- বইয়ের নামঃ উত্তরণ : শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে
- লেখকের নামঃ এ পি জে আবদুল কালাম
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, প্রবন্ধ
উত্তরণ : শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে
০. গ্রন্থটি সম্পর্কে / প্রাক্কথন
গ্রন্থটি সম্পর্কে
২০০৭ সালের জুলাইয়ে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর ১০ রাজাজী মার্গ-এর যে-বাড়িতে ড. কালাম বাস করা শুরু করলেন, সেই বাড়িটি তাঁর চাহিদা পূরণ করেছিল সঠিকভাবেই। বাড়ির সামনে ও পিছনে ছিল বড় লন। তার চারধারে ছিল একটি পথ, যেখানে তিনি এক্সারসাইজ়ের প্রয়োজনে হাঁটতে পারতেন। এক-তলায় ছিল একটি আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা কক্ষ, যার সঙ্গে ছিল একটি কার্যালয়। সেখানে বসতেন তাঁর বিশ্বস্ত দুই সচিব, এইচ শেরিডন এবং আর কে প্রসাদ [R.K. Prasad]। প্যাসেজের ডানদিকে ঘুরলেই ছিল একটি বড় সিঁড়ি, যেটি মোড়া ছিল বহু ব্যবহারে ফিকে হয়ে যাওয়া নীল রঙের কার্পেটে। সিঁড়ির শেষে বাঁদিকে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত ঘরগুলি। সিঁড়ির সামনে ছিল আর একটি কার্যালয়, যার দরজা প্রায় সকল সময়েই অংশত থাকত খোলা। এখানে বসতেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারাল আর স্বামীনাথন, যিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি ভবনে এবং এখানেও তাঁর সামরিক প্রধান, এবং বসতেন আর এক সচিব ডি আর শর্মা।
রাষ্ট্রপতির কার্যভার ত্যাগ করার ঠিক আট বছর, ২০০৭ থেকে ২৭ জুলাই ২০১৫, তাঁর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত, এই কার্যালয়টিতেই তাঁর বহু চিন্তাধারার জন্ম হয়। এটি যেন, বলা যায়, হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর ভাবনাচিন্তার পরীক্ষাগার। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তাঁর যে-ভ্রমণসূচি ছিল পরিব্যাপ্ত, তা ২০০৭-এর পর হয়ে দাঁড়ায় আরও শ্রান্তিকর যেন। অসংখ্য সম্মেলনে তিনি ছিলেন মূল বক্তা; স্রোতোধারার মতো ছিল বিভিন্ন উদ্বোধন ও উন্মোচন অনুষ্ঠান, যার মধ্যে কিছু ছিল বইয়ের; এবং ছিল বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁদের রাজ্যকে কীভাবে উন্নয়নের দ্রুতগতির পথে চালিত করা যায়, সেই সংক্রান্ত তাঁর ক্রমান্বয় প্রেজ়েন্টেশন বৈঠক। এই বৈঠকগুলি থেকে একটি ধারণা বেরিয়ে আসত রাজ্যগুলির ক্ষমতা, তাদের সম্পদ এবং তাদের চাহিদার একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র। এবং প্রকাশ পেত এক গবেষকের অনুসন্ধিত্সা ও আশাবাদী মন। এ ছাড়া ছিল তাঁর নিজের লেখা বই, যার অনেকগুলি-ই বেস্ট-সেলার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল। তাঁর ভ্রমণগুলি, স্বল্প কথায় বলা যায়, ছিল নানান ধরনের। এবং সেগুলি সব সময়ে সহজ গন্তব্যের ছিল না, সরকারি গাড়িতে ভঙ্গুর পথে ছিল সেসব দীর্ঘ যাত্রা।
তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে এই উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে-র চিন্তাটি উঠে আসে। অসংখ্য সম্মেলন ও সেমিনারে হাজারও মানুষের সঙ্গে তাঁর সংযোগ স্থাপন হয়েছিল। এঁদের ভিতর ছিল ডাক্তার, নার্স, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, এবং পুলিশের নানান পেশাভিত্তিক সংগঠন ও সংস্থা। তাঁর কার্যপ্রণালীতে তিনি প্রায় একটি অভ্যাসের মতো করে নিয়েছিলেন যে, ওই সম্মেলনগুলিতে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিদের দিয়ে তাঁদের নিজ পেশার মূল্যবোধ, নীতি ও সম্মান রক্ষার্থে একটি করে শপথ পাঠ করিয়ে নেওয়া।
আমার মনে হয়েছিল যে, এই বিষয়গুলিকে যদি এক সময়হীন মর্যাদা দিয়ে একটি বইয়ের আকারে আনা যায়। বিভিন্ন মানুষের কাহিনি অথবা ঘটনার কথা এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা, যার থেকে দেখা যাবে প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে এই সব মানুষ তাঁদের পেশার সততা ও নিষ্ঠা কেমন করে ধরে রেখেছেন। মানুষকে তাঁর পেশার মূল্য এবং সেই পেশায় তাঁর ভূমিকার কথা এই লেখাগুলি যেন মনে করিয়ে দেবে। বিষয়গতভাবে উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যেমন, আমরা সন্দেহাতীত দক্ষতায় কোনও কঠিন প্রকল্প বা কাজ সমাধা করলেও সাধারণ কোনও কাজে আমরা অপারগ হই, অথবা কোনও কিছু গড়ে তুলে তার রক্ষণাবেক্ষণে আমরা বিচ্যুত হই।
তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী শিক্ষক কিন্তু কোনও আত্মম্ভরিতা বা আপাত নীতিমূলক কিছু তিনি ঘৃণা করতেন। কোনও ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ হত অবশ্যম্ভাবীভাবে বিনম্র। কোনও স্পর্শকাতর বিষয়ে তিনি তাঁর অভিমত দিতেন কিন্তু কাউকে আঘাত না করে। আমি প্রায়ই এই বিষয়টি লক্ষ করেছি, যখন এই প্রকল্পটির বিষয়ে আলোচনা চলছে, এবং আমরা বিভিন্ন কাহিনি ও সূত্র একত্র করছি। ওঁর লেখায় সাহায্য করবে এমন কিছু প্রাসঙ্গিক বই আমি ওঁকে দিই। আমি যখনই বিগত দিনের গরিমাকে আগামী দিনের উৎসাহ হিসেবে উল্লেখ করতে পরামর্শ দিয়েছি, তিনি তা নিতে চাননি। তিনি মনে করতেন, বিগত দিন আজ অতিবাহিত। তার গৌরব সেই সময়ের ও পরিস্থিতির ফসল। আজকের সংকট ভিন্ন এবং তা অনেকগুণ বড়। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলতেন, ভারতের আজকের জনসংখ্যা একশো কোটির অনেক ওপরে। বিগত দিনের গরিমার কথা ভেবে তাই বর্তমানের সংকট কাটবে না। ভবিষ্যৎ বা আগামী দিনই তাঁকে উত্তেজিত করত।
উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে-র মূল ভাবনাটি অত্যন্ত সরল— আইন, নিয়ম ও মূল্যবোধ উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তারা হবে আমাদের নিজস্ব নীতিবোধের অংশ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন থাকতে পারে, কিন্তু কোনও আইন-ই যাবতীয় দুর্নীতির কেস ধরে দিতে পারে না। অথবা আর একটি দৃষ্টান্ত, রুগির পরিচর্যা সুষ্ঠুভাবে করতে একজন ডাক্তারকে কোনও আইন বাধ্য করতে পারে? বিশেষত, যখন সেই ডাক্তার টাকা রোজগারের জন্য তার রুগির কাছ থেকে ফি আদায় করে, আর বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে বাধ্য করে যার কোনও প্রয়োজনই নেই? পরিশেষে এই দাঁড়ায় যে, প্রত্যেকের নীতিবোধই স্থির করে দেবে তার নিজস্ব ব্যবহার-রীতি। শপথগুলি হবে তাই তার চটজলদি নির্দেশিকা আর অনুস্মারক।
একটি রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও সুখের একটি বিশিষ্ট সূত্র হল তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে সুদৃঢ় করে এই সমৃদ্ধি। তবে, ব্যক্তির মতোই রাষ্ট্রকেও যেতে হয় কঠিন সময়ের ভিতর দিয়ে। সেই কঠিন সময়ে কী ঘটতে থাকে এবং রাষ্ট্র কীভাবে তার মোকাবিলা করে, তাও উন্নয়নের একটি উত্তম মাপকাঠি। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শক্তির উপর গুরুত্ব দিলেই কি আমাদের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব? সত্যিকারের নিরন্তর ধরে রাখা উন্নতির পথ হবে সেইটি, যেটিতে রাষ্ট্র তার শৃঙ্খলাপরায়ণতা বজায় রেখেও কঠিন সময়কে উত্তীর্ণ করে যাবে। সেখানে ব্যক্তি, সাধারণ মানুষের জন্য শুভ চিন্তা করবেন আর তাঁর সহ-দেশবাসীকে দেবেন তাঁদের প্রাপ্য সম্মান।
বই প্রকাশের এই প্রকল্পের কাজটি অগ্রসর হতে থাকে, আর সময় সময়ে এই সব বিষয়ে আলোচনা চলতে থাকে। একটি সংশোধিত খসড়া জমা দিয়ে তিনি জানালেন, তাঁর কাজ তিনি করে দিয়েছেন। ২০১৫ সালের ১১ জুলাই আমাদের শেষ সাক্ষাত্কারে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, বইটি মেজর জেনারাল আর স্বামীনাথনকে, যিনি ২০১৩-তে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন বহু বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা সহায়তাকারী, উৎসর্গ করা হবে। আমি সেইদিন যখন বেরিয়ে আসছি, ড. কালাম বললেন, ‘তা হলে আমরা এইটি করবই।’ ২৭ জুলাই আমি যখন তাঁর শিলং থেকে ফেরার পর একটা সাক্ষাত্কার চেয়ে যোগাযোগ করলাম, শ্রীশর্মা, যিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট-এ বক্তৃতার জন্য তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন, আমাকে জানালেন যে, তিনি অসুস্থ। সেই সন্ধ্যায় টিভিতে দুঃখজনক সংবাদটি সম্প্রচারিত হল।
অন্য অনেকগুলি বই তাঁর প্রকাশিত হয়েছে যখন উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে নির্মিত হচ্ছিল। সংশোধিত পাণ্ডুলিপিটি আমাকে দেওয়ার কয়েক মাস পর তিনি সৃজন পাল সিংহ-র সহযোগে লেখা আর-একটি পাণ্ডুলিপি, Advantage India, দেন, যা অক্টোবর ২০১৫-তে প্রকাশিত হয়। উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে তার পূর্বেই লেখা কিন্তু প্রকাশিত হতে সময় লেগে যায়। কারণ, তাঁর সঙ্গে বসে বইটির রিভিউয়ের কাজ চলছিল যখন তিনি মারা যান। এই বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেছে। আমাদের বিচারে বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে— ছাত্র থেকে গৃহী থেকে নেতা, যাঁরা বইটি থেকে গ্রহণ করতে পারবেন অনেক কিছু এবং দিতেও পারবেন— তাঁদের ভেতরে এই বইয়ের প্রচার ব্যাপক আকারে হওয়া বাঞ্ছনীয়। ড. কালামের একটি প্রিয় উক্তি ছিল: ক্ষুদ্র লক্ষ্য একটি অপরাধ। উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে-তে এই কথাই তিনি জোরের সঙ্গে আবারও বলেছেন এবং আমাদের জন্য মানাঙ্কটি বাড়িয়ে এ বইয়ের একটি মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে গিয়েছেন যা বলা যেতে পারে চিরন্তন। এই বই যে ভিন্নতা এনে দেয় তা দেখে তিনি অফুরান আনন্দ পেতেন অবশ্যই।
সম্পাদক
ফেব্রুয়ারি ২০১৭
.
প্রাক্কথন
বন্ধুগণ, যে বইটি আজ আপনারা ধরে আছেন আপনাদের হাতে, সেটি আমার এককভাবে বা কোনও সহলেখকের সঙ্গে লেখা পঁয়ত্রিশতম বই। আমার লেখা এর মধ্যে অনেকগুলি বই-ই বেস্ট-সেলার তালিকায় এসেছে। তাদের মধ্যে দু’টি, Ignited Minds আর Wings of Fire, দশ লক্ষেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু, আমি প্রায়ই নিজেকে প্রশ্ন করি, এই বইগুলির মাধ্যমে আমি কোন বার্তা পৌঁছিয়ে দিতে চাইছি। আমাদের রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে কী করে উন্নতি করবে, অথবা ভারতের তরুণ সমাজের সামনে তাদের আদর্শ পথ কোনটি, বা আমাদের দেশের জীবনালেখ্যের কিছু ঘটনা, এই সব নিয়েই আমি এতদিন লিখেছি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে আমি যেন কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ রেখে গিয়েছি।
এই উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে-র পিছনের ভাবনাটি হল, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নতি একটি দেশকে সর্বোত্তম করে তুলতে পারে না। সবার আগে প্রয়োজন একটি জাতীয় চরিত্রের নির্মাণ, যা জন্ম নিতে পারে আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ, স্কুলের শিক্ষা, আর দেশের সংস্কৃতি থেকে। একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলি বিষয়টা। একবার আমি ভুবনেশ্বর থেকে নয়া দিল্লি আসছি উড়ানে। উড়ানটিতে অর্ধেকের বেশি যাত্রী ছিলেন বিদেশি ভ্রমণার্থী। যাত্রা শুরুর কিছু পরে আমি শৌচালয়ে যাই। তার ঠিক পূর্বেই এক বিদেশি সেখান থেকে বেরোলেন। আমি ঢুকে দেখলাম বেসিন আর টয়লেটটি একেবারে পরিচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছে। আমি আমার নিজের বহু দেশবাসীর কাছেই শৌচালয়কে এমন পরিচ্ছন্ন রাখার অভ্যাস দেখতে পাইনি। এই ধরনের অভ্যাসই জাতীয় চরিত্রের প্রতিফলন।
আমি প্রায়ই চিন্তা করি আমাদের জাতীয় চরিত্র গঠনের জন্য ঠিক কীসের প্রয়োজন। যাবতীয় পরিকল্পনা, বিনিয়োগ আর প্রকল্পগুলি যে স্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যের দিকে এগোয়, তার শেষ ধাপটি অতিক্রম করতে কীসের প্রয়োজন আমাদের সব থেকে বেশি? আমি মনে করি প্রগতি আর উন্নয়ন, সামগ্রিক ছবিটার একটি অংশ মাত্র। এক ব্যক্তিমানুষের মতো, রাষ্ট্রকেও শিখে নিতে হয় কী করে কঠিন সময়েও নিজের অস্তিত্ব বহাল রাখতে হয়। এক ইতিবাচক দৃষ্টির ভারসাম্যকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে কী করে স্থিত রাখতে হয়। শিখে নিতে হয় কী ভাবে অন্যের সঙ্গে কাজ করে যেতে হয়। যে সব রাষ্ট্রে সমাজ বিবর্তিত হয়েছে, যাদের রয়েছে এক সুগভীর সাংস্কৃতিক শিকড়, যাদের আছে কার্যকরী শাসনব্যবস্থা ও তার সঙ্গে সুষ্ঠু আইন ও প্রশাসন, এবং যে সব রাষ্ট্রে ছেলেমেয়েদের ভিতর প্রোথিত করা হয় চিরস্থায়ী পারিবারিক মূল্যবোধ, সেই রাষ্ট্রগুলি একে অপরের সংযোগে তৈরি করে এক জনজাতি যারা সেই লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে যায়। প্রত্যেক নাগরিক তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে সমগ্র দেশের মানকে বৃদ্ধি করে।
আমরা এক অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে বাস করছি। এই পরিবর্তন ঘটানোর পিছনে সর্বাগ্রে আছে প্রযুক্তির উন্নতি। এই উন্নতি এতটাই দ্রুতগতিতে হয়ে চলেছে যে, যারা তার সঙ্গে তাল মেলাতে অক্ষম, তারা পড়ে থাকছে কয়েক দশক নয়, কয়েক শতক পিছনে। আমাদের সমাজের পরিবর্তনের আর একটি কারণ প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে নগরায়ণ। আমাদের চতুর্দিকে মানুষের আকাঙ্ক্ষা আজ ঊর্ধ্বমুখী। তাঁরা সকলেই রয়েছেন কর্মসন্ধানে, কিন্তু কর্মসংস্থানের এই কঠিন সময়ে তাঁদের সকলের ভাগ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হয়তো নেই। আমাদের মতো দেশে সামাজিক বুনটকে ধরে রাখতে প্রাচীন সংস্কৃতি হয়তো একমাত্র উপায় নয়। আমাদের সকল দেশবাসী— ধনী বা গরিব, তরুণ বা বয়োজ্যেষ্ঠ, সুস্থ বা অসুস্থ— সকলের জন্য সম্মানীয়, নিশ্চিন্ত জীবন পাইয়ে দেওয়ার জন্য অতিক্রিয়াশীল হয়ে আমাদের সকলের একটা চেষ্টার প্রয়োজন।
বহু ক্ষেত্রেই ভারত বিরাট উন্নতি করেছে। তাকে অর্থনৈতিকভাবে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হতে আর শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু এই-ই কী সব? না, কখনও নয়। কারণ, জীবনযাপনের মান বাড়াতে এখনও অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে আমাদের। তাই এই বই যেন উন্নত মানবজীবনের এক ম্যানিফেস্টো, এক ঘোষণাপত্র। এখানে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি কোন কোন গুণে একটি দেশ মহান হয়ে ওঠে। জীবনযাপনের মানের ভিত্তিতে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করেছি। দেশে এবং দেশের বাইরে আমার বিভিন্ন ভ্রমণগুলি থেকে, আমার রীতি অনুযায়ী, আমি নিয়েছি বিভিন্ন সূত্র। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা মানুষজনের সঙ্গে আমার সংযোগ থেকেও নিয়েছি বহু সূত্র। এবং আমি এখানে আমার পর্যবেক্ষণ তুলে দিয়েছি, কী করে প্রত্যেক সাধারণ ভারতীয়র জীবন এক সম্মানীয়, কার্যকরী, এবং সবার উপরে এক ঐশ্বরিক জীবনে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।
ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, সিভিল সার্ভেন্ট, আর চিকিৎসাশাস্ত্র সংক্রান্ত পেশাদারদের জন্য আমি কয়েকটি অনন্য শপথবাক্য রচনা করেছি, যাতে ওই উন্নততর মানবজীবন সকলের জন্য সম্ভব হয়। আমি সকল অভিভাবককে অনুরোধ করছি এই বইটি পাঠ করে, এর বার্তাটি আপন আপন সন্তানদের কাছে পৌঁছিয়ে দিন। শিক্ষকদেরও অনুরোধ করছি বইটি পড়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা করতে। সাংসদদের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন বইটি পড়ে সংসদে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তার কথা প্রচার করেন।
উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে নির্মিত হচ্ছিল। আমি আশা করি, যে-পাঠগুলি আমি চেষ্টা করেছি এখানে দিতে, সেগুলি আমাদের রাষ্ট্রকে পরিবর্তনের ধাক্কাকে সামলে নিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে মহানত্বের পথের দিশা দেখাবে।
এ পি জে আবদুল কালাম
মার্চ ২০১৫
১. টুকরো মন্তব্য
পর্ব ১ : টুকরো মন্তব্য
এক
একটি রাষ্ট্র কোন গুণে মহান?
একটি রাষ্ট্র কীসে বা কোন গুণে মহান হয়, সেই আলোচনায় যাবার আগে আমি মানব বিবর্তনের গবেষণায় যে অগ্রগতি হয়েছে, তার কথা কিছু বলতে চাই। এই বিষয়টি বুঝতে চিরাচরিতভাবে দু’টি পথে এগোনো হয়। প্রথমটি হল পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যমে। মহেঞ্জো-দারো আর হরপ্পা বা পৃথিবীর অন্যত্র ওই ধরনের অন্যান্য খনন প্রক্রিয়ায় উঠে আসা প্রমাণগুলি এই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বহু ধরনের সভ্যতার যাপনচিত্র, তাদের সংস্কৃতি এবং ব্যুত্পত্তির হদিশ দিয়েছে তারা।
দ্বিতীয় এবং সাম্প্রতিকতম পথটি চালিত হয়েছে মানব জিনোম বিষয়ে আমাদের উন্নততর জ্ঞানের সাহায্যে। মানুষের জিনের ক্রমের বৃহদাংশ সকল মানুষেই এক, স্বল্পাংশে শুধু দেখা যায় পার্থক্য। এই পার্থক্যর ফলেই মানুষের মধ্যে আমরা দেখতে পাই এত বৈচিত্র্য। দক্ষিণ আফ্রিকার অধ্যাপক ফিলিপ টোবিয়াস (১৯২৫-২০১২) ছিলেন জিনতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের এক পুরোধা পুরুষ, যিনি আমাদের এই কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাসকে জানতে সাহায্য করেছেন। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের গবেষণার নতুন পথ দেখিয়েছে তাঁর কর্মকাণ্ড।
২০০৫ সালের এপ্রিলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি (এনজিএস), ইন্টারন্যাশনাল বিজ়নেস মেশিনস (আইবিএম) এবং ওয়েট ফাউনডেশন (একটি মার্কিন সংস্থা যারা সমুদ্রের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধারের কাজে নিযুক্ত), সম্মিলিতভাবে ‘জিনিয়োগ্রাফিক প্রোজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে। এর লক্ষ্য, জিনগত নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়নের জন্য সারা বিশ্বের কয়েক লক্ষ মানুষের ডিএনএ-র নমুনা সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করে ইতিহাসে যত মানব অভিবাসন হয়েছে, তার একটি মানচিত্র নির্মাণ করা। মাদুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর এম পিচাপ্পান এই প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর সঙ্গে আমার আলোচনা আমার কাছে ছিল এক চিন্তা-উদ্রেককারী অভিজ্ঞতা।
ভবিষ্যতে কোনও একদিন হয়তো, ‘একটি রাষ্ট্র কোন গুণে মহান?’-এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ওই মানব জিনে-ই। আপাতত এইটুকু বলা যায় যে, দেশের জনসাধারণ রাষ্ট্রর থেকে মহান। তাঁদের মননশীল নেতৃত্ব, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অংশীদারির গৌরব, এবং তাঁদের দূরদৃষ্টি— এই সবকিছু মিলিয়ে তাঁরা তাঁদের রাষ্ট্রকে করে তোলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।
মহাত্মা গাঁধী, ড. নেলসন ম্যান্ডেলা ও তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকা
কিছু বছর আগে আমার এক অনন্য অভিজ্ঞতা আমাকে দেখিয়ে দিল যে, এক বিপুল জনজাতিকে কীভাবে একটি মানুষ উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। দিল্লিতে হঠাৎ-ই আমার সুযোগ হল মহাত্মা গাঁধীর প্রপৌত্রী, শ্রীমতি সুমিত্রা গাঁধী কুলকার্নির সঙ্গে সাক্ষাতের। তিনি তাঁর পিতামহ, যাঁকে তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, তাঁর বিষয়ে একটি ঘটনার কথা আমাকে শোনালেন।
গাঁধীজি প্রতি সন্ধ্যায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর প্রার্থনাসভাটি করতেন। প্রার্থনার শেষে হরিজন উন্নয়নের জন্য দান সংগ্রহ করা হত। তাঁর সহকারীরা প্রতিদিন তা গুনে রাখতেন এবং তাঁর রাতের আহারের আগে তাঁকে মোট অঙ্কটি জানিয়ে দেওয়া হত। পরের দিন ব্যাঙ্কের আধিকারিক এসে তা ব্যাঙ্কে নিয়ে যেতেন। একদিন আধিকারিকটি জানালেন যে, সংগৃহীত অর্থ এবং তাঁকে যে টাকা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে কয়েক পয়সার গরমিল রয়েছে। পার্থক্যটি নেহাতই ক্ষুদ্র অঙ্কের। কিন্তু গাঁধীজি জোর দিয়ে বললেন যে, সংগৃহীত অর্থ যেহেতু গরিবদের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তাই তার প্রতিটি পয়সার সঠিক হিসেব থাকা প্রয়োজন। এমনই ছিল গাঁধীজির নৈতিক সততার পথ। সেই পথেই তিনি সমগ্র দেশবাসীকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন মহত্ত্বের অভিমুখে। তাঁর উদাহরণ মেনে আমাদের প্রত্যেকের উচিত আমাদের চিন্তায় ও কাজে এই নৈতিক সততার অভ্যাস করা।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৪ সালে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের একটি প্রাচীন ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় আমার ভ্রমণের একটি বৃত্তান্ত আমি এখানে বর্ণনা করব। একের পর এক স্টেশন পার হয়ে ট্রেনটি ঝিকঝিক করে এগোতে লাগল; আর অবিচারের বিরুদ্ধে সেই দেশে গাঁধীজির সংগ্রামের কথা আমার মনে পড়তে থাকল। আমি পিয়েটারমারিটসবার্গ স্টেশনে, যেখানে নামলাম, সেইখানেই গাঁধীজিকে তাঁর চামড়ার বর্ণের জন্য প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। দেখলাম, সেখানে তাঁকে স্মরণ করে একটি স্মৃতিফলক:
এই ফলকের কাছেই কোনও স্থানে
এম কে গাঁধীকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল
একটি প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে
৭ জুন ১৮৯৩ রাত্রে।
এই ঘটনা তাঁর জীবনের ধারাকে
পরিবর্তিত করে দিয়েছিল।
তিনি বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে
লড়াই শুরু করেন।
তাঁর সক্রিয় অহিংস্রতার
শুরু এই দিনটি থেকে।
সেখানে দাঁড়িয়ে আমার মন চলে গেল দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার দু’টি পূর্ব অভিজ্ঞতার স্মৃতিতে। একটি হল রোবেন দ্বীপে, যেখানে ড. নেলসন ম্যান্ডেলাকে সাতাশ বছর একটা ছোট্ট কুঠুরিতে অন্তরিন করে রাখা হয়েছিল। অন্যটি ড. ম্যান্ডেলার বাড়িতে।
টেবল পর্বতের জন্য কেপ টাউন খুবই বিখ্যাত। এই পর্বতমালার তিনটি শিখর— টেবল পিক, ডেভিল পিক আর ফেক পিক। শিখরগুলি দেখতে ভারী সুন্দর লাগে। সারাদিন ধূসর আর সাদা মেঘ এক একটি শিখরকে যেন আলিঙ্গন করে শিখরগুলির মধ্য দিয়ে উড়ে বেড়ায়। টেবল পিকটি সমুদ্রতটের সব থেকে কাছের শিখর। সেখান থেকে দশ মিনিটে আমি রোবেন দ্বীপে পৌঁছে যাই হেলিকপ্টারে। সমুদ্রর গর্জন বাদে সেই দ্বীপ একেবারে শান্ত, নিশ্চুপ। এইখানেই ব্যক্তির স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছিল।
বিস্মিত হতে হয় ড. ম্যান্ডেলার কুঠুরিটির পরিমাপ দেখে। এক ছ’ফুট দীর্ঘ মানুষের পক্ষে সাতাশ বছর ধরে ওই ক্ষুদ্র কুঠুরিতে শোয়া-থাকার কথা ভাবা যায় না। প্রতিদিন প্রখর সূর্যের আলোয় কয়েক ঘণ্টার জন্য তাঁকে নিকটবর্তী পাহাড়ে খনন কাজে নিয়ে যাওয়া হত। এই সময়েই তাঁর দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি হয়। কিন্তু শারীরিকভাবে নির্যাতিত হলেও, তাঁর অন্তরাত্মা ছিল অজেয়। ওয়ার্ডেন শুয়ে পড়লে, তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষরে লিখে যেতেন তাঁর পাণ্ডুলিপি, যা পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয় একটি বিখ্যাত গ্রন্থের আকারে, Long Walk to Freedom.
জোহানেসবার্গে তাঁর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল আমার কাছে এক বিরাট ঘটনা। ছিয়াশি বছরের মানুষটি হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাকে কী অসাধারণ অভ্যর্থনা জানালেন। বিদায়ের সময়ে তিনি আমাকে এগিয়ে দিতে পোর্টিকো পর্যন্ত এলেন। তাঁর হাতের লাঠিটি তিনি পরিত্যাগ করে আমাকে ভর করে হাঁটলেন। আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘ড. ম্যান্ডেলা, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী আন্দোলনের মুখ্য ব্যক্তিরা কারা ছিলেন?’
তাঁর তাত্ক্ষণিক উত্তর, ‘অবশ্যই দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন এম কে গাঁধী। ভারত আমাদের এম কে গাঁধীকে দিয়েছিল, আর দু’দশক পর আমরা ভারতকে ফিরিয়ে দিলাম মহাত্মা গাঁধীকে।’ ভারতের ঐতিহ্যই তো তাই। আমরা যে দেশেই গিয়েছি আমরা তাদের সাহায্য করেছি— অর্থনৈতিকভাবেই শুধু নয়, জ্ঞান, শ্রম, এবং সর্বোপরি মান ও সম্মান দিয়ে।
ড. ম্যান্ডেলা যখন দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি হলেন, তিনি তাঁর দেশবাসীকে, যারা তাঁর সঙ্গে অসদাচরণ করেছিল, সাতাশ বছর অন্তরিন করে রেখেছিল, তাদের তিনি দিলেন স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সমঅধিকার। সুপ্রিয় বন্ধুগণ, ২২০০ বছর আগে কবি-সন্ন্যাসী তিরুভাল্লুভারের লেখা তিরুক্কুরালের দু’টি চরণ, ড. ম্যান্ডেলার কাছে প্রাপ্ত শিক্ষার যেন প্রতিফলন:
এর অর্থ, যারা তোমার সঙ্গে অসদাচরণ করবে, তাদের সঙ্গে তুমি সু-আচরণ করো। রাজনৈতিক দুই নেতা, মহাত্মা গাঁধী এবং ড. নেলসন ম্যান্ডেলা, পৃথিবীর এক ষষ্ঠাংশ জনসংখ্যার যথাক্রমে, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁদের দেখানো পথে অন্য বহু রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে শামিল হয়েছে।
ইউরোপ
এবার আমরা ইউরোপের দিকে তাকাই এবং খুঁজে নিই শ্রেষ্ঠত্বের কোন পাঠ আমরা তাদের কাছ থেকে পেতে পারি।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে ইউরোপীয় সভ্যতার একটি অনন্য স্থান আছে। সেখানকার মানুষেরাই এই গ্রহকে প্রথম অন্বেষণ করে বেড়িয়েছে। তারাই শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী চিন্তাভাবনার জন্ম দিয়ে তাদের উন্নতিসাধন করেছে। কিন্তু অন্যদিকে এই ভূখণ্ডেই সেখানকার বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত হয়েছে শয়ে শয়ে বছর ধরে, যার মধ্যে আছে গত শতকের দু’টি বিশ্বযুদ্ধ।
এতত্সত্ত্বেও, তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) প্রতিষ্ঠা করল। লক্ষ্য, সমগ্র অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট সব রাষ্ট্রের মধ্যে সংযোগের উদাহরণ হয়ে আছে। তেমনই সম্ভবত, রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা নিষ্ক্রান্ত করেছে এবং ওই অঞ্চলে এক চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের নিদর্শন হয়ে আছে, এই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। পরস্পরের একান্ত নিজস্ব দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে একটি স্থিতিশীল শান্তির পরিবেশ রচনার এই ধরনের আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ইইউ যেন এক পথপ্রদর্শক। বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির উচিত ইইউ-র মতো আঞ্চলিক সহযোগিতাকে বৃদ্ধি করে এক উন্নততর স্থায়ী বিশ্বশান্তির পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা।
সিঙ্গাপুর
আবার অন্যদিকে আছে একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর। এটি এমন একটি দেশ যার নিজস্ব কোনও প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, তার জনসাধারণ ছাড়া। এই জনসাধারণই তাঁদের জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে দেশটিকে করে তুলেছেন অর্থনৈতিকভাবে এক উন্নত রাষ্ট্র। দেশের নেতৃবৃন্দের ভিতরেও জনগণের এই গুণগুলি বর্তমান। তাঁরা সততা ও আত্মনিয়োগের প্রতিমূর্তি। লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, ১৯৫৯ থেকে ১৯৯০। তাঁর মননশীল নেতৃত্বে সিঙ্গাপুরকে তিনি করে তুলেছেন এক মহান বহুসংস্কৃতির সংহত রাষ্ট্র, যার লক্ষ্য ছিল একটিই— সিঙ্গাপুরই। তাঁর নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর হয়ে উঠল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এক রাষ্ট্র, যার সংস্কৃতি তার নাগরিকদের করে তুলল তাঁদের দেশ সম্পর্কে গর্বিত এবং দেশের আইনকে মান্যতা দিয়ে তাঁরা নিজেদের যাপনকে করে তুললেন সুস্থির।
ইউনাইটেড স্টেটস অফ অ্যামেরিকা
জ্ঞানত মাত্র ২৫০ বছরের দেশ এই ইউনাইটেড স্টেটস অফ অ্যামেরিকা (ইউএস)। কিন্তু এদের থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। ধরা যাক, তাদের গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা অথবা প্রাকৃতিক বা অর্থনৈতিক বা অন্যান্য প্রতিকূলতাকে যুঝে তাদের সমাধান করার ক্ষমতা। মার্কিন দৃষ্টিকোণ ও স্বপ্ন আজ তার দেশের জনগণের জন্যই বিশ্বময় একটি বহুল প্রচারিত ও আলোচিত ধারণা। সেখানে প্রত্যেক দেশবাসী চান অ্যামেরিকা বিশ্বে একনম্বর রাষ্ট্র হবে। এই ভাবধারাই ইউএস-কে প্রতিনিয়ত করে তুলছে উন্নত। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, শিল্প— সকল ক্ষেত্রেই তারা নেতৃত্ব প্রদানে এগিয়ে।
মহান নেতারা কীভাবে একটি মহান রাষ্ট্রের জন্ম দেন, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই ইউএস। স্বপ্নদর্শী কিছু পুরুষ ও মহিলা একটি রাষ্ট্রকে দিয়েছেন তার দিশা এবং জুগিয়েছেন তার স্থায়িত্ব। থমাস জেফারসন এবং জর্জ ওয়াশিংটন ইউএস-কে দিয়েছিলেন তার শক্তপোক্ত গণতান্ত্রিক বুনিয়াদ। আব্রাহাম লিঙ্কন তাঁর জীবনকে বাজি রেখে উচ্ছেদ করলেন দাসপ্রথা। ড. ম্যান্ডেলা যদি মহাত্মা গাঁধীর পথ অনুসরণ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় জাতি-বর্ণ-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করে থাকেন, তো ইউএস-এ গাঁধীজির অনুপ্রেরণায়ই ওই একই পথে হেঁটেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ারের মতো নেতৃবৃন্দ। এমনই সব মহান নেতারা তাঁদের কাজের মাধ্যমে তাঁদের দেশকে করে তুলেছিলেন মহিমান্বিত। তাঁদের হত্যাকাণ্ডর ঘটনাগুলি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্বাধীনতা ও ন্যায়ের সংগ্রামকে দৃঢ়তর করেছে।
ভারত
পরিশেষে আসা যাক ভারতের কথায়। ভারত ও ইউএস-এর মধ্যে কিছু মিল পাওয়া যায়, বহু পার্থক্য সত্ত্বেও। আবার অন্যদিকে, ভারতীয় সভ্যতা কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন। তেমনই, ভারতে বিভিন্ন ভিনদেশের আগ্রাসন হয়েছে, তার আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য। ইউএস-এর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। কিন্তু, দুই রাষ্ট্রই আজ আধুনিক, বহুসংস্কৃতির, বহুধর্মের, বহুভাষার দুই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী পৃথিবীর বিভিন্ন রাজবংশ ভারতে তাদের শাসন কায়েম করে গিয়েছে । কিন্তু এই বিদেশি আক্রমণকারীরা ভারতবর্ষের ইথস বা যাকে বলা যায় মূল ধারণাকে তাদের মধ্যে আহরণ করে নিয়েছে। আর ভারত ভিন্ন সভ্যতার গুণগুলিকে নিজের মধ্যে আত্মীকরণ করে নিয়েছে। সে বহু হিংস্রতা প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু আজ সে অহিংসার পুণ্যভূমি। একটি মানুষ তা তিনি সম্রাট অশোকই হোন বা মহাত্মা গাঁধীই হোন, তাঁদের মননশীল নেতৃত্ব আমাদের জাতীয় চরিত্রের উপর প্রভাব ফেলে।
বহুভাবেই ভারত আজ এক মহান রাষ্ট্র। যেসব রাষ্ট্রর কথা উল্লিখিত হল তাদের সঙ্গে সমপর্যায়ে উচ্চারিত হতে পারে তার নাম। সারা বিশ্ব তার প্রগাঢ় সমৃদ্ধশালী সভ্যতাকে শ্রদ্ধা করে। অনুপ্রাণিত করবার মতো বহু নেতা আজ বর্তমান। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন ও শিল্পে বহু মহান মানুষের জন্ম হয়েছে এই দেশে। কিন্তু একবিংশ শতকে ভারতকে সার্বিকভাবে এক মহান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এখনও কিছু পথ চলার বাকি আছে।
সেই শ্রেষ্ঠত্বের পথটি কিছু মৌলিকতার সাহায্যে শুরু হয়।
.
দুই : মূলের দিকে ফেরা
ভারতের বহু গ্রাম, নগর ও শহরের রাস্তায় আমি হেঁটে ঘুরেছি। প্রায় কুড়িটির মতো যে-সব দেশে আমি ভ্রমণ করেছি, সেখানেও আমি হেঁটেছি বেশ কিছু পথ। অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের একটি পার্থক্য হল, অন্য দেশের চাইতে আমাদের দেশের মানুষ অনেক বেশি পদসঞ্চারণ করেন। আর একটি পার্থক্য হল, অন্য দেশের নাগরিক তাঁদের রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নিজেরাই নেন। সেখানকার পুরদপ্তর অবশ্য নজর রাখেন যাতে আবর্জনা ফেলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে, এবং যাতে সেগুলি নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করা হয়। ঘন বসতিপূর্ণ টোকিও বা হংকং-এর মতো শহরগুলিও পরিচ্ছন্নতায় অনেক এগিয়ে। কারণ, সেখানে আছে কঠোর আইন এবং আছে সকল বয়সের নাগরিকদের জন্য রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। কিন্তু ভারতে সে ব্যবস্থা নেই।
যেখানে পরিচ্ছন্নতা ও হাইজিন, টয়লেট ও স্যানিটেশন বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ, সেখানে আমরা কী করে আশা করতে পারি আমাদের দেশ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশগুলির অন্যতম হবে? এ এক বিরাটাকার সমস্যা। গ্রাম-গঞ্জে, নগরে এমনকি বড় বড় শহরগুলিতেও আমরা দেখি শৌচালয়ের অপর্যাপ্ততা। যেখানে শৌচালয় আছে, সেখানে সেগুলি অপরিষ্কার এবং সেগুলির কোনও দেখভালও হয় না। পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা একেবারেই সঠিক না হওয়ায় আশপাশ হয়ে থাকে দুর্গন্ধময় এবং পোকা-মাকড়ের জন্মস্থান।
আমরা প্রত্যেকেই এই সমস্যার বিশালত্ব এবং সাধারণ জনসাধারণের উপর তার প্রভাব বিষয়ে ওয়াকিবহাল। স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি, নন-গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজ়েশন (এনজিও) এবং সাধারণ মানুষের সংযোগে এক উৎসর্গীকৃত কর্মোদ্যোগ গড়ে ওঠা। এর বিভিন্ন দিক আছে। যেমন, স্বাস্থ্য শিক্ষা, বিভিন্ন সংস্থাগুলির মধ্যে এক সংহত ক্রিয়াশীল সম্পর্ক স্থাপন যার ফলে গড়ে উঠবে সুযোগ সুবিধা, সাশ্রয়ী, এবং সর্বক্ষণের পর্যবেক্ষণ এবং উন্নতিসাধন।
কোনও রাষ্ট্রের উন্নতির মান বুঝতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হল সেখানকার স্যানিটারি ব্যবস্থা ও তার পরিকাঠামো। আমাদের পক্ষে কি সম্ভব শুধু এই বিষয়টির ভিত্তিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ হিসেবে ভারতকে তুলে ধরা? এই প্রশ্ন আমার মনে দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছে।
২০০৭ সালে আমার সুযোগ হয়েছিল ওয়ার্ল্ড টয়লেট সামিট-এ বক্তৃতা দেবার। এই শিখর সম্মেলন প্রতি বছর সংঘটিত হয় ওয়ার্ল্ড টয়লেট অর্গানাইজ়েশনের তরফে। সেই বছর তা নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় ও বিদেশি প্রতিনিধিরা সেখানে অংশগ্রহণ করেন। বিশ্বের একচল্লিশটি দেশ অংশ নেয় সেই সম্মেলনে। সেখানে উঠে আসে নানান চিন্তাভাবনা। স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতির বিষয়ে নানা কৌশলগত দিক নিয়ে আলোচনা হয়, যাতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই ব্যবস্থার সুস্থ প্রয়োগ করে উন্নতি করা যায়। সেইখানেই আমি দীর্ঘ সময় ধরে এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ পাই। এইখানে সেই চিন্তাভাবনাগুলি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
কীরাপালায়াম অভিজ্ঞতা
২০০৪ সালের অগাস্টে আমি তামিলনাডুর কুডালুর জেলার কীরাপালায়াম পঞ্চায়েত পরিদর্শনের জন্য যাই। সেই পঞ্চায়েতের আধিকারিকরা আমায় জানান যে, সেখানকার ১১২৫টি বাসগৃহের প্রতিটিতেই শৌচালয়ের ব্যবস্থা আছে। একটি বিষয় আমাকে আগ্রহান্বিত করল। গ্রামের মহিলারা নিজেরাই ইট-চুন-সুরকির কাজ শিখে নিজ নিজ বাসগৃহে শৌচালয় নির্মাণ করেছেন। শুধু নিজেদের পঞ্চায়েত অঞ্চলেই এই নির্মাণ কাজ তাঁরা করেননি, পার্শ্ববর্তী গ্রামেও তাঁদের এই নির্মাণ দক্ষতার পরিচয় রেখে এসেছেন। এর ফলে কর্মসংস্থানের একটা পথ যেমন উন্মুক্ত হল, তেমনই গ্রামগুলিতে দেখা গেল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রোগমুক্ত পরিবেশ।
ওই রাজ্যের রামানাথাপুরম জেলার থামারাইকুলম পঞ্চায়েতেও একই ফল পাওয়া গেল। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের বিভিন্ন গ্রামে, গঞ্জে, শহরে বিক্ষিপ্ত এমন কিছু উদাহরণ আমরা পাব। এমন একটি তথাকথিত ‘সরল’ সমাধান, যা সারা দেশেই প্রযোজ্য হতে পারে, তা কিন্তু আমাদের নজরের বাইরেই থেকে গিয়েছে এতকাল। ভারতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং ঘিঞ্জি বাসস্থানের কারণে আজ এই সমস্যা আকাশছোঁয়া চেহারা নিয়েছে। অতি দ্রুত আমাদের একটি সুসংহত ব্যবস্থার আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই সমস্যা মোকাবিলায়।
সমাধান
বাস্তবে কীরাপালায়াম আর থামারাইকুলম ভারতে সত্যই ব্যতিক্রমী উদাহরণ। সাধারণভাবে শৌচালয় আর স্যানিটেশনের ছবিটা আমাদের দেশে খুবই ভয়ানক। এবং তার জন্য অন্য কেউ না, আমরাই দায়ী। আমাদের আশপাশে তাকালে স্কুল, কলেজ, রেলস্টেশন এবং সাধারণ মানুষের যাতায়াতের স্থানগুলির টয়লেটের প্রাচীন চেহারা দেখে আমরা মনে করি, এর পরিবর্তন অসম্ভব। এই নিয়েই আমাদের থাকতে হবে হয়তো। এমনই বদ্ধ চিন্তাধারা আমাদের। কিন্তু, না, এমন ভাবে চলতে পারে না।
বিষয়টি নিয়ে সচেতনতার প্রচার চালানো এবং এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার সম্ভাব্য কর্মসূচির মধ্যেই রয়েছে এর সমাধান। এই কাজ আমাদের শুরু করতে হবে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আমাদের নিজেদের বাড়ি থেকে। আমাদের কর্তব্য ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্যকর টয়লেটের প্রয়োজনীয়তা, তা বাড়িতে হোক, সাধারণ মানুষের যাতায়াতের স্থান হোক বা পরিবহণ সংশ্লিষ্ট স্থানেই হোক, সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা। স্থানীয় নাগরিক গোষ্ঠী তৈরি করতে হবে যারা এই বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করবে এবং কাজটিকে পর্যবেক্ষণে রেখে যথাসাধ্য সাহায্য করবে।
এই প্রসঙ্গে, আমি অন্ধ্রপ্রদেশের পেড্ডাপুরমের [Peddapuram] এম আর রাজুর কাজটির উল্লেখ করি। তিনি তাঁর গ্রামের নার্সারি ক্লাসের তিন বছরের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের এই ধরনের শিক্ষা দিচ্ছেন। তাঁর শিক্ষার মধ্যে দিয়ে তিনি তাদের ভাল খাদ্যস্বভাব ও শৌচস্বভাবের অভ্যাস করাচ্ছেন। এমন শিক্ষা আমাদের প্রতিটি স্কুলে প্রয়োজন।
স্যানিটেশন ও পানীয় জলের এক সংহত মিশন
ভারতের নগর, শহর ও মেট্রো শহরগুলির সমস্যা হল শৌচকর্মের সুযোগ সুবিধার অভাব। গ্রামাঞ্চলে এই সুযোগ সুবিধার অভাবের সঙ্গে আছে শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের অভাব। বাস্তবিকই এ এক জাতীয় সমস্যা। কেউ যদি প্রকল্পগুলি এবং তাদের বরাদ্দের পরিমাণ দেখেন, কোনও সময়েই তা নিমিত্ত মনে হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন তা হলে তুলনামূলকভাবে কোনও উন্নতির চিহ্ন দেখা যায় না, যখন অর্থ এবং অন্যান্য সম্পদাদি এতটা করেই ঢালা হচ্ছে প্রকল্পগুলিতে।
উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় যে, ভারতের প্রতি জনের জন্য প্রতি বছর ৩৫০ টাকা বিনিয়োগ করা হয় জল সরবরাহের ক্ষেত্রে। এই পরিমাণ যদিও আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় কম, কিন্তু তা একবিংশ শতকের প্রথম দশকের তুলনায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই সরবরাহ উপলব্ধও হচ্ছে অনেক বেশি মানুষের কাছে। গ্রামীণ স্যানিটেশন ব্যবস্থা যেখানে ১৯৮০ সালে ছিল প্রতি একশো জনে ১, সেখানে ২০০৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রতি শতকে ২১। উন্নত জল সরবরাহ ব্যবস্থা যেখানে ১৯৯০ সালে উপলব্ধ ছিল ৭২ প্রতি শতকে, তা ২০০৮-এ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৮৮ প্রতি শতক। আবার সঙ্গে সঙ্গে এও দেখা যায় যে, ভারতের মাত্র দু’টি শহরে আছে নিরবচ্ছিন্ন জল সরবরাহ ব্যবস্থা। আবার প্রতি একশো জন ভারতীয়র ভিতর প্রায় ৬৯ জনের কাছে এখনও উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা পৌঁছতে পারেনি।
সমস্যাটা হল কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে জল সরবরাহ আর স্যানিটেশনের দায়িত্ব ভাগ করে নেয় বিভিন্ন মন্ত্রক। কেন্দ্রীয় স্তরে আছে তিনটি মন্ত্রক: পানীয় জল ও স্যানিটেশন মন্ত্রক (গ্রামাঞ্চলের দায়িত্বে), বাসস্থান ও নগর দারিদ্র্য দূরীকরণ মন্ত্রক, এবং নগর উন্নয়ন মন্ত্রক (নগরাঞ্চলের দায়িত্বে)। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী জল সরবরাহ ও স্যানিটেশন রাজ্যের আওতায় পড়ে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রকগুলির শুধু পরামর্শ এবং সামান্য কিছু অর্থ বরাদ্দর ক্ষমতা আছে। ক্ষেত্রীয় যোজনা রাজ্যের অগ্রাধিকারে আসে। মূল বিষয়টি হল, বিভিন্ন সংস্থাগুলির মধ্যে একটি সুসংহত সহযোগ প্রয়োজন যাতে প্রকল্পগুলি যাদের উদ্দেশে রচিত তারা যেন তার পূর্ণ সুবিধা লাভ করতে পারে।
চলতি যে ব্যবস্থা রয়েছে, তার গুণাগুণ বিচারে একটি কার্যকরী মাপযন্ত্রের প্রয়োজন। ধরা যেতে পারে যে, যখন স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি হয়, তখন জনসাধারণের স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমার মতে, আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থার উপলব্ধতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকবে তীব্র ডায়ারিয়ার কেসগুলির হ্রাস পাওয়া।
সামাজিক অংশগ্রহণ
সেই সঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করা উচিত যে, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা এবং তাকে সার্বিকভাবে কার্যকরী করার দায়িত্ব শুধুমাত্র সরকারের উপর পড়ে না। পঞ্চায়েতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, এনজিও-গুলির এবং নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে এ ব্যাপারে। আমাদের সকলের উচিত এই বিষয়টিতে নজর দেওয়া, কারণ তবেই সকলের জন্য স্যানিটেশনের সুব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।
বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে মহাত্মা গাঁধী স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের উপর জোর দিতেন। স্যানিটেশন ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ছিল তাঁর অতি প্রিয় দু’টি বিষয়। পঞ্চায়েতের বিভিন্ন বিভাগের অংশগ্রহণ ছাড়া সার্বিক স্যানিটেশনের লক্ষ্যে পৌঁছনো অসম্ভব। যেহেতু তৃণমূল স্তরের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, তাই স্যানিটেশনের প্রচারে তারাই মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করবে।
মহিলাদের অংশগ্রহণও সমানভাবে অত্যন্ত জরুরি। স্বনির্ভর গোষ্ঠী, মহিলা সমক্ষ (মহিলাদের সম-অধিকারে শিক্ষা দান) এবং মহিলাদের গোষ্ঠীগুলিকে স্যানিটেশনের বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। দিতে হবে কিছু পারিতোষিক। আমি কীরাপালায়াম গ্রামে এ কাজ স্বচক্ষে দেখে এসেছি।
রেলের টয়লেট
আমাদের ট্রেনের টয়লেটগুলির যা দশা, তাদের বিষয়ে সত্বর দৃষ্টি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন। প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত যাতে মলমূত্র রেল লাইনে না পড়ে। যেহেতু আমাদের ট্রেনগুলির জন্য লক্ষ লক্ষ টয়লেটের প্রয়োজন, তাই টয়লেটগুলি যাতে সাশ্রয়ী হয় তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। রেল দপ্তর এমন কামরা চালু করতে পারে বা চলতি কামরাগুলিকে পরিবর্তন করে নিতে পারে, যেখানে আধুনিক ইউরিনাল, টয়লেট, বেসিন এবং আবর্জনা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা থাকবে যাতে রেললাইন পরিচ্ছন্ন থাকে আর যাত্রীদের ট্রেন যাত্রা হয় আরামদায়ক ও সুখকর।
জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে রেল কর্তৃপক্ষ, গবেষক ও নির্মাণ সংস্থা বসে এই নতুন পরিকল্পনা আমাদের ট্রেনগুলিতে যাতে সত্বর চালু করা যায়, তা দেখা উচিত।
কেমনভাবে স্মরণীয় থাকা যায়?
আমি সাধারণভাবে মনে করি যে, বেশিরভাগ এনজিও-ই একটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। তারা সমাজকল্যাণে অংশ নিতে চায়। প্রত্যেক এনজিও-রই নিজেকে জিজ্ঞাসা করা উচিত, ‘আমরা কোন কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকব?’ এই ক্ষেত্রে সুলভ ইন্টারন্যাশনাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে স্যানিটেশন, পাবলিক টয়লেট, পুনর্নবীকরণ ও বায়োগ্যাসের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রয়োগের কাজের জন্য। আমি সুলভ ইন্টারন্যাশনাল, অন্যান্য এনজিও এবং গ্রামোন্নয়ন সংস্থাগুলিকে অনুরোধ করব বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে এই কাজ করতে। এই ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও কর্মোদ্যোগ এবং সেবার লক্ষ্যে স্থির থেকে এমন কাজের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। গ্রাম-রূপান্তরের কাজে তাই, তারা সাহায্য করতে পারে।
ধরা যাক, একটি গ্রামে কয়েক ঘণ্টার জন্য কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। এর ফলে কয়েকটি নালার সৃষ্টি হল। সেই নালা হয় ঝিলে বা পুকুরগুলিতে গিয়ে পড়বে, যেখানে সেই জল জমা থাকবে ভবিষ্যতের জন্য। নয়তো সেই নালার জল গিয়ে সমুদ্রে পড়বে, অথবা কোথাও না গিয়ে নিজে থেকেই শুকিয়ে যাবে। এ সবই নির্ভর করছে গ্রাম পঞ্চায়েত কেমনভাবে সেই জলের স্রোতের পথ নির্ধারণ করে দেয়, তার উপর। কোনও কোনও স্থানে রাস্তা নির্মিত হয় আশপাশের জমির থেকে উঁচুতে। ফলে, বৃষ্টির জলের যে অংশ রাস্তায় পড়ে, তা গড়িয়ে আশপাশের জমিতে চলে যায়। রাজস্থানের মাউন্ট আবুতে আমি এটা প্রত্যক্ষ করেছি।
আমার সুদীর্ঘ পাবলিক জীবনে আমি বহু এনজিও-র কাজের অগ্রগতি নিরীক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছি। বহু ক্ষেত্রে দেখেছি এক-পিট টয়লেটের মাধ্যমে স্যানিটেশন ব্যবস্থা করা হয়। যখনই ওই পিট পূর্ণ হয়ে যায়, সেটি আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না। সুতরাং, আমাদের দেখতে হবে যে, এনজিও-গুলি বা সরকারি সংস্থা কাজের শেষে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেও যাতে কাজের মূল উদ্দেশ্যটি অব্যাহত থাকে। এটা করতে গেলে স্থানীয় মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজটি শিখিয়ে দিতে হবে, যাতে প্রকল্পটির সুফল গ্রামবাসীরা ভোগ করতে পারেন। এই প্রশিক্ষণের দায়িত্ব প্রাক্তন সেনানীদের দেওয়া যেতে পারে। কারণ, তাঁরা আসেন এক শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগঠন থেকে এবং সারা দেশেই এঁদের দেখা মেলে।
জীবন এক অসাধারণ সুযোগ। মসৃণ পথে হাঁটায় কোনও চ্যালেঞ্জ নেই। নতুন নতুন পথ তৈরি করবে গ্রামের এনজিও-রা এবং সারা ভারত জুড়ে সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রামের সৃষ্টির জন্য চিরকাল তারা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বর্জ্য পরিচালনে ক্লোজড-লুপ ব্যবস্থা
গ্রামের স্যনিটেশন ব্যবস্থার বিষয় মনে এলে প্রথমেই যে কথাটি মাথায় আসে তা হল প্রত্যেক গৃহস্থালির জন্য পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থার সঙ্গে সঠিক সুযোগ সুবিধার আয়োজন। গ্রামের সার্বিক ধনসম্পদ বৃদ্ধির একটি উপায় এই সুযোগ সুবিধার জন্য পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করা। যেমন, কোনও কোনও গ্রামে দেখা যায় সেখানকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর তৈরি ফাইবার গ্লাসের টয়লেট সরঞ্জাম সেখানে ব্যবহার হয়। তামিলনাডুর কীরাপালায়াম আর ভাল্লামে [Vallam] এবং গুজরাতের আহমেদাবাদে আমি গ্রামের মানুষের হাতে এই ধরনের টয়লেট সরঞ্জাম তৈরি হতে দেখেছি।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে, এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, গ্রামের সব টয়লেট সব সময়ে কাজ করছে কিনা। তার অর্থ, গ্রামের মানুষজনকে জল-কলের বা যাকে বলে প্লাম্বিং-এর কাজে প্রশিক্ষিত ব্যক্তির দ্বারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি রাখতে হবে। তৃতীয়ত, টয়লেটের জন্য সর্বক্ষণ জল সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রকৃতিতে জলসম্পদ হ্রাস পাওয়ার দরুন, টয়লেটে ব্যবহৃত জলকেই পুনর্বার ব্যবহারযোগ্য করে নিতে হবে। এবং প্রতি ঘরে ঘরে জল ধরে রাখার ব্যবস্থাও করতে হবে।
চতুর্থত, প্রত্যেক টয়লেটকে একটি কেন্দ্রীয় পয়ঃপ্রণালীর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এটি না করতে পারলে ঘরে ঘরে আদর্শ টয়লেট নির্মাণের প্রকল্প তার কাঙ্ক্ষিত ফল পাবে না। এইচ জি এস গিল নামে এক অনাবাসী ভারতীয়র তৈরি একটি মডেল আমার চোখে পড়ে পাঞ্জাবের হোশিয়ারপুর জেলার কারোডি গ্রামে। তিনি যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন তাতে, প্রত্যেক টয়লেট একটি কেন্দ্রীয় পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে, বর্জ্যকে একটি ঢাকা নর্দমার মাধ্যমে নিয়ে গিয়ে ফেলে দূরস্থ একটি স্থানে। সেখানে সূর্যের আলোয় উন্মুক্ত একটি স্যুয়ারেজ ট্যাঙ্কে বর্জ্য থেকে জল পৃথকীকরণ করা হয়। এই জল শোধন করে চাষের কাজে ব্যবহার করা হয়। শ্রী গিল নজর রাখেন যাতে প্রতি ঘরের টয়লেট ঠিক মতো কাজ করে এবং কোনও প্রতিবন্ধকতা যাতে না থাকে। কেন্দ্রীয় পয়ঃপ্রণালীটিও যাতে আটকে না যায়, সেদিকেও নজর রাখেন এক দল প্রশিক্ষিত মানুষ। কেন্দ্রীয় ট্যাঙ্কটি কয়েক মাস অন্তর পরিষ্কার করা হয়। তার কঠিন বর্জ্য শোধন করে চাষে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হোশিয়ারপুরের অন্যান্য গ্রামেও তিনি তাঁর এই মডেল চালু করেছেন।
যে বিষয়টি আমি এখানে গুরুত্ব দিতে চাইছি তা হল, প্রতিটি গৃহস্থালিতে টয়লেটের ব্যবহার শুরু করানোটাই সব নয়। যা সব থেকে প্রয়োজনীয় তা হল, সঠিকভাবে বর্জ্য নিষ্কাশন এবং সেই বর্জ্যের সঠিক শোধন, যাতে পারিপার্শ্বিক থাকে নির্মল পরিচ্ছন্ন। একটি আদর্শ টয়লেট সাতটি চাহিদা পূরণ করে। আমাকে বলা হয়েছে দুই-পিটের টয়লেট এই সাতটি চাহিদা পূরণে আদর্শ। এই ব্যবস্থায় একটি পিট পরিপূর্ণ হয়ে গেলে, তা আর আগামী তিন বছর ব্যবহার করা হয় না। অন্য পিটটি তখন ব্যবহার করা হয়। এই তিন বছর প্রথম পিটের বর্জ্য জীবাণুমক্ত, পূতিগন্ধমুক্ত কঠিন সারে রূপান্তরিত হয়। কৃষিক্ষেত্রে ওই সার ব্যবহার হয়।
এই বর্জ্য বাদে গ্রামে অন্য বর্জ্য আসে পশুপাখি, গাছপালা, রান্নাবান্না, কাপড়চোপড় কাচা, থালাবাটি ধোয়া এমন নানান দৈনন্দিন কাজ থেকে। এগুলি দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: বায়োডিগ্রেডেবল বা জৈবিকভাবে পচ্য আর নন-বায়োডিগ্রেডেবল বা জৈবিকভাবে অপচ্য। গৃহস্থালির কাজে সাধারণ জ্বালানির পরিবর্তে জৈবিকভাবে পচ্য আবর্জনা থেকে তৈরি গুল ব্যবহার করা যায়। কোনও গ্রামে মানুষ ও পশুর সংখ্যা যদি অত্যধিক হয়, তাহলে জৈবিকভাবে পচ্য আবর্জনা থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে।
স্যানিটেশন ও টয়লেট পরিকাঠামো মিশন
স্যানিটেশন প্রকল্পকে পুরোপুরি সফল করতে আমার তরফে এই পরামর্শগুলি রইল:
১। ভারতের গ্রাম ও শহরাঞ্চলে টয়লেট ব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তিগত কারও ঘরে টয়লেট নির্মাণের থেকে জরুরি টয়লেট ব্যবস্থাকে সার্বিক পরিকাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা।
২। স্যানিটেশন ও টয়লেট ব্যবস্থার পরিকাঠামোর এই কর্মযজ্ঞে অনেকগুলি কাজ করতে হবে। প্রথমে একটি কেন্দ্রীয় ট্যাঙ্ক নির্মাণ করতে হবে। তারপর বর্জ্যকে সারে রূপান্তরিত করতে ও জলকে পুনর্ব্যবহারের জন্য একটি শোধন ব্যবস্থা করার সঙ্গে রাস্তা পর্যন্ত পাইপলাইনকে সম্প্রসারণ করে প্রতি ঘরের ও কমিউনিটি টয়লেট নির্মাণ করে মূল পাইপের সঙ্গে সংযোগ করে দিতে হবে। বর্জ্য জলের সব ক’টি নিকাশি পাইপ একটি আধারের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে। সেই আধারে জলকে পুনর্নবীকরণ ও শোধন করার ব্যবস্থা থাকবে। এই মডেলটি নতুন যে পিইউআরএ বা ‘পুরা’ (প্রোভাইডিং আরবান ফেসিলিটিজ় টু রুরাল এরিয়াজ়) প্রকল্প, বা শহরের বস্তি এবং সাধারণের উপযোগ ব্যবস্থায় প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৩। যে টয়লেটগুলি নির্মিত হবে তা বিশ্বাসযোগ্য, দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প জল ব্যবহারের উপযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ব্যক্তিগত টয়লেটগুলিতে পুনর্ব্যবহার্য জলের ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪। গ্রাম অঞ্চলে বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক টয়লেট ব্যবস্থায় ডেসিকেটিং ও কম্পোস্টিং মডেল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তার আগে বর্জ্যকে সম্পূর্ণ গন্ধমুক্ত করতে ও কম্পোস্টিং-এর ফলে উদ্গত সারকে যান্ত্রিক উপায়ে সরিয়ে ফেলার জন্য প্রয়োজন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে এগোনো।
৫। গ্রামোন্নয়ন, নগরোন্নয়ন, স্বাস্থ্য, সমাজ কল্যাণ, কর্মসংস্থান, জলসম্পদের মতো মন্ত্রকগুলি নিজেদের মধ্যে একটি কার্যকরী সম্পর্ক তৈরি করে নিতে হবে।
৬। নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদেরকে তাঁদের গ্রামের জন্য টয়লেট নির্মাণের আদর্শ মডেলটি বিবেচনা করে, তার নির্মাণের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য নিজেদের প্রশিক্ষিত করে নিতে হবে। সঠিক প্রযুক্তি তাঁদেরই বেছে নিতে হবে। পরিচর্যার জন্য সকল রকম ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তাঁদের গ্রামের টয়লেট ব্যবস্থা বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে, ত্রুটিমুক্তভাবে ও নির্বিঘ্নে চলতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রতিটি টয়লেট— ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত— কেন্দ্রীয় পরিকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত থাকে।
উপসংহার
২০২০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষ একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। সেই রূপান্তরের ভিত হচ্ছে স্যানিটেশন এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। এই ব্যবস্থা সরাসরি প্রভাব ফেলবে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর। জন্ডিস এবং অন্যান্য জলবাহিত রোগ ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ হ্রাস পাবে। একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা রাখতে হবে যা খেয়াল করবে, স্যানিটশন প্রকল্পগুলির প্রয়োগের সঙ্গে স্বাস্থ্য পরিসেবার খরচ কমছে কিনা। সুতরাং এই স্যানিটেশন প্রকল্পকে একটি লাভজনক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করতে তাই প্রয়োজন স্যানিটেশন ও টয়লেট পরিকাঠামো নির্মাণের এই উদ্যোগ।
.
তিন : ভ্রমণ থেকে উপলব্ধ কিছু শিক্ষা
ছ’দশকের আমার পেশাদারি জীবনে আমি বহু সংগঠনে, বহু পদে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, এবং আমাদের দেশের দৈর্ঘ্য প্রস্থ চষে বেড়িয়েছি। ২০০২ থেকে ২০০৭, আমি যখন রাষ্ট্রপতি পদে আসীন, আমি নিশ্চিত করেছিলাম যাতে আমি প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে ভাব আদানপ্রদান করতে পারি। সেই সুযোগে তাঁদের কাছ থেকে কিছু শিখতেও পারি। ভারতবর্ষের হৃৎপিণ্ড রয়েছে তার এই গ্রামেই। ডাক্তার যেমন রুগির চিকিৎসা শুরু করেন তার হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনে, তেমনই একশো কোটি মানুষের এই রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগ করতে হবে দেশের ৬০০,০০০ গ্রামের কথা শুনে।
তুয়েনসাং, নাগাল্যান্ড, অক্টোবর ২০০৭
২০০৭ সালের অক্টোবরে হিমালয়ের পূর্বপ্রান্তের শেষে অবস্থিত নাগাল্যান্ড ভ্রমণের কথা আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। আয়তনে ক্ষুদ্র এই রাজ্য কিন্তু তার জীববৈচিত্র্য ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী। তার জনসংখ্যা পঁচিশ লক্ষ যার বেশির ভাগই উপজাতি গোষ্ঠীর। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন উপজাতির রয়েছে বিবিধ উপভাষা এবং সংস্কৃতি। আমার অন্যতম ভ্রমণস্থান ছিল তুয়েনসাং। তুয়েনসাং সেখানকার সব থেকে বড় জেলা। ভারত-মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় এর অবস্থানগত গুরুত্বও আছে। ওখানে থাকাকালীন ওই এলাকার উপজাতীয় পরিষদের একটি অধিবেশনে উপস্থিত হয়েছিলাম।
নাগাল্যান্ডের উপজাতি নেতারা সেখানকার রাজনৈতিক প্রতিনিধিই শুধু নন, তাঁরা তাঁদের সংস্কৃতির রক্ষাকর্তাও বটে। তাঁরা প্রত্যেকেই হাজির হলেন তাঁদের রংবেরং-এর উজ্জ্বল ঐতিহ্যশালী পোশাকে। প্রত্যেকের হাতে এক গুচ্ছ কাগজ, তাতে হাতে লেখা তাঁদের আলোচ্য বিষয়গুলি। আমাকে জানানো হল যে, সাধারণত তাঁরা একটি বড় গাছের ছায়ায় বসে মিটিংটা করে থাকেন। কিন্তু যেহেতু ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁদের আজ অতিথি, তাই তাঁরা একটি বন্ধ ঘরে বসে মিটিংটা করতে রাজি হয়েছেন। তাঁরা আমাকে এবং পরে পরস্পরকে অভিনন্দন জানিয়ে অত্যন্ত পেশাদারি চলনে যে যাঁর জায়গায় গোল হয়ে বসে পড়লেন। অত্যন্ত গাম্ভীর্যময় পরিবেশে আলোচনা শুরু হল। সেদিনের আলোচ্যসূচিতে ছিল এই পরিষদের উদ্যোগে কেমনভাবে ফল ও সবজির চাষে উন্নতি এসেছে।
একজন বললেন, ‘এই প্রথম, চাহিদার থেকে অনেকগুণ বেশি ফলন হয়েছে।’
সকলে বাহবা জানালেন। আমারও ভাল লাগল ওখানকার গ্রামগুলির এই উজ্জ্বল সাফল্যে।
কিন্তু এক যুবক নেতা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘শ্রদ্ধেয় সদস্যগণ, এটা সত্যিই আনন্দের যে, উৎপাদন ও মান দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কীভাবে একটি অর্থনৈতিকভাবে কার্যকরী মডেল তৈরি করতে পারি।’
কোনায় বসা এক মহিলা সদস্য তাঁর একটি ভাবনার কথা তুলে ধরলেন। তিনি বললেন, ‘আমাদের এখন রপ্তানির বাজার খুঁজতে হবে।’ তিনি জানালেন, ‘আমার একটি গোষ্ঠী আছে যারা আশপাশের গ্রামের ও শহরের চাহিদা কেমন, তার একটা সমীক্ষা করতে পারবে। এইভাবেই আমাদের নতুন পথের সন্ধান করতে হবে।’ উপস্থিত সকলেই তাঁকে সমর্থন করলেন।
এরপর এক বয়োজ্যেষ্ঠ উপজাতীয় নেতা তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। অন্যরা তা মন দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনতে লাগলেন। তিনি বললেন, ‘রাষ্ট্রপতি মহোদয় এবং আমার পরিষদীয় সদস্যবৃন্দ, আমাদের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হল, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে বা শহরে যাবার ভাল রাস্তার বড় অভাব। পণ্য বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও যানের ব্যবস্থাও আমাদের নেই।’
এই সমস্যাটা নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক এক অতি আকর্ষক আলোচনা হল। নানান মতামতের আদানপ্রদানের পর স্থির হল যে, একটি সমবায় সমিতি গঠিত হবে। এই সমিতি অতিরিক্ত যে ফলন তা সদস্যদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে একটি শক্তপোক্ত পরিবহণ ব্যবস্থা তৈরি করে বিভিন্ন দুর্গম স্থানের দূরাবস্থিত বাজারে এমনকি নাগাল্যান্ডের সীমানার বাইরেও বিক্রির জন্য নিয়ে যাবে। এরপর, তাঁরা পর্যটন শিল্পে কীভাবে উন্নতি আনা যায়, তাই নিয়ে আলোচনা করলেন। এই আলোচনার ভিত্তিতে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর জন্য একটি স্মারকলিপি প্রস্তুত করলেন। মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হল, পর্যটকদের বিভিন্ন দর্শনযোগ্য স্থানে যাবার সুবিধার্থে কয়েকটি হেলিপ্যাড নির্মাণ করা হোক। অতিরিক্ত কৃষিপণ্য পরিবহণেও সাহায্য প্রার্থনা করা হয়।
নিকোবর দ্বীপ, জানুয়ারি ২০০৫
অগম্যতা বহু ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশের উপজাতি অঞ্চলে এ ঘটনা আমি দেখেছি। সেই ভয়ঙ্কর সুনামির পরের মাসে, ২০০৫-এর জানুয়ারিতে আমি নিকোবর দ্বীপে কিছু উপজাতি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করি। আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করি, কেন তাঁরা সমুদ্রসম্পদকে তাঁদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কাজে লাগাচ্ছেন না।
আমি তাঁদের বলি, ‘এত সমুদ্রসম্পদ আপনাদের কাছে রয়েছে। প্রতিবেশী দেশের মত্স্যজীবীরা আমাদের সাগরের সম্পদ বেআইনিভাবে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আপনারা কেন এই জাতীয়সম্পদ নিজেরা ব্যবহার করছেন না?’
উপজাতি নেতারা কিছুটা ভেবে আমার কথার উত্তর দিলেন। তাঁদের সমবেত বক্তব্য ছিল যে, তাঁরা চিরাচরিত প্রথায় মাছ শিকার করতে জানেন। কিন্তু অতিরিক্ত মাছ কীভাবে তাঁদের নিজ নিজ গ্রামের বাইরের বাজারে নিয়ে গিয়ে বেচতে হবে, তার ধারণা নেই। মত্স্য প্রক্রিয়াকরণের প্রযুক্তি বিষয়েও তাঁরা জানতে ইচ্ছুক। এই অজ্ঞানতাই তাঁদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
নিকোবর যাবার আগে নয়া দিল্লিতে আমাকে জানানো হয়েছিল যে, সুনামি বহু পিতামাতাকে কেড়ে নিয়ে তাঁদের সন্তানদের অনাথ করে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম সেই দ্বীপে কোনও অনাথ আশ্রমই নেই। আমি নেতাদের বললাম, ‘আন্দামানে গিয়ে আমি তিনটি অনাথ আশ্রম দেখেছি। নিকোবরে কোথায়?’
আমাকে বিস্মিত করে তাঁরা আমাকে জানালেন, ‘এখানে কোনও অনাথ আশ্রম নেই।’ এ যেন সুনামির পর কালো মেঘের কোলে রৌপ্যঝলক। এক বরিষ্ঠ অথচ কর্মঠ নেতা অনেক ভেবে আমায় বললেন, ‘যে সব ছেলেমেয়েদের পিতামাতা নেই তারা আমাদের ঘরের ছেলেমেয়ে হয়ে রয়েছে। আমাদের এখানে তাই অনাথ আশ্রমের প্রয়োজন নেই। আমাদের ঘরই তাদের ঘর। আসলে এই দ্বীপে আমরা একটি বৃহৎ পরিবার।’
কী অপরূপ রীতি। ভালবাসা, স্নেহ, অনুকম্পার এই যে সঞ্চারণ, তা সারা রাষ্ট্রে এবং সারা বিশ্বে সংরক্ষিত ও লালিত হওয়ার প্রয়োজন। আমরা যখন উন্নতির কথা বলি, আমাদের চিন্তায় এই বিষয়টি রাখতে হবে অবশ্যই।
ওয়্যানাড, কেরালা, ফেব্রুয়ারি ২০১১
চলুন আপনাদের পশ্চিমে ১২০০ কিমি. দূরে কেরালায় নিয়ে যাই। ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে আমাকে একটি অনন্য শিক্ষা প্রকল্পের উদ্ঘাটনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ওয়্যানাড জেলা শিক্ষা দপ্তর। ওই দিনই জহর নবোদয় বিদ্যালয়ে বিভিন্ন স্কুল পড়ুয়াদের সঙ্গে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। আমার কিছু সহকর্মীর সঙ্গে সকাল ৯.৩০ মিনিটে আমার ব্যাঙ্গালোরের পথে দিল্লি থেকে রওনা হওয়ার কথা ছিল। ব্যাঙ্গালোর থেকে কালিকাটের প্লেন ধরে ৩.৩০-এ সেখানে পৌঁছে গাড়িতে ওয়্যানাডের ৫টার অনুষ্ঠানে পৌঁছনোর কথা। যাত্রার প্রতিটি বিষয় নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত হয়েছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনার কারণে যে-কোনও নিখুঁত পরিকল্পনাই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
দিল্লি বিমানবন্দরে আমরা ঠিক সময়েই পৌঁছে গেলাম। কিন্তু আমাদের জানানো হল যে, কিছু অনিবার্য কারণে ব্যাঙ্গালোরের প্লেন ছাড়তে দেরি হবে। প্রথমে, আমাদের মনে হয়েছিল যে, হয়তো কিছু মিনিটের মধ্যেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক কাটার পর, আরও এক ঘণ্টা, তারপর আরও-ও এক ঘণ্টা কেটে গেল। প্রতীক্ষালয়ে বসে আমরা আমাদের বক্তৃতাগুলি ঝালিয়ে নিলাম, বই পড়লাম। শেষে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছতে ৫.৩০টা বেজে গেল। আমাদের কালিকাটগামী সংযোগকারী প্লেন বহুক্ষণ আগেই স্বাভাবিকভাবে ছেড়ে চলে গিয়েছে । ওয়্যানাডের ছেলেমেয়েদের এবং অন্যান্যদের কথা চিন্তা করে আমি সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাপারটা জানালাম।
তাঁরা আমায় বললেন, ‘স্যার, আমরা কেউই এখান থেকে একটুও নড়ছি না। আপনার অপেক্ষায় প্রয়োজনে আমরা এখানে সারা রাত থাকব। আমরা জানি আপনি কখনওই আমাদের অসন্তুষ্ট করবেন না।’
আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম, এবং ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক ওয়্যানাড আমরা পৌঁছবই। বিভিন্ন উপায় আলোচনা করে ঠিক হল, গাড়ি নিয়ে কয়েকশো কিলোমিটার কেরালার ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গেলে ঘণ্টা ছয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাব। আমার ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ছ’টা। যত তাড়াতাড়িই যাই মধ্যরাতের আগে আমরা ওয়্যানাড পৌঁছতে পারব না। আমি সেইভাবেই যাওয়া মনস্থ করলাম এবং সংগঠকদের তা জানিয়ে দিলাম।
শুরু হল আমার জীবনের দীর্ঘতম একনাগাড় পথযাত্রা। ১০০ কিমি.-র আগেই, ওই রাস্তাটি বাদে, মানবসভ্যতার সব চিহ্নই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল— শুধু পড়ে রইল সবুজ বনানী তার একান্ত নিজস্ব দৃশ্যাবলি ও শব্দগুচ্ছ নিয়ে। ওই চন্দ্রাভিষিক্ত রাত্রিতে আমাদের গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখছিলাম গাছের লম্বা লম্বা ছায়াগুলি। মাঝে মাঝে আমাদের গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল হাতির পালের আওয়াজ। বনাঞ্চলের এই বিশাল সম্পদ যেন আমাদের সামগ্রিক জাতীয়সম্পদের এক সাক্ষ্য বহন করছে।
কোথাও না থেমে দীর্ঘ সাড়ে ছ’ঘণ্টার পথ অতিক্রম করার পর আমাদের স্বাগত জানাল একটি সাইনবোর্ড যাতে লেখা, ‘ওয়্যানাডে স্বাগত’। শহরে ঢোকা মাত্রই মোবাইল ফোনের যোগাযোগ আবারও পাওয়া গেল, আর রাতের আকাশের তারার প্রেক্ষিতে মানুষের তৈরি আলো ঝিলমিল করতে লাগল। আমরা সরাসরি চন্দ্রাগিরি প্রেক্ষাগৃহে চলে গেলাম প্রথমেই। সেখানেই আয়োজন করা হয়েছে প্রথম অনুষ্ঠানটির।
বিপুল উল্লাস ধ্বনিতে আমাদের আপ্যায়ন জানাল প্রায় ২০০০ মানুষ, যা দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। তাঁদের আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে দিল। এই গভীর রাত পর্যন্ত এতটা সময় তাঁরা কী কষ্টেই না কাটিয়েছেন। এ এক অনন্য দেশ— এই ভারতবর্ষ। তার মানুষেরাও অন্য দেশের তুলনায়, অতুলনীয়। যখন কোনও লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য তাঁর সামনে, দেশের যে-কোনও অংশে যে-কোনও ভারতীয় অকল্পনীয় কিছু করে দেখাতে পারেন। ওয়্যানাডের এই ঘটনা তারই একটি ক্ষুদ্র নিদর্শন মাত্র।
ওই অনুষ্ঠানে জেলায় শিক্ষা প্রসারের জন্য অরিভিদম প্রকল্পের উদ্বোধন করলাম। অরিভিদম-এর অর্থ জ্ঞান ও তথ্যের এক স্থান। জ্ঞান একজন ব্যক্তিকে মহান করে তোলে। সুতরাং, কেরালার জন্য উৎকৃষ্ট নাগরিকের বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প। আঞ্চলিক স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থায় ডিজিটাল জ্ঞানের যে অভাব রয়েছে তার অভাব মেটাতে ছাত্র, শিক্ষক এবং সাধারণের মধ্যে শিক্ষা, জ্ঞান ও তথ্যের প্রসার ঘটানো এই প্রকল্পর লক্ষ্য। প্রিন্সিপ্যাল, হেডমাস্টার ও আধিকারিকদের মধ্যে ভিডিও-সম্মেলনের ব্যবস্থা, প্রতি স্কুলে ওয়েবসাইট নির্মাণ, এবং সাধারণ মানুষের জন্য একটি নেটওয়ার্ক সৃষ্টি, এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত।
সাধারণের কাছে জ্ঞানের ভাণ্ডার পৌঁছিয়ে দিতে এক অপূর্ব হাতিয়ার হল তথ্যপ্রযুক্তি আর কম্পিউটারের সঙ্গে উদ্ভাবনী পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগের যুক্তকরণ। ফেসবুকের মতো অ্যাপ্লিকেশন আজ কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে । সেই প্রযুক্তি আর সেই দর্শন নিয়েই আমরা কেন গ্রামের মানুষের কাছে এনে দিতে পারব না জ্ঞান আর তথ্যের ভাণ্ডার?
এই অনুষ্ঠান শেষে পূর্ণ উদ্যম নিয়ে পৌঁছে গেলাম জহর নবোদয় বিদ্যালয়ে ভোর ২.৩০ মিনিটে। সেখানে তখন জড়ো হয়েছে ওয়্যানাডের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে। একটি অনুষ্ঠান বা মিটিং-এর জন্য সময়টি ছিল অ-সাধারণ। কিন্তু অবাক করার বিষয় হল যে, তারা প্রত্যেকেই ছিল মনোযোগী। অনুষ্ঠান শেষে এক পড়ুয়া জানতে চাইল, ‘স্যার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কী করে অশিক্ষাকে দূর করতে পারে?’ আমি তাকে একটি দারুণ উদাহরণ দিলাম, যার পরিচয় আমি কিছু ঘণ্টা আগেই পেয়েছি: অরিভিদম।
ঊরি, ঊর্সা আর তাংধার, জম্মু ও কাশ্মীর, অক্টোবর ২০০৫
কেরালা থেকে যাওয়া যাক কাশ্মীরে। ২০০৫ সালের অক্টোবরে কাশ্মীর উপত্যকায় এক ভয়ানক ভূমিকম্প জীবন ও সম্পত্তির প্রভূত ক্ষতি করে। বিশালাকার সেই উদ্ধার আর পুনর্বাসনের কাজ কেমন চলছে তা দেখার জন্য আমি পাকিস্তান সীমান্তের কাছে ঊরি, ঊর্সা আর তাংধারে গিয়েছিলাম।
সেখানকার স্থানীয় মানুষ যার সংখ্যাগরিষ্ঠই কৃষক, সরকারের প্রতিনিধি, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একটি মিটিং-এ যোগ দিয়েছিলাম। মিটিং-এ আমি তার আগের দিন ওই তিনটি জায়গা পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করে বললাম যে, আমার বিশেষ করে নজরে পড়েছে যে, সেখানে জীবনধারণের কোনও আয়োজন নেই। আমি স্থানীয়দের প্রশ্ন করলাম যে, কেন তাঁরা তাঁদের জমিতে ফল, বিশেষ করে কাশ্মীরের জগৎ-বিখ্যাত আপেল, ফলান না।
তাঁরা জানালেন, ‘স্যার, আমাদের কোনও জমি নেই। আমাদের সব জমি সেনাবাহিনীর হাতে।’
তাঁদের এই উত্তর আমাকে অবাক করে দিল। কিন্তু আমার সঙ্গে যেসব আধিকারিকরা ছিলেন তাঁরা একটু হতচকিত হয়ে পড়লেন। আমি রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী এবং সেনার বরিষ্ঠ অফিসারদের দিকে তাকালাম। একটা যেন অস্বস্তিকর নীরবতা চেপে বসেছে। আমি জানতাম আমাকেই এর উত্তর দিতে হবে। আমি বললাম, স্থানীয়দের এই অসুবিধা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। তাই কিছু জমি চিহ্নিত করে তা ফসল ফলানোর জন্য রাখতেই হবে— এবং তাতেই ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব। বাজারের সঙ্গে সঠিক যোগাযোগ ব্যবস্থার বিষয়ের উপরও জোর দিলাম। ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেন তার সীমান্তবর্তী এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। বস্তুত, সকল সামাজিক অশান্তিকে প্রশমিত করার সব থেকে উত্তম পথ হল উন্নয়ন।
কিবিথু, অরুণাচল প্রদেশ, মার্চ ২০০৭
২০০৭ সালে, আমার রাষ্টপতি পদে থাকার শেষ বছর, সামরিক বাহিনীর প্রধান, জেনারাল জোগিন্দর যশবন্ত সিংহ অরুণাচল প্রদেশে ভারতের সঙ্গে চিনের সীমান্ত একবার ঘুরে আসার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। এই জেনারালটি, যাঁকে সকলে জেজে নামেই ডাকেন, হলেন একজন বহুদিনের সেনানী যাঁর ছিল অত্যন্ত দৃঢ় অথচ সকলকে অভিভূত করে রাখার মতো এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব। আর ছিল তাঁর চিরহরিৎ হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। সুতরাং, তিনি যখন জোর দিয়ে আমাকে অনুরোধ করলেন সীমান্তের সেনা জওয়ানদের সামনে বক্তব্য রাখতে, আমি তত্ক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম।
কিবিথু নামের একটি স্থানে আমরা পৌঁছলাম। এখানে মিলেছে চৈনিক আর ভারতীয় অঞ্চল। আমরা ছিলাম একটি উপত্যকায় যাকে ঘিরে পর্বতমালা আকাশকে ছুঁয়েছে। ওপারে দেখা যাচ্ছিল চিনা শিবির, আমাদের থেকে সামান্য উঁচুতে অবস্থিত। সেখানকার কিছু অনুসন্ধিত্সু সৈনিক জড়ো হয়ে দেখছিল আমাদের এখানে আসা নিয়ে এখানকার ব্যস্তসমস্ত কার্যকলাপ। আমি বিশাল হিমালয়ের প্রেক্ষাপটে তাকিয়ে দেখছিলাম আমাদের তরুণ সেনানীদের আর ওই অঞ্চলের কিছু স্থানীয় মানুষদের যাঁরা সেখানে জড়ো হয়েছিলেন। আমাদের সৈনিকদের ওই কঠিন পরিস্থিতির সাহসী মোকাবিলা, আমাকে মুগ্ধ করে দিল। আমরা যতই তাঁদের জন্য সবরকম ব্যবস্থা করি না কেন, হিমালয়ের যুদ্ধক্ষেত্রের কঠিন বাস্তব হল সেখানকার সব থেকে বড় প্রতিপক্ষ, পার্শ্ববর্তী দেশের সেনাদের থেকেও, সেখানকার কঠিন আবহাওয়া।
এরপর আমি স্থানীয়দের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। তাঁদের বেশিরভাগই উপজাতি সম্প্রদায়ের। তাঁদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর উল্লসিত চেহারা। কিন্তু তাঁদের দারিদ্র্য ও কঠিন জীবনকে তা ঢেকে দিতে পারল না। তাঁদের জীর্ণ শরীর, অতিরিক্ত কর্মে ক্লান্ত হাত দু’খানি বা দীর্ণ পোশাক জানিয়ে দিচ্ছিল তাঁদের অবস্থা। এই সব সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কোনও অতিরিক্ত সাহায্য ছাড়াই যে-পরিমাণ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করেন তার তুলনা নেই। সেনার কাজে সাহায্যর জন্যও তাঁদের বহু অতিরিক্ত কাজ যেমন করতে হয়, তেমনই তাদের কিছু লজিস্টিক কাজেও সাহায্য করতে হয়। তাঁদের পাশ দিয়ে আমি যখন হেঁটে যাচ্ছি, আমার কানে এল এমন উপজাতীয় এলাকার অতি পরিচিত অভিবাদন: ‘জয় হিন্দ’।
এরপর আমি সংযুক্ত স্থলসেনা কমান্ডের উদ্দেশে বক্তৃতা দিলাম। আমি লক্ষ করলাম, ওই কঠিন পরিবেশ সত্ত্বেও, সাধারণ জওয়ান ও অফিসারদের তাঁদের কর্তব্যকর্মের প্রতি এক অদ্ভুত উদ্যম। লক্ষ করলাম যে-কোনও চ্যালেঞ্জ, তা আবহাওয়া হোক বা ওপারের হুমকিই হোক, তার জন্য তাঁরা চিরপ্রস্তুত। বক্তৃতার শেষে কয়েকজন তরুণ অফিসারের সঙ্গে আমার আলাপ হল।
আমি তাঁদের বললাম, ‘আপনারা রাষ্ট্রের ও তার মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য দিনরাত কাজ করে চলেছেন— আপনাদের জন্য আমি গর্বিত। আপনাদের প্রত্যেকের বহু যত্নে পোষণ করা সব থেকে ঈপ্সিত স্বপ্নের কথা এবার আমাকে বলুন।’
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর, কয়েকটি হাত উঠে এল।
এক তরুণ অফিসার উঠে আমাকে একটা দুর্দান্ত স্যালুট ঠুকে বেশ উচ্চস্বরে বললেন, ‘স্যার, আমি যখনই চিনাদের হিমালয়ে আমাদের থেকে উঁচুতে দেখি, তখনই আমার মনে আসে আমার তাওয়াং যাওয়ার কথা। আমার সব থেকে বড় উচ্চাশা হল, আমি যেন চিনাদের যে-কোনও আগ্রাসন পরাস্ত করে দিতে পারি।’
আর একজন যোগ দিলেন, ‘স্যার, যে ৫০,০০০ বর্গ কিমি. আমাদের দেশের অংশ চিনাদের কবলে রয়েছে, তা উদ্ধার করে আনা হল আমার জীবনের অভিপ্রায়। আমি আমার শেষ নিশ্বাস দিয়ে তার জন্য লড়ে যাব।’
স্থানীয়রা করতালি দিয়ে স্বাগত জানিয়ে ক্রমাগত আওড়াতে লাগলেন, ‘জয় হিন্দ! জয় হিন্দ!’ আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম জওয়ান, অফিসার এবং স্থানীয়দের এই সুদৃঢ় মনোবল আর অটল সংকল্পের মানসিকতা দেখে। আমাদের এই সব অঞ্চলকে যেমন লালন করতে হবে, তেমনই এই স্পিরিটটা বা মানসিকতাটাকেও জিইয়ে রাখতে হবে।
ভাদারিয়া, রাজস্থান, মে ১৯৯৮
দেশের একেবারে পূর্ব থেকে ৩০০০ কিমি. ভারতের বুকের উপর দিয়ে পেরিয়ে, যাওয়া যাক পশ্চিমে। সেটা ছিল ১৫ মে, ১৯৯৮, ভারত, তার প্রতিরক্ষার মানকে সুউচ্চ স্তরে তুলে, সবে সাফল্যের সঙ্গে তার পাঁচটি আণবিক পরীক্ষা করেছে, ১১ মে ও ১৩ মে। সারা রাষ্ট্র উত্ফুল্ল। আমি এবং আমার বিজ্ঞানীদের দল যেখানে পরীক্ষাগুলি সংঘটিত হয়েছিল, সেই পোখরান থেকে ফিরছি। থর মরুভূমির অভ্যন্তরে অবস্থিত পোখরানে জীবনের প্রায় কোনও চিহ্নই নেই। মে মাসের ওই সময়টায় প্রচণ্ড গরম, তাপমাত্রা ৫০˚ সে. ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং মরুভূমির বালি যেন ফুটছে।
এঁকেবেঁকে মরুপথে ফেরার সময়ে আমরা পেলাম একটি ছোট গ্রাম— ভাদারিয়া। রাস্তায় জায়গাটির বোর্ড দেখে আমার এক সহকর্মী উল্লসিত হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন যে, ওই জায়গার নাম তিনি আগে শুনেছেন। ওখানে নাকি একটি বিখ্যাত আশ্রম আছে। তাঁর অনুরোধে আমরা স্থির করলাম সামান্য ঘুরপথ হলেও আমরা ওই স্থানটিতে যাব।
ভাদারিয়া আসলে একটি ছোট হ্যামলেট বা যাকে পল্লি বলা যায়। আশ্রমটি খুঁজে পেতে তাই বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু সেখানে আমরা যা দেখলাম তা বিশ্বাস করা কঠিন। একটি বিশাল জায়গা নিয়ে সবুজ বনানীতে ঢাকা মরুর মধ্যে এই স্থানটি। আশ্রমের প্রধান, বাবা শ্রীভাদারিয়া মহারাজ, আমাদের অভ্যর্থনা করে জানতে চাইলেন, আমরা তাঁর তৈরি গ্রন্থাগারটি দেখতে ইচ্ছুক কিনা। তিনি সিঁড়ি দিয়ে আমাদের একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে নিয়ে গেলেন। সেই কক্ষ দিয়েই ঢুকতে হয় গ্রন্থাগারটিতে।
ঘরটি অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। বাবা শ্রীভাদারিয়া মহারাজ আমাদের জানালেন, ঘরটির পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে যে, বাইরে যতই তাপ বৃদ্ধি পাক, গ্রন্থাগারের ভিতরটা থাকবে ঠান্ডা। বিভিন্ন বিষয়ের, বিভিন্ন ভাষার, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের উপর বই দেওয়াল জোড়া। কিছু ছিল বল্কলের উপর হাতে লেখা। বাবা শ্রীভাদারিয়া মহারাজ আমাদের কয়েকশো বছরের পুরনো বই দেখালেন। তিনি জানালেন যে, প্রাচীন ঐতিহ্যশালী জ্ঞানভাণ্ডারকে তাঁর আশ্রম বহু যুগ ধরে সংরক্ষণ করে আসছে।
তাঁর গ্রন্থাগারে বসে আমরা যখন তাঁর বইগুলিতে মশগুল, তিনি আমাদের সকলকে বড় বড় গেলাস ভর্তি দুধ এনে দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাবা, এই মরুভূমিতে এমন চমকার টাটকা দুধ আপনি কোথায় পেলেন?’
তিনি হেসে আমাকে তাঁর সঙ্গে আসতে বললেন। আশ্রমের পিছনে একটি বিশাল গোশালায় তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে রয়েছে শয়ে শয়ে গোরু। তিনি বললেন, ‘কালাম, এই গোরুগুলি সব পরিত্যক্ত। দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় এদের মানুষ পরিত্যাগ করেছে। তাদের কাছে এই গোরুর কোনও মূল্য নেই। কিন্তু আপনার মতোই আমিও এক প্রযুক্তিবিদ।’ এই বলে তিনি হাসলেন। ‘আমি একটি বিশেষ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে এই পরিত্যক্ত গোরুদের আবার সুস্থ সবল করে তুলেছি। তারা আবারও দুধ দিচ্ছে— যা আপনার হাতের গেলাসে আপনি ধরে আছেন।’
আমি মুগ্ধ হয়ে দেখে যাচ্ছিলাম, এমন এক মহিমান্বিত কর্মযজ্ঞ— এক মিশন। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘কিন্তু বাবা, আপনি এদের খাদ্য কোথা থেকে জোগাড় করেন?’
তিনি আমাকে গাছের ছায়ায় একটি খাটিয়াতে বসতে বলে ভাদারিয়ার রূপান্তরের কাহিনি শোনালেন। তিনি বললেন, ‘বহু বছর আগে এই অঞ্চলের মানুষরা ছিলেন ভীষণ গরিব। তাঁরা নানা রকম নেশা করতেন সিগারেট, মদ থেকে, স্থানীয় আগাছা থেকে উৎপন্ন মাদক। জায়গাটা ছিল একেবারেই অনুর্বর, নিষ্ফলা। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব, অপুষ্টি ইত্যাদির মতো নানান সামাজিক সমস্যা ছিল। জলের জোগান ছিল অপ্রতুল, আর যতটুকু পাওয়া যেত তাও বিনা তত্ত্বাবধানে নষ্ট হত। এখন দেখুন আমরা গ্রামবাসীদের সহযোগিতা এবং সমর্থনে কী করে ফেলেছি। নেশা-মুক্তির শিবির খোলা হল এই আশ্রমের ভিতরেই। আজ ভাদারিয়ার আশপাশে প্রায় সত্তরটি গ্রামে তা চলছে। লক্ষ লক্ষ গাছ রোপণ করে স্থানীয়দের সহযোগিতায় আমরা ভাদারিয়া ও তার আশপাশ অঞ্চলে সবুজায়ন অভিযান করেছি। টিউবওয়েল বসানোর কাজের ফলে এই এলাকায় কৃষিকাজ শুরু হয়। বিশেষ পদ্ধতিতে জল সংরক্ষণের কাজও শুরু হয়।
‘আশ্রম থেকে প্রাকৃতিক চিকিৎসা ও বনৌষধি সম্পর্কে জ্ঞাতব্য স্থানীয় গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রচার করা হয়। গবাদি পশুর চিকিৎসাও হয়।’ বাবা এরপর বললেন, ‘কালাম জানেন, গ্রামবাসীরা এতটাই তৃপ্ত এই ব্যবস্থায় যে, এই গোশালার গোরুদের খাদ্য তাঁরাই জোগাড় করে আনেন। যখন গোরু দুধ দেওয়া শুরু করে আমি গ্রামের যাঁরা দুঃস্থ তাঁদের বিনাপয়সায় দুধ, মাখন দিই— আর দিই এই গ্রামে আসা অতিথিদের… যেমন আপনি, কালাম!’ বলে হেসে উঠলেন আর আমার গেলাসে ঢেলে দিলেন আরও দুধ।
‘পরিশেষে একটি প্রশ্ন আপনাকে করি, বাবা’, আমি বললাম। ‘এই বনৌষধির বিষয়ে বা গোরুদের পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কাজকর্মের বিষয়ে আপনি কোথা থেকে জানলেন?’
বাবার চোখ দু’টি মরুর আলোকোজ্জ্বল তেজের মতো জ্বলে উঠল। ভূগর্ভস্থ গ্রন্থাগারটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওইখান থেকে।’
ভাদারিয়া থর মরুভূমির মাঝে একটি ছোট্ট গ্রাম। কিন্তু সে সারা বিশ্বকে এক অমূল্য পাঠ শিখিয়েছে। সুসংহত উন্নয়নের এক আদর্শ নিদর্শন এই গ্রাম— যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা, জ্ঞানের প্রসার, স্বাস্থ্য পরিষেবা, গবাদি পশুর রক্ষণাবেক্ষণ, পশুখাদ্যের সুষম পরিচর্যা— এই সবকিছুই ঘটেছে মরু অঞ্চলে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে পরম্পরাগত জ্ঞানের এক অদ্ভুত মিলনে, এই অঞ্চলের জমি, সম্পদ, এমনকী মানুষের জীবনে এসেছে এক অত্যাশ্চর্য রূপান্তর। শ্রেষ্ঠত্বের পথে উত্তরণে এইটিই মৌলিক দিক, যা আমরা এই গ্রন্থে আলোচনা করছি। তা কেবল একটি রাষ্ট্রের নয় বা এক রাষ্ট্রগোষ্ঠীর বিষয় নয়, তা সমগ্র বিশ্বের মানব গোষ্ঠীর জন্য মূল্যবান।
.
চার : হাতে হাত
ভাদারিয়ার ক্ষেত্রে যা সত্য, তা যে-কোনও সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সত্য। সার্বিক বৃদ্ধি ও অগ্রগতির জন্য জীবনের বিবিধ দিকের একযোগে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন। যত ধরনের ব্যবস্থা কায়েম আছে তাদের সকলেরই অভিমুখ কিন্তু এক হওয়া চাই। এবং তাকে হতে হবে স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ। তবেই পাওয়া যাবে উন্নয়নের প্রতি স্থির লক্ষ্যে এক সুসংহত প্রয়াস। বিবিধ জটিল সমস্যা আমাদের রাষ্ট্রকে জর্জরিত করে রেখেছে। কিন্তু জাতীয় উন্নয়ন যেহেতু লক্ষ্যের মূলে তাই এই সমস্যাগুলি এক ধরনের নিরপেক্ষতায় যথাযথ সময়ের ভিতরে সমাধান হয়ে যায়। কীভাবে প্রতিটি ব্যবস্থার নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যের দিকে নিষ্ঠাভরে কাজ করা বাঞ্ছনীয়, তা আমি বুঝিয়ে বলছি।
১। রাজনৈতিক নেতা
রাষ্টের সামনে একটি লক্ষ্য স্থির করে উন্নয়নমূলক রাজনীতির মাধ্যমে নাগরিক সমাজের সামনে একটি দৃষ্টান্ত রাখার প্রয়োজন আছে রাজনৈতিক নেতাদের। রাজনৈতিক নেতাদের উচিত দেশের আইনব্যবস্থার উপর শ্রদ্ধাশীল হওয়া। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে যেন সেই আইন লঙ্ঘিত না হয়, সে দিকেও দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
২। আইনপ্রণেতা
আইনকে সরল করার প্রয়োজন এবং পুরনো অপ্রাসঙ্গিক অ্যাক্টগুলিকে একটা নির্ধারিত সময় অন্তর বাতিল করে দেওয়া। এমনই ব্যবস্থা হওয়া উচিত যেখানে বিচার হবে ন্যায্য এবং তাড়াতাড়ি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আইনবিষয়ক ধারণা দেওয়ার সুযোগ রাখতে হবে তা প্রথাগতভাবে হোক বা অন্য উপায়ে— বিশেষ করে গ্রামের মানুষদের জন্য।
৩। নাগরিক
প্রত্যেক নাগরিকের অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। ন্যায্য সঠিক কারণে আইনব্যবস্থাকে কাজে লাগানো উচিত, নিজেদের তুচ্ছ কারণে নয়। এ ছাড়া, নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া যে-কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতার সঙ্গে তাঁদের সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেওয়া উন্নতির জন্য অনুকূল অবস্থা তৈরি করে দেয়।
৪। শাসনব্যবস্থা
সমাজের পরিবর্তন ও মানুষের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে শাসনব্যবস্থাকে হতে হবে সংবেদনশীল এবং অতিক্রিয়াশীল। প্রযুক্তি, যেমন ই-গভর্নেন্সের মতো ব্যবস্থা, তার সাহায্যে সিদ্ধান্তকে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কার্যকরী করতে হবে।
৫। পুলিশ
সুশীল নাগরিকের সামনে সার্বিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও বরাভয় জোগানো পুলিশের কর্তব্য। তাদের বিচার যেন বহিরাগত কোনও চাপের মুখে পরাজিত না হয়ে যায়। সত্যনিষ্ঠ আধিকারিকদের কর্তব্য সমাধা করতে যেন সব সময়ে একটা নিরাপত্তা দেওয়া হয়। পুলিশের কাজের ভিত্তিতে তাঁদের যথাযথ বেতন ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া উচিত।
৬। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ
উন্নতির যে কাজ তাতে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদকে হতে হবে সহযোগী। দ্রুত গতিতে উন্নয়নের জন্য চাই উদ্ভাবনী সমাধানসূত্র। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সমাজের সব স্তরের মানুষকে ওয়াকিবহাল করতে হবে যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হতে পারে দ্রুত।
৭। আইনজ্ঞ
আইন ব্যাবসা শুধুই একটি ব্যাবসা নয়— সমাজে সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার দায়ও তার। আইনের চর্চা করেন যাঁরা, তাঁদের উচিত, তাঁদের পেশাদারি নীতিজ্ঞান বজায় রেখে চলা। আইন স্কুলগুলিতে শিক্ষার্থী আইনজীবীদের ভিতরে এই মূল্যবোধ প্রোথিত করে দিতে হবে তাঁদের পেশাদারি জীবনের গোড়াতেই, যাতে তাঁরা যখন তাঁদের পেশায় বরিষ্ঠ হয়ে উঠবেন, নতুন প্রজন্মের কাছে তখন যেন তাঁরা রোল মডেল হয়ে ওঠেন।
৮। বিচারক
সত্যকে তুলে ধরতে অভিগ্রস্ত পক্ষের সামাজিক অধিষ্ঠান বিচার্য নয়। দ্রুততার সঙ্গে বিচার সমাপ্ত করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে আইন অপরাধের প্রতিবন্ধক, তেমন আইন, উত্তম রোল মডেল আর কম বয়সে নীতিজ্ঞান শিক্ষা, এইসবই অপরাধ হ্রাসে সাহায্য করে। অন্যদিকে, সময় মতো বিচার পেলে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের নিন্দুক প্রবৃত্তিও হ্রাস পাবে।
৯। সংবাদমাধ্যম
সদা সজাগ ও অতিক্রিয়াশীল থাকতে হবে সংবাদমাধ্যমকে। তবে তাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে উত্তেজনাকে ইন্ধন জোগাতে গিয়ে সত্যের অপলাপ না হয়ে যায় অথবা কোনও বিষয় পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে পড়ে।
১০। শিল্পী ও লেখক
ইতিহাস, সাহিত্যর মতো কলা বিষয়ে চর্চা করেন যাঁরা, তাঁরা সারা দেশের মনোজগৎকে সঙ্ঘবদ্ধ করে, দেশের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে দেশের সম্ভাবনাময় গুণগুলিকে বিশ্বের দরবারে মেলে ধরার কাজ ছাড়াও, তাঁদের উচিত নিজস্ব চিন্তাধারাকে প্রকাশ করা, গণতান্ত্রিক উপায়ে কোনও বিষয় সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করা।
১১। নন-গভর্নমেন্টাল ও কল্যাণকারী সংগঠন
তাদের প্রবল উদ্দীপনাপূর্ণ দায়বদ্ধতার জন্য নন-গভর্নমেন্টাল সংগঠনগুলি খ্যাত এবং তাদের কর্মোদ্যোগ, নিষ্ঠা ও সততা দিয়ে তারা দেশে দর্শনীয় পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা সকলে, তা যে যা পেশাতেই যুক্ত থাকি না কেন, সংবিধানে নির্দিষ্ট যে আচরণবিধি আছে তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। বিচক্ষণতার সঙ্গে আমরা আমাদের প্রতিটি কাজ করব এবং আমাদের প্রতিটি কার্যাবলি সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকব। আমি একজন নাগরিক হিসেবে এ কথা সোচ্চারে উচ্চারণ করছি, কারণ আমি দেখেছি কম সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ আইনের সুফল পান না। যাঁদের উপর সুযোগ-সুবিধা বর্ষিত হয় তাঁদের উচিত যোগ্য সম্মান দিয়ে তার সদ্ব্যবহার করা। যাঁদের কাছে সেই সুযোগ সুবিধা নেই তাঁদের ক্লেশ দেবার জন্য তা ব্যবহার করা সমুচিত নয়। এবং অবশ্যই তা জাহির করার জন্য নয়। অধিকার আস্ফালনের জন্য নয়, তাকে সঠিক কাজে লাগানোটাই কর্তব্য। সৌজন্য ও সংযমের মতো গুণগুলি আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে লালন করা প্রয়োজন।
গণতন্ত্রের যে তিনটি স্তম্ভ— আইনসভা, প্রশাসন ব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা— তারা যত শীঘ্র বুঝবে যে, এক স্বাস্থ্যকর প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থায় একটির অন্য দু’টি ছাড়া কোনও অস্তিত্ব নেই, ততই মঙ্গল আমাদের পক্ষে। আমাদের চেষ্টা হবে নাগরিকদের আশা আকাঙ্ক্ষাকে পোষণ করে এমন এক পরিবেশ তৈরি করা যেখানে সত্যিকারের গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারবে। সেইটিই হবে এক স্বাস্থ্যকর পুনরুদীয়মান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপযুক্ত পরামর্শ।
২০১৩ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমার এক বক্তৃতার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। মেরিল্যান্ডে জগদ্গুরু শ্রীশিবরাত্রীস্বর (জেএসএস) প্রতিষ্ঠানে কিছু মানুষের সামনে ‘Evolving a World without War’ বিষয়ে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। বক্তৃতাশেষে আমি লক্ষ করলাম যে, মার্কিন শ্রোতারা আমাকে আমার বক্তব্যের উপর প্রশ্ন করলেন বা পরামর্শ দিলেন। কিন্তু ভারতীয় শ্রোতারা আমায় যা প্রশ্ন করলেন, তা সাধারণ বিষয়ে, যা আমার বক্তব্যর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এর থেকে আমি এই বার্তাই দিতে চাইছি যে, বক্তার বক্তব্য অনুধাবন করার অভ্যাস করতে হবে আমাদের, এবং সেই মতো প্রশ্নগুলিকে সাজিয়ে নিতে হবে। তাহলেই সমগ্র আলোচনাটি ফলপ্রসূ হবে।
এই ঘটনা আমাকে একটা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একটি রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কি নিজেদেরকে সঠিক প্রশ্ন করছি? প্রাসঙ্গিক সমস্যার বিষয় বলতে গিয়ে আমরা কি বিমূর্ত কিছু কথা বলে বসি? আমরা এমন সমাধানসূত্র দিই যা হয়তো পাঁচ বছর পর কাজে আসবে, কিন্তু এই মুহূর্তে কোনও সুবিধা হবে না। আমরা অন্তরিক্ষ অন্বেষণের কথা বলি অথচ পায়ের নীচের পথটি সারানোর কথা ভাবি না।
একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতি এমন হওয়া উচিত যা হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। এবং তার জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রশ্ন। প্রতিদ্বন্দ্বিতার শক্তি থাকে জ্ঞানে। জ্ঞানের শক্তি প্রযুক্তিতে। প্রযুক্তির শক্তি লুকিয়ে থাকে উদ্ভাবনীতে। জ্ঞানের সমাজে, আমাদের সর্বক্ষণ উদ্ভাবন চালিয়ে যেতে হবে। উদ্ভাবন নতুন নতুন জ্ঞানের রাস্তা উন্মোচন করে দেয়। তার ফলে কল্পনার নতুন দিক খুলে যায়। ফলে আমাদের কল্পনাতে যুক্ত হয় নতুন নতুন পরত যা দৈনন্দিনতাকে করে তোলে অনেক অর্থবহ এবং সমৃদ্ধ, বিষয়ে এবং গুরুত্বে। মননশীলতা জন্ম দেয় উদ্ভাবনকে। এবং মননশীলতা আসে সুন্দর মন থেকে। সুন্দর মন পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় পাওয়া যাবে— মত্স্যজীবী পল্লিতে, বা কৃষকের ঘরে, ক্লাসরুমে বা ল্যাবরেটরিতে, শিল্পে বা আর-অ্যান্ড-ডি কেন্দ্রে। মননশীলতা দিয়ে আমরা সারাক্ষণ আমাদের চিন্তাভাবনাকে উন্নততর করে তুলতে পারি। আমাদের কাজে পরিবর্তন ও পরিশোধন এনে নতুন নতুন সমাধানে উপনীত হতে পারি। মননশীলতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সবাইকার মতোই কোনও কিছু নিরীক্ষা করে অন্যকিছু ভাবে তাকে চিন্তা করা। উদ্ভাবন ও মননশীলতা পরিশেষে শ্রেষ্ঠত্বের আবাদ করে— সুন্দর মন থেকে জন্ম হয় এক সুন্দর রাষ্ট্রের।
.
পাঁচ : একটি সুন্দর রাষ্ট্র
ধরুন এক ভ্রমণযাত্রী হিমালয়ের সুউচ্চ কোনও এক গিরিকন্দরে দাঁড়িয়ে তাঁর সম্মুখে উন্মীলিত সম্পূর্ণ দেশটিকে দেখছেন। তিনি কী দেখবেন? এক বৈচিত্র্যে ভরপুর ভূস্বর্গচিত্র তাঁর সামনে। সেখানে রয়েছে সব ধরনের গাছগাছালি, জীবজন্তু; নদ, নদী, নালা যারা গিয়ে পড়ছে ভূখণ্ডের তিন দিক ঘেরা সমুদ্রে; রয়েছে মরুভূমি, পাথুরে পর্বতমালা; শাল তরু এবং শত শত প্রজাতির গাছে ভরা ঘন জঙ্গল; এবং রয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতির, বিভিন্ন ভাষার মানুষ যাঁদের সাহিত্য ভাণ্ডার এতটাই অসীম যে পণ্ডিতদের বহু জীবন লেগে যাবে তার অধ্যয়নে, আর তদুপরি আছে তাঁদের উষ্ণ আতিথেয়তা এবং নজরকাড়া স্বভাব। মূল ভূখণ্ডটিই সব নয়। বৈচিত্র্যপূর্ণ সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে বঙ্গোপসাগরে, মূল ভূখণ্ড থেকে ১৩০০ কিমি. দূরে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে, আর আরব সাগরে মূল ভূখণ্ড থেকে ৪৫০ কিমি. দূরের লাক্ষাদ্বীপে।
এই অসীম সৌন্দর্যর সঙ্গে ভ্রমণযাত্রীর চোখে পড়বে অনেক কিছু অনভিপ্রেত বিষয়, যা সহজেই সংশোধন করে নেওয়া সম্ভব। যেমন, নদ-নদীর ক্রমবর্ধমান দূষণ; অরণ্যবিনাশ; পূতিগন্ধময় আবর্জনার মধ্যে স্যানিটেশন ব্যবস্থাহীন যত্রতত্র নগরায়ণ; অবহেলা ও বঞ্চনা; প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষার অভাব যা জনসংখ্যার বিরাট অংশকে গ্রাস করে রেখেছে, এমন বেশ কিছু বিষয়। সব থেকে নিকৃষ্ট যে বিষয়টি তাঁর চোখে পড়বে তা হল দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং বেকারত্ব। একটি সমাজকে অস্থির করে দেয় যে ক্রোধ ও হিংসা তা জন্ম নেয় এই পরিস্থিতিতেই। সমাজে স্থিতিশীলতা, শান্তির গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান। এসবই নির্ভর করে জীবনধারণের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা কতটা উপলব্ধ হচ্ছে তার উপর। এইসবের উপর প্রত্যেক মানুষের পূর্ণ অধিকার আছে। অধিকার আছে সম্ভ্রম নিয়ে ও সম্মানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাঁচার। মূলত গণতন্ত্র হল এই সম্ভ্রম নিয়ে বাঁচা ও সম্মান আদায়ের জন্য ন্যায় ও ন্যায্য পথে এগোনোর সুযোগের প্রতুলতা। আমাদের সংবিধানের মূল বক্তব্যই তাই। একটি সত্যিকারের প্রাণিত গণতন্ত্রে জীবনযাপনকে সুখকর এবং আনন্দময় করে তোলে এইটিই।
এই ক্ষণে আমি সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমাদের গণতন্ত্রের মসৃণ পথ চলা নির্ভর করছে আমাদের সকলে মিলে সমাজের সকলের মনের মিল ঘটানোতে। অন্যের চিন্তাধারা ও জীবনবোধের প্রতি যে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা দেখা দিচ্ছে, যার প্রকাশ মানুষেরই বিরুদ্ধে আইনভাঙা হিংসা, তা যে প্রসঙ্গেই হোক, মেনে নেওয়া যায় না কোনওমতেই। আমাদের সকলকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং সভ্য আচরণে দৈনন্দিন জীবনকে চালিত করতে হবে যাতে অন্যের অধিকার সুরক্ষিত হয়। এই আমাদের গণতান্ত্রিক নীতিবোধের ভিত। ভারতবর্ষকে এক সুন্দর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে এই মূল্যবোধই।
আলোকপ্রাপ্ত মানুষ
সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে কেমনভাবে আমরা আলোকপ্রাপ্ত মানুষে বিবর্তিত হতে পারি? এর উত্তর আছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট কাজের মধ্যে। সন্তানের বিভিন্ন বয়সে যখন তার পিতামাতা কোনও কাজের জন্য তাকে ক্ষমতা প্রদান করেন, সে ধীরে ধীরে এক দায়িত্বশীল নাগরিকে পরিণত হয়। শিক্ষক তাঁর শিক্ষা ও অভিজ্ঞতায় যখন ক্ষমতাবান হন, ভাল নীতিবোধ নিয়ে মানুষের প্রকাশ ঘটে। প্রযুক্তির ক্ষমতাবলে সাধারণ মানুষ তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রকাশের সুযোগ পায়। কোনও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক যখন তাঁর অধীনস্থদের ক্ষমতা দেন তখন আরও অনেক পরিচালকের সৃষ্টি হয় যাঁরা দেশের পরিবর্তন আনতে পারেন বিভিন্ন দিকে। বিভিন্ন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ মানুষকে ক্ষমতা এনে দিলে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি নিশ্চিত। প্রতিটি ধর্মকে যদি ক্ষমতা দেওয়া হয় যাতে তারা আধ্যাত্মিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, তাহলে প্রতিজনের হৃদয়ে প্রস্ফুটিত হবে সুখ ও শান্তি। এই ধরনের ক্ষমতায়নই পারে উত্তম মূল্যবোধ নিয়ে আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক তৈরি করতে।
আমি মনে করি আলোকপ্রাপ্ত মানবসমাজ তৈরি করতে প্রয়োজন তিনটি মূল উপাদান: নীতিজ্ঞানসম্পন্ন এক শিক্ষা ব্যবস্থা, দক্ষতার সুসংবদ্ধতা আর সামাজিক ছুঁতমার্গের বিলোপ।
১। উত্তম মূল্যবোধযুক্ত শিক্ষা
মানুষের জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল তার শৈশব। তাদের পাঁচ থেকে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত, বাড়ি, স্কুল ও সমাজ থেকে তারা যে শিক্ষা পায়, তা-ই তাদের সারা জীবনকে তৈরি করে দেয়। এই পর্যায়েই তাদের প্রয়োজন হয় এক উত্তম মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার, যাতে তারা আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক হয়ে গড়ে ওঠে। এক প্রাচীন গ্রিক শিক্ষকের কথাগুলি মনে পড়ে যায়: ‘আমাকে সাত বছরের জন্য এক শিশু সন্তানকে দাও। তারপর ভগবান হোক বা শয়তান, নিয়ে যাক সেই শিশুকে। তাকে তারা আর পরিবর্তন করতে পারবে না।’ অভিভাবক ও শিক্ষক, এঁরা দু’জন মিলে স্থির করুন এক সুসংবদ্ধ লক্ষ্য: উত্তম মূল্যবোধের শিক্ষা— বাড়িতে এবং স্কুলে। ২৫,০০০ ঘণ্টার এই মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা থেকে যদি আমাদের সন্তানরা বঞ্চিত হয়, আমাদের এক সত্যনিষ্ঠ সমাজ স্থাপনের স্বপ্ন সার্থক হবে না। শিক্ষাই একটি স্বপ্নের রাষ্ট্র নির্মাণের মৌলিক উপাদান। আমাদের জনসংখ্যার এক বড় অংশ এই তরুণরা যাঁদের দক্ষতার উপর নির্ভর করেই আমাদের সমাজের যত প্রত্যাশা। ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণন একবার বলেছিলেন, ‘Education should be imparted with a view to the type of society that we wish to build. We are working for a modern democracy built on the values of human dignity and equality. These are only ideals; we should make them living forces. Our vision of the future should include these great principles.’ [‘কী ধরনের সমাজ আমরা গড়ে তুলতে চাই সেইটাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক রূপায়ণের নিয়ামক হওয়া আবশ্যক। মানবিক মর্যাদা ও সাম্যতার মূল্যবোধের উপর আমরা এক আধুনিক গণতন্ত্র গড়তে চলেছি। এ সবই শুধু তাত্ত্বিক স্তরে রয়েছে; তাকে বাস্তবে জীবন্ত করে তুলতে হবে। এই মহান তত্ত্বকে আমাদের ভবিষ্যতের লক্ষ্যে যুক্ত করতে হবে।’]
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি শিশুর নিজস্বতা ও মননশীলতাকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিতে হবে। পাঠ্যসূচিকে করে তুলতে হবে উদ্ভাবনী। পরীক্ষা পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এনে মুখস্থ বিদ্যার বদলে মননশীলতা ও নতুন চিন্তা যাতে প্রশ্রয় পায়, তাই দেখতে হবে। শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রদানের কেন্দ্র না হয়ে স্কুলগুলিকে জ্ঞান ও দক্ষতার উন্মেষ কেন্দ্র হতে হবে।
আমার নিজের জীবনের কিছু ঘটনা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। সুদূর ১৯৪৩ সালে আমার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষক ছিলেন শ্রীশিবসুব্রহ্মনিয়া আয়ার [Sivasubramania Iyer]। এই দারুণ মানুষটি আমাদের বিজ্ঞান ও অন্যান্য কিছু বিষয় পড়াতেন। পাখি কী করে ওড়ে, এই বিষয়ে তিনি একদিন আমাদের পড়াচ্ছিলেন। তিনি বললেন যে, পাখির শরীরের আকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে তারা ডানা ঝাপটায়, কীভাবে গতি নেয়, এবং তাদের লেজ কীভাবে দিক পরিবর্তনে সাহায্য করে, এ সবই তিনি খুব সুন্দরভাবে বোঝালেন। কিন্তু আমাদের মনশ্চক্ষুতে আমরা তা ঠিক ধরতে পারছিলাম না। আমার মনে আছে, তখন বাজে দুপুর ৩.৩০। তিনি আমাদের নিয়ে চললেন রামেশ্বরম দ্বীপের সমুদ্রতটে। সেখানে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় আমরা সামুদ্রিক পাখির ওড়া দেখলাম। আমরা দেখলাম তাদের ডানা ঝাপটানো, গতি নিয়ে উড়ে যাওয়া, এবং লেজের সাহায্যে দিকের পরিবর্তন করা। ওই দিনটিতেই আমি জেনে গেলাম আমি কী করব। আমি উড্ডয়ন বিজ্ঞানের অধ্যায়ন করব। আমার শিক্ষক, তাঁর জীবন ও তাঁর শিক্ষাপ্রদান পদ্ধতি আমাকে আমার পথ বেছে দিল। ওই ক্লাসেই আমি আমার জীবনের ব্রত ঠিক করে ফেললাম।
অন্য ঘটনাটি ঘটেছিল যখন আমি তিরুচিরাপল্লীর [Tiruchirappalli] সেন্ট জোসেফস কলেজে পড়ি। সেখানে পড়াতেন তোটাদ্রী আয়েঙ্গার [Totadri Iyengar] নামে এক বিখ্যাত অঙ্কের শিক্ষক। প্রজ্ঞা যেন বিচ্ছুরিত হত যখন তিনি পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন। তরুণ শিক্ষার্থীরা সকলে বিস্ময়ে ও শ্রদ্ধায়ে তাঁর দিকে চেয়ে থাকত। আমার অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন অন্য একজন, যাঁকে সকলে ‘ক্যালকুলাস’ শ্রীনিবাসন নামে ডাকে। তিনিও অধ্যাপক আয়েঙ্গার সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আমার বিএসসি-র প্রথম বর্ষেই ক্যালকুলাস শ্রীনিবাসন কলেজের ম্যাথামেটিক্স ক্লাবে দশজন সদস্যর অন্যতম হিসেবে আমাকে নির্বাচন করলেন। এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার সবথেকে বড় লাভ হল, ক্লাবের সদস্যদের জন্য অধ্যাপক আয়েঙ্গারের বক্তৃতামালা শোনার সুযোগ। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, প্রথম দিনে অধ্যাপক আয়েঙ্গার তাঁর এক ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতায় প্রাচীন ভারতের অঙ্কশাস্ত্র আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের পণ্ডিতদের বিষয়ে বললেন। আমার এখনও কানে বাজে সেই বক্তৃতা, যেন গতকালই তা শুনেছি। আর্যভট্ট, ভাস্কর এবং আমাদের এখনকার সময়ের রামানুজম— অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের পুরোধা পুরুষ এবং অনুপ্রেরণাদায়ী মানুষজনের কথা তাঁর কাছেই আমার প্রথম শোনা। এই দুই ঘটনা আমার শিক্ষা, জ্ঞান আহরণ ও মূল্যবোধের ভিত্তি হয়ে থেকে গিয়েছে।
তাঁর মতোই আমাদের স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের উচিত আত্মসমীক্ষা করা এবং বিচার করা যে তাঁরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে কতটা সাহায্য করছেন।
২। সংঘবদ্ধ দক্ষতা
আমাদের উচিত অর্থনৈতিক উন্নতিতে ও রাষ্ট্র গঠনে আমাদের সন্তানদের কর্মদক্ষতা প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া। মননশীলতা ও উদ্ভাবন এবং উদ্যোগী অধিনায়কত্বের জন্য যে গবেষণা বা অনুসন্ধিত্সার প্রয়োজন, তার সুযোগ করে দেওয়াও তার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের সন্তানদের প্রয়োজন এই বিভিন্ন ধরনের দক্ষতাকে সুসংহত করে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা।
৩। সামাজিক ছুঁতমার্গের দূরীকরণ
আমাদের সন্তান, যারা ভবিষ্যতের নাগরিক, তাদের ভিতর মনের মিল এবং সাম্যবোধ সৃষ্টিতে শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সমাজে যে বিভিন্ন ধরনের ছুঁতমার্গ লক্ষ করা যায়, যেমন সামাজিক অবস্থান ও লিঙ্গ, বা অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষকদের কর্তব্য এমন ধরনের প্রভেদ তাঁদের ক্লাসঘর থেকে তথা শিক্ষার্থীদের মন থেকে দূর করে দেওয়া। কোনও পক্ষপাতিত্ব যেমন, সেই শিক্ষার্থী ছেলে না মেয়ে, ধনী না গরিব ঘর থেকে আসছে, অথবা কোন বিশেষ অঞ্চল থেকে আসছে বা কোন ধর্মের, এসব প্রশ্ন ছাড়াই যদি তাঁরা সকল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একরকম ব্যবহার করেন, তবেই ওই লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব।
সুখী পরিবার
এক সুন্দর রাষ্ট্র নির্মাণের পরবর্তী পদক্ষেপ হল সুন্দর পরিবারের সৃষ্টি। আমি মনে করি একমাত্র সংযুক্ত সুখী পরিবারই পারে এক সুন্দর দেশের জন্ম দিতে। সুন্দর গৃহকোণের চারটি দিক আছে:
১। বই পড়ার অভ্যাস
পিতামাতা আর তাঁদের এক পুত্র আর এক কন্যা— অথবা দুই পুত্র আর দুই কন্যা— এই নিয়ে ধরা যাক একটি ছোট সংসার। পরিবারে পিতামাতা দু’জনেই উপার্জন করেন। আমি মনে করি এমন এক সংসারে নিদেনপক্ষে খান দশেক ভাল ভাল বইয়ের একটি সংগ্রহ আছে। রোজ সকালের জলখাবারের সময়ে অথবা রাতের আহারের সময়ে পিতামাতা যদি তাঁদের সন্তানদের বই পড়ে শোনান, তাহলে সন্তানদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস ঢুকে যাবে। নিজেদের মধ্যে এক সহজ যোগাযোগের স্বার্থে যে-কোনও একটি আহারের সময়ে অন্তত, সমগ্র পরিবারের একত্র হওয়া বাঞ্ছনীয়।
পিতামাতার কোনও একজনের উচিত আহারের সময়ে কোনও একটি বই থেকে কাহিনি বা আখ্যান পড়ে শোনানো, যেখানে আছে নীতি ও মূল্যবোধের কথা। সেই কাহিনি শুনে সন্তানরা তাদের মতামত জানাবে। এই অভ্যাস ছেলেমেয়েদেরও অনুপ্রাণিত করবে বই পড়ায়। নীতি ও মূল্যবোধের শিক্ষা তারা প্রয়োগ করবে তাদের জীবনে। কেউ কেউ স্কুলে তাদের বন্ধুদের ওই সব কাহিনির কথা বলবে। এবং এইভাবেই এক বৃহৎ গোষ্ঠীর মধ্যে সেই শিক্ষার উপকারিতা ছড়িয়ে পড়বে।
এই দৈনন্দিন পারিবারিক মিলনের ফলে সমাজ জুড়ে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, তথ্য ও জ্ঞানের সঙ্গে নীতিবোধের সম্প্রসারণ ঘটবে। এই অভ্যাস থেকে যে সন্তানরা লাভবান হবে, তারা সকল সময়েই যে-কোনও কাজে হবে দায়িত্বশীল। সে দায়িত্ব তারা সুন্দরভাবে, নিষ্ঠাভরে ও আত্মসম্মানের সঙ্গে অতিবাহিত করবে।
২। মায়ের প্রসন্নতা
এক সুখী মা-ই যে কোনও সুখী পরিবারের ভিত। সংসারের সকলের পরিচর্যা ও লালন করেন যেহেতু তিনি, তাই তাঁর সুখসমৃদ্ধির দিকে খেয়াল রাখা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়— যেখানেই আমি তরুণদের সাক্ষাৎ পাই, আমি তাদের জোর দিই যাতে প্রতিদিন তারা একটি সময় বের করে তাদের মায়েদের প্রসন্ন রাখার চেষ্টা করে। তাদের একটা শপথবাক্য পাঠ করাই। সেটা অনেকটা এইরকম:
আজ থেকে আমি আমার মাকে সুখী রাখব।
আমার মা সুখে থাকলে, আমার পরিবার সুখে থাকবে।
আমার পরিবার সুখে থাকলে, সমাজ সুখে থাকবে।
সমাজ যদি সুখে থাকে, আমার রাজ্য সুখে থাকবে।
রাজ্য যদি সুখে থাকে, দেশ সুখে থাকবে।
৩। স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত পরিবার
এক স্বচ্ছ দুর্নীতিমুক্ত সমাজের অপেক্ষায় আজ সারা রাষ্ট্র। দুর্নীতি শুরু হয় কিছু পরিবারে, তাই ঘরের অভ্যন্তরেই তাকে বিনাশ করে দিতে হবে। প্রায় ২০ কোটি পরিবারের সমাজ আমাদের। তার এক তৃতীয়াংশ যদি আমরা মনে করি দুর্নীতিগ্রস্ত, তা হলে কমবেশি প্রায় ৬ কোটি পরিবার দুর্নীতির কবলে।
এর থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ আছে। আমি তরুণদের বলব, তারা যদি তাদের পরিবারে এই দুর্নীতি-ভাইরাসের সন্ধান পায়, তারা যেন তাদের পিতামাতাকে স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে এই পথ— যে পথে রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাবে— সেই পথ থেকে নিবৃত্ত করে। আমার বিবেক বলছে, কোনও আইন নয়, যুবকদের এই অভিযানই পারবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা নিতে।
৪। সবুজ গৃহকোণ
আবহাওয়ার পরিবর্তন আজ পৃথিবীর সবথেকে বড় সমস্যা। অরণ্যবিনাশ, শিল্পায়ন এবং পরিবহণ— আমাদের এই গ্রহের উষ্ণতার কারণ। পৃথিবী জুড়ে আজ যে ভয়াবহ বন্যা বা খরা, তার কারণ এই উষ্ণায়ন।
আমাদের প্রতিটি পরিবার যদি দায়িত্ব নেয়, এই পরিস্থিতি পালটে দেওয়া যায়। প্রত্যেক পরিবার অঙ্গীকার করুক, তারা অন্তত একটি গাছের পরিচর্যা ও লালন করবে। একটি পূর্ণ বয়সের ২০ কেজি কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং ১৪ কেজি অক্সিজেন ত্যাগ করে। যদি প্রতিটি পরিবার একটি গাছ রোপণ করে তাকে পরিচর্যা করে, তবে ২০ কোটি গাছ থাকবে আমাদের, যা আবহাওয়া পরিবর্তনের সমস্যায় সাহায্য করবে অবশ্যই।
এক সুন্দর ভারত
আলোকপ্রাপ্ত মানুষজন আর সুখী পরিবার একসঙ্গে এক সুন্দর ভারত গড়ার কাজে বহু দূর যাবে। এক সুন্দর ভারতের বিবর্তনের বিষয়ে আমার কিছু চিন্তাভাবনা আমি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। এই বিবর্তনের সঙ্গে আছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে আহরিত মূল্যবোধ। বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনীতিবিদদের ভবিষ্যৎ বাণী বলছে যে, ২০২০ সালের মধ্যে ভারত সারা পৃথিবীতে এক গৌরবময় স্থান নিয়ে উঠে আসবে। ওই লক্ষ্য-বছরটিকে ধরে এবং গত কয়েক বছরের অর্থনৈতিক উন্নতির চেহারাটা দেখে, আমাদের জাতীয় সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে প্রয়োজন একটি বিরাট ধাক্কার। ভবিষ্যতের প্রজন্মকে আমরা এমন এক প্রতিযোগিতামূলক রাষ্ট্র উপহার দেব যার নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য থাকবে-
১। এক সমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ, সুখী রাষ্ট্র।
২। গ্রাম-নগরের বিভাজন রেখা যে রাষ্ট্রে অতি সূক্ষ্ম।
৩। যে রাষ্ট্রে শক্তি ও উন্নতমানের জলের ন্যায়সংগত বিতরণ আছে।
৪। এমন রাষ্ট্র যেখানে কৃষি, শিল্প এবং অন্যান্য কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলি প্রযুক্তির সাহায্যে এক সুরে বেজে ওঠে, যাতে এক নিরবচ্ছিন্ন সম্পদসৃষ্টি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৫। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে যে রাষ্ট্রের মেধাবী বিদ্যার্থী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় না।
৬। সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেধার শিক্ষার্থী ও বিজ্ঞানীদের জ্ঞান লাভের আদর্শ গমনস্থান হয় যে রাষ্ট্র।
৭। যে রাষ্ট্রে সমগ্র জনগণের জন্য শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্য পরিষেবা সহজলভ্য হয়।
৮। যে রাষ্ট্রের সরকার প্রযুক্তির ব্যবহারে তার শাসনকে করে তোলে সকলের কাছে গ্রহণীয়, স্বচ্ছ ও সহজে সংযোগকরণীয়, আর আইন যেখানে সরল হওয়ায় সরকার হয় দুর্নীতিমুক্ত।
৯। যে রাষ্ট্রে দারিদ্র্য সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্ত, অশিক্ষা এবং মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিলুপ্তি ঘটেছে, আর সমাজের কোনও ব্যক্তিই যেখানে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবেন না।
১০। যে দেশ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাসযোগ্য স্থান, আর যে দেশ একশো কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে।
২. শপথ
পর্ব ২ : শপথ
ছয়: যুবসমাজ
একজন শিক্ষক, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে মিলিত হয়েছি। সংসদ এবং বিভিন্ন বিধানসভাগুলিতে রাজনৈতিক নেতা ও সদস্যদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। স্কুলগুলিতে আমার দেখা হয়েছে পড়ুয়া ও শিক্ষকদের সঙ্গে। ডাক্তার ও প্যারামেডিকাল স্টাফদের সঙ্গে দেখা হয়েছে হাসপাতালগুলিতে। দেশের দূর দূর স্থানে আমি মিলিত হয়েছি উপজাতি নেতাদের সঙ্গে। আমি যেখানেই গিয়েছি সেখানকার গোষ্ঠী বা তাঁদের পেশার কথা মাথায় রেখে আমি তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই শপথগুলি তাঁদের জীবনে প্রভাব ফেলে, অথবা খুব ক্ষুদ্রভাবে হলেও তাঁদের জীবনে পরিবর্তন এনে দেয়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, পূর্ববর্তী কোনও এক অধ্যায়ে আমি আমার ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেরালার ওয়্যানাড ভ্রমণের কথা লিখেছি। জহর নবোদয় বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের সঙ্গে সেখানে আমার দেখা হয়েছিল ভোর ২.৩০-এর সময়ে। ওই সময়তেও তারা ছিল তরতাজা জীবনীশক্তিতে ভরপুর। তারা খুশি মনে আমার দেওয়া দশ দফার এই শপথটি পাঠ করেছিল:
১। আমার জীবনে একটি লক্ষ্য থাকবে যার জন্য আমি পরিশ্রম করব। আমি মনে করি লক্ষ্য ক্ষুদ্র হওয়া এক অপরাধ।
২। আমি নিষ্ঠার সঙ্গে আমার কাজ করব এবং সফলও হব সততার সঙ্গে।
৩। আমি আমার পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের ও বিশ্বের এক ভাল সদস্য হব।
৪। আমি সকল সময়ে সচেষ্ট থাকব কাউকে রক্ষা করতে বা তাঁর জীবনকে উন্নত করতে— তা তিনি যে-কোনও গোত্রের, বর্ণের, ভাষার, ধর্মের বা প্রদেশের হোন।
৫। আমি যেখানেই থাকি, যাই করি, আমি নিজেকে প্রশ্ন করব, ‘আমি কী দিতে পারি।’
৬। সময়ের গুরুত্ব আমি সকল সময়ে মনে রাখব। আমার মন্ত্র হবে: ‘আমার এই মুক্ত বিহঙ্গের সময়টিকে নষ্ট হতে দেব না।’
৭। আমি সকল সময়ে পরিচ্ছন্ন পৃথিবী আর পরিচ্ছন্ন শক্তির জন্য কাজ করব।
৮। রাষ্টের যুবসমাজের একজন হিসেবে নির্ভয়ে আমার সকল কাজে সাফল্য পেতে সচেষ্ট হব, এবং অন্যের সাফল্যে আনন্দ পাব।
৯। আমি আমার বিশ্বাসের মতোই তরতাজা এবং আমার সন্দেহর মতোই প্রাচীন। তাই বিশ্বাসের দীপশিখা আমার হৃদয়ে জ্বালিয়ে রাখি।
১০। জাতীয় পতাকা আমার হৃদয়ে সর্বক্ষণ উড্ডীন এবং আমার রাষ্ট্রের জন্য আমি নিয়ে আসব গৌরব।
একটি সমাজের, তার যুবজগতের স্বপ্ন, উদ্বেগ, ভাবনাচিন্তা, আশা আকাঙ্ক্ষার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত সকল সময়ে, কারণ ভবিষ্যত্টা তারাই নির্ধারণ করবে। ২০১১ সালের গণনা অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ হল কুড়ি বছরের নীচের জনগণ। আমি প্রায়ই বলে থাকি যে, এই পৃথিবীর উপরনীচে সব থেকে শক্তিশালী সম্পদ হল প্রজ্বলিত যুবসমাজ। আমি নিশ্চিত যে, যুবশক্তিকে সঠিক পথে চালিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে পারলে মানবসমাজে রূপান্তর ঘটবে তার অগ্রগতি, নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা এবং সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি নিয়ে আসার জন্য।
পৃথিবীর সামনে যে মূল সমস্যাগুলি রয়েছে সেগুলি নিয়ে এবার আলোচনায় আসা যাক। দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী বাস করে দারিদ্র্যে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরাপদ পানীয় জল পাওয়া যায় না, ভাল শিক্ষার কথা তো বাদই দেওয়া হল। এই পরিস্থিতির সংস্কারে যুবসমাজ কীভাবে সাহায্য করতে পারে? একজন শিক্ষিত তার সারা জীবনে অন্তত পাঁচজনকে কী অক্ষর শিক্ষা করাতে পারে? জল সংরক্ষণের বার্তা যুবসমাজ কী প্রচার করতে পারে? চিরাচরিতের বাইরে তার বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের পথ কী বের করতে পারে?
কিছু বছর আগে Lead India ২০০২ নামে একটি অভিযান শুরু করি আমি। এটি মূলত একটি যুবসমাজের অভিযান। আমার দশ দফা শপথের উপর ভিত্তি করে এটি তৈরি করি। কারণ, আমি মনে করি, শিক্ষা, পরিবেশ, সামাজিক ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে এবং গ্রাম-শহর বিভাজন কমিয়ে আনতে যুবসমাজই সক্ষম। নিজস্ব লক্ষ্যে পৌঁছনোর চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা জাতীয় উন্নয়নেও ভাগ নেন। আমি আবারও বলি, ক্ষুদ্র লক্ষ্য রেখে এগোনো এক অপরাধ। এক যুবক বা যুবতী নিজের জীবন বা পেশা গড়তে যে কাজ করেন তার সঙ্গেই তাঁর পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সমগ্র মানবজাতির সেবায়ও নিয়োজিত থাকেন। প্রতিটিই অন্যের পরিপূরক।
আমার তৈরি এই শপথের পিছনে আছে কিছু তত্ত্ব, কিছু ছোট ছোট ঘটনা, এবং আছে বিভিন্ন ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চিন্তানায়কদের শিক্ষা। সেই প্রেক্ষিতের কাহিনিগুলি আপনাদের বলা যাক।
১। অন্যের জীবনকে রক্ষা কর বা তার উন্নতিসাধন কর
মহাত্মা গাঁধীর মা একবার তাঁকে বলেছিলেন: ‘পুত্র, তুমি যদি তোমার সারা জীবনে কোনও মানুষের জীবনকে রক্ষা করতে পার বা তাঁর জীবনে উন্নতি নিয়ে আসতে পার, তা হলে জেনো যে, তোমার মানবজীবন সার্থক। তুমি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য।’ এই পরামর্শ গাঁধীজির উপর গভীর প্রভাব ফেলে যা তাঁকে সারা জীবন মানবজাতির জন্য কাজ করে যেতে অনুপ্রাণিত করে।
২। ‘আমি’ শব্দটিকে নিজের দর্শন থেকে দূর কর
২০০৩-এ অরুণাচল প্রদেশ ভ্রমণের সময়ে আমি তাওয়াং-এ একটি ৪০০ বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মনাস্ট্রিতে গিয়েছিলাম। সারাদিনই প্রায় সেখানে অতিবাহিত করি। ওই প্রচণ্ড ঠান্ডায় আমি লক্ষ করলাম, সেখানকার আশপাশের গ্রামের মানুষদের ভিতর থেকে এক আশ্চর্যরকমের সুখানুভূতি নির্গত হচ্ছে। সেই মন্দিরের সব বয়সের ভিক্ষুদের মধ্যে দেখলাম এক প্রশান্তি। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, তাওয়াং বা আশপাশের গ্রামগুলিতে কী এমন বস্তু আছে যার জন্য এখানকার মানুষজনের মধ্যে এত শান্তি বিরাজ করে। মনাস্ট্রির প্রধানকে আমি এই প্রশ্নটা করলাম।
তিনি তাত্ক্ষণিক কোনও উত্তর দিলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি হেসে বললেন, ‘আপনি ভারতের রাষ্ট্রপতি। আমাদের এবং সারা দেশের সব কিছু সম্পর্কে আপনার জানা উচিত।’
আমি বললাম, ‘আপনি দয়া করে আপনার সুচিন্তিত বিশ্লেষণ আমাকে জানান। আমার খুব প্রয়োজন এটা জানার।’
আমাদের ঠিক পিছনেই বুদ্ধর হাস্যোজ্জ্বল প্রদীপ্ত স্বর্ণাভ মূর্তি। প্রধান ভিক্ষু প্রায় একশো যুব এবং প্রবীণ অভিজ্ঞ ভিক্ষুদের সেখানে জড়ো করলেন। তিনি এবং আমি তাঁদের মাঝে বসলাম। তিনি তাঁদের একটি ছোট বক্তৃতা দিলেন, যা আমি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
‘বর্তমান পৃথিবীতে অবিশ্বাস ও অসন্তোষ হিংসাতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই মনাস্ট্রি এই বার্তাই প্রচার করে যে, যখনই তুমি “আমি”-কে তোমার মন থেকে সরিয়ে দিতে পারবে তখনই তোমার অহং-ও বিলুপ্ত হবে। তুমি যে মুহূর্তে তোমার আমিত্ব ত্যাগ করতে পারবে, তখনই অন্যের প্রতি তোমার ঘৃণা দূর হবে। যে মুহূর্তে ঘৃণা তোমার মন থেকে দূর হবে সেই ক্ষণেই হিংস্রতা অদৃশ্য হয়ে যাবে। হিংস্রতা দূর হলেই সেই জায়গায় শান্তি প্রস্ফুটিত হবে। এবং তখনই সমাজে শান্তি আর শুধু শান্তিই ফুটে উঠবে।’
এইভাবেই আমি জানতে পারলাম প্রশান্তিময় জীবনের সুন্দর সূত্রটি। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন কাজটি হল ‘আমি’-কে চিন্তার জগৎ থেকে সরিয়ে ফেলা। তাই আমাদের প্রাচীন দার্শনিক জ্ঞানীদের শিক্ষা আমাদের সন্তানদের মধ্যে প্রোথিত করতে হবে তাদের কম বয়স থেকেই।
৩। ক্ষমাশীলতা
আমার প্রশ্ন, ‘কীভাবে একটি প্রশান্তিময় সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ে ওঠে?’, তার উত্তরের একটি অংশ পেয়েছিলাম তাওয়াং-এ। কিন্তু সম্পূর্ণ সত্যের অন্বেষণ আমার জারি ছিল। ওই বছরই তারপর বুলগেরিয়া ভ্রমণে গেলাম আমি।
দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের শেষে আমি সেখানকার বিখ্যাত রিলা মনাস্ট্রিতে গেলাম। দশম শতাব্দীতে বুলগেরীয় সন্ন্যাসী সন্ত ইভান রিল্স্কির ভক্তরা মিলে নির্মাণ করেছিলেন এই মনাস্ট্রি। ওই দেশের এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যাবার পর ঊনবিংশ শতকে এটি সম্পূর্ণভাবে পুনর্নির্মিত করা হয়। বুলগেরীয়দের কাছে পবিত্র এই স্থানের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে আমার কৌতূহল ছিল। আমি সেখানকার যাজকদের সঙ্গে তাওয়াং-এর বার্তাটি বিষয়ে আলোচনা করলাম। তাঁরা আমার প্রশ্নের উত্তরের অন্য অংশটি জানালেন।
তাঁদের মূল বার্তাটি হল, ক্ষমাশীলতা, যা এক পবিত্র জীবনের ভিত্তি তৈরি করে।
৪। দানধ্যান এনে দেয় শান্তি ও সুখ
২০০৪ সালে তেমনই এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দর জন্মভিটায়। উত্তর কলকাতার ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে তাঁর পৈতৃক বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করে জনসাধারণের জন্য ওই বছর অক্টোবরে খুলে দেওয়া হয় প্রচুর আনন্দোত্সাহের সঙ্গে। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় উদ্বোধনের জন্য।
১৮৬৩ সালে ওই বাড়িতে স্বামীজি জন্মগ্রহণ করেন। ওই সময়ে বাড়িটির চার ধারে বাগান আর তার ওপারে ছিল একটি উন্মুক্ত স্থান। পরবর্তীকালে শহরের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটিতে যাওয়ার রাস্তাটি সরু হতে শুরু করে এবং তা একটি গলিপথে পরিণত হয়। অষ্টাদশ শতকের বাড়িটির ভগ্নদশা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রামকৃষ্ণ মিশন সেটিকে অধিগ্রহণ করে পুনর্নির্মাণ করে একটি স্মারক সংগ্রহশালাতে পরিণত করে।
তার সঙ্গে পাশের জমিতে তৈরি হয়েছে একটি সাংস্কৃতিক ও গবেষণা কেন্দ্র এবং একটি পাঠ্যবইয়ের গ্রন্থাগার।
উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে স্বামীজির শিষ্যদের আমি আমার তাওয়াং অভিজ্ঞতার কথা বললাম। তাঁরাও মনে করেন এটি একটি অপূর্ব বার্তা। এর সঙ্গে তাঁরা যোগ করলেন, কাউকে কোনও দান অর্পণ করলে বৃদ্ধি পায় সুখ শান্তি।
৫। ভাল কাজ এনে দেয় শুভ ক্রিয়া
একবার রাজস্থানের অজমেরে খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির বিখ্যাত দরগায় আমি গিয়েছিলাম। শুক্রবারের নামাজ পাঠের পর আমি এক সুফি জ্ঞানীজনের সঙ্গে আলোচনায় বসি। তিনি আমায় বলেন যে, সর্বশক্তিমানের সৃষ্ট এই মানুষ আজ এক শক্তিমান শয়তানের সম্মুখীন। সে মানুষকে মন্দ কাজে প্রলুব্ধ করছে। একমাত্র ভাল কাজই পারে ভাল চিন্তার জন্ম দিতে, এবং শুভ চিন্তাই সেই ক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে যা থেকে, সর্বশক্তিমানের নির্দেশে, বিচ্ছুরিত হয় প্রেম।
আমি যখন দশ বছরের বালক আমি প্রায়ই দেখতাম যে, আমাদের বাড়িতে তিনজন মানুষের আলোচনা হত। এঁরা হলেন পক্ষী লক্ষ্মণ শাস্ত্রীগাল [Pakshi Lakshmana Sastrigal], বিখ্যাত রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত এবং একজন বৈদিক পণ্ডিত; রেভারেন্ড ফাদার বোদেল [Bodel], যিনি রামেশ্বরম দ্বীপের প্রথম চার্চটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; এবং আমার পিতা যিনি ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। এঁরা নিজেদের মধ্যে বসে দ্বীপটির সমস্যাগুলি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতেন এবং সমাধান সূত্র বের করে দিতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নিজেদের সহমর্মিতা দিয়ে সেতু রচনা করতেন।
যুবসমাজ কী ধরনের বিশ্ব নির্মাণে এগোবে— এই কথা চিন্তা করলেই ওই স্মৃতি আমার মনে আসে। মনের মিলন ও সম্প্রীতি হল ভারতের হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি। আমি এই কথাই বলব যে, আমাদের যুবশক্তিকে বোঝাতে হবে যে, সমাজে বিচ্ছিন্নতাবাদকে অতিক্রম করতে হবে তাদের। সারা বিশ্বের ও আমাদের দেশের অগণিত সমস্যার বহু ক্ষেত্রেই সমাধান পাওয়া যাবে যদি এই পথে তারা এগোয়।
.
সাত : শিক্ষক
দেশের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ধরে দেড় কোটির বেশি স্কুলপড়ুয়ার সঙ্গে আমার সংযোগ ঘটেছে। অরুণাচল প্রদেশ হোক, নাগাল্যান্ড হোক বা মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত বা কর্ণাটক হোক, অথবা জম্মু ও কাশ্মীর বা ভারতের অন্য যে-কোনও অংশ হোক— যুবকণ্ঠস্বরটি অনন্য এবং পরাক্রমী। তারা তাদের লক্ষ্যে দৃঢ় ও অচঞ্চল, এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে উদ্যোগী। তাদের সকলের স্বপ্ন, তারা বাস করবে এক সমৃদ্ধশালী ভারতে, এক সুখী ভারতে, এক শান্তির ভারতে, এবং এক নিরাপদ ভারতে। সমৃদ্ধি, সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তাকে মিলতে হবে এক বিন্দুতে, তবেই ভারত হবে এক আদর্শ উন্নত রাষ্ট্র। এবং আমাদের সন্তানদের স্বপ্ন ও লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে পারে যে চালকযন্ত্র তা হল শিক্ষকসমাজ। আমি যখনই কোনও শিক্ষার্থী আর শিক্ষকদের সমাবেশে ভাষণ দিতে যাই, আমি অনুভব করি যে আমি মিলিত হচ্ছি এমন একটি গোষ্ঠীর ছোট্ট এক অংশের সঙ্গে যারা ভারতের ভবিষ্যৎ গড়ার ভিত্তি তৈরি করবে। শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীর মনকে প্রজ্বলিত করে দেন। সরকারি হিসেবমতে দেশে সাড়ে ষাট লক্ষ স্কুলশিক্ষক আছেন। এঁরা প্রত্যেকেই এক একটি প্রজ্বলিত দীপ যা আলোকিত করে দেয় আরও বহুজনকে। ছেলেমেয়েরা গড়ে ২৫,০০০ ঘণ্টা অতিবাহিত করে তাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। সুতরাং শিক্ষকদের কাছে অনেকটাই সময় থাকে তাঁদের পড়ুয়াদের সামনে রোল মডেল হয়ে নিজেদের দাঁড় করাতে।
আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?
আমরা প্রত্যেকেই শিক্ষার বিভিন্ন স্তর পার হয়ে এসেছি। আমি কখনও কখনও ভাবি যে, ওই প্রতিটি স্তরে মানুষের চাহিদা সম্পর্কে আমাদের প্রতিক্রিয়া আমরা কেমনভাবে প্রকাশ করি? শিশু প্রশ্ন করে, ‘আমার জন্য তুমি কী করতে পার?’ কিশোর বলে, ‘আমি নিজেই করে নিতে চাই।’ যুবক সোচ্চারে বলে ওঠে, ‘চল সকলে মিলে করি।’ নেতা বলেন, ‘আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’ শিক্ষকরা, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বা প্রধান, তাঁরা এক শিশুকে এক নেতায় রূপান্তর করে দিতে পারেন— ‘আমার জন্য তুমি কী করতে পার?’ থেকে ‘আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’-তে। এটি করতে গেলে তাঁদের দ্রষ্টা হতে হবে। সঙ্গে থাকতে হবে অনুপ্রেরণা দেবার ক্ষমতা। অধ্যক্ষদের এটাও দেখতে হবে যে, শিক্ষকরা যেন এমনভাবে শিক্ষা দেন যাতে শিক্ষার্থীদের ভিতরের শ্রেষ্ঠ গুণগুলি প্রকাশ পেতে পারে। এটি করতে গেলে অধ্যক্ষকে এক আদর্শ শিক্ষক হতে হবে।
আমি নিশ্চিত যে, শ্রেষ্ঠ মনন প্রকাশ পেতে পারে একমাত্র অধ্যক্ষ, শিক্ষক আর অভিভাবকের এক যৌথ প্রভাবে।
ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময়
মানুষের মন এক অনন্য উপহার যেন। আপনার যদি অনুসন্ধিত্সা থাকে আর আপনি যদি চিন্তাশীল হন, তবেই আপনি, আমি যাকে বলি ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময়, তাতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবেন। আপনার জীবনযাপনে যতই চড়াই-উতরাই থাক, এই কৌতূহল আর চিন্তাশক্তি আপনার সব থেকে মূল্যবান সম্পদ। চিন্তাই প্রগতি। অ-চিন্তা একটা মানুষের জীবনে বা কোনও প্রতিষ্ঠানে বা দেশে এনে দেয় এক বদ্ধ অবস্থা। চিন্তাই জন্ম দেয় ক্রিয়াশীলতার। ক্রিয়া ছাড়া জ্ঞান অর্থহীন এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। জ্ঞানের সঙ্গে ক্রিয়া নিয়ে আসে সমৃদ্ধি।
শিক্ষকদের উচিত তরুণ মনের লালন করে মানবজীবনের প্রতিটি দিকের অন্বেষণ করা। আকাশের দিকে তাকান। আমরা সেখানে একা নই। সারা ব্রহ্মাণ্ড আমাদের সাথি। যাঁরা স্বপ্ন দেখতে চান তাঁদেরই সে দেয় তার শ্রেষ্ঠ দান। সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের ক্ষেত্রে যেমন। তারাদের বিবর্তন সম্পর্কে তাঁর গাণিতিক বিশ্লেষণ, বৃহদাকার তারাদের এবং কৃষ্ণ গহ্বরগুলির বিবর্তনের পরবর্তী পর্যায়গুলি সম্পর্কে এখনকার চলতি বেশ কয়েকটি তাত্ত্বিক মডেল তৈরিতে সাহায্য করেছে। কেন কিছু তারা জ্বলজ্বল করে আর কেন কিছু মরে যায়, তাঁর সেই কৌতূহলী প্রশ্ন থেকেই শুরু তাঁর অনুসন্ধান। আজ Chandrasekhar Limit ব্যবহার করে আমরা গণনা করতে পারি সূর্য আর কতদিন তার আলো বিচ্ছুরণ করতে পারবে।
অথবা নেওয়া যাক স্যার সি ভি রমনের উদাহরণ। সমুদ্র আর আকাশের দিকে চেয়ে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, সমুদ্রকে কেন নীল হতে হল। এর থেকেই জন্ম হল Raman Effect-এর। তিনি দেখলেন সমুদ্রের নীল রং আলোর অণুর বিচ্ছুরণের ফলে হয়। সাধারণ মানুষ যেমন ভাবেন আকাশের প্রতিফলনের কারণে হয়— তা কিন্তু নয়। কিংবা অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, যিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হল কীভাবে। তার থেকেই জন্ম হল সেই বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2, যা ঘটিয়ে দিল নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যায় এক বিপ্লব।
ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ১৯৬০-এর দশকে। প্রোফেসর বিক্রম সারাভাই ভারতকে দেখালেন সম্পূর্ণ দেশজ অন্তরিক্ষ প্রকল্পের স্বপ্ন। তিনি বললেন, ভারতের উচিত নিজস্ব রকেট সিস্টেম এবং যোগাযোগ ও রিমোট সেন্সিং উপগ্রহ নির্মাণ করে নিজস্ব কেন্দ্র থেকে তা উৎক্ষেপণ করা। তিনি যে স্বপ্নগুলি দেখেছিলেন আজ ভারতের কাছে সব কিছুই মজুত।
সকল শিক্ষককে অনুরোধ করতে চাই যে, তাঁরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের স্যার সি ভি রমন বা অ্যালবার্ট আইনস্টাইন অথবা সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর বা বিক্রম সারাভাইর মতো মহান চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন যদি। আমি তাঁদের উদ্দেশে বলব যে, ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময় অবলোকন করে উপলব্ধি করুন যে, আপনার মধ্যে আছে সেই ক্ষমতা যা বিরাট বিরাট চিন্তাবিদের জন্ম দিতে পারে।
শুভ নীতিজ্ঞান যুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা
তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফস কলেজে ছাত্রাবস্থায় শোনা রেভারান্ড ফাদার কালাথিলের বক্তৃতাগুলি এখনও আমার স্মৃতিতে আছে। জেস্যুইট প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন প্রধান। প্রতি সোমবার তিনি একটি একঘণ্টার ক্লাস নিতেন। প্রাচীন এবং বর্তমান সময়ের আদর্শ কিছু মানুষ সম্পর্কে তিনি সেই ক্লাসে বলতেন। গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, সন্ত অগাস্টিন, কালিফা ওমর, মহাত্মা গাঁধী, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, এবং আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো মহান ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলতেন। তিনি আমাদের সভ্যতার ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু নীতিকাহিনিও বলতেন। মরাল সায়েন্স ক্লাসে ফাদার কালাথিল বুঝিয়ে দিতেন যে, কীভাবে অভিভাবকদের যত্ন, শিক্ষা আর ভাল বইয়ের সান্নিধ্যে এসে এই মহাপুরুষরা বিকশিত হয়েছিলেন।
১৯৫০-এর দশকে যখন আমি কলেজ ছাত্র, তখন শোনা সেই বক্তৃতা আজও ছ’টি দশক পার করে আমায় উদ্বুদ্ধ করে। আমি মনে করি, স্কুলে বা কলেজে প্রতি সপ্তাহে ভারতের সভ্যতার ঐতিহ্য বিষয়ে এক ঘণ্টার একটি বক্তৃতা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি প্রত্যেক ভাল শিক্ষকের। এর ফলে শিক্ষার্থীরা থাকবে এক শুভ নৈতিক যাপনে। এর থেকেই দেশের প্রতি, দশের প্রতি একটি ভালবাসা জন্ম নেবে। তরুণ বয়স থেকেই প্রতিটি নাগরিকের ভিতর প্রোথিত হয়ে যাবে নীতিজ্ঞান।
রাষ্ট্রনির্মাণের ক্ষমতা
সব থেকে মূল্যবান যে কর্মকাণ্ডে শিক্ষকরা নিজেদের যুক্ত করতে পারেন তা হল রাষ্ট্রনির্মাণের ক্ষমতা সৃষ্টি করা। শিক্ষার পরিমণ্ডলে কী ধরনের মানুষ আমরা হতে চাই? আমাদের সন্তানদের আমরা কোন কোন ক্ষমতা দিতে চাই? আমরা যদি তাদের কোনও ক্ষমতা দিতে আগ্রহী হই, তো আমাদের প্রশ্ন করতে হবে: কীসের জন্য সেই ক্ষমতা? আমরা আমাদের সন্তানদের দেব অর্থনীতির উন্নতি আনার আর রাষ্ট্র গড়ার ক্ষমতা। কোন ধরনের রাষ্ট্র ভারত গড়তে চায়?
ভারতকে ২০২০ সালের ভিতর এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে আমাদের লক্ষ্য। পাঁচটি ক্ষেত্র আছে যেখানে একযোগে উন্নয়ন করতে হবে: কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়া; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি; পরিকাঠামো উন্নয়ন যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নদী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক; এবং জটিল প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা।
এই লক্ষ্য পূরণে স্কুলগুলিতে আর তার পড়ুয়াদের ভিতর যে ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন সেগুলি হল: গবেষণা ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা; মননশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা বিশেষ করে তথ্য হস্তান্তরে মননশীলতা; উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা; উদ্যোগী নেতৃত্বের ক্ষমতা; এবং নৈতিক নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা।
১। গবেষণা ও অনুসন্ধান
আমাদের আঙুলের গোড়ায় জ্ঞান ও তথ্যের যে ভাঁড়ার তার ব্যবস্থাপনা হবে একুশ শতকের অভিমুখ। আমাদের সন্তানদের দিতে হবে সেই ক্ষমতা যার সাহায্যে তারা জ্ঞান ও তথ্যের সাগর সাঁতরে পার হয়ে তার সঠিক প্রয়োগ করবে। প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা আজ সততই হতে পেরেছি জীবনভরের পড়ুয়া, যে পড়ুয়াদের প্রয়োজন হয় যে-কোনও নিরন্তর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতিতে।
২। মননশীলতা ও উদ্ভাবন এবং তথ্যের মননশীল হস্তান্তর
অন্যকে শিক্ষাদানে আমাদের নিজেদের শিক্ষা হয় সব থেকে ভাল। একুশ শতকে জ্ঞানের ব্যবস্থাপনা কোনও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতার বাইরে। যে তথ্য ভাণ্ডার থেকে কিছু আহরণ করা সম্ভব তার পরিমাণ এত বৃহৎ যে, তা কোনও ব্যক্তিবিশেষের আয়ত্তে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং তথ্যের ম্যানেজমেন্ট ব্যক্তির আওতা থেকে সরে গিয়ে তা এখন সমাজের আওতায় চলে গেছে। সকলে মিলে সংঘবদ্ধ হয়ে কী করে তথ্যের পরিচালনা করা যায়, তা আমাদের শিখতে হবে। অর্থাৎ, নিজেদের শুধু শিক্ষিত করে তুললে হবে না, অন্যকেও শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
৩। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার
আমাদের স্কুলগুলির প্রতিটি শিক্ষার্থীর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার জানতে হবে, তার শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োজনেই। স্কুলগুলির উচিত আধুনিক হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, ল্যাবরেটরি সরঞ্জাম এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থায় সুসজ্জিত থাকা। সেই রকম বাতাবরণ তৈরির প্রয়োজন আছে যাতে পড়ুয়ারা তাদের শিক্ষাগ্রহণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।
৪। উদ্যোগী নেতৃত্ব
উদ্যোগী নেতৃত্বের তিনটি দিক আছে। প্রথম, সমস্যার খোঁজ করে তাকে উন্নয়নের প্রেক্ষিতে সমাধান করে ফেলা। উদ্যোগপতি হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হল আমাদের চাহিদা কী তা বুঝে নেওয়া এবং তার সঙ্গে বুঝে নেওয়া যে, মানুষ হিসেবে সকলেরই চাহিদা একই ধরনের হয়। দ্বিতীয়, ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা। উদ্যোগপতি অন্যের থেকে ভিন্নভাবে কাজ করেন, সাহসী চিন্তা করেন, এবং তা সকল সময়েই হয় ঝুঁকিপূর্ণ। বৃহৎ লাভের জন্য কেমন ভাবে পরিকল্পিত ঝুঁকি নিতে হয়, তার শিক্ষা আমাদের সন্তানদের দিতে হবে। তৃতীয় অংশটি হল সঠিকভাবে কাজ করার সদিচ্ছা।
৫। নৈতিক নেতৃত্ব
নৈতিক নেতৃত্বের দু’টি বিষয় আছে। প্রথমত, বাধ্যকারী এবং শক্তিশালী স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা থাকতে হবে, যার লক্ষ্য হবে মানুষের কল্যাণ। অর্থাৎ, যে অবস্থায় আজ মানুষ আছে, ভবিষ্যতে তার থেকে উন্নত অবস্থায় তাকে তুলে আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, যেখানে উদ্যোগী নেতৃত্ব চায় মানুষ সঠিক কাজ করার অভ্যাস করুক, সেখানে নৈতিক নেতৃত্ব সঠিক কাজ করার সদিচ্ছা তৈরি করে দেবে, এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্যকেও সেই সঠিক কাজ করার প্রেরণা দেবে।
যদি আমাদের স্কুলগুলি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি একুশ শতকের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে চায়, তা হলে শিক্ষা প্রদানকারীদের নিজেদের মধ্যে নৈতিক নেতৃত্বের চর্চা করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা সঞ্চারিত করতে হবে। স্কুলগুলির জন্য এবং স্কুলশিক্ষার বিষয়ে তাঁদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে পড়ুয়ারা অধ্যয়নের মাধ্যমে স্বশাসিত হয়ে বেড়ে উঠতে পারে।
আমাদের সন্তানদের জন্য তেমনই এক শিক্ষার প্রয়োজন যা রাষ্ট্রকে দেবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ একনিষ্ঠ নেতা, যারা ভারতকে এক সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ, সুখী রাষ্ট্রে রূপান্তর করে দেবে।
এই পাঁচটি গুণ যদি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রোথিত করে দেন তাদের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা, তা হলে তাদের মধ্যে তৈরি হবে জীবনভর জ্ঞানার্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। অন্যের কাছে তা হবে এক দৃষ্টান্তও। অর্থাৎ, তারা হয়ে উঠবে আদর্শ শিক্ষার্থী। ক্লাসরুম ছাড়াও তারা শিক্ষা নেবে তাদের পারিপার্শ্বিক থেকে। আমি নিশ্চিত করে বিশ্বাস করি যে, প্রত্যেক শিক্ষকের লক্ষ্য হল তেমনই আদর্শ শিক্ষার্থী তৈরি করা। এই কথা মনে রেখে আমি একটি এগারো-দফার শপথ তৈরি করেছি যা আমি চাই সারা ভারতের সব শিক্ষক যেন মেনে চলেন:
১। সর্বাগ্রে, আমি শিক্ষাদানকে ভালবাসব। শিক্ষকতাই হবে আমার আত্মা।
২। আমি মনে করি যে, আমি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলাই নয়, আমি গড়ে তুলব সেই সব প্রজ্বলিত মনের তরুণদের যারা পৃথিবীতে, পৃথিবীর উপরে ও পৃথিবীর নীচে সর্বশক্তিমান সম্পদ। আমি এই শিক্ষকতার মহান মিশনে থাকব সম্পূর্ণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও একনিষ্ঠ।
৩। আমি নিজেকে একজন মহান শিক্ষক হিসেবে দেখব কারণ, একজন সাধারণকে অসাধারণ স্তরে উন্নীত করে দিতে পারে আমার শিক্ষাদান।
৪। উদারতা ও স্নেহ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আমার সকল কাজ চালিত করব। তাদের কাছে আমি হব একাধারে মাতা, ভগিনী, পিতা বা ভ্রাতা।
৫। আমি আমার জীবনকে এমনভাবে চালিত করব যে, আমার জীবনই হবে আমার শিক্ষার্থীদের কাছে এক বার্তা।
৬। আমার ছাত্রছাত্রীদের আমি উৎসাহিত করব যাতে তারা প্রশ্ন করে আর তাদের মধ্যে একটা অনুসন্ধিৎসার স্পৃহা জন্মায়, যাতে তারা মননশীল আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক হয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
৭। আমার সকল ছাত্রছাত্রীকে আমি সমান চোখে দেখব এবং ধর্ম, বর্ণ বা ভাষার ভিত্তিতে তাদের পৃথকীকরণকে সমর্থন করব না।
৮। আমি আমার শিক্ষকতার ক্ষমতাকে সর্বক্ষণ বর্ধিত করার চেষ্টা করব যাতে আমি আমার শিক্ষার্থীদের দিতে পারি উৎকৃষ্ট শিক্ষা।
৯। আমার শিক্ষার্থীদের জন্য আমি অসম্ভব গর্বিত হব।
১০। আমি উপলব্ধি করি যে, সব ধরনের জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্পে এক শিক্ষক হিসেবে আমার মূল্যবান যোগদান আছে।
১১। আমার সর্বক্ষণের প্রচেষ্টা থাকবে যাতে উৎকৃষ্ট চিন্তায় আমার মন ভরে থাকে এবং যাতে আমি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারি চিন্তায় ও কর্মে আভিজাত্য।
.
আট : কৃষক
কবি-সন্ত তীরুভাল্লুভারের ভিটে তামিলনাডু থেকে আমি এসেছি। প্রায় ২২০০ বছর আগে তিনি রচনা করেছিলেন ১৩০০ দ্বিপদী যাকে একত্রে বলা হয় তীরুক্কুরাল। এর মধ্যে দশটি দ্বিপদী কৃষকদের উদ্দেশে রচিত যেখানে তাঁদের পেশাকে উদ্যাপিত করা হয়েছে। তীরুক্কুরাল পাঠ করেই আমি বড় হয়েছি। আমাদের দেশের কৃষকদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। সর্বশেষ গণনা অনুযায়ী ভারতে রয়েছেন ১২ কোটি চাষকর্মী। প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মশক্তি আমাদের দেশে রয়েছে কৃষিতে, যা গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি)-র ১৩.৭ শতাংশ।
তিনটি অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই, যা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে ভারতের কৃষিসমাজ আমাদের রাষ্ট্রকে মহান করে তুলে ধরতে পারে। একটি কাহিনি বিহারের, অন্যটি তামিলনাডুর আর তৃতীয়টি গুজরাতের।
দ্বিগুণ উৎপাদনশীলতা, বিহার
টেকনোলজি ইনফর্মেশন, ফোরকাস্টিং অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট কাউন্সিল (টিআইএফএসি) দল ২০০০ সালে বিহারের আরপি চ্যানেল ৫ আর মাঝোলি শাখানদী অঞ্চলে একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। পরবর্তী সময়ে কৃষকদের অনুরোধে তা সম্প্রসারিত হয় পালিগঞ্জ ও পাঁচটি অন্য শাখানদী অঞ্চলে। এই পরীক্ষাটি টিআইএফএসি পরিচালনা করলেও সঙ্গে ছিল কৃষকদের একটি সমবায় সমিতি, ভারতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থা (আইএআরআই), এবং বিহারের পুসাতে অবস্থিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারে উৎপাদন হল দ্বিগুণ। এই পদ্ধতিগুলির মধ্যে ছিল মাটির শ্রেণিগত চরিত্র নিরূপণ, মাটির চরিত্র অনুযায়ী সঠিক বীজের নির্বাচন, সময়মতো রোপণ, সার ও কীটনাশকের সঠিক নির্বাচন, জলের ব্যবস্থা এবং ফসল তোলার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রণালীর সঠিক প্রয়োগ। প্রতি হেক্টর জমিতে ২ টনের জায়গায় ৫.৮ টন ধান চাষ হল। গমের ক্ষেত্রে ০.৯ টনের পরিবর্তে ২.৬ টন প্রতি হেক্টর। বর্তমানে ধান ও গম চাষ হয় ২৫০০ হেক্টর জমিতে এবং সেখানে যুক্ত আছেন ৩০০০ জন কৃষক।
অন্যান্য রাজ্যেও এই সাফল্য কাহিনির পুনরাবৃত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রিসিশন চাষ পদ্ধতি, তামিলনাডু
প্রিসিশন চাষ বা কৃষি হল এক ধরনের প্রযুক্তি যা তামিলনাডুতে প্রয়োগ হয়েছে। কৃষির সঠিক কাজ, সঠিক স্থানে, সঠিক সময়ে করাই হল এই প্রযুক্তি। এর ফলে উচ্চ হারে উৎপাদন হয়েছে, কৃষক সরাসরি বাজারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পেয়েছে, এবং সে এক উদ্যোগপতি হয়ে উঠতে পেরেছে। এই পদ্ধতি সর্বোত্তম রোপণ ঘনত্ব, সার এবং অন্যান্য প্রয়োগ বস্তুর চাহিদা, এবং ফলনের পরিমাণ আগে থেকে সঠিকভাবে নিরূপণ করে নিতে সাহায্য করে। স্থানীয় মাটি এবং আবহাওয়াকে ধর্তব্যে না রেখে কোনও ফসলে অবাঞ্ছিত পদ্ধতি প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে এই পদ্ধতি। অর্থাৎ, শ্রম, জল, সার ও কীটনাশক জাতীয় প্রয়োগ বস্তুর মাত্রা কমিয়ে উৎকৃষ্ট মানের ফসল পাওয়া যায়।
২০০৪-০৫ সালে তামিলনাডুর ধর্মাপুরি জেলায় প্রথম প্রিসিশন ফার্মিং প্রোজেক্ট চালু করা হয়। শুরুতে ১০০ হেক্টর জমিতে প্রয়োগ করা হয়, তারপর ২০০৫-০৬-তে ২০০ হেক্টর এবং ২০০৬-০৭-এ ১০০ হেক্টর জমিতে করা হয় এই পদ্ধতিতে চাষ। ড্রিপ পদ্ধতির সেচ স্থাপনের জন্য ৭৫,০০০ টাকা এবং ফসল ফলানোর জন্য ৪০,০০০ টাকা কৃষকদের দেওয়া হয়। তামিলনাডু এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে প্রথম ফসলটি তোলা হয়। পরবর্তী পাঁচটি ফসল কৃষকরা তোলেন তিন বছরে।
প্রথম বছর কৃষকরা গররাজি ছিলেন এই প্রকল্পটি গ্রহণ করতে। কারণ, ২০০২ সাল থেকে চলছিল লাগাতার খরা। কিন্তু ওই প্রথম ১০০ জন কৃষকের সাফল্য এবং বাজারে সেই ফসলের উচ্চ মূল্য দেখে কৃষকরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছর থেকে প্রকল্পটিতে নাম নথিভুক্ত করতে শুরু করেন।
সালেম-এ কৃষক দিবস অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এক প্রিসিশন কৃষক অশ্রুসিক্ত চোখে জানান যে, তাঁর জীবনে তিনি প্রথম এত গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা যা সর্বমোট ১০০,০০০ টাকা হয় তা চর্মচক্ষুতে দেখেন শুধুমাত্র ওই পদ্ধতিতে চাষ করে। এই ঘটনার ফলে নীতিনির্ধারকরা, ব্যাঙ্ক আধিকারিকরা, বিমা সংস্থারা ভিড় করতে থাকেন। তার ফলে কৃষিসমাজে বহু আর্থিক সহায়তা আসতে থাকে। ন্যূনতম ১০০,০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০০,০০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি হেক্টরে মুনাফা হওয়ায় প্রত্যেক কৃষকই এক একটি প্রকল্পের মালিক হয়ে উঠলেন। উদাহরণস্বরূপ, কৃষক পি এম চিন্নাসামী এক হেক্টর জমিতে পনেরো মাসে ৫০০ টন বেগুন উৎপাদন করেন। অন্য শ’য়ে শ’য়ে বেগুন চাষিদের জন্য তিনি হয়ে ওঠেন এক রিসোর্স কৃষক।
ওই পদ্ধতির প্রয়োগকারীরা পঁয়তাল্লিশটি ফসলের ফলন, রাজ্য এবং জাতীয় স্তরের গড়ের তুলনায় দ্বিগুণ করায় ওই রাজ্যে প্রিসিশন পদ্ধতিতে চাষ এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নয় শতাংশ কৃষির বৃদ্ধি, গুজরাত
গুজরাতের রাজ্য কৃষি মন্ত্রণালয় আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের কৃষি বিভাগের সঙ্গে যৌথভাবে একটি উচ্চ ফলনশীল কৃষি পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়েছে। সাধুবাদযোগ্য এই কাজের ফলে কৃষিতে রাজ্য ৯ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে নিরন্তর, যেখানে জাতীয় গড় ৩ শতাংশ। নানান বাধা যেমন, জলস্তর কমে যাওয়া, লবণাক্ততার কারণে মাটি ও জলের চরিত্র বদল, বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিপাত ও ২০০০ সাল থেকে বারবার খরার প্রকোপের মতো বিষয় সত্ত্বেও এই সাফল্য পেয়েছে গুজরাত।
কৃষি ক্ষেত্রে গুজরাতের এই ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি সারা দেশের জন্য শিক্ষণীয়। এর থেকে বেশ কয়েকটি পাঠ নেওয়া যায়। তার ভিতর গুরুত্বপূর্ণগুলি হল:
১। সঠিক সময়ে ভাল বীজ, সার ও কীটনাশক কৃষকদের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া।
২। শুধুমাত্র কৃষকদের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা যা বিদ্যুৎ পৌঁছিয়ে দেবে কম দামে।
৩। বর্ষার আগেই সব জলাশয় পলিমুক্ত করে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া।
৪। সমবায় সমিতি তৈরি করে সরকার অতিরিক্ত ফসল কিনে নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তা বিক্রি করা।
উপসংহার
দীর্ঘ কয়েক বছরে ভারতে এমন সাফল্য কাহিনি বহু আছে। জাতীয় স্তরে প্রয়োজন সেই কাহিনিগুলির বিস্তৃতভাবে পুনরাবৃত্তির। ভারতের প্রয়োজন দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের। যার ফলে কৃষিক্ষেত্রে ফলনশীলতা বৃদ্ধি পাবে বেশি মাত্রায়। ওই ধরনের বিপ্লবই কৃষকের কর্মক্ষেত্রকে শস্য ফলানো থেকে প্রসারিত করে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং সমবায়ের মাধ্যমে বাজারজাত করা পর্যন্ত বিস্তৃত করবে। এ কাজ করতে গিয়ে নজর দিতে হবে যেন পরিবেশ-মানুষ সংক্রান্ত উন্নয়নগুলি নিরন্তর চলতে থাকে। এই সব মাথায় রেখে আমি, আমাদের কৃষকদের জন্য আট-দফা শপথ রচনা করেছি:
১। কৃষি একটি অতি উত্তম কর্মযজ্ঞ। আমি কৃষিকাজ ভালবাসি।
২। জমি ও জল আমাদের মহত্তম সম্পদ। আমি তাদের রক্ষা ও সংরক্ষণ করব।
৩। ফলনের মানের উন্নতির জন্য আমি প্রযুক্তি আর উত্তম কৃষিপদ্ধতির ব্যবহার করব।
৪। কৃষিকে স্থায়ী নির্ভরযোগ্য করতে আমি জৈব চাষ করব।
৫। সন্তানরা আমাদের বিত্ত। সন্তানকে আমি শিক্ষা দেব যাতে কৃষি ফলন ও কৃষি পদ্ধতি বর্ধিত হয়।
৬। কৃষিবর্জ্যকে আমি জৈব জ্বালানি আর জৈব সারে রূপান্তরিত করব।
৭। আমি কৃষি, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের মধ্যে একটি ঐকতান রচনাতে নিয়োজিত থাকব।
৮। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় কৃষিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে তুলব।
.
নয় : পঞ্চায়েতপ্রধান
ভারতের হৃত্পিণ্ড তার গ্রামে অবস্থিত, এ কথা আমি প্রায়ই বলে থাকি। প্রায় ৫,৪৩,০০০টি গ্রাম আছে আমাদের দেশে। জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বাস ওই গ্রামে। ফলে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে গ্রামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ভারতের স্থানীয় স্বশাসিত ব্যবস্থার ভিত্তি হল গ্রামের পঞ্চায়েত, যার সংখ্যা ২,৫০,০০০। পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রধানের পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের বিশাল গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে সরকারি দপ্তরের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলেন এই প্রধান। বিহারের মতো কিছু রাজ্যে, সরপঞ্চদের ক্ষমতা দেওয়া আছে বিভিন্ন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা তদারকের। আইনভঙ্গকারীদের শাস্তি প্রদান ও জরিমানা ধার্য করার ক্ষমতাও তাঁদের দেওয়া আছে আইনে। এক উন্নয়নশীল দেশ থেকে এক উন্নত দেশে পরিবর্তিত হওয়ার লক্ষ্যে আগামী দুই দশক ভারতের কাছে অত্যন্ত জরুরি। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে কিছু কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে আমার কিছু ভাবনা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
‘পুরা’ এবং স্ত্রীসমাজ
প্রোভাইডিং আরবান অ্যামেনিটিস ইন রুরাল এরিয়াজ় (পিইউআরএ বা ‘পুরা’) হল তেমনই একটি প্রকল্প যা আমার হৃদয়ের সব থেকে কাছের। বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে এমন এক গুচ্ছ গ্রামকে শনাক্ত করে চার ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা এর মূল লক্ষ্য:
১। সড়ক, পরিবহণ ও বিদ্যুৎ যোগাযোগ।
২। নির্ভরযোগ্য টেলিকম, ইন্টারনেট ও আইটি পরিষেবার মাধ্যমে বৈদ্যুতিন যোগাযোগ।
৩। উত্তম মানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দ্বারা জ্ঞানের যোগাযোগ।
৪। কৃষক এবং অন্যান্যদের তাঁদের পণ্যের সব থেকে উৎকৃষ্ট মূল্য পাওয়ার জন্য বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ।
আগামী পাঁচ বছরে সরকার মনস্থ করেছে ‘পুরা’ চালু করা হবে সারা দেশের ৫০০০টি গুচ্ছ-গ্রামে। তৃণমূল স্তরে গ্রামপ্রধানদের গোষ্ঠীবদ্ধ সক্রিয় সহযোগিতার উপর নির্ভর করছে এই উচ্চাশার প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ। উপরন্তু, মহিলাদের সহজাত যে সব গুণ যেমন, অন্যের প্রতি সমবেদনা, সহনশীলতা, অধ্যবসায়, সততা, সামাজিক বিষয়ে সংবেদনশীলতা, সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক অভিগমন ও কঠোর পরিশ্রম করার ক্ষমতা, তা এই মিশনকে ফলপ্রসূ করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা পেলে মহিলারা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে দর্শনীয় কাজ করে দেখাতে পারেন।
তামিল মহাকবি সুব্রাহ্মনিয়া ভারতীর কথা মনে পড়ছে, যিনি ১৯১০ সালে, ভারতের নারীদের নিয়ে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। তার অনুবাদ এই রকম হবে:
She walks with raised head,
With her eyes looking straight.
She has her principles
Unafraid of anybody!
She has a lofty
And knowledge-based pride.
Such cultured women
Don’t falter from the chosen path.
She drives ignorance away.
She welcomes the bliss of life
With learned mind.
This is the dharma
Of the emerging woman.
‘পুরা’ এবং পঞ্চায়তপ্রধান
‘পুরা’-র বিষয়ে গ্রামীণ সমাজকে অবগত করে তাঁদের এই উন্নয়ন প্রকল্পে শামিল করতে পারেন পঞ্চায়তপ্রধান। সহযোগিতা করতে পারেন এইভাবে:
১। অশিক্ষা দূরীকরণ অভিযানে সাহায্য ও সহযোগিতা।
২। স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে কম্পিউটারের সাহায্যের বিষয়ে গ্রামীণ প্রশাসনকে ওয়াকিবহাল করা।
৩। গ্রামে সমবায় স্থাপন করে কেন্দ্রীয়ভাবে ন্যায্য মূল্যে পণ্য সংগ্রহ, মজুত, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাত করার ব্যবস্থা করা।
৪। পরিবার ও গোষ্ঠীর সুস্বাস্থ্যের জন্য উৎকৃষ্ট পুষ্টি, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, নিরাপদ পানীয় জল এবং স্বাস্থ্য পরিসেবা জোগান দেওয়া।
৫। পণ, কন্যা ভ্রূণ হত্যা, শিশু বিবাহ, শিশুশ্রম, গার্হস্থ্য হিংসা এবং সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির নির্যাতন ও হয়রানির মতো সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করা।
৬। ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা আর বিভিন্ন দক্ষতা উন্নতি প্রকল্প আয়োজন করে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে মহিলাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করা।
৭। সৌরশক্তির সঠিক ব্যবহার, বর্জ্য পুনর্নবীকরণ এবং বৃষ্টির জল ধারণ করে জলসম্পদের ব্যবস্থাপনার মতো শক্তি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
উপসংহার
ভারতকে উন্নত দেশে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাবে এই কাজে ব্রতী আছি। কৃষি, কৃষিজাত প্রক্রিয়াকরণ, কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, রেশমশিল্প, ঔষধি গাছগাছালি চাষ ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলাদের নানান সাফল্য কাহিনি আমাদের জানা। সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে অভিযানে মহিলারা নেতৃত্ব দেন। ২০২০ সালের মধ্যে ভারতকে এক উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার একমাত্র লক্ষ্যকে সামনে রেখে যদি এই স্ত্রীসমাজ তৃণমূল স্তর থেকে নিরন্তর দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে চলেন, তবে আমাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো কেউ আটকাতে পারবে না।
সময় হয়েছে মহিলা পঞ্চায়েতপ্রধানদের মননশীল নেতৃত্ব দেওয়ার। কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, উদ্যোগপতি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলির সাহায্যে তাঁরা নিজ নিজ গ্রামে ‘পুরা’ প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করতে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন। এটা করা সম্ভব গ্রামীণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাঁদের চালিত করে এই কাজে শামিল করা যায়। এটাই হবে মহিলা প্রধানদের মূল কাজ। তাঁদের জন্য আমার দশ-দফা শপথ:
১। আমি মনে করি ঈশ্বর আমাকে এক অনন্য সুযোগ দিয়েছেন আমার পঞ্চায়েতের মানুষজনকে সেবা করার।
২। আমার ব্রত হল মানুষের সহযোগিতায় পঞ্চায়েতকে সমৃদ্ধ করা।
৩। আমি নিশ্চিত করে বলছি যে, মানষের সঙ্গে সব বিষয়ে আমি সৎ আর স্বচ্ছ থাকব।
৪। আমি নিশ্চিত করব যে, আমার পঞ্চায়েতের মানুষ হবেন জুয়া আর নেশা মুক্ত।
৫। আমার পঞ্চায়েতকে আমি ১০০ শতাংশ, মহিলা সমেত, শিক্ষিত করে তুলব।
৬। আমার পঞ্চায়েতের মানুষকে আমি বোঝাব যাতে পুত্রসন্তান আর কন্যাসন্তানকে সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে দেখা হয়।
৭। আমি নিশ্চিত করব যাতে, আমার পঞ্চায়েতের সকল গৃহে স্যানিটেশন আর নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা থাকে।
৮। আমি নিশ্চিত করব যাতে আমার পঞ্চায়েত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে এবং আমি বিশ্বাস করি পরিচ্ছন্নতা শুরু হয় নিজ গৃহে।
৯। আমার পঞ্চায়েতের যাবতীয় জলাধার আমি ব্যবহারযোগ্য করে দেব।
১০। আমার পঞ্চায়েতকে আমি এক আদর্শ পঞ্চায়েত করে তুলব।
.
দশ : স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী
সকলের জন্য সহজলভ্য স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছিয়ে দেওয়া ভারতের কাছে এক বিরাট উদ্বেগের বিষয়। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জনগণই একটি রাষ্ট্রকে মহান করে তুলতে পারে। সুস্বাস্থ্যের এক দেশ নির্মাণে হাসপাতাল, ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। ২০১৫ সালের যে হিসেব তাতে ভারতে ওই বছর ৯,৫০,০০০ জন অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। হিসেবমতো, সরকারি হাসপাতালে প্রতি ১১,৫০০ জনের জন্য একজন ডাক্তার। গড়ে প্রত্যেক সরকারি হাসপাতাল ৬১,০০০ জন মানুষকে পরিষেবা দেয়। ১৮৩৩ জন রুগির জন্য আছে একটি মাত্র শয্যার ব্যবস্থা। সুতরাং, তার স্বাস্থ্য পরিষেবার চিত্রকে উন্নত করতে ভারতকে পার হতে হবে বহু পথ।
আমার চোখে একুশ শতকের এক হাসপাতাল
সমগ্র চিকিৎসা পরিষেবা ব্যবস্থায় মাল্টি-স্পেশালিটি হাসপাতালগুলির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। আমার দৃষ্টিতে একুশ শতকের হাসপাতাল এমন হওয়া উচিত:
১। প্রত্যেক রুগির ভিতর বিশ্বাস জাগাতে হবে যে, তিনি নিরাময় হবেন। পরিতৃপ্তি আর আশা সর্বত্র ছড়িয়ে দেবে হাস্যোজ্বল ডাক্তার, নার্স এবং হাসপাতালের সুন্দর পরিবেশ।
২। প্রত্যেক রুগি কী বলছেন তা শুনতে হবে। রুগির যন্ত্রণার উপশম করাই হবে প্রত্যেক ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য প্যারামেডিকাল স্টাফের ব্রত। যে-কোনও স্থানে এবং যখন প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের দল রুগিকে পরীক্ষা করে সত্বর চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।
৩। হাসপাতাল গ্রিন হাউস ধারণার প্রয়োগে কমিয়ে আনবে বিদ্যুৎ আর জলের খরচ।
৪। হাসপাতাল ঘিরে থাকবে সবুজ গাছপালা আর মরশুমি ফুল।
৫। রুগিদের যাবতীয় পরীক্ষার রিপোর্ট একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেসে জমা থাকবে যাতে তা সহজলভ্য হয় এবং রুগি বা তাঁর আত্মীয়কে সময় ও শ্রম ব্যয় করে তা খুঁজতে না হয়।
৬। এমনভাবে হাসপাতালের ডিজ়াইন করতে হবে যাতে রুগিকে সময়মতো শুশ্রূষা করতে সহজেই স্থানান্তর করা যায়।
৭। হাসপাতালের সরঞ্জাম ও পরিবেশ রুগিদের দেবে পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমক্ত পরিসেবা।
৮। হাসপাতাল এমন হবে যেখানে রুগি মনে করবেন যে, এই হাসপাতালই সব থেকে উৎকৃষ্ট স্থান যেখানে থেকে তিনি সব থেকে ভাল চিকিৎসা পাবেন।
৯। হাসপাতালকে হতে হবে সম্পূর্ণ আইটি নির্ভর যাতে, রুগির সঙ্গে ডাক্তার, নার্স এবং হাসপাতালের প্রধানের সর্বক্ষণ কম্পিউটার-যোগাযোগ থাকবে। দেশের অন্য বড় হাসপাতালগুলির সঙ্গেও হাসপাতালটির যোগাযোগ থাকবে যাতে পরামর্শ ও মতামত নেওয়া যায়।
১০। প্রতিদিন একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত কনফারেন্সের ব্যবস্থা করবে হাসপাতালটি যাতে, রুগিদের ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র সব সমস্যাগুলি আলোচনা করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
একুশ শতকের এমন রুগি-বন্ধু হাসপাতাল পরিকল্পনা করে গড়তে প্রয়োজন বিভিন্ন বিষয়ে সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ, যাতে ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে থাকে পরিকল্পিত বৃদ্ধির সুযোগ। সাফল্যের চাবিকাঠি হল বিভিন্ন স্তরে মননশীল নেতৃত্ব।
মননশীল স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের কিছু বৈশিষ্ট্যাবলি
আমার জীবনে আমি তিনটি স্বপ্নকে দেখেছি প্রথমে লক্ষ্য হিসেবে, তারপরে ব্রত হিসেবে এবং শেষে বাস্তবায়িত হয়ে মূর্ত হতে: ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (আইএসআরও বা ‘ইসরো’)-র অন্তরিক্ষ প্রকল্প, ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও)-র ‘অগ্নি’ প্রকল্প, এবং প্রোভাইডিং আরবান অ্যামেনিটিস ইন রুরাল এরিয়াজ় বা ‘পুরা’ প্রকল্প। অবশ্য, এই তিনটি প্রকল্পই সাফল্য পেয়েছে নানান চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার মধ্য দিয়ে। এই তিনটি প্রকল্প থেকে আমি নেতৃত্ব সম্পর্কে যা শিখেছি তা হল:
১। নেতার চাই এক ধরনের বীক্ষণ।
২। নেতার প্রয়োজন তার লক্ষ্যকে বাস্তবে পরিণত করার আবেগ।
৩। নেতার থাকবে অনাক্রমণ পথে যাওয়ার ক্ষমতা।
৪। নেতাকে জানতে হবে কীভাবে সাফল্য এবং অসাফল্য— দুই-ই স্বীকার করে নিতে হয়।
৫। নেতার থাকবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।
৬। নেতার ব্যবস্থপনায় থাকবে আভিজাত্য।
৭। নেতার প্রতিটি কাজে থাকবে স্বচ্ছতা।
৮। নেতার কাজে এবং সাফল্যে থাকবে সততা।
একুশ শতকের জন্য ভারতের হাসপাতালগুলিকে প্রস্তুত করে একশো কোটির বেশি জনগণকে উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার জন্য মননশীল নেতৃত্বের প্রয়োজন এই বৈশিষ্ট্যগুলি আয়ত্ত করা।
ছ’টি গুণ যা স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের থাকা আবশ্যিক
২০০৮ সালের নভেম্বরে কাঠমান্ডু ইউনিভার্সিটির চতুর্দশ সমাবর্তন ভাষণ দিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে বৌদ্ধনাথে কা-নিইং শেদ্রুব লিং বৌদ্ধ মঠে গিয়েছিলাম এবং সেখানকার প্রধান সন্ন্যাসী চোকিই নিইমা রিনপোচের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকও বটে। অভ্যর্থনার পর তিনি আমাকে তাঁর অধ্যয়ন কক্ষে নিয়ে গেলেন। এক তরুণের মতো তিনি দৌড়ে উঠে গেলেন ওই পাঁচতলা। আমি তাঁর পিছন পিছন কষ্টসাধ্য ধীর পায়ে উঠলাম।
তাঁর ঘরটি থেকে হিমালয় দৃশ্যমান। ঘরটিতে এক আধ্যাত্মিক বাতাবরণ উপস্থিত। আমাকে যা বিস্মিত করল তা হল যে, তাঁর গবেষক ছাত্ররা সব এসেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তাঁর সহ লেখক, ডেভিড আর শ্লিম, এমডি-র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যৌথভাবে তাঁরা একটি বই লিখেছেন, Medicine and Compassion: A Tibetan Lama’s Guidance for Caregivers নামে। বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় হল, আমরা প্রত্যেকেই আমাদের বৃদ্ধ, অসুস্থ বা অপারগ স্নেহের জনের বিধি বহির্ভূত সেবক হিসেবে কাজ করি। পেশাগত সেবক-সেবিকা নিয়োগ করলেও সেভাবে যত্ন দেওয়া যায় না।
Medicine and Compassion পাঠকের সঙ্গে সেবা দানের সত্যিকারের আদর্শের যোগ ঘটায়। বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা থেকে সেবার আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করে বাস্তবে তার প্রয়োগের কথা বলে এই বই। যাঁরা তাঁদের চিকিৎসা বা তাঁদের সেবকদের বিষয়ে অসন্তুষ্ট বা যে ব্যক্তি মৃত্যুর পথে অথবা যাঁদের অবস্থা সংকটজনক তাঁদের পরিবারের জন্য বাস্তবোচিত পরামর্শ রয়েছে এই বইতে। যাঁরা তাঁদের সহনশীলতা, সহমর্মিতা আর কার্যকারিতাকে নতুন উদ্যমে ফিরে পেতে চান তাঁদের জন্য এই বই এক প্রেরণা।
চোকিই আর আমার মধ্যে কিছু বইয়ের আদানপ্রদান হল। তিনি আমাকে যে বইগুলি দিলেন তার অন্যতম ছিল Medicine and Compassion। কাঠমান্ডু থেকে দিল্লি আসার পথে বইটি আমি পড়লাম। আমার অসম্ভব ভাল লাগল। মূল যে বিষয়টি আমি বইটি থেকে আহরণ করলাম তা হল, ছ’টি গুণ প্রত্যেক চিকিৎসাশাস্ত্রের পেশার ব্যক্তির থাকা আবশ্যক। রিনপোচে আর শ্লিমের মতে, এই ছ’টি গুণ হল, উদারতা, বিশুদ্ধ ন্যায়বোধ, সহনশীলতা, অধ্যবসায়, সম্পূর্ণ মনঃসংযোগ এবং মেধা। সেবকের মধ্যে এই গুণগুলি থাকলে তবেই মুমূর্ষুর যত্ন নিতে পারবেন সেবক। সারা পৃথিবীর চিকিৎসাশাস্ত্রে নিয়োজিত ব্যক্তিরা, স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী, নার্স এবং প্যারামেডিকাল স্টাফদের জন্য এ যেন এক পথ নির্দেশিকা।
বিশ্বাসের শক্তি
আর একটি বই যা আমার অত্যন্ত প্রেরণাকারী মনে হয়েছে তা হল, The Biology of Belief: Unleashing the Power of Consciousness, Matter and Miracles. বইটির লেখক আমার বন্ধু ড. ব্রুস লিপটন আমাকে পাঠিয়েছিলেন। বইটি নব্য জীববিজ্ঞানের এক নতুন রাস্তা খুলে দিয়ে আমাদের চিন্তা সম্পর্কের ধারণায় বিপ্লব এনে দিয়েছে। মনের এবং শরীরের পারস্পরিক ক্রিয়া এবং কোশ কেমনভাবে তথ্য গ্রহণ করে, এই বিষয়ে ড. লিপটন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা অবিশ্বাস্য নতুন আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, জিন এবং ডিএনএ আমাদের জৈবিক কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে না। পরিবর্তে ডিএনএ নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু কোশবহিঃস্থ বার্তা দ্বারা। এই বার্তার মধ্যে আমাদের চিন্তাভাবনাও অন্তর্ভুক্ত। সহজ করে বললে, জিন এবং ডিএনএ-কে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের বিশ্বাস, আমাদের প্রত্যয়।
এই বক্তব্যকেই তিনি প্রসারিত করে যুক্তি দিচ্ছেন যে, রোগ আর তার চিকিৎসার ভিত রয়েছে আমাদের চিন্তায় যার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে কোশের। তিনি বলছেন, ‘এই বিশ্বাসের শক্তিকে ডাক্তাররা যেন ওষুধের রাসায়নিক বা অস্ত্রোপচারের ছুরির থেকে নিকৃষ্ট মনে না করেন।’
মহাত্মা গাঁধীও বলেছেন যে, আমাদের নিয়তিকে গড়ে তোলে আমাদের চিন্তা। ড. লিপটন তাঁকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন:
Your beliefs become your thoughts
Your thoughts become your words
Your words become your actions
Your actions become your habits
Your habits become your values
Your values become your destiny.
আমি সকল স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীকে বলব, তাঁরা যেন ড. লিপটনের বইটা পড়ে তার বার্তাটি উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে তাঁদের রুগিদের সেই প্রশিক্ষণ দেন যাতে রোগ থেকে নিরাময় হয়ে উঠতে তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসের শক্তিকে প্রয়োগ করতে পারেন।
মানুষ তাই-ই হয়ে ওঠেন যা তিনি চিন্তা করেন
এই প্রেক্ষিতে আমি আর একটি বইয়ের কথা বলব যেটি পড়ে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। বইটি হল মরিস গুডম্যানের লেখা The Miracle Man: An Inspiring True Story of the Human Spirit। তাঁর ছত্রিশ বছর বয়সে, ১৯৮১-র মার্চে, মরিস গুডম্যান যখন একটি প্লেন চালাচ্ছেন, তখন তাঁর ইঞ্জিনটি বিনা হুঁশিয়ারিতে হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। রানওয়েতে কোনওভাবে প্লেনটাকে নামিয়ে আনতে চেষ্টা করলেও কিছু বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে উলটে গিয়ে সেটি মাটিতে আছড়ে পড়ে। দুর্ঘটনায় তিনি পক্ষঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর শিরদাঁড়া চূর্ণ হয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় কশেরুকা দু’টি ভেঙে যায়। সাহায্য ছাড়া তিনি খাওয়াদাওয়া এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাসও চালাতে পারতেন না। শুধু চোখের পাতা খোলা-বন্ধ করতে পারতেন। ডাক্তাররা বলে দিলেন, সারা জীবন তাঁকে অসাড়ত্ব নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।
এমন কথাই ডাক্তাররা ভেবেছিলেন, কিন্তু গুডম্যানের কাছে সে কথার কোনও গুরুত্ব ছিল না। তিনি নিজে কী ভাবছেন সেইটিই ছিল তাঁর কাছে বেশি জরুরি। তিনি কল্পনা করতেন যে, তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে হাসপাতাল থেকে পায়ে হেঁটে বেরোচ্ছেন। তিনি মনের সঙ্গে তাঁর ক্রীড়া চালিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁর বইতে তিনি লিখেছেন যে, একবার যদি মনকে তুমি তোমার সঙ্গে পেয়ে যাও, তোমার সবকিছু নিজের নিজের জায়গায় ফিরে আসবে। দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহের গভীর অনুশীলনের পর গুডম্যান একদিন যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই প্রথমবার শ্বাস গ্রহণ করতে সক্ষম হলেন। স্পিচ থেরাপিস্টের সঙ্গে বসে তিনি তাঁর প্রথম একটি শব্দ বলে উঠলেন: Mama: কয়েকমাস পর তাঁকে একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হল। সেখানে তিনি নিজে হাতে খেতে শুরু করলেন এবং হাঁটতে শেখার চেষ্টা করতে থাকলেন। শারীরিক পরিচর্যায় তিনি তাঁর পেশিশক্তির বৃদ্ধি ঘটাতে থাকলেন এবং বাড়িয়ে তুলতে থাকলেন তাঁর মনোবল যতক্ষণ না তিনি নিজের ক্ষমতায় দাঁড়াতে পারছেন। বেশ কয়েক সপ্তাহ পর তিনি কোনও সাহায্য ছাড়াই হাঁটতে সক্ষম হলেন।
ডাক্তারেরা দিশাহারা। ক্রিসমাসের আগেই গুডম্যান মনস্থির করেছেন হাসপাতাল থেকে হেঁটে বেরোবেন। এবং তিনি ঠিক তা-ই করে দেখালেন। পৃথিবীর জন্য তিনি যে বার্তা দিলেন তা হল, ‘মানুষ তাই-ই হয়ে ওঠেন যা তিনি চিন্তা করেন’। আমি আশা করি স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীরা, এই কাহিনিগুলি মনে করবেন, যখন তাঁদের রুগিদের চিকিৎসা করবেন এবং শেখাবেন কেমনভাবে, শুধুমাত্র ওষুধে নয়, তাঁদের নিজ চিন্তার শক্তিতে নিরাময় হতে পারেন।
উপসংহার
আমি শেষ করতে চাই স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য দু’টি শপথ দিয়ে। প্রথমটি নার্সদের জন্য:
১। আমি আমার এই নার্সিং পেশাকে ভালবাসি। এটি একটি মহান ব্রত।
২। আমি মনে করি কারোর যন্ত্রণার উপশম করা একটি মহান, ঈশ্বরপ্রদত্ত ব্রত।
৩। আমি সকল রুগিকে সমানভাবে যত্ন ও সহমর্মিতা দিয়ে সেবা করব।
৪। আমি অন্তত কুড়িজন গ্রাম্য রুগির বিশেষ সেবা যত্ন করব।
৫। আমি জীবনভর নার্সিং-এ শিক্ষা নিয়ে যাব।
৬। আমি সেই ব্রত নিয়ে চলব যেখানে বলা হয়েছে, ‘আমার যত্ন তোমার যন্ত্রণাকে নিরাময় করে তোমার মুখে হাসি ফোটাক’।
দ্বিতীয়টি ডাক্তারদের জন্য:
১। আমি মনে করি চিকিত্সক পেশায় আমি ঈশ্বরপ্রদত্ত কাজ করে চলেছি।
২। আমার সময়ের কিছুটা আমি সেই সব রুগিদের চিকিৎসার জন্য দেব, যাঁদের সামর্থ্যের অভাব।
৩। আমি কোনও সময়েই আমার রুগিদের অপ্রয়োজনীয় রোগ নির্ণয়কারী পরীক্ষার যন্ত্রণা দেব না এবং পরামর্শ দেব একান্ত জরুরি পরীক্ষাগুলি করতে।
৪। গ্রামে গিয়ে আমি বছরে অন্তত কুড়িজন গ্রাম্য রুগির চিকিৎসা করব ন্যূনতম খরচে।
৫। আমার যাবতীয় রোগ নির্ণয়ে এবং চিকিৎসায় আমি উৎসাহ দেব উচ্চমানের দেশি সরঞ্জাম এবং অন্য সামগ্রীর ব্যবহারে।
৬। যদি আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানে যাই আমি তাহলে নির্দিষ্ট গবেষণায় যাব যেমন এইচআইভি-র জন্য ভ্যাকসিন বা ডায়াবেটিস টাইপ ১ এবং টাইপ ২-এর স্থায়ী নিরাময়ের উপায়।
৭। আমি সেই ব্রত মেনে চলব যেখানে বলা হয়েছে, ‘আমার মেধা যেন সকল পীড়িতের যন্ত্রণা নিরাময় করে হাসি ফোটায় তাঁদের মুখে।’
.
এগারো : সিভিল সার্ভেন্ট
ভারতের সিভিল সার্ভিসই সব থেকে উত্তম এবং সব থেকে নিকৃষ্ট সময়ে রাষ্ট্রকে চালনা করে নিয়ে যায়। ২০১০ সালের হিসেব মতো দেশে সিভিল সার্ভেন্টদের সংখ্যা ৫০,০০০। আমাদের এই বিশাল দেশের দৈনন্দিন শাসনব্যবস্থাকে তাঁরাই দেখাশুনা করেন। দেশের অস্থির সময়েও তাঁরাই দেশকে মসৃণভাবে এগিয়ে নিয়ে যান।
মধ্য ১৯৯০ দশকে ভারতের Vision ২০২০-র পরিকল্পনা রচনার এক অভিজ্ঞতার কথা আমার মনে পড়ে যায়। আমাকে টিআইএফএসি-র সভাধ্যক্ষর দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথম বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় যে, কাউন্সিল একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে যাতে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা যায়। ভারতের জিডিপি-র বৃদ্ধির হার যেখানে প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ শতাংশ ছিল, এই লক্ষ্য পূরণে সেখানে আমাদের ধরে নিতে হচ্ছিল নিরন্তর দশ বছরের বেশি সময় ধরে সেই বৃদ্ধির হার দশ শতাংশ রাখার কথা। কাউন্সিলের সকলের মনকে এই বিষয়টি প্রজ্বলিত করে দিল।
সেই সময়ে টিআইএফএসি-র সদস্যরা ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রধান সচিব; ভারত সরকারের ন’জন সচিব; কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই), অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া (এএসএসওসিএইচএএম) এবং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)-র প্রধানরা; আইডিবিআই, আইসিআইসিআই এবং আইএফসিআই ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানরা; কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা; কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা; এবং ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ডিএসটি)-র বিজ্ঞানীরা।
নানান তর্কবিতর্কের পর ৫০০-র কিছু বেশি সদস্য নিয়ে সতেরোটি কার্যনির্বাহী দল তৈরি করা হল। অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রের ৫০০০ মানুষের সঙ্গে বৈঠক করলেন এঁরা। এই কমিটিগুলি দু’বছরের কিছু বেশি সময় কাজ করে পঁচিশটি রিপোর্ট প্রস্তুত করলেন যা তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রী এইচ ডি দেবেগৌড়ার হাতে ২ অগাস্ট ১৯৯৬ তুলে দেওয়া হয়। কীভাবে বিভিন্ন সরকারি বিভাগ এবং সংস্থা যা ভারতের সিভিল সার্ভিসের শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কের সমন্বয়, একযোগে জাতীয় উন্নয়নে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করেন, এটি ছিল তার এক চিত্তাকর্ষক নিদর্শন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি হবার আগে, স্যাটেলাইট লঞ্চিং ভেহিকল (এসএলভি) প্রকল্প এবং পরে ওই ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের নির্মাণ ও কার্যক্ষম করার সময়ে, আমি বেশ কিছু বরিষ্ঠ সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে চিন্তার আদানপ্রদান করেছিলাম। পরবর্তীকালে, আমি শ’য়ে শ’য়ে সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি, যখন আমি মুসৌরির লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এ সিভিল সার্ভিস প্রোবেশনারদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছি। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন, রাষ্ট্রপতি ভবনে নতুন সিভিল সার্ভেন্টরা আমার সঙ্গে এসে দেখা করতেন। আমি তাঁদের পাঁচ-দফা শপথ (যার বিষয়ে আমি এই অধ্যায়ের শেষে আসব) পাঠ করাতাম। আমি ভারতের গ্রাম অঞ্চলে গেলে কোনও কোনও পরিচিত সিভিল সার্ভিস অফিসার মুসৌরি বা রাষ্ট্রপতি ভবনে আমার সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বর্তমানে তাঁদের কর্মকাণ্ডের কথা বলতেন।
২০০৫-এ সংসদের উভয় কক্ষের উদ্দেশে আমার বক্তৃতায় সাংসদদের সঙ্গে যে কবিতাটি আমি ভাগ করে নিয়েছিলাম সেটি আমি এখানে বলতে চাই:
প্রিয় বন্ধু, আমরা এখন কোথায়?
সেই মহাসভায় যেখানে আমাদের ইতিহাস গড়া হয়।
ভারতের জনতার হৃদস্পন্দনের ডাক।
জনতা প্রশ্ন করে, জনতা প্রশ্ন করে:
হে! সাংসদরা, ভারত মাতার ভাস্কর,
আলোয় নিয়ে চল আমাদের, আমাদের জীবন সমৃদ্ধ কর।
তোমাদের সততার শ্রম, আমাদের আলোর দিশারী,
তোমরা যদি কঠোর শ্রম দাও, আমরা সমৃদ্ধ হব।
যেমন রাজা, তেমন জনতা,
মহান চিন্তার লালন কর, উঠে দাঁড়িয়ে কাজে লাগ,
সততার পাথেয় হোক তোমাদের দিশারী।
ঈশ্বরের কৃপায় তোমাদের শ্রীবৃদ্ধি হোক।
আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ যতটা সাংসদদের হাতে, ততটাই তা আমাদের সিভিল সার্ভেন্টদের হাতে। আমি ভারতের সিভিল সার্ভেন্টদের জোর দিয়ে বলব তাঁরা যেন এই কবিতাটার মর্ম উপলব্ধি করে তা অন্তরে গ্রহণ করেন— তোমরা যদি কঠোর শ্রম দাও, আমরা সমৃদ্ধ হব।
মুসৌরিতে সংযোগ
২০১০ সালে আমি মুসৌরি গিয়েছিলাম। সেখানে পঁচাশিতম ফাউন্ডেশন ব্যাচ-এ সদ্য-যোগ দেওয়া সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে সংযোগ ঘটেছিল। প্রশিক্ষণের মধ্যবর্তী পর্যায়ের ট্রেনিদের উদ্দেশে আমি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। আমি তাঁদের মননশীল ও উদ্ভাবনী নেতৃত্ব এবং আরও ভাল এক পৃথিবীর উন্মেষের কথা বলেছিলাম। বক্তৃতা শেষে অংশগ্রহণকারীদের থেকে কিছু অনন্য প্রশ্ন করা হয়েছিল। সেগুলি ছিল আমলাতন্ত্রের উচ্চতম পর্যায়ে প্রশাসনকে যে সুযোগ আর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, তার উপর। আমি এই তরুণ অফিসারদের বলেছিলাম যে, কেমনভাবে তাঁরা মননশীল নেতৃত্ব দিয়ে জীবনের মহান সব কর্মযজ্ঞে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন, তার উপায় চিন্তা করুন। বক্তৃতার পর এক তরুণী অফিসার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ড. কালাম, স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য আমলাতন্ত্র খ্যাত এবং সেই ভাবে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। ফলে তার প্রেক্ষিতে আমি কীভাবে মননশীল ও উদ্ভাবনী হতে পারব?’ আর এক তরুণ অফিসার বললেন, ‘স্যার, এই মুহূর্তে, যখন আমরা আমাদের কর্মজীবনের শুরুতে রয়েছি, আমাদের ন্যায়বোধ প্রখর এবং সততায় আমরা দৃঢ়। আমরা সকলেই কঠোর পরিশ্রম করে পরিবর্তন আনতে চাই। কিন্তু এক দশক পর, আমাদের পারিপার্শ্বিক সত্ত্বেও আমরা কেমনভাবে ওই একই ন্যায়বোধ নিয়ে সমান উচ্ছ্বাসে কাজ করে যেতে পারব?’
এই প্রশ্নগুলির উত্তরে আমি বললাম যে, যে তরুণ অফিসাররা প্রশাসনে ঢুকছেন তাঁদের এক সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য স্থির করে নিতে হবে, যাতে তাঁরা স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন। ওই লক্ষ্য তাঁদের সকল সময়ে উদ্বুদ্ধ করবে এবং সকল বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করবে। আমি তাঁদের বললাম যে, আমাদের রাষ্ট্রের তরুণ অফিসারদের মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা যখন কোনও কঠিন কর্মযজ্ঞে ঢুকবেন, তখন নানা সমস্যা আসবে। কিন্তু এই সমস্যাগুলি যেন আমাদের অধিনায়ক হয়ে না দাঁড়ায়; সমস্যাগুলিকে পরাস্ত করে আমাদের সাফল্য পেতে হবে।
আর এক তরুণ অফিসার বললেন, ‘ড. কালাম, আপনি বললেন যে, আমাদের কাজ করতে হবে সত্যনিষ্ঠা নিয়ে এবং সাফল্যও পেতে হবে সততার সঙ্গে। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং আমাদের বরিষ্ঠরা যাঁরা দুর্নীতিপরায়ণ তাঁরা তো কোনও এক সময়ে আমাদের ন্যায়-নীতিবোধের সঙ্গে আপোস করতে আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করবেন। আমরা কীভাবে তার মোকাবিলা করব?’ এই প্রশ্নটি সম্পর্কে আমি চিন্তা করলাম। প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবসম্মত। প্রত্যুত্তরে আমি, আমার রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বললাম।
আমি ডিআরডিও-র সচিব, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং ভারত সরকারের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ছিলাম। এই প্রতিটি পদেই আমার দায়িত্বে ছিল বিরাট বিরাট কর্মযজ্ঞ যার মূলধনী বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল বিশাল। কিন্তু কোনও সময়েই কোনও নেতা বা কোনও প্রশাসক আমার কাছে কোনও সুবিধে পাওয়ার আশায় আসেননি। আমি তরুণ অফিসারদের বললাম যে, তাঁরা তাঁদের নিজেদের এক ধরনের সততা তৈরি করে নিন যাতে যাঁরা নীতির সঙ্গে আপোসের কথা বলতে চান তাঁরা দূরেই থাকবেন। অবশ্যই, এরও কিছু সমস্যা থাকবে। কিন্তু অবশেষে, মানুষের মধ্যে যা শুভ তা সফল হবেই।
একশো কোটির প্রশাসন
পরিশেষে কিন্তু একজন সিভিল সার্ভেন্টের কাজ হল রাষ্ট্রকে ভাল প্রশাসন দেওয়া। প্রশাসনের বিচার হয় সে কতটা মানুষের চাহিদা সম্পর্কে ক্রিয়াশীল এবং সংবেদনশীল, তার ওপর এর থেকেই তাঁরা এক নৈতিকভাবে সুঠাম, বৌদ্ধিকভাবে উচ্চতর ও উন্নত মানের জীবনযাপন করতে সক্ষম হবেন। এ একমাত্র সম্ভব শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনে এবং তার সমৃদ্ধিতে। কীভাবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো যায়?
আমি মনে করি এক সমাজভিত্তিক গ্রিড তৈরি করার প্রয়োজন আছে যাতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে জ্ঞানের গ্রিড, স্বাস্থ্য গ্রিড এবং ই-গভর্নেন্স গ্রিড যা ‘পুরা’ গ্রিড-এ এসে মিশবে। প্রথমটি নাগরিকদের গণতান্ত্রিক উপায়ে সঠিক জ্ঞানে বলীয়ান করে জ্ঞান-সমাজের বৃদ্ধি ঘটাবে। দ্বিতীয়টি নজর রাখবে যাতে সঠিক মানের স্বাস্থ্য পরিসেবা আর্তদের কাছে পৌঁছয়। এর দ্বারা তাঁদের জীবনের মান উন্নত হবে এবং ব্যক্তি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে যা রাষ্ট্রের উন্নয়নের গতিকে বৃদ্ধি করবে। তৃতীয়টি প্রশাসনিক কাজে আনবে স্বচ্ছতা এবং তা যেন তার মানে এবং পরিমাণে হ্রাস না হয়ে প্রত্যেকের কাছে সমানভাবে উপলব্ধ হয় তার খেয়াল রাখবে।
যদি এই গ্রিডগুলি একে অপরের পরিপূরক হয় এবং ‘পুরা’ গ্রিড, যা ভারতের ৬,০০,০০০ গ্রামকে যুক্ত করে রেখেছে, তার কার্যকারিতার মানকে উন্নত করে, তা হলে গ্রামগুলি হয়ে উঠবে অধিক ক্ষমতাবান। ক্ষমতাপ্রাপ্ত গ্রাম মানেই ভাল তত্পর প্রশাসন। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, সমাজভিত্তিক গ্রিড মডেলটি প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব। এবং তা ভারতকে ২০২০ সালের মধ্যে এক উন্নত রাষ্ট্রে পরিবর্তন করার আমাদের লক্ষ্যকে সাহায্য করবে।
শ্রী ভেঙ্কটেশাম বুরা, আইএএস, ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের (বর্তমানে তেলেঙ্গানা) মেডাক জেলার কালেকটর। তাঁর সঙ্গে আমার বেশ ভাল আলাপ হয়েছিল যখন আমি অধ্যাপক এন বি সুদর্শন আচার্যর শুরু করা Lead India ২০০২ প্রশিক্ষণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল, সমাজ রূপান্তর প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের দূত হিসেবে তরুণদের প্রশিক্ষিত করা। প্রকল্পটির দর্শন ছিল, ব্যক্তির উন্মেষ আনে জাতির উন্নয়ন।
তাঁর কাজের ব্যাপারে এবং ভাল প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম করায় সিভিল সার্ভিস অফিসারদের ভূমিকা সম্পর্কে আমি শ্রীবুরাকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম। তাঁর প্রতিক্রিয়াগুলি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই এখানে:
APJ: আপনার জেলায় Lead India প্রকল্প কতটা যুবসমাজকে প্রভাবিত করেছে?
VB: আমি যখন মেডাক জেলার কালেকটর ছিলাম, আমি বুঝেছিলাম Lead India প্রকল্প মনোযোগ কাড়বে। আমি প্রকল্পটিকে বিপুলভাবে আমার সমর্থন দিই। এই জেলার ৫০,০০০-এর বেশি পড়ুয়ারা এই প্রকল্পটি থেকে অনেক কিছু নিজেদের ভিতর নিতে পেরেছিলেন। প্রকল্পটি তাঁদের অন্তরের অন্তঃস্থলে পৌঁছে তাঁদের জীবনদর্শনের পরিবর্তন এনেছে। নিজের বাড়িতে, ক্লাসে এবং খেলার মাঠে তাঁদের আচরণেই তা প্রকাশ পায়। প্রকল্পটি তাঁদের সুপ্ত ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলে তাঁদের ব্যক্তিত্বর এক সার্বিক উন্নতি ঘটিয়েছে।
APJ: আপনার সব থেকে বড় সমস্যা কী ছিল এবং তার সমাধান আপনি কীভাবে করলেন?
VB: এই জেলায় কিছু মানুষ অসম্ভব রকমের বঞ্চিত। যাঁরা অত্যন্ত অসুস্থ এবং শারীরিকভাবে অক্ষম তাঁদের রুজিরোজগারের ভীষণ সমস্যা। অনেকেই অনাহারে থাকেন। মানসিক জরাগ্রস্ত যাঁরা রাস্তায় থাকেন, তাঁরা সম্মানজনক কোনও শুশ্রূষা পান না। সমস্যাটা সাংঘাতিক এবং সাধারণ সরকারি কার্যক্রম ও পরিষেবা তাঁদের সমস্যাকে মোকাবিলা করতে অক্ষম। তাঁরা অযত্নে অবহেলায় থেকে যান।
বিভিন্ন এনজিও এবং জনগোষ্ঠীকে এই বিষয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলাম আমি। কয়েকটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সহায়তায় একটি প্রকল্প শুরু করা হল। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হল Assara। তার লক্ষ্য ছিল ওই সব আর্তদের বিশেষ করে বয়স্ক এবং যাঁরা মৃত্যুপথযাত্রী, তাঁদের দিনে অন্তত দু’টি আহারের ব্যবস্থা করা। প্রত্যেক গ্রামে স্বনির্ভর গোষ্ঠী সেই সব আর্তদের সন্ধান করে একজন বেকার মহিলাকে নিযুক্ত করল যিনি এঁদের দু’টি আহারের ব্যবস্থা করবেন। দ্রব্যসামগ্রীর যা প্রয়োজন তা দিলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী এবং স্থানীয় মানুষ।
আর একটি প্রকল্প Ashray নামে শুরু করা হয় জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন এনজিও-গুলির সহযোগিতায়। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানসিক জরাগ্রস্ত গৃহহীনদের জন্য সম্মানীয় জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা। রাস্তা থেকে তুলে এনে তাঁদের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করা হত। তাঁদের পুষ্টিকর খাদ্য ও ওষুধ দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হত।
নিউ ইয়র্কের একটি সংস্থা সোশাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ইন্টারন্যাশনাল, মেডাক জেলাকে তার কাজের জন্য SA8000 সার্টিফিকেট প্রদান করে ২০০৭ সালে। নিরক্ষা সম্মত সামাজিক সার্টিফিকেট প্রদান প্রক্রিয়ায় এটি বিশ্বের প্রথম যা দেওয়া হয় শিল্পক্ষেত্রে সম্মানজনক কর্মস্থানের ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য। সমগ্র এশিয়াতে এটি প্রথম একটি সরকারি সংস্থা যা এই শংসাপত্র পেয়েছিল।
APJ: নাগরিকদের প্রতি আপনার কোনও পরামর্শ আছে যা তাঁদের আরও উত্তম পরিসেবা পেতে সাহায্য করবে?
VB: উত্তমরূপে কাজ করা কোনও গণতন্ত্রের জন্য তো বটেই, প্রশাসনের পক্ষেও অত্যন্ত জরুরি হল নাগরিকদের সচেতন থাকা এবং প্রশ্ন করা। আইনত প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার আছে এক ভদ্রোচিত মানবজীবন যেখানে তার মৌলিক চাহিদা, খাদ্য, বস্ত্র আর বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকবে। আমাদের সকলে মিলে প্রচেষ্টা নিতে হবে যাতে ভারতকে সবথেকে উন্নত ও সুখী রাষ্ট্রসমূহের অন্যতম করে গড়ে তোলা যায়। গণতন্ত্রের সব ক’টি স্তম্ভের একযোগে কাজ করতে হবে এবং একে অপরকে টেক্কা দেবার চেষ্টাকে পরিহার করতে হবে। আমাদের মানুষজনই এই দেশ শাসন করছে, অন্য কোনও বিদেশি শক্তি আমাদের শাসন করছে না। সহযোগিতা, অংশগ্রহণ করা এবং দায়িত্ব নেওয়া হল এই সময়ের চাহিদা।
কিছু সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা
বন্ধুগণ, কিছু সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলব। এই অফিসারদের প্রত্যেককেই আমার মনে হয়েছে অত্যুজ্জ্বল নেতৃত্বের এক একজন উদাহরণস্বরূপ।
সি আর কৃষ্ণস্বামী রাও
১৯৮২-৮৩ সালে গাইডেড মিসাইল প্রকল্পের সময়ে আমি ছিলাম ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ল্যাবরেটরি (ডিআরডিএল)-এর অধিকর্তা। শ্রী সি আর কৃষ্ণস্বামী রাও সাহেব ছিলেন ক্যাবিনেট সচিব। ক্যাবিনেটকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পটির বিষয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়ার আগে, একটি মিটিং হয় যেখানে উপস্থিত ছিলেন তদানীন্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী আর ভেঙ্কটরমন, রাও সাহেব এবং সামরিক বাহিনীর তিন উপ-প্রধান। আমাকেও ওই উচ্চ-ক্ষমতা সম্পন্ন মিটিংটিতে হাজির থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পটির স্টাডি রিপোর্টটি পেশ করতে বলা হয়।
প্রচণ্ড সমালোচনা হল সামরিক বাহিনীর তরফ থেকে। তাঁদের মত হল যে, ভারত যেহেতু আজ পর্যন্ত একটি ক্ষেপণাস্ত্রও সাফল্যের সঙ্গে নির্মাণ করতে পারেনি, তাই পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র বিকাশ ও নির্মাণ অনুমোদন করা যাবে না। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর তদানীন্তন উপদেষ্টা ড. ভি এস অরুণাচলম এবং আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, এটি হবে এক ফ্ল্যাগশিপ প্রোজেক্ট। কিন্তু সদস্যরা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। এই সময়ে শ্রী কৃষ্ণস্বামী রাও সাহেব এমন একটি মন্তব্য করলেন যা আজও আমার কানে বাজে।
তিনি বললেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় স্যার, আমি সমস্ত আলোচনাটাই শুনেছি। আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই। সময় হয়েছে একটা সিদ্ধান্তে আসার এবং একটা সাহসের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নতুন পথে চলার। অতীত নিয়ে বসে থাকলে হবে না। আমরা এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি যে, এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পটির নেতৃত্বে যাঁরা, তাঁরা কর্মকাণ্ডটিতে মনেপ্রাণে নিয়োজিত এবং আবেগে ভরপুর। আমি মনে করি সব ক’টি ক্ষেপণাস্ত্রই একযোগে সুসংহতভাবে নির্মাণ করার প্রয়োজন আছে।’
এই মন্তব্যটি থেকেই শ্রী আর ভেঙ্কটরমন প্রকল্পটির নাম রাখলেন ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল প্রোগ্রাম। ওই মিটিং-এর দু’মাসের মধ্যেই প্রকল্পটি ক্যাবিনেট অনুমোদন দিয়ে দিল। আমি যাবতীয় প্রয়োজনীয় অর্থ, মানবসম্পদ এবং নতুন ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা পেয়ে গেলাম। উৎপাদনের প্রয়োজনে কিছু জরুরি ব্যবস্থা স্থাপনার জন্যও অর্থ বরাদ্দ পেলাম। আজ সেই উৎপাদন সংস্থাটির ‘পৃথ্বী’, ‘অগ্নি’, ‘আকাশ’ এবং প্রথম সুপারসনিক ক্রুইস মিসাইল ‘ব্রহ-মোস’ নির্মাণের বরাতের অর্থমূল্য ৯৩ ট্রিলিয়ন টাকা। আমাদের আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বের এমনই দূরদৃষ্টির ক্ষমতা।
প্রভাত কুমার
বন্ধুগণ, একটি রাষ্ট্রের জীবনে অনেকগুলি বাঁক আসে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বৃদ্ধির পথে প্রভাব ফেলে এইগুলি। একটি ঘটনার কথা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব, যেখানে দেখা যাবে ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারে কেমনভাবে এল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
১৯৯৮-৯৯-এর ওই সময়ে ক্যাবিনেট সচিব শ্রীপ্রভাত কুমারের সভাপতিত্বে সচিবদের মাসিক অধিবেশনে আমি অংশ নিতাম। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে মিটিংগুলির কার্যাবলি খেয়াল করতাম। আমি ভাবতাম সরকার কেন একচেটিয়া ভাবে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) নিজের হাতে রাখে। একদিন শ্রীপ্রভাত কুমার আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘মি. কালাম, আপনাকে আহ্বায়ক করে একটি দল তৈরি করে দিচ্ছি। ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহার কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, তার পথ বাতলাতে পারবেন?’
আমি বললাম, ‘ইন্টারনেট ব্যবহারের ঘনত্ব অত্যন্ত কম আমাদের দেশে। অনেক বেশি ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীর প্রয়োজন একে বৃদ্ধি করতে। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন অবশ্যই আছে, ইন্টারনেট যোগাযোগ ট্র্যাফিকের কারণে।’
শ্রীকুমার জানতে চাইলেন টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের সচিব আর আমি নিজেদের মধ্যে বসে এই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারি কিনা। সেন্টার ফর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রোবোটিক্স-এর তদানীন্তন অধিকর্তা অধ্যাপক এম বিদ্যাসাগরের সভাপতিত্বে আমরা দু’জনে একটি বিশেষ কমিটি তৈরি করে দিলাম। তিনি কমিটির আলোচনাগুলি আমাকে জানিয়ে যেতেন। তিনি আমাকে জানালেন যে, যদিও আইএসপি-র বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে সকলেই একমত, তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে কিন্তু সংশয় আছে।
আমি ঠিক করলাম যে, কমিটি একটি উপস্থাপনা তৈরি করবে যেখানে সকল স্টেকহোল্ডার তাঁদের উত্তর পেয়ে যাবেন। কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করলাম কমিটির মিটিংগুলিতে অংশ নিতে, যেমন, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর অধ্যাপক এন বালাকৃষ্ণান, যিনি তদানীন্তন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন, কারণ রেল এক বৃহৎ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। মিটিংগুলি আমি আহ্বান করতাম কাজের সময়ের পর যাতে সকলেই উপস্থিত থাকতে পারেন।
নিরাপত্তা বিষয়েই বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারীর আপত্তি ছিল। বিশেষজ্ঞরা জানালেন নিরাপত্তার জন্য বিশেষ প্রযুক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যপক্ষ বললেন, তা করতে গেলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রশ্ন এসে যাবে। উলটোদিকে যুক্তি দেওয়া হল যে, যাঁরা প্রকৃত ব্যবহারকারী তাঁদের ভয়ের কোনও কারণ নেই; শুধু যাঁরা কুকর্মে ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন তাঁদেরই গোপনীয়তা নিয়ে সমস্যা হবে। এই নিয়ে বিতর্ক চলল বেশ কিছু সময় ধরে। অবশেষে, সকল অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ঐক্যমতে সিদ্ধান্ত হল যে, আইএসপি খুলে দেওয়া হবে বেসরকারি ক্ষেত্রেও।
আমি শ্রীপ্রভাত কুমারকে কমিটির পরামর্শ জানিয়ে দিলাম। তিনি তত্ক্ষণাৎ পরামর্শগুলিকে কার্যে পরিণত করতে ক্যাবিনেটের অনুমোদন নিয়ে নিলেন। সেই আইএসপি খুলে দেওয়ায় আজ ভারতে ১২০০ ক্রিয়াশীল সার্ভিস প্রোভাইডার রয়েছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরের হিসেব অনুযায়ী ১২ কোটি ১০ লক্ষ ইন্টারনেট ব্যবহাকারীকে তারা পরিষেবা দিচ্ছে। প্রতি বছর বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরাই শুধু নন, এই সমগ্র ১০০ বিলিয়ন ডলারের আইটি শিল্পরও উচিত শ্রীপ্রভাত কুমারের এই অবদানের জন্য তাঁকে স্মরণ করা।
সন্তোষ বাবু
২০০৯ সালে আমার আলাপ হয় ড. সন্তোষ বাবুর সঙ্গে। তিনি তখন ছিলেন ইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন অফ তামিলনাডু (ইএলসিওটি)-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর আর তামিলনাডু ই-গভর্নেন্স এজেন্সি (টিএনইজিএ)-র মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক। আমি গিয়েছিলাম হোসুর এফওএসটিইআরএ (ফস্টারিং টেকনোলজিস ইন রুরাল এরিয়াজ়)-এর ভার্চুয়াল বা কম্পিউটার যোগাযোগ কেন্দ্র এবং গ্রামীণ বাণিজ্য হাবের উদ্বোধনে। এটি একটি গ্রামীণ বিজ়নেস প্রোসেস আউটসোর্সিং (বিপিও)। তিনি যখন কৃষ্ণগিরি জেলার কালেক্টার ছিলেন সেই সময়ে তিনি এই বিপিও-র চিন্তাধারাটির জন্ম দেন। তিনি আর তাঁর দল মিলে স্কুল-পালানোদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁর স্থাপিত বিপিও-তে নিয়োগ করতেন।
ড. বাবু জেলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষ করে স্কুল-পালানোর সংখ্যা প্রায় শূন্যতে এনে ফেলায়। তিনি এটি সম্ভব করতে পেরেছিলেন প্রযুক্তি, জনগোষ্ঠীর সহযোগ এবং সমস্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সাহায্যে। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর সফটওয়্যারে মজুত ডাটার সম্ভার দেখে। তিনি প্রতিটি স্কুল-পালানো শিশুর খুঁটিনাটি ধরে রেখেছিলেন তাঁর সফটওয়্যারে যা সহজেই পাওয়া যায় www.back2school.in এই ঠিকানায়। তাঁর পদ্ধতিতে প্রতিটি শিশুর পরিবারের চাহিদা কী তার উল্লেখ থেকেছে, যার ফলে জেলা প্রশাসন তত্ক্ষণাৎ সাহায্য করতে পেরেছে।
একটি উদাহরণ। নির্মলা নামের একটি মেয়ে বারবার স্কুল পালিয়েছে। জেলা প্রশাসন তা রদ করার আন্তরিক চেষ্টা করেও কোনও ফল হয়নি। খুঁটিনাটি খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, তার পরিবারের প্রয়োজন একটি রেশন কার্ড, একটি বাসস্থান আর তার মায়ের জন্য একটি চাকরি। জেলা প্রশাসন রেশন কার্ড, ইন্দিরা আবাস যোজনায় একটি বাসগৃহ এবং তার মায়ের জন্য একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দিল। কস্তুরবা গাঁধী বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে নির্মলাকে ভর্তি করে দেওয়া হল। কালেক্টার তার পরিবারের এই চাহিদাগুলি পূরণ করে দেবার পর নির্মলা নিয়মিত স্কুলে যেতে শুরু করে দেয়।
যে জিনিসটি অনুধাবনযোগ্য তা হল, একটি শিশুর স্কুলে না যাওয়ার কারণটির খুঁটিনাটি অনুসন্ধান করেছেন ড. বাবু ও তাঁর দল। সমস্যাটিকে শনাক্ত করে তাকে নির্মূল করে বাচ্চাটির স্কুল যাওয়াকে মসৃণ করে দিয়েছেন। এইভাবেই, স্কুল-পালানোর হার কমে গিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি। এই দৃষ্টান্তটি দেখিয়ে দেয় কেমনভাবে একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার প্রযুক্তির সাহায্যে ও তাঁর নিজের কমিটমেন্ট ও প্যাশন দিয়ে কাজ করে সামাজিক জীবনযাপনে আনতে পারেন এক পরিবর্তন এবং এক সার্বিক সুখ।
স্বর্ণ সিংহ
ড. স্বর্ণ সিংহ পঞ্জাবের জলন্ধরের ডিভিশনাল কমিশনার ছিলেন ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অগাস্ট ২০০৭ পর্যন্ত। তিনি আর তাঁর স্ত্রী অমরজিৎ কৌর টেলিফিল্মের সাহায্যে রাজ্যের এক গম্ভীর সমস্যা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, সম্পর্কে সচেতন করার কাজ করেছেন। স্ত্রীর রচিত চিত্রনাট্য নিয়ে ড. সিংহ নির্মাণ করেছিলেন দু’ঘণ্টার ছবি Eh Tera Apmaan। চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছিল কেমনভাবে এক গ্রাম্য মহিলা নাতির মুখ দেখবে বলে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করে নিয়ে এল অপরাধ।
এর পাশাপাশি ড. সিংহ অন্য ধরনের বাস্তবোচিত ব্যবস্থা নিতেন, যেমন কোনও কন্যাসন্তানের জন্ম হলে তিনি সেই গোষ্ঠীতে উৎসবের আয়োজন করতেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এক দিনে যতগুলি কন্যাসন্তান জন্মাল সবাইকার একই নামকরণ করে দিতেন জেলার কালেক্টার। আবার, যে পরিবারে বা ক্লিনিকে কন্যাভ্রূণ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, সেই বাড়ি বা ক্লিনিকের সামনে গোষ্ঠীর মানুষদের একত্র করে আয়োজন করা হত শোকসভা। কোনও স্লোগান নয়, শুধু শান্তিপূর্ণ শোকসভা সেই সব বেআইনি কাজ যাঁরা করেছেন তাঁদের লজ্জিত করে দিত। গোষ্ঠীর সকলের কাছে তা ছিল এক কড়া বার্তা।
আমরা দেখি কেমনভাবে এক নিয়োজিত সিভিল সার্ভেন্ট ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়া সামাজিক এক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করে কন্যাসন্তান সম্পর্কে ধারণার এক বিশাল পরিবর্তন এনে দিতে পারেন।
এম জি ভি কে ভানু
২০১১ সালের ২১ নভেম্বর, আমি আসামের জোরহাটে গিয়েছিলাম ওয়ার্ল্ড টি সায়েন্স কংগ্রেসে ভাষণ দিতে। জোরহাটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর সি জৈনের আয়োজিত প্রশাসক ও পুলিশ আধিকারিকদের একটি সভায় আমি বক্তৃতা দিই। ‘আমি সততার সঙ্গে কাজ করব এবং সফল হব সততার সঙ্গে’ নামে একটি শপথ অংশগ্রহণকারীদের দিয়ে পাঠ করিয়েছিলাম। ‘সততার সঙ্গে কাজ করব’ অংশটি সকলে উচ্চস্বরে বললেন, কিন্তু সে স্বর নীচে নেমে গেল ‘সফল হব সততার সঙ্গে’ অংশটির সময়ে।
পরের দিন অবশ্য, আমি এক অত্যন্ত সুন্দর অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখতে পেলাম ওয়ার্ল্ড টি সায়েন্স কংগ্রেসে মুখ্যমন্ত্রী ও জোরহাট প্রশাসনের উপস্থিতিতে। টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আই এ এস অফিসার এম জি ভি কে ভানুকে দেখলাম আমার সামনে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে সূচনা ভাষণ দিতে।
তিনি তাঁর ভাষণে বললেন, ‘গতকাল, ড. কালাম সকল আইএএস এবং আইপিএস অফিসারদের, যার মধ্যে আমিও অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, একটি শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই ড. কালাম, যে, আমি আমার আইএএস জীবনের চব্বিশ বছর রাজ্যের এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সততার সঙ্গে কাজ করেছি এবং সফলও হয়েছি সততার সঙ্গে। আমি এখন টি বোর্ডে আছি। আমি আসামের মুখ্যমন্ত্রীর সচিব ছিলাম। আমি ড. কালামকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমি আমার সকল কাজে এক ধরনের নীতিনিষ্ঠ দৃঢ়তা বজায় রাখার চেষ্টা করে গিয়েছি।’
তিনি আরও বললেন যে, তিনি সারা রাত চিন্তা করেছেন কোন কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে ভারতকে সর্ববৃহৎ চা উৎপাদক ও রপ্তানির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে চান।
এই অনন্য অভিজ্ঞতাটি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আমার খুব ভাল লাগল। যদি ভারত সরকারের প্রত্যেক কার্যনির্বাহক এমন ভিশন ও মিশন নিয়ে কাজ করেন, আমি নিশ্চিত ২০২০ সালের আগেই আমরা এক উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়ে উঠব।
উপসংহার
প্রায় ২২০০ বছর আগে তাঁর যোগসূত্র-তে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছিলেন: ‘তুমি যখন কোনও মহান উদ্দেশ্যে, কোনও অসাধারণ প্রকল্পের জন্য অনুপ্রাণিত, তখন তোমার চিন্তা সব সীমাই ছিন্ন করে দেয়। তোমার মন সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে, তোমার বিবেক সবদিকে বিস্তার করে এবং তুমি এক নতুন, মহান, অপূর্ব জগতে নিজেকে খুঁজে পাও। সুপ্ত শক্তি, মেধা এবং প্রজ্ঞা জাগ্রত হয়, এবং নিজেকে তোমার স্বপ্নের থেকেও এক বৃহত্তর ব্যক্তি হিসেবে তুমি আবিষ্কার কর।’ এই অনুপ্রাণিত কথাগুলি মনে রেখে সিভিল সার্ভেন্টদের জন্য আমার পাঁচ-দফা শপথ দিয়ে শেষ করা যাক:
১। আমি যে জায়গায় কাজ করতে যাব, আমি সেখানকার মানুষকে ১০০ শতাংশ শিক্ষিত করে তুলতে কাজ করব, এবং আমি নিশ্চিত করব যাতে একটি শিশুও স্কুল ছেড়ে চলে না যায়।
২। আমি নিশ্চিত করব যাতে মহিলাদের অবস্থা সমৃদ্ধ হয়, এবং আমি ছেলে আর মেয়ের মধ্যে সাম্য আনতে কাজ করব।
৩। আমি নিশ্চিত করব যাতে কেউ আমাকে দুর্নীতির পথে প্রলোভিত না করতে পারে।
৪। আমি জেলায় যতদিন কাজ করব আমি নিশ্চিত করব যাতে এক লক্ষ গাছ রোপণ হয় এবং তাদের পরিচর্যা করা হয়।
৫। যে জেলায় আমার নিয়োগ হবে, সেখানে যাতে সেই জেলার অন্তত পাঁচটি ‘পুরা’ কমপ্লেক্স কাজ করতে পারে আমি নিশ্চিত করব, এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষের যাতে কাজের সুযোগ হয়, তার জন্য গ্রামীণ সংস্থা তৈরি করে কাজ করব।
.
বারো : বিচারব্যবস্থাপক
যে রাষ্ট্র ন্যায়ের পথে স্থিত সেই রাষ্ট্রই মহান এক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আশা করতে পারে। সমাজে ন্যায়, সাম্য ও ন্যায্যবোধের প্রতিষ্ঠা করে, এক মহান দেশের ভিত্তি স্থাপন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় এক শক্তসমর্থ বিচারব্যবস্থা। সেই সঙ্গে, সময় মতো বিচার না হলে শুধু বিচারব্যবস্থা নয়, অস্বীকৃত হয় মহত্ত্বও। দুর্ভাগ্য এই যে, আদালতে মামলা পড়ে থাকা এবং নিষ্পত্তির জন্য অস্বাভাবিক দেরি হওয়া, এমন পরিস্থিতি ভারতের আইনব্যবস্থাকে পীড়িত করে রেখেছে বহুদিন ধরেই। ফলে, জাতীয় উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটে যাচ্ছে। আইন ও বিচার মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ভারতের উচ্চতম, উচ্চ, জেলা আর নিম্ন আদালতগুলিতে ৩ কোটি মামলা নিষ্পত্তির জন্য রয়েছে। তার ১০ শতাংশ দশ বছরের বেশি সময়ের জন্য পড়ে আছে।
এর কারণ অনেক: আদালতের সংখ্যা অপ্রতুল এবং জুডিশিয়াল অফিসারদের সংখ্যাও অপর্যাপ্ত (একটি হিসেবে, ৭০,০০০ বিচারপতির স্বল্পতার দরুন ভারতের আইনব্যবস্থা ভুগছে); বিশেষ ধরনের মামলা সামলানোর ক্ষমতা জুডিশিয়াল অফিসারদের নেই; মামলাকারী এবং তাঁদের উকিলরা দীর্ঘসূত্রতার পদ্ধতি অবলম্বন করে, যেমন প্রায়শই মুলতুবি নেওয়া এবং সময়মতো কাগজ নথি জমা না দেওয়া; এবং সব শেষে আছেন আদালতগুলির প্রশাসনিক স্টাফরা।
শক্তসমর্থ বিচারব্যবস্থা
এই সব সমস্যার সমাধান করার প্রয়াস নিয়ে সত্বর বিচারের ব্যবস্থা করে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার উচিত জাতীয় উন্নয়নের চালকের দায়িত্ব নেওয়া। জমে থাকা মামলাগুলির নিষ্পত্তি করা যেতে পারে মানবিক দৃষ্টি, সেগুলির বয়সের বিচার, বিতণ্ডার সমাধানে বিকল্প উপায়, ফাস্ট-ট্র্যাক আদালত, ই-বিচারব্যবস্থা, বিচারক, উকিল এবং জুডিশিয়াল অফিসারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তাঁদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। আইনের নজরে যে সব মামলা এক ধরনের সেগুলি একত্রে একজন বিচারক বা বেঞ্চের কাছে পেশ করা যেতে পারে। যেমন, একই সরকারি দপ্তরের মামলাগুলি নিষ্পত্তির জন্য কোনও বিশেষ পদ্ধতির ব্যবস্থা। অহেতুক মুলতুবি না করে উকিলদের উচিত মামলা চালিয়ে যাওয়া। প্রতি মামলার নির্দিষ্ট সংখ্যার মুলতুবি বেঁধে দেওয়া থাকবে।
ই-বিচারব্যবস্থা মামলাকারীদের পীড়া লাঘবের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। মামলা রুজু থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত সবকিছুই হবে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। এতে খুব সহজেই নথির সার্চিং, তার উদ্ধার, ঠিকভাবে সাজিয়ে নেওয়া, তথ্যের ও রেকর্ডের প্রক্রিয়াকরণ, এবং মামলার নিষ্পত্তিও হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে। স্বচ্ছতার শুরু হতে হবে ঘর থেকে। বিচারক, উকিল এবং অন্য সহযোগী স্টাফ ও মামলাকারী, সকলে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে হবে, এবং প্রত্যেককেই তাঁর কাজের জন্য দায়বদ্ধ থাকতে হবে।
দেশের উন্নতির বিশাল দায়িত্ব রয়েছে আদালতের উপর। বিচারব্যবস্থাকে গতিশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা নিয়ে এই কর্মকাণ্ডে শামিল হতে হবে।
আইন ও নীতি
আইনকে আলাদা করে না দেখে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার বিভিন্ন ভাবনাচিন্তার পরিবর্তনের সঙ্গে আইনের সম্পর্ক বুঝতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রচুর অগ্রগতি হয়েছে বিগত দুশো বছরে। কিছু জিনিস যা বিজ্ঞান ভেবেছিল হওয়া সম্ভব, তা হয়নি; আর কিছু জিনিস যা ভাবা হয়েছিল অসম্ভব, তা সম্ভব হয়েছে। এটা অত্যন্ত দুঃখের হবে যদি আমাদের সমাজে যে বিবর্তন ও বিপ্লব ঘটে চলেছে তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমাদের আইন ও নীতি অক্ষম হয়।
যে দ্রুততার সঙ্গে অগ্রগতি হচ্ছে এবং যার প্রভাব সমগ্র মানবজাতি এবং সমাজের উপর পড়ছে, তার জন্য আইন, বিজ্ঞান ও নীতির সংহতভাবে এক পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ এবং আইনজ্ঞকে একসঙ্গে বসে একটি পথরেখা তৈরি করতে হবে যাতে প্রযুক্তির সাহায্যে আমাদের আইনব্যবস্থা, এক ভারসাম্য বজায় রাখা সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
মানুষের জিনোম প্রকল্পের উদাহরণটাই দেখা যাক, যার সম্পর্কে এই বইয়ে আগে উল্লেখ করেছি। সেই প্রসঙ্গে যে প্রশ্নগুলি মনে আসে সেগুলি হল: প্রকল্পের যে ফলাফল তার মালিকানা কার? ব্যক্তির জিনগত তথ্য কে আহরণ করতে পারবে, এবং তা কেমনভাবে ব্যবহার করা হবে? জিনগত তথ্যের মালিক কে, কে তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে? কেমনভাবে জিনগত পরীক্ষার বিশ্লেষণ এবং প্রবিধান করে সঠিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং উপযোগিতা নিরূপণ হবে? আইনের অন্য যে দিকগুলির পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন তা হল অন্তরিক্ষ সংক্রান্ত আইন আর সাইবার আইন।
বিজ্ঞানের সাধনা প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে বুঝতে সাহায্য করে এবং তা মানব সমাজে বাস্তবোচিত প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়। তেমনই, সমাজকে শাসনে রাখতে যে আইন রচিত হয়েছিল তা আইনত কাজ করে সমাজে আনে শৃঙ্খলা এবং সুস্থিতি। কিন্তু যে সব ব্যক্তি এই আইনের প্রয়োগ করেন তাঁদের কোন আইনে নিয়ন্ত্রণ করা হয়? সেই আইন কে রচনা করেন? আমার মনে হয় এই সব বিস্তৃতভাবে চলে আসে ‘নীতি’র এক্তিয়ারে। এই নীতির অনুশীলন নিয়ম এবং বিধির থেকে অনেক বেশি জরুরি। সব শেষে, প্রয়োজন হয় সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের রূপান্তর।
উপসংহার
হাজারও বছর ধরে ভারত রাজারাজড়া দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। প্রত্যেক শাসকই এক গুচ্ছ আইন রেখে যান। তেমনভাবেই, ভারতে নানান ধর্ম মানা হয়ে এসেছে এবং তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ আইন আছে। ব্রিটিশরা দু’শো বছরের উপর আমাদের শাসন করে দিয়ে গিয়েছে আইনের শাসন, যার ভিত্তি তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আইনি অভিজ্ঞতা। অনেকগুলি দশক ধরে আমরা তা-ই মেনে চলেছি। প্রতিটি আইনই আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
বর্তমানে, ভারত এমন এক অভাবনীয়তার মধ্য দিয়ে চলেছে যেখানে তথ্য সমাজ, শিল্প সমাজ ও কৃষি সমাজকে প্রভাবিত করছে জ্ঞান সমাজ, উদ্ভাবন ও মূল্যবোধের সহযোগে। এই পরিস্থিতি ধন্যবাদার্হ, কারণ এর সাহায্যেই ২০২০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে ভারত। বহু দেশেই শুধুই অর্থনৈতিক অগ্রগতি সামাজিক জীবনে সুখ আনতে পারেনি। এর অর্থ, অর্থনৈতিক অগ্রগতির লক্ষ্যে স্থির থেকে, আমাদের সভ্যতার ঐতিহ্য থেকে নীতিজ্ঞান আর মূল্যবোধকে আহরণ করে আমাদের সমাজের বিবর্তনে তা প্রোথিত করে দিতে হবে। ভারতের উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে মিল রেখে আইনব্যবস্থার বিবর্তন হতে হবে। এর থেকেই জন্ম নেবে সুখী, সমৃদ্ধ এবং নিরাপদ ভারত।
আমি শেষ করব ভারতের উঠতি আইনজীবী এবং আইনব্যবস্থার পেশাদারিদের জন্য শপথ দিয়ে:
১। আমি আমার অভিজাত আইন পেশাকে ভালবাসি।
২। আমি সকল সময়ে আমার সব মামলায় সত্য উদ্ঘাটনের জন্য কাজ করব।
৩। প্রত্যেকের কাছে আইনব্যবস্থা পৌঁছে দেবার জন্য আমি সচেষ্ট থাকব, তাঁর অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা ব্যতিরেকে।
৪। আমি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করব যাতে আমার প্রতিটি মামলা সত্বর শেষ হয়।
৫। আমি আইনের সাহায্যে প্রত্যেক মানুষের জীবনের সম্মান রাখতে সচেষ্ট থাকব।
৬। আমি আইনের সাহায্য নিয়ে কখনওই কোনও নিরীহকে অপরাধী সাব্যস্ত করব না।
৭। আমি আইনের সাহায্যে রাষ্ট্রকে দুর্নীতি ও আতঙ্কবাদ মুক্ত রাখতে সচেষ্ট থাকব।
৮। আমি কোনও সময়েই আইনকে এমনভাবে ব্যবহার হতে দেব না যাতে মানবকল্যাণ এবং জাতীয় উন্নয়ন বিঘ্নিত হয়।
৯। আমার রাষ্ট্রই আমার জীবন, আমি আমার আইনি জ্ঞানের সাহায্যে তার সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখব।
.
তেরো : রাজনৈতিক নেতা
সব শেষে, মহান এক রাষ্ট্র গড়তে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সম্পর্কে আমি বলতে চাই। একটি দেশের ভবিষ্যতের পরিবর্তন ঘটায় রাজনীতিকদের সিদ্ধান্ত, তাঁদের লক্ষ্য এবং তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্ম। এক অনুপ্রাণিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া এক মহান রাষ্ট্র সম্ভব নয়। সুতরাং, আমাদের গভীর চিন্তার প্রয়োজন, কীভাবে এক মননশীল নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটানো যায়। এমন এক নেতৃত্ব যা হয়ে উঠবে নিজেই এক নিদর্শন আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের পথে এগিয়ে দিতে।
আমি এখানে স্মরণ করি আমার অভিজ্ঞতায় ভারতের ইতিহাসের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাকে।
শ্রেষ্ঠদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা
পি ভি নরসিংহ রাও ও অটল বিহারী বাজপেয়ী
১৯৯৬ সালের মে মাসের কোনও এক রাত্রি ৯টা বাজে তখন। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি থেকে আমাকে ফোনে বলা হল পি ভি নরসিংহ রাওর সঙ্গে সত্বর দেখা করতে। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার দু’দিন আগেই আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘কালাম, আপনার দল নিয়ে আপনি এক আণবিক পরীক্ষার জন্য তৈরি থাকুন। আমি তিরুপতি যাচ্ছি। ওই পরীক্ষা আয়োজনের জন্য আমার অনুমতির অপেক্ষায় থাকবেন। ডিআরডিও-ডিএই (ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জি)-এর দল যেন প্রস্তুত থাকে কর্মকাণ্ডটির জন্য।’ তাঁর মন্দির-শহরটিতে যাবার কারণ নির্বাচনে সাফল্য পাওয়ার জন্য প্রার্থনা।
যা ঘটল তা তাঁর আশার থেকে অনেকটাই ভিন্ন। উড়িষ্যার চাঁদিপুরে মিসাইল রেঞ্জে আমি তখন ব্যস্ত। আমি ফোন পেলাম যে, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গিয়ে আমি যেন হবু প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে সত্বর দেখা করি। আমি অবাক হয়ে গেলাম এই দেখে যে, রাও চাইছেন আমি বাজপেয়ীকে আমাদের আণবিক যোজনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে দিই, যাতে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি মসৃণভাবে হস্তান্তরিত হয়। এই ঘটনা দেখিয়ে দিল এক দেশভক্ত কূটনীতিকের পরিণত চিন্তাধারা এবং পেশাগত অসাধারণত্ব, যিনি মনে করতেন রাষ্ট্র, রাজনৈতিক ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে।
১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়ে প্রথম যে কাজটি বাজপেয়ী আমাকে দিয়েছিলেন, সেটি হল, যত শীঘ্র সম্ভব আণবিক পরীক্ষাটার ব্যবস্থা করা। কঠিন এবং কঠোর সিদ্ধান্ত উভয় নেতাই নিয়েছেন সাহসের সঙ্গে, হয়তো-বা সেই সিদ্ধান্তগুলির ফলাফল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হয়েছে অসীম গুরুত্বের।
ইন্দিরা গাঁধী ও বিজু পট্টনায়ক
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভেলপিং প্রোজেক্ট-টির অনুমোদন দিয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে। হায়দ্রাবাদের ডিআরডিএল-এর অধিকর্তা ছিলাম আমি যখন সেই ১৯৮৪ সালে তিনি প্রকল্পটির পর্যালোচনা করতে সেখানে গিয়েছিলেন। শ্রীমতী গাঁধীকে আমরা যখন প্রকল্পটির অগ্রগতি সম্পর্কে জানাচ্ছিলাম, তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ওই অধিবেশন কক্ষে রাখা পৃথিবীর একটি মানচিত্রর উপর। তিনি আমাদের থামতে বলে বললেন, ‘কালাম, মানচিত্রটার দিকে তাকান। মানচিত্রে পূর্বদিকের দূরত্বটা দেখুন। আপনার ল্যাবরেটরি কবে একটি মিসাইল উৎক্ষেপণ করতে পারবে যেটি ওই জায়গাটিতে (যেটি ভারতীয় সীমারেখার ৫০০০ কিমি. দূরে অবস্থিত) গিয়ে পড়বে?’
এই ঘটনা আমাকে আর একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। ১৯৯৩ সালে ডিআরডিও-তে আমরা পরীক্ষামূলক মিসাইল উৎক্ষেপণের একটি যথাযোগ্য স্থানের খোঁজ করছিলাম। পশ্চিম ভারতে মরু অঞ্চলে আমাদের স্থান নির্বাচনের প্রচেষ্টা সম্ভব হল না নিরাপদ রেঞ্জ আর ভৌগোলিক-রাজনৈতিক কারণে। সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা পূর্ব তটরেখায় কোনও জনমানবহীন দ্বীপের সন্ধানে ছিলাম। নৌসেনার তরফে আমাদের যে হাইড্রোগ্রাফিক মানচিত্র দেওয়া হয়েছিল, সেখানে বঙ্গোপসাগরে কয়েকটি দ্বীপ নজরে এল। এগুলি উড়িষ্যার ধামরার তটরেখার বাইরে। আমাদের রেঞ্জ দলের দুই সদস্য ড. এস কে সালওয়ান ও ড. ভি কে সারস্বত একটি নৌকা ভাড়া নিয়ে দ্বীপগুলির খোঁজে গেলেন। মানচিত্রে দ্বীপগুলি লং হুইলার, কোকোনাট হুইলার এবং স্মল হুইলার নামে চিহ্নিত ছিল। একটি ডিরেকশনাল কম্পাস নিয়ে তাঁরা যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু তাঁরা পথ হারিয়ে ওই হুইলার দ্বীপগুলিকে খুঁজে পেলেন না। ভাগ্যবশত তাঁরা কয়েকটি মাছ ধরার নৌকার সাক্ষাৎ পেলেন, এবং তাঁদের কাছ থেকে সঠিক নির্দেশ চাইলেন। মত্স্যজীবীরা হুইলার দ্বীপের কথা জানেন না, তবে চন্দ্রচূড় নামের একটি দ্বীপের কথা জানালেন। বিজ্ঞানীরা মনে করলেন হুইলারের কোনও একটা দ্বীপ হয়তো হবে। চন্দ্রচূড় দ্বীপের সম্ভাব্য অবস্থান জেনে নিয়ে তাঁরা সেই দিকে এগোতে থাকলেন। এইভাবে তাঁরা চন্দ্রচূড়ে গিয়ে পৌঁছলেন। পরে নিশ্চিত হল যে, সেটি স্মল হুইলার দ্বীপ। দ্বীপটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আমাদের কাজের প্রয়োজনে ছিল যথার্থ।
এরপরের ধাপে, এই দ্বীপটিতে কাজের জন্য উড়িষ্যা সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। রাজ্য সরকারের আমলাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে এগিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়কের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আবশ্যক হয়ে পড়ল। তাঁর দপ্তর থেকে সংকেত পাচ্ছিলাম যে, আমাদের অনুরোধ নাকচ হয়ে যাবে কয়েকটি কারণে। যাই হোক, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একটি মিটিংয়ের ব্যবস্থা হল।
আমরা তাঁর দপ্তরে পৌঁছে দেখলাম ফাইলটি তাঁর সামনে রাখা। তিনি বললেন, ‘কালাম, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওখানকার পাঁচটি দ্বীপই আমি আপনাকে (ডিআরডিও)-কে বিনা ব্যয়ে দেব। কিন্তু আমি ফাইলে সই করব যদি আপনি একটা প্রতিজ্ঞা রাখেন।’
আমি চিন্তা করতে লাগলাম এই শক্তিশালী নেতাটি আমার কাছে কী চাইতে পারেন।
তিনি আমার হাতটি ধরে বললেন, ‘চিন যাবার একটি আমন্ত্রণ পেয়েছি। আমি সেখানে যাব যদি আপনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, এমন একটি মিসাইল আপনারা নির্মাণ করবেন যা চিনে গিয়ে পৌঁছবে।’
‘স্যার, আমরা অবশ্যই সেই দিকে কাজ করব,’ আমি বললাম। তিনি ফাইলে সই করে দিলেন।
ইন্দিরা গাঁধী এবং বিজু পট্টনায়কদের মতো নেতাদের দূরদৃষ্টি দু’দশক পরে ২০১২ সালে সম্ভব করেছে আমাদের বিজ্ঞানীদের আণবিক-ক্ষমতাসম্পন্ন ‘অগ্নি ৫’ নির্মাণে, যার রেঞ্জ ৫০০০ কিমি.।
সাংসদদের প্রতি ডাক
আমি যখন ভারতের সাংসদদের দিকে তাকাই, আমি তাঁদের মধ্যে দেখতে পাই পি ভি নরসিংহ রাও ও অটলবিহারী বাজপেয়ী, ইন্দিরা গাঁধী ও বিজু পট্টনায়ক, বা ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, পণ্ডিত জহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, সর্দার বল্লভভাই পটেল, ড. বাবাসাহেব অম্বেদকর, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং মহাত্মা গাঁধীর প্রতিশ্রুতি। তাঁরা ছিলেন ভারতের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃবর্গ। আজকের সাংসদদের আমি প্রশ্ন করতে চাই: আপনারাও কি হতে পারেন না দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সেই সব নেতা, যাঁরা রাষ্ট্রকে নিজের আগে স্থান দেবেন? আপনারা কি বিশ্বের দরবারে ভারতের মহান নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতীয়মান করতে পারেন না? হ্যাঁ তা সম্ভব।
গত সাত দশক ধরে স্বাধীন ভারতের সেই সব মহান নেতাদের দূরদৃষ্টি ভারতকে একটি সন্তোষজনক স্থানে রাখতে পেরেছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের বহু গর্ব করার মতো অবদান আছে। কিন্ত সেই সাফল্য নিয়ে বসে থাকলে হবে না। আগামী দশকগুলি ভারতের ভবিষ্যৎ গড়ে দেবেন আজকের সাংসদ, বিধায়ক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তাঁদের কাঁধে আজ এক বিরাট দায়িত্ব।
সময় বেঁধে জাতীয় কার্যক্রম রচনা করে এবং তার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের ভিতর এক বিশ্বাস তৈরি করতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের। আমাদের সামনে আজ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ: অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে জোরদার করে বিশ্বময় যে আতঙ্কবাদ এবং যে নতুন ধরনের আইনশৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তার মোকাবিলা; অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি হওয়া; পৃথিবীর জীবাশ্ম-জ্বালানির দ্রুত হারে হ্রাস পাওয়া; যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহারের পরিকল্পনা রচনা; একশো কোটি মানুষের জন্য নিরাপদ পানীয় জলের জোগান, অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করা।
এই সব জাতীয় সমস্যাগুলির প্রতি আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের, দলমত নির্বিশেষে, নজর দেওয়া প্রয়োজন। যে-কোনও গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হল সংসদ, তাই সাংসদদেরই এই সমস্যাগুলির সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। তাঁদের এই মিশন রাষ্ট্রের এক ভিশনের জন্ম দেবে। তাঁদের উপরই নির্ভর করছে জনগণের এক সমৃদ্ধশালী, শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ ভবিষ্যৎ। সুতরাং সাংসদদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংসদের প্রত্যেক সদস্যের উচিত তাঁরা যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তার জন্য উঠে দাঁড়ানো। প্রত্যেক সাংসদের মধ্যে যেন যুবসমাজ এক মহান নেতা এবং তাঁদের রোল মডেল খুঁজে পান, এবং খুঁজে পান সেই নেতাকে যিনি রাজনীতি আর সমাজে নিয়ে আসবেন এক অত্যন্ত ক্রিয়াশীল পরিবর্তন।
এখানে আমি সরাসরি ভারতের সংসদের মাননীয় সদস্যদের উদ্দেশে বলতে চাই যে, আপনারা সঠিক নীতি ও আইন প্রণয়ন করে এবং সামাজিক রূপান্তরে সাহায্য করে একশো কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারেন। ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠাগুলিতে আপনাদের নাম উল্লেখ থাকার অপেক্ষায় আছে। ভারতকে এক উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে দিন, তার গরিমা হবে আপনার। বিশ্বকে আপনার পরিণত রাজনীতির পরিচয় দিন এবং দেখিয়ে দিন কীভাবে তাকে আপনি রাষ্ট্রের নিরন্তর উন্নয়নের কাজে লাগাবেন। এক অনুনাদশীল, সজাগ, নিরাপদ ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়ার জন্য এগিয়ে আসুন। আমি নিশ্চিত এই ক্ষমতা আপনাদের আছে এবং তা সম্ভব হবে যদি আপনাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে।
উপসংহার
২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারির একটি ঘটনার কথা আমি এখানে বলতে চাই। মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে ‘সতপুরা শিক্ষণ প্রসারক মণ্ডল’ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। এই অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে আমি লাখ খানেক তরুণদের একটি সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলাম ‘আমি অনন্য’ এই বিষয়ে, সেখানে উপস্থিত ছিলেন বহু রাজনীতিক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ। ভাষণ শেষে অনেকগুলি প্রশ্নের মধ্যে এক তরুণ বালকের প্রশ্নটি ছিল তাত্পর্যের।
সে নিজেকে হারালী গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র বলে পরিচয় দিল। সে প্রশ্ন করল, ‘স্যার, আমাদের সংবাদমাধ্যমে এবং আমার বন্ধুরা সব সময়ে বলে যে, চিন ভারতের থেকে অনেক বেশি অর্থনৈতিক অগ্রগতি করেছে এবং তার অগ্রগতির হারও আমাদের থেকে বেশি। দয়া করে, স্যার, আপনি আমাদের বলুন কেন ভারত দ্রুত হারে অগ্রগতি করতে পারছে না। আপনি আমাদের বলুন, তার জন্য আমার মতো তরুণদের কী করতে হবে?’
বালকের এই প্রশ্ন সকলের সাদর অভিনন্দন পেল। এক লক্ষ তরুণ আমার কাছে উত্তর চায়। মঞ্চে উপবিষ্ট বন্ধুরাও আমার দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে। কিছু পল চিন্তা করে আমি ছেলেটির নাম জানতে চাইলাম।
সে উত্তর দিল, ‘বিনীত।’
আমি বললাম, ‘বিনীত, তোমার রয়েছে এক শক্তিশালী মন এবং তুমি দেশকে ভালবাস। তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলতে পারি, একথা সত্য যে, চিনের অর্থনৈতিক উন্নতি ভারতের থেকে ভিন্ন ধরনের। কিন্তু চিনের সঙ্গে তফাত হল, ভারত এক সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ। তার জনগণ নেতাদের নির্বাচন করেন। গণতন্ত্রের কিছু চাপ, কিছু টান থাকে। কিন্তু আমাদের পাখা মেলে এগিয়ে যেতে হবে। ওই দীর্ঘসূত্রতা যা গণতন্ত্রের সহচর, তাকে দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে নেতৃত্বকেই। এখানে যত তরুণ আজ জমা হয়েছেন, তাঁদের আমি বলব, প্রিয় তরুণ সাথীরা, আমি আপনাদের দু’টি ব্যবস্থা— একটি পূর্ণ গণতন্ত্র, সঙ্গে দ্রুত উন্নয়ন, এবং অন্যটি চিনের মতো রাজনৈতিক ব্যবস্থা— এই দু’টি ব্যবস্থার মধ্যে আপনারা কোনটি বেছে নেবেন?’
হাত তুলে যখন আমি তাঁদের পছন্দ জানাতে বললাম, ৯৯ শতাংশ তরুণ হাত তুলে জানালেন, তাঁরা দ্রুত উন্নয়নের গণতন্ত্রে বাস করতে চান। এই বার্তাটি উচ্চস্বরে এবং স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল: ‘তরুণ সমাজ নিশ্চিত করে চায় নতুনভাবে আবিষ্কৃত হোক এক দ্রুত উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্র।’
আমি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আমাদের গণতন্ত্রকে পুনরাবিষ্কার করে আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের পথটিকে পালটে দেবার জন্য আহ্বান করব। আমি শেষ করব আমাদের সাংসদদের জন্য এই শপথ দিয়ে:
১। আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কারণ আমার নির্বাচন কেন্দ্র আমাকে নির্বাচিত করেছে তাঁদের নেতৃত্ব দেবার জন্য।
২। আমি উপলব্ধি করছি যে জনগণের নেতৃত্বের অর্থ আমার নির্বাচন কেন্দ্রতে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে হবে।
৩। আমার নির্বাচন কেন্দ্রের জন্য আমার লক্ষ্য হবে: ১০০ শতাংশ শিক্ষিত করে তোলা, সব জলাধারগুলিকে কার্যকরী করা, সকল প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রগুলিতে সত্ত্বর কাজ শুরু করা, এবং সর্বোপরি, এক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কেন্দ্র।
৪। আমি প্রশ্ন করব, ‘আমি কী দিতে পারি?’ এই প্রশ্ন আমাকে বিনয়ের সঙ্গে পরিসেবা দিতে বাধ্য করবে।
৫। আমি সততার সঙ্গে কাজ করব এবং সফল হব সততার সঙ্গে।
৬। আমি ২০ লক্ষ গাছ রোপণ করে নিশ্চিত করব আমার নির্বাচন কেন্দ্রতে সবুজ পরিবেশ।
৭। আমার মেধা সকল যন্ত্রণা দূর করুক।
৮। জাতীয় পতাকা আমার হৃদয়ে সর্বক্ষণ উড্ডয়নরত এবং আমি আমার রাষ্ট্রকে এনে দেব গরিমা।
৩. অন্তিম কিছু ভা
পর্ব ৩ : অন্তিম কিছু ভাবনা
চোদ্দ : নেতৃত্বের গুরুত্ব
আমি সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে অনুরোধ করব এই শপথগুলি অনুধাবন করে সেগুলিকে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে। তাহলেই আমরা সকল ক্ষেত্রেই মননশীল নেতৃত্ব পাব, যে নেতৃত্ব আমাদের রাষ্ট্রকে পথ দেখিয়ে সেই শ্রেষ্ঠত্বের দিকে নিয়ে যাবে। নেতৃত্বের গুরুত্বের বিষয়ে আমি বলে সেভাবে ঠিক বোঝাতে পারব না কারণ, তাদের একটিমাত্র লক্ষ্যই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয়। ভারতের ইতিহাস থেকে কিছু কিছু দৃষ্টান্ত নিয়ে আমরা দেখি কেমন ভাবে কয়েকজন নেতা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে এনেছিলেন আমূল পরিবর্তন।
স্বাধীনতা অভিযান
ভারতের স্বাধীনতা অভিযান রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা, সাহিত্য, শিল্পকলা, বিচারব্যবস্থা, বিজ্ঞান এবং শিল্পের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন জন্ম দিয়েছে বেশ কয়েকজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, নিয়োজিত ও আবেগপ্রবণ নেতার। রাজনীতির ক্ষেত্রে বাল গঙ্গাধর টিলক ১৮৮০-র দশকে উচ্চারণ করলেন অগ্নিসম তাঁর সেই উক্তি, ‘স্বাধীনতা আমার জন্মগত অধিকার, এবং তা আমি আদায় করবই’, এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সঞ্চার করলেন নতুন জীবন। জামশেদজি টাটা ভারতে লৌহশিল্পের সূত্রপাত করলেন, যদিও সামন্ত্রতান্ত্রিক শাসকরা তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করেছিলেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, আর বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির স্থাপনা করলেন পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য ১৯১৬ সালে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির রসায়নের অধ্যাপক আচার্য পি সি রায় ছিলেন ভারতে ফার্মাসিউটিকালের পুরোধা পুরুষ।
ভারতীয়-মার্কিনি অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট অধ্যাপক সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর, যিনি ১৯৮৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন, তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, কেমনভাবে ১৯২০ দশকে পাঁচ পাঁচজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ভারতে কাজ করছিলেন। এঁরা হলেন সি ভি রমন, জে সি বোস, শ্রীনিবাস রামানুজন, এস এন বোস এবং মেঘনাদ সাহা। চন্দ্রশেখর বলছেন, এটা এক সুখকর কাকতালীয় ঘটনা নয়। এঁরা প্রত্যেকেই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, ভারতীয় মেধা বিশ্বের যে-কোনও শ্রেষ্ঠ মেধার সমতুল। তিনি আরও বলেছেন, স্বাভিব্যক্তি এবং নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করার এক দুর্দমনীয় অভিপ্রায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে থাকে, তা সে রাজনীতিতেই হোক বা বিজ্ঞানে, এবং তা স্বাধীনতা অভিযানে প্রতীয়মান হয়েছে।
সাহিত্য জগতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরষ্কার পেলেন ১৯১৩ সালে। যে সময়ে ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল দূর অস্ত্, সেই সময়ে তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর দেশবাসীকে স্বাধীনতার জন্য দৃঢ় বিশ্বাস ও আবেগ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছেন:
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,…
পিতঃ, ভারতেরে সেই স্বাধীনতার স্বর্গে করো জাগরিত
[Where the mind is without fear and the head is held high…
Into that heaven of freedom, my Father, let my country awake.]
সেই সময়েই, মহান তামিল কবি, জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী সুব্রাহ্মনিয়া ভারতী তাঁর দূরদৃষ্টিতে এক মহান ভারতকে দেখলেন, যেখানে স্ত্রীজাতি মুক্ত ও যেখানে শিক্ষার বিস্তার হয়েছে। ১৯১০ সালে তিনি স্বাধীনতার জয়গানের এক কবিতায় বললেন, ‘চল সবে উৎসবে মাতি, আমাদের আনন্দময় স্বাধীনতা এসে গিয়েছে।’ সংগীতের ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতকে ত্যাগরাজা, মুথুস্বামী দীক্ষিতার এবং শ্যাম শাস্ত্রীর ত্রিমূর্তি কর্ণাটকি সংগীতকে সমৃদ্ধ করে তুললেন। পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীতে নবজাগরণ নিয়ে এলেন।
এই সময়ে ভারত বেশ কয়েকজন অনুপ্রাণিত মহিলা নেত্রীকে পেয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের ভীমা বাঈ হোলকার, কিট্টুরের রানি চেন্নাম্মা, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, ঔধের বেগম হজরত মহল, আর বিংশ শতকে সরোজিনী নাইডু, কস্তুরবা গাঁধী এবং অ্যানি বেসন্তের মতো কয়েকটি নাম আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়, তাঁদের অবদানের জন্য— যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক বা রাজনীতিতে।
সবশেষে বহু মহান নেতা যেমন পণ্ডিত জহরলাল নেহরু, সুভাষ চন্দ্র বোস, সর্দার বল্লভভাই পটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং সি রাজাগোপালাচারি, মহাত্মা গাঁধীর অনুপ্রাণিত নেতৃত্বে স্বাধীনতা অভিযানের সামনের সারিতে থেকে ভারতকে এনে দেন তার কষ্টার্জিত স্বাধীনতা।
বিক্রম সারাভাই: এক মহান দূরদ্রষ্টা
স্বাধীনতার পর ভারত বহু মহান নেতার দেখা পেয়েছে। এঁদের অনেকের সঙ্গেই কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বিমুগ্ধতা নিয়ে আমি স্মরণ করি তেমনই একজনকে— ড. বিক্রম সারাভাই। ইসরো-তে সাত বছর আমি তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। তাঁর এক-পৃষ্ঠার বিখ্যাত এক বক্তব্যে আমি দেখেছিলাম ভারতের অন্তরিক্ষ যোজনার উন্মেষ।
তাতে বলা হয়েছে: ‘তার বিশাল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানভাণ্ডার ও যুবশক্তির আধার নিয়ে ভারতের নিজস্ব রকেট সিস্টেম সমূহ (স্যাটেলাইট লঞ্চিং ভেহিকল) নির্মাণ করা জরুরি, এবং তার সঙ্গে নির্মাণ করা উচিত তার নিজস্ব যোগাযোগ, রিমোট সেন্সিং এবং আবহবিদ্যাগত নভোযান, এবং নিজস্ব ভূমি থেকে উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা, যাতে উপগ্রহ যোগাযোগ, রিমোট সেন্সিং এবং আবহবিদ্যা ভারতীয় জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। অন্তরিক্ষ প্রকল্পে যে কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হয়েছে তার সবই সমাজের চাহিদা পূরণের জন্য।’
এই মহান নেতা যিনি ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করা আমার কাছে এক দুর্দান্ত শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। এই চার দশক পর যখন আমি সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বক্তব্যটি ফিরে দেখি, আমি বিস্মিত হয়ে যাই তার অভীষ্ট ফল দেখে। আজ ভারত যে-কোনও উপগ্রহ উৎক্ষেপণ যান, যে-কোনও নভোযান তৈরি করতে সক্ষম, এবং তাদের উৎক্ষেপণ হয় ভারতীয় ভূমি থেকেই। চন্দ্রযান ও মঙ্গলযান উৎক্ষেপণ করেছে ভারত। অন্য গ্রহে মানুষ পাঠানোর তোড়জোড় চলছে। ভারত প্রমাণ করেছে নভোবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা কার্যকরী যোগাযোগ, সম্পদ ম্যাপিং, বিপর্যয়ের ভবিষ্যবাণী এবং তার ম্যানেজমেন্ট প্রদান করতে সক্ষম।
ড. সারাভাই ভারতের জন্য এমন এক পথের দিশা দেখিয়েছেন যা কেউ কোনওদিন ভাবতে পারেননি। আমি একটি বিশেষ ঘটনার কথা বলতে চাই যা তাঁর এই বৈশিষ্ট্যটিকে প্রকাশ করেছে। ১৯৬০ দশকের গোড়ার দিকে তিনি আর তাঁর দল মিলে অনেকগুলি বিকল্প জায়গা দেখে একটি জায়গা নির্বাচন করেন যেটি অন্তরিক্ষ গবেষণার জন্য প্রযুক্তিগতভাবে উপযোগী। উচ্চ বায়ুমণ্ডলে আয়নোস্ফেরিক ও ইলেক্ট্র্রোজেট গবেষণার জন্য আদর্শ যে চৌম্বক বিষুবরেখা, তার কাছেই অবস্থিত বলে নির্বাচিত হল কেরালার থুম্বা।
নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি বিশেষ স্থান খুঁজে পাওয়া ছিল ড. সারাভাইয়ের কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রথা অনুযায়ী কেরালা প্রশাসনের কাছে তিনি প্রথমে গেলেন। জায়গাটির এবং তটরেখার প্রোফাইল দেখে জানানো হল যে সেখানে হাজারো মত্স্যজীবীর বাস। সেখানে রয়েছে একটি প্রাচীন গির্জা, বিশপের বাড়ি ও একটি স্কুল। সুতরাং প্রশাসনের মনে হয়েছে জায়গাটি এই কাজে দেওয়াতে সমস্যা হবে। বিকল্প হিসেবে অন্য কোনও জায়গা ব্যবস্থা করে দিতে তাঁরা প্রস্তুত। জানানো হল যে, একজনের সঙ্গে দেখা করতে, যিনি এই ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন।
তিনি হচ্ছেন ওই অঞ্চলের বিশপ রেভারেন্ড ফাদার পিটার বার্নার্ড পেরেরা। আমার মনে আছে, এক শনিবার বিকেলে ড. সারাভাই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সেই সাক্ষাৎটি হয়ে দাঁড়াল ঐতিহাসিক। আমরা অনেকেই ছিলাম প্রত্যক্ষদর্শী।
‘ওহে বিক্রম, তুমি তো বাচ্চাদের গৃহ, আমার গৃহ এবং ঈশ্বরের গৃহ চাইতে এসেছ,’ বললেন বিশপ। ‘সে কী করে সম্ভব?’
উভয়েরই একটি বিষয়ে মিল ছিল। কঠিন সময়েও তাঁরা দুজনেই হাসতে পারতেন। বিশপ, ড. সারাভাইকে রবিবার সকাল ৯টায় গির্জায় আসতে বললেন। ড. সারাভাই আর তাঁর দল তা-ই গেলেন। তাঁরা যখন গির্জায় পৌঁছলেন তখন প্রার্থনা চলছিল। প্রার্থনার শেষে বিশপ, ড. সারাভাইকে মঞ্চে ডেকে নিলেন।
‘প্রিয় সন্তানবৃন্দ, ইনি একজন বিজ্ঞানী, ড. বিক্রম সারাভাই,’ তিনি তাঁর শ্রোতাদের বললেন। ‘বিজ্ঞান কী করে? আমরা সকলেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আলো জ্বালাই, এমনকি এই গির্জায়ও। আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি এই মাইকের মাধ্যমে, যা প্রযুক্তির দান। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যে রুগিদের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা হয়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির সাহায্যে মানবজীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এবং তার মান বৃদ্ধি করেছে। যাজক হিসেবে আমি কী করি? আপনাদের সুখ শান্তির জন্য প্রার্থনা করি। ছোট করে বলতে গেলে, বিক্রম আর আমি একই কাজ করি। বিজ্ঞান আর অধ্যাত্মবাদ উভয়ই সর্বশক্তিমানের কাছে মানবজাতির শারীরিক ও মানসিক সমৃদ্ধির জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। প্রিয় সন্তানেরা, বিক্রম বলছে এক বছরের মধ্যে তটরেখার কাছেই আমাদের এই ব্যবস্থার বিকল্প তৈরি করে দেবে। প্রিয় সন্তানেরা, আমরা কি আপনাদের আবাস, আমার আবাস, ঈশ্বরের আবাস বিজ্ঞানের এক মহান কর্মকাণ্ডের জন্য দিয়ে দিতে পারি?’
নিশ্চুপ স্তব্ধতা সব দিকে। তারপর সকলে, যাঁরা সেদিন গির্জায় সমবেত হয়েছিলেন, উঠে দাঁড়িয়ে একযোগে বলে উঠলেন, ‘আমেন।’
গির্জার জায়গায় আমরা তৈরি করলাম আমাদের ডিজ়াইন কেন্দ্র, যেখানে আমরা শুরু করলাম রকেট অ্যাসেমব্লির কাজ। বিশপের বাড়িটি হল আমাদের বিজ্ঞানীদের কর্মস্থান। সেইখানেই আমরা চালু করলাম থুম্বা ইকুয়েটোরিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন, যা পরবর্তী সময়ে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার হিসেবে স্থাপিত হয়। ওইখানে অন্তরিক্ষ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের সূত্রপাত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্পেস সেন্টারের স্থাপনা হতে লাগল। গির্জাটি বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র যেখানে হাজার হাজার মানুষ জানতে পারছেন ভারতের অন্তরিক্ষ গবেষণার অত্যন্ত ক্রিয়াশীল ইতিহাস। এর সঙ্গে তাঁরা জানতে পারছেন এক বিজ্ঞানী এবং এক অধ্যাত্মবাদী নেতা, এঁদের দু’জনের মহৎ চিন্তা-ভাবনার খবর। থুম্বার বাসিন্দারা বিকল্প স্থানে পেলেন তাঁদের নতুন স্কুলবাড়ি এবং আরাধনার স্থান।
এই ঘটনাটি যখনই স্মরণে আসে, আমি দেখি কেমন করে আলোকপ্রাপ্ত আধ্যাত্মিক জগতের এবং বিজ্ঞান জগতের নেতারা একযোগে মানবকল্যাণে কাজ করেন। থুম্বা ইকুয়েটোরিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন এবং পরবর্তীতে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের জন্ম দেশকে লঞ্চ ভেহিকল, অন্তরিক্ষ যান এবং অন্তরিক্ষ প্রয়োগ সংক্রান্ত দক্ষতা এনে দিল। এবং তার ফলে ভারতের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়ে এক অভাবনীয় স্তরে পৌঁছয়।
আজ আমাদের মধ্যে না আছেন ড. সারাভাই, না আছেন ফাদার পেরেরা, কিন্তু তাঁরা আমাকে ভগবদ্গীতার এই পঙ্ক্তিগুলি মনে করিয়ে দেন: ‘ফুলকে দেখ কেমন উদারভাবে সুগন্ধ ও মধু বিতরণ করছে। সে সকলকেই তা দিচ্ছে, দিচ্ছে তার ভালবাসা। কাজের শেষে সে চুপিসারে ঝরে যায়। ফুলের মতো হও— নানা গুণ সত্ত্বেও নিরভিমান।’ কী অসাধারণ এই বার্তা মানবজীবনের ধর্ম বিষয়ে।
অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান: সাফল্য ও অসাফল্য সমানভাবে স্বীকার করা
তিন দশক আগে, আমি যখন ইসরো-তে কাজ করছি, আমি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা পেয়েছিলাম যা কোনও বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারবে না। ইসরো-র তদানীন্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান আমাকে একটি কাজ দিলেন। প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ যান এসএলভি-৩ নির্মাণ করে রোহিণী উপগ্রহকে কক্ষপথে পাঠাতে হবে। এটি ছিল সেই সময়ে সব থেকে উচ্চপ্রযুক্তির অন্তরিক্ষ যোজনা। সমগ্র অন্তরিক্ষ প্রযুক্তি সমাজ প্রস্তুত এই কর্মকাণ্ডের জন্য। হাজারও বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রযুক্তিবিদ দিনরাত কাজ করে ১০ অগাস্ট ১৯৭৯-এ এসএলভি-৩-কে উৎক্ষেপণ করা গেল।
এসএলভি-৩ আকাশে উঠল ভোর বেলা। প্রথম পর্যায়টি আমরা পেরিয়ে গেলাম মসৃণভাবে। সবক’টি রকেট এবং সিস্টেমগুলি ঠিকঠাক কাজ করলেও প্রকল্পটি তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারল না কারণ দ্বিতীয় পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ সিস্টেমটির কাজ ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কক্ষে ঢোকার পরিবর্তে রোহিণী গিয়ে ডুবল বঙ্গোপসাগরে। মিশনটি হল অসফল।
অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীহরিকোটায় সাংবাদিক সম্মেলনে অধ্যাপক ধাওয়ান আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করলেন যে, এই অসাফল্যর দায়ভার তাঁরই। কিন্তু আমি ছিলাম প্রোজেক্ট ডিরেক্টর এবং মিশন ডিরেক্টর। পরের বছর, ১৮ জুলাই ১৯৮০, এসএলভি-৩ উৎক্ষেপণ করে আমরা যখন সাফল্যের সঙ্গে রোহিণীকে কক্ষপথে নিক্ষিপ্ত করতে পারলাম, একটি সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। এইবার অধ্যাপক ধাওয়ান আমাকে সামনে ঠেলে দিয়ে সাফল্য কাহিনির অংশীদার করে সংবাদমাধ্যমের সামনে উপস্থিত করলেন।
এই ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা পেলাম তা হল, একজন সত্যিকারের নেতা সকল সময়ে সাফল্যের গৌরব যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের দেন, আর অসাফল্যের দায় নেন নিজে। একেই বলে নেতৃত্ব। ভারতের বিজ্ঞান জগতের সৌভাগ্য যে, তেমন নেতৃত্বই সে পেয়েছে। এবং তার ফল হয়েছে তার বহু কৃতিত্ব।
যে-সব তরুণরা আগামী দিনের নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁদের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। যে মহান পাঠটি আমরা পেলাম তা হল, সত্যিকারের নেতা তা তিনি রাজনীতি, প্রশাসন, বিজ্ঞান, শিক্ষা, শিল্প, বিচারব্যবস্থা বা মানব-সংক্রান্ত অন্য যে ক্ষেত্রেই হোক, তাঁর ভিতর মননশীলতা যেমন থাকবে তেমনই অসাফল্যকে স্বীকার করে নেওয়ার ক্ষমতাও থাকতে হবে, এবং সাফল্যের কৃতিত্ব তাঁর দলের সদস্যদের দিতে হবে।
ড. ব্রহ্ম প্রকাশ: ম্যানেজমেন্টে আভিজাত্য
যে নেতা সম্পর্কে এবার বলতে চাই তিনি ধাতুতত্ত্ববিদ ড. ব্রহ্ম প্রকাশ, যিনি আণবিক বস্তু নিয়ে কাজের জন্য খ্যাত। আমি যখন এসএলভি-৩-এর প্রোজেক্ট ডিরেক্টর, ড. প্রকাশ তখন ছিলেন বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের অধিকর্তা। ভারতে অন্তরিক্ষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য তিনি অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি আমার মনে করতে ভাল লাগে, তা হল, যে মুহূর্তে এসএলভি-৩ প্রকল্পটি অনুমোদন পেল, বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের বিভিন্ন ল্যাবরেটরি এবং ইসরো-র বিভিন্ন কেন্দ্র, সঙ্গে স্পেস ডিপার্টমেন্ট, সকলে একত্রে একটি দল হিসেবে কাজ করতে থাকল লক্ষ্যে পৌঁছনোর তাগিদে। ১৯৭৩ থেকে ’৮০, এই সময়টায় বিশেষ করে, মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা, সঙ্গে অন্যান্য ছোট ছোট প্রকল্পের দাবির সঙ্গে যুঝতে হচ্ছিল। কিন্তু তিনি ব্যবস্থা করলেন যাতে যাবতীয় বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত কাজ এসএলভি-৩ এবং তার উপগ্রহে নিয়োজিত হয়।
আমি বলেছি ম্যানেজমেন্টে আভিজাত্যর জন্য ড. প্রকাশ বিখ্যাত। এর কয়েকটি উদাহরণ দিই। রোহিণী উপগ্রহকে অক্ষে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য এসএলভি-৩ প্রকল্পটিতে প্রথমবারের জন্য তিনি নিয়ে এলেন এক সুসংহত ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা। এসএলভি-৩ ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার পরিকল্পনা আমার টাস্ক টিম রচনা করার পর তিনি স্পেস সায়েন্টিফিক কমিটির প্রায় পনেরোটি চিন্তন বৈঠক করলেন তিন মাসে। বহু আলোচনার পর এই ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার পরিকল্পনাটি ড. প্রকাশ সই করে দেন, এবং তা হয়ে দাঁড়ায় সমগ্র সংস্থাটির নির্দেশাবলি। এটি ছিল জাতীয় দূরদৃষ্টিকে কর্মকাণ্ডের নানান যোজনার রূপে নিয়ে আসার শুরুও।
এই ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার পরিকল্পনার উদ্ভাবনের সময়ে আমি খেয়াল করলাম নানা ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী মতামত। বহু ব্যক্তি এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডে নিজেদের ব্যক্তিসত্তাকে হারাবার ভয়ে, মিটিংগুলিতে উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। কিন্তু ড. প্রকাশ তাঁর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা সারাক্ষণ বজায় রাখতেন। মানুষের ক্রোধ, ভয় এবং সংস্কার, সব অদৃশ্য হয়ে যেত এই মানুষটির চিন্তার আভিজাত্যে।
আজ ইসরো-তে অন্তরিক্ষ যোজনাগুলি, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলি এবং উৎক্ষেপণ অভিযানগুলি এক সুসংহত ও সহযোগিতামূলক আবহে হচ্ছে। এই মহান মহাত্মাটির কাছে আমি শিখেছি যে, কোনও প্রকল্প শুরুর আগেই একটি প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান সঠিকভাবে প্রণয়ন করে তাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা আবশ্যক। সেই প্ল্যানে থাকবে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ, কেমনভাবে বিভিন্ন পর্যায় এগোতে হবে, কেমনভাবে আগে থেকেই আসন্ন কঠিন অবস্থার বিষয়ে সতর্ক হয়ে তা সমাধানের ব্যবস্থা করে নিতে হবে— যার মধ্যে সময়, কার্যকারিতা এবং সূচি হচ্ছে সব থেকে জরুরি। ম্যানেজমেন্টে আভিজাত্য নিয়ে আসার জন্য তাঁকে সাধুবাদ।
ই শ্রীধরন: আবেগ নিয়ে লক্ষ্য পূরণ
‘মেট্রো মানব’ ই শ্রীধরন হলেন ইদানীংকালের এক নেতা যাঁকে ভারত পেয়েছে। নিজের ভিশনকে প্যাশন দিয়ে এক মিশনে রূপান্তর করে কোটি কোটি মানুষের জীবন পালটে দেওয়ার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত এই মানুষটি। প্রথমে কোঙ্কান রেলওয়ে এবং পরে দিল্লি মেট্রোর মাধ্যমে ভারতের সরকারি পরিবহণের চিত্রটিই তিনি পালটে দিয়েছেন।
বহু বাধা সত্ত্বেও কোঙ্কান রেলওয়ে প্রকল্পটি সাত বছরে শেষ হয়। তার পথের ৮২ কিমি. অংশে রয়েছে তিরানব্বইটি টানেল। নরম মাটি কেটে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। তার সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ৭৬০ কিমি. এবং রয়েছে ১৫০টিরও বেশি ব্রিজ। এটি এমন এক সরকারি প্রকল্প যার জন্য অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ তেমন তাত্পর্যের নয়, এবং সময়সীমাও বৃদ্ধি না করেই সম্পন্ন করা হয়। এটি তাই এক বিরাট এবং অভূতপূর্ব কৃতিত্ব বলে মানা হয়।
দিল্লি মেট্রো রেল কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর করে দেওয়া হয় তাঁকে। ঘোষিত বাজেট ও সময় মেনেই সব ক’টি নির্দিষ্ট কাজ শেষ হয় তাঁর নেতৃত্বে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সময়ের আগেই শেষ হয় কাজ। তিনি তাঁর প্রকল্পের কাজ রাজনৈতিক চাপ এবং প্রভাব মুক্ত রাখার জন্য খ্যাত ছিলেন। তিনি তাঁর প্রকল্পের কাজকে দ্রুত শেষ করার জন্য রাজনৈতিক মহল থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতেন। তাঁর প্যাশন এবং ভিশন ভারতকে তার প্রথম সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থা দিয়েছিল। ১৫০টি স্টেশন এবং ২০০ কিমি. দৈর্ঘ্যের দিল্লি মেট্রো বিশ্বে দ্বাদশতম বৃহৎ মেট্রো ব্যবস্থা। ২৬ লক্ষ মানুষকে সে প্রতিদিন পরিসেবা দেয়। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রপুঞ্জ কার্বন ক্রেডিট দিয়ে শংসাপত্র দিয়েছে একে— বিশ্বের প্রথম মেট্রোরেল এবং রেললাইনভিত্তিক ব্যবস্থা যা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকে হ্রাস করে শহরের দূষণের মাত্রাকে হ্রাস করেছে।
শ্রীধরণের দিল্লি মেট্রোর কাজ এতটাই সফল ছিল এবং ভারতের কাছে তার গুরুত্ব ছিল এতটাই যে ফ্রাঁস তাঁকে Chevalier de la Legion d’honneur (নাইট অফ দ্য লিজিওন অফ অনার) সম্মানে ২০০৫ সালে ভূষিত করে, এবং ভারত সরকার তাঁকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম নাগরিক সম্মান পদ্মবিভূষণে সম্মানিত করে ২০০৮ সালে। তিনি ২০০৫ সালের শেষে অবসর নেবেন বলে ঘোষণা করেন, কিন্তু তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধি করে দেওয়া হয় দিল্লি মেট্রোর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। দিল্লি মেট্রোর সঙ্গে ষোলো বছরের কর্মজীবনের পর তিনি অবসর নেন ৩১ ডিসেম্বর ২০১১। অবসরের পর তিনি সামান্যই বিশ্রাম পেয়েছেন, কারণ তাঁকে কোচি, লখনউ, জয়পুর, বিশাখাপট্টনম এবং বিজয়ওয়াড়ার মেট্রোর কাজে উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত করে নেওয়া হয়।
বিশ্ব নেতৃত্ব
এঁদের মতো নেতারাই ভারতকে শ্রেষ্ঠ করে তুলে ধরছেন এবং আগামীতেও তুলে ধরবেন। কিন্তু আমি প্রায়ই বলে থাকি, ক্ষুদ্র লক্ষ্য রেখে এগোনো একটি অপরাধ। সুতরাং আমরা এক শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র গড়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি না। এটি একটিই পৃথিবী যা সমগ্র মানবসমাজ ভাগ করে নেয়, তাই আমাদের লক্ষ্য হবে একে এক মহান গ্রহে পরিবর্তন করা।
আমি এখানে এক দূরদ্রষ্টা আধ্যাত্মিক নেতা শ্রীঅরবিন্দর স্বপ্নের কথা বলতে চাই। তাঁর প্রথম স্বপ্নটি ছিল এক বৈপ্লবিক অভিযানে ভারতকে মুক্ত করা এবং সংযুক্ত করা। ১৫ অগাস্ট ১৯৪৭-এ তা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় স্বপ্নটি ছিল এশিয়ার মানুষের পুনরুত্থান এবং মুক্তি। তার সঙ্গে, মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে ভারতকে তার পুরনো মহান ভূমিকায় ফিরে যেতে হবে। তাঁর তৃতীয় স্বপ্ন ছিল, সমগ্র মানব জাতির জন্য সত্যনিষ্ঠ, উজ্জ্বল এবং অভিজাত জীবনের জন্য এক বিশ্বব্যাপী সংযুক্তিকরণে ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন।
অন্য বৃহৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে হাতে হাত রেখে ভারতকে এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হবে। সকলকে নিয়ে একটি বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করবে ন্যায়নিষ্ঠ, সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী পৃথিবী। আমি মনে করি তিনটি লক্ষ্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ:
১। এক আলোকোজ্জ্বল সমাজ: এক সমৃদ্ধিশালী শান্তিপূর্ণ বিশ্বের প্রয়োজনে মূল্যবোধ সম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি।
২। শক্তি ব্যবহারে স্বাধীনতা: এক পরিচ্ছন্ন বসুন্ধরা পাওয়ার যে স্বপ্ন আমরা প্রত্যেকেই পোষণ করি তাকে বাস্তবায়িত করা।
৩। বিশ্বব্যাপী জ্ঞানের মঞ্চ: সকল রাষ্ট্রের দক্ষতাকে মিলিত করে সংকটপূর্ণ সমস্যাগুলির সমাধান করা, যেমন জলের অপর্যাপ্ততা, সকলের জন্য ভাল মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ক্ষমতার নির্মাণ।
আমাদের সত্যিকারের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য অভিযান এখনও শেষ হয়নি। সে কাহিনি আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। পৃথিবীর পরিবেশ আজ বিপজ্জনক, এবং ভারতের স্বাধীনতা, যা বহু যন্ত্রণা ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে এসেছিল, তাকে সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করতে হবে, তাকে শক্তিশালী করে প্রসারিত করতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতার খোঁজ চলবে ক্রমাগত। কঠিন ও দ্রুত কাজের ভিতর দিয়ে সে খোঁজ চলবে এমনভাবে যাতে স্বাধীন ও নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের বিবর্তন ত্বরান্বিত হয়।
ভারত একটি তরুণ রাষ্ট্র এবং সে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে আমরা তাত্পর্যপূর্ণ এক রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন করতে পেরেছি। প্রাকৃতিক রোষ, কয়েকটি যুদ্ধ এবং সীমান্তপারের আতঙ্কবাদের মতো নানান পরীক্ষা এবং ক্লেশের মধ্যে দিয়েই ঘটেছে এই উন্নয়ন। এবং এসবই হয়েছে আমাদের জনসংখ্যা ও রাজনীতির সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েই। এতসত্ত্বেও, সবুজ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বনির্ভরতা এসেছে এবং আমাদের একশো কোটি মানুষের খাদ্য সংস্থান আমরা করতে পেরেছি। গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রের উন্নতির মাধ্যমে গড় আয়ুর বৃদ্ধি করতে পেরেছি আমরা। আমাদের শিল্প ভিত প্রসারিত হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পেয়েছে নতুন উদ্যম। উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তিতে, অন্তরিক্ষ, আণবিক শক্তি এবং প্রতিরক্ষা গবেষণায়।
কিন্তু কোনও রাষ্ট্রই বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাপী সংযোগ আজ একান্তই বাস্তব এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব শান্তি আর সমগ্র মানবজাতির উন্নয়ন নিশ্চিত হলে এক নিরাপদ বিশ্বের সৃষ্টি হবে যেখানে সকল রাষ্ট্রই হবে লাভবান। দারিদ্র্য দূরীকরণ, শক্তির নিশ্চয়তা, পানীয় জলের লভ্যতা এবং পরিবেশ রক্ষা হল আজ মানবজাতির সামনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। বহু রাষ্ট্রকে ভুগতে হয় সীমান্ত পারের আতঙ্কবাদ এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য। এটি শুধু কোনও একটি দেশ বা অঞ্চলের সমস্যা নয়— এ আজ সারা বিশ্বের সুখ শান্তিকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে।
সারা পৃথিবীতে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বেকারত্ব, ক্রোধ ও হিংস্রতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে ঐতিহাসিক শত্রুতা, স্বৈরশাসন, অবিচার, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মের মৌলবাদ। এই সব মিলিয়ে আতঙ্কবাদের বিস্ফোরণ ঘটছে আজ সারা বিশ্বে। এক সুখ শান্তির পৃথিবী নির্মাণের প্রয়োজনে আমাদের যেতে হবে এই সবের মূলে যে সমস্যা, তার মোকাবিলায়। সেগুলি হল দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং বেকারত্ব।
শান্তির জন্য একটি সমাজের স্থায়িত্ব এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। এই স্থায়িত্ব নির্ভর করে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং নিরাপত্তা ও সুরক্ষার মতো মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির পূরণের উপর। অর্থনৈতিক অথবা সামাজিকভাবে যাঁরা নিম্নস্তরে বাস করেন তাঁদের, উচ্চস্তরে বাস করেন যাঁরা, তাঁদের দ্বারা শোষিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অসাম্য কমিয়ে আনতে পারলেই এই শোষণ একভাবে দূর করা যায়। দারিদ্র্য দূর করা এবং সকল মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ নিশ্চিত করার মতো বিশ্বস্তরে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এর ফলেই যাঁদের আছে আর যাঁদের নেই, তাঁদের মধ্যের যে ফারাক, তা কমিয়ে আনা সম্ভব।
কেমনভাবে আমরা তা পারব? পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের উচিত এক সাহচর্য গড়ে তুলে সম্পদের এক বিশ্বব্যাপী ভাগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে সহ-অবস্থান ও সহ-উন্নয়ন দুই-ই চলতে পারে। আগামী কয়েক দশক শক্তি, পরিস্রুত জল ও পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে একটি বিশ্বব্যাপী সংকট থাকবে। বহ রাষ্ট্রকেই এগিয়ে এসে একযোগে একটি ভিশন তৈরি করতে হবে, যাতে পরবর্তী প্রজন্মের তরুণরা সুখে শান্তিতে বাস করতে পারেন। যখন কোনও রাষ্ট্রের সামনে নির্দিষ্ট মিশনের একটি ভিশন থাকে, তখন আতঙ্কবাদ ও হিংসার মতো সমস্যা নির্মূল হয়ে যায়।
.
পনেরো : ‘পুরা’-র গুরুত্ব
এক সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে যদি আমাকে একটি সুনির্দিষ্ট মিশনের কথা বলতে হয় যেটি বহুদূর যেতে সক্ষম, আমি সেই তৃণমূল স্তরের মিশনের কথা বলব যা আমার হৃদয়ের বড় কাছের— ‘পুরা’। এর সম্পর্কে আমি এই বইয়ে আগে ছুঁয়ে গিয়েছি, কিন্তু আমি এখানে তার সম্পর্কে খুঁটিনাটি আলোচনা করতে চাই। কারণ, আমি মনে করি এই সময়ের চাহিদা পূরণে এটি আদর্শ। ভারত থেকে শুরু করে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রে, এই প্রকল্প সকলকে নিয়ে বৃদ্ধি এবং সুসংহত উন্নয়ন আনতে সক্ষম।
‘পুরা’-র সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত
ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এক দেশে রূপান্তরিত হতে হলে তার ৬০০,০০০ গ্রামে উন্নয়ন সব থেকে জরুরি। তার অর্থ:
১। গ্রামগুলিকে নিজেদের মধ্যে এবং বড় বড় শহর ও মেট্রো শহরের সঙ্গে ভাল রাস্তা ও রেললাইনের মাধ্যমে যুক্ত থাকতে হবে। স্থানীয় জনসাধারণ ও বহিরাগতদের জন্য অন্যান্য পরিকাঠামো যেমন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এবং অন্যান্য বন্দোবস্ত থাকতে হবে। একে আমরা বলতে পারি সরাসরি সংযোগ।
২। জ্ঞানের স্ফুরণের যুগে, স্থানীয় জ্ঞানের সংরক্ষণ করে তার ব্যাপ্তি আনতে হবে আধুনিক প্রাযুক্তিক সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে। উৎকৃষ্ট শিক্ষার নাগাল পেতে হবে গ্রামগুলিকে, শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের কাছ থেকে তা তিনি যেখানেই থাকুন, পেতে হবে উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্য পরিষেবা, তেমনই জেনে নিতে হবে কৃষি, মাছচাষ, ফুলচাষ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো বিষয়ে সাহায্যর কথা। এর অর্থ গ্রামগুলির বৈদ্যুতিন সংযোগ থাকতে হবে।
৩। ভৌত সংযোগ এবং বৈদ্যুতিন সংযোগ থাকলেই জ্ঞানের সংযোগ ঘটে যাবে। এর ফলে উৎপাদন বাড়বে, অবসর সময়ের ব্যবহার বাড়বে, স্বাস্থ্য কল্যাণ বিষয়ে সচেতনতা বাড়বে, উৎপাদনের বাজার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, এবং গুণগত মান সম্পর্কে বোধ এবং স্বচ্ছতা বাড়বে।
৪। এই তিন সংযোগ ঘটলেই রোজগার বৃদ্ধির ক্ষমতা বাড়বে।
সুতরাং, মিশন হিসেবে ‘পুরা’, গ্রামগুলিকে সমৃদ্ধশালী জ্ঞানের কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে দিতে পারে। গ্রামের মানুষকে করে দিতে পারে উদ্যোগপতি। হিসেব বলছে ভারতের জন্য ৭০০০ ‘পুরা’ কমপ্লেক্স প্রয়োজন তার ৬০০,০০০ গ্রামের জন্য যেখানে ৭০ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের বসবাস। সেইভাবে ৩০,০০০ পুরা কমপ্লেক্সের প্রয়োজন সারা বিশ্বের ৩ বিলিয়ন গ্রামীণ অঞ্চলকে এক অর্থনৈতিকভাবে উদ্যমী অঞ্চলে পরিণত করতে এবং সেই সঙ্গে স্থায়ী উন্নয়ন নিয়ে আসতে।
‘পুরা’ চালু করতে ভারত সরকার ১,৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে, জাতীয় স্তরে বিভিন্ন জেলায় কাজ শুরু করে দিয়েছে পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ মডেলে। বেশ কয়েকটি কর্মক্ষম ‘পুরা’ চালু করেছে বেশ কিছু শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রতিষ্ঠান এবং তার সঙ্গে শিল্প মহল। তেমন কয়েকটি প্রকল্প হল তামিলনাডুতে পেরিয়ার ‘পুরা’, মহারাষ্ট্রে লোনি ওয়ারানা ভ্যালি ‘পুরা’ এবং চিত্রকূট ‘পুরা’ মধ্য প্রদেশে।
‘পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড
আমি এবার, “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’ নামের একটি অনন্য স্থায়ী উন্নয়নের ব্যাবসায়িক উদ্যোগ-চালিত মডেল উপস্থাপন করতে চাই। “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর মূল ভাবনাটা হল যে, পরবর্তী প্রজন্মের ‘পুরা’ উদ্যোগের ভাবনার মধ্যে রাখতে হবে যে, তাঁদের মানুষের জীবনধারণের ব্যবস্থাপক হয়েই শুধুমাত্র কাজ করলে হবে না, আরও কিছু করতে হবে। একটি ‘পুরা’ কমপ্লেক্সের গ্রামীণ জনসাধারণের সার্বিক, সুসংহত উন্নতি হল “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর লক্ষ্য। তার সঙ্গে আর একটি লক্ষ্য হল, স্থায়ী সামাজিক-ব্যাবসায়িক মডেলের মাধ্যমে বিভিন্ন উদ্যোগপতিদের এক উল্লম্ব সংহত নেটওয়ার্ক রচনা করা, যাতে তাঁরা নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করে পরস্পরের মূল্যমান বৃদ্ধি করেন। যার ফলে, সকল স্টেকহোল্ডারই হবেন লাভবান।
“পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এ দু’ধরনের উদ্যোগপতি আছে:
১। সম্পদ উদ্যোগপতি: তাঁদের মূল দৃষ্টি হল চিরাচরিত প্রযুক্তি ও আধুনিক ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা মারফত প্রাকৃতিক সম্পদ, ঐতিহ্যগত সম্পদ ও মানবসম্পদের, সঠিক আর্থিক মূল্যায়ন করে প্রত্যেক পরিবারের রোজগারের স্তরকে বৃদ্ধি করা। তাঁরা উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালীর মাধ্যমে এবং উৎপাদনকে বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে, সম্পদকে মূল্য শৃঙ্খলের উপরের দিকে টেনে তোলার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করবেন। তাঁদের কাজের পরিণাম দেখা যাবে ওই গ্রামীণ কমপ্লেক্সের সামগ্রিক জিডিপি-র বৃদ্ধিতে।
২। সামাজিক উদ্যোগপতি: অন্য শ্রেণিটি, সামাজিক উদ্যোগপতি, সম্পদ উদ্যোগপতিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবেন। মানব উন্নয়নের সূচক, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির বৃদ্ধির উপর তাঁদের নজর থাকবে। তাঁরা মানুষের বর্ধিত ক্রয় ক্ষমতাকে উত্তম জীবনে পরিণত করার উপর জোর দেবেন। তাঁদের কাজ পরোক্ষ ভাবে প্রতিফলিত হবে শিক্ষার মানের উন্নতিতে, শিশু ও মায়ের মৃত্যু হারের হ্রাসে, পুষ্টির বৃদ্ধিতে, উত্তম গার্হস্থ্যজীবনে, স্যানিটেশন, পরিস্রুত পানীয় জল এবং সঠিক মানের শক্তির ব্যবহারে। এর থেকেই জন্ম নেবে পরিবেশ সচেতনতা, এবং হ্রাস পাবে সামাজিক সংঘর্ষের হার।
“পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর উদ্যোগপতিরা স্থানীয় স্তরে সফল ‘পুরা’ উদ্যোগী, যাঁরা বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাও হতে পারেন, তাঁদের সঙ্গে একযোগে কাজ করবেন। “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর উদ্যোগপতিরা সরকার, স্থানীয় প্রশাসন এবং পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলির সহযোগী হবেন। “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর এক ব্যাবসায়িক নেটওয়ার্ক তৈরি হতে হবে বিবিধ ধারার প্রাযুক্তিক ও ম্যানেজেরিয়াল প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায়। সেইভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন এন্টারপ্রাইজ়গুলি “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর সহযোগী হয়ে উঠতে পারে, ইক্যুইটি ইনভেস্টার হিসেবে, অথবা বাজারের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরির সাহায্যকারী হিসেবে, বা উত্তম কার্যপ্রণালী ও উৎপাদনের নানান চ্যালেঞ্জের উদ্ভাবনী সমাধান সমূহর জন্য প্রাযুক্তিক সহায়তা প্রদানকারী হিসেবে। এইভাবে সারা বিশ্বের এন্টারপ্রাইজ়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যাবসায়িক সংস্থা নিজ নিজ দক্ষতাকে ভাগ করে, গ্রামীণ ও শহরতলি অঞ্চলের অব্যবহৃত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মানুষের উন্নতি নিয়ে আসবে।
ইউজ়ার কমিউনিটি পিরামিড
প্রাকৃতিক সম্পদের হ্রাস প্রাপ্তি এবং জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে আজ মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি অর্থনৈতিক স্তরে স্থায়ী উন্নয়নের কথা চিন্তা করতে হবে। কী সেই অনন্য উপায় যা স্থায়ী উন্নয়নকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করবে? স্থায়ী উন্নয়নের আমি একটি সুসংহত সমাধানের অনন্য মডেল প্রস্তাব করছি যার নাম দিয়েছি ‘ইউজ়ার কমিউনিটি পিরামিড’ (ইউসিপি)।
কাঠামোগতভাবে ইউসিপি তৈরি হয়েছে এইগুলির সংযোগে:
১। প্রাকৃতিক সম্পদ
স্থায়ী উন্নয়নের মূলে আছে প্রাকৃতিক সম্পদ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে এবং তাদের প্রয়োগে আমরা মানব উন্নতিতে প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে আসছি। কিন্তু সেই সঙ্গে, গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণে, বনানী ধ্বংসে এবং মাটি, জল ও বায়ুকে দূষিত করে আমরা পরিবেশকে দূষিত করেছি। আজ, প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে, আর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে যার ফল, বিশ্ব উষ্ণায়ন।
২। তথ্য ও যোগাযোগ
এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তথ্যের সংগ্রহ, তথ্যের উৎপাদন, তার বিস্তার। প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজ এবং পরিবেশের উন্নতির পরিকল্পনা করতে এটি সাহায্য করবে। বর্জ্য, দূষণ, শক্তি, চলন-গমন এবং জীববৈচিত্র্যের মতো বিবিধ ক্ষেত্রে স্থায়ী উন্নয়ন কেমনভাবে করা যায়, তা আধুনিক জিও-স্প্যাশিয়াল অ্যানালিটিকাল সরঞ্জামের সাহায্যে আমরা জানতে পারব।
৩। প্রযুক্তির একত্রীকরণ
প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির কারণে জল, শক্তি, পরিবেশ, দূষণ, বর্জ্য, জীববৈচিত্র্য এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো বিষয়গুলির ম্যানেজমেন্টে নতুন নতুন উৎপাদিত বস্তু ও ব্যবস্থার প্রয়োগ হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখি গুজরাতে সৌর প্রযুক্তির সাহায্যে ৭০০ মেগা ওয়াটের প্রথম সৌর উদ্যান; ন্যানো-প্রযুক্তির সাহায্যে নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা; বা ন্যানো-প্যাকেজিং প্রযুক্তির সাহায্যে বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেজিং-এর ব্যবস্থা। এই সবের একত্রীকরণ আর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মানবজাতির অগ্রগতিতে একান্ত জরুরি।
৪। সমাজ ভিত্তিক ব্যাবসার মডেল
এক দিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থার অগ্রগতি হচ্ছে, আর অন্য দিকে বিবর্তিত হচ্ছে উদ্ভাবনী ব্যাবসার মডেল যা প্রযুক্তিকে পৌঁছিয়ে দেবে অন্তিম ইউজ়ার বা ব্যবহারকারীর কাছে। এর ফলে কৃষক, মত্স্যজীবী, প্রশিক্ষিত কর্মী এবং গ্রামে বাস করা মানুষজন হবেন ক্ষমতাবান ও সমৃদ্ধ।
৫। পিরামিডের তল
ইউসিপি-তে পিরামিডের একেবারে নীচের স্তরে আছেন ইউজ়াররা বা ব্যবহারকারীরা। তাঁরাই হলেন যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ এবং স্থায়ী উন্নয়নের লাভের অংশীদার। সবশেষে, যাবতীয় কাজের সুবিধা বা উপকার পাবেন তাঁরাই। প্রযুক্তি তাঁদের জীবনধারণের মানের উন্নতিতে সাহায্য করবে। এই কাজ বর্তমানের প্রাকৃতিক সম্পদকে এমনভাবে ব্যবহার করবে যাতে পরবর্তী প্রজন্মগুলি নিরন্তর ব্যবহার করতে পারে এই সম্পদ।
সমাজ ভিত্তিক উন্নতির রাডার
উন্নতির রাডার প্রস্তুত করার কারণ, ইউসিপি কেমনভাবে ইউজ়ারদের লাভবান করেছে, তা পর্যালোচনা ও নজরে রাখা। ন’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এইটি করতে হবে। সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে এই বিষয়গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়গুলি হল:
১। খাদ্য ও পুষ্টি
২। পানীয় ও কৃষিতে ব্যবহারযোগ্য জল অধিগত করার সুযোগ
৩। স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার সুযোগ
৪। রোজগার করার ক্ষমতা পাওয়া
৫। শিক্ষা ও দক্ষতা নির্মাণের সুযোগ পাওয়া
৬। উত্তম শক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পাওয়া
৭। সমাজ ভিত্তিক সংঘর্ষের অবস্থান
৮। অর্থনৈতিক সাহায্য প্রাপ্তি
৯। পরিচ্ছন্ন ও সবুজ পরিবেশ প্রাপ্তি
সমাজ ভিত্তিক উন্নতির রাডারের তিনটি লক্ষ্য থাকবে। প্রথমটি হল ওই ন’টি বিষয়ের বর্তমান অবস্থা নিরীক্ষণ করা। দ্বিতীয় লক্ষ্যটি হল মাঝামাঝি সময়ের টারগেট রেখে তৃতীয় একটি দীর্ঘ সময়ের লক্ষ্য স্থির করা। তবে তা একটি নির্দিষ্ট সময়সীমায় বাঁধা রাখতে হবে।
‘পুরা’ ভাবনাটি যখন এইভাবে প্রয়োগ করা হবে, তখন বিশ্বব্যাপী ৩ বিলিয়ন গ্রামীণ জনসাধারণের জীবনের মান উন্নত হবে স্থায়ী উন্নয়নের প্রক্রিয়ায়। সব দিক থেকে উত্তম একটি সাম্যের সুন্দর পৃথিবী তৈরি হবে।
.
ষোলো : উপসংহার
এই বইয়ের ভূমিকায় ভুবনেশ্বর থেকে দিল্লির প্লেনে এক বিদেশি যাত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে আমি আমাদের জাতীয় চরিত্রের বিষয়ে সেই ঘটনাটি কী নির্দেশ করে, তা বলেছিলাম। তেমনই একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে আমি বইটি শেষ করি।
এমিনেন্ট পারসনস গ্রুপের একটি মিটিং সেরে আমি সিওল থেকে ২৯ নভেম্বর ২০১১-র রাত্রে একটি ননস্টপ উড়ানে দিল্লি ফিরছিলাম। পরের বছর সিওল নিউক্লিয়ার সিকিউরিটি সামিট সম্মেলনের আগে এই মিটিংটি আয়োজন করেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি। এই মিটিং-এ এসেছিলেন বিভিন্ন দেশের আণবিক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা। এমিনেন্ট পারসনস গ্রুপের লক্ষ্য ছিল সারা বিশ্বে যে ৫৩৯টি আণবিক শক্তি প্লান্টগুলি রয়েছে তাদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি নির্দেশাবলি প্রস্তুত করা। সেই সম্মেলনের বিষয়ে বিস্তারিত এখানে বলছি না, তবে এক জাপানি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ এবং প্রাক্তন কূটনীতিক শিনিচি কিতাওকা আমাকে এবং এমিনেন্ট পারসনস গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের যে ঘটনার কথা বলেছিলেন, সেইটি বলব।
অধ্যাপকটি বলছিলেন, তাঁর দেশে সেই বছর মার্চ মাসে ফুকুশিমা দাইচির যে আণবিক বিপর্যয়টি ঘটেছিল, তার কথা। ১১ মার্চ ২০১১ সালে তোহোকুতে ভূমিকম্পর জেরে যে সুনামিটি হয়, সেইটি ফুকুশিমা-১ আণবিক শক্তি কেন্দ্রের দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়। ভূমিকম্পর ঠিক পরেই চালু থাকা রিঅ্যাকটরগুলি আপনাআপনি তাদের নিরন্তরভাবে চলতে থাকা ফিশন বিক্রিয়াগুলি বন্ধ করে দেয়। রিঅ্যাকটরগুলিকে যে আপতকালীন জেনারেটরগুলি ঠান্ডা রাখে সেগুলিকে সুনামি ধ্বংস করে দেয়। ফলে, তিনটি নিউক্লিয়ার মেল্টডাউন ঘটে এবং রেডিওঅ্যাকটিভ বস্তু ছড়িয়ে পড়ে। এরপরের কয়েকদিন হাইড্রোজেন-বায়ুর রাসায়নিক বিক্রিয়াজনিত বেশ কিছু বিস্ফোরণ হয়।
তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের চের্নোবিলে ১৯৮৬ সালে ঘটে যাওয়া আণবিক বিপর্যয়ের পর ফুকুশিমা দুর্ঘটনাটির মতো এমন বিপর্যয় পৃথিবী আর দেখেনি। কিন্তু চের্নোবিলে যা ঘটেছিল তা ফুকুশিমাতে দেখা গেল না। একটিও রেডিয়েশন জনিত মৃত্যু ঘটেনি এখানে।
‘দু’টি জাপানি শহর ১৯৪৫ সালে আণবিক অস্ত্রের আক্রমণের শিকার হয়েছিল।’ বললেন অধ্যাপক কিতাওকা। ‘সেটি ছিল অত্যন্ত দুঃসহ এক ট্র্যাজেডি, কিন্তু জাপানি নাগরিকরা তা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করে, মাত্র তিন দশকের মধ্যে জাপানকে বিশ্বের সব থেকে অগ্রণী শিল্পসমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। এখন, ফুকুশিমা শক্তি কেন্দ্রটির সমস্যা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা, জাপানিরা, কখনওই এই সমস্যাকে আমাদের কর্তা হতে দেব না। আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় আমরা, জাপানিরা, নিজেরাই সমস্যাটির কর্তা হয়ে তাকে পরাস্ত করে সফল হব। এবং বিশ্ব দেখবে এক পরিচ্ছন্ন ও সবুজ আণবিক শক্তি চতুর্দিকে উদ্বোধিত হচ্ছে।’
একটি রাষ্ট্র তখনই শ্রেষ্ঠ হয় যখন সে কোনও গভীর চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে সেই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝে, নিজের ভিতরের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রকাশ করে এবং রাষ্ট্রের মানুষ এক হয়ে সমস্যাকে পরাস্ত করে তার উপর কর্তৃত্ব করে। জাপানের মতো এক মহান দেশের এইটিই জাতীয় চরিত্র।
ভারতকে এমন মহান দেশগুলির উদাহরণ থেকে অনেক কিছু শিখতে হবে। আমি যখন ভারতের কোনও পঞ্চায়েতে, গ্রামে বা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনে যাই, এক থেকে দু’ঘণ্টার ভিতরেই আমি বুঝে যাই সেই জায়গা ভাল নেতাদ্বারা ঠিকঠাক প্রশাসিত হচ্ছে কিনা। আমি এও বুঝতে পারি যে সেই জায়গার নাগরিকরা সমবেতভাবে তাদের নিজেদের বাড়ি, আশপাশ, গ্রাম বা শহরের দায়িত্ব নিচ্ছেন কিনা। দুর্ভাগ্যবশত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ নাগরিকদের ভিতর বা তাঁদের নির্বাচিত সরকারের সকল স্তরের প্রতিনিধিদের ভিতর এই স্পিরিটটা দেখতে পাওয়া যায় না।
বিশ্বে যদি ভারতকে তার গরিমার আসনে বসতে হয়, যা তার অবশ্যই প্রাপ্য, তা হলে এই চিন্তাধারার পরিবর্তন করতেই হবে। এ আমাদের সকলের একত্রিত দায়। আমি একান্তভাবে আশা করব এই বই, বিশেষ করে বিভিন্ন জগতের বিভিন্ন ধরনের মানুষের জন্য রচিত শপথগুলি ভারতের নাগরিকবৃন্দকে এই মহান দায়িত্ব নিতে সাহায্য করবে, এবং এক জাতীয় চরিত্র নির্মাণ করবে যাতে আমাদের রাষ্ট্র সারা বিশ্বকে শ্রেষ্ঠত্বের পথে নিয়ে যেতে পারে।