বেঙ্গালুরুর জওহরলাল নেহরু সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্টিফিক রিসার্চ-এর সাম্মানিক সভামুখ্য অধ্যাপক সি এন আর রাও-এর সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। ন্যানো-বিজ্ঞান প্রযুক্তির গবেষণা এবং উন্নয়নের ভবিষ্যৎ দিশা এবং কৃষি, ঔষধ, মহাকাশ এবং শক্তিক্ষেত্রে এর প্রভাব সম্বন্ধে ভারতবর্ষ এবং বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছিল। এই আলোচনা আমায় রাষ্ট্রপতি ভবনে একদিনব্যাপী অধিবেশনের ব্যবস্থা করতে প্রণোদিত করেছিল। শেষপর্যন্ত আলোচনা এবং সুপারিশের দ্বারা ১,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ সমন্বিত কার্যক্রম ফল দেয়। এই কার্যক্রম বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি এবং উদ্ভাবনের পথের দিশা দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, আমি খুব আনন্দিত হয়েছিলাম যখন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা জলের অণু থেকে ন্যানো স্কেল দূষণ এবং পেট্রোলিয়াম থেকে ভারী হাইড্রোকার্বন দক্ষভাবে দূরীভূত করার জন্য কার্বন ন্যানো-টিউব শোধক তৈরি করার সরল পদ্ধতি কৌশল উদ্ভাবন করেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদ ‘ডাবর’ নামক এক বেসরকারি সংস্থার অংশীদারিত্বে সাফল্যজনকভাবে টিউমার কোষের লক্ষ্যে সরাসরি ওষুধ প্রদান ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
এক উন্নত ভারত এবং আমাদের জ্ঞানসমাজের অগ্রগতির জন্য দক্ষ, ফলভিত্তিক এবং স্বচ্ছ সরকার প্রথমেই প্রয়োজন। এরজন্য রাজ্য, জেলা এবং গ্রাম পর্যায়ে বিকেন্দ্রীভূত অখণ্ড ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক। এর পরিকল্পনা এবং প্রয়োগের জন্য কেন্দ্র সরকার এবং রাজ্য সরকার এমনকী সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত পরিকল্পিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এ কথা স্মরণে রেখে, সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর অংশগ্রহণের দ্বারা ই-গভর্ন্যান্স অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ভবনে আমরা ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলাম। এ-বিষয়ে আমি বিচার বিভাগ, নিরীক্ষা এজেন্সি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। কমনওয়েলথ-এর সমাবেশে একটা প্রেজেন্টেশন করা হয়েছিল, যা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। আমার আশা যে, ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের স্মার্ট বা শনাক্তকরণপত্রী-সহ ই-গভর্ন্যান্স কার্যকরী পরিষেবা তৈরি করবে এবং চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামে অবদান রাখবে।
আমার বিশ্বাস জলসম্পদ এবং শক্তিসম্পদ এই দুই মূল ক্ষেত্র ভবিষ্যতে দ্বন্দ্বের মূল উৎস হয়ে উঠবে। রাজ্যপালদের এক অধিবেশনে বক্তৃতার বিষয় ছিল জলসম্পদ, জলাশয়ের রক্ষণাবেক্ষণ, জলসম্পদের সংরক্ষণ এবং রাজ্য ও জাতীয় পরস্পর সংযুক্ত নদীর জটিল সমন্বয়ের পরিপ্রেক্ষিতে। শক্তিক্ষেত্রে স্বনির্ভরতার জন্য বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্পের প্রয়োজনীয়তার প্রচার আমি করে এসেছি। এক্ষেত্রে এক মূল প্রাথমিক পদক্ষেপ হল জৈব-জ্বালানির উন্নয়ন। এই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে এবং প্রাথমিক পদক্ষেপের সকল দিকগুলোকে সম্পূরিতভাবে বিবেচনা করার জন্য আমরা রাষ্ট্রপতি নিলয়মে এক অধিবেশন আহ্বান করেছিলাম। অন্যান্যদের মধ্যে এই অধিবেশনে কৃষকরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, যাঁদের এই ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা আছে এবং সম্ভাব্য ব্যবহারকারী হিসেবেও। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেমন বীজের বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য চিহ্নিতকরণ এবং জৈব-জ্বালানির উৎস হিসেবে ব্যবহারযোগ্য উদ্ভিদ-চাষে সেচব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা। সরকারি আধিকারিকরা পতিত জমি বণ্টন সম্পর্কিত বিষয় উত্থাপন করেছিলেন। মোটরচালিত যানের নকশাকাররা জৈব-জ্বালানি এবং ডিজেলের সংমিশ্রণের কথা বলেছিলেন যা ইঞ্জিনের নকশা অবিকল রেখে ব্যবহার করা সম্ভব। মিশ্রণে যদি জৈব-জ্বালানির শতকরা মাত্রা বৃদ্ধি পায় তা হলে ইঞ্জিনের নকশার পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। বণিক প্রতিনিধিরা বিনিয়োগ এবং না লাভ-না ক্ষতিজনক বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আমি জৈব-জ্বালানির ব্যবহার সম্পর্কে আমার ধারণার পরিচয় দিয়েছিলাম। অধিবেশনের শেষে সুপারিশগুলো তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সংস্থার মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়েছিল। জৈব-জ্বালানি প্রকল্প বিকশিত হয়েছে বলে আমি খুশি।
এই তিনটি অধিবেশনের অতিরিক্ত, আরও একটা প্রযুক্তিগত ঘটনার উন্মেষ রাষ্ট্রপতি ভবনে হয়েছিল।
২০০৬ সালে ইসরো-র তৎকালীন সভাপতি ভবিষ্যৎ মহাকাশ পরিকল্পনা সংক্ষিপ্তাকারে আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এর মধ্যে চন্দ্র অভিযানের চন্দ্রায়ন মিশনও ছিল। আমি নিশ্চিত যে ওটা ছিল আরও বিস্তৃত মহাকাশ অভিযান এবং মানবাভিযানের প্রথম পদক্ষেপ। প্রস্তাবিত চন্দ্রাভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আমায় বলেছিলেন মহাকাশযান চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে এবং মহাকাশীয় বস্তুর রাসায়নিক, খনিজ এবং ভূ-বিজ্ঞান সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য সরবরাহ করবে। তিনি আরও বলেছিলেন, এই মিশন যে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বহন করবে ইসরো তার চূড়ান্ত ব্যবস্থাপনা করছে। আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম এই মিশন চাঁদে প্রবেশপথে অন্ততপক্ষে এক দূরমাপন চ্যানেল ও ঘনত্ব বা চাপ পরিমাপ-সহ এক যুগ্ম কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। এই যন্ত্রগুলি চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে সরাসরি আমাদের কাছে তথ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। ইসরো-র সভাপতি কথা দিয়েছিলেন এই কার্যাবলি অন্তর্ভুক্ত করবেন। এইভাবেই চন্দ্রায়ন মিশনের অংশ হিসেবে মুন ইমপ্যাক্ট প্রোব-এর জন্ম ঘটল। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম যে মহাকাশে অনুসন্ধান ও পরীক্ষার জন্য প্রেরিত যানটি চাঁদের ভূমি স্পর্শ করল ২০০৪ সালের ১৪ নভেম্বর—একেবারে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে। আমি ইসরো টিমকে তাদের সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানালাম।