সারাদিন ধরে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাক্ষাৎ প্রার্থনার নদী বয়ে গিয়েছিল। আমার নিজস্ব চিঠিপত্র লেখালেখি আর ভ্রমণের পাশাপাশি ছিল প্রচারমাধ্যমে সাক্ষাৎকার প্রদান। বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভাল লাগত, সময় থাকলে নানা বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া শুনতাম। এশিয়াড ভিলেজের ৮৩৩ নং ফ্ল্যাটটি কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ২৫ জুলাই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের অতিথি তালিকা তৈরি করা এক বিভ্রান্তিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। সংসদের সেন্ট্রাল হলে মাত্র ১০০০ জনের স্থান সংকুলান সম্ভব। সংসদের সদস্য, রাজ্যসভা-লোকসভার অফিস বেয়ারা, স্বরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মন্ত্রীসভার আমলা, বিদায়ী রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণনের অতিথিদের বাদ দিলে আর মাত্র ১০০ জনের জায়গা হতে পারে। যা টেনেটুনে ১৫০ মতো করা হয়েছিল। সেই ১৫০ জনের মধ্যে কে থাকবে সে এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। পারিবারিক বন্ধুর সংখ্যাই ৩৭। তার মধ্যে আমার পুরনো পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অধ্যাপক চিন্নাদুরাই যেমন ছিলেন, তেমনি মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যাপক কে ভি পানদালাই, রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত পক্ষীভেঙ্কট সুব্রাহ্মনিয়ম শাস্ত্রীগল, রামেশ্বরম মসজিদের ইমাম নুরুল খুদা, রামেশ্বরম চার্চের রেভারেন্ড এ জি লিওনার্ড এবং অরবিন্দ আই ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা চক্ষু বিশারদ ডা. জি ভেঙ্কটস্বামীও ছিলেন। অতিথিদের মধ্যে আরও ছিলেন নৃত্যশিল্পী সোনাল মান সিং, ছিলেন শিল্পপতি, সাংবাদিক এবং ব্যক্তিগত বন্ধুরাও। খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে আমার অতিথি তালিকায় দেশের বিভিন্ন প্রদেশের ১০০ জন শিশুকে আনা হয়েছিল। তাদের জন্য আলাদা করে জায়গার ব্যবস্থা ছিল। বড়দের নিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের দেখাশোনার জন্য। সে দিনটা বেশ গরম ছিল কিন্তু প্রত্যেকে ঐতিহাসিক সেন্ট্রাল হলের অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য বিধিসম্মত আনুষ্ঠানিক পোশাক পরিধান করেছিলেন।
.
আমার দেশের সরল মানুষগুলোর অকপটতার সঙ্গে প্রাজ্ঞতা আমার মনে সবসময় এমন বিশ্বাস আনে যে, একদিন বিশ্বকে শান্তি আর সমৃদ্ধির দোরগোড়ায় পৌঁছতে আমার দেশ নেতৃত্ব দেবে।
০৩. আমার জীবনের সাতটি সন্ধিক্ষণের মুহূর্ত
৩. আমার জীবনের সাতটি সন্ধিক্ষণের মুহূর্ত
“তুমি সমস্যার অধিনায়ক হও, সমস্যাকে পরাজিত করো এবং সফল হও।”
আমি শিক্ষকতা আর গবেষণা ভালবাসি কারণ আমি কখনওই পুনরাবৃত্তিতে ক্লান্ত হই না। আমার ভাবনার, উদ্ভাবনের কেন্দ্রে অধ্যয়নজীবন অবস্থান করে। যুবসমাজ এবং তাঁদের শিক্ষকদের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান আমার অন্তরাত্মার খোরাক। অধ্যয়ন বিষয়ক জীবন এবং গবেষণাক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন করার একটা সিদ্ধান্ত আমি সচেতনভাবে নিয়েছিলাম।
কিছু আগেই বলেছি, ঘটনার আকস্মিক মোড় কীভাবে আমায় দেশের রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করতে প্রণোদিত করেছিল, যদিও আমি নিজেকে অভিজ্ঞ অধ্যয়ন বিষয়ক কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। আমার মনে ছয়টি ঘটনার স্মৃতি বারবার ফিরে আসে যা আমার জীবনপ্রবাহকে বদলে দিয়েছিল। কেউ হয়তো যোগ করতে পারেন, রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে দেশে-বিদেশের অধ্যয়ন বিষয়ক জীবনে নবীন উত্তরণ হিসেবে আমার পুনরাগমন।
আমার জীবনের প্রথম সন্ধিক্ষণ আসে ১৯৬১ সালে। আমার আজও মনে আছে এডিই-র (Aeronautical Development Establishment) বরিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক সহায়ক হিসেবে আমি একটা হোভারক্রাফ্ট-এর মূল পরিকল্পক ছিলাম। ‘নন্দী’ নামক হোভারক্রাফট্টি সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল এবং আমরা বহু দর্শনার্থীর সামনে তার উড়ান প্রদর্শন করেছিলাম। এটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। একদিন এডিই-র অধিকর্তা ড. গোপীনাথ মেদিরাত্তা একজন অতিথিকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন— লম্বা সুদর্শন এবং শ্মশ্রুশোভিত ভদ্রলোক। তিনি যন্ত্রটি সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন। তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আমায় হোভারক্রাফ্টে করে একবার ঘুরিয়ে আনতে পারবেন?’
আমরা ক্রাফ্টে দশ মিনিটের একটা উড়ান দিলাম। হোভারক্রাফ্ট নামের সার্থকতা বজায় রেখে ভূমির ঠিক কয়েক সেন্টিমিটার ওপরে শূন্যে সেটি ভাসমান থাকল। আমি যানটির চালক ছিলাম যা অতিথিকে আশ্চর্য করেছিল। তিনি আমাকে আমার সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন, তারপর ধন্যবাদ জানিয়ে প্রস্থান করলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য নিজের পরিচয় জানিয়ে গিয়েছিলেন— তিনি ছিলেন অধ্যাপক এম জি কে মেনন, টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অধিকর্তা। এর এক সপ্তাহ পরে আমি ICSR (Indian Committee for Space Research যা পরে Indian Space Research Organization বা ISRO হয়েছিল) থেকে একটা ডাক পেলাম রকেট ইঞ্জিনিয়ার পদের ইন্টারভিউ-এর জন্য।
ইন্টারভিউ-এর জন্য বম্বে গিয়ে আমি অধ্যাপক বিক্রম সারাভাই-কে দেখতে পেয়ে অবাক হয়েছিলাম, তিনি ICSR-এর সভাপতি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এইসি অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন (Atomic Energy Commission)-র উপসচিব অধ্যাপক শরাফ এবং অধ্যাপক মেনন। আমি অধ্যাপক সারাভাই-এর উষ্ণ ব্যবহারে মোহিত হয়েছিলাম। তিনি আমার জ্ঞান এবং দক্ষতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা না করে বরং নানা প্রশ্নের মাধ্যমে আমার মধ্যেকার পরিপূর্ণ সম্ভাবনার উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন। তিনি যেন বিশাল কোনও পূর্ণতার পরিপ্রেক্ষিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এই সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি আমার কাছে এক মুহূর্তের সত্য, যাতে আমার স্বপ্ন এক মহান ব্যক্তির মহৎ স্বপ্নের দ্বারা আলিঙ্গনাবদ্ধ ছিল।