পরের দিন, সন্ধেবেলা জানানো হল আমাকে নির্বাচন করা হয়েছে। ১৯৬২ সালে নবগঠিত ইসরো-তে আমাকে রকেট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিযুক্ত করা হল। যেখানে আমার জীবনে মহত্তর ঘটনা সংঘটিত হল, যখন অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান ভারতের প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষেপণযান প্রোগ্রামের প্রোজেক্ট অধিকর্তা হিসেবে নেতৃত্বদানে আমাকে আহ্বান করলেন।
১৯৮২ সালে, মুসউরিতে DIWS-র (Defence Institute of Work Study যা এখন Institute of Technology Management-এ পরিণত হয়েছে) ড. রাজা রামান্নার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর ভারতের মিসাইল প্রোগ্রামে প্রবেশ আমার জীবনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। DIWS হল একটা প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রতিরক্ষাবাহিনীর আধিকারিকদের প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া পরিচালনে প্রশিক্ষিত করা হয়ে থাকে— এক বিশাল ক্ষেত্র যেখানে বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন আছে। যেহেতু আমি SLV-3 প্রোগ্রামের প্রজেক্ট অধিকর্তা ছিলাম তাই আমার ডাক পড়ল DIWS-এ, একগুচ্ছ বক্তৃতার জন্য। কীভাবে প্রথম ভারতীয় উপগ্রহ উৎক্ষেপণযান রোহিণীকে কক্ষপথে স্থাপন করেছিল সেটার একটা প্রেজেন্টেশন তৈরি করলাম। ড. রামান্না বক্তৃতা দিয়েছিলেন, ১৯৭৪ সালে কীভাবে তিনি ভারতের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন।
বক্তৃতা শেষে আমরা দু’জনেই দেরাদুন বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। ওখানে একদল বিজ্ঞানীর সঙ্গে বসে চা পান করেছিলাম। যখন আমরা দেরাদুনে, ড. রামান্না আমাকে হায়দরাবাদের প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং উন্নয়ন গবেষণাগার বা DRDL (Defence Research and Development Laboratory)-র অধিকর্তার পদে গ্রহণ করতে চাইলেন। DRDL মিসাইল সিস্টেম উন্নয়নের মূল গবেষণাগার এবং সেটা প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং উন্নয়ন সংগঠনের (Defence Research and Development Organization বা DRDO)-র অন্তর্ভুক্ত। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটা গ্রহণ করলাম কেননা বরাবরই আমি মহাকাশযান প্রযুক্তিকে মিসাইল প্রযুক্তিতে প্রয়োগ করতে চাইতাম। কিন্তু আমার পরবর্তী লক্ষ্য হল আমার অধ্যক্ষ ইসরো-র সভাপতি অধ্যাপক ধাওয়ানের মনে প্রত্যয় জাগানো।
অনেকগুলো মাস চলে গেছিল। ইসরো এবং ডিআরডিও-র মধ্যে চিঠির আদানপ্রদান হয়েছিল। প্রতিরক্ষা সংগঠনের সচিবালয় (Secretarial of Defence Organizations) এবং মহাকাশ বিভাগে (Department of Space) পারস্পরিক সুবিধাজনক ক্রিয়ার পাঠক্রম শুরু করার জন্য অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। সেসময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আর ভেঙ্কটরামনের বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ভি এস অরুণাচলম মন্ত্রী এবং অধ্যাপক ধাওয়ান-এর মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছিলেন। এই আলাপ-আলোচনার ওপর ভিত্তি করে ১৯৮২-র ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে DRDL-এর অধিকর্তা হিসেবে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল।
১৯৯২ সালের জুলাই মাসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং সচিবের প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং উন্নয়ন বিভাগের (Department of Defence Research and Development) বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে আমি ড. অরুণাচলমের হাত থেকে দায়িত্বভার গ্রহণ করলাম। আমার জীবনের এটা তৃতীয় সন্ধিক্ষণ। ১৯৯৩ সালে আমাকে তামিলনাড়ুর তৎকালীন রাজ্যপাল ড. চেন্না রেড্ডি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। আমি সরকারকে অনুরোধ করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নিয়োগের অনুমোদন দিতে, যা আমি পরে বাষট্টি বছর বয়সে গ্রহণ করতে পারি। যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও ছিলেন, বলেছিলেন আমার পক্ষে বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টারূপে কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত, কারণ আমি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম। এখানে যোগ করতে চাই যে, আমি বহু বছর নরসিংহ রাও-এর সঙ্গে কাজ করেছি এবং দেখেছি, রাও প্রতিরক্ষা বিষয়ে ভীষণ সজাগ। বিশেষত দেশীয় প্রতিরক্ষা সক্ষমতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। প্রতিরক্ষা প্রয়োগের জন্য শক্তপোক্ত প্রক্রিয়া গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর এক সুদূরমেয়াদি লক্ষ্য ছিল। সুতরাং প্রায় সত্তর বছর বয়স অবধি আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টারূপে কাজ করে গেছি।
আমার জীবনের চতুর্থ সন্ধিক্ষণ হল ১৯৯৮ সালের পারমাণবিক পরীক্ষা। এর পেছনে একটা কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনি আছে। আমরা ১৯৯৬-এর মে মাসে ফিরে যাই, ওই বছর নির্বাচন হয়েছিল— ফল ঘোষিত হওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে নরসিংহ রাও-এর পরিচয় হয়েছে। তিনি আমায় বলেছিলেন, ‘কালাম, তুমি তোমার টিম নিয়ে পারমাণবিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হও। আমি এখন তিরুপতি যাচ্ছি। পারমাণবিক পরীক্ষায় অগ্রসর হওয়ার জন্য আমার অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করো। ডিআরডিও-ডিএই টিমগুলো কর্মপ্রক্রিয়ার জন্য যেন নিশ্চয় তৈরি থাকে। তিরুপতিতে তাঁর যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল সুফলের আশায় ঈশ্বরের আশীর্বাদ কামনা। যাই হোক, তিনি যা অনুমান করেছিলেন নির্বাচনের ফলাফল তার চাইতে অন্যরকম হয়েছিল। কংগ্রেসের আসনসংখ্যা সরাসরি ১৩৬-এ নেমে এল। বিজেপি এবং তার জোট দল বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ক্ষমতায় এল কিন্তু মাত্র দু’সপ্তাহের জন্য। তৃতীয় ফ্রন্টের এইচ ডি দেবেগৌড়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। যাই হোক, যে দু’সপ্তাহ বাজপেয়ী সরকার ক্ষমতায় ছিল তারমধ্যে পারমাণবিক পরীক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল।