- বইয়ের নামঃ উত্তরণ : শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে
- লেখকের নামঃ এ পি জে আবদুল কালাম
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, প্রবন্ধ
উত্তরণ : শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে
০. গ্রন্থটি সম্পর্কে / প্রাক্কথন
গ্রন্থটি সম্পর্কে
২০০৭ সালের জুলাইয়ে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর ১০ রাজাজী মার্গ-এর যে-বাড়িতে ড. কালাম বাস করা শুরু করলেন, সেই বাড়িটি তাঁর চাহিদা পূরণ করেছিল সঠিকভাবেই। বাড়ির সামনে ও পিছনে ছিল বড় লন। তার চারধারে ছিল একটি পথ, যেখানে তিনি এক্সারসাইজ়ের প্রয়োজনে হাঁটতে পারতেন। এক-তলায় ছিল একটি আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা কক্ষ, যার সঙ্গে ছিল একটি কার্যালয়। সেখানে বসতেন তাঁর বিশ্বস্ত দুই সচিব, এইচ শেরিডন এবং আর কে প্রসাদ [R.K. Prasad]। প্যাসেজের ডানদিকে ঘুরলেই ছিল একটি বড় সিঁড়ি, যেটি মোড়া ছিল বহু ব্যবহারে ফিকে হয়ে যাওয়া নীল রঙের কার্পেটে। সিঁড়ির শেষে বাঁদিকে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত ঘরগুলি। সিঁড়ির সামনে ছিল আর একটি কার্যালয়, যার দরজা প্রায় সকল সময়েই অংশত থাকত খোলা। এখানে বসতেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারাল আর স্বামীনাথন, যিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি ভবনে এবং এখানেও তাঁর সামরিক প্রধান, এবং বসতেন আর এক সচিব ডি আর শর্মা।
রাষ্ট্রপতির কার্যভার ত্যাগ করার ঠিক আট বছর, ২০০৭ থেকে ২৭ জুলাই ২০১৫, তাঁর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত, এই কার্যালয়টিতেই তাঁর বহু চিন্তাধারার জন্ম হয়। এটি যেন, বলা যায়, হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর ভাবনাচিন্তার পরীক্ষাগার। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তাঁর যে-ভ্রমণসূচি ছিল পরিব্যাপ্ত, তা ২০০৭-এর পর হয়ে দাঁড়ায় আরও শ্রান্তিকর যেন। অসংখ্য সম্মেলনে তিনি ছিলেন মূল বক্তা; স্রোতোধারার মতো ছিল বিভিন্ন উদ্বোধন ও উন্মোচন অনুষ্ঠান, যার মধ্যে কিছু ছিল বইয়ের; এবং ছিল বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁদের রাজ্যকে কীভাবে উন্নয়নের দ্রুতগতির পথে চালিত করা যায়, সেই সংক্রান্ত তাঁর ক্রমান্বয় প্রেজ়েন্টেশন বৈঠক। এই বৈঠকগুলি থেকে একটি ধারণা বেরিয়ে আসত রাজ্যগুলির ক্ষমতা, তাদের সম্পদ এবং তাদের চাহিদার একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র। এবং প্রকাশ পেত এক গবেষকের অনুসন্ধিত্সা ও আশাবাদী মন। এ ছাড়া ছিল তাঁর নিজের লেখা বই, যার অনেকগুলি-ই বেস্ট-সেলার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল। তাঁর ভ্রমণগুলি, স্বল্প কথায় বলা যায়, ছিল নানান ধরনের। এবং সেগুলি সব সময়ে সহজ গন্তব্যের ছিল না, সরকারি গাড়িতে ভঙ্গুর পথে ছিল সেসব দীর্ঘ যাত্রা।
তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে এই উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে-র চিন্তাটি উঠে আসে। অসংখ্য সম্মেলন ও সেমিনারে হাজারও মানুষের সঙ্গে তাঁর সংযোগ স্থাপন হয়েছিল। এঁদের ভিতর ছিল ডাক্তার, নার্স, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, এবং পুলিশের নানান পেশাভিত্তিক সংগঠন ও সংস্থা। তাঁর কার্যপ্রণালীতে তিনি প্রায় একটি অভ্যাসের মতো করে নিয়েছিলেন যে, ওই সম্মেলনগুলিতে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিদের দিয়ে তাঁদের নিজ পেশার মূল্যবোধ, নীতি ও সম্মান রক্ষার্থে একটি করে শপথ পাঠ করিয়ে নেওয়া।
আমার মনে হয়েছিল যে, এই বিষয়গুলিকে যদি এক সময়হীন মর্যাদা দিয়ে একটি বইয়ের আকারে আনা যায়। বিভিন্ন মানুষের কাহিনি অথবা ঘটনার কথা এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা, যার থেকে দেখা যাবে প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে এই সব মানুষ তাঁদের পেশার সততা ও নিষ্ঠা কেমন করে ধরে রেখেছেন। মানুষকে তাঁর পেশার মূল্য এবং সেই পেশায় তাঁর ভূমিকার কথা এই লেখাগুলি যেন মনে করিয়ে দেবে। বিষয়গতভাবে উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যেমন, আমরা সন্দেহাতীত দক্ষতায় কোনও কঠিন প্রকল্প বা কাজ সমাধা করলেও সাধারণ কোনও কাজে আমরা অপারগ হই, অথবা কোনও কিছু গড়ে তুলে তার রক্ষণাবেক্ষণে আমরা বিচ্যুত হই।
তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী শিক্ষক কিন্তু কোনও আত্মম্ভরিতা বা আপাত নীতিমূলক কিছু তিনি ঘৃণা করতেন। কোনও ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ হত অবশ্যম্ভাবীভাবে বিনম্র। কোনও স্পর্শকাতর বিষয়ে তিনি তাঁর অভিমত দিতেন কিন্তু কাউকে আঘাত না করে। আমি প্রায়ই এই বিষয়টি লক্ষ করেছি, যখন এই প্রকল্পটির বিষয়ে আলোচনা চলছে, এবং আমরা বিভিন্ন কাহিনি ও সূত্র একত্র করছি। ওঁর লেখায় সাহায্য করবে এমন কিছু প্রাসঙ্গিক বই আমি ওঁকে দিই। আমি যখনই বিগত দিনের গরিমাকে আগামী দিনের উৎসাহ হিসেবে উল্লেখ করতে পরামর্শ দিয়েছি, তিনি তা নিতে চাননি। তিনি মনে করতেন, বিগত দিন আজ অতিবাহিত। তার গৌরব সেই সময়ের ও পরিস্থিতির ফসল। আজকের সংকট ভিন্ন এবং তা অনেকগুণ বড়। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলতেন, ভারতের আজকের জনসংখ্যা একশো কোটির অনেক ওপরে। বিগত দিনের গরিমার কথা ভেবে তাই বর্তমানের সংকট কাটবে না। ভবিষ্যৎ বা আগামী দিনই তাঁকে উত্তেজিত করত।
উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে-র মূল ভাবনাটি অত্যন্ত সরল— আইন, নিয়ম ও মূল্যবোধ উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তারা হবে আমাদের নিজস্ব নীতিবোধের অংশ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন থাকতে পারে, কিন্তু কোনও আইন-ই যাবতীয় দুর্নীতির কেস ধরে দিতে পারে না। অথবা আর একটি দৃষ্টান্ত, রুগির পরিচর্যা সুষ্ঠুভাবে করতে একজন ডাক্তারকে কোনও আইন বাধ্য করতে পারে? বিশেষত, যখন সেই ডাক্তার টাকা রোজগারের জন্য তার রুগির কাছ থেকে ফি আদায় করে, আর বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে বাধ্য করে যার কোনও প্রয়োজনই নেই? পরিশেষে এই দাঁড়ায় যে, প্রত্যেকের নীতিবোধই স্থির করে দেবে তার নিজস্ব ব্যবহার-রীতি। শপথগুলি হবে তাই তার চটজলদি নির্দেশিকা আর অনুস্মারক।