

[‘The Man Who Could Work Miracles’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Illustrated London News’ পত্রিকায় জুলাই ১৮৯৮ সালে। ‘Doubleday & McClure Co.’ থেকে ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত ‘Tales of Space and Time’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। ১৯৩৭ সালে গল্পটি পরবর্ধিত আকারে ‘Roland Young’ অভিনীত ছায়াছবি হিসাবে মুক্তি পায়।]

ঈশ্বরদত্ত আশ্চর্য এই ক্ষমতা তার সহজাত কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে বিলক্ষণ। আমার তো মনে হয়, ক্ষমতাটা তার মধ্যে এসেছিল অকস্মাৎ। পয়লা নম্বরের নাস্তিক ছিল তিরিশে পা দেওয়ার আগে পর্যন্ত। অলৌকিক শক্তি যে আদৌ কারও থাকতে পারে, এ বিষয়ে বিশ্বাসী ছিল না মোটেই। আকারে নেহাতই খর্বকায়, চোখ দুটো গনগনে বাদামি, বেজায় খাড়া লাল চুল, গোঁফজোড়া রীতিমতো পাকানো এবং দুই প্রান্তে যখন-তখন পাক দেওয়াটা তার অষ্টপ্রহরের মুদ্রাদোষ। নাম তার জর্জ ম্যাকহুইরটার ফোদারিনগে। এ নাম যার থাকে, তাকে আর যা-ই হোক, কোনও অলৌকিক ব্যাপারস্যাপারের সঙ্গে জড়িত করা চলে না। পেশায় তো কেরানি। গলাবাজ তার্কিক। অলৌকিক কাণ্ডকারখানা ঘটা যে একেবারেই অসম্ভব, এই বিষয়টা বিষম গলাবাজি করে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই প্রথম মোলাকাত ঘটে গেল অলৌকিক ব্যাপারের সঙ্গেই। তর্ক চলছিল লং ড্রাগন পানশালায়। প্রতিপক্ষ টোডি বিমিসের তা যা বলেছ শব্দগুচ্ছের একঘেয়ে কশাঘাতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল মি. ফোদারিনুগের।

এই দুজন ছাড়াও পানশালায় সেদিন হাজির ছিল জনৈক ধূলিধূসরিত সাইকেল আরোহী, বাড়িওয়ালা কক্স এবং লং ড্রাগন-এর সুরা পরিবেশন করে যে মেয়েটি–মিস মেব্রিজ। তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে গেলাস ধুয়ে যাচ্ছিল আপন মনে। অন্য দুই ব্যক্তি সকৌতুকে শুনছিল ফোদারিনগের নিষ্ফল গলাবাজি। মি. বিমিসেয় নিরুত্তাপ মন্তব্য এবং নিরুত্তেজ তর্ককৌশলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে অলৌকিক ব্যাপারটাকে প্রাঞ্জল করতে প্রয়াস পেয়েছিল মি. ফোদারিনগে। বলেছিল, জিনিসটা আগে ভালো করে বোঝ। মির্যাল হল এমনই সব উদ্ভট আজগুবি ব্যাপারস্যাপার, যা নিত্যনৈমিত্তিক প্রাকৃতিক ব্যাপারস্যাপারের ঠিক উলটো ইচ্ছাশক্তির জোরে যে অঘটন ঘটানো চলে–বিশেষ ইচ্ছাশক্তি না থাকলে যা ঘটানো যায় না।

তা যা বলেছ, মি. বিমিস কুপোকাত করে দিয়েছিল তাকে আবার সেই মারাত্মক শব্দগুচ্ছ প্রয়োগে।

সমর্থনের আশায় কাতর চোখে সাইকেল-আরোহীর পানে চেয়েছিল মি. ফোদারিনগে। সে ভদ্রলোক এতক্ষণ শুনেই যাচ্ছিল নীরবে। এবার সমর্থন জ্ঞাপন করল খুকখুক করে একটু কেশে এবং মি. বিমিসের পানে এক ঝলক তাকিয়ে। এসব ঝক্কিঝামেলায় নাক গলাতে মোটেই চায় না বলে, উদাসীন রয়ে গেল বাড়িওয়ালা। মি. বিমিস কিন্তু মাথা নেড়ে মির্যাকল সংজ্ঞা মেনে নিতেই যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেল মি. ফোদারিনগে।

বললে বিষম উৎসাহে, যেমন ধর মির‍্যা ঘটানো যায় এইখানেই। ওই যে লম্ফটা দেখছ, ও লম্ফ কি শিখা নিচের দিকে করে কখনও জ্বলতে পারে? হ্যাঁ কি না, বলেই ফেলনা বিমিস।

তুমি তো বলেই দিলে–না, পারে না, উদাসীন জবাব বিমিসের।

আরে গেল যা! তোমার কী মনে হয়, সেটা তো বলবে।

না, পারে না।

তাহলে সমস্ত ইচ্ছাশক্তি জড়ো করে আমিই হুকুম দিচ্ছি সোজা লম্ফকে উলটো হয়ে জ্বলতে।ওহে লম্ফ! উলটে যাও! শিখা নিচের দিকে থাকুক–আছড়ে পড়ে ভেঙে যেয়ো না যেন!–এ কী!

এই যে এ কী! বিস্ময়োক্তি, এটা প্রত্যেকের গলা ফুড়ে তেড়েমেড়ে বেরিয়ে এসেছিল সেই মুহূর্তে। কেননা নিরেট বস্তুর জ্বলন্ত লম্ফ সহসা উলটে গিয়েছিল শূন্যে এবং মেঝের ওপর শূন্যে ভাসমান অবস্থায় থেকে জ্বলন্ত ছিল নির্বিকারভাবে। প্রজ্বলন্ত শিখা সটান বিস্তৃত নিচের মেঝের দিকে! যেন অতিশয় স্বাভাবিক ব্যাপার!

মি. ফোদারিনগে তখন কী করছে?

তর্জনী সামনে বাড়িয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছে কপালে। প্রবল চেষ্টায় যেন জড়ো করে রাখতে হচ্ছে ইচ্ছাশক্তিকে তিলমাত্র বিচ্যুতি ঘটলেই আছড়ে পড়ে তুবড়ে যাবে গদ্যময় লং ড্রাগন দীপাধার। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেও শেষরক্ষা করতে পারবে না।

ফোদারিনগের ঠিক পাশে ছিল সাইকেল-আরোহী। বিপুল লম্ফ মেরে ছিটকে সরে গেল ঘরের অপর প্রান্তে। তিড়িংবিড়িং করে অল্পবিস্তর লম্ফ দিল প্রত্যেকেই। মিস মেব্রিজ ঘাড় ফিরিয়ে অলৌকিক দৃশ্যটা প্রত্যক্ষ করেই এমন আঁ-আঁ-আঁ করে চেঁচিয়ে উঠল যে, গোবরাট থেকে একটা বেড়াল ধড়াস করে পড়ে গেল মেঝেতে। লম্ফ দেওয়া দূরের কথা, এক চুলও নড়বার সাহস হল না শুধু ফোদারিনগের। নড়লেই যদি আছড়ে পড়ে অসম্ভব লম্ফ!

ঝাড়া তিনটে সেকেন্ড কাটল এইভাবে–থমথমে স্তব্ধতার মধ্যে শূন্যে ঝুলে রইল লম্ফশিখা নিচের দিকে করে। ফোদারিনগে আর ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। ইচ্ছাশক্তি একাগ্র করে রাখা কি চাট্টিখানি কথা! কাতরোক্তি বেরিয়ে এল কণ্ঠ চিরে।

এবং, তৎক্ষণাৎ পপাত ধরণিতলে হল অলৌকিক লক্ষ! দড়াম করে পড়ল মেঝেতে। ঢং ঢং ঢং শব্দে কয়েকবার নেচে নিয়ে দপদপ করে শিখা নিবিয়ে।

গড়িয়ে গিয়ে স্তব্ধ হল ঘরের কোণে।

ভাগ্যিস ধাতুর তৈরি তৈলাধার ছিল লক্ষে–তাই অগ্নিকাণ্ডটা ঘটল না। পুরো ঘরখানায় আগুন লেগে যেত, তৈলাধার যদি কাচের তৈরি হত। প্রথম কথা ফুটল মি. কক্সের কণ্ঠে। বিন্দুমাত্র বাগাড়ম্বর না করে ফোদারিনগে- কে আহাম্মক বলা হল কাটছাঁট ভাষায়। প্রতিবাদ করার মতো অবস্থা তখন নেই ফোদারিনগে বেচারির। বাঁইবাঁই করে ঘুরছে মাথা। ঘরসুদ্ধ লোক একমত হল তার হাতসাফাইয়ের কারবারে এবং বেরিয়ে যেতে বললে ঘর থেকে। এবংবিধ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারল না বিমূঢ় ফোদারিনগে।

বাড়ি ফিরল চোখ-মুখ লাল করে। কান গরম, মাথা ভোঁ ভোঁ। আসবার পথে দুধারে রাস্তার বাতিস্তম্ভগুলোর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে এসেছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল চার্ট রো-স্থিত নিজস্ব খুদে কামরায় ঢোকার পর। মোটামুটি সুস্থিত হয়ে ভাবতে বসল উদ্ভট ব্যাপারটা নিয়ে।

কোট আর বুট খুলে বিছানায় বসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেই নিয়ে সপ্তদশ সাফাই গাইল নিজের মনেই–সত্যি সত্যিই তো চাইনি উলটে যাক হতচ্ছাড়া লক্ষ!

কিন্তু উলটে তো গিয়েছিল মুখ দিয়ে কথাটা বার করার সঙ্গে সঙ্গে। কীভাবে যে ঘটল কাণ্ডটা, তা বিলক্ষণ ধোঁয়া ধোঁয়া ফোদারিনগের নিজের কাছেই। ইচ্ছাশক্তি একাগ্র করার জন্যে খুব যে একটা কস্তাকস্তি করতে হয়েছিল মনের সঙ্গে, তা মোটেই নয়। মনের কোনও প্রস্তুতিই ছিল না। ফট করে লক্ষ বেটাচ্ছেলে উলটে যেতেই ভীষণ দায়িত্বটা ধাঁ করে চেপে বসেছিল কাঁধেওলটানো অবস্থাতেই রেখে দিতে হবে হারামজাদাকে। কীভাবে –তা তো জানা ছিল না। তারপর যা ঘটে গেছে, তার কোনও যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা ফোদারিনুগের মগজে অন্তত আসছে না।

দেখাই যাক-না অঘটনটা আবার ঘটানো যায় কি না। নিষ্কল্প তর্জনী তুলে ধরেছিল ঘরের মোমবাতির দিকে। এলোমেলো মনটাকে বেঁধেহেঁদে, জড়ো করেছিল এক জায়গায়। কাজটা নেহাতই আহাম্মকি, তা বুঝেও যাচাই করার লোভ সামলাতে পারেনি।

বলেছিল, বাপু হে, উঠে পড় তো শূন্যে।

বলেই তো থ!

শূন্যে ভেসে উঠেছে মোমবাতি।

বেশ ভাসছিল নিরবলম্বভাবে। কিন্তু মি. ফোদারিনগে খাবি খেতেই ঘটল বিপত্তি। শূন্যাবস্থান পরিত্যাগ করে দড়াম করে আছড়ে পড়ল টেবিলে। অন্ধকার ঘরে কেবল দেখা গেল নিবে-যাওয়া পলতের দীপ্তি।

ক্ষণেকের জন্যে এক্কেবারে নট-নড়নচড়ন নট-কিছু হয়ে তমিস্রার মধ্যে ভূতের মতো বসে ছিল মি. ফোদারিনগে।

তারপর পাঁজর-খালি-করা বিরাট এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট হাতড়েছিল দেশলাইয়ের খোঁজে। পায়নি। হাতড়েছিল টয়লেট টেবিলে। সেখানেও পায়নি। তারপরেই খেয়াল হয়েছিল, মির্যাকল ঘটিয়ে দেশলাইও তো আনতে পারে হাতের মুঠোয়। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল বোকা-বোকা স্বরে, এসে যাক একটা দেশলাইয়ের কাঠি হাতের চেটোয়।

টুপ করে কী যেন পড়েছিল হাতের চেটোয়। মুঠো পাকাতেই আঙুল চেপে বসেছিল একটা দেশলাইয়ের কাঠির ওপর।

বারকয়েক কাঠি জালানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ফোদারিনগে বুঝেছিল, কাঠিটা সেফটি ম্যাচ–তাই জ্বলছে না। ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুড়ত করে আবার একটা ইচ্ছে ঢুকে পড়েছিল মাথার মধ্যে। ইচ্ছাশক্তি দিয়েই তো জ্বালানো যায় কাঠিমহাশয়কে। তৎক্ষণাৎ প্রয়োগ করেছিল শক্তিটাকে–কাঠি, জ্বল তো বাপু নিজে থেকে। টয়লেট টেবিলের কাপড়ের ওপর দপ করে কাঠি জ্বলে উঠতেই ধড়ফড় করে তুলে নিয়েছিল ফোদারিনগে-ফলে, নিবে গিয়েছিল কাঠি।

সম্ভাবনার ক্ষেত্রটা তখন সম্প্রসারিত হয়েছিল মাথার মধ্যে। হাতড়ে হাতড়ে মোমবাতিটা তুলে নিয়ে বসিয়েছিল শামাদানে। বলেছিল, জ্বলে ওঠ তো বাপু মোমবাতি! তখুনি দপ করে প্রজ্বলিত হয়েছিল মোমবাতির পলতে। সেই আলোয় ফোদারিনগে মশায় দেখেছিল, টয়লেট টেবিলের ঢাকনায় একটা ছোট্ট ফুটো-ধোঁয়া উঠছে ফুটোর কিনারা ঘিরে। ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মোমবাতির শিখায় দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল বিমূঢ় মানুষটা। অতঃপর আয়নায় দেখেছিল নিজের মুখের চেহারা এবং নিঃশব্দে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে গিয়েছিল নিজেরই প্রতিফলনের সঙ্গে।

প্রথম শব্দহীন প্রশ্নটা ছিল এই: মির্যাল কি একেই বলে?

ধ্যানস্থ অবস্থায় এরপর এমনই আবোল-তাবোল প্রশ্নোত্তর চলেছিল নিজের সঙ্গে, যা রীতিমতো গোলমেলে–আরও গোল পাকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল মাথার মধ্যে। মোটের ওপর একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। যা কিছু ঘটছে, সবই তার নির্ভেজাল ইচ্ছাশক্তির জোরেই ঘটছে। প্রথম এক্সপেরিমেন্টগুলোয় অনেক অনর্থ ঘটানোর পর পরবর্তী পরীক্ষানিরীক্ষায় হুঁশিয়ার না হয়ে পারেনি। তবে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে এক তা কাগজ তুলেছিল শূন্যে, রং পালটেছিল এক গেলাস জলের প্রথমে গোলাপি, তারপর সবুজ। সৃষ্টি করেছিল একটা পুঁচকে গেঁড়ি এবং নিশ্চিহ্নও করেছিল অত্যাশ্চর্যভাবে। শূন্য থেকে একটা অত্যাশ্চর্য দাঁত-মাজা বুরুশ আনিয়েছিল নিজের ব্যবহারের জন্যে। এইসব করতে করতেই ঘড়িতে রাত একটা বাজতেই খেয়াল হয়েছিল, অত্যাশ্চর্যভাবে রোজকার কেরানিগিরির দফরফা হয়ে যেতে পারে পরের দিন, যদি-না এখুনি একটু ঘুমিয়ে নেয়। জামাকাপড় ছাড়তে গিয়ে শার্টটাকে মাথা গলিয়ে বার করার সময়ে হিমশিম খেতে খেতে হুকুম দিয়েছিল অজান্তেই–নিয়ে যাও আমাকে বিছানায়– বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখেছিল, দিব্যি লম্বমান রয়েছে খাটের ওপর। তারপর হুকুম দিয়েছিল, এবার ভোলা হয়ে যাক জামাকাপড়। পরক্ষণেই দিগম্বর অবস্থায় শীতে কাঁপতে কাঁপতে ধড়ফড় করে ঝেড়েছিল নয়া হুকুম, আমার রাতের শাট এসে যাক গায়ে-না, না, খুব নরম মোলায়েম উলের রাত্রিবাস চাই। আঃ! কী আরাম! আসুক এবার আরামের ঘুম!…

রোজ যে সময়ে ঘুম ভাঙে, পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল সেই সময়ে। গুম হয়ে খেয়ে গেল প্রাতরাশ। একটাই চিন্তা চরকিপাক দিচ্ছে মাথার মধ্যে। কাল রাতের উদ্ভট কাণ্ডকারখানাগুলো জলজ্যান্ত স্বপ্ন নয় তো? অনেকক্ষণ পরে ইচ্ছে হয়েছিল সাবধানে আরও কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করার। যেমন, তিনটে ডিম খেল ব্রেকফাস্টে। ল্যান্ডলেডির দেওয়া দুটো, তৃতীয়টা বানিয়ে নিল শূন্য থেকে। অলৌকিক হাঁসের ডিম। অনেক তাজা, অনেক সুস্বাদু ডিম পাড়া হল টেবিলে, সেদ্ধও হয়ে গেল টেবিলে এবং প্লেটে এসে পড়ল অসাধারণ ইচ্ছাশক্তির দৌলতে। চাকুরিস্থলে গেল হন্তদন্ত হয়ে ভেতরের উত্তেজনাকে প্রাণপণে চেপে রেখে। সেই রাতেই ল্যান্ডলেডি অবশ্য বিস্ময় প্রকাশ করেছিল, তৃতীয় ডিমটার খোলা টেবিলে এল কোত্থেকে, ভেবে পায়নি কিছুতেই।

অফিসের কাজ কিন্তু কিছু হয়নি সারাদিনে। তাতে কোনও অসুবিধেও হয়নি। সারাদিন। নিজের অলৌকিক ক্ষমতার চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকবার পর দিনের শেষে শেষ দশ মিনিটে প্রয়োগ করেছিল বিচিত্র ইচ্ছাশক্তিকে। সারাদিনের স্তূপীকৃত কাজ সমাধা হয়ে গিয়েছিল ওই দশ মিনিটেই! দিনটা শুরু হয়েছিল অপরিসীম বিস্ময়বোধ দিয়ে শেষ হল আত্যন্তিক উল্লাসবোধে। অতিমানুষ হওয়ার পরমোল্লাস! লং ড্রাগন পানশালা থেকে বিতাড়িত হওয়ার মূর্তিটা ওরই মধ্যে কাঁটার মতো খচখচ করে বিধতে লাগল মনের মধ্যে। ঘটনাটা সহকর্মীরাও শুনেছিল। তা-ই নিয়ে একটু-আধটু হাসিঠাট্টাও সহ্য করতে হল। ভঙ্গুর পদার্থ শূন্যে উত্তোলনের ব্যাপারে এখন থেকে সতর্ক থাকাই ভালো। তবে, ঈশ্বরপ্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতাটার অসীম সম্ভাবনা ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে এনেছিল ফোদারিনগেকে। অন্যান্য ভেলকির ফাঁকে ফাঁকে বাড়িয়ে নিয়েছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তিও। যেমন, একজোড়া হীরকখচিত শার্টের বোতাম। শূন্য থেকে বোতামজোড়া আবির্ভূত হতে না-হতেই সাত তাড়াতাড়ি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল শূন্যের মধ্যেই–একজন ছোকরা সহকর্মীকে টেবিলের দিকে আসতে দেখেই। হীরের বোম এল কোত্থেকে, এই নিয়ে জবাবদিহি করতে গিয়ে আবার না ফ্যাসাদে পড়তে হয়। অদ্ভুত ক্ষমতাটাকে রয়েসয়ে ভেবেচিন্তে হিসেব করে কাজে লাগানো দরকার। এমন কিছু কঠিন কৌশল অবশ্য নয়– সাইকেল চালানো শেখার মতোই। প্রথমদিকে একটু-আধটু দুর্ঘটনা ঘটেই–তারপর জল ভাত। কিন্তু প্র্যাকটিস তো দরকার। সেটা লং ড্রাগন পানশালায় সম্ভব নয়। আবার কেলোর কীর্তি আরম্ভ হয়ে যেতে পারে। তাই এল গ্যাস কারখানার পেছনে নিরিবিলি সরু গলিটায় –পাঁচজনের চোখের আড়ালে।

কিন্তু মৌলিকতা দেখাতে পারেনি নিরিবিলি প্র্যাকটিসেও। ইচ্ছাশক্তির বলে বলীয়ান হলেও, মানুষ হিসেবে তো ফোদারিনগে অতিশয় মামুলি টাইপের। একবার ভাবল, হাতের ছড়িটাকে বিষধর সাপ বানালে কেমন হয়? তারপর? এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে অলৌকিক সৰ্পৰ্মহাশয়কে বাগে রাখবে কে? অনর্থ ঘটিয়ে বসবে যে। তার চাইতে বরং ছড়িটাকে বলা যাক ফুলের গাছ হয়ে যেতে।

হুকুমটা মুখ থেকে খসতে-না-খসতেই ফুটপাতের কিনারায় গজিয়ে উঠল ভারী সুন্দর ফুলের ঝোপ। ঠিক এই সময়ে কানে ভেসে এসেছিল ভারী বুটের শব্দ। সর্বনাশ! মির্যাকূলের জবাবদিহি করতে হলেই তো গেছে ফোদারিনগে! সাত তাড়াতাড়ি হুকুম দিয়েছিল ফুলের গাছকে–দূর হ!

বলা উচিত ছিল–ছড়ি হ! কিন্তু হুটোপাটি করতে গিয়ে বেমক্কা হুকুমটা বেরিয়ে গিয়েছিল মুখ দিয়ে। বাস! সাঁই সাঁই করে ভীষণ গতিবেগে দূরে চলে গিয়েছিল ফুল-ধরা ছড়ি এবং ক্রুদ্ধ গালাগাল ভেসে এসেছিল দূর থেকে। চলমান ফুলছড়ি দমাস করে আছড়ে পড়েছে আগুয়ান পুরুষটার গায়ে। কে রে বেল্লিক! ছড়ি ছোঁড়ার এই কি জায়গা? থুতনিটা যে আর-একটু হলে খসে যেত!

সরি, বলেই আরও ঘাবড়ে গিয়ে গোঁফে তা দিতে শুরু করেছিল ফোদারিনগে কনস্টেবল উইঞ্চকে আসতে দেখে।

ফোদারিনগেকে দেখেই চিনতে পেরেছিল উইঞ্চ। জখম থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে সে কী ঝাঁপাই! লং ড্রাগন পানশালায় লম্ফ তোবড়ানোর পর আবার কী নষ্টামি আরম্ভ হল অন্ধকার গলিতে? বলি, ব্যাপারটা কী? পুলিশের ওপর হাঙ্গামা? ফাটকে ঢোকার শখ হয়েছে বুঝি? চুপ কেন? অ্যাঁ?

আমতা আমতা করে বলতে গিয়েছিল ফোদারিনগে, মিরাকলের জন্যেই নাকি ঘটছে। এইসব অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার। কিন্তু মুখ দিয়ে মির্যাল শব্দটা বেরতে-না-বেরতেই তেড়ে উঠেছিল কনস্টেবল উইঞ্চ।

সর্বনাশ! গুপ্ত রহস্য আর তো গুপ্ত থাকবে না! এখুনি শুরু হবে পুলিশি জেরা। নিজের ওপরেই বিষম রাগ হয়ে গিয়েছিল ফোদারিনগের। উইঞ্চের তড়পানিরও ইতি করা দরকার। ঝটিতি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, কান ঝালাপালা করে দিলে দেখছি। মির্যাল দেখতে চাও তো? বেশ তো, দেখে যাও একটু হাতসাফাইয়ের ভেলকি! হেডস যাও– এখুনি!

বাস, ফুটপাতে আবার একা হয়ে গিয়েছিল ফোদারিনগে!

সে রাতে আর মিরাকল ঘটায়নি অঘটন ঘটানোর আজব মানুষটা। ফুলে ফুলে ভরে ওঠা ছড়িটার অবস্থা কী হল, তা নিয়েও আর মাথা ঘামায়নি। ফিরে এসেছিল শহরে। ভয়ে ভয়ে, এক্কেবারে ঠান্ডা মেরে। মুখে আর কথাটি নেই। নিঃশব্দে ঢুকেছিল নিজের শোবার ঘরে। তারপর শুরু হয়েছিল স্বগতোক্তি, জয় ভগবান! এ কী ক্ষমতা দিলে আমাকে! হুকুমের এত জোর? কল্পনাও করা যায় না! হেডস জায়গাটা কেমন, তা-ও তো ছাই জানি না।

খাটে বসে পায়ের বুট খুলতে খুলতে এবং নিজের মনে বকবক করতে করতে শেষকালে কিন্তু বিলক্ষণ সুখীই হয়েছিল নচ্ছার কনস্টেবলটাকে ক্যালিফোর্নিয়ায় পাচার করার সুখচিন্তায়। কীভাবে পাচার হল হতভাগা এবং তারপর কী কী ঘটবে, সেসব নিয়েও আর মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত করেনি। শুতে-না-শুতেই সে কী ঘুম! ঘুমের মধ্যে অবিশ্যি স্বপ্ন দেখেছিল উইঞ্চকে–রেগে তিনটে হয়ে এই মারে কি সেই মারে অবস্থায় তেড়ে আসছে– কিন্তু নাগাল ধরতে পারছে না ফোদারিনগের!

পরের দিন দুটো কৌতূহলোদ্দীপক সংবাদ শ্রবণ করল অঘটন ঘটনবাজ ফোদারিনগে। কে নাকি অতীব সুন্দর একটা গোলাপ ফুলের গাছ পুঁতে গেছে লুলাবরো রোডে বুড়ো গামশটের বাড়ির ঠিক সামনেই। আর, রলিং মিল পর্যন্ত নদীতে জাল ফেলা হচ্ছে কনস্টেবল উইঞ্চের মরদেহের সন্ধানে।

সেদিন বড়ই অন্যমনস্ক ছিল ফোদারিনগেমশায়। নতুন কোনও মিরাকল ঘটায়নি। উইঞ্চের জন্যে বড় মন কেমন করছিল। তাই তার নিত্যব্যবহার্য দু-একটা জিনিস আর ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের জন্যে সামান্য কিছু খাবারদাবার পাঠিয়ে দিয়েছিল হুকুমের জোরে তার বেশি কিছু নয়। মাথার মধ্যে হাজার চিন্তা ভোমরার মতো গুনগুন করে ঘুরপাক খাওয়া সত্ত্বেও দৈনিক কাজে ত্রুটি রাখেনি কোত্থাও। লোকে অবশ্য তা-ই নিয়েও হাসি মশকরা করেছে। কী জ্বালা, কী জ্বালা! ফোদারিনগে কেন এত অন্যমনস্ক, কেন এত চুপচাপ–তা নিয়ে তোমাদের অত ইয়ারকি মারবার দরকারটা কী শুনি? ভাগ্য ভালো, উইঞ্চের চিন্তায় বিভোর হয়ে ছিল ফোদারিনগে–নইলে অনুর্থর পর অনর্থ ঘটে যেত সেইদিনই। রেগেমেগে যদি কাউকে বলে বসত, গোল্লায় যাও, জাহান্নমে যাও!–তাহলে কী কাণ্ডটা হত বলুন তো? নরক জায়গাটা নিশ্চয় খুব আহামরি নয়!

রোববার সন্ধ্যা নাগাদ গির্জাতে গেল ফোদারিনগে মনের জ্বালা জুড়াতে। কী আশ্চর্য! ঠিক সেইদিনই অলৌকিক কাণ্ডকারখানা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন বিশপমশাই। নাম তাঁর মি. মেডিগ। গুপ্তবিদ্যায় তাঁর আগ্রহ ছিল বরাবরই। আইনকানুন যেসব ব্যাপারকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে শাসনে রাখে, সেইসব ব্যাপার নিয়েই অনেক কথা বলে গেলেন তিনি। কান খাড়া করে শুনে গেল ফোদারিনগে। গির্জাতে নিয়মিত সে আসে না। যেদিন এল, সেইদিনই কিনা মনের মতো বক্তৃতা! শুনে প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল। ঈশ্বরদত্ত অলৌকিক ক্ষমতাটা সম্বন্ধে নতুন দিগন্ত যেন উন্মোচিত হল বিহ্বল মনের আকাশে। ঠিক করল, বক্তৃতা শেষ হলেই দেখা করবে মি. মেডিগের সঙ্গে।

ফোদারিনগের নাস্তিকতা অবিদিত ছিল না শহরে। ভগবান-টগবান একেবারেই মানে না, ধর্ম জিনিসটা নিয়ে ফক্কড়ি করে। এহেন ছোকরা হঠাৎ কথা বলতে চায় নিরিবিলিতে–শুনে বিলক্ষণ অবাক হয়েছিলেন মি. মেডিগ। তাই সঙ্গে সঙ্গে দেখা করেননি। হাতের কাজকর্ম সেরে তাকে নিয়ে গেলেন নিজের প্রাইভেট কক্ষে। চুল্লির সামনে বসিয়ে নিজে দাঁড়ালেন দুপা ফাঁক করে খিলানের মতো ফাঁক-করা পদযুগলের ছায়া পড়ল বিপরীতদিকের দেওয়ালে। আত্মকাহিনি বলতে গিয়ে কিন্তু প্রথমদিকটায় লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল ফোদারিনগে। শুরু করবে কীভাবে, তা-ই নিয়েই পড়েছিল মহাবিড়ম্বনায়। জানি না আদৌ বিশ্বাস করবেন কি না জাতীয় দু-একটা বাক্য নিঃসরণের পর আচমকা শুধিয়েছিল মি. মেডিগকে–বলুন তো, মির‍্যা সম্বন্ধে আপনার কী অভিমত?

আচমকা প্রশ্ন শুনে জবাব দিতে একটু টালবাহানা করেছিলেন মি. মেডিগ। কিন্তু চেপে ধরেছিল ফোদারিগে–নেহাতই সাধারণ মানুষ আমি, দেখতেই পাচ্ছেন। কিন্তু আমার মতোই গোবেচারা একটা সত্তার ভেতরে যদি আচমকা ইচ্ছাশক্তি মাথাচাড়া দেয়, ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়, তখন আপনার কী মনে হবে বলুন তো?

অমন হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়, কায়দা করে জবাব দিয়েছিলেন মি. মেডিগ।

টেবিলের ওপর তামাকের বয়েমটা দেখিয়ে বলেছিল ফোদারিনগে, হাতেনাতে দেখিয়ে দিতে চাই, একেই মিরাকল বলে কি না। আধ মিনিট সবুর করুন প্লিজ।

বলে, কপাল কুঁচকে তাকিয়েছিল তাম্রকূট আধারের দিকে। আঙুল তুলে হুকুম দিয়েছিল বিড়বিড় করে, হও তো বাপু ভায়োলেট ফুল।

তা-ই হয়েছিল তামাকের বয়েম। পরিবর্তনটা ঘটেছিল সহসা এবং দারুণভাবে চমকে দিয়েছিল মি. মেডিগকে। ফ্যালফ্যাল করে পর্যায়ক্রমে চেয়ে ছিলেন ফোদারিনগে এবং ফুলের তোড়ার পানে। মুখে একটা কথাও বলেননি। তারপর হেঁট হয়ে ঘ্রাণ নিয়েছিলেন ফুলের। টাটকা ফুল। যেন এখুনি তুলে আনা হয়েছে বাগান থেকে।

চেয়েছিলেন ফোদারিনগের দিকে–কী করে করলেন বলুন তো?

গোঁফে টান মেরে বলেছিল ফোদারিনগে, সেইটাই জানতে এসেছি। যা দেখলেন তা কি মির্যাল, না ডাকিনীবিদ্যা? হুকুম দিয়ে অঘটন ঘটাতে পারি–দেখতেই পেলেন। কী মনে হয় আমাকে? প্রশ্ন সেইটাই–এসেছি জবাবটা জানতে।

খুবই অসাধারণ কাণ্ড।

অথচ দেখুন, এই সেদিনও এ ক্ষমতা আমার ছিল না। ইচ্ছে করলেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতাম না। গত হপ্তায় ছিলাম সাধারণ মানুষ–এখন হলাম অসাধারণ। আচমকা ক্ষমতাটা এসে গেছে ভেতরে। কোথাও একটা গোলমাল ঘটেছে, ইচ্ছাশক্তিটা হঠাৎ এমন জোরদার হয়ে উঠেছে।

এ ছাড়াও আরও কিছু করতে পারেন নাকি?

বলেন কী! যা খুশি তা-ই করতে পারি। একটু ভাবতেই অনেকদিন আগে দেখা একটা ভোজবাজি মনে পড়ে গিয়েছিল ফোদারিনগের, তর্জনীশাসনে হুকুম দিয়েছিল ফুলের তোড়াকে–মাছ হয়ে যাও–না, না, লাল মাছ ভরতি গামলা হয়ে যাও–কাচের গামলা। বাঃ, এই তো চাই! দেখলেন?

আশ্চর্য! অবিশ্বাস্য! আপনি… আপনি…

যা ইচ্ছে বলব, ঠিক তা-ই হবে। দেখবেন?–ওহে মাছের গামলা, পায়রা হও তো বাপু!

পরক্ষণেই ঘরময় উড়ে বেড়িয়েছিল একটা নীল রঙের পায়রা। গোঁত খেয়ে খেয়ে গায়ের ওপর আছড়ে পড়া পাশ কাটিয়ে গেছেন মি. মেডিগ। দেখে, আবার হুকুম ঝেড়েছিল ফোদারিনগে। পায়রা নিশ্চল হয়ে ভেসেছিল শূন্যে। আবার হুকুম দিতেই পায়রা ফিরে এসেছিল টেবিলে ফুলের তোড়া হয়ে। পরের হুকুমেই দেখা গিয়েছিল কোথায় ফুলের তোড়া–এ যে সেই তামাকের বয়েম–মি. মেডিগের অতিপ্রিয় নেশার বস্তু।

শেষের দিকের মির্যালগুলো নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ করে গিয়েছিলেন মি. মেডিগ। তামাকের বয়েম পুনরাবির্ভূত হওয়ার পর দ্বিধাগ্রস্তভাবে তুলে নিয়ে পরখ করে ফের নামিয়ে রেখেছিলেন টেবিলে। বাঃ। বিস্ময়োক্তি ছাড়া আর কোনও শব্দ নিঃসৃত হয়নি। বদনগহ্বর থেকে। ফোদারিনগে তখন নিবেদন করেছিল লং ড্রাগন পানশালার লহ্মকাণ্ড থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি ঘটনা। তৃতীয় ডিমের আবির্ভাব পর্যন্ত শুনেই হাত বাড়িয়ে মি. মেডিগ বাধা দিয়েছিলেন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে–সম্ভব! সম্ভব! যদিও অসম্ভব। যদিও অবিশ্বাস্য! তবুও বলব, এসবই সম্ভব। কতকগুলো ভজঘট ব্যাপার অবশ্য থেকে যাচ্ছে, সমস্যার জট আরও বাড়ছে। যেমন, এ ক্ষমতা সাধারণ মানুষের মধ্যে এতদিন কখনও দেখা যায়নি। মিরাকল ঘটানোর ক্ষমতা পরমকারুণিক তাঁদেরই দেন, যাঁরা মানুষ হিসেবে আর পাঁচজনের মতো নয়। যেমন মহম্মদ, ভারতের যোগীরা, মাদাম ব্লাটক্সি, আরগিলের ডিউক। কদাচিৎ এই ক্ষমতা পায় অসাধারণ প্রকৃতির মানুষরাই-প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের ভেতরে যে আরও গূঢ় নিয়মের অস্তিত্ব রয়েছে–তখনই বোঝা যায়। হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনি চালিয়ে যান–চালিয়ে যান!

চালিয়েই গিয়েছিল ফোদারিনগে। উইঞ্চকে ক্যালিফোর্নিয়া পাচারের কাহিনি বর্ণনা করার পর বিষণ্ণ কণ্ঠে জানিয়েছিল, ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ইচ্ছাশক্তিটা প্রয়োগ করে ফেলায় ঘটেছে। এই বিপত্তি। উইঞ্চকে সুদূর ক্যালিফোর্নিয়ায় অত তাড়াতাড়ি উড়িয়ে নিয়ে ফেলার আদৌ তার বাসনা ছিল না। কিন্তু এমন ঝাঁপাই জুড়েছিল সে, ঝোঁকের মাথায় কী বলতে কী বলে ফেলেছে। আসলে, কী বলা উচিত, আর কী বলা উচিত নয়–এই ব্যাপারটাই বারবার গুলিয়ে ফেলছে ফোদারিনগে। এই যেমন দেখা গেল মাছের গামলার ব্যাপারে। শুধু একখানা মাছ চেয়ে বসল, কিন্তু চাওয়া উচিত ছিল মাছের গামলা, শুধু গামলা নয়, কাচের হওয়া চাই! হুকুম দিতে-না-দিতে তা এত তাড়াতাড়ি ফলে যাচ্ছে যে, হুকুম ফিরিয়ে নেওয়ারও সময় পাওয়া যাচ্ছে না। উইঞ্চকে ফিরিয়ে আনাও তো এখন সম্ভব নয়। সে অবশ্য ফিরে আসতেই চাইছে। কয়েক ঘণ্টা অন্তর তা খেয়াল হতেই ফোদারিনগে নয়া হুকুম ছেড়ে তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে পূর্বাবস্থায়, স্রেফ আত্মরক্ষার তাগিদে। উইঞ্চ অবশ্য তা বুঝতেও পারছে না। হয়তো প্রতিবার ট্রেনের টিকিট কাটার পয়সা জলে যাচ্ছে, বিরাট লোকসান হয়েই চলেছে। কিন্তু এ ছাড়া আর কিছু করারও তো নেই ফোদারিনগের। ধাঁ করে এতটা পথ চক্ষের নিমেষে উড়ে যাওয়ার ফলে বাতাসের ঘষটানিতে হয়তো জামাকাপড় ঝলসে গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার পুলিশ উঞ্ছ আকৃতির উইঞ্চকে নিশ্চয় গারদে পুরে রেখেছে। সম্ভাবনাটা মনে হতেই ফোদারিনগে অবশ্য একপ্রস্থ জামাকাপড়ের অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইচ্ছাশক্তিটাকে ঠিকমতো প্রয়োগ করা নিয়ে। হুটপাট কথা বলে ফেলায় এই যে ডাইনিদের মতো, অথবা অপরাধীদের মতো কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ফেলছে ফোদারিনগে, এর জন্যে মরমে মরে রয়েছে সে।

শুনতে শুনতে ভয় ভেঙে গিয়েছিল মি. মেডিগের। অনেকটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছিলেন। ফোদারিনগেকে সান্ত্বনা এবং আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, আশ্চর্য এই শক্তিকে ডাকিনীবিদ্যা বলা যায় না কোনওমতেই, অপরাধের গন্ধও নেই এর মধ্যে। খাঁটি মিরাকল বলতে যা বোঝায়, এ হল তা-ই।

প্রশস্তি শুনেও বিষাদ কাটেনি ফোদারিনগের। উইঞ্চকে কোনওরকম ঝঞ্ঝাট না পাকিয়ে ফিরিয়ে আনা যায় কীভাবে, এই সমস্যাই তুলে ধরেছিল বারবার। মি. মেডিগ কিন্তু উইঞ্চ সমস্যা নিয়ে তখনকার মতো মাথা ঘামাতে চাননি। ফোদারিনগের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষটাকে নিয়ে আগে ভাবনাচিন্তা করা দরকার। আশ্চর্য এই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগপদ্ধতি সম্পর্কে গবেষণা দরকার। ক্ষমতাটা যে অপরিসীম, তা তো দেখাই যাচ্ছে। অনেক অদ্ভুত কাণ্ডই ঘটানো যায় এই ক্ষমতা দিয়ে, আগে সেইগুলোই দেখা যাক। তারপরে এইভাবেই শুরু হয়ে গেল অবিশ্বাস্য কার্যপরম্পরা। শুরু হল গির্জার ঠিক পেছনেই মি. মেডিগের নিরিবিলি কক্ষে, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর রবিবার রাত্রে। মি. মেডিগ প্রেরণা এবং উৎসাহ জুগিয়ে গেলেন এবং ফোদারিনগে মির্যাল-এর পর মিরাকল ঘটিয়ে চলল। তারিখটার দিকে পাঠক-পাঠিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে বিশেষভাবে। এই কাহিনির কিছু অংশ আপত্তিকর মনে হতে পারে তাঁদের কাছে। কাগজে কিছু কিছু বিবরণ বেরিয়েছিল, পড়েও থাকতে পারেন। যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভয়ংকর দুর্ঘটনায় মারাও হয়তো গিয়েছিলেন বছরখানেক আগে। কাহিনি পড়তে পড়তেই যে কোনও সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন পাঠক অথবা পাঠিকা বুঝতে পারবেন, ঘটনাগুলো দুর্ঘটনা হলেও অপ্রত্যাশিত নয়, অবিশ্বাস্যও নয়। কাহিনিও শেষ হয়ে গেল, এমন ধারণাও করে বসবেন না দয়া করে। বরং বলা যেতে পারে, এই তো সবে জমে উঠল কাহিনি। দুই অলৌকিক ঘটনাবাজ পরমোৎসাহে নিভৃত প্রকোষ্ঠে বসে গোড়ার দিকে যেসব অলৌকিক ঘটনাগুলো ঘটিয়েছিল, তা নিতান্তই মামুলি এবং বৈচিত্রহীন, ছোট ছোট মির্যাকল। থিয়োসফিস্টদের মির্যালের মতোই অকিঞ্চিত্বর, শূন্য থেকে কাপ-ডিশ আনা অথবা বারান্দা সাজানোর জিনিসপত্র বানিয়ে নেওয়ার মধ্যে পিলে-চমকানো ব্যাপার না থাকলেও মি. মেডিগের পিলে চমকে গিয়েছিল প্রতিবারেই। ফোদারিনগে যতবারই উইঞ্চ-ঘটিত ব্যাপারটার সুচারু নিষ্পত্তি চেয়েছে, ততবারই বাধা দিয়ে বিষয়ান্তরে চলে গেছেন মি. মেডিগ। ডজনখানেক এই ধরনের ছোটখাটো অলৌকিক ঘটনাবলি সংঘটিত করার পর একটা সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগ্রহ দেখা গিয়েছিল মি. মেডিগের।

রাত তখন এগারোটা। অলৌকিক কাণ্ডকারখানার ঠেলায় খাবার কথা একদম খেয়াল নেই। খেয়াল হল পেট চুঁইছুঁই করতেই। অথচ খাবার যার আনার কথা, সেই মহিলাটির টিকি দেখা যাচ্ছে না। দায়িত্বজ্ঞানহীনা, কাণ্ডজ্ঞানহীনা এই মহিলার ওপর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মি. মেডিগ। বরাবরই কাজে ফাঁকি দিয়ে অভ্যস্ত। কিছুতেই বাগে আনতে পারেননি তিনি। খিদে মিটিয়ে দিয়েছিল ফোদারিনগে অতি সহজেই। অলৌকিক ক্ষমতার ব্যাপকতর প্রয়োগের সম্ভাবনাটা মাথায় এসে গিয়েছিল পেট চনমন করতেই। অর্ডার দিতেই শূন্য থেকে রাজসিক খানার পর খানা এসে গিয়েছিল টেবিলে। যার যেটা খেতে এবং পান করতে ভালো লাগে–ঠিক সেই সেই খাদ্য এবং পানীয় হাজির হতেই দুজনেই। বীরবিক্রমে সেসব আক্রমণ করেছিল সবার আগে। তারিয়ে তারিয়ে রসাস্বাদন করার পর আবার মগজ খুলে গিয়েছিল ফোদারিনগের। আরও ভালোভাবে অলৌকিক ক্ষমতাটাকে কাজে লাগানোর উৎকৃষ্ট একটা মতলব এসে ছিল মাথায়। প্রস্তাবটা শুনে তো প্রথমে হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন মি. মেডিগের মতো পরমোৎসাহী পুরুষও। এ কাণ্ড যদি সম্ভব হয়। তাহলে সমাজ-সংসারের ভোল ফিরিয়ে দেওয়া যাবে যে!–না হওয়ার কী আছে? জিদ ধরেছিল ফোদারিনগে, হুকুম দিয়েছিল নিজের ইচ্ছানুযায়ী।

বিচিত্র হুকুম নিঃসন্দেহে। হাউসকিপারের মতিগতি যাতে এখন থেকে পালটে যায়, ঘরকন্নায় নজর দেয়, কাণ্ডজ্ঞান যেন ফিরে আসে… ইত্যাদি… ইত্যাদি। হুকুমের ফোয়ারা ফুরানোর আগেই অদ্ভুত আওয়াজের পর আওয়াজ শোনা গিয়েছিল ওপরতলায়। ধড়মড়িয়ে। দৌড়েছিলেন মি. মেডিগ। ফিরে এসে চোখ বড় বড় করে বলেছিলেন, আজব কাণ্ড! নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল মেয়েটা। ঘুমের মধ্যেই ইচ্ছাশক্তি কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে! তোবা! তোবা!

না করার কী আছে? প্রতিবাদের সুরে বলেছিল ফোদারিনগে–জাগরণে-স্বপনে সবসময় কার্যকর হবেই আমার ইচ্ছাশক্তি।

ব্র্যান্ডি খেয়ে ঘুমাচ্ছিল মশায় নাক ডাকিয়ে। সুবুদ্ধি ফিরে এসেছে ঘুমন্ত অবস্থাতেই। ঘুম থেকে উঠেই লুকানো এক বোতল ব্র্যান্ডি বার করে আছড়ে ভেঙেছে… এখন জ্বলছে। অনুতাপে। তোবা! তোবা! তোবা!

এবার তাহলে উইঞ্চের ব্যাপারটা

রাখুন আপনার উইঞ্চের ব্যাপার! আশ্চর্য! আশ্চর্য! আশ্চর্য! এ কী আশ্চর্য ক্ষমতা পেয়েছেন আপনি! সীমাহীন সম্ভাবনা… যতই দেখছি, ততই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি। শুনবেন, আরও কী কী করা যায় আপনাকে দিয়ে?

বলেই সম্ভবপর অলৌকিক ঘটনাবলির ফিরিস্তি শোনাতে শুরু করে দিয়েছিলেন মি. মেডিগ–উইঞ্চকে ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে আনার কথায় কানই দেননি। শুধু মুখে কথা নয়, হাতেনাতে কাজও আরম্ভ করে দিয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ–অবশ্যই ফোদারিনগে বেচারির সহযোগিতায়। শিকেয় তোলা রইল ফোদারিনগের আসল সমস্যা। দুই মূর্তিমান অত রাতে বেরিয়ে পড়েছিল শহরময় চরকিপাক দিয়ে শহরের ভোল ফেরানোর অসম্ভব দায়িত্ব নিয়ে। ঘটেছিল বিস্ময়কর পরিবর্তনের পর পরিবর্তন। কনকনে শীতের রাতে নিথর চাঁদের নিপলক চাহনির নিচে দেখা গিয়েছিল দুই অলৌকিক ঘটনাবাজকে। হাত-মুখ নেড়ে বিষম ফুর্তিতে আটখানা হয়ে পরিবর্তনের প্ল্যান ঝেড়ে যাচ্ছেন মি. মেডিগ–প্ল্যানমাফিক অদ্ভুত অদ্ভুত ফরমাশ দিয়ে যাচ্ছে ফোদারিনগে। প্রথম প্রথম হুকুম দেওয়ার সময়ে যেটুকু দ্বিধা বা লজ্জা ছিল–এখন তা তিরোহিত হয়েছে। এখন রোমাঞ্চ-উল্লাসে মাথার চুল খাড়া হয়ে রয়েছে বললেই চলে। একরাতেই পার্লামেন্টারি ডিভিশনের সব কটা মাতালের মদ্যাসক্তির নিবারণ ঘটিয়েছিল এই দুজনে এবং জলে রূপান্তরিত করেছিল সব কটা পানশালার বিয়ার আর অ্যালকোহল (এই বিষয়টিতে প্রবল আপত্তি করেছিল অবশ্য ফোদারিনগে কিন্তু তুড়ি মেরে সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়েছিলেন মি. মেডিগ)। রেলপথের বিস্তর উন্নতিও ঘটিয়েছিল দুই নিশাচর। ফ্লিনডারের জলাভূমি থেকে বার করে দিয়েছিল সমস্ত জল আর কাদা। ওয়ান ট্রি হিল-এর মাটির উৎকর্ষসাধনও করে ছিল দুজনে। সেই সঙ্গে অদৃশ্য করেছিল পল্লি-পুরুতের ছিনেজোঁক আঁচিল। সাউথ ব্রিজের জখম জেটি মেরামতের মতলব নিয়ে হনহন করে যেতে যেতে রুদ্ধশ্বাসে মি. মেডিগ যখন বলছেন, কাল থেকে এ জায়গা চেনা যাবে না–পিলে চমকাবে প্রত্যেকেরই কৃতজ্ঞতায় গদগদ থাকবে চিরটা কাল –ঠিক তখনই ঢং-ঢং-ঢং করে রাত তিনটে বেজেছিল গির্জার ঘড়িতে।

থমকে গিয়েছিল ফোদারিনগে–সর্বনাশ! এখন যে বাড়ি না ফিরলেই নয়। সকাল আটটা বাজলেই তো শুরু হবে কাজের রুটিন। বাড়িউলি মিসেস উইমসও যা খাণ্ডারনি—

অসীম শক্তির কৃপায় মি. মেডিগ তখন মিছরির মতোই মিষ্টি হয়ে গিয়েছিলেন। সুমিষ্ট বচনে উদাত্ত কণ্ঠে তাই বলেছিলেন, সে কী! এই তো কলির সন্ধে! সবে তো শুরু। দশের মঙ্গল করায় কত মজা পাচ্ছেন, সেটা বলুন? কাল ঘুম থেকে উঠে সবাই যখন দেখবে।

কিন্তু

আচমকা ফোদারিনগের বাহু খামচে ধরেছিলেন মি. মেডিগ। জ্বলজ্বল করে উঠেছিল দুই চক্ষু–তাড়াতাড়ি কীসের ভায়া? বলেই আঙুল তুলে মধ্যগগনের চাঁদ দেখিয়ে নিঃসরণ করেছিলেন একটাই শব্দ–জোশুয়া!

জোশুয়া? ফোদারিনগে তো ভ্যাবাচ্যাকা। মুশার উত্তরাধিকারী হিব্রু নায়ক জোশুয়ার কথা উঠছে কেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, জোশুয়া! থামান চাঁদকে!

চোখ তুলে চাঁদের পানে চেয়েছিল ফোদারিনগে।

উত্তাল উচ্ছ্বাসে ক্ষণিক বিরতি দিয়ে বলেছিল শেষকালে, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?

বাড়াবাড়ি আবার কীসের? তেড়ে উঠেছিলেন মি. মেডিগ। চাঁদ থামে না ঠিকই। আপনি থামিয়ে দিন পৃথিবীর বনবন করে লাটুর মতো পাক খাওয়াটা। তাহলে দাঁড়িয়ে যাবে সময়। ক্ষতি তো কারও করছি না।

তা মন্দ বলেননি! গোঁফে তা দিতে দিতে বলেছিল ফোদারিনগে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। বেশ, তাহলে চেষ্টা করেই দেখা যাক।

বলা বাহুল্য, হুকুমটা মামুলি হুকুম নয়। এত বড় হুকুম দিতে গেলে নিজেকে আগে তৈরি করা দরকার। এই মুহূর্তে ফোদারিনগের ইচ্ছাশক্তি অবশ্য ফ্যালনা নয়, তাহলেও পৃথিবীর আবর্তন স্তব্ধ করতে হলে পুরো ইচ্ছাশক্তিটাকে কথার হুকুমের মধ্যে জড়ো করা দরকার। তাই আটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছিল ফোদারিনগে। কোটের বোতাম এঁটে নিয়ে ধরিত্রীকে উদ্দেশ্য করে সাধ্যমতো আত্মবিশ্বাস কণ্ঠস্বরে ঢেলে দিয়ে বলেছিল, ওহে পৃথিবী, বন্ধ কর আবর্তন।

পরক্ষণেই, ধাঁ করে শুন্যপথে ডিগবাজি খেতে খেতে ছিটকে গিয়েছিল মিনিটে ডজন। ডজন মাইল গতিবেগে। সেকেন্ডে অগণিত চক্রবর্ত রচনা করা সত্ত্বেও চিন্তা করার মতো ক্ষমতাটা লোপ পায়নি ফোদারিনগের। চিন্তার মতো জিনিস আর আছে? কখনও তরল পিচের মতো ঘোলাটে থকথকে, আবার কখনও আলোর মতো ঝকঝকে চকিত। তাই একটা সেকেন্ডের মধ্যেই চিন্তাকার্য সমাপন করে নিয়ে ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছিল ফোদারিনগে এইভাবে–সব কটা হাড় আস্ত অবস্থায় যেন নিরাপদে নামতে পারি। যা-ই। ঘটুক-না কেন, আস্ত শরীরখানাকে দেখে-শুনে ভালো জায়গায় নামিয়ে দাও।

মোক্ষম সময়েই ইচ্ছাশক্তি জাহির করেছিল ফোদারিনগে, আর এক পলক দেরি হলেই জ্বলে যেত নিজেই। বাতাসের মধ্যে দিয়ে অত জোরে ধেয়ে গেলে জামাকাপড় ঝলসে তো যাবেই। মুখ থেকে হুকুমটা খসতে-না-খসতেই হুড়ম করে নেমে এসেছিল মোটামুটি ভদ্রস্থভাবেই টিপির আকারে রাখা সদ্য-খোঁড়া নরম মাটির ওপর। দমাস করে নামলেও চোট লাগেনি মোটেই, হুকুমই যে ছিল তা-ই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক পাশেই প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়েছিল একতাল ধাতু-ইট-কাঠ-পাথর, বস্তুপিণ্ডটার সঙ্গে অসাধারণ সাদৃশ্য রয়েছে বাজার চত্বরের ঘড়ি-মিনারের। মাটিতে পড়েই ঠিকরে গিয়েছিল ফোদারিনগের মাথার ওপর দিয়ে এবং বোমার মতো ফেটে গিয়ে ইট-কাঠ-পাথর হয়ে ছিটকে গিয়েছিল। দিকে দিকে। মস্ত একটা পাথরের চাঁইয়ের ওপর কোত্থেকে দড়াম করে এসে পড়ল একটা উড়ন্ত গোরু এবং নিমেষমধ্যে পিণ্ডি পাকিয়ে গেল ডিমের মতোই। দুমদাম ধড়াম-ধাম, আওয়াজের পর আওয়াজে ফোদারিনগের মাথা তখন বনবন করে ঘুরছে। জীবনে এমন প্রচণ্ড আছড়ে পড়ার শব্দপরম্পরা সে শোনেনি, একটা শব্দ কানের পরদা ফাটানোর উপক্রম করতে-না-করতেই আবার কান-ফাটানো শব্দ খাবলা মেরে নিচ্ছে যেন মগজখানাকেই। ভয়ংকর আওয়াজগুলোর ঢেউ চলে যাওয়ার পরেই এল ছোটখাটো ভাঙাচোরা আছড়ে পড়ার ক্রমশ ম্রিয়মাণ শব্দলহরি। আগাগোড়া অব্যাহত রইল কিন্তু প্রলয়ংকর ঝোড়ো হাওয়া, স্বর্গ-মর্ত জুড়ে তাণ্ডবনাচ নেচে বেড়াচ্ছে সেই মত্ত প্রভঞ্জন, ঝড় যে এত জোরালো হয়, ফোদারিনগে তা জানল সেই প্রথম। সে কী তেজ হাওয়ার। মাথা তুলে চারপাশে চোখ বোলাতেও পারছে না, মুভুখানা ছিঁড়ে উড়িয়ে নিয়ে না যায়। বেশ কিছুক্ষণ এমনই ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় ছিল বেচারি, যে ভালো করে নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারেনি। কোথায় আছে এবং কী ঘটছে, তা চোখ মেলে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। সংবিৎ ফেরার পর প্রথমেই খুলিতে হাত বুলিয়ে দেখে নিয়েছিল, ধড়ে মুন্ডুটা এখনও আছে কি না। ফরফর করে চুল উড়ছে টের পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল অবশেষে, যাক, মাথাটা এখনও বেহাত হয়নি।

লর্ড! খাবি খেতে খেতে ইষ্টনাম জপ করা ছাড়া ঝড়ের মধ্যে আর কোনও কথা ফোটেনি মুখে। তারপর অবশ্য আঁকুপাঁকু করতে করতে পাগলের মতো বকে গিয়েছিল নিজের মনে, ব্যাপারটা কী? ঝড় আর বাজ পড়ার আওয়াজে কান যে চৌচির হয়ে গেল! অথচ এক মিনিট আগেও কী মিষ্টিই না ছিল রাতটা, ফুটফুটে চাঁদের আলো! মেডিগের কথায় কান দিয়েই তো বাধিয়ে বসলাম ফ্যাসাদটা! উফ! হাওয়ার কী জোর রে বাবা! এ কী করে বসলাম নিরেট গাধার মতো! এখুনি যে পটোল তুলতে হবে সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্টে!…

মেডিগটা গেল কোথায়?

তুলকালাম কাণ্ডটাই বা ঘটল কেন?

ঝড়ে কোট উড়ছে পতপত করে চোখের সামনে। তারই ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, দেখে নিল ফোদারিনগে। সত্যিই চারপাশে অত্যন্ত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে চলেছে। দেখে-শুনে বিলকুল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ফের নিজের মনেই বকর বকর করে চলে অঘটনবাজ ফোদারিনগে, আকাশটা তো দেখছি ঠিক জায়গাতেই আছে–এখনও খসে পড়েনি। কিন্তু বিকট-ভয়ানক এই ঝড় বেটাচ্ছেলে তেড়েফুঁড়ে আসছে কোন চুলা থেকে? ওই তো চাঁদ দেখা যাচ্ছে মাথার ওপর। আগে যেখানে ছিল–ঠিক সেইখানেই। দিনদুপুরের মতো আলোরও ঘাটতি নেই। ওইটুকুই কেবল আগের মতো–বাকি তো সবই ওলট-পালট–গাঁ টা গেল কোন চুলোয়? কিছুই তো চোখে পড়ছে না–বিটকেল এই ঝড়খানাই বা এল কোন নরক থেকে? ঝড় ওঠার হুকুম তো আমি দিইনি।

দুপায়ে খাড়া হওয়ার চেষ্টা করেছিল ফোদারিনগে। অত কি সোজা? ঝড়ে মাথা মুড়িয়ে পরক্ষণেই আছড়ে ফেলেছিল মাটিতে। অগত্যা গোরু-ছাগলের মতো অতিকষ্টে, চার হাত পায়ে ভর দিয়ে কোনওমতে দেহ-উত্থান ঘটিয়েছিল ফোদারিনগে। কোটখানা তখনও পতপত করে উড়ছে মাথার ওপর দিয়ে। ঘাড় ফিরিয়ে অনেক কায়দা-কসরত করে দুটি চালনা করেছিল আকাশপানে বিধুমুখী অভিমুখে। এবং, আবার স্বগতোক্তি জাগ্রত হয়েছিল বিমূঢ় কণ্ঠে, সাংঘাতিক একটা গোলমাল হয়ে গেছে কোথাও-না-কোথাও। কী সেই গোলমালটা, সেইটাই যে কচুপোড়া মাথায় আসছে না।

যেদিকে দুচোখ যায়, দেখা যাচ্ছে কেবল প্রলয়ংকর প্রভঞ্জনের দাপটে ধাবমান সাদা ধুলোর কুয়াশা। ঝড় যে এমন রক্ত জল-করা হুংকার ছাড়তে পারে, তা-ও কি ছাই জানা ছিল? এ কী সৃষ্টিছাড়া পেটের মধ্যে হাত-পা ঢুকিয়ে-দেওয়া চেঁচানি! রক্ত যে ঠান্ডা হয়ে গেল। সাদাটে ধুলোর ধাবমান পরদার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে শুধু পাকসাট-খাওয়া মৃত্তিকা স্তূপ আর লন্ডভন্ড ধ্বংসস্তূপ। গাছ নেই, বাড়ি নেই, চেনাজানা কোনও আকারই চোখে পড়ছে না, দিগন্তবিস্তৃত শুধু ধু ধু লন্ডভন্ডতা, বহু দূরে বিলীন হয়েছে ঘূর্ণমান ধুলোস্তম্ভ আর জলস্তম্ভের নিচেকার রক্ত-জমানো নিরেট নিঃসীম তমিস্রার গভীরে। নারকীয় এই দক্ষযজ্ঞ কাণ্ডকারখানার ঠিক ওপরেই অট্টরোলে ফেটে পড়ছে বজ্র, চোখের স্নায়ু ঝলসে দিচ্ছে অতিতীব্র বিদুৎ। ঝড়ের বেগ কিন্তু বেড়েই চলেছে পলকে পলকে। খুব কাছেই পাটকাঠির মতো পটপট করে ভেঙে-যাওয়া একটা গাছ চলেছে গড়িয়ে গড়িয়ে–একটু আগেই যাচ্ছিল বিশাল মজবুত এম মহীরুহ। তারও ওপাশে দলা-পাকানো একটা ইস্পাত-ফ্রেম ঠিকরে ঠিকরে উঠছে মাটি থেকে।

ব্যাপারটা অবশ্যই অস্বচ্ছ নয় আপনার কাছে। ফোদারিনগে তো কোটের বোতাম এঁটে নিয়ে দরাজ গলায় পৃথিবীর আবর্তন বন্ধ করার হুকুম দিয়েই খালাস, ভূপৃষ্ঠের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সঞ্চরমাণ বস্তুগুলোর অবস্থা যে কী হবে, অর্ডার দেওয়ার আগে সেই হিসেবটা মনে মনে কষে নিলেই তো এই মহাপ্রলয়টা ঘটত না। বসুন্ধরা এমনিতেই ভীষণ বেগে পাক খেয়ে চলেছে, ভগবানের লাটুও বলা যায়। নিরক্ষরেখা বরাবর ভূপৃষ্ঠের গতিবেগ ঘণ্টায় হাজার মাইলেরও বেশি। অক্ষাংশ অঞ্চলে তার অর্ধেকেরও বেশি। ফলে, সেকেন্ডে প্রায় নমাইল বেগে সামনের দিকে আচমকা ঠিকরে গেছেন মি. মেডিগ–সেই সঙ্গে গোটা গ্রামটা, ফোদারিনগে স্বয়ং এবং আশপাশের সবকিছুই। সেকেন্ডে নমাইল বেগে ধেয়ে যাওয়া মানেটা কী, তা অবশ্যই অজানা নয় আপনার কাছে, কামান থেকে নিক্ষিপ্ত গোলারও ক্ষমতা নেই অত জোরে ছুটে যাওয়ার! আচমকা এই ভয়াবহ গতিবেগ অর্জন করে বসেছে অঘটনবাজ মানুষ দুটি আশপাশের সবকিছু সমেত। আছড়ে পড়ছে বাড়িঘরদোর, মানুষ, পশুপাখি–পড়ছে আর পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হচ্ছে! গড়িয়ে থেঁতলে পিণ্ডি পাকিয়ে নিমেষে নিমেষে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মহাপ্রলয় বলে একেই। চোখ দিয়ে দেখে মন দিয়ে বোঝবারও সময় দিচ্ছে না।

বলা বাহুল্য, পরিস্থিতিটা মোটেই মনঃপূত হয়নি মি. ফোদারিনগের। মির‍্যা ঘটাতে গিয়ে মহাপ্রলয় ঘটানো হয়ে গেছে–এই চৈতন্যটা বড়ই পীড়াদায়ক হয়েছিল সেই মুহূর্তে। রুদ্র প্রকৃতির করাল রূপ হাড়ে দুব্বো গজিয়ে দিয়েছিল বললেই চলে এবং দুচক্ষের বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাবৎ মির্যাল কাণ্ডকারখানা। ছ্যা ছ্যা! এই যদি মিরাকল হয়, তাহলে সে মিরাকলের দরকারটা কী বাপ? কালো আলকাতরার মতো অন্ধকারে দৃষ্টিও আটকে যাচ্ছে–মওকা বুঝে রাশি রাশি মেঘ দঙ্গল বেঁধে ঢেকে দিয়েছে চাঁদের মুখ। কান আর সইতে পারছে না ক্রমবর্ধমান ঝড়ের হুহুংকার। মেঘ আর ঝড়ে কুস্তি চলছে সমস্ত আকাশ জুড়ে, রণে ভঙ্গ দেওয়ার পাত্র নয় কেউই। পাঁক, জলের ছিটে আর ধুলোয় সর্বাঙ্গ ঢেকে যাচ্ছে কেন দেখবার জন্যে চোখে হাত ঢাকা দিয়ে সেইদিকে চোখ ফিরিয়েই আঁতকে উঠেছিল ফোদারিনগে।

দেখেছিল, বিশাল উঁচু একটা জলের পর্বত ভেঙে পড়তে চলেছে ঠিক তার মাথার ওপরেই!

চেঁচিয়ে উঠেছিল বিকট গলায় (যদিও প্রাকৃতিক শক্তিবর্গের সম্মিলিত হুংকারধ্বনির তুলনায় তা মনে হয়েছিল মিনমিনে ভাঙা স্বর)–মেডিগ? কোথায় আপনি?

জল প্রায় মাথার ওপর!

থাম! থেমে যাও বলছি!

থেমে গিয়েছিল ঝুলে-পড়া জলরাশি।

বজ্র আর বিদুৎকে ধমকে উঠেছিল ফোদারিনগে, দাঁড়াও-না বাপু, ইয়ারকিটা একটু বন্ধ রাখ–ভাববার সময়টা অন্তত দাও!

থেমে গিয়েছিল বজ্রপাত এবং বিদ্যুঝলক।

কী করা যায় এখন? লর্ড! করবটা কী? মেডিগ যদি থাকত ধারেকাছে!

ঠিক হ্যায়, বুদ্ধি খুলে গিয়েছিল ফোদারিনগের–এবার ভুল হবে না। ঠিক অর্ডারটাই দেওয়া যাক।

চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে, ঝোড়ো হাওয়ায় পিঠ দিয়ে মনে মনে ঝড়ের মতোই ভেবে নিয়েছিল আবার সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পন্থাটা।

বলেছিল, পেয়েছি!… চালাও! না-বলা পর্যন্ত আমার হুকুমমতো যেন আর কিছু না ঘটে!… লর্ড! আগে কেন মাথায় আসেনি বুদ্ধিটা? ঝড়ের গোঙানি ছাপিয়ে ষাঁড়ের মতো গলাবাজি শুরু করেছিল ফোদারিনগে। ভয়াবহ ওই ঝড়ের আওয়াজকে কি চেঁচানি দিয়ে টেক্কা মারা যায়? নিজের কণ্ঠস্বরই শুনতে পায়নি অঘটনবাজ মানুষটা। তা-ই বলে ভাটাও পড়েনি গলাবাজিতে–শোন হে, শোন, আমার হুকুমগুলো এবার কান খাড়া করে শুনে যাও! আর যেন ভুল হয় না এক চুলও। প্রথমেই বলে রাখি, আমার কথামতো সবকিছু ঘটে যাওয়ার পর, আমার এই অলক্ষুনে অলৌকিক ঘটনা ঘটানোর শক্তি যেন একেবারেই লোপ পায়, আর পাঁচজনের ইচ্ছাশক্তির মতোই যেন হয়ে যায় আমার ইচ্ছাশক্তি, এবং এই সমস্ত বিপজ্জনক মির্যাকল যেন পত্রপাঠ বন্ধ হয়ে যায়। জঘন্য মির্যাল–দুচক্ষের বালি। না ঘটালেই হত–আহাম্মকি যা হবার তা হয়ে গেছে, আর নয়, ঢের হয়েছে। আমার দ্বিতীয় হুকুমটা এই: মির‍্যা শুরু হওয়ার আগে যেখানে যেভাবে ছিলাম, ঠিক সেইখানে, সেইভাবে ফিরে যেতে চাই। শুধু আমি নয়–হতচ্ছাড়া পাজির পা-ঝাড়া ওই লম্ফটা উলটে যাওয়ার আগে যেখানে যে অবস্থায় যা কিছু ছিল–সমস্ত ঠিক সেই সেই জায়গায় সেই সেই অবস্থায় ফিরে যাক। বিরাট কাজ বুঝছি, কিন্তু এই তো শেষ। মাথায় ঢুকেছে? না, আর কোনও মির্যাকূলের দরকার নেই। ঠিক যা ছিল তা-ই হয়ে যাক। সবকিছুই আগের মতো হয়ে যাক। লং ড্রাগনে আধ পাঁইট গেলবার আগে যেমনটি ছিল– হুবহু সেইরকম। বাস, আর কোনও হুকুম নেই!

বলে-টলে, নরম মাটির গাদায় দশ আঙুল গেঁথে ধরে, কষে চোখ বন্ধ করে ছিল ফোদারিনগে এবং চেঁচিয়ে উঠেছিল বাজখাঁই গলায়, চালাও!

নিস্তব্ধ নিথর হয়ে গিয়েছিল বিশ্বচরাচর। থমথমে নৈঃশব্দ্য। উঁচ পড়লেও যেন ওইটুকু আওয়াজও শোনা যাবে–এমনি স্তব্ধতা। চোখ-বন্ধ অবস্থাতেই ফোদারিনগে টের পেয়েছিল, দাঁড়িয়ে আছে সে দুপায়ে ভর দিয়ে খাড়া অবস্থায়।

কানে ভেসে এসেছিল উদাসীন কণ্ঠস্বর, তা যা বলেছ!

চোখ খুলেছিল ফোদারিনগে।

দাঁড়িয়ে আছে লং ড্রাগন পানশালায়। মির্যাকল প্রসঙ্গ নিয়ে তুলকালাম কথা কাটাকাটি চলছে টোডি বিমিসের সঙ্গে। আবছা একটা অনুভূতি জাগ্রত রয়েছে মাথার মধ্যে–কী যেন চকিতে ধেয়ে গিয়েছে চেতনার ওপর দিয়ে। কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা। মির্যাকূল ঘটানোর ক্ষমতাটাই কেবল হারিয়েছে ফোদারিনগে–ফিরে পেয়েছে। আর সবকিছুই। যা ছিল, তা-ই হয়ে গেছে। এ গল্প শুরু হওয়ার সময়ে ওর মন আর স্মৃতি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল–এখনও রয়েছে সেখানেই। কাজেই যা কিছু বলা হল এইমাত্র এবং যা কিছু বলা হচ্ছে আজ পর্যন্ত, তার বিন্দুবিসর্গ ওর জানা নেই। তার চাইতেও বড় কথা, মিরাকল জিনিসটাতে আজও ওর বিশ্বাস নেই তিলমাত্র৷

তা যা বলেছ, বলে বাঁকা হেসে চেয়ে রইল টোডি বিমিস।

জিনিসটা আগে ভালো করে বোঝ, তেড়েমেড়ে বলেছিল ফোদারিনগে, মির্যাল হল এমনই সব উদ্ভট আজগুবি ব্যাপারস্যাপার, যা নিত্যনৈমিত্তিক প্রাকৃতিক ব্যাপারস্যাপারের ঠিক উলটো, ইচ্ছাশক্তির জোরে যে অঘটন ঘটানো চলে…।

অদ্ভুত অর্কিড

অদ্ভুত অর্কিড ( The Flowering of the Strange Orchid)

[‘The Flowering of the Strange Orchid’ ১৮৯৪ সালের আগস্ট মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয়। ‘Pearsons Magazine’ পত্রিকায়। ১৮৯৫ সালে লন্ডনের ‘Methuen & Co.’ থেকে প্রকাশিত ওয়েলসের প্রথম ছোটগল্পের ‘The Stolen Bacillus and Other Incidents’-তে গল্পটি স্থান পায়।]

অর্কিড এমনই একটা ফুল, যা কেনার জন্যে পাগল হতে হয়, কেনার পরেও পাগল হয়ে থাকতে হয়। একটু একটু করে পাপড়ি মেলে ধরে ফুল যতই ফুটতে থাকে, রং আর শোভা ততই মনকে মাতাল করে দেয়। নব নব আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে হয়।

এ নেশা পেয়ে বসেছিল ওয়েদারবার্নকেও। অর্কিড় জমানোর বাতিক তাকে নিত্যনতুন উত্তেজনার খোরাক জুগিয়ে গেছে। সারাজীবনটাই তার উত্তেজনাবিহীন। চৌকস মানুষ মোটেই নয়। লাজুক। নিঃসঙ্গ। পয়সাকড়ি যা আছে, তাতে প্রয়োজন মিটে যায়, কিন্তু এমন উদ্যম নেই যে, চাকরিবাকরি জুটিয়ে নেয়। ডাকটিকিট জমানো, হোরেস অনুবাদ, বাঁধানো বই কেনা, ডায়াটমের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার–এইসব করেই সময় কাটালে পারত। কিন্তু পেয়ে বসল অর্কিড় জমানোর বাতিকে। ছোট্ট একটা হট-হাউস বানিয়ে নিয়েছে নিজেই। কাচের ছাদওয়ালা উষ্ণ গৃহ। গাছপালা পরিবর্ধন আর ফল পাকানোর মোক্ষম ব্যবস্থা।

সকালবেলা কফি খেতে খেতে গল্প হচ্ছে গৃহকত্রীর সঙ্গে। মেয়েটি তার খুড়তুতো বোনও বটে। স্বভাবে ভাইয়ের ঠিক বিপরীত। ঘরসংসার নিয়ে দিব্যি আছে। খামকা উত্তেজনার পেছনে দৌড়াতে চায় না।

কিন্তু গজগজ করে চলেছে ওয়েদারবার্ন। সারাজীবনটাই তার কেমন ভিজে-ভিজে। অন্য লোকদের জীবনে কত রকমের বৈচিত্র, কত অ্যাডভেঞ্চার, কত বিপদ ঘটে। কিন্তু তার জীবনটা ছেলেবেলা থেকেই বড় একঘেয়ে, শৈশবে পড়তে হয়নি প্রেমে–ফলে, বিয়ে থা-ই হল না। অথচ ওই যে হার্ভে–সোমবারে কুড়িয়ে পেল ছপেনি মুদ্রা, বুধবারে টলতে লাগল সমস্ত মুরগিছানা, শুক্রবারে অস্ট্রেলিয়া থেকে এল খুড়তুতো ভাই, শনিবারে ভাঙল গোড়ালি! অহো! অহো! উত্তেজনার এহেন ঘূর্ণিঝড়ে ওয়েদারবার্নকে কখনও পড়তে হয়নি। এর চাইতে পরিতাপের বিষয় আর হয় কি? তবে হ্যাঁ, কফির দ্বিতীয় কাপে ধীরেসুস্থে চুমুক দিতে দিতে বলেছিল ওয়েদারবার্ন–আজ একটা নতুন কিছু ঘটবে মনে হচ্ছে। কেন না, আজ সে যাচ্ছে আন্দামান আর ইন্ডিজ থেকে আনা কিছু উদ্ভিদ কিনতে।

যার কথা সেদিন তুমি বলছিলে? প্রশান্ত কণ্ঠে বলেছিল বোন।

হ্যাঁ। তাই অর্কিড বেচে দিচ্ছে পিটার দোকানদার।

অর্কিড জমানোর বিষম বাতিক ছিল বুঝি?

সাংঘাতিক। অথচ বয়সে আমার চাইতে তেইশ বছরের ছোট। মোটে ছত্রিশ, এই বয়সের কতরকম উত্তেজনা যে পেয়েছে, তার হিসেব নেই। মারা গেল উত্তেজনা কুড়াতে কুড়াতেই। বিয়ে করেছিল দুবার, বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছিল একবার। ম্যালেরিয়ায় ভুগিয়েছিল চারবার। ঊরুর হাড় ভেঙেছিল একবার। একবার একটা মালয়বাসীকে খুন করেছিল নিজের হাতে, নিজেই একবার জখম হয়েছিল বিষাক্ত তিরে। শেষকালে মারা গেল জঙ্গলের জোঁকের পাল্লায় পড়ে–শুধু এই জোঁকের ব্যাপারটা ছাড়া বাদবাকি সবই দারুণ ইন্টারেস্টিং, তা-ই না?

আমার কাছে নয়, বলেছিল বোন।

তা অবশ্য নয়। আটটা তেইশ বাজল। পৌনে বারোটায় ট্রেন। চললাম।

বাড়ি ফিরল ওয়েদারবার্ন বিষম উত্তেজনা নিয়ে। না বুঝেই কিনে ফেলেছে কিছু অর্কিড, উত্তেজনা সেই কারণেই। অজ্ঞাত অর্কিডের রহস্য বেশ মাতিয়ে তুলেছে তাকে।

ডিনার খেতে খেতে বোনকে বলছিল সেই কথাই। নিশ্চয় আশ্চর্য কিছু এর পর থেকে ঘটবেই। আজ থেকেই যে তার শুরু, সকালেই তা টের পেয়েছিল। কয়েকটা অর্কিডের নাম সে জানে। কিন্তু এই যে এই অর্কিডটা, প্যালিনোফিস হতে পারে, না-ও পারে, এক্কেবারে নতুন প্রজাতি অথবা একটা মহাজাতি হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু সেই। ব্যাটেন। বেচারা নাকি এই অর্কিডটাই সংগ্রহ করার পর মারা গিয়েছিল।

বোন বললে গম্ভীর মুখে, জঘন্য দেখতে–গা শিরশির করছে। মা গো। কী কদাকার চেহারা!

ভাই বললে সঙ্গে সঙ্গে, দূর! আমার চোখে ওর কোনও চেহারাই ধরা পড়ছে না।

গা থেকে ওই যে কী সব বেরিয়ে রয়েছে–কী বিশ্রী! কী বিশ্রী!

কালকেই তো টবে পুঁতে দেব।

মড়ার মতো মটকা মেরে রয়েছে–ঠিক যেন একটা মাকড়সা।

মুচকি হেসে ঘাড় কাত করে শেকড় পর্যবেক্ষণ করতে থাকে ওয়েদারবার্ন।

বলে, আহামরি দেখতে নয় মানছি। কিন্তু শুকনো চেহারা দেখে কিছুই আঁচ করা যায় না। দুদিন পরে ওই থেকেই এমন অর্কিড গজিয়ে উঠবে–তাক লেগে যাবে। তখন তুমিই বলবে–আহা রে, কী সুন্দর! কী সুন্দর! ব্যাটেন বেচারা মরে পড়েছিল ঝোপের মধ্যে এই অর্কিডের ওপরেই–আন্দামান জায়গাটা অতি যাচ্ছেতাই। ঝোপঝাড়ের মধ্যে কতরকম মৃত্যু যে লুকিয়ে থাকে, কেউ জানে না। রক্তচোষা জোঁক শরীর থেকে নাকি সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছিল। এই অর্কিড খুঁজতে গিয়েই ঝোপে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল নিশ্চয়–তারপর পড়েছে জোঁকদের পাল্লায়। দিনকয়েক নাকি জ্বরে বেহুশ হয়ে ছিল।

শুনে আরও কুৎসিত লাগছে তোমার অর্কিডকে।

বিজ্ঞের মতো গম্ভীর হয়ে ওয়েদারবার্ন বললে, মেয়েরা কেঁদে ভাসিয়ে দিলেও পুরুষরা নিজেদের কাজ করে যাবেই–কেউ আটকাতে পারবে না।

ঝোপের মধ্যে ম্যালেরিয়া জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকার মধ্যে কোনও বীরত্ব নেই। বিশেষ করে আন্দামানে–যেখানকার ভয়ানক জংলিরা সেবা করতেও জানে না। সময়মতো কুইনাইন আর ক্লোরোডাইনও জোটে না!

মানছি। কিন্তু ওইরকম কষ্টভোগই কিছু মানুষের খুব ভালো লাগে, বলে ছিল ওয়েদারবার্ন নাছোড়বান্দার মতো। আন্দামানে ব্যাটেন কিন্তু যে জংলিদের সঙ্গে নিয়ে অভিযানে বেরিয়েছিল, তারা কিছুটা সভ্যভব্য ছিল। তাই ব্যাটেনের অতিকষ্টে সংগ্রহ-করা কোনও অর্কিডই ফেলে দেয়নি–যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। তারপর এসে পৌঁছাল ওর এক পক্ষীবিজ্ঞানী বন্ধু, আন্দামানের গভীর জঙ্গল থেকে। ততদিনে সব কটা অর্কিডই শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে। শুকনো বলেই কিন্তু আমার আরও ইন্টারেস্টিং লাগছে।

আমার লাগছে ডিজগাস্টিং, গা-পাক দিচ্ছে দেখলেই। গায়ে যেন ম্যালেরিয়া লেগে রয়েছে এখনও। পাশেই যেন একটা লাশ পড়ে রয়েছে–দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি। খাওয়ার দফারফা হয়ে গেল আমার–এ জিনিসকে সামনে রেখে খাওয়া যায়?

শুকনো অর্কিডগুলো টেবিলের ফরসা কাপড়ের ওপর রেখে এতক্ষণ তন্ময় হয়ে চেয়ে ছিল ওয়েদারবান। বোনের বিতৃষ্ণা দেখে তুলে নিয়ে গিয়ে রাখল জানলার গোবরাটে। ফিরে এসে বসল টেবিলে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল দূরের বিশুদ্ধ কদাকার আকারহীন পিণ্ডের মতো অর্কিডগুচ্ছের পানে।

পরের দিন বিষম ব্যস্ত হল অর্কিড় পরিচর্যায়। কাঠকয়লা, শেওলা এবং আরও অনেক উপাদান নিয়ে বাষ্পচ্ছন্ন হট-হাউসে তন্ময় হয়ে রইল অর্কিডের সেবায়। অর্কিডপ্রেমিকরা জানে, কতরকম রহস্যজনক পন্থায় তরতাজা করে তুলতে হয় বিচিত্র সৌন্দর্যের আকর অর্কিড চারাদের। ওয়েদারবানও শিখেছে অনেক কিছু। সন্ধেবেলা বন্ধুদের ডেকে এনে সোৎসাহে দেখাল মৃতপ্রায় শুষ্ক অর্কিড সংগ্রহ। বারবার বলে গেল একই কথা–অচিরেই এই মড়াদের সে জাগাবে–তখন চিত্তচাঞ্চল্যকর অনেক ঘটনা নিশ্চয় ঘটবে–প্রত্যাশা তার বিফলে যাবে না।

কিন্তু এত সেবাশুশ্রূষা সত্ত্বেও মরেই রইল বেশ কয়েকটা ভান্দাস আর দেনদ্রোবিয়াম। তারপরেই অবশ্য প্রাণের সঞ্চার দেখা গেল অদ্ভুত অর্কিডের মধ্যে। জ্যাম তৈরি নিয়ে ব্যস্ত বোনকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এল আশ্চর্য আবিষ্কারটা দেখানোর জন্য।

বললে, ওই দেখ কুঁড়ি। দুদিন পরেই দেখবে কুঁড়ির জায়গায় গোছা গোছা পাতা। আর ওই যে খুদে খুদে কী সব বেরিয়ে রয়েছে, ওগুলো শেকড়, বাতাসের মধ্যে মেলে-ধরা শেকড়।

বোন বললে, জঘন্য। ঠিক যেন সাদা সাদা আঙুল। আমার কিন্তু মোটেই ভালো লাগছে না।

কেন লাগছে না?

তা তো বলতে পারব না। শুধু মনে হচ্ছে, আঙুলগুলো বেরিয়ে আসছে তোমাকে ক্যাঁক করে ধরবার জন্যে।

বলিহারি যাই তোমার মনে-হওয়াকে।

আমার পছন্দ-অপছন্দের ওপর খবরদারি করার কোনও ক্ষমতা আমার নেই, যা মনে হল তা-ই বললাম।

তবে হ্যাঁ, এরকম বাতাসে মেলে-ধরা শেকড়ওয়ালা অর্কিড জীবনে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না, স্বীকার করে ওয়েদারবার্ন। ডগাগুলো কীরকম চ্যাপটা দেখেছ?

শিউরে উঠে সরে যায় বোন, মোটেই ভালো লাগছে না আমার। কেন জানি না বারবার একটা মড়া মানুষের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

কী আশ্চর্য! ঠিক এই অর্কিড়টার ওপরেই ব্যাটনের লাশ পড়েছিল, তা জানছ কী করে? অন্য অর্কিডও তো হতে পারে?

তুমিই বলেছিলে।

আমি আন্দাজে বলেছিলাম।

যা-ই বল, ওই কদাকার চেহারা দেখলেই আমার গা শিরশির করছে।

আহত হল ওয়েদারবার্ন। প্রাণপ্রিয় অর্কিডকে এত ঘেন্না করার কোনও মানে হয়? তা সত্ত্বেও কিন্তু ফুরসত পেলেই অর্কিড সমাচার শুনিয়ে গেল বোনকে, বিশেষ করে অতি কদাকার বিবমিষা-জাগানো অদ্ভুত অর্কিডটার কোনও খবরই বাদ দিলে না।

একদিন বললে, অনেক বিস্ময়, অনেক চমক, অনেক অদ্ভুত কাণ্ড জঠরে নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে এই অর্কিডরা। ডারউইন অর্কিড় নিয়ে গবেষণা করে বলেছিলেন, মামুলি অর্কিড ফল এমনভাবে গড়া, যাতে এক চারা থেকে আরেক চারায় পরাগরেণু বয়ে নিয়ে। যেতে পারে মথ। কিছু অর্কিডের ক্ষেত্রে অবশ্য তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। গর্ভাধান এভাবে সম্ভব হয় না। যেমন ধর, সাইপ্রিসোডিয়াম। গর্ভাধান ঘটানোর মতো কোনও পোকার সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি। কয়েকটার মধ্যে তো বীজের চিহ্নও দেখা যায়নি। তা সত্ত্বেও তারা বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে গেছে বহাল তবিয়তে।

কীভাবে?

সরু নল আর শুড় দিয়ে। কিন্তু ধাঁধাটা অন্য জায়গায়। ফুলগুলো তাহলে ফোটে কেন?

তোমার জানা নেই?

উঁহু। কে জানে, আমার এই অর্কিড়টাও হয়তো অসাধারণ ঠিক সেইভাবেই। ডারউইনের মতো আমারও সাধ যায় গবেষণা করার। এদ্দিন সময় পাইনি–একটা-না একটা বাগড়া পড়েছে। পাতা মেলে ধরা কিন্তু আরম্ভ হয়ে গেছে–এসো-না, দেখে যাও।

বয়ে গেছে বোনের। ঘাড় বেঁকিয়ে সরাসরি জানিয়ে দিলে, অদ্ভুত অর্কিডকে নিয়ে খামকা সময় নষ্ট করতে সে রাজি নয়। কিলবিলে শুড়গুলো দেখে ইস্তক দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে গেছে তার। এর মধ্যেই প্রতিটা শুড় ফুটখানেক লম্বা হয়ে গেছে দেখে এসেছে। দেখেই লোমটোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল। বীভৎস প্রাণীবিশেষের ভয়াবহ শুড়ের কথাই মনে হয়েছে বারবার। স্বপ্নে দেখেছে, অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে প্রতিটা শুড় বেড়ে উঠে লকলক করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। অতএব, ওই বিদঘুটে গাছকে ইহজীবনে আর দেখতে সে রাজি নয়।

কী আর করা যায়। বেচারি ওয়েদারবার্ন একা একাই তারিফ করে গেল অদ্ভুত অর্কিডের আশ্চর্য শোভার। চকচকে গাঢ় সবুজের ওপর ঘন লালের ছিটে আর ডোরা এমনভাবে নেমে এসেছে তলার দিকে যে, অবাক না হয়ে নাকি থাকা যায় না। এরকম বাহারে পাতা জীবনে সে দেখেনি। গাছটাকে রেখেছিল একটা নিচু বেঞ্চির ওপর। কাছেই। রয়েছে একটা থার্মোমিটার। টবের গা ঘেঁষে একটা জলের কল। টপটপ করে সমানে জল পড়ছে গরম জলের পাইপে–বাষ্প ভরিয়ে রেখেছে বদ্ধ বাতাসকে। প্রতিটা অপরাহু এহেন পরিবেশে কাটায় ওয়েদারবার্ন–অদ্ভুত অর্কিডের আশ্চর্য ফুল ফোঁটা নিয়ে কত বিচিত্র সম্ভাবনার কথাই না ভাবে আপন মনে।

অবশেষে একদিন স্বপ্ন সফল হল তার–ফুল ধরল গাছে। কাচের ঘরে ঢুকেই টের পেয়েছিল, প্রত্যাশা পূর্ণ হয়েছে এতদিনে। প্যালেনিফিস লোয়ি অর্কিড কোণ জুড়ে থাকায় প্রাণপ্রিয় অর্কিডকে অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আশ্চর্য একটা সুগন্ধ ভাসছে বাতাসে। অত্যন্ত কড়া অথচ মিষ্টি একটা সুবাস। ছোট্ট, বহু অর্কিড বোঝাই সবুজ ঘরের সব গন্ধকে ছাপিয়ে উঠেছে সেই সুগন্ধ।

তৎক্ষণাৎ হনহন করে প্রায় ছুটে গিয়েছিল অদ্ভুত অর্কিডের দিকে। চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল তিন-তিনটে বিরাট ফুল দেখে। এত গন্ধ বেরচ্ছে এই তিনটে ফুল থেকেই। তনু মন যেন অবশ করে আনছে মাতাল-করা সেই সুবাস। থ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল টবের সামনে দুই চোখে বিপুল প্রশংসা নিয়ে।

সত্যিই অপূর্ব। সাদা ফুল। পাপড়িগুলোয় সোনালি-কমলা ডোরা। তলার দিকে ছোট পাতা কুণ্ডলী পাকিয়ে সুক্ষ্ম জটিল খোঁচার মতো ঠেলে রয়েছে বাইরের দিকে। অত্যাশ্চর্য নীলচে-বেগুনি রঙে এসে মিশেছে সোনা-সোনা রং। দেখেই বোঝে ওয়েদারবার্ন বাস্তবিকই এ অর্কিড একেবারেই নতুন ধরনের একটা মহাজাতি। আর সে কী সুবাস! অসহ্য! গুমট বাতাসে আতীব্র সেই সুগন্ধ মাথা ঘুরিয়ে দেয় ওয়েদারবার্নের। তিন-তিনটে ফুল যেন দুলে দুলে ওঠে চোখের সামনে।

থার্মোমিটারটা আছে কি না দেখবার জন্যে এক পা এগতেই আচমকা যেন মাটি দুলে উঠেছিল পায়ের তলায়। পুরো সবুজ ঘরটাই যেন চরকিপাক দিতে শুরু করেছিল চোখের সামনে। ইট-বাঁধানো মেঝের প্রতিটা ইট যেন তাথই তাথই নাচ আরম্ভ করে দিয়েছিল। আবিল দৃষ্টিকে আবিলতর করে দিয়ে। পরক্ষণেই সাদা ফুল, সবুজ পাতা, গোটা সবুজ ঘরটা বোঁ করে ডিগবাজি খেয়ে লাফিয়ে উঠেছিল শূন্যে–জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল অর্কিডপ্রেমিক ওয়েদারবার্ন।

বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ চা তৈরি করে মিনিট দশেক হাপিত্যেশ করে বসে থাকার পরেও ভাইকে না আসতে দেখে গজগজ করতে করতে সবুজ ঘরে এসেছিল বোন।

দরজা খুলে ডেকেছিল ভাইকে, জবাব পায়নি। বাতাস ভারী হয়েছে, লক্ষ করেছিল। নাকে ভেসে এসেছিল কড়া সুগন্ধ। তারপরেই চোখে পড়েছিল, গরম জলের পাইপের ফাঁকে কী যেন একটা পড়ে রয়েছে ইটের ওপর। মিনিটখানেক নড়তে পারেনি বোন। অদ্ভুত অর্কিডের তলায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ওয়েদারবার্ন। শুড়ের মতো বাতাসে মেলে ধরা শেকড়গুলো এখন আর হাওয়ায় দুলছে না–দল বেঁধে একগোছা দড়ির মতো সেঁটে রয়েছে ভাইয়ের থুতনি, ঘাড় আর হাতের ওপর। প্রতিটা শুড়ের ডগা চেপে বসে রয়েছে চামড়ায়।

প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি বোন। তারপরেই দেখেছিল, পুষ্ট একটা গুঁড়ের তলা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্তের সরু ধারা নামছে গাল বেয়ে।

অস্ফুট চিৎকার করে দৌড়ে গিয়েছিল বোন। জোঁকের মতো রক্তচোষা শেকড়গুলোর খপ্পর থেকে টেনেহিঁচড়ে মুক্ত করতে চেয়েছিল ভাইকে। ছিঁড়ে ফেলেছিল দুটো শুড়। টপটপ করে রক্ত ঝরে পড়েছিল শুড়ের ভেতরকার থলি থেকে।

তারপরেই উৎকট হয়ে উঠেছিল কড়া সুগন্ধ। সে কী গন্ধ! সুবাস যে এত মিষ্টি অথচ এমন সংজ্ঞালোপকারী হয়–তা জানা ছিল না বোনের। বেশ বুঝেছিল, তার চৈতন্য কেড়ে নিচ্ছে ওই আশ্চর্য মিষ্টি ভয়ানক গন্ধ। মাথা ঘুরে উঠেছিল বনবন করে। আবছাভাবে দেখেছিল, রাশি রাশি শুড় পরম লোভীর মতো ভাইয়ের ওপর সেঁটে বসে রয়েছে তো রয়েছেই–শিথিল হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাজা উষ্ণ রুধির নিশ্চয় সেকেন্ডে সেকেন্ডে চালান হয়ে যাচ্ছে জীবিত দেহ থেকে কদাকার বিকট ওই উদ্ভিদের মধ্যে। এ অবস্থায় জ্ঞান হারালে তো চলবে না–কিছুতেই না। ভাইকে ফেলে রেখেই দরজা। দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এসে খোলা হাওয়ায় হাঁপাতে হাঁপাতে ভেবে নিয়েছিল, এরপর কী করতে হবে। বাইরে থেকে একটা ফুলের টব তুলে নিয়ে আছাড় মেরেছিল কাচের জানলায়। ফের ঢুকেছিল সবুজ ঘরে। পাগলের মতো নিস্পন্দ ওয়েদারবার্নের দেহ ধরে টান মারতেই হুড়মুড় করে বেঞ্চি থেকে উঠে পড়েছিল অদ্ভুত অর্কিডের টব। চুরমার হয়ে গেলেও টবের ভয়াবহ উদ্ভিদটার একটা শুড়ও আলগা হয়নি ভাইয়ের থুতনি, ঘাড়, গাল থেকে। মরণ-কামড় একেই বলে। ছিনেজোঁক যেন। ক্ষিপ্তের মতো শেকড় আর টব সমেত ভাইকে টেনে এনেছিল বাইরে।

তারপর একটা একটা করে রক্তচোষা শেকড় ছিঁড়েছিল গা থেকে। মিনিটখানেকের মধ্যেই শেকড়মুক্ত দেহটাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মূর্তিমান বিভীষিকার নাগালের বাইরে।

দেখেছিল, ডজনখানেক চাকা চাকা দগদগে ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে ভাইয়ের থুতনি, ঘাড় আর গলা বেয়ে। সমস্ত দেহটা যেন রক্তশূন্য–সাদা! ঠিক এই সময়ে ঠিকে কাজের লোকটা বাগানে ঢুকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ভাঙা কাচ আর ওয়েদারবানের রক্ত মাখা অসাড় দেহ দেখে। তাকে দিয়েই জল আনিয়েছিল বোন। ফোঁপাতে ফোঁপাতে রক্ত মুছে দিয়েছিল ভাইয়ের মুখ থেকে। ব্যাপার কী? চোখ খুলেই ফের বন্ধ করে ফেলে ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিল ওয়েদারবার্ন।

লোকটাকে ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছিল বোন। ইতিমধ্যে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল ভাই–একটু পরেই ফের জ্ঞান ফিরে পেয়ে চি-চি করে জানতে চেয়েছিল, ব্যাপারটা কী? এভাবে বাগানের মধ্যে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে কেন? বোনই বা কাঁদছে কেন?

হট-হাউসে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে তুমি।

অর্কিডটা?

তার ব্যবস্থা আমি করছি।

ডাক্তার এসে ওয়েদারবার্নকে নিয়ে গেল ওপরতলায়। ব্র্যান্ডি আর মাংসের স্যুপ খাইয়ে তাকে চাঙ্গা করার পর বোন এল হট-হাউসে–সঙ্গে নিয়ে এল ডাক্তারকে।

ভাঙা জানলা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে কড়া এবং ভয়ানক মিষ্টি সেই গন্ধকে প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছে বললেই চলে। ছেঁড়া শেকড়গুলো যেখানে যেখানে পড়ে, সেইসব জায়গায় ইটের ওপর জমাট কালো রক্ত। বেঞ্চি থেকে টব উলটে পড়ায় ডাঁটি ভেঙে গেছে অর্কিড চারার। নেতিয়ে পড়েছে ফুল তিনটে। বাদামী হয়ে আসছে পাপড়ির কিনারা। সেইদিকে এক পা এগিয়েছিল ডাক্তার। কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল একটা বাতাসে মেলে-ধরা শেকড়কে তখনও থিরথির করে কাঁপতে দেখে।

পরের দিন ভোরবেলা দেখা গেল, মেঝের ওপরেই পড়ে আছে অদ্ভুত অর্কিড। বিবর্ণ কালচে। পচন ধরেছে। হাওয়ায় দমাদম করে আছড়ে পড়ছে দরজা। শিউরে শিউরে উঠছে ওয়েদারবার্নের বিপুল অর্কিড-সংগ্রহ।

আর ওয়েদারবান? অতগুলো ক্ষতমুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় কাহিল হয়ে পড়েছিল খুবই-তার বেশি কিছু নয়। বহাল তবিয়তে শুয়ে ছিল ওপরতলায়। মনে খুব ফুর্তি–অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চারের প্রসাদে বুক দশ হাত!

অন্ধ যে দেশে সকলেই

অন্ধ যে দেশে সকলেই ( The Country of the Blind )

[‘The Country of the Blind’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Strand Magazine’ পত্রিকায় এপ্রিল ১৯০৪ সালে। পরে ‘Thomas Nelson and Sons’ থেকে ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘The Country of the Blind and Other Stories’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। পরে ওয়েলস গল্পটি মার্জনা করেন এবং ১৯৩৯ সালে নতুন করে ‘Golden Cockerel Press’ থেকে বের করেন।]

রহস্যময় পার্বত্য উপত্যকায় আছে অন্ধদের দেশ। আশ্চর্য সেই দেশে অন্ধ প্রত্যেকেই। চক্ষুম্মানের ঠাঁই নেই সেখানে। লোমহর্ষক এই কাহিনি শোনা গিয়েছিল একজনেরই মখে, দৈবাৎ পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে পৌঁছেছিল সেই দেশে, চক্ষুরত্ন সম্বল করে পালিয়ে এসেছিল কোনওমতে।

অনেক… অনেক দূরের পথ সেই পার্বত্য উপত্যকা। শিমবোরাজো থেকে সাড়ে তিনশো মাইলেরও বেশি, কোটোপাক্সির তুষার-ছাওয়া অঞ্চল থেকে শখানেক মাইল তো বটেই। ইকুয়েডর্স অ্যান্ডিজের ধু ধু ঊষর অঞ্চলে রয়েছে সেই অবিশ্বাস্য দেশ–যে দেশে অন্ধ সকলেই।

বহু বছর আগে কিন্তু পাহাড়-পর্বত টপকে, গিরিবর্ক্সের মধ্যে দিয়ে যাওয়া যেত সেই উপত্যকায়। অত্যাচারী স্পেনীয় শাসকের খপ্পর থেকে পালিয়ে কয়েকটি পেরুভিয়ান দোআঁশলা পরিবার পৌঁছেছিল সেখানে।

তারপরেই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় শুরু হল মিনডোবাম্বায়, সতেরো দিন নিশীথ রজনিতে আবৃত রইল কুইটো, জল ফুটতে লাগল আগুয়াচিতে, গুয়ায়াকুইল দিয়ে ভেসে গেল অগুনতি মরা মাছ। প্রশান্ত মহাসাগরের পাহাড়ি ঢাল বরাবর ধস, অকস্মাৎ জলপ্লাবন, আরাউকা শিখরের ধসন বজ্ৰধনির মধ্যে দিয়ে চিরতরে রুদ্ধ করে দিলে অন্ধদের দেশে প্রবেশের যাবতীয় পথ। দুনিয়া যখন এইভাবে প্রকম্পিত, তার আগেই একজন… শুধু একজন ছিটকে এসেছিল বহির্জগতে… রহস্যময় পার্বত্য উপত্যকায় থেকে গিয়েছিল তার স্ত্রী আর ছেলে। বাইরের দুনিয়ায় নতুন করে সে জীবন শুরু করে। কিন্তু স্বাস্থ্যভঙ্গ ঘটে অচিরেই, অন্ধত্ব ছিনিয়ে নেয় চোখের দৃষ্টি, খনি অঞ্চলে অসীম শাস্তিভোগের পর একদিন রওনা হয় পরলোকের পথে। কিন্তু যে কাহিনি সে শুনিয়ে গিয়েছিল, তা আজও কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে অ্যান্ডিজের করডিলারাসে।

দক্ষিণ আমেরিকায় উটের মতো একরকম জন্তু দেখা যায়। কিন্তু উটের চাইতে ছোট এবং পিঠে কুঁজ নেই। নাম, লাম্যা। শৈশবে এই লামার পিঠে মালপত্র সমেত তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সুদুরের সেই উপত্যকায়। নয়নাভিরাম সেই উপত্যকায় মানুষ যা পেলে সুখী হয়, শান্তি পায়, তার সবই আছে। আছে গাছে গাছে ফল, সুপেয় জল, কৃষিক্ষেত্র, মনোরম আবহাওয়া, উর্বর বাদামি মৃত্তিকা, তুষার পর্বতের গায়ে নিবিড় অরণ্য। তিনদিকে ধূসর সবুজ পাহাড় উঠে গেছে যেন আকাশ অবধি-চিরতুষারে ঢাকা তাদের কিরীট। হিমবাহ নদী কিন্তু উপত্যকায় না এসে বয়ে যায় পাহাড়ের অন্যদিকের ঢাল বরাবর। মাঝে মাঝে বরফের চাঙড় খসে পড়ে উপত্যকায়। বৃষ্টি হয় না সেখানে, তুষারপাতও ঘটে না। স্থির পাহাড়ি ঝরনার জলে বারো মাস সবুজ থাকে চাষের জমি, প্রান্তর, তৃণভূমি। মানুষজনের কোনও চাহিদা অপূরণ থাকে না সেখানে, সুখী সেখানকার প্রতিটি পশুপক্ষী।

কিন্তু অতৃপ্তি ছিল কেবল একটি ব্যাপারে। দেবতার উপাসনা মন্দির ছিল না একটিও। তাই যখন অব্যাখ্যাত সংক্রমণে দৃষ্টিশক্তি হারাতে লাগল একে একে অনেকেই, এমনকী দৃষ্টিহীন হয়ে ভূমিষ্ঠ হল বহু নবজাতক, তখন একজন–শুধু একজনই–মন্দির প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে ছিটকে এসেছিল অভিশপ্ত অথচ অপরূপ সেই উপত্যকা থেকে। সে সময়ে সংক্রমণ কী বস্তু তা কেউ বুঝত না। দৃষ্টিহীনতার কারণ নিশ্চয় দেবতার অভিশাপ বদ্ধমূল এই ধারণা নিয়ে সে চলে এসেছিল একখণ্ড রুপোর বাট পোশাকের ভেতরে লুকিয়ে। কোথায় পেয়েছিল এই রজতখণ্ড, তা কিন্তু অনভিজ্ঞ মিথুকের মতো বর্ণনা করতে গিয়ে কৌতূহলই জাগ্রত করেছিল প্রত্যেকের অন্তরে। মূল্যবান এই ধাতু নিশ্চয় অঢেল পাওয়া যায় সেখানে কিন্তু মুদ্রার অথবা অলংকারের প্রয়োজন নেই বলে হেলায় পড়ে থাকে। ক্ষীণদৃষ্টি, রৌদ্রদগ্ধ, শীর্ণকায় যুবকটি সাগ্রহে পুরুতদের কাছে আবেদন জানিয়েছিল, দেবতার অধিষ্ঠান যেন ঘটে অভিশপ্ত উপত্যকায়। নইলে যে অন্ধ হয়ে যাবে সকলেই।

কিংবদন্তির শুরু সেই থেকেই। বহু দূরে… সুদূর উপত্যকায় বসবাস করে অন্ধ মানুষের একটা প্রজাতি।

আজও শোনা যায় সেই কিংবদন্তি।

পর্বতবেষ্টিত বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, মুষ্টিমেয় মানুষগুলির মধ্যে কিন্তু দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল বিচিত্র ব্যাধি। প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রবীণরা, ক্ষীণদৃষ্টি হয়ে এসেছিল নবীনরা, দৃষ্টিহীন হয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল শিশুরা।

জীবনের ধারা কিন্তু বয়ে গিয়েছিল নিরবচ্ছিন্ন গতিতে। যেখানে কাঁটাঝোপ নেই, কীটপতঙ্গের উপদ্রব নেই, হিংস্র শ্বাপদের হামলা নেই–যেখানে শান্ত-প্রকৃতি লাম্যা বিচরণ করে দলে দলে, সমীরণ বয় মৃদুমন্দ বেগে, ঝরনা ঝরে পড়ে অবিরাম, অন্ধ হয়েও সেখানে কারও জীবনে যতি পড়েনি। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে হতে লোপ পেয়েছিল এত ধীরে যে, ক্ষতিটাকে ক্ষতি বলে কেউ মনেও করেনি। অল্প দৃষ্টি নিয়েও সর্বত্র বিচরণ করে নখদর্পণে রেখেছিল পুরো উপত্যকাকে। তারপর যখন একেবারেই লোপ পেল দৃষ্টিশক্তি, বহাল তবিয়তে টিকে গেল পুরো প্রজাতিটা। পাথরের উনুনে আগুনও জ্বালাত চোখ না থাকা সত্ত্বেও। শিক্ষাদীক্ষা ছিল না বললেই চলে। অক্ষরপরিচয় ঘটেনি কোনওদিনই। স্পেনীয় সভ্যতার ছিটেফোঁটা, সুপ্রাচীন পেরু সংস্কৃতি আর লুপ্ত দর্শন–এই ছিল তাদের একমাত্র কৃষ্টি। অতিবাহিত হয়েছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম। বিস্মৃত হয়েছিল অনেক কিছুই, উদ্ভাবনও করেছিল অনেক কিছু অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল বহির্জগতের বর্ণোজ্জ্বল সংস্কৃতি। কিন্তু নিটোল ছিল স্বাস্থ্য, অফুরন্ত ছিল দৈহিক শক্তি হারিয়েছিল কেবল চক্ষু প্রত্যঙ্গ। পুরানো দিনের কাহিনি মুছে গিয়েছিল এক প্রজন্মে। এইভাবেই কেটে গিয়েছিল পরপর পনেরোটি প্রজন্ম–রজতখণ্ড বুকে নিয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ অন্বেষণে উপত্যকার বাইরে গিয়েছিল যে যুবকটি, সে কিন্তু আর ফিরে আসেনি। দীর্ঘ পনেরোটি প্রজন্মের পর তার কথাও কারও স্মৃতিপটে বিরাজমান থাকার কথা নয়। তারপর আশ্চর্য সেই উপত্যকায় বাইরের দুনিয়া থেকে অকস্মাৎ আবির্ভূত হল যে মানুষটি, নাম তার নানেজ। এ কাহিনি শুনেছি তারই মুখে।

কুইটোর কাছে একটা গ্রামনিবাসী পর্বতারোহী সে। বই-পড়া বিদ্যে ছাড়াও সমুদ্রপথে দেখেছে এই পৃথিবীটাকে। ইংরেজদের একটি পর্বত অভিযাত্রীদলে তার ঠাই হয়েছিল তিনজন সুইস পথপ্রদর্শক অসুস্থ হয়ে পড়ায়। ইকুয়েডরে এসেছিল তারা পর্বতারোহণের অভিপ্রায়ে। বিশেষ একটি উচ্চশিখর জয় করতে গিয়ে একদিন নিখোঁজ হয় নানেজ। তুষার-ছাওয়া শিখরের কিছু নিচেই তাঁবু পেতে অনেক হাঁকডাক এবং বাঁশি বাজিয়েও আর তার সাড়া পাওয়া যায়নি। ঘটনার বিবরণ প্রায় বারোবার প্রকাশিত হয়েছে। পয়েন্টারের বিবরণটাই সবচেয়ে নাটকীয় এবং বিশদ।

বিনিদ্র রজনি যাপনের পর সকালবেলা তারা দেখেছিল পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার বহু চিহ্ন। নিশ্চয় আর্ত-চিৎকার করেছিল নানেজ গড়িয়ে পড়ার সময়। কিন্তু কেউ তা শোনেনি –এটাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার। অথবা হয়তো গলা ফাটিয়ে চেঁচাবার সুযোগও পায়নি। পা পিছলে পড়েছে পাহাড়ের পূর্বদিকে–যেদিকটার কোনও খবরই রাখে না অভিযাত্রীরা। তুষারের বুক কেটে লাঙল চষার মতো পতনচিহ্ন অতিশয় সুস্পষ্ট, বুক-কাঁপানো খাড়াই ঢাল বেয়ে সটান গড়িয়ে গেছে বলেই চেঁচাবার ফুরসতও পায়নি। তারপর আর কিছুই চোখে পড়েনি। অনেক, অনেক নিচে দেখা গেছে কেবল সারি সারি মহীরুহ। অস্পষ্ট ধোঁয়ার মতো, একটা বদ্ধ উপত্যকা ঘিরে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে এক নিবিড় অরণ্য, অন্ধদের হারিয়ে-যাওয়া দেশ। অভিযাত্রীরা কিন্তু জানত না, এই সেই কিংবদন্তির দেশ, অন্ধদের উপত্যকা। এরকম উপত্যকা আরও রয়েছে দুর্গম এই পাহাড়ি অঞ্চলে। দুর্ঘটনাটা কিন্তু তাদের নার্ভাস করে দেয়। বিকেলের দিকে অভিযান মুলতুবি রেখে নেমে আসে পাহাড় থেকে। তারপরেই যুদ্ধে যেতে হয় পয়েন্টারকে। আজও পার্সকোটোপেটল শিখর কেউ জয় করতে পারেননি। আজও শিখরের ঠিক নিচেই পয়েন্টারের ঘাঁটি তুষারাবৃত হয়ে পড়ে আছে।

পাহাড় থেকে পড়ে-যাওয়া মানুষটা কিন্তু মরেনি-প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল স্রেফ আয়ু ছিল বলে।

হাজার ফুট গড়িয়ে এসেছিল চক্ষের নিমেষে। তার পরেও হাজারখানেক ফুট পিছলে গিয়েছিল পতনের বেগে আরও খাড়াই ঢাল বেয়ে। তুষার সেখানে আরও পুরু। পাকসাট খেতে খেতে আচমকা এইভাবে গড়িয়ে পড়ার ফলে মাথা ঘুরে গিয়েছিল, চৈতন্য লোপ পেয়েছিল, কিন্তু একটা হাড়ও ভাঙেনি নরম তুষার গদির ওপর পিছলে যাওয়ার দরুন– খাড়াই ঢাল আর ততটা খাড়াই থাকেনি–আস্তে আস্তে মন্দীভূত হয়েছে পতনের বেগ, নরম তুষারস্থূপে আলতোভাবে আছড়ে পড়ায় বেঁচে যায় প্রাণটা। জ্ঞান ফিরে আসার পর মনে হয়েছিল, বুঝি বা অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে আছে কোমল শয্যায়। কিন্তু অচিরেই পর্বতারোহীর উপস্থিতবুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করেছিল পরিস্থিতির গুরুত্ব। তুষার-গদির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিল আকাশের অগুনতি তারার পানে চেয়ে। হাড়গোড় একটাও ভাঙেনি। শুধু যা কোটের সব কটা বোতাম ছিঁড়ে গেছে। পকেট থেকে ছুরিটাও পড়ে গেছে। থুতনির সঙ্গে বাঁধা টুপিটাও নিপাত্তা। একটু একটু করে মনে পড়েছিল, পাথর খুঁজছিল আস্তানা বানাবে বলে। পা পিছলেছে তখনই। বরফ-কুঠারও ছিটকে গেছে হাত থেকে।

তখন চাঁদ উঠেছে। আকাশছোঁয়া পাহাড়ের ঢাল দেখে বুঝেছিল, আচমকা পা পিছলে গিয়ে সটান নেমে আসার ফলেই মাথা ঘুরে গিয়েছিল, চেঁচাতেও পারেনি।

পায়ের তলায় কিছু দূরে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট ঝোপ। তুষারপ থেকে পা টিপে টিপে নেমে গিয়েছিল সেখানে। ফ্লাস্কের জল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল একটা গোলাকার স্থলিত শিলার পাশে।

ঘুম ভেঙেছিল পাখির গানে। ঐকতান শোনা যাচ্ছে মাথার ওপর।

খাড়াই পাহাড়ের পর পাহাড় উঠে গেছে যেন আকাশ পর্যন্ত। পূর্ব আর পশ্চিমে প্রাচীরের মতো পাহাড়। রৌদ্রালোকে প্রদীপ্ত।

পায়ের তলায় ঢাল বেয়ে কিন্তু নামা যায়। চিমনির মতো একটা ফাঁক বরাবর ঝরনার জল গড়িয়ে যাচ্ছে। সন্তর্পণে সেইখান দিয়ে কিছুটা নেমে আসার পর বহু দূরে উপত্যকার মধ্যে দেখেছিল কয়েকটা প্রস্তর-কুটির।

জঙ্গল পড়েছিল নামবার পথে। পেরিয়ে এসেছিল হুশিয়ার চরণে।

দুপুর নাগাদ পৌঁছেছিল গিরিবর্ক্সের তলদেশে। পাহাড়ি ঝরনার জল পান করে, একটু জিরিয়ে নিয়ে রওনা হয়েছিল প্রস্তর-কুটিরগুলোর দিকে।

পুরো উপত্যকাটাই মনে হয়েছিল কেমন যেন অদ্ভুত। বাড়িগুলোর চেহারাও সৃষ্টিছাড়া। বিভিন্ন রঙের পাথর দিয়ে তৈরি। কখনও ধূসর পাথর, কখনও উজ্জ্বল। অত্যন্ত বেমানানভাবে অজস্র রঙের পাথর দিয়ে প্রস্তর-কুটির নির্মাণ করেছে যারা, তারা যেন চোখের ব্যবহার করতেও জানে না। অন্ধ নাকি? অন্ধ শব্দটা সেই প্রথম তার মাথায় এসেছিল শুধু এই বর্ণবৈষম্য দেখে।

অথচ বৈষম্য নেই আর কোথাও। নিখুঁত পারিপাট্য বিরাজমান সর্বত্র। বহু উঁচুতে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাম্যার দল। পাহাড়ি ঝরনার জল সঞ্চিত হচ্ছে একটা বিশাল উঁচু প্রাচীরের মতো পরিখায়। জ্যামিতিক ছকে সাজানো বিস্তর কৃষিক্ষেত্রে জলসিঞ্চনের ব্যবস্থা রয়েছে। এই পরিখা থেকে। নিয়মিত ব্যবধানে বহু পাথর বাঁধাই পথ বেরিয়েছে মূল পরিখা থেকে। একটা চওড়া নালা নেমে এসেছে, নালার দুপাশে বুকসমান উঁচু পাঁচিল। কুটিরগুলোও নিয়মিত ব্যবধানে নির্মিত পথের দুপাশে, পথটিও আশ্চর্যভাবে পরিষ্কার। পাহাড়ি গ্রামের কুটির ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, এখানে তা নয়।

আরও একটু নেমে এসেছিল নানেজ। উপত্যকা ঘিরে-থাকা পাঁচিল আর পরিখার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল, নালার বাড়তি জল জলপ্রপাতের আকারে ঝরে পড়ছে উপত্যকার এক প্রান্তে একটা গভীর খাদের মধ্যে। পুরো উপত্যকার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে নালাটা, প্রতিটি জমিতে জলসিঞ্চনের অপূর্ব ব্যবস্থা দেখে অবাক না হয়ে পারেনি। দূরে স্তূপীকৃত ঘাসের ওপর যেন দিবানিদ্রা দিচ্ছে কয়েকজন নারী এবং পুরুষ। প্রান্তরের অপরদিকে কুটিরগুলোর সামনে খেলা করছে কয়েকটি শিশু। কাছেই, উঁচু পাঁচিল বরাবর পথ বেয়ে কুটির সারির দিকে অগ্রসর হচ্ছে তিনজন পুরুষ। জলপাত্র বয়ে নিয়ে চলেছে জোয়ালের ওপর। খুব কাছে রয়েছে বলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ। পায়ের বুটও লাম্যার চামড়ায় তৈরি। কান আর কাঁধ-ঢাকা টুপি রয়েছে মাথায়। চলেছে একজনের পেছনে আর-একজন। যাচ্ছে আর হাই তুলছে, যেন সারারাত কেউ ঘুমায়নি। হাবভাব দেখে সম্ভ্রমবোধ জাগে, সমৃদ্ধির ছাপ যেন পা থেকে মাথা পর্যন্ত। মনে সাহস পায় নানেজ। আরও একটু এগিয়ে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচিয়েছিল তারস্বরে। প্রতিধ্বনির পর প্রতিধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিল নিবিড় প্রশান্তির নিকেতন সেই উপত্যকা।

থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল লোক তিনটে। পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করে দৃষ্টি আকর্ষণ করার অনেক চেষ্টা করেছিল নানেজ। কিন্তু তিনজনের কেউই যেন তাকে দেখতে পায়নি। এদিক-ওদিক মাথা ঘুরিয়েছে অন্ধের মতো। তারপর ডানদিকে মুখ ঘুরিয়ে সাড়া দিয়েছিল জোর গলায়।

অন্ধ নাকি? ফের মনে মনে বলেছিল নানেজ।

বেশ কিছুক্ষণ চেঁচা- মেচি করার পর রেগে মেগে পাথর থেকে নেমে এসেছিল নানেজ। ছোট্ট স্রোতস্বিনীটা পেরিয়ে এসেছিল সাঁকোর ওপর দিয়ে। পাঁচিলের ছোট দরজা দিয়ে ঢুকেছিল ভেতরে। গটগট করে এগিয়ে গিয়েছিল তোক তিনটের দিকে। তিনজনেই যে অন্ধ, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহই ছিল না মনে। অনেকদিন ধরেই শুনে আসছিল, অন্ধদের দেশ আছে দুর্গম পাহাড়ের কোলে। তখন মনে হয়েছিল অলীক উপকথা। বিশ্বাস করতে মন চায়নি। এখন তো স্বচক্ষে দেখছে সেই দেশ। অন্ধদের দেশে মস্ত অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পেয়ে বসেছিল নানেজকে। দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়েছিল দুই চক্ষুর অধিকারী মানুষটা চক্ষুহীন তিনজনের দিকে।

নিশ্চুপ দেহে দাঁড়িয়ে ছিল তিনজন তার দিকে কান পেতে, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। কানই যেন তাদের চোখ। কান দিয়ে শুনে বুঝেছিল ওই পায়ের আওয়াজ তাদের একেবারেই অচেনা। তাই ভয় পেয়েছিল। পরস্পরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল তিনজনে। কাছ থেকে নানেজ দেখছিল। চোখের পাতা তাদের বন্ধ, অক্ষিকোটরে যেন চোখ ঢুকে রয়েছে, চক্ষুগোলক যেন হারিয়ে গেছে কোটরের মধ্যে। আতঙ্ক পরিস্ফুট তিনজনেরই মুখের পরতে পরতে।

ফিসফিস করে দুর্বোধ্য স্পেনীয় ভাষায় বলেছিল একজন, প্রেত অথবা মানুষ পাহাড় থেকে নেমে এসেছে—

নানেজের প্রতি পদক্ষেপে কিন্তু তখন যৌবনের সুগভীর আত্মপ্রত্যয়। মাথার মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছে চারণগীত–একচক্ষুও যেন রাজা অন্ধদের সেই দেশে। দৃষ্টিহীনদের আশ্চর্য দেশের অত্যাশ্চর্য সমস্ত গল্পই হুটোপুটি জুড়েছে মাথার মধ্যে।

একচক্ষুও যেন রাজা অন্ধদের সেই দেশে।

রাজার মতোই তাই বীরোচিত পদক্ষেপে, বুক উঁচিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিমায় অগ্রসর হয়েছিল নানেজ। সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল তিন চক্ষুহীনকে নিজের চক্ষুরত্নের পূর্ণ ব্যবহার করে।

ফিসফিস করে তিনজনের একজন বলে উঠেছিল, পেড্রো, কোত্থেকে এল বল তো?

পাহাড়ের ওপার থেকে।

পাহাড়ের ওপার থেকে বলেছিল নানেজ। এমন একটা দেশ থেকে, যে দেশের সবাই দেখতে পায়। বাগোটার কাছে আছে সেই দেশ, আছে হাজার হাজার মানুষ, বিরাট শহর, দৃষ্টি দিয়েও তার শেষ দেখা যায় না।

দৃষ্টি? বিড়বিড় করে উঠেছিল পেড্রো, দেখা?

নিম্নস্বরে বলেছিল দ্বিতীয় অন্ধ, পাহাড়ের বাইরে থেকে এসেছে।

নানেজ তখন খুঁটিয়ে দেখছিল তিনজনের পোশাক। অদ্ভুত ফ্যাশনের পোশাক। তিনজনের তিনরকম। সেলাই আর কাটছাঁটও তিনরকম।

চমকে উঠেছিল পরক্ষণেই। সামনে বিস্তৃত দুহাতের দশ আঙুল বাড়িয়ে একযোগে তিন অন্ধ এগিয়ে আসছে তাকে ধরতে। ঝটিতি নাগালের বাইরে সরে এসেছিল নানেজ, কিন্তু পালাতে পারেনি। পায়ের শব্দ শুনে ঠিক সেইদিকেই ছুটে গিয়ে নানেজকে কষে চেপে ধরেছিল তিনজনে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত হাত বুলিয়ে দেখে নিয়ে সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিল একজন, হুশিয়ার!

নানেজের চোখে আঙুল পড়তেই আঁতকে উঠেছিল অন্ধ মানুষটা। চোখের পাতা পড়ছে, চোখ নড়ছে! অদ্ভুত ব্যাপার তো! আবার হাত বুলিয়ে দেখেছিল পা থেকে মাথা পর্যন্ত। পেড্রো নামধারী অন্ধ বলেছিল, কোরিয়া, এ তো আচ্ছা সৃষ্টিছাড়া জীব! মাথার চুল লাম্যার মতো কড়া!

শুধু চুল নয়, গালও পাথরের মতো কর্কশ, নানেজের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলেছিল কোরিয়া, হাতও ভিজে ভিজে। পাহাড় থেকে এসেছে তো, পাহাড়ের মতোই নোংরা। পরে পরিষ্কার করে নেওয়া যাবেখন।

কথা চলছে, কিন্তু নানেজকে কেউ ছাড়ছে না, শক্ত মুঠিতে এমনভাবে ধরে রেখেছে যে পালানোর ক্ষমতাও নেই। ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে বুঝেছিল, চোখ না থাকতে পারে, এদের গায়ে জোর আছে বিলক্ষণ।

পেড্রো বলেছিল, ওহে, তুমি তো কথাও বল, মানুষ নিশ্চয়?

মানুষ তো বটেই, তোমাদেরই মতো মানুষ। তফাত শুধু এক জায়গায়–তোমাদের চোখ। নেই–আমার চোখ আছে–দেখবার ক্ষমতা আছে।

দেখবার ক্ষমতা! পেড্রো বিমূঢ়।

হ্যাঁ, তোমরা যে দেশের মানুষ, আমি এসেছি সে দেশের বাইরে থেকে। সে দেশ হিমবাহ পেরিয়ে, পাহাড় পেরিয়ে, অনেক দূরে, সূর্যের কাছাকাছি। সেখান থেকে সমুদ্র মোটে বারো দিনের পথ।

বৃথাই বকে গিয়েছিল নানেজ। দৃষ্টিশক্তির ক্ষমতা সম্বন্ধে কিসসু বোঝাতে পারেনি অন্ধদের। উলটে নানেজকে যখন টেনে নিয়ে যাচ্ছে প্রবীণদের কাছে, তখন কবলমুক্ত হতে গিয়েছিল গায়ের জোরে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মনে হয়? সে কি অন্ধ? রীতিমতো চক্ষুষ্মন। নিজেই পথ দেখে যেতে পারবে।

কিন্তু চোখ থাকা সত্ত্বেও হুমড়ি খেয়ে পড়ায় সহানুভূতিসচক মন্তব্য করেছিল একজন, বেচারা! বিচিত্র প্রাণীটার অনুভূতিগুলোও ভোঁতা, ত্রুটিপূর্ণ। নইলে এইভাবে হোঁচট খায়? কথাবার্তাও অসংলগ্ন, অর্থহীন প্রলাপ। হাত ধরে নিয়ে চল হে, নইলে মুখ থুবড়ে পড়বে।

বেদম হাসি পেয়েছিল নানেজের। আর বাধা দেয়নি৷ লাভ কী? দৃষ্টিশক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান যাদের নিতান্তই অপ্রতুল, তাদের সঙ্গে চোখ নিয়ে কথা বলাটাও আহাম্মুকি। পরে শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া যাবেখন।

অন্ধ তিনজনে হাঁকার দিয়ে সজাগ করে দিয়েছিল সবাইকে। আজব চিড়িয়া এসেছে তাদের দেশে, বাচ্চাকাচ্চারা যেন তার সান্নিধ্যে আঁতকে না ওঠে। নানেজের কানে ভেসে এসেছিল বহু ব্যক্তির চেঁচামেচি, দেখেছিল, গ্রামের মধ্যিখানের পথে জড়ো হচ্ছে কাতারে কাতারে মানুষ। কাছাকাছি হতেই হেঁকে ধরেছিল নানেজকে। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝতে চেয়েছিল আজব চিড়িয়াটা কী ধরনের। কেউ কেউ ভয়ে কাছে আসেনি। কিন্তু কান খাড়া করে শুনেছে নানেজের প্রতিটি কথা। ওর চড়া, কর্কশ কণ্ঠস্বর যে মোটেই শ্রুতিমধুর নয়, অন্ধদের সংবেদনশীল কর্ণকুহরে অত্যাচার সৃষ্টি করে চলেছে–মুখের ভাব দেখে তা অনুমান করেছে নানেজ। শুধু কানের পরদা নয়, অন্ধ মানুষদের সবকিছুই কোমল এবং তীব্র মাত্রায় অনুভূতিসচেতন। হাত নরম, মুখের ভাবও স্নিগ্ধ সুন্দর। কয়েকজনকে দেখতে মিষ্টি ফুলের মতোই। শুধু যা চোখ নেই কারওই, চোখের গর্তে অক্ষিগোলক হারিয়ে গেছে চিরতরে। পথপ্রদর্শক অন্ধ তিনজন আগাগোড়া আগলে রেখেছিল তাকে, নানেজ যেন তাদেরই একার সম্পত্তি, পাহাড় থেকে খসে-পড়া বিচিত্র জীবটার একমাত্র স্বত্বাধিকারী।

নানেজ বোঝাতে চেয়েছে, তার দেশ বাগোটা নামক জায়গায়, অনেক দূরে, পাহাড়ের ওপারে।

কিন্তু বাগোটা নামটাই যে তাদের কাছে নতুন। রঙ্গপ্রিয় একটা বাচ্চা বলে উঠেছে, অদ্ভুত মানুষটার নাম নাকি বাগোটা, আধো আধো বুলি ফুটেছে মুখে, তাই ভালো করে কথাও বলতে পারছে না। ফোড়ন দিয়েছে পেড্রো। নানেজের সবকিছুই নাকি কচি খোকার মতো। নির্ভুল পদক্ষেপে হাঁটতেও শেখেনি। নইলে আসবার সময়ে দু-দুবার হোঁচট খায়?

ধৈর্য ফুরিয়ে আসছিল নানেজের। স্নায়ুর ওপর এই ধরনের ধকল যাবে, আগে ভাবেনি। নারী-পুরুষ, বাচ্চাকাচ্চা প্রত্যেকেই তাকে অদ্ভুত জীব মনে করছে, হাসছে, টিটকিরি দিচ্ছে।

তারপর তাকে ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল প্রবীণদের আস্তানায়। গাঢ় আঁধারে ভরা একটা ঘরে, এক হাত দূরেও চোখ চলে না। এক কোণে ম্যাড়ম্যাড় করে জ্বলছে একটা আগুন। হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল নানেজ। পড়বার সময়ে বাতাস আঁকড়ে ধরতে গিয়ে হাত লেগেছিল একজনের মুখে, অন্ধকারে তাকে দেখা যায়নি, কিন্তু রাগে চেঁচিয়ে উঠেছিল সে। পেছন থেকে ভয় ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে পেড্রো বলেছিল, নতুন জীবটার সবকিছুই এখনও অপরিণত। হাঁটে টলে টলে, কথা বলে আধো আধো।

রেগেমেগে প্রতিবাদ করেছিল নানেজ। অন্ধকারে দেখা যায় না বলেই সে হোঁচট খেয়েছে, অত চেপে ধরে রাখার প্রয়োজন নেই। ছেড়ে দিলেই তো হয়। ঘর ভরতি অন্ধরা শলাপরামর্শ করে নিয়ে হাত সরিয়ে নিয়েছিল নানেজের গা থেকে।

যার সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিল নানেজ, বয়সে সে বৃদ্ধ। অচিরেই শোনা গিয়েছিল তার কণ্ঠস্বর। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গিয়েছিল নানেজকে। নানেজ ধীরস্থিরভাবে বলেছিল তার কাহিনি। বহির্জগতের বিস্ময়, বিশাল দুনিয়া, অনন্ত আকাশ, সুউচ্চ পর্বত, দিগন্তব্যাপী সমুদ্র, সে যা দেখেছে দুচোখ ভরে, সব জ্ঞানই উজাড় করে দিয়েছিল বৃদ্ধের সামনে। আরও অনেক বয়োবৃদ্ধ বসে ছিল অন্ধকারময় সেই প্রকোষ্ঠে। দিনের আলো ক্ষীণভাবে দেখা যাচ্ছিল প্রবেশপথে। জানলা নেই দেওয়ালে। আসবার সময়ে অদ্ভুত এই ব্যাপারটাও লক্ষ করেছিল নানেজ। সারি সারি নির্মিত কুটিরের কোনওটাতেই বাতায়নের বালাই নেই।

বিস্ময়ভরা এই বিরাট পৃথিবীর কোনও বিস্ময়ই কিন্তু অন্তর স্পর্শ করেনি বৃদ্ধ অন্ধদের। চোদ্দো প্রজন্ম ধরে তারা যা জেনেছে, শিখেছে, বুঝেছে, নানেজের কথামালার সঙ্গে তার কিছুই মেলে না। তাই বিশ্বাস করেনি একবর্ণও। চোখ আর দৃষ্টি তাদের কাছে একেবারেই অজ্ঞাত। কান আর আঙুলের ডগা অতিশয় অনুভূতিসচেতন। নানেজের ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। তাই শিশু ঠাউরেছিল নানেজকে। অপরিণত মস্তিষ্ক আর অপ্রতুল জ্ঞান নিয়ে যখন এসেই পড়েছে জ্ঞানবৃদ্ধ অন্ধদের সামনে, তখন জ্ঞানদান করে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার ভরিয়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিল। এই দেশ আগে ছিল একটা পার্বত্য খোঁদলের মধ্যে। এই তাদের পৃথিবী। এর বাইরে আর কিছু নেই। প্রথম যারা এসেছিল এই নিরালা অঞ্চলে, স্পর্শ অনুভূতি ছিল না তাদের। তারপর জাগ্রত হল আশ্চর্য সেই অনুভূতি। জীবন আর ধর্ম সম্বন্ধে শিখল অনেক কিছুই। এখন এখানকার আকাশে গান গেয়ে বেড়ায় পরিরা, মাঠে চরে বেড়ায় লাম্যারা। লাম্যারা তাদের বশ মেনেছে, পরিদের কিন্তু স্পর্শও করা যায় না, শুধু কান পেতে শোনা যায়, তারা আছে, তারা আছে। শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল নানেজ। পরি? পরক্ষণেই বুঝেছিল, পাখিদের কথা বলা হচ্ছে। পাখিরাই এদের কাছে পরি!

প্রবীণতম অন্ধ দিনরাতের অদ্ভুত ব্যাখ্যা শুনিয়েছিল নানেজকে। অন্ধদের কাছে দিন মানে উষ্ণ সময়, রাত্রি মানে শীতল সময়। দুভাগে ভাগ করা দুটিমাত্র সময় ছাড়া দিনরাতের মাধুর্য তাদের অজানা। উষ্ণ সময়ে তারা ঘুমায়। শীতল সময়ে কাজ করে। এখন ঘুমানোর সময়, নানেজ কি ঘুমাবে? ঘুমাতে হয় কী করে, জানে তো? কথাবার্তা যার অসংলগ্ন, চলতে গেলে হোঁচট খায়, ঘুমাতে হয় কী করে, তা কি শিখিয়ে দিতে হবে?

নানেজ যেন কচি খোকা, দোলনার শিশু। অসীম সহানুভূতি ঝরে পড়েছিল বৃদ্ধদের কণ্ঠে।

নানেজ বলেছিল, ঘুমাতে সে জানে। ঘুমাবেও। তার আগে চাই খাবার। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে।

খাবার এনে দিয়েছিল অন্ধরা। নিরালায় বসে পেট ভরে খেয়েছিল নানেজ। কখনও হেসেছে, মজা পেয়েছে, আবার রাগও হয়েছে। দুগ্ধপোষ্য শিশু ভেবেছে তাকে। শিশুর মতোই নাকি মনবুদ্ধি, কথাবার্তা, চলাফেরা পেকে ওঠেনি। নির্বোধ কোথাকার! রাজা হতে যে এসেছে অন্ধদের দেশে, তার সম্বন্ধে কী চমৎকার ধারণা! সময় আসুক, বুদ্ধি আর জ্ঞান কাকে বলে, হাতেনাতে দেখিয়ে দেবে। হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে ছাড়বে।

অন্ধদের দেশে সবাই যখন ঘুমাচ্ছে, নানেজ তখন জেগে বসে। সাত-পাঁচ ভাবছে আর নানান ফন্দি আঁটছে। ভাবতে ভাবতেই বিকেল গড়িয়ে সূর্য অস্ত গেল।

সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য দেখে মনটা কানায় কানায় ভরে উঠেছিল নানেজের, তুষার প্রান্তর আর হিমবাহের ওপর গোধূলির বর্ণসুষমা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। বিপুল আবেগে প্রণত হয়েছিল ঈশ্বরের উদ্দেশে, যার আশীর্বাদে এই চক্ষুরত্ন ব্যবহার করে মহান সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছে সমস্ত হৃদয় দিয়ে।

গ্রাম থেকে একজন অন্ধ হাঁক দিয়ে ডেকেছিল তাকে।

একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারেনি নানেজ। তার যে চোখ আছে এবং আশ্চর্য এই প্রত্যঙ্গটার ক্ষমতা কতখানি, তা সমঝে দেওয়ার এই তো সুযোগ। হেসে উঠে বলেছিল, এই তো আমি।

কাছে এসো।

ইচ্ছে করেই রাস্তা ছেড়ে ঘাসের ওপর পা দিয়েছিল নানেজ–যাতে শব্দ না করে এগিয়ে গিয়ে চমকে দেওয়া যায় মূঢ় অন্ধটাকে।

ধমক খেয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। ঘাসে পা দেওয়া হচ্ছে কেন? রাস্তা থাকতে ঘাসের ওপর যায় তো খোকাখুকুরা? বুদ্ধিশুদ্ধি, জ্ঞানগম্যি কি একেবারেই নেই?

অট্টহেসে জবাব দিয়েছিল নানেজ, চোখ তো আছে, তোমাদের মতো অন্ধ নই।

অবাক হয়ে গিয়েছিল দৃষ্টিহীন গ্রামবাসী। চোখ আর অন্ধ, এ দুটো শব্দ তার জানা নেই। বাঁচালতা আর প্রলাপ বকা যেন বন্ধ করে আগন্তুক। এখনও অনেক জানবার আছে এই দুনিয়ায়। আস্তে আস্তে সব শিখিয়ে নেওয়া যাবে।

সে কী হাসি নানেজের, তাহলে একটা গান শোনাই শোন… একচক্ষুও জেনো রাজা অন্ধদের সেই দেশে।

আবার ধমক খেতে হয়েছিল গান শোনাতে গিয়ে। অন্ধ আবার কী? অন্ধ বলে কোনও শব্দ আছে নাকি?

এইভাবেই গেল চারটে দিন, চারটে রাত। অন্ধদের দেশে রাজা হওয়ার বাসনা তিরোহিত হল একটু একটু করে। পয়লা নম্বরের অপদার্থ এই বিচিত্র জীবটাকে নিয়ে নাজেহাল হয়ে গেল অন্ধরা। দৃষ্টিশক্তি তাদের নেই ঠিকই, কিন্তু আছে আশ্চর্য প্রখর শ্রবণশক্তি আর ঘ্রাণশক্তি। দূর থেকেই হৃৎস্পন্দন শুনে আর গায়ের গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারে, কে আসছে এগিয়ে, আর কে যাচ্ছে দূরে। লাম্যারা নির্ভয়ে নেমে আসে পর্বত থেকে জুগিয়ে যায় খাদ্য, পরিধেয় এবং দুগ্ধ। চাষবাস করে নিখুঁতভাবে। জমি কর্ষণ করে সুচারুভাবে। পথঘাট মসৃণ–উঁচুনিচু নেই কোথাও। মেহনত করে রাতে ঘুমায় দিনে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত তো পেয়ে যাচ্ছে অল্পায়াসেই। বাড়তি সময়টুকু কাটায় গানবাজনা নিয়ে। অবসর বিনোদনের আয়োজনে ত্রুটি নেই কোথাও। সরল গ্রাম্য জীবন। জটিলতাবিহীন ধর্মভীরু মানুষ। নিটোল স্বাস্থ্যের অধিকারী। ছেলেপুলে-বউ নিয়ে সুখের সংসার।

চক্ষুরত্নের ব্যবহার তাই তাদের বোঝাতে পারেনি নানেজ। তিতিবিরক্ত হয়ে বিদ্রোহী হল একদিন।

জোর করে জ্ঞান দিতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি। অন্ধদের ধারণা ছিল, লাম্যারা যেখানে বিচরণ করে–পৃথিবীর শেষ সেইখানেই। মাথার ওপর আছে পাথুরে ছাদ। সূর্য, চন্দ্র, তারা, মহাকাশ, মেঘ–কিসসু নেই।

নানেজের মুখে উলটো কথা শুনে তারা ভাবলে, নানেজ তাদের মন্দ শেখাচ্ছে। অধার্মিকের মতো এ জাতীয় কথাবার্তা তারা শুনতে চায় না। প্রথম প্রথম কান পেতে শুনত নানেজের কথা। শুনত এই পৃথিবীর সীমাহীন বিশালতা আর অপরূপ সৌন্দর্য বর্ণনা। কিন্তু চোখ যাদের নেই, তাদের কাছে এসব কথা দুষ্ট কথা ছাড়া কিছুই নয়। তাই আরম্ভ হল বকাঝকা। তা সত্ত্বেও দমেনি নানেজ। চোখ না-থাকার কত অসুবিধে, বুঝিয়ে দেবার জন্যে একদিন বলেছিল, পেড্রো আসছে সতেরো নম্বর রাস্তা দিয়ে। তোমরা দেখতে পাচ্ছ না, আমি পাচ্ছি। পেড্রো কিন্তু সতেরো নম্বর রাস্তা ছেড়ে আড়াআড়িভাবে চলে গেল অন্য রাস্তায়, কাছে এল না। শুরু হল টিটকিরি। পরে যখন শুনল পেড্রো, রেগে আগুন হল নানেজের ওপর। কুশিক্ষা দেওয়া হচ্ছে গাঁয়ের মানুষদের, নানেজ তাই শত্রু হয়ে উঠল তাদের কাছে।

তবুও হাল ছাড়েনি নানেজ। রাজা হওয়ার বাসনা উগ্রতর হয়ে উঠেছিল রক্তের মধ্যে। মাঠের মধ্যে গিয়ে অন্ধদের চক্ষুরত্নের ক্ষমতা বোঝাতে চেয়েছিল। হাসি-মশকরা শুনে মাথার ঠিক রাখতে পারেনি। বুঝিয়ে যখন কিছু হল না, বলপ্রয়োগে রাজা হবে ঠিক করেছিল। একটা কোদাল কুড়িয়ে তেড়ে মারতে গিয়েও থমকে গিয়েছিল।

অন্ধকে তো এভাবে মারা যায় না!

নিশ্চুপ দেহে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল অন্ধরা। টের পেয়েছিল, কোদাল কুড়িয়ে নিয়েছে নানেজ! হুকুমের স্বরে বলেছিল কোদাল ফেলে দিতে। শোনেনি নানেজ। গাঁ থেকে দল বেঁধে বেরিয়ে এসেছিল অন্ধরা কোদাল আর শাবল নিয়ে। অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে ফেলেছিল তাকে বাতাসের গন্ধ শুঁকে। মাড়িয়ে-চলা ঘাসের ওপর পা ফেলে ফেলে নির্ভুল লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছিল ধীরগতিতে। রাগতস্বরে ফের বলেছিল কোদাল ফেলে দিতে। নানেজ শোনেনি। ভয় পেয়েছিল সেই প্রথম। চোখ নেই, অথচ পায়ে দলা ঘাস আর বাতাসে গায়ের গন্ধ শুঁকে অন্ধরা তাকে ঘিরে ফেলেছে কোদাল-শাবল হাতে। রাজা হওয়া তো দূরের কথা, এখন পালাতে পারলে বাঁচে। একজনকে মরিয়া হয়ে শাবল দিয়ে এক ঘা কষিয়ে পাগলের মতো দৌড়ে গিয়েছিল পাঁচিলের কাছে। কিন্তু মসৃণ আস্তরণ বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়। অদূরে ছিল একটা ছোট্ট দরজা। দরজা পেরিয়ে সাঁকো, তারপর পাহাড়। লাম্যাদের বিচরণ স্থল। সেইখানেই পালিয়েছে নানেজ। দুদিন দুরাত খাবার জোটাতে পারেনি। রাজা হওয়ার সাধ ফুরিয়েছে এইভাবেই।

অবশেষে পুঁকতে ধুঁকতে নেমে এসেছে অন্ধদের মধ্যে। হ্যাঁ, সে অন্যায় করেছে। চোখ বলে কোনও প্রত্যঙ্গ নেই। দৃষ্টিশক্তি অবান্তর কথা। মাথার ওপর পাথুরে ছাদ ছাড়া আর কিসসু নেই, আকাশ, নক্ষত্র, মেঘ, সব বাজে কথা। ভুল করেছে সে। ক্ষমা চায়। বড় খিদে পেয়েছে। খাবার চায়।

ক্ষমা পেয়েছিল সহিষ্ণু অন্ধদের কাছে। বেত্রাঘাত আর অন্ধকার ঘরে বন্দি–এই শাস্তিভোগের পর আর পাঁচজনের মতোই সরাসরি কুলির মতো খাটতে হয়েছে মাঠেঘাটে। তার মতো নির্বোধ জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এর চাইতে বড় কাজ দিতে চায়নি অন্ধরা। অসুস্থ হয়েছিল, সেবা পেয়েছে। প্রবীণরা এসে জ্ঞান দিয়েছে–মনের বিভ্রান্তি ঘোচাতে চেয়েছে।

আস্তে আস্তে অন্ধদের মধ্যে ভিড়ে গেছে নানেজ৷ ইয়াকুবের গোলাম হয়ে সারারাত খেটেছে খেতে। ইয়াকুব লোকটা ভালো, না রেগে গেলে। তার ছোট মেয়ে মেদিনা-সারোতে কিন্তু দিদিদের মতো দেখতে নয়। সুঠাম মুখশ্রী। চোখ অক্ষিকোটরে ঢোকানো নয়। চোখের পাতাও নড়ে। যেন ইচ্ছে করলেই দৃষ্টিশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। কণ্ঠস্বর মোলায়েম নয়। অন্ধদের কাছে এইসব কারণেই সে সুন্দরী নয়। যার চোখ ঠেলে থাকে, চামড়া রুক্ষ, স্বর কানে বাজে–তার কি বর জোটে?

নানেজের কিন্তু পছন্দ হয়েছিল তাকে এইসব কারণেই। আড়ালে পেলেই তাকে শোনাত বহির্জগতের কথা, এই সুন্দর বিশ্বের বর্ণসুষমার কথা। কান পেতে একমনে শুনত সে। তারপর একদিন বিয়ের কথা উঠতেই বেঁকে বসল তার দিদিরা। এমনকী গাঁয়ের যুবকরাও। মেদিনা-সারোতে অসুন্দরী–তা-ই বলে কি একটা জরদৃগবের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বিকৃত প্রজন্মের সূচনা করতে হবে? রক্ত অশুচি করতে হবে? কক্ষনো না। একজন তো মেরেই বসল নানেজকে। নানেজ পালটা মার দিয়ে শুইয়ে দিলে তাকে।

এবং সেই প্রথম হাতেনাতে দেখিয়ে দিলে, হাতাহাতি মারপিটে চোখ কত কাজে লাগে।

তারপর থেকে কেউ আর তার গায়ে হাত দেয়নি। মেদিনা-সারোতে কিন্তু কেঁদে পড়েছিল বাবার কাছে। মেয়ের কান্নায় গলে গিয়ে গাঁয়ের প্রবীণদের পরামর্শ নিতে গিয়েছিল ইয়াকুব। ভেবেচিন্তে একজন বয়োবৃদ্ধ শুনিয়েছিল আশার বাণী। নানেজকে তাদের মতো করে নেওয়া যাবে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে। ওর মাথার গোলমাল ঘটছে চোখ নামক ঠেলে বেরিয়ে থাকা ওই অদ্ভুত রোগগ্রস্ত প্রত্যঙ্গটা থেকে। মগজে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে ওই জিনিসটা। যত উদ্ভট কল্পনার সৃষ্টি ওইখান থেকেই। অস্ত্রোপচার করে জিনিসটাকে বাদ দিলেই নানেজ সুস্থ হয়ে উঠবে, ইয়াকুবের জামাই হতে পারবে।

কিন্তু বেঁকে বসেছিল নানেজ। বাকি জীবনটা এই অন্ধদের দেশেই তাকে থাকতে হবে ঠিকই, রাজার মতো নয়, ক্রীতদাসের মতো। কিন্তু চক্ষুর বিসর্জন দিয়ে কারও জামাই হতে সে রাজি নয়।

নিঃশব্দে কেঁদেছিল মেদিনা-সারোতে। নানেজের কল্পকাহিনি শুনতে তার ভালো লাগে। ভালো লাগে তার সঙ্গ। তাহলে কেন রাজি হচ্ছে না? সামান্য একটু ব্যথা পাবে বই তো নয়, তারপরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

অশ্রুসিক্ত মিষ্টি মুখখানার পানে অনিমেষে চেয়ে থেকে অবশেষে রাজি হয়েছিল নানেজ!

অস্ত্রোপচারের এক সপ্তাহ আগে মহা উদ্যমে অন্ধরা তাকে শিক্ষাদান করে গেল, পরিমার্জনা এবং পরিশোধনের বিস্তর আয়োজন করল, গোলামি আর নিকৃষ্ট সত্তাটাকে উন্নততর করে অন্ধদের পর্যায়ে তাকে নিয়ে আসার জন্যে কোনও প্রয়াসই বাকি রাখল না। নানেজের চোখ থেকে ঘুম উড়ে গিয়েছিল। দিবাভাগের অরুণ-কিরণদীপ্ত অন্ধ-নিকেতনে যখন দৃষ্টিহীনরা সুষুপ্ত, নানেজ তখন নিবিষ্ট চিন্তায় নিমগ্ন থেকে বিমর্ষচিত্তে ইতস্তত পরিভ্রমণ করেছে লক্ষ্যহীনভাবে। উভয়সংকটের দুশ্চিন্তা বহু বিষধর সরীসৃপের মতো তার শিরায়-ধমনিতে বিচরণ করেছে, তাকে অস্থির চঞ্চল করে তুলেছে। দুর্ধর্ষ দুঃসাহসিকতায় দুর্দান্ত সে চিরকালই, কিন্তু অন্ধ-আলয়ে আজ সে নিতান্তই অসহায়। পর্বতারোহীর জীবনযাপনে অভ্যস্ত বলেই মৃত্যুকে পরোয়া করেনি কোনওদিনই, অকুতোভয় মানুষটার ধারেকাছেও তাই মৃত্যু তার করাল ছায়া ফেলতে সাহসী হয়নি। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতিতে পড়েছে, তার চাইতে মৃত্যুর শীতল আলিঙ্গনও অনেক বরণীয়। অথচ সম্মতি দিয়েছে চক্ষুরত্ন উৎপাটনের। কাজের প্রহর শেষ হলেই বিপুল ঐশ্বর্যসম্ভার নিয়ে বর্ণময় শিখরে শিখরে জীবনের সুবর্ণশোভা মেলে ধরে তপনদেবের আবির্ভাব ঘটতেই আরও মুষড়ে পড়ল নানেজ। আজই শেষ দিন। ঈশ্বরের দেওয়া ঐন্দ্রজালিকের ক্ষমতাসম্পন্ন এই চক্ষু প্রত্যঙ্গটিকে বিসর্জন দিতে হবে আজকে, নিশুতি রাতে। মেদিনা-সারোতের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে কোমল কণ্ঠে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে গেছে নানেজকে। ক্ষণিকের যন্ত্রণাবোধের পরেই নানেজ পাবে চিরশান্তি, মগজের অহরহ যন্ত্রণা মিলিয়ে যাবে চিরতরে, অচিন্ত্যপূর্ব প্রশান্তিতে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে নানেজ।

নিমেষহীন নয়নে নয়ন-প্রসাদে বঞ্চিত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে বিদায় জানিয়েছে নানেজ। অসীম করুণায় আর্দ্র হয়েছে চিত্ত।

বিদায় জানিয়েছে দুই করতল মুঠির মধ্যে তুলে নিয়ে। বলেছে স্নেহক্ষরিত স্বরে, বিদায়।

নিঃশব্দে সরে গিয়েছে দূর হতে দূরে। পায়ের শব্দ কান পেতে শুনেছে মেদিনা সারোতে। ক্রমশ ক্ষীণতর হয়ে আসছে কিন্তু দৃঢ় পদধ্বনি। পদধ্বনির মধ্যে জাগ্রত হয়েছে এমন একটা ছন্দ, যা যাত্রার আগে ধরা পড়েনি মেদিনা-সারোতের আতীক্ষ্ণ শ্রবণযন্ত্রে। তাই অকস্মাৎ প্রবল আবেগে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে।

নানেজ চেয়েছিল, জনশব্দহীন নিরালা কোনও তৃণভূমিতে গিয়ে নিবিষ্ট থাকবে অন্তরের অন্তঃস্থলের দুঃসহ চিন্তায়। যে আবেগ প্রবল বন্যার মতো উৎসারিত হচ্ছে মনের গহনতম অঞ্চল থেকে, তাকে আর বাঁধ দিয়ে ধরে রাখতে পারছে না। ঘাস, সবুজ প্রান্তরের নার্সিসাস পুষ্পের পাশে একলা বসে থাকবে চক্ষু বিসর্জনের সময় আগত না-হওয়া পর্যন্ত। যেতে যেতে বিহ্বলভাবে দুচোখ তুলে তাকিয়েছিল অজস্র বর্ণে প্রদীপ্ত ভোরের আকাশের দিকে। দেখেছিল, উষাদেবী যেন সোনার বর্ম পরে নেমে আসছে কাঞ্চন-সোপান বেয়ে।

ওই তো স্বর্গ! ওই তো দেবতাদের আলয়! মহান ওই সৌন্দর্য দেখে অকস্মাৎ তার মনে হয়েছিল, অপরূপ এই দৃশ্যের তুলনায় অন্ধদের এই নিকেতন একটা বদ্ধ বিবর ছাড়া কিছুই নয়–পাপাত্মা-পরিবেষ্টিত হয়ে এই পাপপুরীতে, ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ প্রসাদবঞ্চিত এই অন্ধ মানুষদের দেশে অন্ধত্ব অর্জন করে তাকেও কি সরে আসতে হবে স্বর্গের কাছ থেকে? এমনকী স্বর্গদৃশ্যও মুছে দিতে হবে চিরতরে চোখের সামনে থেকে?

পুষ্পসমৃদ্ধ কানন থেকে ফিরে যাবে–এইটাই মনস্থ করেছিল কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু সহসা আকাশ আর উচ্চ পর্বতালয়ের অজস্র বর্ণদীপ্ত সুষমা অবসান ঘটাল উভয়সংকটে অস্থির চিত্তবিক্ষেপের। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সম্মুখে। প্রাচীরের ওপারে সাঁকো পেরিয়ে আরোহণ করতে লাগল পাহাড় বেয়ে, সম্মোহিতের মতো কিন্তু আগাগোড়া চেয়ে রইল চিত্ত-অবশকারী অনিন্দ্যসুন্দর তপন-প্রদীপ্ত তুষার আর বরফের পানে।

অনন্ত সৌন্দর্য দেখে তিরোহিত হল তার অন্তরের বিষাদের যবনিকা। অশুচি জগৎ থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার নীরব আহ্বান সে উপলব্ধি করেছে, হৃদয়ের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রীতে ধ্বনিত হয়েছে পরম কারুণিকের অমোঘ আহ্বান–শক্তি সঞ্চারিত হচ্ছে পেশিতন্ত্রীতে। জাগরূক হচ্ছে কল্পনা–উন্মোচিত হচ্ছে স্মৃতির আধার। মনে পড়ছে ফেলে-আসা বাগোটাকে। যেখানে দিনের আলো সগর্বে কর্মচঞ্চল রাখে চক্ষুষ্মনদের, নিশীথের রোমাঞ্চ নিদ্রিত করে কর্মক্লান্ত মানুষকে। বিস্তর প্রাসাদ, অট্টালিকা, নিকেতন আছে যেখানে, আছে পথ, যানবাহন। আরও দূরে আছে দিগন্তব্যাপী সুনীল জলধি। নদীপথে দিনের দিন বহু অ্যাডভেঞ্চারের পর পৌঁছানো যায় সীমাহীন সেই জলরাশির উত্তাল তরঙ্গশীর্ষে শুরু হয় বৃহত্তর দুঃসাহসিকতা–জীবনমৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে, মত্ত প্রভঞ্জনের সঙ্গে লড়াই করে টহল দিয়ে আসা যায় বিশাল ভূগোলকটিকে।

আশ্চর্য উদার বিশাল সেই দুনিয়ার সামনে যবনিকা তো ওই পর্বত প্রাচীর। অতীব খাড়াই দুর্গম এবং দুরারোহ।

চোখ কুঁচকে আসে নানেজের। নির্নিমেষে চেয়ে থাকে প্রদীপ্ত পর্বতশিখরগুলোর দিকে।

চেষ্টার অসাধ্য কিছু আছে কি? দুপাহাড়ের ফাঁকে ওই খাঁজের খোঁচা খোঁচা পাথরে পা দিয়ে সন্তর্পণে উঠে যাওয়া কষ্টকর হতে পারে, অসম্ভব নয়। অচিরেই পৌঁছে যাবে পাইন। অরণ্যে। চাতালের মতো পাথরে ওই যে কিনারাটা দেখা যাচ্ছে, ওখান দিয়ে উঠে যাবে আরও উঁচুতে গিরিবর্জ্যের মাথার দিকে। তারপর নিশ্চয় ভাগ্য সহায় হবে। প্রকৃতি তাকে ডাক দিয়েছে–প্রকৃতিই তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। তুষাররেখার নিচেই ওই চিমনি দিয়ে উঠবে আরও ঊর্ধ্বে–একটা চিমনিপথ দুরারোহ হলে আরও একটা খুঁজে নেবে। তার চোখ আছে, চোখ মেলে সে পথের বাধা দূর করতে পারবে না? একসময়ে নিশ্চয় পৌঁছে যাবে অম্বর-আলোকিত তুষারলোকে–ধু ধু শূন্যতার মধ্যে পাবে মুক্তির স্বাদ, স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের নতুন পথ…

ফিরে তাকালে গ্রামের দিকে। চেয়ে রইল চোখের পাতা না ফেলে।

মনে পড়ল মেদিনা-সারোতের কথা। বহু দূরে অস্পষ্ট বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছে তার নিষ্কম্প মূর্তি।

চোখ ফেরালে পর্বত প্রাচীরের দিকে দিনের আলোর ঢল নামছে প্রাচীর বেয়ে।

তনু-মন সংহত করে শুরু হল পর্বতারোহণ।

সূর্যাস্ত। নানেজ আর পাহাড় বেয়ে উঠছে না। নিশূপ দেহে শুয়ে আছে। অধরপ্রান্তে অসীম প্রশান্তির নিবিড় হাস্যরেখা। পোশাক যদিও শতচ্ছিন্ন, হাত-পা রক্তারক্তি, সারা গায়ে কালশিটের নীল বর্ণ, তা সত্ত্বেও আত্মপ্রসাদের অনাবিল প্রশান্ত হাসিতে সমুজ্জ্বল মুখ।

এত উঁচু থেকে অন্ধদের গ্রামটাকে মনে হচ্ছে যেন একটা গভীর বিবর। মাইলখানেক নিচে একটা বদ্ধ উপত্যকা। গোধূলির অস্পষ্টতা গ্রাস করছে অভিশপ্ত উপত্যকাকে একটু একটু করে। মাথার ওপরে শিখরগুলোয় অগ্নিদেবের রোশনাই যেন খুশির পেখম মেলে ধরেছে। হাতের কাছেই ঝলমল করছে আরও অপরূপ সৌন্দর্য। সবুজ খনিজ মিশেছে ধূসর খনিজে। ক্রিস্টালের চমক-দ্যুতি চোখ ঝলসে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। বিশাল খাদগুলোর মধ্যে অসীম রহস্যময়তার মধ্যে নীলাভ আর বেগুনি আভা। তমিস্রার ক্রীড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। মাথার ওপর পরমানন্দে হাসছে আলোকময় আকাশ।

এই তো স্বর্গ। অন্ধদের দেশে রাজা হওয়ার বাসনা আর তার নেই।

রাত ঘনীভূত হল। নিবিড় তমিস্রায় গা এলিয়ে শুয়ে শীতল নক্ষত্ররাজির পানে নির্নিমেষে চেয়ে রইল নানেজ…

আত্মার ব্রহ্মাণ্ড পর্যটন

আত্মার ব্রহ্মাণ্ড পর্যটন ( Under the Knife )

[‘Under the Knife’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘The New Review’ পত্রিকায় জানুয়ারি ১৮৯৬ সালে। ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘The Country of the Blind and Other Stories’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়।]

হ্যাডনের বাড়ি থেকে ফেরবার পথে কেবলই ভাবছিলাম, কাল যদি মরে যাই তো কী হবে? বউ নেই যে কাঁদবে, বন্ধুবান্ধব যা আছে, তাদের ব্যাপারে আমি এমনই নিস্পৃহ যে, মোটেই শোকে বিহ্বল হবে না। বাল্যবন্ধু ছাড়া জীবনের শেষ ভাগে কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী আর শুভাকাক্ষীও জুটিয়ে ফেলেছি, কিন্তু এদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই আমি এতই উদাসীন যে, আমার মৃত্যুতে তাদের যেমন কোনও মাথাব্যথা নেই–আমারও তা নিয়ে অযথা মস্তিষ্কপীড়ন নেই। সুতরাং দুনিয়ায় কেউ কেঁদে ভাসিয়ে দেবে না কালকের অপারেশনে আমি অক্কা পেলে।

ভাবাবেগ জিনিসটা যেন একেবারেই মরে গেছে আমার ভেতরে। একেবারেই নির্বিকার। শরীর ভেঙে পড়ার লক্ষণ নিঃসন্দেহে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। হঠাৎ খুব রক্তক্ষরণ হয়েছিল। মরতে বসেছিলাম। তখনকার সেই অনুভূতির ছিটেফোঁটাও আর নেই মনের ভেতরে–নিংড়ে বেরিয়ে গেছে বললেই চলে। নিবিড় প্রশান্তি–ভাগ্যের হাতে নিঃশেষে নিজেকে সঁপে দিলে যা হয়। বেশ কয়েক হপ্তা আগে অনুভূতি, উচ্চাশা, মমত্ববোধ–সবই ছিল পুরো মাত্রায়।

রক্তশূন্য হয়েছি আবার। হপ্তাখানেক কিছুই খেতে পারছি না। খিদেই নেই। মানুষ নামক প্রাণীটাকে চালিত করে যন্ত্রণা আর আনন্দবোধের চক্র। এই চক্র হঠাৎ আমার ভেতর থেকে সরে গেছে। তাই এই উদাসীনতা। ছোটখাটো ভয় আর আকাক্ষা থেকেই বড় রকমের আবেগ, অনুভূতি, মমত্ববোধের সৃষ্টি হয়। মৃত্যুর ছায়াপাত ঘটলেই অবসান ঘটে এই জটিল চক্রবর্তের। উদ্যম তিরোহিত হয়। তখন আর কিছুই থাকে না।

একটা কসাই-ছোকরার বারকোশে ধাঁই করে ধাক্কা খেতেই ছিঁড়ে গেল চিন্তার সুতো। ঘটনাটা ঘটল রিজেন্ট পার্ক ক্যানালের ব্রিজ পেরনোর সময়ে। নীলবসন ছোকরা ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে রয়েছে একটা কালো মালবাহী বড় নৌকোর দিকে। হাড় বার-করা সাদা ঘোড়া গুন টেনে নিয়ে যাচ্ছে নৌকোটাকে। ব্রিজের ওপরে হাত ধরে তিনটে খুশি-খুশি বাচ্চাকে নিয়ে আসছে একজন আয়া। উজ্জ্বল সবুজ গাছ, ঝকঝকে আকাশ, তরঙ্গায়িত কালো জল এবং বসন্তের মৃদুমন্দ সমীরণও নাড়া দিতে পারল না আমার অসাড় মনে।

কীসের পূর্বাভাস এই অসাড়তা? যুক্তিবুদ্ধির ধার তো ভোঁতা হয়নি। কেন এমন হচ্ছে, তা তো বেশ ভাবতে পারছি। অসাড়তা নয়, প্রশান্তি চেপে বসছে চেতনায়। মৃত্যুর পূর্বলক্ষণ নাকি? মন জানতে পেরেছে আগে থেকেই? মৃত্যুর কনকনে আলিঙ্গনে দেহ ঠান্ডা হওয়ার আগেই কি মন নিজে থেকেই এইভাবে সরে আসে জড়জগৎ আর অনুভূতির জগৎ থেকে? দলছাড়া মনে হল নিজেকে। জীবন থেকে, চারপাশের অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার দরুন কিন্তু বিন্দুমাত্র পরিতাপের উদয় ঘটল না মনের মধ্যে। জীবনের চাঞ্চল্য চারদিকে। ছেলেমেয়েরা খেলছে, মালি-আয়ার সঙ্গে গল্প করছে, হাসতে হাসতে পাশ দিয়ে চলে গেল প্রাণবন্ত দুটি তরুণ-তরুণী, রাস্তার পাশের গাছগুলো নতুন পাতা মেলে ধরছে। সূর্যকিরণের দিকে, মর্মরধ্বনি শোনা যাচ্ছে ডালপালার মধ্যে। প্রাণময় এই জগতের অংশ ছিলাম আমিও। এখন নেই। ফুরিয়ে গেছে আমার ভূমিকা।

ক্লান্ত বোধ করছিলাম। পা যেন আর চলছে না। বসলাম রাস্তার পাশের সবুজ চেয়ারে। বেশ গরম পড়েছে। ঢুলুনি এল বসতে-না-বসতেই। তলিয়ে গেলাম অদ্ভুত স্বপ্নের মধ্যে। উদবেল চিন্তা ধুয়ে-মুছে গেল পুনর্জন্মের স্বপ্নদৃশ্যে। বসে রয়েছি চেয়ারেই, কিন্তু প্রাণ নেই দেহে৷ শুষ্ক, জীর্ণ দেহ। একটা চোখ খোবলাচ্ছে কয়েকটা পাখি। জাগ বলে কে হেঁকে উঠতেই বিদ্রোহী হল যেন রাস্তার ধুলো আর ঘাসের তলাকার মাটির ঢিপি। রিজেন্ট পার্কের এই বাগানটাকে কবরখানা বলে কোনওদিনই ভাবতে পারিনি। সেই মুহূর্তে কিন্তু দেখলাম, যত দূর দুচোখ যায়, কেবল কবর আর সমাধিস্তম্ভ। কাঁপছে, দুলছে, শিরশির করছে, কিলবিল করছে। কোথায় যেন একটা বিরাট গোলমাল চলেছে। জাগ্রত মড়ারা কবর ঠেলে উঠে আসতে চাইছে প্রাণপণে! রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ। সাদা হাড় থেকে খসে পড়ছে লাল মাংস। জাগ হাঁক আবার শোনা গেল কানের কাছে। কিন্তু দাঁতে দাঁত কামড়ে বসে রইলাম আমি। জাগুক সবাই, আমি জাগব না। দানোদের দলে ভিড়ব না। চাষাড়ে গলায় আবার জাগতে বলছি না? বলেই কাঁধ ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিল চোয়াড়ে লোকটা। টিকিট চাইছে বাগানের মালি।

পয়সা গুনে দিয়ে টিকিট পকেটস্থ করে, হাই তুলে উঠে পড়লাম চেয়ার ছেড়ে, চললাম ল্যাংহাম প্লেসের দিকে। আবার মৃত্যুর চিন্তা জলপ্রপাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল মনের ওপর। আর-একটু হলে গাড়িচাপা পড়তাম মোড়ের মাথায়। ধাক্কাটা গেল কাঁধের ওপর দিয়ে। রক্ত তো বেরলই, সেই সঙ্গে উত্তাল হল হৃদযন্ত্র। টলতে টলতে সরে এলাম পাশে। কালকের মৃত্যু-ধ্যান আর-একটু হলেই মৃত্যু ঘটিয়ে ছাড়ত এখুনি।

যা-ই হোক, সেই দিনের এবং তার পরের দিনের অভিজ্ঞতা শুনিয়ে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। সময় যতই গড়িয়েছে, ততই নিশ্চিত হয়েছি। কাল অপারেশন হবে এবং আমিও মরব। বাড়ি ফিরে দেখলাম, প্রস্তুতিপর্ব সাঙ্গ হয়েছে। ঘর পরিষ্কার। সাদা চাদর ঝুলছে। নার্স মোতায়েন হয়েছে। জোর করেই শুতে পাঠাল সকাল সকাল।

বড় কুঁড়ে মনে হল নিজেকে সকালবেলা। সকালের ডাকে আসা খবরের কাগজ আর চিঠিপত্র নিয়ে বসলাম বটে, কিন্তু মন দিতে পারলাম না। আমার লেখা নতুন বইটায় কয়েক জায়গায় ত্রুটি আছে, ছাপার ভুলও আছে–লিখেছে স্কুলের বন্ধু অ্যাডিসন। বাকি চিঠিপত্র ব্যাবসা সংক্রান্ত। এক কাপ চা ছাড়া খেতে দেওয়া হল না কিছুই। পাঁজরায়। যন্ত্রণাটা আরও বেড়েছে। কিন্তু অনুভব করতে পারছি না। রাত্রে ঘুমাইনি। মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। তেষ্টা পাচ্ছিল। সকালে কিন্তু বেশ ভালোই লাগল। সারারাত অতীতের ঘটনা ভেবেছি। ভোরের দিকে অমরত্ব নিয়ে ভাবতে ভাবতে চুলেছি। ঘড়ি ধরে ঠিক সময়ে এল হ্যাডন–হাতে কালো ব্যাগ। মোব্রে এল তার পরেই। ওরা আসতে জবুথবু ভাবটা একটু কাটল। আটকোনা ছোট টেবিলটা খাটের পাশে এনে রাখল হ্যাডন। আমার দিকে পেছন ফিরে ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে রাখতে লাগল টেবিলে। শুনলাম স্টিলের ওপর স্টিল রাখার আওয়াজ। চিন্তাধারা আর ডোবা জলের মতো বদ্ধ নয়। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ছুরি চালালে খুব লাগবে কি?

হ্যাডন বলেছিল, মোটেই না। ক্লোরোফর্ম করা হবে তো। আমার হার্ট নাকি দারুণ মজবুত। নাকে ভেসে এসেছিল ঘুমপাড়ানি ওষুধের মিষ্টি গন্ধ।

পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিয়েই ক্লোরোফর্ম দিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। প্রথমে মনে হয়েছিল, দম আটকে আসছে। মরতে চলেছি তো জানি, এবার লোপ পাবে জ্ঞান। হঠাৎ মনে হল, সে কী! মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হইনি তো এখনও অনেক কর্তব্য যে এখনও বাকি। কী কর্তব্য তা অবশ্য জানি না, মনেও করতে পারলাম না, কী কাজ এখনও করা হয়নি। জীবনে কী কী আকাক্ষা এখনও অপূর্ণ রয়েছে, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। অথচ মরবার ইচ্ছেও হল না। শারীরিক অস্বস্তি যন্ত্রণার পর্যায়ে পৌঁছেছে–বেশ উপলব্ধি করলাম। ছটফট করেছিলাম। তারপর নিস্পন্দ হয়ে গেলাম। নৈঃশব্দ্য আর তমিস্রা গ্রাস করল আমাকে।

কত মিনিট কত সেকেন্ড জ্ঞান হারিয়েছিলাম, বলতে পারব না। হঠাৎ গা শিরশির-করা আবেগহীন অনুভূতির মধ্যে দিয়ে টের পেলাম, আমি মরিনি। দেহের খাঁচার মধ্যেই রয়েছি। কিন্তু যেন মুক্তি পেয়েছি। পুরোপুরি নয়। মাংসময় দেহে আটকে আছি ঠিকই, কিন্তু দেহটা যেন আর আমার নয়। কিছুই দেখিনি, কিছুই শুনিনি, তবুও যা যা ঘটেছে, তার সবই টের পেয়েছি–শোনা আর দেখার মতোই। হ্যাডন ঝুঁকে রয়েছে আমার ওপর, বিরাট একটা স্ক্যালপেল হাতে পাঁজরা কেটে ফালাফালা করছে মোব্রে। যন্ত্রণা নেই। মাংস কেটে যাচ্ছে টের পাচ্ছি কিন্তু ভালোই লাগছে। যেন দুজন দাবা খেলোয়াড়ের দান দেওয়া দেখছি মজা লাগছে। কৌতূহল নিবিড়। হ্যাডনের মুখ শক্ত, হাত অচঞ্চল। কিন্তু অপারেশন যে সাকসেসফুল হবে না–এইরকম একটা ধারণা রয়েছে মনের মধ্যে। কী করে ওর মনের কথা টের পেলাম, তা বলতে পারব না।

মোব্রে কী ভাবছে, তা-ও টের পেয়েছিলাম। ও ভাবছিল, বিশেষজ্ঞ হয়েও হ্যাডন এত মন্থরগতি কেন? কী কী করা উচিত, বলতে চাইছে, মাথার মধ্যে চিন্তাগুলো হাজার হাজার বুদবুদের মতো ঠেলে উঠছে। হ্যাডনের দক্ষ ক্ষিপ্র ছুরিচালনা দেখে মুগ্ধ হয়েছে, তা-ও টের পাচ্ছি ওর চেতনার বিস্ফোরণ অনুভব করে। হ্যাডনের দক্ষতা মোরে মাথার মধ্যে ঈর্ষার সঞ্চার ঘটাচ্ছে, তা-ও উপলব্ধি করছি। যকৃৎ খুলে বার করে নেওয়া দেখলাম। হতভম্ব হলাম নিজের অবস্থা দেখে। মরিনি। কিন্তু জীবিত সত্তা বলতে যা বোঝায়, তা-ও নই। বছরখানেক যে বিষণ্ণতায় ভুগেছি, আচম্বিতে তা উধাও হয়েছে। চিন্তা করছি, উপলব্ধি করছি কিন্তু আবেগের ছিটেফোঁটাও অনুভব করছি না। জানি না আর কেউ এভাবে ক্লোরোফর্মে জ্ঞান হারিয়ে সবকিছু টের পেয়েছে কি না, অন্যের মনের মধ্যে ঢুকতে পেরেছে কি না, তারপরেও সব মনে রাখতে পেরেছে কি না।

মরিনি এখনও বলতে পেরেও এইটুকু বুঝলাম, মরতে আর দেরি নেই। ঢুকলাম হ্যাডনের মনের মধ্যে। ভয় পাচ্ছে একটা মূল শিরার শাখা কাটতে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওর মানসিক দ্বন্দ্ব। গ্যালভানোমিটারের আয়নায় আলো কাঁপে যেভাবে থিরথির করে, ওর সজ্ঞান মনে তেমনি দুটো চিন্তার লড়াই চলছে। একটা আলো জোরালো হয়ে উঠছে। এই আলোয় দেখা যাচ্ছে ওর মনের ভাবনা–একটা কাটা শিরার ছবি। পরক্ষণেই জোরালো হয়ে উঠল আর-একটা আলোকময় চিন্তা-ভুল জায়গায় কাটা হয়েছে শিরা। ধস্তাধস্তি লেগে গেল দুটো আলোকময় সম্ভাবনাচিত্রে। প্রথমটা জোর করে হটিয়ে দিলে দ্বিতীয়টাকে। ভয় পেয়েছে হ্যাডন। বেশি কেটে ফেললেও বিপদ, কম কেটে ফেললেও বিপদ।

আচমকা যেন লক গেট খুলে তোড়ে জল বেরিয়ে গেল। দোটানার চিন্তাপ্রবাহ হু-উ-উ-স করে বেরিয়ে গেল ওর চেতনাকেন্দ্রের আলোময় অঞ্চল থেকে। মনস্থির করে ফেলেছে। হ্যাডন। টের পেলাম, শিরা কাটাও হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। ভাঙা গলায় পেঁচিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। ছিটকে সরে গেল পেছনে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। বাদামি-বেগুনি রক্ত। সে কী আতঙ্ক হ্যাডনের। দুই ডাক্তারই আটকোনা টেবিল থেকে স্ক্যালপেল তুলে নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বিপর্যয় রোধ করার জন্যে। আমি কিন্তু জানলাম, মৃত্যু হল আমার সেই মুহূর্তেই–দেহটা অবশ্য তখনও আঁকড়ে রয়েছে আমাকে নাছোড়বান্দার মতো।

সবই উপলব্ধি করলাম। কিন্তু খুঁটিয়ে বর্ণনা আর দেব না। চেষ্টার ত্রুটি করেনি দুজনে আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে। জীবনে এত ধারালোভাবে দ্রুতগতিতে কিছু উপলব্ধি করতে পারিনি। অবিশ্বাস্য গতিবেগে চিন্তা ছুটছে মনের মধ্যে দিয়ে–আশ্চর্য রকমের অনাবিল সুস্পষ্টভাবে। সঠিক মাত্রায় আফিম খেলে চিন্তারাশি যেভাবে গাদাগাদি অবস্থায় থেকেও স্পষ্ট থাকে, আমার তখনকার অবস্থা যেন সেইরকমই। এ ছাড়া আর কোনও উপমা মাথায় আনতে পারছি না। বুঝলাম, এখুনি সব শেষ হয়ে যাবে, মুক্তি পাব আমি। আমি জানি, আমি অমর। কিন্তু কী ঘটবে, তা জানি না। বন্দুকের নল থেকে ফুস করে ধোঁয়া ঠিকরে যায় যেভাবে, সেইভাবেই কি ছিটকে যাব দেহের খাঁচা থেকে? মৃতদের জগতে হাজির হব কি এবার? প্রেতচক্রে হাজির হব নাকি তারপর? বেরং প্রত্যাশা, আবেগহীন কৌতূহলে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম সেই মুহূর্তে। তারপরেই একটা চাপ অনুভব করলাম। উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। যেন একটা অতিকায় মানবিক চুম্বক আমাকে আমার দেহ থেকে টেনে ওপরে তুলে নিয়ে যেতে চাইছে। বাড়ছে… ক্রমশ বেড়ে চলেছে অস্বস্তি। প্রচণ্ড আকর্ষণ আর এড়ানো যাচ্ছে না। অনেকগুলো দানবিক শক্তির সঙ্গে সঙ্গে আমি একটা খুদে পরমাণুর মতো যুঝে চলেছি। পারছি না… প্রচণ্ড এই আকর্ষণকে ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। ক্ষণেকের জন্যে একটা বিশাল কালো তমিস্রা জলপ্রপাতের মতো আছড়ে পড়ে মহা-আতঙ্কের অমানিশায় ডুবিয়ে দিল আমাকে… ভয়াবহ আতঙ্ক চকিতের মতো চাবুক আঘাতে জড়তা কাটিয়ে দিল আমার এক নিমেষের জন্যে। পরক্ষণেই দুই ডাক্তার, ছোট্ট ঘর, পাঁজরা-কাটা দেহ প্রবল জলোচ্ছ্বাসে একটা ফেণা-বুদবুদের মতো ভেসে গেল কোথায় কে জানে।

দেখলাম, শূন্যে ভাসছি। শুধু ভাসছি নয়, প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে যাচ্ছি ওপরদিকে। অনেক নিচে দ্রুত ছোট হয়ে আসছে লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ড। ঊর্ধ্বগতি কিন্তু পশ্চিম-ঘেঁষা। পাতলা ধোঁয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম অসংখ্য ছাদের চিমনি, মানুষ আর যানবাহনে বোঝাই সরু সরু রাস্তা, ছোট্ট ছোট্ট ধূলিকণার মতো চৌকোনা পার্ক, আর কাপড়ের গায়ে বিঁধে থাকা কাঁটার মতো গির্জের চূড়া। অচিরেই তা সরে গেল দৃষ্টিপথ থেকে পৃথিবী ঘুরছে বলে। সে জায়গায় আবির্ভূত হল পাশের গ্রাম, শহরতলি, নদী। কোথায় যে চলেছি নক্ষত্রবেগে, কিছু বলতে পারলাম না।

পলকে পলকে নিচের নিসর্গদৃশ্য বিশাল হতে বিশালতর অঞ্চল জুড়ে জেগে উঠল চোখের সামনে, শহর আর প্রান্তর, পাহাড় আর উপত্যকা, আরও কুয়াশাচ্ছন্ন, আরও ম্যাড়মেড়ে, আরও অস্পষ্ট হয়ে এল, পাহাড়ের নীল বর্ণ আর মাঠ-ময়দানের সবুজ রঙের সঙ্গে আলোকময় ধূসরাভা আরও বেশি মিশে যেতে লাগল। নিচে অনেক পশ্চিমে ছোট ছোট মেঘের টুকরো আরও ঝকমকে সাদা হয়ে উঠতে লাগল। মাথার ওপর আকাশের রংও পালটে গেল একটু একটু করে। প্রথমে যা ছিল বসন্তের আকাশের মতো নীলিমায় নীল, আস্তে আস্তে তা গাঢ়তর হয়ে মধ্যরাতের আকাশের মতো কালো হয়ে গেল, তারপর হল তুষার-ঝরা নক্ষত্রলোকের মতো মিশমিশে কালো, তারপর যে মসিকৃষ্ণ রংটি উপস্থিত হল, সেরকম কালো রং কখনও দেখিনি। প্রথমে দেখা গেল একটা তারা, তারপর অনেক, তারপর ঝাঁকে ঝাঁকে–অগুনতি। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে এত নক্ষত্র একসঙ্গে কেউ কখনও দেখেনি। দিনের আলোয় তারা দেখা যায় না নীল গগনে। শীতের রাতেও দেখা যায় না। তারার আলো থাকে বলে। কিন্তু এখন আর চোখে ধাঁধা লাগছে না–রাশি রাশি তারার অদ্ভুত সমারোহ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মরলোকের কেউ এমন স্বর্গীয় দৃশ্য কখনও দেখেনি। অবিশ্বাস্যভাবে অদ্ভুত এবং আশ্চর্য হয়ে উঠেছে সূর্য। চোখধাঁধানো সাদা আলোয় গড়া সূর্য। পৃথিবী থেকে দেখায় হলদেটে। কিন্তু আমি দেখলাম ধবধবে সাদা সূর্য। লাল ডোরা রয়েছে সাদার ওপর। কিনারা ঘিরে লকলকে লোহিত অগ্নিজিহ্বা। দুপাশে পাখির ডানার মতো রুপোলি সাদা দুটো প্রত্যঙ্গ ঠিকরে গেছে মহাশূন্যের বহু দূর পর্যন্ত। ঠিক যেন ডানাওয়ালা গোলক। মিশরীয় ভাস্কর্যে দেখেছিলাম এই ধরনের ছবি। পার্থিব জীবনে সৌরচ্ছটার ছবি দেখেছিলাম–এখন দেখলাম স্বচক্ষে।

পৃথিবীর দিকে ফের তাকিয়ে দেখি, সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ সরে গেছে আরও দূরে। অনেক আগে থেকেই মাঠ-ময়দান-প্রান্তর পর্বতকে আলাদাভাবে চেনা যাচ্ছিল না। সব রং মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এখন যা দেখা যাচ্ছে তা একটা সমান উজ্জ্বল ধূসর রং। মাঝে মাঝে ঝকঝকে সাদা মেঘপিণ্ড। সমুদ্র ডাঙার চাইতে গাঢ় ধূসর রঙের। পুরো দৃশ্যটা আস্তে আস্তে ঘুরে যাচ্ছে পূর্বদিকে।

দ্রুত ঘটে চলেছে ঘটনাস্রোত। পৃথিবী থেকে হাজারখানেক মাইল সরে আসার আগে নিজের কথা মনেই হয়নি। উপলব্ধি করলাম একটা আশ্চর্য ব্যাপার। আমার হাত নেই, পা নেই, দেহাংশ নেই, দেহযন্ত্র নেই, ভয় নেই, যন্ত্রণা নেই। বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে এসেছি অনেকক্ষণ। চারপাশে শূন্যতা। মানুষের কল্পনাতীত। আমি কিন্তু নির্বিকার। নির্ভয়। সূর্যালোক ধেয়ে যাচ্ছে শূন্যতার মধ্যে দিয়ে। বস্তুতে প্রতিহত হচ্ছে না বলে আলো বা উত্তাপ দিচ্ছে না। নিবিড় প্রশান্তিময় বিস্মৃতিতে আছন্ন আমার সত্তা। যেন স্বয়ং ঈশ্বর আমি। সেকেন্ডে সেকেন্ডে অসংখ্য মাইল দূরে সরে যাচ্ছে বহু নিচে লন্ডন শহরের আমার ছোট্ট ঘরখানি–দুজন ডাক্তার আমার খোলসটাকে নিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছে আবার তার মধ্যে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু আমি যে মুক্তির স্বাদ, যে অনাবিল প্রশান্তি, যে অনির্বচনীয় পরিতৃপ্তি পেয়েছি, তার সঙ্গে মরজগতের কোনও আনন্দের তুলনা হয় না।

পলকের মধ্যে এতগুলো উপলব্ধির পর পৃথিবী ছেড়ে বেগে উধাও হওয়ার অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এত সহজ আর অবশ্যম্ভাবী ব্যাপারটা কেন যে আগে ভাবিনি, ভাবতে গিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি হঠাৎ–ভেসে যাচ্ছি শূন্যপথে। বস্তুজগতের সঙ্গে যেখানে এতটুকু বাঁধন ছিল, সব ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে সেকেন্ডে সেকেন্ডে প্রচণ্ড গতিবেগে ধেয়ে চলেছি আকাশভরা সব চন্দ্র-গ্রহ-নক্ষত্রর দিকে। মাধ্যাকর্ষণের আকর্ষণ অনুভব করছি না। বস্তুরহিত বলেই মহাশূন্যে এত আকর্ষণশূন্য। মাংস দিয়ে গড়া পিঞ্জর পড়ে তো পৃথিবীতে। পৃথিবীকে আমি ত্যাগ করছি না–পৃথিবীই আমাকে ত্যাগ করছে–গোটা সৌরজগৎটাই সাঁ সাঁ করে সরে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। চোখে দেখতে না পেলেও উপলব্ধি করছি, আমার মতোই মুক্তির আনন্দে বিহ্বল বহু আত্মা বিরাজমান আমার চতুর্দিকে। বস্তুপিঞ্জর থেকে মুক্তি পেয়ে, পাশবিক লোভ, নগ্ন বুদ্ধিমত্তা, অর্থহীন আবেগ-অনুভূতি থেকে ছাড়া পেয়ে আচম্বিতে উদবেল হয়ে উঠেছে প্রত্যেকেই। মহাশূন্য ভেদ করে ধেয়ে চলেছে তারা আমার পাশে পাশে–অদৃশ্য অবস্থায়!

পৃথিবী আর সূর্যের কাছ থেকে ক্রমশ দুরে সরে যেতে যেতে উপলব্ধি করলাম, অবিশ্বাস্যভাবে আকারে-আয়তনে বড় হয়ে যাচ্ছি যেন। মানুষের জীবনে বড় বলতে যা কল্পনা করা যায়, সেই তুলনায় অনেক… অনেক বড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পূর্ণিমার চাঁদের মতোই বৃহদাকার ধারণ করল পৃথিবী। মিনিটকয়েক আগে দ্বিপ্রহরের সূর্য প্রদীপ্ত রেখেছিল যেখানে ইংল্যান্ডে, এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে রোদ্দুর ঝকঝকে আমেরিকাকে। মুহূর্তে মুহূর্তে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে আসছে পৃথিবী গোলক। কিনারায় আবির্ভূত হল চন্দ্র। নক্ষত্রমণ্ডলী দেখে অবাক হলাম। চেনাজানা তার মালা ছাড়াও দেখলাম অনেক অজানা অচেনা নক্ষত্রমণ্ডলী। প্রশান্ত দ্যুতি সমুজ্জ্বল নক্ষত্ররাশিতে উদ্ভাসিত মহাশূন্য। পৃথিবী পলকের মধ্যে সূর্যের মতো ছোট হয়ে এল। বিপরীতদিকে আলপিনের ডগার মতো মঙ্গল গ্রহকে দেখা গেল। মহাজাগতিক ধূলিকণার মতো পৃথিবী মিলিয়ে যাচ্ছে বহু দূরে। আতঙ্ক বা বিস্ময়–কোনওটাতেই আচ্ছন্ন হলাম না।

এরপরেই উপলব্ধি করলাম, মন মন্থরগতি হয়েছে, ধারণা নতুন রূপ নিচ্ছে, মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে আবর্তন দেখলাম, এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তার মধ্যেকার সময়ের ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে–এক-এক মুহূর্তে এক-একটা হাজার বছর অতিবাহিত হচ্ছে।

অনন্ত মহাশূন্যের কালো পটভূমিকায় এতক্ষণ নিশ্চল ছিল নক্ষত্রমণ্ডলী। হঠাৎ তাদেরকেও সরে যেতে দেখলাম। ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে দুর হতে দুরে। আচমকা অন্ধকারের মধ্যে থেকে সূর্যকরোজ্জ্বল একঝাঁক প্রস্তরখণ্ড ধূলিকণার মতো আলোকময় প্রভায় চারদিক উজ্জ্বল করে দিয়ে বেরিয়ে গেল আশপাশ দিয়ে। মিলিয়ে গেল দুরে। তারপরেই দেখলাম, একটা উজ্জ্বল আলোর কণা দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠল আলোটা। শনি গ্রহ। আকার বেড়েই চলেছে পলকে পলকে। মুহূর্তে মুহূর্তে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পেছনের মহাকাশ আর অগুনতি নক্ষত্র। চ্যাপটা, ঘুরন্ত গ্রহের চারদিকে থালার মতো বলয় আর সাতটা উপগ্রহকে স্পষ্ট লক্ষ করা যাচ্ছে। নিমেষে বিশাল হতে বিশালতর হয়ে যেন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল অতিকায় শনি গ্রহ, ধেয়ে চললাম অগুনতি পাথরের ধারাবর্ষণের মধ্যে দিয়ে… পাথরে পাথরে সে কী সংঘাত। ধূলিকণার তাণ্ডবনৃত্য আর গ্যাস-আবর্তের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চকিতের জন্যে দেখলাম মাথার ওপর প্রকাণ্ড তিনটে বেল্ট; একই কেন্দ্র ঘিরে যেন তিনটে চন্দ্রালোকিত খিলেন। ছায়া পড়েছে নিচের ফুটন্ত প্রলয়কাণ্ডের ওপর। বলতে যতটা সময় গেল, তার এক দশমাংশ সময়ের মধ্যেই ঘটে গেল এত কাণ্ড। বিদ্যুঝলকের মতো উধাও হয়ে গেল শনি গ্রহ। সূর্যকে ঢেকে রাখল কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। তারপরেই দেখা গেল আলোর পটভূমিকায় পাক খেতে খেতে মিলিয়ে যাচ্ছে একটা ধ্যাবড়া কালচে দাগ। ধরিত্রী মা-কে। আর দেখতে পেলাম না।

রাজকীয় গতিবেগে, অখণ্ড নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে এলাম সৌরজগৎ। যেন একটা জামা খুলে পড়ে গেল গা থেকে। অগণিত তারকারাজির মধ্যে নিছক একটা নক্ষত্র হয়ে জেগে রইল সূর্য-আশপাশে ধূলিকণার মতো গ্রহ–বহু দূরের আলোয় স্পষ্ট নয় কোনওটাই মিলেমিশে একাকার। সৌরজগতের বাসিন্দা আর নই আমি। এসে পড়েছি বাইরের ব্রহ্মাণ্ডে–বহিঃমহাকাশে। আরও দ্রুত ঘনীভূত হল কয়েকটা নক্ষত্রমণ্ডলী–চেনা তারকামণ্ডলীরা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর। ঘুরন্ত নীহারিকার মতো দেখতে হল মহাকাশের সেইদিকটা। তার ওপারে ব্যাদিত মহাশূন্যতা–খণ্ড খণ্ড নিঃসীম তমিস্রা–মাঝে মাঝে চিকমিক করছে নক্ষত্র। কমে আসছে সংখ্যায়। মনে হল যেন দ্রুত হতে দ্রুততর হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ডের ছুটে যাওয়া–ধূলিকণার আকারে নিঃশব্দে বিলীন হচ্ছে মহাশূন্যে। ঝকঝকে নক্ষত্ররা আরও ঝকঝকে হয়ে উঠছে, কাছাকাছি এসে দেখছি, গ্রহদের গা থেকে ঠিকরে যাচ্ছে যেন ভৌতিক দ্যুতি। পরমুহূর্তেই দপ করে নিবে যাচ্ছে ভূতুড়ে আলো–মিলিয়ে যাচ্ছে অনস্তিত্বের মধ্যে। অস্পষ্ট ধূমকেতু, উল্কার ঝাঁক, বস্তুকণা, আলোককণার ঘূর্ণি সাঁত সাঁত করে বেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। কেউ কোটি কোটি মাইল দূর দিয়ে, কেউ কাছ দিয়ে। অকল্পনীয় গতিবেগ প্রত্যেকেরই। ধাবমান তারকামণ্ডলী, ক্ষণিক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ কুচকুচে কালো প্রকাণ্ড রাত্রির বুক ভেদ করে ছুটে এসেই মিলিয়ে যাচ্ছে নিমেষে নিমেষে। বিশাল হতে বিশালতর হচ্ছে নক্ষত্রহীন দুরের মহাশূন্য–যেদিকে আকৃষ্ট হয়ে চলেছি আমি বিরামবিহীনভাবে। দেখতে দেখতে মসিকৃষ্ণ এবং বেবাক শূন্য হয়ে গেল মহাকাশের সিকি অঞ্চল–দ্যুতিময় নক্ষত্রময় ব্রহ্মাণ্ড পেছনে ছুটে গিয়ে কাছাকাছি হতে হতে আলোকপুঞ্জ হয়ে গেল। এসে পড়লাম ধু ধু মহাশূন্যতার মধ্যে। কালো অমানিশা আস্তে আস্তে বিরাটতর হয়ে চারদিক থেকে ছেকে ধরল আমাকে–আগুনের কণার মতো নক্ষত্রগুলো ঝটিতি সরে গেল দূর হতে দূরে–নাস্তি আর শূন্যতার গহ্বরে একা আমি ধেয়ে চললাম কোথায় কে জানো বস্তু দিয়ে গড়া অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডও শেষকালে এক কণা আলোকময় ধুলোর মতো অস্পষ্ট হয়ে এল পেছনে–একেবারেই অদৃশ্য হতে আর দেরি নেই।

আচম্বিতে মহা-আতঙ্ক পেয়ে বসল আমাকে। ভাষা দিয়ে সেই আতঙ্ক অনুভূতিকে প্রকাশ করা যায় না। সীমাহীন এই অন্ধকারের মধ্যে আমার মতোই কি রয়েছে আরও অনেক অদৃশ্য আত্মা? পৃথিবীর সমাজবদ্ধ জীব আমি–আত্মাদের সমাজ কি পাব এখানেনা, একাই থাকতে হবে? কী অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছি, তা-ও তো বুঝছি না। জীবসত্তা থেকে বেরিয়ে এসে সত্তা আর সত্তাহীনতার মাঝামাঝি পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম নাকি? দেহের খোলস, বস্তুর খোলস সবই টেনে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে আমার কাছ থেকে সঙ্গ আর নিরাপত্তা এখন নিছক মরীচিকা। চারদিকেই তো নিবিড় তমিস্রা–অখণ্ড নীরবতা। সত্তা ছিল –এখন নেই। কিছুই নই এখন আমি। নিতল গহ্বরে নিরতিশয় ক্ষুদ্র এক কণা আলো ছাড়া কিছুই তো আর দেখা যাচ্ছে না। প্রাণপণে শোনার, দেখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অসীম নৈঃশব্দ্য, অসহ্য অন্ধকার, বিভীষিকা আর নৈরাশ্য ছাড়া কিছুই উপলব্ধি করিনি।

ব্রহ্মাণ্ডের সব বস্তু যেখানে জড়ো হয়েছে, সেইখানে হঠাৎ দেখলাম একটা ক্ষীণ দ্যুতি। দ্যুতির দুপাশের পটিও নিঃসীম তমিস্রায় আবৃত নয়। যেন অনন্তকাল ধরে চেয়ে ছিলাম সেইদিকে। দীর্ঘক্ষণ প্রতীক্ষার পর ঝাপসা দ্যুতি স্পষ্টতর হল বটে, কিন্তু বোধগম্য হল না কিছুই। তারপরেই পটির চারদিকে আবির্ভূত হল অতিশয় ক্ষীণ, অতিশয় ম্যাড়মেড়ে বাদামি রঙের মেঘ। অসহ্য অসহিষ্ণুতায় অস্থির হয়েছিলাম। কিন্তু এত ধীরগতিতে মেঘটার ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে, কিছুতেই আন্দাজ করতে পারলাম না কী ধরনের বিস্ময়ের সম্মুখীন হতে চলেছি। মহাশূন্যের চিররাত্রির মধ্যে ওই অদ্ভুত লালাভ উষা কীসের সূচনা বহন করছে, কিছুতেই বুঝে উঠলাম না।

আস্তে আস্তে বিদঘুটে হয়ে উঠছিল মেঘের আকার। তলার দিকে যেন ঠেলে বেরিয়ে রয়েছে চারটে বস্তুপুঞ্জ–ওপরদিকে কী যেন একটা উঠে গেছে সিধে সরলরেখায়। অপচ্ছায়ার মতো এ আবার কী জিনিস? এ জিনিস দেখছি আগে… হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখেছি… কিন্তু কোথায় যে দেখেছি, কিছুতেই খেয়াল করতে পারলাম না। আচমকা উপলব্ধি করলাম বিচিত্র আকৃতির স্বরূপ। মুঠো-করা একটা হাত! মহাশূন্যে আমি একা, সামনে ওই প্রকাণ্ড ছায়াসম হাত, বস্তুময় গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক কণা অকিঞ্চিৎকর ধুলোর মতো পড়ে রয়েছে ওই হাতের নিচে। তর্জনীতে ঝকঝক করছে একটা আংটি। আংটির কিনারায় চিকমিক করছে এক কণা অলো–যে ব্রহ্মাণ্ড ছেড়ে এলাম–ওই ব্রহ্মাণ্ড। মুঠোয় ধরা বস্তুটাকে দেখতে অনেকটা কালো ডান্ডার মতো। অনন্তকাল ধরে ভয়ে-বিস্ময়ে অসহায়ভাবে চেয়ে ছিলাম সেই হাত আর সেই ডান্ডার দিকে–কী যে ঘটবে এরপর, বুঝতে পারিনি। কেবলই মনে হচ্ছিল, ঘটবে না কিছুই, চেয়ে থাকতে হবে অনন্তকাল ধরে এইভাবে কোনওদিনই বুঝব না ওই হাত আর ওই ডান্ডার তাৎপর্য, কেন ওই উপস্থাপন, কীসের ছায়া। আমার সত্তাহীন নৈর্ব্যক্তিক সত্তায় থেকে যাবে শুধু যা অমোঘ, যা আদি এবং অন্তহীন–তারই উপস্থিতি। বৃহত্তর অন্য কোনও সত্তার ওপরে এই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা প্রতিসরিত আলোককণা কি না, এ প্রশ্নের জবাবও পাব না কোনওদিন। কোনওদিনই জানব না এই রবি-শশী-তারাভরা বিশাল ব্ৰহ্মাণ্ড আরেকটা ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণুমাত্র কি না, সেই ব্রহ্মাণ্ডটাও হয়তো আরেকটা ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণু। এবং সে ব্রহ্মাণ্ডও আরেক ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণু ছাড়া কিছুই নয়। এইভাবেই কি চলছে সৃষ্টির পরম্পরা? কে জবাব দেবে এই প্রহেলিকার? আমিই বা কী? বাস্তবিকই কি অ-বস্তু? আমার চারদিকে একটা দেহ দানা বেঁধে উঠছে যেন মনে হল–খুবই আবছা উপলব্ধি। নারকীয় তমিস্রার মধ্যে ওই হাত যে ইঙ্গিত বহন। করছে, নিশ্চিতভাবে তা বুঝলাম না। হৃদয়ভাব দিয়ে শুধু টের পেলাম, নিরাকারের মধ্যে থেকে অনেক আকার তৈরি হয়ে যাচ্ছে… কাঁপছে… দুলছে… আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।

ঘণ্টাধ্বনির মতো একটা শব্দ শুনলাম। ক্ষীণ শব্দ। যেন অসীমের ওপার থেকে ভেসে আসা শব্দ–নিরেট তমিস্রা ফুঁড়ে আসতে হচ্ছে বলে, এত অস্পষ্ট। আবার… আবার সেই ঘণ্টাধ্বনি… অনুধ্বনিত হচ্ছে সুগম্ভীর শব্দে… অনুকম্পন আর অনুরণন কাঁপছে একটি ঘণ্টাধ্বনি থেকে আরেকটি ঘণ্টাধ্বনির অন্তর্বর্তী সময়ে। সেই সঙ্গে মনে হল যেন শক্তভাবে ডান্ডা চেপে ধরল হাতটা। হাতের অনেক ঊর্ধ্বে, অন্ধকারের মধ্যবিন্দুতে দেখলাম একটা আলোকবৃত্ত–অস্পষ্ট ফসফরাস-দ্যুতির মতো। ভৌতিক বর্তুলের মতো আলোক-গোলকের মধ্যে ধুক ধুক করে শব্দনাদ সৃষ্টি করে চলেছে ঘণ্টাধ্বনি। শেষ ধ্বনিটার সঙ্গে সঙ্গেই অদৃশ্য হয়ে গেল হাতখানা। বুঝলাম, সময় হয়েছে নিকট। শুনলাম বিপুল জলোচ্ছাসের গুরুগম্ভীর দূরায়ত গর্জন। মহাকাশের বুকে বিশাল পটির মতো কিন্তু স্থির হয়ে রইল কালো ডান্ডাটা। তারপরেই মহাশূন্যের দূরতম প্রান্ত পর্যন্ত ধেয়ে গেল একটা কণ্ঠস্বর অবসান ঘটল যন্ত্রণার।

তৎক্ষণাৎ অসহ্য হর্ষ-উল্লাসের আবর্তে মুহ্যমান হয়ে গেলাম। দেখলাম, উজ্জ্বল হয়ে উঠছে চকচকে সাদা বৃত্তটা, চেকনাই ছড়াচ্ছে কালো ডান্ডাটা, স্পষ্ট পরিষ্কার হয়ে উঠছে আরও অনেক কিছু। বৃত্তটা হয়ে গেল ঘড়ির ডায়াল, ডান্ডাটা আমার খাটের রেলিং। হ্যাডনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আমার পায়ের দিকে রেলিং-এর পাশে–হাতে একটা ছোট কাঁচি। ঘাড়ের ওপর দিয়ে ম্যান্টেলে রাখা ঘড়ির ডায়ালে দেখা যাচ্ছে, কাঁটা দুটো এক হয়ে গিয়ে খাড়া হয়ে রয়েছে বারোটার ঘরে। আটকোনা টেবিলে কী যেন ধুচ্ছে। মোত্রে, পাঁজরে অনুভব করলাম একটা চাপা অনুভূতি–যাকে যন্ত্রণা বলা যায় না কোনওমতেই।

সাঙ্গ হয়েছে অপারেশন। আমি মরিনি। আচম্বিতে উপলব্ধি করলাম, আধখানা বছর জুড়ে থাকা চাপা বিষাদবোধও তিরোহিত হয়েছে মনের ভেতর থেকে।

ইপাইওরনিস আইল্যান্ড রহস্য

ইপাইওরনিস আইল্যান্ড রহস্য (Epyornis Island)

[‘ÆpyornisIsland’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায়। ১৯০৫ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘Pearsons Magazine’ পত্রিকায়। ১৮৯৫ সালে লন্ডনের ‘Methuen & Co.’ থেকে প্রকাশিত ওয়েলসের প্রথম ছোটগল্পের সংকলন ‘The Stolen Bacillus and Other Incidents’-তে গল্পটি স্থান পায়।]

একে তো ওই ষণ্ডা চেহারা, তার ওপর চোয়াড়ে মুখজোড়া বিরাট কাটার দাগ। দেখলেই গা শিরশির করে।

টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে আমার পুঁটলির দিকে তাকিয়ে সে বললে, অর্কিড চারা মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ।

সাইপ্রিপেডিয়াম নিশ্চয়?

বেশির ভাগ তা-ই।

নতুন কিছুই পাননি। পঁচিশ… না, না, সাতাশ বছর আগে ও দ্বীপের সব দেখে এসেছি। কতই বা বয়স তখন। উড়ে উড়ে বেরিয়েছি। কাঁচা বয়সে যা হয় আর কী। দুবছর ছিলাম ইস্ট ইন্ডিজে, ব্রাজিলে সাত বছর। তারপর গেলাম মাদাগাসকারে।

জনাকয়েক অভিযাত্রীর নাম আমার জানা আছে। কার চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন?

ডসন-এর। বুচার নামটা জানা আছে?

বুচার? খুবই চেনা-চেনা মনে হল নামটা। তারপরেই মনে পড়ে গেল বুচার বনাম ডসন মোকদ্দমা-কাহিনি–আচ্ছা! আপনিই তাহলে বুচার! চার বছরের মাইনে আদায় করেছিলেন মামলা ঠুকে দিয়ে। চার বছর মরুদ্বীপে পরিত্যক্ত থাকার মাইনে–

মাথা নুইয়ে সবিনয়ে অভিবাদন জানিয়ে ষণ্ডা বুচার বললে, খুবই মজার মামলা, তা ই না? চার-চারটে বছর দ্বীপে আটক ছিলাম, চাকরি থেকে জবাব দিতেও পারেনি। বছর বছর মাইনের টাকা জমা হয়েছে, দ্বীপে বসে আমি তার হিসেব রেখেছি।

ইন্টারেস্টিং।

খুবই। ইপাইওনিস নামটা নিশ্চয় শুনেছেন?

একটু একটু। মাসখানেক আগে অ্যান্ড্রুজ বলছিল। গবেষণা করছে একটা প্রজাতি নিয়ে, শোনার পরেই পাড়ি দিয়েছিলাম সমুদ্রে। একখানা মাত্র ঊরুর হাড় নিয়ে কেন যে এত পাগলামি।

ঊরুর হাড়?

হ্যাঁ। গজখানেক লম্বা। যার হাড়, সে নাকি দৈত্য বললেই চলে।

দৈত্য তো বটেই। সিন্দবাদের কিংবদন্তি এদের নিয়েই লেখা হয়েছে। কবে পেয়েছিল হাড়খানা?

বছর তিন-চার আগে। একানব্বইতে। কেন বলুন তো?

কেন মানে? ও হাড় তো আমিই আবিষ্কার করেছিলাম, বিশ বছর আগে। মাইনে নিয়ে ডসন কাদা ছোঁড়াছুড়ি না করলে ওই একখানা হাড়ের দৌলতেই মাতব্বর হয়ে যেতে পারত।

পেলেন কী করে?

হঠাৎ। নৌকোটা যে অমনভাবে নিজের খেয়ালে ঠিক ওই দ্বীপটাতে ভাসতে ভাসতে গিয়ে ঠেকবে, তা তো জানতাম না। আস্তানানারিভো থেকে প্রায় নব্বই মাইল উত্তরে সে বিরাট একটা জলাভূমি।

অ্যান্ড্রুজ তো বলছিল, জলা জায়গায় পাওয়া গেছে হাড়খানা।

পূর্ব উপকূলে আছে জায়গাটা। আপনার চোখে পড়েনি। জলের গুণেই হোক কি যে কারণেই হোক, পচন ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে না। গন্ধটা অনেকটা আলকাতরার মতো। ত্রিনিদাদের কথা মনে পড়ে যায়। ডিম পেয়েছিল আপনার বন্ধুরা? আমি পেয়েছিলাম। লম্বায় দেড় ফুটের মতো। গোল হয়ে ঘুরে গিয়ে জলাভূমি ঘিরে রেখেছে পুরো তল্লাটটাকে। বেশির ভাগই নুন। কপালজোরে পেয়ে গিয়েছিলাম ডিমগুলো। গিয়েছিলাম অবশ্য ডিম খুঁজতেই; দুজন কালা আদমি ছিল সঙ্গে। খানকয়েক ক্যানো নৌকো একসঙ্গে পাশাপাশি বেঁধে নিয়েছিলাম। তাঁবু ছিল সঙ্গে। ছিল চার দিনের খাবারদাবার। জমি যেখানে মোটামুটি শক্ত, কাদা কম, তাঁবু পেতেছিলাম সেখানে। সে কী গন্ধ মশায়! এখনও নাকে লেগে রয়েছে। দিনরাত ওই আলকাতরার গন্ধ সইতে হয়েছে। কাজটা কিন্তু মজার। লোহার শিক নিয়ে কাদা খোঁচানো, বাস! ওভাবে খোঁচাখুঁচি করলে ডিম কি কখনও ব্যস্ত থাকে? ডিম ফুটে কবে তারা শেষবারের মতো দাপিয়ে বেড়িয়েছিল দ্বীপময়, কালা আদমিদের কিংবদন্তি থেকে নাকি তা জানা যায়। কথাটা মিশনারিদের। আমি কিন্তু মশাই কোনও গল্পই শুনিনি। জীবন্ত ইপাইওরনিস কোনও ইউরোপীয়ের চোখে পড়েনি আজও। ১৭৪৫ সালে ম্যাকার নাকি মাদাগাসকার গিয়ে দেখেছিলেন। কিন্তু তা বিশ্বাস করতে মন চায় না। আমি কিন্তু তাজা ডিম পেয়েছিলাম। যেন সদ্য-পাড়া। এক্কেবারে টাটকা! নৌকোয় বয়ে আনতে গিয়ে পাথরে পড়েই মাস করে চৌচির একখানা। কী মিষ্টি গন্ধ মশায়, টাটকা ডিমে যেমন হয়। বাসি হলে পচা গন্ধ বেরত। অথচ ধরুন ডিম বেরিয়েছে যার পেট থেকে, সে অক্কা পেয়েছে চারশো বছর আগে। সারাদিন গেল কাদা ঘেঁটে ডিম বার করতে। মেজাজ খিঁচড়ে তো যাবেই। তবে হ্যাঁ, ডিমের মতো ডিম পেয়েছিলাম বটে। পরে লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে গিয়ে দেখেছিলাম খানকয়েক ডিম। চটা-ওঠা, খোলা-ভাঙা, ফুটিফাটা। আমার ডিমের মতো নয়, চিড় পর্যন্ত খায়নি খোলায়।

এই পর্যন্ত বলে মাটির পাইপ বার করেছিল বুচার। তামাকের থলি রেখেছিলাম সামনে। অন্যমনস্কভাবে পাইপে তামাক ভরতে ভরতে সে বলেছিল, মোট তিনটে আস্ত ডিম পেয়েছিলাম। বিলকুল তাজা, নৌকোয় রেখে ডাঙায় নেমেছিলাম তাঁবুতে বসে এক মগ কফি বানিয়ে খাব বলল। ভুল করেছিলাম সেইখানেই।

কেন?

যে কালা আদমিটার হাত ফসকে আস্ত একখানা ডিম পড়ে ফুটিফাটা হয়েছিল, তাকে পিটিয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছিলাম রাগের মাথায়। রাগলে আমি চণ্ডাল, কী করি বলুন। তা-ই বলে শোধ নেবে ওইভাবে? ভাবতেও পারিনি। কেটলিতে জল ফুটছে, মজাসে পাইপ টানছি–দুচোখ ভরে দেখছি জলাভূমির ওপর সূর্যাস্ত। সে এক খাসা দৃশ্য মশায়। সামনে লাল আকাশ, ধূসর পাহাড়, পেছনে কালো কাদা। মনে মনে হিসেব করছি, নৌকোয় আছে তিন দিনের মতো খাবার আর এক পিপে জল। ভয়ের কিছু নেই। এমন সময়ে একটা শব্দ কানে ভেসে এল। চোখ ফিরিয়ে দেখি, নৌকো নিয়ে হারামজাদারা সরে গেছে ডাঙা থেকে। বিশ গজ দূরে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম মতলব কী শয়তানের বাচ্চাদের। বন্দুক একটা আছে বটে তাঁবুতে–কিন্তু বুলেট নেই–পাখি-মারা ছররা আছে। হারামজাদারা তা জানে। তবে একটা ছোট রিভলভার ছিল পকেটে। টেনে বের করে দৌড়ালাম সমুদ্রের ধারে। তুলে ধরে হেঁকে বললাম ফিরে আসতে। কিন্তু কাজ হল না। উলটে সে কী টিটকিরি মশায়! হাড় জ্বলে গেল আমার। দিলাম দমাদম গুলি চালিয়ে। নৌকো তখন পঞ্চাশ গজ দূরে। কিন্তু এক বেটাকে ফেলে দিলাম জলে। আর-একটা মুখ গুঁজরে শুয়ে পড়ল খোলে। দাঁড়টাও ভেসে গেল জলে।

গলাবাজি করে কোনও লাভ নেই জেনে, জামাকাপড় খুলে, দাঁতে ছুরিখানা কামড়ে নিয়ে লাফ দিলাম জলে। সাঁতরে উঠব নৌকোয়–নৌকো যদিও ততক্ষণে বেশ দূরে। জলে হাঙর আছে জানি–সেই ভয়ে তো এই বিজন দ্বীপে একলা পড়ে থাকতে পারি না। যে নৌকোয় দাঁড় নেই, তা স্রোতের টানে কোনদিকে ভেসে যাবে, আঁচ করে নিয়ে সাঁতরে চললাম সেইদিকেই। নৌকো অবশ্য তখন দেখা যাচ্ছে না। দেখতে দেখতে রাত ঘনিয়েও এল, কালো কালির মতো অন্ধকারে ঢেউয়ের ডগায় সে কী ফসফরাসের আলো। চোখ ধাঁধিয়ে যায়! মাথার ওপর তেমনি তারার আলো। একটু পরেই দেখলাম কালো জমাট ছায়া। নৌকো। তলায় ঢেউ আছড়ে পড়ছে–

ফসফরাসের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। চুপিসারে গেলাম কাছে। ভেবেছিলাম, ছুরি চালানোর দরকার হবে। কিন্তু হাত গন্ধ করতে হল না। মুখ গুজরে যে বেটা খোলে লটকে পড়েছিল –আমার গুলিতেই তার প্রাণটা বেরিয়ে গেছে। লাশটা ফেলে দিলাম জলে।

খানকয়েক বিস্কুট আর জল খেয়ে একটু ঝিমুনি এসেছিল। ভোর হল, ডাঙার চিহ্ন কোনওদিকে দেখলাম না। দূরে একটা পালতোলা জাহাজের মাস্তুলের ডগাটুকুই কেবল দেখা গেল–দূরেই তা মিলিয়ে গেল। মাথার ওপর সূর্য আসতেই চড়া রোদে প্রাণ যায় আর কী। বিস্কুট মোড়া ছিল একটা খবরের কাগজে। জীবনে কাগজ পড়ি না মশায়। জঘন্য! সেদিন কিন্তু কাজে দিল কাগজখানা। মাথায় ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। বার কুড়ি পড়েও ফেললাম। তা সত্ত্বেও ফোঁসকা পড়ে গেল সারা গায়ে।

দিন দশেক কষ্ট সয়েছি এইভাবে। কী মারাত্মক রোদ! চোখ মেলে তাকাতেও পারিনি। ভোরবেলা আর বিকেলবেলা দেখতাম, জাহাজ-টাহাজ দেখা যায় কি না। দেখেওছিলাম– দুবার। গলাবাজি করেও কাউকে কাছে আনতে পারিনি। দ্বিতীয় দিন একটা ডিম ভেঙে খাওয়া আরম্ভ করেছিলাম। একটু গন্ধ থাকলেও খারাপ নয়। অনেকটা হাঁসের ডিমের মতো। হলদে কুসুমের একপাশে ইঞ্চি ছয়েক লম্বা এক ধ্যাবড়া দাগ দেখেছিলাম। সরু সরু সুতোর মতো রক্ত আর মইয়ের মতো কী যেন ছিল তাতে–অদ্ভুত। মানে বুঝতে পারিনি তখন–পরে পেরেছিলাম। তিন দিন ধরে খেয়েছিলাম ওই একখানা ডিম–বিস্কুট আর জলের সঙ্গে। আট দিনের দিন আর-একখানা ডিম ভাঙবার পর খাড়া হয়ে গেল গায়ের লোম। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। ডিম ফুটছিল একটু একটু করে। বিশ্বাস করা যায় না। আমার কিন্তু হয়েছিল। চোখের সামনে দেখে বিশ্বাস না করে পারা যায়? তা ধরুন শতিনেক বছর কালো কনকনে কাদায় পোঁতা ছিল ডিমখানা–একদম নষ্ট হয়নি–এখন বাচ্চা তৈরি হচ্ছে রোদের তাতে। জ্বণই তো বলে?–জ্বণের মধ্যে বিরাট মাথা আর বাঁকা পিঠ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, গলার নিচে হৃৎপিণ্ড ধুকধুক করছে, কুসুম শুকিয়ে আসছে, মস্ত পাতলা পরদা খোলার ভিতরে ছড়িয়ে পড়ছে, কুসুম ঢেকে ফেলছে। কী কাণ্ড বলুন তো! ভারত মহাসাগরের ঠিক মধ্যিখানে ডিমে তা দিচ্ছি! পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখি যারা ছিল, তাদেরই একজনের ডিম–কোনকালে লোপ পেয়েছে, কিন্তু ডিম ফুটে বাচ্চা বেরচ্ছে আমার সামনে! ডসন যদি জানত, চার বছরের মাইনে এককথাতে বার করে দিত! তা-ই না?

তা-ই বলে খেতেও ছাড়িনি। আধফোঁটা বাচ্চাকেই খেয়েছি একটু একটু করে। বিতিকিচ্ছিরি খেতে। তৃতীয় ডিমটাকে আর ভাঙিনি। রোদ্দুরের সামনে তুলে ধরেছিলাম। খোলার মধ্যে দিয়ে কিছু দেখতে পাইনি। তবে রক্তচলাচলের শব্দ যেন শুনতে পেয়েছিলাম। কানের ভুলও হতে পারে।

তারপর পেছোলাম অ্যাটলে। চাকার মতো প্রবালদ্বীপ-মাঝখানে উপহ্রদ। তখন সূর্য উঠেছে অ্যাটলের সামনে। আধ মাইল পথ হাতে করে দাঁড় টেনেছিলাম, কখনও ডিমের ভাঙা খোলা দিয়ে। স্রোতের টান নৌকোকে অন্যদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। মরিয়া হয়ে জল কেটে নৌকো নিয়ে গেলাম তীরে। মামুলি অ্যাটল। ডাঙায় নেমে দেখলাম গোটাকয়েক গাছ, একপাশে একটা ঝরনা, হ্রদ বোঝাই কাকাতুয়া-মাছ। একপাক ঘুরে এলাম, মোটে মাইল চারেক। ডিমটাকে ডাঙায় রাখলাম রোদের তাতে বালির ওপর, জল সেখানে পৌঁছায় না। নৌকোটাকে টেনে তুলে রেখেছিলাম আগেই। তারপর শুরু হল রবিনসন ক্রুসোর জীবন। ছেলেবেলায় ভাবতাম খাসা জীবন। এখন দেখলাম জঘন্য। একঘেয়ে। খাবার খুঁজতে খুঁজতেই গেল প্রথম দিনটা। দিনের শেষে ঝড় উঠল, বৃষ্টি নামল রাতে।

ঘুমাচ্ছিলাম ক্যানোর তলায়। কপাল ভালো, ডিমটা ছিল অনেক উঁচুতে, বালির ওপর। হঠাৎ একটা ভয়ানক শব্দ শুনলাম। যেন একশো নুড়িপাথর আছড়ে পড়ল ক্যানোর গায়ে। ঢেউ চলে গেল মাথার ওপর দিয়ে। স্বপ্ন দেখছিলাম। আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় অন্ধকারে হাতড়েছিলাম চেয়ার আর দেশলাই। তারপরেই খেয়াল হল, আছি কোথায়। ফসফরাস জ্বলা ঢেউ যেন গিলে খেতে আসছে। আলো আর কোথাও নেই, আকাশ কালোকালির মতো রাত। বাতাস চেঁচিয়ে যাচ্ছে গলা ফাটিয়ে। মেঘ ঝুলে পড়েছে, মাথায় ঠেকে আর কী। বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে, আকাশ যেন ফুটো হয়ে গেছে। আগুন সাপের মতো কিলবিল করে বিরাট একটা ঢেউ তেড়ে এল আমাকে পেটে পুরতে। ভোঁ দৌড় দিলাম তক্ষুনি। ঢেউ যখন নেমে যাচ্ছে ফোঁস ফোঁস করে, ফিরে এলাম ক্যানোর কাছে। কিন্তু কোথায় ক্যানো? ডিমটাকে কিন্তু ঢেউ ধরতে পারেনি। ওই ডিমের পাশেই গুটিসুটি মেরে বসে কাটিয়ে দিলাম রাত। সে কী রাত! এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, এই দেখুন।

ভোর হল। ঝড় থামল। বালির ওপর নৌকোর কঙ্কালটাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখলাম। কুড়িয়ে আনলাম তক্তাগুলো। দুটো লাগোয়া গাছের ওপর পেতে বানিয়ে নিলাম ছাউনি। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরল সেইদিনই।

আমি তখন ঘুমিয়ে কাদা ডিমটাকেই মাথার বালিশ করে। হঠাৎ খটাং করে একটা আওয়াজে চটকা ভাঙল। ঝাঁকুনি লাগতেই ধড়মড় করে উঠে বসেছিলাম। দেখি কী, খোলা ফুটো হয়ে গেছে। ফাঁক দিয়ে একটা কদাকার বাদামি মুন্ডু আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। খাতির করে ডেকেছিলাম, এসো বাবা এসো, দুদু দেব, মাছ দেব, টুকুটুকু এসো। শুনেই খুটুর খুটুর করে সে বেরিয়ে এল বাইরে।

প্রথমদিকে মনের মতোই সঙ্গী পেয়েছিলাম। আকার-আয়তনে ছোট্ট মুরগি বললেই চলে। পাখির ছানার মতোই দেখতে–একটু যা সাইজে বড়। গোড়ায় পালক ছিল নোংরা বাদামি রঙের, ধুলো-রঙের মামড়ি একটু ছিল, খসে গেল দুদিনেই। দেখা গেল চুলের মতো পালক। নাম দিলাম তার ফ্রাইডে। রবিনসন ক্রুসোর ফ্রাইডে ছিল মানুষ-সঙ্গী। আমার ফ্রাইডে হল তিনশো বছর আগেকার দানব-পাখির ছানা। কুৎসিত। গা ঘিনঘিন করেছিল ঠিকই। কিন্তু মুরগির মতোই ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে ক্যাঁ-কোঁ আওয়াজ করে খাবার খুঁটতে শুরু করতেই মনটা হু-হুঁ করে উঠেছিল। আহা রে, মা নেই, বাবা নেই। খাবার জোগাতে হবে তো আমাকেই। ল্যাগুন থেকে কাকাতুয়া-মাছ ধরে এনে খেতে দিয়েছিলাম। দিতে-না দিতেই শেষ। আরও চাই। ঠোঁট ফাঁক করে সে কী লাফাই। মজা পেয়েছিলাম। তেমন। বুঝলে ওকেই খাওয়া যাবে। বড় হোক।

দিনরাত ঘুরত সঙ্গে ন্যাওটার মতো। মাছ ধরতাম, যখন পাশে দাঁড়িয়ে দেখত। যা মাছ উঠত, তার বখরা নিত–আমাকেও দিত। বালির ওপর একরকম আচারের শসার মতো ছোট শসা গজাত এন্তার। গায়ে ছোট ছোট আঁচিল। একদিন একটা ঠুকরেই এমন মেজাজ খিঁচড়ে গেল যে, আর এদিক মাড়ায়নি। ইন্টারেস্টিং, তা-ই না?

দিনে দিনে বেড়ে চলল ইপাইওনিস ছানা। রোজই দেখতাম যেন বাড়ছে একটু করে। দুবছর দেখেছিলাম এইভাবে। বেশ সুখে ছিলাম মশায়। কাজকর্ম নেই, মাথাব্যথাও নেই। মাইনে জমা পড়ছে ডসনের অফিসে। সময় কাটানোর জন্য দ্বীপটাকে সাজাতাম মনের মতো করে। শামুক, ঝিনুক, গেঁড়ি কুড়িয়ে এনে বালির ওপর সাজিয়ে লিখেছিলাম দ্বীপের নাম–ইপাইওরনিস আইল্যান্ড। দ্বীপের সব দিকেই। তারপর শুয়ে শুয়ে দেখতাম, জাহাজ টাহাজ আসে কি না। আশপাশে ঝাঁপাই জুড়তে দৈত্য-পাখির ছানা। বাড় দেখে অবাক হতাম। যত দিন যাচ্ছে, ততই খোলতাই হচ্ছে চেহারাটা। মাথায় নীল ঝুঁটি গজাল চোখের সামনেই, সবুজ পালক গজালো পেছনে। ঝড়বৃষ্টির সময়ে ছাউনির তলায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে থেকেছি কত দিন কত রাত। ঝড়বৃষ্টি থামলে আবার টহল দিতে বেরিয়েছি। যদি কিছু ভেসে আসে, এই আশায়; এই দুবছরে মাঝে মাঝে পালের ডগা চোখে পড়েছে। –কিন্তু দ্বীপের দিকে আসেনি কোনও জাহাজ।

বড় সুখে ছিলাম। স্বর্গসুখ বললেই চলে। তামাক ছিল না, এইটুকুই যা দুঃখের। কিন্তু এত সুখ সইল না। দ্বিতীয় বছরের শেষাশেষি কপাল ভাঙল। ফ্রাইডে তখন মাথায় চোদ্দো ফুট উঁচু। গাঁইতির ফলার মতো ইয়া মুন্ডু ঘাড়ের ওপর। মস্ত দুটো বাদামি চোখ। চোখ ঘিরে হলুদ আংটি। ঠিক মানুষের চোখের মতোই কাছাকাছি চোখ, কিন্তু মুরগির চোখের মতো দুদিকে সরানো নয়। মিহি পালক-অস্ট্রিচের পালকের মতো কর্কশ নয়। রং আর পালক দুটোই নিউ গিনির ক্যাসয়ারি বা এমু পাখির মতো অনেকটা।

কিন্তু রক্তে যার বেইমানি রয়েছে, তার বাইরে দেখে কি চেনা যায়? চেহারা যত খোলতাই হয়েছে, গায়েগতরে ভারী হয়েছে আমারই হাতে খেয়ে, ততই তিরিক্ষে হয়েছে। মেজাজ। ঘাড় বেঁকিয়ে কিনা তেড়ে আসে আমাকেই? নেমকহারাম কোথাকার!

একদিন হিমশিম খেয়ে গেলাম মাছ ধরতে গিয়ে। মাছ আর পাই না–এদিকে হারামজাদা ইপাইওরনিস সমানে ঘুরঘুর করছে আমার পাশে–মনে মনে যেন একটা মতলব আঁটছে। খিদেয় পেট জ্বলছে বুঝতে পারছি, সমুদ্রের শসা তো পড়ে রয়েছে– খেলেই হয়। শয়তানের বাচ্চার আবার তা মুখে রোচে না। অনেক কষ্টে পেলাম একখানা মাছ। পেট চুইচুই করছে আমারও। তাই ভাগ দিতে চাইনি। আরে সব্বনাশ! হোঁয়াক করে কিনা তেড়ে এসে কামড়ে নিল মাছখানা, হ্যাঁচকা টান মেরে কেড়ে নিয়ে মাথায় এক ঘা কষিয়ে দিয়েছিলাম। বাস–সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর।

মুখখানা দেখুন। আচমকা রামঠোক্করেই এই কাণ্ড। এ কাটার দাগ জীবনে আর মেলাবে? ঠোক্কর মেরেও রেহাই দিল না। কী করল জানেন? ধাঁই করে সে কী লাথি! ঘোড়ার চাট সে তুলনায় কিছুই নয়। ঠিকরে পড়েই লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছিলাম। ফের তেড়ে আসছে দেখেই দুহাতে মুখ ঢেকে দৌড়েছিলাম পাঁইপাঁই করে। কিন্তু কী বলব মশায়, হারামজাদা পক্ষিরাজের মতো সাঁইসাঁই করে তেড়ে এল। রেস-হর্সও অত জোরে ছুটতে পারে না। তারপরেই শুরু হল রামধোলাই। উফ! লাথির পর লাথি–সেই সঙ্গে ঠোক্করের পর ঠোক্কর! এক-একখানা লাথি দুরমুশের মতো যেন হাড়গোড় গুঁড়িয়ে দিতে লাগল–আছড়ে আছড়ে ফেলতে লাগল এক-একদিকে–সেই সঙ্গে পিঠের ওপর চলল গাঁইতি ঠোঁটের ধারালো ঠোক্কর। কোনওমতে ঠিকরে গিয়ে পড়েছিলাম ল্যাগুনের জলে– গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে পড়েছিলাম। হারামজাদা বেল্লিকের বাচ্চা জলে নামবে না জানি গা ভিজে যাবে যে! সে কী ঝাঁপাই। চিৎকারটা অনেকটা ময়ূরের ডাকের মতো, তবে সাংঘাতিক চড়া। সহ্য করা যায় না। ঝুঁটি উঁচিয়ে শুরু হল পায়চারি বালির ওপর, যেন নবাবপুত্তুর। না বলেও পারছি না, খানদানি টহল দেখে নিজেকে বড় ছোট মনে হয়েছিল। ওরকম লর্ড স্টাইলে হাঁটা আমার দ্বারা জীবনে হবে না। দেখছি আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। সারা শরীর থেঁতলে দিয়েছে শয়তানের বাচ্চা, দরদর করে রক্ত পড়ছে মুখের এই কাটা থেকে।

কাটাছেঁড়া থেঁতলানির যন্ত্রণাকেও ছাপিয়ে উঠল মনের যন্ত্রণা। ডিম ফুটিয়ে যাকে জন্ম দিলাম, খাইয়েদাইয়ে এতটা বড় করলাম, তার কাছে এইরকম নেমকহারামি আশা করতে পারিনি। বেটাছেলের মেজাজ ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত কোথাও ঘাপটি মেরে বসে থাকা দরকার বুঝলাম। সাঁতরে গেলাম একটা লম্বা তাল গাছের তলায়। ডগায় উঠে বসে রইলাম চোরের মতো। ভাবুন তখন আমার মনের অবস্থাটা! একটা বেইমানের ভয়ে জুজু হয়ে বসে রয়েছি বিজন দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু গাছের ডগায়! মানুষের বাচ্চা আমি। চারশো বছর আগে লোপ পেয়ে-যাওয়া একটা পাখির বাচ্চার ভয়ে কাঁপছি ঠকঠক করে।

ভেবেছিলাম, মেজাজ ঠান্ডা হলেই শয়তানের বাচ্চা সব ভুলে যাবে। ব্রেন আর কতটুকু। তারপর মওকা বুঝে নেমে আসব। মাছ নিয়ে আস্তে আস্তে কাছে গেলেই আহ্লাদে আটখানা হবে। আবার আগের মতো সবকিছু হয়ে যাবে। কিন্তু হাড় বদমাশটার হাড়ে হাড়ে যে শয়তানি আর কুচুটেপনা–তা তখনও বুঝিনি। নেমকহারামির জন্যে লজ্জা পাওয়া দূরে থাক, বিটলে বাচ্চার রক্তে ক্ষমাঘেন্না জিনিসটা যে একেবারেই নেই, সে শিক্ষা হল বড় কষ্টের মধ্যে দিয়ে।

মাথা খাটিয়ে অনেক ফিকির, অনেক কায়দা আবিষ্কার করেছিলাম বেল্লিকটাকে বশ করতে। সব আর বলব না। কিন্তু হার মেনেছি প্রতিবারেই। নরকের পোকা কোথাকার! এখনও ভাবলে লজ্জায় মাথা হেট হয়, গাল লাল হয়! শেষকালে খোশায়োদ ছেড়ে মারধর করেছিলাম। প্রবালের ডেলা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতাম দূর থেকে। কোঁত কোঁত করে গিলে ফেলত। খোলা ছুরি টিপ করে ছুঁড়ে ছিলাম। বড় ছুরি বলে গিলতে পারেনি–কিন্তু ছুরি ফিরিয়ে আনতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। না খাইয়ে মারবার মতলব এঁটেছিলাম। মাছ ধরাই ছেড়ে দিলাম, হারামজাদা অল্প জলে নেমে পোকা খুঁটে খুঁটে খেতে আরম্ভ করল। অর্ধেক সময় গলা-জলে ডুবে বসে থাকতাম, বাকি অর্ধেক তাল গাছের ডগায়। একটা গাছ ছিল পেল্লায় উঁচু। শয়তানের বাচ্চা একদিন সেখানেও নাগাল ধরে ফেলল। ঠোক্কর মেরে আমার পায়ের ডিম থেকে এক চাকলা মাংস খুবলে নিয়ে গেল। সে কী অসহ্য যন্ত্রণা! ওই অবস্থায় তাল গাছে ঘুমানো যায়? আপনি পারবেন? সারারাত দুঃস্বপ্ন দেখেছি, চমকে চমকে উঠেছি।

কী লজ্জা! কী লজ্জা! আমারই দ্বীপে রাজার মতো হেলেদুলে টহল দিচ্ছে লোপ পেয়ে যাওয়া একটা জানোয়ার, পায়ের চেটো ছোঁয়াতে দিচ্ছে না মাটিতে। লজ্জার মাথা খেয়ে বলছি, শেষকালে কান্নাকাটিও করেছি ক্লান্তিতে। আশা মিটিয়ে গালাগালও দিয়েছি। এ কী নষ্টামি? আমারই দ্বীপে আমাকে তাড়িয়ে গাছের ডগায় তুলে দেওয়া! জাহান্নমে যেতে বলেছি যতবার, ততবারই তেড়ে এসে এমন ঠোক্কর মেরেছে যে, পালাবার পথ পাইনি। ভয়ে কাঁটা হয়ে থেকেছি খোদ শয়তান–পাখি না কচু! দেখতে যেমন জঘন্য, স্বভাব চরিত্রও তা-ই? ছি! ছি!

এই অবস্থা বেশি দিন চলতে পারে না। বেদম হয়ে পড়েছিলাম। শেষে মাথায় খুন চাপল। দক্ষিণ আমেরিকায় দড়ির ফাঁস ছুঁড়ে যেভাবে জানোয়ার ধরে, সেইভাবে হারামজাদাকে কুপোকাত করব ঠিক করলাম। মাছ ধরার দড়ি যা কিছু ছিল, সব একটার পর একটা বাঁধলাম। লম্বায় হল প্রায় বারো গজ। একদিনে হয়নি। ল্যাগুন থেকে লম্বা লম্বা ঘাস আর আঁশ তুলে কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি জলে, কখনও গাছের ডগায়। তারপর দুটো বড়সড়ো প্রবালের টুকরো বাঁধলাম দড়ির ডগায়। গলা-জলে ডুবে বসে থেকে মাথার ওপর বনবন করে ঘুরিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিলাম শয়তানের বাচ্চার দিকে। জড়িয়ে গেল দুপায়ে। যত লাফায়, তত বেশি জড়ায়। শেষকালে উলটে পড়তেই উঠে এলাম জল ছেড়ে। ছুরি দিয়ে কাটলাম গলা…

ভাবলেও মনটা খারাপ হয়ে যায় আজও। মানুষ খুন করছি যেন মনে হয়েছিল। কিন্তু রাগে তখন মাথায় আগুন জ্বলছে। বালির ওপর রক্তের পুকুরে সুন্দর পা আর বাহারি গলা মুচড়ে যন্ত্রণায় ছটফটানির দৃশ্য আজও ভাসছে চোখের সামনে।

সেই থেকে নিঃসঙ্গতা অসহ্য হয়ে উঠল। ডিম থেকে বার করে যাকে বড় করেছিলাম, দিনের পর দিন কত মজার খেলা খেলে আমার নিঃসঙ্গতাকে যে ভরিয়ে রেখেছিল–সে না থাকায় খাঁ খাঁ করতে লাগল চারদিক। অসহ্য! অসহ্য! একেবারে মেরে ফেলাটা ঠিক হয়নি, জখম করলেই পারতাম। তারপর না হয় সেবাশুশ্রূষা করে আবার চাঙ্গা করে তোলা যেত। প্রবাল পাহাড় খোঁড়বার সরঞ্জাম ছিল না সঙ্গে। থাকলে, পাথর খুঁড়ে মানুষের মতোই তাকে কবর দিতাম। হতে পারে বেইমান জানোয়ার, আমি কিন্তু তাকে মানুষের মতোই দেখেছিলাম। ভালোবেসেছিলাম। মানুষের মাংস কি মানুষ খেতে পারে? আমিও পারিনি। জলে ফেলে দিয়েছিলাম। মাংস খেয়ে শুধু হাড়গুলো ফেলে গিয়েছিল মাছেরা। পালক পর্যন্ত রাখেনি। তারপর একদিন একটা পালতোলা জাহাজ হঠাৎ এসে গেল অ্যাটলে।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাছে উইন্সলো নামে একজন দোকানদারকে বেচে দিয়েছিলাম হাড়গুলো। সে বেচেছিল হ্যাঁভার্সকে। হ্যাঁভার্স লোকটা একটা আস্ত পাঁঠা, অত বড় হাড় দেখেও জিনিসটার কদর করতে পারেনি। তার মৃত্যুর পর হইচই আরম্ভ হল ইপাইওরনিসকে নিয়ে। নামটা দেওয়া হয়েছিল তখনই, তা-ই না? পুরো নামটা জানেন?

ইপাইওরনিস ভ্যাসটাস, বলেছিলাম আমি। গজখানেক লম্বা একখানা ঊরুর হাড় পাওয়া গিয়েছিল সবার আগে। এর চাইতে বড় হাড় আর নাকি হয় না। নাম দেওয়া হল ইপাইওরনিস ম্যাক্সিমাম। তারপর পাওয়া গেল সাড়ে চার ফুট লম্বা আর-একখানা উরুর হাড়। নাম দেওয়া হল ইপাইওনিস টাইটান। হ্যাঁভার্সের মৃত্যুর পরে পাওয়া গেল আপনার ভ্যাসটাস। তারপরেও পাওয়া গিয়েছিল ভ্যাসটিসিমাস।

মুখের কাটা দাগটায় হাত বুলিয়ে নিয়ে বুচার বললে, এখন বলুন তো মশায়, আমার সঙ্গে অমন জঘন্য ব্যবহারটা করা কি উচিত হয়েছে ইপাইওনিস ভ্যাসটাসের?

ক্রিস্টাল ডিম

ক্রিস্টাল ডিম ( The Crystal Egg)

[‘The Crystal Egg’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Pearsons Magazine’ পত্রিকায় ১৮৯৭ সালে। গল্পটি উল্লেখযোগ্য কারণ এর ঠিক এক বছর বাদে ওয়েলস ‘The War of the Worlds’ উপন্যাস হিসেবে প্রকাশ করেন, এবং এই গল্পের মঙ্গল গ্রহবাসীদের দেখতে অথবা তাদের মেশিনগুলির বর্ণনা একদম মিলে যায়। যদিও ‘The War of the Worlds’ এর মঙ্গল গ্রহবাসীদের পৃথিবী আক্রমণ নিয়ে এই গল্পে কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না, এই গল্পটিকে ‘The War of the Worlds’ জগতের পূর্বসুরি ধরা হয়। ‘Doubleday & McClure Co’. থেকে ১৮৯৯ সালে পেকাশিত হয় ‘Tales of Space and Time’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। সেপ্টেম্বর ১৯২৬ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘Amazing Stories’ পত্রিকায়।]

বছরখানেক আগেও ছিল দোকানটা। ছোট্ট এবং অত্যন্ত নোংরা। সেভেন ডায়ালস-এর কাছেই। রোদে-জলে ফিকে হয়ে এসেছিল হলুদ অক্ষরে লেখা নামটা:

–প্রকৃতিপ্রেমিক মি. কেভ।

–পুরানো জিনিসের দোকান।

শোকেসগুলোয় ঠাসা থাকত অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস। হাতির দাঁত, বেজোড় দাবার খুঁটি, পুঁতি, অস্ত্রশস্ত্র, এক বাক্স চোখ, দুটো বাঘের করোটি, একটা নরকরোটি, পোকায় খাওয়া কয়েকটা খড় আর কাঠের কুঁচো ঠাসা বাঁদর (একটা বাঁদর লম্ফ ধরে আছে), মান্ধাতার আমলের একটা ক্যাবিনেট, অস্ট্রিচের ডিম কয়েকখানা, মাছ ধরার কিছু সরঞ্জাম, একটা অসাধারণ নোংরা, শূন্য কাচের মাছ-চৌবাচ্চা।

ছিল আরও একটা বস্তু, এই গল্প শুরু হওয়ার সময়ে। ডিমের আকারে একতাল ক্রিস্টাল। খুব চকচকে পালিশ করা। দুই ব্যক্তি বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিল একদৃষ্টে। একজন পাদরি। লম্বা, শীর্ণ আকৃতি। অপরজন বয়সে তরুণ। গালে কালো দাড়ি। গায়ের রং কালচে। জামাকাপড় চোখে পড়ার মতো নয়।

ডিমটার দিকে এমনভাবে আঙুল তুলে দেখাচ্ছিল ছোকরা যেন কেনবার জন্যে পীড়াপীড়ি করছে পাদরিকে।

এমন সময়ে দোকানে এল মি. কেভ। সবে চা খেয়ে এসেছে। মাখন আর রুটি লেগে রয়েছে ঝোলা দাড়িতে৷ দুজন খদ্দের দাঁড়িয়ে ডিম দেখছে দেখেই ঝুলে পড়ল চোয়াল। চোরের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পেছনদিকে এবং আলতো করে ভেজিয়ে দিলে দরজা।

মি. কেভের বয়স হয়েছে। খর্বকায় পুরুষ। ফ্যাকাশে মুখ-চোখ দুটো অদ্ভুত নীল–যেন জল টলটল করছে। চুল ধূসর এবং ময়লা। গায়ে নোংরা ফ্রক-কোট। মাথায় মান্ধাতার আমলের টুপি। পায়ে গোড়ালি ক্ষয়ে চুন-হয়ে-যাওয়া কার্পেট-চটি।

শোকেসের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে দুজন–মি. কেভও চেয়ে আছে তাদের দিকে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠো খুচরো বার করে মুচকি হাসল পাদরি–ভাবখানা, কুলিয়ে যাবে এই পয়সাতেই। দেখেই কিন্তু আরও ঘাবড়ে যায় মি. কেভ। মুখ একেবারেই শুকিয়ে গেল দুই খদ্দের দোকানে ঢুকতেই।

গৌরচন্দ্রিকার ধার দিয়েও গেল না পাদরি–দাম জানতে চাইল ডিমটার। ভয়ে ভয়ে পেছনে অন্দরমহলের দরজায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে পাঁচ পাউন্ড দাম হাঁকল মি. কেভ।

এত দাম? হতেই পারে না।–সে কী রাগ পাদরির। হতে যে পারে না, তা কি জানে না মি. কেভ? জেনে-শুনেই হেঁকেছে চড়া দাম। ফলে শুরু হয়ে গেল দর কষাকষি।

কিন্তু কথা না বাড়িয়ে দোকানের দরজা খুলে ধরে মি. কেভ জানিয়ে দিলে, পাঁচ পাউন্ডের এক পাই কম হবে না।

ঠিক এই সময়ে অন্দরের দরজার ওপরকার কাঁচে দেখা গেল একটি স্ত্রী-মুখ। নির্নিমেষে চেয়ে আছে খদ্দের দুজনের দিকে। গলা কেঁপে গেল মি. কেভের।

এতক্ষণ চুপ করে দর কষাকষি শুনছিল ছোকরা। তীক্ষ্ণ চাহনি ঘুরছিল চারদিকে।

হঠাৎ বললে, পাঁচ পাউন্ডই দিন।

আপত্তি জানালে পাদরি। কিন্তু ধোপে টিকল না। ব্যাজার মুখে পকেট হাতড়ে দেখলে, তিরিশ শিলিং-এর বেশি হচ্ছে না। এই সুযোগে বোঝাতে লাগল মি. কেভ, ক্রিস্টাল ডিমটা নাকি বিক্রির জন্য নয়। বিক্রির জন্যে নয় তো দর হাঁকা হল কেন?–জানতে চায় দুই খদ্দের। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মি. কেভ বলে, বিকালেই একজন লোক এসেছিল তো। কিনবে বলে গেছে। তাই একটু দর চড়িয়ে নিরাশ করতে চেয়েছিলাম।

এমন সময়ে খুলে গেল অন্দরের দরজা। দরজার ওপরকার কাচ দিয়ে এতক্ষণ উঁকি দিচ্ছিল যে, দোকানে ঢুকল সে।

স্থূল, কর্কশ-আকৃতি এক স্ত্রীলোক। মি. কেভের চেয়ে বয়স কম–কিন্তু আয়তনে অনেক বড়। ভারী ভারী পা ফেলে মুখ লাল করে বললে, কে বললে, বিক্রি হবে না ক্রিস্টাল ডিম? আলবত হবে। বিক্রির জন্যেই রাখা হয়েছে। পাঁচ পাউন্ড তো ভালো দাম। কেভ, ভদ্রলোকদের ফিরিয়ে দিচ্ছ কেন শুনি?

বাধা পেয়ে ভীষণ রেগে গেল কেভ। কটমট করে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে কড়া গলায় জানিয়ে দিলে ব্যাবসাটা তার, চালাতে হয় কী করে, সে জ্ঞানও তার আছে।

শুরু হয়ে গেল কথা কাটাকাটি। মজা পেয়ে কেভ-গৃহিণীকে উসকে দিতে থাকে খদ্দের দুজন। বড়ই কোণঠাসা হয়ে পড়ে মি. কেভ বেচারি, কিন্তু গোঁ ছাড়ে না কিছুতেই।

কথা কাটাকাটির অবসান ঘটায় প্রাচ্যের সেই ছোকরা। বিকেল নাগাদ যে লোকটা ক্রিস্টাল ডিম কেনবার আগ্রহ দেখিয়ে গেছে, সে যদি ইতিমধ্যে নিয়ে যায় যাক, কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু যদি না নেয়, দুদিন পরে এসে পাঁচ পাউন্ড দাম দিয়েই ক্রিস্টাল ডিম নিয়ে যাবে তারা।

বিদেয় হল দুই খদ্দের। চরমে উঠল স্বামী-স্ত্রীর কোঁদল। রাগের মাথায় উলটো-পালটা বকতে থাকে মি. কেভ। একবার বলে, আগে যে কিনতে এসেছে, ক্রিস্টাল ডিম তারই প্রাপ্য। তাহলে পাঁচ পাউন্ড চাইলে কেন? সে কী তম্বি কেভ-গৃহিণীর। ব্যাবসাটা যেন তারই, হুকুম দিতে পোক্ত। তেলে-আগুনে জ্বলে উঠে মি. কেভ শুনিয়ে দিলে মুখের ওপর, আমার ছাগল, আমি মাথায় কাটি কি লেজে কাটি, তোমার কী দরকার?

রাতে খেতে বসে আবার শুরু হল ঝগড়া ক্রিস্টাল ডিম নিয়ে। এবার মায়ের দলে ভিড়েছে মি. কেভের সৎ-ছেলে আর সৎ-মেয়ে। তিনজনের কারওই উচ্চধারণা নেই মি. কেভের ব্যাবসা-বুদ্ধি সম্পর্কে।

সৎ-ছেলের বয়স আঠারো, সৎ-মেয়ের বয়স ছাব্বিশ। বড় তার্কিক।

তেড়েমেড়ে বললে সৎ-ছেলে, বেশি বোঝে। এর আগেও ডিমটা পাচার করার ব্যাপারে আমার মতামতকে পায়ে মাড়িয়ে গেছে।

পাঁচ পাউন্ড কি কম কথা! মন্তব্য প্রকাশ করে সৎ-মেয়ে। পরের ব্যাপারে নাক গলাতে ওস্তাদ।

বেচারা মি. কেভ। তিন-তিনটে তোপের মুখে পড়ে কান-টান লাল করে যুক্তিবুদ্ধি এক্কেবারে গুলিয়ে ফেলল। তাড়া খেয়ে আধ-খাওয়া খাবার ফেলেই সরে পড়ল দোকানঘর বন্ধ করতে। পেছন থেকে শুনল গজগজানি, এদ্দিন ধরে শোকেসে ডিমখানা ফেলে রাখার কোনও মানে হয়?

সত্যিই হয় না। ওইখানেই তো ভুল করে বসেছে মি. কেভ। বিক্রি না করে এখন উপায় নেই।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিপিতাকে আর-এক হাত নিয়ে পাড়া বেড়াতে বেরল সৎ-ছেলে আর সৎ-মেয়ে। গরম জলে লেবু-চিনি মিশিয়ে শরবত খেতে বসল কেভ-গৃহিণী ওপরতলায়। মি. কেভ কিন্তু রয়ে গেল দোকানঘরেই, অনেক রাত পর্যন্ত। কী করল দোকানে, তা নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার, পরে প্রকাশ করা যাবে। পরের দিন সকালে কেভ-গৃহিণী দেখলে সামনের শোকেস থেকে ডিমটাকে সরিয়ে এনে রাখা হয়েছে মাছ ধরার খানকয়েক পুরানো বইয়ের পাশে, এমন জায়গায় যে খদ্দেরদের চোখে চট করে পড়বে না। মাথা দপদপ করছিল বলে কথা না বাড়িয়ে ডিমটাকে চোখে পড়ার মতো জায়গায় রেখে দিলে কেভ-গৃহিণী। তিলমাত্র বাগড়া দিলে না মি. কেভ। কথাও বলল না। সারাদিনটা কাটল কিন্তু খিটখিটে মেজাজে। বিকেল নাগাদ যথারীতি ঘুমাতে গেল কেভ গৃহিণী। সেই ফাঁকে শোকেস থেকে ডিমটাকে ফের সরিয়ে দিলে মি. কেভ।

পরের দিন সকালে স্থানীয় স্কুলে মাছ দিয়ে আসতে গেল মি. কেভ ক্লাসে কেটেকুটে বিজ্ঞান শেখানোর জন্যে দরকার। ঠিক ওই সময়ে দোকানে এল কেভ-গৃহিণী ক্রিস্টাল ডিম দেখতে। ডিমটা বিক্রি হয়ে গেলে ওই পাঁচ পাউন্ড কীভাবে খরচ করা হবে, তার একটা ফিরিস্তি খাড়া হয়ে গিয়েছিল মাথার মধ্যে এর মধ্যেই। খুবই লম্বা ফর্দ। তার মধ্যে আছে। নিজের জন্যে একটা সবুজ সিল্কের পোশাক আর রিচমন্ডে বেড়িয়ে আসা। কিন্তু ডিম দেখবার আগেই উত্তপ্ত মেজাজে দোকানে এল এক খদ্দের। আগের দিন ব্যাং দেওয়ার কথা ছিল, দেওয়া হয়নি কেন? স্বামীমশায়ের এই ব্যাং ব্যাবসাটা কোনওদিনই সুনজরে দেখেনি কেভ-গৃহিণী। ব্যাঙের খদ্দেরকেও তাই মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনিয়ে বার করে দিলে দোকান থেকে। তারপর দেখতে গেল, ডিমটা ঠিক জায়গায় আছে কি না, ওই ডিমই যে নিয়ে আসবে কড়কড়ে পাঁচটা পাউন্ড… পূর্ণ হবে তার স্বপ্ন।

ও মা! ডিম তো নেই শোকেসে!

সওয়া দুটো নাগাদ ফিরে এসে মি. কেভ দেখলে, মেঝের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে মরা জানোয়ারের ভেতরে খড়কুটো ঠাসার সরঞ্জাম টেনে নামাচ্ছে তার বউ। দোকানঘর তছনছ। কোনওখানেই দেখতে বাকি রাখেনি কেভ-গৃহিণী। স্বামীরত্নকে দেখেই ঝাঁপাই জুড়াল চোখ পাকিয়ে–আস্পদ্দা তো কম নয়! লুকিয়ে রাখা হয়েছে?

লুকিয়ে রেখেছি? কী বল তো?

ন্যাকা আর কী! ডিমটা… ডিমটা… কোথায় রেখেছ?

ডিম! শোকেসের সামনে ছুটে গিয়ে যেন আকাশ থেকে পড়ল মি. কেভ–কী আশ্চর্য! গেল কোথায়?

ঠিক সেই সময়ে খেতে এসে খাবার না পেয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দোকানে ঢুকল মি. কেভের সৎ-ছেলে। ক্রিস্টাল ডিম নিপাত্তা হয়েছে শুনে রাগটা মায়ের ওপর থেকে সরে এসে পড়ল বিপিতার ওপর। মা আর ছেলে মিলে নির্মমভাবে দুষতে থাকে মি. কেভকে– পাছে বেচতে হয়, তাই লুকিয়ে রেখেছে নিজেই। পালটা অভিযোগ নিয়ে এল মি. কেভ– টাকার লোভে নিশ্চয় তাকে না জানিয়ে বেচে দেওয়া হয়েছে ক্রিস্টাল।

ফলে লাগল তুমুল ঝগড়া। ঝগড়ার পর দেখা গেল, মৃগীরুগির মতো হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা নিয়ে রণে ভঙ্গ দিচ্ছে কেভ-গৃহিণী। আর, কর্মক্ষেত্রে আধ ঘণ্টা দেরি করে পৌঁছাল সৎ-ছেলে। ক্ষিপ্ত বউকে আর না ঘাঁটিয়ে দোকানে বসে মাথা ঠান্ডা করতে লাগল মি. কেভ।

সন্ধের সময়ে আবার খাওয়ার টেবিলে শুরু হল চেঁচামেচি। এবার আক্রমণ চলল সৎ মেয়ের নেতৃত্বে। সহ্য করতে না পেরে দড়াম করে দরজা খুলে চম্পট দিল মি. কেভ। সেই ফাঁকে চিলেকোঠা থেকে পাতাল কুঠুরি পর্যন্ত সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে দেখেও ক্রিস্টাল ডিমকে কিন্তু পাওয়া গেল না।

পরের দিন খদ্দের দুজন দোকানে আসতেই সজল চোখে কেভ-গৃহিণী তাদের খাতির করে বসিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে শুনিয়ে দিলে তার অসীম দুঃখ-দুর্দশার নানান কাহিনি। সবার মূলে ওই মি. কেভ। জীবনটা নাকি মাঠে মারা যেতে বসেছে কেভের সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার পর থেকে। কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ। তাকে তো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারছেই, ক্রিস্টাল ডিমটাকে নিয়েও কী খেলাই না খেলছে। কেভের সারাজীবনটাই এইরকম নষ্টামিতে ভরতি। পাদরি সাহেব যদি ঠিকানাটা দিয়ে যান, তাহলে বাড়ি বয়ে গিয়ে একদিন শুনিয়ে আসবে। সকৌতুকে সব শুনে ঠিকানা দিয়ে গিয়েছিল পাদরি। কিন্তু সে ঠিকানা হারিয়ে যাওয়ায় পাদরিকে আর খুঁজে পায়নি কেভ-গৃহিণী।

সন্ধে হলে দম ফুরিয়ে ঝিমিয়ে পড়ল গোটা কেভ পরিবার। মি. কেভকে একা একাই খেতে হল রাতের খাবার–আগের দুরাতের ঝড় বইল না খাওয়ার টেবিলে। পুরো বাড়িটা কিন্তু থমথম করতে লাগল এই ব্যাপারের পর থেকে।

ক্রিস্টাল ডিম কিন্তু আর ফিরে এল না–এল না খদ্দেররাও।

কেচ্ছাকাহিনির মধ্যে না গিয়ে এককথায় বলা যায়, মি. কেভ পয়লা নম্বরের মিথ্যুক, ক্রিস্টাল ডিমটা সরিয়েছিল সে নিজেই। মাছের থলির মধ্যে করে নিয়ে গিয়ে রেখে এসেছিল সেন্ট ক্যাথরিনস হসপিটালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিমনস্ট্রেটর মি. জ্যাকোবি ওয়েসের কাছে। ক্রিস্টাল ডিম রয়েছে সেখানেই–আমেরিকান হুইস্কির পাশে কালো ভেলভেট-ঢাকা অবস্থায়। সব কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি মি. ওয়েস। তবে কেভ-দম্পতির মধ্যে যে নিরন্তর খিটিরমিটির লেগেই আছে–তা জানত, মি. কেভের মুখেই শুনেছিল। মিসেস কেভকেও দেখেছিল, বিচিত্র চরিত্র ভালো লাগত বলেই মি. কেভকে তার ভারী পছন্দ। তাই ক্রিস্টাল ডিম রেখে দিতে আপত্তি করেনি। সামান্য একটা ডিমের ওপর কেন মি. কেভের মায়া পড়ে গেছে, তা পরে বিস্তারিতভাবে বলবে বলেছিল ভদ্রলোক। তবে হ্যাঁ, ডিমের মধ্যে নাকি মরীচিৎকার মতো অনেক ছায়াবাজি সে দেখেছে–সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।

এই কাহিনি মি. ওয়েসের মুখেই শোনা। সুতরাং মি. কেভের আশ্চর্য অভিজ্ঞতার ঘটনাগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সন্ধের দিকে মি. ওয়েসের কাছে ফের গিয়েছিল মি. কেভ। শুনিয়েছিল রহস্যনিগুঢ় এক কাহিনি। ক্রিস্টাল ডিমটা তার হাতে এসেছিল অন্যান্য পাঁচটা জিনিসের সঙ্গে এক কিউরিয়ো দোকানির কাছ থেকে–দেনার দায়ে জলের দামে বেচে দিয়েছিল সমস্ত হাবিজাবি জিনিস। ডিমটার মূল্যায়ন করা তখন সম্ভব হয়নি বলে মি. কেভ দীর্ঘদিন দশ শিলিং-এর টিকিট ঝুলিয়ে রেখেছিল ডিমের গায়ে। তারপর যখন ভাবছে, দামটা আরও কমানো যায় কি না, এমন সময়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল অদ্ভুত একটা আবিষ্কারের পর।

শরীর তখন খুবই খারাপ যাচ্ছে মি. কেভের। এই ঘটনার গোড়া থেকেই স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু হয়েছিল ভদ্রলোকের। নিজেও গা করেনি। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙেছে মনও। স্ত্রী আর সৎ ছেলেমেয়ে চূড়ান্ত দুর্ব্যবহার চালিয়ে গেছে স্বাস্থ্যভঙ্গ সত্ত্বেও, গুণের শেষ নেই বউয়ের, এক নম্বরের দাম্ভিক, স্বামীর জন্যে তিলমাত্র সহানুভূতি নেই মনে, অত্যন্ত খরুচে। লুকিয়ে-চুরিয়ে মদও খায়। সৎ ছেলেমেয়ে দুটোই নীচ প্রকৃতির বিপিতা যে চোখের বালি–তা সোজাসুজি জানাতে দ্বিধা করেনি কোনওদিনই। ব্যাবসার চাপে মি. কেভও নিশ্চয় মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি। রুপোর চামচ মুখে দিয়ে ধরায় আগমন ঘটেছিল ভদ্রলোকের, পেটে মোটামুটি বিদ্যেও আছে। মাসের পর মাস মানসিক অত্যাচার সইবার ফলে ঘুমাতে পারত না রাত্রে। বিষণ্ণ হয়ে থাকত সারাদিন। পাছে কেউ বিরক্ত হয়, তাই গভীর রাতে শয্যা ছেড়ে উঠে ঘুরঘুর করত বাড়িময়, একদিন রাত তিনটের সময়ে ঢুকেছিল দোকান ঘরে।

অন্ধকার ঘর, অথচ চাপা দ্যুতি দেখা যাচ্ছে একদিকে। শোকেসের দিকে। ভাঙা খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে সরু আলোকরেখা পড়েছে ক্রিস্টাল ডিমের ওপর এবং ঝলমল করছে ডিম্বাকার ক্রিস্টাল। আলোকরেখা যেন আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলেছে ক্রিস্টালের ভেতরটা।

দেখেই বৈজ্ঞানিক কৌতূহল মাথচাড়া দিয়েছিল মি. কেভের মনে। বিজ্ঞান সে পড়েছে– বিজ্ঞানকে ভাঙিয়েই তার যা কিছু রোজগার। খটকা লেগেছিল সেই কারণেই। ক্রিস্টালের মধ্যে আলোক প্রতিসরণ হয় কী করে, তা তার জানা। কিন্তু ক্রিস্টালের মধ্যে আলো ছড়িয়ে পড়ে কী করে, তা তো জানা নেই!

ক্রিস্টালটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে গিয়ে আরও বেশি গুলিয়ে গেল মাথাটা। আলো স্থির নয়–যেন সরে সরে যাচ্ছে ক্রিস্টালের মধ্যে। তালগোল পাকিয়ে যেন নেচে নেচে বেড়াচ্ছে!

আশ্চর্য ব্যাপার তো! ক্রিস্টাল নয়, যেন দ্যুতিময় বাষ্প-ভাত ফোঁপরা কাচের বর্তুল!

আচমকা আলোকরেখা আর ক্রিস্টালের মাঝখানে এসে পড়েছিল মি. কেভ। তা সত্ত্বেও দ্যুতি কমেনি ডিমটার। ঝলমলে ক্রিস্টাল ডিম নিয়ে ঘরের সবচেয়ে অন্ধকারে যাওয়ার পরেও দেখা গেছে, আলো যেন ফেটে পড়ছে আশ্চর্য ক্রিস্টালের ভেতরে। মিনিট চার-পাঁচ ঝলমলে থাকার পর আস্তে আস্তে ফিরে এসেছে দ্যুতি। একেবারে নিবে যাওয়ার পর আবার খড়খড়ির সামনে আলোকরেখার সামনে রাখতেই সঙ্গে সঙ্গে আলো ঝলমলে হয়ে উঠেছে আজব ক্রিস্টাল।

অদ্ভুত উপাখ্যানের এই অংশটুকু কিন্তু যাচাই করা হয়েছে-মিথ্যে বলেনি মি. কেভ। এক মিলিমিটারের সরু ব্যাসের আলোকরেখার সামনে ক্রিস্টাল ডিম রেখে একই কাণ্ড দেখেছে মি. ওয়েস। সবার চোখে সমানভাবে কিন্তু ধরা দেয়নি আশ্চর্য ক্রিস্টালের অত্যাশ্চর্য আলোকপ্রভা। পাস্তুর ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক মি. হারবিঞ্জার কিছুই দেখেননি। মি. ওয়েস দেখেছে বটে–কিন্তু মি. কেভের মতো নয়। মি. কেভও শরীর যখন খুব খারাপ গিয়েছে, ক্লান্তিতে যখন ভেঙে পড়েছে–তখনই অনেক বেশি স্পষ্টভাবে দেখেছে। ক্রিস্টালের ভেতরকার আজব কাণ্ডকারখানা।

প্রথম থেকেই মি. কেভ কিন্তু অবিশ্বাস্য এই অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বলতে সাহস পায়নি–বেমালুম চেপে গিয়েছে। অষ্টপ্রহর যাকে দাঁতে পেষা হচ্ছে, তার পক্ষে এরকম লুকোচুরি খুবই স্বাভাবিক। বললেই তো অত্যাচার বাড়ত। তাই ফাঁক পেলেই ক্রিস্টাল ঘুরিয়ে দেখত একাই-কাকপক্ষীকেও জানায়নি। ক্রিস্টাল যেন তাকে পেয়ে বসেছিল। লক্ষ করেছে, ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিস্টালের আলো অন্যের চোখে অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন জিনিসটা নেহাতই একটা ক্রিস্টাল ডিম ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু রাত ঘনিয়ে এলেই তার ওপর আলো ফেললে জীবন্ত হয়ে ওঠে যেন ডিমটা। দিনরাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে আরও অনেক আবিষ্কার করেছে মি. কেভ। যেমন, দিনের বেলাতেও বিশেষ কোণ থেকে দেখলে অন্ধকারের মধ্যেও আলোময় ক্রিস্টালের মধ্যে দেখা যায় অদ্ভুত দৃশ্য।

সবচেয়ে ভালো দেখা যায় বিকেলের দিকে। খাণ্ডারনি বউ যখন খেয়েদেয়ে নাক ডাকাত ওপরে, মি. কেভ তখন কাউন্টারের তলায় কালো ভেলভেট ডবল ভাঁজ করে মাথা মুখের ওপর ঢেকে চেয়ে থাকত ক্রিস্টালের দিকে। এইখানেই একদিন দেখলে, আলোকরেখা থেকে ১৩৭ ডিগ্রি কোণে চোখ রাখলে ক্রিস্টালের মধ্যে দেখা যায় অদ্ভুত একটা দেশ। নিছক ছবি নয়, যেন প্রাণস্পন্দনে ভরপুর একটা দৃশ্য। যেন সত্যিই সে দেশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মি. কেভনড়ে নড়ে যাচ্ছে ছবিটার মধ্যে অনেক জিনিস। আলো যত ভালোভাবে পড়ে, চারদিক যত অন্ধকার হয়–আশ্চর্য সেই জীবন্ত দৃশ্য ততই স্পষ্ট দেখা যায়। আলোকরেখা বা চোখের অবস্থানে তিলমাত্র হেরফের ঘটলেই জীবন্ত দৃশ্যটাও পট পালটায়। যেন একটা গোল কাচের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে আছে সত্যিকারের প্রাণময় জীবনধারার দিকে–প্রাণচাঞ্চল্যে স্পন্দিত সেই দেশের হরেকরকম দৃশ্যপট ঝলক দিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিকোণ এবং আলোকব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে।

প্রথম যখন এই দৃশ্য দেখেছিল মি. কেভ, তখন তা ক্ষণেকের জন্যে ঝলসে উঠেই মিলিয়ে গিয়েছিল–অস্পষ্ট কুয়াশার আড়ালে যেন ঢেকে গিয়েছিল। বিশাল একটা তেপান্তরের মাঠের দিকে যেন চেয়ে আছে ভদ্রলোক। চেয়ে আছে ওপর থেকে নিচে। খুব উঁচু বাড়ি বা মাস্তুলের ওপর থেকে নিচের দিকে তাকালে বহু দূরের বহু দৃশ্য যেমন একসঙ্গে দৃষ্টিসীমায় জেগে ওঠে–ঠিক সেইভাবে দেখেছিল একসঙ্গে পূর্ব-পশ্চিম উত্তর দক্ষিণের দৃশ্য। পরিচিত তারা দেখে বুঝতে পেয়েছিল কোনদিকটা উত্তর, আর কোনদিকটা দক্ষিণ। পূর্ব আর পশ্চিমে বহু দূরে রয়েছে আকাশছোঁয়া লালচে খাড়া পাহাড়–কোথায় যেন এর আগেও দেখেছে এই পাহাড় মি. কেভ, চেনা চেনা মনে হয়েছে, কিন্তু মনে করতে পারেনি। উত্তর আর দক্ষিণেও ঘুরে এসেছে লালচে পাহাড়। পাহাড়বেষ্টিত ধু ধু প্রান্তরে সঞ্চরমাণ অনেক কিছুই। অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে বিশাল উঁচু বাড়ির পর বাড়ি। অদ্ভুত আকারের ঘন শেওলা-সবুজ গাছপালা। কয়েকটা গাছ উৎকৃষ্ট ধূসর। দেখা যাচ্ছে একটা চকচকে খাল। মি. কেভ রয়েছে পূর্বদিকের পাহাড়ের কাছে। পাহাড় পেরিয়ে যেন একদল পাখি উড়ে আসতে আসতে প্রতিসরিত আলোর অস্পষ্টতায় মিলিয়ে গেল। সুস্পষ্টভাবে আর দেখা গেল না। তখন সূর্য উঠছে পাহাড়ের ওপর। সূর্যের সামনে কালো ছায়ার মতো উড়ুক্কু বস্তুগুলোকে পাখি বলেই মনে হয়েছিল মি. কেভের। তারপরেই ঝলমলে রঙিন বিশাল একটা বস্তু উড়ে গেল ছবির ওপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে। প্রথমবার দেখেই হাত কেঁপে গিয়েছিল ভদ্রলোকের, মাথা সরে গিয়েছিল। দৃশ্যপট কুয়াশা-আবিল হয়ে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে অনেক সময় নিয়ে আবার তা দেখতে পেয়েছিল পরে।

মি. ওয়েসের কাছে শুনেছি, মি. কেভের এই অভিজ্ঞতায় নাকি বাড়াবাড়ি নেই মোটেই। যদিও অনেক চেষ্টা করেও মি. কেভের মতো পরিষ্কারভাবে সেই দৃশ্য দেখতে পায়নি মি. ওয়েস–তা সত্ত্বেও ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতাকে ভাবাবেগে আচ্ছন্ন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এটাও ঠিক যে, মি. কেভের কাছে যা সুস্পষ্ট দৃশ্য, মি. ওয়েসের কাছে তা ধোঁয়াটে নীহারিকার মতো দৃশ্যপট ছাড়া আর কিছুই নয়।

দৃশ্যটা আবার সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল দিন সাতেক পরে। এই সাত দিনে তেপান্তরের মাঠে ভাসা-ভাসা অনেক কিছুই চোখে পড়েছিল। কিন্তু প্রতিবারেই কেন জানি মনে হয়েছিল, একই জায়গায় থেকে অদ্ভুত এই দৃশ্যপটের দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে মি. কেভ। দৃষ্টিকোণ পালটালেই এক-একদিকের দৃশ্য ফুটে উঠছে চোখের সামনে। অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে একটা বিরাট বাড়ির অসম্ভব দীর্ঘ ছাদ। ছাদের মাঝখানে রয়েছে অনেকগুলো উঁচু খুঁটি। প্রত্যেকটা খুঁটির ডগায় সূর্যের আলোয় চকচক করছে একটা করে খুদে জিনিস। খুঁটিগুলো সমান দূরত্বে, নিয়মিত ব্যবধানে খাড়া ছাদের ঠিক মাঝখানে। চকচকে খুদে জিনিসগুলো যে আসলে কী, তা পরে বুঝেছিল মি. কেভ। বাড়ির পরেই নিবিড় গাছপালা। তারপর ঘাস-ছাওয়া মাঠের ওপর গুটিগুটি নড়ছে গুবরেপোকার মতো অনেকগুলো প্রাণী আয়তনে যদিও প্রকাণ্ড। মাঠের পরেই গোলাপি পাথর-বাঁধাই একটা রাস্তা। রাস্তার ওপারে দূরের পাহাড়ের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বিস্তৃত একটা নদী। দুপাশে ঘন লাল ঝোপ। নদীর জল চকচকে আয়নার মতো। উপত্যকার একদিক থেকে আরেকদিকে চলে গিয়েছে এই চওড়া নদীপথ। বাতাস যেন মথিত বহু পাখির ডানাসঞ্চালনে। ঘুরছে গোল হয়ে। নদীর ওপারে অসংখ্য আকাশছোঁয়া প্রাসাদ। উজ্জ্বল রঙিন এবং যেন চকচকে ধাতু দিয়ে কারুকাজ করা। আশপাশে শেওলা-সবুজ অরণ্য। আচমকা কী যেন ডানা ঝাঁপটিয়ে চলে এসেছিল চোখের সামনে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছিল মি. কেভের মুখের সামনে। যেন রত্নখচিত হাত-পাখা সঞ্চালন অথবা ডানা ঝাপটানির সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত সেই মুখের ওপরের অংশ, অর্থাৎ শুধু দুটো বিশাল চোখ চলে এসেছিল মি. কেভের চোখের একদম সামনে–এত কাছে যেন ক্রিস্টাল ডিমের ঠিক উলটোদিকে। আঁতকে উঠে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল মি. কেভ। আবার ফিকে হয়ে এসেছিল ক্রিস্টাল। অন্ধকার দোকানঘরে পরিচিত মিখাইল আর সোঁদা সোঁদা গন্ধের মধ্যে বসে ঘেমে গিয়েছিল ভদ্রলোক। নিবিষ্ট হয়ে থাকায় এতক্ষণ খেয়ালই ছিল না, বসে রয়েছে নিজের দোকানেই–অন্য জগতে নয়।

ক্রিস্টাল ডিমের ভেতরের আশ্চর্য দেশ যেন পেয়ে বসেছিল মি. কেভকে সেই থেকেই। সময় পেলেই উঁকি মেরে দেখত ক্রিস্টালের ভেতরে। যেমন নতুন খেলনা নিয়ে তন্ময় থাকে শিশু–অন্য কোনওদিকে হুঁশ থাকে না, কারও হাতে খেলনা ছাড়তে চায় না–মি. কেভের অবস্থাও হয়েছিল সেইরকম। প্রথমদিকের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাই সহজ-সরলভাবে খোলাখুলি শুনিয়েছিল মি. ওয়েসকে। আজব ক্রিস্টাল হঠাৎ আবির্ভূত খদ্দেরদের হাতে পাচার হওয়ার সম্ভাবনা ঘটতেই অস্থির হয়ে উঠেছিল। তুমুল ঝগড়া লেগেছিল বাড়িতে। অত্যাচার চলেছিল মনের ওপর।

কিন্তু মি. কেভের মতো ক্রিস্টাল দুনিয়া নিয়ে ছেলেমানুষের মতো ভুলে থাকতে পারেনি মি. ওয়েস। বৈজ্ঞানিক মন নিয়ে তদন্তকারীর মতোই পদ্ধতিমাফিক অবিশ্বাস্য এই নয়া জগৎকে খুঁটিয়ে দেখতে প্রয়াসী হয়েছিল বিজ্ঞানীদের মতোই। আলোকরেখা কখন পড়বে ক্রিস্টালে–এই ভরসায় না থেকে বৈদ্যুতিক আলো ফেলার ব্যবস্থা করেছিল ক্রিস্টাল ডিমে। মোটা ভেলভেট চাপা দেওয়ার চাইতে উন্নততর ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটিয়ে এবং ক্রিস্টালকে ঠিক কোনদিক থেকে দেখলে দৃশ্যাবলি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে, তা আবিষ্কার করার পর থেকে ক্রিস্টাল জগতের সব দৃশ্যই যখন খুশি দেখতে পেত মনের আশ মিটিয়ে।

মি. ওয়েস দেখত বৈজ্ঞানিক কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্যে–মি. কেভও আসত প্রায় রোজই-কল্পনা-রঙিন মনোজগতের খোরাক জোগানোর জন্যে। যেহেতু দেখার ব্যাপারে ভদ্রলোকের ক্ষমতা ছিল মি. ওয়েসের চাইতে বেশি, তাই গড়গড় করে বলে যেত মি. কেভ আশ্চর্য দেশের অদ্ভুত বৃত্তান্ত–অন্ধকারেও লেখার অভ্যেস থাকায় সেই বর্ণনা খুঁটিয়ে লিখে নিত মি. ওয়েস। লিখেছিল বলেই এই কাহিনি লেখবার সুযোগ এসেছে।

পাখির মতো উড়ুক্কু প্রাণীগুলো সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল মি. কেভের মনকে। প্রথমে মনে হয়েছিল এক জাতের বাদুড়। তারপর মনে হল পরি-টরি নয় তো? মাথাটা গোলাকার–অনেকটা মানুষের মাথার মতো। চওড়া রুপোলি ডানায় কিন্তু পালক নেই– পাখি, বাদুড়ের ডানার নকশায় নির্মিত নয় মোটেই। মরা মাছের মতোই চকচকে রং ঝলমলে পাখা বরাবর রয়েছে বাঁকা পাঁজরা–যেমনটা থাকে প্রজাপতির ডানায়। দেহটা ছোট। কিন্তু মুখের কাছে আছে দুগুচ্ছ শুড়, এদেরই একজনের বিশাল চোখ দেখে প্রথমদিকে অমন আঁতকে উঠেছিল মি. কেভ।

মি. ওয়েসের কেন জানি মনে হয়েছিল, আশ্চর্য দেশের বাগান, বাড়ি, খুঁটি–সবকিছুরই প্রভু কিন্তু এই উড়ুক্কু জীবেরা। বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করত তারা অদ্ভুত পন্থায়। দরজা দিয়ে নয়। দরজার বালাই ছিল না বিশাল বাড়িগুলোয়। ছিল বিস্তর গোলাকার গবাক্ষ। উড়ুক্কু প্রাণীগুলো শুড়ের ওপর ভর দিয়ে টুক করে নামত জানলার সামনে, ডানা মুড়ে পাশে গুটিয়ে আনত সরু রডের আকারে, তারপর ছোট্ট লাফ মেরে ঢুকে যেত ভেতরে। ছোট ডানাওয়ালা বিস্তর প্রাণী ঘুরত এদের সঙ্গে। অনেকটা বিশালকায় গঙ্গাফড়িঙের মতো। অথবা মথ আর উড়ুক্কু গুবরেপোকার মতো। খোলা লনে গুটিগুটি ঘুরে বেড়াত রং ঝলমলে দানবিক গুবরেপোকাসদৃশ ডানাহীন প্রাণী। পথে আর ছাদেও দেখা যেত উড়ুক্কু প্রাণীদের মতো প্রাণী–ডানা বাদে। মাথা বিরাট। শুড়ের ওপর হাতের মতো ভর দিয়ে লাফ দিয়ে ঘুরত ছাদে, রাস্তায়, লনে।

খুঁটির মাথায় চকচকে বস্তুগুলো নিয়েও মাথা ঘামিয়ে চমকপ্রদ সিদ্ধান্তে এসেছিল মি. ওয়েস। দেখেছিল, বিশটা খুঁটি অন্তর একটা করে খুঁটির মাথায় রয়েছে চকচকে বস্তুগুলো। মাঝে মাঝে ডানাওয়ালা উড়ুক্কু প্রাণীরা এসে শুড় দিয়ে খুঁটির ডগা জড়িয়ে ধরে চেয়ে থাকে চকচকে বস্তুগুলোর দিকে।

দেখেই খটকা লেগেছিল। তবে কি ক্রিস্টাল ডিমের মতোই অগুনতি ডিম বসানো রয়েছে খুঁটির মাথায়? এখানকার ডিম দিয়ে যেমন ওখানকার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, ওখানকার ডিমের মধ্যেও কি তেমনি এখানকার দৃশ্য ফুটে উঠছে? এখানকার ডিম যেখানে খুশি বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়–ওখানকার ডিম কিন্তু খুঁটির ডগায় আটকানো। এইরকম ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে অন্য জগতের এক বাসিন্দা কি দেখতে পেয়েছিল মি. কেভকে? তার বিশাল চোখ দেখেই তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম হয়েছিল মি. কেভের। তবে কি এখানকার ক্রিস্টাল একই সঙ্গে অবস্থান করছে দুটো জগতে? দুটো ক্রিস্টালের মধ্যে যোগসাজশ আছে? পৃথিবীজোড়া কাণ্ডকারখানার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাবনাটাকে একান্ত সম্ভবপর বলেই মনে হয়–অন্তত আমার কাছে।

আশ্চর্য এই জগৎটা তাহলে রয়েছে কোথায়? অচিরেই এই প্রশ্নের জবাব জুগিয়ে দিয়েছিল মি. কেভ। ভারী হুঁশিয়ার লোক। যা দেখে তা ভোলে না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল বলেই জানা গিয়েছিল আশ্চর্য সেই জগতের ঠিকানা।

চোখ পাকিয়ে একদিন ক্রিস্টালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মি. কেভ দেখলে, সূর্য ডুবে যাচ্ছে আশ্চর্য জগতে; তারা দেখা যাচ্ছে কালো আকাশে। তবে আকাশ যেন আরও কালচে। তারাগুলোও চেনা–সৌরজগতে যেসব নক্ষত্রমণ্ডলী দেখা যায়– সেইগুলোই, তবে রয়েছে আরও দূরে। অদ্ভুত এই জগৎ তাহলে রয়েছে সৌরজগতেই পৃথিবী থেকে আরও কয়েক কোটি মাইল দূরে, তাই সূর্যকে আরও ছোট দেখিয়েছে দিনের বেলা–আকাশকে মনে হয়েছে আরও ঘন নীল। এই সূর্যই সেদিন ডুব দিতেই দু-দুটো চাঁদকে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে আকাশে!

হ্যাঁ, জোড়া চাঁদ। উত্তেজিতভাবে মি, কেভ বলেছিল, আমাদের চাঁদা মামার মতোই তাদের দেখতে। তবে আয়তনে অনেক ছোট। দুটোর একটা এত জোরে ছুটছে যে, শুধু চোখেই ছোটার বেগ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ দুটো চাঁদই গ্রহের এত কাছে রয়েছে যে, দিকরেখা ছাড়িয়ে বেগে উঠে আসতে-না-আসতেই চন্দ্রগ্রহণ হয়ে যাচ্ছে!

সৌরজগতে একটি গ্রহের ক্ষেত্রেই এইসব তথ্যপঞ্জি মিলে যায়। নাম তার মঙ্গল গ্রহ!

ডানাওয়ালা জীবগুলো তাহলে মঙ্গলগ্রহী। ডানা যাদের নেই, কিন্তু বাদবাকি চেহারা একই রকম–তারা তাহলে কে? তারাও কি মঙ্গলগ্রহী? কৃত্রিম ডানা লাগিয়ে উড়ে বেড়ায় দরকারমতো?

ডানা থাকুক আর না থাকুক, এরাই যে মঙ্গল গ্রহের প্রভু, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিদঘুটে দুপেয়ে একজাতীয় জীবকে শেওলা বৃক্ষ খেতে দেখেছিল মি. কেভ। দেখতে অনেকটা নর-বানরের মতো। দেহ আংশিক স্বচ্ছ। হঠাৎ শুড় বাড়িয়ে তেড়ে এল ডানাহীন একটা মঙ্গলগ্রহী। হুটোপাটি করে পালিয়েও আংশিক স্বচ্ছ দুপেয়েরা রক্ষে পায়নি। শুড় বাড়িয়ে একজনকে সাপটে ধরেছিল গুবরেপোকার মতো মঙ্গলগ্রহী। তারপরেই ক্রিস্টাল অস্পষ্ট হয়ে আসায় আর কিছু দেখা যায়নি। কিন্তু ঘাম ছুটে গিয়েছিল মি. কেভের।

আর-একটা চলমান বস্তু দেখেছিল মি. কেভ। হনহন করে আসছিল রাস্তা বেয়ে। কাছাকাছি আসতেই দেখা গিয়েছিল ধাতুর জটিল চকচকে কলকবজা। পরক্ষণেই দৃষ্টিপথ থেকে উধাও হয়েছিল চলমান রহস্য।

মঙ্গলগ্রহীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার অনেক চেষ্টা করেছে মি. কেভ। পৃথিবীর দৃশ্য নিয়ে যেন সন্তুষ্ট নয়, অথবা যেন যা দেখা যাচ্ছে তা মনের মতো নয়–এরকম ভাব দেখা দিয়েছে বিশাল চোখে। তাই একদিন গ্যাঁট হয়ে বসে ছিল মি. কেভ নজর কাড়ার জন্যে বিশাল চোখ দুটো এক্কেবারে সামনাসামনি দেখেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আলো-টালো জ্বেলে নানারকম ইশারা ইঙ্গিত করেছিল। কিন্তু পলকের মধ্যেই সরে গিয়েছিল মঙ্গলগ্রহী– অন্য খুঁটির ডগায় চোখ রেখেছিল। মি. কেভের অস্তিত্ব যেন টেরই পায়নি।

নভেম্বর মাসটা গেল এইভাবে। ডিসেম্বরের গোড়ায় পরীক্ষার চাপে মি. ওয়েস সময় দিতে পারেনি দিন সাতেকের মতো। এই ফাঁকে ক্রিস্টাল সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরত মি. কেভ–বাড়ির হাঙ্গামা ততদিনে ঝিমিয়ে এসেছিল। দিন দশ-এগারো পরে ক্রিস্টালের জন্যে মনটা হু হু করে ওঠায় মি. ওয়েস নিজেই দৌড়েছিল মি. কেভের বাড়ি।

গিয়ে দেখলে, বন্ধ হয়ে গেছে দোকান। কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এল মিসেস কেভ। পরনে কালো পোশাক।

মি. কেভ? এখন পরলোকে। এইমাত্র কবরখানা থেকেই ফিরছে মিসেস কেভ।

মি. ওয়েসের কাছ থেকে ক্রিস্টাল নিয়ে আসবার পরের দিন খুব ভোরবেলায় মরে কাঠ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় মি. কেভকে। শক্ত, আড়ষ্ট আঙুলের ফাঁকে ধরা ছিল ক্রিস্টাল ডিমটা–পায়ের কাছে লুটাচ্ছিল কালো ভেলভেটটা–যা দিয়ে মাথা-মুখ চাপা দিত মি. কেভ। ক্রিস্টালের ভেতর দিয়ে অন্য জগতের দৃশ্য দেখার সময়ে।

মরে কাঠ হয়ে গেলেও মি. কেভের মুখে নাকি তৃপ্তির হাসি লেগে ছিল। যেন অনেক সুখ, শান্তি নিয়ে এসেছে মরণ।

শরীর তার খারাপ যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন–চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল মি. ওয়েসের। না করার ফলেই তো এই কাণ্ড। মনটা তাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল ভদ্রলোকের। তা সত্ত্বেও খোঁজ নিয়েছিল ক্রিস্টাল সম্বন্ধে। আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল মিসেস কেভের জবাব শুনে।

বেচে দেওয়া হয়েছে ক্রিস্টাল ডিম। মালিকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিধবা বউ ডিমটা নিয়ে ওপরতলায় গিয়ে খুঁজেছিল পাদরির ঠিকানা। ঠিকানা আর পাওয়া যায়নি। কড়কড়ে পাঁচ পাউন্ড এভাবে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় পাগলের মতো ছুটেছিল আরেক দোকানদারের কাছে–দোকানের হাবিজাবি জিনিস বেচে সেই টাকায় ধুমধাম করে মালিককে গোর দিতে হবে। ধুরন্ধর সেই দোকানদার জলের দামে ক্রিস্টাল ডিম সমেত অনেক জিনিসই কিনে নিয়ে গেছে।

মি. ওয়েস তৎক্ষণাৎ দৌড়েছিল তার কাছে। দুঃসংবাদ শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল। ডিমটা এই তো সেদিন বিক্রি হয়ে গেল। লম্বামতো একটা লোক কিনে নিয়ে গেছে–জামা-প্যান্ট ধূসর রঙের। কোনদিকে গেছে, কোথায় থাকে–তা তো জানা নেই। দোকানদারের।

কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও লাভ হয়নি। কেউ সাড়া দেয়নি। যে কিনেছে, সে নিশ্চয় কিউরিয়ো-সংগ্রাহক নয়। হলে বিজ্ঞাপন পড়ে সাড়া দিত। খেয়ালের বশে কিনে নিয়ে গিয়ে এই লন্ডন শহরেই হয়তো কাগজ-চাপা করে টেবিলে রেখে দিয়েছে। ক্রিস্টালের মহিমা এখনও জানে না।

মি. ওয়েসের কাছে লেখা বিবরণগুলো ছিল। বিষয়টি দুটো পত্রিকায় প্রকাশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু দুটো পত্রিকাই এসব গালগল্পে কান দেয়নি।

তাই কাগজপত্র এল আমার হাতে। এ কাহিনি আমি লিখলাম গল্পের আকারে। মনে মনে। কিন্তু মি. ওয়েসের সঙ্গে একমত। আশ্চর্য সেই জগৎ মঙ্গল গ্রহ নিঃসন্দেহে। মঙ্গলগ্রহীরাই ক্রিস্টালটাকে পাঠিয়েছে পৃথিবীতে–ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর দৃশ্য দেখবার জন্যে। হয়তো তাদের কেউ কেউ এসেছে এই গ্রহে। এটা ঘটনা, কল্পনা নয়, মরীচিকা নয়।

দীর্ঘদেহী ধূসরবেশী লোকটা কে, তা আজও জানা যায়নি। তবে পাদরি আর তার সঙ্গী তরুণের হদিশ পাওয়া গেছে। পাদরির নাম রেভারেন্ড জেমস পার্কার। সঙ্গী তরুণটি জাভার বোসেন-কুনির যুবরাজ। মি. কেভ ক্রিস্টাল বেচতে অনিচ্ছুক দেখেই চড়া দামে বস্তুটি দখলে আনতে চেয়েছিল–আর কোনও উদ্দেশে নয়।

ক্রিস্টাল যেখানেই থাকুক–তার সঙ্গে কিন্তু যোগাযোগ রয়েছে মঙ্গল গ্রহের জুড়ি ক্রিস্টালের–এটাও একটা ঘটনা, অলীক কল্পনা নয়!

চোরাই জীবাণু

চোরাই জীবাণু (The Stolen Bacillus)

[‘The Stolen Bacillus’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৪ সালের জুন মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায়। ১৮৯৫ সালে লন্ডনের ‘Methuen & Co.’ থেকে প্রকাশিত ওয়েলসের প্রথম ছোট গল্পের সংকলন ‘The Stolen Bacillus and Other Incidents’-তে গল্পটি স্থান পায়। প্রথম বায়ো-টেররিজমের উল্লেখ এই গল্পেই পাওয়া যায়।]

মাইক্রোস্কোপের তলায় কাচের প্লেট ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন জীবাণুবিজ্ঞানী, এই হল গিয়ে স্বনামধম্য কলেরা-ব্যাসিলাস–কলেরার জীবাণু।

পাঙাসপানা মুখ নিয়ে অণুবীক্ষণে একটা চোখ রাখল লোকটা। মাইক্রোস্কোপ দেখতে অভ্যস্ত নয় নিশ্চয়, তাই শীর্ণ শিথিল একটা সাদা হাতে চাপা দিলে অন্য চোখটা।

বললে, কিসসু দেখতে পাচ্ছি না।

স্ক্রু-টা ঘুরিয়ে আপনার চোখের উপযোগী করে মাইক্রোস্কোপ ফোকাস করে নিন। সবার চোখে সমান দৃষ্টি তো থাকে না। এইদিকে সামান্য একটু ঘোরান।

এই তো… দেখা যাচ্ছে। আহামরি অবশ্য কিছু নয়। গোলাপি রঙের পুঁচকে কতকগুলো ডোরা আর ফালি। অথচ দেখুন, এই খুদে পরমাণু থোকারাই গোটা শহরকে তছনছ করে দিতে পারে। ওয়ান্ডারফুল!

বলে, কাচের স্লাইডটা নিয়ে মাইক্রোস্কোপের ধার থেকে সরে গেল জানলার পাশে। আলোর সামনে স্লাইড তুলে ধরে বললে, দেখাই যাচ্ছে না। বেঁচে আছে তো? এখনও কি বিপজ্জনক?

রং দিয়ে রাঙিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। যদি পারতাম, বিশ্বের সমস্ত কটা জীবাণুকে এইভাবে মারতাম।

ক্ষীণ হাসি ভেসে ওঠে বিবর্ণমুখ লোকটার ঠোঁটে–জীবন্ত জীবাণু, আপনার ঘরে রাখতে চান না–এই তো?

মোটেই তা নয়। জীবন্ত জীবাণুই তো রাখতে হয়। যেমন ধরুন এই জীবন্ত জীবাণুগুলো, বলতে বলতে ঘরের আরেকদিকে গিয়ে মুখ-আঁটা একটা টিউব তুলে নিলেন জীবাণু-বিজ্ঞানী–রোগজীবাণুর চাষ করে পাওয়া এই দেখুন বেশ কিছু সজীব জীবাণু। বোতল-কলেরাও বলতে পারেন।

ক্ষণেকের জন্যে যেন পরম খুশির হালকা হাসি ভেসে যায় সাক্ষাৎপ্রার্থীর পাতলা ঠোঁটের ওপর দিয়ে। দুচোখ দিয়ে যেন গিলতে থাকে ছোট্ট টিউবটা।

নজর এড়ায় না জীবাণু-বিজ্ঞানীর। লোকটার চোখে-মুখে অস্বাস্থ্যকর রুগ্‌ণ আনন্দের দ্যুতি। প্রথম থেকেই খটকা লেগেছিল জীবাণু-বিজ্ঞানীর। হাবভাব কীরকম যেন খাপছাড়া। অথচ পরিচয়পত্র নিয়ে এসেছে এক বন্ধুর কাছ থেকে। বিজ্ঞানসাধকরা হয় শান্তশিষ্ট, আত্মচিন্তায় সদানিমগ্ন। কালোচুলো এই লোকটার গভীর ধূসর চোখে কিন্তু উদ্ভ্রান্ত চাহনি, হাবভাব ছটফটে-নার্ভাস। চঞ্চল কিন্তু তীক্ষ্ণ চাহনি নিবদ্ধ কাচের টিউবের ওপর, ঠিক এই ধরনের বিজ্ঞানসাধকের সংস্পর্শে কোনওদিন আসেননি জীবাণু-বিজ্ঞানী। হয়তো তাঁর আবিষ্কার লোকটাকে চঞ্চল করে তুলেছে, এমনটা হওয়াও বিচিত্র নয়।

টিউব হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন জীবাণু-বিজ্ঞানী চিন্তাকুটিল ললাটে। বললেন নিবিষ্ট স্বরে, মহামারীকে বন্দি করে রেখেছি এই টিউবের মধ্যে। খাবার জলের চালান যাচ্ছে যেখান থেকে, ছোট্ট এই টিউবটাকে যদি ভেঙে ফেলেন সেই জলের মধ্যে, তাহলেই দেখবেন এই খুদে অণুবীক্ষণে দৃশ্যমান প্রাণীগুলোর ক্ষমতা। অথচ এদের গায়ে গন্ধ নেই, খেতেও বিস্বাদ নয়–অত্যন্ত শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ না হলে দেখাও যায় না। কিন্তু তুচ্ছ প্রায়-অদৃশ্য এই এদেরকে জলে ঢেলে দিয়ে যদি হুকুম দেন–যাও হে মৃত্যুদূতেরা, বংশবৃদ্ধি করে ছেয়ে ফেল সব কটা সিসটার্ন আর চৌবাচ্চা–তাহলেই ভয়ানক মৃত্যু আসবে চক্ষের নিমেষে, রহস্যময় সেই মৃত্যুর কিনারা করাও যাবে না, যন্ত্রণাময় মৃত্যু অসীম লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে এক-একটা মানুষকে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেবে মৃত্যুকূপে। সারা শহর জুড়ে তাথই তাথই নাচ নেচে চলবে মৃত্যু-যজ্ঞের সৈনিকরা–এই প্রায়-অদৃশ্য জীবাণুরা। নিজেরাই শিকার খুঁজে বার করবে–কাউকে দেখিয়েও দিতে হবে না। স্বামীকে ছিনিয়ে নেবে স্ত্রীর কাছ থেকে, শিশুকে মায়ের কোল থেকে, রাজনীতিবিদকে কঠিন কর্তব্যের মধ্যে থেকে। শ্রমিককে আর উদয়াস্ত হাড়ভাঙা মেহনত নিয়ে কষ্ট পেতে হবে না। এগিয়ে যাবে জলের মেইন পাইপ দিয়ে, গুটিশুটি এগবে রাস্তা বরাবর, যেসব বাড়িতে জল ফুটিয়ে খাওয়ার হাঙ্গামা কেউ পোয়াতে চায় না–ঠিক সেইসব বাড়িতেই হানা দিয়ে সাজা দেবে মৃত্যুর পরোয়ানা হাজির করে, খনিজ জল উৎপাদন করে যারা–সেঁধিয়ে বসবে তাদের কুয়োর জলে, মিশে যাবে স্যালাডে, ঘুমিয়ে থাকবে বরফের মধ্যে। ঘোড়াদের জল খাবার চৌবাচ্চায় ওত পেতে থাকবে আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিবারণের সুযোগ নিয়ে উদরে প্রবেশের অপেক্ষায়, রাস্তার কল থেকে স্কুলের ছেলেমেয়েরা যখন নিশ্চিন্ত মনে জল খাবে–তখন তাদেরও একে একে টেনে নিয়ে যাবে মৃত্যুর অজানা লোকে। মাটি শুষে নেবে মহাভয়ংকর এই সৈনিকদের, কিন্তু আবার বেরিয়ে আসবে হাজার হাজার অপ্রত্যাশিত পথে-ঝরনার জলে, কুয়োর জলে। জলাধারে একবার ছেড়ে দিলেই হল–ডেকে ফিরিয়ে এনে ফের বন্দি করার সুযোগ বা সময়ও আর দেবে না–মহাশ্মশান করে ছাড়বে বিশাল এই শহরকে।

অকস্মাৎ স্তব্ধ হলেন জীবাণু-বিজ্ঞানী। বাগ্মিতা তাঁর এক দুর্বলতা। সবাই বলে, নিজেও জানেন।

শেষ করলেন ছোট্ট কথায়, এই টিউবের মধ্যে মহামারীর মৃত্যুদূতরা কিন্তু সুরক্ষিত।

ঘাড় নেড়ে নীরবে সায় দেয় বিবর্ণমুখ লোকটা। কিন্তু চকচক করছে দুই চোখ। কেশে গলা সাফ করে নিয়ে বললে, তাহলেই দেখুন, অরাজকতা সৃষ্টি করার জন্যে যারা আদা জল খেয়ে লেগেছে, সেই অ্যানার্কিস্টগুলোর মতো মহামূর্খ আর নেই। বোমা-টোমার দরকার কী? হাতের কাছেই রয়েছে যখন এমন নিঃশব্দ, মোক্ষম অস্ত্র। আমার তো মনে হয়–

মৃদু টোকা শোনা গেল দরজায়। নখ দিয়ে কে যেন টোকা মারছে।

দরজা খুলে দিলেন জীবাণু-বিজ্ঞানী।

সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর স্ত্রী। বললেন, একটা কথা আছে, বাইরে আসবে?

স্ত্রীর সঙ্গে কথা শেষ করে ল্যাবরেটরিতে ফিরে এসে জীবাণু-বিজ্ঞানী দেখলেন, ঘড়ি দেখছে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী।

বললে, চারটে বাজতে বারো মিনিট। ঘণ্টাখানেক সময় নষ্ট করলাম আপনার। যাওয়া উচিত ছিল সাড়ে তিনটেয়। কিন্তু এমন কৌতূহল জাগিয়ে ছেড়েছিলেন যে খেয়ালই ছিল না। এখন চলি–ঠিক চারটেয় একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

আর-এক দফা ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেল লোকটা। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট ললাটে ফিরে এলেন জীবাণু-বিজ্ঞানী। সাক্ষাৎপ্রার্থীর মানবজাতিতত্ত্ব নিয়ে মনে মনে পর্যালোচনা করছিলেন তিনি। লোকটা টিউটোনিক টাইপ নয়, মামুলি ল্যাটিন টাইপও নয়। রুগণ মনুষ্য–দেহে এবং মনে। রোগ তৈরির ডিপো জীবাণুগুলোর দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল!

ভাবতে ভাবতেই একটা অস্বস্তিকর চিন্তা ঢুকে গেল মাথায়। ভেপার বাথের পাশে রাখা বেঞ্চির দিকে গেলেন, সেখান থেকে ঝটিতি গেলেন লেখবার টেবিলে। পাগলের মতো পকেট হাতড়ালেন এবং পরক্ষণেই তিন লাফে হাজির হলেন দরজায়। হয়তো হলঘরের টেবিলে রেখেছেন–কিন্তু সেখানেও জিনিসটা না পেয়ে বিকট গলায় ডাকলেন স্ত্রী-র নাম ধরে।

দূর থেকে সাড়া এল স্ত্রী-র।

বললেন জীবাণু-বিজ্ঞানী গলার শির তুলে, যখন কথা বলছিলাম তোমার সঙ্গে, আমার হাতে কিছু দেখেছিলে?

কিছুক্ষণ কোনও জবাব এল না।

কই না তো!

আর্তনাদ করে উঠলেন জীবাণু-বিজ্ঞানী, নীল সর্বনাশ! ঝড়ের মতো দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন সদর দরজা পেরিয়ে এক্কেবারে রাস্তায়।

স্ত্রী-র নাম মিনি। দড়াম করে দরজা বন্ধ করার শব্দে বাড়ি কেঁপে উঠতেই সভয়ে দৌড়ে গেল জানলার সামনে। দেখল, পাঁইপাঁই করে রাস্তা দিয়ে ছুটছে একজন শীর্ণকায় পুরুষ তারপরেই একটা ছ্যাকড়া গাড়ি দাঁড় করিয়ে উঠে বসছে ভেতরে। পেছনে দৌড়াচ্ছেন তাঁর স্বামী। মাথায় টুপি নেই। পায়ে কার্পেট-চটি। ক্ষিপ্তের মতো হাত নাড়ছেন সামনের ছ্যাকড়া গাড়িটার দিকে। ছুটতে ছুটতে পা থেকে ছিটকে গেল একখানা চটি–কিন্তু কুড়িয়ে নেওয়ার জন্যেও দাঁড়ালেন না–এক পায়ে চটি পরেই দৌড়াচ্ছেন উন্মাদের মতো।

মিনি দেখলে, স্বামীদেবতার মাথাটি সত্যিই এদ্দিনে বিগড়ে গেল। ভয়ানক বিজ্ঞান নিয়ে দিনরাত অত ভাবলে মাথা খারাপ তো হবেই।

জানলা খুলে স্বামীকে চেঁচিয়ে ডাকতে যাচ্ছে মিনি, এমন সময়ে শীর্ণকায় লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। পরক্ষণেই একই পাগলামিতে যেন পেয়ে বসল তাকেও। চকিতে হাত নেড়ে দেখাল জীবাণু-বিজ্ঞানীকে, কী যেন বললে গাড়োয়ানুকে, লাফিয়ে উঠে বসল ভেতরে, দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা, সপাং সপাং করে চাবুক পড়ল ঘোড়ার পিঠে! রাস্তা কাঁপিয়ে টগবগিয়ে ছুটে গেল গাড়ি

পেছনে পেছনে জীবাণু-বিজ্ঞানী ছুটলেন পাগলের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে এক পায়ে চটি পরে।

মিনিটখানেক জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে থাকার পর বিমূঢ়ভাবে জানলা বন্ধ করে দিলে মিনি। পতিদেবতা নির্ঘাত পাগল হয়ে গিয়েছে, কিন্তু হাঁ করে বসে থাকলে তো চলবে না। জীবাণু-বিজ্ঞানীর টুপি, জুতো আর ওভারকোট নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। একটা ছ্যাকড়া গাড়িতে উঠে বসে গাড়োয়ানকে বললে, মাথায় টুপি না দিয়ে ভেলভেট কোট পরে একটা লোক দৌড়াচ্ছে–চল তো তার কাছে। হ্যাভলক কেসেন্টের দিকে গেলেই পাবে।

চাবুকের ঘায়ে গাড়িখানাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে চলল তেজিয়ান ঘোড়া। হইচই পড়ে গেল পথের দুপাশে। পরপর দুখানা গাড়ি পথ কাঁপিয়ে ছুটছে নক্ষত্রবেগে। পটাপট হাততালিতে মুখরিত হল আকাশ-বাতাস। ভদ্রমহিলা যে সামনের গাড়ির নাগাল ধরতে চাইছে, এটা বুঝেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল রাস্তায়।

মিনি নিজেও বুঝল, এত উত্তেজনা তাকে নিয়েই। কিন্তু সে চলেছে তার কর্তব্য করতে। সামনের গাড়ির দিকে তার নজরই নেই–চোখ রেখেছে কেবল তার উন্মাদ স্বামীর পৃষ্ঠদেশে।

সামনের গাড়ির ভেতরে এক কোণে ঝুঁকে বসে রয়েছে সেই লোকটা। শক্ত মুঠোর মধ্যে রয়েছে ধ্বংসের বীজ কলেরার জীবাণু ভরতি টিউবটা। ভয় আর উল্লাস–এই দুই ভাবের খেলা চলছে মাথার মধ্যে। ভয়টা আবার দুরকমের। কর্তব্য সম্পাদনের আগেই না ধরা না পড়তে হয়। দ্বিতীয় ভয়টা তার অপরাধজনিত। কিন্তু এই দু-দুটো ভয়কে ছাপিয়ে গেছে উৎকট উল্লাস। মনেপ্রাণে সে একজন অ্যানার্কিস্ট–অরাজকতা সৃষ্টি করার বিকৃত বাসনা শেকড় গেড়ে রয়েছে তার অণুতে-পরমাণুতে। কিন্তু অন্য কোনও অ্যানার্কিস্ট যা কল্পনাও করতে পারেনি–সে তা কল্পনা তো করেইছে, কাজে রূপান্তরিত করতে চলেছে। অহো! অহো! র‍্যাভাচোল, ভ্যালিয়ান্ট এবং আরও কত অ্যানার্কিস্ট এখন বিস্মৃত–কিন্তু সে অমর হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। তাকে পাত্তা দেয়নি কেউ, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে প্রত্যেকেই–মোক্ষম প্রতিশোধ নেবে এখুনি। খাসা মতলব এনেছিল মাথায়। পরিচয়পত্র জাল করে দেখা করেছিল উজবুক ওই জীবাণু-বিজ্ঞানীটার সঙ্গে, কথায় কথায় ভুলিয়ে রেখে সুযোগ বুঝেই পকেটে ঢুকিয়েছে বিশেষ টিউবটা। এখন শুধু জলাধারে উপুড় কয়ে দিলেই হল। হাঃ হাঃ হাঃ! মৃত্যু নেচে নেচে বেড়াবে সারা শহরে। কিন্তু উজবুকটা এখনও পেছনে পেছনে দৌড়ে আসছে নাকি? মুখ বাড়িয়ে দেখল অ্যানার্কিস্ট। মাত্র পঞ্চাশ গজ পেছনে এসে গেছে আহাম্মকটা গাড়ি। উঁহু, এত কাছাকাছি আসতে দেওয়াটা ঠিক নয়। একটা আধ গিনি গাড়োয়ানের হাতে গছিয়ে গাড়িটাকে আরও জোরে উড়িয়ে নিয়ে যেতে হুকুম দিলে অ্যানার্কিস্ট।

আধ গিনি কম কথা নয়। সপাং করে চাবুক পড়ল ঘোড়ার পিঠে। আচমকা মার খেয়ে তিড়বিড়িয়ে ছিটকে ধেয়ে গেল ঘোড়া–সেই সঙ্গে গাড়ি। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছিল অ্যানার্কিস্ট-হাতের মুঠোয় মূল্যবান সেই ধ্বংসের বীজ। দুলন্ত গাড়িতে খাড়া থাকা যায়? ভারসাম্য বজায় না রাখতে পেরে উলটে পড়তেই পিড়িং করে ভেঙে গেল পাতলা কাচের টিউবধ্বংসের বীজ গড়িয়ে গেল গাড়ির মেঝেতে!

ধপ করে বসে পড়ল অ্যানার্কিস্ট। মুখ চুন করে চেয়ে রইল হাতে ধরা ভাঙা টিউবটার দিকে! জীবাণু যখন গাড়ির মেঝেতে কিলবিল করছে, তখন মৃত্যুও ছড়িয়ে পড়বে অচিরেই। কিন্তু নাটকটা আর হল না।

ভাঙা টিউবে টলটল করছে একটা ফোঁটা। মৃত্যুদূত নিশ্চয়ই থুকথুক করছে তার মধ্যে। খেয়ে নেওয়া যাক–শহিদ হয়ে প্রশস্ত করে যাক মৃত্যুবাহিনীর বিজয়পথকে।

কলেরার জীবাণু এখন অ্যানার্কিস্টের পেটে। ভীষণ শক্তিশালী জীবাণু তো। মাথার মধ্যে কীরকম যেন করছে। কিন্তু খামকা আর আহাম্মক বৈজ্ঞানিকটাকে উদ্‌বেগের মধ্যে রাখা কেন? কাজ তো হাসিল!

ওয়েলিংটন স্ট্রিটে গাড়ি ছেড়ে দিল অ্যানার্কিস্ট। দুহাত বুকের ওপর ভাঁজ করে রেখে মৃত্যু-মহিমায় উন্নতশিরে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল জীবাণু-বিজ্ঞানীর প্রতীক্ষায়।

এসে গেছে আহাম্মকটা! উন্মত্ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে অ্যানার্কিস্ট।

বেঁচে থাক অ্যানার্কিস্ট! হে বন্ধু, বড় দেরি করে ফেললে। জিনিসটা এখন আমার পেটের মধ্যে। মুক্তি পেয়েছে কলেরা খাঁচার মধ্যে থেকে।

জীবাণু-বিজ্ঞানী বুদ্ধি করে মাঝপথে একটা ছ্যাকড়া গাড়িতে উঠে পড়েছিলেন বলেই নাগাল ধরতে পেরেছিলেন বিকৃতমস্তিষ্ক অ্যানার্কিস্টের। জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে তার কথাটা শুনে সবিস্ময়ে কী যেন বলতে গেলেন, কিন্তু না শুনেই সাড়ম্বরে বিদায় অভিনন্দন। জানিয়ে হেলেদুলে ওয়াটার ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে গেল অ্যানার্কিস্ট-ভাঙা টিউবের জীবাণু পোশাকে পড়েছিল–ভেজা পোশাক ঘষটে গেল বহু পথচারীর গায়ে যত তাড়াতাড়ি রোগটা ছড়িয়ে পড়ে, ততই ভালো!

গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে হাঁ করে সেই দৃশ্য দেখছেন জীবাণু-বিজ্ঞানী, এমন সময়ে মিনি এসে দাঁড়াল তাঁর পাশে হাতে জুতো, টুপি আর ওভারকোট।

দেখে সংবিৎ ফেরে জীবাণু-বিজ্ঞানীর, ভারী বুদ্ধি তো তোমার! মনে করে ঠিক এনেছে।

বলেই আবার তন্ময় হয়ে চেয়ে রইলেন বিলীয়মান অ্যানার্কিস্টের দিকে। আচম্বিতে হেসে উঠলেন হো হো করে একটা অদ্ভুত সম্ভাবনার কথা মনে পড়ায়, বললেন হাসতে হাসতেই, মিনি, লোকটা নাম ভাঁড়িয়ে এসেছিল কলেরার জীবাণু চুরি করবে বলে–অ্যানার্কিস্ট তো লন্ডনের জলে কলেরার জীবাণু ছেড়ে দেওয়ার মতলব, কিন্তু ভুল করে কী নিয়ে গেছে জান? প্রথম ভুলটা অবশ্য আমারই। এশিয়াটিক কলেরার জীবাণু ভরতি টিউবের বদলে দেখিয়েছিলাম সেই টিউবটা–যে টিউবের জীবাণু খেয়ে ছোপ ছোপ নীল দাগে ভরে উঠেছিল বাঁদরগুলো, তিন তিনটে ছানা সমেত বেড়াল-মা বিলকুল নীল হয়ে গিয়েছিল। ঘন নীলবর্ণ ধারণ করেছিল চড়ুই পাখিটা। সেই জীবাণুই ও খেয়েছে। –জানি না কী হবে এখন–কিন্তু ওভারকোট পরতে যাব কেন? গরমে হাঁসফাঁস করছি দেখছ না? ঠিক আছে, ঠিক আছে, দাও!

জাদু বিপণি

জাদু বিপণি ( The Magic Shop)

[‘The Magic Shop’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Stand Magazine’ পত্রিকায় জুন ১৯০৩ সালে। পরে ‘Macmillan and Co.’ থেকে ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘Twelve Stories and a Dream’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়।]

দূর থেকে বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম ম্যাজিকের দোকানটা। সামনে দিয়েও গেছি কয়েকবার। দেখেছি কাচের শোকেসে লোভনীয় জাদুসামগ্রী। ম্যাজিক বল, ম্যাজিক মুরগি, বিচিত্র শঙ্কু, হরবোলা পুতুল, ম্যাজিক ঝুড়ি, ম্যাজিক তাস। দেখেই গিয়েছি এই ধরনের হরেক রকমের জিনিস–ঢোকার ইচ্ছে হয়নি কখনও। কিন্তু না ঢুকে পারলাম না সেইদিন –যেদিন আমার আঙুল ধরে হাঁটতে হাঁটতে জিপ টেনে নিয়ে গেল দোকানটার সামনে, একটার পর একটা জিনিস দেখাতে দেখাতে বুঝিয়ে দিলে, উপায় নেই, ঢুকতেই হবে ভেতরে। সত্যি কথা বলতে কী, দোকানটা যে রিজেন্ট স্ট্রিটেই আছে, তা-ও তো মাথায় আসেনি কখনও, রয়েছে মুরগির ছানা আর ছবির দোকানের ঠিক মাঝখানে। আমার কিন্তু বরাবরই মনে হয়েছে, এ দোকান যেন দেখেছি সার্কাসে, অথবা অক্সফোর্ড স্ট্রিটের মোড়ে, অথবা হলবর্নে। রাস্তার ওপরেই, কিন্তু ভেতরে ঢোকার পথটা কখনও পাওয়া যায়নি। মরীচিৎকার মতো দোকানের অবস্থান যেন ধাঁধা সৃষ্টি করে গেছে এতটা কাল। কিন্তু কী আশ্চর্য! ওই তো সেই দোকান! জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনেই, বিস্তর জাদুসামগ্রী যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে, ভেতরে এসো! ভেতরে এসো! আঙুল তুলে একটার পর একটা জিনিস দেখতে দেখতে শেষকালে কাচের ওপর আঙুলের বাজনা পর্যন্ত শুনিয়ে দিলে জিপ।

ঠকঠক করে কাঁচে আঙুল ঠুকে একটা আজব ডিম দেখিয়েছিল, অদ্ভুত ক্ষমতা এই ডিমের, অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে যখন-তখন। বলেছিল, জান বাবা, বড়লোক যদি হতাম, তাহলে আমিই কিনে ফেলতাম। আর ওই যে ওইটা দেখছ– ঠকঠক ঠকঠক শব্দে আঙুল ঠুকে এবার দেখিয়েছিল একটা কাঁদিয়ে শিশুকে, দেখতে অবিকল মানুষের শিশুর মতোই, পুতুল বলে মনেই হয় না, ওটাও কিনতাম। রহস্যময় এইসব ম্যাজিকের জিনিসপত্রের পাশে রাখা কার্ডটার দিকেও শেষ পর্যন্ত আঙুল তুলে দেখিয়েছিল জিপ। কার্ডে লেখা যে। কোনও একটা জিনিস কিনে নিয়ে গিয়ে বন্ধুদের মুন্ডুগুলো ঘুরিয়ে দাও।

জিপের মুখে তখন খই ফুটছে, ওই যে শব্দুগুলো দেখছ-না বাবা, ওর নিচে জিনিস রাখলেই অদৃশ্য হয়ে যায়। বইতে পড়েছি। তারপরেই

আধ পেনিটা দেখেছ? ফুস করে মিলিয়ে যায় বাতাসে।

জিপ হয়েছে ওর মায়ের মতোই। শিক্ষাদীক্ষাই আলাদা। দোকানে ঢোকার নামও করেনি। আমাকে জ্বালিয়েও মারেনি। নিজের অজান্তেই কেবল আমার আঙুলটাকে টানতে টানতে নিয়ে গেছে ভেতরে ঢোকবার দরজার সামনে। ইচ্ছেটা স্পষ্ট করে তুলেই শান্ত হয়েছে। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে একটা ম্যাজিক বোতলের দিকে। বড় হলে, অনেক টাকার মালিক হলে নাকি ওটাও কিনবে।

আমি তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখুনি যদি কিনে ফেলিস, তাহলে কী করবি?

উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল জিপের চোখ-মুখ, জেসিকে দেখাব।

দরজার হাতলে হাত রেখে আমি তখন বলেছিলাম, তোর জন্মদিনের তো এখনও একশো দিনেরও বেশি দেরি রে।

জবাব দেয়নি জিপ। আমার আঙুলের ওপর মুঠোর চাপটা কেবল বেড়েছিল। তাই ঢুকতেই হয়েছিল দোকানে।

দোকানটা মামুলি দোকান নয় মোটেই। ম্যাজিকের দোকান বলেই জিপ যেসব খেলা দেখলে আনন্দে নেচে উঠত, সেসব খেলা একটাও নেই। তা সত্ত্বেও বোবা মেরে গিয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল আজব বস্তুগুলোর দিকে।

দোকানে আলোর বাড়াবাড়ি তেমন নেই পর্যাপ্ত আলোও নেই। ছোট্ট সংকীর্ণ ঘর। দরজা বন্ধ করে দিতেই দরজার ঘণ্টায় পিং পিং আওয়াজটা একনাগাড়ে বেজেই চলল পেছনে। কেউ নেই আশপাশে। বাপ-বেটায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম কিম্ভুতকিমাকার জিনিসগুলো। কাউন্টারের তলার দিকে দেখলাম একটা কাঠের মণ্ড দিয়ে তৈরি গম্ভীরবদন শান্তচক্ষু বাঘ, নিয়মিত ছন্দে নেড়ে চলেছে বিরাট মাথা। দেখলাম বেশ কয়েকটা ক্রিস্টাল বর্তুল, ম্যাজিক তাস ধরে থাকা একটা চৈনিক হাত, বিভিন্ন আকার এবং আয়তনের বেশ কিছু ম্যাজিক মাছের স্ফটিক পাত্র, একটা কদাকার ম্যাজিক টুপি, ভেতরকার স্প্রিং পর্যন্ত চোখে পড়ছে। মেঝের ওপর গড়াগড়ি যাচ্ছে ম্যাজিক আয়না, বেশ কয়েকটা। কোনওটায় প্রতিফলিত চেহারা লম্বা আর রোগাটে হয়, কোনওটায় হয় বেঁটে আর মোটা। দেখছি আর হাসছি দুজনে, এমন সময়ে দোকানে ঢুকল নিশ্চয় দোকানদার নিজেই।

ঢুকল, মানে কাউন্টারের পেছন থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু এমন আচমকা এসে দাঁড়াল সামনে যে মনে হল, ছোট্ট ওই দোকানঘরে এতক্ষণ তার কোনও অস্তিত্বই ছিল না। থাকলে দোকানে ঢুকেই কি তাকে দেখতে পেতাম না? ওইটুকু তো ঘর রে বাপু।

লোকটার চেহারা মনে রাখবার মতো। বিচিত্র বলতে যা বোঝায়, তা-ই। নোংরা। গায়ের রং কালচে। একটা কান আরেকটা কানের চেয়ে বেশি লম্বা। থুতনি তো নয়, যেন বুটজুতোর ডগা, মোটা চামড়ার টুপি পরানো।

কাউন্টারের ওপরকার কাচের বাক্সে লম্বা লম্বা দশখানা আঙুল মেলে ধরে, বললে সে আচমকা, বলুন কী দেখাব? ওই গলা শুনেই তো বুঝলাম, দোকানদার রয়েছে দোকানেই, কিন্তু এতক্ষণ তাকে দেখা যায়নি মোটেই।

খানকয়েক সোজা ধরনের ম্যাজিকের জিনিস চাই ছেলেটার জন্যে, বলেছিলাম আমি।

হাতসাফাইয়ের ম্যাজিক, না কলের ম্যাজিক? ঘরোয়া ম্যাজিক, না—

মজা পাওয়ার মতো যা হয় কিছু হলেই চলবে।

হু-উ-উম! বলে তো খচমচ করে মাথা চুলকে নিলে দোকানদার, যেন কত ভাবনাতেই না পড়েছে। তারপরেই চোখের সামনেই আস্তে আস্তে মাথার মধ্যে থেকে টেনে বার করল কিনা একটা কাচের বল! নাকের ডগার সামনে বাড়িয়ে ধরে বললে ভিজে ভিজে গলায়, এইরকম মজার জিনিস হলে চলবে কি?

তৈরি ছিলাম না এ ধরনের ম্যাজিকের জন্যে–যদিও হাতসাফাইয়ের এ ম্যাজিক আমি যে কতবার দেখেছি এর আগে, তার ঠিক নেই। সব ম্যাজিশিয়ানই রপ্ত করে এই ধরনের হস্তকৌশল, কিন্তু এ দোকানে কায়দাটা দেখবার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই। অট্টহেসে তাই বলেছিলাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই ধরনের হলেই চলবে।

যন্ত্রচালিতের মতো স্ফটিক বর্তুলকে হস্তগত করার মানসে হাত বাড়িয়েই কিন্তু বোকা বনে গিয়েছিল জিপ বেচারি। কোথায় কাচের বল? হাত তো ফাঁকা!

মুচকি হেসে বলেছিল কিম্ভুত দোকানদার, পকেটে দেখ খোকা, পেয়ে যাবে।

সত্যিই তো! জিপের পকেট থেকে বেরল আশ্চর্য বলটা!

দাম কত? জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।

বিনয়ের অবতার হয়ে তখুনি বলেছিল দোকানদার, আরে ছি ছি! কাচের বলের দাম আমরা নিই না, ওটা ফ্রি! পাচ্ছিও তো ফ্রি! বলতে বলতে আর-একখানা কাচের বল বার করেছিল নিজের কনুই থেকে। পরক্ষণেই তৃতীয় বলটাকে টেনে আনল কাঁধ থেকে। পাশাপাশি তিনটে বল সাজিয়ে রাখল কাচের কাউন্টারে। সীমাহীন শ্রদ্ধায় বলগুলোর দিকে জিপ তাকিয়ে আছে দেখে একগাল হেসে বলেছিল দোকানদার, নিয়ে যাও খোকা, এটাই বা বাদ যায় কেন? বলতে বলতে চতুর্থ বলটা টেনে বার করেছিল নিজের বদন গহ্বর থেকে।

চকিতে আমার সঙ্গে শলাপরামর্শ করে নিলে জিপ চোখে চোখে, মুখে একটি কথাও না বলে। তারপর নিবিড় নৈঃশব্দ্যকে তিলমাত্র ব্যাহত না করে বল চারখানা সরিয়ে রাখল একপাশে, ফের শক্ত করে চেপে ধরল আমার আঙুল এবং উদগ্রীব হয়ে রইল পরবর্তী ম্যাজিক দেখার জন্যে।

নৈঃশব্দ্য ভাঙল দোকানদার নিজেই। বললে, ছোটখাটো কায়দা-টায়দাগুলো দেখাই এইভাবেই।

হাসলাম। যেন ঠাট্টা শুনে মজা পেয়েছি, এইরকম একখানা ভাব করলাম।

বললাম, পাইকারি দোকানের চাইতে সস্তাও বটে।

একরকম তা-ই বটে। শেষমেশ দাম কিন্তু দিতেই হয়। তবে আগুন-দাম নয়, অনেকের যা ধারণা… বড়সড়ো ম্যাজিক, রোজকার খাবারদাবার আর অন্যান্য যা কিছু দরকার, সবই পাই ওই টুপির ভেতর থেকে… খাঁটি ম্যাজিকের দোকান বলতে যা বোঝায়, সেরকম দোকান অবশ্য কোথাও পাবেন না, পাইকারি দোকান তো নেই-ই… ঢাকবার সময়ে খেয়াল করেননি বোধহয় সাইনবোর্ডে লেখা আছে, খাঁটি ম্যাজিকের জিনিস পাবেন এখানে। বলতে বলতে একটা বিজনেস কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে দিল দোকানদার, এক্কেবারে খাঁটি জিনিস, স্যার, লোক ঠকানোর কারবার এখানে হয় না।

আহা, রগুড়ে লোক তো! রঙ্গরসিকতায় বিলক্ষণ পোক্ত।

জিপের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত অমায়িক হাসি হাসল লোকটা, মূর্তিমান শিষ্টাচার বললেই চলে। বললে, খোকা, বড় ভালো ছেলে তুমি।

জিপ যে সত্যিই ভালো ছেলে, এ তথ্যটাও লোকটা জেনে বসে আছে দেখে অবাক হয়েছিলাম বিলক্ষণ। বাড়িতেও ব্যাপারটা গোপন রেখেছি নিছক নিয়মানুবর্তিতার খাতিরে। জিপের কানে যেন না যায়। কিন্তু এ লোকটা…।

জিপ কিন্তু তিলমাত্র সপ্রতিভ হল না। উচ্ছ্বাস প্রকাশও করল না। নিরেট নীরবতায় ঢেকে রেখে দিল নিজেকে। পলকহীন চক্ষু নিবদ্ধ রইল অদ্ভুত দোকানের বিচিত্র দোকানদারের ওপর।

ভালো ছেলেরাই শুধু এ দোকানের চৌকাঠ পেরতে পারে–আর কেউ না৷

কথাটা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, তার উদাহরণস্বরূপ সহসা দোকানের বাইরে ছিচকাঁদুনে বায়না শুনলাম বালক-কণ্ঠে। ঘ্যানঘ্যান করছে বাবার কাছে। অচিরেই দেখা গেল তাকে কাচের মধ্যে দিয়ে। চকোলেট খাওয়া গোবদা চেহারা, নিরক্ত সাদাটে মুখ, চাই-চাই ভাব চোখে-মুখে–নিজের কথা ছাড়া যেন দুনিয়ায় আর কারও কথা ভাবে না। বাবা বেচারি সামলাতে পারছে না ছোঁড়াটাকে। তিতিবিরক্ত হয়ে বলছে, এডওয়ার্ড, দোকান তো দেখছি বন্ধ।

সে কী, দরজা তো খোলাই রয়েছে, বলেছিলাম আমি।

না, বন্ধ রয়েছে, নির্বিকারভাবে বলেছিল দোকানদার।

কর্ণপাত না করে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিলাম দরজা খুলে দিতে। কিন্তু পারিনি। দরজা সত্যিই বন্ধ রয়েছে। খোলে কার সাধ্যি। নাছোড়বান্দা ছিচকাঁদুনে ছোঁড়াটাকে টানতে টানতে বিব্রত বাবা সরে যেতেই কাউন্টারে এসে বলেছিলাম, আশ্চর্য তো! দরজা বন্ধ হয়ে গেল কীভাবে?

ম্যাজিকের জোরে! বলেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নেড়ে ব্যাপারটাকে যেন উড়িয়ে দিয়েছিল জাদুকর দোকানদার। সঙ্গে সঙ্গে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল আমার! কেননা, আঙুলের ডগা থেকে নিঃশব্দে ছিটকে গিয়েছিল অনেকগুলো রংবেরঙের তারা। ঠিক যেন রংমশাল! তারাবাজির খেলা! ঝলমলে তারাগুলো ভাসতে ভাসতে মিলিয়ে গিয়েছিল কোণের অন্ধকারে।

আমি তো হতভম্ব। কিন্তু দোকানদারের ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে। জিপের দিকে তাকিয়ে বলেছিল আপন-করে-নেওয়া সুরে–খোকা, দোকানে ঢোকবার আগে বাইরে দাঁড়িয়ে বলছিলে-না, বন্ধুবান্ধবদের তাক লাগিয়ে দেওয়ার ম্যাজিক কিনবে বড় হয়ে?

বলছিলামই তো।

পকেটেই পেয়ে যাবে।

বলেই, কাউন্টারের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে জিপের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ম্যাজিশিয়ানদের মামুলি কায়দায় ম্যাজিক বাক্স বার করে এনেছিল অদ্ভুত মানুষটা। তখনই লক্ষ করেছিলাম আশ্চর্য রকমের ঢেঙা তার আকৃতি। মানুষ যে এমন গাছের মতো লম্বা হতে পারে, জানা ছিল না। কাউন্টারের ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকার সময়েও বুঝতে পারিনি। পুরো কাউন্টারের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়েছিল হিলহিলে লম্বা দেহটা!

চক্ষুস্থির হতে তখনও বাকি আমার। ম্যাজিক বাক্স টেনে বার করেই শূন্যকে লক্ষ্য করে হাঁক দিয়েছিল সৃষ্টিছাড়া দোকানদার, কাগজ। বলেই, স্প্রিং বার-করা টুপিটার ভেতর থেকে টেনে বার করেছিল একটা প্যাকিং কাগজ। দড়ি, বলতেই, দেখি, দড়ির বাক্স হয়ে গিয়েছে দোকানদারের মুখবিবর। টানছে তো টানছেই–দড়ি যেন আর ফুরাচ্ছে না। বাক্স বাঁধা হয়ে যেতেই দাঁত দিয়ে দড়ি কেটে দিলে এবং বেশ মনে হল যেন কোঁত করে গিলেই ফেলল দড়ির বাক্স। তারপরেই একটা মোমবাতি ধরল একটা হরবোলা ডামি পুতুলের নাকের ডগায়। পিলে চমকে উঠেছিল দপ করে মোমবাতির শিখা ধরে ওঠায়। তারপরেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল যখন দেখলাম, নিজের একটা আঙুল নির্বিকারভাবে মোমবাতির শিখায় পোড়াচ্ছে দোকানদার! সর্বনাশ! এ তো আঙুল নয়–গালা! লাল গালা! গালা গলে গিয়ে টপটপ করে পড়ছে দড়ির গিঁটের ওপর। প্যাকেট সিল করে দিয়েই জিপকে বলেছিল আজব দোকানদার, এবার তো চাই অদৃশ্য-হওয়া ডিম, তা-ই না? কথাটা বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে খপ করে আমার বুকপকেট থেকে একটা ডিম বার করে প্যাক করে ফেলেছিল কাগজে। এরপরেই আবির্ভূত হল কাঁদুনে বাচ্চা–সেটাও বেরল আমারই কোটের ভেতরের পকেট থেকে। প্রতিটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছিলাম জিপের হাতে। একটা কথাও না বলে প্যাকেটগুলো আঁকড়ে ধরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটা আমার মতো এমনভাবে আকাশ থেকে পড়ার ভাব দেখায়নি আঁতকে ওঠার মতো অত ম্যাজিক দেখেও। চোখ দুটোতেই অবশ্য ফুটে উঠেছিল মনের কথা–ম্যাজিক! ম্যাজিক! এই হল গিয়ে খাঁটি ম্যাজিক!

আচমকা ভীষণ চমকে উঠেছিলাম। নরম নরম কী যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে মাথার ওপর টুপির মধ্যে? টুকুস টুকুস করে লাফ দিচ্ছে তো দিচ্ছেই?

ধাঁ করে টুপি খুলতেই ফরফর করে উড়ে নেমে এসেছিল একটা পায়রা-খড়মড় করে ঢুকে গিয়েছিল কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি বাঘটার পাশে রাখা কার্ডবোর্ড বাক্সের মধ্যে। ছি ছি ছি! বলতে বলতে মহা আড়ম্বরে টুপিখানা নিজের হাতে নিয়েছিল দোকানদার, কাণ্ডজ্ঞান দেখেছেন? ডিম পাড়বার আর জায়গা পেল না!

আরে সর্বনাশ! টুপি ঝাড়তেই যে খান তিনেক ডিম বেরিয়ে এল দোকানদারের হাতের চেটোয়। তার পরেও বেরল একটা মার্বেল গুলি, একটা ঘড়ি, আধ ডজন সেই কাচের বল আর দোমড়ানো কাগজের ডেলা। শেষোক্ত বস্তুটার যেন শেষ নেই। বেরচ্ছে তো বেরচ্ছেই। পর্বতপ্রমাণ কাগজের স্তূপের আড়ালে শেষ পর্যন্ত দোকানদারকে আর দেখতেও পেলাম না। বকবকানিই কেবল শুনে গেলাম। কী আশ্চর্য! টুপির মধ্যে এত জিনিস! তাহলেই দেখুন, ইচ্ছে করলে কত কী-ই না লুকিয়ে রাখা যায় জামা-প্যান্ট-টুপির মধ্যে… আরে… আরে… শেষ কি নেই!

আচমকা স্তব্ধ হল কণ্ঠস্বর। যেন গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে পিন ঠিকরে গেল ইটের ঠোক্করে।

আর কোনও কথা নেই।

কাগজের খসখসানিও নেই।

থমথমে নীরবতা।

টুপির কাজ শেষ হল? জানতে চেয়েছিলাম গলাখাঁকারি দিয়ে। জবাব নেই।

দৃষ্টিবিনিময় করেছিলাম আমি আর জিপ। বিদঘুটে আয়নাগুলোয় দেখেছিলাম বাপ বেটার বিদঘুটে প্রতিবিম্ব–দুজনেরই চোখ বড় বড়।

জিপ কিন্তু রীতিমতো গম্ভীর। শান্ত। নির্বিকার।

হেঁকে বলেছিলাম আমি, এবার যাওয়া যাক। ও মশাই, দাম কত হল?

সাড়া নেই।

গলা চড়িয়েছিলাম, দয়া করে ক্যাশ মেমোটা এবার দিন।

তাচ্ছিল্যের নাসিকাধ্বনি যেন শুনলাম কাগজের ডাঁইয়ের আড়ালে?

জিপকে বলেছিলাম, চল তো দেখি কাউন্টারের ওদিকে–নিশ্চয় লুকিয়ে আছে–মজা করছে।

বাঘটা কিন্তু সমানে মাথা দুলিয়েই যাচ্ছিল এত কাণ্ডের মধ্যে। তার পাশ দিয়ে গেলাম কাউন্টারের ভেতরে। কী দেখলাম জানেন? কাউকে না! মেঝের ওপর কেবল পড়ে রয়েছে আমার টুপিটা। পাশেই বসে একটা খরগোশ। ম্যাজিশিয়ানদের খরগোশদের মতোই বোকা-বোকা চেহারা। কিন্তু ভাবখানা যেন বড় কঠিন সমস্যায় পড়েছে–ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না। আমি টুপি তুলে নিতেই তিন লাফ মেরে চলে গেল চোখের বাইরে।

বাবা! ফিসফিস করে বলেছিল জিপ।

কী রে?

কী সুন্দর দোকান বাবা, খু-উ-উ-ব ভালো লাগছে।

ভালো তো আমারও লাগছে রে। মনে মনেই বলেছিলাম আমি, আরও ভালো লাগত, যদি কাউন্টারটা হঠাৎ নিজে থেকেই লম্বা হয়ে না গিয়ে দরজার পাল্লাটা এঁটে ধরত। মুখে কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ করলাম না, পাছে জিপের নজর সেদিকে গিয়ে পড়ে। অদ্ভুত কাণ্ডটা ওর না দেখাই ভালো।

জিপের নজর তখন অবশ্য খরগোশটার দিকে। লাফাতে লাফাতে পাশ দিয়ে সরে পড়বার মতলবে রয়েছে। জিপ কি অত সহজে ছাড়ে? আদুরে গলায় বললে, এই পুসি, জিপকে একটা ম্যাজিক দেখাবি না? পুসির বয়ে গেছে ম্যাজিক দেখাতে! টুকুস টুকুস করে লাফ দিয়ে সুড়ত করে গলে গেল পাশের একটা দরজা দিয়ে।

অবাক কাণ্ড! এ দরজা তো একটু আগেও চোখে পড়েনি আমার! হলফ করে বলতে পারি, ছোট্ট ঘরখানায় এ দরজা ছিল না। এল কোত্থেকে?

আচমকা ঈষৎ ফাঁক হয়ে-থাকা পাল্লাটা খুলে গেল দুহাট হয়ে–নিঃশব্দে বিটকেল হাসি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল দোকানদার স্বয়ং–যার একটা কান আর-একটা কানের চেয়ে। বেশি লম্বা। হাসিটা দেখে পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল আমার। কেননা, এ হাসি নিছক আমুদে হাসি নয়, সেই সঙ্গে মিশে আছে যেন একটু বেপরোয়া ভাব–যেন আমাকে তোয়াক্কা না করার ভাব–ম্যাজিক জিনিসটার প্রতি আমার অবিশ্বাসী মনোভাবটাকে যেন নস্যাৎ করার মনোভাব। বিচ্ছিরি হাসিটা ঠোঁটের কোণে বিচ্ছিরিভাবে দুলিয়ে রেখেই বলেছিল রহস্যময় জাদুকর, স্যার, শোরুমটা দেখতে চান তো? এমন মসৃণভাবে প্রস্তাবটা রাখল সামনে যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। আঙুলের ওপর জিপের টান অনুভব করলাম– হঠাৎ-আবির্ভূত দরজার দিকে টানছে আমাকে। দৃষ্টি ফেরালাম ভূতুড়ে কাউন্টারটার দিকে পরক্ষণেই চোখাচোখি হয়ে গেল দোকানদারের সঙ্গে। ম্যাজিক জিনিসটা ততক্ষণই মজাদার থাকে, যতক্ষণ তা খাঁটি জাদুবিদ্যা না হয়ে যায়। এখানে যেন বড় বেশি অলৌকিক খেলা দেখে ফেলছি। গা শিরশির করছিল সেই কারণেই। তাই বলেছিলাম, হাতে বেশি সময় নেই। কিন্তু মুখের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দেখি, কীভাবে জানি না, চৌকাঠ পেরিয়ে পৌঁছে গেছি শোরুমের মধ্যে।

আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখচ্ছবি নিরীক্ষণ করতে করতে দোকানদার তখন পরম আয়েশে ঘষছে নিজের দুহাত। হাত তো নয়, যেন রবার দিয়ে তৈরি।

আঙুল-টাঙুলগুলোয় গাঁট-ফাঁটের বালাই নেই বললেই চলে। কথা বলছে যেন মিছরির রসে ডুবিয়ে ডুবিয়ে, বিলকুল খাঁটি ম্যাজিকের জিনিসপত্র, স্যার–নকলি মাল এখানে একটাও নেই।

হারামজাদা! মনে মনেই বলেছিলাম আমি। কিন্তু মুখে তা ব্যক্ত করা সমীচীন নয়। ওই জাতীয় কোনও শব্দ মুখ দিয়ে বার করার আগেই অবশ্য কোটের হাতা ধরে কে যেন টানাটানি আরম্ভ করে দিয়েছিল। চোখ নামিয়েই দেখেছিলাম, একটা লেজওয়ালা লাল রঙের বিটলে বামন-দৈত্য টানাটানি করছে আমার কোটের হাতা ধরে! দোকানদার ধরে রয়েছে তার লম্বা লেজটা। টেনে নিয়ে আনতে চাইছে নিজের দিকে, বিটলে দৈত্যর মহা আপত্তি তাতে–কামড়ে দিতে যাচ্ছে দোকানদারের হাত। কিন্তু ভ্রূক্ষেপ বা ভয়ডর নেই। আশ্চর্য দোকানদারের। চোখের পলক ফেলার আগে অদ্ভুত কায়দায় লেজ ধরে লাল দৈত্যকে টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলে কাউন্টারের পেছনে–খুব স্বাভাবিকভাবেই অবশ্য। মুখের চামড়ায় সামান্যতম বিকৃতি বা কুঞ্চন দেখা গেল না–যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমার অবস্থা কিন্তু তখন শোচনীয়।

নিশ্চয় রবারের তৈরি দৈত্য। নাড়ালেই কিলবিল করে উঠেছে–চকিত দেখায় মনে হয়েছে জ্যান্ত দৈত্য। চক্ষুভ্রম সৃষ্টি করাই তো জাদুকরের মুনশিয়ানা। মনকে এইভাবে প্রবোধ দিলেও কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন ডিগবাজি খেয়ে এসে ঠেকেছিল গলার কাছে!

ঢোক গিলে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম লাল দৈত্যের অন্তর্ধান ঘটতেই। লোকটার হাবভাব মোটেই ভালো লাগেনি। এই ধরনের কুৎসিত কদাকার গা-ঘিনঘিনে নচ্ছার প্রাণীদের ঘাঁটাঘাঁটি যারা করে, তাদের দেখলেই যেমন গা শিরশির করে ওঠে, আমার সারা গা তখন শিরশির করছে ঠিক সেইভাবে। তাকিয়েছিলাম জিপের দিকে। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম ওর অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা দেখে। একদৃষ্টে দেখছে একটা ম্যাজিক ঘোড়া, দুলন্ত ঘোড়া। বিতিকিচ্ছিরি দৈত্যটাকে চোখে পড়েনি জেনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। চোখের ইঙ্গিতে জিপকে দেখিয়ে আর অন্তর্হিত লাল দৈত্যের দিকে ইশারা করে খাটো গলায় বলেছিলাম দোকানদারকে, আশা করি এই ধরনের সৃষ্টিছাড়া জিনিস আর নেই আপনার হেপাজতে?

আরও রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল পাজির পা-ঝাড়া দোকানদারের চোখে-মুখে। খাটো গলাতেই বলেছিল বিষম বিস্ময় প্রকাশ করে, সে কী! ও জিনিস তো এ দোকানের নয়! বাইরে থেকে এসে পড়েছে–আপনিই এনেছেন হয়তো জামা-প্যান্টের মধ্যে। পরের কথাটা নিক্ষিপ্ত হল জিপের উদ্দেশে, খোকা, মনের মতো আর কী দেখতে চাও বল দিকি?

অনেক কিছুই তো দেখতে চায় জিপ–এ দোকানের সবই তো দেখছি ওর মনের মতোই। প্রশ্নটা শুনেই সসম্ভমে তাকিয়েছিল নচ্ছার দোকানদারের দিকে–দুচোখে ফুটে উঠতে দেখেছিলাম ম্যাজিকের ব্যাপারে লোকটার ওপর অপরিসীম আস্থা। বলেছিল সশ্রদ্ধ সুরে, ওটা কি ম্যাজিক তলোয়ার?

খেলনা ম্যাজিক তলোয়ার। বাঁকে না, ভাঙে না, আঙুল কেটেও যায় না। এ তলোয়ার যার কাছে থাকে, আঠারো বছরের নিচে যে কোনও শত্রুকে সে হারিয়ে দিতে পারে তলোয়ার যুদ্ধে। যেমন সাইজ, তেমন দাম। আধ ক্রাউন থেকে সাড়ে সাত পেনি পর্যন্ত। আর এই যে কার্ডের তৈরি ফুল সেট বর্ম দেখছ, এগুলো বাচ্চা নাইট-যোদ্ধাদের খুবই দরকার। এই ঢাল নিয়ে তলোয়ার যুদ্ধে নামলে শত্রুর তলোয়ার গায়ে লাগবে না, এই চটি পায়ে গলালে বিদ্যুৎবেগে শত্রুকে হারিয়ে দেবে, এই শিরস্ত্রাণ মাথায় পরলে কার সাধ্যি তোমার মাথায় তলোয়ারের কোপ মারে।

শুনে যেন দম আটকে এল জিপের–বাবা!

অর্থাৎ এমন জিনিস না কিনলেই নয়। দাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু আমার কোনও কথাতেই কান দেয়নি দোকানদার। জিপকে বেশ কবজায় এনে ফেলেছে ততক্ষণে; জিপ আমার আঙুল ছেড়ে তার আঙুল খামচে ধরে শোরুম ভরতি অজস্র বিদঘুটে জিনিসপত্রের আশপাশ দিয়ে দিব্যি ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে। জিপকে ফেরানোর সাধ্যি তখন আমারও নেই। দেখে মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিল আমার। একটু ঈর্ষাও হয়েছিল। জিপ এত সহজে আমার আঙুল ছেড়ে আর-একজনের আঙুল ধরে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়াবে, ভাবতেও পারিনি। লোকটার অনেক গুণ আছে মানছি, ছেলেপুলে তো বটেই, তাদের বাবাদের মনেও চমক সৃষ্টি করতে পারে, চক্ষু চড়কগাছ করে দেওয়ার মতো নকল সামগ্রীও বানাতে ওস্তাদ, তা-ও মানছি, তবুও

কথা না বাড়িয়ে অগত্যা ওদের পেছনেই লেগে ছিলাম আঠার মতো। বিশেষ করে নজর রেখেছিলাম হাতসাফাইয়ের জাদুকরটার ওপর। জিপ আনন্দ পাচ্ছে, এটাই বড় কথা। সময় হলেই বাপ-বেটায় বেরিয়ে পড়ব দোকানের বাইরে।

শেষ নেই যেন শোরুমের। টানা লম্বা প্রদর্শনী মঞ্চের পর প্রদর্শনী মঞ্চ। জাদুসামগ্রীর বীথি বলা যায়। ম্যাজিক গ্যালারি, থাম, তাক আর কাউন্টার যেন আর ফুরাচ্ছে না। একটা খিলেন শেষ হয় তো আরম্ভ হয় আর-একটা। একটা ডিপার্টমেন্টের শেষে পৌঁছাতেই দেখি ধনুকাকৃতি নতুন ভিলেনের তলায় আর-একটা ডিপার্টমেন্ট। অদ্ভুত বিটকেল কিম্ভুতকিমাকার সহকারীরা প্যাটপ্যাট করে চেয়ে রয়েছে থাম, তাক আর কাউন্টারের আড়াল থেকে। এরকম কিম্ভুতদর্শন সহকারীর দল জীবনে দেখিনি মশায়। সারি সারি বিচিত্র দর্পণে নিজের রকমারি প্রতিবিম্ব দেখছি আর চমকে চমকে উঠছি। পরদার বাহারই বা কতরকম। ধাঁধা সৃষ্টি করে চলেছে বিরামবিহীনভাবে। চোখের ধাঁধা থেকে মনের ধাঁধা। শেষ পর্যন্ত পরদা আর আয়নার গোলকধাঁধায় বনবন করে মাথা ঘুরতে লাগল আমার। কোন দরজা দিয়ে ঢুকেছিলাম আশ্চর্য এই শোরুমের ভেতরে, কোনদিকে যে তা আছে, সে হিসেবও হারিয়ে ফেলেছিলাম।

জিপকে ম্যাজিক ট্রেন দেখিয়েছিল দোকানদার। ম্যাজিকই বটে। বাষ্পে চলে না সে ট্রেন, ঘড়িযন্ত্রের মতো দম দেওয়ার কারবারও নেই। সিগন্যালগুলো যেখানে যা দরকার, কেবল বসিয়ে দিলেই হল, কু-ঝিকঝিক করে গড়িয়ে চলবে জাদু রেলগাড়ি। তারপরেই জিপকে দেখানো হল ভীষণ দামি বাক্স ভরতি সৈনিক। জ্যান্ত সৈন্যরা গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে আসবে বাইরে ডালাটা খুলে ধরে একটা দাঁত-ভাঙা মন্ত্র বললেই। একবার শুনেই সে মন্ত্র মনে রাখার মতো কান আমার নেই। কিন্তু জিপ পেয়েছে ওর মায়ের মতো ধারালো কান। নিমেষে আওড়ে গেল ভজকট মন্ত্রটা। পিঠ চাপড়ে দিয়ে দোকানদার সৈন্যদের দুমদাম করে ছুঁড়ে ঢুকিয়ে দিলে বাক্সের মধ্যে এবং গোটা বাক্সটা তুলে দিলে জিপের হাতে। খোকা, এবার তোমার পালা। জাগাও সৈন্যদের, দোকানদারের মুখ থেকে কথাটা খসতে না-খসতেই মন্ত্র আওড়ে জ্যান্ত সৈন্যদের বাক্সের বাইরে বার করে এনেছিল জিপ।

নেবে নাকি? দোকানদারের প্রশ্ন।

জবাবটা দিয়েছিলাম আমি, নেব বইকী, কিন্তু পুরো দাম নিতে হবে আপনাকে। চুম্বকটাও দিয়ে দেবেন সেই সঙ্গে

কী যে বলেন! বলেই দুমদাম করে সৈন্যদের আবার বাক্সের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে ডালা বন্ধ করে গোটা বাক্সটাকে শূন্যে দুলিয়ে নিতেই চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল আমার। শূন্যপথেই বাদামি কাগজে প্যাকিং হয়ে গেছে বাক্স, সুতো দিয়ে বাঁধাও হয়ে গেছে, এমনকী লেবেলের ওপর জিপের পুরো নাম-ঠিকানা পর্যন্ত লেখা হয়ে গেছে!

আমার ছানাবড়া চক্ষু দেখে সে কী হাসি দোকানদারের।

বলেছিল হাসতে হাসতেই, খাঁটি ম্যাজিক, স্যার। ভেজালের কারবার নেই এ দোকানে।

বিড়বিড় করে বলেছিলাম, এত খাঁটি ম্যাজিক আমার রুচিতে সয় না।

কথাটা বললাম যাকে লক্ষ্য করে, সে কিন্তু ততক্ষণে জিপকে আরও অদ্ভুত অদ্ভুত ম্যাজিকের কায়দা দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। প্রতিটা ম্যাজিকই অদ্ভুত, তার চাইতেও অদ্ভুত হাতসাফাইয়ের কায়দা। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে দোকানদার, গাম্ভীরি চালে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যাচ্ছে জিপ।

যতখানি সম্ভব এড়িয়ে চলছিলাম। কিন্তু কানে ছিপি দিয়ে তো থাকা যায় না। ম্যাজিক দোকানদার যখন যে জাদু-শব্দ উচ্চারণ করছে, চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে হুবহু সেই ঢঙে সেই উচ্চারণে তার পুনরাবৃত্তি শুনছি কচি গলায়! কান সেদিকে থাকলেও মন সরে গিয়েছিল অন্যদিকে৷ শোরুমের বিশালতা এবং মজাদার পরিবেশ সম্বন্ধে আগেই বলেছি। মজা এখানে সর্বত্র। এমনকী কড়িকাঠ, মেঝে, পরদাগুলোতেও। এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা চেয়ারগুলোর মধ্যেও রয়েছে মজা, শুধুই মজা। কেন জানি না বারবার মনে হচ্ছিল, যখনই চেয়ারের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেছি, তখনই যেন চেয়ারগুলো আপনা থেকেই নড়েচড়ে জায়গা বদল করে নিচ্ছিল। নিঃশব্দে চলেছে এই খেলা আমার দুপাশে, আমার পেছনে। সবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে কিন্তু আর কোনও চেয়ারকে জীবন্ত অবস্থায় দেখিনি। এ ধরনের অদ্ভুত মজা মোটেই ভালো লাগেনি আমার। ঘরের ওপরকার কার্নিশে দেখেছিলাম এমন একটা কিলবিলে সর্পিল নকশা, যা আমার রুচি মেনে নিতে পারেনি কোনওমতেই। তার চাইতে বিদঘুটে, সর্পিল হল, কার্নিশ থেকে ঝোলানো সারি সারি কিম্ভুতকিমাকার মুখোশগুলো–নিছক প্লাস্টারে কি অমন ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব?

আচমকা আকৃষ্ট হয়েছিলাম অদ্ভুতদর্শন এক সহকারীর বিটকেল কার্যকলাপ দেখে। স্থূপাকার খেলনার আড়ালে থাকায় সে নিশ্চয় দেখেনি আমাকে, আমি দেখতে পেয়েছিলাম তার শরীরের তিন-চতুর্থাংশ। একটা থামে হেলান দিয়ে অলসভাবে খেলা করছিল নিজের নাকখানাকে নিয়ে অত্যন্ত বীভৎসভাবে! নেই কাজ তো খই ভাজ ভাব নিয়ে সময় কাটানো ঢঙে নিজের গোদা মোটকা নাকখানাকে হঠাৎ দূরবিনের মতো লম্বা করে ফেলেও ক্ষান্ত হয়নি। আরও মজা করার জন্যে ক্রমশ সরু করে ফেলেছিল নাকের ডগা। দেখতে দেখতে লাল রঙে ছোপানো চাবুকের মতো ইয়া লম্বা একখানা নাক সপাং সপাং করে বাতাস আছড়ে গিয়েছিল নিজের খেয়ালে। অতি বড় দুঃস্বপ্নেও যে এমন দৃশ্য দেখা যায়। না! থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চাবুকের মতো হাঁকড়ে চলেছে হিলহিলে লম্বা নাক। কী ভয়ানক! কী ভয়ানক!

দেখেই তো আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল আমার। এস্তে তাকিয়েছিলাম জিপের দিকে– ভয়ানক এই অবসর বিনোদন যেন সে বেচারির চোখে না পড়ে। দেখলাম, একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে ষড়যন্ত্রকারীর মতো সে ফিসফিস করে কথা বলছে। দোকানদারের সঙ্গে। দোকানদারও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হাতে একটা পেল্লায় ড্রাম।

চোখাচোখি হতেই সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠেছিল জিপ, লুকোচুরি খেলা, বাবা! লুকোচুরি খেলা!

বাধা দেওয়ার আগেই মাথার ওপর দিয়ে ড্রামখানা গলিয়ে দিয়েছিল দোকানদার।

সঙ্গে সঙ্গে দাবড়ানি দিয়েছিলাম তারস্বরে, ও কী হচ্ছে? ভয় দেখাচ্ছেন কেন ছেলেটাকে? তুলুন–এখুনি তুলুন!

দ্বিরুক্তি না করে অসম কর্ণের দোকানদার তুলে নিয়েছিল ড্রাম–ঘুরিয়ে ধরেছিল আমার দিকে। শূন্য ড্রাম। টুলও শূন্য! মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেছে আমার পুত্র!…

অদৃশ্যলোক থেকে অশুভশক্তি যদি হাত বাড়িয়ে কারও হৃৎপিণ্ড খামচে ধরে অকস্মাৎ, তখন তার মনের যা অবস্থা হয়–আমারও হল তা-ই। নিজস্ব সত্তা বলে যেন আর কিছুই রইল না। কাঠ হয়ে গেলাম। ধড়ফড় করতেও ভুলে গেলাম। রাগ বা ভয় কোনও বোধশক্তিই আর রইল না।

লম্বা লম্বা পা ফেলে দেঁতো হাসি-হাসা দোকানদারের সামনে গিয়ে লাথি মেরে সরিয়ে দিলাম টুলখানা।

বললাম দাঁতে দাঁত পিষে, কোথায় গেল আমার ছেলে?

দুহাতে শূন্য ড্রামখানা আমার দিকে ফিরিয়ে বললে সে, দেখতেই পাচ্ছেন, লোক ঠকানো কারবার আমরা করি না—

হাত বাড়িয়েছিলাম কাঁধখানা খামচে ধরব বলে। কিন্তু সাঁত করে পিছলে গেল সে নাগালের বাইরে। আবার তেড়ে গেলাম কাঁধ খামচানোর জন্যে। বিদ্যুৎগতিতে ছিটকে গিয়ে সে একটা দরজা খুলে ধরল সটকান দেওয়ার মতলবে। চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠেছিলাম পেছন থেকে, দাঁড়ান… দাঁড়ান বলছি! বলেই ক্ষিপ্তের মতো ধেয়ে গিয়েছিলাম তাকে ধরতে গিয়ে পড়লাম নিঃসীম অন্ধকারের মধ্যে।

ধপ করে একটা আওয়াজ ভেসে এল কানে। কে যেন সশব্দে আছড়ে পড়েছে আমার গায়ের ওপর।

বিমূঢ় অবস্থায় শুনেছিলাম তার ক্ষমা প্রার্থনা–মাপ করবেন। দেখতে পাইনি।

দেখলাম, দাঁড়িয়ে আছি রিজেন্ট স্ট্রিটে। ধাক্কা লেগেছে একজন ভদ্রবেশী শ্রমিকের সঙ্গে। গজখানেক দূরে হতচকিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে জিপ। আমাকে দেখেই কাষ্ঠ হেসে এসে দাঁড়াল পাশে।

বগলে রয়েছে চারখানা প্যাকেট!

ঝকঝকে হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলে মুঠোয় চেপে ধরেছিল আমার একখানা আঙুল। ফ্যালফ্যাল করে আমি কিন্তু তখন ইতিউতি চেয়ে দেখছি। কই, ম্যাজিক দোকানের দরজা তো দেখা যাচ্ছে না! দোকানের চিহ্নও তো কোথাও নেই! ছবির দোকানটা আছে, মুরগিছানার দোকানটা কাছে–ম্যাজিকের দোকানটা গেল কোথায়?

মাথার মধ্যে এইরকম লন্ডভন্ড অবস্থায় একটাই করণীয় ছিল–ফুটপাতের কিনারায় গিয়ে ছাতা তুলে হাঁক দিলাম একটা ছ্যাকড়া গাড়িকে। জিপকে ধরে তুলে দিলাম গাড়ির মধ্যে। অতি কষ্টে মনে করলাম নিজের বাড়ির ঠিকানা, তারপর উঠে বসলাম জিপের পাশে। কোটের পকেটে কী যেন একটা ঠেলে রয়েছে দেখে হাত ঢোকাতেই পেলাম একটা কাচের বল। টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম রাস্তায়।

জিপ শুধু দেখল, কথা বলল না।

বেশ কিছুক্ষণ কেউ কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারিনি।

তারপর জিপ বলেছিল বিষম উচ্ছ্বাসে, বাবা, দোকান বটে–খাঁটি ম্যাজিক!

ধুত্তোর ম্যাজিক! ছেলেটার গায়ে আঁচড় লেগেছে কি না, মনটা ঠিকঠাক আছে কি না, আগে তো সেইটা দেখি। সন্ধানী চোখে দেখেও গোলমাল কোথাও দেখলাম না। ছেলে আমার ঠিকই আছে, বরং বেশ ফুর্তিতেই আছে–বৈকালিক প্রমোদ উপভোগ করেছে মনপ্রাণ দিয়ে। বগলে রয়েছে চার-চারখানা প্যাকেট।

কিন্তু কী আছে প্যাকেটের মধ্যে?

মুখে বলেছিলাম, ছোটদের রোজ রোজ যেতে নেই এ ধরনের দোকানে।

চুপ করে রইল জিপ। নিরুচ্ছ্বাস, নিরুত্তাপ। যা ওর স্বভাব। হু-হুঁ করে উঠেছিল মনটা। সেই মুহূর্তে ওর মা যা করত, আমিও তা-ই করেছিলাম। হঠাৎ হেঁট হয়ে চুমু খেয়েছিলাম ওর কপালে। হাজার হোক, ছেলেটা তো মজা পেয়েছে, আমি না-ই বা পেলাম!

প্যাকেটগুলো পরে খোলার পর আশ্বস্ত হয়েছিলাম পুরোপুরি। তিনটে বাক্সের মধ্যে সিসের সৈন্য। মামুলি খেলনা। কিন্তু ভারী সুন্দর দেখতে। এত সুন্দর যে, জ্যান্ত সৈন্য না পাওয়ার দুঃখ ভুলে গিয়েছিল জিপ। চতুর্থ বাক্সটায় ছিল কিন্তু একটা জ্যান্ত বেড়ালছানা। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। যেমন স্বাস্থ্য, তেমনি খিদে। মেজাজি নয় মোটেই।

হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম প্যাকেট চারটের জিনিসপত্র দেখে। তারপরেও অবশ্য মন না চাইলেও আপনা থেকেই পা চলে যেত ওর খেলাঘরের দিকে, ঘুরঘুর করতাম আশপাশে…

এ ঘটনা ঘটেছিল ছমাস আগে। এই ছমাসের মধ্যে উদ্ভট কিছু না ঘটায় মনের মধ্যে আর কোনও অস্বস্তি বোধ করিনি। সব বেড়ালছানার মধ্যে অল্পবিস্তর ম্যাজিক থাকে, ব্যতিক্রম দেখিনি এই বেড়ালছানার ক্ষেত্রেও। ম্যাজিকের নামগন্ধ পাইনি তিন বাক্স সিসের সৈন্যদের মধ্যে। খেলনা হিসেবে অতুলনীয়।

কিন্তু হুঁশিয়ার ছিলাম জিপকে নিয়ে। বুদ্ধিমান বাপ-মা মাত্রই ছেলেকে চোখে চোখে রাখে এমতাবস্থায়

একদিন জিজ্ঞেসও করেছিলাম, জিপ, ধর তোর সৈন্যগুলো জ্যান্ত হয়ে গিয়ে যদি কুচকাওয়াজ করতে আরম্ভ করে দেয়, কী করবি তখন?

করেই তো, ডালাটা খোলবার আগে শুধু ফুসমন্তরটা বলে দিই, সরলভাবে বলেছিল জিপ।

বাস? সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় কুচকাওয়াজ?

নইলে কি এত ভালোবাসতাম?

চমকে ওঠাটা স্বাভাবিক। উঠেছিলাম।

তারপর বেশ কয়েকবার জানান না দিয়ে হুট করে ঢুকে পড়েছিলাম ওর খেলাঘরে। দেখেছিলাম, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৈন্যরা। কিন্তু ম্যাজিক আচরণ কারও মধ্যে দেখিনি ক্ষণেকের জন্যেও। টাকাকড়ির ব্যাপারটা এবার বলা যাক। দেনা মিটিয়ে দেওয়ার বদভ্যেসটা আমার মজ্জাগত। ম্যাজিক দোকানের খোঁজে রিজেন্ট স্ট্রিটে বহুবার হানা দিয়েছি, হতাশ হয়েছি প্রতিবারেই। তবে, দোকানদার যখন জিপের নাম-ঠিকানা জেনে বসে আছে, তখন আশা আছে, একদিন-না-একদিন বিলটা পৌঁছাবেই, দামটাও মিটিয়ে দেব। টাকাকড়ির ব্যাপারটা তাই ছেড়ে দিয়েছি ম্যাজিশিয়ান মহাশয়ের মর্জির ওপর।

জীবন্ত স্বপ্ন

জীবন্ত স্বপ্ন ( A Dream of Armageddon)

[‘A Dream of Armageddon’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Black and White’ পত্রিকায় জুন ১৯০১ সালে। পরে ‘Thomas Nelson and Sons’ থেকে ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘The Country of the Blind and Other Stories’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়।]

লোকটাকে দেখেছিলাম রাগবি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। সাদা নিরক্ত মুখ। শ্লথ চরণ। কুলির দরকার, কিন্তু হেঁকে ডাকছে না কুলিকে। খুবই অসুস্থ মনে হয়েছিল। তাই চেয়েছিল একদৃষ্টে। পা টেনে টেনে এসে বসে পড়েছিল আমার পাশে। পাঁজর গুড়ো করে যেন বেরিয়ে এসেছিল দীর্ঘশ্বাসটা। গায়ের শালটা কোনওমতে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে শূন্য চাহনি মেলে তাকিয়েছিল অন্যদিকে। একটু পরেই অস্বস্তি জাগ্রত হয়েছিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, আমার নিষ্পলক চাহনি তার ওপরেই নিবদ্ধ রয়েছে বুঝতে পেরে। বারেক তাকিয়েছিল আমার দিকে। পরক্ষণেই ফের চোখ মেলেছিল আমার ওপর।

বই পড়ে যাওয়ার ভান করেছিলাম আমি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে বিড়ম্বনায় ফেলেছি, এই আশঙ্কায় আর তার দিকে তাকাইনি। অবাক হয়েছিলাম একটু পরেই। কী যেন সে বলছিল আমাকে।

কিছু বলছেন? জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।

আঙুল তুলে আমার হাতের বইটা দেখিয়ে সে বলেছিল, স্বপ্ন সংক্রান্ত বই, তা-ই না?

নিশ্চয়, ড্রিম স্টেটস নামটা তো প্রচ্ছদেই লেখা রয়েছে।

চুপ করে ছিল সে কিছুক্ষণ। যেন বলার মতো কথা খুঁজছে মনের মধ্যে। তারপর বলেছিল আত্মগত স্বরে, কিন্তু ওরা তো কিছু বলবে না আপনাকে।

মানে বুঝলাম না। তাই নীরব রইলাম।

সে বললে, জানলে তো বলবে।

খুঁটিয়ে দেখছিলাম তার মুখচ্ছবি। সে বলেছিল, স্বপ্ন আছে বইকী–বিলক্ষণ আছে।

এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করি না আমিও।

দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে সে তখন বলেছিল, স্বপ্ন দেখেন? মানে, জীবন্ত স্বপ্ন?

বলেছিলাম, স্বপ্নই দেখি কম। বছরে তিনটেও হয় কি না সন্দেহ।

আবার চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল সে। যেন কথা সাজাচ্ছে মনের মধ্যে।

তারপরেই প্রশ্ন করেছিল আচমকা, স্মৃতি আর স্বপ্ন কি তালগোল পাকিয়ে যায়? স্বপ্ন আদৌ সত্যি বলে মনে হয় কখনও?

কদাচিৎ। ক্ষণেকের জন্যে দ্বিধা জাগে মাঝেমধ্যে। সবারই তা-ই হয়।

বইতে কী লিখছে?

লিখছে, মনের মধ্যে গভীর চাপ পড়লে স্বপ্নে তার প্রকাশ ঘটতে পারে। স্বপ্নের তীব্রতা থেকেই বিচার করে নেওয়া যায় স্বপ্নদৃশ্য সত্যি কি না। অনেক অনুমিতি আছে এ ব্যাপারে। জানেন নিশ্চয়।

সামান্যই জানি। তবে সব কটা অনুমিতিই যে ভুল, সেটা জানি বেশ ভালো করেই।

শীর্ণ হাত বাড়িয়ে জানলার ফিতে ধরে নাড়তে লাগল সে। দেখে, ফের তুলে নিলাম। বইটা। অমনি সে ঝুঁকে পড়ল আমার দিকে। বই পড়া আর হল না পরবর্তী প্রশ্নে।

ধারাবাহিক স্বপ্ন বলে কিছু আছে কি? এমন স্বপ্ন, যা চলে রাতের পর রাত?

আছে বলেই তো মনে হয়। মানসিক রোগ সংক্রান্ত বহু বইতে এ ধরনের স্বপ্নের বৃত্তান্ত আছে।

মানসিক রোগ! হয়তো তা-ই। মনই তো উপযুক্ত ক্ষেত্র। কিন্তু আমি যা বলতে চাই, কথা থামিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল নিজের অস্থিময় আঙুলের গাঁটের দিকে, এ ধরনের স্বপ্ন কি বারে বারে ফিরে আসে? সত্যিই কি এর নাম স্বপ্ন? অন্য কিছু নয় তো?

ছিনেজোঁকের মতো কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে নির্ঘাত দাবড়ানি দিয়ে বসতাম। সামলে নিলাম শূন্যগর্ভ চাহনি আর রক্তিম ঠোঁট দেখে। এ চাহনির অর্থ যারা বোঝবার, তারা বোঝে।

চুপ করে আছি দেখে সে বলেছিল, আপনার মতামতের জন্য তর্ক করছি ভাববেন না যেন। মরতে বসেছি এই স্বপ্নের জ্বালায়! তাই

স্বপ্নের জ্বালায়?

জানি না তাকে স্বপ্ন বলবেন কি না। রাতের পর রাত চলছে এই উৎপাত। জীবন্ত স্বপ্ন। এত জীবন্ত যে, সেই তুলনায় রেললাইনের ধারে ওই ল্যাম্পপোস্টগুলোকেও মনে হয়। অবাস্তব! তখন কিন্তু আর মনেই পড়ে না কে আমি… কী আমার কাজ…

আটকে গেল কথা। একটু পরে–এই এখনই ধরুন-না কেন…

সব স্বপ্নই একই, এই তো বলতে চান? আমার প্রশ্ন।

সব শেষ… সব শেষ।

মানে?

আমি মারা গেছি।

মারা গেছেন?

রাতের পর রাত জেগে উঠেছি এই পৃথিবীরই অন্য এক অঞ্চলে, অন্য এককালে– স্বপ্নের মধ্যে। রাতের পর রাত জাগরণ ঘটেছে অন্য এক জীবনধারার মধ্যে। রাতের পর রাত নতুন নতুন ঘটনা, নতুন নতুন দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে। তারপর একদিন সব শেষ হয়ে গেছে। খুন হয়ে গিয়েছি। স্বপ্ন বলতে এখন যা রয়েছে তা মড়ার স্বপ্ন। চিরমৃত্যু আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাকে। শেষ দৃশ্যটা

মানে আপনার মৃত্যুর দৃশ্য?

হ্যাঁ, আমার মৃত্যুর দৃশ্য।

তারপর থেকে

না, আর নেই। স্বপ্ন খতম হয়েছে সেইখানেই।

বেশ বুঝলাম, উদ্ভট এই স্বপ্নকাহিনি আমাকে না শুনিয়ে ছাড়বে না লোকটা। হাতে অবশ্য সময় আছে পুরো একটা ঘণ্টা।

বলেছিলাম, অন্য এককালে জীবনযাপনের কথা কী বলছিলেন, বুঝলাম না। কাল মানে কী বলতে চাইছেন, অন্য একটা যুগ? অন্য শতাব্দী?

হ্যাঁ।

অতীতে?

না, না, সে যুগ আসবে।

তিন হাজার খ্রিস্টাব্দ কি?

কত খ্রিস্টাব্দ, তা তো বলতে পারব না। মনে ছিল স্বপ্নের মধ্যে জাগরণের সময়ে। এখন ভুলে গেছি। তা ছাড়া, সাল-শতককে ওরা খ্রিস্টাব্দের হিসেবেও প্রকাশ করে না। কী যেন বলে– বলে, কপালে হাত রেখে মনে করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল সেনাঃ, একদম মনে পড়ছে না।

ক্লিষ্ট হাসি ভেসে ওঠে ঠোঁটের কোণে। ক্ষণেকের জন্যে মনে হয়েছিল, স্বপ্নবৃত্তান্ত আমাকে শোনানোর আদৌ কোনও বাসনা হয়তো নেই। স্বপ্নের কথা যারা চেপে যায়, দুচক্ষে তাদের দেখতে পারি না আমি। কিন্তু এ ব্যাপারটা মনে হচ্ছে সেরকম নয়। আমার সহযোগিতা দরকার। তাই বলেছিলাম, ধরুন—

জীবন্ত… প্রথম থেকেই। হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে যায় নতুন এক জীবনের মধ্যে। তখন কিন্তু এই জীবনের কিছু মনে পড়ে না। অদ্ভুত, তা-ই না? মনে হয় যেন স্বপ্নের আয়ু যতক্ষণ, ততক্ষণ যা কিছু ঘটছে, তা-ই যথেষ্ট। স্বপ্নের জীবনের বাড়তি আর কোনও জীবন নিষ্প্রয়োজন। হয়তো, নাঃ, গোড়া থেকেই বলা যাক। দেখাই যাক-না, কতখানি মনে করতে পারি। হঠাৎ নিজেকে দেখি, একটা বাগানের মধ্যে বসে আছি, সামনে সমুদ্র। এর আগেকার কোনও ব্যাপারই মনে পড়ছে না। ঢুলছি। আচমকা তন্দ্রা ছুটে গেল। যেন স্বপ্ন নয়, সত্যি সত্যিই আধঘুম থেকে জেগে উঠলাম। কারণ আর কিছুই নয়। যে মেয়েটা বাতাস করছিল হাতপাখা দিয়ে, তার হাত আর চলছে না, গায়ে হাওয়া লাগছে না।

মেয়েটা?

হ্যাঁ, সেই মেয়েটা। কথার মাঝে কথা বলবেন না। সব ভুলে যাব।

বলতে বলতে সে থমকে গেল আচমকা, পাগল ভাবছেন না তো?

না তো। স্বপ্ন দেখছিলেন। বলে যান, কী দেখছেন।

তন্দ্রা ছুটে গেল মেয়েটা বাতাস করা থামিয়েছে বলে। অবাক হচ্ছি না হঠাৎ এমন একটা জায়গায় নিজেকে দেখে। আচমকা সেখানে পৌঁছে গেছি বলেও মনে হচ্ছে না। ঘুম ভাঙল, ঠিক সেইখান থেকেই সহজভাবে শুরু হয়ে গেল জীবনের ধারা। ঊনবিংশ শতাব্দীর যা কিছু স্মৃতি, ভাবীকালের সেই জীবনে মিলিয়ে গেল মন থেকে তৎক্ষণাৎ। এ যুগের কোনও ছাপই রইল না চিন্তার মধ্যে। আমার এখানকার নাম কুপার, তা-ও মুছে গেল চেতনা থেকে। জেগে রইল কেবল সেই যুগে আমার যা নাম, যা সামাজিক অবস্থান

কী নাম?

হেডন।

হেডন।–তারপর?

স্বপ্ন ছুটে যাওয়ার পর অনেক কথাই কিন্তু মনে নেই। ঘটনাগুলো পরপর ঠিকমতো মনে পড়ছে না। তখন কিন্তু জ্ঞান ছিল টনটনে… উদ্ভট মনে হচ্ছে না তো?

একেবারেই না। চালিয়ে যান। বাগানটা কীরকম বলুন।

বীথি বলা যায়–মামুলি বাগান নয়। সঠিক নামটা বলা সম্ভব নয়। দক্ষিণমুখো। ছোট্ট। ছায়াচ্ছন্ন। বারান্দার মাথার ওপর আধখানা চাঁদের মতো ফাঁক দিয়ে কেবল দেখা যাচ্ছে আকাশ, সমুদ্র। কোণে দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটা। আমি বসে রয়েছি একটা ধাতুর তৈরি কৌচে –ডোরাকাটা গদির ওপর। বারান্দায় হেলান দিয়ে আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়েটা। সূর্য উঠছে। আলো পড়েছে তার কানে আর গালে। ঢেউখেলানো চুল লুটিয়ে রয়েছে ভারী সুন্দর সাদা কাঁধে। পেছনে সূর্য থাকায় শীতল নীলাভ ছায়া লুটিয়ে রয়েছে সাদা কাঁধে। পোশাকের বর্ণনা দেওয়াটা একটু মুশকিল। জবরজং কিছু নয়–সহজ সুন্দর। উচ্ছল প্রপাতের মতোই ঢল নেমেছে যেন গা বেয়ে। এককথায় বলা যায়, তার সৌন্দর্য মনকে টানে টানছিল আমাকেও। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম। মাথা তুলেছিলাম। সে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল আমার পানে।

আমার বয়স তিপ্পান্ন এই যুগে। আমার মা আছে, বোন আছে, বন্ধু আছে, স্ত্রী আছে, মেয়ে আছে। তাদের প্রত্যেকের মুখের ছবি জ্বলজ্বল করছে মনের মধ্যে, কিন্তু সবচেয়ে বাস্তব মনে হচ্ছে এই মেয়েটার মুখের ছবি। স্মৃতির পটে ফুটিয়ে তুলতে পারি ইচ্ছে করলেই–ছবি এঁকেও ফেলতে পারি, এত স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও

স্তব্ধ হল বিচিত্র সহযাত্রী। আমি বাগড়া দিলাম না। চেয়ে রইলাম।

সে বললে, স্বপ্নে দেখা মুখ। তবুও তা সত্যি… অনেক বেশি সত্যি। সুন্দরী নিঃসন্দেহে। কিন্তু ভয়ানক নিরুত্তাপ সৌন্দর্য নয়, এ সৌন্দর্যের উদ্দেশে অর্ঘ নিবেদন করতে মন চায়– তাপসিক রূপরাশি বতে যা বোঝায়, তা-ই। ধমনিতে কামনার তুফান তোলে না–রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয় না। স্নিগ্ধ দ্যুতিবর্ষণ জুড়িয়ে দেয় হৃদয়-দহনকে, মিষ্টি ঠোঁটের নরম হাসি আর শান্ত গম্ভীর ধূসর চোখের চাহনি পেলব প্রলেপ দিয়ে যায় অস্থিরচিত্তে। তার ঘুরে দাঁড়ানো, তার ঘাড় বাঁকানো, তার বাহুভঙ্গিমা–সবকিছুর মধ্যেই এমন একটা সুকুমার ছন্দ

বলতে বলতে যেন কথা হারিয়ে ফেলল স্বপ্নকাতর মানুষটা। মাথা হেঁট করে বসে রইল কিছুক্ষণ। মাথা তোলার পর মুখচ্ছবিতে দেখলাম পরম স্বস্তিবোধ। গল্পের বাস্তবতায় যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে, গোপন করার প্রয়াসও নেই মুখের পরতে পরতে।

জীবনের যা কিছু উচ্চাশা, সবই ছেড়ে এসেছি শুধু এই মেয়েটির জন্যে। পেয়েছি অনেক, চাওয়ারও রয়েছে অনেক কিছু–কিন্তু চাওয়া-পাওয়া সবই হেলায় ত্যাগ করেছি শুধু এই পরমাসুন্দরীর জন্যে। উত্তর অঞ্চলের জনগণের শীর্ষে ছিলাম। ছিল প্রভাব, প্রতিপত্তি, যশ, অর্থ, বিপুল সম্পত্তি। ওই রূপসির পাশে নিষ্প্রভ, অকিঞ্চিৎকর, তুচ্ছ মনে হয়েছে জীবনের এতগুলো পাওয়া। তাকে নিয়ে চলে এসেছি রোদ্দুর ঝলমলে আনন্দ উচ্ছল এই শহরে জীবনের শেষটুকু শান্তিতে কাটাতে। অনেক পরিকল্পনা ছিল, ছিল বিস্তর উচ্চাকাক্ষা–ছিটেফোঁটাও এখন আর নেই মনের মধ্যে। বাহুবলে আর বুদ্ধিবলে অর্জিত সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছি জীবনের গণ্ডি থেকে–শুধু এই মেয়েটিকে কাছে পাওয়ার জন্যে। তার ভালোবাসা পেয়েছি, পাব আমৃত্যু, সেই হোক আমার পরম বিত্ত, বাকি যা কিছু ঐশ্বর্য, মিলিয়ে যাক ধরণির ধুলায়, নশ্বর এই সংসারে অমর তো কেবল প্রেম… অক্ষয়, অব্যয়, অম্লান। আমার হৃদয় জুড়ে থাক কেবল সেই ভালোবাসা, বাকি সবকিছুই মনের মরীচিকা, মিথ্যে অহংকারের প্রাসাদ, যাক-না মিলিয়ে ভোরের কুয়াশার মতো। রাতের পর রাত এই ছিল আমার একমাত্র আকাক্ষা, আত্যন্তিক যাচ, নিষিদ্ধকে পাওয়ার উদগ্র বাসনা।

কিন্তু কোনও পুরুষেই পারে না মনের এই আবেগ আর-এক পুরুষের মনে সঞ্চারিত করতে। এ যেন একটা রঙের আভাস, একটা রশ্মির ঝলক, আসে আর যায় চকিতে। উপলব্ধি করা যায় সত্তা দিয়ে, ব্যক্ত করা যায় না ভাষা দিয়ে। ধরা যায় না, কেবল টের পাওয়া যায় পরিবর্তনের পর পরিবর্তন পালটে দিয়ে যাচ্ছে দিগন্ত থেকে দিগন্তব্যাপী মনের আকাশকে।

তাই তো আমি ত্যাগ করেছি ওদের সব্বাইকে, ফেলে এসেছি মহাসংকটের মধ্যে, সুরাহা কর গে নিজেরাই, যা পারে।

ঝরনাধারার মতো হেঁয়ালির পর হেঁয়ালির আবির্ভাবে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম আমি। –কাদের কথা বলছেন? কাদের ফেলে এলেন মহাসংকটের মধ্যে?

উত্তর অঞ্চলের মানুষ তারা। আমাকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, আমার কথায় প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাকে চোখেও দেখেনি, কিন্তু তবুও তাদের চোখে আমি একটা বিরাট পুরুষ। অসীম আস্থা আমার ওপর। বিশাল এই দেশ জুড়ে ষড়যন্ত্র আর হানাহানি, বিশ্বাসঘাতকতা আর উত্তেজনা চলছে বছরের পর বছর। রুখে দাঁড়িয়েছি আমি। ভয়ানক খেলা খেলে এসেছি বছরের পর বছর। অরাজকতা চরমে পৌঁছেছে একটা সংঘবদ্ধ দুষ্টচক্রের দাপটে। এদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ সংঘবদ্ধ হতে পেরেছে আমাকে ঘিরে। আমি তাদের শ্রদ্ধেয়, বরেণ্য, আস্থাভাজন নেতা। সাধারণ মানুষের ভাবাবেগ আর বোকামির সুযোগ নিয়েছে এই দুষ্টচক্র, চোখধাঁধানো বিরাট বিরাট পরিকল্পনা আর গালভরা কথাবার্তা দিয়ে ধোঁকা দিয়ে চলেছে বছরের পর বছর দেশের মানুষকে, রসাতলে যেতে বসেছে গোটা দেশটা। সে দেশের বর্ণময় পূর্ণ চিত্র আপনার সামনে তুলে ধরা সম্ভব নয়। অনেক জটিল, অনেক বক্র। স্বপ্নের মধ্যে কিন্তু অনুপুঙ্খ চিত্র ধরা পড়েছিল আমার মনের আকাশে। কেউ বলে দেয়নি, করাল কুটিল এই দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছি আমি, কিন্তু আমি তা নিমেষে জেনেছিলাম তন্দ্রা ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। ঢুলুনির মধ্যেও ভাবছিলাম বলেই চোখ রগড়ে নিয়ে ভাবনার রেশ ধরে মনকে বুঝিয়েছিলাম, ভালোই করেছি হানাহানির ওই নোংরা পরিবেশ থেকে রোদ্দুর ঝলমলে এই শহরে সরে এসে, ওই তো দাঁড়িয়ে আমার মনের মানুষ, শুধু যাকে নিয়েই আমি সুখী হতে পারব শেষ জীবনটায়। প্রেম আর সৌন্দর্য, আকাঙ্ক্ষা আর আনন্দের এই জগৎই প্রকৃত জগৎ, দ্বন্দ্ব আর সংঘর্ষময় নিরানন্দ জীবনের শেষে যত বিরাট প্রাপ্তিই থাকুক না, এর তুলনায় তা কিছুই নয়। মুগ্ধ চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম আপন মনে, সব ছেড়েও সব পেয়েছি শুধু তোমাকে পেয়ে।

আনন্দোচ্ছল কণ্ঠে সে ডেকেছিল আমাকে–এখানে এসো-না, দেখে যাও কী সুন্দর সূর্য উঠছে মন্টি সোলারোতে।

লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছিলাম ডাক শুনেই। দেখেছিলাম, সাদা চুনাপাথরের পাহাড় ঝলমল করছে ভোরের আলোয়। তার আগে অবশ্য মুগ্ধ হয়েছিলাম মেয়েটির সুন্দর কাঁধে আর গালে সকালের রোদের বিচিত্র খেলা দেখে। ক্যাপ্রিতে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই–

ক্যাপ্রি! মন্টি সোলারো! সোল্লাসে বাধা দিয়েছিলাম আমি, আরে, আমি তো উঠেছি মন্টি সোলারোর পাহাড়ে। চুড়োয় বসে ভেরো ক্যাপ্রিও খেয়েছি। কাদার মতো ঘোলাটে, সিডার সুরার মতো তেজালো অদ্ভুত ভেরো ক্যাপ্রির স্বাদ তো ভোলবার নয়।

যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল নিরক্তমুখ সহযাত্রী–যাক, আপনি তাহলে দেখেছেন। আমি কিন্তু আজও জানি না কোথায় সেই ক্যাপ্রি দ্বীপ–যাইনি জীবনে। গোটা দ্বীপটা একটা বিরাট হোটেল। অজস্র ছোট ছোট ঘর চুনাপাথরের গা খুদে তৈরি। সমুদ্র থেকে অনেক উঁচুতে। এত বড় আর এত জটিল হোটেল এ যুগে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না বলেও আপনাকে বোঝাতে পারব না। দ্বীপের একদিকে মাইলের পর মাইল ভাসমান হোটেল আর ভাসমান মঞ্চ–উড়ুক্কু যানের অবতরণ মঞ্চ। এ যুগে তার কিছুই দেখতে পাবেন না।

আমরা দাঁড়িয়ে আছি অগুনতি ঘরের একটা ঘরে। অন্তরিপের শেষ প্রান্তে। দেখা যাচ্ছে পূর্বদিক আর পশ্চিমদিক। পূর্বে রয়েছে একটা বিশাল খাড়াই পর্বত-হাজারখানেক ফুট উঁচু তো বটেই। ধূসর রং–নিরুত্তাপ শীতল। একটা দিক কেবল সোনালি হয়ে রয়েছে সকালের রোদ পড়ায়। পর্বতের ওদিকে দেখা যাচ্ছে সাইরেন দ্বীপপুঞ্জ–বিলীয়মান উপকূলরেখা। পশ্চিমে চোখ ফেরালে দেখা যায় ছোট্ট একটা উপসাগর। এখনও ছায়া ঘনিয়ে রয়েছে বালুকাময় সৈকতে। ছায়াগর্ভ থেকে উন্নতশিরে দাঁড়িয়ে সোলারো পর্বত। সোনা-রোদে সোনালি চুড়ো। পেছনে সাদা চাঁদ। পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত বহুরঙা সমুদ্রে ভাসছে পালতোলা নৌকো-অজস্র।

পূর্বদিকের নৌকোগুলো তখনও ধূসর কিন্তু স্পষ্ট–পশ্চিমদিকেরগুলো যেন সোনা দিয়ে তৈরি–জ্বলছে ছোট ছোট আগুনের শিখার মতো। আমাদের ঠিক নিচেই একটা পাথরের খিলানের মধ্যে দিয়ে সবুজ আর সাদা ফেনা ছড়িয়ে বেরিয়ে আসছে একটা পাল আর দাঁড়ওয়ালা লম্বাটে নিচু জাহাজ।

ফ্যারাগলিওনি, বাধা না দিয়ে পারলাম না। পাথরের খিলানটার নাম ফ্যারাগুলিওনি। ডুবতে বসেছিলাম ওই সবুজ আর সাদা ফেনার মধ্যে

সায় দিলে নিরক্তমুখ লোকটা–হ্যাঁ, ঠিক নামই বলেছেন। ফ্যারাগলিওনি। মেয়েটার মুখে শুনেছি। একটা গল্পও বলেছিল। গল্পটা… গল্পটা… রগ টিপে কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে–নাঃ, মনে পড়ছে না।

যাক গে, প্রথম স্বপ্নকাহিনিটাই বরং বলা যাক। কিচ্ছু ভুলিনি। ফিসফিস করে কথা বলছিলাম দুজনে–আমি আর সেই মেয়েটা। ঘরে আর কেউ ছিল না। তবুও কথা বলছিলাম গলা নামিয়ে। কারণটা আর কিছুই না–কাছাকাছি হয়েও যেন মনুকে মেলে ধরার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

খিদে পেল একটু পরেই। অদ্ভুত একটা অলিন্দ পেরিয়ে পৌঁছালাম প্রাতরাশ খাওয়ার বিরাট ঘরে। অদ্ভুত অলিন্দ এই কারণে যে, সেখানকার মেঝে দিয়ে হাঁটতে হয় না–শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে হয়–মেঝে গড়িয়ে যায় আপনা থেকে।

প্রাতরাশ ঘরে উপচে পড়ছে আনন্দ আর হাসি। বাজছে তারের বাজনা। রোদ্দুর ঠিকরে যাচ্ছে ফোয়ারা থেকে। টেবিলে বসে হাসিভরা মুখে দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে তন্ময় হয়ে রইলাম রকমারি খাবার নিয়ে। তাই খেয়াল করিনি, অদূরে টেবিলে বসে একটি লোক একদৃষ্টে চেয়ে আছে আমার দিকে।

খাওয়া শেষ করে গেলাম নাচের ঘরে। সে ঘরের বর্ণনা দিই কীভাবে, ভেবে পাচ্ছি না। বিরাট ঘর। এ যুগের বিরাটতম প্রাসাদের চেয়েও বিরাট সেই একখানা হলঘর। অনেক উঁচুতে মাথার ওপরে রয়েছে প্রস্তর-বীথিক্যাপ্রির তোরণ। বড় বড় থাম থেকে মেরুজ্যোতির মতো অজস্র ধারায় ঝুলছে সোনার সুতো। অজস্র সুন্দর প্রস্তরমূর্তি, অদ্ভুত ড্রাগন, সূক্ষ্ম জটিল কিম্ভুতকিমাকার স্ট্যাচুর গা থেকে ঠিকরে পড়ছে বিচিত্র আলো। দিনের আলোও ম্লান হয়ে যাচ্ছে ঘরের কৃত্রিম আলোকপ্রভায়। হাজার হাজার নরনারী পাশ দিয়ে যেতে যেতে সসম্ভ্রমে দেখছে আমাকে আর আমার পাশের মহিলাকে। আমাকে সবাই চেনে, শ্রদ্ধা করে। নাম-যশ-দ্বন্দ্ব ত্যাগ করে প্রমোদ-দ্বীপে চলে এসেছি শুধু এই রূপসির সঙ্গকামনায়–এইটুকুই কেবল এরা জানে। সবটুকু জানে না–অথবা বিভিন্ন রটনাই কেবল শুনেছে–তবুও আমার প্রতি শ্রদ্ধা-সম্ভমে চিড় খায়নি এতটুকু।

হাজার হাজার নাচিয়ে আশ্চর্য রঙিন ডিজাইনের পোশাক পরে গোল হয়ে নাচছে। মূর্তিগুলো ঘিরে। হাজার হাজার নরনারী খোশগল্প করছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, অথবা পানাহারে হাসি-মশকরায় উল্লোল করে তুলেছে নাচের ঘর। হাজার হাজার যুবক-যুবতী দল বেঁধে হাসতে হাসতে ঢুকছে ঘরে-হুঁল্লোড় করে বেরিয়ে যাছে ঘর থেকে। বাজছে অদ্ভুত সুরেলা বাজনা–এ যুগের কোনও বাজনদার মন-ভরিয়ে-তোলা সেই সুরের ইন্দ্রজাল কল্পনাও করতে পারবে না। সে ঘরে কেবল হাসি আর গান, সুর আর নাচ, আনন্দ আর উল্লাস ছাড়া আর কিছু নেই।

আমরা হাত ধরাধরি করে নাচলাম। নাচিয়েরা দুপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিলে। প্রগলভতা নেই আমার সুন্দরী সঙ্গিনীর নাচের ছন্দে। আছে শুধু অতলান্ত গভীরতা–শান্ত মিষ্টি হাসি আর চাহনির মধ্যে আছে আরও অনেক কিছু, যা শুধু উপলব্ধি করা যায় হৃদয় দিয়ে।

হলঘরে আসবার সময়ে লক্ষ করেছিলাম অদূরে টেবিলে আসীন লোকটাকে। নির্নিমেষে চেয়ে ছিল আমার পানে। চোখে চোখ রাখিনি।

নাচ শেষ করে যখন সঙ্গিনীকে নিয়ে বসেছি নিরালায়–সেই লোকটা আমার বাহু স্পর্শ করে জানালে, কথা আছে। এখানে নয়, নিরিবিলিতে।

আমি বলেছিলাম, যা বলবার, এঁর সামনেই বলা হোক। বলুন কী চান? লোকটি তখন বলেছিল, উত্তর অঞ্চলে আমার নেতৃত্ব নিতান্তই দরকার হয়ে পড়েছে। দল যে ভেঙে যেতে বসেছে দ্বিতীয় নেতা এক্সহ্যামের অবিচক্ষণতায়। যুদ্ধ ঘোষণা করে ফেলেছে ঝোঁকের মাথায়। বুদ্ধির সূক্ষ্মতা তার কোনওকালেই নেই। এই আশঙ্কাটাই। করেছিল সবাই আমাকে ছাড়তে চায়নি এই কারণেই।

শুনতে শুনতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়েছিল মাথার মধ্যে। সাংগঠনিক ক্ষমতা যে আমার শিরা-উপশিরায়–নতুন করে দলের মধ্যে শক্তিসঞ্চারের নেশায় তাই চনমন করে উঠেছিলাম।

তারপরেই চোখ পড়েছিল সঙ্গিনীর নীরব মুখের দিকে। আমি তো জানি, এখন উত্তর অঞ্চলে ফিরে যাওয়া মানেই বিচ্ছেদ

লোকটা জানত, আমার মনে এ দ্বিধা আসবেই। তাই নতুন করে কথার জাল বিছিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিল–

কিন্তু আমি আর কথা বাড়াতে দিইনি। বিদায় জানিয়েছিলাম।

যাবার সময়ে সে শুধু একটা কথাই বলে গেল–যুদ্ধ।

নীরবে বসে রইলাম দুজনে। অনেকক্ষণ পরে সঙ্গিনী বললে, যুদ্ধ যদি লাগে, তোমার তো ফিরে যাওয়াই উচিত। দল ভেঙে যেতে বসেছে

বুঝিয়ে বলেছিলাম, যুদ্ধ লাগছে শুধু এক্সহ্যামের হঠকারিতার জন্য। এটা যদি বুঝে থাকে দলের আর সবাই, এক্সহ্যামকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা তারাই করুক-না কেন। আমার যাওয়ার দরকার নেই।

এরপর গেলাম সমুদ্রস্নানে। স্নান শেষে ফিরে এলাম ঘরে–সে আর আমি। ঢুলুনি এসেছিল। হঠাৎ যেন বেহালার তারে টংকার জাগল–তন্দ্রা ছুটে গেল। দেখলাম, লিভারপুলে নিজের খাটে শুয়ে আছি, এই যুগে।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে কেবলই মনে হয়েছিল, স্বপ্ন নয়–যা কিছু ঘটে গেল, সব সত্যি। দাড়ি কামাতে কামাতে, স্নান করতে করতে কেবলই ভেবেছি, এক্সহ্যামের অবিমৃশ্যকারিতার জন্য অ্যামি কেন সুন্দরী সাহচর্য ছেড়ে ফিরে যাব উত্তরাঞ্চলে? স্বপ্ন দেখার পর এভাবে কেউ কিন্তু ভাবে না। বিশেষ করে আমার পক্ষে এমন ভাবাটা নিতান্তই হাস্যকর। কারণ, পেশায় আমি আইনজীবী। অথচ, ঘুরে-ফিরে স্বপ্নদৃশ্য মনে পড়ছে নিখুঁতভাবে। এমনকী, টেবিলের ওপর রাখা আমার স্ত্রী-র একখানা বইয়ের প্রচ্ছদে সোনালি বর্ডার দেখে মনের মধ্যে ভেসে উঠল নাচের ঘরের থাম থেকে মেরুজ্যোতির মতো ঝুলে-থাকা সোনার সুতোগুলোর দৃশ্য। এত সুস্পষ্টভাবে স্বপ্নদৃশ্য কেউ কি মনে করতে পারে?

মাথা নেড়ে বললাম, না, পারে না।

লিভারপুলের নামী আইনবিদ আমি। মক্কেলদের ভিড়েও কিছুতেই ভুলতে পারিনি, আজ থেকে হাজার দুয়েক পরে এক প্রেমিকার সাহচর্য উন্মনা করে রেখেছে আমাকে– দুহাজার বছর পরে আমার সন্তানসন্ততিদের হঠকারিতা নিয়ে বিচলিত রয়েছি সারাদিন। নেতৃত্ব আর সাংগঠনিক শক্তি যার সহজাত, অবিচক্ষণ নেতার অদূরদর্শিতায় সে উতলা রয়েছে প্রতিটি মুহূর্তে। সেইদিনই একটা নিরানব্বই বছরের বিল্ডিং লিজ নিয়ে দারুণ কথাকাটি হয়ে গেল মক্কেলের সঙ্গে। মাথা গরম হয়ে যাওয়ার ফলেই বোধহয় স্বপ্নটা আর দেখেনি। পরের রাতেও ফিরে আসেনি জীবন্ত স্বপ্নদৃশ্য। ভাবলাম বুঝি, স্বপ্নই দেখেছি তাহলে। নিতান্তই অলীক ব্যাপার। সত্যতা বা বাস্তবতার নামগন্ধও নেই। তারপরেই আবার আবির্ভাব ঘটল আশ্চর্য স্বপ্নের।

এবার এল চার রাত্রি পর। এই চার দিন চার রাত স্বপ্নদৃশ্যও ফুরিয়েছে, অনেক ঘটনা ঘটে গেছে ওর মধ্যে। স্বপ্নে জাগরণের ঠিক পরেই আমি গুম হয়ে বসে ছিলাম সেইসবের ভাবনায়, চমক ভাঙল সুন্দরী সঙ্গিনীর গলা শুনে। ডাকছে আমার নাম ধরে।

দেখলাম, দুজনে পাশাপাশি হাঁটছি প্রমোদ-শহরের বাইরে, এসে পড়েছি মন্টি সোলারোর চুড়োর কাছে, দূরে দেখা যাচ্ছে উপসাগর। তখন বিকেল গড়িয়ে এসেছে। অনেক দূরে বাঁদিকে দেখা যাচ্ছে সোনালি কুয়াশার মধ্যে ইশচিয়া, পাহাড়ের বুকে নেপলস, সামনেই ভিসুভিয়াসের চুড়ো থেকে ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে দক্ষিণদিকে, দেখা যাচ্ছে। টোরি অ্যাম্বুজিয়াটা আর ক্যাস্টেলামারের ধ্বংসস্তূপ।

চকিতে বললাম, ক্যাপ্রি গেছেন নিশ্চয়?

গেছি–স্বপ্নের মধ্যে। স্বপ্নের মধ্যেই দেখেছি উপসাগরে ভাসমান প্রাসাদের পর প্রাসাদ, নোঙর-বাঁধা অবস্থায়। উত্তরদিকে দেখেছি এরোপ্লেন নামবার ভাসমান মঞ্চের পর মঞ্চ, বিকেল হলেই প্রমোদসন্ধানীরা হাজারে হাজারে এসে নামছে এরোপ্লেনে করে।

এইসব দেখছি আর ভাবছি, কেন এক্সহ্যামের নির্বুদ্ধিতার নিরশন ঘটাতে উত্তরাঞ্চলে যাব আমি। আমিও মানুষ–আমারও সুখের প্রত্যাশা আছে। আমাকে যারা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, তারা তাদের সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই ডাকছে আমাকে। আমার স্বার্থ আমি দেখব না কেন? মানুষের মতো বাঁচার অধিকার তো আমার আছে।

চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল এরোপ্লেনের গর্জনে। চারখানা বিশালকায় অদ্ভুতদর্শন যুদ্ধবিমান খেলা দেখাচ্ছে শূন্যে। এক্সহ্যামের নির্বুদ্ধিতার অন্যতম নিদর্শন। চিরকালই ও এইরকম। চমক লাগিয়ে লোকের মন কেড়ে নেয়। বুদ্ধির কুশলতা নেই বলে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। বিমান মহড়া দেখিয়ে সাধারণ মানুষের চোখে নিজেকে শক্তিমান করে তোলার এই প্রয়াসে গা জ্বলে গেল আমার। যুদ্ধবিমানগুলো তৈরি হয়েছিল অনেকদিন আগে-যুদ্ধে কখনও নামেনি। অস্ত্রবিশারদদের তৈরি বহু বিধ্বংসী অস্ত্রই এখন গাদায় পড়ে। সাধারণ মানুষ পাট চুকিয়ে দিচ্ছে অস্ত্রশস্ত্রের। নির্বোধ এক্সহ্যাম তা সত্ত্বেও শক্তি প্রদর্শন করে চলেছে আকাশে-বাতাসে। ওর গর্ব খর্ব করতে পারি আমি এখুনি। উত্তরের মানুষ আমাকে ছাড়া কাউকে নেতা বলে মানে না। পূর্বের আর দক্ষিণের মানুষের কাছে উত্তরের মানুষ বলতে কেবল আমিই। সবাইকে একজোট করতে পারি আমি চক্ষের নিমেষে। কিন্তু কেন করব? কেন আমার মনের মানুষকে ছেড়ে নিরর্থক এই দ্বন্দ্ব রাজনীতির মধ্যে ছুটে যাব?

যার জন্যে যেতে চাই না, সে কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে রাতের পর রাত আমাকে বুঝিয়েছে –ফিরে যেতে বলেছে উত্তরে, বৃহত্তর স্বার্থে, দেশের লোকের স্বার্থে।

কথাগুলো মনে পড়তেই কীরকম যেন হয়ে গেলাম। দুহাতে ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নেমে এলাম পাহাড়ের গা বেয়ে। যারা আমাকে চেনে, তারা অবাক হয়ে গেল কাণ্ড দেখে। ভ্রূক্ষেপ করিনি আমি। পেছনে শুনলাম উড়ুক্কু যুদ্ধ-যন্ত্রযানের প্রচণ্ড ধাতব শব্দ।

দেখতে কীরকম মেশিনগুলো? প্রশ্ন করেছিলাম কৌতূহলী হয়ে।

বর্শার ফলার মতো–ডান্ডাটা কেবল নেই। গোলা বেরয় পেছনের ডান্ডার জায়গা থেকে –সামনের ফলাটা ঢু মারার জন্যে। গতিবেগ প্রচণ্ড। উড়ন্ত গাছের পাতা বলা যায়।

কী দিয়ে তৈরি?

লোহা নয়।

অ্যালুমিনিয়াম?

তা-ও নয়। খুব মামুলি একটা ধাতু-তামা-পিতলের মতো সব জায়গায় পাওয়া যায়। নামটা… নামটা… আবার রগ টিপে ধরে মনে করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলে নিরক্তমুখ সলিসিটর–নাঃ, কিছুতেই মনে পড়ছে না।

যা-ই হোক, ফিরে যাওয়ার শেষ সুযোগটা ছেড়ে দিলাম কীভাবে, এবার তা শুনুন। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে যখন ফিরে এলাম প্রমোদ-শহরে, তখন আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে। ছাদে বেড়াতে বেড়াতে চোখের জলে সঙ্গিনী আমাকে বারবার মিনতি করেছিল উত্তরে ফিরে যেতে। নইলে যে যুদ্ধ লাগবেই, দেশে দেশে জমিয়ে রাখা অস্ত্রের ভাঁড়ার খালি হবেই–পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি নিজেও তা জানি বইকী। দক্ষিণের নেতারা একজোট হয়ে এক্সহ্যামের ধাপ্পাবাজির উচিত জবাব দিয়েছে গরম গরম ভাষায়। তামাম এশিয়া, সব কটা মহাসাগর থমথম করছে আসন্ন শেষ বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে। ঘন ঘন হুঁশিয়ারি যাচ্ছে ইথার আর তারের মধ্যে দিয়ে সাজ-সাজ রব উঠেছে সারা পৃথিবীতে।

কিন্তু আমি যাব না–কিছুতেই না। কথায় আমার সঙ্গে সে পারেনি। বুঝিয়ে দিয়েছিলাম কেন আমি যাব না। যদি তার মৃত্যু হয়, আমারও মৃত্যু হোক তৎক্ষণাৎ।

ফিরে যাওয়ার শেষ সুযোগটা হাতছাড়া করলাম এইভাবেই।

তারপর গেছে তিনটে সপ্তাহ–স্বপ্নে জাগরণ ঘটতে লাগল ঘন ঘন। এই তিনটে হপ্তার প্রায় প্রতিরাত্রে স্বপ্নই আমার একমাত্র জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার চাইতেও বেশি কষ্ট গেছে, যে রাতগুলো স্বপ্নহীন অবস্থায় কেটেছে। ছটফট করেছি বিছানায় শুয়ে, অভিশপ্ত এই জীবনে, আমার জীবন্ত স্বপ্নের জীবনে তখন কিন্তু সময় বয়ে চলেছে ঘটনার পর ঘটনার মধ্যে দিয়ে, ভয়াবহ ঘটনাপরম্পরার বিন্দুবিসর্গ জানতে পারিনি, বিষম উদ্‌বেগে বিনিদ্র রাত্রি কাটিয়েছি যে কী কষ্টে, তা শুধু আমিই জানি।

ভাবনার মধ্যে কিছুক্ষণ তলিয়ে রইল সলিসিটর।

তারপর বললে, রাতের বেলায় স্বপ্নের মধ্যে জাগরণের মুহূর্তে যা যা ঘটেছে, সব আপনাকে খুঁটিয়ে বলে যেতে পারি, প্রতিটি ব্যাপার মনে পড়ছে, কিন্তু দিনের বেলায় কী যে ঘটেছে, কিছুতেই তা মনে করতে পারি না। অনেক চেষ্টা করেছি, বিদ্রোহী থেকেছে স্মৃতি বরাবর

ঝুঁকে পড়ে দুহাত জড়ো করে বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ অবস্থায় বসে রইল নিরক্তমুখ মানুষটা।

তারপর কী হল বলুন, জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।

হারিকেন ঝড়ের মতো যুদ্ধ ফেটে পড়ল পৃথিবীময়।

অবর্ণনীয় এক দৃশ্যের পানে যেন চেয়ে রইল সে বিস্ফারিত চোখের শূন্য চাহনি মেলে।

বলুন? তাড়া লাগিয়েছিলাম আমি।

আত্মগত সুরে সে বললে, অবাস্তবতার ঈষৎ ছোঁয়াকেই লোকে বলে দুঃস্বপ্ন। কিন্তু আমি যা দেখেছি, তা দুঃস্বপ্ন নয়… না, না, তা দুঃস্বপ্ন নয়… কিছুতেই নয়!

আবার নীরবতা। ভয় হল, কাহিনির শেষের অংশে নিশ্চয় বীভৎস ঘটনাপরম্পরার জন্যেই মুখ খুলতে চাইছে না নিরক্তমুখ সহযাত্রী। আমিও আর তাড়া না লাগিয়ে চাবি এঁটে রইলাম মুখে। অচিরেই অবশ্য শুরু হয়ে গেল স্বগতোক্তি।

পালিয়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। ভেবেছিলাম, যুদ্ধের আওতার বাইরে থাকবে ক্যাপ্রি। কিন্তু দুরাত যেতেই যুদ্ধ-পাগল হয়ে উঠল গোটা দ্বীপটা। খেপে গেল দ্বীপের প্রতিটি মানুষ। উৎকট গলাবাজিতে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম হল বললেই চলে। প্রতিটি পুরুষ, প্রতিটি নারীর বুকে ঝুলতে দেখলাম এক্সহ্যামের ব্যাজ। ব্যাজ না-পরার জন্যে আমার সঙ্গিনীর ওপরেই ঝাজিয়ে উঠল এক মহিলা। বুঝলাম, আমার সময় খতম হয়ে গেছে। ব্যাজের দাম এখন অনেক বেশি–আমার চেয়ে। মানুষের গাদাগাদি, কানের কাছে যুদ্ধ-সংগীতের উন্মত্ত অট্টরোল-কাঁহাতক আর সওয়া যায়।

সঙ্গিনীকে নিয়ে ফিরে এলাম নিজের ছোট্ট ঘরে। অপমানিত, লাঞ্ছিত, নিগৃহীত হয়েও মুখ খুলতে পারলাম না। যে সুযোগ হারিয়েছি, আর তো তা ফিরে আসবে না। নিষ্ফল ক্রোধে ফুলতে লাগলাম ছোট্ট বন্দিশালায়। রক্তহীন সাদা মুখে নীরবে শুধু চেয়ে রইল আমার সঙ্গিনী। ঝগড়া করতেও পিছপা হতাম না, যদি এ অবস্থার জন্যে সামান্যতম দোষারোপও শুনতে হত সেই সময়ে।

খানদানি চালচলনের কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না আমার মধ্যে। প্রস্তর কারাগারে পায়চারি করেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আর দেখেছি, কালো সমুদ্রের ওপর দিয়ে আলোর ঝলক ছুটে যাচ্ছে দক্ষিণের আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে দেখতে দেখতে।

বারংবার বলেছিলাম–আর নয়, এবার পালাতে হবে। এ যুদ্ধে আমার কোনও ভূমিকা নেই–থাকবেও না। শান্তি যখন নেই এ দ্বীপে, চল, তখন চলে যাই।

পরের দিন বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের খপ্পর থেকে পলায়ন করেছিলাম দুজনে। দূরে… দূরে অনেক দূরে।

কত দূরে?

জবাব নেই।

কদ্দিন লেগেছিল পালাতে?

সে নিরুত্তর। মুখ সাদা। হাত মুষ্টিবদ্ধ। আমার কৌতূহল তাকে আর স্পর্শও করছে না।

পালিয়ে গেলেন কোথায়?

কখন?

ক্যাপ্রি থেকে বেরিয়ে?

দক্ষিণ-পশ্চিমে। নৌকোয় করে।

এরোপ্লেন নিলেন না কেন?

সব এরোপ্লেনই তখন যুদ্ধ-পাগলদের হাতে।

আর প্রশ্ন করা সমীচীন বোধ করলাম না। একটু পরে সে যেন নিজের মনের সঙ্গেই তর্ক চালিয়ে গেল আত্মগত সুরে।

কেন এই যুদ্ধ? কেন এই রক্তক্ষয়? কেন জীবন নিয়ে হানাহানি? ভালোভাবে জীবনটাকে উপভোগ করব বলেই তো সরে এসেছিলাম যুদ্ধ থেকে ভালোবেসে বাঁচতে চেয়েছিলাম, ঢলঢলে দুটো চোখের মধ্যে নতুন জীবনের ছবি দেখেছিলাম, সুন্দর একটা মুখের মধ্যে জীবনের আহ্বান স্পন্দিত হতে দেখেছিলাম। কিন্তু তার বদলে কী পেলাম? যুদ্ধ আর মৃত্যু!

স্বপ্ন ছাড়া তো কিছু না।

স্বপ্ন! দপ করে জ্বলে উঠেছিল সে–এখনও বলবেন এর নাম স্বপ্ন!

সেই প্রথম দেখলাম, প্রচণ্ড প্রাণশক্তির প্রলয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটল যেন তার মধ্যে। দুহাত মুঠো পাকিয়ে শূন্যে তুলে ফের নামিয়ে নিল হাঁটুর ওপর। চোখ ফিরিয়ে নিলে আমার দিক থেকে। বাকি কথাগুলো বলে গেল অন্যদিকেই চেয়ে।

প্রেতচ্ছায়ার মতোই অনেক বাসনা-কামনা ঘিরে রয়েছে আমাদের। প্রেতচ্ছায়ার মধ্যে প্রেতচ্ছায়ার মতোই এগিয়ে চলেছি আমরা দিনের পর দিন। আলো আর ছায়ার মতো বাস্তবতা আর অবাস্তবতার দোলায় দুলে যাচ্ছি নিরন্তর। একটা বিষয় কিন্তু স্বপ্ন নয়। মোটেই, কখনও নয়। যা আমার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, আর সবকিছুই তুচ্ছ, নগণ্য, অকিঞ্চিৎকর এই কেন্দ্রবিন্দুর কাছে। সব মিথ্যে, সব ফাঁকা! কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আমার সঙ্গিনী, যাকে আমি ভালোবাসি, আমার স্বপ্নের সেই সঙ্গিনী, যাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। মারা গেছি দুজনেই!

স্বপ্ন! যে স্বপ্ন একটা জীবন্ত মানুষের দিবস-রজনির প্রতিটি মুহূর্তে বিষম যাতনায় ভরিয়ে রাখে, তাকে কি স্বপ্ন বলা যায়? স্বপ্নের শোকের যন্ত্রণা জাগরণে একজনকে এইভাবে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দিতে পারে? তবুও বলবেন এর নাম স্বপ্ন?

সঙ্গিনী নিহত হওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত আশা ছিল, পালিয়ে বেঁচে যাব। নৌকোয় যাওয়ার সময়ে দেখেছিলাম যুদ্ধসাজে সজ্জিত ক্যাপ্রিকে। সাদা পাথরের অজস্র জানলা আর তরুবীথি-সমারোহ দেখে তখনও শান্তির নিকুঞ্জ বলেই মনে হয়েছিল দ্বীপটাকে। তারপরে চোখে পড়েছিল বিরাট বিরাট হাতিয়ার। উত্তরে-দক্ষিণে-পূর্বে দেখেছিলাম বর্শাফলকের আকারে ধাবমান বিমানশ্রেণির ছুটোছুটি। এ্যাম নিশ্চেষ্ট নেই–ধেয়ে যাচ্ছে পূর্বে। পূর্বের বিমান ধেয়ে যাচ্ছে উত্তরে। দক্ষিণ থেকেও আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে বিমান। বিশালকায় পাখির দঙ্গল পঙ্গপালের মতো ছেয়ে ফেলেছে আকাশকে। যুদ্ধে মেতেছে সারা পৃথিবী।

ডাঙায় পায়ে হেঁটে যেতে গিয়ে বাধা পেয়েছি পদে পদে। পকেটে অর্থ নেই–আমার পরিচয়েরও আর কোনও দাম নেই। সঙ্গিনীর নিগ্রহ-সম্ভাবনায় কারও কাছে। দাক্ষিণ্যপ্রত্যাশীও হইনি। ঘন ঘন কামান নির্ঘোষ শুনেছি দক্ষিণ-পশ্চিমে। চোরের মতো গা ঢেকে আমরা এগিয়েছি শুধু উত্তরদিকে। পথকষ্ট ক্লান্ত করেছে সঙ্গিনীকে, কষ্ট কাকে বলে, জীবনে সে জানেনি, তবুও মুখ ফুটে কখনও তা ব্যক্ত করেনি। খিদের জ্বালা মুখ বুজে সহ্য করে গেছে। ছিন্ন পোশাকে ধুলোয় আর নোংরায় আমাদের চেহারা পর্যন্ত পালটে গেছে। পালাচ্ছে চাষিরাও। ধরা পড়ছে সৈন্যদের হাতে, চালান করছে সেনাশিবিরে। মতলব ছিল, আবার একটা নৌকো নিয়ে সমুদ্রে ভাসব, কিন্তু তা আর হল না। যুদ্ধ গিলে নিল আমাদের দুজনকেই।

বেশ বুঝেছিলাম, দুদল সৈন্যের মাঝে পড়ে গিয়েছি৷ লড়াইয়ের ঠিক মাঝখানে। ঘন ঘন এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। শুনছি কামান নির্ঘোষ। সেসব কামান এ যুগের কামানের চেয়েও অনেক বেশি বিধ্বংসী, সে যুগের যুদ্ধবিমানদের ক্ষমতা যে কদ্দূর, সে হিসেবও কেউ রাখে না, তৈরি হওয়ার পর থেকে কোনও দিন কাজে তো লাগেনি…

আমার সঙ্গিনী কাঁদছিল। আমি পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পথকষ্ট আর সইতে পারছে না–কাঁদুক। একটু আগে মিনতি করেছিল। আমি রাজি হইনি। যুদ্ধে আমি নেই–থাকবও না। অনুতাপ? একেবারে নেই। মৃত্যু? আসুক-না।

মাথার ওপর ফাটল একটা গোলা। দূরে কয়েকটা বিমান জ্বলতে জ্বলতে ফেটে গেল শুন্যে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, সঙ্গিনী উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়েছে আমার দিকে। তারপরেই মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে।

কাছে গেলাম। হৃৎপিণ্ড এ ফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে গোলার টুকরোয়।

তারপর?

পাঁজাকোলা করে তাকে বয়ে আনলাম কতকগুলো পুরানো মন্দিরের মাঝে একটা চত্বরে–কবরখানা বলেই মনে হল। পাথরের ওপর তাকে শুইয়ে পাশে বসে রইলাম পাথরের মতো। টিকটিকি আর গিরগিটি ছুটোছুটি করতে লাগল আশপাশে।

এইভাবেই কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। স্বপ্ন থেকে ফিরে এসে দেখেছিলাম, বসে রয়েছি অফিসঘরে। কীভাবে যে ঘুম থেকে উঠে জামাকাপড় পালটে অফিসে এসেছি, কিছু মনে নেই। চিঠিপত্র দেখে গেছি যন্ত্রের মতো–কী লেখা ছিল কাগজপত্তরে–তা-ও মনে নেই।

আবার যখন ফিরে গেলাম স্বপ্নের মধ্যে–দেখেছিলাম, একদল সৈন্য এগিয়ে যাচ্ছে মন্দির চত্বরের দিকে–আমি বসে আছি বাইরে। বাধা দিয়েছিলাম। আমার ভাষা তারা বোঝেনি। আমিও তাদের ভাষা বুঝিনি। একজন তলোয়ারধারীর হাত চেপে ধরতেই

তলোয়ারটা আমূল ঢুকিয়ে দিয়েছিল আমার বুকে।

না। কোনও যন্ত্রণা অনুভব করিনি৷ অপরিসীম বিস্ময়বোধে শুধু আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম।

লন্ডন এসে গেছে। ল্যাম্পপোস্টের পর ল্যাম্পপোস্ট সাঁত সাঁত করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। গোধূলির রক্তাভা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গতি কমে আসছে ট্রেনের।

আর স্বপ্ন দেখেননি? প্রশ্ন করেছিলাম বিষম উৎকণ্ঠায়।

দেখেছি। শুধুই দুঃস্বপ্ন। মন্দিরের ওদিকে রয়েছে আমার সঙ্গিনী। কাছে যেতে পারছি না কিছুতেই।

কুলির হাঁক শুনলাম বাইরে।

———–

[অনুবাদক: আরমাগেডন–বাইবেলে, বিশেষ করে বুক অব রিভিলেশন-এ শেষের দৃশ্য, শুভ বনাম অশুভ শক্তির চূড়ান্ত লড়াই। এ লড়াই হবে বিচার দিবসের আগে। নামের মধ্যে সম্ভবত মেগিডো পাহাড়ের উল্লেখ আছে। বহু প্রাচীন যুদ্ধের ক্ষেত্র ছিল বলে লোকপ্রসিদ্ধ যুদ্ধ প্রতীক হিসাবে মেগিডো পাহাড় বিখ্যাত।]

ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ

ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ ( The Remarkable Case of Davidsons Eyes )

[‘The Remarkable Case of Davidsons Eyes’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘The Story of Davidsons Eyes’ নামে, ১৮৯৫ সালের মার্চ মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায়। যদিও ওয়েলসের খুব বিখ্যাত গল্পগুলির মধ্যে একে গণ্য করা হয় না, গল্পটি সে যুগের রিমোট ভিউইং গোত্রের গল্পগুলির মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। এরপর গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় বিখ্যাত সাই-ফাই পত্রিকা ‘Amazing Stories’-তে, প্রথম বর্ষপূর্তি সংখ্যায় ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে। অদ্রীশের কলমে গল্পটি বাংলায় অনুদিত হয় অধুনালুপ্ত কিশোর মন পত্রিকায় ১৯৮০-র দশকে ‘ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ’ নামে।]

সিডনি ডেভিডসনের ক্ষণস্থায়ী মানসিক ভ্রান্তি এমনিতেই রীতিমতো চমকপ্রদ। ওয়েড যে ব্যাখা শুনিয়েছেন, তা মানতে গেলে ব্যাপারটা আরও বেশি চমকপ্রদ হয়ে দাঁড়ায়। দূর ভবিষ্যতে নাকি দারুণ দারুণ ঘটনা ঘটবে যোগাযোগব্যবস্থায়। পৃথিবীর এ পিঠ আর ও পিঠের মধ্যে দূরত্ব বলে আর কিছুই থাকবে না। স্বচ্ছন্দে মিনিট পাঁচেক কাটিয়ে আসা যাবে পৃথিবীর উলটোদিকে। ঘর ছেড়ে বেরতেই হবে না–চেয়ার ছেড়েও নড়তে হবে না। এমনও হতে পারে, লুকিয়ে-চুরিয়ে কোনও গোপন কাজই আর করা যাবে না। অদৃশ্য চাহনি খর-নজর রাখবে আমাদের প্রতিটি গুপ্ত ক্রিয়াকলাপের ওপর। ভবিষ্যতে এমনি অনেক পিলে-চমকানো সম্ভাবনা সত্যি সত্যিই পিলে চমকে দেবে বাস্তবের চেহারা নিয়ে। ডেভিডসন এই সৃষ্টিছাড়া ভ্রান্তি-ঘোরে আক্রান্ত হয়েছিল আমার সামনেই। প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী আমিই। কাজেই কাহিনিটা কাগজে-কলমে প্রকাশ করার দায়িত্বও আমার।

ঘটনাস্থলে প্রথম হাজির হয়েছিলাম আমি–তাই আমি সেই মুহূর্তের প্রত্যক্ষদর্শী। আশ্চর্য ব্যাপারটা ঘটেছিল হার্লো টেকনিক্যাল কলেজে-হাইগেট আর্চওয়ের পাশেই। ছোট ঘরটায় ছিলাম আমি। নোট লিখছিলাম। ওজন করার সরঞ্জাম থাকে এই ঘরেই। কাজে অবশ্য মন দিতে পারছি না। লন্ডন শহরটার ঝুঁটি ধরে যেন ঝাঁকুনি দিচ্ছে সাংঘাতিক ঝড়। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাজ পড়ছে। আচমকা একটা বাজের আওয়াজে কানের পরদা যেন। ফালাফালা হয়ে গেল! দারুণ চমকে উঠেছিলাম। বজ্রপাতের কানফাটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা আওয়াজ যেন ভেসে এল কানে পাশের ঘর থেকে। কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ। লেখা থামিয়ে কান খাড়া করলাম। সেকেন্ডকয়েক আর কোনও আওয়াজ পেলাম না। ঢেউখেলানো দস্তা-ছাদের ওপর শিলাবৃষ্টির ঝমাঝম আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। ঠিক যেন শয়তানের আঙুলের বাদ্যি। খট খটা খট! খট খটা খট! খট খটা খট! তারপরেই আবার কানে এল আর-একটা আওয়াজ। দড়াম করে কী যেন আছড়ে পড়ল বেঞ্চি থেকে নিচে। বেশ ভারী জিনিস। না, এবার আর কানের ভুল নয়। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দরজা খুলে ঢুকলাম বড় ল্যাবরেটরির মধ্যে।

অবাক হয়ে গিয়েছিলাম বিদঘুটে একটা হাসির আওয়াজ শুনে। ডেভিডসনকে অপ্রকৃতিস্থের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ঘরের মাঝখানে। পা টলছে। চোখে-মুখে ভ্যাবাচ্যাকা ভাব। দেখেই প্রথমে মনে হয়েছিল, নেশা করেছে। আমাকে লক্ষই করল না। হাত বাড়িয়ে বাতাসে কী যেন খামচে ধরার চেষ্টা করছে দশ আঙুল দিয়ে। জিনিসটা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। ডেভিডসনের রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে, অদৃশ্য বস্তুটা রয়েছে চোখের গজখানেক সামনে। হাত বাড়িয়ে দিল খুব আস্তে আস্তে। বেশ দ্বিধার সঙ্গে খামচে ধরল বস্তুটা। কিন্তু পেল না কিছুই। আপন মনেই বললে, ব্যাপার কী বুঝছি না। দশ আঙুল ছড়িয়ে হাত বুলিয়ে নিলে মুখে। কী আশ্চর্য! বলেই পা তুলল বদ্ধপাগলের মতো–যেন পা আটকে যাচ্ছে মেঝেতে বেগ পেতে হচ্ছে পা তুলতে।

চিৎকার করে বলেছিলাম, ডেভিডসন! হল কী তোমার? বোঁ করে আমার দিকে ফিরে তাকাতে লাগল ডেভিডসন আমার আশপাশ দিয়ে। কখনও তাকায় আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছনে, কখনও দুপাশে, কখনও সোজাসুজি আমার দিকেই। অথচ দেখতে পেয়েছে বলে মনেও হল না। বিড়বিড় করে বললে নিজের মনে–ঢেউ! ঢেউ! পালতোলা জাহাজটাও কী সুন্দর। বেলোজের গলা শুনলাম না? হ্যাঁ, বেলোজের গলাই তো বটে! না, ভুল হয়নি। হ্যাল্লো? তুমি কোথায়? আচমকা চেঁচিয়ে উঠল গলার শির তুলে।

আমি ভাবলাম বুঝি ফচকেমি শুরু করেছে ডেভিডসন। তারপরেই দেখলাম, তার পায়ের কাছে ভেঙেচুরে পড়ে রয়েছে ল্যাবরেটরির সবচেয়ে ভালো ইলেকট্রোমিটারটা। বললাম, কী চ্যাংড়ামি হচ্ছে ডেভিডসন? ইলেকট্রোমিটারটা ভাঙলে কেন?

আরে গেল যা! বেলোজই তো চেঁচাচ্ছে। ইলেকট্রোমিটার ভেঙেছি? বেলোজ! এ বেলোজ! কোথায় তুমি? বলেই আচমকা টলতে টলতে এগিয়ে এল আমার দিকে। বেঞ্চির সামনে এসেই যেন কুঁচকে গেল। মাখনের মধ্যে পা চালিয়ে এলাম যেন এতক্ষণ। এখন তো আর পারছি না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলতে লাগল মাতালের মতো।

এবার ভয় পেলাম। বললাম, কী হল তোমার?

ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে ঘুরে ঘুরে আমাকে খুঁজল ডেভিডসন। বললে আপন মনে, বেলোজের গলা। কিন্তু বেলোজ! কী ইয়ারকি হচ্ছে? সামনে এসো-না!

ডেভিডসন কি হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেছে? সন্দেহটা বিদ্যুঝলকের মতোই ঝলসে উঠল মাথার মধ্যে। টেবিলটাকে পাক দিয়ে ওর হাতে হাত রাখলাম, সাংঘাতিক চমকে উঠল ডেভিডসন। জীবনে এভাবে চমকে উঠতে কাউকে দেখিনি। আতঙ্কে বিকৃত মুখভঙ্গি করে দাঁড়াল আত্মরক্ষার ভঙ্গিমায়। সেই সঙ্গে সেই অর্থহীন চিৎকার–যাচ্চলে! এ আবার কে?

আমি–ডেভিডসন–আমি বেলোজ!

তিড়িং করে লাফিয়ে উঠেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ডেভিডসন–আমাকে ছুঁড়ে আমার মধ্যে দিয়ে ওর দৃষ্টি চলে গেল অনেক দূর!

তারপরই শুরু হল বিড়বিড় বকুনি। নিজের মনেই বকে চলেছে–আমার উদ্দেশে বলছে না কিছুই–এই তো দিনের আলো… ঝকঝক করছে সমুদ্রসৈকত। লুকিয়ে থাকবে কোথায়? পাগলের মতো চাইল ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে। দেখি তো কোথায়? আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়েই ধাঁ করে ধেয়ে গেল সটান বড় ইলেকট্রোম্যাগনেটটা লক্ষ্য করে– পরক্ষণেই ধাঁই করে এক ধাক্কা। পরে দেখেছিলাম, কাঁধ আর চোয়ালের হাড়ে কালশিটে পড়ে থেঁতলে গিয়েছিল এইভাবে দমাস করে আছড়ে পড়ায়। যন্ত্রণায় মুখ বেঁকিয়ে এক পা পেছিয়ে এসে সে কী গোঙানি–হে ভগবান! এ কী হল আমার! বিষম আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল ডান হাত দিয়ে বাঁ হাত খামচে ধরে–ম্যাগনেট চোট দিয়েছিল সেখানেও।

উদ্ভট এই কাণ্ডকারখানা দেখে আমি কিন্তু ততক্ষণে যেমন উত্তেজিত, তেমনি ভয় পেয়েছি। তা সত্ত্বেও অভয় দিয়েছিলাম মিনমিনে স্বরে। ও কিন্তু আমার গলা শুনেই আবার আগের মতোই আঁতকে উঠেছিল একটু বেশিরকমভাবেই। কেশে গলা সাফ করে পরিষ্কারভাবে আবার অভয় দিতে ও জানতে চেয়েছিল আমিই বেলোজ কি না।

কেন? চোখে দেখতে পাচ্ছ না? বলেছিলাম আমি। আবার সেই বিতিকিচ্ছিরি হাসি হেসেছিল ডেভিডসন। নিজেকেই নাকি দেখতে পাচ্ছে না, আমাকে দেখার প্রশ্নই উঠছে। না!

আমি বলেছিলাম, সে কী! ল্যাবরেটরিতে দাঁড়িয়ে আছি তোমার সামনেই।

ল্যাবরেটরি! বিমূঢ় স্বরে জবাব দিয়েছিল ডেভিডসন–ল্যাবরেটরিতে তো ছিলাম দারুণ ঝলকে চোখ ঝলসে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। এখন তো সেখানে নেই। যাক গে! জাহাজটা দেখছ?

জাহাজ? কী আবোল-তাবোল বকছ?

তেড়ে উঠেছিল ডেভিডসন। স্পষ্ট দেখছে, জাহাজ ভাসছে জলে, ঢেউ নাচছে সমুদ্রে– বললেই হল জাহাজ নেই! তাহলে নিশ্চয় অক্কা পেয়েছি দুজনেই। কিন্তু মজা তো সেখানেই। মরে গেলে কি দেহ থাকে? দেহের যন্ত্রণা থাকে? ওর নাকি দেহ আছে–কিন্তু দেহটাকে বাগে আনতে পারছে না কিছুতেই। ধমক দিয়েছিলাম আমি। পাগলামির একটা সীমা আছে। বহাল তবিয়তে ল্যাবরেটরির মধ্যে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউ আর জাহাজ দেখা যায়? এইমাত্র একটা ইলেকট্রোমিটার ভাঙা হল তো এইখানেই–বয়েস এসেই তো একহাত নেবে।

ক্রায়োহাইড্রেটসের রেখাচিত্রের দিকে যেতে যেতে ডেভিডসন বলেছিল, কালা হয়ে গেলাম নাকি? কামান ছুঁড়েছে জাহাজ থেকে ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছি আওয়াজ তো পেলাম না।

এ তো আচ্ছা জ্বালা! আবার হাত রেখেছিলাম ওর হাতে। এবার আর ভূত দেখার মতো চমকে ওঠেনি। বলেছিল অনেকটা আত্মস্থ স্বরে, তবে কি দুজনেই অদৃশ্য দেহ পেয়ে বসেছি? বেলোজ, দেখতে পাচ্ছ না? নৌকো আসছে–ডাঙার দিকে আসছে–দেখছ?

ডেভিডসন! জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিলাম, জাগ, বন্ধু, জাগ!

ঠিক এই সময়ে ঘরে ঢুকেছিল বয়েস। ওর গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে কী চিৎকার ডেভিডসনের–বয়েস! তুমিও মারা গেছ! কী সর্বনাশ!

বয়েসকে তাড়াতাড়ি বুঝিয়ে দিয়েছিলাম ব্যাপারটা। ঘুমের ঘোরে হাঁটাচলার রোগে পেয়েছে নিশ্চয় ডেভিডসনকে। শুনেই কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল বয়েসের। ঘোর কাটিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলাম দুজনে। প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল। ডেভিডসন নিজেও প্রশ্ন করেছিল, কিন্তু মনটা পড়ে রয়েছে যেন সৈকত আর জাহাজের দিকে। মরীচিকা কাটিয়ে উঠতে পারছে না কিছুতেই। ছায়ামায়ায় ভরা বীক্ষণাগারের মধ্যে ও নাকি সমানে দেখতে পাচ্ছে পাল আর জাহাজ, নৌকো আর ঢেউ। শুনলেও গা শিরশির করে।

বেশ বুঝলাম, চোখের দৃষ্টি একেবারেই হারিয়েছে। নিতান্ত অসহায়। দুজনে দুপাশ থেকে কনুই ধরে করিডর বরাবর হাঁটিয়ে নিয়ে গেলাম বয়েসের প্রাইভেট ঘরে।

ডেভিডসনের মনে, চোখে ভাসছে কিন্তু সেই অবাস্তব জাহাজ। বয়েসও ছেলে ভোলানোর মতো সায় দিয়ে গেছে সমানে। ঘরে পৌঁছে খবর পাঠিয়েছিলাম কলেজের ডিন বুড়ো ওয়েডকে। ওঁর গলা শোনার পর একটু যেন শান্ত হয়েছিল ডেভিডসন। ঘ্যানর ঘ্যানর কিন্তু কমেনি। জানতে চেয়েছিল, হাত দুখানা তার কোন চুলোয়–দেখা যাচ্ছে না কেন? কোমরসমান উঁচু জমির মধ্যে দিয়েই বা তাকে হাঁটিয়ে আনা হল কেন? শুনে-টুনে ভুরু কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলেন বুড়ো ওয়েড। তারপর ডেভিডসনের হাতখানা তুলে ধরে কৌচ ছুঁইয়ে বললেন, এই তো তোমার হাত-হাত দিয়েছ কৌচে–প্রফেসার বয়েসের প্রাইভেট রুমে। ঘোড়ার চুল-ঠাসা কুশন–তা-ই না?

হাত বুলিয়ে আরও ঘাবড়ে গিয়েছিল ডেভিডসন। হাতে টের পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু চোখে তো দেখছে না।

তাহলে দেখছটা কী? জানতে চেয়েছিলেন ওয়েড। ডেভিডসন আবার আরম্ভ করেছিল একই ধানাইপানাই। রাশি রাশি বালি, ভাঙা ঝিনুক ছাড়া চোখে তো আর কিছুই পড়ছে না ঠিক এই জায়গাটায়।

ওয়েড আরও খানকয়েক জিনিস ধরিয়ে দিয়েছিলেন ডেভিডসনের হাতে। জানতে চেয়েছিলেন জিনিসগুলো কী। তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিলেন মুখের চেহারা।

কিন্তু জবাবটা এসেছিল খাপছাড়া–জাহাজ নোঙর ফেলছে মনে হচ্ছে? আত্মগত স্বর ডেভিডসনের।

মৃদু ভর্ৎসনা করেছিলেন ওয়েড। জাহাজ নিয়ে পরে মাথা ঘামালেও চলবে। মরীচিকা দর্শন মানেটা কি জানা আছে ডেভিডসনের?

একটু একটু, আনমনাভাবে বলেছিল ডেভিডসন!

যা দেখছ, সবই মরীচিকা।

বিশপ বার্কলে, আবার সেই খাপছাড়া জবাব।

দূর! পাদরির দরকার হবে কেন? দিব্যি বেঁচে রয়েছ। তবে চোখের গোলমাল হয়েছে দেখা যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছ, হাত বুলিয়ে টের পাচ্ছ–অথচ দেখতে পাচ্ছ না। বুঝেছ?

খুব ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছি, চোখ ডলে বলেছিল ডেভিডসন।

হয়েছে, হয়েছে। যা দেখছ, তা নিয়ে মাথাটাকে আর কষ্ট দিয়ো না। গাড়ি আনাচ্ছি– বেলোজ আর আমি পৌঁছে দেব বাড়িতে।

দাঁড়ান।–ধরে বসিয়ে দেবেন?… ঠিক আছে… এবার বলুন গোড়া থেকে ব্যাপারটা কী?

ধৈর্য না হারিয়ে পুনরাবৃত্তি করে গেলেন ওয়েড। চোখ মুদে কপালে হাত রেখে সব শুনল ডেভিডসন। তারপর বললে চোখ মুদেই, এখন তো মনে হচ্ছে, সবই ঠিক আছে। ইংল্যান্ডেই রয়েছি। বেলোজ বসে রয়েছে পাশে, কৌচে। অন্ধকার।

বলেই খুলল চোখ–ওই দেখা যাচ্ছে সূর্য। জাহাজ। পাগলা সমুদ্র। উড়ন্ত পাখি। সত্যি, একেবারে সত্যি। বসে রয়েছি বালির ঢিপিতে।

চোখ ঢাকা দিয়ে হেঁট হয়েই ফের চোখ খুলে যেন ককিয়ে উঠল পরক্ষণেই–কালো সমুদ্র আর সূর্যোদয়! তা সত্ত্বেও কিন্তু বসে রয়েছি বয়েসের ঘরে–ওরই সোফায়!… এ কী হল আমার!

সেই শুরু। ঝাড়া তিন-তিনটে হপ্তা চলেছিল এই বিচিত্র ভোগান্তি। আক্কেল গুড়ুম করে ছেড়েছিল আমাদের ডেভিডসনের দু-দুটো চোখ, যে চোখে দৃষ্টি আছে, অথচ দৃষ্টি নেই। যেখানে বসে, সেখানকার কিছুই দেখছে না–দেখছে অন্য এক জায়গার দৃশ্য। অন্ধ হওয়াও বরং এর চাইতে ভালো। ওর সেই অসহায় অবস্থা ভাবলেও কষ্ট হয়। সদ্য ডিম ফোঁটা পাখির ছানাকে যেভাবে খাইয়ে দিতে হয়, সেইভাবেই তাকে খাওয়াতে হয়েছে দিনের পর দিন, হাত ধরে নিয়ে যেতে হয়েছে কলতলায়, জামাকাপড় খুলে আবার পরিয়ে দিতে হয়েছে বাচ্চা ছেলের মতো। নিজের চেষ্টায় হাঁটতে গেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দেওয়ালে বা দরজায়–হোঁচট খেয়েছে পায়ের কাছে রাখা জিনিসের ওপর। দু-একদিন পরে অবশ্য আমাদের দেখতে না পেলেও গলা শুনে আর অমন আঁতকে উঠত না। আমার বোনের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বোন এসে বসে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ডেভিডসন আশ মিটিয়ে শোনাত সাগর আর সৈকতের অলীক কাহিনি। কলেজ থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময়ে সে আর-এক ফ্যাসাদ। বাড়ি তো সেই হ্যাঁম্পস্টিড গ্রামে। গাড়ি নাকি ওকে নিয়ে সোজা একটা বালিয়াড়ি ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। চোখে কিছু দেখতে পায়নি… অন্ধকার… কুচকুচে অন্ধকার। ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে আসার পর আবার চোখে পড়েছে গাছ, পাথর, নিরেট জিনিস। গাড়ি নাকি এই সবকিছুর মধ্যে দিয়েই ওকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে–অথচ গাছ, পাথর, নিরেট বস্তু বালিয়াড়িটার মতোই ওকে আটকে রাখতে পারেনি। বাড়ি পৌঁছে ওপরতলার ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময়ে সে কী পরিত্রাহি চিৎকার। কাল্পনিক দেশের পাথুরে জমির তিরিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট ওপরে শূন্যে তোলা হচ্ছে কেন? পড়ে গেলে ছাতু হয়ে যাবে যে! ডিমের মতো ফট করে ফেটে যাবে মাথার খুলি। একনাগাড়ে এই কাঁইমাই সহ্য করা যায়? নামিয়ে আনা হল একতলায়। বাবার কনসাল্টিং রুমের একটা সোফায় বসে তবে নিশ্চিন্ত হল ডেভিডসন।

দ্বীপটার বর্ণনা শুনেছিলাম ওরই মুখে। মন দমে যাওয়ায় মতো জায়গা। গাছপালা অতি সামান্যই। বেশির ভাগই নেড়া পাথর, পেঙ্গুইন আছে বিস্তর, পাথর সাদা হয়ে থাকে– সংখ্যায় এত, দেখতে অতি বিচ্ছিরি, সমুদ্র মাঝেমধ্যে দামাল। প্রথম দু-একদিনের মধ্যে বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়ও দেখেছে। বজ্রপাত দেখেছে, বিদ্যুতের চমক দেখে নিজেই চমকে চমকে উঠে সমানে চেঁচিয়ে গেছে কিন্তু বজ্রের আওয়াজ, মেঘ ডাকার গুরগুর শব্দ কানে ভেসে আসেনি। নিঃশব্দ সেই বজ্রপাত নাকি এমনই রোমাঞ্চকর যে ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। বার দুয়েক বালির ওপর সিল মাছ উঠে এসেছে। পেঙ্গুইনরা নাকি ওর দেহ কুঁড়ে হেলেদুলে দিব্যি চলে গিয়েছে–কারও কোনও অসুবিধে হয়নি। ওর শুয়ে থাকার জন্যে পেঙ্গুইনরা তিলমাত্র বিচলিত বোধ করেনি।

অদ্ভুত একটা ব্যাপার বেশ মনে আছে। সিগারেট খাওয়ার খুব ইচ্ছে হয়েছিল ডেভিডসনের। আঙুলে পাইপ গুঁজে দিয়েছিলাম। কোটর থেকে চোখ দুটো প্রায় ঠেলে বার করে এনেও সিগারেট বা পাইপ কোনওটাই দেখতে পায়নি। ধরিয়ে দিয়েছিলাম সিগারেট। টেনে কোনও স্বাদ পায়নি। এ ব্যাপার আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ধোঁয়া না দেখতে পেলে তামাক খাওয়ার মজা পাওয়া যায় না।

আশ্চর্য দর্শনের সবচেয়ে অদ্ভুত অংশটা শুরু হয়েছিল ঠেলা-চেয়ারে বসিয়ে ওকে হাওয়া খেতে নিয়ে যাওয়ার সময়ে। আমার বোন গিয়েছিল সঙ্গে। কেঁদে ফেলেছিল নাকি ডেভিডসন। কাকুতিমিনতি করেছিল বোনের কাছে। ভয়াবহ এই অন্ধকারে আর সে থাকতে পারছে না। অসহ্য! অসহ্য! বোনের হাত খামচে ধরে বলেছিল কাঁদতে কাঁদতে, নিয়ে চল, নিয়ে চল এই অন্ধকারের বাইরে–নইলে আর বাঁচব না। খুলে বলতে পারেনি। ডেভিডসন। বোন ওকে নিয়ে বাড়িমুখে রওনা হয়েছিল তৎক্ষণাৎ চড়াই ভেঙে হ্যাঁম্পস্টিডের দিকে যেতে যেতেই বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেয়েছিল বন্ধুবর। আবার নাকি তারা দেখা যাচ্ছে–অথচ তখন সূর্য মাথার ওপর।

পরে আমাকে বলেছিল, মনে হচ্ছিল যেন জলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাকে– বাধা দিতে পারছি না। প্রথমে অতটা ভয় পাইনি। যদিও তখন নিশুতি রাত–কিন্তু বড় সুন্দর রাত।

হ্যাঁ। এখানে যখন দিন, ওখানে তখন রাত।… জলের মধ্যে সটান ঢুকে গেলাম তারপরেই। ফুলে ফুলে উঠছে জল–চওড়া হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত পর্যন্ত–ঠিক যেন চকচকে চামড়া দিয়ে ঢাকা ফোঁপরা গহ্বরের মধ্যে নেমে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। নামছি ঢালু পথে। জল উঠে এল চোখ পর্যন্ত। তারপর চলে এলাম জলের তলায়। চকচকে চামড়া টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গিয়ে ফের জুড়ে গেল মাথার ওপর। চাঁদ লাফ দিয়ে উঠল আকাশে, সবুজ চাঁদ। অস্পষ্ট। চারপাশে খেলছে আবছা দ্যুতিময় মাছ। ঠিক যেন কাচের মাছ-গা থেকে আলো ছিটকে যাচ্ছে। সামুদ্রিক উদ্ভিদের একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নেমে এলাম আস্তে আস্তে–তেলতেলে আভা বেরুচ্ছে জঙ্গল থেকে। নামছি, নামছি, আরও নামছি। একে একে নিবে গেল একটার পর একটা তারা। আরও সবুজ হয়ে এল চাঁদ আরও গাঢ়। বেগুনি-লাল হয়ে এল সামুদ্রিক উদ্ভিদ। রহস্যময় সেই আলো-আঁধারির মধ্যে সবই থিরথির করে কাঁপছে আবছাভাবে। কানে ভেসে আসছে একটানা শব্দের পর শব্দ এই জগতের শব্দ… চেয়ার গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ… আশপাশে জুতো মশমশিয়ে লোকজনের হাঁটাচলার শব্দ… দূরে খবরের কাগজ ফেরি করার চিৎকার–নেমে গেলাম জলের আরও গভীরে। কালির মতো কালো হয়ে এল চারদিক… নিঃসীম সেই অন্ধকারে বাইরের কোনও আলো ঢোকার যেন অধিকার নেই… অন্ধকার… অন্ধকার… সীমাহীন নিবিড় তমিস্রা ভেদ করে চলেছি তো চলেইছি… ফসফরাস-দ্যুতি বিকিরণ করে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে অন্ধকারের প্রাণীরা… গভীর জলের উদ্ভিদের সর্পিল শাখা নড়ছে স্পিরিট-ল্যাম্পের জ্বলন্ত শিখার মতো… আরও কিছুক্ষণ পরে উদ্ভিদও আর চোখে পড়ল না। বিকট হাঁ আর ড্যাবডেবে চোখ মেলে সটান আমাকে ছুঁড়ে বেরিয়ে গেল ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ। হাঁ-মুখ দেখে প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম–তারপর কিছুই টের পেলাম না– মাছেরাও পেল না। সমুদ্রে যে এরকম বিকট মাছ আছে, কোনওদিন কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি।

আলোকময় পেনসিল দিয়ে আঁকা যেন মাছগুলো-কিনারা ঘিরে ঠিকরে যাচ্ছে আগুন। কিলবিলে অনেকগুলো হাত মেলে বিকটাকার একটা প্রাণী পেছনদিকে সাঁতরে আসতেই আঁতকে উঠেছিলাম। তারপরেই কাঠ হয়ে গেলাম অস্পষ্ট বিশাল একটা আলোকপুঞ্জকে ধীরে ধীরে আমার দিকেই এগিয়ে আসতে দেখে। জমাট আঁধারের মধ্যে থেকে একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বহু দুরের চাপ-বাঁধা আলোর ডেলা। কাছে আসতেই টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল আলোর কণা। মাছ। ভাসমান কী যেন একটা ঘিরে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরছে দ্যুতিময় মাছ। আমি চেয়ারে বসে সটান চলেছি সেইদিকেই। আরও কাছে… আরও কাছে… হঠাৎ দেখলাম একটা ভাঙা বরগা… মাছেদের আলোয় তুলকালাম কাণ্ডের মধ্যে মাথার ওপরে ভাসতে দেখলাম লম্বা কাঠখানা… জমাট কালো অন্ধকারের মতো একটা জাহাজের খোলও দেখলাম, কাত হয়ে রয়েছে মাথার ওপর… অন্ধকার কিন্তু ফিকে হয়ে এসেছে ফসফরাস-দ্যুতিতে… মাছেদের ঠোকরানিতে ফুলিঙ্গের মতো ফসফরাস-দ্যুতি ঠিকরে ঠিকরে যাচ্ছে কতকগুলো আকৃতি থেকে… আতঙ্কে দমবন্ধ হয়ে এসেছিল আমার… চেঁচিয়ে ডেকেছিলাম তোমার বোনকে… আধখাওয়া সেই মড়াদের গায়ে অজস্র ছেদা… আমাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেইদিকেই… মড়াদের গায়ের ফুটোগুলোর দিকেই…! উঃ! কী বীভৎস! গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, তাই না বেলোজ? দেখ তো হাতটা?

তিন-তিনটে সপ্তাহ সেই অপচ্ছায়া-জগতের মধ্যে কাটিয়েছে ডেভিডসন–নিজের চারপাশের এই জগৎকে দেখতে পায়নি একটুও। তারপর এক মঙ্গলবারে দেখা করতে যেতেই ওর বুড়ো বাবার মুখোমুখি হলাম করিডরে। ওভারকোটে হাত গলাতে গলাতে ছুটছেন। আমাকে দেখেই সজল চোখে ধরা গলায় বললেন, বেলোজ, ছেলেটা এবার ঠিক হয়ে যাবে। দেখতে পাচ্ছে… নিজের বুড়ো আঙুলটা এদ্দিনে দেখতে পেয়েছে।

দৌড়ালাম। ডেভিডসন একটা বই চোখের সামনে ধরে বসে ছিল–হাসছিল আপন মনে –অনেকটা পাগলের মতো। বলেছিল, কী আশ্চর্য! এইখানটা… এই জায়গাটা একটুখানি দেখা যাচ্ছে– আঙুল রেখেছিল বইয়ের পাতায় এক জায়গায়–পাথরের ওপর বসে রয়েছি কিন্তু এখনও। বড় গোলমাল করছে পেঙ্গুইনগুলো। দূরে মাঝে মাঝে দেখছি একটা তিমিকে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এইখানে কিছু ধর–দেখতে পাব… খুব অস্পষ্ট… ভাঙা ভাঙা… তবুও দেখা যাচ্ছে… অস্পষ্ট প্রেতচ্ছায়ার মতো। আজ সকালে জামাকাপড় পরানোর সময়ে প্রথম দেখেছিলাম। নারকীয় এই অপচ্ছায়া-জগতের মধ্যে যেন একটা ফুটো। রাখ–তোমার হাতটা রাখ এইখানে… না… না… ওখানে নয়। হ্যাঁ… ঠিক হয়েছে! দেখতে পাচ্ছি… তোমারই বুড়ো আঙুল… তলার দিক আর শার্টের হাতার একটুখানি। অন্ধকার আকাশ ফুটো করে যেন বেরিয়ে আছে তোমার ভূতুড়ে হাতের একটুখানি! ঠিক পাশেই ভাসছে একদঙ্গল নক্ষত্র!

সেই থেকেই একটু একটু করে সেরে উঠতে লাগল ডেভিডসন। অপচ্ছায়া-জগৎ দেখে যে বর্ণনা দিয়েছিল–নিখুঁত সেই বর্ণনার মতোই দৃশ্য পরিবর্তনের এই বর্ণনাও বিশ্বাস না করে পারা যায় না। অপচ্ছায়া-জগতের জায়গায় জায়গায় যেন ছেদা হয়ে যাচ্ছে… ছায়াবাজির মতো অলীক জগৎ ছিঁড়েখুঁড়ে উড়ে যাচ্ছে… অর্ধস্বচ্ছ ফুটোর মধ্যে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে স্বচ্ছ, অস্পষ্ট এই সত্যিকারের জগতের ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্য। ক্রশঃ পরিধি বেড়েছে ফুটোগুলোর… বেড়েছে সংখ্যায়… আস্তে আস্তে গায়ে গায়ে লেগে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সত্যিকারের এই জগতের দৃশ্যর ওপর–অলীক অপচ্ছায়া-জগৎ অস্পষ্ট ছেঁড়া-ছেঁড়াভাবে দেখা গিয়েছে এখানে-সেখানে। চোখের ওপর অন্ধত্ব দানা আকারে যেন জমে রয়েছে–সেই দানার জায়গাগুলোয় তখনও ঠেলাঠেলি করে ফুটে উঠছে অবাস্তব সেই জগতের মরীচিকাদৃশ্য। নিজে থেকে উঠে বসা, চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া, ধূমপান করা, বই পড়ায় অভ্যস্ত হল আস্তে আস্তে। দুটো ছবি ওপর-ওপর থাকায় প্রথমটা একটু গোলমাল লাগত। তা-ও সয়ে গেল দুদিনেই। অলীক মায়াজগতের দৃশ্য আর বাস্তব জগতের দৃশ্য আলাদা করে নিতে পারল সহজেই।

প্রথমটা দারুণ খুশি হয়েছিল ডেভিডসন। ফেটে পড়েছিল মুক্তি পাওয়ার আনন্দে। তারপরেই শুরু হল উলটো টান। বিলীয়মান আশ্চর্য দ্বীপ, বিচিত্র সমুদ্র, পেঙ্গুইনের পাল, সমুদ্রের গভীরে ভাসমান জাহাজের খোল আবার ভালো করে দেখার জন্যে ব্যাকুল হয়েছিল। একা একা ছুটে যেত হ্যাঁম্পস্টিডের নিচু অঞ্চলে। কিন্তু সত্যিকারের দুনিয়ার চড়া রোদ দুদিনেই মিথ্যে দুনিয়ার রাতের অন্ধকারকে মুছে দিলে একেবারে। ছেঁড়া-ছেঁড়া দৃশ্য একটু একটু করে ফিকে হতে হতে একেবারেই গেল মিলিয়ে। তা সত্ত্বেও গভীর রাতে অন্ধকার ঘরে দেখতে পেত অলীক দ্বীপের রোদে তেতে-ওঠা সাদা পাথর, পেঙ্গুইনদের হেলেদুলে চলা। আস্তে আস্তে এ দৃশ্যও সরে গেল তার চোখের সামনে থেকে নিশুতি রাতেও। আমার বোনকে বিয়ে করার পর অলীকদর্শন তিরোহিত হল একেবারেই।

সবচেয়ে উদ্ভট ঘটনাটায় এবার আসা যাক। বিয়ের দুবছর পরে ডিনার খেতে গিয়েছিলাম ডেভিডসন-দম্পতির সঙ্গে। খাওয়াদাওয়ার পর অ্যাটকিন্স নামে একজন ভদ্রলোক এলেন ঘরে। রয়াল নেভির লেফটেন্যান্ট। ভারী চমৎকার মানুষ। আড্ডাবাজ। আসর জমাতে ওস্তাদ। কথায় কথায় পকেট থেকে একটা ফোটো বার করে দেখিয়েছিলেন আমাদের। ছবিটা একটা জাহাজের।

দেখেই আঁতকে উঠেছিল ডেভিডসন!

সেই জাহাজ! যে জাহাজ সে বারবার দেখেছে অলীকদর্শনে–নিখুঁত বর্ণনাও শুনিয়েছে।

অ্যাটকিন্স তো অবাক! এ জাহাজ ডেভিডসন দেখবে কী করে? অ্যান্টিপোড আইল্যান্ডের দক্ষিণে জাহাজ নোঙর করে অ্যাটকিন্স নৌকো নিয়ে দ্বীপে নেমেছিলেন পেঙ্গুইনের ডিম আনবেন বলে। দ্বীপের বর্ণনা, পেঙ্গুইনের বর্ণনা, জাহাজের বর্ণনা কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল ডেভিডসনের বর্ণনার সঙ্গে। হ্যাঁ, বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড় উঠেছিল সেই রাতে বাধ্য হয়ে রাত কাটাতে হয়েছিল দ্বীপে।

সব শোনবার পর পরিষ্কার বোঝা গেল, সেরাতের সবকিছুই ডেভিডসন দেখেছে। এই লন্ডন শহরে সে যখন এখানে-সেখানে ঘুরছে আমাদের সঙ্গে–অব্যাখ্যাতভাবে তার দৃষ্টিশক্তি বহু দূরের সেই দ্বীপে ঘুরে বেড়িয়েছে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায়। কীভাবে, আজও তা রহস্য।

ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখের অত্যাশ্চর্য কাহিনির পরিসমাপ্তি এইখানেই। দূরের দৃশ্য চামড়ার চোখ দিয়ে দেখার এত বড় নজির আর কেউ দিতে পারবেন না। ব্যাখ্যা অনেকরকমই শোনা যাচ্ছে–প্রফেসার ওয়েডের ব্যাখ্যাটাই সবচেয়ে জোরালো। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা চতুর্থ মাত্রিক জগৎকে কেন্দ্র করে রচিত, স্থান সম্পর্কে তত্ত্বকথাপূর্ণ ভারী নিবন্ধ ফোর্থ ডাইমেনশনের হেঁয়ালিতে পূর্ণ। দড়ি বা তার যেমন পাকিয়ে যায়, স্থান বা স্পেসও নাকি হঠাৎ পাকিয়ে গিয়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। হাস্যকর ব্যাখ্যা, সন্দেহ। নেই। এক্কেবারেই উদ্ভট। অবশ্য অঙ্ক জিনিসটা আমার মাথায় ঢোকে না কোনওকালেই। আট হাজার মাইলের ব্যবধান রয়েছে দুটো জায়গার মধ্যে–এটা একটা ঘটনা এবং কোনও তত্ত্বই এ ঘটনাকে উলটে দিতে পারে না। আমার এই জবর যুক্তি শুনে প্রফেসার শুধু বলেছিলেন, এক তা কাগজের ওপর দুটো বিন্দু এক গজ তফাতে রেখেও অনায়াসে মিলিয়ে দেওয়া যায় কাগজটাকে মুড়ে ধরলেই। ফোর্থ ডাইমেনশনের স্থানও নাকি ওইভাবে মোচড় খেয়ে এক হয়ে গিয়েছিল। সুধী পাঠক-পাঠিকা হয়তো তাঁর এই যুক্তির সারবত্তা বুঝতে পারবেন। আমি পারিনি–পারবও না। প্রফেসারের আইডিয়া মাথায় আনতে গেলে মাথা ঘুরতে থাকে আমার। ডেভিডসন বড় ইলেকট্রোম্যাগনেটের দুই প্রান্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার সময়েই নাকি এই বৈজ্ঞানিক বিস্ময়টি ঘটে যায় চকিতের মধ্যে, অস্বাভাবিক এক মোচড় মুচড়ে দেয় তার অক্ষিপটের মৌলকে–এবং সেটা ঘটে বজ্রপাতের ফলে শক্তিক্ষেত্র অকস্মাৎ পালটে যাওয়ার।

প্রফেসারের বিশ্বাস, এর পরিণামস্বরূপ, পৃথিবীর এক জায়গায় দেহ নিয়ে বিদ্যমান থেকে অপর জায়গায় শুধু চোখে দেখার জগৎ নিয়ে দিব্যি বসবাস করা অসম্ভব কিছু নয়। আইডিয়াটা সপ্রমাণ করার জন্যে কিছু এক্সপেরিমেন্টও করেছিলেন, কিন্তু কয়েকটাকুকুরকে অন্ধ করে দেওয়া ছাড়া ফললাভ কিছু ঘটেনি। বেশ কয়েক হপ্তা আর দেখা হয়নি প্রফেসারের সঙ্গে। জানি না এখনও তাঁর ওই ফ্যান্টাস্টিক তত্ত্ব নিয়ে হেদিয়ে মরছেন কি না। আমার কিন্তু ধ্রুব বিশ্বাস, ডেভিডসনের অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতার মূল অন্যত্র–ফোর্থ ডাইমেনশনের উদ্ভট গণ্ডির মধ্যে অন্তত নয়।

দেহ-লুঠেরা

দেহ-লুঠেরা ( The Story of the Late Mr. Elvesham )

[‘The Story of the Late Mr. Elvesham’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘The Idle’r পত্রিকায় মে ১৮৯৬ সালে। ১৮৯৭ সালে লন্ডনের ‘Methuen & Co.’ থেকে প্রকাশিত ওয়েলসের ছোটগল্পের সংকলন ‘The Plattner Story and Others’ বইটিতে গল্পটি স্থান পায়। জুন ১৯২৭ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘Amazing Stories’-তে।]

কাহিনিটা লিখে যাচ্ছি স্রেফ পরোপকারের মনোবৃত্তি নিয়ে। আমার মতো আর কেউ যেন ফাঁদে পা না দেয়। আমার দুর্গতির কাহিনি পড়ে যেন পাঁচজনে উপকৃত হয়। আমার যা হবার, তা তো হয়েই গেছে। পরিত্রাণ নেই। মৃত্যুর জন্যে তৈরি হচ্ছি।

জানি, অবিশ্বাস্য এই কাহিনি পড়ে মুচকি হাসি হাসবেন প্রত্যেকেই। সত্যি কথা বলতে কী, বিশ্বাস করানোর প্রত্যাশা নিয়েও কলম ধরিনি। উদ্দেশ্যটা স্রেফ পরোপকার–আমার মতো হাল আর যেন কারও না হয়।

এবার শুনুন আমার নামধাম, বাবা-কাকার পরিচয়। এডওয়ার্ড জর্জ ইডেন, এই নামে আমি ধরায় আগমন করেছিলাম খুবই মন্দ কপাল নিয়ে স্ট্যাফোর্ডশায়ারের ট্রেন্টহ্যামে। বাবা চাকরি করত ওখানকার বাগানে। মা-কে হারিয়েছি তিন বছর বয়সে, বাবাকে পাঁচ বছরে। ছেলের মতো করেই মানুষ করেছিল কাকা জর্জ ইডেন। বিয়ে-থা করেনি কাকা। উচ্চশিক্ষিত। পেশায় সাংবাদিক। বার্মিংহ্যামে চিনত সবাই। শিক্ষার বীজ, উচ্চাশার নেশা ভালোভাবেই ঢুকিয়ে দিয়েছিল আমার ভেতরেও। মারা যাওয়ার সময়ে উইল করে নিজের সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়ে যায় আমার নামে। সবার পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দেখা গেল তার পরিমাণ পাঁচশো পাউন্ড। উইলে একটাই উপদেশ দিয়ে গিয়েছিল কাকা। লেখাপড়া শেষ করার পর যেন টাকাটা খরচ করি। ডাক্তারি পড়ব বলে তখন মনস্থ করে ফেলেছি। স্কলারশিপের টাকায় আর কাকার সম্পত্তির জোরে ভরতি হয়ে গেলাম লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের ডাক্তারি ক্লাসে। তখন থাকতাম ১১এ, ইউনিভার্সিটি স্ট্রিটের বাড়িতে ওপরতলার যাচ্ছেতাইভাবে আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো একটা ছোট্ট ঘরে। কানাকড়ির হিসেব রেখে অত্যন্ত মিতব্যয়ী থাকব, এই অভিলাষে ছোট্ট এই ঘরখানাতেই থাকা, খাওয়া, শোয়া, পড়া–একাধারে সবই চালিয়ে যেতাম।

একদিন বগলে পুরানো একজোড়া জুতো নিয়ে বেরতে যাচ্ছি টটেনহ্যাম কোর্ট রোডে মুচির কাছ থেকে মেরামত করে আনব বলে, এমন সময়ে দেখলাম, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ চেয়ে আছে দরজার নম্বরের দিকে। নম্বর সঠিক কি না বুঝতে পারছে না। চৌকাঠ পেরিয়ে পড়লাম একেবারে বুড়োর সামনেই। মুখখানা হলদেটে। জীবনে কখনও দেখিনি। কিন্তু আমার সারাজীবন এখন জড়িয়ে গেছে এই বুড়োর জীবনের সঙ্গে অত্যন্ত সূক্ষ্ম জটিলভাবে।

দরজা খুলে বেরতেই বৃদ্ধর চোখ পড়ল আমার মুখের ওপর। নিষ্প্রভ ধূসর চোখ, কিনারার দিকে লালচে। আমাকে দেখামাত্র মুখখানা ঢেউখেলানো করোগেটেড টিনের মতো তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল মধুর আপ্যায়নের ভঙ্গিমায়।

যাক, এসে গেছেন। বাড়ির ঠিকানাটা একদম ভুলে মেরে দিয়েছিলাম। বলুন আছেন কেমন, মি. ইডেন!

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। চিনি না, শুনি না, কিন্তু এমন সাদর সম্ভাষণ করে বসল যেন সাত জন্মের চেনাশোনা। বগলের বুটজোড়ার দিকে প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে আছে দেখে মেজাজটাও গেল খিঁচড়ে। সুতরাং পালটা ভদ্রতা অবশ্যই দেখাইনি।

বুড়ো তা লক্ষ করে বললে, ভাবছেন এ আবার কে? বন্ধু… বন্ধু বলেই মেনে নিন। কেমন? আমাকে আপনি দেখেননি ঠিকই, কিন্তু আমি আপনাকে দেখেছি। কোথায় কথা বলা যায় বলুন তো?

দ্বিধায় পড়লাম। আমার নিজের ঘরের যা ছিরি, কোনও অজানা-অচেনা মানুষকে সেখানে বসানো যায় না।

তাই বললাম, চলুন-না, হাঁটা যাক।

রাস্তায় তো? কোনদিকে বলুন?

টুপ করে বুটজোড়া নামিয়ে নিলাম ফুটপাতে।

বুড়ো বললে, এসেছি তো বাজে কথা বলতে। লাঞ্চ খেতে খেতে বলা যাবেখন। বুড়ো হয়েছি, গলার আওয়াজ তো ফাটা বাঁশির মতো, গাড়ি-ঘোড়ার যা আওয়াজ

বলে, আমার বাহু স্পর্শ করেছিল বুড়ো, যাতে অমত না করি। লক্ষ করলাম, হাত কাঁপছে বুড়োর পয়সায় খেতে মন চায়নি। ক্ষীণ আপত্তি করেছিলাম। বুড়ো শোনেনি। পাকা চুলকে একটু শ্রদ্ধা জানালে ক্ষতি কী? রাজি হয়ে গেলাম যুক্তি শুনে।

দুজনে গেলাম ব্ল্যাভিটস্কির হোটেলে। এমন খাসা খানা অনেকদিন খাইনি। খেতে খেতে যখন কাজের প্রশ্ন করলাম, সুকৌশলে এড়িয়ে গেল বুড়ো। চেহারাটা দেখে নিলাম বেশ খুঁটিয়ে। দাড়িগোঁফ পরিষ্কার কামানো। মুখ সরু। চামড়া কোঁচকানো। দাঁত বাঁধানো। শিথিল ঠোঁট ঝুলছে বাঁধাই দাঁতের ওপর। সাদা চুল খুবই পাতলা আর লম্বা। আমার যা বিরাট শরীর, বেশির ভাগ লোকই সে তুলনায় বামন বললেই চলে। সুতরাং বুড়োর ছোটখাটো আকৃতি দেখে খুব একটা মাথা ঘামালাম না। কাঁধ গোল। একটু কুঁজো।

লক্ষ করলাম, আমার ওপরেও চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে বুড়ো। চাহনি যেন লোভাতুর। এরকম অদ্ভুত লোভ-চকচকে চোখ বড় একটা দেখা যায় না। আমার বৃষস্কন্ধ, আমার রোদে জ্বলা হাত, আমার ফুটফুটে দাগযুক্ত মুখ–সবই যেন লাভের উন্মেষ ঘটিয়ে চলেছে বৃদ্ধের চোখে।

খাওয়া শেষ হল, সিগারেট ধরিয়ে বুড়ো বললে, এবার কাজের কথায় আসা যাক। প্রথমেই বলে রাখি, বয়স আমার খুবই বেশি–অথর্ব বলতে যা বোঝায়, তা-ই। কিন্তু আমার টাকা আছে। ছেলেপুলে নেই। ভাবনাটা সেই কারণেই, এত টাকা দিয়ে যাব কাকে?

এসব চালাকি আমার জানা আছে। পাঁচশো পাউন্ড না বেহাত হয়। সাবধান হয়ে গেলাম তৎক্ষণাৎ। বুড়ো কিন্তু ইনিয়েবিনিয়ে গাওনা গেয়ে গেল নিজের নিঃসঙ্গ জীবনের। বড় একা, বড় একা। উপযুক্ত উত্তরাধিকারী না পেলে এত সম্পত্তি দেবে কাকে? নানা পরিকল্পনা এসেছিল মাথায়–কিন্তু খারিজ করেছে একটার পর একটা। দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান, স্কলারশিপ, সমাজসেবী সংস্থা, লাইব্রেরি–সব নাকচ হয়ে গেছে মনে মনে তৌল করার পর।

শেষ পর্যন্ত ঠিক করেছি, আমার মুখের ওপর খর-নজর নিবদ্ধ রেখে বলেছিল বৃদ্ধ, নওজোয়ান কাউকে দিয়ে যাব আমার বিপুল সম্পত্তি। এমন একজন যুবা পুরুষ চাই, যার উচ্চাকাক্ষা আছে, যার মন নির্ভেজাল, যে গরিব কিন্তু দেহ-মনে স্বাস্থ্যবান। হ্যাঁ, আবার বলছি, এইরকম একটি ছেলেকেই দিয়ে যাব আমার যা কিছু আছে–স-ব। ঝাটমুক্ত হব তখনই–কিন্তু আমার টাকায় সে উচ্চশিক্ষা পাবে, প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করবে, স্বাধীন। জীবনযাপন করবে।

এমন ভান দেখানোর চেষ্টা করলাম যেন আমার কোনও আগ্রহই নেই। ছলনাটা নিতান্তই স্বচ্ছ যদিও। কাষ্ঠ হেসে বলেছিলাম, আমাকে দিয়ে সেইরকম একটা ছেলে খুঁজে বার করতে চান, এই তো?

ছলনা যে ধোপে টিকল না তা বুড়োর হাসি দেখেই বুঝলাম। সিগারেটে লম্বা টান মেরে চেয়ে রইল আমার দিকে।

বললে, কয়েকটা শর্ত অবশ্য থাকবে। প্রথম, আমার নাম তাকে নিতে হবে। কিছু না দিলে কি কিছু পাওয়া যায়? দ্বিতীয়, সে যে যে পরিস্থিতিতে যে যে মহলে জীবনযাপনে অভ্যস্ত, সবকিছুর মধ্যে আমাকেও রপ্ত করে দিতে হবে। বাজিয়ে নেব ভালো করেই। জানব তার বংশপরিচয়, জানব কীভাবে মারা গেছেন তার বাবা-মা, ঠাকুরদা-ঠাকুমা। এমনকী তার চরিত্রের যেদিকটা পাঁচজনকে না জানিয়ে করা হয়–তা-ও জানব।

সেরকম ছেলে বলতে কি আমাকেই

হ্যাঁ, বাবা, তোমাকেই!

জবাব দিতে পারলাম না। মন-ময়ূর তখন পাখা মেলে ধরেছে। কল্পনার রথ তখন উড়ে চলেছে। বলবার মতো ভাষা এল না মুখে।

কিছুক্ষণ বোবা হয়ে থাকার পর বলেছিলাম আমতা আমতা করে, কিন্তু দুনিয়ায় এত ছেলে থাকতে আমাকেই

প্রফেসার হ্যাসলারের কাছে তোমার অনেক প্রশংসা শুনেছি। তোমার স্বাস্থ্য, চরিত্র, উচ্চাকাঙ্ক্ষা–সবই নিরেট। নির্ভরযোগ্য। সততা আর স্বাস্থ্য যার মধ্যে আছে, আমার সম্পত্তির ওয়ারিশ হতে পারে একমাত্র সে-ই। তুমিই সেই ছেলে।

বুড়োর সঙ্গে সেই আমার প্রথম মোলাকাত। প্রথম থেকেই লক্ষ করেছিলাম, রহস্যের আবরণে ঘিরে রেখে দিয়েছে নিজেকে। নাম বলেনি। দু-চারটে প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল বেশি নয়। বিদায় নিল ব্ল্যাভিটস্কির গাড়িবারান্দা থেকে। লাঞ্চের দাম মিটিয়ে দিয়েছিল পকেট থেকে এক মুঠো মোহর বার করে। কথা হয়েছিল অনেকক্ষণ। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলেছিল, দৈহিক স্বাস্থ্য অটুট থাকা চাই। চাহিদা বড়ই অদ্ভুত। খটকা লেগেছিল। তখনই। সেইদিনই বৃদ্ধের ইচ্ছেমতো মোটা টাকার জীবনবিমা করিয়েছিলাম। ডাক্তারদের চুলচেরা পরীক্ষা সত্ত্বেও খুশি হয়নি বুড়ো। বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ ডক্টর হেন্ডারসনকে দিয়ে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বাজিয়ে নিয়েছিল। পরের সপ্তাহের শুক্রবারে নিয়েছিল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করছিলাম অনেক রাত পর্যন্ত। ডাক শুনে নেমে এলাম নিচে। দেখলাম, বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে ম্যাড়মেড়ে গ্যাস-লণ্ঠনের তলায়। ছায়ামায়ায় বিদঘুটে হয়ে উঠেছে শীর্ণ মুখখানা। প্রথম দিন যতখানি কুঁজো দেখেছিলাম, সেদিন দেখলাম আরও বেশি। তোবড়ানো গাল তুবড়েছে আরও খানিকটা।

চাপা আবেগে কাঁপা গলায় বলেছিল, ইডেন, সবই তো মনের মতো হল–এবার তোমার জিনিস তুমি বুঝে নাও। তার আগে একটু উৎসব করে নেওয়া যাক–আজ রাতেই –দেরি না–একদম না।…

বলতে বলতে কুঁজো দেহটা দুমড়ে গিয়েছিল কাশির ধমকে। রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছে নিয়ে, হাড় বার-করা আঙুলে আমার বাহু খামচে ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল রাস্তায়। ছ্যাকড়া গাড়ি থামিয়ে ভেতরে উঠে বসেছিল আমাকে নিয়ে, ঝড়ের মতো গাড়ি বেয়ে। গিয়েছিল রিজেন্ট স্ট্রিটের খানদানি রেস্তরাঁয়। সেদিনের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি দৃশ্য জ্বলজ্বল করছে মনের মধ্যে। গ্যাসের লণ্ঠন, তেলের বাতি, বিজলি আলো সাঁত সাঁত করে বেরিয়ে গিয়েছিল দুপাশ দিয়ে। জনবহুল পথেও গাড়ি উড়ে যাচ্ছিল যেন পক্ষিরাজের মতো।

দারুণ খানা খেয়েছিলাম রেস্তরাঁয়। আমার সাদামাটা পোশাকের দিকে সুবেশ ওয়েটারের তির্যক চাহনি প্রথমটা একটু দমিয়ে দিয়েছিল আমাকে। কিন্তু রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল পেটে শ্যাম্পেন পড়তেই। ফিরে এসেছিল আত্মবিশ্বাস।

নিজের কথা দিয়েই কথাবার্তা শুরু করেছিল বৃদ্ধ। গাড়িতে আসবার সময়ে বলেছিল নিজের নাম। স্কুলে পড়বার সময়েই শুনেছিলাম সেই নাম। বিরাট দার্শনিক। এগবার্ট এলভেসহ্যাম, ছেলেবেলা থেকেই যার বুদ্ধিমত্তার প্রভাব পড়েছে আমার ওপর, যার জীবনদর্শন নাড়া দিয়ে গেছে আমাকে বিলক্ষণ, বিখ্যাত সেই ধীশক্তিটি কৃশকায় অপটু জীর্ণ দেহে আমার এত সান্নিধ্যে এসেছে জেনে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম আমি। স্মরণীয় ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে হতাশ হয় অনেকেই–আমার হতাশা উপলব্ধি করতে পারবে তারাই। কথার তোড়ে অনেক কথাই বলে গিয়েছিল বৃদ্ধ। আয়ু তো প্রায় শেষ, প্রাণবহ্নি নিবু নিবু–কোনওরকমে টিকিয়ে-রাখা জীবনধারা ধু ধু মরু হয়ে যাবে সর্বস্ব আমাকে দান করার পর। বাড়ি, লেখার স্বত্ব, জমানো টাকা, নানা ব্যবসায়ে লগ্নি করা অর্থ-সমস্ত এবার থেকে হবে আমারই। দার্শনিকরা যে এত বড়লোক হয়, আগে জানা ছিল না। আমার খাওয়া এবং মদ্যপান–দুটোই ঈর্ষার চোখে নিরীক্ষণ করে গেছে বৃদ্ধ। বলেছিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বাঁচবার সামর্থ্য আছে বটে তোমার–তবে বেশি দিন থাকে না কিছুই। দীর্ঘশ্বাসের ধরনটা আমার কাছে মনে হয়েছিল একটু অন্য রকমের। যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচে গেল বৃদ্ধ।

শ্যাম্পেন খেয়ে আমার মাথা তখন বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। বলেছিলাম সোল্লাসে, কিন্তু ভবিষ্যৎ তো আছে। উজ্জ্বলতর হবে সেই ভবিষ্যৎ আপনার কৃপায়। আপনার নাম ব্যবহারের সম্মান পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? আপনার গৌরবময় অতীতও হবে আমার ভবিষ্যতের পাথেয়।…।

তোষামুদে তারিফ শুনে একটু বিষণ্ণভাবেই মাথা নেড়ে ক্ষীণ হাসি হেসেছিল বুড়ো। বলেছিল, ভবিষ্যৎ কি পালটাতে পারবে? আমার নাম নিতে তোমার আপত্তি নেই, আমার সামাজিক প্রতিষ্ঠা নিতেও দ্বিধা নেই, কিন্তু পারবে কি আমার বয়সের ভার মাথায় নিতে?

আপনার সমস্ত কীর্তির সঙ্গে সঙ্গে তা তো নেবই, বলেছিলাম বুক চিতিয়ে।

ওয়েটার এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে। হেসে সুপেয় সুরার অর্ডার দিয়েছিল বৃদ্ধ। তারপর পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজের মোড়ক বার করে হলদেটে কাঁপা আঙুলে মোড়ক খুলতে খুলতে বলেছিল, এর মধ্যে আছে আমার অপ্রকাশিত জ্ঞানের একটুখানি। অডার দিলাম কুমেল-এর–এই জিনিস একটু ছিটিয়ে দাও তার মধ্যে–দেখবে কুমেল হয়ে গেছে হিমেল।

কুমেল একজাতীয় উৎকৃষ্ট আসব। যে জিনিসটা ছিটিয়ে দেওয়ার জন্যে মোড়ক খুলে দেখালে, সেটা একটা গোলাপি গুঁড়ো। শেষ কথাটা বলতে বলতে মর্মভেদী তীক্ষ্ণ ধূসর চোখে চেয়ে রইল আমার মুখের দিকে।

সুরার সৌরভ নিয়েও এত বড় দার্শনিক মাথা ঘামায়, ভাবতে গিয়ে মনে মনে আঘাত পেয়েছিলাম। কিন্তু মদের নেশা সত্ত্বেও বুড়োর সৌরভবাতিক নিয়ে তোষামোদ করতে ছাড়িনি।

গোলাপি গুঁড়ো দুভাগ করে দুটি মদিরাপাত্রে মিশিয়ে দিয়েছিল বৃদ্ধ। তারপরেই আচমকা এমন মর্যাদাগম্ভীর ভঙ্গিমায় সুরাপাত্র বাড়িয়ে তুলেছিল আমার দিকে যে, থতমত খেয়ে অনুকরণ করেছিলাম আমিও। টুং করে ঠোকাঠুকি লেগেছিল দুই গেলাসে। উত্তরাধিকার বর্তাক অবিলম্বে, বলেই গেলাস তুলেছিল ঠোঁটের গোড়ায়।

না, না, দ্রুত স্বরে বাধা দিয়েছিলাম আমি।

থমকে গিয়েছিল বৃদ্ধ। সুরাপাত্র নেমে এসেছিল চিবুকের তলায়। দুই চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল আমার ওপর।

আমি বলেছিলাম, কামনা জানাই দীর্ঘ জীবনের।

দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিল বৃদ্ধ।

পরক্ষণেই অট্টহেসে বলেছিল, তা-ই হোক, কামনা জানাই দীর্ঘ জীবনের।

দুজনে দুজনের চোখে চোখে চেয়ে খালি করে দিয়েছিলাম গেলাস। চোঁ চোঁ করে চুমুক দেওয়ার সময়েও দেখেছিলাম, বুড়োর চোখ নির্নিমেষে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। গেলাস খালি হতেই অদ্ভুত তীব্র একটা অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। বিচিত্র সেই অনুভূতির প্রথম পরশেই তোলপাড় কাণ্ড আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল মস্তিষ্কের মধ্যে। খুলির মধ্যে কোষগুলো যেন সত্যি সত্যিই লাফালাফি জুড়েছে মনে হয়েছিল। কানের মধ্যে শুনেছিলাম একটানা গুঞ্জনধ্বনি। সুরার স্বাদ পাইনি জিবে অথবা গলায়, সৌরভে মুখ-গলা ভরে গেলেও তার উপলব্ধি ঘটেনি-বুড়োর ধূসর অনিমেষ চাহনির তীব্রতা যেন পুড়িয়ে দিয়েছিল আমার সত্তা। এক চুমুকেই শেষ করেছিলাম পাত্র। কতটুকুই বা আর সময় লাগে তাতে? আমার কিন্তু মনে হয়েছিল যেন অনন্তকাল ধরে চুমুক দিয়েই চলেছি। মাথার মধ্যে লন্ডভন্ড কাণ্ডও অব্যাহত রয়েছে অনন্তকাল ধরে। দুমদাম আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে মগজের প্রতিটা কোষ যেন তাণ্ডবনৃত্য জুড়েছে করোটির মধ্যে। চিন্তা-বুদ্ধি সবকিছুই ঘোলাটে– আবিলতা কাটছে না কিছুতেই। চৈতন্য লোপ পেলেও পাচ্ছে না–অর্ধ-অচৈতন্য অবস্থায় আবছাভাবে শুধু মনে আছে যেন বিস্তর অর্ধবিস্মৃত ঘটনা নেচে নেচে বেড়াচ্ছে অস্ফুট অবস্থাতেই।

সম্মোহনের ঘোর ভঙ্গ করল বৃদ্ধ নিজেই। আচম্বিতে পাঁজর-ভাঙা দমকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নামিয়ে রাখল গেলাস।

বললে, কেমন বুঝছ?

অপূর্ব! সুরার স্বাদ গ্রহণ করতে না পেরেও বলেছিলাম মুহ্যমানের মতো।

মাথায় তখন চরকিপাক দিচ্ছে। বসে পড়েছিলাম ধপ করে। প্রলয়কাণ্ড চলছে ব্রেনের মধ্যে, এইটুকুই কেবল উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম হাড়ে হাড়ে। একটু একটু করে স্বচ্ছ হয়ে এসেছিল অনুভূতি। ফাঁপা, বক্র, অবতল আয়নায়।

যেভাবে সবকিছুই খুদে খুদেভাবে দেখা যায়, মনে হয়েছিল, সেইরকমই দেখছি। সামনের দৃশ্য–কাছে থেকেও যেন দূরে সরে গেছে, ছোট হয়ে গেছে। বুড়োর হাবভাবেও পরিবর্তন এসেছে। ধড়ফড় করছে অত্যন্ত নার্ভাসভাবে। চেনে বাঁধা ঘড়ি টেনে বার করল হন্তদন্ত ভঙ্গিমায়। এক পলক দেখেই যেন ভুত দেখার মতো চমকে উঠল। এখুনি না বেরলেই নয়। ট্রেন ফেল হয়ে যাবে। আরেকজনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি বিল মিটিয়ে দিয়ে দুজনে বেরিয়ে এলাম বাইরে। ভাড়াটে গাড়িতে উঠে বসার পর নিজের কপালে হাত বোলাতে বোলাতে বললে, গুঁড়োটা তোমাকে না খাওয়ালেই হত। কাল তো মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হবে। এক কাজ কর। এই গুড়োটা নাও। রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে খেয়ে নিয়ো, কেমন? শুতে যাওয়ার আগে কিন্তু খেয়াল থাকে যেন।

বলে একটা সাদা প্যাকেট গছিয়ে দিল আমার হাতে। অনেকটা সিডলিজ পাউডারের মতো দেখতে, যা নাকি মৃদু জোলাপ হিসেবে খাওয়া হয়। বুড়োর বুলে-পড়া চোখের পাতা দেখে বুঝলাম, আমার মতোই অবস্থা হয়েছে নিজেরও। প্যাকেটটা হাতে গছিয়ে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর হোক বলে চেঁচিয়ে উঠতেই হাত খামচে ধরে আমিও বিদায় জানিয়েছিলাম সোল্লাসে। গাড়ি ছাড়ার আগের মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে বুকপকেট হাতড়ে শেভিং স্টিকের মতো একটা ছোট চোঙা বার করে গুঁজে দিলে আমার হাতে। দেখ দিকি কাণ্ড। এক্কেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। কাল তো আবার দেখা হবে–তখন খুলো–তার আগে নয়। কেমন?

ঘড়ঘড় শব্দে বেরিয়ে গেল গাড়ি। পুঁচকে চোঙাটা হাত পেতে নিয়েছিলাম আলগোছে– আর-একটু হলেই হাত ফসকে পড়ে যেত রাস্তায়। দারুণ ভারী। সিসের না প্ল্যাটিনামের? দুপাশে আর মাঝখানের জোড় বরাবর লাল গালা লাগানো।

সযত্নে বস্তুটা রাখলাম পকেটে। মাথার মধ্যে চাকা ঘুরছে তখনও। ওই অবস্থাতেই হাঁটতে শুরু করলাম রিজেন্ট স্ট্রিট দিয়ে। রাস্তার লোক কী ভাবল কে জানে। চলেছি আপন মনে। অন্ধকার গলিখুঁজি পেরিয়ে এলাম পোর্ট স্ট্রিটে। হাঁটছি যেন আফিমের ঘোরে। কে জানে গোলাপি গুঁড়োটা সত্যিই আফিম কি না। হাঁটার সময়ে যা যা অনুভব করেছিলাম, এখনও তা সুস্পষ্ট মনে আছে। আফিম খাওয়ার অভিজ্ঞতা আগে তো কখনও হয়নি। মনটা যেন দুভাগ হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত অনুভূতিটা কী করে বোঝাই, ভেবে পাচ্ছি না। রিজেন্ট স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মন যেন বলতে চাইল, ওয়াটারলু স্টেশনে এসে গেছি–ট্রেনে ওঠা দরকার। চোখ রগড়ে নিয়ে দেখলাম, আরে গেল যা, রিজেন্ট স্ট্রিটেই তো হাঁটছি। বোঝতে পারলাম কি? পাকা অভিনেতা যেন কটমট করে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে–আমি যেন আর-এক মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম–কটমটে চাহনির সময়ে জোর করে যা ছিলাম, তা-ই হয়ে গেলাম। রিজেন্ট স্ট্রিটকে রিজেন্ট স্ট্রিট মনে হতেই মনের মধ্যে ভিড় করে এল সৃষ্টিছাড়া অনেক স্মৃতি, মনে মনে ভাবলাম, ত্রিশ বছর আগে এইখানেই ঝগড়া করেছিলাম ভাইয়ের সঙ্গে। হো হো করে হেসে উঠেছিলাম। ফ্যালফ্যাল করে পাশের পথচারীরা চেয়ে ছিল আমার দিকে। ত্রিশ বছর আগে তো জন্মই হয়নি আমার ভাই-টাইও নেই কস্মিনকালে। গোলাপি গুঁড়োর মাহাত্ম কী অপরিসীম। ভাই যে একটা ছিল, এই চিন্তাটা কিন্তু জাঁকিয়ে বসল মাথার মধ্যে এর পরেও। পোর্টল্যান্ড রোড দিয়ে যাওয়ার সময়ে নতুন মোড় নিল পাগলামি। মনে পড়ল এমন অনেক দোকানের কথা, যা অদৃশ্য হয়ে গেছে। রাস্তা আগে যা ছিল, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে লাগলাম বর্তমান রাস্তার চেহারা। আবিল চিন্তাধারার পুরানো স্মৃতি ঠেলাটেলি করে ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চম্পট দিলে অন্যান্য অনেক স্মৃতিও। ঘাবড়ে গেলাম খুবই। ভূতুড়ে স্মৃতির আনাগোনায় আরও গুলিয়ে গেল মাথা। স্টিভেন্স-এর দোকানের সামনে পৌঁছাতেই খেয়াল হল, কী যেন একটা কাজ ছিল দোকানটায়, কিন্তু মনে করতে পারছি না কিছুতেই। সশব্দে একটা বাস বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে, আওয়াজটা মনে হল অবিকল চলন্ত ট্রেনের আওয়াজ। একপাশে সরে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আগামীকাল তিনটে ব্যাং পাঠানোর কথা ছিল স্টিভেন্স-এর। আশ্চর্য! এই সহজ ব্যাপারটা ভুলে মেরে দিয়েছিলাম!

একটার পর একটা স্মৃতিদৃশ্য ভৌতিক ছায়ার মতো মনের মধ্যে ঠেলে উঠেই হটিয়ে দিচ্ছে তার একটা অপচ্ছায়ার মতো স্মৃতিকে। স্মৃতি আর স্মৃতি! কোনওটাই আমার জীবনে কখনও ঘটেনি–অথচ তা আমারই স্মৃতি মনে হচ্ছে! হুটোপাটি করছে মনের মধ্যে।

চেনা রাস্তা ছেড়ে কখন যে অন্য পথ ধরে হাঁটতে আরম্ভ করেছি, সে খেয়ালও ছিল না। মাথার মধ্যে ভৌতিক কাণ্ডকারখানা চলায়। ইউনিভার্সিটি স্ট্রিটে পৌঁছানোর পর বাড়ির নম্বর মনে পড়ল না। অনেক চেষ্টার পর ২১এ নম্বর মনে পড়ল বটে, কিন্তু বেশ মনে হল, আর কেউ যেন নম্বরটা বলেছে আমাকে আমার নিজের বাড়ির নম্বর আমারই মনে নেই –অন্যে মনে করিয়ে দিয়েছে। মাথা ঠান্ডা করার জন্যে ডিনার খাওয়ার ঘটনাগুলো মাথায় আনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই বুড়োর মুখটা আনতে পারলাম না মনের মধ্যে। আবছা ছায়ার মতো একটা আকৃতি বারবার ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল স্মৃতির পরদায়। ঠিক যেন কাচের শার্সিতে প্রতিফলিত কারও মুখ দেখছি। বুড়োর মুখের বদলে দেখলাম। নিজের অদ্ভুত রকমের বাহ্য আকৃতি। টেবিলে বসে উজ্জ্বল চোখে রাঙা মুখে বকর বকর করে চলেছি বিষম উৎসাহে।

অসম্ভব! অন্য গুঁড়োটা এবার খাওয়া দরকার! আর তো পারা যাচ্ছে না, বলেছিলাম। নিজের মনেই।

হলঘরে ঢুকে দেশলাই আর মোমবাতি খুঁজলাম যেদিকে, সেদিকে দেশলাই আর মোমবাতি কখনও থাকে না। সিঁড়িতে উঠে কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, কোন তলায় রয়েছে আমার ঘর। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেলাম। মাতাল হয়েছি নিঃসন্দেহে। নইলে হোঁচট খাব কেন?

ঘরে ঢুকেই অচেনা লাগল সবকিছুই। জোর করে বশে আনলাম মনকে। উদ্ভট চিন্তাভাবনা তাড়ালাম মন থেকে। চেনা-চেনা মনে হল ঘরখানা। ওই তো আয়না–কোণে সাঁটা কাগজ। ওই তো চেয়ার–মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছে জামাকাপড়। তা সত্ত্বেও বেশ মনে হল, জোর করে চেনবার চেষ্টা করছি বটে, কিন্তু আমি যেন সেই মুহূর্তে বসে রয়েছি রেলগাড়িতে। গাড়ি থামল একটা স্টেশনে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি একটা অচেনা প্ল্যাটফর্মের দিকে।

অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি পেয়ে গেলাম নাকি হঠাৎ? নাঃ! কালকেই চিঠি লিখতে হবে সাইকিক্যাল রিসার্চ সোসাইটিতে।

খাটে বসে বুট খুললাম পা থেকে। বেশ বুঝছি, আমার এই বর্তমান অনুভূতি আঁকা রয়েছে আর-একটা অনুভূতির ওপর। সেই অনুভূতিটাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে আসতে চাইছে ওপরে। একই সঙ্গে দুজায়গায় থাকা তো যায় না! জামাকাপড় অর্ধেক খুললাম, অর্ধেক পরেই রইলাম। পাউডারটা গেলাসে ঢেলে দিতেই ভুসভুস করে বুদবুদ উঠল কিছুক্ষণ। দ্যুতিময় অম্বর রঙে রঙিন হয়ে উঠল জল। গলায় ঢেলে দিলাম তৎক্ষণাৎ। বিছানায় শোয়ার সময়ে বুঝলাম, মাথা ঠান্ডা হয়ে আসছে। বালিশটা মাথার তলায় লাগাতে না লাগাতেই নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

ঘুম ভাঙল হঠাৎ। স্বপ্ন দেখছিলাম। অদ্ভুত জানোয়ারদের স্বপ্ন। মন ভারাক্রান্ত। নামহীন আতঙ্কে বুক তোলপাড়। মুখ বিস্বাদ। হাত-পা অবশ। চামড়ায় অস্বস্তিকর শিহরন। শুয়ে রইলাম বালিশে মাথা দিয়ে। অস্বস্তি আর আতঙ্কের ভাবটা কেটে গেলেই আবার ঘুমিয়ে পড়ব ভাবছিলাম। কিন্তু তা হল না। বেড়েই চলল রহস্যজনক অপার্থিব অনুভূতি। চারপাশের খাপছাড়া দৃশ্য প্রথমে ধরতে পারিনি। মৃদু আলো রয়েছে ঘরে–প্রায় অন্ধকার বললেই চলে। তাল তাল তমিস্রার জায়গায় রয়েছে আসবাবপত্রগুলো। চাদরের ওপর দিয়ে। চোখ পাকিয়ে চেয়ে রইলাম সেইদিকে।

মনে হয়েছিল, নিশ্চয় কেউ ঘরে ঢুকেছে। মানিব্যাগ নিয়ে চম্পট দেওয়ার মতলব। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর বুঝলাম, আশঙ্কাটা মনের ভ্রান্তি। তা সত্ত্বেও খটকা গেল না মন থেকে। কোথায় যেন একটা ছন্দপতন ঘটেছে। মুন্ডু তুলে তাকালাম ঘরের চারদিকে। যা দেখলাম তা কল্পনাতে আনতে পারলাম না। অন্ধকার কোথাও কম, কোথাও বেশি। দেখা যাচ্ছে পরদা, টেবিল, ফায়ারপ্লেস, বইয়ের তাক এবং আরও অনেক কিছু। তারপরেই দূরের অন্ধকারের মধ্যে অচেনা-অপরিচিত অনেক কিছুই দেখতে পেলাম। খাট ঘুরে গেল নাকি? বইয়ের তাক হতে পারে দূরের ওই জমাট অন্ধকার, কিন্তু তার পাশে যা দেখছি, সেটা তো আমার চেয়ার নয়। চেয়ারের চেয়ে অনেক বড়।

ছেলেমানুষি আতঙ্কে গায়ের চাদর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পা বাড়ালাম খাট থেকে নামব বলে। কিন্তু মাটিতে পা ঠেকা দূরের কথা, তোশকের কিনারা পর্যন্ত পা পৌঁছাল না। এগিয়ে গিয়ে বসলাম খাটের ধারে। খাটের পাশেই থাকা উচিত মোমবাতি, ভাঙা চেয়ারের ওপর দেশলাই। হাত বাড়ালাম। হাতে ঠেকল না কোনওটাই। প্রায়ান্ধকারে হাতড়াতে গিয়ে হাত ঠেকল ভারীমতো একটা বস্তুতে। খসখস আওয়াজ হল হাত দিতেই। খামচে ধরে টান দিতেই বুঝলাম, খাটের মাথায় ঝুলছে পরদা।

ঘুমের জড়তা তখন কেটে গেছে। বেশ বুঝলাম, অজানা-অচেনা একটা ঘরে বসে আছি। ঘাবড়ে গেলাম। গত রাতের ঘটনাগুলো মনে করলাম। অবাক কাণ্ড! সুস্পষ্ট মনে করতে পারলাম। খাওয়া, হাত পেতে মোড়ক নেওয়া, নেশাখোরের মতো হাঁটাচলা, আধখ্যাঁচড়াভাবে জামাকাপড় খোলা, বালিশে মাথা দেওয়ার পর নিবিড় প্রশান্তি। বিশ্বাস করতে পারলাম না নিজেকেই। গতকালের ঘটনা না পরশু রাতের ঘটনা? চুলোয় যাক, এ ঘরটা তো আমার নয়–এলাম কী করে? আবছা আঁধার আরও পাতলা হয়ে আসছে, জানলা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, খড়খড়ি দিয়ে যেন ভোরের আলো ঢুকছে। ডিম্বাকৃতি কাচটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উঠে দাঁড়াতেই বড় কাহিল মনে হল নিজেকে। টলছি। কাঁপা হাত সামনে বাড়িয়ে জানলার দিকে এগতে গিয়ে হাঁটু ছড়ে গেল একটা চেয়ারে হুমড়ি খেয়ে পড়ায়। কাঁচে হাত বোলালাম। বেশ বড় কাচ। হাতে ঠেকল বাহারি ঝুলন্ত দীপাধার– পেতলনির্মিত। খড়খড়ির দড়ি খুঁজলাম। পেলাম না। হাত ঠেকল ঝুমকোয়। টান মারতেই খট করে খড়খড়ি উঠে গেল ওপরে।

যে দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের সামনে, তা কখনও দেখিনি। আকাশ মেঘে ঢাকা। ভোরের আবছা আলো মেঘের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে। রক্ত-রঙিন হয়ে উঠেছে মেঘস্তূপের কিনারা আকাশের প্রান্তে। নিচে অন্ধকার। অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে দুরের পাহাড়, মসিকৃষ্ণ মহীরুহ, আবছা বাড়ির সারি। জানলার তলায় কালো ঝোপ, ফিকে ধূসর পথ। স্বপ্ন দেখছি নাকি? এসব তো কস্মিনকালেও দেখিনি! প্রসাধন টেবিলে হাত বোলালাম। পালিশ-করা কাঠ। সাজানোয় ত্রুটি তো নেই-ই, বরং বাহুল্য আছে। ছোট ছোট কাট-গ্লাসের শিশি রয়েছে বিস্তর। রয়েছে একটা বুরুশ। আরও একটা অদ্ভুত বস্তু হাতে ঠেকল। ঘোড়ার খুরের মতো আকার। মসৃণ। খোঁচা দুটো বেশ শক্ত। জিনিসটা রয়েছে একটা প্লেটের ওপর। দেশলাই পেলাম না। মোমবাতিও পেলাম না। আবার চোখ বোলালাম ঘরময়। খড়খড়ি খোলা থাকায় আলো আসছে বলে দেখতে পেলাম, চারদিকে ঝোলানো পরদা দিয়ে ঢাকা বিরাট একটা খাট, খাটের পায়ের দিকে ঝকঝকে সাদা মার্বেল পাথরের মতো বস্তু দিয়ে তৈরি ফায়ারপ্লেস।

প্রসাধন টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে ফের চোখ খুলে চেয়েছিলাম। স্বপ্ন নয়। একেবারে বাস্তব। গত রাতের নেশার ঘোের বোধহয় কাটেনি। রাতারাতি সম্পত্তির দখল নিয়ে ফেলেছি–এই পাগলামিটাই নেশার ঘোরে অবাস্তবকে বাস্তবের মতো নিশ্চয় তুলে ধরেছে চোখের সামনে। নিজের ঘরদোর সব ভুলে মেরে বসে আছি। সবুর করলেই নিশ্চয় আবার মনে পড়বে। বৃদ্ধ এলভেসহ্যামের সঙ্গে খাওয়াদাওয়ার স্মৃতিটা তো কিন্তু বেশ জ্বলজ্বলে।

শ্যাম্পেনের স্বাদ, ওয়েটারের তাচ্ছিল্যপূর্ণ চাহনি, গোলাপি গুঁড়ো, কড়া মদ–বেশ স্পষ্ট মনে পড়ছে। যেন মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগের ঘটনা।

তারপরেই ঘটল একটা তুচ্ছ কিন্তু ভয়ংকর ঘটনা। এখনও ভাবতে গিয়ে গা কাঁপছে। স্বগতোক্তি করেছিলাম–বেশ জোরেই।

কী মুশকিল! এলাম কোন চুলোয়?… কণ্ঠস্বর কিন্তু আমার নয়!

না, সে কণ্ঠস্বর কখনওই আমার নয়! অত সরু গলা আমার নয়! উচ্চারণ জড়িত। মুখের হাড়ে স্বরের অনুরণন অন্য ধরনের। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যে এক হাত দিয়ে আরেক হাত বুলিয়েছিলাম। হাতে ঠেকেছিল শিথিল চামড়া–ভাঁজ-খাওয়া কোঁচকানো চামড়া, হাড়ের ওপর সেঁটে থাকা চামড়া। স্বপ্ন! নিঃসন্দেহে স্বপ্ন দেখছি! গলা তাই বিকৃত, চামড়াও খসখসে মনে হচ্ছে। হাত বুলিয়েছিলাম মুখে, দাঁত নেই। আঙুল ঠেকেছিল শুকিয়ে-যাওয়া মাড়িতে। ঘিনঘিন করে উঠেছিল সর্বাঙ্গ।

আয়নায় দেখা দরকার মুখখানা। টলতে টলতে গিয়েছিলাম ম্যান্টেলের দিকে। দেশলাই খুঁজতে গিয়ে ভয়ানক কাশির ধমকে প্রাণ যায় আর কী। খামচে ধরেছিলাম ফ্লানেলের রাত্রিবাস। আমার গায়ে ফ্লানেলের রাত্রিবাস?

দেশলাই পাইনি। খুব শীত করছিল। নাক বুজে আসছিল। কাশতে কাশতে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল। টলতে টলতে খাটে উঠে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখছি! স্বপ্ন দেখছি! খাটে উঠতে উঠতে বলেছিলাম গোঙানির স্বরে। অথর্ব বৃদ্ধরাই কিন্তু এইভাবে এক কথা বারবার বলে। চাদর মুড়ি দিয়ে জোর করে চোখে ঘুম টেনে আনার চেষ্টা করেছিলাম। ঘুমালেই স্বপ্ন উধাও হবে। ভোরের আলোয় চিনতে পারব চেনা ঘরকে।

কিন্তু যা ভেবেছিলাম, তা হয়নি। ঘুমাতে পারিনি। পরিবর্তনটা ধীরগতিতে কিন্তু বেশ দৃঢ়ভাবে জাঁকিয়ে বসছিল মনের মধ্যে। অব্যাখ্যাত রহস্যজনক পন্থায় আমি রাতারাতি বুড়িয়ে গেছি। যৌবন হারিয়েছি–হ্যারিয়েছি শক্তি, সামর্থ্য, ভবিষ্যতের স্বপ্ন! প্রতারিত হয়েছি রাতারাতি ঠগবাজের হাতে সঁপে দিয়েছি আমার জীবন আর যৌবনের অমূল্য সম্পদ। অজান্তেই আবার শীর্ণ আঙুল বুলিয়েছিলাম কুঁচকে-যাওয়া মাড়িতে। ভ্রান্তি নয়। সত্যি, নিষ্ঠুর সত্যি।

স্পষ্টতর হয়েছিল ভোরের আলো। ঘুমের চেষ্টা বাতুলতা বুঝে উঠে বসেছিলাম। হিমশীতল উষালোকে স্পষ্ট দেখেছিলাম ঘরের সব জিনিস। পেল্লায় ঘর। ফার্নিচারও বিস্তর। রুচিসম্মত। জীবনে এমন ঘরে ঘুমাইনি। এক কোণে নিচু তেপায়ার ওপর মোমবাতি আর দেশলাই দেখা যাচ্ছে আবছাভাবে। চাদর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নেমে পড়েছিলাম খাট থেকে। ভোরের ঠান্ডায় শিরশির করে উঠেছিল সর্বাঙ্গ–অথচ তখন গরমকাল। মোমবাতি ধরে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখতে গিয়ে দেখেছিলাম–

এলভেসহ্যামের মুখ!

এই আতঙ্কটাই আবছাভাবে জড়িয়ে রেখেছিল এতক্ষণ আমাকে।

এলভেসহ্যামের শীর্ণকায় চেহারা আগেও দেখেছি–তখন গায়ে ছিল ধাচূড়া। এখন দেখলাম অনাবৃত অবস্থায়। রাত্রিবাস খসে পড়ায় সরু গলা আর হাড় বার-করা বুক দেখে শিউরে উঠেছিলাম। তোবড়োনো গাল। লম্বা নোংরা সাদা চুল, ঘোলাটে চোখ। শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট কাঁপছে থিরথির করে। নিচের শিথিল ঠোঁটের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে কালচে মাড়ি। সমবয়সিরা উপলব্ধি করবেন আমার মানসিক অবস্থা। পূর্ণ যৌবনের উদ্দাম স্বাধীনতা হারিয়ে সহসা বন্দি হয়েছি এক জরাকম্পিত বৃদ্ধের জীর্ণ খাঁচায়–আয়ু যার নিঃশেষিত।

মূল কাহিনি থেকে কিন্তু সরে আসছি। ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া আচমকা দেহ-পরিবর্তন নিয়ে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়েছিলাম নিশ্চয়। দিনের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠল চিন্তা করার ক্ষমতা। জানি না কোন জাদুমন্ত্রবলে এক দেহ থেকে আরেক দেহে যাওয়া সম্ভব হয়, কিন্তু অব্যাখ্যাতভাবে ঠিক তা-ই ঘটেছে আমার ক্ষেত্রে। এলভেসহ্যামের পৈশাচিক মৌলিকতার নগ্নরূপ স্পষ্ট হয়ে উঠল মনের মধ্যে। আমি যেমন তার দেহে ঢুকে বসে আছি, নিঃসন্দেহে এলভেসহ্যামও ঢুকে পড়েছে আমার দেহে–আমার ভবিষ্যৎ, আমার শক্তি এখন তারই দখলে। কিন্তু তা প্রমাণ করা যায় কী করে?

সম্ভাবনাটা এমনই অসম্ভব যে, যাচাই করার জন্যে আবার চিমটি কেটেছিলাম চামড়ায়, আঙুল বুলিয়েছিলাম মাড়িতে, আয়নায় দেখেছিলাম মুখখানা। ঘটনা কিন্তু ঘটনাই থেকেছে। এমন জীবন-মরীচিকাও কি সম্ভব? সত্যিই কি আমি হয়েছি এলভেসহ্যাম, আর এলভেসহ্যাম হয়েছে আমি? ইডেনকে স্বপ্ন দেখছি না তো? ইডেন বলে সত্যিই কেউ কখনও ছিল কি? বেশ তো, আমি যদি এলভেসহ্যামই হই, তাহলে মনে থাকা উচিত। গতকাল সকালে ছিলাম কোথায়, আছি কোন শহরে এবং কী কী ঘটেহিল স্বপ্ন শুরুর অগে। ধস্তাধস্তি করেছিলাম চিন্তার সঙ্গে। গত রাতে দুটো স্মৃতি হুড়োহুড়ি করেছিল মনের মধ্যে। এখন মন পরিষ্কার। আসল ইডেনের কোনও স্মৃতিকেই টেনেটুনে তুলে আনতে পারলাম না মনের পরদায়।

যত্তসব পাগলামি! ফাটা বাঁশির মতো সরু গলায় চিৎকার করে উঠে টলতে টলতে দুর্বল পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম মুখ ধোয়ার বেসিনের সামনে, ঠান্ডা জলে ভিজিয়েছিলাম মাথার সাদা চুল। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে আবার ভাবতে চেষ্টা করেছিলাম। বৃথা চেষ্টা। নিঃসন্দেহে আমি ইডেনই ছিলাম–এলভেসহ্যাম নয়। ইডেন কিন্তু এখন বন্দি রয়েছে। এলভেসহ্যামের শরীরে।

অন্য বয়সের মানুষ হলে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিতাম নিজেকে। মন্ত্রের কাছে জারিজুরি খাটে না, অতএব হাল ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয় মনে করতাম। কিন্তু এ যুগটা যাচাই করে নেওয়ার যুগ। অলৌকিক বা দৈব ঘটনা এ যুগে পাত্তা পায় না। অতএব পুরো ব্যাপারটাই নিশ্চয় মনোবিজ্ঞানের কারসাজি। ওষুধ খাইয়ে আর নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থেকে যা ঘটানো যায়, তার উলটোটা ঘটিয়ে দেওয়া যেতে পারে অন্য ওষুধ খাইয়ে আবার নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকতে পারলে। স্মৃতিলোপের ঘটনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু স্মৃতিবিনিময়ের ঘটনা কেউ কখনও শোনেনি! হাসতে গিয়ে বুড়োটে কেশো হাসি বেরিয়ে এসেছিল গলা দিয়ে। বুড়ো এলভেসহ্যামও নিশ্চয় আমার দুরবস্থা কল্পনা করে হাসছে এই মুহূর্তে। ভাবতেই প্রচণ্ড ক্রোধে জ্বলে উঠেছিলাম দপ করে–অথচ এরকম রাগে অগ্নিশর্মা হওয়ার ধাত আমার নয়। জামাকাপড় পরতে গিয়ে মেঝে থেকে যা কুড়িয়ে পেলাম তা সান্ধ্য পোশাক। ওয়ার্ডরোব খুলে বার করলাম সেকেলে ট্রাউজারস আর ড্রেসিং গাউন। সাদা মাথায় বুড়োটে টুপি চাপিয়ে কাশতে কাশতে বেরিয়ে এলাম চাতালে।

তখন বোধহয় পৌনে ছটা। বাড়ি নিস্তব্ধ। সব জানালাতেই খড়খড়ি বন্ধ। চাতালটা বেশ চওড়া। দামি কার্পেট পাতা প্রশস্ত সোপান নেমে গেছে নিচের তলার অন্ধকার হলঘরে। সামনেই খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে লেখবার টেবিল, ঘোরানো বুককেস, চেয়ারের পেছনদিক আর মেঝে থেকে কড়িকাঠ পর্যন্ত তাক বোঝাই সারি সারি চমৎকার বাঁধানো কেতাব।

আমার পড়ার ঘর, বিড়বিড় করে বলে খোলা দরজার দিকে এগিয়েই থমকে গিয়েছিলাম কণ্ঠস্বর কানে বেজে ওঠায়। শোবার ঘরে ফিরে গিয়ে নকল দাঁতের পাটি মাড়িতে বসিয়ে অভ্যস্ত কায়দায় কামড় বসাতে খাপে খাপে বসে গিয়েছিল বাঁধাই দাঁত।

লেখবার টেবিলের সব ড্রয়ারেই চাবি দেওয়া। ওপরে খাড়াই ঘোরানো অংশটাতেও চাবি দেওয়া। চাবি কোথাও নেই–এমনকী আমার প্যান্টের পকেটেও নেই। শোবার ঘরে পা টেনে টেনে গিয়ে সব কটা জামা-প্যান্টের পকেট হাতড়ালাম। ঘরের অবস্থা দেখে মনে হল যেন চোর ঢুকেছিল। ঘরময় ছত্রাকার জামা-প্যান্টের কোনও পকেটেই নেই চাবি, নেই টাকাপয়সা, নেই একচিলতে কাগজ–গত রাত্রের ডিনার খাওয়ার বিলটা ছাড়া।

বসে পড়েছিলাম। ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিলাম প্রত্যেকটা টেনে বার করা জামা-প্যান্টের দিকে। প্রচণ্ড ক্রোধাগ্নি তখন নিবে গেছে। নিঃসীম নিরাশায় ভেঙে পড়েছি। প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করেছি শত্রুর বিপুল বুদ্ধিমত্তা, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি কতখানি অসহায় আমি। জোর করে উঠে পড়ে হন্তদন্ত হয়ে গিয়েছিলাম পড়ার ঘরে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে খড়খড়ি টেনে তুলছিল একজন পরিচারিকা। আমার মুখের অবস্থা দেখেই বোধহয় চেয়ে রইল চোখ বড় বড় করে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চুল্লি খোঁচানোর লোহার ডান্ডা মেরে ভাঙতে লাগলাম লেখবার টেবিল। চুরমার হয়ে গিয়েছিল টেবিলের ওপরদিক, খসে পড়েছিল তালা, খুপরি থেকে চিঠিপত্র ছিটকে পড়েছিল ঘরময়। রগচটা বৃদ্ধের মতোই কলম ছুঁড়ে ফেলেছিলাম, দোয়াত উলটে দিয়েছিলাম, লেখবার হালকা সরঞ্জাম সমস্ত ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। ম্যান্টেলের ওপর বিরাট ফুলদানিও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল –কীভাবে তা বলতে পারব না। তছনছ করেও পাইনি চেকবই, টাকা অথবা আমার দেহ ফিরিয়ে আনার কোনও নিদর্শন। ড্রয়ারগুলো পিটিয়ে তক্তা করার সময়ে দুজন পরিচারিকাকে সঙ্গে নিয়ে খাসভৃত্য ঘরে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার ওপর।

সংক্ষেপে, এই আমার দেহ-পরিবর্তনের গল্প। ছিটগ্রস্তের এই গল্প কেউ বিশ্বাস করবে না, আমি কি তা জানি না? পাগল হয়ে গেছি, তাই নাকি নজরবন্দি আমি। কিন্তু পাগল যে হইনি, তা প্রমাণ করার জন্যেই কাগজ-পেনসিল নিয়ে বসেছি এই কাহিনি লিখব বলে। কিছু বাদ দিলাম না–খুঁটিয়ে লিখলাম। পাঠক-পাঠিকারা পড়ে বলুন, রচনাশৈলী বা বলার ভঙ্গির মধ্যে উন্মত্ততার লক্ষণ কিছু দেখছেন কি? এক বৃদ্ধের দেহপিঞ্জরে বন্দি এক তরুণের হাহাকার নয় কি এই কাহিনি? এত বড় একটা সত্যি ঘটনাও কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য নয় কারও কাছেই। আমার ডাক্তারের, আমার সেক্রেটারিদের, আমার চাকর-চাকরানি এবং প্রতিবেশীদের নাম জানি না। খুবই স্বাভাবিক। তারা আসছে রোজ, কিন্তু যেহেতু তাদের চিনতে পারছি না, তাই আমাকে অপ্রকৃতিস্থ ধরে নিচ্ছে। এদের চোখে তো আমি পাগলই–বদ্ধ পাগল। অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করছি এদের প্রত্যেককে, কাঁদছি, গলাবাজি করছি, নিষ্ফল রাগে হাত-পা ছুড়ছি। আমার অবস্থায় এর প্রতিটি স্বাভাবিক–ওদের কাছে। অস্বাভাবিক। আমার কাছে টাকা নেই, চেকবইও নেই। ব্যাঙ্কে আমার সই মিলবে না–কাঁপা হাতে যে সই করব, তাতে তো মনে হয় ইডেনের লেখার টান থাকবেই। আমি যে নিজে ব্যাঙ্কে গিয়ে সব কথা বলব, সে পথও বন্ধ। এই শুভানুধ্যায়ীরা বেরতে দিচ্ছে না। আমার অ্যাকাউন্ট রয়েছে লন্ডনের কোনও এক পাড়ায়। ধড়িবাজ এলভেসহ্যাম নিশ্চয় নিজের আইনবিদের নামও গোপন রেখেছে বাড়ির লোকের কাছে–যাচাই করার সে পথও বন্ধ। এলভেসহ্যাম মনোবিজ্ঞানে পণ্ডিত ছিল। আমার কাহিনি শুনে প্রত্যেকেরই বিশ্বাস, মন। নিয়ে বেশি তন্ময় থাকায় মাথা বিগড়েছে এলভেসহ্যামের, মানে আমার। নিজেকেই নাকি আর নিজে বলে চিনতে পারছি না। দুদিন আগে ছিলাম প্রাণবন্ত যুবক–সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আর আজ আমি জরাজীর্ণ; ক্ষিপ্ত মস্তিষ্কে হনহন করে টহল দিচ্ছি বাড়িময়, রেগে টং হয়ে আছি, ভয়ে কেউ সামনে আসছে না–দূর থেকে নজরবন্দি রেখেছে উন্মাদকে। লন্ডনে এই মুহূর্তে পূর্ণ যৌবনের সমস্ত সুযোগ নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চলেছে এলভেসহ্যাম–সেই সঙ্গে মগজের মধ্যে ঠাসা রয়েছে সত্তর বছরের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা। চুরি করেছে কেবল আমার জীবনটা! কীভাবে যে এ কাণ্ড ঘটল, আজও তা পরিষ্কার নয় আমার কাছে। পড়ার ঘর ভরতি অনেক পাণ্ডুলিপিতে দেখেছি মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধে বিস্তর তথ্য সংক্ষেপে লিখে রেখেছে এলভেসহ্যাম, সাংকেতিক হরফে অনেক গণনাও রয়েছে– আমার কাছে সবই দুর্বোধ্য। কয়েক জায়গায় যা লিখেছে, তা পড়ে এইটুকু বুঝলাম যে, অঙ্কশাস্ত্রের দর্শনবাদ নিয়েও মাথা ঘামিয়েছে বিস্তর। যে জ্ঞান আর পাণ্ডিত্যের জন্যে এলভেসহ্যামের আসল ব্যক্তিত্ব, জীর্ণ এই মগজ থেকে তার সবটুকুই চালান করেছে আমার তাজা মগজে এবং আমার যা কিছু তা বিদেয় করেছে এই বাতিল মগজের খাঁচায়। এককথায়, দেহবদল করেছে বুড়ো। এ জিনিস সম্ভব হয় কী করে, তা-ই তো ভেবে থই পাচ্ছি না। আমার জ্ঞানবুদ্ধির বাইরে। চিন্তার জগতে আমি বরাবর বস্তুবাদী। হঠাৎ এই ঘটনার পর দেখছি বস্তু থেকে ব্যক্তির সত্তা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া সম্ভব।

মরিয়া হয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করব ঠিক করেছি। মরবার আগে বসেছি সব কথা লিখে রাখার জন্যে। আজ সকালে প্রাতরাশের টেবিল থেকে একটা ছুরি দিয়ে অভিশপ্ত এই টেবিলের একটা গুপ্ত ড্রয়ার ভেঙে ফেলেছি। গুপ্ত ড্রয়ার নামেই–চোখের সামনে রেখে যেন। গুপ্ত করা হয়েছে। ভেতরে পেয়েছি একটা ছোট্ট সবুজ শিশি–আর কিছু না। শিশির মধ্যে রয়েছে খানিকটা সাদা গুঁড়ো। লেবেলে লেখা একটাই শব্দ–মুক্তি। নিঃসন্দেহে বিষ। এলভেসহ্যামই রেখেছে আমার নাগালের মধ্যে লুকিয়ে রাখার অছিলায়–যাতে খেয়ে মরি এবং তার অপকর্মের একমাত্র সাক্ষীটি ইহলোক থেকে বিদায় নেয়। লোকটা যত দুরাত্মাই হোক, অমর হওয়ার পথ যে আবিষ্কার করেছে, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। দুর্ঘটনা না ঘটলে, আমার শরীর নিয়ে বাঁচবে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত। তারপর সুযোগ বুঝে জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে প্রবেশ করবে আবার কোনও হতভাগ্য তরুণের দেহে। চুরি করবে তার জীবন, যৌবন, ভবিষ্যৎ। হৃদয়হীন সন্দেহ নেই… কিন্তু আমি ভাবছি, এইভাবে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা বাড়তে বাড়তে গিয়ে ঠেকবে কোথায়… ভাবছি, কতকাল ধরে এইভাবে দেহ থেকে দেহান্তরে লাফ দিয়ে দিয়ে চলেছে বৃদ্ধ… কিন্তু আর পারছি না। ক্লান্তি বোধ করছি। সাদা গুড়ো জলে গুলে যায় দেখেছি। খেতেও খারাপ নয়।

.

মি. এলভেসহ্যামের টেবিলে পড়ে-থাকা লেখাটার শেষ এইখানেই। মৃতদেহটা পড়ে ছিল চেয়ার আর টেবিলের মাঝখানে। শেষ মুহূর্তে খিচুনির সময়ে সম্ভবত চেয়ার ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল পেছনে। গল্পটা পেনসিলে লেখা, হাতের লেখাও মি. এলভেসহ্যামের সুন্দর হস্তাক্ষরের মতো নয়। দুটো অদ্ভুত ঘটনা নথিভুক্ত করেই ইতি টানা যাক উপাখ্যানে। ইডেন আর এলভেসহ্যামের মধ্যে যে একটা সম্পর্ক ছিল, সে বিষয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশই নেই। কেননা এলভেসহ্যামের যাবতীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করা হয়েছে ইডেনকে। ইডেন কিন্তু উত্তরাধিকারী হয়েও হতে পারেনি। মারা গিয়েছিল এলভেসহ্যাম আত্মহত্যা করার চব্বিশ ঘণ্টা আগে–জনবহুল চৌমাথায় গাড়িচাপা পড়ে। অত্যাশ্চর্য এই কাহিনিতে আলোকসম্পাত করতে পারত একমাত্র যে ব্যক্তি, এখন সে জেরার বাইরে।

নিতল নগরী

নিতল নগরী ( In the Abyss )

[‘In the Abyss’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Pearsons Magazine’ পত্রিকায় আগস্ট ১৮৯৬ সালে। ১৮৯৭ সালে লন্ডনের ‘Methuen & Co.’ থেকে প্রকাশিত ওয়েলসের ছোটগল্পের সংকলন ‘The Plattner Story and Others’ বইটিতে গল্পটি স্থান পায়। সেপ্টেম্বর ১৯২৬ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘Amazing Stories’ পত্রিকায়।]

ইস্পাত গোলকটার সামনে দাঁড়িয়ে পাইন কুচি চেবাতে চেবাতে লেফটেন্যান্ট বললে, দেখে কি মনে হয়, স্টিভেন্স?।

আইডিয়াটা ভালোই, ভোলা মনেই জবাব দিয়েছিল স্টিভেন্স।

চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে যাবে কিন্তু।

জলের চাপ তো সাংঘাতিক। জলের উপরিভাগে এই চাপ প্রতি বর্গইঞ্চিতে চোদ্দো পাউন্ড, ত্রিশ ফুট নিচে তার দ্বিগুণ, ষাট ফুট নিচে তিনগুণ, নলুই ফুট নিচে চারগুণ, নশো ফুট নিচে চল্লিশগুণ, পাঁচ হাজার ফুট নিচে তিনশোগুণ–প্রায় মাইলখানেক–চোদ্দো পাউন্ডের দুশো চল্লিশগুণ–প্রায় দেড় টন। প্রতি বর্গইঞ্চিতে দেড় টন। সমুদ্র যেখানে পাঁচ মাইল গভীর, সেখানে সাড়ে সাত টন–

ইস্পাতের চাদরও তো দারুণ মোটা।

নিরুত্তর রইল লেফটেন্যান্ট।

আলোচনা হচ্ছে স্টিলের একটা অতিকায় বল নিয়ে। ব্যাস প্রায় নফুট। দেখতে অনেকটা দানবিক কামানের গোলার মতো। জাহাজের ওপর বিরাট ভার আর মঞ্চ তৈরি করে বলটা রাখা হয়েছে তার ওপর। এইখান থেকেই নামিয়ে দেওয়া হবে সমুদ্রের জলে। বলের গায়ে দুটো গোলাকার জানলা। একটার ওপর আর-একটা। দারুণ পুরু কাচ দিয়ে ঢাকা। স্টিলের ফ্রেম। একটা জানলা খোলা রয়েছে। লেফটেন্যান্ট এবং স্টিভেন্স সাত সকালেই গোলকের ভেতর দেখে এসেছে। পুরু কুশন দিয়ে মোড়া। কুশনের ফাঁকে ফাঁকে হাতল–সাদাসিধে যন্ত্রপাতি চালু রাখার ব্যবস্থা। ভেতরে ঢুকে জানলা বন্ধ করে দেওয়ার পর শ্বাস-প্রশ্বাসের কার্বনিক অ্যাসিড শুষে নিয়ে তার বদলে অক্সিজেন ছেড়ে দেওয়ার মায়ার্স যন্ত্রটাও গদি দিয়ে সুরক্ষিত। পুরো ভেতরটা এমনভাবে গদি দিয়ে মোড়া যে কামান থেকে গোলার মতো ছুঁড়ে দিলেও ভেতরে যে বসবে, তার গায়ে আঁচড়টি লাগবে না। একটু পরেই কাচের ম্যানহোল দিয়ে সত্যিই এক ব্যক্তির প্রবেশ ঘটবে ভেতরে, গোলক। নিক্ষিপ্ত হবে জলে তলিয়ে যাবে অনেক নিচে–মাইল পাঁচেক তো বটেই।

তারপর? কাচ বেঁকে ভেতরে ঢুকে যাবে–জানলার দফারফা হয়ে যাবে। সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করলে লেফটেন্যান্ট। তখন হুড়হুড় করে জল ঢুকবে ভেতরে। লোহার ফলা ঢুকিয়ে দেওয়ার মতোই জলের খোঁচায় প্রাণটা উধাও হবে চক্ষের নিমেষে। বুলেট বলাও যায়। জলের বুলেট। চিঁড়েচ্যাপটা তো হবেই ভেতরের মানুষ, সেই সঙ্গে পুঁটি দুটুকরো হবে, ফুসফুস ফাটিয়ে দেবে, কানের পরদা—

গোলকের অবস্থাটা? জানতে চেয়েছিল স্টিভেন্স।

বেশ কিছু বুদবুদ ছেড়ে চিরকালের মতো তলিয়ে যাবে কাদার ওপর। রুটিতে মাখন মাখানোর মতো ব্যাপার আর কী।

উপমাটা মনে ধরল লেফটেন্যান্টের নিজেরই। নিজের মনেই বারকয়েক আওড়ে গেল একই কথা।

এলসটিড কথাটা শুনল পেছনে দাঁড়িয়ে। সমুদ্রতলের ভাবী অ্যাডভেঞ্চারার এলসটিড। পরনে ধবধবে সাদা পোশাক। দাঁতের ফাঁকে সিগারেট। টুপির কিনারার নিচে কৌতুক তরলিত দুই চক্ষু।

কী হে ওয়েব্রিজ? লোকজন বেশি মাইনে চাইছে নাকি? রুটিতে মাখন মাখানো নিয়ে। খুব ফাঁপরে পড়েছ দেখছি। আরে বাবা, আজ বাদে কালই তো ডুব মারল জলে। চমৎকার আবহাওয়া। সিসে আর লোহা নিয়ে বারো টন তলিয়ে যাবে টুপ করে। এত ঝামেলা কীসের?

ভাবছি, তোমার অবস্থাটা তখন কী হবে, বললে ওয়েব্রিজ।

দূর! জলের ওপর ঢেউ যতই উঁচুতে উঠুক-না কেন, বারো সেকেন্ডের মধ্যে তলিয়ে যাব সত্তর-আশি ফুট নিচে। সেখানে শান্তি… শুধুই শান্তি!

ঘড়ি-যন্ত্র ঠিকমতো চলবে তো?

পঁয়ত্রিশবার চালিয়ে পরখ করে নিয়েছি।

যদি না চলে?

কেন চলবে না?

বিশ হাজার পাউন্ড দিলেও ওই নচ্ছার গোলার মধ্যে ঢুকব না আমি।

কিন্তু আমি ঢুকব। ভেতরে ঢুকে ক্রু টাইট দিয়ে জানলাটা আগে বন্ধ করব। তারপর ইলেকট্রিক লাইটটা তিনবার জ্বালব, তিনবার নেবাব। বুঝিয়ে দেব, বহাল তবিয়তে আছি। তখন কপিকলে টুপ করে নামিয়ে দেবে গোলা। বলের তলায় সিসের ওজনগুলো যেভাবে ঝুলছে, ঝুলবে ঠিক ওইভাবেই। গোলার ওপরে ওই যে সিসের কাটিমটা রয়েছে, ওতে জড়ানো আছে একশো ফ্যাদম লম্বা দড়ি। তারের দড়ি লাগাইনি ইচ্ছে করেই-কাটতে সুবিধে, ভাসেও ভালো। তারের দড়ি হলে তো ডুবে যাবে। বিষয়টা গুরত্বপূর্ণ। যথাসময়ে বুঝবে।

কিন্তু

প্রত্যেকটা সিসের ওজনের মধ্যে একটা ফুটো রয়েছে দেখছ? একটা করে লোহার রড ঢুকিয়ে দেওয়া হবে ফুটোগুলের মধ্যে দিয়ে। ছফুট নিচে নেমে থাকবে প্রত্যেকটা রড। নিচ থেকে রডে ধাক্কা লাগালেই ধাক্কা লাগবে একটা হাতলে–চালু হয়ে যাবে ঘড়ি-যন্ত্র।

কপিকলে ঝুলিয়ে সবসুদ্ধ জলে নামিয়ে ঝোলানোর দড়ি কেটে দিলেই গোলা ভাসবে জলে। বাতাস ভরতি গোলা। হালকা। সিসের ওজনগুলো তলিয়ে যাবে নিজেদের ওজনেই –কাটিম থেকে দড়িও খুলে যাবে। বেশ খানিক দড়ি খুলে যাওয়ার পর গোলাও তলিয়ে যাবে–দড়ির টানে।

দড়ির টানে কেন? সিসের ওজনগুলো সরাসরি গোলার গায়ে লাগাওনি কেন? স্টিভেন্সের প্রশ্ন।

নিচের ধাক্কা এড়ানোর জন্যে। কিছুক্ষণ পরেই হু হু করে মাইলের পর মাইল নেমে যাবে গোলা। দড়ি না থাকলে আছড়ে পড়ে থেঁতলে যাবে। দড়ির তলায় ঝোলানো সিসের ওজনগুলো আগে ঠেকবে তলায়, কমে আসবে গোলার তলিয়ে যাওয়ার গতিবেগ, আস্তে আস্তে গিয়ে ঠেকবে তলায়, তারপর ভেসে উঠতে থাকবে আস্তে আস্তে।

ঘড়ি-যন্ত্র চালু হবে ঠিক তখন। লোহার ডান্ডাগুলো সমুদ্রের তলায় ধাক্কা দিয়ে ঘড়ি-যন্ত্র চালু করে দিলেই কাটিমে গুটিয়ে যাবে দড়ি। আধ ঘণ্টা থাকব সাগরতলে। ইলেকট্রিক লাইট জ্বেলে দেখব চারপাশ। তারপরেই ঘড়ি-যন্ত্র খুলে দেবে একটা স্প্রিং-এর ছুরি। কেটে দেবে দড়ি। সোডা ওয়াটার বুদবুদের মতো হু হু করে গোলা ভেসে উঠবে ওপরে, দড়িটাই সাহায্য করবে ভেসে উঠতে।

নিচ থেকে অত জোরে উঠে এসে গোলা যদি ঢু মারে কোনও জাহাজের তলায়?

বেশ ফাঁকা জায়গায় কামানের গোলার মতো নামব, উঠব আধ ঘণ্টা পরে। কাজেই দুশ্চিন্তা কীসের?

যদি কোনও সামুদ্রিক জীব ঘড়ি-যন্ত্রে শুড় জড়িয়ে ধরে?

সানন্দে দাঁড়িয়ে যাব।

বলে, মুগ্ধ চোখে ইস্পাতের গোলকের দিকে চেয়ে রইল এসটিড।

.

এগারোটা নাগাদ এসটিডকে নামিয়ে দেওয়া হল কপিকলে করে। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। বাতাস মৃদুমন্দ৷ দিগন্তে কুয়াশা। ওপরের কামরার ইলেকট্রিক আলো জ্বলল তিনবার, নিবল তিনবার। সামান্য দুলছে গোলা। কাচের জানলা দুটো একজোড়া গোল গোল চোখ মেলে যেন অবাক হয়ে দেখছে ডেকের লোকজনদের। ডেকের ওপর গোলাটাকে মনে হয়েছিল না জানি কী বিরাট, জলে নামিয়ে দেওয়ার পর ধু ধু সমুদ্রের মধ্যে মনে হল নিতান্তই পুঁচকে।

দড়ি কেটে দিতেই একটা ঢেউ চলে গেল গোলার ওপর দিয়ে, দুলছে গোলা, ভীষণভাবে ওলট-পালট খাচ্ছে। দশ পর্যন্ত গুনতেই হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে সিধে হয়ে গেল কিম্ভুত গোলক।

ক্ষণেকের জন্যে ভেসে থেকেই আস্তে আস্তে গেল তলিয়ে। তিন পর্যন্ত গোনবার আগেই অদৃশ্য হল দৃষ্টিপথ থেকে। অনেক নিচে দেখা গেল আলোর দ্যুতি–আস্তে আস্তে আলোককণিকায় পর্যবসিত হয়ে মিলিয়ে গেল একেবারেই। অন্ধকার জলে ঘুরপাক খেয়ে গেল কেবল একটা হাঙর।

মাইলখানেক তফাতে সরে এল জাহাজ। ভেসে ওঠার সময়ে ইস্পাতের গোলা তলায় যাতে টু না মারে।

নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসে নিঃশব্দে কাটল আধ ঘণ্টা। মাথার ওপর ডিসেম্বরের সূর্য বেশ গরম।

ওয়েব্রিজ কিন্তু বলেছিল, জলের তলায় নাকি এত ঠান্ডা যে, এসটিড নিশ্চয় এতক্ষণে হি হি করে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।

পঁয়ত্রিশ মিনিট পরেও গোলা ভেসে উঠল না। শুরু হল উৎকণ্ঠা। সূর্য ডুবে যাওয়ার একুশ মিনিট পরেও গোলার পুনরাবির্ভাব না দেখে শুরু হল জল্পনা-কল্পনা। মাঝরাতে আরম্ভ হল দুর্ভাবনা। পাঁচ মাইল নিচে কাদার মধ্যে দড়িদড়া সমেত গোলা আটকে গিয়েছে নিশ্চয়। মায়ার্স যন্ত্র আর কাজ করছে না। অক্সিজেন নেই, খাবার নেই, জল নেই। এসটিড কি আর বেঁচে আছে?

গোলক যেখানে ডুব দিয়েছে, সেই জায়গা ঘিরে গোল হয়ে ঘুরতে লাগল গানবোট। আচমকা বহু দূরে একটা আলোর রেখা জল থেকে ঠিকরে উঠে গেল আকাশ অভিমুখে–শূন্যে আলোকবৃত্ত রচনা করে গিয়ে পড়ল জলে।

এলসটিড!

ভোর হয়ে গেল–তবে নাগাল ধরা গেল গোলকের। কপিকল থেকে আংটা ঝুলিয়ে গোলকের মাথায় লাগিয়ে টেনে তুলে আনা হল ডেকে। ম্যানহোল খুলে উঁকি দিল লেফটেন্যান্ট। কালির মতো অন্ধকার। ইলেকট্রিক লাইট লাগানো হয়েছিল শুধু গোলকের চারপাশ আলোকিত করার জন্যে–ভেতরটা নয়।

ভীষণ উত্তাপ ভেতরে। ম্যানহোলের কিনারা বরাবর রবারের পটি নরম হয়ে গেছে উত্তাপে। নড়াচড়া নেই, উৎকণ্ঠিত প্রশ্নের জবাবও নেই। জাহাজের আলো ফেলে দেখা গেল, মড়ার মতো পড়ে এসটিড। মুখ হলুদবর্ণ, ঘামে চকচকে। ডাক্তার এল। তুলে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল কেবিনে।

না, মরেনি, কিন্তু স্নায়ুর অবস্থা কাহিল। সারা গা থেঁতলে কালশিটে পড়ে গেছে। দিনকয়েক পড়ে রইল নিস্পন্দ দেহে। মুখে কথা ফুটল সাত দিন পরে। শোনা গেল অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতার অবিশ্বাস্য কাহিনি।

প্রথম কথাটাতেই প্রকাশ পেল অদ্ভুত জেদ। আবার যাবে ও সমুদ্রের তলায়। গোলকটাকে একটু পালটে নিতে হবে। দড়ি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। অসংলগ্নভাবে বলেছিল, সমুদ্রের তলায় কাদা ছাড়া আর কিছু দেখা যাবে না যারা বলেছিল–চোখ তাদের ঠিকরে যাবে সেখানকার দৃশ্য দেখলে। চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এলসটিড–দেখে এসেছে আশ্চর্য এক জগৎ!

খাপছাড়া কথাগুলো গুছিয়ে লেখা হল নিচে।

প্রথমে গোলকটা ভীষণভাবে ওলট-পালট খেয়েছিল ঠিকই। পা ওপরে চলে গিয়েছিল। মাথা নিচের দিকে করে কুশনে আছড়ে পড়েছিল। জানলার মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছিল আকাশ আর জাহাজের ডেকে দাঁড়ানো লোকজনকে।

আচমকা সিধে হয়ে গিয়েছিল গোলক। শুরু হয়েছিল তলিয়ে যাওয়া। সবুজ-নীলাভ মনে হয়েছিল চারপাশের জল। একটু একটু আলো আসছিল ওপর থেকে। ছোট ছোট ভাসমান বস্তু ঝাঁকে ঝাঁকে ধেয়ে যাচ্ছিল ওপরের আলোর দিকে। অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছিল। মাথার ওপর যেন মধ্যরাতের কালো আকাশ–সামান্য সবুজাভ। নিচের জল কালির মতো কালো। খুদে খুদে আলোকময় স্বচ্ছ বস্তু আবছা সবজে রেখা রচনা করে ধেয়ে যাচ্ছিল ওপরদিকে।

পতনের বেগ নাকি মনে রাখবার মতো। ঠিক যেন লিফট নামছে হু হু করে। এবার একটু ভয় হয়েছিল এলসটিডের। অক্টোপাস, তিমি বা ওই জাতীয় কিছুর খপ্পরে পড়লেই তো দফারফা। ঘড়ি-যন্ত্র যদি আর চালু না থাকে?

পঞ্চাশ সেকেন্ড পর মিশমিশে অন্ধকারে প্রখর ইলেকট্রিক আলোয় কেবল দেখা গেল, মাছ বা ভাসমান বস্তু ধেয়ে যাচ্ছে আশপাশ দিয়ে ওপরদিকে–এত জোরে যাচ্ছে যে ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না। একবার মনে হল, একটা হাঙর ধড়ফড় করতে করতে ছিটকে গেল পাশ দিয়ে। জলের ঘর্ষণে গোলক তখন গরম উঠছে। অতএব সমুদ্রের গভীরে নাকি কনকনে ঠান্ডা–এ ধারণাটা একেবারেই ভুল।

ঘামে সারা গা সপসপে হয়ে গেছে লক্ষ করে খটকা লেগেছিল এসটিডের। পরক্ষণেই কানে ভেসে এসেছিল সোঁ সোঁ শব্দ। শব্দটা আসছে পায়ের তলা থেকে। বেড়েই চলেছে। চোখে পড়েছিল বিস্তর বুদবুদ। সাঁ সাঁ করে ধেয়ে যাচ্ছে ওপরদিকে। যেন পাখা ঘুরছে। বাইরে জলের মধ্যে। বাষ্প নাকি? নিশ্চয় তা-ই! হাত দিয়েছিল জানলায়। কাচ গরম। জ্বালিয়ে নিয়েছিল ছোট্ট লণ্ঠনটা। হাতলের ডগায় গদি দিয়ে মোড়া ঘড়িতে দেখেছিল, মোটে দুমিনিট হয়েছে। এরই মধ্যে জলের ঘর্ষণে এত উত্তাপ? কাচ তো ফেটে যাবে এবার। নিচে ঠান্ডা, গোলকের গা গরম–তাপের তারতম্য কাচ তো সইতে পারবে না।

আচমকা কমে এসেছিল তলিয়ে যাওয়ার গতিবেগ। সেই সঙ্গে কমে এসেছিল ওপরদিকে ধাবমান বুদবুদের সংখ্যা। পায়ের তলায় মেঝে অনুভব করেছিল শক্তভাবে। কমে এসেছিল সোঁ সোঁ শব্দ। সামান্য দুলে উঠেই স্থির হয়ে গিয়েছিল গোলক। না, কাচ ভাঙেনি। অঘটন কিছুই ঘটেনি। নির্বিঘ্নে তলদেশ স্পর্শ করতে চলেছে গোলক। খুব জোর আর মিনিটখানেক।

মনে পড়েছিল স্টিভেন্স আর ওয়েব্রিজের কথা। রয়েছে পাঁচ মাইল ওপরে। অত উঁচুতে মেঘও থাকে না।

উঁকি মেরেছিল জানলা দিয়ে। বুদবুদ আর দেখা যাচ্ছে না। সোঁ সোঁ শব্দও একেবারে থেমে গেছে। বাইরে মসিকৃষ্ণ অন্ধকার। নরম ভেলভেটের মতো। ইলেকট্রিক আলো যেখানে যেখানে পড়ছে, শুধু সেই জায়গাগুলোতেই দেখা যাচ্ছে জলের রং হলদেটে-সবুজ। তারপরেই আলোক বলয়ের মধ্যে ভেসে উঠল তিনটে বস্তু। অগ্নিময় আকৃতির মতো। ওর বেশি আর কিছু দেখা যায়নি। বস্তু তিনটে ছোট না বড়, কাছে না দূরে–বোঝা যায়নি।

মাছ ধরার জাহাজে যেমন জোরালো আলো থাকে, প্রায় সেইরকম নীলাভ আলোর রেখা দিয়ে ঘেরা তিনটে আকৃতিই। প্রচুর ধোঁয়া বেরচ্ছে যেন সেই আলো থেকে। জাহাজের দুপাশে যেমন সারি সারি পোর্টহোল থাকে, সেইরকম সারবন্দি ফুটো রয়েছে প্রত্যেকের দুপাশে। এলসটিডের প্রখর আলোকবৃত্ত এসে পড়তেই যেন নিবে গিয়েছিল তাদের আলোকপ্রভা।

দেখতে তাদের অদ্ভুত মাছের মতো। বিরাট মাথা। প্রকাণ্ড চোখ। কিলবিলে দেহ আর লেজ। চোখ ফেরানো রয়েছে এসটিডের দিকেই। যেন তাকেই অনুসরণ করছে। আলো দেখে আকৃষ্ট হয়েছে নিশ্চয়।

অচিরেই এই ধরনের আরও সামুদ্রিক প্রাণী ভিড় করে এল চারদিক থেকে। গোলক তখনও নামছে নিচের দিকে। ঘোলাটে হয়ে উঠছে জলের রং। আলোকরশ্মির মধ্যে চিকমিক করছে খুদে খুদে কণা–সূর্যরশ্মির মধ্যে ধূলিকণার মতো। সিসের ওজন কাদা ঘুলিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়।

সিসের ওজন আস্তে আস্তে গোলক টেনে নামিয়েছিল কাদার ওপর। চারপাশে ঘন সাদা কুয়াশা। কয়েক গজের বেশি এগচ্ছে না বিদ্যুৎ বাতির আলো। বেশ কয়েক মিনিট পর থিতিয়ে গিয়েছিল ঘুলিয়ে-যাওয়া তলানি। বিদ্যুৎ বাতির আর দূরের স্বচ্ছ প্রভাময় মাছের ঝাঁকের আলোয় দেখা গিয়েছিল ধূসর-সাদাটে তলানির ওপর দুলে দুলে সরে যাচ্ছে ঘন কালো সীমাহীন জলরাশি। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে সামুদ্রিক লিলি ফুলের জটলা। ক্ষুধিত শুড় নাড়ছে শূন্যে।

দূরে দেখা যাচ্ছে দানবিক স্পঞ্জের জটলা। অর্ধস্বচ্ছ বহিঃরেখাই কেবল চোখে পড়ছে। মেঝেময় ছড়িয়ে গাঢ় বেগুনি আর কালো রঙের গুচ্ছ গুচ্ছ চকচকে চ্যাটালো বিস্তর বস্তু। নিশ্চয় কাঁটাওয়ালা সামুদ্রিক প্রাণী। এ ছাড়াও দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট বিশালচক্ষু অথবা চক্ষুহীন অদ্ভুত আকারের জিনিস। কাউকে দেখতে কেঠোপোকার মতো, কাউকে গলদাচিংড়ির মতো। আলোকরশ্মির সামনে দিয়ে চলেছে মন্থরগতিতে–অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে–পেছনে রেখে যাচ্ছে ফুটকি ফুটকি রেখা।

আচমকা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল খুদে মাছের ঝাঁক–গোলকের দিকে ধেয়ে এসেছিল হরবোলা পাখির ঝাঁকের মতো। প্রভাময় তুষারের মতো উড়ে গিয়েছিল গোলকের ওপর দিয়ে। পলাতকদের পেছনে দেখা গিয়েছিল আরও বড় প্রাণী। সংখ্যায় অনেক। আসছে গোলকের দিকেই।

প্রথমে দেখা গিয়েছিল অস্পষ্ট দেহরেখা। চলমান আকৃতি। ঠিক যেন মানুষের মূর্তি। তারপরেই আলোকরশ্মির আওতায় এসে গিয়েছিল চলমান বিস্ময়রা। হতভম্ব হয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল এলসটিড। পরক্ষণেই চোখ খুলে চেয়েছিল ফ্যালফ্যাল করে। মেরুদণ্ডী প্রাণী নিঃসন্দেহে। অতিশয় বিদঘুটে। গাঢ় বেগুনি রঙের মাথার সঙ্গে বহুরূপী গিরগিটির মাথার কোথায় যেন একটা সাদৃশ্য আছে। কিন্তু অত উঁচু কপাল আর বিরাট করোটি আজ পর্যন্ত কোনও সরীসৃপের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। মুখের খাড়াই দিকটার সঙ্গে অস্বাভাবিক মিল রয়েছে মানুষের মুখের।

বহুরূপী গিরগিটির চোখের মতোই দুটো বিরাট চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে কোটর থেকে। রয়েছে ডাঁটির ডগায়। মুখবিবর সরীসৃপ-মুখবিবরের মতো চওড়া। ছোট্ট নাসিকাগহ্বরের নিচে আঁশযুক্ত ঠোঁট। কানের জায়গায় দুটো বিরাট কানকো-ঢাকনি। ঢাকনি থেকে বেরিয়ে রয়েছে সরু সরু সুতোর মতো প্রবালময় তন্তু। গাছের মতো কানকো বললেও চলে। খুব বাচ্চা রে মাছ আর হাঙর মাছেদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। শুধু মুখখানাই মানুষের মতো বলেই যে এদের মানুষের মতো আকৃতি, তা নয়। এর চাইতেও বড় মিল রয়েছে অন্যান্য প্রত্যঙ্গে। অসাধারণ মিল। অত্যন্ত অসাধারণ। প্রতিটি প্রাণীই দুপেয়ে। খাড়া রয়েছে অবশ্য তিনটে প্রত্যঙ্গের ওপর। একটা লেজ আর দুখানা পায়ের ওপর ঠিক যেন পেটমোটা ব্যাঙের পা। এদের দেহও প্রায় গোলাকার। ব্যাঙের সামনের দুটি প্রত্যঙ্গের মতোই দুখানা প্রত্যঙ্গও রয়েছে সামনে। বিদঘুটে গড়ন। মানুষের অতি বিতিকিচ্ছিরি হাত যেন। দুহাতে ধরে রয়েছে একটা লম্বা হাড়। হাড়ের ডগায় তামার ফলা। গায়ের রং এক-এক জায়গায় এক-একরকম। মাথা, হাত আর পা বেগুনি রঙের। চামড়া আলোকময় ধূসর রঙের। জামাকাপড়ের মতোই ঢিলেভাবে চামড়া ঝুলে রয়েছে সারা গায়ে। প্রখর আলোয় ধাঁধিয়ে যাওয়ায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে গোলকের সামনে।

হঠাৎ জোরালো আলোয় ড্যাবডেবে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল বটে, খুলেছিল পরক্ষণেই। ঘন ঘন চোখের পাতা ফেলে আলো সইয়ে নিয়েছিল এক হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে। তারপরেই মুখ হাঁ করে বিকট চিৎকার। নিছক আওয়াজ নয়–চিৎকারই বলা উচিত। যেভাবে কথা উচ্চারণ করা হয় মুখ নেড়ে–ঠিক সেইভাবে। স্টিলের আবরণ ভেদ করে চিৎকার পৌঁছেছিল গদি গোলকের ভেতরে। ফুসফুস ছাড়া চেঁচানি সম্ভব হয় কী করে, এলসটিডের মাথায় তা ঢোকেনি। চেঁচিয়ে উঠেই আলোকরশ্মির দুপাশের অন্ধকারে সরে গিয়েছিল কিম্ভুতকিমাকার মূর্তিবাহিনী। চোখ দিয়ে দেখতে না পেলেও এলসটিডের মনে হয়েছে, নিশার দুঃস্বপ্নরা এগিয়ে আসছে গোলকের দিকেই। আলো নিবিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছিল এসটিড। আলো দেখে যদি ছুটে এসে থাকে, অন্ধকারে সরে পড়বে নিশ্চয়। কিন্তু তা হয়নি, আলো নিবে যেতেই আচমকা নরমমতো ধাক্কা লেগেছিল গোলকে। দুলে উঠেছিল গোলক।

আবার শোনা গিয়েছিল বিষম চিৎকার। প্রতিধ্বনি ভেসে এসেছিল যেন অনেক দূর থেকে। প্রতিধ্বনি না বলে তাকে প্রত্যুত্তরই বলা যায়–অন্তত এসটিডের মনে হয়েছিল। তা-ই। আবার থপথপ করে ধাক্কা পড়েছিল গোলকে। দুলে উঠে গোলক, ঘষটে গিয়েছিল তলায় তার জড়ানো কাটিমের ওপর দিয়ে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে এসটিড চেয়ে ছিল চিরন্তন রাত্রির দিকে। ধু ধু বিস্তৃত অন্ধকারের মধ্যে বহু দূরে দেখেছিল খুব আবছা কয়েকটা দ্যুতিময় অর্ধনর আকৃতি। দ্রুতচরণে আসছে তার দিকেই।

বাইরের জোরালো আলো জ্বালানোর জন্যে তাড়াতাড়ি যেতে গিয়ে এসটিড হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল ভেতরকার লণ্ঠনের সুইচের ওপর। আছড়ে পড়েছিল গদি-মোড়া মেঝের ওপর। দুলে উঠেছিল গোলক। জ্বলে উঠেছিল আলো। কানে ভেসে এসেছিল বিস্ময়ধ্বনি। অপার্থিব সেই চিৎকার। যেন অবাক হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়েই দেখেছিল, নিচের জানলায় চেপে বসেছে দুজোড়া ডাঁটি-চোখ। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে তার দিকে।

পরক্ষণেই বহু হাতের ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গিয়েছিল গোলকের ওপর। প্রচণ্ড ধাক্কায় সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও পারেনি এলসটিড। ভয়ে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল দমদম আওয়াজ শুনে। যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছে বাইরের ঘড়ি-যন্ত্রের ওপর!

সর্বনাশ! ঘড়ি-যন্ত্র বিগড়ালে সলিলসমাধি যে অনিবার্য! আচম্বিতে ভীষণভাবে দুলে উঠেছিল গোলক। পা যেন চেপে বসেছিল মেঝেতে। তাড়াতাড়ি ভেতরের লণ্ঠন নিবিয়ে দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল বাইরের জোরালো আলো। সমুদ্রতল খাঁ খাঁ করছে। অজানা প্রাণীরা উধাও হয়েছে। দুটো মাছ পরস্পরকে ধাওয়া করতে করতে তলিয়ে গেল জানলার তলায়।

গভীর সমুদ্রের বিচিত্র বাসিন্দারা কি তাহলে দড়ি ছিঁড়ে দিয়েছে? গোলক তাই সবেগে ভেসে উঠছে? মুক্তি তাহলে আর বেশি দূরে নেই।

বাড়ছে… ওপরদিকে ধেয়ে যাওয়ার গতিবেগ বেড়েই চলেছে। আচমকা ঝাঁকুনি খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল গোলক। এসটিড ছিটকে গিয়ে ছাদের গদিতে মাথা ঠুকে ঠিকরে পড়ল মেঝেতে। আধ মিনিটের মতো চিন্তা করার ক্ষমতা ছিল না। শুধু বিস্ময়বোধ। অপরিমেয়।

তারপরেই আস্তে আস্তে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছিল গোলক। সেই সঙ্গে অল্প অল্প ঝাঁকুনি। মনে হয়েছিল যেন জলের মধ্যে দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইস্পাত বর্তুলকে। হামাগুড়ি দিয়ে জানলার দিকে গিয়েছিল এলসটিড। নিজের দেহের ওজন চাপিয়ে বর্তুলকে কাত করিয়ে নিয়েছিল সেইদিকে, যাতে জানলা দিয়ে দেখা যায় তলার দৃশ্য। কিন্তু নিঃসীম অন্ধকারে প্রখর আলোর ফিকে হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। আলো নিবিয়ে দিলে নিশ্চয় অন্ধকারে চোখ সয়ে যাবে–এই ভরসায় আলো নিবিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর অর্ধস্বচ্ছ হয়ে এসেছিল মখমল কোমল তমিস্রা। গোধূলি-আলোকের মতো ক্ষীণ আভা দেখা গিয়েছিল বহু দূরে। সেই সঙ্গে চলমান আকৃতি। একাধিক। দড়ি কেটে দিয়ে নিশ্চয় বিদঘুটে প্রাণীরা গোলক টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলেছে সাগরের তলা দিয়ে।

তারপরেই জলতল-প্রান্তরের ওপর দিয়ে বহু দূরে আবছামতো চোখে পড়েছিল ক্ষীণ প্রভাময় প্রশস্ত দিগন্ত। খুদে জানলা দিয়ে ডাইনে-বাঁয়ে চোখ চালিয়েও সুদীর্ঘ সেই দিগন্তের শেষ দেখতে পায়নি এসটিড। গোলক টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এইদিকেই। খোলা মাঠের ওপর দিয়ে শহরের দিকে বেলুন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেন। এগচ্ছে কিন্তু অত্যন্ত ধীরগতিতে। একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ম্যাড়মেড়ে আলোকপ্রভা। কাছাকাছি জড়ো হয়ে, জমাট বেঁধে, যেন নির্দিষ্ট আকার নিচ্ছে।

পাঁচটা নাগাদ গোলক এসে পৌঁছেছিল আলোকময় সেই অঞ্চলে। দূর থেকে মনে হয়েছিল যেন বিস্তর পথঘাট বাড়ি ঘিঞ্জি অবস্থায় দেখা যাচ্ছে প্রকাণ্ড ছাদহীন একটা মঠের চারদিকে। মঠের মতোই মনে হয়েছিল এলসটিডের। উদ্ভট মঠ। ছাদ নেই। ভেঙে ধসে পড়েছে। পুরো দৃশ্যটা বিরাট মানচিত্রের মতো এলিয়ে রয়েছে পায়ের তলায়। বাড়িগুলো শুধু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ছাদের বালাই নেই। পরে দেখেছিল, ভেতরে প্রভাময় হাড়ের স্তূপ। দূর থেকে মনে হয়েছিল যেন ডুবো জ্যোৎস্না দিয়ে নির্মিত প্রতিটি বাড়ি।

ঘিঞ্জি অঞ্চলের ভেতরে গুহার মতো সুড়ঙ্গ থেকে দুলছে সামুদ্রিক উদ্ভিদের শুড়। দীর্ঘ, হিলহিলে, স্ফটিকসদৃশ স্পঞ্জ ঠেলে উঠেছে চকচকে খুদে মিনারের মতো। গোটা শহর জুড়ে ছড়িয়ে-থাকা চাপা আভায় চিকমিক করছে মিহি লিলি ফুলের স্তবক। খোলা প্রাঙ্গণে সঞ্চরমাণ যেন বিপুল জনতা। বহু ফ্যাদম নিচে থাকায় আলাদা করে কাউকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।

আস্তে আস্তে গোলককে টেনে নামিয়েছিল অদ্ভুত প্রাণীরা। স্পষ্টতর হয়ে উঠেছল খুঁটিনাটি দৃশ্য। একটু একটু করে ভয় জাঁকিয়ে বসেছিল শিরায়-উপশিরায়। মেঘের মতো বাড়িগুলো যেন গোলাকার বস্তুর মতো পুঁতির লাইন দিয়ে চিহ্নিত করা রয়েছে। বেশ কিছু খোলা জায়গায় জাহাজের মতো বিস্তর আকৃতি জড়ো করা রয়েছে।

ধীরগতিতে টেনে নামানো হচ্ছিল গোলককে। নিচের আকৃতিগুলো আরও স্পষ্ট, আরও পরিষ্কার, আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। গোলক নামানো হচ্ছিল শহরের কেন্দ্রে একটা পেল্লায় ইমারতের দিকে। দড়ি ধরে টানছে অসংখ্য প্রাণী–স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের। একটা জাহাজের কিনারায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে গোলক দেখাচ্ছে অগণিত প্রাণী। তারপরেই বিশাল ইমারতের দেওয়াল আস্তে আস্তে উঠে এল চারপাশে-শহর আর দেখা গেল না।

এলসটিড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল দেওয়ালের চেহারা। ডোবা কাঠ, দোমড়ানো তারের দড়ি, লোহার কড়িবরগা, তামার পাত, মানুষের হাড় আর করোটি। আঁকাবাঁকা লাইনে পড়ে রয়েছে করোটি। করোটির বৃত্ত। অত্যাশ্চর্যভাবে বাঁকা করোটির রেখা। অক্ষিকোটরে ঢুকছে আর বেরচ্ছে অগণিত ছোট ছোট রুপোলি মাছ।

আচম্বিতে কানের পরদায় আছড়ে পড়েছিল চাপা গলার চিৎকার। শিঙা বাজানোর মতো প্রচণ্ড আওয়াজ। ফ্যান্টাস্টিক বন্দনাসংগীতে যেন মুখরিত হয়েছিল পুরো অঞ্চল। গোলক তখনও নামছে আস্তে আস্তে। ছুঁচোলো জানলার পাশ দিরে যেতে যেতে এসটিড দেখেছিল, দাঁড়িয়ে আছে কাতারে কাতারে কিম্ভুতকিমাকার ভৌতিক প্রাণী। নির্নিমেষে ডাঁটি-চোখ মেলে চেয়ে আছে তার দিকে। অবশেষে স্থির হয়েছিল গোলক–অবতীর্ণ হয়েছিল ঠিক মাঝখানে একটা বেদির ওপরে।

নিতল বাসিন্দাদের আবার স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছিল এলসটিড। অবাক হয়েছিল সাষ্টাঙ্গে সবাই শুয়ে আছে দেখে। দুপায়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল একজনই। গায়ে যেন আঁশ দিয়ে তৈরি শক্ত পোশাক। মাথায় আলোকময় মুকুট। সরীসৃপসদৃশ মুখ খুলছে আর বন্ধ করছে। পূজারি যেন স্তোত্রপাঠ করে যাচ্ছে–শুনে শুনে বলে যাচ্ছে উপাসনারত ভক্তের দল। চাপা গুমগুম ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে ইমারতের ভেতরে বিরাট জায়গা। অদ্ভুত একটা বাসনা মাথায় এসেছিল এলসটিডের। নিজেকে দেখানোর বাসনা। জ্বালিয়ে দিয়েছিল গোলকের ভেতরকার ছোট্ট লণ্ঠন। সঙ্গে সঙ্গে যদিও অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল বিদঘুটে জীবগুলো। আচমকা ওকে দেখতে পেয়ে প্রবল নির্ঘোষ জেগে ছিল চারদিকে। ভক্তি গদগদ মন্ত্রোচ্চারণ আর নয়–উল্লাসধ্বনি। অন্ধকারে শুধু চেঁচানি শুনে ক্ষান্ত থাকতে পারেনি এলসটিড। ছোট লণ্ঠন নিবিয়ে দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল বাইরের জোরালো আলো। নিজে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল বিহ্বল ভক্তদের দৃষ্টি থেকে–কিন্তু দেখা গিয়েছিল, হাঁটু গেড়ে বসে আবার সমস্বরে স্তোত্রপাঠ শুরু করেছে আজব প্রাণীরা। বিরাম নেই, ছেদ নেই। একটানা তিন ঘণ্টা চলেছিল গোলক-পূজা।

আশ্চর্য শহর আর শহরবাসীদের বর্ণনায় খুঁত রাখেনি এলসটিড। চিররাত্রি বিরাজমান। সেই দেশে। সূর্য বা চাঁদ কখনও দেখেনি। দেখেনি তারার মালা। দেখেনি সবুজ পাদপ অথবা বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাসে অভ্যস্ত সজীব জীব। আগুন কী জিনিস, তারা জানে না। সামুদ্রিক জীব আর উদ্ভিদের ফসফরাস-দ্যুতি ছাড়া অন্য কোনও আলোর সঙ্গে কখনও পরিচয় ঘটেনি।

উদ্ভট গল্প সন্দেহ নেই। কিন্তু অ্যাডামস আর জেনকিন্সের মতো বিজ্ঞানীরা মনে করেন এমন ব্যাপার সম্ভব হলেও হতে পারে। উদ্ভট বলব বরং তাঁদের এই বিশ্বাসকে। তাঁদের মুখেই শুনেছি, নিউ রেড স্যান্ডস্টোন মহাযুগের মহান থেরিওমোরফাঁদের বংশধররা আমাদের মতোই টিকে আছে নিতল সমুদ্রে। জলের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া এমন কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়। ধীশক্তি থাকাটাও উদ্ভট মোটেই নয়। মেরুদণ্ডী শুনেও চমকে ওঠার কোনও কারণ নেই। অতি স্বল্প তাপমাত্রায় নিশ্চয় মানিয়ে নিয়েছে নিজেদের। প্রচণ্ড চাপে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সজীব অথবা নিষ্প্রাণ ভারী বস্তুগুলো ভেসে উঠতে পারে না বলেই তলিয়ে রয়েছে সাগরের গভীরে।

সাগরতলের এই বিচিত্র বাসিন্দাদের মধ্যে আমরা খসে-পড়া উল্কার মতোই মৃত প্রাণী বা বস্তু ছাড়া কিছুই নই। দুর্ঘটনা আর বিপর্যয়ের পর তলিয়ে যায় আমাদের মৃতদেহ অথবা ডোবা জাহাজ। জলময় আকাশের রহস্যময় অন্ধকার ভেদ করে অবতীর্ণ হয় তাদের লোকালয়ে। তাই আমরা অদ্ভুত তাদের কাছেও। নিথর তমিস্রাময় রাতের মধ্যে দিয়ে খসে পড়ে আমাদের যন্ত্রপাতি ধাতু, জাহাজ-বৃষ্টির মতো। ঘাড়ের ওপরেও নিশ্চয় পড়ে থেঁতলে যায়। মাথার ওপরকার মহাশক্তির কাণ্ডকারখানা বলে মেনে নেয়। মাঝে মাঝে এমন জিনিস খসে পড়ে, যা নিতান্তই দুষ্প্রাপ্য অথবা একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। কিম্ভুত আকৃতি দেখে তাজ্জব হয়ে যায়। বর্বর অসভ্যদের দেশে আচমকা মহাশূন্য থেকে চকচকে গোলকের মধ্যে আলোকপ্রদীপ্ত প্রাণীর আবির্ভাব ঘটলে যেমন চাঞ্চল্য এবং ভয়মিশ্রিত উপাসনা দেখা যায়, এদের ক্ষেত্রেও নিশ্চয় তা-ই হয়েছে।

এত ব্যাপার একবারে বলেনি এলসটিড। বলতে পারেনি। বারো ঘণ্টার বিচিত্র অভিজ্ঞতা ছাড়া-ছাড়াভাবে শুনিয়েছিল গানবোটের বিভিন্ন অফিসারকে। খুব ইচ্ছে ছিল, নিজেই লিখবে পুরো কাহিনি। কিন্তু লেখা আর হয়ে ওঠেনি। তাই উদ্যোগী হতে হয়েছে। আমাদেরকেই। কম্যান্ডার সিমন্স, ওয়েব্রিজ, স্টিভেন্স, লিন্ডলে এবং অন্যান্য অনেকের মুখ থেকে টুকরো টুকরো কাহিনি শুনে নিয়ে সাজিয়ে দিলাম পরপর।

টুকরো টুকরো বর্ণনার মধ্যে দিয়েই কিন্তু গা-ছমছমে দৃশ্যটা যেন ভেসে ওঠে চোখের সামনে। বিরাট ভৌতিক ইমারত, হেঁট মাথায় স্তোত্রপাঠে তন্ময় আজব প্রাণী, বহুরূপী গিরগিটির মতো গাঢ় রঙের মাথা, ক্ষীণ প্রভাময় বসন, ফের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে এলসটিডের বৃথাই বোঝানোর চেষ্টা যে, গোলকে বাঁধা দড়িটা এবার কেটে দেওয়া হোক। মিনিটের পর মিনিট কেটেছে অসহ্য উৎকণ্ঠায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভয়ে প্রাণ উড়ে গেছে এলসটিডের, অক্সিজেন ফুরাতে আর মোটে চার ঘণ্টা বাকি। কিন্তু বিরতি নেই ভজনায়। এসটিডের কাছে তা মৃত্যু-সংগীতই মনে হয়েছে।

কী করে যে শেষকালে মুক্তি পেয়েছিল এলসটিড, তা নিজেই বোঝেনি। গোলকের তলায় ঝোলা দড়িটা বেদির কিনারায় ঘষটে কেটে যেতে পারে। আচমকা ভয়ানকভাবে ঘুরপাক খেয়ে বর্তুল সাঁ সাঁ করে ধেয়ে গিয়েছিল ওপরদিকে। বায়ুশূন্য আধারের মধ্যে সুরক্ষিত অবস্থায় ইথিরীয় প্রাণীর ছিটকে যাওয়ার মতো–ভূপৃষ্ঠের ঘন বায়ুমণ্ডল থেকে স্বদেশের ইথিরীয় পরিমণ্ডলে ফিরে যাওয়া যেন। বাতাসের স্তর ভেদ করে তীব্রবেগে হাইড্রোজেনের বুদবুদ যেভাবে ছিটকে যায়, গোলকের সেই ধরনের চকিত ঊর্ধ্বগতি দেখে নিশ্চয় থ হয়ে গিয়েছিল নিতল বাসিন্দারা।

সিসের ওজন নিয়ে যে গতিতে গোলক তলিয়েছিল, ভেসে উঠল তার চেয়ে অনেক বেশি গতিবেগে। ফলে, গরম হয়ে গিয়েছিল সাংঘাতিকভাবে। জানলা দুটো ওপরদিকে করে ছিটকে যাওয়ায় এলসটিড দেখেছিল, ফেনার মতো বুদবুদের প্রপাত আছড়ে পড়ছে কাচের ওপর। প্রতিমুহূর্তে মনে হয়েছে, এই বুঝি কাচ খুলে ঢুকে এল ভেতরে, তারপরেই আচমকা যেন একটা চাকা বনবন করে ঘুরপাক দিয়ে উঠেছিল মাথার মধ্যে, গদি-মোড়া কামরা চরকিপাক দিয়েছিল চারপাশে। জ্ঞান হারিয়েছিল এলসটিড। এরপরেই মনে পড়ে, শুয়ে আছে কেবিনে, কানে ভেসে এসেছে ডাক্তারের গলা।

এলসটিড নিজেই লিখবে বলেছিল অত্যদ্ভুত এই উপাখ্যান যন্ত্রপাতি মেরামত করে নেওয়ার পর।

কিন্তু ১৮৯৬ সালের দোসরা ফেব্রুয়ারি আবার গোলক নিয়ে সমুদ্রতলে পাড়ি জমায় এসটিড, আর ফেরেনি৷ তেরো দিন অপেক্ষা করার পর গানবোট রিওতে ফিরে এসে তারবার্তা পাঠায় বন্ধুবান্ধবদের।

আপাতত এর বেশি আর কিছু জানা যায়নি। গভীর সমুদ্রের তলদেশে এমন একটা শহরের অস্তিত্ব কেউ কোনওদিন কল্পনাও করতে পারেনি। সুতরাং আশ্চর্য এই কাহিনি ছড়িয়ে পড়ার পর নিশ্চয় অন্য কেউ গোলক নিয়ে যাবে শহর দেখতে, এই আশা নিয়েই শেষ করা যাক নিতল নগরীর কাহিনি।

পাইক্র্যাফট প্রহেলিকা

পাইক্র্যাফট প্রহেলিকা ( The Truth About Pyecraft)

[‘The Truth About Pyecraft’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Strand Magazine’ পত্রিকায় এপ্রিল ১৯০৩ সালে। পরে ‘Macmillan and Co.’ থেকে ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘Twelve Stories and a Dream’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। পরবর্তী কালে এটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘Alfred Hitchcocks Ghostly Gallery’ সংকলনটিতে স্থান পায়।]

পাইক্র্যাফট বসত আমার কাছ থেকে প্রায় বারো গজ দূরে। কিন্তু ঠায় চেয়ে থাকত আমার দিকে, দুচোখে অসীম মিনতি নিয়ে। নিছক মিনতি বলব না, তার সঙ্গে মিশে থাকত একটু সন্দেহ।

এত সন্দেহ? কোনও কথাই তো কাউকে বলিনি এদ্দিন। বলবার হলে অনেক আগেই বলতাম। বললেই বা কে বিশ্বাস করছে?

বেচারি পাইক্র্যাফ্ট। যেন একটা জেলির পিপে। লন্ডনের সবচাইতে ধুসকো মোটকা মানুষ!

চুল্লির ধারে বসে কেক গিলছে, গিলছেই। আর আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে আমার দিকে। চোখে সেই নীরব মিনতি, কাউকে বলো না, ভায়া!

বলতাম না, যদি-না ওর চোখের কোণে আমার সতোর ওপর সন্দেহের ছায়াপাত দেখা যেত। পাইক্র্যাফট, এই জন্যেই সব কথা বলব সবাইকে। অনেক সাহায্য করেছি তোমাকে, অথচ তোমার জন্যেই আজ আমার ক্লাব-জীবন অসহ্য হয়ে উঠেছে। তাই তোমার সামনেই এই টেবিলে বসে লিখে যাচ্ছি তোমার গুপ্তকথা।

এত খাওয়াই বা কেন? খাওয়ার কি আর শেষ নেই? গিলেই যাচ্ছ কোঁত কোঁত করে।

যাক গে, এবার অবসান ঘটুক পাইক্র্যাফট প্রহেলিকার!

পাইক্রাটের সঙ্গে প্রথম পরিচয় এই ধূমপানকক্ষেই। একে তো অল্প বয়স, তার ওপর নতুন সদস্য, কাজেই একটু নার্ভাস ছিলাম। পাইক্র্যাফ্ট তা লক্ষ করেই হেলেদুলে ভারী গতরখানা টেনে এনে ধপাস করে বসে পড়েছিল আমার গা ঘেঁষে। হুস-হুঁস কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস ফেলার পর ইয়া মোটা একখানা চুরুট বার করে ধরিয়ে নিয়েছিল দেশলাই জ্বেলে। তারপর কথা শুরু হয়েছিল আমার সঙ্গে। কী কথা তা সঠিক মনে নেই। তবে দেশলাইয়ের কাঠিগুলো যে একেবারেই বাজে, এই জাতীয় কিছু বলেই মনে আছে। পাশ দিয়ে যত ওয়েটার গেছে, তাদের প্রত্যেককে ডেকে বলেছে একই কথা, অতি রদ্দিমার্কা দেশলাই। ঘষতে ঘষতে প্রাণ বেরিয়ে যায়।

খ্যানখেনে সরু গলায় অসভ্য দেশলাই-প্রসঙ্গ দিয়েই পাইক্র্যাট গায়ে পড়ে আলাপ জমিয়েছিল আমার সঙ্গে।

হাবিজাবি অনেক বিষয় নিয়ে ভ্যাড়ভ্যাড় করে বকতে বকতে অবশেষে জ্ঞান দিতে আরম্ভ করেছিল খেলাধুলো সম্বন্ধে। আমার চেহারাটা একটু পাতলা, রোগাই বলা চলে; গায়ের রংটাও কালচে, ঠাকুমার মা হিন্দু বলেই হয়তো, কিন্তু সে জন্যে লজ্জা পাই না মোটেই। কিন্তু আমার গায়ের রং দেখে ধমনির হিন্দু রক্ত সম্বন্ধে কেউ ইঙ্গিত করুক, এটাও চাই না মোটেই। তাই যখন পাইক্র্যাফট ফট করে বলে বসল, নিশ্চয় ক্রিকেট খেলি আমি, কেন-না চেহারাটা বেশ পাতলা, গায়ের রংও কালচে, খাইও নিশ্চয় কম, পাইক্র্যাফটের মতোই (সব মোটা মানুষের মতো ওরও বিশ্বাস, স্রেফ না খেয়েই নাকি মোটা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন), ব্যায়ামও করি কম নাকি ওর মতোই–তখন থেকেই মনটা খিঁচড়ে গিয়েছিল পাইক্র্যাফটের ওপর।

তারপর থেকেই শুরু হয়ে গেল নিজের মোটা হওয়া নিয়ে ধানাইপানাই। মোটা হওয়ার ব্যাপারে কী কী করেছে এবং কী কী করতে চায়। পাঁচজনে কী কী উপদেশ দিয়েছে তার মোটা হওয়ার ব্যাপারে এবং মোটা যারা হয়েছে, তারাই বা কী কী করেছে তাদের মোটা হওয়ার ব্যাপারে, পুষ্টিকর খাবারদাবার বন্ধ করলেই ল্যাটা চুকে যায় না, আসলে দরকার খাদ্যনিয়ন্ত্রণ এবং উপযুক্ত ওষুধপত্র। মাথা ধরে গেল যাচ্ছেতাই মোটা মোটা কথাবার্তায়।

ক্লাব-জীবনে এ ধরনের অত্যাচার এক-আধদিন সওয়া যায়। কিন্তু পাইক্র্যাফট অত্যাচার চালিয়ে গেল দিনের পর দিন। ওর জন্যে ধূমপানকক্ষে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু রেহাই পেলাম না। যেখানেই থাকি-না কেন, ঠিক হেলেদুলে ভারী গতরখানা নিয়ে আমার গা ঘেঁষে বসে পড়ত এবং শুরু হয়ে যেত একই বিষয়ের চবির্তচর্বণ। প্রথম থেকেই একটা জিনিস আঁচ করেছিলাম। ওর বিষম বিপদের সুরাহা নাকি আমার মধ্যে দিয়েই হতে পারে –একমাত্র সুযোগ বাড়িয়ে দিতে পারি কেবল আমিই–এইরকম একটা ধারণা ঘুরঘুর করছে ওর মগজে। গায়ে পড়ে তাই এত আলাপ জমানোর চেষ্টা।

শেষ পর্যন্ত তো একদিন বলেই ফেলল, পশ্চিমি ওষুধপত্রের নাকি কোনও ক্ষমতাই নেই চর্বি কমানোর–শরীর হালকা করার। পারে কেবল প্রাচ্যের মানুষরা। আর সামলাতে পারিনি নিজেকে। তেড়েমেড়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার ঠাকুমার মা যে ভারতবর্ষের মেয়ে, এ খবরটা দিয়েছে কে? প্যাটিসন?

হ্যাঁ, মিনমিন করে বলেছিল পাইক্র্যাফট। ঘুরিয়ে বলেছিল অবিশ্যি। জানি কথাটা মিথ্যে। প্যাটিসন পাঁচন খেয়েছিল নিজের ঝুঁকিতে।

বলেছিলাম ঝাঁজের সঙ্গে, আমার ঠাকুমার মা অনেকরকম পাঁচনের ফর্মুলা দিয়ে গেছে। আমাদের ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাটা বিপজ্জনক ব্যাপার। আনাড়ির হাতে পড়লে আর রক্ষে নেই। পইপই করে বারণ করে গেছে বাবা

পরখ করে দেখেছিলেন বুঝি? যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না, এমনি সুরে। বলেছিল পাইক্র্যাফট।

একবারই করেছিল–একটা পাঁচনের।

এমন কোনও পাঁচন কি নেই, যা খেলে—

বিদঘুটে পুঁথিগুলোয় যা লেখা আছে, তা পড়েই ভয় ধরে যায়। অদ্ভুত, উদ্ভট সব ব্যাপার ঘটতে পারে। খাওয়া তো দূরের কথা–নাকে গন্ধ পেলেও

কিন্তু পাইক্র্যাফটকে আর কি আটকানো যায়? ভেবেছিলাম, ওইটুকু বলেই ওর উৎসাহ নিবিয়ে দেওয়া যাবে। ঘটল ঠিক তার উলটো। উৎসাহটা গেল বেড়ে। জান কয়লা করে ছাড়ল আমার। প্যাটিসন যে পাঁচনটা গিলেছিল, তার মধ্যে ক্ষতিকর কিছু ছিল না। অন্যান্য পাঁচনের ফর্মুলাতেও দোষের কিছু নেই বলেই জানি। কিন্তু পাইক্র্যাটকে অত কথা বলতে যাব কেন? পাঁচন খাওয়ার মধ্যে ঝুঁকি আছে বললেই ঘ্যানর ঘ্যানর করে এক গানই গেয়ে গেছে–ঝুঁকি নিতে সে রাজি আছে।

মোট কথা, অতিষ্ঠ করে ছাড়ল আমাকে পাইক্র্যাট হারামজাদা। বিদঘুটে পাঁচনগুলোর মধ্যে বিষ-টিশ যদি কিছু থাকে…

ভাবতেই চনমন করে উঠেছিল মনটা। মোটকা পাইক্র্যাটকে বিষ-পাঁচন গিলিয়ে দিলে কেমন হয়?

সেই দিনই রাত্রে অদ্ভুতদর্শন অদ্ভুতগন্ধী চন্দন কাঠের বাক্সটা বার করলাম সিন্দুকের ভেতর থেকে। ভেতরকার খসখসে চামড়াগুলো দেখলাম উলটে-পালটে। যে ভদ্রলোক ফর্মুলা লিখে দিয়েছিলেন ঠাকুমার মা-কে, তাঁর বাতিক ছিল নানা ধরনের পশুচর্ম সংগ্রহের। গোটা গোটা অক্ষরে এইসব চামড়ার ওপরেই ঠেসে লিখে গেছেন অজস্র ফর্মুলা। আমাদের ফ্যামিলির অনেকেই ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যুক্ত থাকায় বংশানুক্রমে কাজ চলার মতো হিন্দুস্তানি ভাষায় দখল আছে প্রত্যেকেরই। তা সত্ত্বেও কয়েকটা ফর্মুলা এক্কেবারে পড়তেই পারলাম না এবং কোনওটাই খুব সহজবোধ্য ঠেকল না। এরই মধ্যে একটায় নাক গলাতে পারলাম কোনওমতে এবং সেইটা নিয়েই বসে পড়লাম সিন্দুকের পাশে।

পরের দিন পাইক্র্যাফ্টকে চামড়াখানা দেখাতেই ছিনিয়ে নেয় আর কী–ঝাঁ করে সরিয়ে নিয়েছিলাম নাগালের বাইরে।

বলেছিলাম, দেখ বাপু, অতিকষ্টে পাঠোদ্ধার করেছি–যদূর বুঝেছি, মনে হয়, এই পাঁচন খেলেই তোমার ওজন কমবে। তুমি তো ওজনটাই কমাতে চাও–তা-ই না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে কী উৎসাহ পাইক্র্যাফটের।

আমি বলেছিলাম, আমার পরামর্শ যদি নাও, তাহলে বলব, এসব ঝুটঝামেলার মধ্যে যেয়ো না। প্রথমত, পাঁচনের ফর্মুলার মানেটা পুরোপুরি বুঝেছি বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, আমার মায়ের দিকের পূর্বপুরুষরা বড়ই সৃষ্টিছাড়া টাইপের মানুষ ছিলেন। বুঝেছ, কী বলতে চাইছি?

চেষ্টা করেই দেখা যাক-না।

বুঝলাম গোঁ ছাড়বার পাত্র নয় মোটকা পাইক্র্যাফ্ট। কী আর করা যায়, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে জানতে চেয়েছিলাম, রোগা হয়ে যাওয়ার পর নিজের চেহারাখানা কীরকম দাঁড়াবে, সে ব্যাপারটা কি ভাবা হয়েছে। কিন্তু পাইক্র্যাফটকে তখন যুক্তি দিয়ে বোঝায় কার সাধ্যি। নিরুপায় হয়ে ছোট্ট চামড়াখানা ওর হাতে গছিয়ে দিয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম, খবরদার, আর যেন নিজের মোটা বপু সম্বন্ধে মোটা মোটা কথা শোনাতে আমাকে না আসে।

শেষকালে বলেছিলাম, পাঁচনটা কিন্তু সুবিধের নয় বলে রাখছি। জঘন্য।

হোক গে, বলে চামড়াখানা উলটে-পালটে দেখেই খাবি খেয়েছিল হিন্দুস্তানি হরফ দেখে! ইংরেজি তো নয়!

শেষ পর্যন্ত তরজমা করে শোনাতে হয়েছিল আমাকেই। তারপর গেছে পনেরোটা দিন। এই পনেরো দিনে যতবার আমার কাছে ঘেঁষতে এসেছে সে, ততবারই দূর থেকে হাত নেড়ে বলেছি আরও দূরে সরে পড়তে। কিন্তু পরে পনেরোটা দিন যাওয়ার পরেও দেখেছি, মোটা রয়েছে আগের মতোই।

পনেরো দিন পর আর দূরে আটকে রাখা যায়নি পাইক্র্যাফটকে। শুরু হয়েছিল নাকিকান্না। নিশ্চয় কোথাও গোলমাল হয়েছে। পাঁচনে কাজ হচ্ছে না কেন?

ফর্মুলাটা চাইতেই পকেট বুক থেকে বার করে দিয়েছিল পাইক্র্যাফট।

উপাদানগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, ডিমটা ফেটিয়ে নিয়েছিলে?

না তো। দরকার ছিল কী?

সেটা কি বলতে হবে? ঠাকুমার মা ঠিক যেভাবে পাঁচন তৈরি করতে বলেছে, সেইভাবেই করতে হবে। সামান্য হেরফের থেকেই মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। র‍্যাটল সাপের বিষটা টাটকা ছিল তো?

র‍্যাটল সাপের বিষ জোগাড় করেছিলাম জ্যামরাকসের কাছ থেকে। দামটা

সেটা তোমার ব্যাপার। শেষ উপাদানটা—

ওটার ব্যাপারে একজনের সঙ্গে

বুঝেছি। এই ফর্মুলায় চলবে না। একই পাঁচনের আরও কয়েকটা ফর্মুলা লেখা রয়েছে দেখছি। তা-ই থেকেই আর-একটা লিখে দিচ্ছি। বানানটা দেখছি জঘন্য–আমার বিদ্যেয় কুলাচ্ছে না। ভালো কথা, কুকুর মানে খুব সম্ভব নেড়িকুত্তা!

এরপর ঝাড়া একটা মাস ধরে দেখেছি একই রকম মোটা শরীর নিয়ে ভীষণ উদবেগে ক্লাবময় চক্কর মারছে পাইক্র্যাফ্ট। চুক্তিভঙ্গ করেনি একবারও। দু-একবার শুধু দূর থেকেই মাথা নেড়েছে হতাশভাবে। একদিন পোশাক-ঘরে আমাকে একলা পেয়েই যেই বলেছে, তোমার ঠাকুমার মা, অমনি এক দাবড়ানি দিয়ে আমি বলেছি, খবরদার, কোনও কথা বলবে না আমার ঠাকুমার মা সম্বন্ধে। বাস, এক্কেবারে ঠান্ডা মেরে গেছে। পাইক্র্যাফট।

ভেবেছিলাম, বুঝি আর ঘাঁটাতে আসবে না আমাকে। একদিন দেখলাম, তিনজন নতুন সদস্যকে জ্বালিয়ে মারছে নিজের মোটা চেহারার কথা শুনিয়ে। নতুন ফর্মুলার সন্ধানে আছে নিশ্চয়। তারপরেই বলা নেই, নেই দুম করে পেলাম তার টেলিগ্রাম।

ঈশ্বরের দোহাই, এখুনি এসো।–পাইক্র্যাফ্ট।

যাক, ওষুধ তাহলে ধরেছে। পাঁচনে কাজ হয়েছে। ঠাকুমার মায়ের ইজ্জত রক্ষে পেয়েছে। মনের আনন্দে দশ রকমের পদ দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খেলাম দুপুরের খাওয়া। কফি খাওয়ার পর চুরুটটা শেষ না করেই রওনা হলাম পাইক্র্যাফটের বাড়ির দিকে। ঠিকানা জোগাড় করেছিলাম ক্লাব থেকে। ও থাকে ব্লমসবুরির একটা বাড়ির ওপরতলায়। সদর দরজায় পাইক্র্যাফট কোথায় আছে জিজ্ঞেস করতেই শুনলাম, নিশ্চয় শরীর খারাপ হয়েছে, দুদিন তার টিকি দেখা যায়নি। ও যে তলায় থাকে, সেই তলার চাতালে পৌঁছাতেই উদবিগ্ন মুখে এগিয়ে এসেছিল এক মহিলা। আমার নাম শুনেই বলেছিল, পাইক্র্যাফ্ট বলেই রেখেছে, আমি পৌঁছালেই যেন ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু…

শেষ কথাটা ভেঙেছিল ভীষণ একটা গুপ্তকথা বলার ভঙ্গিমায় ফিসফিস করে, স্যার, উনি তো ঘরে তালা দিয়ে রেখেছেন ভেতর থেকে।

তালা দিয়ে রেখেছে ভেতর থেকে?

গতকাল সকাল থেকে ঘর বন্ধ ভেতর থেকে। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেন না। অনবরত গালাগাল দিয়ে যাচ্ছেন যেন কাকে।

ওই দরজাটা তো?

আজ্ঞে, হ্যাঁ।

ব্যাপারটা কী?

কিসসু বুঝছি না। খালি খাবার চাইছেন। কত খাবারই তো এনে দিলাম, তবুও… ভীষণ কিছু একটা নিশ্চয় ঘটেছে।

দরজার ওদিক থেকে ভেসে এল সরু খ্যানখেনে গলার চিৎকার–ফর্মালিন নাকি?

পাইক্র্যাফট? বলেই দমাদম ঘুসি মেরেছিলাম দরজায়।

তোমার পাশে যে রয়েছে, দূর হতে বল ওকে।

তা-ই বললাম।

তারপরেই শুনলাম দরজার ওপর একটা অদ্ভুত খড়মড় খচমচ আওয়াজ। অন্ধকারে কে যেন দরজার হাতল হাতড়াচ্ছে, ধরতে পারছে না। সেই সঙ্গে পাইক্র্যাফটের গজগজানি– শুয়োরের ঘোঁত ঘোঁত শব্দের সঙ্গে যার আশ্চর্য মিল আছে। বলেছিলাম, খামকা দেরি করছ কেন? আর কেউ নেই এখানে। তবুও খুলল না দরজা। বেশ কিছুক্ষণ গেল এইভাবে। তারপরেই শুনলাম দরজার চাবি ঘোরানোর শব্দ, সেই সঙ্গে পাইক্র্যাফটের কণ্ঠস্বর, এসো ভেতরে।

হাতল ঘুরিয়ে খুললাম দরজা, কিন্তু পাইক্র্যাফ্টকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম না।

না, পাইক্র্যাফট নেই ঘরের মধ্যে।

এরকমভাবে আমার পিলে জীবনে চমকায়নি–সেই মুহূর্তে যেমন চমকে ছিল। ঘরের মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে। বই আর লেখবার সরঞ্জামের ওপর খাবার প্লেট-ডিশ গড়াগড়ি যাচ্ছে, খানকয়েক চেয়ার উলটে পড়ে রয়েছে, কিন্তু পাইক্র্যাফট গেল কোথায়?

ঠিক আছে হে, ঠিক আছে। দরজাটা আগে বন্ধ কর। পাইক্র্যাফটের ঝাঁজালো কণ্ঠস্বর।

আঁতকেই উঠেছিলাম।

তারপরেই আবিষ্কার করেছিলাম তাকে, সশরীরে।

ঘরের কোণে কার্নিশের কাছে দরজার ঠিক মাথায় আটকে রয়েছে কড়িকাঠের সঙ্গে কে যেন আঠা দিয়ে তাকে আটকে রেখেছে সেখানে। মুখখানা রাগে আর উদ্‌বেগে থমথম করছে, হাঁপাচ্ছে হুসহাস করে আর হাত-পা ছুড়ছে পাগলের মতো, দরজাটা… দরজাটা বন্ধ কর আহাম্মক কোথাকার! মেয়েছেলেটা যদি ঢুকে পড়ে ভেতরে…

দরজা বন্ধ করে এসে দাঁড়িয়েছিলাম তার নিচে, চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিলাম কড়িকাঠে আটকানো শূকরপ্রতিম বপুখানার পানে।

বলেছিলাম, পাইক্র্যাফ্ট, এ আবার কী খেলা? পড়ে গেলে যে ঘাড়খানা ভেঙে যাবে।

ভাঙলে তো বাঁচি, সে কী তেজ গলায়।

এই বয়স আর এই ওজন নিয়ে এ ধরনের ছেলেমানুষি জিমন্যাস্টিক দেখাতে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?

নিকুচি করেছে তোমার ঠাকুমার মায়ের। তার জন্যেই…

সাবধান!

কথাটা শোনই-না!

তার আগে বল দিকি, কড়িকাঠে আটকে আছ কীসের আঠায়?

বলে ফেলেই বুঝলাম, আঠা নয়, আঠা নয়–কোনও আঠার জোরেই পাইক্র্যাফট আটকে নেই কড়িকাঠে, গ্যাস ভরতি বেলুনের মতো ফুলে উঠে সেঁটে রয়েছে কার্নিশের কোণে। হাঁচোড়-পাঁচোড় করে দেওয়াল খামচে ধরে নিচের দিকে নামবার চেষ্টা করতে করতে পাইক্র্যাফট বলেছিল, যত নষ্টের মূল ওই প্রেসক্রিপশনটা। তোমার ঠাকুমার মা…

খবরদার! হেঁকে উঠেছিলাম আমি।

দাবড়ানি খেয়ে একটা বাঁধানো ফ্রেম অন্যমনস্কভাবে চেপে ধরেছিল পাইক্র্যাফ্ট, ফ্রেম ভেঙে রয়ে গেল হাতে, ছবি আছড়ে পড়ে খানখান হয়ে গেল মেঝেতে, সাঁ করে ফের শুন্যে উঠে গিয়ে ধাঁই করে কড়িকাঠে ধাক্কা খেয়ে রবারের বলের মতো নেচে নেচে উঠল পাইক্র্যাফট। গতরখানার উঁচু উঁচু জায়গায় সাদা হয়ে রয়েছে কেন, বুঝলাম এতক্ষণে। চুনকাম মেখে কি খোলতাই চেহারাখানিই হয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্র নয় এত মেহনত এবং ধকল সত্ত্বেও। হুঁশিয়ার হয়ে একটু একটু করে চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে নেমে এল ম্যান্টল ধরে।

দৃশ্যটা বাস্তবিকই অপূর্ব! অসাধারণ! ওইরকম বিশাল, চর্বি-থসথসে, সন্ন্যাসরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাযুক্ত একখানা গতর যদি মাথা নিচের দিকে করে কড়িকাঠ থেকে মেঝের দিকে দেওয়াল বেয়ে নিম্নগামী হয়, তাহলে কি দৃশ্যটা মনে রাখবার মতো হয় না?

ফর্মালিন, প্রেসক্রিপশনটা দারুণ কাজে লেগেছে।

কীভাবে পাইক্র্যাফ্ট?

ওজন হারিয়েছি–এক্কেবারে।

এতক্ষণে বুঝলাম ব্যাপারটা।

কী সর্বনাশ! পাইক্র্যাফ্ট, তোমার মনের ইচ্ছেটা ছিল চর্বি কমানোর, মুখে কিন্তু আগাগোড়া বলে গেছ, ওজন কমাতে চাও।

কেন জানি না, দারুণ খুশিতে ডগমগ হয়েছিলাম পাইক্র্যাফটের এহেন পরিস্থিতিতে। সেই মুহূর্তে বড় ভালো লেগেছিল ওকে। হাত বাড়িয়ে ধরে টেনেহিঁচড়ে নামিয়েও এনেছিলাম। পা দুখানা ছুঁড়ে পা রাখবার জায়গা পেতে গলদঘর্ম হয়ে গিয়েছিল বেচারি। আমার কিন্তু মনে হয়েছিল, ঠিক যেন ঝোড়ো বাতাসে নিশান উড়ছে পতপত করে। আঙুল দিয়ে মেহগনি কাঠের ভারী টেবিলটা দেখিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল অপরূপ নাটকের নায়ক, ওর তলায়… ওর তলায় ঢুকিয়ে দাও–আটকে রেখে দেবে—

তা-ই দিয়েছিলাম। বন্দি বেলুনের মতোই সাঁই করে টেবিলের তলায় আটকে গিয়েছিল ফুলো গতরখানা। মেঝের কার্পেটে পরম আয়েশে বসে জেরা চালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। আগে অবশ্য একটা চুরুট ধরিয়ে নিয়েছিলাম মৌজ করে।

তারপর জিজ্ঞেস করেছিলাম খুশি খুশি গলায়–এবার বল, কীভাবে এ হাল হল তোমার।

পাঁচনটা খাওয়ার পরেই।

খেতে কীরকম?

জঘন্য!

জঘন্য তো বটেই। সব কটা পাঁচনের স্বাদই তাই। গুণাগুণ যা-ই থাক-না কেন, ঠাকুমার মায়ের কোনও পাঁচনই আমার কাছে রুচিকর নয়।

প্রথমে এক চুমক খেয়েছিলাম, খুব সামান্য।

তারপর?

বেশ হালকা হালকা লাগছিল নিজেকে। ঘণ্টাখানেক বাদে বেশ তাজা তাজা। তাই ঠিক করলাম, এক ঢোকেই মেরে দেব সবটা।

বল কী?

নাক টিপে গিলেছিলাম অবশ্য। তারপর থেকেই হালকা হতে হতে এই অবস্থা দাঁড়িয়েছে। এই পর্যন্ত মিনমিন করে বলে হঠাৎ ঝাঁ করে তেড়ে উঠল আমার ওপর, ফর্মালিন, কী করি এখন বল তো?

একটা কাজ কখনওই করবে না। বাইরে বেরবে না। বেরলেই শূন্যে উড়ে যাবে, হস্তসঞ্চালনে দেখিয়েছিলাম উড়ে যাওয়ার দৃশ্য।

পাঁচনের কাজ নিশ্চয় মিলিয়ে যাবে আস্তে আস্তে?

সে গুড়ে বালি, খুব জোরে মাথা নেড়ে নাকচ করে দিয়েছিলাম সম্ভাবনাটা। তৎক্ষণাৎ এক পশলা ঝাঁজালো তেজালো রসালো গালাগাল বৃষ্টি হয়ে গেল আমার ওপর। আমার চোদ্দোপুরুষের পিণ্ডি চটকানোর সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে আদ্যশ্রাদ্ধ করা হল আমার ঠাকুমার মা বেচারির। এমতাবস্থায় ওর মতো মোটকা হোঁতকা অশিষ্ট মানুষের পক্ষে এবংবিধ আচরণ খুবই স্বাভাবিক। তাই আমি গায়ে মাখলাম না। শুধু বললাম, আমি তো তোমায় সাধিনি, তুমি নিজেই

বলে, উঠে বসলাম ওই হাতলওয়ালা চেয়ারে। বিপদে যে বন্ধু পাশে দাঁড়ায়, সে-ই প্রকৃত বন্ধু। উপদেশ-টুপদেশ দিলাম কিছুক্ষণ। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম, এ অবস্থার জন্যে দায়ী পাইক্র্যাফ্ট নিজেই। অতখানি পাঁচন ঢক করে গিলে ফেলা উচিত হয়নি। কোঁত কোঁত করে গেলার স্বভাব ওর চিরকালই। এই বিষয়টা নিয়ে ঘোর মতান্তর ঘটল দুজনের মধ্যে।

গাঁক গাঁক চিৎকার শুনে আর মারদাঙ্গা মূর্তি দেখে ঠিক করলাম, শিক্ষাদানের এ প্রসঙ্গটা মুলতুবি থাক আপাতত। যুক্তি দিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিলাম, মহাপাপ সে করেছে শ্রুতিকটু পদের পরিবর্তে কোমলতর পদের প্রয়োগ করে। বলা উচিত ছিল চর্বি, কিন্তু শুনতে খারাপ লাগে বলে বলেছিল ওজন। কাজটা অত্যন্ত গর্হিত। ফল পেয়েছে হাতে হাতে

প্রসঙ্গটা অসমাপ্ত রাখতে বাধ্য হলাম পাইক্র্যাফটের প্রবল বাধাদানে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব দোষই সে মানছে। মহাপাপ সে করেছে, অস্বীকার তো করছে না। কিন্তু এখন করণীয়টা কী?

নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলা ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখছি না, বুঝিয়ে বলেছিলাম আমি। সমস্যা সমাধানের সত্যিকারের আলোচনাটা শুরু হয়েছিল তখনই, এবং বেশ মনে রাখবার মতো আলোচনা। বলেছিলাম, চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে কড়িকাঠে হাঁটাটা এমন কিছু অসুবিধাজনক হবে না কিছুদিনের চেষ্টার পর

ঘুমাতে তো পারছি না, গোঙিয়ে উঠেছিল পাইক্র্যাট।

সেটা কি একটা বিরাট সমস্যা? ধীরেসুস্থে সে সমস্যারও সমাধান করে দিয়েছিলাম আমি। কড়িকাঠে একটা তারের জাল লাগিয়ে নিলেই হল। বিছানার লেপ-তোশক ফিতে দিয়ে লাগানো থাকবে কড়িকাঠের জালে। কম্বল, চাদর বোতাম দিয়ে লাগানো থাকবে পাশে পাশে। ঘরকন্না দেখার ভার রয়েছে যে মেয়েছেলেটার ওপর, তাকেই শুধু সব কথা খুলে বলতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ গজর গজর করার পর রাজি না হয়ে পারেনি। পাইক্র্যাফট। যথাসময়ে জিনিসপত্র এসে পৌঁছেছিল ঘরের মধ্যে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই। উলটো বিছানাপত্র নিয়ে তিলমাত্র উলটো-পালটা কৌতূহল না-দেখানোটা বিলক্ষণ উপভোগ্য হয়েছিল কিন্তু অন্তত আমার কাছে। লাইব্রেরি থেকে মইটা এনে রাখা যাবেখন বসবার এই ঘরে। খাবারদাবার সমস্ত রাখা হবে বুকশেলফের ওপরে। হাত বাড়িয়ে খেয়ে নিলেই হল। খুশিমতো মেঝেতে নেমে আসার মৌলিক পদ্ধতিটাও বাতলে দিয়েছিলাম কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর। খুবই সোজা কায়দা, খোলা বুকশেলফে ব্রিটিশ এনসাইক্লোপিডিয়ার দশম সংস্করণটা রেখে দিলেই হল। হাত বাড়িয়ে খান দুয়েক খণ্ড টেনে নিলেই আস্তে আস্তে নেমে আসবে নিচে। আরও অভিনব একটা ব্যাপারে মতৈক্য ঘটল দুজনের মধ্যে। ঘরের ধার বরাবর অনেকগুলো লোহার আঁকশি লাগানো থাকবে। আঁকশি আঁকড়ে ধরে ঘরের নিচের দিক দিয়ে যত্রতত্র গমন করা যাবে। বুদ্ধিটা মন্দ বলা যায় কি?

এই ধরনের বুদ্ধির পর বুদ্ধি গজিয়ে যাচ্ছিল মাথার মধ্যে ফটাফট করে। বেশ চনমনে বোধ করছিলাম বিপদগ্রস্ত বন্ধুকে সাহায্য করার সুযোগ পেয়ে। উদ্যোগী হয়ে আমিই ঘরকন্না দেখার মেয়েছেলেটাকে ডেকে এনেছিলাম, পাইক্র্যাফটের গুপ্ত রহস্য ফাঁস করেছিলাম, এবং মূলত আমিই ওলটানো বিছানা কড়িকাঠে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, পুরো দুটো দিন কাটিয়েছিলাম ওর ফ্ল্যাটে। স্ক্রু-ড্রাইভার বাগিয়ে অনেক অভিনবআয়োজন সমাপন করেছিলাম আমিই। তার টেনে ঘণ্টা রেখেছিলাম ওর হাতের কাছে, সব কটা ইলেকট্রিক লাইট লাগিয়েছিলাম উলটো করে। এই ধরনের বহুবিধ বিচিত্র ব্যবস্থা সবই করেছিলাম নিজের হাতে এবং পরমোৎসাহে। সব মিলিয়ে দৃশ্যটা এতই সুখপ্রদ হয়ে উঠেছিল যে, ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কড়িকাঠ থেকে দরজার পাশ দিয়ে বিশালকায়। টিকটিকির মতো নেমে আসছে ধুসকো পাইক্র্যাফট, আঁকশি ধরে ধরে যাচ্ছে এক ঘর থেকে আর-এক ঘরে… কিন্তু ছায়া মাড়াতে পারছে না ক্লাবের… জীবনে আর পারবেও না! অহো! অহো!

তারপরেই কুড়ল মেরে বসলাম নিজেরই পায়ে। দায়ী এই উর্বর মগজটা। ভুরভুর করে গজিয়ে যাচ্ছিল বুদ্ধির পর বুদ্ধি–শেষকালে সুড়ত করে এসে গেল এমন একটা বুদ্ধি, যে সর্বনাশ হয়ে গেল আমার নিজেরই।

বসেছিলাম বসবার ঘরে। আগুনের ধারে ওরই চেয়ারে বসে ওরই হুইস্কি পান করছিলাম মৌজ করে। পাইক্র্যাফট লেপটে ছিল ওর অতিপ্রিয় কার্নিশের কোণে হাতে হাতুড়ি নিয়ে পেরেক ঠুকে ঠুকে তুরস্ক দেশের একটা কার্পেট বসাচ্ছিল কড়িকাঠে। বুদ্ধিটা মাথার মধ্যে ঝলসে উঠল ঠিক সেই মুহূর্তেই। চিৎকার করে উঠেছিলাম সঙ্গে সঙ্গে পাইক্র্যাফট! এত ঝামেলার তো কোনও দরকারই দেখছি না।

আইডিয়াটার পুরো প্রতিক্রিয়া ধারণা করে নেওয়ার আগেই গাঁক গাঁক করে তা ব্যক্ত করে ফেলেছিলাম স্বমুখে–সিসের অন্তর্বাস! বাস, ক্ষতি যা হবার হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।

পাইক্র্যাফটের চোখে জল এসে গিয়েছিল শুধু ওই দুটি শব্দ শুনেই–তাহলে বলছ, আবার মাথা তুলে দাঁড়ানো যাবে

চমকপ্রদ আইডিয়াটা গরগর করে বলে গিয়েছিলাম নিজের ক্ষতি কতখানি হতে পারে তা না ভেবেই–সিসের চাদর কেননা পাইক্র্যাফট। চাকা চাকা করে কেটে নিয়ে সেলাই করে নাও গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া, পায়জামায়। পায়ে পর সিসের সুকতলা দেওয়া বুটজুতো। হাতে নাও নিরেট সিসে ভরতি থলি। বাস, আর কী চাই! বন্দিদশা ঘুচবে, আবার টো টো করে যেখানে খুশি টহল দিতে পারবে

বলতে বলতে আরও প্রীতিপদ একটা আইডিয়া ফুরুক করে ঠেলে উঠেছিল মগজের বুদ্ধিকোষ থেকে, জাহাজডুবি হলেও আর তোমাকে মরার ভয় করতে হবে না, পাইক্র্যাফট। কিছু বোঝা বা জামাকাপড় ফেলে দিলেই হল–দরকারমতো মালপত্র হাতে নিয়ে হু-উ-উ-স করে ভেসে উঠবে ডোবা জাহাজ থেকে জলের ওপর–ঠিকরে যাবে শূন্যে! বিষম উত্তেজনায় হাতুড়িটা খসে পড়েছিল পাইক্র্যাফটের হাত থেকে–আমার মাথা ঘেঁষে।

ফর্মালিন! আবার তো তাহলে ক্লাবে যাওয়া যাবে।

শুনেই তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! উৎসাহ নিবে গেল দপ করে। খাবি খেতে খেতে সায় দিয়েছিলাম এইভাবে, তা-ও তো বটে! তা-ও তো বটে!

হ্যাঁ, ক্লাবে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে পাইক্র্যাফ্ট। ওই তো ওই টেবিলে বসে কোঁত কোঁত করে গিলে যাচ্ছে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়। জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমার পানে। চোখে সেই নীরব মিনতি–বলো না ভায়া, বলো না কাউকে। কড়িকাঠে হেঁটেছি কেউ যদি শুনে ফেলে, ঢি ঢি পড়ে যাবে যে। পড়ুক। ওর ওই গেলা দেখে ঘুণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করতে পারছে না যে তিলমাত্র ওজন নেই অত বড় গতরখানার–হালকা… হালকা… বাতাসের মতোই হালকা চর্বির ওই বিশাল পাহাড়টার। তাই জানুক সকলে, কী কুক্ষণেই শেষ বুদ্ধিটা বাতলে ফেলেছিলাম আমি। লেখা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। নতুন একখানা প্লেট নিয়ে চোখ নামিয়ে গোগ্রাসে গিলছে পাইক্র্যাফট, এই ফাঁকে পাশের দরজাটা পেরিয়ে যাওয়া যাবে না?

পিপীলিকা-সাম্রাজ্য

পিপীলিকা-সাম্রাজ্য ( The Empire of the Ants )

[‘The Empire of the Ants’ প্রথম প্রকাশিত হয় পত্রিকায় এপ্রিল ১৯০৫ সালে। আগস্ট ১৯২৬ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয়’ Amazing Stories’ পত্রিকায়। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘The Empire of the Ants and Other Stories’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান। পায়। ১৯৭৭ সালের ‘Empire of the Ants’ সিনেমাটি এই গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরি।]

০১.

মহাসমস্যায় পড়েছেন ক্যাপটেন গেরিলো।

হুকুম এসেছে গানবোট বেঞ্জামিন কনস্ট্যান্ট-কে নিয়ে যেতে হবে বাদামায়। পিঁপড়েরা মড়ক শুরু করেছে–লড়তে হবে তাদের সঙ্গে। স্থানীয় বাসিন্দারা সৈন্য-সাহায্য চায়।

হুকুমটা শুনে অব্দি ক্যাপটেনের ঘোর সন্দেহ হয়েছে, নিশ্চয় তাঁকে অপদস্থ করার চক্রান্ত এঁটেছে কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি তাঁর পদোন্নতি ঘটেছে এমন প্রক্রিয়ায়, যা ন্যায়সংগত মোটেই নয়। ক্যাপটেনের রোমান্টিক চোখের চাহনিতে মুগ্ধ হয়ে বিশেষ এক মহিলা এমন কলকাঠি নেড়েছিলেন যে, পদোন্নতি কেউ আটকাতে পারেনি। তবে, দু-দুটো দৈনিকে তা ই নিয়ে বেশ টিটকিরি শোনা গেছে।

ক্যাপটেন গেরিলো জাতে পর্তুগিজ। আদবকায়দা আর নিয়মশৃঙ্খলার পরম ভক্ত। তাই মনের কথাটা পাঁচজনের কাছে ব্যক্ত করতে পারেননি। সমপর্যায়ের মানুষ না হলে কি প্রাণ খুলে কথা বলা যায়?

এমন একজনকে অবশেষে পাওয়া গেল গানবোটে। নাম তাঁর হলরয়েড–ল্যাঙ্কাশায়ার ইঞ্জিনিয়ার। চাপা বিরক্তিটা প্রকাশ করে ফেললেন তাঁর কাছে। এ কী উদ্ভট কাণ্ড? মানুষ বনাম পিঁপড়ে? বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? পিঁপড়ে আসে পিলপিল করে, মানুষের তাতে বয়ে গেল। খামকা লড়তে যাবে কেন?

ইঞ্জিনিয়ারমশায় জবাব দিয়েছিলেন, আমি তো শুনেছি, এই পিঁপড়েরা পিলপিল করে আসে বটে, কিন্তু চলে যায় না। সাম্বো বলছিল–

সাম্বো নয়–জাম্বো। দোআঁশলা।

সাম্বো, ইঞ্জিনিয়ারের জিবের জড়তা সত্যিই অদ্ভুত। ধরিয়ে দিলেও সঠিক উচ্চারণ করতে পারেন না। সাম্বো বলছিল, পিঁপড়েরা কিন্তু যাচ্ছে না–পিলপিল করে পালাচ্ছে মানুষরাই।

রাগের চোটে অনর্গল ধূমপান করে গেলেন ক্যাপটেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, অসম্ভব। পিঁপড়ে মড়ক ছড়ায়–তার পেছনে থাকে ভগবানের হাত। পিঁপড়েরা নিমিত্তমাত্র। ত্রিনিদাদে খুদে পিঁপড়েরা এইরকম মহামারী ডেকে এনেছিল। কমলা গাছ আর আম গাছের পাতা মুখে করে নিয়ে যেত। মাঝে মাঝে বাড়ির মধ্যেও হামলা করে পিঁপড়েরা লড়াকু পিঁপড়ে–আরশোলা, মাছি, উকুন মেরে বাড়ি সাফ করে দিয়ে চলে যায়। ভালোই করে।

সাম্বো বলছিল, এই পিঁপড়েরা একেবারেই অন্য ধরনের।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সিগারেট নিয়ে তন্ময় হলেন ক্যাপটেন। মুখ খুললেন কিছুক্ষণ পরে, গোল্লায় যাক পিঁপড়ে। আমি তার কী করব? লড়ব কামান-বন্দুক নিয়ে? যত্তসব।

বিকেল নাগাদ কিন্তু পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম গায়ে চাপিয়ে নেমে গেলেন তীরে। অনেক বয়েম আর বাক্স নিয়ে ফিরে এলেন গানবোটে।

ডেকে বসে রইলেন হলরয়েড। ব্রাজিলের মহাবনের দৃশ্য বাস্তবিকই অপরূপ। সিগারেট টানতে টানতে পড়ন্ত বিকালের ঠান্ডা বাতাসে দুচোখ দিয়ে উপভোগ করলেন সেই দৃশ্য। ছদিন হল অ্যামাজন দিয়ে চলেছে গানবোট। সমুদ্র থেকে চলে এসেছে কয়েকশো মাইল দূরে। পূর্ব আর পশ্চিমের দিক্‌রেখা কিন্তু সমুদ্রের মতোই। দক্ষিণে দেখা যাচ্ছে প্রায় নেড়া একটা বালির চড়া দ্বীপ–সামান্য কিছু আগাছা ছাড়া কিছুই নেই সেই দ্বীপে। কাদা-ঘোলা খরস্রোতা জলে ভেসে যাচ্ছে গাছের গুঁড়ির পাশে কুমির-পাখি উড়ছে জলের ওপর। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে আলেমকুর শহরের একটিমাত্র গির্জে-সাহারা মরুভূমির মাঝে যেন একটিমাত্র ছপেনি মুদ্রা। উদ্দাম সবুজ বনানীর মাঝে আর কোনও লোকালয়ের চিহ্ন নেই। মানুষ যে কত নগণ্য প্রকৃতির এই বিশালতার মধ্যে, হাড়ে হাড়ে তা উপলব্ধি করছেন ইঞ্জিনিয়ার। বয়সে তরুণ। শিক্ষাদীক্ষা ইংল্যান্ডে। নিরক্ষীয় অঞ্চলে এসেছেন এই প্রথম। এই ছদিনে দুষ্প্রাপ্য প্রজাপতির মতোই এক-আধবার দর্শনলাভ ঘটেছে মানুষ নামক প্রাণীটার। একদিন দেখেছেন একটা ক্যানো, আর একদিন বহু দূরের একটা স্টেশন, তারপর থেকে মানুষের টিকিও আর দেখেননি। বিশাল এই ভূখণ্ডে মানুষ যে একটা দুষ্প্রাপ্য জন্তু এবং পাত্তা পাচ্ছে না মোটেই, এই ধারণাটাই শেকড় গেড়ে বসেছে মনের মধ্যে।

যত দিন যায়, ততই ধারণাটা বদ্ধমূল হতে থাকে। কামানবাজ কমান্ডারের কাছ থেকে স্প্যানিশ ভাষা রপ্ত করছেন অসীম ধৈর্য সহকারে। ইংরেজিতে কথা বলার মতো লোক। আছে একজনই–একটা নিগ্রো ছোকরা–চুল্লিতে কয়লা দেওয়া তার কাজ। ভুল ইংরেজি বললেও কথাবার্তা চালিয়ে নেওয়া যায় কোনওমতো সেকেন্ড কমান্ডার দা কুন্‌হা জাতে পতুর্গিজ। ফরাসি ভাষা জানে–কিন্তু অশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করে। আবহাওয়া সম্পর্কে সৌজন্যমূলক দু-একটা বাক্যবিনিময় ছাড়া আর কথা হয় না। কাজেই প্রাণ খুলে বলার লোক ওই একজনই–ক্যাপটেন গেরিলো।

আবহাওয়াও অতি যাচ্ছেতাই। আশ্চর্য এই নবীন দুনিয়ার আবহাওয়াও এমন আশ্চর্য হবে, কে জানত। দিনেরাতে সমান গরম। বাতাস তো নয়, যেন গরম বাষ্প। পচা গাছ পাতার গন্ধে ভরপুর। কুমির, অদ্ভুত পাখি, নানা রকমের পতঙ্গ আর আকাশের মাছি, গুবরেপোকা, পিঁপড়ে, সাপ আর বাঁদররা পর্যন্ত যেন বিস্মিত ভয়াবহ এই আবহাওয়ায়। মনুষ্য নামক সুখী প্রাণীর আবির্ভাব দেখে। কী গরম! কী গরম! গায়ে পোশাক রাখা যায় না, খুলে ফেলাও যায় না–রোদ্দুরে চামড়া ঝলসে যায়। রাত্রে এক ধরনের মশা এসে কামড়ায় গায়ে পোশাক না থাকলে। দিনের বেলায় ডেকে উঠলে চোখ ধাঁধিয়ে যায় জ্বলন্ত সূর্যের কিরণে–যেন দম আটকে আসতে থাকে। দিনের বেলাতেও পোকামাকড়ের সে কী উৎপাত। এক ধরনের ধড়িবাজ মাছি এসে কামড়ায় গোড়ালি আর কবজিতে।

ক্যাপটেন গেরিলোর সঙ্গে কথা বলাও ঝকমারি। বান্ধবীদের গল্প ছাড়া আর কোনও কথা নেই তাঁর মুখে। মাঝে মাঝে তাঁরই উৎসাহে কুমির শিকার করে কিছুটা সময় কাটানো গেছে। বনের মধ্যে লোকালয় দেখে নেমে গিয়ে ক্রিয়ল মেয়েদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ নাচানাচিও হয়েছে। এ ছাড়া এই ছদিনে আর কোনও বৈচিত্র নেই।

ক্যাপটেন গেরিলো কিন্তু পিঁপড়ে সম্বন্ধে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছেন। মাঝে মাঝেই গানবোট থামিয়ে নেমে যাচ্ছেন এবং একটু একটু করে এই বিচিত্র অভিযানে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

একদিন তো স্বীকার করেই বসলেন, পিঁপড়েগুলো নাকি একেবারেই নতুন ধরনের আলাদা জাতের। কীটতত্ত্ববিদরা পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে যাবেন বিশেষ এই পিঁপড়েদের চেহারা চরিত্রের বর্ণনা শুনলে। লম্বায় পাক্কা পাঁচ সেন্টিমিটার! ভাবা যায়? আরও বড় আছে! হোক গে অতিকায়, তা-ই বলে কি বাঁদরের মতো পোকা খুঁটতে যেতে হবে? ছ্যা ছ্যা! তবে হ্যাঁ, দানবিক এই পিঁপড়েরা নাকি গোটা তল্লাটটাকে পেটে পুরতে বসেছে। পুরুক গে, পিঁপড়েদের যদি খিদে পায়, রণকুশল ক্যাপটেন কি কামান-বন্দুক নিয়ে তাদের সঙ্গে লড়াই করতে যাবে? লোকে হাসবে না? এই সময়ে ইউরোপে যদি লড়াই লেগে যায়? ক্যাপটেন গেরিলো তখনও কি মহাবিক্রমে পিপীলিকা নিধন চালিয়ে যাবে? ভাবতেও গা রি-রি করে!

এটা ঠিক যে, পিঁপড়ে-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে রিও নিগ্রোতে। নাচের আড্ডায় ওই যে মেয়েগুলোর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হল, ওরাও তো সব খুইয়ে পালিয়ে এসেছে। একদিন নাকি বিকেল নাগাদ পালে পালে হানা দিয়েছিল পিঁপড়েরা। বাড়িঘরদোর ছেড়ে চম্পট দিয়েছিল প্রতিটি মানুষ। নইলে তো পিঁপড়ের পেটেই যেতে হবে। তাই পিঁপড়ে এলেই পালায়, পরে ফিরে আসে। একজন এসেছিল সবার আগে। ওরে বাবা! দেখে কী, ঘরদোর দখল করে বসে রয়েছে পিঁপড়েরা–কেউ যায়নি। তাকে দেখেই আরম্ভ করে দিলে লড়াই! মানুষের সঙ্গে পিঁপড়ের লড়াই!

লড়াই মানে সারা গায়ে উঠে পড়েছিল, এই তো?… বলেছিলেন হলরয়েড।

কামড়ে পাগল করে দিয়েছিল। চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে গিয়ে নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পিঁপড়েদের ডুবিয়ে মেরেছিল। নিজেও কিন্তু মারা গিয়েছিল সেই রাতেই–ঠিক যেন সাপের কামড়ে বিষ ছড়িয়ে পড়েছিল রক্তের মধ্যে?

বলেন কী! পিঁপড়ে বিষ ঢালতে পারে?

ঈশ্বর জানেন। হয়তো খুব বেশি কামড়েছিল। তবে কী জানেন, লড়াই বিদ্যেটা শিখেছি মানুষ মারার জন্যে, পিঁপড়ে মারার জন্যে নয়।

এরপর থেকে প্রায় পিঁপড়ে-পুরাণ নিয়ে আলোচনা হত দুজনের মধ্যে। স্থানীয় বাসিন্দারা নাকি এই বিশেষ পিঁপড়েদের নাম দিয়েছে সৌবা। বিশাল এই অরণ্যকে পদানত করতে চলেছে সৌবারা!

পিঁপড়েদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা ছেড়ে দিয়েছেন ক্যাপটেন গেরিলো। পিঁপড়ে জাতটা সম্বন্ধে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল তিনি। যে পিঁপড়েরা শুধু গাছের পাতা কাটে, তাদের খবর জেনেই এতদিন অনেক বড়াই করেছেন। কর্মীরা আকারে ছোট, পিলপিল করে ছড়িয়ে পড়ে, প্রাণ দিয়ে লড়ে যায়। বড় সাইজের কর্মীরা হুকুম দেয়, শাসন করে, তবে এই শেষোক্ত পিঁপড়েরা যদি চড়াও হয় কারও ওপর, তাহলে গুটিগুটি সটান উঠে যায় ঘাড়ে আর কোথাও নয়–কামড়ে রক্ত টেনে নেয়। পাতা কেটে শেওলার বিছানা বানিয়ে নেয় এই শ্রেণির পিঁপড়েরা। কয়েকশো গজ পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা গেছে এদের বাসাবাড়ি।

পিঁপড়েদের চোখ আছে কি না, এই নিয়ে পুরো দুটো দিন দারুণ কথা কাটাকাটি হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। দ্বিতীয় দিনে হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম হতে হলরয়েড তীরে নেমে গিয়ে বেশ কিছু পিঁপড়ে পাকড়াও করে এনে দেখালেন, কিছু পিঁপড়ের চোখ আছে, কারও কারও নেই।

তারপরেই ঝগড়া লাগল নতুন বিষয় নিয়ে। পিঁপড়েরা কামড়ায়, না হুল ফোঁটায়?

গোরু-মোষ চরানোর একটা বিস্তীর্ণ জমিতে নেমে এ বিষয়ে কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য সংগ্রহ করে এনেছিলেন গেরিলো।

বললেন, বিশেষ এই পিঁপড়েদের নাকি ড্যাবডেবে চোখ আছে। অন্য পিঁপড়েদের মতো অন্ধ নয়–সেইভাবে চলাফেরাও করে না। আড়ালে-আবডালে ড্যাবডেবে চোখ মেলে ওৎ পেতে বসে থাকে।

হুল ফোঁটায় নিশ্চয়?

হ্যাঁ, ফোঁটায়। বিষ আছে ওই হুলেই।

অন্য পিঁপড়েদের মতো চড়াও হওয়ার পর চলে যায় না–ঘাঁটি আগলে থেকে যায়।

তা ঠিক।

তামান্দু পেরিয়ে আসার পর প্রায় আশি মাইল পর্যন্ত তীরভূমিতে মানুষের বসতি একেবারেই নেই। তারপরেই নদী আর ততটা চওড়া নয়, দুপাশের জঙ্গল ক্রমশ কাছে এগিয়ে এসেছে। সেই রাতে একটা ঝুপসি গাছের গাঢ় ছায়ায় নোঙর ফেলল বেঞ্জামিন কনস্ট্যান্ট। অনেকদিন পরে শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেল প্রত্যেকেরই। পরমানন্দে ডেকে বসে চুরুট খেয়ে গেলেন গেরিলো আর হলরয়েড।

গেরিলোর মাথার মধ্যে কিন্তু ঘুরছে আজব এই পিঁপড়েদের কথা। আতঙ্ক ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে, শেষ পর্যন্ত বেটাচ্ছেলেরা কী করে বসবে, তা-ও তো আঁচ করা যাচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে হাল ছেড়ে দিয়ে মাদর পেতে ঘুমিয়ে পড়লেন ডেকের ওপরেই।

মশার কামড়ে ফুলে-ওঠা কবজি রগড়াতে রগড়াতে বসে রইলেন হলরয়েড। তাঁর মাথাতেও হাজারো চিন্তার জট। বনের বিশালতা এই কদিনেই আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তাঁকে। নির্নিমেষে চেয়ে রইলেন রহস্যময় জঙ্গলের দিকে। মাঝে মাঝে জোনাকির আলোয় আলোকিত নিবিড় তমিস্রার মধ্যে শোনা যাচ্ছে যেন ভিনগ্রহীদের গুঞ্জন রহস্যনিবিড় তৎপরতায় চঞ্চল যেন অন্ধকারের দেশ!

বনভূমির এই অমানবিক বিশালতায় তিনি যুগপৎ বিস্মিত এবং বিমর্ষ। হলরয়েড জানেন, আকাশে মানুষ নেই, অবিশ্বাস্য প্রকাণ্ড মহাশূন্যে ধূলিকণার মতো ছড়িয়ে রয়েছে অগণিত নক্ষত্র; তিনি জানেন, মহাসমুদ্রের বিশালতায় মানুষ বিমূঢ় এবং পরাভূত। সমুদ্র শাসন করতে না পারলেও স্থলভূমিকে কবজায় এনেছে ভালোভাবেই। শুধু ইংল্যান্ড কেন, পৃথিবীর যেখানে যত ডাঙা আছে, মানুষের বিজয়কেতন উড়ছে সর্বত্র। এই বিশ্বাস ছিল ইংল্যান্ড ছেড়ে আসার আগে।

কিন্তু রহস্য থমথমে এই বনানী তাঁর ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছে। এখানে মানুষ পরাজয় স্বীকার করেছে। এখানে তার বিজয়কেতন ওড়েনি। এখানকার মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ বনভূমিতে বীরদর্পে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে পোকামাকড়, কচ্ছপ, কুমির, পক্ষী, বিশাল মহীরুহ আর অজগরসম লতার জটাজালের মধ্যে–নেই শুধু মানুষ। দু-একজন চেষ্টা চালিয়ে হার মেনেছে। সাপ, পোকা, পশু আর জ্বরের খপ্পরে প্রাণ দিয়েছে। তাই মাঝে মাঝে গভীর জঙ্গলে দেখা গেছে পরিত্যক্ত গ্রাম, ভেঙেপড়া সাদা দেওয়াল, মিনারের ভগ্নস্তূপ। পুমা আর জাগুয়ারই এই মহাবনের প্রভু–মানুষ নয়।

কিন্তু প্রকৃত প্রভু কে?

পৃথিবীতে যত সংখ্যক মানুষ আছে, তার চাইতেও বেশি সংখ্যক পিঁপড়ে আছে এই জঙ্গলের মাত্র কয়েক মাইলের মধ্যে! চিন্তাটা মাথার মধ্যে আসতেই অন্য চিন্তায় পেয়ে বসে হলরয়েডকে। বর্বর মানুষ কয়েক হাজার বছরের চেষ্টায় সভ্য হয়েছে। পিঁপড়েদের ক্ষেত্রেও যে এই ধরনের ক্রমবিবর্তন আসবে না, তা কি কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে? হাজার হাজার দলবদ্ধ পিঁপড়ে বৃহত্তর বহির্জগৎ নিয়ে এতাবস্কাল মাথা ঘামায়নি ঠিকই। কিন্তু মাথা ঘামানোর মতো বুদ্ধিমত্তা তাদের আছে, আছে নিজস্ব ভাষা! বর্বর মানুষ আদিম অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে, পিঁপড়েরাই বা তা পারবে না কেন? মানুষ যেমন পুঁথি আর নথির মধ্যে জ্ঞান সংগ্রহ করে বানিয়েছে হাতিয়ার, গড়েছে বিশাল সাম্রাজ্য, ঘটিয়েছে পরিকল্পনামাফিক সংগঠিত যুদ্ধ–পিঁপড়েরাই বা তা পারবে না কেন?

গেরিলো অনেক খবর সংগ্রহ করেছেন বিশেষ এই পিঁপড়েদের সম্পর্কে। সাপের বিষের মতোই বিষ ব্যবহার করে এই পিপীলিকাবাহিনী। পাতা-কাটিয়ে পিঁপড়েদের চাইতেও তারা হুকুম মেনে চলে আরও বড় দলপতির। মাংস খায়, এবং যে জায়গা দখল করে, তা দখলেই রাখে, ছেড়ে দিয়ে চলে যায় না…

বনভূমি নিথর। জাহাজের গায়ে বিরামবিহীনভাবে জল আছড়ে পড়ছে। মাথার ওপরে লণ্ঠন ঘিরে উড়ছে প্রেতচ্ছায়ার মতো মথোকা।

অন্ধকারে নড়ে উঠলেন গেরিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ঘুমের ঘোরে, কে জানে, কী করে বসে।

দুঃস্বপ্ন দেখছেন নিশ্চয়!

.

০২.

পরের দিন বাদামার চল্লিশ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছেন শুনে তীরভূমি সম্বন্ধে আগ্রহ বৃদ্ধি পেল হলরয়েডের। ডেকে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন সুযোগ-সুবিধে পেলেই আশপাশের অবস্থা খুঁটিয়ে দেখে নেওয়ার মতলবে। মানুষের চিহ্ন কোথাও দেখতে পেলেন না। দেখলেন কেবল আগাছায় ছাওয়া একটা বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, আর একটা শেওলা-সবুজ দীর্ঘ পরিত্যক্ত মঠের সামনের দিকশূন্য গবাক্ষ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে একটা অরণ্য বৃক্ষ এবং মোটা মোটা লতার জটাজালে ঢেকে গেছে দুহাট করে খোলা প্রবেশপথ। অদ্ভুত হলুদ রঙের এক রকমের প্রজাপতি বেশ কয়েকবার নদী পারাপার করল সেদিন–ডানা তাদের অর্ধস্বচ্ছ। জাহাজে নেমে পড়ল কিছু নিহত হল তৎক্ষণাৎ। বিকেলের দিকে দেখা গেল একটা বড় ক্যানো। পরিত্যক্ত।

অথচ পরিত্যক্ত বলে মনে হয়নি প্রথমে। দুটো পালই শিথিলভাবে ঝুলছে প্রশান্ত হাওয়ায়। সামনের গলুইতে বসে রয়েছে একটি মনুষ্যমূর্তি। আর-একটা লোক যেন উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ভাসতে ভাসতে যেভাবে এগিয়ে এল ক্যানোটা গানবোটের দিকে, দেখেই খটকা লাগল প্রত্যেকেরই। দূরবিন কষে গেরিলা বসে-থাকা লোকটির দিকে চেয়ে ছিলেন। বিচিত্র আলো-আঁধারির মাঝে মনে হল যেন ঝুঁকে রয়েছে–বসে থাকা বলতে যা বোঝায় তা নয়। লাল মুখ, নাক নেই। একবার দেখেই আবার দেখবার শখ উবে গেল। অথচ চোখ থেকে দূরবিন নামাতে ইচ্ছে হল না।

বেশ কিছুক্ষণ পরে দূরবিন নামিয়ে হলরয়েডকে ডাকলেন। ভাসমান ক্যানোর লোকজনকেও হেঁকে ডাক দিলেন। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখলেন ক্যানোর গায়ে লেখা নামটা-সান্তারোজা।

গানবোট পাশ দিয়ে যেতেই ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলে উঠেছিল সান্তালরাজা। ঝুঁকে-থাকা লোকটা অকস্মাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনে। খসে পড়ল টুপি। প্রতিটি অস্থিসন্ধি যেন খুলে আলগা হয়ে গেল চক্ষের নিমেষে–কাত হয়ে পড়ল দেহটা–সেই সময়ে পলকের জন্যে দেখা গেল মুখখানা!

ভয়াবহ সেই মুখাকৃতি দেখলেই নাকি গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়!

কারাম্বা! বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন গেরিলো। হলরয়েড পাশে এসে দাঁড়াতেই বলেছিলেন, দেখেছেন?

মরে ভূত হয়ে গেছে! ক্যাপটেন, নৌকা পাঠান ক্যানোয়–কিছু একটা ঘটেছে মনে হচ্ছে।

মুখখানা দেখেছিলেন?

কীরকম দেখতে বলুন তো?

কী করে বলি?… কী করে বলি?… ভাষা নেই বোঝাবার! বলেই আচমকা হলরয়েডের দিকে পিছন ফিরে প্রচণ্ড হাঁকডাক দিয়ে ক্যাপটেনগিরি আরম্ভ করে দিয়েছিলেন গেরিলো।

স্থলিত ভঙ্গিমায় ভেসে যাওয়া বড় ক্যানোর পাশাপাশি চলে এসেছিল গানবোট। নৌকো নামিয়ে রওনা হয়েছিল লেফটেন্যান্ট দা কুনহা আর তিনজন নাবিক। কৌতূহলে ফেটে পড়ছিলেন গেরিলো। গানবোটকে নিয়ে এসেছিলেন ক্যানোর একদম পাশে। ফলে, লেফটেন্যান্ট নৌকোয় ওঠবার পর, সান্তারোজার সবকিছুই স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন হলরয়েড।

সুস্পষ্ট দেখলেন, অত বড় ক্যানোর আরোহী বলতে শুধু এই দুটি লোক। মুখ দেখতে না পেলেও সামনে ছড়িয়ে-থাকা হাত দেখে গা শিরশির করে উঠেছিল। অদ্ভুত পচন ধরেছে হাতে। দগদগে ঘা আর মাংস পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার! হুমড়ি খেয়ে পড়ে-থাকা এই দুটি মনুষ্যদেহের পেছনে উন্মুক্ত খোলের মধ্যে স্থূপীকৃত ট্রাঙ্ক আর কাঠের বাক্স। কেবিনের দরজা খোলা। কেউ নেই ভেতরে।

মাঝখানের ডেকে সঞ্চরমাণ অনেকগুলো বিন্দুবৎ কালো বস্তু দেখেই গা কীরকম করে উঠেছিল হলরয়েডের। চোখ সরাতে পারেননি। বিন্দুগুলো দ্রুত সরে যাচ্ছে হুমড়ি খেয়ে পড়া লোকটার চারপাশ থেকে। ঠিক যেন মোষের লড়াই দেখছিল কাতারে কাতারে মানুষ –পালাচ্ছে বাগড়া পড়ায়।

বলেছিলেন গেরিলোকে, ক্যাপো, দুরবিন কষে পাটাতনগুলো ভালো করে দেখুন তো।

চেষ্টা করেছিলেন গেরিলো। হাল ছেড়ে দিয়ে দূরবিন তুলে দিয়েছিলেন হলরয়েডের হাতে।

খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে দূরবিন ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন হলরয়েড, পিঁপড়ে!

নিছক পিঁপড়ে। কুচকুচে কালো পিঁপড়ে। কাতারে কাতারে অতিকায় পিঁপড়ে। দেখতে সাধারণ পিঁপড়ের মতোই-সাইজে কিন্তু বিরাট। কয়েকটার পরনে ধূসর পোশাকও রয়েছে যেন।

ক্যানোর পাশে নৌকো নিয়ে গিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট। গানবোট থেকে হুকুম দিয়েছিলেন গেরিলোক্যানোয় উঠতে হবে, এখুনি।

আপত্তি জানিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট। ক্যানো থুকখুক করছে পিঁপড়েতে। ওঠেন কী করে?

পায়ে বুটজুতো আছে তো? ধমক দিয়ে উঠেছিলেন গেরিলো।

কথার মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে লেফটেন্যান্ট জানতে চেয়েছিলেন, লোক দুটো মারা গেল কীভাবে?

দারুণ কথা কাটাকাটি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল দুজনের মধ্যে। একবর্ণও বুঝতে পারেননি হলরয়েড। দূরবিনটা গেরিলোর হাত থেকে নিয়ে ভালো করে ফোকাস করে দেখেছিলেন পিঁপড়েদের। আর, মড়া দুটোকে।

দেখেছিলেন বলেই, অদ্ভুত পিঁপড়েদের আশ্চর্য নিখুঁত বর্ণনা উপহার দিতে পেরেছিলেন আমাকে।

এত বড় পিঁপড়ে নাকি জীবনে দেখেননি। মিশমিশে কালো গায়ের রং। চলাফেরা রীতিমতো শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং সাধারণ পিঁপড়েদের মতো যান্ত্রিক নয়–যেন বুদ্ধি দ্বারা চালিত। প্রায় প্রতি কুড়িটা পিঁপড়ের মধ্যে একটা আয়তনে আরও বড়–মাথা অস্বাভাবিক রকমের বৃহৎ। গেরিলোর বচনমালা মনে পড়ে গিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। পাতা-কাটিয়ে পিঁপড়েদের মধ্যেও নাকি দলপতি কর্মী থাকে। হুকুম দেয় সে। বিরাটমস্তিষ্ক এই পিঁপড়েগুলোও হুকুম দিয়ে সংহত এবং সংঘবদ্ধ রেখেছে পিঁপড়েবাহিনীকে। শরীর বাঁকাচ্ছে অদ্ভুতভাবে–যেন চার পা ব্যবহারে অভ্যস্ত। পরনে রয়েছে যেন বিচিত্র ধূসর পোশাক–সাদা ধাতুর সুতোর মতো উজ্জ্বল শ্বেতপটির কোমরবন্ধনী দিয়ে পোশাক আটকানো রয়েছে গায়ে।…

অন্তত হলরয়েডের তা-ই মনে হয়েছিল। যাচাই করার সুযোগ পাননি।

গেরিলা আর লেফটেন্যান্টের মধ্যে বাগযুদ্ধ চরমে ওঠায় নামিয়ে নিয়েছিলেন দূরবিন।

কড়া গলায় ধমকে উঠেছিলেন গেরিলো, আমার হুকুম… আপনার ডিউটি… উঠুন ক্যানোয়।

বেঁকে বসেছেন লেফটেন্যান্ট। ঘিরে দাঁড়িয়েছে মুলাটো নাবিকরা। তারাও ক্যানোয় উঠতে নারাজ।

ইংরেজিতে বলেছিলেন হলরয়েড, লোক দুটোকে মেরেছে কিন্তু পিঁপড়েরা।

ক্রোধে ফেটে পড়েছিলেন ক্যাপটেন। হলরয়েডের কথার জবাব দেননি। গলার শির তুলে আতীক্ষ কণ্ঠে পর্তুগিজ ভাষায় হুকুম দিয়েছিলেন অধস্তন কর্মচারীদের, ক্যানোয় উঠতে হুকুম দিয়েছি, খেয়াল রাখবেন। যদি না ওঠেন–তাহলে বিদ্রোহী বলে গণ্য করা হবে আপনাকে আপনার সঙ্গে যারা যারা রয়েছে–তাদেরকেও। ভীরু কোথাকার! লোহার শেকলে বেঁধে কুকুরের মতো গুলি করে মারব বলে দিলাম।

সে কী গালাগাল! তাণ্ডবনাচ নাচতে লাগলেন উন্মত্ত ক্রোধে। মুষ্টি পাকিয়ে নাড়তে লাগলেন মাথার ওপর। অপরূপ সেই মূর্তি দেখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন লেফটেন্যান্ট মুখ নিরক্ত! নাবিকরা স্তম্ভিত!

আচম্বিতে মনস্থির করে ফেললেন লেফটেন্যান্ট। বীরোচিত সিন্ধান্ত নিলেন। কাষ্ঠদেহে গটগট করে উঠে গেলেন ক্যানোয়। সঙ্গে সঙ্গে দুরকলে দরজা পড়ে যাওয়ার মতো ঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল ক্যাপটেনের অবিশ্রান্ত গালিগালাজ। হলরয়েড দেখলেন, দা কুহার বুটজুতোর পাশ থেকে পিছু হটে যাচ্ছে পিঁপড়েরা। মন্থর চরণে হুমড়ি খেয়ে পড়ে-থাকা লোকটার পাশে গিয়ে ঝুঁকে পড়লেন লেফটেন্যান্ট। দ্বিধায় পড়লেন যেন। তারপর কোট খামচে ধরে চিৎ করে শুইয়ে দিলেন। অমনি ঝাঁকে ঝাঁকে কালো পিঁপড়ের ধারাস্রোত বয়ে গেল জামাকাপড়ের ভেতর থেকে। লাফিয়ে পিছিয়ে এলেন দা কুনহা। বারকয়েক জোরে পা ঠুকলেন ডেকে।

চোখে দূরবিন লাগালেন হলরয়েড। দেখলেন আগন্তুক দা কুহার পায়ের গোড়ায় বিক্ষিপ্ত পিঁপড়েদের। আর যা দেখলেন, তা তিনি জীবনে দেখেননি।

দৈত্যের পানে ঘাড় বেঁকিয়ে যেমন খুদে মানুষরা তাকিয়ে থাকে, অগুনতি কালো পিঁপড়ে ঠিক সেইভাবে প্যাটপ্যাট করে দেখছে দা কুনহাকে!

ক্যাপটেনের হুংকার শোনা গেল কানের কাছে–মারা গেল কী করে লোকটা?

পর্তুগিজ ভাষায় জবাবটা বুঝতে পেরেছিলেন হরয়েড। এত মাংস খুবলে খুবলে খেয়ে নেওয়া হয়েছে যে মৃত্যুর কারণ অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

সামনের লোকটা? ক্যাপটেনের প্রশ্ন।

কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে পর্তুগিজ ভাষায় জবাব দিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট। তারপরেই আচমকা দাঁড়িয়ে গিয়ে সজোরে পা ঝাঁকুনি দিয়ে কী যেন ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। অদ্ভুতভাবে নাচানাচি করেছিলেন কিছুক্ষণ–যেন অদৃশ্য আতঙ্ককে পা দিয়ে পিষে ফেলতে চাইছেন। তারপর সরে গিয়েছিলেন পাশে। খুব দ্রুত। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে সটান দেহে গটগট করে গিয়েছিলেন ক্যানোর সামনের দিকে উপুড় হয়ে শুয়ে-থাকা লোকটার পানে। হেঁট হয়ে দেখেছিলেন কিছুক্ষণ। যেন গোঙিয়ে উঠেছিলেন। কেবিনের মধ্যে পায়চারি করেছিলেন। অত্যন্ত আড়ষ্টভাবে তাঁর সেই ঘোরাফেরা নাকি রীতিমতো শিহরনময়। ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীরস্থির স্বরে কথা বলেছিলেন ক্যাপটেনের সঙ্গে–একটু আগেই অত লাঞ্ছনার বাষ্পটুকুও ছিল না কণ্ঠস্বরে। সাময়িক শৃঙ্খলাবোধের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন নিরুত্তাপ আচরণে।

দূরবিন চোখে লাগিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন হলরয়েড। খোলা ডেকে একটি পিঁপড়েও আর নেই–বেমালুম অদৃশ্য! ডেকের তলায় ছায়ার মধ্যে কিন্তু যেন অগুনতি চোখ নজরে রেখেছে দা কুনহাকে।

ক্যানো বাস্তবিকই পরিত্যক্ত–বলেছিলেন লেফটেন্যান্ট। তবে পিঁপড়ে থুকখুক করছে বলে মানুষ নামানো সমীচীন হবে না। গানবোটে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যেতে হবে। দড়ির দিকেই এগিয়েছিলেন। নৌকোয় দাঁড়িয়েছিল নাবিকরা দরকার হলে হাত লাগাবে বলে।

দুরবিন কষে তন্নতন্ন করে ক্যানোটাকে দেখছিলেন হলরয়েড।

মনে হয়েছিল যেন খুব সূক্ষ্মভাবে বিরাট তোড়জোড় চলছে পুরো ক্যানোর মধ্যে। ইঞ্চিকয়েক লম্বা কয়েকটা হুকুমদার পিঁপড়েকে দেখলেন সাঁত করে সরে গেল একদিক থেকে আর-একদিকে অদ্ভুত বোঝা ঘাড়ে করে–বোঝাটা যে কী কাজে লাগবে, তা ঠাহর করেও ধরতে পারেননি হলরয়েড। খোলা জায়গা দিয়ে লাইন দিয়ে যাচ্ছে না মোটেই– যাচ্ছে আধুনিক পদাতিক বাহিনীর মতো ছড়িয়ে পড়ে। লড়াই আরম্ভ হল যেন। বেশ কিছু পিঁপড়ে ঘাপটি মেরে রইল মৃত ব্যক্তির জামাকাপড়ের মধ্যে। বাকি সবাই ঝাঁকে ঝাঁকে সুসংযত সৈন্যবাহিনীর মতো জড়ো হল ঠিক সেইদিকেই, যেদিকে এখুনি পা দেবেন লেফটেন্যান্ট।

হলফ করে বলেছেন হলরয়েড, স্বচক্ষে না দেখলেও তাঁর বিশ্বাস, একযোগে দা কুনহার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পিঁপড়েবাহিনী। আচম্বিতে বিকট গলায় চেঁচিয়ে উঠে সজোর পা ঠুকেছিলেন লেফটেন্যান্ট। হুল ফোঁটাচ্ছে পিঁপড়ে–পরিষ্কার করে বলেছিলেন ক্যাপটেনকে বিষম বিতৃষ্ণায়। চোখে-মুখে প্রকট হয়েছিল ক্যাপটেনের প্রতি আতীব্র ঘৃণা।

পরক্ষণেই ক্যানো থেকে ঠিকরে পড়েছিলেন জলে।

নৌকোর তিন নাবিক তাঁকে টেনে তুলেছিল জল থেকে–ধরাধরি করে নিয়ে এসেছিল গানবোটে।

কিন্তু মারা গিয়েছিলেন সেই রাতেই!

.

০৩.

ক্যাপটেন গেরিলো কঠোর প্রকৃতি সামরিক পুরুষ হতে পারেন, কিন্তু রক্তমাংসের মানুষ তো বটেই। জ্বরের ঘোরে মৃত্যুর আগে লেফটেন্যান্ট দা কুনহা তাঁকেই দায়ী করেছিলেন তাঁর ওই শোচনীয় মৃত্যুর জন্য। প্রলাপের ঘোরে বলেছিলেন, ক্যাপটেনই খুন করল তাঁকে!

ক্যাপটেন মনে মনে তা উপলব্ধি করলেও মুখে তা প্রকাশ করেননি। কিন্তু বৃশ্চিক দংশনের মতো কথাটা তাঁকে যন্ত্রণা দিয়েছে পরের দিন। ছটফট করেছেন। আপন মনে বকেছেন। হলরয়েডকে সাক্ষী মানবার চেষ্টা করেছেন। তিনি কেন খুন করতে যাবেন দা কুনহাকে? তিনি কর্তব্য করেছেন, দা কুনহাকেও কর্তব্য করার অর্ডার দিয়েছেন। ক্যানোয় একজনকে উঠতে তো হতই।

কোনও জবাব দেননি হলরয়েড। জবাব দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তাঁর ছিল না। কেবিনে শোয়ানো রয়েছে দা কুহার বিষজর্জর মৃতদেহ। চোখের সামনে ভাসছে বিষপ্রয়োগে কুশলী শৃঙ্খলাবদ্ধ সৈন্যবাহিনীর মতো বৃহদাকার পিপীলিকাবাহিনীর আক্রমণের দৃশ্য। চক্ষুষ্মন তারা, বুদ্ধিমানও বটে।

দা কুনহার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল বিষের জ্বালায়মনকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ক্যাপটেন। হলরয়েডকেও প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নিরুত্তর থেকেছেন হলরয়েড। দূর বনভূমি থেকে ভেসে এসেছে বাঁদরদের কিচিরমিচির আর ব্যাঙেদের বিকট হল্লাবাজি। কানের ওপর সেই অত্যাচার আরও বিমর্ষ করে তুলেছে। মনকে। কিছুতেই ভুলতে পারেননি ভয়াবহ সত্যটুকু–পিঁপড়েগুলোর চোখ আছে, ব্রেনও আছে। পরিধেয় ব্যবহারে অভ্যস্ত, ধাতব সামগ্রী নির্মাণে দক্ষ এবং বিষপ্রয়োগের হাতিয়ার উৎপাদনেও চৌকস। বৃহদাকার পিঁপড়েদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম, কোমরে বেল্ট, কাঁধে অদ্ভুত বোঝা–কী সেই বোঝা? বিষ ছুঁড়ে দেওয়ার অস্ত্র নিশ্চয়। বিষটাও নিশ্চয় বানিয়ে নিয়েছে। নইলে–

আচম্বিতে ক্ষিপ্তের মতো একটা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন গেরিলো। ক্যানোটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দরকার কী? পুড়িয়ে ফেলা হোক।

দড়ি কেটে, কেরোসিন তেল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল পিপীলিকা বোঝাই ক্যানো। আগুনের আভায় প্রদীপ্ত হয়েছিল দুপাশের বনভূমি। রহস্য থমথমে অন্ধকারের মধ্যে অজস্র চক্ষু যেন নির্নিমেষে দেখেছিল, জলের মধ্যে ভাসমান জ্বলন্ত ক্যানোয় পুড়ে মরছে কাতারে কাতারে পিঁপড়ে–চক্ষুষ্মনদেরই সগোত্র!

সারাদিন সারারাত অস্থিরভাবে পায়চারি করেছেন গেরিলো। কী যে করবেন, কিছুতেই ভেবে ঠিক করে উঠতে পারেননি। হলরয়েডকে জিজ্ঞেস করেছেন, হলরয়েডও জবাব দেননি। পরের দিন সকালবেলা দেখেছেন, বিনিদ্র রজনি যাপন করে অর্ধোন্মাদের পর্যায়ে পৌঁছেছেন গেরিলো। অদূরে দেখা যাচ্ছে বাদামা। পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘর, লতায় ঢাকা চিনিকল, গুঁড়ি আর বেতের ছোট্ট জেটি। উষ্ণ প্রভাতে কিন্তু নিথর নিস্পন্দ সবকিছুই। প্রাণের সাড়া নেই কোথাও। মানুষ তো নেই-ই। খাঁ খাঁ করছে বাদামা। পরিত্যক্ত। একটা নরকঙ্কাল দেখা যাচ্ছে তীরভূমিতে। সাদা ধবধবে। মাংস পরিষ্কার। শুধু হাড়গুলো রয়েছে। পড়ে।

গেরিলো উচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অকস্মাৎ। পরপর দুবার বংশীধ্বনি করেও সাড়া না-পাওয়ায় ঠিক করেছিলেন, একাই নেমে গিয়ে দেখে আসবেন। এতগুলো মানুষকে বিষ আর বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়াটা অন্যায়।

মনে মনে সায় দিয়েছিলেন হলরয়েড। মুখে কিছু বলেননি। চোখে কিন্তু দেখেছিলেন, নদীর ধারে সারি সারি চক্ষুষ্মন পিপীলিকার খর-নজর রেখেছে গানবোটের ওপর। দূরে দূরে কুটির আর শুগার মিলের পাশে অদ্ভুত আকারে মাটির ঢিপি আর প্রাচীরও দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধের প্রস্তুতি যেন সম্পূর্ণ। বাদামা যাদের দখলে, তারা ওত পেতে রয়েছে নতুন হানাদারদের আবির্ভাবের প্রতীক্ষায়।

তাই মত পালটে নিয়েছিলেন গেরিলো। কামান ব্যবহারে বড় কৃপণ ছিলেন গোড়া থেকেই, বারুদ খরচ করতে চাইতেন না কোনওমতেই। সেদিন কিন্তু হুকুম দিয়েছিলেন কামান দাগতে। গুরুগম্ভীর গর্জনে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল নিস্তব্ধ অরণ্য। মহা আড়ম্বরে উপর্যুপরি গোলা নিক্ষেপ করে গিয়েছিলেন গেরিলো। ধসে পড়েছিল শুগার মিল, উড়ে গিয়েছিল জেটির পেছনকার গুদামঘর।

অবশেষে বুঝেছিলেন, বৃথা চেষ্টা। গোলার অপচয়ই হচ্ছে শুধু–শনিধন আর হচ্ছে না। বাদামাকে আবার দখল করা যাবে না এভাবে। আবার শুরু হয়েছিল অস্থিরতা। সিদ্ধান্ত নিতে না-পারার যন্ত্রণায় যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। শয়তানের বাচ্চাদের কামান দেগে ধ্বংস করা যাবে না। ফিরেই যেতে হবে। সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট পেশ করে তাঁদের নির্দেশ অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।

তাই ফিরে এসেছিল গানবোট। অনেকটা পথ এসে তীরভূমিতে কবরস্থ করা হয়েছিল দা কুনহাকে।

এমন একটা জায়গায়, যেখানে নতুন শ্রেণির এই পিঁপড়েরা এখনও পৌঁছায়নি।

তিন হপ্তা আগে টুকরো টুকরোভাবে পুরো বিবরণটা শুনেছিলাম হলরয়েডের মুখে।

বিশেষ এই পিঁপড়েদের মস্তিষ্ক আছে। আর দেরি করা উচিত নয়। মহাবিপদ আসন্ন বদ্ধমূল এই ধারণা নিয়েই ইংল্যান্ডে ফিরেছেন হলরয়েড। বুদ্ধিমান এই পিপীলিকাবাহিনী আপাতত যেখানে সক্রিয়, ব্রিটিশ গুয়ানা সেখান থেকে এক হাজার মাইলের মধ্যেই। কাজেই এখন থেকেই হুঁশিয়ার না হলে ব্রিটিশ গুয়ানার যে কী হাল হবে, তা ভাবতেও গায়ের রক্ত জল হয়ে যাচ্ছে তাঁর।

নারকীয় এই কীটদের যে আর উপেক্ষা করা সমীচীন নয়, ব্রাজিল সরকার তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে পাঁচশো পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করেছে মোক্ষম কীটনাশকের জন্যে। মাত্র তিন বছর আগে অজেয় এই কীট আবির্ভূত হয়েছিল অনতিদূরে পাহাড়ের ওপরে। এর মধ্যেই তাদের বিজয়-অভিযান রীতিমতো বিস্ময়কর। বাতেমো নদীর দক্ষিণ তীরভূমির প্রায় ষাট মাইল জায়গা তাদের পুরো দখলে। মানুষকে একেবারেই তাড়িয়ে ছেড়েছে, অথবা খতম করেছে। জায়গা-জমি, বাড়িঘরদোর, কলকারখানায় ঘাঁটি গেড়েছে।

একটা জলপোতও দখলে এনে ফেলেছিল। অব্যাখ্যাত পন্থায় কাপুয়ানা শাখানদীর ওপর সেতু রচনা করে অ্যামাজনের ভেতরে বহু মাইল পথ নাকি এগিয়ে এসেছে। সাধারণ পিঁপড়েদের মতো তারা নয়, ঢের বেশি সংঘবদ্ধ এবং সমাজবদ্ধ। অন্য পিঁপড়েদের সমাজ বিক্ষিপ্ত, কিন্তু এরা একত্র হয়ে একটা জাত গড়ে তুলেছে। বুদ্ধিমত্তার শেষ এখানেই নয়, ভয়াবহতা প্রকটতর হয়েছে বিষপ্রয়োগের নৈপুণ্যে। বৃহদাকার শত্রুকে বল প্রয়োগে বধ করে না–করে বিষপ্রয়োগে। বিষটা সাপের বিষের মতোই মারাত্মক। খুব সম্ভব উৎপাদনও করে নিজেরা। ওদেরই মধ্যে আয়তনে যারা বড়, তারা ছুচের মতো তীক্ষ্ণাগ্র ক্রিস্টাল বয়ে নিয়ে যায় মানুষের মতো বড় শত্রুদের গায়ে বিঁধিয়ে দেওয়ার জন্যে।

বিশ্ববাসীকে সজাগ করার মতো বিশদ বিবরণ এখনও পাওয়া যায়নি। চাক্ষুষ বর্ণনা পাওয়া গেছে কেবল হলরয়েডের কাছ থেকেই। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে যেটুকু বলেছেন, চমৎকৃত এবং হুঁশিয়ার হওয়ার পক্ষে তা যথেষ্ট। ঊর্ধ্ব অ্যামাজনে ক্রমশ কিংবদন্তির আকারে ছড়িয়ে পড়ছে অসাধারণ এই পিঁপড়েদের অত্যাশ্চর্য কীর্তিকলাপ–কল্পনার আতঙ্ক মিশ্রিত হওয়ার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নানারকম অতিরঞ্জিত কাহিনি। বিচিত্র এই পোকারা নাকি বিবিধ হাতিয়ারের ব্যবহার জানে, আগুনের ব্যবহার জানে, ধাতুর ব্যবহার জানে, যন্ত্রবিদ্যাও জানে। তাই পারাহাইবার নদীর তলায় সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ফেলেছে অদ্ভুত কৌশলে লন্ডনের টেমস নদীর মতোই চওড়া সেই নদী অতিক্রম করেছে পাতাল-বিবর দিয়ে। তাদের জ্ঞানবুদ্ধি সঞ্চিত থাকে মানুষের মতোই পুঁথি আর নথির মধ্যে–সঞ্চিত বিদ্যেকে কাজে লাগায় প্রয়োজনমতো। আপাতত তারা শুধু অগ্রসর হচ্ছে বিরামবিহীনভাবে এবং পথে মানুষ পড়লেই খতম করে দিচ্ছে নির্দয়ভাবে। বংশবৃদ্ধিও ঘটছে দ্রুতহারে। হলরয়েডের ধ্রুব বিশ্বাস, অচিরেই পুরো নিরক্ষীয় দক্ষিণ আমেরিকা এসে যাবে তাদের আধিপত্যে।

কিন্তু শুধু দক্ষিণ আমেরিকাতেই বিজয়কেতন উড়িয়ে তারা ক্ষান্ত হবে, এমন কথা কে বলতে পারে? যে গতিবেগে এগচ্ছে, ১৯১১ সাল নাগাদ হানা দেবে কাপুয়ারানা এক্সটেনশন রেলপথে–ইউরোপের ধনকুবেরদের টনক নড়বে তখনই।

১৯২০ নাগাদ পেরিয়ে আসবে অ্যামাজনের অর্ধেক। আমার তো মনে হয়, ১৯৫০ কি ১৯৬০-এর মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলবে ইউরোপকে।

প্রলয়-তারার ধ্বংসলীলা

প্রলয়-তারার ধ্বংসলীলা (The Star)

[‘The Star’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘The Graphic’ পত্রিকায় ডিসেম্বর ১৮৯৭ সালে। ‘Doubleday & McClure Co.’ থেকে ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত ‘Tales of Space and Time’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। জুন ১৯২৬ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয়। ‘Amazing Stories’ পত্রিকায়।]

সূর্যকে প্রদক্ষিণরত গ্রহদের মধ্যে দূরতম গ্রহ নেপচুন যে হঠাৎ টলমল করে উঠেছে, এ খবর প্রথম প্রচারিত হল নতুন বছরের পয়লা তারিখেই। সব কটা মানমন্দির থেকেই প্রায় একই সঙ্গে জানানো হল, নেপচুনের গতিপথ আগের মতো আর নেই রীতিমতো টলটলায়মান! গতিবেগ যে কমে এসেছে, এরকম একটা সন্দেহের আভাস ডিসেম্বরেই দিয়েছিলেন ওগিলভি। বেশির ভাগ মানুষই খবরটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি–কেন-না নেপচুন গ্রহের অস্তিত্বের খবরই তারা রাখত না। অত দূরে ধূলিকণার মতো একটা আলোকবিন্দুর সহসা আবির্ভাবে নেপচুন গ্রহ চঞ্চল হয়েছে কেন, তা উত্তেজিত করেনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী যারা নয়, তাদের কাউকেই। চঞ্চল হয়েছিলেন কিন্তু বিজ্ঞানীরা। ছোট্ট আলোককণাটা দ্রুত বড় হচ্ছে, উজ্জ্বলতর হচ্ছে, অন্য গ্রহদের নিয়মমাফিক গতিপথের ধারকাছ দিয়েও যাচ্ছে না–সবই তাঁরা লক্ষ করেছিলেন। উপগ্রহ সমেত নেপচুনের কক্ষপথচ্যুতি এভাবে এর আগে কখনও ঘটেনি।

বিজ্ঞানে যাদের অনুশীলন নেই, সৌরজগতের বিশাল বিচ্ছিন্নতা তাদের কল্পনায় আসবে না। সৌরজগতের বাইরের মহাশূন্যতাও ধারণা করতে পারবে না। নেপচুনের পর যে ধু ধু শূন্যতা, তা দশ লক্ষ মাইলকে দুকোটি দিয়ে গুণ করলে যা দাঁড়ায়–তা-ই। এখানে আলো নেই, তাপ নেই, শব্দ নেই। নিকষ শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই। নিকটতম তারামণ্ডল রয়েছে। এরপরেই। মাঝেমধ্যে ক্ষীণতম অগ্নিশিখার মতো দু-একটা ধূমকেতু দেখা যায় এই বিপুল মহাশূন্যতার মধ্যে–এ ছাড়া এখানকার আর কোনও খবর রাখে না মানুষ। রহস্যময় এই কালো অঞ্চল থেকেই সহসা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আবির্ভূত হল এই আগন্তুক টহলদার। বিশাল বস্তুপুঞ্জ। কৃষ্ণরহস্য থেকে বেরিয়ে এসেই ধেয়ে চলল জ্বলন্ত সূর্যের দিকে। দ্বিতীয় দিনেই দূরপাল্লার যন্ত্রে দেখা গেল তাকে রেগুলাসের কাছে লিও তারামণ্ডলের পাশে। বিশাল ব্যাস। অল্পক্ষণের মধ্যেই মামুলি দূরবিনেও ধরা পড়ল তার চেহারা।

তৃতীয় দিনে পৃথিবীর সব মানুষকে সজাগ করে দিলে খবরের কাগজগুলো। মহাশূন্যের এই প্রেতচ্ছায়াকে আর উপেক্ষা করা যায় না। লন্ডনের একটা দৈনিক লিখল, খুব সম্ভব

নেপচুন গ্রহকে ধাক্কা মারতে চলেছে মহাকাশের আগন্তুক। তেসরা জানুয়ারি সূর্যাস্ত হতেই পৃথিবীর মানুষরা আকাশপানে চেয়ে রইল আসন্ন সংঘাতের আশঙ্কায় শিহরিত অন্তরে।

লন্ডনের রাস্তাঘাট থেকে দেখা গেল একটা বিশাল সাদা তারা–দেখা গেল সমুদ্র থেকেও। আচমকা পশ্চিম আকাশে উঠে এসেছে নবাগত নক্ষত্র!

সন্ধ্যাতারার চাইতেও উজ্জ্বল নক্ষত্র। মিটমিটে আলোককণা নয়–পরিষ্কার চাকাঁপানা দেহ। সারারাত ধরে বড় হচ্ছে আকার। ভোরের দিকে হল আরও স্পষ্ট। বিজ্ঞান যার বৃত্তান্ত জানে না, সাধারণ মানুষ তার এই চেহারা দেখে আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেল। না জানি আবার কী মহামারী আর মহাযুদ্ধ নিয়ে এল এই উৎপাত। বুয়র, হটেনটট, নিগ্রো, ফরাসি, স্প্যানিয়ার্ড, পর্তুগিজ প্রত্যেকেই ভোরের আলোয় স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল অদ্ভুত নতুন নক্ষত্রের দিকে।

সংঘর্ষটা লাগল তারপরেই। বহু দুরের দুটি জ্যোতিষ্ক কাছাকাছি হয়েই মিশে গেল। একসঙ্গে। রুদ্রতেজের ঝলক সূচনা করল নেপচুন গ্রহের মৃত্যু। আগন্তুক গ্রহের ধাক্কায় দুই জ্যোতিষ্ক তালগোল পাকিয়ে আরও বিরাট নক্ষত্রের আকারে ঢলে পড়ল পশ্চিমের আকাশে পূর্বে সূর্য ওঠার আগেই। দূর সমুদ্রের নাবিকরা দেখল, আচমকা আকাশে উঠে এল এক নয়া চাঁদ–স্থির হয়ে ভেসে রইল মাথার ওপররাত ফুরালেই ঢলে পড়ল পশ্চিমে। ক্যামেরা আর স্পেকট্রোস্কোপে ধরে রাখা হল সেই দৃশ্য।

ইউরোপের আকাশে নবাগতকে দেখেই আঁতকে উঠল আপামর মানুষ। আকারে আরও বড়–গতকালের চাইতেও। সাদা আগুনের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে সামনে। পশ্চিমের চাঁদও সে তুলনায় নিষ্প্রভ। প্রতিটি ছাদ আর পাহাড় থেকে দেখা গেল তাকে।

মানমন্দিরের বৈজ্ঞানিকরা দেখল আরও ভয়ংকর ঘটনা। বিচিত্র নতুন তারা শুধু

আকারেই বড় হয়নি–আরও কাছে এগিয়ে আসছে! টেলিগ্রাম মারফত বিদ্যুৎ বেগে খবর ছড়িয়ে গেল তামাম দুনিয়ায়। রহস্যময় আগন্তুক এগিয়ে এসেছে পৃথিবীর অনেক কাছে। মাঠে-ঘাটে-হাটেও দেখা গেল, সত্যিই অনেক কাছে চলে এসেছে নবাগত হানাদার!

সন্ধে নামল। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা গেল আকাশের আতঙ্ককে–যেন একটা হলদে প্রেত–চাঁদের মতো সাদা ঝকঝকে নয়। সূর্য ডুবেছে, অথচ আকাশ আলোয় আলো হয়ে রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এক বড়লোক রাস্তায় আলোর মালা ঝুলিয়েছিল বিয়ে উপলক্ষে। আকাশের আলো দেখে হতবাক হল সে। খুশিও বটে। আকাশেও আলো ঢেলে দিয়ে গেল নতুন তারা।

গণিত-গুরু কাগজপত্র সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তাঁর নিজস্ব ঘরে। চার রাত ওষুধ খেয়ে জেগে থেকেছেন–শুধু অঙ্ক কষে গেছেন। হিসেবে তাঁর ভুল হয়নি। সাদা শিশির মধ্যে এখনও একটু ওষুধ পড়ে রয়েছে–কিন্তু আর রাত জাগার দরকার হবে কি? হিসেব ঠিকই আছে। পৃথিবীর শেষ দিন। ঘনিয়ে এল বলে।

উঠে দাঁড়ালেন গণিত-গুরু। জানলার সামনে গিয়ে খড়খড়ি তুলে চেয়ে রইলেন চিমনি আর বাড়ির ছাদের ওপর ঝুলন্ত তারার দিকে।

চেয়ে রইলেন নির্নিমেষে। অকুতোভয় সৈনিক যেন নিরীক্ষণ করছেন বিষম বৈরীকে। চোখের পাতা ফেললেন না বেশ কিছুক্ষণ। তারপর নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করে বললেন নিজের মনে, হত্যা তুমি করতে পার আমাকে–কিন্তু তোমাকে আর এই গোটা ব্ৰহ্মাণ্ডটাকে এই মাথার মধ্যে ধরে রাখার ক্ষমতা আমার আছে। ছোট্ট এই মস্তিষ্কে বন্দি রইলে তুমি।

পরের দিন কাঁটায় কাঁটায় ঠিক দুপুরবেলা ঢুকলেন ক্লাসঘরে। তুলে নিলেন একটা চকখড়ি। এটা তাঁর মুদ্রাদোষ। চকখড়ি নিয়ে নাড়াচাড়া না করলে বক্তৃতা দিতে পারেন না। ছাত্রছাত্রীরা একবার সে এক্সপেরিমেন্ট করে খুব মজা পেয়েছে। আজ কিন্তু তাঁর মুখচ্ছবি দেখে থমথম করতে লাগল গোটা ক্লাস। চকখড়ি নাড়তে নাড়তে বললেন গণিত-গুরু, যা পড়াব ঠিক করেছিলাম, তা আর শেষ করতে পারব না। কারণ, মানুষ জাতটা বৃথাই এসেছিল পৃথিবীতে সংক্ষেপে, এই আমার আজকের বক্তৃতা।

বিমূঢ় ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারটা প্রাঞ্জল করে দিয়েছিলেন অচিরেই ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক কষে।

সেই রাতেই আরও বৃহৎ, আরও স্পষ্ট, আরও ঝকঝকে হয়ে উঠল নতুন তারা। একটু দেরিতেই আবির্ভূত হল আকাশে। দ্যুতিময় নীলচে হয়ে উঠল কালো আকাশ। আলোর দাপটে একে একে অদৃশ্য হয়ে গেল লিও প্রমুখ অনেক নক্ষত্র–বৃহস্পতিকেই কেবল দেখা গেল মাথার ওপর। নবাগতের চারধারে জ্যোতির্বলয়ের মতো নিষ্প্রভ আলোকচ্ছটা। নিরক্ষীয় অঞ্চলের পরিষ্কার আকাশে তার আয়তন চাঁদের আয়তনের চার ভাগের এক ভাগ। ইংল্যান্ডের মাটি ছুঁয়ে রয়েছে কুয়াশা তখনও–কিন্তু গোটা পৃথিবী উদ্ভাসিত হল অত্যুজ্জ্বল চাঁদের আলোয়। শীতল পরিষ্কার আলোয় স্পষ্ট পড়া গেল ছাপা হরফ। হলদে ম্যাড়মেড়ে হয়ে উঠল শহরের বাতিগুলো।

জেগে রইল তামাম দুনিয়ার মানুষ। গির্জায় গির্জায় বাজল ঘণ্টা, দেবালয়ে উপাসনালয়ে শুরু হল প্রার্থনা–অনেক পাপ করেছ পৃথিবীর মানুষ, আজ রাতে আর ঘুমিয়ো না, আর পাপ করো না। এসো, বন্দনা কর নতুন তারাকে। নতুন তারা তখন মুহূর্তে মুহূর্তে আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে–ভীমবেগে ধেয়ে আসছে যেন পৃথিবীর দিকেই।

তাই ঘুম এল না কারও চোখে। ভিড় করে দাঁড়িয়ে রইল ছাদে, রাস্তায়, জাহাজের ডেকে। এক-এক সেকেন্ডে জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড পেরিয়ে আসছে কয়েকশো মাইল। গণিত গুরুর ভবিষ্যদ্বাণী আর কারও অজানা নেই। আগন্তুকের লক্ষ্য সূর্য। নেপচুনকে কোলে নিয়ে মহাবেগে সোজা ছুটছে সূর্যের দিকে। পৃথিবীর কয়েক লক্ষ মাইল দূর দিয়ে বেরিয়ে যেত, যদি না বৃহস্পতির টলটলায়মান অবস্থা না দেখা যেত। সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতি। তার পাশ দিয়েই আসতে হবে আগন্তুককে। প্রচণ্ড আকর্ষণের ফলে কক্ষ্যচ্যুতি ঘটবে বৃহস্পতির–উপবৃত্তের আকার নেবে কক্ষপথ। নতুন তারাও সোজা পথ থেকে একটু বেঁকে গিয়ে ছুটবে সূর্যের দিকে যাওয়ার পথে হয় আছড়ে পড়বে পৃথিবীর ওপর, নয়তো এত গা ঘেঁষে যাবে যে, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, জলপ্লাবন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সাইক্লোন মিলেমিশে মহাপ্রলয় ডেকে আনবে পৃথিবীর বুকে।

গণিত-গুরুর এহেন ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়ে তুলতে যাচ্ছে মাথার ওপর ওই শীতল জ্বলন্ত একক তারকা।

সারারাত চেয়ে থেকে যারা চোখ টনটনিয়ে ফেলল, তারা কিন্তু স্পষ্ট দেখল, শনৈঃ শনৈঃ এগচ্ছে দুরন্ত তারকা। আবহাওয়াও পালটে গেল সেই রাতেই। মধ্য ইউরোপ, ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের বরফ নরম হয়ে এল বাতাস গরম হয়ে ওঠায়।

গণিত-গুরুর কথা কিন্তু সবাই মেনে নিতে পারেনি। পৃথিবীর সব মানুষ ভয়ে কাঠ হয়ে থাকেনি। প্রতি দশজনের মধ্যে একজন উৎকণ্ঠিত থেকেছে–বাকি নজন স্বাভাবিক জীবনযাপন করে গেছে–আকাশের উৎপাত নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এক হাজার সালেও নাকি এমনি উদ্ভট ভবিষ্যদ্বাণী শোনা গিয়েছিল। তারপরেও অনেকে এমনি বুক-কাঁপানো শেষের সেদিনের বার্তা শুনিয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। এখনও কিছু হবে না। যে আসছে, সে নক্ষত্র নয়–নিছক ধূমকেতু, গ্যাসের পিণ্ড। নক্ষত্রও যদি হত, পৃথিবীকে ধাক্কা মারতে তার বয়ে গেছে। সুতরাং আজগুবি তত্ত্বকথা নিয়ে বেশির ভাগ মানুষই বাজে সময় নষ্ট করতে চাইলে না। তাচ্ছিল্য করল গণিত-গুরুর সাবধানবাণীকে। ডুবে রইল যে যার কাজে। এমনকী অপরাধীমহলও আবার তৎপর হল অপরাধ অনুষ্ঠানে। দু-একটা কুকুরের ডাক ছাড়া পশুজগৎও মাথা ঘামাল না নতুন তারাকে নিয়ে।

গণিত-গুরু বলেছিল, সেই রাতেই গ্রিনউইচ সময়ের ৭টা ১৫ মিনিটে, বৃহস্পতির সবচেয়ে কাছে আসবে নতুন তারা।

সন্ধে হল। যথাসময়ে আগন্তুককে দেখা গেল ইউরোপের আকাশে। এক ঘণ্টা পরেও আকার বাড়ল না তার। শুরু হয়ে গেল হাসি আর টিটকিরি। হায়! হায়! গণিত-গুরুর এত অঙ্ক শেষে বৃথাই গেল! বিপদ তো কেটে গেছে, দেখাই যাচ্ছে।

তারপরেই মিলিয়ে গেল হাসি। আবার বাড়ছে তারার আকার। আগের চাইতেও দ্রুত। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বড় হচ্ছে ঘণ্টায় ঘন্টায়। থেমে থাকার কোনও লক্ষণই নেই। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঔজ্জ্বল্য। মাথার ওপর খ-বিন্দুতে আসার পর যেন দিনের আলো ছড়িয়ে গেল মর্তে। বৃহস্পতির টানে বাঁকা পথে না এলে পাঁচ দিনের পথ একদিনেই ছুটে আসত। বাঁচিয়ে দিয়েছে বৃহস্পতি। কিন্তু এখন? পরের রাতেই ইংরেজরা দেখলে, চাঁদের তিন ভাগের এক ভাগ আয়তন নিয়েছে আগন্তুক তারা, বরফ গলে যাওয়া আর চোখের ভুল নয় –ঘটনা। আমেরিকার আকাশে নতুন তারা আবির্ভূত হতেই আঁতকে উঠল দেশের লোক। সর্বনাশ! এ যে চাঁদের মতোই বড় হয়ে উঠেছে। কিন্তু চাঁদের মতো ঠান্ডা তো নয়। গনগনে সাদা চোখ মেলে চেয়ে থাকাও যাচ্ছে না। নিদারুণ উত্তাপে গরম বাতাস ঝড়ের মতোই বইতে শুরু করেছে এর মধ্যেই। ভার্জিনিয়া, ব্রাজিল আর সেন্ট লরেন্স উপত্যকায় শুরু হয়ে গেল বজ্রবিদ্যুৎ, শিলাবৃষ্টি। মানিকতাবায়ে বরফ গলে গিয়ে শুরু হল বন্যা। চিরতুষার গলতে শুরু করল পৃথিবীর সব কটা উঁচু পাহাড়ে। বরফ-গলা জল গাছ-পশু-মানুষ ভাসিয়ে নেমে এল সমতলভূমির দিকে নদীগুলোর দুকূল ছাপিয়ে–প্রাণ নিয়ে ছুটল সমতলের মানুষ।

আর্জেন্টিনা থেকে দক্ষিণ আটলান্টিক উপকূল বরাবর জলোচ্ছ্বস এত উঁচুতে ঠেলে উঠল, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। বহু জায়গায় প্রবল ঝড় ঠেলে নিয়ে গেল জলকে ভূখণ্ডের অনেক ভেতর পর্যন্ত–ডুবিয়ে দিল শহরের পর শহর। দারুণভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেল রাত্রে। ফলে, সকালবেলার সূর্যকে মনে হল যেন নিছক একটা ছায়া। শুরু হল ভূমিকম্প। বেড়ে চলল পলকে পলকে। শেষকালে আমেরিকা থেকে আরম্ভ করে মেরুবৃত্ত হয়ে কেপ হন পর্যন্ত বিরাট অঞ্চলের প্রতিটি পাহাড়-পর্বতে ধস নামল, মাটি চৌচির হয়ে ফেটে গেল, বাড়িঘরদোর ধূলিসাৎ হল। কোটোপাক্সির পুরো পাশটা দুমড়ে-মুচড়ে যেন বিষম যন্ত্রণায় পিছলে যাওয়ার ফলে তোড়ে বেরিয়ে এল লাভাস্রোত, ঠেলে উঠল অনেক উঁচুতে এবং বিশাল অঞ্চল জুড়ে বেগে ধেয়ে গিয়ে একদিনেই পৌঁছে গেল খোলা সমুদ্রে।

নিবু নিবু অবস্থায় চাঁদ যখন উঁকি দিল আকাশে, আগন্তুক তারার দাপট তখন চলেছে গোটা প্রশান্ত সাগরীয় অঞ্চলে। পেছনে টেনে আনছে ঝড়বিদ্যুৎকে। সেই সঙ্গে উত্তাল হয়ে উঠছে জলরাশিফঁসে উঠে জলোচ্ছ্বাসের আকারে ঝাঁপিয়ে পড়ছে একটার পর একটা দ্বীপে মানুষশূন্য করে ছাড়ছে প্রতিটি দ্বীপকে। চোখধাঁধানো দ্যুতি যখন অসহ্য হয়ে উঠেছে, যখন গরমে চামড়া পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, যখন মনে হচ্ছে, লক্ষ চুল্লি জ্বলছে আকাশে-বাতাসে–তখন পঞ্চাশ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস গজরাতে গজরাতে নারকীয় ক্ষুধা নিয়ে আছড়ে পড়ল এশিয়ার সুদীর্ঘ উপকূলের ওপর এবং অগ্নিনিঃশ্বাসের মতো ঝড়ের ঠেলায় ভীমবেগে ঢুকে পড়ল চীন দেশের সমতলভূমিতে। সূর্যের চাইতেও বিরাট আর জ্বলন্ত হয়ে উঠেছে তখন আগন্তুক তারকা, সূর্যের চাইতেও লেলিহান এবং তপ্ত মুহূর্তের জন্য প্রলয়ংকর সেই রূপ দেখল চীনের মানুষ। দেখল প্যাগোডা, মহীরুহ, রাস্তা, চাষের মাঠ থেকে আকাশের আতঙ্ক আকাশ পুড়িয়ে ধ্বংস করে চলেছে বিশাল চীন। দেশকে–অন্য কোনও দেশে এত মানুষ নেই, যা আছে চীন দেশে। দেশসুদ্ধ মানুষের ঘুম উড়ে গেল চোখ থেকে। আকাশের বিভীষিকা ক্ষণেকের জন্যে দেখে আঁতকে উঠতেই-না উঠতেই চাপা গজরানির শব্দে রক্ত জল হয়ে গেল প্রত্যেকের–এল প্রবল জলোচ্ছাস। পালিয়ে যাবে কোথায়? উত্তাপে চামড়ায় ফোঁসকা পড়ছে, তপ্ত বাতাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে নেওয়ায় ফুসফুস জ্বলে যাছে, তারপরেই ওই কালান্তক জলোচ্ছ্বাস-পঞ্চাশ ফুট উঁচু। এল অতর্কিতে, মৃত্যু ঢেলে দিয়ে গেল আচম্বিতে। নিষ্প্রাণ হয়ে গেল চীন দেশ।

গনগনে অঙ্গারের মতো সাদা হয়ে গেল চীন দেশ, কিন্তু জাপান, জাভা আর পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলোর ওপর ম্যাড়মেড়ে লাল আগুনের বলের মতো দেখা গেল বৃহৎ তারকাকে উন্মত্ত আগ্নেয়গিরিগুলোর ছাই, বাষ্প আর ধোঁয়ার আবরণের মধ্যে দিয়ে। নতুন তারাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যেই এলাহি কাণ্ড আরম্ভ করে দিয়েছিল সব কটা আগ্নেয়গিরি একযোগে। মাথার ওপর লাভা, গরম গ্যাস আর ছাই–নিচে ফুঁসছে জল, মাটি কাঁপছে ভূমিকম্পে। দেখতে দেখতে গলে গেল হিমালয় আর তিব্বতের চিরতুষার। এক কোটি ধারায় ছেয়ে নেমে এল ব্রহ্মদেশ আর হিন্দুস্থানের ওপর। হাজারখানেক জায়গায় দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল ভারতের নিবিড় জঙ্গল। ধাবমান জলের মধ্যে দিয়েও দেখা গেল জায়গায় জায়গায় লেলিহান অগ্নিশি