আমায় ইতিহাসের এক ক্ষুদ্র অংশ বলতে অনুমতি দেওয়া হোক— দুটো কথোপকথনের উল্লেখ করব, যার একটা ১৯৮৪ এবং অন্যটি ১৯৯১ সালে হয়েছিল। আমি সেসময় DRDL-এর অধিকর্তা হিসেবে হায়দরাবাদে ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী তাঁর মন্ত্রিসভার মাধ্যমে IGMDP-র অনুমোদন দেবার পরে, ১৯৮৩ সালে পরের বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করার জন্য DRDL এসেছিলেন। আমরা যখন কার্যক্রমের অগ্রগতি প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করছিলাম অধিবেশন কক্ষে একটা বিশ্বমানচিত্র শ্রীমতী গাঁধীর নজরে পড়ে। তিনি প্রেজেন্টেশন স্থগিত রেখে আমাদের মনোযোগ মানচিত্রের দিকে আকর্ষণ করলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কালাম, মানচিত্রটি দেখুন, এখানে যে দূরত্বগুলি দেখানো আছে দেখুন। কখন এই গবেষণাগার কোনও উৎক্ষেপণ অস্ত্র উৎক্ষেপণ করবে যা যে-কোনও সম্ভাব্যতার মুখোমুখি হতে অনেক দূর পৌঁছনোর সক্ষমতা রাখবে।’ (তিনি ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে ৫০০০ কিমি. দূরে একটা জায়গা নির্দেশ করলেন।) আমাদের ডিআরডিও বৈজ্ঞানিকগণ অবশ্যই এই মহান দেশনেত্রী দ্বারা দৃষ্ট মনচ্ছবি তাঁদের লক্ষ্য হিসেবে অর্জন করেছেন।
পরবর্তীকালে যখন পৃথ্বী উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখল তখন সেনাবাহিনী আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার কথা জানাল। সেনাবাহিনী CEP (Circular Error Probability)-কে বলবৎ করতে ভূমি পরিসরে প্রমাণ সহায়ক পরীক্ষা চেয়েছিল। সুরক্ষা এবং ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার কারণে আমাদের পরীক্ষা পরিচালনার প্রচেষ্টা মরুভূমি অঞ্চলে সম্ভব হয়নি। এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা পূর্ব উপকূল অঞ্চলে জনমানবহীন দ্বীপ খুঁজছিলাম। নৌবাহিনী যে জলচিত্রণ (হাইড্রোগ্রাফিক) মানচিত্র দিয়েছিল তাতে আমরা ধামরা থেকে (ওড়িশা উপকূলে) দূরবর্তী বঙ্গোপসাগরের মধ্যে কিছু দ্বীপ দেখেছিলাম যা সেখানে কিছু ভূ-খণ্ডের অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। আমাদের টিমের ড. এস কে সালোয়ান এবং ড. ভি কে সারস্বত ধামরা থেকে একটা নৌকো ভাড়া করে দ্বীপের খোঁজে গিয়েছিলেন। মানচিত্রে এই দ্বীপগুলোকে লং হুইলার, কোকোনাট হুইলার এবং স্মল হুইলার নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। টিম একটা দিকনির্দেশক কম্পাস নিয়ে যাত্রাপথে এগিয়েছিল। তাঁরা তাঁদের রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং হুইলার দ্বীপ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সৌভাগ্যক্রমে কয়েকটা জেলে ডিঙির সঙ্গে তাঁদের দেখা হল। রাস্তার খোঁজ করাতে তারা বলেছিল, হুইলার দ্বীপ নামে তারা কিছু জানে না, তবে একটা দ্বীপ আছে যার নাম ‘চন্দ্রচূড়’, তাঁরা যে দ্বীপ খুঁজছেন হয়তো সেটাই সে দ্বীপ। জেলেদের পথনির্দেশ অনুসরণ করে টিমটি চন্দ্রচূড় দ্বীপে পৌঁছল, পরে জানা গেল ওই দ্বীপটি আসলে স্মল হুইলার আইল্যান্ড, রেঞ্জ অপারেশনের জন্য যার দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।
ওই দ্বীপকে কাজে লাগাতে আমাদের ওড়িশার আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণ জরুরি হয়ে ওঠে। সেসময় ক্ষমতাশালী জাতীয় নেতা বিজু পট্টনায়েক মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর দপ্তর থেকে নির্দেশ এল নানা কারণে দ্বীপাঞ্চলটি হাতে পাওয়া সম্ভব নয়। অতএব, আমাদের অনুরোধে একটা বৈঠকের ব্যবস্থা নেওয়া হল। আমরা মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে পৌঁছলে সমস্ত নথিপত্র তাঁর সামনে রাখলাম। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘কালাম আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি পাঁচটি দ্বীপই বিনা ব্যয়ে আমি আপনাকেই (ডিআরডিও)-কে দেব, অনুমোদনপত্রে স্বাক্ষর করার আগে আপনাকে কিন্তু একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে।’ তিনি আমার দুটি হাত ধরে বলেছিলেন, ‘আপনি অবশ্যই এমন এক উৎক্ষেপণ অস্ত্র তৈরি করুন যা আমাদের বিদেশি রাষ্ট্রের চোখরাঙানি থেকে রক্ষা করতে পারবে।’ আমি বলেছিলাম, ‘স্যার,অবশ্যই আমরা এ নিয়ে কাজ করব।’ তৎক্ষণাৎ আমি রক্ষামন্ত্রীকে জানিয়ে দিলাম। মুখ্যমন্ত্রী ফাইলে স্বাক্ষর করলেন এবং আমরা স্মল হুইলার দ্বীপ পেয়েছিলাম।
পাঠকগণ আপনারা হয়তো জানেন, ২০১২ সালের এপ্রিল মাসের ২৬ এপ্রিল ইসরো সাফল্যজনকভাবে ভারতের প্রথম RISAT-1 বা Radar Imaging Satellite উৎক্ষেপিত করে। উপগ্রহটি PSLV=C19 (Polar Satellite Launch Vehicle) চড়ে শ্রীহরিকোটা সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়। উপগ্রহটি কক্ষপথে প্রবিষ্ট করানোর পরে রিস্যাট-১র সি-ব্যান্ড কৃত্রিম র্যাডার যন্ত্রের সৌর প্যানেল এবং অ্যান্টেনা প্যানেল সাফল্যজনকভাবে নিয়োজিত হয়েছিল। আরও, চার কক্ষপথ উত্তোলনকারী কৌশল সরণির মধ্য দিয়ে মেরুপ্রদেশীয় সূর্য সমলয়িত কক্ষপথে উপগ্রহকে সফলভাবে বসানো হয়েছিল। গঙ্গোত্রী, ভূপালের মধ্য দিয়ে অতিক্রমকালে এবং উত্তর কর্নাটকের উচ্চমানের কিছু ছবি গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল, ২০১২ সালের ১ মে সেগুলোর বিশ্লেষণ করা হয়েছিল।
এই মিশন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিল। আমি এর দিকগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে বলব—
ORSS (optical remote sensing satellites)-এর মতো নয়, ভূপৃষ্ঠের ছবি তোলার জন্য রিস্যাট-১ এর SAR (Synthetic Aperture Radar) নিজে থেকেই নিজের বিকিরণ করে। এই প্রক্রিয়া বিনা সূর্যালোকে মেঘের স্তর ভেদ করে ছবি তুলতে সক্ষম। তাই এ যে-কোনও আবহাওয়া ও সূর্যালোকেই ছবি তোলে। রিস্যাট-১ বহুমুখী প্রক্রিয়া ও মেরুকরণ দ্বারা ছবির স্ফীতি এক থেকে পঞ্চাশ মিটার এবং প্রসার ব্যাপ্তি দশ থেকে ২২৩ কিমি পর্যন্ত সক্ষমতা-সহ ছবি তুলতে পারে। চিহ্নিতকরণ, শ্রেণিবিশ্লেষণ এবং জমির একর পরিমাপ নির্ধারণ দ্বারা খরিফ মরশুমে কৃষিক্ষেত্রে ধান চাষের মানচিত্র তৈরি করা রিস্যাট-১ এর এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ ছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বন্যা ও সাইক্লোন প্লাবিত এলাকার মানচিত্র তৈরি করে দুর্যোগ মোকাবিলা করা ও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করা হয়।