রাষ্ট্রপতি ভবনের পরামর্শে এই দুই উচ্চ পর্যায়ের প্রযুক্তিগত পদক্ষেপের প্রারম্ভিক সূচনা হয়েছিল। আমি এই দুই সম্ভাবনাময় উদ্যোগের অংশীদার হতে পেরে ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলাম।
২০১১ সালের বিশ্ব উদ্ভাবন প্রতিবেদন আমি যখন পড়ছিলাম, তখন দেখলাম বিশ্ব উদ্ভাবন সূচক অনুযায়ী সুইজারল্যান্ডের স্থান ১, সুইডেন ২, সিঙ্গাপুর ৩, হংকং ৪ এবং ভারতবর্ষ ৬২-তম স্থানে। উদ্ভাবন সূচক এবং প্রতিযোগিতামূলকতার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। ২০১০-১১ সালে যেখানে ভারত বিশ্ব উদ্ভাবন সূচকে ৬২, সেখানে বিশ্ব প্রতিযোগিতামূলকতা সূচকে ৫৬, যদি ভারতবর্ষকে ৫৬ থেকে উন্নীত হতে হয় এবং উন্নত রাষ্ট্রের (প্রথম ১০টি রাষ্ট্রের) সমকক্ষ হতে চায় সেক্ষেত্রে দেশীয় নকশা প্রযুক্তিতে সক্ষমতা গড়ে তোলা আবশ্যিক। বর্তমান বিকাশ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভিত্তিতে অন্যত্র আবশ্যিকভাবে গড়ে ওঠা প্রযুক্তির ব্যবহার দ্বারা অর্জিত হয়েছে এবং দশ থেকে পনেরো বছর আগে মালিকানা স্বত্ব শুরু হয়েছিল। বিজ্ঞানের অগ্রগতির থেকে যে সাম্প্রতিকতম প্রযুক্তি গড়ে উঠেছিল তা উন্নত দেশগুলি থেকে অন্তত এক দশক ভারতের হাতে অধরা ছিল। এখান থেকে, ভারতবর্ষকে বিশ্ব প্রতিযোগিতামূলকতার অভীপ্সিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গবেষণা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, বিশেষত মৌলিক বিজ্ঞানে। আমি এর পরে এক উদ্যমের পরিণতির কথা বলব যেখানে ভারত প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি গড়ে তুলেছিল।
আমরা খুব সম্প্রতি এক কীর্তিস্তম্ভ পার করে এসেছি। ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল, ওড়িশা উপকূলে, হুইলার দ্বীপের উৎক্ষেপণকেন্দ্রে উদ্বেগ চরম সীমায় পৌঁছেছিল কারণ ওখানে বিশালাকার ৫০ টন ওজনের ১৭.৫ মি. উঁচু অগ্নি ৫ উৎক্ষেপণ অস্ত্র উল্লম্ব অবস্থানে উত্তোলন করা হয়েছিল এবং উৎক্ষেপণপূর্ব ব্যবস্থাপনা পরীক্ষা করা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সকাল ৮.০৭-এ প্রতিগণনা শুরু হয়েছিল এবং উৎক্ষেপণ অস্ত্রের প্রথম পর্বের অগ্নি সংযোগে একটা বিশাল অগ্নিগোলক ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। অগ্নি ৫ মসৃণভাবে উৎক্ষেপণ মঞ্চ থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে বৈজ্ঞানিকরা তার সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়া জনতার উদ্দেশে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁদের কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত বরং দর্শকরা অনেক বেশি উৎকণ্ঠিত ছিলেন। ৯০ সেকেন্ডের পর প্রথম পর্যায় জ্বলে ভস্মীভূত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যে গতিবেগের মাত্রা স্থির করে দেওয়া হয়েছিল উৎক্ষেপণ অস্ত্রটি ঠিক সেই মাত্রায় ছুটছিল। তারপর নির্ঘণ্ট অনুযায়ী সম্পূর্ণ নব-সমন্বিত দ্বিতীয় পর্যায় জ্বলে ভস্মীভূত হয়ে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কয়েক মিনিটের মধ্যে উৎক্ষেপণ অস্ত্রটি মহাকাশে ভেসে যায়। বিদ্যুৎগতিতে ২০০০ কিমি দক্ষিণে বিষুবরেখা পার করে। তারপর আরও ৩০০০ কিমি সবেগে ধাবিত হওয়ার পরে মকরক্রান্তি রেখার ওপরে বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশ করে আফ্রিকার দক্ষিণতম বিন্দুপ্রান্ত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে ঝাঁপিয়ে সমুদ্রে অবতরণ করেছিল। উৎক্ষেপিত হওয়ার পর থেকে সমুদ্রে অবতরণ করতে ঠিক ২০ মিনিট লেগেছিল। ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ উৎক্ষেপণ অস্ত্রের গতিপথের প্রথম থেকে শেষ অবধি অনুসরণ নথিবদ্ধ করেছে। উৎক্ষেপণ অস্ত্রটি লক্ষ্যকে তার পূর্ব-নির্ধারিত অভ্রান্ততায় বিদ্ধ করে।
IGMDP ১৯৮৩ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা অনুমোদন করে। এই কার্যক্রম চারটি উৎক্ষেপণ অস্ত্রের উন্নয়ন, উৎপাদন এবং নিয়োজনের সম্ভাব্যতা নিরূপণ করেছিল। সেগুলোর নাম— ভূমি থেকে ভূমি উৎক্ষেপণ অস্ত্র (পৃথ্বী); মধ্যম পরিসর ভূমি থেকে বায়ু উৎক্ষেপণ অস্ত্র (আকাশ); স্বল্প পরিসর শীঘ্র প্রতিক্রিয়া ভূমি থেকে বায়ু উৎক্ষেপণ অস্ত্র (ত্রিশূল); এবং একটা কামানবাহী যান প্রতিরোধ উৎক্ষেপণ অস্ত্র (নাগ)। এর অতিরিক্ত প্রযুক্তি প্রতিপাদন উৎক্ষেপণ অস্ত্র (অগ্নি) এই কার্যক্রমের অংশ ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল দূর পরিসর উৎক্ষেপণ অস্ত্রের পুনঃপ্রবেশের বৈশিষ্ট্যগুলির প্রদর্শন করা। এই প্রযুক্তি প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল ১৯৮৯-এর মে মাসে ওড়িশার উপকূলে। পরবর্তীকালে, শেষ দুই দশকে দীর্ঘতর পরিসরের বর্ধিতক্রমে পরিসর সক্ষমতা-সহ অগ্নি ১, ২, ৩, এবং ৪ প্রদর্শিত হয়েছে। এবং শেষ অবধি ডিআরডিও-র বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়াররা ৫০০০কিমি পরিসর উৎক্ষেপণ অস্ত্র অগ্নি ৫-র উড়ান পরীক্ষা সহজসাধ্য করেছিলেন। এইসমস্ত উৎক্ষেপণ অস্ত্রগুলি MTCR (Missile Technology Control Regime) এবং অন্যান্য অনুমোদনের অধীনস্থ হয়েছিল। অতএব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া বা এই প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি কোনওটাই অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করা সম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়াকে শ্রমসাধ্য পথে প্রণালীবদ্ধ গবেষণা এবং উন্নয়নের মাধ্যমে উপলব্ধি করা সম্ভব।
অতএব জটিল প্রযুক্তিতে আত্মবিশ্বাসী হওয়া ও স্বাধীন বৈদেশিক নীতি অনুসরণে রাষ্ট্রকে সক্ষম করার ক্ষেত্রে উৎক্ষেপণ অস্ত্রের সাফল্যজনক পরীক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রাখে।
আমার বন্ধু ড. ভি কে সারস্বত এবং তাঁর দল অগ্নি ৫-র উৎক্ষেপণের সময় আমায় সংক্ষেপে তথ্য শুনিয়েছিলেন।