- বইয়ের নামঃ সন্ধিক্ষণ : প্রতিকূলতা জয়ের লক্ষ্যে যাত্রা
- লেখকের নামঃ এ পি জে আবদুল কালাম
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
সন্ধিক্ষণ : প্রতিকূলতা জয়ের লক্ষ্যে যাত্রা
০. মুখবন্ধ / কৃতজ্ঞতা স্বীকার
সন্ধিক্ষণ : প্রতিকূলতা জয়ের লক্ষ্যে যাত্রা – এ পি জে আবদুল কালাম
অনুবাদ: ব্রততী সেন দাস
.
মুখবন্ধ
লেখা বই ‘অগ্নিপক্ষ’ ১৯৯২ সাল অবধি আমার জীবনকে বিবৃত করেছে। ১৯৯৯ সালে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর অভাবনীয় প্রতিক্রিয়া দেখা গেছিল এবং বইটির ১০ লক্ষের বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল। আরও উৎসাহজনক মনে হয় যে, হাজার হাজার মানুষের জীবনে এই বইটি এক ইতিবাচক প্রভাব এনেছিল ও তাদের জীবনকে উন্নততর করতে সাহায্য করেছিল।
আমি যখন ‘সন্ধিক্ষণ’ লিখছিলাম তখন আমার মনে ভাবনার উদয় হয়েছিল যে, কেন আমি বইটা লিখছি। কেউ হয়তো বলতে পারেন আমার কাহিনিতে অসংখ্য ভারতীয়র দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আমি আমার জীবনসিঁড়ির সর্বনিম্ন ধাপ থেকে শুরু করেছিলাম। আমার প্রথম চাকরি ছিল বরিষ্ঠ সহকারী বৈজ্ঞানিক সহায়কের। ক্রমে আমাকে অধিকতর দায়িত্বভার নিতে হয়েছিল এবং পরিশেষে ভারতের রাষ্ট্রপতির দপ্তরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলাম। গত শতকে অবশ্যই অজস্র ঘটনা ঘটেছিল এবং তারও বেশি ঘটনা স্মরণের প্রয়োজন আছে। বলা যেতে পারে এ এক অতি ঐকান্তিক অভিজ্ঞতা।
যাই হোক, ‘সন্ধিক্ষণ’ লেখার পেছনে আমার কারণগুলো একটু আলাদা ছিল। ‘অগ্নিপক্ষ’-এর দ্বারা যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল তাতে আমার মনে হয়েছিল এই বইটির দ্বারা সামান্য কিছু মানুষও যদি উপকৃত হন তাতে আমার প্রচেষ্টা সার্থক হবে। সত্যি বলতে কী, একজন মানুষ বা একটি পরিবারও যদি এই বই-এর ক্ষুদ্রাংশের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জীবনকে উন্নততর দিশায় নিয়ে যেতে পারেন আমি নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করব। প্রিয় পাঠক, অতএব এই বই আপনাদের উৎসর্গ করলাম।
এ পি জে আবদুল কালাম
৩০ মে, ১০১২
নিউ দিল্লি
.
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
প্রিয় বন্ধুগণ, আমার এখন আশি বছর বয়স এবং ঠিক এই মুহূর্তে আমি আমার একুশতম বই ‘সন্ধিক্ষণ’ সমাপ্ত করেছি। এর সূচনা হয়েছিল এক শীতের সকালে ১০, রাজাজি মার্গ, নিউ দিল্লিতে। আমি এবং আমার ব্যক্তিগত সচিব এইচ শেরিডন দু’জনে মিলে আমার ডায়েরি পড়ছিলাম। এবং আমরা দেখলাম আমার সম্পূর্ণ জীবনে সাফল্যলাভের ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রপতি দপ্তরভার পরিত্যাগকে অষ্টম বলে ধরা হয়, তবে এর আগে সাতটা সন্ধিক্ষণ বা চ্যালেঞ্জ আমার জীবনে এসেছিল।
আমার প্রতি যাঁরা সারাজীবন অকুণ্ঠ স্নেহ ও ভালবাসা জানিয়েছেন তাঁদের প্রতি আমি অসীম কৃতজ্ঞ। যাঁরা তাঁদের চ্যালেঞ্জ ও আনন্দ আমার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন তাঁদের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞতা বোধ করি। আমার বইয়ের পাঠকসমাজে এঁদের অন্তর্ভুক্ত করি। আমায় দুটি বইয়ের পাঠকসংখ্যা দশলক্ষ ছাড়িয়েছে এবং অন্য পাঁচটি বইয়ের পাঠকসংখ্যা ১০০,০০০ জনেরও বেশি। আমি সবার প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। বিশেষত আমার জীবনের ত্রিশ বছরের সাথি মেজর জেনারেল আর স্বামীনাথনকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। মেজর আমার জীবনের সমস্ত পর্যায়ে অজস্র সাফল্য এবং কতিপয় অসাফল্যের সাক্ষী। তিনি একজন সখা, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক। ‘সন্ধিক্ষণ’-এর বিস্তারিত বর্ণনা নির্ভুল রাখার ক্ষেত্রে তিনি এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই গ্রন্থটি বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার অন্তরালে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতিতে ধন শ্যাম শর্মা ও বিশাল রাস্তোগির নিরলস ও নিবেদিত প্রচেষ্টা রয়েছে। নারায়ণমূর্তি ও ভি পেনরাজের সূক্ষ্ম তথ্যনিবেশ আমার কাছে মূল্যবান। পাণ্ডুলিপি পর্যালোচনা এবং আমার সঙ্গে অবিরত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গ্রন্থ কাঠামো গড়ে তোলা ও নিখুঁত সম্পাদনার জন্য হারপার কলিন্সের কৃষ্ণণ চোপরার কাছে আমি গভীরভাবে ঋণী। অতি স্বল্পসময়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি টাইপ করে বইটি মুদ্রণালয়ে পাঠানোয় সাহায্য করার জন্য রাজিন্দর গাঞ্জুকেও ধন্যবাদ জানাই।
০১. কবে আমি একটি ভারতের গান গাইতে পারব?
১. কবে আমি একটি ভারতের গান গাইতে পারব?
‘প্রকৃতিকে ভালবাসো এবং তার আশীর্বাণীর মূল্য দাও,
তবেই তুমি ঈশ্বরত্বকে সর্বত্র খুঁজে পাবে।’
সেদিনটা ছিল ২৪ জুলাই, ২০০৭ সাল। আমার রাষ্ট্রপতিপদের কার্যকালের শেষ দিন। দিনটা আগাগোড়া নানা আনুষ্ঠানিক কার্যসূচিতে পূর্ণ ছিল। সেদিন সকালবেলা আমি আমার ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত ছিলাম। পরে, বেলার দিকে তিনটে পঁচিশ থেকে সিএনএন-আইবিএনের তরফ থেকে রাজদীপ সরদেশাই এবং দিলীপ ভেঙ্কটরামনের সঙ্গে ছোট একটা সাক্ষাৎকারের আয়োজন ছিল। এর পরেই ছিল ছত্তিশগড়ের রাজ্যপাল ই এস এল নরসিংহনের সঙ্গে একটা মিটিং। তারপরে আমার উত্তরাখণ্ডের স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রী ড. রমেশ পোখারিয়াল ‘নিশাঙ্ক’-এর সঙ্গে দেখা করার ছিল। এ ছাড়াও ছিল— দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কুমারী করিশ্মা থাঙ্কাপ্পন, তাঁর বাবা-মা ও আরও পাঁচজনের সঙ্গে আমার একটা মিটিং, পরে বিকেল চারটে নাগাদ বৈদেশিক মন্ত্রকের প্রোটোকল প্রধান সুনীল লাল ও তাঁর স্ত্রী গীতাঞ্জলি মেয়ে নীতিকাকে নিয়ে দেখা করতে এসেছিলেন। এরকম নানা বিদায়কালীন সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার চলেছিল রাত আটটা অবধি।
সেসময় আমায় ভাবী রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করতে হয়েছিল।
সবরকম বিদায় সংবর্ধনা, সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা এবং আমার সামান্য ক’টি জিনিসপত্র দুটি সুটকেসে গোছানোর তদারকি করা— আমি বলে রেখেছিলাম ও-দুটোই শুধু আমি সঙ্গে নেব, এর মধ্যে বাতাসে যেন কোনও অব্যক্ত ভাবনা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। যারা যারা আমার সঙ্গে দেখা করেছে বা কথা বলেছে একটা প্রশ্ন তাদের সকলের মনে উঁকি মেরেছে যে, আমি এরপর কী করব? তা কি আমি চিন্তা করেছি? আমি কি আবার শিক্ষকতায় ফিরে যাব নাকি আমার সক্রিয় জীবন থেকে অবসর নেব? আমায় যে চেনে তার কাছে শেষের কথাটা অসম্ভব বলে মনে হবে। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি ভবনের শেষ পাঁচটা বছর আমার মনে ভীষণ সজীব। মুঘল গার্ডেনের ফুল দিয়ে আমায় অভ্যর্থনা জানানো আমার আজও মনে আছে। যে বাগানে ওস্তাদ বিসমিল্লা খান তাঁর শেষ অনুষ্ঠান করেছিলেন। এরকম অসংখ্য গুণী শিল্পী ওখানে গানবাজনা করে মানুষকে আনন্দ দান করেছিলেন। বাগানের সুন্দর সুবাস, নৃত্যরত ময়ূর, গ্রীষ্মের দাবদাহে প্রখর-দীপ্ত সূর্যের নীচে বা কনকনে শীতের দংশনে কর্তব্যে অবিচল প্রহরী আমার দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল। এই পাঁচ বছরে কী সমৃদ্ধ জীবন-অভিজ্ঞতা!
জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষজন দেশের উন্নতির জন্য নানা ধ্যানধারণার কথা আমায় শুনিয়েছে। তারা একে অপরকে ছাপিয়ে বলতে চেষ্টা করেছে যে, কীভাবে তারা দেশের জন্য নিজেদের যথাসাধ্য দিয়েছে। প্রতিটি স্তরের রাজনীতিকরা তাঁদের নির্বাচন ক্ষেত্রের উন্নতির জন্য নিজেদের চিন্তাভাবনার কথা আমায় জানিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা জরুরি বিষয়গুলির সমাধানের জন্য সুতীব্র আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ভারতবর্ষের প্রতি তাঁদের ভালবাসা গুণী শিল্পী এবং লেখকরা সুললিত ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। ধর্মীয় নেতারা এক সাধারণ মঞ্চ থেকে ধর্মীয় সামঞ্জস্য এবং অভিন্ন মনের কথা বলেছেন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা এক জ্ঞানসমাজ গড়ে তুলতে নিজেদের চিন্তা ভাগ করে নিয়েছেন। আইন এবং বিচার বিভাগ প্রায়শই নানা সাম্প্রতিক বিষয়, যেমন— সর্বসাধারণের প্রতি পক্ষপাতহীন বিচারব্যবস্থা, অমীমাংসিত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও ই-জুডিশিয়ারি বিষয়ে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। যখনই কোনও অনাবাসী ভারতীয়র সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে তাঁরা জন্মভূমি ভারতবর্ষের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য কিছু করতে চেয়েছেন।
দেশের নানা প্রান্তে ঘুরতে পারা, আমায় এক অনন্য অভিজ্ঞতার আস্বাদ দিয়েছে— বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের চাওয়া-পাওয়া, আকাঙ্ক্ষা আমি বুঝেছি। বুঝেছি কত ভাল কাজ হয়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা, উপলব্ধি করেছি যৌবনের অপরিসীম শক্তিকে।
চিকিৎসাশাস্ত্র সংক্রান্ত ক্ষেত্রে আমার বিস্তারিত যোগাযোগ, সেটা প্রত্যন্ত গ্রামের প্রতিটি মানুষের কাছে উপযুক্ত চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছনো হোক বা গবেষণায় উৎসাহ প্রদান, প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন সহজতর করা হোক বা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের প্রতি যত্নশীল হওয়া বা প্রতিষেধক স্বাস্থ্য পরিষেবার বার্তা প্রচারই হোক, সর্বত্র।
দেশে বা বিদেশে যে নার্সদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে তাঁরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে উন্নতমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র স্থাপন করেছেন, বিশেষত গ্রামবাসীদের জন্য।
কৃষক, বিশেষত দুঃস্থ তুলো-চাষিদের সঙ্গে আমার আলাপ হওয়ার দরুন তাঁদের সমস্যা এবং যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তাঁরা হয়েছিলেন তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাঁরা আমার ভাবনাগুলো সূত্রাকারে সাজাতে এবং কৃষিবিজ্ঞানীদের কাছে পেশ করতে সহায়তা করেছিলেন।
ডাকবাহক বা পোস্টম্যানদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার আমার মনে এই ভাবনা উসকে দিয়েছিল যে, ডাকসংযোগ ব্যবস্থা জ্ঞানসমাজে এক মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, যেখানে পোস্টম্যান গ্রামে-গঞ্জে জ্ঞান-আধিকারিক হতে পারেন।
পুলিশবাহিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পুলিশ বিভাগের সংস্কারের নানা পরিকল্পনার কথা আমায় জানিয়েছিল। পুলিশ স্টেশনের পরিকাঠামোর উন্নয়ন এবং পুলিশি ক্রিয়াকলাপে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ ইত্যাদি পরিকল্পনা, যা আমি পুলিশ বিভাগ পুনর্গঠন ফোরামে ভাগ করে নিয়েছিলাম।
পঞ্চায়েত সভাধিপতি, বিশেষত মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানরা গ্রামীণ উন্নয়ন ও বিকাশের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং বিশ্লেষণ করেছিলেন তাঁদের কী কী প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হয়।
যত জায়গায় আমি গেছি, সেখানকার শিক্ষকরা আমায় এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তাঁদের লক্ষ্য হল দেশগঠনের জন্য যুবসমাজকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। তাঁরা বলেছিলেন, তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করবেন যুবক-যুবতীদের মধ্যে সেই মূল্যবোধ জ্ঞাপন করার, যা তাদের আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক করে গড়ে তুলবে।
এসমস্ত সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা শপথ পরিকল্পনায় একত্রে জড়ো করা হয়েছিল, যা সমাজের বিভিন্ন অংশের দ্বারা গৃহীত আকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপের সংক্ষিপ্তসার। তা শিশু, অভিভাবক, শিক্ষক, সেনাকর্মী, প্রশাসন বিভাগের কর্মী, আইনজীবী, ডাক্তার, নার্স বা অন্যান্য যে-কেউ হোক না কেন। শপথের পরিচালনা এমনভাবে হয় যাতে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে আন্তঃক্রিয়া ঘটে। সাধারণত শপথে সমাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা প্রাসঙ্গিক পাঁচ, সাত বা দশটি বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত হয়। শপথ গ্রহণের সময় স্বাভাবিকভাবে অনেক মানুষ একত্রিত হন এবং শপথের কথাগুলি পাঠ করা সমস্ত শ্রোতাদের এক সাধারণ সূত্রে গ্রন্থিত করে। তাঁদের এমন কিছু মর্মবাণী দেওয়া হয় যা তাঁরা আজীবন বহন করতে পারেন।
আমি যখন রাষ্ট্রপতি ছিলাম তখন যে বিপুল পরিমাণ চিঠিপত্র, ই-মেল বা ওই ধরনের অন্যান্য বার্তা আসত তা দেখে আমি আশ্চর্য না হয়ে পারতাম না। কার কাছ থেকে না-আসত! বাচ্চা, যুবসমাজ, বয়স্ক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী সবার কাছ থেকে। অবিশ্বাস্যভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার চিঠি আসত। প্রতিটি চিঠির উত্তর দেওয়া বা প্রতিটি সাহায্যপ্রার্থীকে উপযুক্ত সাহায্য করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমরা চেষ্টা করতাম। বহু ক্ষেত্রে চিঠি নির্দিষ্ট বিভাগে, নির্দিষ্ট পদাধিকারীর কাছে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য পাঠাতাম। যদি কোনও চিকিৎসা সংক্রান্ত ঘটনা হত, আমরা উপযুক্ত হাসপাতালের খোঁজ জানাতাম। ক্ষেত্র বিশেষে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম যথার্থ উপদেশ বা পরামর্শ দেবার। এমনকী সামান্য আর্থিক সহায়তাও দেবার চেষ্টা করেছি। চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশের মানুষের আশা, বিশ্বাস এবং ইতিবাচক মনোভাবের যে পরিচয় পেতাম তা আমায় খুব আশ্চর্য করত। এর পাশাপাশি অবশ্যই যন্ত্রণাভোগ, বেদনা এবং দারিদ্র্যের বিশাল বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছিল। একজন তরুণীর লেখা একটা চিঠি আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। ওর পরিবার যে বিশেষ আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত সেকথা ও চিঠিতে জানিয়েছিল। আমি ওর লেখার মধ্যে একটা উদ্দীপনার আভাস পেয়েছিলাম এবং মনে হয়েছিল ওর জীবনের পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা আছে। আমরা চিঠিটা এক যোগ্য ব্যক্তিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম যার ফলে বিষয়টি একটি আশ্চর্যজনক পরিণতি হয়েছিল। চিঠিতে লেখা ছিল—
‘আমার পরিবার ভীষণ অশান্তির মধ্যে আছে। গত তেইশ বছর ধরে নানা সমস্যায় আমার পরিবার জর্জরিত। এমন একটা দিন নেই যেদিন আমি বা আমার পরিবার এক মুহূর্তের জন্য সুখের মুখ দেখেছি। আমি পড়াশোনায় ভাল ছিলাম— আমার সেন্টারে পঞ্চম শ্রেণিতে আমি প্রথম হয়েছিলাম। আমি ডাক্তার হতে চাইতাম কিন্তু পরে আর কখনও আমি প্রথম হইনি, সবসময় দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান পেতাম। বি এ পরীক্ষায় আমি মাত্র ৫০% নম্বর পেয়েছি। আমি ডাক্তারিতে ভর্তি হতে পারিনি, কেননা সবসময় আমি নানা সমস্যার চাপে থাকতাম। চোদ্দো বছর ধরে আমার এইভাবে কাটছে…।’
এ ধরনের অজস্র চিঠি আসত। রাষ্ট্রপতি দপ্তরের সাহায্য করার ক্ষমতার ওপর মানুষের বিশ্বাস, তাদের সততা এবং কপটতাহীনতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করত।
এর বিপ্রতীপে বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান থেকে আসা চিঠিপত্রও ছিল— ‘প্রিয় রাষ্ট্রপতি কালামজি, আমরা অ্যাডভান্সড ন্যানো টেকনোলজির ওপর (বা অন্যান্য কোনও বিশিষ্ট বিষয়, যেমন— জীব বৈচিত্র্য, কার্বন কম্পোসিটস, মহাকাশযাত্রা পুরশ্চালন প্রযুক্তি, কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি, সংক্রমণশীল রোগ আদালতে অমীমাংসিত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির কৌশল বা বৈদ্যুতিন শাসনপ্রক্রিয়া) একটা অধিবেশনের আয়োজন করেছি। এবং আমরা আশা করছি যে আপনি মূল বক্তব্য রাখুন…’ অবশ্যই এগুলোর উত্তর দেওয়া অনেক সহজতর ছিল আমার কাছে— কারণ এগুলো শুধুমাত্র তারিখনির্ভর এবং বিষয়টি সম্বন্ধে আমার জ্ঞান সম্পর্কিত। জীবনের সফল হওয়ার জন্য একটা সুযোগ প্রত্যাশী তরুণী এবং আধুনিক প্রযুক্তি অধিবেশন উভয়েই বিশেষ দুটি দিক যা ২০২০-এর ভারতবর্ষর উদ্দেশে বলা প্রয়োজন।
এইসব ভাবনাচিন্তা থেকে আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমার এর পরে কী করা উচিত? আমার কি উচিত শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করা, নাকি অন্য কিছুর চেষ্টা করা? স্থির করতে পারছিলাম না। একটা মূল ঘটনা সেদিন কাজটাকে একটু সহজতর করে দিয়েছিল— জাতির উদ্দেশে আমার বিদায়ী ভাষণের প্রস্তুতি।
আমি ঠিক করেছিলাম— বিদায়ী ভাষণে আমি ভারতবর্ষের সমস্ত নাগরিককে ধন্যবাদ জানাব এবং তাঁদের সঙ্গে ভারতের উন্নয়নের রেখাচিত্র সম্বন্ধে মত আদানপ্রদান করব। যা গত পাঁচ বছরে তাঁদের সঙ্গে এবং তাঁদের জন্যই বিকশিত হয়েছে।
মূল কথা, আমি তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলাম— আমার প্রিয় নাগরিকবৃন্দ আমাদের দেশের লক্ষ্য উপলব্ধি করে আসুন সকলে মিলে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার সংকল্প করি। আমাদের দেশের লক্ষ্য হল সমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ এবং সুখী হওয়া ও নিরবচ্ছিন্নভাবে উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া, যেখানে গ্রামীণ আর নাগরিক বিভাজন একটা সূক্ষ্মরেখায় পর্যবসিত হয়— প্রশাসন যেখানে সংবেদনশীল, পরিচ্ছন্ন এবং দুর্নীতিমুক্ত হয়। উন্নত ভারতবর্ষের জন্য দশ দফা রেখাচিত্রের মধ্যে আরও অন্য কিছু বিষয় আমি কল্পনা করেছিলাম, সেগুলি এই বইতে বলেছি।
আমার জীবনের ব্রত হল, ভারতবর্ষের মতো বহু সংস্কৃতি সম্পন্ন সমাজের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ও মনন উন্নয়নের দশটা স্তম্ভের মধ্য দিয়ে সংযোগ স্থাপন করা এবং ‘আমরা করতে পারি’ এই আত্মবিশ্বাস মানুষের মধ্যে প্রোথিত করা।
২০২০ সালের আগেই ভারতবর্ষকে এক উন্নত দেশ তৈরি করার যে মহান ব্রত নেওয়া হয়েছে তা সফল করার জন্য হে নাগরিকবৃন্দ আমি সবসময় আপনাদের সঙ্গে থাকব।
.
কিছু ঘটনা আমার দিগন্তকে আলোকিত করেছিল। আমার মুখে হাসি ফুটিয়েছিল, আমায় শিক্ষাদান করেছিল এবং দেশের মানুষের ভালবাসা আমায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছিল।
০২. আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নবম ভাষণ
২. আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নবম ভাষণ
যুবসমাজের প্রজ্বলিত মন পৃথিবীতে,
পৃথিবীর ওপরে এবং গভীরে সবচেয়ে শক্তিশালী মূলধন।
জামগাছের ওপর একটা হলুদ পাখির গানে আমার প্রতিদিনকার প্রাতঃকালীন ভ্রমণ ভীষণ আনন্দজনক হয়। এক জোড়া ধনেশ পাখি মাঝে মাঝে আমার বাগানে উড়ে আসে, তাদের দিকে আমি নজর রাখার চেষ্টা করি। রাষ্ট্রপতি ভবনের পর আমার বাসস্থান এখন দশ রাজাজি মার্গ। আমায় বলা হয়েছিল নিউ দিল্লির স্থপতি এডউইন লুটিয়েন্স একসময় এখানে বাস করতেন। সময় বাতাসের বেগে এগিয়ে চলে, আমাকে দেশে-বিদেশে শিক্ষকতা আর গবেষণায় ব্যস্ত রাখে। তরুণসমাজের যে উদ্দীপনা আর অটল সংকল্প আমি ক্লাসরুমের ছাত্রদের মধ্যে দেখেছি তা আমার মধ্যেও উৎসাহ ছড়ায়।
উন্নত ভারতের লক্ষ্য উপলব্ধি করার উদ্দেশ্যে মানুষের আবেগমথিত আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ শেষ কিছু বছরে আমি পেয়েছি, জেনেছি ক্ষমতানুযায়ী নিজেদের নিবেদন করার প্রতিজ্ঞার কথা। যখন আমি পুরনো দিনের কথা চিন্তা করি আর রাষ্ট্রপতি পদে থাকাকালীন দিনগুলোর কথা ভাবি, কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়, যা এই বৈচিত্র্যময় দেশের বিচিত্র বৈশিষ্ট্যর সঙ্গে ঐতিহ্যমণ্ডিত অতীত এবং চ্যালেঞ্জিং বর্তমানের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু একটা বার্তা সুস্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত : ভারতবর্ষ ২০২০ সালে এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ের অপূর্ব সুন্দর পরিবেশে ১০ জুন, ২০০২-এর সকালটা অন্যান্য যে-কোনও দিনের মতো ছিল। ওখানে আমি ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে কাজ করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল, প্রশান্ত পরিবেশে গবেষণার প্রজেক্ট এবং শিক্ষকতায় যুক্ত অধ্যাপক এবং কৌতূহলী ছাত্রদের সঙ্গে কাজ করে সময়টা আমি সুন্দরভাবে উপভোগ করছিলাম। আমার ক্লাসে ষাটজন ছাত্রের অনুমোদন ছিল। কিন্তু প্রতিটি লেকচার চলাকালীন ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা সারে তিনশো ছাড়িয়ে যেত এবং কোনওভাবে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা যেত না। আমার উদ্দেশ্য ছিল যৌবনের আকাঙ্ক্ষাকে উপলব্ধি করা, নানা ধরনের জাতীয় মিশন থেকে লব্ধ আমার অভিজ্ঞতা বণ্টন করা এবং স্নাতকোত্তর ছাত্রদের জন্য বিশেষভাবে পরিকল্পিত দশ লেকচারের কোর্সের মাধ্যমে সামাজিক রূপান্তরের জন্য প্রযুক্তির প্রয়োগের কার্যসাধন পদ্ধতি উন্মোচন করা।
জাতীয় মিশন বলতে আমি কী বোঝাতে চাই? আমি বলছি মহাকাশযান নিক্ষেপ, SLV-3, Ig MDP (Integrated Guided Misile Development Programme), 1998 পারমাণবিক পরীক্ষা এবং TIFAC (Technology Information, Forecasting and Assesment Council) দ্বারা প্রস্তুত India ২০২০ রিপোর্ট-এর কথা। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের উন্নয়নে এবং বৃদ্ধির বিকাশপথে এসব পরিমাপ যোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। SLV-3 প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল ৪০ কিলোগ্রাম ওজনের রোহিণী উপগ্রহকে পৃথিবীর সন্নিবিষ্ট কক্ষপথে স্থাপন করার জন্য দেশীয় উপগ্রহের উৎক্ষেপণ। উপগ্রহটির উদ্দেশ্য ছিল আয়ন-মণ্ডলীয় পরিমাপ নেওয়া। লক্ষ্য ছিল IgMPD দ্বারা জাতীয় প্রতিরক্ষার শক্তির বহুবিধ মিসাইল পদ্ধতির চাহিদা পূরণ করা হবে। রণকৌশলগত এবং রণনীতিগত, উভয়ভাবেই। ‘অগ্নি-৫’ ক্ষেপণাস্ত্র এর শেষতম সাফল্য। ১৯৯৮ সালে ১১ এবং ১৩ মে-তে এই পারমাণবিক পরীক্ষা সম্পাদিত হয়েছে। এইসঙ্গে ভারতবর্ষ পারমাণবিক সশস্ত্র দেশ হিসেবে পরিগণিত হল। ২০২০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার দিকনির্দেশিক ভারতের সৃষ্টি করতে TIFAC সফল হল।
আমার নবম লেকচারের নাম ছিল ‘লক্ষ্যের স্বপ্ন’ বা লক্ষ্যের প্রতি সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি (Vision to Mission)। এতে বেশ কিছু ঘটনা পর্যবেক্ষণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। যখন লেকচার শেষ করেছিলাম, আমায় অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল এবং ক্লাসে আমার পড়ানোর সময় এক ঘণ্টা থেকে বেড়ে দু’ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছিল। লেকচারের পরে আমার অফিসে ফিরলাম অন্যান্য দিনের মতো এবং গবেষক ছাত্রদের সঙ্গে লাঞ্চ সারলাম। পাচক প্রসঙ্গম হাসিমুখে আমাদের সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করেছিল। দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের পরে আমি পরের ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম এবং তারপর সন্ধেবেলায় আমার ঘরে ফিরলাম।
আমি যখন ফিরছিলাম আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য, অধ্যাপক এ কালানিধি আমার সঙ্গ নিলেন। তিনি জানালেন আজ সারাদিনে আমার অফিসে অগুনতি টেলিফোন এসেছে এবং কেউ একজন পাগলের মতো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছিলেন। যে মুহূর্তে আমার ঘরে পৌঁছলাম, শুনলাম আমার ফোন বাজছে। ফোন তুলে জবাব দিতেই অপর প্রান্তের কণ্ঠস্বর বলল, ‘প্রধানমন্ত্রী আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’ আমি যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য প্রতীক্ষারত তখনই অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু আমার সেলফোনে ফোন করলেন। তিনি আমায় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে একটা জরুরি ফোনের প্রতীক্ষায় থাকতে বললেন এবং সে-সঙ্গে যোগ করলেন, ‘দয়া করে আপনি না বলবেন না।’
আমি যখন চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে কথা বলছি, অটলবিহারী বাজপেয়ীর টেলিফোন তখনই এল। তিনি বললেন, ‘কালাম, আপনার অধ্যাপনার জীবন কেমন চলছে?’
‘দুর্দান্ত,’ আমি জবাব দিলাম।
বাজপেয়ীজি বললেন, ‘আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংবাদ আছে। এক্ষুনি আমি বিশেষ অধিবেশন থেকে আসছি যেখানে সমস্ত জোট-পার্টির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। আমরা সর্বসম্মতভাবে বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, আপনাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের প্রয়োজন আছে। আমায় আজ রাত্রের মধ্যে ঘোষণা করতে হবে। আমি আপনার সম্মতি চাই। শুধু শুনতে চাই একটা ‘হ্যাঁ,’ কোনও ‘না’ নয়।’ এ প্রসঙ্গে আমায় বলতে হবে, বাজপেয়ীজি সেসময় এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক অ্যালায়েন্স) বা জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের নেতৃত্বদান করছিলেন। এই জোটে প্রায় দু’ডজন দল অন্তর্ভুক্ত ছিল যাদের ঐক্যমত পাওয়া সবসময় বেশ সহজ ব্যাপার ছিল না।
ঘরে প্রবেশ করার পর বসার সময় পর্যন্ত আমি পাইনি। ভবিষ্যতের নানা ধরনের দৃশ্যকল্প আমার সামনে ভেসে উঠল। তারমধ্যে একটা হল, আমার চারধারে ছাত্র এবং শিক্ষকদের ভিড়। অন্যটায় আমি সংসদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছি দেশের জন্য স্বপ্ন নিয়ে। আমার মনের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হল। আমি বললাম, ‘বাজপেয়ীজি, (সাধারণত তাঁকে আমি এই নামেই সম্বোধন করতাম) আপনি আমায় বিবেচনার জন্য দু’ঘণ্টা সময় দিতে পারেন? এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে আমার মনোনয়নের জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যও প্রয়োজন।’
বাজপেয়ীজি বললেন, ‘আপনার সম্মতি জানার পরে আমরা ঐকমত্যের জন্য এগোব।’
পরের দু’ঘণ্টায় আমি হয়তো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের তিরিশটা টেলিফোন কল করে বসেছিলাম। তাঁদের কেউ হয়তো শিক্ষাবিভাগের, কেউ সিভিল সার্ভিসে বা কেউ কেউ রাজনীতিতে যুক্ত। একটা দৃষ্টিভঙ্গি আমার মনে দাগ কাটল যে, আমি একটা অধ্যাপনার জীবন উপভোগ করছি, যাতে আমার প্রবল উৎসাহ আর ভালবাসা তাতে বিঘ্ন ঘটানো উচিত হবে না। আর দ্বিতীয়টি হল, সংসদ এবং জাতির সামনে ইন্ডিয়া ২০২০ স্বপ্নকে তুলে ধরার এই সৌভাগ্য আমার দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করা উচিত। পাক্কা দু’ঘণ্টা পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ হলে আমি বলেছিলাম, ‘বাজপেয়ীজি আমি মনে করি এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য এবং আমি সর্বদলের প্রার্থী হতে চাই।’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, সেজন্য আমরা চেষ্টা করব, ধন্যবাদ।’
খবরটা খুব দ্রুত ছড়িয়ে গেল। পনেরো মিনিটের মধ্যে আমার রাষ্ট্রপতি পদ প্রার্থনা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে অজস্র টেলিফোন কলে আমি জর্জরিত হয়ে পড়লাম, আমার সুরক্ষা আরও বাড়িয়ে তোলা হল এবং বিশালসংখ্যক দর্শনপ্রার্থী আমার ঘরে ভিড় জমালেন।
সেই দিনই বাজপেয়ীজি শ্রীমতী সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে পদপ্রার্থী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করলেন। যখন শ্রীমতী গাঁধী প্রশ্ন করলেন এনডিএ-র বাছাই কি চূড়ান্ত, প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচক জবাব দিলেন। তাঁর দলের সদস্য এবং জোটসঙ্গী দলের সঙ্গে প্রত্যাশিত মন্ত্রণা গ্রহণের পরপর শ্রীমতী গাঁধী আমার প্রার্থীপদে আইএনসি-র (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস) সমর্থন ঘোষণা করলেন ২০০২ সালের ১৭ জুন। বামপন্থী দলের সমর্থন পেলে আমি খুশি হতাম কিন্তু তারা নিজেদের প্রার্থীকে মনোনীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যে মুহূর্তে আমি রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য সম্মত হলাম সঙ্গে সঙ্গে আমার সম্পর্কে নানা লেখা বিপুল সংখ্যায় বেরোতে লাগল। প্রচারমাধ্যমে অনেক প্রশ্ন দেখা দিল। সারমর্ম হল, কীভাবে একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি, বিশেষত একজন বিজ্ঞানী, জাতির রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হতে পারেন— এই ছিল তাঁদের প্রশ্ন।
রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে আমার মনোনয়নপত্র পেশ করার পর ১৮ জুন প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হল। সাংবাদিকরা আমায় নানা প্রশ্ন করেছিলেন গুজরাত নিয়ে (এই রাজ্য দাঙ্গাহাঙ্গামার দরুন নজরে এসেছিল এবং কীভাবে মোকাবিলা হয়েছিল সে সম্পর্কে উদ্বেগ ধরা পড়েছিল।) অযোধ্যা বিষয়ে (রামজন্মভূমি তো সবসময় সংবাদের বিষয়), পারমাণবিক পরীক্ষা এবং রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকাকালীন আমার পরিকল্পনা নিয়ে। আমি উল্লেখ করেছিলাম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে এক শিক্ষিত রাজনৈতিক শ্রেণির প্রয়োজন যাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল ভিত্তি হবে সহানুভূতি। অযোধ্যা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, প্রয়োজন শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য অনেক কমে আসবে। আমি অঙ্গীকারও করেছিলাম রাষ্ট্রপতি ভবনের জাঁকজমক ও গৌরবের মধ্যে সারল্য বজায় রাখব। রাষ্ট্রপতি হিসেবে যে-কোনও জটিল বিষয়ে দেশের নেতৃত্বস্থানীয় সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করব। রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার মতো বিষয়ে কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ কী চাইছে তার পরিবর্তে দেখা হবে মানুষ কী চায়।
আমি যখন ১০ জুলাই চেন্নাই থেকে এশিয়াড ভিলেজে আমার ফ্ল্যাটে ফিরলাম, তখন প্রস্তুতি জোরকদমে শুরু হয়ে গেছে। ভারতীয় জনতা দলের প্রমোদ মহাজন আমার নির্বাচন-প্রতিভূ ছিলেন। আমি আমার ফ্ল্যাটে একটা ক্যাম্প বা অস্থায়ী দপ্তর বসিয়েছিলাম। ফ্ল্যাটটা যদিও বিশাল কিছু ছিল না, কিন্তু এর মধ্যে রদবদলের কিছু সুবিধা ছিল। আমি দর্শনার্থীদের জন্য একটা ঘর বানিয়েছিলাম, অধিবেশনকক্ষটি ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হল। পরে একটা ইলেকট্রনিক ক্যাম্প অফিসও গড়ে তোলা হয়েছিল— তারপর থেকে সমস্ত তথ্য বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রেরণ করা হত। একটা চিঠির খসড়া করা হয়েছিল সাংসদদের জন্য। লোকসভা এবং রাজ্যসভা উভয়ের সদস্যদের জন্য লেখা চিঠির সংখ্যা প্রায় ৪০০-র কাছাকাছি ছিল। এই চিঠিতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও সেই সঙ্গে আমাকে ভোট দেবার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। মহাজনের পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে ব্যক্তিগতভাবে কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করেও প্রতিটি রাজ্যের নির্বাচন মণ্ডলীর কাছে আমার চিঠি পাঠিয়ে দিতে পারি। এটা কার্যকর হওয়ায় ১৮ জুলাই বিপুল সংখ্যাধিক্য ভোটে আমাকে জয়ী ঘোষণা করা হল।
সারাদিন ধরে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাক্ষাৎ প্রার্থনার নদী বয়ে গিয়েছিল। আমার নিজস্ব চিঠিপত্র লেখালেখি আর ভ্রমণের পাশাপাশি ছিল প্রচারমাধ্যমে সাক্ষাৎকার প্রদান। বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভাল লাগত, সময় থাকলে নানা বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া শুনতাম। এশিয়াড ভিলেজের ৮৩৩ নং ফ্ল্যাটটি কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ২৫ জুলাই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের অতিথি তালিকা তৈরি করা এক বিভ্রান্তিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। সংসদের সেন্ট্রাল হলে মাত্র ১০০০ জনের স্থান সংকুলান সম্ভব। সংসদের সদস্য, রাজ্যসভা-লোকসভার অফিস বেয়ারা, স্বরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মন্ত্রীসভার আমলা, বিদায়ী রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণনের অতিথিদের বাদ দিলে আর মাত্র ১০০ জনের জায়গা হতে পারে। যা টেনেটুনে ১৫০ মতো করা হয়েছিল। সেই ১৫০ জনের মধ্যে কে থাকবে সে এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। পারিবারিক বন্ধুর সংখ্যাই ৩৭। তার মধ্যে আমার পুরনো পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অধ্যাপক চিন্নাদুরাই যেমন ছিলেন, তেমনি মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যাপক কে ভি পানদালাই, রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পক্ষীভেঙ্কট সুব্রাহ্মনিয়ম শাস্ত্রীগল, রামেশ্বরম মসজিদের ইমাম নুরুল খুদা, রামেশ্বরম চার্চের রেভারেন্ড এ জি লিওনার্ড এবং অরবিন্দ আই ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা চক্ষু বিশারদ ডা. জি ভেঙ্কটস্বামীও ছিলেন। অতিথিদের মধ্যে আরও ছিলেন নৃত্যশিল্পী সোনাল মান সিং, ছিলেন শিল্পপতি, সাংবাদিক এবং ব্যক্তিগত বন্ধুরাও। খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে আমার অতিথি তালিকায় দেশের বিভিন্ন প্রদেশের ১০০ জন শিশুকে আনা হয়েছিল। তাদের জন্য আলাদা করে জায়গার ব্যবস্থা ছিল। বড়দের নিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের দেখাশোনার জন্য। সে দিনটা বেশ গরম ছিল কিন্তু প্রত্যেকে ঐতিহাসিক সেন্ট্রাল হলের অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য বিধিসম্মত আনুষ্ঠানিক পোশাক পরিধান করেছিলেন।
.
আমার দেশের সরল মানুষগুলোর অকপটতার সঙ্গে প্রাজ্ঞতা আমার মনে সবসময় এমন বিশ্বাস আনে যে, একদিন বিশ্বকে শান্তি আর সমৃদ্ধির দোরগোড়ায় পৌঁছতে আমার দেশ নেতৃত্ব দেবে।
০৩. আমার জীবনের সাতটি সন্ধিক্ষণের মুহূর্ত
৩. আমার জীবনের সাতটি সন্ধিক্ষণের মুহূর্ত
“তুমি সমস্যার অধিনায়ক হও, সমস্যাকে পরাজিত করো এবং সফল হও।”
আমি শিক্ষকতা আর গবেষণা ভালবাসি কারণ আমি কখনওই পুনরাবৃত্তিতে ক্লান্ত হই না। আমার ভাবনার, উদ্ভাবনের কেন্দ্রে অধ্যয়নজীবন অবস্থান করে। যুবসমাজ এবং তাঁদের শিক্ষকদের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান আমার অন্তরাত্মার খোরাক। অধ্যয়ন বিষয়ক জীবন এবং গবেষণাক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন করার একটা সিদ্ধান্ত আমি সচেতনভাবে নিয়েছিলাম।
কিছু আগেই বলেছি, ঘটনার আকস্মিক মোড় কীভাবে আমায় দেশের রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করতে প্রণোদিত করেছিল, যদিও আমি নিজেকে অভিজ্ঞ অধ্যয়ন বিষয়ক কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। আমার মনে ছয়টি ঘটনার স্মৃতি বারবার ফিরে আসে যা আমার জীবনপ্রবাহকে বদলে দিয়েছিল। কেউ হয়তো যোগ করতে পারেন, রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে দেশে-বিদেশের অধ্যয়ন বিষয়ক জীবনে নবীন উত্তরণ হিসেবে আমার পুনরাগমন।
আমার জীবনের প্রথম সন্ধিক্ষণ আসে ১৯৬১ সালে। আমার আজও মনে আছে এডিই-র (Aeronautical Development Establishment) বরিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক সহায়ক হিসেবে আমি একটা হোভারক্রাফ্ট-এর মূল পরিকল্পক ছিলাম। ‘নন্দী’ নামক হোভারক্রাফট্টি সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল এবং আমরা বহু দর্শনার্থীর সামনে তার উড়ান প্রদর্শন করেছিলাম। এটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। একদিন এডিই-র অধিকর্তা ড. গোপীনাথ মেদিরাত্তা একজন অতিথিকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন— লম্বা সুদর্শন এবং শ্মশ্রুশোভিত ভদ্রলোক। তিনি যন্ত্রটি সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন। তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আমায় হোভারক্রাফ্টে করে একবার ঘুরিয়ে আনতে পারবেন?’
আমরা ক্রাফ্টে দশ মিনিটের একটা উড়ান দিলাম। হোভারক্রাফ্ট নামের সার্থকতা বজায় রেখে ভূমির ঠিক কয়েক সেন্টিমিটার ওপরে শূন্যে সেটি ভাসমান থাকল। আমি যানটির চালক ছিলাম যা অতিথিকে আশ্চর্য করেছিল। তিনি আমাকে আমার সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন, তারপর ধন্যবাদ জানিয়ে প্রস্থান করলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য নিজের পরিচয় জানিয়ে গিয়েছিলেন— তিনি ছিলেন অধ্যাপক এম জি কে মেনন, টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অধিকর্তা। এর এক সপ্তাহ পরে আমি ICSR (Indian Committee for Space Research যা পরে Indian Space Research Organization বা ISRO হয়েছিল) থেকে একটা ডাক পেলাম রকেট ইঞ্জিনিয়ার পদের ইন্টারভিউ-এর জন্য।
ইন্টারভিউ-এর জন্য বম্বে গিয়ে আমি অধ্যাপক বিক্রম সারাভাই-কে দেখতে পেয়ে অবাক হয়েছিলাম, তিনি ICSR-এর সভাপতি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এইসি অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন (Atomic Energy Commission)-র উপসচিব অধ্যাপক শরাফ এবং অধ্যাপক মেনন। আমি অধ্যাপক সারাভাই-এর উষ্ণ ব্যবহারে মোহিত হয়েছিলাম। তিনি আমার জ্ঞান এবং দক্ষতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা না করে বরং নানা প্রশ্নের মাধ্যমে আমার মধ্যেকার পরিপূর্ণ সম্ভাবনার উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন। তিনি যেন বিশাল কোনও পূর্ণতার পরিপ্রেক্ষিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এই সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি আমার কাছে এক মুহূর্তের সত্য, যাতে আমার স্বপ্ন এক মহান ব্যক্তির মহৎ স্বপ্নের দ্বারা আলিঙ্গনাবদ্ধ ছিল।
পরের দিন, সন্ধেবেলা জানানো হল আমাকে নির্বাচন করা হয়েছে। ১৯৬২ সালে নবগঠিত ইসরো-তে আমাকে রকেট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিযুক্ত করা হল। যেখানে আমার জীবনে মহত্তর ঘটনা সংঘটিত হল, যখন অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান ভারতের প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষেপণযান প্রোগ্রামের প্রোজেক্ট অধিকর্তা হিসেবে নেতৃত্বদানে আমাকে আহ্বান করলেন।
১৯৮২ সালে, মুসউরিতে DIWS-র (Defence Institute of Work Study যা এখন Institute of Technology Management-এ পরিণত হয়েছে) ড. রাজা রামান্নার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর ভারতের মিসাইল প্রোগ্রামে প্রবেশ আমার জীবনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। DIWS হল একটা প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রতিরক্ষাবাহিনীর আধিকারিকদের প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া পরিচালনে প্রশিক্ষিত করা হয়ে থাকে— এক বিশাল ক্ষেত্র যেখানে বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন আছে। যেহেতু আমি SLV-3 প্রোগ্রামের প্রজেক্ট অধিকর্তা ছিলাম তাই আমার ডাক পড়ল DIWS-এ, একগুচ্ছ বক্তৃতার জন্য। কীভাবে প্রথম ভারতীয় উপগ্রহ উৎক্ষেপণযান রোহিণীকে কক্ষপথে স্থাপন করেছিল সেটার একটা প্রেজেন্টেশন তৈরি করলাম। ড. রামান্না বক্তৃতা দিয়েছিলেন, ১৯৭৪ সালে কীভাবে তিনি ভারতের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন।
বক্তৃতা শেষে আমরা দু’জনেই দেরাদুন বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। ওখানে একদল বিজ্ঞানীর সঙ্গে বসে চা পান করেছিলাম। যখন আমরা দেরাদুনে, ড. রামান্না আমাকে হায়দরাবাদের প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং উন্নয়ন গবেষণাগার বা DRDL (Defence Research and Development Laboratory)-র অধিকর্তার পদে গ্রহণ করতে চাইলেন। DRDL মিসাইল সিস্টেম উন্নয়নের মূল গবেষণাগার এবং সেটা প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং উন্নয়ন সংগঠনের (Defence Research and Development Organization বা DRDO)-র অন্তর্ভুক্ত। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটা গ্রহণ করলাম কেননা বরাবরই আমি মহাকাশযান প্রযুক্তিকে মিসাইল প্রযুক্তিতে প্রয়োগ করতে চাইতাম। কিন্তু আমার পরবর্তী লক্ষ্য হল আমার অধ্যক্ষ ইসরো-র সভাপতি অধ্যাপক ধাওয়ানের মনে প্রত্যয় জাগানো।
অনেকগুলো মাস চলে গেছিল। ইসরো এবং ডিআরডিও-র মধ্যে চিঠির আদানপ্রদান হয়েছিল। প্রতিরক্ষা সংগঠনের সচিবালয় (Secretarial of Defence Organizations) এবং মহাকাশ বিভাগে (Department of Space) পারস্পরিক সুবিধাজনক ক্রিয়ার পাঠক্রম শুরু করার জন্য অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। সেসময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আর ভেঙ্কটরামনের বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ভি এস অরুণাচলম মন্ত্রী এবং অধ্যাপক ধাওয়ান-এর মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছিলেন। এই আলাপ-আলোচনার ওপর ভিত্তি করে ১৯৮২-র ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে DRDL-এর অধিকর্তা হিসেবে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল।
১৯৯২ সালের জুলাই মাসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং সচিবের প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং উন্নয়ন বিভাগের (Department of Defence Research and Development) বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে আমি ড. অরুণাচলমের হাত থেকে দায়িত্বভার গ্রহণ করলাম। আমার জীবনের এটা তৃতীয় সন্ধিক্ষণ। ১৯৯৩ সালে আমাকে তামিলনাড়ুর তৎকালীন রাজ্যপাল ড. চেন্না রেড্ডি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। আমি সরকারকে অনুরোধ করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নিয়োগের অনুমোদন দিতে, যা আমি পরে বাষট্টি বছর বয়সে গ্রহণ করতে পারি। যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও ছিলেন, বলেছিলেন আমার পক্ষে বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টারূপে কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত, কারণ আমি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম। এখানে যোগ করতে চাই যে, আমি বহু বছর নরসিংহ রাও-এর সঙ্গে কাজ করেছি এবং দেখেছি, রাও প্রতিরক্ষা বিষয়ে ভীষণ সজাগ। বিশেষত দেশীয় প্রতিরক্ষা সক্ষমতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। প্রতিরক্ষা প্রয়োগের জন্য শক্তপোক্ত প্রক্রিয়া গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর এক সুদূরমেয়াদি লক্ষ্য ছিল। সুতরাং প্রায় সত্তর বছর বয়স অবধি আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টারূপে কাজ করে গেছি।
আমার জীবনের চতুর্থ সন্ধিক্ষণ হল ১৯৯৮ সালের পারমাণবিক পরীক্ষা। এর পেছনে একটা কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনি আছে। আমরা ১৯৯৬-এর মে মাসে ফিরে যাই, ওই বছর নির্বাচন হয়েছিল— ফল ঘোষিত হওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে নরসিংহ রাও-এর পরিচয় হয়েছে। তিনি আমায় বলেছিলেন, ‘কালাম, তুমি তোমার টিম নিয়ে পারমাণবিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হও। আমি এখন তিরুপতি যাচ্ছি। পারমাণবিক পরীক্ষায় অগ্রসর হওয়ার জন্য আমার অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করো। ডিআরডিও-ডিএই টিমগুলো কর্মপ্রক্রিয়ার জন্য যেন নিশ্চয় তৈরি থাকে। তিরুপতিতে তাঁর যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল সুফলের আশায় ঈশ্বরের আশীর্বাদ কামনা। যাই হোক, তিনি যা অনুমান করেছিলেন নির্বাচনের ফলাফল তার চাইতে অন্যরকম হয়েছিল। কংগ্রেসের আসনসংখ্যা সরাসরি ১৩৬-এ নেমে এল। বিজেপি এবং তার জোট দল বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ক্ষমতায় এল কিন্তু মাত্র দু’সপ্তাহের জন্য। তৃতীয় ফ্রন্টের এইচ ডি দেবেগৌড়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। যাই হোক, যে দু’সপ্তাহ বাজপেয়ী সরকার ক্ষমতায় ছিল তারমধ্যে পারমাণবিক পরীক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল।
তখন রাত ন’টা। ৭ নং রেসকোর্স রোড থেকে একটা টেলিফোনে আমাকে অনুরোধ করা হল যেন অবিলম্বে নতুন প্রধানমন্ত্রী এবং বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী রাও-এর সঙ্গে দেখা করি। রাও আমায় বললেন, পারমাণবিক কার্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা বাজপেয়ীজিকে জানাতে, যাতে নতুন সরকারের কাছে এই গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপের মসৃণ হাতবদল ঘটে।
এর বছর দুয়েক পরে বাজপেয়ীজি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। ১৯৯৮ সালের ১৫ মার্চের মাঝরাতে আমি ওঁর কাছ থেকে একটা টেলিফোন পেলাম। জানালেন তিনি মন্ত্রীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করছিলেন এবং আমাকে তিনি তাঁর ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করতে চান। আমি জবাব দিয়েছিলাম যে, চিন্তা করার জন্য আমার কিছু সময়ের প্রয়োজন। তিনি পরদিন সকাল ন’টায় ওঁর সঙ্গে আমায় দেখা করতে বললেন। ফলে, ওই মাঝরাতে আমি আমার কিছু বন্ধু জড়ো করে ফেললাম এবং আমার ক্যাবিনেটে যোগ দেওয়া উচিত হবে কি না এ নিয়ে প্রায় ভোর ৩-টে অবধি আমাদের তর্কবিতর্ক চলল। সাধারণ মত হল, যেহেতু আমি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দুটো মিশনে সম্পূর্ণভাবে জড়িত এবং দুটোই অন্তিম পর্যায়ে ও সার্থকতার সম্মুখীন সুতরাং এই অবস্থায় ওগুলো ছেড়ে রাজনীতির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা আমার উচিত হবে না।
পরদিন, ৭ সফদরজং রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আমি পৌঁছেছিলাম। তিনি বসার ঘরে আমায় অভ্যর্থনা জানিয়ে প্রথমে ঘরে তৈরি মিষ্টি খেতে দিলেন। তারপর আমি তাঁকে বললাম, ‘আমি এবং আমার টিম দুটো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে খুব ব্যস্ত। একটা হল অগ্নি মিসাইল প্রক্রিয়া প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়টি হল ডিএই ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জি (Department of Atomic Energy)-র অংশীদারিত্বে একগুচ্ছ পরীক্ষার মাধ্যমে পারমাণবিক প্রক্রিয়া শেষ করা। আমি মনে করি এই দুটি কার্যক্রমে সম্পূর্ণভাবে আবিষ্ট থেকে আমি আমার দেশকে আরও বেশি কিছু নিবেদন করতে পারব। অনুগ্রহ করে আমায় কাজ চালানোর অনুমতি দিন।’
প্রত্যুত্তরে বাজপেয়ীজি বললেন, ‘আমি আপনার মনোভাবের প্রশংসা করি, আপনি এগিয়ে যান, ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।’ এরপর অনেক ঘটনা ঘটেছিল। ‘অগ্নি’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রক্রিয়ার অভিষেকের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল, পাঁচটি পারমাণবিক পরীক্ষা পরপর নির্বাচিত হয়েছিল এবং ভারতবর্ষ পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছিল। আমার ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার দরুন দুটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কার্যক্রমে নিজেকে নিবেদন করতে সক্ষম হয়েছিলাম যা দেশকে অভূতপূর্ব ফলদান করেছিল।
আমার জীবনের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এল ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে। আমাকে ভারত সরকারের মুখ্য বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা বা পিএসএ (প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইসার) হিসেবে নিযুক্ত করা হল, যা ক্যাবিনেট মন্ত্রী পদের সমকক্ষ। আমার টিমে ছিলেন ড. ওয়াই এস রাজন, বৈদ্যুতিন তথ্য বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ড. এম এস বিজয়রাঘবন যিনি আমার সঙ্গে TIFAC-এ কাজ করেছিলেন এবং আমার ব্যক্তিগত সচিব এইচ শেরিডন— আমি বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা থাকাকালীন যিনি আমার দপ্তরের আধিকারিক ছিলেন। যখন কর্মভার হাতে নিলাম তখন আমাদের কোনও দপ্তর ছিল না, কিন্তু আমরা পরে বানিয়ে নিয়েছিলাম। এরজন্য ডিআরডিও-কে ধন্যবাদ জানাই, বিশেষত ডিআরডিও-র অসামরিক কার্য এবং আবাসন বিভাগের মুখ্য নির্বাহিক কে এন রাই, ডিআরডিও-র আর অ্যান্ড ডি-র মুখ্য নিয়ন্ত্রক মেজর জেনারেল আর স্বামীনাথনের অক্লান্ত প্রচেষ্টার কথা বলতে হবে। ইন্ডিয়া ২০২০ ভিশন সরকার দ্বারা গৃহীত হয়েছে যদিও এই লেখার কর্মপ্রক্রিয়াকেন্দ্রিক পরিকল্পনার এগিয়ে দেবার ক্ষেত্রে প্রধান বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা দপ্তর যোগ্য মঞ্চ হয়ে উঠেছিল বলে আমি মনে করি। এই ভিশন বা স্বপ্ন প্রথম দেবগৌড়া সরকার থাকাকালীন পরিবেশিত হয়েছিল। এরপর আই কে গুজরাল প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং ১৯৯৮ সালে আবার বাজপেয়ী ফিরে এলেন। তিন সরকারই এই সুপারিশ বাস্তবায়িত করায় জোর দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানভবন অ্যানেক্সে আমাদের দপ্তর ছিল। সেটা একটা বিশাল বিল্ডিং যেখানে অসংখ্য তথ্যানুসন্ধান সংস্থা এবং কিছু সরকারি বিভাগও ছিল। শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ। সংলগ্ন বিজ্ঞানভবন অবশ্যই বিশালাকারের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য বিখ্যাত স্থল। অ্যানেক্সটি উপরাষ্ট্রপতির বাসভবনের ঠিক পাশেই ছিল, নর্থ ও সাউথ ব্লকের হইহট্টগোল ওখানে না থাকায় কাজ করার সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল।
যথারীতি ভ্রমণ আমার কার্যসূচির মধ্যে একটা বড় অংশ দখল করে ছিল। ২০০১ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর অল্পের জন্য হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে ফিরেছিলাম। ঝাড়খণ্ডের বোকারো স্টিল প্ল্যান্টে হেলিকপ্টার অবতরণ করার সময় দুর্ঘটনাটি ঘটে। আমরা অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছিলাম। লাফিয়ে নেমেই আমি বিমানচালক ও সহচালকের কাছে দৌড়ে গেছিলাম ও তাঁদের বলেছিলাম, ‘আমায় রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ, ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন।’ দু’জনের চোখে তখন জল। কিন্তু আমি তাঁদের বললাম, এরকম কখনও কখনও হয় তবে আমরা যা করতে পারি তা হল সমস্যা খুঁজে বার করা ও তার সমাধান করা। সেদিন সন্ধ্যায় আমার পাঁচটা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। আমায় সেখানে অভিভাষণ দিতে হয়েছিল। শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন বোকারো স্টিল প্ল্যান্টের বিশেষ দায়িত্বশীল পদাধিকারী, ইঞ্জিনিয়ার এবং কর্মীবৃন্দ এবং বোকারোর কিছু স্কুলের ছাত্রছাত্রী। বিমান দুর্ঘটনার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল— জাতীয় চ্যানেলগুলো খবরটা লুফে নিয়েছিল। যখন বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা হল, দেখলাম ঘটনাটি ওদেরকেও যেন নাড়িয়ে দিয়েছে। আমি ওদের সঙ্গে করমর্দন করলাম এবং নির্ভীকতার মন্ত্র উচ্চারণ করলাম, যা ওদের উৎফুল্ল করেছিল। সেটা ছিল নিতান্ত এক উদ্বুদ্ধ করার উপদেশ:
নীর্ভিকতা
অন্য কিছু ভাবার নির্ভীকতা,
উদ্ভাবন করার নির্ভীকতা,
অনাবিষ্কৃত পথে চলার নির্ভীকতা,
অসম্ভাব্য আবিষ্কারের নির্ভীকতা,
সমস্যা আর সাফল্যের দ্বন্দ্বে নির্ভীকতা,
এ সবই হল যৌবনের অনন্য নৈপুণ্য।
দেশের যুবসমাজ হিসেবে,
আমি কাজ করব এবং
লক্ষ্যে সফলতা পাবার জন্য সাহসের সঙ্গে কাজ করব।
ওই একই দিনে আর একটা মর্মন্তুদ উড়ান দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তাতে মাধবরাও সিন্ধিয়া, সাংবাদিক, ওঁর কর্মী এবং বিমানকর্মী-সহ ছয়জন ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন। দুটো খবরই রামেশ্বরমে আমার পরিবার এবং দেশে-বিদেশে ছড়ানো বন্ধুদের কাছে পৌঁছে গেছিল। আমি কেমন আছি জানার জন্য তাঁরা প্রত্যেকে ভীষণ উৎকণ্ঠিত ছিলেন। আমি সুস্থ আছি, সংবাদপত্রের মাধ্যমে এ খবর পেয়েও দাদার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই ওঁর সঙ্গে কথা বলে ওঁকে এবং পরিবারের সবাইকে আশ্বস্ত করতে হয়েছিল।
সেই সন্ধ্যায় আমি যখন দিল্লি পৌঁছলাম, বাজপেয়ীজির সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটা জরুরি বার্তা এসে পৌঁছল— আমি যেতেই তিনি অভ্যর্থনা জানিয়ে দুর্ঘটনা সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। আমায় সুস্থ দেখে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন। তারপর তিনি বললেন ইন্ডিয়া ২০২০ ভিশনের কাগজপত্র নিয়ে নেতৃস্থানীয় শিল্পপতি ও ক্যাবিনেটের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন এবং এর ওপর আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সংসদে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু আমি তাঁকে বললাম, এই কাজে অনেকগুলো বাধা আছে। কিছু ব্যাপার ছিল যা নিয়ে আমি ভাবনাচিন্তা করছিলাম।
ওই দুর্ঘটনার পরিণামে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। একটা হল আমার বই ‘Ignited Minds’ এর বীজরোপণ ও তার জন্ম— যার উদ্দেশ্য ছিল ‘আমি পারি’ এই আকাঙ্ক্ষা যুবসমাজে জাগিয়ে তোলা। এবং দ্বিতীয়টি হল নিজেকে আত্মিকভাবে পুনরুদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে আম্মা-মাতা অমৃতানন্দময়ীর সঙ্গে দর্শন করার জন্য রাঁচি থেকে কুইলন যাত্রা করা। ঘটনাক্রমে আমি রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হওয়ার ঠিক আগেই ‘Ignited Minds’ প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থটির শিরোনাম প্রচার মাধ্যমের খুব পছন্দসই বাক্যবন্ধ হিসেবে বারংবার আমার রাষ্ট্রপতি পদে অভিষেককালীন সংবাদে প্রচার করা হচ্ছিল। গ্রন্থটি অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছিল এবং এখনও সারা বছর ধরে বিক্রি হয়। আম্মা এক দেবতুল্য আত্মা, যিনি সামাজিক উন্নয়ন, বিশেষত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য আর অনাথ ও পতিতদের সহায়তায় নিজেকে নিমজ্জিত করেছেন। যে দুই বন্ধুর সঙ্গে আম্মার দর্শনে যাত্রা করেছিলাম, তাঁদেরকে আমি বলেছিলাম যে পিএসএ পদ থেকে পদত্যাগ করছি এবং প্রধানমন্ত্রীকে একটা পত্র পাঠিয়ে দিয়েছি। অতএব আমি নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে আম্মার সঙ্গে দেখা করলাম। ওঁর সঙ্গে আমি আমার ইন্ডিয়া ২০২০ ভিশনের কথা ও মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষার কথা আলোচনা করেছিলাম।
সময়টা ছিল ২০০১ সালের নভেম্বর মাস, পিএসএ বা মুখ্য বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে আমার ততদিনে দু’বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। চিঠিতে লিখেছিলাম আমি আবার আমার শিক্ষা বিষয়ক ক্ষেত্রে ফিরে আসতে চাই। অবশ্যই এর গভীরতর কারণ ছিল। আমার মনে হয়েছিল, আমি যে গ্রামীণ ক্ষেত্রে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান বা PURA (Providing Urban Amenities in Rural Areas) এবং ইন্ডিয়া ২০২০-র ব্যবস্থাপন পরিচালনা করছিলাম তা প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পাচ্ছিল না। কোথায় সমস্যার উদ্ভব হচ্ছিল? সু-সংহায়িত সময়োপযোগিতা, তহবিল এবং দায়িত্বভার সহযোগে যতদূর সম্ভব আমি প্রতিটা লক্ষ্য বা কার্যক্রমকে রূপায়ণ করতে পছন্দ করি। সামগ্রিকভাবে, সরকারি নিয়মতন্ত্রে এই ধরনের পরিবেশ পাওয়া বেশ কঠিন। কেননা অজস্র মন্ত্রী এবং সরকারি বিভাগ এবং তাদের নিজস্ব লক্ষ্য ও কার্যক্রমের দ্বারা মিশনের উদ্দেশ্য সম্পাদিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কৃষিক্ষেত্রে যদি কেউ প্রতি বছরে ৪% উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করে, সেজন্য তাকে জলসম্পদ, শক্তি, সার, রসায়ন, গ্রামীণ বিকাশ, পঞ্চায়েত রাজ, রেল (সার পরিবহণের জন্য) মন্ত্রক ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর সাহায্য নিতে হবে। এখানে সহায়ক সংগঠনগুলির কোনও স্বচ্ছ সাধারণ লক্ষ্য নেই। দ্বিতীয়ত পিএসএ-র সমন্বয়সাধনার, উপদেষ্টার ব্যাপক প্রসারিত ভূমিকা ছিল কিন্তু কোনও প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব ছিল না। এটা যে-কোনও মিশন সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কারণ।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার মেয়াদ কালের শেষ তিনমাসে দ্বিতীয়বার আমার প্রার্থীপদ নিয়ে বারবার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। আমি ততদিনে মনস্থির করে নিয়েছিলাম যে, শিক্ষকতায় আর ইন্ডিয়া ২০২০ ভিশনকে সার্থক রূপদান করতে প্রচার করব। হঠাৎ করে, জুলাই মাস এসে পড়তেই কংগ্রেসের শাসক দল পছন্দসই প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করল। বিরোধী দলের মনোভাব অন্যরকম ছিল। রাজনৈতিক কার্যকলাপে সারা দেশ জুড়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছিল। নদীর স্রোতের মতো বিভিন্ন দলের নেতারা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আবার একবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জনসাধারণ, প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং দেশের যুবসমাজের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে এবং ই-মেলের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি পদগ্রহণের জন্য অজস্র অনুরোধ এসেছিল। মনোনয়ন গ্রহণ শেষ হওয়ার ঠিক আগে একদল রাজনৈতিক নেতা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, যদি আমি নির্বাচনে প্রার্থী হতে রাজি হই তাঁরা সমস্ত দল থেকে এমনকী শাসকদল থেকে সমর্থন পাবেন।
আমি তাঁদের জানিয়েছিলাম, যদি অধিকাংশ দল রাজি থাকে তবে আমি প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা বিবেচনা করে দেখতে পারি। নেতারা ফিরে এসে জানালেন শাসক দল আমার প্রার্থীপদে রাজি নয়। কিন্তু তাঁরা আমার সাফল্য সম্পর্কে এতটা নিশ্চিত ছিলেন যে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আমায় পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলেন। সমস্ত দ্বিধা সরিয়ে দিয়ে আমি তাঁদের বলেছিলাম, যদি তাই হয় আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবই না কারণ আমি বিশ্বাস করি রাষ্ট্রপতি ভবনকে কোনও দলীয় রাজনীতির মধ্যে নিয়ে আসা উচিত নয়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও নেতারা রাজি হলেন। প্রেস বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আমি প্রার্থী হচ্ছি না। শিক্ষা বিষয়ক এবং গবেষণা বিষয়ক কর্মজীবনে ফেরার জন্য এবং ভারতবর্ষকে ২০২০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী দেশে রূপান্তর করার তীব্র আবেগ-সহ কাজ চালানোর ইচ্ছে থেকে আমি সচেতনভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
.
আমি সব সময় বিশ্বাস করি কাপুরুষ কখনও ইতিহাস রচনা করতে পারে না, ইতিহাস সৃষ্টি করে মানুষ, যাদের মধ্যে সাহস এবং প্রাজ্ঞতা আছে। সাহসিকতা একক, প্রাজ্ঞতা আসে অভিজ্ঞতা থেকে।
০৪. মতভাব বিনিময়কারী রাষ্ট্রপতি
৪. মতভাব বিনিময়কারী রাষ্ট্রপতি
সক্ষমতা নিজের অন্তর থেকে আসে,
ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ তা দিতে পারে না
রাষ্ট্রপতি পদগ্রহণ আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল। ইন্ডিয়া ২০২০ কে রূপদান করার ক্ষেত্রে এটা একটা মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। আমি বিশ্বাস করি দেশের সকল নাগরিকের যেমন, সংসদ-অভিমুখী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, প্রশাসক, শিল্পী, লেখক এবং দেশের যুবসমাজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একে অর্জন করা সম্ভব। এই মিশন বা লক্ষ্যের প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করানোর জন্য মুখোমুখি আলোচনাই সবচেয়ে শ্রেয় উপায়, যা অন্যের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকেও এর সঙ্গে সম্মিলিত করতে সাহায্য করবে।
রাষ্ট্রপতি পদ আমায় এই সুযোগ দিয়েছিল। আমি সরাসরি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, বিশেষত যুবসমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদেরকে দেশের জন্য এই লক্ষ্য কার্যে পরিণত হওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে পারছিলাম।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার ভূমিকার এটা একটা অতিরিক্ত উদ্দেশ্য ছিল। সাংবিধানিক ভূমিকানুযায়ী সরকার এবং বিধানমণ্ডলের প্রতিটি কার্য যাতে ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী সম্পাদিত হয় সে-ব্যাপার রাষ্ট্রপতি সুনিশ্চিত করবেন। সরকারের প্রতিটি কার্য ভারতের রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয়। সংসদে বিল ও অধ্যাদেশ পাশ হলে সরকার রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর অনুমোদনের জন্য আসে। এবং তাঁকে নিশ্চিত হতে হয় যে, সেই আইন সংক্রান্ত নথি সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের মঙ্গলসাধনে সক্ষম। তাঁকে আরও দেখতে হয় যে, পক্ষপাতদুষ্ট কার্যে পরিণত হওয়ার মতো কোনও পূর্বদৃষ্টান্ত যেন স্থাপিত না হয়।
আমি রাষ্ট্রপতি প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির মধ্যে যাব না। যদিও এগুলো সংবিধান, ঐতিহ্য এবং পূর্বদৃষ্টান্ত দ্বারা পূর্বনির্দিষ্ট, আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি শুধু দেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হয়ে না থেকে আরও অনেক কিছু করার অপেক্ষা রাখেন।
সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করবার সুযোগ আছে, সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগে অনুঘটকের কাজ করে উন্নয়নখাতে যেমন অর্জন সম্ভব। রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁকে ক্ষমতাসীন দল বা জোটের শক্তি ব্যক্তিগতভাবে মূল্যায়ন করতে হয়, যাতে তারা সংখ্যায় যথেষ্ট না হওয়ার দরুন যে-কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারে। রাজ্যপাল এবং তাঁদের রাজ্যসমূহের কার্যকলাপের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিচক্ষণ পরামর্শদান এবং সামরিক শক্তির সর্বাধিনায়ক হওয়ায় তাদের অনুকরণীয় অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে উদ্বুদ্ধ করতে হয়।
উপরন্তু, দেশের প্রধান হওয়ায় তিনি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। আমার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি ভবনকে আরও বেশি মানুষের সহজগম্য করে তোলা যাতে তা মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকে। মানুষকে নিজেদের দেশের বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির অন্যতম অংশ হিসেবে বিবেচনা করানোর এবং শাসনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত করানোর এই ছিল আমার পদ্ধতি। ফলে, রাষ্ট্রপতি হয়েও আমি মানুষের জীবনযাত্রার অঙ্গ ছিলাম এবং এই প্রতিষ্ঠানটি অনেক বেশি পারস্পরিক প্রভাব বিস্তারকারী ছিল।
প্রথম যে কাজগুলো আমি রাষ্ট্রপতি ভবনে শুরু করি তার মধ্যে অন্যতম হল ই-গভর্ন্যান্স চালু করা। ওখানে কম্পিউটার ব্যবহার করা হত কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সেই প্রণালীকে আরও আধুনিক করার প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে যে-সমস্ত নথি, দস্তাবেজ এবং চিঠিপত্র আসত আমরা একটা ব্যবস্থা নিয়েছিলাম যে, প্রথমেই সেগুলো ডিজিটাইজ়ড বা আঙ্কিক করা ও তাতে বার কোড বসানো। কাগজের নথিগুলো তারপর মহাফেজখানায় সংরক্ষিত হবে। তারপর থেকে নথি বৈদ্যুতিনভাবে বিভিন্ন সরকারি আধিকারিক, অধিকর্তা, সচিবের দপ্তরে, রাষ্ট্রপতির কাছে গুরুত্বানুসারে পাঠানো হত।
আমার এমন এক প্রক্রিয়ার স্বপ্ন ছিল যার দ্বারা রাষ্ট্রপতি ভবন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, সমস্ত রাজ্যপালের দপ্তর এবং নানা মন্ত্রকের সঙ্গে সুরক্ষিত মেসেজিং নেটওয়ার্কের দ্বারা, সঙ্গে G২G ই-গভর্ন্যান্স অপারেশনে সক্ষম ডিজিটাল সিগনেচার সংযুক্ত থাকে। আমরা প্রক্রিয়াটি পরীক্ষা করেছিলাম এবং সেটা প্রয়োগের জন্য তৈরি ছিল। আশা করা যায় একদিন আমার স্বপ্ন সত্যি হবে। যখন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের নয়টি বিভাগে আমরা বৈদ্যুতিন শাসনব্যবস্থা বা ই-গভর্ন্যান্স প্রয়োগ করলাম, পরীক্ষা করে দেখলাম এটা সত্যি কার্যকারিতা সহায়ক কি না। সাধারণত নাগরিকদের কাছ থেকে দরখাস্ত পাবলিক-১ বিভাগে দাখিল হত। একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কুড়িটা দরখাস্তের সাধারণত সাতদিন সময় লাগত, কিন্তু বৈদ্যুতিন শাসনব্যবস্থা বা ই-গভর্ন্যান্স চালু হওয়ার পর দেখা গেল চল্লিশটা দরখাস্তের ফয়সালা মাত্র ৫ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে যায়। আমি আশা করি বিভিন্ন রাজ্যে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে গেলে এই ব্যবস্থাগুলি যে কেউ দেখতে পাবেন।
রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালের প্রথম দিকে আমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রাতরাশকালীন আলোচনায় রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সংসদ সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো, যাতে আমি সেখানকার উন্নয়ন অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারি। ২০০৩ সালে এই বৈঠক ১১ মার্চ থেকে ৬ মে এই তিন মাস হয়েছিল। আমার মনে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।
প্রতিটা বৈঠকের উদ্দেশ্য পরিকল্পনামাফিক সাজানো হত। আমি এবং আমার সহযোগীরা তার জন্য বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় নিতাম। আমরা প্রতিটা রাজ্যের সামর্থ্য এবং উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটা গবেষণার ব্যবস্থা করতাম। প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি পরিকল্পনা কমিশন, কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারি বিভাগ, রাজ্যগুলির জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক দস্তাবেজ থেকে সংগ্রহ করা হত।
তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করে গ্রাফিক্স এবং মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে উপযুক্তভাবে পেশ করা হত। বৈঠকগুলোতে সংসদের সদস্যদের জন্য পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানানো হত তিনটি ক্ষেত্রের ওপর জোর দিয়ে। ১. উন্নত ভারতের স্বপ্ন ২. বিশেষ কয়েকটা রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের উত্তরাধিকার এবং ৩. তাদের মূল দক্ষতা।
উদ্দেশ্য ছিল দেশের উন্নতি অর্জনের জন্য লক্ষ্যের ওপর জোর দেওয়া। এইসমস্ত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে উন্নতি অর্জন অত্যন্ত জরুরি ছিল। এর ফলে চতুর্থ দিকটাও তৈরি করা হল— প্রতিটি রাজ্যর জন্য উন্নয়নসূচক নির্বাচন করা হল। সমস্ত দলের সংসদ সদস্যদের প্রস্তুতি এবং নিবেদনের দ্বারা কী অসামান্য সমৃদ্ধসাধন ঘটল। ওঁদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সমৃদ্ধি সম্বন্ধে উপলব্ধি করতে আমাকে সাহায্য করেছিল।
আমার প্রথম বৈঠক বিহার থেকে আগত সাংসদের সঙ্গে ছিল। প্রেজেন্টেশনের বিষয়ে সদস্যদের উদ্দীপনা দেখে আমি প্রবল উৎসাহিত হয়ে পড়লাম— প্রেজেন্টেশনে বিহার সম্পর্কিত জাতীয় উন্নয়নে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, রাজ্যের মূল দক্ষতা এবং কীভাবে রাজ্যকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব অন্তর্ভুক্ত হয়। সাংসদদের মনে হয়েছিল বৈঠক অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। ফলে আমরা প্রাতরাশকালীন আলোচনা ৬০ মিনিট থেকে বাড়িয়ে ৯০ মিনিট করেছিলাম। আমাদের সন্তোষজনক অভিজ্ঞতা হয়েছিল যখন বৈঠকে মীমাংসা হওয়ার পরেও বা প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হয়ে গেলেও অনেক সদস্য তাঁদের নিজেদের রাজ্যে প্রেজেন্টেশনের প্রযোজ্যতা নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এই বৈঠকগুলো নথিবদ্ধ করে রাখা হত।
ব্যক্তিগতভাবে আমি বৈঠকগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতাম। প্রতিটি অঞ্চলের চাহিদা আমার পক্ষে প্রকৃত শিক্ষা ছিল। এই প্রস্তুতি সাংসদদের আয়ত্তাধীন ক্ষেত্র থেকে পরিযোজনের দ্বারা সম্পূরিত হত। অনেক সদস্য আমায় এও বলেছিলেন, এই ধরনের বিস্তৃত প্রস্তুতি তাঁদের পক্ষে খুব কার্যকরী হয়েছিল। আসল কথা হল এই খুঁটিনাটি এবং আলোচনা রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালে বা পরবর্তী সময়ে আমার এবং সাংসদদের মধ্যে বিশেষ যোগাযোগবন্ধন হয়ে উঠেছিল। এখনও, যখন ওঁদের সঙ্গে আমার দেখা হয়, আমাদের কথোপকথন এবং আলোচনা উন্নয়নভিত্তিক হয়ে থাকে।
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাওয়া পরিযোজন-সহ ইন্ডিয়া ২০২০ ক্রমবিবর্তন আমাকে সমাজ সংক্রান্ত রূপান্তরের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে মনোনিবেশ করাত। প্রাতরাশকালীন বৈঠকে রাজ্যগুলির বিস্তারিত আলোচনা আমাকে উন্নয়নের জন্য পথপ্রদর্শনে অতিরিক্ত নিশ্চয়তা দিয়েছিল। সাংসদরা অনেক প্রয়োজনীয় ধারণার কথা আমায় জানাতেন। সংসদে অন্ততপক্ষে ন’বার আমি ২০২০ সালে ভারতের স্বপ্ন নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছি এবং বারোটা রাজ্য বিধানসভায় কোনও একটা বিশেষ রাজ্যের উন্নয়নের উপায় নিয়ে অভিভাষণ দিয়েছিলাম। প্রাতরাশকালীন বৈঠকে যে ধরনের প্রশ্ন ও পরামর্শ আমার কাছে আসত, তার দ্বারা রাজ্যগুলির উন্নয়নে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয়তাকে একত্রিত করার রাস্তা তৈরি হত, যেমন কর্মসংস্থান বাড়ানো, জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র সক্রিয়করণ, গ্রামীণ অঞ্চলের যোগাযোগের উন্নতিসাধন এবং আমার ডাটাবেস বা তথ্যসংগ্রহে শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষসাধন। আমি সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে যা বক্তব্য রেখেছিলাম তা এই ডাটাবেস-এ অন্তর্ভুক্ত ছিল। যখন আমি জাতীয় এবং রাজ্য বণিকসভা, শিল্প মহল, পরিচালন সংঘ, কারিগরি প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতাম তখন কীভাবে ইন্ডিয়া ২০২০ অর্জন করতে পারব সে-বিষয়ে উদাহরণযোগে ব্যাখ্যা করতে এই ডাটাবেস বা সূত্রসংগ্রহ সহায়ক হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে যুক্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় এই স্বপ্নের অংশ হিসেবে উন্নয়নের দশটা স্তম্ভের উদ্ভব ঘটেছিল। আজ আমি পেশাদার, বণিকনেতা এবং গবেষকদের উদ্দেশে বলি এই দশ স্তম্ভ অর্জন করতে কীভাবে তাঁরা উদ্ভাবনী ধারণা নিবেদন করতে পারেন, যেমন—
১. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে গ্রামীণ এবং নাগরিক বিভাজন এক ক্ষীণরেখায় অবনমিত হয়।
২. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে শক্তি এবং উৎকৃষ্ট জলের যথাযথ বণ্টন এবং যথেষ্ট অধিগম্যতা থাকে।
৩. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে কৃষি, শিল্প এবং সেবাবিভাগ এক ছন্দে কাজ করে।
৪. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে নৈতিক মূল্য সমম্বিত শিক্ষাব্যবস্থা সমাজ সংক্রান্ত বা অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে কোনও মেধাবী ছাত্রকে অস্বীকার করে না।
৫. এমন এক রাষ্ট্র যা প্রতিভাবান পণ্ডিত, বিজ্ঞানী এবং বিনিয়োগকারীর মূল গন্তব্য হয়।
৬. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় সবাই থাকে।
৭. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে শাসন বিভাগ দায়িত্বশীল, স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত হয়।
৮. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে দারিদ্র্য সম্পূর্ণ উৎপাটিত, অশিক্ষা দূরীভূত এবং নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে কোনও অপরাধ থাকবে না এবং সমাজের কেউ নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাববে না।
৯. এমন এক রাষ্ট্র যা সমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যবান, সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ, সুখী এবং এক নিরবচ্ছিন্ন বৃদ্ধির পথ অনুসরণ করে।
১০. এমন এক রাষ্ট্র যা অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবাসভূমি এবং যে রাষ্ট্র তার নেতৃত্বের জন্য গর্ববোধ করে।
কীভাবে দেশের নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে উন্নয়ন বিষয়ক আলোচনা করবেন তা এই প্রাতরাশকালীন বৈঠকে নির্ণয় করা হত। নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপতি ভবন হল একমাত্র স্থান যেখানে দলগত পার্থক্য মুছে গিয়ে সমস্ত সাংসদদের কাছে সম্পূর্ণ অখণ্ড রাষ্ট্ররূপে ধরা পড়ত।
রাষ্ট্রপতি ভবনে সাংসদদের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও দুটি সভার উদ্দেশে ভাষণের সুযোগ আমি দশবারের বেশি পেয়েছি।
ভাষণ ভাবগম্ভীর পরিবেশে হয়ে থাকে এবং সেন্ট্রাল হলের উপছে পড়া ভিড়ে আমার ভাষণের সময় পিন পতনের নৈঃশব্দ্য বিরাজ করত। সংসদের সঙ্গে আমার দু’ধরনের ভাবের আদানপ্রদান হত। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, পাঁচটা বাজেট বক্তৃতার মতো সম্পূর্ণ সরকারি বক্তৃতা আর অন্যটা হল আমার নিজস্ব ভাবনাচিন্তা, ধ্যানধারণাসমৃদ্ধ বক্তৃতা। সরকারি প্রেজেন্টেশনেও আমি আমার নিজস্ব কিছু ভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটাতাম যা আমি আলোচনা করতে চাইতাম। বাজপেয়ীজি এবং ড. সিং আমার পরামর্শ গ্রহণ করতেন।
দেশের প্রতি সাংসদদের কী ভূমিকা ও দায়িত্ববোধ থাকা উচিত সে বিষয়ে তাঁদের প্রভাবিত করতে আমি এই মঞ্চ ব্যবহার করতাম। ২০০৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক স্মারক অনুষ্ঠানে সাংসদদের উদ্দেশে ভাষণকালে আমি যে বার্তা দিয়েছিলাম তার দ্বারা স্ব-স্ব নির্বাচন ক্ষেত্র, তাঁদের রাজ্য এবং রাষ্ট্রের প্রতি তাঁদের দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। আমি বক্তব্য রেখেছিলাম, ‘প্রকৃত মুক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য আমাদের আন্দোলন আজও অসম্পূর্ণ, আমাদের কাহিনি আজও উন্মোচিত হচ্ছে। সাংসদ এবং বিধানসভা সদস্যদের নতুন লক্ষ্য এবং নেতৃত্বের সঙ্গে অগ্রসর হওয়ার সময় এসে গেছে, যাতে আমাদের রাষ্ট্র শুধুমাত্র আলোকিত, ঐক্যবদ্ধ, সুসংবদ্ধ, সম্পদশালী এবং সমৃদ্ধ হয়ে না থেকে, সর্বোপরি এক সুরক্ষিত রাষ্ট্র, বহিঃশত্রু এবং সীমান্ত অনুপ্রবেশকারীদের কাছে চির অভেদ্য হয়…
রাষ্ট্রের জনগণের ভেতর জাতীয় নেতৃত্ব আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলবে এবং নির্দিষ্ট সময়সীমা লক্ষ্যের দিকে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে নতুন নতুন জাতীয় মিশন সূত্রাকারে এবং রূপায়ণের দ্বারা সাহসিকতার সঙ্গে উদ্ভাসিত হবে। ভারতবর্ষ গত ষাট বছরে অর্থনীতি, সমাজ এবং রাজনীতির প্রাঙ্গণে বহু সাফল্যজনক কৃতিত্বের জন্য যথেষ্ট গর্ববোধ করতে পারে। কিন্তু অতীতের সাফল্যে আমরা আত্মতুষ্ট হয়ে থাকতে পারি না এবং প্রযুক্তি, শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে সাম্প্রতিক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনের আহ্বানকেও উপেক্ষা করতে পারি না। অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া প্রয়োজন। যেমন, স্থায়ী সরকার গঠন করতে বহুদলীয় জোটের উত্থান ঘটাতে হবে যা দ্রুতগতিতে স্থায়ী, দ্বি-দলীয় শাসনব্যবস্থায় পরিণত হবে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের মোকাবিলা করার জন্য এবং অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। মোট অন্তর্দেশীয় উৎপাদন বা জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) বদলে সার্বিক জাতীয় উন্নয়নসূচক (ন্যাশনাল প্রসপারিটি ইনডেক্স) না থাকায় আশানুরূপ বিকাশের সময়েও আর্থিক অসমতা বড় প্রকট দেখায়। পৃথিবী জুড়ে জৈব জ্বালানির ভাণ্ডারের দ্রুত ক্ষয়ের ফলে শক্তিক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হওয়া, নতুন ধরনের যুদ্ধের সংকেতের উদ্ভাবন আমাদের নিরাপত্তার প্রতি আতঙ্ক বাড়াচ্ছে…।
আমি আরও বলেছিলাম: যখন আমি আপনাদের দেখি, মাননীয় সাংসদগণ, বিশেষত তরুণ সদস্যগণ, তখন আপনাদের মধ্যে আমাদের দেশের অনেক দূরদর্শী নেতা, যেমন— মহাত্মা গাঁধী, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সর্দার পটেল, সুভাষচন্দ্র বোস, ড. অম্বেডকর, আবুল কালাম আজাদ, রাজাজি প্রমুখের শাশ্বত চৈতন্যের সন্ধান পাই। সব কিছুর ঊর্ধ্বে দেশকে স্থাপন করে আপনারা কি ভবিষ্যৎদর্শী পথপ্রদর্শক হতে পারবেন? ভারতবর্ষের মহান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে আপনি কি অন্যতম একজন হতে পারবেন? হ্যাঁ। হ্যাঁ আপনি পারবেন। আপনি পারবেন যদি, ভারতবর্ষকে ২০২০ সালের আগে একটা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ, সুখী, শক্তিশালী এবং সুরক্ষিত রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত করার মহান লক্ষ্যে ব্রতী হয়ে সংসদকে আপনার নেতৃত্ব দ্বারা উজ্জীবিত করতে পারেন। বাস্তবে এর রূপায়ণ ঘটাতে, মাননীয় সদস্য, আপনার থাকতে হবে মহৎ উদ্দেশ্য এবং দেশের জন্য আপনাকে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে কাজ করতে হবে। ক্ষুদ্র এবং খণ্ডিত কার্যকলাপ থেকে লক্ষণীয়ভাবে অপসারণ করে দেশের জন্য এক মহান, সাহসী এবং তড়িদ্গতি মিশন শুরু করার ক্ষেত্রে আপনার উৎসাহর জন্য ইতিহাস আপনাকে মনে রাখবে।
যে সময় আমি ইন্ডিয়া ২০২০ মানসচিত্র হৃদয়ঙ্গম করার জন্য বিধানসভা এবং সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজেকর্মে নিযুক্ত ছিলাম তখন আর-এক সাংবিধানিক পদাধিকারী রাজ্যপালের দপ্তরকে এই লক্ষ্যে কাজে লাগানোর প্রয়োজন ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে রাষ্ট্রপতি ভবনে রাজ্যপালদের সঙ্গে বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
ভারতবর্ষ ২০২০ সালের মধ্যে এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীজির এই নিশ্চয়তার অঙ্গীকারের পশ্চাদপটে ২০০৩ সালের বৈঠক পরিচালিত হয়েছিল। যে রূপরেখার ইঙ্গিত তিনি পূর্ববর্তী বছরে লালকেল্লা এবং সংসদ অভিভাষণে দিয়েছিলেন। ২০০৫ সালের রাজ্যপাল অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একই উদ্দেশ্যে ভারতকে সরকারের নেতৃত্বদানের অঙ্গীকারে নিশ্চিত করলেন।
বৈঠকের হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতাগুলো আক্ষরিকভাবে মনে নেই যদিও যা বলা হয়েছিল তা আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি এবং দ্রুত উন্নয়নের ক্ষেত্রে আন্তরিক অঙ্গীকার প্রকাশের জন্য আজও তা মনে রেখেছি।
বাজপেয়ীজি বলেছিলেন, শাসনব্যবস্থার প্রতিটা অংশ অবশ্যই উন্নয়নের চাহিদা সম্পর্কে অবহিত থাকবে এবং একে এগিয়ে নিয়ে যাবে যাতে আমাদের লক্ষ্য পূরণের উপলব্ধি যত শীঘ্র সম্ভব ঘটা সম্ভব হয়। একটা সম্মিলিত লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিভাগকে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে কত প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয় সেটা দেখার পরে আমি এর প্রশংসা করি। … অংশগ্রহণকারী রাজ্যপালগণ কুণ্ঠাহীনভাবে খোলাখুলি বলার সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। সামগ্রিকভাবে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল যাতে প্রতিটি অংশগ্রহণকারী সমস্যা এবং তার সমাধান আলোচনা করতে পারেন।
২০০৫ সালের বৈঠকে রাষ্ট্রপতি দপ্তরের নির্দেশিত আলোচ্যসূচিভিত্তিক শিক্ষা, সন্ত্রাস, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা এবং ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্সেশন) প্রয়োগ বিষয়ে ড. মনমোহন সিং তাঁর মন্ত্রিসভার সমস্ত সদস্যদের নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করেছিলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরিচালন, উন্নয়নে রাজ্যপালদের ভূমিকার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দান করেছিলেন যে, রাষ্ট্রপতির উৎসাহ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। আমি এর উল্লেখ করে দেখাতে চাই কীভাবে রাষ্ট্রপতির দপ্তর আমার লক্ষ্যপূরণে প্রভাবশালী মঞ্চ হয়ে উঠেছিল।
ভারতবর্ষের ট্রায়ালকোর্ট, হাইকোর্ট বা সুপ্রিমকোর্টে বিস্ময়করসংখ্যক মামলা-মোকদ্দমা অমীমাংসিতভাবে বকেয়া থাকে। এর সঙ্গে নতুন কোনও মামলা দাখিল করায় সেগুলো সংখ্যার গণনায় লক্ষাধিক হয়ে যায়। যারা এই মামলায় জড়িত তাদের পক্ষে সময় ও অর্থের বিপুল অপচয় এবং ভোগান্তির কোনও সীমাপরিসীমা থাকে না।
২০০৫ সালে, সর্বভারতীয় বিচার বিভাগীয় সংস্কার আলোচনাসভার সঙ্গে বকেয়া আদালত মামলার বিশেষ সূত্রে আমার ভাষণ প্রদানের সৌভাগ্য হয়েছিল, যেখানে আমি জাতীয় অমীমাংসিত মামলা অপসারণ মিশনের উদ্ভব সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলাম। বিচারে রায়দানের বিলম্বের কারণগুলো আমি বিশ্লেষণ করেছিলাম, যা হল: ১. যথেষ্টসংখ্যক বিচারালয়ের অভাব; ২. যথেষ্টসংখ্যক বিচার বিভাগীয় আধিকারিকের অভাব; ৩. বিচার বিভাগীয় আধিকারিকরা বিশেষ জ্ঞানসমন্বিত মামলা মোকাবিলায় সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত নয়; ৪. মামলা দায়েরকারী এবং তাঁদের আইনজীবী, যাঁরা বারে বারে মুলতুবির জন্য আবেদন করেন এবং দস্তাবেজ দাখিল করতে বিলম্ব করেন। এই দীর্ঘসূত্রী কৌশল তাঁদের দ্বারা অনুসরণ করা হয়; এবং ৫. শাসন বিভাগীয় কর্মচারীদের ভূমিকা।
আমার বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে আমি মানবতার স্পর্শের মাধ্যমে লোক আদালতের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির দ্বারা জাতীয় অমীমাংসিত মামলা হ্রস্বীকরণ মিশন গঠনের দ্বারা; সালিশি বা ফার্স্ট-ট্র্যাক কোর্টের মতো মামলার বিকল্প প্রতিবিধানের সুসমন্বিত কর্মপ্রক্রিয়ার আশ্বাস দানের দ্বারা; ভ্রান্তির সরলীকরণে উৎসাহ দানের পরামর্শ দিয়েছিলাম।
উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি-অধীন মামলায় বিশেষ বিশেষ সূত্রে আমি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তার মধ্যে কালভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ অন্তর্ভুক্ত ছিল অর্থাৎ, উত্তর প্রজন্মের অপ্রয়োজনীয় মামলার প্রতি নিরুৎসাহের কারণে সেগুলো অদরকারি হিসেবে চিহ্নিত করা।
আমার প্রাথমিক সুপারিশের মধ্যে ই-বিচার বিভাগ শুরু হয়েছিল। এর অংশ হিসেবে, কাল বিশ্লেষণ করে প্রচলিত মামলা নথিভুক্ত করার জন্য আমি কম্পিউটার চালিত নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছিলাম। কাল বিশ্লেষণের দ্বারা অমীমাংসিত মামলার সংখ্যা অবশ্যই কমে যাবে। আমাদের একটা ডাটাবেস-এর প্রয়োজন ছিল, যা মামলা নথিভুক্ত হওয়া থেকে শুরু করে নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত তথ্যানুসরণ করবে। এই ধরনের বৈদ্যুতিন অনুসরণ সহজেই অনুসন্ধান, পুনরুদ্ধার শ্রেণিবদ্ধকরণ, তথ্যসমূহের প্রক্রিয়াকরণ, বিচার বিভাগীয় নথি প্রক্রিয়াকরণ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে মামলায় নিষ্পত্তি এবং প্রক্রিয়া গতিশীল করতে সহজে সক্ষম হবে। অভিযোগকারী যে-কোনও সময় মামলাটি কোন পর্যায়ে আছে, কোন বিচারালয়ে এবং কবে শুনানি হবে, বিচারালয় দ্বারা কোন বিষয় উত্থাপিত হবে, সে-সম্পর্কে জেনে সম্পূর্ণভাবে মামলার পক্ষে প্রস্তুত হতে সক্ষম হবে। সামগ্রিক স্বচ্ছতা আনা ছাড়াও বিচারকরাও মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে, মুলতুবি মামলার সংখ্যা খুঁজে বার করে তার ভিত্তি অকিঞ্চিৎকর নাকি গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যান্য তথ্য যা রায়দানে সাহায্য করে সে-সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবেন।
উপরন্তু, ভিডিও কনফারেন্স ব্যাপকাকারে ব্যবহৃত করা সম্ভব। এই ব্যবস্থা বৃহদাকারে ব্যয়সংকোচন এবং বিচারাধীনের সঙ্গে পুলিশবাহিনীর গমনাগমনের অনাবশ্যক ঝঞ্ঝাট থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব করবে।
যেখানে একাধিক ব্যক্তি মামলায় জড়িত সেখানে ভিডিও কনফারেন্স অত্যন্ত উপযোগী। তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি বা আইসিটি (ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি) দ্বারা সাক্ষী চিহ্নিতকরণ এবং অপরাধ পুনর্নির্মাণ ক্ষেত্র অতুলনীয়ভাবে লাভবান হয়েছে।
অনেক রাষ্ট্র, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিঙ্গাপুর এবং অস্ট্রেলিয়া ইন্টারনেট বিচারালয় এবং সম্ভাব্য মামলা দায়েরকারীর মামলার আইনসম্মত সংশোধন বিষয়ে পরামর্শদান করতে পারায় আইনমাফিক পরামর্শদান পরিষেবা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে। সর্বক্ষেত্রে, আইসিটি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও সেসঙ্গে প্রতারণা মামলা অগ্রাহ্য করার ক্ষেত্রে খুব উপযোগী, এই প্রভাব আমাদের বিচারব্যবস্থাকে গতিশীল করবে। পরিশেষে, সময়মতো দেশের নাগরিককে ন্যায়বিচার দিতে বিচারব্যবস্থাকে সক্ষম করে তুলতে নয়টি পরামর্শ দিয়েছিলাম:—
১. বিচারপতি এবং আইনজীবী সম্প্রদায়ের সদস্যরা মুলতুবি মামলার সংখ্যা কীভাবে সীমিত করবেন তার বিবেচনা করা যেতে পারে।
২. আমাদের বিচারালয়ে ই-বিচারব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটানো যেতে পারে।
৩. মামলাগুলো তাদের তথ্য এবং প্রাসঙ্গিক আইনানুযায়ী শ্রেণিবিভাগকরণ ও গোষ্ঠীবদ্ধকরণ করা যেতে পারে।
৪. বিশেষ আইনশাখা যেমন, সামরিক আইন, পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়, করসংক্রান্ত এবং সাইবার আইনে দক্ষ ব্যক্তিকে বিচারক পদে গ্রহণ করা যেতে পারে।
৫. আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শিক্ষার মান, আইন স্কুলের বিন্যাসে উন্নীত করা যেতে পারে।
৬. অকারণ মুলতুবি এবং তুচ্ছ মামলা দায়ের করার জন্য দৃষ্টান্তমূলক দণ্ডপ্রদান রীতির প্রচলন করা যেতে পারে।
৭. সুপ্রিমকোর্টের প্রস্তাবিত মডেল উচ্চ আদালত এবং জেলা আদালতগুলির অনুসরণ করা উচিত এবং কাজের দিনে বাড়তি সময় এবং শনিবার কাজ করে মীমাংসিত মামলার সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
৮. অতিরিক্ত লোকবল এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত পরিচালন কাঠামো-সহ কর্মক্ষম উপযোগিতা বৃদ্ধি করার জন্য ‘বিচারালয়ে একাধিক অধিবেশন’ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন খণ্ডিত ও বর্ধিত সময়ের সঙ্গে (সময়সূচি এমনভাবে বিন্যাস করা উচিত যাতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে দিয়ে কাজ করানো সম্ভব হয়)।
৯. বকেয়া মামলাগুলোর সময়নির্দিষ্ট মীমাংসার জন্য দু’বছর প্রক্রিয়ার প্রয়োজন। এরজন্য দরকার একটা জাতীয় অমীমাংসিত মামলা হ্রস্বীকরণ মিশন ন্যাশনাল লিটিগেশন পেন্ডেন্সি ক্লিয়ারেন্স মিশন গঠন করা।
একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে দেখলাম আমাদের বিচার বিভাগ ওইসমস্ত পরামর্শ অনুধাবন করেছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে তার প্রয়োগ শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, ভারতে বসবাসকারী স্বামী এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী স্ত্রীর মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে অমীমাংসিত বিবাহবিচ্ছেদ মামলা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মীমাংসিত হওয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।
সারা বিশ্বের মধ্যে ভারতবর্ষ অন্যতম চমৎকার সশস্ত্র বাহিনীর অধিকারী যারা বিশ্বাসী, নির্ভীক এবং নিয়মানুবর্তী। রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি সব সময় তাদের পারিপার্শ্বিক জানতে আগ্রহী ছিলাম— কীভাবে তাদের চালনা করা হয়, তাদের প্রস্তুতি, তাদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ। এই উপলক্ষে আমি বেশ কয়েক বার সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর ইউনিট পরিদর্শন করেছিলাম। সেখানকার আধিকারিক এবং জওয়ানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ফলে আমি সমস্যাসংকুল অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে আমি সিয়াচেন হিমবাহের কুমার পোস্টে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম, ওটা ছিল পৃথিবীর উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র এবং ওখানে আমাদের বাহিনী তীব্র শীতের মধ্যে কাজ করে। আমি বিশাখাপত্তনম উপকূলে সাবমেরিন চালনাও পরিদর্শন করেছিলাম আর সুখোই-৩০ এমকেআই-এ বসে শব্দের প্রায় দ্বিগুণ গতিবেগে উড়ান দিয়েছিলাম। এইসব উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল এবং আমি আপনাদের সঙ্গে সেগুলো ভাগ করে নিতে চাই।
২০০৪ সালের ২ এপ্রিল, সিয়াচেন হিমবাহের কুমার পোস্টে অবতরণ করেছিলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭০০০ মি. উচ্চে পোস্টটি অবস্থিত। তখন বরফ পড়ছিল, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ৩৫° সেলসিয়াস নীচে, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। যখন আমি ফিল্ড স্টেশনে পৌঁছলাম কর্নাটকের নায়েক, পশ্চিমবঙ্গের উইলিয়ামস এবং উত্তরপ্রদেশের সালিম— তিন সেনা এসে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। তাঁদের করমর্দনের উষ্ণতা স্থানটার শৈত্যভাবকে দূর করে দিল। আমার মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস জাগাল যে এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও যে সমস্ত সৈনিক দেশকে রক্ষা করে চলেছেন তাঁদের হাতে আমাদের দেশ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। এই সংকটাকুল পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য অসাধারণ নেতৃত্বগুণের প্রয়োজন।
২০০৬ সালে, ১৩ ফেব্রুয়ারি নৌবাহিনীর সাবমেরিন আইএনএস সিন্ধুরক্ষকের সওয়ার চড়ে আমার জলের নীচে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সাবমেরিনটা ৩০ মিটার জলের তলায় নিয়ন্ত্রিত গতিতে চলতে শুরু করেছিল। আমি কন্ট্রোল রুম পরিদর্শন করেছিলাম। ওখানকার কর্মীরা প্রবল উৎসাহে আমাকে চালানোর কৌশল (ম্যানুভারিং) কর্মপদ্ধতি, এবং প্লবতা-নিয়ন্ত্রক প্রযুক্তি ব্যাখ্যা করে সাবমেরিনের কার্যকলাপ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। নৌ-প্রধান অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশ এবং তরুণ নাবিক ও আধিকারিকদের সঙ্গে ভ্রমণ আমার কাছে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। পর্যালোচনাকালে, আমাকে জলের গভীরে যোগাযোগ, লক্ষ্য চিহ্নিতকরণ এবং উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা দেখানো হল। এরপর সমুদ্রের অন্তঃস্তলে আমাদের বাহিনীর যুদ্ধের সক্ষমতা দেখানোর জন্য আক্রমণ করার অনুকরণে টর্পেডো ছোড়া হয়েছিল। টর্পেডোগুলো বৈশিষ্ট্যজনকভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চালিত হওয়ার ক্ষমতা দেখিয়েছিল। জলের নীচে যুদ্ধের জটিলতা আমি অনুধাবন করেছিলাম।
সাবমেরিনের নব্বইজন আধিকারিক এবং নাবিকের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল। প্রত্যেকে তাঁর নিজস্ব কাজে ব্যস্ত। যে কাজ খুব সহজসাধ্য ছিল না, কিন্তু তাঁরা তাঁদের মিশনের চ্যালেঞ্জের জন্য গর্ববোধ করেন। মধ্যাহ্নভোজনে সুস্বাদু নিরামিষ খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল এবং পরবর্তী ত্রিশ বছরে নৌবাহিনীর সাবমেরিন পরিকল্পনা নিয়ে একটা প্রেজেন্টেশন উপস্থাপিত হয়েছিল। জলের নীচে তিন ঘণ্টা কাটিয়ে আমরা জলের ওপরে ভেসে উঠলাম ও তীরে ফিরেছিলাম। সার্বিকভাবে ওটা ছিল এক স্মরণীয় পরিভ্রমণ।
২০০৬ এর ৮ জুন, আমি সুখোই-৩০ যুদ্ধবিমানে এক উড়ানে উড়লাম। আগের রাতে কমান্ডার অজয় রাঠোর আমায় কেমনভাবে উড়তে হবে তার পাঠ দিয়েছিলেন, শিখিয়েছিলেন কীভাবে বিমান চালাতে হবে, সঙ্গে অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আয়ত্তে রাখতে হবে। এই কাজটা আমি যখন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলাম, সেই ১৯৫৮ সাল থেকে করতে চেয়েছিলাম। মহাকাশ উপযোগী পোশাক পরার পরে সুখোই টেক অফ করে হু-হু ৭৫০০ মিটার — ২৫,০০০ ফিট উঁচুতে উড়ে চলল, ঘণ্টায় ১২০০ কিমি বেগে। উইং কমান্ডার রাঠোর কয়েকটা পাক ও কৌশলের বুদ্ধি দিলেন। আমার যুদ্ধবিমান চালানোর এক ব্যাপক অভিজ্ঞতা এবং তিনগুণ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কাছাকাছি শক্তি অনুভব করার অভিজ্ঞতা হল। অবশ্যই ব্ল্যাক আউট থেকে বাঁচার জন্য জি-স্যুট বা জি মহাকাশ উপযোগী পরিধান পরেছিলাম। উড়ান চলাকালীন ভারতীয় বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা যে-সমস্ত ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে এবং যুদ্ধবিমানে একত্রিত করা হয়েছে তা বোঝবার চেষ্টা করছিলাম। মিশন কম্পিউটার, র্যাডার ওয়ার্নিং রিসিভার, ডিসপ্লে প্রসেসর ও দেশে নির্মিত অন্যান্য যন্ত্রপাতি দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। বায়ুমণ্ডলে বা ভূমিতে কোনও লক্ষ্য স্থির করতে কীভাবে কৃত্রিম আলোকরন্ধ্রের মাধ্যমে প্রতিফলিত বেতার রশ্মির সাহায্য নেওয়া হয় তা দেখানো হয়েছিল। প্রায় ৩৬ মিনিট ধরে উড়ান চলেছিল, আমার বহুদিনকার স্বপ্ন যেন পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ছত্রী সেনাবাহিনী, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পুলিশবাহিনী এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করার। তাঁদের নিষ্ঠা এবং শৌর্য আমার মনে গভীর ছাপ রেখেছিল।
.
রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমাদের সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। পারস্পরিক ভাবের আদানপ্রদানের মাধ্যমে আমি তাদের বোঝার এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং চ্যালেঞ্জ উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। সমস্ত মানুষকে সাধারণ জাতীয় লক্ষ্যে একতাবদ্ধ করাও আমার পক্ষে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
০৫. জাতিকে আমি কী দিতে পারি?
৫. জাতিকে আমি কী দিতে পারি?
স্বপ্নই জাতিকে উন্নীত করে
দেশকে আমি কী দিতে পারি? অন্যান্য দেশের মধ্যে আমার দেশকে সম্মান এবং শ্রদ্ধা দিতে পারি। আমার একলক্ষ কোটি দেশবাসী ভাই-বোনের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শিক্ষার মাধ্যমে তা সম্ভব। আত্মসম্মান অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষা হল সর্বপ্রধান। নিবেদনের অভ্যাসের বদ্ধমূল সংস্কার উন্নয়নের মূলস্রোতে আমাদের দেশবাসীকে নিয়ে আসবে।
স্বাধীনতা দিবস এবং প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে ভারতের রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবার সম্মান লাভ করেন। এই দুই উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি নির্দিষ্ট পর্বে দেশের উন্নয়ন এবং উন্নয়নকালীন পর্বে যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় তা জ্ঞাপন করেন।
অভিভাষণ প্রথমে ইংরেজিতে দেওয়া হয়, তারপর হিন্দিতে। ব্যতিক্রম হিসেবে আমি অভিভাষণের শুরুতে শুভেচ্ছা জানাতাম এবং বক্তৃতার একটা সংক্ষিপ্তসার হিন্দিতে বলতাম।
আমি যখন রাষ্ট্রপতি হলাম তখন হিন্দি ভাষায় আমার জ্ঞান খুব সামান্য ছিল। যদিও আমি উপলব্ধি করতাম হিন্দি ভাষায় প্রারম্ভিক জ্ঞানের সাহায্যে বৃহদাংশ শ্রোতার কাছে অন্ততপক্ষে ভাষণের সৌরভ তো পৌঁছনো সম্ভব।
প্রজাতন্ত্র দিবসের ভাষণের একটা নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু থাকে। সাধারণত এর প্রস্তুতি বেশ কিছুদিন আগে থেকে নেওয়া হয়। প্রথমে আমরা বিষয় নির্বাচন করি তারপর বিভিন্ন বিভাগ থেকে তথ্যসংগ্রহ এবং ওই বিষয়ে আন্তর্জাতিক চিত্রটা বোঝার চেষ্টা করি। আমরা বিশেষজ্ঞদের কাজে এক-একটা প্রশ্নাবলি পাঠিয়ে তারপর তথ্যগুলো একত্রিত করতাম। ভাষণের অসংখ্য খসড়া তৈরি হত, দশটা বা তার বেশি খসড়া কোনও অসম্ভব ঘটনা ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৪ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসের বিষয় ছিল-‘একশো কোটি মানুষের মুখে হাসি’-এর প্রায় দশটা খসড়া হয়েছিল। মূল্যবোধ ছিল এর উদ্দেশ্য। ২০০৫-এর ১৪ অগস্টের বিষয়বস্তু ছিল শক্তিক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা। পনেরোটি খসড়ার মধ্যে দিয়ে ভাষণটি তৈরি হয়েছিল। সর্বাধিকসংখ্যক খসড়া তৈরি হয়েছিল ২০০৭ সালের ২৫ এপ্রিল ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আমার ভাষণ তৈরি করতে গিয়ে। ৩১টি খসড়ার মধ্য দিয়ে এ ভাষণ তৈরি হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালীন আমি দশটা ভাষণ দিয়েছি। প্রতিটি ভাষণের বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেগুলো ছিল স্বপ্নকে লক্ষ্যে রূপান্তর করার বক্তৃতা। আরও অনেক বিষয়বস্তু ছিল যার জন্য আমাদের মনে রাখা উচিত: মানবজীবনে আত্মসম্মানের জন্য শিক্ষা; কর্মনিয়োগ সংঘটনে এক কর্মপ্রক্রিয়া পরিকল্পনা; একশো কোটি দেশবাসী: এক দর্শন; জাতীয় জাগরণ এবং আমি আমার দেশকে কী দিতে পারি। সমস্ত বিষয়গুলি ভারতবর্ষকে এক উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার সাধারণ ভাবনা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এই বার্তা দেশের নাগরিক ও পেশাদারদের কাছে ছড়িয়ে গিয়ে নিজেদের ক্ষেত্রে বিতর্ক তুলেছে এবং সক্রিয় করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, কর্মনিয়োগ সৃষ্টি করতে যখন জাত্রোফা কার্কাস-এর বাগিচাশিল্পের কথা আমি বলেছিলাম, বহুসংখ্যক রাজ্য একে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এবং আজকের দিনে লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমি এই শিল্পে ব্যবহৃত হয়। উপরন্তু, জাত্রোফা চাষ সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞরা আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলিতে আমাদের কৃষকদের সহযোগিতায় এই বাগিচাশিল্পের উন্নয়ন ঘটান, যাতে জৈব-জ্বালানি উৎপাদনে তারা এই গাছের ব্যবহার করতে পারে। জাত্রোফা পতিত জমিতে উৎপাদিত হতে পারে। একবার গাছ রোপণ করলে পঞ্চাশ বছর অবধি বাঁচে এবং প্রতি বছর ফল দেয়, যার বীজ থেকে তেল নিঃসৃত হয় এবং ডিজেলের সঙ্গে মেশানো যায়।
শিক্ষা প্রাঙ্গণে, বাৎসরিক পরীক্ষার ভীতিপ্রদ পরিবেশ ব্যতিরেকে নানা ধরনের ছাত্র মূল্যায়ন সংক্রান্ত ভাবনা জেগে উঠেছিল। CBSE বা সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন নম্বর প্রথার পরিবর্তে গ্রেড প্রথার প্রচলন ঘটাল। তার ফলে নম্বর নিয়ে ছাত্রদের মনে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব গড়ে উঠল।
দেশকে ২০৩০-র মধ্যে তার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করার জন্য শক্তি স্বনির্ভরতার বিষয়ে, আমি সৌরশক্তির মাধ্যমে ৫৫,০০০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষম বিদ্যুৎ নির্মাণকেন্দ্র স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছিলাম। ভারতবর্ষের শক্তির রূপরেখার প্রতি এক পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। ভারতের কয়লার চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ পূর্ণ করা সম্ভব, যেখানে শক্তির চাহিদা ৫ শতাংশের বেশি হারে প্রতিবছর বাড়ছে, কয়লা উৎপাদন বাড়ছে খুব বেশি হলে ১ শতাংশ। আমাদের দেশের অনেক রাজ্যে দিনে আট ঘণ্টারও বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি থাকে। ফলে বিকল্প শক্তি সম্পদ উন্নয়ন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে।
পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য আমাদের কয়লা, প্রাকৃতিক তেল ও গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। জোর দিতে হবে দূষণমুক্ত শক্তি উৎপাদনের ওপর-যা সৌর, বায়ু, পারমাণবিক এবং জল থেকে উৎপাদিত হতে পারে। সরকার ২০২০ সালের মধ্যে ২০,০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরশক্তি উৎপাদন নয়া মাত্রা ঘোষণা করেছে। সৌরশক্তির উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে অন্যান্য অনেক বিষয় সম্পৃক্ত। যেমন, উপযুক্ত মাধ্যমের বাছাইয়ের দ্বারা ফোটোভোলটেয়িক সেল এফিশিয়েন্সি বর্তমান ১৫ শতাংশ থেকে অন্ততপক্ষে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক আকারে গবেষণা প্রয়োজন। দিনের বেলা সৌরশক্তির ব্যবহার এবং রাতের বেলা জৈব-জ্বালানি ব্যবহার করে যাতে বিদ্যুৎশক্তি ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায় সেজন্য উন্নয়নমূলক গবেষণার প্রয়োজন। গুজরাতে এক বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরশক্তি উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন ৩০ লক্ষ ইউনিট উৎপন্ন করা হয় এবং রাজ্য সরকার প্রতি ইউনিট পিছু পনেরো টাকা হারে কেনেন।
আজ ভারতবর্ষকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার জন্য রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার উভয়েরই লক্ষ্য একই, যা দেশের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব— পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত নাগরিকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।
এইসমস্ত উদাহরণের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে দেশের নাগরিকের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ রক্ষা এবং দেশের পক্ষে লাভজনক প্রভাব বিস্তার করায় রাষ্ট্রপতি সম্পূর্ণভাবে সক্ষম।
জাতির উদ্দেশে আমার অভিভাষণ ছাড়াও সাংসদদের উদ্দেশে আমার ভাষণও সমানভাবে চলত। ১৯৯৯, ২০০০, ২০০১ এবং ২০০২ সালের অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী সাংসদদের সম্মান প্রদান উপলক্ষে ২০০৫ সালের ২১ মার্চ আমার অভিভাষণে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।
আমি বলেছিলাম, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র বরাবরই ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রকৃতপক্ষে এর ইতিহাস আমরা প্রাচীনকালেও খুঁজে পাই। আজকের জনপ্রিয় প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠনগুলোর সম্পাদিত একই ধরনের কার্যকলাপ প্রাচীনকালে ‘সভা’ এবং ‘সমিতি’ নামক সম্মানীয় গ্রামীণ প্রজাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পাদিত করত। স্বাধীনতা অর্জনে আমাদের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ফলত: ভাবসত্তার স্বতঃচলমান ধারাবাহিকতা যা সর্বদা ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। বহু ধর্ম, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি সমন্বিত পৃথিবীর বৃহত্তম সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতবর্ষের অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য আমরা গর্বিত। ভারতীয় ভোটদাতাদের বিচক্ষণতা এবং পরিণত মানসিকতা বিশ্বকে হয়তো বিস্মিত করেছে। ভারতবাসী সবসময় সচেতনভাবে মতদান করার চেষ্টা করে এবং আমাদের সংবিধানের দ্রষ্টা অনুযায়ী নিজেকে প্রমাণিত করে তারা সার্বভৌম এবং তাদের মধ্যে ক্ষমতার উৎস নিহিত আছে। মানুষের এক উন্নত ভারতে বাস করার অধিকার আছে, তাই উন্নয়নমূলক রাজনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনীতির দুটো মাত্রা আছে। এক হল রাজনৈতিক দলগুলির পরিচিত জগৎ যা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অতএব, আজকের ভারতবর্ষের কী চাই? যেখানে দারিদ্র্যসীমার নীচে ২৬০ মিলিয়ন বা ২৬ কোটি মানুষ বাস করে এবং অশিক্ষার হার ৩৪ শতাংশ, আর ৩৬ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৬০ লক্ষেরও বেশি মানুষ কর্মপ্রার্থী। আমাদের লক্ষ্য হল দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও কর্মহীনতার অন্ধকার থেকে মুক্ত এক উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে ভারতবর্ষকে গড়ে তোলা। এই পরিস্থিতি উন্নয়নমূলক রাজনীতিকে অপরিহার্য করে তোলে।
আমাদের দেশের উন্নয়নমূলক রাজনৈতিক পরিবেশে আমি রাজনৈতিক দলকে এমন এক পরিস্থিতিতে দেখতে আগ্রহী যেখানে তারা একে অপরকে ছাপিয়ে উন্নতির লক্ষ্যে নিজের নিজের ইস্তাহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জ্ঞাপন করবে। কয়েকটা দৃষ্টান্তমূলক রূপরেখার দ্বারা বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করা যাক—
১. ধরে নেওয়া যাক ক পার্টি বলল পনেরো বছরের মধ্যে আমরা ভারতবর্ষকে এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার পথে নিয়ে যাব এবং প্রতি ৫ বছরের জন্য উন্নয়মুখী বিকাশ পরিকল্পনা করব এবং তাকে বাস্তবে রূপদান করব।
খ পার্টি বলে, আমরা এক স্বচ্ছ কর্ম প্রক্রিয়ার দ্বারা ১২ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষকে এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করব।
গ পার্টি হয়তো ভিন্ন নির্দেশক-সহ জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের উন্মোচন করতে পারে এবং বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে আমাদের ভূমিকা সম্পর্কিত ধারণায় অসাধারণ বুত্পত্তি দেখাল। এটা হয়তো ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট সময়ের (X) মধ্যে ইউনাইটেড নেশনের সিকিউরিটি কাউন্সিলের আজীবন সদস্য হওয়া আশ্বাসদানের পথনির্দেশ হতে পারে।
২. আমার রূপরেখার দ্বিতীয় দৃশ্যে-ক পার্টি বলল যে তারা এমন এক রাষ্ট্র স্থাপন করবে যেখানে কোনও বেকারত্ব নেই। এ কারণে তারা এমন এক সুসংগঠিত কর্মপ্রক্রিয়া প্রচলন করতে চায় যেখানে কর্মপ্রার্থীর তুলনায় নিয়োগকর্তার সংখ্যা অধিক হবে।
খ পার্টি বলবে তারা এমন এক পরিবেশ এবং সুসংগঠিত কর্মপ্রক্রিয়া দান করবে যেখানে আদালতে কোনও মামলা অমীমাংসিত থাকবে না এবং আইনশৃঙ্খলা সমস্যা ভীষণভাবে কমে যাবে ও দেশের নাগরিক এক সুখশান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করবে।
গ পার্টি বলে যে, কোনও ভারতীয়কে ক্ষুধা নিয়ে রাত্রিযাপন করতে হবে না। এদের একটা লক্ষ্য আছে যা নিশ্চিত করবে যে, বিশ্বকে বাস করার পক্ষে শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল এবং সুন্দর করার জন্য ভারতবর্ষের প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের দিকে সমগ্র বিশ্ব তাকিয়ে আছে। ভারতের লক্ষ্য হবে বিশ্বশান্তি।
৩. তৃতীয় রূপরেখা—ক পার্টি বলবে, তারা আশ্বাসদান করছে যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সীমান্তবর্তী সংঘর্ষ দশ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
খ পার্টি বলবে তারা পাঁচ বছরের মধ্যে সমস্তরকম সীমান্তবর্তী সংঘর্ষর সমাধান করবে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে এক সুসমন্বিত সম্পর্ক গড়ে তুলবে।
গ পার্টি বলবে তাদের উদ্যোগে সীমান্তবর্তী বাণিজ্য কোনওরকম সীমান্ত অনুশাসন মানবে না। বাণিজ্যে সমৃদ্ধি আসবে, সমৃদ্ধি আনবে শান্তি।
যখন বিশেষ কোনও দলকে জনগণ উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা প্রয়োগের সুযোগ দেয় এবং অন্যান্য সদস্যদের সমর্থনে সেটা বাস্তবায়িত হলে রাষ্ট্র ও জনগণ সংসদীয় সদস্যর মহৎ ক্রিয়ার দ্বারা আশীর্বাদধন্য হয়। গণতন্ত্র প্রত্যেককে একটা সুযোগ দেয় যাতে সে কর্মের দ্বারা প্রমাণ করতে পারে রাষ্ট্রের লক্ষ্যকে সে কতটা ভালভাবে উপলব্ধি করেছে।
দারিদ্র্য সম্পূর্ণ দূরীভূত করার প্রয়োজনীয়তা, তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এবং জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বে সকলকে সুযোগ দান করার প্রয়োজনীয়তা ও আজকের জটিল দুনিয়ায় দেশ এবং জাতিকে সুরক্ষা দান করার প্রয়োজনীয়তা-এই বহুবিধ প্রয়োজনীয়তাগুলো দেশকে ‘রাজনীতির স্বার্থে রাজনীতি’ থেকে আমাদের জানা উন্নয়নমূলক রাজনীতির দিকে ধীরে ধীরে উন্নীত করার প্রয়োজনীয়তা মেটাবে।
সংসদের অনুসরণীয় এমন অনেক জাতীয় বিষয় আছে যা দলগত আদর্শের ঊর্ধ্বে। এইসব বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি দেশকে এক উন্নত রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে চলে, যেমন— বিশুদ্ধ জলের সংস্থান, অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসংযোগ, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং দেশের প্রতিটি নাগরিকের আশ্রয়ের সংস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কম্পিউটার ব্যবহার পরিকল্পনা ও জাতীয় সুরক্ষা। সংসদীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে আলোচনা ও তর্কালোচনা দ্বারা ঐকমত্য স্থাপিত হয় যা ভারতবর্ষকে উন্নত অবস্থায় দ্রুতগতিতে পৌঁছনোর রাস্তায় নিয়ে যাবে। অতএব দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সংসদ তার ক্ষমতাকে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবে ব্যবহার করা উচিত।
সুতরাং বলা যেতে পারে সাংসদদের ভূমিকা তাই ভীষণ তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে এবং এটা খুবই প্রয়োজনীয় যে প্রতিটি সদস্যর আকাঙ্ক্ষা এবং আদর্শ এমন একটা উন্নীত স্তরে আনবেন যার জন্য তাকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
এ সত্ত্বেও আমি যেমন সংসদ সদস্যদের বলেছিলাম এমন কিছু উলঙ্গ সত্য আছে যা আমরা স্বীকার করতে চাই না। সেগুলো নিয়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই, আমি বলেছিলাম, কারণ আমি আপনাদেরই একজন। আপনারা যেমন সংসদের সদস্য, আমিও তেমনি। আপনাদের মতো আমিও সংসদীয় ব্যবস্থার সাফল্য সম্পর্কে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। আমাদের ভোট পদ্ধতি পরবর্তীকালে অত্যন্ত চাপযুক্ত হয়েছে। আসুন, আমরা নিজেদের প্রতি সৎ হই। আসনসংখ্যা বৃদ্ধির বাধ্যবাধকতা এবং নির্দিষ্ট কিছু বিধানমণ্ডলের আসনের তথাকথিত বাণিজ্যিকতা, যা হয়তো সন্দেহপূর্ণ এবং অগণতান্ত্রিক উপায়ে অধিকৃত হয়েছে তা জনগণের মনে আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতি সন্দেহ তৈরি করেছে। যখন রাজনীতি নিজেই রাজনৈতিক হঠকারী হয় তখন রাষ্ট্র বিধ্বংসী পথে অবশ্যম্ভাবী আকস্মিক দুর্ঘটনা এবং ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। এই ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। ভারতবর্ষ যাতে পরিণত, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছল, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে নিরবচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকে এবং আমাদের সংবিধানের রচয়িতাদের দ্বারা যে আশা-আকাঙ্ক্ষা অভিনিবেশ সহকারে এবং কার্যকরভাবে সংরক্ষিত— সেই আশা পূরণে নিজেদের উন্নীত করার এবং আমাদের আত্মপরীক্ষার সময় এসেছে।
ভারতীয় সংস্কৃতির ভাবসত্তা, মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষিত করে যে জীবনযাপন পদ্ধতি মানুষ তা ব্যাকুলভাবে কামনা করে। সঠিক নীতি প্রয়োগ, আইন এবং সমাজ সংক্রান্ত রূপান্তরের মাধ্যমে সংসদ তাদের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে পারে। আমরা এমন কিছু নীতি এবং পদ্ধতি নিয়ে কাজ করে থাকি যার বেশিরভাগ অবিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। যার ফলে প্রণোদনা এবং সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত ও অবদমিত হয়, অথচ ভারতের নাগরিক নির্ভরযোগ্য এবং কর্ম-অনুকূল পরিবেশে অতুলনীয় সাফল্য প্রদর্শন করেছে।
উন্নয়নকেন্দ্রিক অর্থনীতির বিকাশের পথে যে-যে জটিল পুরনো আইন ও শাসনব্যবস্থামূলক কার্যপ্রণালী আছে সেগুলো শনাক্ত করা ও অপ্রয়োজনীয় বলে বাতিল করার লক্ষ্যে সংসদের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এর দরুন সমাজের এক বৃহদাংশ যারা সৎ তাদের মনে কুসুমিত ও বিকশিত হওয়ার সুযোগ ও আশা জাগায়। আমি তাঁদের প্রণোদিত করেছিলাম যে ভারতবর্ষ অবশ্যই বিশ্বাসনির্ভর সুষ্ঠু প্রণালীর দিকে এগোবে এবং ওই মহান সংসদের সদস্যরাই একমাত্র সেই পরিবর্তন আনতে পারেন।
আমাদের লক্ষ্যে সাফল্য পেতে গেলে একত্রীভূত কাজের জন্য ভারতবর্ষের পাঁচটি মূল ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত সামর্থ্য আছে— ১. কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ২. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা, ৩. পরিকাঠামো: বিশ্বাসযোগ্য এবং গুণগত বিদ্যুৎশক্তি, ভাল সড়ক ব্যবস্থা এবং দেশের সমস্ত প্রান্তের জন্য অন্যান্য পরিকাঠামো, ৪. তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি, ৫. জটিল প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা।
এই পাঁচটি ক্ষেত্র ঘনিষ্ঠভাবে আন্তঃসম্পর্কিত, এবং সমন্বয় সাধনের দ্বারা যদি এদের উন্নত করা যায় তা হলে খাদ্য, আর্থিক এবং জাতীয় সুরক্ষার দিকে পথনির্দেশ করবে।
এই পাঁচটি ক্ষেত্রের মধ্যেকার মূল লক্ষ্যগুলির অন্যতম হল PURA-দ্বারা নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য আনার জন্য পরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটানো। এই উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক, বৈদ্যুতিন এবং জ্ঞান এই তিনের সংযোগসাধন প্রয়োজন, যা অর্থনৈতিক সংযোগসাধনের পথ প্রদর্শন করে, হিসাবমতো সমগ্র রাষ্ট্রে এই PURA গুচ্ছ সংখ্যায় প্রায় ১০০০।
যখন আমাদের অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান অবস্থায় রয়েছে এবং আমাদের জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) বা মোট অন্তর্দেশীয় উৎপাদন বাৎসরিক ৯ শতাংশ হারে বাড়ছে, তখন এটা সত্য যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সংখ্যাধিক্য মানুষের জীবনযাপনের মানে সামগ্রিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে তো অবশ্যই এমনকী শহরাঞ্চলেও। ফলে, আমরা NPI বা জাতীয় সমৃদ্ধি সূচকের উদ্ভব ঘটিয়েছি, যা প্রকৃতপক্ষে যোগফল ক. জিডিপি-র বাৎসরিক বৃদ্ধি হার খ. মানুষের জীবনযাত্রায় গুণগত মানের উন্নতি, বিশেষত যারা দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে এবং গ. জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের সভ্যতাজনিত ঐতিহ্য থেকে আমরা যে মূল্যবোধ ব্যবস্থা আত্মীকরণ করি, যা এককভাবে ভারতের বৈশিষ্ট্য। অতএব ক + খ + গ বিশেষত ‘খ’ হল গৃহ, শুদ্ধজল, পুষ্টি, সুষ্ঠু নির্মলীকরণ, উৎকৃষ্ট শিক্ষা, উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সম্ভাব্য কর্মসংস্থান এবং ‘গ’ হল যৌথ পরিবার ব্যবস্থা, একত্রে কাজ করার মানসিকতা স্থাপন, জীবনের সঠিক দিশায় পথপ্রদর্শন, সামাজিক অসাম্য মোচন এবং সর্বোপরি দ্বন্দ্ববিহীন সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজের গঠনক্রিয়া। এসমস্ত কিছু সূচিত হয় সম্প্রদায় এবং পরিবারের মধ্যে শান্তি, দুর্নীতি সূচকের নিম্নগমন, আদালতে মামলার সংখ্যার হ্রাসপ্রাপ্ত রূপ, শিশু এবং নারীর প্রতি হিংস্রতার দূরীকরণ এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিশ্চিহ্ন করা দ্বারা। দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে ২০২০ সালের মধ্যে শূন্যে পরিণত হওয়া উচিত। সবসময় জাতীয় অর্থনৈতিক ক্রিয়ার উন্নতির জন্য আমাদের প্রচেষ্টা রাষ্ট্রের জাতীয় সমৃদ্ধিসূচক বা NPI দ্বারা পথ প্রদর্শিত হওয়া উচিত।
আমরা কীভাবে এই লক্ষ্য উপলব্ধি করব? লক্ষ্যকে উপলব্ধি করার জন্য তাত্ক্ষণিক কী কী পদক্ষেপ আমাদের গ্রহণ করা উচিত?
আপনাদের অনেকের সঙ্গে আমার আলাপচারিতা, নানা ধরনের কেন্দ্র এবং রাজ্যের কার্যক্রম, সরকারি এবং বেসরকারি সংগঠনের প্রাথমিক পদক্ষেপ ছাড়াও জাতীয় উন্নয়নে দেশের নাগরিকদের অংশগ্রহণের অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা আমার মনে এই বিশ্বাস জাগায় যে, সমাজ এই লক্ষ্যের জন্য কাজ করতে প্রস্তুত। দুটো প্রধান কর্মসূচি প্রস্তুত করার জন্য আপনাদের একত্রে কাজ করতে আমি দুটো পরামর্শ দিতে পারি:
১. শক্তি স্বনির্ভর বিল: শক্তি সম্পদের প্রতি নির্মল পরিবেশ সহায়ক ত্রিমাত্রিক অগ্রগমন।
২. ভিশন ২০২০: ২০২০ সালের পূর্বে জাতীয় সমৃদ্ধিসূচক NPI মাপকাঠি ধরে নিয়ে সুরক্ষিত, সমৃদ্ধ, সুখী এবং অর্থনৈতিক উন্নত রাষ্ট্রে ভারতবর্ষকে রূপান্তরিত করার অঙ্গীকার গ্রহণ।
নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এই বিলকে বাস্তবে রূপায়িত করার গুরুত্ব সম্বন্ধে আপনারা নিশ্চয় সহমত হবেন।
এই বিষয়গুলো আমি এতই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করি যে আমার বইয়ের পরের দিকে এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
রাষ্ট্রপতি ভবনে আমার এক অভিনব অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যখনই কোনও বিশেষ রাজ্য বা সরকারি বিভাগ বা মন্ত্রকের কোনও বিশেষ প্রতিষ্ঠান, পরিকল্পনা কমিশন বা রাজ্য সরকার থেকে কোনও নির্ভুল সর্বশেষ তথ্য প্রয়োজন হত সংশ্লিষ্ট এজেন্সি রাষ্ট্রপতির সচিবালয় থেকে কোনও তাগিদ ছাড়াই পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রেরণ করত। জাতি, সংসদ এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা, সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে অভিভাষণ রচনায় এই তথ্যসমূহ আমার পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। এই প্রক্রিয়াগত সুবিধা পূর্বে কখনও এইভাবে কাজে লাগানো হয়নি।
আমরা রাষ্ট্রপতি ভবনে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কর্মদক্ষতা তৈরি করতে পেরেছিলাম। কার্যত অধিবেশন এবং বৈঠকের সুবিধা ব্যবস্থা করার ফলে দূরতম অঞ্চলের বিভিন্ন সংগঠনের খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমরা চিন্তাউদ্রেককারী আদানপ্রদান করতে সক্ষম হতাম। রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে আমি বারোটা রাজ্য বিধানসভার উদ্দেশে অভিভাষণ দিয়েছিলাম এবং রাজ্যের সমৃদ্ধির লক্ষ্যের কথা বলেছিলাম—তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষ, তথ্য নিবেশ, চিন্তাদায়ী আলোচনা দ্বারা সমৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিতে পনেরো দিন থেকে একমাস লেগে যেত। এই প্রস্তুতির জন্য ভিডিও অধিবেশন রাষ্ট্রপতি ভবনের মাল্টিমিডিয়া বন্দোবস্ত থেকে সাধারণত রাত আটটা থেকে মাঝরাত অবধি চলত যখন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শদানের জন্য সাধারণভাবে পাওয়ার আশা করা যেত। এই ব্যবস্থায় যেসমস্ত রাজ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল তা হল: জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গোয়া, কর্নাটক, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, মিজোরাম, মেঘালয়, সিকিম এবং পুদুচেরি।
সমৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজ্য নির্বাচনের জন্য কিছু মাপকাঠি তার সামাজিক-অর্থনৈতিক রূপরেখা অধ্যয়ন করে স্থির করা হয়েছিল। যেমন, মাথাপিছু রোজগার, শিক্ষাহার, দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা, বেকারত্বের হার, শিশুমৃত্যু হার, প্রসূতি-মৃত্যু হার এবং সে রাজ্যের কৃষি, শিল্প এবং সেবামূলক পরিষেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, বিহারের ক্ষেত্রে মিশন বা লক্ষ্য চিহ্নিত করেছিল— ১. কৃষি এবং পশুপালন উৎপাদনে মূল্য সংযোজন, ২. শিক্ষা ও শিল্পোদ্যোগ, ৩. মানবসম্পদ, ৪. নালন্দা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৫. স্বাস্থ্য পরিষেবা লক্ষ্য, ৬. বন্যা ব্যবস্থাপন, ৭. পর্যটন, ৮. পরিকাঠামো, ৯. বিশেষ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, ১০. ই-গভর্ন্যান্স।
২০১০ সালের মধ্যে বিহারের মাথাপিছু উপার্জন ৬৩০০.০০ টাকা (২০০৫-০৬) থেকে বাড়িয়ে ৩৫,০০০.০০ করার জন্য এবং এছাড়াও, ২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ১ কোটি বা ১০ মিলিয়ন বেকার-আধা বেকারের বৃহদাকারে রোজগারের উপায়ের পথপ্রদর্শনে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য দশটি লক্ষ্যের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। ২০১৫-র মধ্যে ১০০ শতাংশ শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য বিহারকে নির্দিষ্ট অভিমুখে এগোতে হবে। সরকার অনেক প্রকল্প গ্রহণ করেছে এবং আমি সন্তুষ্ট যে বিহার আজকের দিনে দেশের দ্রুততম উন্নয়নশীল রাজ্য। উপরন্তু, উপার্জনের জন্য বহির্রাজ্য অভিমুখী মানুষের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। এর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে বিহারে বৃহদায়তন মূল্যযুক্ত কর্মসংস্থান সৃজন শুরু হয়েছে।
বিধায়কবৃন্দের কাছ থেকে সু-সহযোগিতা ছিল। প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে রাজ্যে অনেক ক্রিয়া-কেন্দ্রিক কার্যসূচির প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। বিধানসভায় অভিভাষণ দেওয়ার পর আমি রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের উদ্দেশে এবং একই বিষয়ে বণিকসভার উদ্দেশে অভিভাষণ দিয়েছি।
কেরলে ‘মালয়লা মনোরমা’ পত্রিকা কেরলের সমৃদ্ধি লক্ষ্য মালয়লাম ভাষায় অনুবাদ করেছিল। জেলাভিত্তিক কর্মশালার আয়োজন করেছিল এবং কোন পদ্ধতিতে মিশন বা লক্ষ্য সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করা সম্ভব সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের মতামত চাওয়া হয়েছিল এবং সে সুপারিশগুলো বিধানমণ্ডলে প্রেরণ করা হয়েছিল। অন্যান্য রাজ্যেও প্রচারমাধ্যম এই বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল এবং আমি বিভিন্ন রাজ্য সংগঠন থেকে অজস্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম।
.
আমার স্বপ্ন লক্ষ কোটি মানুষ সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের সাধারণ সূত্রে গ্রন্থিত হোক। আমাদের মহান মহাকাব্যগুলো আমাদের গৌরবময় অতীতের কথা স্মরণ করায় এবং সুন্দর ভবিষ্যতের আশা পোষণ করে।
০৬. অন্য সকলের কাছ থেকে শিক্ষা
৬. অন্য সকলের কাছ থেকে শিক্ষা
“আমি যেন নিঃসহায় মানুষের রক্ষাকর্তা হতে পারি
সর্ব পর্যটকের জন্য পথের দিশারী হতে পারি;
যারা (জল) পার হতে চায়
তাদের সবার জন্য আমি যেন একটা সেতু, একটা নৌকা, একটা জাহাজ হতে পারি।”
-আচার্য শান্তিদেব
৮ম শতকের বৌদ্ধগুরু
সকল মানুষের মন কীভাবে মিলিত হয়ে সাফল্যকে প্রতিষ্ঠাদান করে তা আমায় মোহিত করে। এ খুব সহজ পন্থা নয়, আশানুরূপ সিদ্ধিলাভের ঘাটতির কারণ হিসেবে বলা চলে এতে নানা মতের সমাবেশ। রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নসাধন কালে দলবদ্ধভাবে আমাদের অনেক কাজ করতে হত। আমি কাজ করতে করতে মানুষের ভাবনাচিন্তার পদ্ধতিগুলো কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে এবং তাঁদের কাছ থেকে শিখতে শুরু করি। ইন্ডিয়া ২০২০কে স্পষ্টরূপে বাস্তবে রূপদানের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার পদ্ধতি এই অভ্যাসকে আরও জোরালো করেছিল। রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং পরবর্তীকালে অভিজ্ঞ এবং অনভিজ্ঞ মানুষের আদর্শ, মতামত এবং সমালোচনা থেকে লাভবান হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সব ধরনের মতামত ও জিজ্ঞাসা মানবোন্নয়নে পথপ্রদর্শনকারী জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ও পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের হাজার হাজার ঘটনার মধ্যে সামান্য কিছু ঘটনার উল্লেখ করতে চাই, যা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত করেছে।
উপহার:
আমি অনেকবার এই ঘটনাটি বলেছি, তাই এখন খুব সংক্ষেপে বলব। আমি যখন ছোট তখন আমার বাবা জনাব আভুল পাকির জয়নুলাবেদিন আমায় এক শিক্ষা দিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতালাভের ঠিক পরবর্তী সময়ে। রামেশ্বরম দ্বীপে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল এবং আমার বাবা গ্রামপরিষদের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁকে এজন্য নির্বাচন করা হয়নি যে, তিনি কোনও বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ভুক্ত অথবা বিশেষ কোনও অর্থনৈতিক স্তরের মানুষ ছিলেন। তাঁকে তাঁর চরিত্রমাহাত্ম্যে ও একজন মহৎ মানুষ হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল।
যেদিন বাবাকে সভাপতি হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল সেদিন এক ভদ্রলোক আমাদের বাড়ি আসেন। আমি তখনও স্কুলে পড়ি, সেসময় জোরে জোরে আমার পড়া তৈরি করছিলাম, এমন সময় শুনলাম দরজায় কেউ করাঘাত করছে। রামেশ্বরমে তখন কেউ বাড়ির দরজা বন্ধ করত না। এক ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে বাবার খোঁজ করলেন। বাবা তখন সান্ধ্য নমাজ পড়তে গেছেন শুনে তিনি বললেন, বাবার জন্য তিনি কিছু নিয়ে এসেছেন, শুধালেন সেগুলো রেখে যাওয়া যাবে কি না। আমি তাঁকে সেগুলো খাটিয়ার ওপর রাখতে বলে আবার পড়ায় মন দিলাম।
বাবা নমাজ সেরে ফিরে, খাটিয়ার ওপর একটা রুপোর প্লেট এবং উপহারসামগ্রী পড়ে থাকতে দেখে আমায় জিজ্ঞেস করলেন। আমি তাঁকে জানালাম যে এক ভদ্রলোক এসে ওসব ওঁর জন্য রেখে গেছেন। মোড়ক খুলে দেখা গেল দামি কাপড়ের সঙ্গে কয়েকটা রুপোর কাপ, কিছু ফল এবং মিষ্টি রয়েছে। সেসব জিনিসপত্র দেখে বাবা দারুণ বিরক্ত হলেন ও রেগে গেলেন। সবচেয়ে ছোট সন্তান হিসেবে আমি বাবার খুব আদরের ছিলাম। বাবাকেও আমি ভীষণ ভালবাসতাম। সেদিন প্রথম আমি বাবাকে অত রেগে যেতে দেখলাম এবং সেবার প্রথম বাবার হাতে আচ্ছামতো পিটুনি খেলাম। আমি ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। পরে বাবা আমায় বুঝিয়েছিলেন কেন তিনি অত রেগে গেছিলেন, এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন কখনও কোনও উপহার ওঁর অনুমতি ছাড়া যেন গ্রহণ না করি। তিনি হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিলেন, ‘পরমেশ্বর যখন মানুষকে কোনও কাজে নিযুক্ত করেন তিনি তাঁর প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখেন, এর বাইরে যদি কেউ কিছু গ্রহণ করে সেটা অবৈধ।’
তিনি আমায় বলেছিলেন, উপহার নেওয়া ভাল অভ্যাস নয়। উপহারের সঙ্গে কোনও উদ্দেশ্য জড়িত থাকে যা খুব বিপজ্জনক। ঠিক যেমন বিষধর সাপকে স্পর্শ করা পরিবর্তে বিষদংশন সহ্য করা। আশি বছর বয়সেও এই শিক্ষা আজও আমার মনে দাগ কেটে রেখেছে। ঘটনাটা গভীরভাবে আমার মনে মুদ্রিত হয়ে আমার মূল্যবোধ গঠনে সাহায্য করেছিল। এখনও কেউ যদি আমায় কোনও উপহার দিতে চায় আমার শরীর আর মন শিউরে ওঠে।
পরবর্তীকালে আমি মনুস্মৃতি বা মনুর বিধান পড়েছি-যাকে হিন্দু ধর্মভাবনায় মূলসূত্র হিসেবে মান্য করা হয়। সেখানেও বলা হয়েছে উপহার গ্রহণ করলে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত ঐশ্বরিক শক্তি নির্বাপিত হয়ে যায়। মনু প্রতিটা ব্যক্তিকে উপহার গ্রহণের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। কারণ উপহার স্বীকার করলে গ্রহীতা দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হন। পরিবর্তে তিনি কোনও অনৈতিক বা অবৈধ কাজ করতে বাধ্য হন।
এক সযত্নলালিত মূল্যবোধ ব্যবস্থা
কয়েক মাস আগে, আমার বড় দাদা একদিন আমায় রামেশ্বরম থেকে ফোন করেছিলেন। তাঁর তখন পঁচানব্বই বছর বয়স। তিনি আমার সঙ্গে ফোনে বার্তালাপ শুরু করেছিলেন আমেরিকাবাসী আমার এক ভারতীয় বন্ধুর কথা দিয়ে— বন্ধুটি আমার দাদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আলাপচারিতার মধ্যে আমার বন্ধু দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমাদের বাসগৃহটি কত পুরনো। উত্তরে দাদা জানিয়েছিলেন বাড়িটা একশো বছরেরও আগে আমার বাবা তৈরি করেছিলেন। আমার ছোট ভাই এবং উপার্জনশীল নাতিরা প্রস্তাব দিয়েছিলেন পুরনো বাড়িটা ভেঙে ওই জায়গায় নতুন বাড়ি করার। আমার বন্ধুটি বলেছিলেন ওরকম ঐতিহাসিক স্থান ধ্বংস করা তাঁর মনঃপূত নয়। তাঁর ইচ্ছা কোনও অছির মাধ্যমে এমন একটা ব্যবস্থা করা যাতে বাসগৃহটা জাদুঘর ও গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত হয়, পাশাপাশি আমার ভাই এবং তাঁর পরিবারের জন্য বিকল্প বসবাসের বন্দোবস্ত করা সম্ভব। দাদা আমায় ফোন করেছিলেন জানানোর জন্য যে, তিনি এই প্রস্তাবের বিরোধী— ‘আমি যে বাড়িতে বড় হয়েছি এবং ৯৫ বছর ধরে বাস করছি সে বাড়িতেই আমি থাকতে চাই। আমার যাবতীয় কিছু দিয়ে ওই জায়গাতেই একটা নতুন বাড়ি তৈরি করতে চাই— এ ছাড়া অন্য কোনও বন্দোবস্ত আমার পছন্দ নয়। তুমি তোমার বন্ধুকে সুন্দরভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে দিয়ো।’ দাদার কথায় আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম যে, একজন মানুষ যিনি নিজের শর্তে বাঁচবেন এবং কারও কাছ থেকে কোনও সাহায্য নেবেন না, যতই তা অর্থবহ হোক-না কেন— আমার কাছে এ এক পরমশিক্ষা এবং বড়দাদার মধ্যে আমি আমার বাবার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছিলাম। বাবা একশো তিন বছর বয়স অবধি বেঁচে ছিলেন এবং আমাদের মধ্যে এই ধরনের ঐতিহ্য বদ্ধমূল গেঁথে দিয়েছিলেন।
এক হজ তীর্থযাত্রা
ব্যস্ত একটা দিন। লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার, ফাইলপত্র পর্যালোচনা করার কাজকর্ম চলছিল। সেইসময় আমার দাদার নাতি মক্কা থেকে ফোন করল। ও আমার জীবনের অন্যতম এক মহান উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেছিল। আমার পরিবারের তিনজন সদস্য এক স্মরণীয় আধ্যাত্মিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিন প্রজন্মের তিনজন সদস্য ছিলেন— নব্বই বছর বয়সি আমার দাদা, তাঁর মেয়ে এবং নাতি। এই তিনজন ২০০৫-এর ডিসেম্বর মাসে চেন্নাই থেকে হজ তীর্থ করতে যাত্রা করেছিলেন।
আমার দাদা যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়েছিলেন বলে এই পরিকল্পনাটা আমার হৃদয়ের খুব কাছের ছিল এবং তাঁর ধর্মবিশ্বাসই ছিল তাঁদের হজ তীর্থযাত্রায় পাঠানোর মূল চালিকাশক্তি। সৌদি আরবে আমাদের রাষ্ট্রদূত এই তীর্থযাত্রা সম্পর্কে জানতে পেরে আমায় রাষ্ট্রপতি ভবনে টেলিফোন করেছিলেন, এবং যে-কোনওরকম সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, রাষ্ট্রদূত মহাশয়, শুধু একটা অনুরোধ— আমার দাদার ইচ্ছে তিনি কোনও সরকারি সাহায্য ব্যতিরেকে একজন সাধারণ নাগরিকের মতো হজ তীর্থযাত্রায় যান। এ তাঁর ব্যক্তিগত মনোবাসনা। তীর্থযাত্রার জন্য হজ কমিটি যে সাধারণ পদ্ধতিতে যাত্রী নির্বাচন করেন আমার দাদা সে পদ্ধতির মাধ্যমেই নির্বাচিত হওয়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর নাতি নিজে গিয়ে নির্বাচন দপ্তরে দরখাস্ত জমা দিয়েছিলেন এবং কমিটির প্রচলিত যদৃচ্ছ নির্বাচন পদ্ধতিতে, ঈশ্বরের আশীর্বাদে তাঁদের বেছে নেওয়া হয়েছিল।
এই তীর্থযাত্রা নানা স্থানে, নানা ধর্মীয় অবশ্যকরণীয় কর্তব্যপালনের মধ্য দিয়ে পঞ্চাশ দিন ধরে চলেছিল।
দাদার সঙ্গে ওঁর কন্যা এবং নাতি ছিলেন, তীর্থযাত্রায় দাদাকে সাহায্য করার জন্য আমি ওঁদের দাদার সঙ্গে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু দাদা সব রকমের অসুবিধে আর অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হওয়ার জন্য বিশেষ প্রাণোচ্ছলতা এবং মানসিক জোর দেখিয়েছিলেন। তিনি শান্ত সমাহিতভাবে নাতিকে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতে অনুমতি দিয়েছিলেন এবং তার নির্দেশ কোনও অদলবদল না করে মেনে চলেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তীর্থযাত্রার সময় ওঁর নাতি প্রচণ্ড জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। দাদা ওই পরিস্থিতিতে সব দায়িত্বভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন, পরিবারের কোনও সমস্যার সম্মুখীন হলে যা তিনি সর্বদা করে থাকেন। মসজিদ দর্শন, খাওয়াদাওয়ার সমন্বয়সাধন, প্রয়োজন অনুসারে ডাক্তার তলবের দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। ওঁর নাতি আমায় বলেছিল জ্বরের ঘোরে যতটুকু মনে পড়ে রাত্রে দাদা ওর বিছানার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে অন্ততপক্ষে তিন ঘণ্টা ধরে প্রার্থনা করতেন। যখন নাতি সুস্থ হয়ে উঠল আবার তখন পূর্বেকার ছন্দে শান্তভাবে প্রার্থনায় ফিরে গেলেন।
ওঁর নাতি আমাকে শেষ ক’দিনে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল তা বুঝিয়ে বলেছিল। মিনায় তাঁবুতে দিনযাপন করে আরাফতের দিকে তাঁরা এগিয়েছিলেন, আরাফত এমন একটা জায়গা যেখানে ৫০ লক্ষ তীর্থযাত্রী একত্রিত হয়। আমি বেশ কল্পনা করতে পারি দাদা আকাশের দিকে দু’ হাত তুলে প্রার্থনা করছেন।
এরকম এক দিন, দাদার নাতি মূল মসজিদের ওপরের তলে প্রার্থনা সেরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসছিল। তীর্থযাত্রীদের সিঁড়ি ব্যবহার করতে হত, কেননা দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য চলমান সিঁড়ি বা এসকেলেটর বন্ধ করে দেওয়া হত। যদিও ওই মারাত্মক ভিড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামা যথেষ্ট কষ্টকর ছিল। ফলে ভিড়ের চাপে নাতির দেওয়ালে পিষে যাওয়ার উপক্রম হল। ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ছটফট করছিল। হঠাৎ ওর মনে হতে লাগল চারদিকের বাতাসের রুদ্ধচাপ একটু যেন হালকা হয়ে গেল এবং ওর চারদিকটা ফাঁকা হয়ে গেল। আসলে ওকে শ্বাসকষ্টে ছটফট করতে দেখে আফ্রিকা থেকে আগত এক তীর্থযাত্রী এগিয়ে এসেছিলেন। নিজের শক্তসমর্থ চেহারা দিয়ে উপচে পড়া ভিড় থেকে আড়াল করে নাতিকে বাঁচিয়েছিলেন। যখন তাঁরা নীচের তলায় পৌঁছলেন ধন্যবাদ জানানোর সুযোগটুকু না দিয়ে ওই তীর্থযাত্রী কোথাও উধাও হয়ে যান।
দ্বিতীয় ঘটনাটা আরও উৎসাহজনক। আরাফতে প্রার্থনা জানানো হলে ওঁরা মিনায় ফিরলেন। সমস্ত ৫০ লক্ষ তীর্থযাত্রীকে একই দিনে টানা ১৫ কিমি রাস্তা ফিরতে হয়। দাদারা যে গাড়িতে ফিরছিলেন তার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছিল। মরুভূমিতে তীব্র গরম অথচ আমার দাদা একবিন্দু জল বা খাবার গ্রহণ না করে সারা রাস্তা প্রার্থনা করছিলেন। প্রতি আধঘণ্টায় গাড়ি একটু একটু করে এগোচ্ছিল এবং তাঁরা টানা আট ঘণ্টা ধরে গাড়িতে ছিলেন। শেষপর্যন্ত গাড়ির চালক প্রস্তাব করল যেহেতু গন্তব্যস্থল আর আধঘণ্টাটাক পায়ে হাঁটার রাস্তা সুতরাং ওটুকু রাস্তা হেঁটে যাওয়াই ভাল। দাদার কাছে এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য বলে মনে হল। নাতি দাদার আপত্তি সত্ত্বেও তাঁকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল। যেতে যেতে রাস্তার একটা ফাটলের কাছে এসে তাঁরা আটকে গেলেন— এবার দাদাকে হুইলচেয়ার থেকে নেমে ফাটল পার হতে হবে। দু’জন তীর্থযাত্রী সমস্যা বুঝতে পেরে দাদাকে ইশারায় হুইলচেয়ারে বসে থাকতে বললেন। এমনকী তাঁর নাতি কিছু বলার আগেই দু’জন এসে হুইলচেয়ার দাদা-সহ তুলে ফাটলের ওপারে পার করে দিয়ে চলে গেলেন। এবারও তাঁরা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার সুযোগটুকু পেলেন না।
মাঝদালিফা নামক এক জায়গায় তীর্থযাত্রীদের খোলা প্রাঙ্গণে রাত্রিযাপন করতে হয়েছিল। মরুভূমিতে শীতের রাত্রে, খোলা আকাশের নীচে মাটিতে শুধু মাদুর পেতে শুতে হয়েছিল। পরনের হালকা কাপড় শীতে যথেষ্ট আরামদায়ক ছিল না। ভোরবেলায় শৌচাগারের সামনে সুদীর্ঘ লাইন। যারা বচসা করে সুযোগ পেতে অপারগ তারা শান্ত হয়ে ধৈর্যসহকারে প্রতীক্ষা করছিল। এরকম একটা লাইনে একজন মহিলা প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় এক অল্পবয়সি মেয়ে এগিয়ে এসে ওঁর কাছে প্রার্থনা করল—শৌচাগারে ওকে আগে যেতে দেওয়া হোক, লাইনের আর সকলে ব্যাপারটা মহিলার সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিল। ভদ্রমহিলা সেই মেয়েটিকে যেতে দিলেন। একটু পরে আরও একজন বৃদ্ধা মহিলা এসে ওঁকে একই অনুরোধ জানালেন, ওখানে যারা উপস্থিত ছিল তারা প্রত্যেকেই ভাবছিল এতক্ষণ ধরে অপেক্ষায় থাকা ভদ্রমহিলা হয়তো দ্বিতীয়বার কাউকে সুযোগ দেবেন না। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে দ্বিতীয়বারও ভদ্রমহিলা ওই বৃদ্ধা মহিলাকে তৎক্ষণাৎ যেতে দিলেন। একথা এখানে মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা কিন্তু একে অপরের ভাষা জানেন না, আকারে ইঙ্গিতে তাঁরা মনের ভাব প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু এই ঘটনাংশ আমাদের শেখায় ছোট্ট ছোট্ট ব্যঞ্জনাপূর্ণ কাজ আমাদের জীবনকে মহৎ করে তোলে।
আমার দাদার মেয়ে নাজিমা এবং নাতি গুলাম কে মউনুদ্দিনের কথাবার্তা থেকে আমার এই উপলব্ধি হয়েছিল, যদি সুযোগ দেওয়া হয়, মানুষের প্রতি ভালবাসার অবারিত নদী বিভেদের সব চিহ্নকে মুছে ফেলতে পারে।
ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ’
আমি যখন ২০০৬-এ কোয়েম্বাটুর পরিদর্শনে গেছিলাম তখন ফিল্ড মার্শাল-এর কাছ থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটা টেলিফোন এসেছিল। যখন আমায় সংবাদ প্রেরণ করা হল আমি বলেছিলাম, ওয়েলিংটনে সেনাবাহিনীর হাসপাতালে আমি অবশ্যই ওঁর সঙ্গে দেখা করব। ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের কথা বলি—
১৯৯০-র নাগাদ একবার আমি যখন ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমানে চড়ে যাচ্ছিলাম, আমার সহযাত্রী ভদ্রলোক ছিলেন ফিল্ড মার্শাল এম এইচ এফ জে ‘স্যাম’ মানেকশ’। আমি নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম রক্ষামন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে। তাঁকে এ কথা বলাতে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তিনি কি অতি সজ্জন ব্যক্তি?’ তাঁর পরের প্রশ্ন ছিল, ‘আপনার বয়স কত?’ উত্তরে জানালাম আমার বয়স উনসত্তর বছর। শুনে তিনি বললেন, ‘আপনি তো নেহাতই বাচ্চা!’ আমি কখনও ভাবিনি যে আমি ফিল্ড মার্শালকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বময় কর্তা হিসেবে পাব। যে মুহূর্তে আমি ওঁর ঘরে ঢুকলাম উনি সবাইকে বাইরে যেতে বললেন। আমায় উনি কাছে বসতে বলে আমার হাত দুটি ধরে বললেন, ‘কী অসাধারণ রাষ্ট্রপতি আপনি, আমি যখন ক্ষমতায় নেই আপনি তখন একজন সৈনিককে সম্মানিত করছেন।’ আমায় দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, শয্যাশায়ী, তবুও তখনও তাঁর মনে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কার্যোপযোগিতা সম্বন্ধে ভাবনাচিন্তা বজায় আছে। তিনি বললেন যে, প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রতিপক্ষ এবং উদ্ভাবনী প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির কারণে সর্বদা শক্তিশালী করে রাখতে হবে। তিনি আমায় এক কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন করলেন, ‘কালাম আপনি কি বলতে পারেন আর এক দশকের মধ্যে বর্তমান অস্ত্রগুলি কি বরবাদ হয়ে যাবে এবং বৈদ্যুতিন আর সাইবার যুদ্ধপ্রযুক্তি তার জায়গা নেবে?’ ফিল্ড মার্শালের কাছ থেকে শোনা এই প্রশ্ন আমার মনে বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল এবং আমি যখন কোনও এক মহান আধ্যাত্মিক নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পৃথিবী থেকে পারমাণবিক অস্ত্রসমূহ নির্মূল করা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলাম তখন আমার ভেতর থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এসেছিল। আমি যখন ফিল্ড মার্শালকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কি আপনার জন্য কিছু করতে পারি?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি জানি না, কিন্তু একটা কথা আমি বলতে চাই— আমাদের দেশের ফিল্ড মার্শাল বা তার সম-পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিকে দেশের কাছে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন হতে হবে।’ এই মন্তব্য আমার মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে গেছিল।
দিল্লি আসামাত্রই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার অন্যান্য কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য বৈঠক ছিল। আমি তাঁকে বলেছিলাম ফিল্ড মার্শাল মানেকশ’ দেশের জন্য যে মহান কর্তব্য করেছিলেন তার প্রতি আমাদের উপযুক্ত সম্মান জানানো উচিত। ওইদিন সাক্ষাৎকারপ্রার্থী উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য রাত্রিকালীন ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর প্রধানদের কাছে আমি ফিল্ড মার্শাল মানেকশ’ এবং বিমানবাহিনী প্রধান অর্জুন সিং-এর উপযুক্ত সম্মানজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিলাম। তৎক্ষণাৎ আমার সচিব পি এম নায়ারকে ডেকে পাঠালাম। অতীতের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে নোট তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাতে বললাম। দেশের প্রতি তাঁর অবদানের প্রকৃতি বিবেচনা করে সরকার খুব সন্তুষ্টচিত্তে তাঁর বেতন পুনর্নির্ধারণ করলেন। আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম যে ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ’-এর জীবদ্দশায় এই স্বীকৃতি প্রদান সম্ভব হয়েছিল।
অদ্বিতীয় খুশবন্ত
খুশবন্ত সিং-এর সঙ্গে পরিচয় হওয়া আমার কাছে এক মস্ত অভিজ্ঞতা, উনি এখন নব্বই বছর পার করেছেন। আমি ওঁর লেখা কিছু বই পড়েছি এবং ‘হিন্দুস্থান টাইমস্’ সংবাদপত্রে ওঁর কলামের (Column)-এর একজন উৎসাহী পাঠক। অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন কেন আমি বিশেষ করে ওঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আমার উত্তর ছিল আমি বই এবং তার লেখকদের পছন্দ করি। খুশবন্ত সিং একজন মহান লেখক এবং পঁচানব্বই বছর বয়সেও তিনি অবিরাম লিখে চলেছেন। তিনি ২০০৭ সালে তাঁর কলামে আমাকে নিয়ে লিখেছিলেন। আমি তার একটা সংক্ষিপ্ত রূপ তুলে দিচ্ছি। এতে ঈশ্বর সম্বন্ধে ওঁর এবং আমার যে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণিত হয়েছিল, সেগুলো আমার চিন্তানুযায়ী যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক ছিল।
‘আর কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের প্রজাতান্ত্রিক দেশের একাদশতম রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদকাল সমাপ্ত করে অবসরগ্রহণ করবেন। সর্বোচ্চ পদাধিকারী হিসেবে তিনি ছিলেন মুসলিম ধর্মের তৃতীয় ব্যক্তি। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের দাবির এটাই এক সুষ্ঠু প্রমাণ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের কাছে শিক্ষণীয়।
আমার কোনও ধারণা নেই অবসর গ্রহণের পর তিনি তাঁর গবেষণায় ফিরবেন, কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন, না সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করবেন। তিনি সত্তর বছর বয়স পার করেছেন। আমার একবার ওঁর সঙ্গে আধঘণ্টা কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। আমার গৃহে এসে তিনি আমায় সম্মানিত করেছিলেন। রাষ্ট্রের প্রধান যখন সাধারণ একজন কেরানির সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখন তাঁর বিনম্রতাই প্রকাশ পায়।
আমাদের দু’জনের মধ্যে খুব সামান্যই মিল আছে। তিনি তামিল আর আমি তামিল ভাষায় মাত্র দুটো শব্দ জানি—ওয়ানাক্কাম আর আই-আই-য়ো। তিনি বিজ্ঞানসাধক হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত ধার্মিক। আমি একজন অজ্ঞেয়বাদী এবং বিশ্বাস করি বিজ্ঞান এবং ধর্ম একসঙ্গে পথ চলতে পারে না। একটা হল যুক্তিনির্ভর, আর একটা হল বিশ্বাসনির্ভর। ওঁর সঙ্গে কথা বলে এবং ওঁর লেখা পড়ে মনে হল মহাত্মা গাঁধীর মতোই এঁর ধর্মবিশ্বাস। বাপুর সব মতবাদ গ্রহণ করার অক্ষমতা সত্ত্বেও আমি নিজেকে গাঁধীবাদী বলি। কালামও বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব দেখেন না। যখন আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম যে তিনি কি “শেষ বিচারের দিন” এবং আমাদের সকলকে জীবনের পরে পুরস্কার অথবা শাস্তি নিতে হতে পারে এই বিষয়টি বিশ্বাস করেন, তিনি পাশ কাটানো উত্তর দিলেন, ‘স্বর্গ এবং নরক মনের মধ্যে থাকে…।’
সুতরাং ঈশ্বর সম্পর্কে কালামের মত তা হলে কী? আল্লাহ বনাম ঈশ্বর, খোদা বনাম ভগবান তো নয়। তাঁকে মসজিদ বা মন্দিরে খুঁজে পাওয়ার নয়। তাঁকে যুদ্ধ করে বা আত্মোৎসর্গে খুঁজে পাওয়া যায় না— যেমন আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মের মূল প্রচারকরা করে থাকেন। তাঁরা একে অপরের রক্তপাত করার পর ঈশ্বরসম কণ্ঠে বজ্র ঘোষণা ওঠে:
আলোক থেকে সহসা বজ্রনিনাদ গর্জিত হল
‘শোনো সবাই! আমি তোমাদের কারও নই!
প্রেম ছিল আমার ব্রত, আর তোমরা ঘৃণায় তা অপচয় করেছ,
আমার হর্ষকে হনন করে, জীবনকে শ্বাসরোধ করে।
জেনো: খোদা আর রাম
উভয়েই এক, ভালবাসায় তাঁরা প্রস্ফুটিত।’
কোনও যুক্তিবাদী ঈশ্বরত্ব সম্বন্ধে কালামের দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচনা করতে পারবেন না। কেউ ঈশ্বরকে দেখেন সত্যরূপে, কেউ প্রেমরূপে। কালামের কাছে ঈশ্বরত্ব হল সহানুভূতি…।’
আমি ওঁর রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিলাম, কারণ আমি মনে করি খুশবন্তের মতো লেখকের আমার লেখা নিয়ে অতটা সময় ধরে পর্যালোচনা করা এবং ঈশ্বর, ধর্ম ও সৎ মানুষ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় মানবিক গুণ সম্পর্কে আমার অভিমত নিবেদন করা আমার বিবেচনায় খুব বিরল সৌভাগ্য।
দানেই আমাদের প্রাপ্তি
অবশ্যই আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ ধনসম্পদে সৌভাগ্যবান। আমি এখানে এমন এক ব্যক্তির কথা বলব যিনি মুক্তহস্তে দান করেছেন এবং সারা বিশ্বে আনন্দ বিতরণ করেছেন। ২০০৭ সালে আমি শ্রীশ্রীশিবকুমার স্বামীগালুর শততম বার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার অনুরোধ নিয়ে সিদ্ধগঙ্গা মঠে এক ব্যক্তিগত আমন্ত্রণ পেলাম। ওখানে পৌঁছে দেখলাম লক্ষ লক্ষ ভক্ত আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন স্বামীজিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য জমায়েত হয়েছে। মঞ্চে অনেক রাজনৈতিক নেতা ও ধর্মগুরুও আসীন ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য রাখা হয়ে গেলে স্বামীজি এলেন। কোনও লিখিত বিবৃতি ছাড়াই ভক্তকুলের উদ্দেশে তাঁর আশিসবাণী তাত্ক্ষণিক বক্তৃতার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেন। আমি ওই দৃশ্য দেখে পরমবিস্মিত হয়েছিলাম। একশো বছর বয়সি ওই মহান নেতা ঋজু শরীরে, হাসিমুখে বক্তৃতা দিচ্ছেন এই দৃশ্য আমায় নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছিল কীভাবে তিনি নিজের শক্তি এবং উৎসাহ এত সুন্দরভাবে বজায় রেখেছেন। এর একমাত্র কারণ আমি মনে করি, তিনি মুক্ত হস্তে দান করেছেন। শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অগুনতি অনাথাশ্রম এবং প্রতিদিন হাজার হাজার দুঃস্থ মানুষকে খাদ্যদানের মাধ্যমে প্রভূত দান করেছেন। ওঁর অক্লান্ত সেবাব্রত এবং অশিক্ষা ও সামাজিক বৈষম্য বিলোপসাধনের প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে ওই অঞ্চলের অনেক মানুষকে উন্নীত করেছিল। আমি এটা লিখতে অনুপ্রাণিত হলাম—
আমি কী দিতে পারি?
হে আমার সহ-নাগরিক বন্ধু,
তুমি দিয়ে দেহমনে অশেষ আনন্দ পাও।
তোমার দেবার সবকিছু আছে।
যদি তোমার জ্ঞান থাকে, বণ্টন করো।
যদি তোমার সংস্থান থাকে, নিঃস্বকে দান করো।
হৃদয় আর মস্তিষ্ক ব্যবহার করে
পীড়িতের যন্ত্রণা দূর করো
ব্যথিত হৃদয়কে উৎফুল্ল করো,
দেবার বদলে পাবে অপার আনন্দ।
সর্বশক্তিমান তোমার সমস্ত কর্মোদ্যোগ আশীর্বাদ করবেন।
প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে ধ্যানধারণার আদানপ্রদান
ডিআরডিএল-এর অধিকর্তা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা, ক্যাবিনেটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি পদমর্যাদাকালে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে ধ্যানধারণা আদানপ্রদানের সৌভাগ্য আমার হয়েছে, যেমন-ড. সতীশ ধাওয়ান, ড. রাজা রামান্না, ড. ভি এস অরুণাচলম, আর ভেঙ্কটরামন, পি ভি নরসিংহ রাও, এইচ ডি দেবেগৌড়া, আই কে গুজরাল, অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং ড. মনমোহন সিং। এই যোগাযোগ ভীষণ অর্থবহ ছিল এবং আমার হৃদয়ে এক চিরস্থায়ী চিহ্ন রেখে গিয়েছিল। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তা এবং ইসরো প্রধান ড. সতীশ ধাওয়ানের কাছ থেকে শিখেছিলাম কোনও জটিল লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে হলে সবসময় তার চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি বলতেন কখনও কোনও সমস্যা যেন তোমার নিয়ামক না হয়। তুমি হবে সমস্যার পরিচালক। সমস্যাকে পরাজিত করো ও সাফল্য লাভ করো। কোনও জটিল কর্ম সম্পাদনে নিযুক্ত যাঁরা, তাঁদের কাছে এ এক মহৎ শিক্ষা। ড. রাজা রামান্না এবং ড. অরুণাচলম কোনও ব্যক্তির যোগ্যতা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে এবং জটিল কর্ম সম্পাদনের উপযুক্ত ব্যক্তি নিযুক্ত করার কুশলতা প্রদর্শন করেছিলেন। আর ভেঙ্কটরামন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে আমাদের দেশের প্রতিরক্ষার জন্য ব্যাপকাকারে সশস্ত্র বহুগুণক ব্যবস্থার চাহিদা আন্দাজ করে এ কার্যক্রমে উত্তরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, যা আজকের দিনে বহুল পরিমাণে কাজে আসছে।
নরসিংহ রাও অসম্ভব স্বচ্ছ চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, দেশের উন্নয়নমূলক সমস্ত বিষয় তাঁর করায়ত্ত ছিল। একবার, তিনি যখন প্রতিরক্ষা পরামর্শদাতা কমিটির সভাপতিত্ব করছেন, তখন ASC (Army Supply Corps) জোগান এবং পরিবহণের মহানির্দেশক দুগ্ধজাত খামার-এর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব এবং পরিকল্পনার আধুনিকীকরণ বিষয়ে একটা প্রেজেন্টেশন করছিলেন। প্রেজেন্টেশন চলাকালীন মহানির্দেশক উল্লেখ করেছিলেন, মহিষের বদলে সে জায়গায় জার্সি গোরু আনতে চান। রাও তত্ক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন আমাদের দেশের পক্ষে মহিষ তুলনাহীন, কেননা এদের ক্রান্তীয় অঞ্চলে সস্তা খোরাক ও খাদ্যে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব— পরিবর্তে পাওয়া যায় উচ্চমাত্রার প্রোটিনযুক্ত দুধ। এ ধরনের দেশীয় লাভজনক সম্পদ দেশ হারাতে পারে না। এখান থেকে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, প্রস্তাব পুনরায় পর্যালোচিত হবে এবং সেনা দুগ্ধ খামার জরুরি সংশোধনীয় ক্রিয়া গ্রহণ করবে।
অন্য এক ক্ষেত্রে ১৯৯৫ সালে কোনও একসময় যখন আমি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আত্মনির্ভরশীলতার ওপর প্রতিবেদন পেশ করছিলাম, রাও চটজলদি পর্যবেক্ষণ করলেন যে আমরা এমন এক ব্যবস্থা রাখছিলাম যে, প্রতিরক্ষা ব্যয় যেন মোট অন্তর্দেশীয় উৎপাদন বা জিডিপি-র (গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট) ৩ শতাংশে কম থাকে। তিনি বলেছিলেন এরকম কোনও সীমা নির্দিষ্ট করা উচিত নয়। বরং রাষ্ট্রের জন্য শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যা-কিছু অত্যাবশ্যকীয় তার ওপর কাজ করা উচিত। জিডিপি হয়তো ক্রমাগত পরিবর্তনশীল হবে, কিন্তু তার দরুন আমাদের ব্যয় বাড়বে-কমবে তা অভিপ্রেত নয়।
আরও একটা উদাহরণের কথা আমার মনে পড়ে— প্রযুক্তি প্রদর্শকের কার্যকলাপের অতিরিক্ত ডিআরডিও-কে অগ্নি উৎক্ষেপণ ব্যবস্থার লাগাতার অনুসন্ধান ব্যবস্থার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হত, যা সেনাবাহিনীতে যোগ করতে পারত। রাও অবিলম্বে প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এক পৃষ্ঠার প্রস্তাবনায় বিনা প্রশ্নে ৪০০ কোটি টাকা মূল্যের কার্যক্রমের অনুমোদন দিয়েছিলেন। সময়মতো কার্যনির্বাহ এবং সেনাবাহিনীতে উৎক্ষেপণ অস্ত্র প্রেরণ করার জন্য প্রয়োজনভিত্তিক পরিচালন ব্যবস্থার নকশা গড়ে তোলার সুযোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে, এই কার্যক্রম ড. মনমোহন সিং-এর অনুমোদন পেয়েছিল, সাধারণ নিয়মে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পৌঁছনোর আগে যাঁর কাছে পৌঁছনোর কথা। পরে এই নথি কার্যনির্বাহের নিয়মশৃঙ্খলায় ভারত সরকারের সচিবদের কাছে পৌঁছেছিল। কোনও কার্যক্রমের ধারণা, অনুমোদন এবং প্রয়োগসাধনের এ এক বিপরীত কর্মপ্রণালীর উদাহরণ।
পরবর্তীকালে, ২০০৪ সালে আমার ড. সিং-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁর সমগ্র অর্থনীতি সংক্রান্ত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বর্ধিত করেছিলেন, সাম্প্রতিককালে যা ৭ শতাংশ উচ্চতায় পৌঁছেছিল। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তিনি এক উষ্ণ এবং মানবিক স্পর্শ এনেছিলেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীর মধ্যে আমি যে-কোনও সিদ্ধান্তগ্রহণে তৎপরতাবোধ লক্ষ করেছিলাম। ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রথম করণীয় হিসেবে তিনি আমাকে পারমাণবিক পরীক্ষা সম্পাদনকার্য দিলেন। সাধারণভাবে বলা যায়, জাতীয় কোনও সমস্যা নিয়ে নিজের কাজ করার ক্ষেত্রে বাজপেয়ী দ্বিধাহীন। আমি আগেই বলেছি, ২০০২ সালের অগস্ট মাসে লালকেল্লার প্রাকার থেকে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ভারতবর্ষ ২০২০ সালের মধ্যে এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। ১৯৯৮ সালে এইচ ডি দেবেগৌড়া প্রথমবার ইন্ডিয়া ২০২০-কে জাতীয় কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
.
সৎ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ এক শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যক্তিদের সাক্ষাৎলাভে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করি।
০৯. আমার গুজরাত পরিদর্শন
৯. আমার গুজরাত পরিদর্শন
দেবদূত মুক্ত কারণ তার আছে জ্ঞান,
অজ্ঞানতার জন্য পশুও মুক্ত,
এই দুই-এর মাঝে সংগ্রাম করে মানবসন্তান।
—রুমি
আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি, উন্নয়নের অন্যতম স্তম্ভ হল আমাদের এমন এক রাষ্ট্র গঠন করতে হবে যেখানে দারিদ্র্য সম্পূর্ণ নির্মূল হবে এবং অশিক্ষা দূরীভূত হবে। এর পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজন এমন এক সমাজের উদ্ভব ঘটানো যেখানে নারী এবং শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধ থাকবে না এবং সমাজের কেউ নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাববে না। আমি রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করার ঠিক পরেই প্রথম গুরুতর দায়িত্বভার হিসেবে ২০০২ সালের অগস্ট মাসে যখন গুজরাত পরিদর্শনে গেছিলাম তখন এই চিন্তাগুলো আমার মনের মধ্যে প্রবলভাবে কাজ করছিল। মাত্র কয়েক মাস আগে ওই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল এবং তার দরুন হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু রাজনৈতিক সংকটাকুল পরিবেশের অনন্যসাধারণ পরিস্থিতিতে পরিদর্শনে যাওয়া হয়েছিল ফলে এটা একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর দায়িত্বভার ছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার লক্ষ্য হল কী হয়েছিল বা কী হচ্ছে তা দেখা নয় বরং কী হওয়া উচিত সেদিকে মনোনিবেশ করা। যা হয়েছিল তা ইতিমধ্যেই বিচারবিভাগ এবং সংসদে এক আলোচ্য বিষয়, এবং এখনও সে আলোচনা ধারাবাহিকভাবে হয়ে চলেছে।
যেহেতু এই ধরনের পরিস্থিতিতে কখনও কোনও রাষ্ট্রপতি কোনও অঞ্চল পরিদর্শন করতে যাননি, ফলে এই সংকটকালে আমার পরিদর্শনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। মন্ত্রী এবং আমলাতান্ত্রিক মহল পরামর্শ দিয়েছিলেন, ওই সময়ে আমার গুজরাত যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না। রাজনীতি তার প্রধান কারণ। যদিও আমি স্থির করেছিলাম যাওয়া এবং রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার প্রথম পরিদর্শনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছিল।
প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী আমায় শুধু একটা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে আপনার গুজরাত যাওয়া কি খুব জরুরি?’ আমি উত্তরে বলেছিলাম, ‘আমার বিবেচনায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যাতে আমি কোনওভাবে যন্ত্রণা লাঘবে সহায়তা করতে পারি এবং ত্রাণব্যবস্থা ত্বরান্বিত করতে পারি। আর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের অভিভাষণে যে বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলাম, যা আমার লক্ষ্যও ছিল সেই মানসিক সমন্বয় গঠনেও সাহায্য করতে পারি।’
এ প্রসঙ্গে অনেক ধরনের আশঙ্কার কথা প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল আমার গুজরাত গমন মুখ্যমন্ত্রীর বয়কট করা উচিত যাতে আমি শীতল অভ্যর্থনা পাই, এবং বিভিন্ন দিক থেকে প্রতিবাদ হওয়া উচিত। কিন্তু যখন আমি গাঁধীনগরে পদার্পণ করলাম, আশ্চর্য হলাম দেখে যে শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রী নন, তাঁর সমগ্র মন্ত্রিসভা, বিরাটসংখ্যক বিধানসভার সদস্য, আধিকারিক এবং জনতা বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। আমি বারোটা জায়গায় পরিদর্শনে গেছিলাম— তিনটে ত্রাণশিবির এবং দাঙ্গাবিধ্বস্ত ন’টি অঞ্চল— যেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি ছিল। মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পরিদর্শনকালে আগাগোড়া আমার সঙ্গে ছিলেন। একদিক থেকে তিনি আমায় সাহায্যই করেছিলেন, যেহেতু তিনি আমার সঙ্গে ছিলেন যেখানে যেখানে আমি গিয়েছিলাম সর্বত্র যে অভিযোগ ও আর্জিগুলো পেয়েছিলাম সেগুলো সম্পর্কে তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হস্তক্ষেপ করার পরামর্শ দিতে পেরেছিলাম।
কোনও এক ত্রাণশিবিরের একটা দৃশ্যের কথা আমার মনে পড়ে। ছ’বছরের একটা বাচ্চা কাছে এসে আমার দু’হাত ধরে বলেছিল, ‘রাষ্ট্রপতিজি, আমার বাবা আর মাকে আমি চাই’—শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। তৎক্ষণাৎ আমি জেলা কালেক্টরদের সঙ্গে একটা বৈঠক ডেকেছিলাম—ছেলেটির শিক্ষা এবং কল্যাণভার সরকার কর্তৃক গৃহীত হবে মুখ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে আমাকে আশ্বাসদান করেছিলেন।
যখন অহমদাবাদ ও গাঁধীনগরে ছিলাম, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আমার সঙ্গে কথা বলা ও তাঁদের সমস্যা ও দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিগতভাবে জানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
এরকম একটা সম্মেলনে প্রায় ২০০০ জন অহমদাবাদবাসী আমার চারদিকে জড়ো হয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের বক্তব্য গুজরাতি ভাষায় জানাচ্ছিলেন, আমার এক বন্ধু তা অনুবাদ করছিলেন। আমাকে প্রায় ৫০টা প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং ১৫০টা আর্জি জানানো হয়েছিল।
অহমদাবাদে দুটো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আমার পরিদর্শন অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে। অক্ষরধামে আমি প্রমুখ স্বামীজি মহারাজের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, তিনি আমায় স্বাগত জানিয়েছিলেন। ওই পুণ্যাত্মার সঙ্গে আমি মানসিক ঐক্য অর্জনের এবং গুজরাত দেশ মহাত্মা গাঁধী, সর্দার বল্লভভাই পটেল এবং বিক্রম সরাভাই-এর মতো মহান ব্যক্তিত্বদের জন্ম দিয়েছে সেই রাজ্যের ক্ষতস্থানে শান্তির প্রলেপ দেওয়া সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলাম।
আমি সাবরমতী আশ্রমেও গিয়েছিলাম। ওখানে অনেক আশ্রমবাসীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। দেখেছিলাম ওদের চোখে-মুখে তীব্র মর্মবেদনার ছায়া—এমনকী প্রতিদিনকার জীবনযাত্রার কাজকর্ম যেন বিষাদাক্রান্ত হৃদয়ে ওরা করে চলেছিল। অক্ষরধামেও আমি একই আবেগের সম্মুখীন হয়েছিলাম। যখন আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলাম কেন, তখন উপলব্ধি করেছিলাম এই দুটো প্রতিষ্ঠানই তাদের মানবজাতির প্রতি সহজাত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং তাদের ধর্মীয় পরিবেশ সমাজে আনন্দ, শান্তি এবং উন্নয়নের জন্য কাজ করার দরুন এই উদ্ভূত বেদনাজনক পরিস্থিতি যা নিবারণ করা সম্ভব ছিল, সেটা গ্রহণ করতে পারছিল না। আমি একথা বলি, যেহেতু আমাদের জন্মভূমিতে উন্নত মানবসভ্যতা উদ্ভূত হওয়ার ঐতিহ্য আছে এবং যেখানে মহান মনীষীরা জন্মগ্রহণ করে উন্নতমস্তকে অবিচলরূপে সমগ্র বিশ্বের মানবজাতির আদর্শস্বরূপ প্রতিভাত, সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাজনিত বিয়োগান্তক ঘটনার মতো বুদ্ধিবৈকল্য কখনও হওয়া উচিত নয়।
এই সফরে আগাগোড়া একটা চিন্তা আমার মন থেকে কখনও যাচ্ছিল না। অনেক মানুষের উন্নতি ঘটাতে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে আমাদের হাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ছিল। উন্নয়ন আমাদের সম্পাদ্য কার্যাবলি হওয়া উচিত নয় কি? যে-কোনও ধর্মবিশ্বাসী নাগরিকের আনন্দের সঙ্গে বাঁচার মৌলিক অধিকার আছে। কারও অধিকার নেই মানসিক একতাকে বিপন্ন করে তোলার, কারণ আমাদের রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি হল মনের ঐক্য, আর এ কারণেই আমাদের দেশ অতুলনীয়। তা হলে বিচারই-বা কী আর গণতন্ত্রই-বা কী? দেশের প্রতিটি নাগরিকের সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার আছে, কোনও ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য অর্জন করার অধিকার আছে। গণতন্ত্র যে সম্মান এবং স্বাতন্ত্র্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাকে অর্জনের জন্য যথার্থ এবং সত্পথে বিপুল পরিমাণে সুযোগের অধিকার পেতে হবে। সংবিধানের মূল বিষয়বস্তু তাই। এবং এ সমস্তই একটি প্রকৃত প্রাণস্পন্দিত গণতন্ত্রে জীবনযাত্রাকে সামগ্রিক ও অর্থপূর্ণ করে তোলে— মানবজীবনের বিশ্বাস এবং জীবনশৈলীর সহিষ্ণুতার মধ্যেই যার সারাৎসার।
মানসিক সমন্বয়ের লক্ষ্যে আমাদের সকলের কাজ করা খুব প্রয়োজনীয় বলে আমি বিশ্বাস করি। অন্যের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি এবং অন্যের জীবনযাত্রা বা ধর্মের প্রতি ঘৃণা বৃদ্ধি বা এই মনোভাবের বিভিন্নতা মানুষের বিরুদ্ধে যখন নীতিহীন হিংসার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় তাকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না। আমাদের সবাইকে পরিশ্রম করতে হবে এবং ব্যক্তির অধিকার রক্ষার প্রচেষ্টায় সক্রিয় হতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এই ভিত্তিকে আমি আমাদের সভ্যতার ঐতিহ্য বলে মনে করি যা আমাদের দেশের পরমাত্মা।
দু’দিনের সফরসূচির শেষে প্রচারমাধ্যম আমার কাছ থেকে একটা বার্তা আশা করেছিল, তাই এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। আমি এক বক্তব্যের মাধ্যমে আমার মনোভাব প্রকাশ করেছিলাম যে, সাম্প্রদায়িক এবং অন্যান্য যাবতীয় দ্বন্দ্বকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার জন্য এক ঐকান্তিক আন্দোলনের এবং মানসিক সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন আছে।
.
প্রত্যেক ব্যক্তির তার নিজের ভাষা-সংস্কৃতি এবং ধর্মবিশ্বাসের অনুশীলন করার মৌলিক অধিকার আছে। আমরা কোনওভাবে তা বিঘ্নিত করতে পারি না।
১০. প্রবাসে সমান স্বচ্ছন্দ
১০. প্রবাসে সমান স্বচ্ছন্দ
আমি বিশ্বনাগরিক।
প্রতিটি নাগরিক আমার আত্মীয়॥
কর্মজীবনের আগাগোড়া যেহেতু আমি নানা ধরনের সময়সীমা নির্দিষ্ট জাতীয় কর্মভারে ব্যস্ত ছিলাম তাই সেভাবে আমি কখনও বিদেশভ্রমণ করতে পারিনি। যাই হোক, দেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের ভারতে অভ্যর্থনা জানানো এবং বিদেশি রাষ্ট্র পরিদর্শনের মাধ্যমে আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন সরকারি কার্যকলাপের মধ্যে পড়ে। যখনই বিদেশি প্রতিনিধিরা আমাদের দেশে এসেছেন তখনই রাষ্ট্রপতি ভবনের উৎসাহী কর্মীবৃন্দ অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা তাঁদের আতিথেয়তা প্রদর্শনে কোনও অভাব রাখেননি এবং আমাদের দেশের অর্জিত নৈপুণ্য তাঁদের প্রদর্শন করেছেন। আমার কাছে এই ধরনের সফরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ কর্মদক্ষতা কীভাবে জ্ঞাপন করা হবে এবং আমাদের নিজেদের উপকারের জন্য কীভাবে অন্য দেশের রীতিনীতি শিখব। এর থেকেই বিশ্ব জ্ঞানমঞ্চের ধারণার জন্ম হয়, যা আমার মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল অনেক বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার ফলস্বরূপ। পরিবেশের অবনমনজনিত উদ্বেগ-চিন্তা ভাগ করে নিয়েছিলাম এবং শক্তিক্ষেত্রে স্ব-নির্ভরতার প্রয়োজনীয়তা আমরা আলোচনা করেছিলাম। আমরা বিদেশি অতিথিদের ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি, ই-গভর্ন্যান্স এবং ভেষজ শিল্পে সক্ষমতা দেখিয়েছিলাম। প্রতিটি সাক্ষাৎ পারস্পরিক দ্বিপাক্ষিক বা নানাদিক সমন্বিত লাভজনক প্রায়োগিক কার্যক্রমের দিকে পরিবর্তিত হত দেখে আমি খুশি হয়েছিলাম।
আমার প্রতিটি বিদেশভ্রমণ তার নিজের কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুদানে, দেশের দক্ষিণাংশ থেকে রাজধানী খার্টুম অবধি একটা জ্বালানি তেলের পাইপলাইন নির্মাণকেন্দ্রিক আলোচনা হয়েছিল। এর জন্য খরচের হিসাব ধরা হয়েছিল প্রায় এক বিলিয়ন ডলার, যাতে ভারতের সহযোগিতা থাকবে। আজ সুদান থেকে ভারতে তেল পরিবাহিত হচ্ছে। ইউক্রেনে প্রচণ্ড ব্যস্ত কর্মসূচি ছিল। ইউক্রেন পরিদর্শন মহাকাশ ক্ষেত্রে সহযোগিতায় অগ্রগমন ঘটিয়েছিল। যাই হোক, আমি এইসমস্ত সফরের শুধু কিছু তাৎপর্যময় ঘটনাবলি পরিবেশন করব। আমি ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিলাম, রাষ্ট্রপতি Thabo Mbeki-র জোহানেসবার্গে প্যান আফ্রিকীয় সংসদ ভবনে আমায় অভিভাষণ দিতে অনুরোধ করেছিলেন, ওই সংসদ তিপ্পান্নটা আফ্রিকান রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। আমি সন্তুষ্টচিত্তে এই অনুরোধ স্বীকার করেছিলাম এবং যখন আমি বা আমার সঙ্গীরা বক্তৃতা তৈরি করছিলাম তখন ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় কর্মদক্ষতাগুলির সঙ্গে আফ্রিকা জাতিকে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে আমরা কী নিবেদন করতে পারি বিবেচনা করতে হয়েছিল। এই ঘটনা সমগ্র আফ্রিকান ই-নেটওয়ার্ক ধারণার উদ্ভব ঘটাল, যা ভারত এবং আফ্রিকার বারোটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সতেরোটা স্পেশালিটি হাসপাতালের থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং ই-গভর্ন্যান্স পরিষেবা নিবেদন করতে পারে, এ ছাড়া প্যান আফ্রিকীয় রাষ্ট্রগুলোর সব রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে যোগাযোগ সংস্থাপন করতে পারে যাতে তাঁরা পারস্পরিক ধ্যানধারণা বিনিময় করতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা ই-নেটওয়ার্ক স্থাপনা করতে প্রাথমিক সম্ভাব্য ব্যয় ৫০ মিলিয়ন ডলার থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার নির্দেশ করেছিলেন। প্যান আফ্রিকান সংসদে প্রস্তাবনা পেশ করার আগে আমি প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-কে সংক্ষিপ্তাকারে সব জানিয়েছিলাম। তিনিও মনে করেছিলেন এ প্রস্তাবনা ভারত সরকারের ফোকাস আফ্রিকা (Focus Africa) বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং প্যান আফ্রিকার রাষ্ট্রসমূহ ও ভারতবর্ষের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
প্যান আফ্রিকান ই-নেটওয়ার্ক প্রজেক্ট এখন যথেষ্ট পরিমাণে গতিবেগ অর্জন করেছে যা ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছে। আজকের দিনে আন্তর্জাতিক সামাজিক দায়িত্ব পালনে ই-নেটওয়ার্ক একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
মনে হয় ২০০৬ সাল নাগাদ, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সভাপতি Josep Borrell Fontelles-এর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে আমার দেখা হয়েছিল। কথোপকথনের সময় তিনি এমন একটা বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন যা আমার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। আলোকপ্রাপ্ত নাগরিকের বিকাশ বা Evolution of Enlightened Citizens বিষয়ে তিনি আমার ওয়েবসাইট থেকে জেনেছিলেন। তিনি এ-বিষয়ে অসংখ্য প্রশ্ন করেছিলেন। সেগুলো ছিল সুগভীর, সুচিন্তিত ও উদ্দেশ্যপূর্ণ। আলোচনা শেষে তিনি আমায় ইউরোপীয় সংসদে অভিভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সংসদে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৭৮৫ জন সদস্য সাতাশটা সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। সংসদ হল একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত। তিনি আমায় তাঁর রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেয়াদকাল ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার আগে অভিভাষণ দেবার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যাই হোক, ২০০৬ সালে আমার নানা পূর্বনির্ধারিত প্রতিশ্রুতি পালনের ব্যস্ততার কারণে সে অনুরোধ রাখতে পারিনি। শেষপর্যন্ত ২০০৭ সালের ২৫ এপ্রিল আমি অভিভাষণ দিয়েছিলাম, তখন ইতিমধ্যে Hans Gert Pottering রাষ্ট্রপতি হিসেবে Fontelles-এর হাত থেকে কর্মভার নিয়েছিলেন।
যেহেতু এই অভিভাষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাই ভ্রমণসূচি ঘোষণা করবার অনেক আগে থেকে আমি প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছিলাম। বন্ধু, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা, বিজ্ঞানী এবং তরুণদের সঙ্গে আমার চিন্তাউদ্রেককারী অধিবেশন হয়েছিল। বিশেষ করে এই উপলক্ষে আমি একটি কবিতা রচনা করেছিলাম ‘ধরিত্রীমাতার বার্তা’ বা ‘Message from Mother Earth’। এই কবিতাটিতে প্রতিফলন ঘটেছিল কীভাবে ইউরোপীয় জাতিগুলি একে অপরের সঙ্গে হিংস্র যুদ্ধে রত ছিল এবং পরে সাফল্যের সঙ্গে ইউরোপীয় সংঘে পরিণত হল— প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, শান্তি ও আনন্দের প্রতি লক্ষ্য রেখে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে অবশ্যই এ এক অগ্রণী পদক্ষেপ।
যখন ২৫ এপ্রিলের ভোরে আমি ইউরোপীয় সংসদে পৌঁছলাম তখন রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর সহকর্মীরা আমায় স্বাগত জানালেন। ইউরোপীয় সংঘের ৭৮৫ জন প্রতিনিধি এবং সংসদে দর্শনার্থীর ভিড়ে উপচে পড়া গ্যালারি সত্যি সত্যি মনকে অভিভূত করার মতো দৃশ্য।
ওই উপলক্ষে আমার অভিভাষণের শিরোনাম ছিল ‘জাতির ঐক্যের গতিময়তা’ বা ‘Dynamics of Unity of Nations’। ভারতবর্ষের ইতিহাসগত অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে সভ্যতাসমূহের দ্বন্দ্বের পরিবর্তে তাদের একত্রে প্রবাহিত হওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। আমার বক্তৃতা আলোকপ্রাপ্ত নাগরিকত্বের বিকাশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিল, যার তিনটি অংশ ছিল— মূল্যবোধব্যবস্থা-সহ শিক্ষা, ধর্মের আধ্যাত্মিকতায় রূপান্তর, এবং জাতীয় উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সমাজের রূপান্তর।
এ ছাড়াও আমি ভারতবর্ষ এবং ইউরোপে শক্তিক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলাম এবং একে বাস্তবায়িত করার পদ্ধতির রূপরেখা অঙ্কিত করেছিলাম। আমার বক্তৃতা পর্যায়ক্রমে অভিনন্দিত হয়েছিল অভিভাষণের শেষে, সমস্ত সদস্যর অনুমতি নিয়ে আমি এই উপলক্ষে রচিত আমার কবিতা পাঠ করেছিলাম—
ধরিত্রীমাতার বার্তা
মনোরম পরিবেশ
সুন্দর মনের দিশা দেখায়;
সুন্দর মন তৈরি করে,
সতেজতা আর সৃষ্টিশীলতা।
তৈরি করেছে দেশ ও সমুদ্র অনুসন্ধানকারীর দল,
তৈরি করেছে আবিষ্কার করার মন,
তৈরি করেছে বৈজ্ঞানিক মানসিকতা,
সব জায়গায় তৈরি করেছে, কেন?
অনেক আবিষ্কারের জন্ম দিয়েছে,
খুঁজে পেয়েছে এক মহাদেশ আর
অনেক অজানা দেশ,
অনেক না-জানা পথের সন্ধান পেয়েছে,
কত নতুন রাজপথ তৈরি করেছে।
সবচেয়ে ভাল মনের ভেতরে
শয়তানও জন্ম নেয়;
যুদ্ধ ও ঘৃণার বীজ জন্মায়
শত শত বছর ধরে চলে যুদ্ধ আর রক্তক্ষয়।
আমার লক্ষ লক্ষ অপূর্ব সন্তানেরা
কত দেশ ও সাগরে হারিয়ে গেছে;
অশ্রুজলে প্লাবিত হয়েছে কত দেশ
দুঃখের সাগরে লুপ্ত হয়েছে কত লোক।
তারপর, তখন এল ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বপ্ন
তারা শপথ নিল,
মানবের জ্ঞানকে কখনওই
আমাদের অথবা অন্যদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাব না।
তাদের এই চিন্তার সমন্বয় প্রচেষ্টা,
কাজ করেছে।
ইউরোপকে সমৃদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ করতে,
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্ম হল।
ওই খুশির তরঙ্গগুলি মোহিত করেছিল
সকল জায়গার সকল মানুষকে।
হে! ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তোমার লক্ষ্য
সর্বত্র ছড়িয়ে দাও, শ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাস যেমন
ছড়িয়ে যায়।
কবিতাপাঠ শেষ হওয়ার পর সাংসদদের আলোড়ন এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় আমি অভিভূত হয়ে গেছিলাম। শ্রোতারা উঠে দাঁড়িয়ে যে অভ্যর্থনা আমায় জানালেন তা নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। প্রত্যুত্তরে আমি ভারতবর্ষের একশো কোটি নাগরিকের শুভেচ্ছাবার্তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রসমূহকে জানালাম। আমার অভিভাষণের পরে রাষ্ট্রপতি পটারিং উপসংহারে যা বললেন আমি তা উদ্ধৃত করছি, ‘মাননীয় রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম, ইউরোপীয় সংসদের পক্ষ থেকে, সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং উৎসাহব্যঞ্জক বক্তৃতার জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এরকম অসাধারণ বক্তব্য আমরা কখনও কোনও রাষ্ট্রনায়ক, বৈজ্ঞানিক এবং কবির কাছ থেকে কখনও শুনিনি। এ বক্তৃতা অতুলনীয়। মহান দেশ ভারতবর্ষের শুভেচ্ছা কামনা করি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মহান রাষ্ট্র ভারতবর্ষের মধ্যে সহযোগিতার শুভেচ্ছা কামনা করি এবং রাষ্ট্রপতির শুভেচ্ছা কামনা করি।’
অভিভাষণের পরে সদস্যদের অনেকেই বক্তৃতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। সাধারণ পর্যবেক্ষণ হল ভারতবর্ষ এক মহান রাষ্ট্র যার মানবিকমূল্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
সমগ্র বিশ্বে মানসিক সমন্বয় প্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় সংসদে আমার অভিভাষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। ওই অভিভাষণটি অনেক রাষ্ট্রে উদ্ধৃত করা হয়েছিল এবং ইউ টিউব (You Tube)-সহ অসংখ্য ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিশ্বের শ্রোতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছেছিল।
ভারতবর্ষে ফিরে আসার পরে সংসদে যে অভিভাষণ দিয়েছিলাম তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা লক্ষ্যে কাজ করার আগ্রহের কথা উল্লেখ করেছিলাম, যেমন— শক্তিক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা এবং বিশ্ব জ্ঞানমঞ্চ নির্মাণ। এর কারণ ছিল, ভারতবর্ষ যাতে অগ্রসরের লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
আমি যখন গ্রিসে গেছিলাম সক্রেটিস গুহায় যাত্রার এক বিশেষ কর্মসূচি নিয়েছিলাম। ভ্রমণার্থীরা কদাচিৎ ওখানে যায় কারণ জায়গাটা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। আমার অনুরোধেই যাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ওখানে গিয়ে গুহার মধ্যে আমাকে দেওয়া একটিমাত্র কাঁপাকাঁপা আলোয় কিছু মুহূর্ত আমি কাটিয়েছিলাম। ওই পাঁচ মিনিট আমি একা ছিলাম— ধ্যানস্থ ভাবে। ভাবছিলাম, জগতের শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল ব্যক্তিদের অন্যতম সক্রেটিস কেন নিজের জীবন শেষ করে দিতে বিষ পান করেছিলেন। আমার মনে পড়ল তাঁর উক্তি যে, তাঁর সদুপদেশের মূল্য তাঁর জীবনের চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সহসা সেই অন্ধকার গুহার ভেতরে একটা উজ্জ্বল আলোর মতো দেখা যেতে পারে— যেটা তাঁর এই পৃথিবীকে দিয়ে যাওয়া যুক্তির পরম্পরা।
২০০৫ সালে আমি সুইজারল্যান্ড সফরে গেছিলাম। বিমান থেকে অবতরণ করার পর আমার জন্য এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। উপরাষ্ট্রপতি আমায় অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেছিলেন, আমার আগমন দিবসের স্মারক হিসেবে ২০০৫ সালের ২৬ মে দিনটি বিজ্ঞান দিবস হিসেবে রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল। সুইজারল্যান্ড সরকারের তরফ থেকে অবশ্যই এ এক অপ্রত্যাশিত ব্যঞ্জনাপূর্ণ কাজ। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে আমি এরজন্য ধন্যবাদ জানালাম। তিনি বললেন আমার লেখা দুটো বই ‘Ignited Minds’ এবং ‘India ২০২০’ তিনি পড়েছেন। লেখা পড়ে প্রভাবিত হয়ে তিনি মন্ত্রিসভায় সংক্ষিপ্তাকারে মহাকাশ এবং প্রতিরক্ষা বিজ্ঞান বিষয়ে আমার সম্পাদিত কাজ বিষয়ে বর্ণনা করেছিলেন এবং মন্ত্রিসভা স্থির করেছিল আমার সুইজারল্যান্ড পরিদর্শনের দিনটি বিজ্ঞান দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হবে। ওখানকার বিজ্ঞান গবেষণাগার পরিদর্শন করা ও গবেষক, ছাত্র এবং অধ্যাপকের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমি জুরিখে স্যুইস ফেডারাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে গিয়েছিলাম, আইনস্টাইন জার্মানি থেকে এসে ওখানেই প্রথম পড়াশোনা করেছিলেন। ওখানে আমি বোস-আইনস্টাইন গবেষণাগারে গেছিলাম, যেখানে ৬ জন বিজ্ঞানী বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন পরীক্ষা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এখানেও আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ এবং ছাত্রদের উদ্দেশে অভিভাষণ দেবার সুযোগ হয়েছিল এবং আমি ‘প্রযুক্তি এবং জাতীয় উন্নয়ন’ বিষয়ে বক্তব্য রেখেছিলাম।
উপসংহারে ছাত্রদের আমি স্যর সি ভি রমনের উদ্বুদ্ধকারী উপদেশ শুনিয়েছিলাম, ‘আমাদের জয়ের উদ্দীপনা চাই, এমন চালিকাশক্তি চাই যা আমাদের এই পৃথিবীতে সঠিক জায়গায় বহন করে নিয়ে যাবে। এমন চৈতন্য চাই যা আমাদের গর্বিত সভ্যতার উত্তরসূরি হিসেবে এই গ্রহে সঠিক স্থান লাভ করতে সাহায্য করবে। যদি এই অপরাজেয় চৈতন্য জাগ্রত হয় তা হলে কোনও কিছুই আমাদের সঠিক ভবিতব্য অর্জনে প্রতিরোধ করতে পারবে না।’
আমি ড. নেলসন ম্যান্ডেলার কথা না বলে থাকতে পারি না। ওঁর সঙ্গে ২০০৪ সালে আমার দেখা হয়েছিল। এই মহান ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে দুটো মহৎ শিক্ষা পাওয়া সম্ভব— চৈতন্যের অপরাজয়তা এবং ক্ষমার মহত্ত্ব।
কেপটাউন মালভূমির জন্য বিখ্যাত, এর তিনটি শিখর আছে— টেবল পিক, ডেভিল পিক এবং ফেক পিক। সারাদিন ধরে এই শিখরগুলি ঘিরে অত্যন্ত মনোহর দৃশ্য দেখা যায়, যেমন লাগামছেঁড়া ভেসে থাকা মেঘ শিখরকে জড়িয়ে রেখেছে, কখনও সেগুলো কালো, কখনও-বা সাদা রঙের। আমরা হেলিকপ্টারে করে কেপটাউন থেকে রবেন দ্বীপে গিয়েছিলাম। ওখানে আহমেদ কাথরাদা আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। উনি নেলসন ম্যান্ডেলার সহবন্দি ছিলেন। দেখে আশ্চর্য লেগেছিল যে, প্রায় ছয় ফুট লম্বা ম্যান্ডেলা বর্ণবৈষম্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন বলে তাঁকে ২৬ বছর কারাগারে একটা ছোট ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। জীবনের বেশিরভাগ সময় তাঁকে ওই দ্বীপে নির্বাসিত অবস্থায় কাটাতে হয়েছে। তাঁকে কাছাকাছি কোনও পাহাড়ের পাথর খাদান থেকে পাথর তোলার জন্য প্রখর সূর্যের তাপে কয়েক ঘণ্টার জন্য নিয়ে যাওয়া হত। সেসময়ই তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এত অত্যাচার সত্ত্বেও তাঁর প্রাণশক্তি অটুট ছিল। যখন প্রহরীরা ঘুমোতে যেত সেসময় তিনি লিখতেন। এভাবেই তিনি লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘Long walk to Freedom’।
জোহানেসবার্গে ওঁর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া আমার পক্ষে এক বিরল সৌভাগ্য। যখন আমি করমর্দন করলাম মনে হল আমি যেন এক মহান আত্মাকে স্পর্শ করছি। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে পথ চলার লাঠিটা ছুড়ে ফেলে দিলেন, আমায় অবলম্বন করলেন। ওঁর কাছ থেকে এক বিশাল শিক্ষা পেলাম যা অন্যতম তিরুক্কুরালেও আছে, ‘যারা তোমার অনিষ্ট করতে চায় তার পরম শাস্তি হল তাদের ভাল করা।’
রেলগাড়ির সঙ্গে আমার সম্পর্ক আমাকে ছেলেবেলার দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন আমি রামেশ্বরম শহরের রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে ছুড়ে দেওয়া সংবাদপত্র ঘরে ঘরে বিলোনোর জন্য কুড়িয়ে নিতাম। নিজের দেশকে দেখা এবং তার সুগন্ধ আঘ্রাণ করার জন্য রেলযাত্রা খুব ভাল। মাঝেমধ্যে কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থায় নিসর্গদৃশ্য কিছুটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যেমন, সবুজ খেত এবং গ্রামের টুকরো ছবিগুলো অনেক কাছের বলে মনে হয়। সব মিলিয়ে রেলযাত্রা যথেষ্ট আনন্দদায়ক এবং আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম যে প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রেন আবার চালু করব।
প্রেসিনডেন্সিয়াল কক্ষ এক জোড়া জুড়ি কোচের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে— একান্তভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের ব্যবহারের জন্য। কামরার ভেতরে ভোজন কক্ষ, তার দ্বিগুণ জায়গাবিশিষ্ট দর্শনার্থীদের কক্ষ, বসবার বা অধিবেশনের জন্য কক্ষ এবং রাষ্ট্রপতির শয়নকক্ষ থাকে। এ ছাড়াও থাকে রান্নাঘর এবং রাষ্ট্রপতির সচিব ও কর্মী এবং তাঁর যাত্রাসঙ্গী রেলকর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ। কামরাগুলো সেগুন কাঠের আসবাবপত্র, সিল্কের পরদা এবং কুশান ঢাকনা দিয়ে বিলাসবহুলভাবে সজ্জিত।
এই কামরাগুলো ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর প্রথম দিকে কিছু ব্যবহার হয়েছিল। একটা ঐতিহ্যও ছিল যে, রাষ্ট্রপতি তাঁর কার্যের মেয়াদকাল শেষ হলে নিউ দিল্লির বাইরে, যেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসে ইচ্ছুক হবেন সেখানে ওই ট্রেনে চড়ে যেতেন। এইভাবে শেষ যে রাষ্ট্রপতি ট্রেনে চড়েছিলেন তিনি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি, ১৯৭৭ সালে।
এর পর থেকে হয়তো সুরক্ষার কারণেই কামরাগুলো আর ব্যবহার করা হয়নি— কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ বজায় ছিল। এর আবার ব্যবহার হল ২০০৬ সালের ৩০ মে, ২৬ বছর পরে— হরনউত থেকে পটনা পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিমি রাস্তা আমি এই ট্রেনে চড়ে গেছিলাম। কামরাগুলো মেরামত করা হয়েছিল এবং আধুনিক সরঞ্জাম যেমন উপগ্রহনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছিল। আমি যতটা সম্ভব তার ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলাম— সর্বমোট তিনবার।
আরও দু’বার ট্রেনযাত্রা করেছিলাম— ২০০৪ সালে চণ্ডীগড় থেকে দিল্লি এবং ২০০৬ সালে দিল্লি থেকে দেরাদুন। এই রেলযাত্রা আবহাওয়ার অনিশ্চয়তার কারণে জরুরি হয়ে পরে। এ ছাড়া যাত্রাকালীন সময়ে নানা বৈঠকও সমাপন করা যায়।
হরনউত থেকে পটনা রেলযাত্রার অনেকগুলো কারণ ছিল। হরনউতে আমি নতুন রেলপথ কর্মশালার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলাম। নীতিশকুমার তখন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর নিজের রাজ্যে বিশালাকারের কর্মশালা কেন্দ্র ব্যবস্থা স্থাপিত হওয়ার দরুন তিনি দারুণ খুশি হয়েছিলেন। আমার অভিভাষণে আমি হরনউতের উপস্থিত শ্রোতাকে বলেছিলাম— আমি সবেমাত্র প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্র নালন্দার ধ্বংসস্তূপ থেকে আসছি। আমি আশা করি বিহার বিশ্বশান্তি প্রচার সম্পর্কিত বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন সমকালীন পাঠ্যক্রম দ্বারা এই মহান বিশ্ববিদ্যালয় পুনরুজ্জীবিত করবে।
রেলযাত্রা অসম্ভব কার্যকরী হয়েছিল কারণ আমি বিহারের পনেরোজন উপাচার্যকে আমার সঙ্গে যাত্রা করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এবং যাত্রাপথে ওঁদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে ঘণ্টা খানেক আলোচনা করেছিলাম।
রাজ্যের উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষভাবে প্রাসঙ্গিক এমন পাঠ্যসূচি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তার ওপর আমি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে চেয়েছিলাম। বিহারের রাজ্যপাল যেসমস্ত সমস্যাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে সেগুলোর সমাধান করে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমর্যাদায় উন্নীত করার প্রতি বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। দু’বছর পরে ক্যালেন্ডারভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলনের দ্বারা দেখলাম লক্ষ্য অর্জনে তারা সফল হয়েছে।
এই ভ্রমণের এক সন্তোষজনক পাদটীকা আছে— পটনা রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে দেখি আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা লালুপ্রসাদ যাদব এবং সংযুক্ত জনতা দলের নেতা নীতিশকুমার দু’জনেই উপস্থিত কিন্তু দু’জনেই বিপরীত দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ট্রেন থেকে নেমেই এই দুইজন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে এক জায়গায় আনলাম এবং উপস্থিত জনতাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য পরস্পরের সঙ্গে করমর্দন করালাম।
২০০৪ সালের ৫ জানুয়ারি, আমি শিশুদের বিজ্ঞান কংগ্রেস বা Childrens’ Science Congress উদ্বোধন করার জন্য এবং বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে অভিভাষণ দেওয়ার জন্য চণ্ডীগড় গিয়েছিলাম। পরদিন ৬ জানুয়ারি আমাকে বিশেষ কাজের জন্য দিল্লি ফিরে আসতে হয়েছিল। সকালবেলার কুয়াশার দরুন যাত্রার অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেয়ে সঠিক সময়ে দিল্লিতে পৌঁছনোর জন্য আমি ট্রেনে ফিরেছিলাম। বিজ্ঞান কংগ্রেস উদ্বোধন করতে পেরে বিশেষ আনন্দ পেয়েছিলাম। কারণ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী তাদের প্রজেক্ট নিয়ে ওখানে জড়ো হয়েছিল।
২০০৬ সালে আমি তৃতীয়বার ভ্রমণ করেছিলাম। ভারতীয় সেনাবাহিনী অ্যাকাডেমির প্রশিক্ষণ সমাপ্তকরণ কুচকাওয়াজে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করার জন্য আমি দেরাদুনে গেছিলাম। সময়টা ছিল শীতকাল এবং সকালবেলার অস্পষ্ট দৃশ্যমানতার কারণে বিমানে করে সময়মতো পৌঁছনো বেশ অনিশ্চিত ছিল। রাতের বেলাও যথেষ্ট কুয়াশা পড়েছিল। ট্রেন সফদরজং থেকে দেরাদুন পর্যন্ত কোথাও না থেমে অবিরাম চলেছিল কিন্তু রেল বিভাগ যাত্রার নির্বিঘ্নতার জন্য অনেকগুলো চেকপয়েন্টের ব্যবস্থা করেছিল।
উৎফুল্ল ভাবী স্নাতকদের সঙ্গে সময় কাটানো এক আনন্দজনক অভিজ্ঞতা। বিশেষত অনেক ভাবী স্নাতক অফিসাররা আমায় প্রশ্ন করেছিলেন কীরকম ভারতবর্ষকে তাঁরা সুরক্ষা দেবেন। এই অফিসারদের দলকে আমি যখন পরিদর্শনে সীমান্ত নিকটবর্তী, উত্তরাঞ্চল সেনাবাহিনীর ইউনিটে গেছিলাম সে-কথা বললাম। সীমান্ত ওপারবর্তী পাকিস্তানি সেনাধিকারীরা আমার পরিদর্শন পুঙ্খানুপুঙ্খ লক্ষ রাখছিল। আমি বিভিন্ন ইউনিটের প্রায় দুশো তরুণ আধিকারিকদের উদ্দেশে অভিভাষণ দিয়েছিলাম। অভিভাষণের পরে বড়াখানায় যাওয়ার আগে আমি এই তরুণ আধিকারিকদের কাছে একটা প্রশ্ন রেখেছিলাম— প্রিয় নবীন আধিকারিকগণ, যেহেতু সৈন্যবাহিনীতে আপনাদের সামনে প্রায় ত্রিশ বছরের বেশি কর্মজীবন পড়ে রয়েছে, আপনারা আমায় বলতে পারবেন কি একজন আধিকারিক হিসেবে কী অভিনব লক্ষ্যপূরণের স্বপ্ন আপনারা দেখেন?
বর্ষীয়ান আধিকারিকরা নিশ্চুপ ছিলেন কিন্তু নবীন আধিকারিকদের মধ্যে যারা উত্তর দেবার জন্য হাত তুলেছিলেন তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে আমি বেছে নিলাম। আমায় অভিবাদন জানিয়ে তিনি বললেন, ‘স্যার আমার একটা স্বপ্ন আছে, সে স্বপ্ন হল আমাদের দেশের ভূমি যা অন্য রাষ্ট্র দখল করে নিয়েছে তা ফেরত পাওয়া।’ সমস্ত অধিবেশনে যেন তড়িৎপ্রবাহ সঞ্চালিত হল, সবাই ওই নবীন আধিকারিককে বাহবা দিলেন। এই উত্তর যখন আমি স্নাতক পরীক্ষার্থী সামরিক শিক্ষানবিশদের জানালাম সেখানেও একই প্রতিক্রিয়া দেখলাম— ‘আমরাও তাই করব স্যার।’ এসব নানা কারণে রেলযাত্রা দীর্ঘদিন আমার স্মরণে রয়ে গেছে।
.
সুদানে আমি এক অত্যন্ত সুন্দর এক দৃশ্য দেখেছিলাম যে নীলরঙা নীলনদ এবং সাদারঙা নীলনদ মিলিত হয়ে অন্য এক নদীতে, অন্য কোনও এক রং ধারণ করে বয়ে চলেছে, যেন এ এক সঙ্গম। বহু মিলনে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখলেও আমরাও পরিবর্তিত হই।
১১. ভারতবর্ষের হৃদয়কে পুনরুজ্জীবিত করা
১১. ভারতবর্ষের হৃদয়কে পুনরুজ্জীবিত করা
সেবামূলক চৈতন্যে উদ্দীপিত মানুষের গ্রামে বাস করতে পারা এবং
গ্রামবাসীর প্রতি সেবায় আত্ম-অভিব্যক্তি খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে
গ্রামীণ আন্দোলন গ্রামের সঙ্গে সুস্থ যোগাযোগ
স্থাপনার একটা প্রচেষ্টা।
—মহাত্মা গাঁধী
গ্রামেই আসল ভারতবর্ষের অধিষ্ঠান। গ্রাম থেকে তার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, রীতিনীতি এবং জীবনদর্শনের উদ্ভব ঘটে। আমার জন্ম এবং বেড়ে-ওঠা গ্রামে। গ্রাম্যজীবনের ছন্দ আমি উপলব্ধি করতে পারি। সাম্প্রতিক কালে গ্রাম থেকে শহরে পরিযান অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। এই পরিযায়ী মানুষগুলো শহরে এসে ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য কাজ ও অর্থ রোজগারের প্রচেষ্টা করতে গিয়ে বস্তিতে বাস করে পীড়িত ও উদ্বেগজনক জীবন কাটায়। তাদের জীবন থেকে নিজস্ব সবকিছু ও ভালবাসা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আমার বিশ্বাস গ্রামে যথেষ্ট পরিমাণে উপার্জনের উপায় সৃষ্টি এবং স্বাচ্ছন্দ্যের উন্নতি সাধনের মাধ্যমে গ্রাম-উন্নয়নের বিকাশ ঘটিয়ে ভারতবর্ষের প্রকৃত পরিবর্তন আনা সম্ভব। এভাবেই শহরমুখী মানুষের পরিযান বন্ধ এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশামুক্ত করা সম্ভব। এই ভাবনা থেকে উদ্ভূত হল PURA (Providing Urban Amenities to Rural Areas).
কোনও রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তার গ্রামের উন্নয়ন। এ-বিষয়ে সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভের জন্য ২০০২ সালে ভুপাল ভ্রমণের সময় আমি একটা গ্রামীণ অঞ্চল দর্শনে যাব বলে স্থির করি। তোরনি নামক যে অঞ্চলে গেছিলাম সেখানে না আছে যথাযথ রাস্তা, না বিদ্যুৎ। যে মুহূর্তে ওই গ্রাম পরিদর্শনের ইচ্ছার কথা ঘোষণা করেছিলাম সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য কর্তৃপক্ষ অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছিল— সর্বপ্রথমে কয়েক কিলোমিটার লম্বা, সব আবহাওয়ায় উপযোগী রাস্তা তৈরি করে ফেলেছিল। বিদ্যুৎও জেট প্লেনের গতিতে গ্রামে পৌঁছে গেছিল।
আমার ওই গ্রাম পরিদর্শন কালে গ্রামবাসীরা খুশি হয়ে তাদের জলবিভাজিকা ব্যবস্থাপনা এবং জৈব কীটনাশক ব্যবহারের নমুনা প্রদর্শন করেছিল। আমি জেলা কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম, তোরনি গ্রামের সাফল্য অর্জনের বার্তা ওই অঞ্চলের অন্যান্য গ্রামে প্রচার করতে, যাতে তারাও এই অভিজ্ঞতা থেকে লাভবান হয়। আমি রাজ্য কর্তৃপক্ষকে আরও পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, তারা কয়েকটি গ্রাম নিয়ে এক-একটি গুচ্ছ (Cluster) গড়ে তুলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারে। যাতে শুধুমাত্র রাস্তা বা পরিবহণব্যবস্থা নির্মাণের মাধ্যমে বাস্তব সংযোগসাধন নয়, গ্রামীণ সমষ্টির মধ্যে সাধারণ স্বাচ্ছন্দ্য যেমন স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফল-সবজির মতো দ্রুত পচনশীল দ্রব্যের সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে ওই অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুবিধা ঘটে। শস্য এবং কাষ্ঠভিত্তিক শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন বহু প্রসারিত এবং আজকাল বিশাল চাহিদা। আমি মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং জেলাকর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিয়েছিলাম উপগ্রহচিত্রের মাধ্যমে গ্রামের যত জলাশয় আছে তা ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে পলিমুক্ত করার এবং যথার্থ প্রবেশ এবং নির্গমন সংযোগস্থাপন করার।
তোরনি অঞ্চলের গ্রামের তরুণরা মিডল বিদ্যালয়কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করার অনুরোধ জানিয়েছিল, রাজ্য সরকার তাতে সম্মত হয়েছিল।
তোরনি গ্রামের পরিদর্শন আমায় এমন এক ক্ষেত্রের সন্ধান দিল যা গ্রামীণ ও নাগরিক বিভেদের সীমারেখা মুছে, সংযোগসাধনের প্রয়োজনীয়তা সমন্বিত উন্নয়নের ভিন্ন মাত্রা জানায়।
রামেশ্বরমে আমার জন্ম এবং বেড়ে-ওঠা। ওখানকার অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে আমি মাঝে মাঝে ভাবনাচিন্তা করতাম গ্রামগুলোর কীভাবে উন্নয়ন করা সম্ভব যাতে যথেষ্ট পরিমাণে উপার্জনের ব্যবস্থা হয়। আমার কর্মজীবন বৃহত্তর শহরেই গড়ে উঠেছিল কিন্তু আমি দূরদূরান্ত গ্রামে যাওয়ার অনেক সুযোগ পেয়েছিলাম। আমরা যখন ইন্ডিয়া ২০২০ কার্যক্রমের উন্নয়ন করছিলাম দেশের ৬০০,০০০ সংখ্যক গ্রামের উন্নয়ন সবচেয়ে জরুরি হয়ে দেখা দিল। যখন আমার বন্ধু অধ্যাপক পি ভি ইন্দিরেসান PURA-ভাবনা নিয়ে এলেন, আমার স্মৃতিপথে পুরনো কথা জেগে উঠল। ওঁর সঙ্গে এবং এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ বেশ কিছু আগ্রহী ব্যক্তির সঙ্গে আমি বিশদভাবে আলোচনা করেছিলাম।
আমি সৌভাগ্যবান যে, একটি চিকিৎসাদলের উদ্যোগে মধ্যপ্রদেশের চিত্রকূট PURA, তামিলনাড়ুর ওয়ালামের পেরিয়ার PURA-র, নানাজি দেশমুখের এবং মহারাষ্ট্রের লোনি PURAর মেডিকাল গ্রুপের সংস্পর্শে এসেছিলাম। সর্বোপরি তত্ত্ব সাহেব কোরের পথপ্রদর্শনকারী কার্যকলাপের অধীনে মহারাষ্ট্রের ওয়ারনা PURA আকৃতি লাভ করেছিল। গ্রামীণ উন্নয়নের এই অভিজ্ঞতা সমগ্র রাষ্ট্রের PURA ব্যবস্থা উদ্ভাবনার ভিত্তি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি শহরাঞ্চলের চাইতে বেশি গ্রামীণ অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। এই ভ্রমণের দরুন আমার যে পর্যবেক্ষণ তা PURA প্রতিষ্ঠান গড়তে আরও সাহায্য করেছিল।
যখনই আমরা কোনও শহরবাসীর সঙ্গে আলাপচারিতা করি অবধারিতভাবে তাঁদের মধ্যে অনেকেই সাম্প্রতিককালের বর্ধিত দূষণের পরিস্থিতি, জীবনের দ্রুত গতিবেগ, মানুষের ভিড় ও অন্যান্য অসুবিধার কথা বলে থাকেন। কিন্তু তবুও তাঁরা নিজেদের গ্রামে ফিরে যাবার ঝুঁকি নিতে চান না। অন্যদিকে, গ্রামের মানুষজন তাঁদের নিজেদের পরিবেশ পছন্দ করা সত্ত্বেও বাসগৃহ পরিত্যাগ করে আরও উন্নততর জীবনের আশায় শহরে ভিড় জমান। আমরা কি এমন কোনও সমাধান খুঁজে বার করতে পারি যার দরুন গ্রামবাসীরা, বিশেষত তরুণরা গ্রামীণ পরিবেশে বাস করেও তাঁদের উপার্জনক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারেন? পাশাপাশি আমরা কি নগরবাসীর কাছে গ্রামগুলো শুধুমাত্র পর্যটন বা বাণিজ্যিক কারণ ছাড়া সম্ভাব্য পরিযানের উপযোগী আকর্ষণীয় করতে পারি? এই ধরনের ভাবনাচিন্তাই PURA-র নির্মাণের ভিত্তি।
গ্রামীন উন্নয়নকে সরকারি, বেসরকারি এবং জাতীয় ক্ষেত্রগুলি আংশিকভাবে গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ— অতীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, রাস্তা বা বাড়ি নির্মাণ বা নির্দিষ্ট কোনও গ্রামীণ অঞ্চলে যোগাযোগ সূত্র রক্ষা করা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বেশ কয়েক দশক ধরে আমাদের অভিজ্ঞতা বলে প্রাথমিক পদক্ষেপের সূচনা ভালই হয়, যেমন অবিশ্রাম বর্ষণ ক্ষণকালের জন্য অজস্র জলস্রোত তৈরি করে। যখনই বৃষ্টি থেমে যায় সব জলধারা শুকিয়ে যায়, কারণ অতিরিক্ত জল সঞ্চয় করার মতো কোনও জলাশয় তৈরি হয়নি। এবারই প্রথম PURA এক অখণ্ড কর্মসংস্থান সৃষ্টি অভিমুখী মজবুত উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার সম্মুখীন হল যেখানে জনবসতি, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, সরাসরি এবং বৈদ্যুতিন সংযোগ এবং বিপণনের সুযোগ আছে। এই মুহূর্তে নিরবচ্ছিন্ন ব্যবস্থার বিবর্তন বা উদ্ভাবন প্রয়োজন যা ‘কার্যকরী’ ভূমিকায় কাজ করবে এবং সমস্তরকম বিকাশ ঘটাবে।
উন্নত ভারতবর্ষের জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন যে অত্যন্ত জরুরি আমরা সবাই তা উপলব্ধি করি। গ্রামীণ উন্নয়ন বলতে কী বোঝায়? এর অর্থ হল:
১. গ্রামগুলি আবশ্যিকভাবে উপযুক্ত রাস্তা এবং প্রয়োজনানুসারে রেলপথে সংযুক্ত হওয়া উচিত। স্থানীয় অধিবাসী এবং অতিথিদের জন্য স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এবং অন্যান্য স্বাচ্ছন্দ্যের পরিকাঠামো থাকা উচিত। একে বলা যাক ‘বাস্তবিক’ সংযোগসাধন।
২. এই জ্ঞান উদ্ভাবনা কালে, দেশজ জ্ঞান প্রযুক্তিগত কৌশল, প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার দ্বারা সংরক্ষিত এবং বর্ধিত করা প্রয়োজন। গ্রামগুলি তাদের সর্বোত্তম শিক্ষক দ্বারা উপযুক্ত শিক্ষার অধিকারে অধিকারী হওয়া উচিত। তারা অবশ্যই যথার্থ চিকিৎসা পরিষেবা এবং কৃষি, মৎস্যচাষ, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যান সংক্রান্ত বৃত্তির আধুনিকতম তথ্যের দ্বারা লাভবান হবে। অর্থাৎ তাদের ‘বৈদ্যুতিন’ সংযোগসাধনের অধিকার পাওয়া উচিত।
৩. একবার বাস্তবিক এবং বৈদ্যুতিন সংযোগসাধন সক্ষম হওয়া মানে জ্ঞানের সংযোগসাধনে সক্ষম হওয়া। এগুলো উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ঘটানোর যোগ্যতাকে সহজসাধ্য এবং উৎপাদিত দ্রব্যের জন্য বাজারের সন্ধান করতে পারে। দ্রব্যমান সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উৎপাদন কর্মে অংশীদারদের সঙ্গে পারস্পরিক মতামত বিনিময়, যোগ্যতম যন্ত্রপাতি পেতে সাহায্য স্বচ্ছতার বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি ও অবসরকালীন সময়ের যথাযোগ্য ব্যবহার করতে পারে, এবং একেই আমরা বলতে পারি জ্ঞানের সংযোগসাধন।
৪. একবার যদি তিনটি সংযোগসাধন সংঘটিত হয়, উপার্জনের সামর্থ্য এরা বৃদ্ধি করে। PURA-কে একটা লক্ষ্য হিসেবে ধরে আমরা গ্রামগুলো সমৃদ্ধ জ্ঞানকেন্দ্রে বিকশিত করতে পারি এবং গ্রামবাসীরা উদ্যোক্তা হিসেবে উত্থিত হতে পারে।
পেরিয়ার PURA প্রতিষ্ঠানটি পেরিয়ার ওয়াল্লামের মানিয়াম্মাই কলেজ অফ টেকনোলজি ফর ওমেন দ্বারা পথপ্রদর্শিত হয়েছিল। আমি ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখে এর উদ্বোধন করেছিলাম এবং ২০০৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আর-একবার ওখানে গিয়েছিলাম। ২০০৩ সালে এই PURA-র পঁয়ষট্টিটির বেশি গ্রামসমষ্টি নিয়ে গঠিত, ২০০৩ সালে যেখানে লোকসংখ্যা ১০০,০০০-এর বেশি ছিল। এর তিনটি সংযোগসাধন অর্থনৈতিক সংযোগসাধনের দিকে নিয়ে গেছিল। প্রতিবার পরিদর্শনকালে সমষ্টির অখণ্ড উন্নয়নকে সম্ভব করার জন্য স্থানীয় অধিবাসী এবং যুবসমাজের উৎসাহে আমি পরম আশ্চর্য হই। যুবসমাজ এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং উদ্ভাবনী দক্ষতাকে প্রদর্শন করেছিল। এই পদক্ষেপের দরুন ১,৮০০ স্বনির্ভর সম্প্রদায়ের সক্রিয় সমর্থনে অসংখ্য উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছিল এবং বৃহদায়তন কর্মসংস্থানের উপায় সৃজন হয়েছিল। দু’শো একর পতিত জমি উদ্ভাবনী জল ব্যবস্থাপন পরিকল্পনার মাধ্যমে চাষযোগ্য ভূমিতে উন্নীত করা হয়েছিল। পেরিয়ার মনিয়াম্মাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত পেরিয়ার মানিয়াম্মাই কলেজটি কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং বিভাগীয় সদস্যদের স্থানীয় বাসিন্দাদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে PURA-র উন্নয়নের কাজে নিযুক্ত করেছে। এরা এক গ্রাম এক উৎপাদন, পরিকল্পনা রূপায়িত করার ফলে গ্রামগুলি থেকে পঁয়তাল্লিশটা দ্রব্য নির্বাচন সম্ভব হয়েছে যার আন্তর্জাতিক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষা-সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্টতা পঁয়ষট্টিটি গ্রামে অগ্রসরমান গ্রামীণ উন্নয়নে সক্ষম হয়েছে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে।
নানাজি দেশমুখ এবং দীনদয়াল রিসার্চ ইন্সটিটিউট বা ডিআরআই-এ ওঁর টিম সদস্যরা মধ্যপ্রদেশে চিত্রকূট PURA স্থাপন করেছিল। ডিআরআই এক অভিনব প্রতিষ্ঠান যা ভারতের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত এক গ্রামীণ উন্নয়ন মডেলের প্রয়োগ ও বিকাশসাধন করেছিল।
এই প্রতিষ্ঠান বুঝতে পেরেছিল মানবশক্তি রাজনৈতিক শক্তির তুলনায় কার্যকর, স্থিতিশীল ও সহনশীল। নিপীড়িত ও অনুন্নতদের মধ্যে একাত্ম হতে পারলে তবেই সে শাসনব্যবস্থা ও শাসনপদ্ধতির বিশ্লেষণী অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে। তরুণসমাজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং উৎকর্ষতার মানসিকতার সঞ্চারণ দ্বারাই একমাত্র সামাজিক অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধিলাভ সম্ভব। এই নীতিকে ব্যবহার করে ডিআরআই এক কোটি গ্রামীণ গুচ্ছ উন্নয়নের পরিকল্পনা করেছে যেগুলোর মোটামুটিভাবে পাঁচটি গ্রাম চিত্রকূট ঘিরে রয়েছে। তারা এর মধ্যেই ৪০টি গ্রামের উন্নতিসাধন করেছে, যেখানে প্রায় ৫০,০০০ গ্রামবাসী নিয়ে ১৬টি গুচ্ছ আছে।
পাটনি নামক একটি গ্রামে ডিআরআই দেশজ ঐতিহ্যগত প্রযুক্তি, জ্ঞানব্যবস্থা এবং স্থানীয় প্রতিভাভিত্তিক সক্ষম উন্নয়ন ঘটিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে গবেষণার দ্বারা গ্রামের স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্য অবিকল অনুকৃতিযোগ্য ও সুনির্দিষ্ট আদর্শের উন্নয়ন সহজসাধ্য হয়েছে। এই কার্যক্রম লক্ষ্য স্থির করে— মূল্য সংযোজনের ফলে আয়ের বৃদ্ধি, উদ্ভাবনী কৃষিসংক্রান্ত অনুশীলনী, গ্রামবাসীদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক মনোভাব তৈরি করা, স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য-বিধির উন্নতি ঘটানো এবং একশো শতাংশ সাক্ষরতার জন্য প্রচেষ্টা। উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের বাইরে এই প্রতিষ্ঠান সংযোগশীল, দ্বন্দ্ববিহীন সমাজ গড়ে তোলা সহজসাধ্য করে। এর ফলে চিত্রকূটের চারদিকে আশিটি গ্রাম মামলা-মোকদ্দমা মুক্ত। গ্রামবাসীরা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোনও বচসা আদালত পর্যন্ত গড়াবে না। গ্রামে বসেই তার বন্ধুত্বপূর্ণভাবে সমাধান হবে। এর কারণ হিসেবে নানাজি দেশমুখ বলেছিলেন যে, যদি মানুষ একে অপরের সঙ্গে শুধু লড়াই চালিয়ে যায় তবে তারা উন্নয়নের জন্য সময় পাবে না। তারা নিজেদের জন্য অথবা সম্প্রদায়ের জন্য কোনও কাজ করতে পারবে না। এই বার্তা সেখানকার লোকেরা বুঝতে পেরেছিল।
আমার মনে হয় গ্রামীণ ভারতের উন্নয়নের জন্য চিত্রকূট প্রকল্প এক পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। এটি এমন সমাজ নির্মাণের দিকে লক্ষ্য রাখে যা পারিবারিক বন্ধন, ভারতীয় সংস্কৃতির গৌরব, আধুনিক শিক্ষা ও ভারতীয় প্রাজ্ঞতার মেলবন্ধন, সামাজিক উদ্বেগ মোচন, প্রত্যেকের বিশেষত মহিলাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, সকলের জন্য স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা, পরিবেশ সচেতনতা, সমাজের সমস্ত স্তরে সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই ধারণা আমার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যায়। আমিও মনে করি উন্নত ভারত মানে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, শিল্প ও সাহিত্যে, মানবতাবাদ এবং চিন্তাভাবনায় মহত্ত্ব, সবের সমষ্টিগত উন্নয়ন ও সর্বোপরি পাঁচ হাজার বছরের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে ভারতবর্ষের উন্নয়ন সম্ভব।
PURA উপলব্ধির এক স্বীকৃতিমূলক আন্দোলনের সূচনা হয়েছে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে একে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের লক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে। আমি নিশ্চিত যে এই পূর্বাভাস অত্যন্ত শক্তিশালী এবং নিকটবর্তী ভবিষ্যতে প্রায় ৭০০০ PURA গুচ্ছ সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে।
.
গাঁধীজি বলেছেন সত্যকার ভারত গ্রামেই অবস্থান করে। মানবতার এই বিশাল সমষ্টি ভারতবর্ষকে বিশ্বের কাছে নিবেদনে সাহায্য করতে পারে॥
১২. উদ্যানে
১২. উদ্যানে
প্রাচীর তুলে দুঃখ বা আনন্দকে আমি কারারুদ্ধ করি না;
আত্মত্যাগে বা অর্জনে, লাভে বা লোকসানে,
খোলা প্রাঙ্গণে আমি শুধু ফুল ফোটাই,
নদীতে ও পুকুরে পদ্মফুল ভাসাই।
১৯৯৭ সালে আমাকে যখন ভারতরত্ন উপাধি দেওয়া হল, চিত্রা নারায়ণন (রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন-এর কন্যা) আমায়, আমার ভাই এবং তাঁর নাতি-নাতনিদের নিয়ে মুঘল গার্ডেনে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সে এমন এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে আমি ওই উদ্যানের সমারোহ জ্যোৎস্নারাত্রে দেখবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর স্ত্রী উষা নারায়ণন কথাটা শুনেছিলেন। তারপর থেকে যখনই আমি কোনও রাষ্ট্রীয় ভোজে আপ্যায়িত হয়েছি তখনই রাষ্ট্রপতি এবং ফার্স্ট লেডি আমাকে রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তখনও ভাবতে পারিনি যে আমি রাষ্ট্রপতি ভবনে এরকম আরও ষাটটি জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রি দেখতে পাব।
যখন আমি ওখানে ছিলাম মুঘল গার্ডেন আমার কাছে এক গবেষণামূলক মঞ্চ ছিল। উদ্যানটি প্রকৃতি এবং দেশের নাগরিকের সঙ্গে আমার যোগাযোগের এক মহৎ মাধ্যম ছিল। সেটা ছিল এমন এক জায়গা যেখানে সমাজের বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে আমি মিলিত হয়েছিলাম। তাদের মধ্যে ভেষজ উদ্ভিদের বিশেষজ্ঞরাও ছিলেন, সেইজন্য ওই চত্বরে একটা বিভাগও ছিল। বাগানে যে পাখি এবং জীবজন্তু ঘোরাফেরা করত তারা ছিল আমার পরমবন্ধু। বাগানের নির্মল ও ছন্দময় পরিবেশ এবং অপূর্ব সুন্দর বৃক্ষগুলো আমায় শান্তির সন্ধান দিত।
নানা উপলক্ষে আমি আমন্ত্রিত রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের প্রধানের সঙ্গে বাগানে পদচারণা করেছি। বিশেষ স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হল ২০০৭ সালে সার্ক রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে পদচারণা করা। আমার মনে আছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজ মন্তব্য করেছিলেন, যদি আমরা মুঘল গার্ডেনে বসে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সম্পাদন করতাম তা হলে আমাদের মধ্যেকার মতবিরোধগুলো মুছে যেত। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এক ঘণ্টা চা-পান বৈঠকের পরিবর্তে আমার উচিত ছিল এই মনোরম উদ্যানে বসে আমাদের অঞ্চলের উন্নয়নমূলক আলোচনা সভার আয়োজন করা।
বাগানে আমি দুটি কুটির তৈরি করেছিলাম। কুটির দুটোর নকশা এমনভাবে করা হয়েছিল যা পরিবেশ সহায়ক এবং নির্মাণে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হয়েছিল। একটি কুটির ত্রিপুরা থেকে কারিগর নিয়ে এসে তৈরি করা হয়েছিল, নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ভাবনা কুটির’ বা থিংকিং হাট (Thinking Hut)। সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ওই কুটিরে আলাপ-আলোচনার জন্য নিয়ে যেতাম। আর আমার অন্যতম বই ‘Indomitable Spirit’-এর বেশিরভাগ অংশ ওখানে বসেই লেখা। দ্বিতীয় কুটিরের নাম ছিল ‘অমর কুটির’ বা ইম্মরটাল হাট (Immortal Hut)। এর চারিদিকে একটি কুঞ্জবন ছিল— যেখানে ষোলোটি গাছ, চৌত্রিশ ধরনের ভেষজ গাছ, একটি সংগীত উদ্যান এবং একটি জীববৈচিত্র্য বাগান ছিল। আমার লেখা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘Guiding Soul’-এ মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে চর্চা আছে যা আমার বন্ধু অধ্যাপক অরুণ তিওয়ারির সঙ্গে ‘অমর কুটিরে’ বসে আমাদের আলোচনা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। যখনই কোনও জটিল জাতীয় সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজন হত তখন ওই কুটির দুটোয় বসেই আমি ভাবনাচিন্তা করতাম। অবশ্যই, ওখানে বসে অনেক কবিতা লেখার প্রেরণাও পেয়েছিলাম।
রাষ্ট্রপতি ভবনের সম্পত্তি প্রায় ৩৪০ একর জুড়ে ছড়ানো। মুঘল গার্ডেন গড়ে উঠেছিল ১৫ একর জায়গা জুড়ে। উদ্যানে পরপর তিনটি উঁচু চত্বর আছে-আয়তাকার, লম্বা আর গোলাকার। আয়তাকার চত্বর বা আসল মুঘল গার্ডেনটির অত্যন্ত সুন্দর কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেমন— চারটি খাল, ছয়টি ঝরনা এবং ৭০ বর্গ মিটার আয়তনের মধ্যবর্তী লন (ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক জাতীয় বৈঠক এখানে সম্পাদিত হয়েছিল এবং প্রজাতান্ত্রিক দিবসে ও স্বাধীনতা দিবসের জনপ্রিয় ঘরোয়া অনুষ্ঠানগুলো এখানে অনুষ্ঠিত হয়), ১৪৪টা মউলসারি গাছের ছাতার মতো চন্দ্রাতপ, অসাধারণ সুন্দর গোলাপ আর বিভিন্ন আয়তনের বেশ কিছু লন। এই বাগানটি লম্বা, বাগান চত্বরটির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। লম্বা বাগানটির মাঝখান দিয়ে ৫০ মি. লম্বা রাস্তা চলে গেছে এবং মাঝখানে একটা অর্ধবৃত্তাকার ছাউনি আছে যা পুষ্পলতা দিয়ে আচ্ছাদিত। রাস্তাটির দু’পাশে গোলাপ গাছের কেয়ারি এবং চিনা কমলালেবুর গাছ আছে। লম্বা বাগানটি তৃতীয় উদ্যানকে পশ্চিমদিকে যুক্ত করেছে। এখানে রয়েছে ফুলের বাগান, মাঝখানে আছে একটা ঝরনা। এই বাগানের আকার গোলাকার বলে একে গোলাকার বাগান বা সার্কুলার গার্ডেন বলা হয়। বাগানে যখন ফুলগুলি পূর্ণভাবে বিকশিত হয় তখন রাজকীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়। এই বাগানটিতে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং তাঁর স্ত্রী লরা ও তাঁর সঙ্গী প্রতিনিধি দলের জন্য ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল। বিখ্যাত শিল্পী, বুদ্ধিজীবী এবং প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ওই ভোজসভায় যোগদানের দরুন যে সাফল্যলাভ হয়েছিল রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানসমূহের মধ্যে তা বিশেষ তাৎপর্যময়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর স্ত্রী উভয়েই এর প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন।
মুঘল গার্ডেনের তিনটি চত্বর ও বাকি অন্যান্য বাগানগুলির সৌন্দর্য তুঙ্গে উঠে যায় মধ্য-ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য-মার্চ সময়টায়। একসঙ্গে গোলাপ, নানা ধরনের লতা, গুল্ম ফুলের গাছ এবং শীতের মরশুমি ফুল ফুটে চারদিক আলো করে চমকপ্রদ প্রদর্শনী করে।
ড. ব্রহ্ম সিং, বিশেষ কর্তব্যরত আধিকারিক, উদ্যানপালন, প্রদর্শনীতে বিচিত্র ফুলের তালিকাবদ্ধ করতে গিয়ে পরম আনন্দিত হয়েছিলেন। ওখানে অ্যাকরোকলিনিয়াম, অ্যান্টিরহিনাম, ব্র্যকিকোম, বিগোনিয়া, ক্যালেন্ডুলা, ক্যাম্পানুলা, ক্যান্ডিটাফ্ট, কারনেশান, ক্রিসানথিমাম, কেলোসিয়া, চিনা অ্যাস্টর, সিনেরারিয়া, ক্যালিওপসিস, কস্মস, ক্লারকিয়া, কর্নফ্লাওয়ার, ডেইজি, ডেলফিনিয়াম, ডায়ানথাস, ডালিয়া এবং আরও নানা ফুল ছিল, বর্ণমালা ধরে নানা ফুলের নাম।
উদ্যানের সৌন্দর্য হাজার হাজার মানুষকে আকৃষ্ট করে। জনসাধারণ বিনামূল্যে এই উদ্যানে প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ দিনে একান্তভাবে বিশেষ সম্প্রদায়ের যেমন কৃষক, প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মচারী, প্রবীণ নাগরিক, শারীরিকভাবে অক্ষম এবং দৃষ্টিহীন মানুষদের প্রবেশের ব্যবস্থা থাকে।
ড. ব্রহ্ম সিং রাষ্ট্রপতি ভবনের গাছ নিয়ে সুন্দরভাবে চিত্রিত একটা বই প্রকাশ করেছিলেন।
রাষ্ট্রপতি ভবন চত্বরের নিসর্গচিত্র বিকশিত করে এবং আরও অতিরিক্ত সবুজ ক্ষেত্র নির্মাণের মাধ্যমে কীভাবে ভবন চত্বর আরও মূল্যবান করা যায় এ-বিষয়ে ২০০২ সালে আমার কিছু ভাবনাচিন্তা ছিল। পার্বত্য অঞ্চলের কৃষি এবং নুড়িপাথর মিশ্রিত বন্ধুর জমিতে সবজি ও পুষ্পোদ্যান বিকাশের ক্ষেত্রে ডিআরডিও-তে আমার যে অভিজ্ঞতা ছিল তা কাজে এসেছিল। আমি ডিআরডিও ছাড়াও অন্যান্য সংগঠন যেমন, ভারতীয় কৃষিবিদ্যা গবেষণা সংসদ বা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ এবং বৈজ্ঞানিক ও শিল্প বিষয়ক গবেষণা সংসদ বা সিএসআইআর (কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ)-এর কৃষি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম। ড. ব্রহ্ম সিং সহায়তা করেছিলেন এবং আমাদের প্রচেষ্টার ফলে বারোটি উদ্যান সৃষ্টি হয়েছিল।
ভারতবর্ষে বা ভারতের বাইরে স্পর্শনীয় বাগানের সংখ্যা খুব কম। লখনউ-এর সিএসআইআর-এর অন্তর্গত জাতীয় উদ্ভিদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা এনবিআরআই (ন্যাশনাল বোটানিকাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট)-এর একটি স্পর্শনীয় উদ্যান আছে, তার বিশেষজ্ঞসুলভ নৈপুণ্য ব্যবহার করে ২০০৪ সালে রাষ্ট্রপতি ভবনের স্পর্শনীয় উদ্যান গড়ে উঠেছে। এখানেও একটি ডিম্বাকৃতি বাগান আছে যার মধ্যে একটা ঝরনা এবং পাথর বাঁধানো রাস্তা আছে। এখানে আছে চৌত্রিশটা সুগন্ধী গাছ, গুল্ম, মশলা, ফল এবং শোভাবর্ধক গাছের কেয়ারি। প্রতিটি কেয়ারির একটি করে নির্দেশক আছে যেখানে গাছের বর্ণনা হিন্দি এবং ইংরেজিতে ব্রেইল ভাষায় দেওয়া আছে।
দৃষ্টিহীন যাঁরা, তাঁরা এই উদ্যানে এসে ভীষণ খুশি হন। তাঁদের মুখমণ্ডলে আনন্দের লক্ষণ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। প্রতি বছর যখন স্পর্শনীয় উদ্যান দৃষ্টিহীনদের জন্য খোলা হয় আমি সবসময় ওদের সঙ্গে থাকি।
এক রবিবার অমর কুটিরে বসে আমি যখন ড. ব্রহ্ম সিং এবং আমার বন্ধু ড. ওয়াই এস রাজনের সঙ্গে আলাপচারিতা করছিলাম তখন সংগীতময় উদ্যানের ভাবনাটি জেগে উঠল। আমরা অনুভব করলাম বটগাছের কুঞ্জবন, জৈববৈচিত্র্যপূর্ণ বাগান এবং ঔষধি উদ্যানকে পশ্চাদপটে রেখে একটি সংগীতময় উদ্যানের প্রয়োজনীয়তা আছে। ২০০৬ সালে একটি সংগীতময় ঝরনার ব্যবস্থা চালু হল। এই প্রকল্পটি বহু প্রযুক্তির এক উদ্দীপনাময় সম্পূরণকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেমন-গাণিতিক, বৈদ্যুতিন তড়িৎ-চুম্বকত্ব, জল-গতিবিদ্যা, উদ্স্থিতি বিদ্যা এবং মানুষের উদ্ভাবনী কৌশল।
ঝরনার জলে এক অভূতপূর্ব প্রদর্শন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ঝিকমিক করা আলো ঝরনার ঢেউয়ের মতো ফিনকি দেওয়া জলকে, রেকর্ড-করে-রাখা বা সরাসরি বাজানো মার্গসংগীতের সুরে নিখুঁত ছন্দ সমতায় আলোকিত করে। পূর্ণিমা রাত্রে, গরিমা এবং আত্মমর্যাদার প্রতীক রাষ্ট্রপতি ভবনের গম্বুজকে পশ্চাদপটে রেখে উদ্যানে এক জোড়া ঝরনা রাজকীয়ভাবে দাঁড়িয়ে পবিত্রতা, উৎকর্ষতা এবং গৌরব বিচ্ছুরণ করে।
এক অপূর্ব আনন্দদায়ক মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছিল যেদিন এক পূর্ণিমা রাত্রে এই সংগীতময় উদ্যানে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা ৫০০ জন শ্রোতার সামনে সন্তুর বাজিয়েছিলেন।
বহু বছর ধরে নানা ধরনের পাখি এবং পশুপ্রজাতি, একটা জলপ্রপাত, শৈলোদ্যান, মাছের পুকুর, খরগোশের বাড়ি, হাঁসের বাড়ি, অসুস্থ পশুর জন্য নিরালা স্থান এবং পক্ষীনিবাস যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বাগান গড়ে উঠেছিল। উদ্যান শুধুমাত্র প্রকৃতির প্রতি যত্ন এবং ভালবাসার ভাব গড়ে তোলেনি, শান্তি এবং প্রশান্তি অর্জনের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে আমি একটা পরিত্যক্ত হরিণশাবক দেখেছিলাম। আমি আর ভ্রমণসঙ্গী ড. সুধীর লক্ষ করেছিলাম জন্মকালীন কোনও দৈহিক ক্ষতিগ্রস্ততার কারণে শাবকটি উঠে দাঁড়াতে পারছিল না। ড. সুধীর ওর পা দুটো পরিচর্যা করে শাবকটিকে মা-র সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। প্রতিদিন আমি হরিণশাবকটিকে বোতলে করে দুধ পান করাতাম। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিল। যখনই সে আমাকে দেখত দৌড়ে আসত আমার কাছে, দুধ পান করার জন্য। কয়েক সপ্তাহ পরে হরিণের পাল শাবকটিকে নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করল। এই ঘটনা আমার মর্মস্পর্শ করেছিল।
.
রাষ্ট্রপতি ভবনে বাসকাল এবং মুঘল গার্ডেন ও অন্যান্য উদ্যান যে আনন্দদান করেছিল তা আমাকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। সবার সঙ্গে এই আনন্দকে ভাগ করে নেওয়া ছিল আমার কাছে এক সুখকর অভিজ্ঞতা। যেমন, ওই উদ্যানে যে প্রখ্যাত শিল্পীরা অনুষ্ঠান করতেন তা সকলের সঙ্গে উপভোগ করার চেষ্টা। ঈশ্বরের পরম করুণায় প্রকৃতি উপভোগ করার এই সৌভাগ্য প্রাপ্ত হয়েছি বলে আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
১৩. বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলি
১৩. বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলি
বিবেক হল আত্মার আলোক
রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার যে ভাবনাচিন্তা বা কার্যকলাপ ছিল তা রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে বা পরের ভাবনাচিন্তার সঙ্গে কোনও পার্থক্য ছিল না। যতই হোক, মানুষটি তো একই, এবং একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতার এক ধারাবাহিক রূপ। যদিও যুক্তি এবং কারণের ওপর ভিত্তি করে কাজ করা হয়েছিল এমন তিনটি পরিস্থিতির কথা আমি বলতে পারি যা আমার ব্যক্তিগত অনুভবকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। প্রথমটি হল বিহার বিধানসভা ভেঙে দেওয়া। আমি এই বিষয়টি নিয়ে বহুবার আলোচনা করেছি, আবার আর-একবার করব।
আমার কার্যকালে তথ্যপ্রযুক্তির প্রভূত অগ্রগতি হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ভবন সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিনভাবে সংযুক্ত ছিল। যেখানেই আমি থাকতাম, পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক আমি ফাইল থেকে সঠিক সময়ে তথ্য সংগ্রহ করতে এবং আলোচনায় তা প্রয়োগ করতে পারতাম। ই-মেল তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করিয়ে দিত। এইভাবে মনমোহন সিং যখন আমায় বললেন বিধানমণ্ডলের স্বতঃপরিবর্তনশীলতায় রাজ্যপালের পরামর্শের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিহার বিধানসভা ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেবে, তখন যা আমায় আশ্চর্য করল তা হল বিধানসভা ছয়মাসের বেশি সময় ধরে বরখাস্ত অবস্থায় রয়েছে। সেখান থেকে আমি প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলাম, কীভাবে এই হঠাৎ পরিবর্তন সম্ভব হল? তিনি বললেন যে, তিনি আমার সঙ্গে পরে যোগাযোগ করবেন। দ্বিতীয় ফোনটি মস্কোর সময় অনুযায়ী রাত একটার সময় এল। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি আলোচনা করেছিলাম। আমার বিশ্বাস হয়েছিল যদি আমি মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুমোদন নাও করি তাতে কিছু যাবে-আসবে না, কারণ যেভাবেই হোক এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, ফলে আমি ঠিক করেছিলাম বিধানমণ্ডল ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করব।
আদালত আরও প্রায়োগিক পরিভাষা ব্যবহার করেছিল, ‘বিহারের রাজ্যপাল ভারতের রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে দুটো প্রতিবেদন তৈরি করেছিল-২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল এবং ২০০৫ সালের ২১ মে তারিখে। ২০০৫ সালের ২৩ মে সংবিধানের ১৭৪ অনুচ্ছেদের ২ ধারার (বি) উপপ্রকরণ দ্বারা ক্ষমতার অধিকার অর্পণ করার অনুশীলনীতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল। সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদের অন্তর্গত ২০০৫ সালে ৭ মার্চ-এ প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি জি এস আর ১৬২ (ই)-এর ধারা (এ)-সহ পঠিত হবে এবং বিহার রাজ্যের বিধানমণ্ডল তৎক্ষণাৎ ভেঙে দেওয়া হল…’ এখন উচ্চতম ন্যায়ালয় এই বিষয়ে বিতর্ক শুরু করেছে এবং আলোচনায় নানা দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটেছে।
উচ্চতম ন্যায়ালয় তার রায়ে বলেছে যে, ২০০৫ সালের ২৩ মে-র বিজ্ঞপ্তি একটি অভিনব বিষয়। ‘আগেকার মামলাগুলোয় আদালতে উপস্থিত বিষয়গুলির ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলির বিধানসভার প্রতি অনাস্থা পোষণ করার কারণে বিধানসভা ভঙ্গ করার আদেশ জারি করা হয়েছিল। বর্তমান ক্ষেত্রে বিষয়টি সেই ধরনের, যেখানে জোড়াতালি দিয়ে সংখ্যালঘু দলকে সংখ্যাগুরু দেখানোর প্রচেষ্টা এবং রাজ্যে সরকার গঠনের দাবি করা হয় এবং যদি এই প্রচেষ্টা বজায় থাকে তবে তা সাংবিধানিক বিধানের সঙ্গে কারচুপি করা হবে, এই পরিপ্রেক্ষিতে বিধানমণ্ডলের প্রথম বৈঠক হওয়ার আগে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।’
বিচারালয় চারটি প্রশ্ন উত্থাপিত করেছিল—
১. প্রথম বৈঠক অধিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই কি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭৪ (২) (বি) অনুযায়ী বিধানসভা ভেঙে দেওয়া অনুমোদনযোগ্য?
২. বিহার বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার ২০০৫ সালের ২৩ মে-র ঘোষণা কি অবৈধ এবং অসাংবিধানিক?
৩. যদি পূর্বোক্ত প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ-বাচক হয় তবে ৭ মার্চ, ২০০৫ অথবা ১৪ মার্চের ২০০৫ এর আগে যে অবস্থা ছিল তা বজায় রাখার জন্য নির্দেশের কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
৪. রাজ্যপালকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৩৬১-এ কী সুযোগ আছে?
যখন উচ্চতম ন্যায়ালয় এ-বিষয়ে বিতর্ক শুরু করে তখন বিভিন্নরকম দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটে। আমি যে প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম তা ঠিকভাবে যে আদালতে পরিবেশন করা হয়নি সে-কথা প্রধানমন্ত্রীকে আমি জানিয়েছিলাম। প্রথমবার টেলিফোনে, পরে সামনাসামনি তাঁকে বলি। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, মস্কোর ঘটনাপরম্পরা এবং প্রকৃত সত্য দ্বারা সমর্থিত রাষ্ট্রপতির ক্রিয়া পরিবেশন করার জন্য আইনজীবীদের সংক্ষিপ্তাকারে বলে দেবেন এবং এও বলবেন যে চূড়ান্তভাবে ভেঙে দেবার অনুমোদন করার আগে কতবার আমরা আলোচনা করেছি। শেষাবধি আমি নিশ্চিত হলাম যে, প্রত্যাশা অনুযায়ী আইনজীবীরা আমার কাজের দিকটা গোচরে আনেননি। সুপ্রিমকোর্ট এর বিরুদ্ধ মতে রায় দেয়। অবশ্যই বিচারকরা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং তাঁরা রাজ্যপাল এবং কিছুদূর অবধি সরকারের ওপর দায়ভার প্রদান করেছিলেন। যতই হোক, ক্যাবিনেট হল আমার অধীনে এবং আমাকে এই দায়িত্ব নিতে হবে।
যে মুহূর্তে রায় জানা গেল, আমি ইস্তফাপত্র লিখে স্বাক্ষর করে উপরাষ্ট্রপতি ভৈঁরো সিং শেখাওয়াতকে পাঠাবার জন্য তৈরি করে রাখলাম। ভৈঁরো সিং অত্যন্ত ঝানু রাজনীতিক ছিলেন। আমি চেয়েছিলাম ওঁর সঙ্গে কথা বলে হাতে হাতে ইস্তফাপত্র দিতে। তিনি তখন বাইরে ছিলেন। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে অন্য কোনও আলোচনার জন্য দেখা করতে চেয়েছিলেন। বেলার দিকে আমার দপ্তরে ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। আলোচনা শেষে আমি জানালাম যে, রাষ্ট্রপতি পদ থেকে আমি ইস্তফা দিতে চাই এবং তাঁকে সেই পদত্যাগপত্র দেখালাম। উপরাষ্ট্রপতির ফিরে আসার জন্য আমি প্রতীক্ষা করছিলাম। প্রধানমন্ত্রী চমকে গেলেন।
খুব মর্মস্পর্শী দৃশ্যর অবতারণা হল এবং আমি তা বর্ণনা করতে চাই না। প্রধানমন্ত্রী কাতর অনুরোধ জানালেন যেন এই জটিল পরিস্থিতিতে আমি ওই পদক্ষেপ না নিই। এর পরিণতিতে যে অস্থিরতার জন্ম হবে তাতে সরকারের পতনও ঘটতে পারে। আমার তখন বিবেক ছাড়া আর কারও সঙ্গে পরামর্শ করার ছিল না। বিবেক হল আত্মার আলো যা আমাদের হৃদয়ের কোটরে জ্বলে। সেই রাত্রে আমি ঘুমোতে পারিনি। নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম আমার বিবেক না দেশ, কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? পরদিন খুব সকালে রোজকার মতো আমি নমাজ পড়লাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ইস্তফা প্রস্তাব ফিরিয়ে নেব এবং সরকারকে বিচলিত করব না। কোনও ক্ষমতাসীন দল নির্বিশেষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হত।
দেশের খুব অল্পসংখ্যক মানুষই ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। আমার বিবেচনায় এ এক সীমাহীন বিশ্বকে আয়ত্ত করার মাধ্যম। দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকি-না কেন আমি ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার করি। যাঁরা আক্ষরিক অর্থে কাগজেকলমে কাজ করে অভ্যস্ত তাঁদের পক্ষে ই-গভর্ন্যান্সের ক্ষমতা উপলব্ধি করা কঠিন। বিহার বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে (যা তখন সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় ছিল) আমার বিবেকের কাছে ঠিক মনে হয়েছে তাই করেছি।
মনু প্রত্যেক ব্যক্তিকে দানগ্রহণ করার ক্ষেত্রে সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এর ফলে গ্রহীতা একটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে এবং ভ্রান্তপথে চালিত হয়।
বিস্তারিতভাবে বলা যায়, সংসদের অযোগ্যতার নিবারণ আইন ১৯৫৯ শর্ত দেয় সরকারের কিছু কিছু লাভজনক দফতর তার নির্বাচিত পদাধিকারী ভোক্তা বা সাংসদ হওয়ার দরুন অযোগ্য বিবেচনা করে না।
২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমি কয়েক জন সাংসদদের কাছ থেকে তাঁদের সহকর্মী সদস্যদের সম্বন্ধে অভিযোগ শুনলাম যে তাঁরা লাভজনক পদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। আমাকে এই অভিযোগগুলো নিয়ে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। আমি অভিযোগ মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের কাছে পর্যবেক্ষণের জন্য এবং যেখানে প্রয়োজন সেখানে অনুসন্ধান চালনার জন্য পাঠিয়েছিলাম। দু’জন সদস্য শ্রীমতী জয়া বচ্চন এবং শ্রীমতী সনিয়া গাঁধীর নামে যখন অভিযোগ এসেছিল তখন অনেক সদস্য আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন কেন রাষ্ট্রপতি এ ধরনের অনুসন্ধান শুরু করলেন? ইতিমধ্যে আমি সংসদ থেকে লাভজনক পদসংক্রান্ত বিল অনুমোদনের জন্য পেয়েছিলাম।
আমি বিল বিশ্লেষণ করে নানা অসংগতি খুঁজে পেয়েছিলাম। প্রস্তাবিত লাভজনক পদ বিলে, লাভজনক পদ বলতে কী বোঝায় এই প্রশ্নের মীমাংসার প্রতি আমি কোনও বিধিবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পাইনি। পরিবর্তে সাংসদ দ্বারা অধিকৃত পদের ক্ষেত্রে বর্তমান পদগুলোকে শুধু অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমি উচ্চতম ন্যায়ালয়ের পূর্বতন তিনজন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অসংগতিসমূহ ও আমার উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আমার সহকারীবৃন্দ এবং তিনজন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে একটা চিঠি তৈরি করেছিলাম। তাতে আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম বিলে অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে শর্তগুলি উল্লেখ করা উচিত, কেন কোনও বিশেষ পদকে লাভজনক পদের বিলের আওতা থেকে অব্যাহতি দেবে তার কারণগুলো যেন ‘সঠিক এবং যুক্তিপূর্ণ’ হয় এবং সমস্ত রাজ্যগুলি এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে তার প্রয়োগ যেন ‘স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ’ভাবে হয়। আরও একটা বিষয় আমি উত্থাপন করেছিলাম যে, পদের সঙ্গে সম্পর্ক খুঁজে নতুন আইন দ্বারা তাকে অব্যাহতি দিতে হবে। তাঁরা বলেছিলেন আমার উদ্বেগ অকৃত্রিম এবং কোনও বিশেষ পদ লাভজনক পদ বিলের এক্তিয়ারের মধ্যে আসছে কি না তা নির্ধারণ করার জন্য যথার্থ নিয়মনীতির প্রয়োজন আছে।
এবার প্রশ্ন হল আমার লাভজনক বিল সম্পর্কিত পত্র কি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় যাবে না সংসদে? সংবিধান ভাল করে পাঠ করে দেখলাম আর্টিকল III অনুযায়ী এটি আবার সংসদে পুনর্বিবেচনার জন্য পুনরায় উল্লিখিত হওয়া উচিত। অনুমোদনের জন্য লাভজনক পদ সংক্রান্ত বিল আমার কাছে মন্ত্রিসভা পাঠায়নি, পাঠিয়েছে সংসদ। তাই আমি বিলটি সংসদের উভয়কক্ষের পুনর্বিবেচনার জন্য লোকসভা ও রাজ্যসভার মহাসচিবের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। সংসদ বা রাষ্ট্রপতি ভবনের ইতিহাসে প্রথমবার এই ঘটনা ঘটল যে, একজন রাষ্ট্রপতি বিল পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠালেন। অবশ্যই পরের দিন, সংসদে বিল ফেরত পাঠানোর জন্য আমার চিঠিটি বৈদ্যুতিন আর সংবাদমাধ্যমে প্রধান আলোচ্য নিবন্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটা জোরদার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল। বিলে স্বাক্ষর করার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দল থেকে আমার ওপর খুব চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল।
‘মনুস্মৃতি’তে লাভ বা দান বলতে কী বোঝায় তার অর্থ আমি তখনই কেবলমাত্র বুঝতে পেরেছিলাম: ‘দান গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যেকার ঐশ্বরিক রশ্মি নির্বাপিত হয়ে যায়।’ একজন হাদিস বলেছেন, ‘পরমেশ্বর যখন কাউকে কোনও পদে নিযুক্ত করেন তখন তিনি তাঁর প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখেন। যদি কোনও ব্যক্তি এর বাইরে কোনও কিছু গ্রহণ করেন তবে তা হয় অবৈধপ্রাপ্তি।’
এই ছিল লাভজনক পদ বিল ফেরত পাঠানোয় আমার উদ্বেগ এবং যুক্তি। বিল পুনর্বিবেচিত হয়ে আমার অনুমোদনের জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সাধারণত আমি বিল-সংক্রান্ত অনুমতি পরের দিনই পাঠিয়ে দিই, কিন্তু সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলে যাওয়ার পরেও যখন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হল না তখন প্রধানমন্ত্রী চিন্তিত এবং আশ্চর্যান্বিত হয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, সংসদের পক্ষ থেকে কিছু করা প্রয়োজন এবং সে-বিষয়ে আমি কিছু শুনিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সংসদ আমার পরামর্শমতো লাভজনক পদ বিলের সমস্ত দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনা করার জন্য ইতিমধ্যে যুগ্মসংসদীয় সমিতি বা জেপিসি (জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি) গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ইত্যবসরে, বিলম্বের কারণে সমালোচনার ঝড় তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল। অবশ্যই, আমি পরিষ্কার ছিলাম যে, বিল অনুমোদন করার আগে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো যেন নেওয়া হয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে বহু প্রতিনিধি আমার সঙ্গে দেখা করে এ-বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমি সেসময় উত্তর-পূর্বাঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। দিল্লি আসার পথে আমি যখন কোহিমা থেকে গুয়াহাটি যাচ্ছি তখন বার্তা পেলাম যে সংসদ লাভজনক পদ বিল বিবেচনার জন্য একটা জেপিসি গঠন করার অনুমোদন দিয়েছে। যে মুহূর্তে আমি সংসদের কাছ থেকে আমার কাজের অনুমোদন পেলাম তৎক্ষণাৎ লাভজনক পদ বিলে স্বাক্ষর করলাম।
বেশ কয়েক মাস পরে, সংসদ জেপিসি-র যে রিপোর্ট মঞ্জুর করল সেটা অসম্পূর্ণ ছিল এবং আমি যে সমস্যাগুলো তুলে ধরেছিলাম সেগুলোর সম্বন্ধে কিছুই বলা হয়নি। সংসদের উচিত এই ধরনের বিষয়গুলি খুব গুরুত্ব সহকারে চর্চা করা, নয়তো জনগণের কাছে এই বার্তা পৌঁছয় যে, রাষ্ট্রের উচ্চতম দায়িত্বাধিকারী সংগঠন ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার প্রচার করছিলেন এবং সরকারের বিশেষ স্তরের ব্যক্তিদের কাছে এ একজাতীয় প্রবণতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
এই মত লাভজনক পদ বিলের ফেরত পাঠানো সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করে, যে-সমস্ত প্রথা জনগণের সততার স্তরে পৌঁছতে পারে না তা সংসদীয় স্তরে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব সহকারে বিচার-বিবেচনা ও পর্যালোচনা করা দরকার। ত্রুটিপূর্ণ প্রথা গ্রহণের ক্ষেত্রে সূচনা হিসেবে একে গণ্য করা যায় যা জাতীয় মান গঠন এবং প্রথার ক্ষেত্রে সমঝোতার দিকে নিয়ে যাবে।
সাম্প্রতিককালে আমরা দেখি দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুটো অনশন আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে এবং এতে অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম— আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেন এই আন্দোলন হচ্ছে। বস্তুত, এর পেছনে কারণ হল, সংসদ নিজেই নিজের মানের অবনমন ঘটাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে আমি পরামর্শ দিই, সংসদ অন্ততপক্ষে দু’সপ্তাহ সময় নিয়ে, দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদে কক্ষ ত্যাগ না করে আলাপ-আলোচনা করুক এবং জনজীবন থেকে এ পাপ মুক্ত করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা স্থির করুক। এর অংশ হিসেবে সংসদীয় সদস্যদের জন্য একটা আচরণবিধির প্রয়োজনীয়তা আছে। যদি জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের লক্ষ্যপূরণে অসমর্থ হন তবে তাঁদের যাঁরা নির্বাচন করেছেন তাঁরা নানা উপায়ে নিজেদের হতাশা এবং অসম্মতি প্রকাশ করতে পারেন। প্রতিটা রাজনৈতিক দলকে সংসদের মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ করতে বা দুর্নীতি মুক্ত করতে নিজস্ব কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। সময় এসে গেছে, সংসদের উভয় কক্ষের উচিত দুর্নীতির বিষয় নিয়ে সতর্কভাবে চিন্তা করার এবং একটা সময়সীমানির্দিষ্ট সাংবিধানিক সমাধান খুঁজে বার করা, যা এই বিপজ্জনক প্রবণতা অপসারিত করবে, যার মধ্যে বিদেশে সঞ্চিত অর্থ পুনরুদ্ধার অন্তর্ভুক্ত। যথাসময়ে সংসদের এই ধরনের সক্রিয়তা নাগরিকদের মধ্যে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবে এবং সমাজের শান্তি ও সামঞ্জস্যতার প্রচার করবে যা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে জরুরি।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার পক্ষে অন্যতম কঠিন কাজ ছিল, আবেদনের সমস্ত বিকল্প প্রক্রিয়াসমূহ রুদ্ধ হওয়ার পর বিচারবিভাগ দ্বারা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। রাষ্ট্রপতি ভবনে এরকম প্রচুর আবেদন অমীমাংসিতভাবে রয়েছে। এ পূর্বসূরিদের থেকে প্রাপ্ত এমন একটি কাজ, যে কোনও রাষ্ট্রপতি এতে আনন্দিত হবেন না। আমি ভেবেছিলাম মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির অপরাধ, অপরাধের গুরুত্ব এবং ব্যক্তিটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে একজন সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলি পরীক্ষা করব। এই পর্যালোচনার ফলে আমি আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম— যে-সমস্ত অমীমাংসিত মামলাগুলো রয়েছে সেগুলো বেশিরভাগ সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। এর ফলে আমার মনে এই ধারণার জন্মাল যে, আমরা এমন মানুষকে শাস্তি দিচ্ছি, যার সঙ্গে শত্রুতার খুব সামান্যই সম্পর্ক এবং কোনও উদ্দেশ্যমূলক অপরাধ করেনি। অবশ্যই, এমন একটি মামলা আছে যেখানে দেখা গেছে লিফটম্যান একটি কিশোরীকে ধর্ষণ এবং হত্যা করার মতো অপরাধ ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে। সে মামলার ক্ষেত্রে আমি মৃত্যুদণ্ড জারি রেখেছিলাম।
আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে, যখন বিচারালয় মৃত্যুদণ্ড মামলায় শুনানি করছে তখন তাদের উচিত আইন বলবৎকারী সংস্থাকে সতর্ক করে দেওয়া যাতে তারা বুদ্ধিপ্রয়োগ করে শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধী এবং তার পরিবারের জীবিকানির্বাহের সূত্রটি খুঁজে বার করে। এই ধরনের বিশ্লেষণ হয়তো আসল মানুষটি এবং তার অপরাধের কারণ খুঁজে বার করবে।
আমরা সবাই ঈশ্বরের সৃষ্টি। মানুষের তৈরি বিধি-নিয়ম বা একজন ব্যক্তির কৃত্রিম এবং গড়ে তোলা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কারও জীবনকে শেষ করে দিতে কতটা উপযুক্ত সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন হওয়ার পর অথবা পরিবর্তনের দরুন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা রাষ্ট্রপতির অন্যতম কর্তব্য। এসব ক্ষেত্রে স্থিতিশীল সরকার গঠন করার জন্য যেন দল বা জোট সরকারের যথেষ্টসংখ্যক সদস্য থাকে সে-বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে নিশ্চিত হতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে যায় যখন একাধিক দল সরকার গঠনের দাবি করে, যেখানে কক্ষে কোনও দলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালের নির্বাচন বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। নির্বাচন সমাপ্ত হওয়ার পর, ফলাফল ঘোষিত হয়ে গিয়েছিল এবং কোনও একটি দলের সরকার গঠনের সামর্থ্য ছিল না।
কংগ্রেস দলের সর্বাধিক নির্বাচিত সদস্য ছিল। তা সত্ত্বেও তিনদিন চলে গেল অথচ কোনও দল বা জোটদল সরকার গঠন করতে এগিয়ে এল না। ঘটনাটি আমায় উদ্বিগ্ন করে এবং আমি আমার সচিবের সঙ্গে আলোচনা করে বৃহত্তম দলের, এখানে কংগ্রেস দলের নেতাকে একটা পত্র পাঠিয়েছিলাম যাতে সরকার গঠনের দাবির স্বার্থে তারা অগ্রসর হয়।
আমাকে বলা হয়েছিল সনিয়া গাঁধী আমার সঙ্গে ১৮ মে দুপুর ১২.১৫-তে দেখা করতে চান। কিন্তু দেখা গেল, একা আসার পরিবর্তে তিনি মনমোহন সিং-এর সঙ্গে এসেছিলেন আমার সঙ্গে আলোচনা করতে। শ্রীমতী গাঁধী বলেছিলেন, তাঁর আবশ্যিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে কিন্তু তিনি দলের সদস্যদের স্বাক্ষরিত প্রয়োজনীয় সমর্থনপত্র সঙ্গে আনেননি। পরদিন অর্থাৎ ১৯ তারিখ তিনি সেই সমর্থনপত্র নিয়ে আসবেন। আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন আপনি পিছিয়ে দিচ্ছেন। আমরা আজ দুপুরের মধ্যে কার্যসম্পাদন করতে পারতাম। তিনি চলে গেলেন। পরে একটি বার্তা পেলাম যে, তিনি আমার সঙ্গে সন্ধে ৮.১৫টায় সাক্ষাৎ করতে চান।
যখন এই বার্তা আদান-প্রদান চলছিল, আমি কোনও কোনও ব্যক্তি, সংগঠনগুলি এবং দলসমূহ থেকে অসংখ্য ই-মেল, চিঠিপত্র পেয়েছিলাম যে আমি যেন শ্রীমতী সনিয়া গাঁধীকে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুমতি না দিই। আমি কোনওরকম মন্তব্য না করেই সেগুলো বিভিন্ন সরকারি দফতরকে তাদের তথ্যসমূহের জন্য প্রেরণ করেছিলাম। এই সময়ে অনেক রাজনৈতিক নেতা আমার সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কোনও চাপের কাছে নতিস্বীকার করে যেন শ্রীমতী গাঁধীকে প্রধানমন্ত্রী না করি। তাঁরা যে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তা সাংবিধানিকভাবে গ্রহণীয় নয়। যদি শ্রীমতী গাঁধী দাবি করতেন আমায় তাঁকে নিয়োগ করা ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় থাকত না।
পূর্বনির্ধারিত সময়, সন্ধে ৮.১৫-এ শ্রীমতী গাঁধী ড. মনমোহন সিং-এর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে এসেছিলেন। কুশল বিনিময় করার পর ওই বৈঠকে শ্রীমতী গাঁধী বিভিন্ন দলের সমর্থনপত্র দেখালেন। তৎক্ষণাৎ আমি তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বললাম, রাষ্ট্রপতি ভবন আপনার সুবিধামতো সময়ে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত। ঠিক তখনই তিনি বললেন, তিনি ড. মনমোহন সিং-এর নাম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রস্তাব করতে চান, যিনি ১৯৯১-এ অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের স্থপতি ছিলেন এবং নিষ্কলঙ্ক চরিত্র-সহ কংগ্রেস দলের একজন বিশ্বাসী সহযোদ্ধা। এ ঘটনা অবশ্যই আমায় আশ্চর্য করেছিল এবং রাষ্ট্রপতি ভবনের সচিবালয় ড. মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করার জন্য নতুনভাবে নথিপত্র তৈরি করেছিল এবং তাঁকে যত শীঘ্র সম্ভব সরকার গঠন করার জন্য আহ্বান করেছিল।
অবশেষে, ২২ মে জাঁকজমকপূর্ণ অশোক হলে ড. মনমোহন সিং এবং ৬৭ জন মন্ত্রীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
অবশেষে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাপন করার স্বস্তিতে আমি নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। যদিও, আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম কেন তিনদিনের জন্য কোনও দল সরকার গঠনের দাবিদার হয়নি।
.
রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালে আমাকে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আইনি এবং সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মতামত উদ্রিক্ত করে আমি আমার মনকে সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীনভাবে প্রয়োগ করেছিলাম। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সংবিধানের পবিত্রতা এবং কাঠিন্যকে সুরক্ষিত করা এবং লালন করা।
১৪. রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালের পরে
১৪. রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালের পরে
ফুলকে দেখো, কী অকৃপণভাবে সুগন্ধ আর মধু দান করে,
কিন্তু যখন তার কাজ শেষ হয়ে যায়, নিঃশব্দে ঝরে পড়ে যায়।
—ভগবদ্গীতা।
রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন আমার খুব ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। আমাদের এই সুন্দর দেশ ঘুরে ঘুরে প্রতিটি রাজ্যে গিয়ে কীভাবে মানুষ সেখানে বেঁচে থাকে, তাদের পরিবেশ এবং সমস্যা স্বচক্ষে দেখা আর তারা জীবনে কতটা সুখী তা উপলব্ধি করা ছিল প্রথম বছরে আমার অন্যতম লক্ষ্য। কেরল উপকূলের নিকটবর্তী লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জ একমাত্র স্থান যেখানে পরিদর্শনে যেতে পারিনি বলে আমি অনুতপ্ত। প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব আকর্ষণ থাকে। সরলতা আর উষ্ণতার যে অন্তঃসলিলা প্রবাহিত হয় তা কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ভারতীয়।
অন্যরা এই ধরনের সফর কী চোখে দেখে তা জানা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ‘Outlook’ পত্রিকায় একটা প্রতিবেদন আমি উদ্ধৃত করছি-‘কালাম একজন সদা ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রপতি, যিনি দফতরে ১০ মাসের মেয়াদে ২১টি রাজ্য ইতিমধ্যে পরিদর্শন করেছেন। যা সম্ভবত ৫ বছরের মেয়াদকালে কোনও রাষ্ট্রপতি যা করে থাকেন তার চাইতেও বেশি। তিনি এই ধরনের ঝড়ের মতো ভ্রমণে যথেষ্টসংখ্যক এমনকী সংখ্যায় ১৫টি পর্যন্ত কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করেন, ব্যস্ত কর্মসূচিতে যাতে যথাসম্ভব সুস্থ থাকতে পারেন তার জন্য আগের দিন রাত্রে পৌঁছন…।’
রাষ্ট্রপতি মেয়াদকাল সমাপ্ত হলে পরে আমি দুটি ক্ষেত্রে সন্তুষ্টবোধ করেছিলাম। যখন আমি রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করি তখন ছাত্রমহলে একটা বিষণ্ণতা ও নৈরাশ্যবোধ কাজ করছিল। আমি তাঁদের কাছে গিয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে বলতাম। চেষ্টা করতাম তাঁদের উৎসাহিত করতে। বলতাম, যুবসমাজের কারও ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা করার প্রয়োজন নেই, কারণ ভারত ভালভাবেই অগ্রসর হচ্ছে। ভারতবর্ষের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের উন্নতি ঘটছে, তাঁদের বলেছিলাম। অবশ্যই এই উন্নয়নের হার সাম্প্রতিককালে বর্ধিত হয়েছে। আমার মেয়াদকাল শেষে যুবসমাজের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছিল। তাঁরা উন্নত ভারতে বাস করতে চেয়েছিলেন এবং তার জন্য তাঁরা কাজ করতে প্রস্তুত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতির ব্যস্ততাপূর্ণ জীবনের বাইরে কীভাবে আমি মানিয়ে নেব ভেবে অনেকে আশ্চর্য হতেন। যদিও রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার আগে আমি সক্রিয়ভাবে লেখা, শিক্ষকতা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনুপ্রেরণা দান করা এবং সেমিনার ও বৈঠকে যোগদানে নিযুক্ত ছিলাম। এই রোজনামচায় ফিরে যাওয়াই আমার ইচ্ছে ছিল। আমার কাছে চেন্নাইয়ের আন্না বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দরাবাদের ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বা আইআইআইটি (Indian Institute of Information Technology), পন্থনগরের জি বি পন্থনগর কৃষি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, অহমদাবাদ ও ইন্দোরের আইআইএম, খড়গপুর আইআইটি, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বা বিএইচইউ এবং আরও অনেক স্থানে শিক্ষকতার প্রস্তাব এসেছিল।
মনশ্চক্ষে দেখতে গেলে ২০০৭ সালের ২৬ জুলাই থেকে আজ পর্যন্ত আমার জীবনের লক্ষ্য আরও বর্ধিত হয়েছে। আমার শিক্ষকতা এবং গবেষণা এখন পন্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুসংজ্ঞায়িত হয়েছে। আমার লক্ষ্য ছিল ছাত্ররা কীভাবে ভারতের দ্বিতীয় সবুজবিপ্লবে এক সঞ্চালক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াতে পারে। পন্থ বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের প্রথম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় গবেষণামূলক কৃষি উৎপাদনের জন্য বিস্তৃত ক্ষেত্র আছে। ভারতের প্রথম আইআইটি খড়গপুরে আমি সাম্মানিক অধ্যাপক বা ডিসটিংগুইশড প্রফেসর হিসেবে সামাজিক রূপান্তর ও নেতৃত্ব বিষয়ে অধ্যাপনা করেছিলাম। হায়দরাবাদের আইআইআইটি-তে আমি তথ্যপ্রযুক্তি এবং জ্ঞান উৎপাদিত বিষয়ে শিক্ষাদান শুরু করেছিলাম যা ইন্ডিয়া ২০২০ লক্ষ্যে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। বিএইচইউ এবং আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রযুক্তি এবং গ্রামীণ অর্থনীতি রূপান্তর ঘটানোয় তার বহুমাত্রিক দিক বিষয়ে অধ্যাপনা করেছি। অহমদাবাদের আইআইএম এবং লেক্সিংটনে Gatton College of Business and Economics, USA-এ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে চ্যালেঞ্জ বিষয়ক একটি ইন্টার-অ্যাকটিভ কোর্স ম্যানেজমেন্টে স্নাতক ছাত্রদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ছাত্ররা ২০২০ সালের পূর্বে ভারতবর্ষের প্রতিযোগিতামূলক দশ দফা রেখাচিত্র উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে নানা কৌশল এবং উন্নয়নের জন্য অভিনব ধারণাগুলি নিবেদন করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ একদল ছাত্র PURA-কে সরাসরি বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্বে প্রচেষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করছে।
বিদেশের অনেক আমন্ত্রণ পাই। এখনও, দফতর ত্যাগ করার পরেও আমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে, রাজনৈতিক এবং শিল্পমহল থেকে, এ ছাড়া আমেরিকা যুক্তরাজ্য, ব্রিটেন, ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ড, কোরিয়া, ইজরায়েল, কানাডা, ফিনল্যান্ড, নেপাল, আয়ারল্যান্ড, সংযুক্ত আরবশাহী, তাইওয়ান, রাশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে বিশেষ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সফর করেছি। সফরের সময়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিদর্শন করেছি, শিল্প এবং বিশ্ব যুব সম্মেলনে যোগদান করেছি, এক উন্নত ভারতের লক্ষ্য মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি এবং মূল্যভিত্তিক শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অন্য রাষ্ট্রের অংশীদারিত্বের গুরুত্ব ব্যক্ত করেছি। এখনও পর্যন্ত আমি ১,২০০-এর বেশি কার্যক্রমে যোগদান করে ১৫ লাখ মানুষের সঙ্গে, বিশেষত তরুণদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তাদের সঙ্গে তরুণ সমাজের স্বপ্ন আমি বণ্টন করে নিয়েছিলাম, তারা কীভাবে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উন্নয়নের মহান লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা সহযোগে অনন্যসাধারণ হয়ে উঠতে চায়। এই প্রচেষ্টা এখন ওয়ার্ল্ড ভিশন ২০৩০-তে উন্নীত হয়েছে।
প্রতিটি ঘটনা আমার জীবনে নবদিগন্তের সূচনা করেছে। যখন আমি অতীতচারণ করি, তখন আত্মবিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করি ঘটনাগুলির দরুন যে পালাবদল ঘটেছিল সেখান থেকে আমি কী শিক্ষা পেয়েছিলাম। প্রতিটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তগুলি যথেষ্ট জটিল ও ঘটনাগুলি কালানুক্রমিকভাবে একে অপরের থেকে একেবারে আলাদা। তা সত্ত্বেও, নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য আমি যে আকাঙ্ক্ষা বোধ করি তা সমস্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তি। এইভাবে জীবন সমৃদ্ধ হয়।
একজন যা-কিছু করতে চায় তার সমস্ত কিছুর জন্য সময় বার করা খুব কঠিন। সত্যি কথা বলতে কী, আমার কার্যসূচিগুলো খুব জীবন্ত বলে মনে হয়। আগের তুলনায় আমার জীবন আরও কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছিল আর ভাবছিলাম নিজেকে কীভাবে আরও একটু জায়গা দেব। এই তো একদিন আগে আর কে প্রসাদ, যিনি আমার কর্মসূচি এবং কার্যক্রমসূচি দেখাশোনা করেন, তাঁকে ঠাট্টা করে বলছিলাম, কীভাবে শুক্রবার মহীশুর থেকে ফিরেই সোমবারের জন্য মোরাদাবাদ এবং রামপুরের কার্যক্রম নির্দিষ্ট করেছিল। গভীর রাত্রে গাড়িতে করে দিল্লি ফিরে আসার আগে ওখানে চারটে অনুষ্ঠানে যোগদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। বুধবার প্যান আফ্রিকান ই-নেটওয়ার্কে একটা অভিভাষণ এবং তারপর বৃহস্পতিবার গুয়াহাটি, শুক্রবার রাতে দিল্লি ফিরে আবার শনিবার সকালে মন্ত্রণাসভার জন্য লখনউতে বিমানে গমন। সাম্প্রতিক মাস, যেমন মে মাসের তালিকাবদ্ধ অনুষ্ঠানসূচি নিম্নলিখিত। প্রতিদিনকার পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎকার যার সংখ্যা খুব-একটা সামান্য নয়, বাদ দেওয়া হয়েছে।
২০১২ সালের মে মাসের তালিকা:
১ মে, মঙ্গলবার
• বোকারো পরিদর্শন: বোকারো ইস্পাত কেন্দ্র পরিদর্শন, প্রযুক্তিবিদদের উদ্দেশে এবং চিন্ময় বিদ্যালয়ের উদ্দেশে অভিভাষণ প্রদান।
• ‘আমি কী দিতে পারি’ কার্যক্রমের উদ্বোধনে অংশগ্রহণ করব, রাঁচিতে।
৫ এবং ৬ মে, শনিবার ও রবিবার
• চেন্নাই, ত্রিচি এবং কারাইকুড়ি পরিদর্শন
৭ মে, সোমবার
•ছত্তিশগড় সরকারি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৩০ জন ছাত্র এবং শিক্ষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা।
৯ মে, বুধবার
• মথুরায় ‘আমি কী দিতে পারি’ কার্যক্রম স্থাপন করার জন্য সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিদর্শন।
• বৃন্দাবনে বিধবাদের আশ্রম ‘পাগল বাবা আশ্রম’ পরিদর্শন।
১১ মে, শুক্রবার
• বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিভাগের প্রযুক্তি দিবস উদ্যাপনের উদ্বোধন।
১২ মে, শনিবার
• বেদান্ত হাসপাতালের উদ্বোধন এবং আজমগড়ের ছাত্রদের উদ্দেশে অভিভাষণ দেওয়ার জন্য উত্তরপ্রদেশের আজমগড় পরিদর্শন।
১৫ মে, মঙ্গলবার
• জাতীয় সমবায় উন্নয়ন নিগমের সমবায়সমূহ ২০১২-এর আন্তর্জাতিক বর্ষের উদ্বোধন।
১৭-১৮ মে, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার
• সিএমআর ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির স্নাতক দিবস উদ্যাপনে প্রধান অতিথি।
• মহীশূরের প্রতিরক্ষা খাদ্য গবেষণাগারে স্বর্ণজয়ন্তী বক্তৃতা।
• অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং-এ পরিদর্শন।
• জেএসএস বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন এবং ছাত্রদের উদ্দেশে অভিভাষণ প্রদান।
২১ মে, সোমবার
• মোরাদাবাদের তীর্থঙ্কর মহাবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি।
• রামপুর পরিদর্শন এবং রামপুর জেলার স্কুল ছাত্রদের অভিভাষণ প্রদান।
• সি এল গুপ্ত আই ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করা এবং ডাক্তার/কর্মীদের উদ্দেশে অভিভাষণ দেওয়া।
• মোরাদাবাদ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি পরিদর্শন ও ছাত্রদের উদ্দেশে অভিভাষণ দেওয়া।
২৩ মে, বুধবার
• আফ্রকীয় জাতির উদ্দেশে প্যান আফ্রিকীয় ই-নেটওয়ার্ক।
২৪ মে, বৃহস্পতিবার
• গুয়াহাটি পরিদর্শন এবং আইআইটি গুয়াহাটির বার্ষিক সমাবর্তনে অভিভাষণ প্রদান।
২৬ মে, শনিবার
লখনউ-এ হিন্দুস্তান টাইমস-এর হিন্দুস্থান উত্তরপ্রদেশ উন্নয়ন কনক্লেভে অভিভাষণ দান।
কর্মসম্পাদনের বৈচিত্র্যে, এতে যে-কেউ লক্ষ করতে পারবেন, প্রতিটি অভিভাষণে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা এবং বক্তৃতা তৈরি করাও একটা বিশেষ কাজ।
২৬ মে লখনউতে, উত্তরপ্রদেশের উন্নয়নের পরিকল্পনা উদ্ভাবনের জন্য মন্ত্রণাসভার আয়োজন করা হয়েছিল। যথারীতি বক্তব্য উপস্থাপনার প্রস্তুতির জন্য বেশ কিছু সময় নিয়েছিলাম। আমি যে-যে বিষয়গুলো তুলে ধরতে চেয়েছিলাম সেগুলো ওখানে উপস্থিত বিশেষজ্ঞ এবং নতুন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে দেখে খুশি হয়েছিলাম। আটত্রিশ বছর বয়সি অখিলেশ যাদব দেশের কনিষ্ঠতম মুখ্যমন্ত্রী।
উত্তরপ্রদেশ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদে সহজাতভাবে সমৃদ্ধ। দেশের ১০০ মিলিয়ন তরুণদের মধ্যে, প্রতি পঞ্চম ব্যক্তি উত্তরপ্রদেশের অধিবাসী। আমার বিশেষজ্ঞ বন্ধুরা আমায় বলেছেন ২০১৬ সালের মধ্যে সারা বিশ্ব জুড়ে যে ১০০টা দক্ষতাভিত্তিক কর্মসংস্থানের সৃজন ঘটবে, তার মধ্যে শুধু এই রাজ্য থেকেই সরাসরি আটটি গড়ে উঠবে।
উত্তরপ্রদেশের অর্থনৈতিক রূপরেখা বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ অনুসারে এখানকার জনসংখ্যার ৭৩ শতাংশ কৃষি এবং কৃষিজাত কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত এবং রাজ্যের উপার্জনের ৪৬ শতাংশ কৃষি থেকে অর্জিত হয়। একাদশতম পরিকল্পনা পর্বকালীন সময়ে রাজ্যে ৭.৩ শতাংশ মোট রাজ্য অন্তর্দেশীয় উৎপাদন বা জিএসডিপি (গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রডাক্ট) নথিবদ্ধ করেছে, যা তার ৬.১ শতাংশ লক্ষ্যকে অতিক্রম করেছে। রাজ্যে ২.৩ লক্ষেরও বেশি ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা রয়েছে। বর্তমানে ওখানে ২.৫ লক্ষেরও বেশি বেকার যুবক-যুবতী রয়েছে যার মধ্যে ০.৭ লক্ষ সংখ্যক হল ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে।
এ-সমস্ত কিছু মনে রেখে আমার প্রেজেন্টেশন মূল্যসংযোজিত কর্মসংস্থান উদ্ভাবনার মাধ্যমে মাথাপিছু উপার্জন বর্তমান ২৬,০৫১ টাকা থেকে ১০০,০০০ টাকারও বেশি বৃদ্ধি করার উপায়, ১০০ শতাংশ হারে সাক্ষরতা প্রসার, শিশু মৃত্যু হার বা আইএমআর (ইনফান্ট মর্টালিটি রেট) ১০-এর নীচে নামিয়ে আনা এবং কুষ্ঠরোগ, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু এবং যক্ষ্মার মতো ব্যাধি রাজ্য থেকে নির্মূলীকরণ করার কথা বিবেচনা করেছিল।
২০০ মিলিয়ন মানুষকে সক্ষম করার এই লক্ষ্যগুলো কীভাবে সম্পাদন করা সম্ভব আমি তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলাম।
আমি যে পরামর্শগুলি দিয়েছিলাম তার মধ্যে একটি ছিল উত্তরপ্রদেশের এক কর্মদক্ষতার মানচিত্র তৈরি করা। অর্থাৎ এমন মানচিত্র তৈরি করা যা রাজ্যের প্রতিটি জেলার শিল্প, সংগীত, হস্তশিল্প, কৃষিজাত দ্রব্য এবং বিশেষ ধরনের রন্ধনপ্রণালী প্রভৃতির দিকগুলো দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা চিহ্নিত করবে।
প্রেজেন্টেশনে আরও অনেক নির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা ছিল। আমার মনোবাসনা দ্রুত উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনক্ষম পরিকল্পনাসমগ্র রাষ্ট্রে প্রযুক্ত হোক যাতে প্রক্রিয়া পারস্পরিক এবং ফলভিত্তিক হয়।
আমেরিকা এবং ভারতের মধ্যে যে ১২৩ চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা ইন্দো-ইউ এস পারমাণবিক চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত তার সামরিক ও অসামরিক পারমাণবিক ব্যবস্থা পৃথক করতে রাজি হয় এবং তার যাবতীয় অসামরিক পারমাণবিক ব্যবস্থাগুলিকে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি বা IAEA (International Atomic Energy Agency)-র সুরক্ষা বন্দোবস্তের অধীনে নিয়ে আসে। এর পরিবর্তে আমেরিকা ভারতের সঙ্গে ‘সম্পূর্ণ’ অসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতার লক্ষ্যে কাজ করতে সম্মত হয়। দীর্ঘমেয়াদি আলাপ-আলোচনার পর IAEA-র সঙ্গে সুরক্ষা বন্দোবস্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে ঐক্যবদ্ধ প্রগতিশীল জোট বা ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স) সরকারকে ২০০৪ সালের ২২ জুলাই এক আস্থা ভোটের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
এই আস্থা ভোটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল বাম দলগুলি যারা ইউপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন জানাচ্ছিল। এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরতা বিষয়ে অংশীদার হতে তারা অসম্মত হয়। সমাজবাদী দলের সভাপতি মুলায়ম সিং যাদব এবং তাঁর পূর্বতন সহকারী অমর সিং পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে মানসিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন এবং সরকারকে সমর্থন বজায় রাখবেন কি না সে-বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। এই চুক্তি ভারতের পক্ষে অনুকূল হবে নাকি পশ্চিমের বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক মুনাফা বিবেচনা করে করা হচ্ছে, সে-বিষয়ে তাঁদের মনে অনিশ্চয়তা ছিল। এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মুলায়ম সিং যাদব এবং অমর সিং উভয়েই আমার সঙ্গে আমার ১০ রাজাজি মার্গ-এর বাড়িতে দেখা করতে এবং এই চুক্তি স্বাক্ষর করলে ভারতের পক্ষে ভাল ও খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। আমি তাঁদের বলেছিলাম, ভারতবর্ষকে থোরিয়ামভিত্তিক পারমাণবিক রি-অ্যাক্টরে স্বনির্ভর হতে হবে। এর অর্থ, আমাদের উন্নয়নমূলক কার্যের জন্য পরিচ্ছন্ন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন। এই চুক্তি ইউরেনিয়ামের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বর্তমান অভাব অনেকটা মিটিয়ে দিতে সাহায্য করবে।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছিল ২০১১ সালের মার্চে, জাপানের ফুকোসিমায় সুনামি তাণ্ডবের পরে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র, বিশেষত তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলামে নির্মীয়মাণ পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে ক্রমাগত বিক্ষোভ প্রদর্শন। বিক্ষোভকারীরা স্থানীয় গ্রামবাসী, তাঁরা চাইছিলেন কুড়ানকুলামের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া হোক এবং সেখানকার ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। এঁদের সমর্থন করছিল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলি বা এনজিও। অবস্থার গুরুত্ব বুঝে ভারতের পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের সুরক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে এবং এই নিয়ে অগ্রসর হওয়া কাঙ্ক্ষিত কি না সেই সম্পর্কে এক বিশদ বিস্তৃত পর্যালোচনা করেছিলাম। ইংরেজি ও আঞ্চলিক সংবাদপত্রে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে বিশ্লেষিত হয়েছিল ভারতের প্রয়োজনীয় উন্নয়নের জন্য কেন এই প্রযুক্তি এত জরুরি।
পাশাপাশি, আমি আমার টিম নিয়ে ২০০০ মেগাওয়াট থার্ড জেনারেশন প্লাস প্ল্যান্ট (third generation plus plant) পর্যবেক্ষণ করতে কুড়ানকুলাম গিয়েছিলাম। শক্তিকেন্দ্রের সুরক্ষা বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে এবং কীভাবে মানুষের আশঙ্কা সম্বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, বিশেষত আলোড়ন সৃষ্টিকারী ফুকোসিমা ঘটনার পর তা আমি উপলব্ধি করতে চেয়েছিলাম। আমি সারাদিন বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম এবং শক্তিকেন্দ্রের নানান ধরনের সুযোগসুবিধা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। সুরক্ষাব্যবস্থায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দেখে আমি উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের সুরক্ষা ব্যবস্থার চারটে মূল দিক আছে— গঠনগত অখণ্ড সুরক্ষাব্যবস্থা (Structural integrity safety), তাপীয় জলপ্রবাহ সুরক্ষা ব্যবস্থা (Thermal hydraulic safety), বিকিরণ সুরক্ষা ব্যবস্থা (Radiation safety), নিউট্রনিক সুরক্ষা ব্যবস্থা (Neutronic safety) এবং এই চারটে প্রয়োজনীয়তা পূরণ করেছিল।
পরে আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম শক্তিকেন্দ্রের আশপাশের গ্রামগুলোর জন্য একটা লাগোয়া বিশেষ PURA কমপ্লেক্স গড়ে ওঠা প্রয়োজন যা শিক্ষা, প্রশিক্ষণ সুযোগ এবং মূল্যসংযোজিত কর্মসংস্থানে স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তা করবে।
এই বন্দোবস্তগুলি প্রয়োগ করা হয়েছে দেখে আমি আনন্দিত। সরকার ঘোষণা করেছেন যে, শক্তিকেন্দ্রের দ্বারা অর্জিত লভ্যাংশের ২ শতাংশ সমাজকল্যাণ, গ্রামীণ উত্তরণ এবং কুড়ানকুলাম অঞ্চলের বাসিন্দাদের আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধির জন্য ব্যয় করা হবে। শক্তিকেন্দ্রের সম্পাদনকার্য শক্তিক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা লক্ষ্য অর্জনের অংশ হয়ে উঠবে।
.
গত পাঁচ বছর আমার অসংখ্য বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করার, দেশ-বিদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা এবং অধ্যয়নে নিত্যসঙ্গী হওয়া, সমাজের রূপান্তর সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাপকসংখ্যক ম্যানেজমেন্ট ছাত্রদের শিক্ষক হওয়া এবং তাৎপর্যপূর্ণ জাতীয় বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি নিবেদন করার সৌভাগ্য হয়েছে। সর্বোপরি, আটটি রাজ্যে আপৎকালীন জরুরি ব্যবস্থাপন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে জীবনরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় করানোর অনুঘটন সম্ভব করেছিলাম।
১৫. উপসংহার / পরবর্তীকালে
১৫. উপসংহার
হে সাংসদগণ! ভারতমাতার ভাস্কর,
আমাদের আলোকের দিকে নিয়ে চলো,
মাদের জীবনকে সম্পদশালী করো।
তোমাদের সৎ পরিশ্রম আমাদের আলোকদিশা,
যদি তুমি কঠিন পরিশ্রম করো, আমরা সবাই সমৃদ্ধ হতে পারি।
২০০৭ সালে যখন আমি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার থেকে অব্যাহতি পেলাম, সংসদের উদ্দেশে আমি একটি ভাষণ দিয়েছিলাম। আগের পৃষ্ঠাগুলিতে আমি যা বলেছি, আমি অনুভব করি আমার ভাষণ সে-বিষয়ে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক এবং মনে রাখার মতো আরও কিছু সূত্রও দেয়। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিকতার অভিজ্ঞতা বিশ্বস্ততার একটি অনবদ্য ক্রিয়া। যখন ১৯৫১ সালে সার্বভৌমিক ভোটাধিকার অধিগ্রহণ করা হয় তখন সারা বিশ্ব জুড়ে এমন একটিও নজির ছিল না যেখানে লক্ষ-কোটি অশিক্ষিত দরিদ্র মানুষ এক শান্ত এবং সমান গতিতে অগ্রসরমান সামাজিক আন্দোলন উদ্ভাবনার আশা নিয়ে রাতারাতি ভোটদানের অধিকারপ্রাপ্ত হয়েছেন। সমস্ত নাগরিককে আশ্বস্ত করা হয় তাঁদের যে অধিকারের অঙ্গীকার করা হয়েছে তা সমস্তই সংবিধানস্বীকৃত। এক মহত্তর জাতীয় ঐক্যের পরিবেশ আনা এবং শতাব্দীর পর শতাব্দীর বৈদেশিক শাসনে অধীনে থাকবার ইতিহাসের যে-কোনও সময় অপেক্ষা অনেক বেশি জাতীয় সুরক্ষা, সুস্থিত ও সমৃদ্ধির প্রশ্নে আশ্বাস প্রদান করে।
রাষ্ট্র হিসেবে বিশেষত সাম্প্রতিককালে, ঐতিহাসিক অতীতের তুলনায় অর্থনৈতিক কার্যকলাপে আমরা তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য লাভ করেছি। যদিও আমাদের সাফল্যের সিংহভাগ প্রকৃতিনির্ভর কারণ মানবোন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের ক্রিয়াকর্ম যতটুকু সম্ভব হয়েছে তাতে আরও দীর্ঘ পথ চলতে হবে। আমাদের দেশের মানুষের জন্য সংগ্রামে ব্রতপালনের উদ্দীপনার জাতীয় মানসিকতা পুনরুদ্ধারের জন্য একটা নতুন দর্শন এবং সত্যদ্রষ্টা নেতৃবৃন্দের প্রয়োজন কারণ এভাবেই আমরা বিশ্বের জন্যও যুদ্ধ করে যাচ্ছি।
সংসদ নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের প্রধান প্রতিষ্ঠান, প্রতিনিধিসুলভ গণতন্ত্রের প্রতিরূপ। শাসনকার্যের পদ্ধতি হিসেবে সংসদীয় গণতন্ত্র ও এক জাতীয় রাজনীতিক ব্যবস্থা, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলিকে বজায় রেখে এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সুযোগ বর্ধন করে ভারতীয় সমাজের ঐতিহাসিক ক্ষমতা-কাঠামোকে শিথিল করে মহৎ উদ্দেশ্য প্রদর্শন করেছে। একুশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সংসদ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে কঠিনতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তা ১৯৫১ সালের প্রতিষ্ঠাকালের পরে কখনও হয়েছে কি না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বিশেষত যেখানে বিষয়গুলি মানব উন্নয়ন এবং শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত।
কিন্তু আমাদের স্পষ্টভাবে দেখতে হবে যে, ‘সংসদ নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান’ এই মনোভাবের পরিবর্তে শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানগত যন্ত্র হিসেবে সংসদের কার্যকারিতা এবং আইন উদ্ভাবন ও বিবেচনার ক্ষমতা এবং রাষ্ট্র ও সরকারকে দূরদর্শী নেতৃত্ব প্রদান করার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের সক্রিয়তা, সক্ষমতা ও হিসেবনিকেশের ওপর নির্ভরশীলতা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাষ্ট্র যে-যে চ্যালেঞ্জ, তার মধ্যে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদও যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে আপনার সঙ্গে তা ভাগ করে নেওয়া কেন এত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি এটাই তার মূল কারণ। ভারতবর্ষকে ২০২০ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এগোনোর নানা পথের পরামর্শ দিই।
সাধারণভাবে অনুভব এবং মূল্যায়ন করা হয় যে, ভারতের শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃস্থ পরিবেশ দ্রুত এবং আপাত অপরিবর্তনীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, বিশেষত গত দুই দশকে। জাতীয় সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যা পরিবেশগত পরিবর্তনের দ্বারা উপস্থাপিত হয় তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং দ্রুত মোকাবিলা করা প্রয়োজন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয়তন ও জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সামাজিক সংগঠনগুলোর অবনমন ঘটে এবং সংকটপ্রবণ হয়ে ওঠে। সামাজিক সত্তা হিসেবে, ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থা মনে হয় সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে এবং এই সময়েই আত্ম-নবীকরণ এবং পরিবর্তনের তূর্যনিনাদ বেজে উঠেছে।
ভারতবর্ষের সৌভাগ্য যে, সে সরকারে এবং সংসদে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন, যোগ্যতাসম্পন্ন ও দূরদর্শী নেতাসমূহকে পেয়েছে। এই দেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানাবিধ সাফল্যের জন্য যথেষ্ট গর্বিত হতে পারে। অনেকে অনুমান করেন ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষ বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে। কিন্তু গণতন্ত্র বা অর্থনৈতিক পুনরুত্থান কোনওটাই স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া উচিত নয়। অবিচল সতর্কতা হল স্বাধীনতার মূল্য। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং ব্যাবহারিক উপযোগিতা উপরিতলে যতই সন্তোষজনক মনে হোক-না কেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা এক জায়গায় স্থাণু হয়ে থাকতে পারে না এবং হওয়া উচিতও নয়। আমরা অতীতের সাফল্যে আত্মসন্তুষ্ট হয়ে থেমে থাকতে পারি না এবং যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে চালনা করি সেই পথের পরিবর্তনের জন্য যে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তাকে উপেক্ষা করতে পারি না। স্বাধীনতা লাভের পরে যে আর্থিক উন্নতি এবং ইতিবাচক বিকাশের ধারা বয়ে চলেছে তা প্রধানত সরকারি এবং জাতীয় সংস্থাগুলির বাইরে সংঘটিত হচ্ছে এবং আমাদের সামনে মহত্তম চ্যালেঞ্জ হল ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনঃসঞ্জীবিত করা ও পুনর্জীবিত করা।
সরকারি এবং সরকার অধীনস্থ ক্ষেত্রে শুধু উৎপাদন, লাভ এবং জনসঞ্চয়ের পরিপ্রেক্ষিতে নয়— শিল্প, স্বাস্থ্য, জল এবং পরিবহণের মতো অপরিহার্য জনসেবা ক্ষেত্রের সংস্থানের ভিত্তিতে আমরা চাই উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন। বহু প্রখ্যাত পণ্ডিত সংসদের ক্রিয়াকলাপ পর্যালোচনা করেন এবং ভারতীয় সংসদ যে ব্যাপক বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তা চিহ্নিত করেন। আমি মনোনিবেশ সহকারে তা পর্যালোচনা করে তাঁদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ এবং উদ্বেগ সম্বন্ধে কিছু বলব।
রাষ্ট্রে এক সর্বব্যাপী অনুভব বর্তমান যে জবাবদিহির দায়বদ্ধতা এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদের কার্যকারিতায় উন্নয়নের উপযুক্ত সময় এসে গেছে। সংসদ সরকারি কার্যক্রমের জবাবদিহির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে অনেকরকম হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে। যেমন সংসদ কক্ষে প্রস্তাব আনা, তত্ত্বাবধান ক্ষমতা এবং কমিটি গঠন প্রক্রিয়া। কিন্তু এই হাতিয়ারেরও বর্ধিত হারে পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন। ভারতীয় অর্থনীতির বিশ্বায়নের ফলে আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে একথা সত্য। রাষ্ট্র সমৃদ্ধতর, কিন্তু সংসদের ক্ষমতাকে দু’ভাবে বাড়ানোর জন্য ব্যাপক সতর্কতা প্রয়োজন। বেশিরভাগ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণ আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘বিশ্বের সামান্য কিছুসংখ্যক সংসদের মধ্যে ভারতীয় সংসদ হল অন্যতম যার কোনও কার্যকরী চুক্তির তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা নেই।’ সংসদে আসার আগেই চুক্তিগুলি সাধারণভাবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। তাই বিদেশি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে এই চুক্তি এবং সমঝোতাপত্র দেখাশোনা ও আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষমতা সংসদের পক্ষে খুব জরুরি।
অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো ভারতীয় রাষ্ট্রেও নিয়ন্ত্রক কাঠামো পুনর্গঠন করা হচ্ছে অনির্বাচিত সংগঠনগুলিতে আরও ক্ষমতা অভিযোজন করে। এই ক্ষমতা অভিযোজন কার্যকরীভাবে বহু বছর ধরে কার্যে পরিণত হয়ে স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করেছে, বিশেষত উদারীকরণের পর। অতএব সংসদীয় দায়বদ্ধতার সঙ্গে গতিময়তা বজায় রাখতে গেলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সংসদীয় তত্ত্বাবধান শক্তিশালী করতে হবে। সাংসদদের আরও কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধি করতে হবে ক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার জন্য আইন প্রণয়ন এবং দুর্বল আর্থিক তত্ত্বাবধানের ফলে বিকল্প অধ্যাদেশের সংখ্যা হ্রাস করে।
দৈনন্দিন আর্থিক বিষয়ে কার্যনির্বাহীতে সংসদীয় তত্ত্বাবধান এমন এক ক্ষেত্র যেখানে অধিকতর গুরুত্ব এবং চূড়ান্ত ফোকাসের দরুন সংসদীয় কার্যকলাপের মূল্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করবে এবং প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করবে বিশেষত বর্ধনশীল সংখ্যক তরুণ এবং প্রথমবারের নতুন সদস্যদের কাছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণপ্রাচুর্যের ফলে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেয়েছে— প্রথম লোকসভার পাঁচটি রাজনৈতিক দল থেকে ১৪তম লোকসভার প্রায় ৫০টি দলে পৌঁছনোর মাধ্যমে। সংসদে রাজনৈতিক দলগুলির সংখ্যাধিক্যর সুবিধা গ্রহণ করা উচিত; এবং সংসদে রাজনৈতিক দলগুলির ক্রিয়াকলাপ এমনভাবে সহজসাধ্য করা উচিত যার ফলে সংসদ এবং দল উভয়েরই শক্তিবৃদ্ধি করে এবং মিলিতভাবে কাজ করার প্রতিবন্ধকতা দূর হয়। একদিকে সাংসদদের ওপর জটিল চাহিদার দায়িত্ব অন্যদিকে সেই আইন অবধাবনে তাঁদের ধারণক্ষমতা ও প্রবণতার মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান পার্থক্য এই মানদণ্ডগুলি দ্বারা শীঘ্র হ্রাসপ্রাপ্ত হবে।
সংসদে ভাল কাজের জন্য সাংসদদের স্বতন্ত্রভাবে সচেতনভাবে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত এবং তাঁদের নিজের নির্বাচনক্ষেত্রে, রাজনৈতিক দল এবং জোটের পক্ষ থেকে রাজনৈতিকভাবে পুরস্কৃত করা প্রয়োজন। এর দ্বারা ভাল সংসদীয় কার্যকলাপের উদ্দীপনা বৃদ্ধি পাবে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যেরকম হয়েছিল সেইরকম সংসদকে আবার আর-একবার কার্যকরী কণ্ঠস্বর হতে হবে সরকারি রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনে, অর্থনীতিতে, সামাজিক নীতিতে এবং ভারতবর্ষের বিশ্ব অর্থনীতি একীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে। সংসদের কণ্ঠস্বর জোরালো করার বন্দোবস্তের পথে কোনও অনিয়ন্ত্রণযোগ্য, বহিরাগত উপকরণ বাধা সৃষ্টি করছে না। ইতিবাচক উৎসাহপ্রদান, দূরদর্শী নেতৃত্ব অবশ্যই সাংসদদের দায়বদ্ধতা ও দক্ষ শাসনব্যবস্থার জন্য নতুন এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণে উৎসাহিত করবে।
কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কয়েক বছর ধরে সংসদের কার্যকলাপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তার মধ্যে কিছু কিছু প্রয়োগের জন্য গভীরভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
১. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে
ক. যেমনভাবে বিশেষ কোনও দলের এক বা একাধিক সদস্যর দলত্যাগ রোধ করতে যে বিধিনিয়ম বর্তমান আছে, তেমনিভাবে কোনও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলের জোট সরকারকে অস্থায়ীকরণের ভীতি প্রদর্শনের প্রতিবাদে বন্দোবস্ত অধিগ্রহণ করা দরকার। একটি ক্ষুদ্র দল (মনে করা যাক, লোকসভায় ১০ বা ১৫ শতাংশের কম আসনসংখ্যা-সহ) প্রথমে জোট সরকারে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নেবে, এবং পরে বেরিয়ে যাওয়া মনস্থ করলে, অযোগ্য বিবেচিত হবে।
খ. সমস্ত দলগুলি যখন জোটবদ্ধ তখন সংসদীয় কার্যপ্রণালী পরিচালনার ক্ষেত্রে একক সংসদীয় দল হিসেবে কর্মপ্রক্রিয়া চালানো উচিত।
গ. মন্ত্রকসমূহ বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে নেবে এবং মন্ত্রীগণ অবশ্যই সংসদে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার দিকে লক্ষ রেখে প্রকৃত কার্য নিষ্পন্ন করতে দায়বদ্ধ থাকবেন।
ঘ. সংবিধানের সংশোধনী সম্পাদন করে যাতে সংসদের সংখ্যাগুরু সরকার ইচ্ছা হলে ক্যাবিনেটের ২৫ শতাংশ সদস্য সংসদের বাইরে থেকে নিযুক্ত করতে সক্ষম হবে।
ঙ. নির্বাচনের বেসরকারি তহবিল প্রচলন করা উচিত।
চ. আইন প্রণয়ন করা উচিত যে, তালিকাবদ্ধ কার্যপ্রণালী যদি সমাপন না হয় তবে কোনও কক্ষই সপ্তাহে দু’দিনের বেশি মুলতুবি রাখা যাবে না।
ছ. কোনও বিল অনুমোদন বা আইনগত কার্যপ্রণালীতে ‘ধ্বনি ভোট’-কে পদ্ধতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়। ভোটগণনা আবশ্যিক করা উচিত।
জ. স্পিকার/চেয়ারম্যানের উচিত যে-সমস্ত সদস্যরা প্রায়শই কক্ষে কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটান তাঁদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত বা বহিষ্কার করা।
২. শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে
ক. কেন্দ্রীকরণ: অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষমতা রাজ্য থেকে কেন্দ্রে স্থানান্তর করা।
খ. বিকেন্দ্রীকরণ: আর্থিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব কেন্দ্র থেকে রাজ্যে স্থানান্তরণ।
গ. একটি কেন্দ্রীয় কমিশন গঠিত করা যা কেন্দ্রীয় সহায়তা প্রাপ্ত সমস্ত অনুমোদিত দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রম রাজ্য সরকারকে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এবং এই হস্তান্তর প্রকৃত বাস্তব কার্যনির্বাহের ভিত্তিতে গঠিত হবে।
ঘ. স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, সরকারি ক্ষেত্রের জন উদ্যোগ, ব্যাঙ্কসমূহ, আর্থিক, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে সবরকম নিয়োগের জন্য UPSC-র মতো স্বশাসিত নিয়ামক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রয়োজন।
ঙ. বেসরকারি ক্ষেত্র পুনরুত্থানশীল হয়ে ওঠার দরুন সামগ্রিক বিকাশের হার ত্বরান্বিত হয়েছে বলে সরকারের অভ্যন্তরীণ সংস্কার জরুরিভিত্তিতে করা দরকার।
চ. সরকারি পরিষেবার সুদক্ষতা প্রয়োগের জন্য একজন মন্ত্রীকে দায়িত্বশীল করার ক্ষেত্রে নতুন প্রতিষ্ঠানগত পদক্ষেপ করা জরুরি।
ছ. প্রস্তাবিত বার্ষিক প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বাস্তবায়িত কর্মসম্পাদনের রিপোর্টের জন্য সংসদের কাছে পরিকল্পনা কমিশনকে দায়বদ্ধ রাখা উচিত।
জ. অন্ততপক্ষে মন্ত্রীত্ব পর্যায়ে দুর্নীতি বিষয়ে সহনশীলতায় একটা ইতি টানা উচিত।
ঝ. সবশেষে বিচার সংক্রান্ত ক্ষেত্রে আইনব্যবস্থার কোনও সংস্কার দীর্ঘকাল ধরে মুলতুবি থাকতে পারে না।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে কর্মসম্পাদনে বহুদলীয় জোটের বিধিসম্মত সরকার গঠনের উত্থানের এক তাৎপর্যময় ইঙ্গিত আছে। সংসদীয় কার্যপ্রণালীর ভূমিকা এবং কার্যকারিতা এতে আনুপাতিক হারে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। সংসদের মহিমাময় ভূমিকা বর্ধন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যাতে সংসদের তত্ত্বাবধানে বৃহত্তর দায়িত্বভার গ্রহণের মাধ্যমে এর কার্যনির্বাহকরা তার বিষয়গুলি পরিচালনায় আরও মূল্য যোগ করতে পারে। অতএব, আমাদের সংবিধানের চরম প্রত্যাশাপূরণের জন্য সংসদীয় ব্যবস্থাকে আরও স্থিতিশীল ও বাস্তবোপযোগী করার জন্য এই ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। সর্বোপরি, এই ধরনের উদ্বেগ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস এবং দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতার সঙ্গে মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার শক্তি বর্ধনের জরুরি আবশ্যকীয়তাকে গুরুত্বহীন করে দিচ্ছে।
উচ্চহারে বিকাশ পর্যায়ে অর্থনৈতিক অসাম্য আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে। শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীগণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে ফলে তাঁদের দায়বদ্ধতাও বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়া অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বাণিজ্য সংক্রান্ত এবং অন্যান্য বিধিবদ্ধ নিয়ম সংক্রান্ত ক্ষমতার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের বিস্তৃত সতর্কতায় যাতে সরকারি তহবিলের অপব্যবহার এবং গতিমুখ পরিবর্তন না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। শাসনব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস করতে হবে যাতে রাজনৈতিক পদগুলির উচ্চপর্যায়ে চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা না থাকে যার ফলে এই পদগুলির দুষ্প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
আর্থসামাজিক লক্ষ্যসমূহের পরিকল্পনা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাংসদদের আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণে উৎসাহদানের ফলে আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র থেকে সংসদীয় নেতাদের আগমন ঘটবে এবং ক্ষমতা ব্যবহার এবং লাভের ‘একচেটিয়া’ উপভোক্তাদের প্রভাব হ্রাস পাবে। এর ফলে ইতিবাচক নেতৃত্বদানের পরিস্থিতি তৈরি হবে, যা দণ্ডনীয় অপরাধ এবং অন্যান্য আইন লঙ্ঘনের মতো অপরাধে অপরাধী ব্যক্তির রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ কমিয়ে দেবে। সাংসদদের আরও কার্যকরীভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়সাধন করায় আর্থসামাজিক বিকাশ নিশ্চিত হবে। এবং এও সুনিশ্চিত হবে বহুবিধ এজেন্সি এবং সরকারি বিভাগগুলো যাতে কার্যক্ষেত্রে একে অপরের বিরুদ্ধে কাজ না করে। প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতিগত পার্থক্য সঠিক সময় এবং সঠিক পর্যায়ে বসে মীমাংসা করতে হবে এবং প্রস্তাবের জন্য উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এর ফলে ক্যাবিনেট কমিটি এবং গ্রুপ অফ মিনিস্টারস যথার্থ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির প্রতি মনোযোগ নিয়োগ করতে পারবে যেখানে ক্ষমতাপ্রাপ্ত সাংসদদের পক্ষেও বিষয়গুলোর সমাধান সম্ভব হয় না। ঘন ঘন রাষ্ট্র-রাজ্য এবং প্রতিষ্ঠানব্যাপী নির্বাচন এবং কোনও দলের স্বল্পমেয়াদি অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সাংসদদের বর্ধিত ভূমিকা সামগ্রিক শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কার্যকরী কর্মসম্পাদনে নিশ্চয়তা দেবে এবং আশ্বস্ত করবে যে, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা বারংবার সংকটের সম্মুখীন হওয়ার প্রয়োজন নেই।
সংসদকে এখন এক নতুন লক্ষ্যে এবং নেতৃত্বে বিকশিত হতে হবে যা শুধু আমাদের রাষ্ট্রকে জ্ঞানসমৃদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ, সংগতিপূর্ণ, সচ্ছল এবং সমৃদ্ধই করবে না, সর্বোপরি সীমান্তবর্তী এলাকায় অনুপ্রবেশ ও আক্রমণে চির-অভেদ্য একটি সুরক্ষিত রাষ্ট্র করবে। আমি মনশ্চক্ষে ২০২০ সালের ভারতবর্ষের জন্য এই বিশেষ রেখাচিত্র দেখি— এক দৃঢ়, সমৃদ্ধ এবং সুখী রাষ্ট্র, যদি সংসদ আজ মিশন ইন্ডিয়া ২০২০ প্রয়োগ করার সংকল্প গ্রহণ করে।
উন্নত ভারত ২০২০ লক্ষ্য উপলব্ধির চ্যালেঞ্জ, শাসনব্যবস্থা এবং আইনগত কর্মপ্রক্রিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে উদ্ভাবনার সুযোগ তৈরি করে। যখন আমরা একুশ শতকে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং আইনগত প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করি তখন প্রযুক্তিগত আন্দোলন, জাতীয় এবং বিশ্বব্যাপী সংযোগস্থাপন, বিশ্বায়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার সম্পূর্ণ সুযোগ এবং তাৎপর্য গণ্য করতে হবে।
সাংসদগণ রাষ্ট্রের জন্য এক স্বপ্ন নিয়ে ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংবদ্ধ নেতৃত্ব-সহ এই পরামর্শ নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন এবং বিকশিত হতে পারেন ঠিক যেমনভাবে আমাদের সংবিধান প্রথম রচিত হওয়ার সময় হয়েছে। ভারতবর্ষের জন্য এই একুশ শতকের সংসদীয় স্বপ্নর ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিত থাকা প্রয়োজন। জাতীয় সমৃদ্ধি সূচককে মাপকাঠি ধরে এবং ২০৩০-এর আগে শক্তি স্বনির্ভরতা অর্জন-সহ ভারতবর্ষকে ২০২০-র মধ্যে একটা উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তর করার জন্য প্রায়োগিক কৌশল, অখণ্ড কাঠামো এবং কর্মপরিকল্পনা জোরালো করা প্রয়োজন।
এটাই সেই অনন্য সংসদীয় লক্ষ্য এবং এর কার্যকরী প্রয়োগ আমাদের কোটি কোটি দেশবাসীর মুখে হাসি আনবে। জাতীয় লক্ষ্যের জন্য আমাদের সাংসদদের এই মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংবদ্ধভাবে কাজ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যিকতা।
দুর্নীতি, শাসনপদ্ধতি এবং অন্যান্য বিষয়ে জাতীয় জাগরণ সংসদকে তৎপরতা এবং অন্তর্দৃষ্টি-সহ সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
.
পরবর্তীকালে
যতদিন না আমি আচার্য মহাপ্রজ্ঞার দর্শন পেয়েছি আমার মনে সবসময় এক অনুভূতি হত যে, পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে আমি যা করেছি তা বিশ্বাস, দর্শন এবং মহান মানবকীর্তির পরিপন্থী। আচার্য মহাপ্রজ্ঞা ছিলেন জ্ঞানের উৎস, তাঁর সংস্পর্শে আসা প্রতিটি আত্মা তাঁর দ্বারা শুদ্ধ হবে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাস, প্রায় মধ্যরাত্রি, আচার্য তাঁর আশ্রমবাসী ভিক্ষুদের নিয়ে দেশ এবং দেশবাসীর কল্যাণের জন্য তিনবার প্রার্থনা করেছিলেন। প্রার্থনা শেষে তিনি আমার দিকে ফিরে যে কথাগুলি বলেছিলেন তা আজও আমার মনে প্রতিধ্বনিত হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘কালাম, তুমি তোমার টিমের সঙ্গে মিলে যা কাজ করেছ তার জন্য ঈশ্বর তোমায় আশীর্বাদ করবেন। কিন্তু পরমেশ্বর তোমার জন্য আরও বড় কোনও লক্ষ্য স্থির করে রেখেছেন এবং সে কারণেই তুমি আজ আমার সঙ্গে রয়েছ। আমি জানি আমাদের দেশ আজ একটি পারমাণবিক রাষ্ট্র। কিন্তু তুমি এবং তোমার সহকারীরা মিলে যে কাজ করেছ তোমার লক্ষ্য তার চেয়েও মহত্তর, যে কোনও মানবকীর্তির চাইতেও মহত্তর। পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্বে অতি দ্রুত হারে বর্ধিত হচ্ছে। আমি আমার সমস্ত ঐশ্বরিক আশীর্বাদ-সহ তোমায় আদেশ করছি— তুমি এবং শুধুমাত্র তুমি এমন একটি শান্তিপূর্ণ পদ্ধতির বিকাশ করো যাতে প্রত্যেকটি পারমাণবিক অস্ত্র নিষ্ক্রিয়, তাৎপর্যহীন এবং রাজনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।’
যখন আচার্যজি তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন তখন সভাকক্ষে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। আমার মনে হয়েছিল সমগ্র প্রকৃতি যেন ওই পুণ্যশ্লোক মহাত্মার কথার সুরে সুর মেলাচ্ছে। জীবনে প্রথমবার আমি যেন কেঁপে উঠেছিলাম। তখন থেকে আচার্যর বার্তা আমার জীবনের পথপ্রদর্শনকারী আলোকশিখা আর তাকে বাস্তবায়িত করা আমার জীবনের একটা চ্যালেঞ্জ, যা আমার জীবনকে নতুন অর্থ দিয়েছে।
প্রথম অধ্যায়ে একটি ছোট মেয়ের চিঠির কথা উল্লেখ করেছিলাম। ওই চিঠি পড়ে আমরা যে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম তাতে বেশ বিস্ময়কর ও আনন্দজনক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। এক ব্যাঙ্ককর্মীকে আমরা তাকে সহায়তার জন্য নিযুক্ত করেছিলাম। তিনি ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে মিলে সমস্ত অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব হয়েছিল। মেয়েটি এখন সুখী বিবাহিত জীবনযাপন করছে। আমরা আনন্দিত যে আমাদের ব্যবস্থাগ্রহণ তাকে তার স্বপ্নপূরণে সহায়তা করেছে।
.
পরিশিষ্ট-১ : সাক্ষাৎকার
২০০৬ সালে বেশ কিছু রাজ্য পরিদর্শনের পর আমি যখন মিজোরামে তখন এনই টিভি চ্যানেলের মনোরঞ্জন সিং আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ওই সাক্ষাৎকার আমি পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই কেননা সেটা বেশ কিছু বিষয়, উদ্বেগ এবং কার্যকলাপের ওপর আলোকপাত করেছিল।
১. আপনার প্রদত্ত রাজ্যগুলির বিস্তারিত উন্নয়নমূলক মিশন অনুযায়ী রাজ্য সরকার কর্ম সম্পাদন করছে কি না আপনি কি তারও তদারকি করেন? এখানে কি কার্যকরী তদারকির সুসংগঠিত কর্মপ্রক্রিয়া আছে?
পরিকল্পনা কমিশন, রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রক থেকে পরিযোজন ও স্বাধীন মূল্যায়ন দ্বারা রাজ্য পরিদর্শনের মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম সেগুলো ব্যবহার করে আমি পথনির্দেশিকা দিয়েছি। এই প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে আমার টিম বিনিদ্র রাত্রিযাপন করেছে। আমি জোর দিয়েছিলাম যে রাজ্যের উন্নয়ন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজ্য রাজনৈতিক দল থেকে অনেক বড়। অংশগ্রহণকারী সদস্যদের এই মিশনের ওপর আলোচনা করতেও আমি অনুমতি দিয়েছিলাম। আমার প্রেজেন্টেশন পেশ করার পর বেশ কিছু রাজ্য বিধানসভা প্রস্তাবিত মিশনের রূপায়ণ পরিকল্পনা আলোচনার জন্য পুরোদস্তুর অধিবেশন পরিচালনা করেছিল। এ ছাড়াও পরে যখনই সেই রাজ্যে গেছি ও বিশ্ববিদ্যালয়, বণিকসভা ও অন্যান্য বাণিজ্য ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে অভিভাষণ দিয়েছি, আমি সবসময় মিশনের উল্লেখ করেছি ও প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে রাজ্য মিশনের যোগসূত্র তৈরি করেছি। উদাহরণস্বরূপ কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, বিহার সমস্ত মিশন পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কেরলে প্রচারমাধ্যমও প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়ে সরকার, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য অংশীদারের সঙ্গে আলোচনা সহজসাধ্য করেছে। তারা মিশনের রূপায়ণের জন্য একটা কর্মপরিকল্পনা দিয়েছে। এভাবে প্রচারমাধ্যম রাজ্য সরকারের অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আমি সিকিম, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং মেঘালয়কে মিশনগুলি প্রদান করেছিলাম। এই রাজ্যগুলিকে বিশেষভাবে জলবিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনে এবং জলাশয়গুলির সংযুক্তিকরণে মনোযোগ দিতে হবে এবং বাঁশগাছে ফুল ধরার সময় কৃষি উৎপাদনে ক্ষয়ক্ষতি রোধ করায় সক্রিয় হতে হবে।
২. পরিকল্পিত উন্নয়নে আপনার পথনির্দেশিকা কি অতিরিক্ত হিসেবে বার্ষিক এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় স্থান পেয়েছে? এই দুয়ের মধ্যে কি কোনও বিরোধ আছে?
যখন পথনির্দেশিকা তৈরি করছিলাম তখন সমস্ত মন্ত্রক, রাজ্য সরকার এবং পরিকল্পনা কমিশন থেকেও আমরা বিস্তারিত বিবরণ জানতে চেয়েছিলাম। পরিকল্পনা কমিশন এক আট সূত্রের মানদণ্ডের (an eight point criteria) উন্নয়নমূলক র্যাডার প্রস্তুত করেছিল যা আমরা গ্রহণ করেছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল উন্নয়ন র্যাডারের সমস্ত মাপকাঠির উৎকর্ষ ঘটানো এবং সমস্ত উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করা যা অভীষ্টের ত্বরান্বিত উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়। আমরা যে মিশনগুলির প্রস্তাবনা করেছিলাম তা রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কর্মদক্ষতাভিত্তিক এবং রাজ্য পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা কমিশনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সম্পূরক। ২০১৫-এর আগে উন্নত এক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আমরা এক দীর্ঘমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিত দিয়েছিলাম, কারণ উন্নত রাজ্যগুলিই ভারতবর্ষকে ২০২০-র আগেই উন্নত বানাবে।
৩. আপনার বুদ্ধিমত্তার প্রশস্ততা ও সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত প্রয়োগের হাতেকলমের অভিজ্ঞতা পথনির্দেশিকার আকার দান করতে এক গুরুতর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। আপনার এই বৈশিষ্ট্য কি মহান দপ্তরে আপনার উত্তরসূরিদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতিফলিত হয় না?
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, যে-কোনও সুব্যবস্থা কোনও নির্ভরতা নির্বিশেষে টিকে থাকে। গত চার বছরে আমি দেখেছি দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক সর্বব্যাপী জাগরণ ঘটেছে। কিছু সু-সাফল্য লাভ করেছে। আমি মনে করি সেইজন্যই বেশ কিছু রাজ্য বিধানসভা আমার উন্নয়ন মিশনগুলি আলোচনা করার সুযোগ দিয়েছে। যখন আমি একটা বা দুটো বিধানসভায় কাজ শুরু করেছিলাম, অন্যান্য রাজ্য বিধানসভাগুলিও তখন আমায় আমন্ত্রণ করে, আমি সেখানে যাই এবং অভিভাষণ দিই। ফলে আমি দেখি যে ভারতীয় জনগণ এবং ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা, জাতীয় বিকাশের জন্য মিশন-কেন্দ্রিক উন্নয়নের কার্যক্রমের ধারণায় বিশ্বাসী হতে শুরু করেছে। এরজন্য প্রয়োজন পথনির্দেশিকা এবং একটি কার্যনির্বাহী পরিকল্পনা, যা হয়তো মধ্যপথে পর্যালোচনা দ্বারা সুসমন্বিত হবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রপতির দপ্তরে এক পেশাদার কর্মীবৃন্দ থাকা উচিত যাঁরা বিধানসভায় নানা ধরনের নথিপত্র প্রস্তুত করবেন। আপনি ঠিকই বলেছেন রাষ্ট্রপতির দপ্তরের অবশ্যই এ এক নতুন পদক্ষেপ এবং সেটা খুবই উদ্দেশ্যমূলক জাতীয় মিশন এবং সেসঙ্গে রাষ্ট্রপতিকে দেশের নাগরিকের চাহিদার সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ রাখার জন্যও এক সুযোগ দেয়।
৪. যদিও সংবিধানে রাষ্ট্রপতি এবং সরকারের দায়িত্বসমূহ সংজ্ঞায়িত করা আছে, বিগত চার বছরে আপনি কি রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে অনেক সমাপতিত ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছেন, সম্পর্কে কি দ্বন্দ্ব এবং অস্পষ্টতার জায়গা আছে?
এই ব্যবস্থা অত্যন্ত সুন্দর ও স্থিতিস্থাপক যা একসঙ্গে কাজ করার পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়। দেশ যে-কোনও একজন ব্যক্তির চাইতে গুরুত্বপূর্ণ, এই দর্শন মনে রেখে যদি কোনও কাজ করা হয় তা হলে কোনও সম্পর্কসম্বন্ধীয় সমস্যা থাকে না। রাজ্যপালদের সঙ্গে দুটো অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর একত্রিত হয়ে কাজ করার ধরন প্রকাশিত হয়েছে।
৫. লাভজনক পদ আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে যে মতপার্থক্য ছিল তা জনগণের সামনে প্রকাশিত হয়েছিল। আপনার অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও বিলটি ফেরত এল এবং আপনার উত্তমতর বিবেচনাকে বিচার না করে আপনাকে যে বাধ্য করা হল স্বাক্ষর করতে, সে-বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
লাভজনক পদ বিলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি যথেষ্ট স্বচ্ছ। আমরা আক্ষরিক এবং বিষয়াগতভাবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা দৃঢ়ভাবে সাংবিধানিক নির্দেশের অনুবর্তী। আপনি লক্ষ করবেন যৌথ সংসদীয় কমিটি বা জেপিসি (Joint Parliamentary Committee) গঠন করার ক্ষেত্রে সংসদের উভয় কক্ষের এবং জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলির সাধারণ মনোভাব আমাদের অবস্থানের যাথার্থ্য প্রতিপাদন করেছিল। সাংসদদের লাভজনক পদ বিলের সংজ্ঞাদান করার জন্য নির্দেশিকা তৈরির কারণে জেপিসি-র গঠনের পর আমি বিলে স্বাক্ষর করেছিলাম।
৬. আপনার প্রিয় বিষয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সুযোগের প্রতি তরুণ হৃদয়ে জাগরণে আপনার লক্ষণীয় উদ্যোগ আছে, আপনার মতানুসারে আর কী কী নতুন পদক্ষেপ সরকারের নেওয়া উচিত?
ক. ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীল করে তোলার পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার এক পুনর্গঠন প্রয়োজন। অবশ্যই সংসদে শিক্ষার অধিকার বিল অনুমোদন পেয়েছে রাজ্য বিধানমণ্ডলগুলিতে আলোচনার মাধ্যমে। পরিশেষে, শিক্ষার অধিকার আইন দেশের সমস্ত ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের আবশ্যিক এবং বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ করে দেবে।
খ. প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রভূত সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ দল প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় এক সৃজনশীল পাঠ্যক্রম, সৃজনশীল ক্লাসরুমের উদ্ভাবনা করবেন এবং সর্বোপরি প্রশিক্ষিত সৃজনশীল শিক্ষক নিয়োগ করবেন।
গ. বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ইন্ডিয়া ২০২০ মিশন উপলব্ধির উদ্দেশ্য অভিমুখী হওয়া উচিত।
ঘ. বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম তরুণদের মধ্যে গবেষণা এবং অনুসন্ধান, সৃজনশীলতা এবং নৈতিক নেতৃত্বের সক্ষমতা অবশ্যই গড়ে তুলবে যাতে তাঁদের ইন্ডিয়া ২০২০ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অবদান থাকে।
ঙ. প্রতিবছর এক হাজারজন তরুণ ছাত্রছাত্রী যাতে বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে জীবিকার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে সেই উপায় উদ্ভাবন করার বিশেষ পথ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। পরে এই বিজ্ঞান গোষ্ঠীর কর্মনিয়োগের সুবিধা প্রয়োজন।
৭. বলা যায়, যেখানে চিকিৎসা, প্রযুক্তিবিদ্যা এবং ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণ কলেজগুলো আবেদনকারীর দ্বারা পূর্ণ যেখানে মৌলিক বিজ্ঞান পাঠ্যক্রমগুলো কোনও ছাত্র পায় না। সেক্ষেত্রে কী বিশেষ কর্মপন্থা বা কৌশল থাকা প্রয়োজন যা ছাত্রদের মৌলিক বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে এবং গবেষণা করতে উৎসাহিত করবে?
আপনি হয়তো জানেন, বিজ্ঞান-গবেষণা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (Institute of Science, Research and Education) সরকার দুটো রাজ্যে প্রচলন করেছেন। আমাদের একটা বিশ্বব্যাপী মানবসম্পদ সংগঠন গড়ে তোলার জন্য ক্রমান্বয়ে কাজ করার প্রয়োজন যা তরুণসমাজকে হয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং গবেষণার জন্য উচ্চতর শিক্ষা প্রদান করবে নয়তো শিল্পক্ষেত্রে নিয়োগযোগ্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দক্ষতা নিবেদন করবে, যা রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পাই ২০৫০-এর মধ্যে ভারতীয় যুবসমাজের ৩০ শতাংশ ক্রমবর্ধনশীলভাবে উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, এখনকার ১০ শতাংশের তুলনায়। এবং বাকি ৭০ শতাংশের শিল্প, সেবামূলক ক্ষেত্র ও কৃষিতে উন্নত দক্ষতা থাকবে।
৮. সরকারের ১০০ কোটি টাকা আইআইএসসি-তে বিনিয়োগ করে বিশ্বমানের রিসার্চ এবং ডেভলপমেন্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলা নিশ্চয়ই প্রশংসার্হ কাজ, কিন্তু এত বড় একটা লক্ষ্যপূরণের জন্য বিজ্ঞানীরা নিজেদের যথেষ্ট অপ্রতুল মনে করছেন। MIT এবং স্ট্যানফোর্ডে তাদের নিজস্ব বৃহত্তর সম্পদ ছিল, অন্যদিকে আইআইএসসি বলে, পর্যাপ্ত ডক্টোরাল ছাত্র গবেষণা বিভাগগুলিতে পাওয়া যায় না।
সরকার পক্ষ থেকে এ এক অন্যতম পদক্ষেপ। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলিতেও সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। পরিকাঠামোগত উৎকর্ষসাধনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নানা উৎস থেকেও আসতে পারে। বিজ্ঞান সংগঠনে যে পরামর্শ দিয়েছিলাম, আমি নিশ্চিত এর দরুন বেশ কিছুসংখ্যক তরুণ ছাত্র বিশুদ্ধ গবেষণাকার্য করতে চাইবেন।
৯. ন্যানো প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, কার্বন বিমিশ্র, ধাতুবিদ্যা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বমানের গবেষণা করেছে, বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে সম্প্রতি আমাদের এই দাবি সত্ত্বেও দেশের এই কাজের জন্য বিগত ষাট বছরে একটাও নোবেল পুরস্কার আমরা পাইনি। এতে প্রশ্ন ওঠে আমরা কি সত্যি বিশ্বমানের গবেষণা করছি নাকি আমাদের কাজ অন্য কোনও কারণে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
বেশিরভাগ নোবেল পুরস্কার মৌলিক গবেষণার জন্য দেওয়া হয়। বর্তমানে মৌলিক গবেষণার জন্য বরাদ্দ বিপুল পরিমাণ অর্থ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন তরুণ ছাত্রদের মধ্যেকার সৃজনশীলতার বন্ধনমুক্তি ঘটানো যাতে তাঁরা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নবতম উন্মেষ ঘটাতে পারেন এবং তাঁদের প্রচেষ্টা ভিন্ন ভিন্ন দিকে বিক্ষিপ্ত না করে নির্দিষ্ট বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সংহত করতে পারেন। আমি ন্যানো প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রযুক্তিসমূহের অভিসরণ ঘটিয়ে নির্দিষ্ট কেন্দ্রাভিমুখী গবেষণার পরামর্শ দেব। ভারতবর্ষ গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং উচ্চতর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্দিষ্ট গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কর্মদক্ষতা এবং অর্থভাণ্ডার থাকতেই হবে। যদি আরও গবেষক অধ্যাপক এবং বিজ্ঞানীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দ্বারা প্রতিপালিত হন তা হলে আরও গবেষক ছাত্ররা আকর্ষণ বোধ করবেন। এর দরুন উদ্ভাবনী গবেষণার সফলতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশীয় প্রযুক্তিতে এর প্রভাব রাখবে। কিছু কিছু গবেষণা হয়তো পুরস্কার বিজয়ী গবেষক গড়ে তুলবে। এখানে আমি এক অভিজ্ঞতার কথা বলব যে, কীভাবে বৈজ্ঞানিক মহানুভবতা গবেষণা-পরিবেশের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে।
বৈজ্ঞানিক মহানুভবতা: ২০০৫ সালের ১৫ মার্চ দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে এক প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী এবং ভারতের প্রথম সবুজ বিপ্লবের অংশীদার, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক নর্ম্যান ই বোর্লগ এম এস স্বামীনাথন পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। ৯১ বছরের অধ্যাপক বোর্লগের প্রতি উপস্থিত সবাই প্রশস্তিবাক্য বর্ষণ করছিলেন। যখন ওঁকে বলতে অনুরোধ করা হল, উনি উঠে দাঁড়িয়ে কৃষিবিজ্ঞান এবং উৎপাদনে ভারতবর্ষের অগ্রগতির কথা বললেন, আরও বললেন রাজনৈতিক দূরদ্রষ্টা সি সুব্রাহ্মনিয়াম এবং ড. এম এস স্বামীনাথন ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম সবুজ বিপ্লবের মূল রূপকার। তিনি গর্বের সঙ্গে ভার্গিস ক্যুরিয়েনকে স্মরণ করলেন, যিনি ভারতবর্ষের শ্বেতবিপ্লবের অগ্রগমন ঘোষণা করেছিলেন। ড. বোর্লগ দর্শকদের মধ্যে তৃতীয়, পঞ্চম এবং অষ্টম সারিতে বসা বিজ্ঞানীদের দিকে ফিরে গম বিশেষজ্ঞ ড. রাজা রাম, ভুট্টা বিশেষজ্ঞ ড. এস কে ভাসাল এবং বীজ বিশেষজ্ঞ ড. বি আর বারওয়ালেকে চিহ্নিত করলেন। তিনি বলেছিলেন এইসমস্ত বিজ্ঞানীরা ভারতবর্ষ এবং এশিয়ার কৃষি সংক্রান্ত বিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন। তাঁদের তিনি দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং নিশ্চিত করলেন যাতে দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে এই বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানান। এই দৃশ্য আমাদের দেশে আমি আগে কখনও দেখিনি। ড. বোর্লগের এই মনোভাবকে আমি বৈজ্ঞানিক মহানুভবতা বলি। বন্ধু, যদি আপনি জীবনে মহৎ কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা করেন আপনার প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক মহানুভবতা। আমার অভিজ্ঞতা বলে মহান কার্য এবং মহৎ হৃদয় যুগপৎ চলে। এই বৈজ্ঞানিক মহানুভবতা বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে অনুপ্রাণিত করবে। বৈজ্ঞানিকদলের সমষ্টি চেতনাকে প্রতিপালন করে নানা গবেষণা ক্ষেত্রে নতুনতর আবিষ্কার ও উদ্ভাবনার দিকে তাঁদের নিয়ে যাবে।
১০. আপনি কি মনে করেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র সফর কোনও বাস্তবিক উদ্দেশ্যসাধন করে, নাকি সেগুলো শুধুমাত্র সীমিত মূল্যের আনুষ্ঠানিকতা?
এই পরিদর্শনের সাফল্য সম্পূর্ণ নির্ভর করে ভারতবর্ষ কী অর্জন করতে চায় তার ওপর। আমি ১৪টি রাষ্ট্রে গেছি এবং তাদের জাতীয় সভা ও সংসদে অভিভাষণ দিয়েছি। এই সফরগুলোতে পারস্পরিক বোঝাপড়া আরও ভাল হয়েছে এবং সহযোগিতা ও ভাববিনিময়ের নতুনতর পথে নিয়ে গেছে। এর ফলে উভয় রাষ্ট্রই দীর্ঘমেয়াদি সুফল ভোগ করবে।
উদাহরণ হিসেবে, আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্যান আফ্রিকীয় সংসদে অভিভাষণ দিয়েছিলাম। ওখানে আমি প্যান আফ্রিকীয় ই-নেটওয়ার্ক স্থাপনার প্রস্তাব দিয়েছিলাম যার প্রাথমিক খরচ ছিল ৫০ মিলিয়ন ডলার। আপনি শুনে সুখী হবেন যে, প্রকল্পটির ভালভাবে অগ্রগতি হচ্ছে এবং এর ফলে আফ্রিকীয় ইউনিয়ন এবং ভারতীয় বিশেষজ্ঞদলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ প্রযুক্তিগত সহযোগিতা গড়ে উঠেছে। আমি একে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হিসেবে গণ্য করি।
আমি যখন সুদান গেছিলাম ওএনজিসি-র পাইপ লাইন প্রকল্পটি শুরু হচ্ছিল। আজ সেই প্রকল্পটি ওএনজিসি বিদেশ দ্বারা সম্পূর্ণ হয়েছে এবং উভয় রাষ্ট্র এর সুফল ভোগ করছে।
ফিলিপিনস আমাদের দেশের উদাহরণ গ্রহণ করে জাত্রোফা চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য তাঁরা ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এ ছাড়াও ভারতবর্ষ এবং ফিলিপিনসের ভেষজ শিল্পের মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা গড়ে ওঠে যার দরুন মানুষ ব্যয়সাধ্য মূল্যে ওষুধ পায়। ন্যাসকম (NASSCOM) ফিলিপিনসের সঙ্গে আইটি, আইটিইএস এবং বিপিও পরিষেবা গড়ে তোলার জন্য কাজ শুরু করেছে।
সহৃদয়তার নিরিখে আমরা বেশ কিছু হৃদ্রোগীর চিকিৎসা করতে রাজি হয়েছিলাম, বিশেষত তানজানিয়ার কিছু হৃদ্রোগাক্রান্ত বাচ্চাদের। আমার বলতে আনন্দ লাগছে যে, সেই বাচ্চাদের ভারতবর্ষে এনে চিকিৎসা করে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এর পাশাপাশি অনেক তানজানিয়ার চিকিৎসককে হৃদ্রোগ মোকাবিলায় প্রশিক্ষিত করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়া ভ্রমণ কালে আমি দুই অংশীদারী রাষ্ট্রে বিশ্ব জ্ঞানমঞ্চ সৃজনের প্রস্তাবনা দিয়েছি। এই কার্যক্রম আধুনিকতম দ্রব্যের নকশা, উন্নয়ন এবং উৎপাদনের সম্ভাব্যতা কল্পনা করে অংশীদার রাষ্ট্রের বারোটি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মদক্ষতা ব্যবহার করে, যা আন্তর্জাতিকভাবে বিপণন হতে পারে। এইসমস্ত রাষ্ট্রগুলি সক্রিয়ভাবে এক বিশ্ব জ্ঞানমঞ্চ প্রয়োগের বিবেচনা করছে।
১১. এখন যে আপনি আপনার মেয়াদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সমাপন করেছেন সেখানে আপনি কি এমন কিছু কার্যক্রমের তালিকা রচনা করবেন যার প্রাথমিক পদক্ষেপ আপনি নিয়েছেন এবং যেগুলি আপনাকে গভীর সন্তুষ্টি দিয়েছে? যেমন PURA-র উদাহরণ?
সন্তোষজনক কিছু কার্যক্রমের উল্লেখ আমি করতে চাই—
গ্রামীণ উন্নয়ন: গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রক সমগ্র দেশ জুড়ে ৩৩ টি PURA গুচ্ছ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করেছে। কিছু বেসরকারি শিক্ষা ও সামাজিক সংগঠন PURA-কে গ্রহণ করেছিল পল্লিগ্রাম গুচ্ছ উন্নয়নের জন্য।
শক্তি: পাঁচটি রাজ্য জৈব ডিজেল উৎপাদনের জন্য জাত্রোফা চাষ শুরু করেছে। একটি শক্তি প্রকল্প ঘোষিত হয়েছে।
নলেজ গ্রিড: জাতীয় জ্ঞান কমিশন বা NKC (National Knowledge Commission) পরিকল্পনা করছে সমগ্র দেশ জুড়ে নলেজ গ্রিড প্রতিষ্ঠা করবে কমপক্ষে ৫০০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ১০০ mbps নেটওয়ার্কের নেটওয়ার্কিং দ্বারা।
ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়: ১৫০ বছরের পুরনো তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয় প্রচলন করেছে এবং আমি ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষের মাধ্যমে উদ্বোধন করেছি ও ২০,০০০ ছাত্রছাত্রীর উদ্দেশে অভিভাষণ দিয়েছি।
গ্রামীণ জ্ঞান কেন্দ্র: যোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক বা এমসিআইটি (মিনিস্ট্রি অফ কমুনিকেশনস অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি) দ্বারা ১০০,০০০ সাধারণ সেবাকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে যাতে গ্রামীণ নাগরিকদের মূল্যভিত্তিক পরিষেবা দেওয়া যায়।
ই-গভর্ন্যান্স: জাতীয় আইডি বা পরিচয়পত্র এবং G২G এবং G২C পরিষেবার জন্য ই-গভর্ন্যান্স গ্রিড স্থাপনা গতি অর্জন করছে। ভারত সরকার G২C ই-গভর্ন্যান্স পরিষেবার জন্য ২৩,০০০ কোটি টাকা ঘোষণা করেছিল এবং রাজ্য বিস্তৃত ক্ষেত্র নেটওয়ার্ক বা SWAN (State Wide Area Network) স্থাপনা করেছে।
১২. দপ্তরভার ছেড়ে দেবার পরে আপনার বিপুল প্রতিভা, উৎসাহ এবং মহান আত্মোৎসর্গতা কি আপনার কোনও প্রিয় পরিকল্পনায় নিবেদন করার অভিপ্রায় রাখেন? যেমন বিজ্ঞান গবেষকদের পথপ্রদর্শন ও ডক্টোরাল ছাত্রদের শিক্ষাদান করা? আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার আগের কাজ কি আপনি আবার শুরু করবেন?
২০২০-র পূর্বে উন্নত ভারত স্বপ্ন উপলব্ধি করায় আমি অক্লান্তভাবে কাজ করে যাব। শিক্ষকতা এবং গবেষণাকার্য করব। ছাত্রছাত্রী ও তরুণ সমাজের সঙ্গে আমার ভাববিনিময় চলতেই থাকবে।
এ ছাড়াও প্রতি বছর বেশ কিছু সময় আমি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য ব্যয় করব। ওখানকার জনজীবনের মানোন্নয়নের সময়-নির্দিষ্ট উন্নত প্রভাব বিস্তারকারী প্রকল্পের প্রয়োগের সক্ষমতা এবং উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গঠনের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। ফলে ওই অঞ্চলের যুবসমাজকে উচ্চ পারিশ্রমিকযুক্ত কর্মনিয়োগের অজস্র সুযোগ নিবেদন করা যাবে।
১৩. ওই বিশিষ্ট পদ আপনি সম্মানের সঙ্গে বহন করা সত্ত্বেও আপনার সবচেয়ে বড় অসন্তুষ্টির কারণ আপনি কি ব্যক্ত করবেন?
আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমি গভীরভাবে আশাবাদী। আমি শুধুমাত্র অগ্রগতির হার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। রাষ্ট্রের যুবসমাজকে সক্ষম করার জন্য যদি সমস্ত অংশীদাররা একই লক্ষ্যে সমন্বিত ছন্দে কাজ করে তবে আমরা ইন্ডিয়া ২০২০-র উন্নয়নমূলক লক্ষ্য আরও দ্রুত উপলব্ধি করতে পারব। আমাদের প্রত্যেকের এই মনোভাব নিয়ে কাজ করা উচিত যে, রাষ্ট্র ব্যক্তিমানুষের চাইতে অনেক বড়। আমাদের ৫৪০ কোটি তরুণদের প্রতি আমার অসীম বিশ্বাস আছে।
১৪. আপনি উত্তর-পূর্বাঞ্চল পরিদর্শন করেছেন এবং তাদের উন্নয়নের জন্য পথনির্দেশিকা-সহ উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু যেখানে প্রায় প্রতি রাজ্যে অসংখ্য সন্ত্রাসবাদী দল রয়েছে সেখানে আপনার এ ধরনের উপদেশ যথেষ্ট নয় বলে কি আপনি বিবেচনা করেন না? এই সন্ত্রাস বিনিয়োগের স্রোতকে অবরুদ্ধ করে, বিনিয়োগের অভাব যুবমানসে অসন্তোষ সৃষ্টি করে বা সন্ত্রাসবাদীদের পুষ্ট করে, ফলে উন্নয়নমূলক কাজকর্মে অচলাবস্থার উদ্ভব ঘটে। এই পরিস্থিতিতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পীড়িত জনগণের জন্য কোনও আশা রয়েছে কি?
উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহ আমাদের অনেক সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের সুযোগ দেয়। আমিও দেখেছি, জনসাধারণ উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে, সন্ত্রাসের ঘটনাগুলি যুবসমাজের ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে কাজ করছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চল এক উদ্যমশীল উন্নয়ন গ্রহণ করেছে, প্রগতির পথে যে-কোনও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে মানুষ তৈরি হবে। অতএব আমি রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে এই বার্তা দেব যে, রাজ্যের যুবসমাজকে সক্ষম করে উদ্যমশীল উন্নয়নের জন্য অগ্রসর হতে হবে। সন্ত্রাস এবং উগ্রবাদী হিংসা সত্ত্বেও আমাদের দক্ষতা সম্পন্ন, জ্ঞান সমৃদ্ধ এবং শিল্পোদ্যোগে উন্নয়ন করতে হবে।
১৫. উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি থেকে পূর্ব ভারতে বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং সড়ক-রেল যাত্রাপথ সুগম হওয়া সম্বন্ধে আপনার কী মতামত? অর্থনীতিতে এগুলো কি উদ্দীপনা সৃষ্টি করে এবং আরও কর্মসংস্থান এবং সুযোগ সৃষ্টি করে?
উন্নয়নের জন্য এ আবশ্যিক। রাজনৈতিক দলগুলির উচিত পূর্বদিকে বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং সড়ক-রেল যাত্রাপথের মতো সম্ভাবনার উন্মোচন যত শীঘ্র সম্ভব সহজসাধ্য করা। সীমান্ত বাণিজ্য উন্নয়ন সম্বন্ধে আমি রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম যা যুবসমাজের কর্মনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
১৬. আমাদের শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রচলিত উৎস থেকে অপ্রচলিত উৎস পরিবর্তনে রাষ্ট্রপতি ভবন কি কোনও দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে যা আপনি করবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন?
বর্তমানে, রাষ্ট্রের শুধুমাত্র এক কিলোওয়াট ধারণক্ষমতা সম্পন্ন সৌরশক্তি ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা আছে। রাষ্ট্রপতি ভবনের জন্য আমরা ৫ মেগাওয়াট সৌরশক্তিকেন্দ্রের পরিকল্পনা করছি। যত শীঘ্র সম্ভব এই শক্তিকেন্দ্র স্থাপনা করার জন্য শক্তিমন্ত্রক এবং অপ্রচলিত শক্তি উৎস মন্ত্রক সক্রিয়ভাবে এই প্রকল্পের জন্য কাজ করছে।
১৭. শক্তি সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আপনার উদ্বেগের কারণে আপনি কি আপনার প্রভাব রাষ্ট্রে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং জোয়ার-ভাটা উদ্ভূত শক্তি ইত্যাদির দিকে বদল করার প্রচেষ্টা করবেন?
আপনি লক্ষ করেছেন আমার বক্তৃতায় আমি সৌরশক্তি কেন্দ্রের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সিএনটি (Carbon nanotube) ভিত্তিক সৌর আলোক উদ্বায়ী কোষ সহিত সৌরশক্তি ক্ষেত্রে গবেষণার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এ ছাড়াও থোরিয়াম ব্যবহারের মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তির পরামর্শ দিয়েছিলাম। পরিবহণ ক্ষেত্রে, জৈব ডিজেল উৎপাদনের জন্য ব্যাপক হারে জাত্রোফা বাগিচা নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিলাম। আমাদের বিজ্ঞানীরা এইসমস্ত ক্ষেত্রে কাজ করেছেন।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিনটি রাজ্যে আমার সফর সেই রাজ্যগুলির জৈববৈচিত্র্য এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও বস্ত্রশিল্পের বিশেষায়িত উৎপাদন সম্ভাব্যতা সম্বন্ধে আমার মনে বিশ্বাস জাগায়। এই পরিদর্শনের দ্বারা এই রাজ্যগুলির তরুণদের জীবনে সফল হওয়ার অনুপ্রেরণা সম্পর্কে আমার মনে বিশ্বাস গড়ে ওঠে। প্রয়োজন শুধু ওদের মধ্যে উন্নয়নের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠা। পাশাপাশি, রাজ্যগুলির ত্বরান্বিত বিকাশ অর্জনের জন্য যুবসমাজকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে। এর জন্য দরকার সহজসাধ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং গতিশীল পরিকাঠামোর বৃদ্ধি।
.
পরিশিষ্ট-২
মিশনের প্রয়োগপদ্ধতি
রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার ছেড়ে আসবার সময় আমি যে বক্তৃতা দিয়েছিলাম তাতে সংসদকে শক্তিশালী করার জন্য একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা জ্ঞাপন করেছিলাম। প্রতিটি দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং অন্যান্য যে চ্যালেঞ্জগুলি একযোগে সংসদ এবং সরকার রূপায়ণ করবে বলে আমি মনে করি, প্রয়োজনানুসারে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে, নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সময় এবং সংস্থান, বিভিন্ন মন্ত্রক, বিভাগের সীমা অতিক্রম করে, তাকে ‘মিশন-কার্য প্রণালী’ হিসেবে বর্ণনা করার পরামর্শদান করেছিলাম। আমি আশাপোষণ করেছিলাম যে, প্রতিটি মিশনের জন্য সংসদের প্রতিভাবান সদস্যদের মধ্যে থেকে দূরদর্শী নেতৃত্বর উত্থান ঘটবে। এই পথে সমস্ত সদস্যরা রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের ভিন্নতা অগ্রাহ্য করে কার্যকরী শাসনব্যবস্থায় প্রকৃত অংশগ্রহণে সক্ষম হবেন। নির্দিষ্ট মিশনের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে দায়বদ্ধতা এসে যায়।
মিশন ব্যবস্থাপনে সংগঠনমূলক কাঠামো
অগ্রবর্তী ক্ষেত্রের মিশন ব্যবস্থাপনের জন্য প্রতিভূস্বরূপ আদর্শের দ্বারা যেতে গিয়ে আমি মনশ্চক্ষে দেখি
• যখন নির্বাচিত সাংসদরা মিশনের সমন্বয়সাধন করবেন, সংশ্লিষ্ট শাসনতান্ত্রিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী একই মিশনে প্রয়োজনীয় পরিধিতে এবং নিজের নিজের মন্ত্রক/বিভাগের সীমারেখার মধ্যে যতদূর সম্ভব সরাসরি নেতৃত্ব দান করবেন।
• কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ‘মিশন মন্ত্রী’ কে প্রয়োজনীয় মন্ত্রক/বিভাগীয় সংস্থানকে দায়িত্বভার অর্পণ করবেন যাঁকে তাঁর মিশনের জন্য বার্ষিক কর্মসূচি এবং আর্থিক লক্ষ্যপূরণের উপলব্ধির জন্য দায়ী করা হবে।
ইন্ডিয়া ২০২০ স্বপ্ন উপলব্ধি করতে বহুগুণিত মিশনের ম্যাট্রিক্স কাঠামোর একটা ধারণামূলক রেখাচিত্র দেখানো হল
মিশনে কার্যপ্রণালী ব্যবস্থাপনের জন্য মন্ত্রক বা বিভাগীয় বাজেটের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বিকেন্দ্রীকরণ এবং মিশন অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ বরাদ্দের প্রয়োজন। কোনও বিশেষ মিশনের জন্য প্রতিটি মন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ দায়িত্বভার অধিকর্তা/ যুগ্মসচিব পদমর্যাদার নির্দিষ্ট আধিকারিকের ওপর ন্যস্ত করা হবে। এভাবে মিশন— মন্ত্রীর একটা দল হবে বিভিন্ন মন্ত্রকের কয়েক জন যুগ্ম সচিব/অধিকর্তা নিয়ে এবং মিশনের লক্ষ্য সফল করার দিকে তাঁদের মনোনিবেশ করাবে। মিশন ব্যবস্থাপন দলের প্রতিটি সদস্য শাসনতান্ত্রিকভাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে কিন্তু কর্তব্যগতভাবে মিশন পরিচালকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।
তা হলে সহজেই দেখা যাচ্ছে ‘ম্যাট্রিক্স ব্যবস্থাপন’-এ সাংসদদের এ ধরনের বিস্তৃত অংশগ্রহণে নিম্নলিখিত সংগঠনের নীতিসমূহ এবং দায়বদ্ধতার প্রয়োজন হবে।
ক. মিশন মন্ত্রীরা রাজ্যের মন্ত্রী হতে পারেন বা তাঁদের সংসদ থেকে আনা হতে পারে। এমনকী শাসন রূপরেখায় অবস্থান না করা কোনও রাজনৈতিক দলেরও হতে পারেন।
খ. নির্দিষ্ট মিশনসমূহ, কার্যক্রমগুলি এবং প্রকল্পগুলির জন্য মিশন মন্ত্রীদেরকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের দ্বারা সংস্থান ও ক্ষমতার উপর থেকে নীচে ক্ষমতার দায়িত্ব বিতরণ।
গ. মিশন মন্ত্রীদের দ্বারা বিভাগীয় সীমা অতিক্রম করে মিশন ব্যবস্থাপন টিমের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট মিশনের সমান্তরাল একীকরণ।
ঘ. সামগ্রিক মিশন পরিকল্পনা এবং সংস্থান বিলিবণ্টনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন এবং প্রতিটি মন্ত্রক/বিভাগের ইন্ডিয়া ২০২০ স্বপ্ন পরিকল্পনা টিম গড়ে তুলতে হবে।
ঙ. প্রতিটি মন্ত্রক এবং মিশন পরিকল্পনা দল দ্বারা সযত্নে বিস্তৃত মিশন ২০২০ পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে।
চ. মিশনগুলিকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এবং মিশনগুলির কার্যকালের মেয়াদ সংসদ ও সরকারের কার্যকালের মেয়াদের পরিধির বাইরে অবধি বিস্তৃত করতে হবে।
ছ. ই-গভর্ন্যান্স নেটওয়ার্ক ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে হবে।
জ. মিশন-মন্ত্রীরা সংসদের কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ থাকবেন।
ঝ. কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা মন্ত্রিসভার কাছে এবং মন্ত্রিসভা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।
ঞ. বহুলসংখ্যক মিশন-মন্ত্রীরা ইন্ডিয়া ২০২০ স্বপ্ন ম্যাট্রিক্স-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে, এর ফলে সংসদের ভূমিকা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে এবং নির্দিষ্ট মিশনগুলোর জন্য উচ্চ সরকারি পদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
গণতন্ত্র বজায় রাখতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও একে শুধুমাত্র উন্নতির জন্য একটা যান্ত্রিক কৌশল হিসেবে দেখা উচিত হবে না। শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে এর সফল ব্যবহার সামাজিক মূল্যবোধ এবং জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করে। এবং নিয়মমাফিক পরিবর্তনের জন্য অনুঘটক হিসেবে জাতীয় বিতর্কের সময় এসে গেছে।
৭. এক প্রতিযোগিতামূলক রাষ্ট্রের উদ্দেশে
৭. এক প্রতিযোগিতামূলক রাষ্ট্রের উদ্দেশে
জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রতিযোগিতার দ্বারা শক্তিশালী।
প্রতিযোগিতা জ্ঞান দ্বারা শক্তিশালী।
জ্ঞান প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
ভারতের জনসংখ্যার বৃহদাংশ গ্রামে বাস করে এবং এটাই হল বিজ্ঞানীমহলের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ; যেখানে ৭৫০ কোটি বাস করে তাদের জীবন প্রযুক্তির ফল ব্যবহার করে সমৃদ্ধ করা।
বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ৫০ বছরের কর্মজীবনে আমি সবসময় বিশ্বাস করে এসেছি— এই দুই ক্ষেত্র সামনে রেখে অগ্রসর হওয়া এক উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার একমাত্র পথ। তিনটি যে মূল ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য স্থির করা উচিত তা হল, ন্যানো টেকনোলজি, ই-গভর্ন্যান্স এবং জৈব-ডিজেল। উদ্ভাবনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হল রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে শুরু করি না কেন?
জটিল এবং নতুন সূচনায় অসংখ্য বিশেষজ্ঞের মিলিত ভাবনার প্রয়োজন। লক্ষ্য এবং কর্ম সম্পাদন করার জন্য বিভিন্ন মতামত এবং সংকলিত প্রচেষ্টা বিবেচনা করতে হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি ভবন এবং সেকেন্দ্রাবাদে রাষ্ট্রপতির বিশ্রামস্থল রাষ্ট্রপতি নিলয়ম-এ তিনটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনা তিনটি হল— ন্যানো টেকনোলজির অধিবেশন, ই-গভর্ন্যান্স অধিবেশন এবং জৈব-ডিজেল অধিবেশন। রাষ্ট্রের কর্মক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনাগুলি খুব তাত্পর্যপূর্ণ ছিল।
বেঙ্গালুরুর জওহরলাল নেহরু সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্টিফিক রিসার্চ-এর সাম্মানিক সভামুখ্য অধ্যাপক সি এন আর রাও-এর সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। ন্যানো-বিজ্ঞান প্রযুক্তির গবেষণা এবং উন্নয়নের ভবিষ্যৎ দিশা এবং কৃষি, ঔষধ, মহাকাশ এবং শক্তিক্ষেত্রে এর প্রভাব সম্বন্ধে ভারতবর্ষ এবং বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছিল। এই আলোচনা আমায় রাষ্ট্রপতি ভবনে একদিনব্যাপী অধিবেশনের ব্যবস্থা করতে প্রণোদিত করেছিল। শেষপর্যন্ত আলোচনা এবং সুপারিশের দ্বারা ১,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ সমন্বিত কার্যক্রম ফল দেয়। এই কার্যক্রম বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি এবং উদ্ভাবনের পথের দিশা দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, আমি খুব আনন্দিত হয়েছিলাম যখন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা জলের অণু থেকে ন্যানো স্কেল দূষণ এবং পেট্রোলিয়াম থেকে ভারী হাইড্রোকার্বন দক্ষভাবে দূরীভূত করার জন্য কার্বন ন্যানো-টিউব শোধক তৈরি করার সরল পদ্ধতি কৌশল উদ্ভাবন করেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদ ‘ডাবর’ নামক এক বেসরকারি সংস্থার অংশীদারিত্বে সাফল্যজনকভাবে টিউমার কোষের লক্ষ্যে সরাসরি ওষুধ প্রদান ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
এক উন্নত ভারত এবং আমাদের জ্ঞানসমাজের অগ্রগতির জন্য দক্ষ, ফলভিত্তিক এবং স্বচ্ছ সরকার প্রথমেই প্রয়োজন। এরজন্য রাজ্য, জেলা এবং গ্রাম পর্যায়ে বিকেন্দ্রীভূত অখণ্ড ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক। এর পরিকল্পনা এবং প্রয়োগের জন্য কেন্দ্র সরকার এবং রাজ্য সরকার এমনকী সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত পরিকল্পিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এ কথা স্মরণে রেখে, সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর অংশগ্রহণের দ্বারা ই-গভর্ন্যান্স অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ভবনে আমরা ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলাম। এ-বিষয়ে আমি বিচার বিভাগ, নিরীক্ষা এজেন্সি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। কমনওয়েলথ-এর সমাবেশে একটা প্রেজেন্টেশন করা হয়েছিল, যা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। আমার আশা যে, ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের স্মার্ট বা শনাক্তকরণপত্রী-সহ ই-গভর্ন্যান্স কার্যকরী পরিষেবা তৈরি করবে এবং চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামে অবদান রাখবে।
আমার বিশ্বাস জলসম্পদ এবং শক্তিসম্পদ এই দুই মূল ক্ষেত্র ভবিষ্যতে দ্বন্দ্বের মূল উৎস হয়ে উঠবে। রাজ্যপালদের এক অধিবেশনে বক্তৃতার বিষয় ছিল জলসম্পদ, জলাশয়ের রক্ষণাবেক্ষণ, জলসম্পদের সংরক্ষণ এবং রাজ্য ও জাতীয় পরস্পর সংযুক্ত নদীর জটিল সমন্বয়ের পরিপ্রেক্ষিতে। শক্তিক্ষেত্রে স্বনির্ভরতার জন্য বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্পের প্রয়োজনীয়তার প্রচার আমি করে এসেছি। এক্ষেত্রে এক মূল প্রাথমিক পদক্ষেপ হল জৈব-জ্বালানির উন্নয়ন। এই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে এবং প্রাথমিক পদক্ষেপের সকল দিকগুলোকে সম্পূরিতভাবে বিবেচনা করার জন্য আমরা রাষ্ট্রপতি নিলয়মে এক অধিবেশন আহ্বান করেছিলাম। অন্যান্যদের মধ্যে এই অধিবেশনে কৃষকরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, যাঁদের এই ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা আছে এবং সম্ভাব্য ব্যবহারকারী হিসেবেও। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেমন বীজের বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য চিহ্নিতকরণ এবং জৈব-জ্বালানির উৎস হিসেবে ব্যবহারযোগ্য উদ্ভিদ-চাষে সেচব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা। সরকারি আধিকারিকরা পতিত জমি বণ্টন সম্পর্কিত বিষয় উত্থাপন করেছিলেন। মোটরচালিত যানের নকশাকাররা জৈব-জ্বালানি এবং ডিজেলের সংমিশ্রণের কথা বলেছিলেন যা ইঞ্জিনের নকশা অবিকল রেখে ব্যবহার করা সম্ভব। মিশ্রণে যদি জৈব-জ্বালানির শতকরা মাত্রা বৃদ্ধি পায় তা হলে ইঞ্জিনের নকশার পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। বণিক প্রতিনিধিরা বিনিয়োগ এবং না লাভ-না ক্ষতিজনক বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আমি জৈব-জ্বালানির ব্যবহার সম্পর্কে আমার ধারণার পরিচয় দিয়েছিলাম। অধিবেশনের শেষে সুপারিশগুলো তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সংস্থার মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়েছিল। জৈব-জ্বালানি প্রকল্প বিকশিত হয়েছে বলে আমি খুশি।
এই তিনটি অধিবেশনের অতিরিক্ত, আরও একটা প্রযুক্তিগত ঘটনার উন্মেষ রাষ্ট্রপতি ভবনে হয়েছিল।
২০০৬ সালে ইসরো-র তৎকালীন সভাপতি ভবিষ্যৎ মহাকাশ পরিকল্পনা সংক্ষিপ্তাকারে আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এর মধ্যে চন্দ্র অভিযানের চন্দ্রায়ন মিশনও ছিল। আমি নিশ্চিত যে ওটা ছিল আরও বিস্তৃত মহাকাশ অভিযান এবং মানবাভিযানের প্রথম পদক্ষেপ। প্রস্তাবিত চন্দ্রাভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আমায় বলেছিলেন মহাকাশযান চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে এবং মহাকাশীয় বস্তুর রাসায়নিক, খনিজ এবং ভূ-বিজ্ঞান সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য সরবরাহ করবে। তিনি আরও বলেছিলেন, এই মিশন যে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বহন করবে ইসরো তার চূড়ান্ত ব্যবস্থাপনা করছে। আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম এই মিশন চাঁদে প্রবেশপথে অন্ততপক্ষে এক দূরমাপন চ্যানেল ও ঘনত্ব বা চাপ পরিমাপ-সহ এক যুগ্ম কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। এই যন্ত্রগুলি চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে সরাসরি আমাদের কাছে তথ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। ইসরো-র সভাপতি কথা দিয়েছিলেন এই কার্যাবলি অন্তর্ভুক্ত করবেন। এইভাবেই চন্দ্রায়ন মিশনের অংশ হিসেবে মুন ইমপ্যাক্ট প্রোব-এর জন্ম ঘটল। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম যে মহাকাশে অনুসন্ধান ও পরীক্ষার জন্য প্রেরিত যানটি চাঁদের ভূমি স্পর্শ করল ২০০৪ সালের ১৪ নভেম্বর—একেবারে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে। আমি ইসরো টিমকে তাদের সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানালাম।
রাষ্ট্রপতি ভবনের পরামর্শে এই দুই উচ্চ পর্যায়ের প্রযুক্তিগত পদক্ষেপের প্রারম্ভিক সূচনা হয়েছিল। আমি এই দুই সম্ভাবনাময় উদ্যোগের অংশীদার হতে পেরে ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলাম।
২০১১ সালের বিশ্ব উদ্ভাবন প্রতিবেদন আমি যখন পড়ছিলাম, তখন দেখলাম বিশ্ব উদ্ভাবন সূচক অনুযায়ী সুইজারল্যান্ডের স্থান ১, সুইডেন ২, সিঙ্গাপুর ৩, হংকং ৪ এবং ভারতবর্ষ ৬২-তম স্থানে। উদ্ভাবন সূচক এবং প্রতিযোগিতামূলকতার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। ২০১০-১১ সালে যেখানে ভারত বিশ্ব উদ্ভাবন সূচকে ৬২, সেখানে বিশ্ব প্রতিযোগিতামূলকতা সূচকে ৫৬, যদি ভারতবর্ষকে ৫৬ থেকে উন্নীত হতে হয় এবং উন্নত রাষ্ট্রের (প্রথম ১০টি রাষ্ট্রের) সমকক্ষ হতে চায় সেক্ষেত্রে দেশীয় নকশা প্রযুক্তিতে সক্ষমতা গড়ে তোলা আবশ্যিক। বর্তমান বিকাশ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভিত্তিতে অন্যত্র আবশ্যিকভাবে গড়ে ওঠা প্রযুক্তির ব্যবহার দ্বারা অর্জিত হয়েছে এবং দশ থেকে পনেরো বছর আগে মালিকানা স্বত্ব শুরু হয়েছিল। বিজ্ঞানের অগ্রগতির থেকে যে সাম্প্রতিকতম প্রযুক্তি গড়ে উঠেছিল তা উন্নত দেশগুলি থেকে অন্তত এক দশক ভারতের হাতে অধরা ছিল। এখান থেকে, ভারতবর্ষকে বিশ্ব প্রতিযোগিতামূলকতার অভীপ্সিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গবেষণা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, বিশেষত মৌলিক বিজ্ঞানে। আমি এর পরে এক উদ্যমের পরিণতির কথা বলব যেখানে ভারত প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি গড়ে তুলেছিল।
আমরা খুব সম্প্রতি এক কীর্তিস্তম্ভ পার করে এসেছি। ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল, ওড়িশা উপকূলে, হুইলার দ্বীপের উৎক্ষেপণকেন্দ্রে উদ্বেগ চরম সীমায় পৌঁছেছিল কারণ ওখানে বিশালাকার ৫০ টন ওজনের ১৭.৫ মি. উঁচু অগ্নি ৫ উৎক্ষেপণ অস্ত্র উল্লম্ব অবস্থানে উত্তোলন করা হয়েছিল এবং উৎক্ষেপণপূর্ব ব্যবস্থাপনা পরীক্ষা করা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সকাল ৮.০৭-এ প্রতিগণনা শুরু হয়েছিল এবং উৎক্ষেপণ অস্ত্রের প্রথম পর্বের অগ্নি সংযোগে একটা বিশাল অগ্নিগোলক ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। অগ্নি ৫ মসৃণভাবে উৎক্ষেপণ মঞ্চ থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে বৈজ্ঞানিকরা তার সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়া জনতার উদ্দেশে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁদের কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত বরং দর্শকরা অনেক বেশি উৎকণ্ঠিত ছিলেন। ৯০ সেকেন্ডের পর প্রথম পর্যায় জ্বলে ভস্মীভূত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যে গতিবেগের মাত্রা স্থির করে দেওয়া হয়েছিল উৎক্ষেপণ অস্ত্রটি ঠিক সেই মাত্রায় ছুটছিল। তারপর নির্ঘণ্ট অনুযায়ী সম্পূর্ণ নব-সমন্বিত দ্বিতীয় পর্যায় জ্বলে ভস্মীভূত হয়ে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কয়েক মিনিটের মধ্যে উৎক্ষেপণ অস্ত্রটি মহাকাশে ভেসে যায়। বিদ্যুৎগতিতে ২০০০ কিমি দক্ষিণে বিষুবরেখা পার করে। তারপর আরও ৩০০০ কিমি সবেগে ধাবিত হওয়ার পরে মকরক্রান্তি রেখার ওপরে বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশ করে আফ্রিকার দক্ষিণতম বিন্দুপ্রান্ত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে ঝাঁপিয়ে সমুদ্রে অবতরণ করেছিল। উৎক্ষেপিত হওয়ার পর থেকে সমুদ্রে অবতরণ করতে ঠিক ২০ মিনিট লেগেছিল। ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ উৎক্ষেপণ অস্ত্রের গতিপথের প্রথম থেকে শেষ অবধি অনুসরণ নথিবদ্ধ করেছে। উৎক্ষেপণ অস্ত্রটি লক্ষ্যকে তার পূর্ব-নির্ধারিত অভ্রান্ততায় বিদ্ধ করে।
IGMDP ১৯৮৩ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা অনুমোদন করে। এই কার্যক্রম চারটি উৎক্ষেপণ অস্ত্রের উন্নয়ন, উৎপাদন এবং নিয়োজনের সম্ভাব্যতা নিরূপণ করেছিল। সেগুলোর নাম— ভূমি থেকে ভূমি উৎক্ষেপণ অস্ত্র (পৃথ্বী); মধ্যম পরিসর ভূমি থেকে বায়ু উৎক্ষেপণ অস্ত্র (আকাশ); স্বল্প পরিসর শীঘ্র প্রতিক্রিয়া ভূমি থেকে বায়ু উৎক্ষেপণ অস্ত্র (ত্রিশূল); এবং একটা কামানবাহী যান প্রতিরোধ উৎক্ষেপণ অস্ত্র (নাগ)। এর অতিরিক্ত প্রযুক্তি প্রতিপাদন উৎক্ষেপণ অস্ত্র (অগ্নি) এই কার্যক্রমের অংশ ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল দূর পরিসর উৎক্ষেপণ অস্ত্রের পুনঃপ্রবেশের বৈশিষ্ট্যগুলির প্রদর্শন করা। এই প্রযুক্তি প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল ১৯৮৯-এর মে মাসে ওড়িশার উপকূলে। পরবর্তীকালে, শেষ দুই দশকে দীর্ঘতর পরিসরের বর্ধিতক্রমে পরিসর সক্ষমতা-সহ অগ্নি ১, ২, ৩, এবং ৪ প্রদর্শিত হয়েছে। এবং শেষ অবধি ডিআরডিও-র বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়াররা ৫০০০কিমি পরিসর উৎক্ষেপণ অস্ত্র অগ্নি ৫-র উড়ান পরীক্ষা সহজসাধ্য করেছিলেন। এইসমস্ত উৎক্ষেপণ অস্ত্রগুলি MTCR (Missile Technology Control Regime) এবং অন্যান্য অনুমোদনের অধীনস্থ হয়েছিল। অতএব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া বা এই প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি কোনওটাই অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করা সম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়াকে শ্রমসাধ্য পথে প্রণালীবদ্ধ গবেষণা এবং উন্নয়নের মাধ্যমে উপলব্ধি করা সম্ভব।
অতএব জটিল প্রযুক্তিতে আত্মবিশ্বাসী হওয়া ও স্বাধীন বৈদেশিক নীতি অনুসরণে রাষ্ট্রকে সক্ষম করার ক্ষেত্রে উৎক্ষেপণ অস্ত্রের সাফল্যজনক পরীক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রাখে।
আমার বন্ধু ড. ভি কে সারস্বত এবং তাঁর দল অগ্নি ৫-র উৎক্ষেপণের সময় আমায় সংক্ষেপে তথ্য শুনিয়েছিলেন।
আমায় ইতিহাসের এক ক্ষুদ্র অংশ বলতে অনুমতি দেওয়া হোক— দুটো কথোপকথনের উল্লেখ করব, যার একটা ১৯৮৪ এবং অন্যটি ১৯৯১ সালে হয়েছিল। আমি সেসময় DRDL-এর অধিকর্তা হিসেবে হায়দরাবাদে ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী তাঁর মন্ত্রিসভার মাধ্যমে IGMDP-র অনুমোদন দেবার পরে, ১৯৮৩ সালে পরের বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করার জন্য DRDL এসেছিলেন। আমরা যখন কার্যক্রমের অগ্রগতি প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করছিলাম অধিবেশন কক্ষে একটা বিশ্বমানচিত্র শ্রীমতী গাঁধীর নজরে পড়ে। তিনি প্রেজেন্টেশন স্থগিত রেখে আমাদের মনোযোগ মানচিত্রের দিকে আকর্ষণ করলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কালাম, মানচিত্রটি দেখুন, এখানে যে দূরত্বগুলি দেখানো আছে দেখুন। কখন এই গবেষণাগার কোনও উৎক্ষেপণ অস্ত্র উৎক্ষেপণ করবে যা যে-কোনও সম্ভাব্যতার মুখোমুখি হতে অনেক দূর পৌঁছনোর সক্ষমতা রাখবে।’ (তিনি ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে ৫০০০ কিমি. দূরে একটা জায়গা নির্দেশ করলেন।) আমাদের ডিআরডিও বৈজ্ঞানিকগণ অবশ্যই এই মহান দেশনেত্রী দ্বারা দৃষ্ট মনচ্ছবি তাঁদের লক্ষ্য হিসেবে অর্জন করেছেন।
পরবর্তীকালে যখন পৃথ্বী উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখল তখন সেনাবাহিনী আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার কথা জানাল। সেনাবাহিনী CEP (Circular Error Probability)-কে বলবৎ করতে ভূমি পরিসরে প্রমাণ সহায়ক পরীক্ষা চেয়েছিল। সুরক্ষা এবং ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার কারণে আমাদের পরীক্ষা পরিচালনার প্রচেষ্টা মরুভূমি অঞ্চলে সম্ভব হয়নি। এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা পূর্ব উপকূল অঞ্চলে জনমানবহীন দ্বীপ খুঁজছিলাম। নৌবাহিনী যে জলচিত্রণ (হাইড্রোগ্রাফিক) মানচিত্র দিয়েছিল তাতে আমরা ধামরা থেকে (ওড়িশা উপকূলে) দূরবর্তী বঙ্গোপসাগরের মধ্যে কিছু দ্বীপ দেখেছিলাম যা সেখানে কিছু ভূ-খণ্ডের অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। আমাদের টিমের ড. এস কে সালোয়ান এবং ড. ভি কে সারস্বত ধামরা থেকে একটা নৌকো ভাড়া করে দ্বীপের খোঁজে গিয়েছিলেন। মানচিত্রে এই দ্বীপগুলোকে লং হুইলার, কোকোনাট হুইলার এবং স্মল হুইলার নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। টিম একটা দিকনির্দেশক কম্পাস নিয়ে যাত্রাপথে এগিয়েছিল। তাঁরা তাঁদের রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং হুইলার দ্বীপ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সৌভাগ্যক্রমে কয়েকটা জেলে ডিঙির সঙ্গে তাঁদের দেখা হল। রাস্তার খোঁজ করাতে তারা বলেছিল, হুইলার দ্বীপ নামে তারা কিছু জানে না, তবে একটা দ্বীপ আছে যার নাম ‘চন্দ্রচূড়’, তাঁরা যে দ্বীপ খুঁজছেন হয়তো সেটাই সে দ্বীপ। জেলেদের পথনির্দেশ অনুসরণ করে টিমটি চন্দ্রচূড় দ্বীপে পৌঁছল, পরে জানা গেল ওই দ্বীপটি আসলে স্মল হুইলার আইল্যান্ড, রেঞ্জ অপারেশনের জন্য যার দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।
ওই দ্বীপকে কাজে লাগাতে আমাদের ওড়িশার আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণ জরুরি হয়ে ওঠে। সেসময় ক্ষমতাশালী জাতীয় নেতা বিজু পট্টনায়েক মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর দপ্তর থেকে নির্দেশ এল নানা কারণে দ্বীপাঞ্চলটি হাতে পাওয়া সম্ভব নয়। অতএব, আমাদের অনুরোধে একটা বৈঠকের ব্যবস্থা নেওয়া হল। আমরা মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে পৌঁছলে সমস্ত নথিপত্র তাঁর সামনে রাখলাম। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘কালাম আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি পাঁচটি দ্বীপই বিনা ব্যয়ে আমি আপনাকেই (ডিআরডিও)-কে দেব, অনুমোদনপত্রে স্বাক্ষর করার আগে আপনাকে কিন্তু একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে।’ তিনি আমার দুটি হাত ধরে বলেছিলেন, ‘আপনি অবশ্যই এমন এক উৎক্ষেপণ অস্ত্র তৈরি করুন যা আমাদের বিদেশি রাষ্ট্রের চোখরাঙানি থেকে রক্ষা করতে পারবে।’ আমি বলেছিলাম, ‘স্যার,অবশ্যই আমরা এ নিয়ে কাজ করব।’ তৎক্ষণাৎ আমি রক্ষামন্ত্রীকে জানিয়ে দিলাম। মুখ্যমন্ত্রী ফাইলে স্বাক্ষর করলেন এবং আমরা স্মল হুইলার দ্বীপ পেয়েছিলাম।
পাঠকগণ আপনারা হয়তো জানেন, ২০১২ সালের এপ্রিল মাসের ২৬ এপ্রিল ইসরো সাফল্যজনকভাবে ভারতের প্রথম RISAT-1 বা Radar Imaging Satellite উৎক্ষেপিত করে। উপগ্রহটি PSLV=C19 (Polar Satellite Launch Vehicle) চড়ে শ্রীহরিকোটা সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়। উপগ্রহটি কক্ষপথে প্রবিষ্ট করানোর পরে রিস্যাট-১র সি-ব্যান্ড কৃত্রিম র্যাডার যন্ত্রের সৌর প্যানেল এবং অ্যান্টেনা প্যানেল সাফল্যজনকভাবে নিয়োজিত হয়েছিল। আরও, চার কক্ষপথ উত্তোলনকারী কৌশল সরণির মধ্য দিয়ে মেরুপ্রদেশীয় সূর্য সমলয়িত কক্ষপথে উপগ্রহকে সফলভাবে বসানো হয়েছিল। গঙ্গোত্রী, ভূপালের মধ্য দিয়ে অতিক্রমকালে এবং উত্তর কর্নাটকের উচ্চমানের কিছু ছবি গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল, ২০১২ সালের ১ মে সেগুলোর বিশ্লেষণ করা হয়েছিল।
এই মিশন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিল। আমি এর দিকগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে বলব—
ORSS (optical remote sensing satellites)-এর মতো নয়, ভূপৃষ্ঠের ছবি তোলার জন্য রিস্যাট-১ এর SAR (Synthetic Aperture Radar) নিজে থেকেই নিজের বিকিরণ করে। এই প্রক্রিয়া বিনা সূর্যালোকে মেঘের স্তর ভেদ করে ছবি তুলতে সক্ষম। তাই এ যে-কোনও আবহাওয়া ও সূর্যালোকেই ছবি তোলে। রিস্যাট-১ বহুমুখী প্রক্রিয়া ও মেরুকরণ দ্বারা ছবির স্ফীতি এক থেকে পঞ্চাশ মিটার এবং প্রসার ব্যাপ্তি দশ থেকে ২২৩ কিমি পর্যন্ত সক্ষমতা-সহ ছবি তুলতে পারে। চিহ্নিতকরণ, শ্রেণিবিশ্লেষণ এবং জমির একর পরিমাপ নির্ধারণ দ্বারা খরিফ মরশুমে কৃষিক্ষেত্রে ধান চাষের মানচিত্র তৈরি করা রিস্যাট-১ এর এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ ছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বন্যা ও সাইক্লোন প্লাবিত এলাকার মানচিত্র তৈরি করে দুর্যোগ মোকাবিলা করা ও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করা হয়।
এ কেবলমাত্র আমাদের আত্মবিশ্বাস ও মহাকাশ ক্রিয়াকলাপের একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র দেয়। এ ছাড়া আরও অনেক কৃতিত্বের বিস্তারিত বিবরণ আমি দিতে পারি। যেমন এক আংশিক মেঘলা দিনে বেঙ্গালুরুতে নৌবাহিনীর বিকল্প এক জলযান এলসিএ (Light Combat Aircraft)-র পরীক্ষামূলক উড়ানের কথা। সাফল্যমণ্ডিত নৌবাহিনীর বিকল্প এই LCA উড়ান-এর মধ্যে দিয়ে ভারত বাছাই করা শ্রেষ্ঠ কতগুলি দেশের দলে প্রবেশ করল। যারা চতুর্থ প্রজন্মের জাহাজ বাহিত ফ্লাই বাই ওয়্যার ‘স্কি টেক অফ বাট অ্যারেস্টেড রিকভারি’ (Stobar) যুদ্ধ বিমানের নকশা, বিকাশ, নির্মাণ ও পরীক্ষা করতে সক্ষম। নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে এই নৌবিকল্প যান প্রথম পদক্ষেপ। এটা একবিংশ শতকের ভারতীয় নৌবাহিনীর নৌ-উড়ান শাখাকে এক অসাধারণ যুদ্ধ ক্ষমতা দেবে। এর অর্জিত গুণরাজি একাধিক নকশা তৈরির প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সাফল্যের প্রতিনিধিত্ব করে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও সম্প্রচার প্রযুক্তি মিলিত হয়ে তৈরি হয়েছে তথ্যসম্প্রচার প্রযুক্তি। তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে জৈবপ্রযুক্তিবিদ্যা যুক্ত হয়ে জৈব-তথ্যপ্রযুক্তি গড়ে উঠেছে। একইভাবে পরীক্ষাগারের বাইরে ফোটনবিদ্যা চিরন্তন বৈদ্যুতিন এবং অণুবৈদ্যুতিন বিদ্যার সঙ্গে মিশে উচ্চগতিসম্পন্ন ভোগ্যপণ্য বাজারে এসেছে। স্বচ্ছ পলিমারের ওপর ফিল্মের একটা পাতলা আস্তরণ ব্যবহার করে নমনীয় ও অভঙ্গুর প্রদর্শিত দ্রব্য বিনোদন ও প্রচার মাধ্যম জগতে একটা নতুন সংকেত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। এখন ন্যানোপ্রযুক্তি এসে গেছে। এটা ভবিষ্যতের চিকিৎসা, বৈদ্যুতিন এবং বস্তুবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সাংঘাতিক প্রয়োগক্ষমতা দ্বারা অণুবৈদ্যুতিন এবং আরও অনেক ক্ষেত্রকে অপসারিত করবে।
যখন অণুপ্রযুক্তি ও তথ্যসম্প্রচার প্রযুক্তি মিলিত হয়, সিলিকন ও বৈদ্যুতিন পরস্পরকে আলিঙ্গন করে, তখনই ফোটোনিক্স-এর জন্ম। বলা যায় যে বস্তুর অভিসরণ ঘটবে। অভিসৃত বস্তু ও জীবপ্রযুক্তি মিলে বুদ্ধিসম্পন্ন জীববিজ্ঞান নামে এক নতুন বিজ্ঞানের জন্ম হবে যা দীর্ঘজীবন ও সক্ষমতার সঙ্গে এক রোগমুক্ত সমাজের পথ দেখাবে।
বিজ্ঞানের এই অভিসরণ অভিযান বিনিময়যোগ্য। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক: সম্প্রতি আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছিলাম। সেখানে হার্ভার্ড স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স বিভাগের অনেক প্রখ্যাত অধ্যাপকের পরীক্ষাগার দেখেছি। আমার মনে পড়ছে কীভাবে প্রফেসর হংবুন পার্ক আমাকে তাঁর আবিষ্কৃত ন্যানোছুঁচ দেখিয়েছিলেন যা কোনও নির্দিষ্ট কোষকে বিদ্ধ করে তার ভেতরে সামগ্রী চালান করতে পারে। এভাবেই ন্যানো কণাবিজ্ঞান জীববিজ্ঞানের রূপ দিচ্ছে। এরপর আমি প্রফেসর বিনোদ মনোহরণের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে বোঝান কীভাবে জীববিজ্ঞান ন্যানো বস্তুবিজ্ঞানকে রূপ দিচ্ছে। স্ব-সংযুক্তি কণার নকশা করার জন্য তিনি ডিএনএ ব্যবহার করেছেন। যখন একটা নির্দিষ্ট ধরনের ডিএনএ আণবিক স্তরে কোনও একটা কণার ওপর প্রয়োগ করা হয়, তখন সেটা একটা পূর্বনির্ধারিত ধারায় এবং স্বয়ংক্রিয় সংযুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় তৈরি হতে সক্ষম হয়। মানবহস্তক্ষেপ ছাড়া মহাকাশে স্বয়ং-সংযুক্তি প্রক্রিয়াকরণ ও সংঘবদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যে এটা আমাদের জবাব হতে পারে যেমনটি স্বপ্ন দেখেছিলেন ড. কে এরিক ড্রেক্সলার। এভাবে একটা গবেষণা গড়ে ওঠার মধ্যে, আমি দেখেছি কীভাবে দুটো পৃথক বিজ্ঞান একে অপরকে গড়ে উঠতে সাহায্য করছে। বিজ্ঞানের এই একে অপরকে পারস্পরিক সহযোগিতা আমাদের ভবিষ্যৎ গঠনে এগিয়ে আসছে এবং আমাদের শিল্পকে এরজন্য প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রযুক্তি সংগঠনে যে বাধা রয়েছে তা দূর হবে এই ধরনের গবেষণার ফলে।
পরিশেষে, সারা বিশ্বে, প্রযুক্তিগতভাবে উৎকৃষ্ট, মজবুত ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকে চাহিদার অপসরণ হচ্ছে। এটা হল একবিংশ শতকের জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজের নতুন মাত্রা, যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং পরিবেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এভাবে নতুন যুগের আদর্শ হবে এক চতুর্মাত্রিক জৈব-ন্যানো-তথ্য-পরিবেশভিত্তিক, যার মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ সম্ভাবনা থাকবে।
.
আমি আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই, কীজন্য আপনাকে মনে রাখলে আপনি খুশি হবেন? সেটা আপনার লিখে ফেলা উচিত। হতে পারে উদ্ভাবন বা পরিবর্তনের মতো কোনও গুরুত্বপূর্ণ নিবেদনের দ্বারা আপনি সমাজে এমন কোনও পরিবর্তন আনলেন যার দরুন সমগ্র জাতি আপনাকে স্মরণ করবে।
৮. মোমবাতি ও মথ
৮. মোমবাতি ও মথ
বাতিদান ভিন্ন হতে পারে
আলোকশিখা কিন্তু একই,
পার্থিব আনন্দ তুমি পৃথিবীকেই ফিরিয়ে দাও,
তুমি আমার অন্তরস্থ আত্মায় থাকো।
১৯৯৯ সালের ১১ জানুয়ারি এয়ারবোর্ন সারভিল্যান্স মঞ্চ ভেঙে পড়া আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার ভিন্ন এক দিক, বিষাদের দিক তুলে ধরেছিল। বন্ধু অধ্যাপক অরুণ তিওয়ারির সঙ্গে আমার আলাপচারিতায় এই পরীক্ষানিরীক্ষা সম্পর্কে, যা পরিকল্পনা অনুযায়ী সাফল্য লাভ করেনি, আমার মনোভাব ফুটে উঠেছিল। যাঁরা এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের প্রতি এ আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
অরুণ তিওয়ারি (এ টি): জীবনের আবশ্যকীয় বিষয়গুলির সাধারণত অবস্থান্তর এবং ঐকান্তিক মুহূর্তে জেগে ওঠার প্রবণতা দেখা যায়। আত্মবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এদের সামনে নিয়ে আসা যায়। আত্মা যখন ভেতরে প্রবিষ্ট হয় এবং অহংবোধকে ছাপিয়ে যায় বিশেষত তখনই এর জাগরণ ঘটে। ফ্রাঞ্জ কাফকা এ-বিষয়ের ওপর তাঁর শ্রেষ্ঠ ও বিখ্যাত বই ‘মেটামরফোসিস’ লিখেছিলেন।
এ পি জে: আমি সেটা দেখতে পাই। এসএলভি ৩-এর প্রথম উড়ানের অসাফল্যের পরবর্তী পর্যায় এবং অগ্নির প্রথম পরীক্ষামূলক উড়ানের উৎক্ষেপণপূর্ব জটিলতা আমার নিজেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে আবিষ্কার করতে বাধ্য করে। কিন্তু ১৯৯৯-এর আরাকোনাম দুর্ঘটনা আমার কাছে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা, আমার অহং বোধের প্রতি যা করেছিল সেই পরিপ্রেক্ষিতেও।
এ টি: আপনি কখনও এই নিয়ে আলোচনা করেননি। কাজের সমুদ্রে আপনি যে বিশাল যন্ত্রণার হিমবাহ নিমজ্জিত রাখেন আমি তার চূড়াটুকুমাত্র দেখতে পাই—আপনি কি সেই দুঃখ আমার সঙ্গে ভাগ করে নেবেন?
এ পি জে: মনঃকষ্ট ভাগ করে নেওয়ার চাইতে এক বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টায় যে আটজন তরুণ তাঁদের জীবন উৎসর্গ করলেন তাঁদের আমি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। দেশের অবশ্যই এই প্রশংসিত নায়কদের সম্বন্ধে জানা উচিত। তাঁদের পরিবার যে যন্ত্রণাভোগ করেছে তা যেন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
এ টি: স্যার, আপনি কি ১৯৯৯ সালের ১১ জানুয়ারি এয়ার বোর্ন সার্ভেলেন্স মঞ্চের (এএসপি) দুর্ঘটনার কথা বলছেন?
এ পি জে: হ্যাঁ, এএসপি (Airborne Surveillance Platform) আরাকোনামের গভীর জঙ্গলে ভেঙে পড়েছিল।
এ টি: এই ঘটনাটি নিয়ে আমি একবার কে রামচন্দের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তিনি ছিলেন সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার। তিনি আমায় বলেছিলেন অ্যাভ্রো বিমানটি বায়ুবাহিত নজরদারিতে রোটোডোমের মতো চূড়ায় উত্তরণ করেছিল, বেলা দুটো নাগাদ উড়ান শুরু করে, ১০,০০০ ফিট ওপরে উঠে গিয়েছিল এবং চেন্নাই উপকূলের দিকে উড়ে চলেছিল। আরাকোনাম আর চেন্নাই-এর উপকূলের মধ্যে র্যাডার পরীক্ষা হয়েছিল। এই পরীক্ষামূলক মিশনে লক্ষ্য বিমান ছিল AN-32 বিমান, যা অ্যাভ্রো-র ১৫ মিনিট আগে উড়েছিল। র্যাডারের কার্যকারিতা সমুদ্র এবং ভূমি, উভয় অঞ্চলে পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিল। বিমানে কর্মরত মিশনের কর্মীদের উচ্চমানের কম্পাভূ বা VHF (very high frequency) যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেরিত র্যাডারের কার্যকারিতা রিপোর্ট অত্যন্ত ভাল ছিল। দেড় ঘণ্টা উড়ান পরীক্ষার পর লক্ষ্য বিমান আরাকোনামে বেলা ৪টে নাগাদ অবতরণ করে। পরবর্তীকালে এএসপি বিমানে তার গতিমুখ চেন্নাই থেকে আরাকোনামের দিকে স্থাপিত করেছিল এবং বিমান অবতরণ ক্ষেত্রে উচ্চতা ১০,০০০ ফিট থেকে ৫০০০ ফিটে নামিয়ে নিয়ে এসেছিল। যখন বিমানটি অবতরণক্ষেত্র থেকে ৫ নটিক্যাল মাইল দূরত্বে এবং উচ্চতা ৩০০০ ফিট থেকে ৫০০০ ফিট তখন রোটোডোম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিমানটি স্থিতিশীলতা হারিয়ে ফেলে এবং আটজন যাত্রী-সহ ধ্বংস হয়ে যায়।
এ পি জে: আমি তখন সাউথ ব্লকে আমার দপ্তরে প্রতিরক্ষা গবেষণা পরিষদের বৈঠকে ছিলাম, সেসময় আমাকে দুর্ঘটনার খবর দেওয়া হয়েছিল। তৎক্ষণাৎ আমি বেঙ্গালুরু ছুটে গেছিলাম শোকাতুর পরিবারের পাশে থাকার জন্য। বিমানবাহিনীর প্রধান এ ওয়াই টিপনিসও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অল্পবয়সি স্ত্রীদের আর্ত ক্রন্দন এবং বাবা-মায়েদের হতভম্ব অবস্থা দেখা আমার পক্ষে নিদারুণ অভিজ্ঞতা। এক মহিলা তাঁর শিশুসন্তানকে আমার কোলে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘এই নতুন প্রাণকে কে বাঁচিয়ে রাখবে?’ অন্য আর-একজন মহিলা বললেন, ‘কেন আপনি আমাদের সঙ্গে এরকম করলেন মি. কালাম?’
এ টি: রামচন্দ নিহত আধিকারিকদের তালিকা তৈরি করে আমায় দিয়েছিলেন—স্কোয়াড্রন লিডার পি ভেঙ্কটরামন বিমানটির চালক ছিলেন।
ইন্সট্রুমেন্টেশন ইঞ্জিনিয়ার পি ইলাঙ্গো এবং র্যাডার সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার কে পি শাহু— এঁরা তিনজনেই ক্যাবস (সেন্টার ফর এয়ারবোর্ন সিস্টেমস)-এর র্যাডার প্রসেসিং সায়েন্টিস্ট।
ডি নরসিংহস্বামী এবং সিগন্যাল প্রসেসিং সায়েন্টিস্ট আই জয়াকুমার ERDE (Electronics Research and Development Establishment)-এর এবং স্কোয়াড্রন লিডার এন ডি সেসু, আর ভাটনগর এবং এস রবি বিমানবাহিনীর অন্যান্য আধিকারিকগণ।
এ পি জে: কোনও অবশিষ্টাংশ খুঁজে পাওয়া যায়নি, পরিবারের সুবিধার্থে কর্তৃপক্ষ কফিন বানিয়ে কমিউনিটি কক্ষে রেখে দিয়েছিলেন।
এ টি: হায় ঈশ্বর!
এ পি জে: ওই সুতীব্র যন্ত্রণাময় মানসিক অবস্থায় আমায় যে বিদায়কালীন ভাষণ দিতে হয়েছিল তাতে আমি শুধুমাত্র কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করতে পেরেছিলাম।
এ টি: এই ঘটনা আমায় মনে করিয়ে দেয় পাঁচটি সন্তানহারা এক মায়ের উদ্দেশে লেখা আব্রাহাম লিঙ্কনের এক চিঠির কথা। ওই মায়ের পাঁচটি সন্তান গৃহযুদ্ধে বীরের মরণ আলিঙ্গন করেছিল।
‘আপনার অভাববোধের যন্ত্রণা এতটাই দুর্বহ যে, সেক্ষেত্রে আমার সান্ত্বনা বাক্যের যে-কোনও শব্দ যে কতটা দুর্বল ও নিষ্ফল হয়ে দাঁড়াবে তা আমি অনুভব করি। কিন্তু যে প্রজাতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে তারা মৃত্যুবরণ করেছে তারজন্য ধন্যবাদজ্ঞাপনের মধ্যে যে সান্ত্বনা আছে তা আপনার হৃদয়কে আর্দ্র করা থেকে আমি নিজেকে নিরস্ত করতে পারি না।
আমি প্রার্থনা করি স্বর্গীয় পিতা আপনার প্রিয় বিয়োগের নিদারুণ যন্ত্রণার তীব্রতা লাঘব করুন এবং আপনার হৃদয়ে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের মধুর স্মৃতি বজায় রাখুন এবং স্বাধীনতার বেদিতে যে অমূল্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার পবিত্র গর্ব অবশ্যই একান্ত আপনার।’
এ পি জে: বিধবা স্ত্রীদের বিলাপসূচক ক্রন্দনধ্বনি, নিশ্চল বাবা-মা, আমার কোলে এক নিষ্পাপ শিশু এবং প্রতীকী কফিনের সৎকারের স্মৃতি রাষ্ট্রপতি ভবনেও আমাকে তাড়া করে ফিরত। যে কয়েক জন মানুষ চারদিকে রাজনীতি ও সরকারি দপ্তরের রীতিনীতি সংক্রান্ত আচরণবিধির অধীনে চলেন তাঁরা কার্যক্ষেত্রে এবং গবেষণাগারে মানুষকে যে যন্ত্রণা এবং মর্মবেদনা ভোগ করতে হয় তা কি উপলব্ধি করতে পারেন?
এ টি: এর থেকে আপনি কী বার্তা দিতে চান?
এ পি জে: মোমবাতি হওয়ার ভান কোরো না, আলোক দ্বারা আকৃষ্ট মথ হও। সেবার মধ্যে যে শক্তি লুকিয়ে আছে তা জানো। দেখা যায় রাজনীতির বহিরাঙ্গের সঙ্গে আমরা জুড়ে যাই এবং তাকে রাষ্ট্র গড়ে ওঠা বলে ভুল করি। আত্মত্যাগ, পরিশ্রম এবং সাহসিকতা যে কদাচিৎ দেখা যায় বা দেখি, দেশ প্রকৃত অর্থে তা দিয়ে গড়ে ওঠে।
.
এয়ারবোর্ন সারভেল্যান্স মঞ্চ ভেঙে পড়া আমার জীবনের অন্যতম মর্মান্তিক ঘটনা। আমি যে কত গভীরভাবে বেদনার্ত ছিলাম এই কথোপকথনের বিস্তারিত বিবরণের মাধ্যমে তা প্রকাশিত। সেইসঙ্গে জটিল মিশনের উদ্যোগের ক্ষেত্রে এ যে এক দীর্ঘ কঠিন যাত্রা, কথোপকথন সে ইঙ্গিতও দেয়। কিন্তু এই ধরনের বিপর্যয় আমাদের দৃঢ় হতেও সাহায্য করে।