‘দুর্দান্ত,’ আমি জবাব দিলাম।
বাজপেয়ীজি বললেন, ‘আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংবাদ আছে। এক্ষুনি আমি বিশেষ অধিবেশন থেকে আসছি যেখানে সমস্ত জোট-পার্টির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। আমরা সর্বসম্মতভাবে বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, আপনাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের প্রয়োজন আছে। আমায় আজ রাত্রের মধ্যে ঘোষণা করতে হবে। আমি আপনার সম্মতি চাই। শুধু শুনতে চাই একটা ‘হ্যাঁ,’ কোনও ‘না’ নয়।’ এ প্রসঙ্গে আমায় বলতে হবে, বাজপেয়ীজি সেসময় এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক অ্যালায়েন্স) বা জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের নেতৃত্বদান করছিলেন। এই জোটে প্রায় দু’ডজন দল অন্তর্ভুক্ত ছিল যাদের ঐক্যমত পাওয়া সবসময় বেশ সহজ ব্যাপার ছিল না।
ঘরে প্রবেশ করার পর বসার সময় পর্যন্ত আমি পাইনি। ভবিষ্যতের নানা ধরনের দৃশ্যকল্প আমার সামনে ভেসে উঠল। তারমধ্যে একটা হল, আমার চারধারে ছাত্র এবং শিক্ষকদের ভিড়। অন্যটায় আমি সংসদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছি দেশের জন্য স্বপ্ন নিয়ে। আমার মনের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হল। আমি বললাম, ‘বাজপেয়ীজি, (সাধারণত তাঁকে আমি এই নামেই সম্বোধন করতাম) আপনি আমায় বিবেচনার জন্য দু’ঘণ্টা সময় দিতে পারেন? এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে আমার মনোনয়নের জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যও প্রয়োজন।’
বাজপেয়ীজি বললেন, ‘আপনার সম্মতি জানার পরে আমরা ঐকমত্যের জন্য এগোব।’
পরের দু’ঘণ্টায় আমি হয়তো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের তিরিশটা টেলিফোন কল করে বসেছিলাম। তাঁদের কেউ হয়তো শিক্ষাবিভাগের, কেউ সিভিল সার্ভিসে বা কেউ কেউ রাজনীতিতে যুক্ত। একটা দৃষ্টিভঙ্গি আমার মনে দাগ কাটল যে, আমি একটা অধ্যাপনার জীবন উপভোগ করছি, যাতে আমার প্রবল উৎসাহ আর ভালবাসা তাতে বিঘ্ন ঘটানো উচিত হবে না। আর দ্বিতীয়টি হল, সংসদ এবং জাতির সামনে ইন্ডিয়া ২০২০ স্বপ্নকে তুলে ধরার এই সৌভাগ্য আমার দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করা উচিত। পাক্কা দু’ঘণ্টা পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ হলে আমি বলেছিলাম, ‘বাজপেয়ীজি আমি মনে করি এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য এবং আমি সর্বদলের প্রার্থী হতে চাই।’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, সেজন্য আমরা চেষ্টা করব, ধন্যবাদ।’
খবরটা খুব দ্রুত ছড়িয়ে গেল। পনেরো মিনিটের মধ্যে আমার রাষ্ট্রপতি পদ প্রার্থনা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে অজস্র টেলিফোন কলে আমি জর্জরিত হয়ে পড়লাম, আমার সুরক্ষা আরও বাড়িয়ে তোলা হল এবং বিশালসংখ্যক দর্শনপ্রার্থী আমার ঘরে ভিড় জমালেন।
সেই দিনই বাজপেয়ীজি শ্রীমতী সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে পদপ্রার্থী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করলেন। যখন শ্রীমতী গাঁধী প্রশ্ন করলেন এনডিএ-র বাছাই কি চূড়ান্ত, প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচক জবাব দিলেন। তাঁর দলের সদস্য এবং জোটসঙ্গী দলের সঙ্গে প্রত্যাশিত মন্ত্রণা গ্রহণের পরপর শ্রীমতী গাঁধী আমার প্রার্থীপদে আইএনসি-র (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস) সমর্থন ঘোষণা করলেন ২০০২ সালের ১৭ জুন। বামপন্থী দলের সমর্থন পেলে আমি খুশি হতাম কিন্তু তারা নিজেদের প্রার্থীকে মনোনীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যে মুহূর্তে আমি রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য সম্মত হলাম সঙ্গে সঙ্গে আমার সম্পর্কে নানা লেখা বিপুল সংখ্যায় বেরোতে লাগল। প্রচারমাধ্যমে অনেক প্রশ্ন দেখা দিল। সারমর্ম হল, কীভাবে একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি, বিশেষত একজন বিজ্ঞানী, জাতির রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হতে পারেন— এই ছিল তাঁদের প্রশ্ন।
রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে আমার মনোনয়নপত্র পেশ করার পর ১৮ জুন প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হল। সাংবাদিকরা আমায় নানা প্রশ্ন করেছিলেন গুজরাত নিয়ে (এই রাজ্য দাঙ্গাহাঙ্গামার দরুন নজরে এসেছিল এবং কীভাবে মোকাবিলা হয়েছিল সে সম্পর্কে উদ্বেগ ধরা পড়েছিল।) অযোধ্যা বিষয়ে (রামজন্মভূমি তো সবসময় সংবাদের বিষয়), পারমাণবিক পরীক্ষা এবং রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকাকালীন আমার পরিকল্পনা নিয়ে। আমি উল্লেখ করেছিলাম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে এক শিক্ষিত রাজনৈতিক শ্রেণির প্রয়োজন যাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল ভিত্তি হবে সহানুভূতি। অযোধ্যা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, প্রয়োজন শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য অনেক কমে আসবে। আমি অঙ্গীকারও করেছিলাম রাষ্ট্রপতি ভবনের জাঁকজমক ও গৌরবের মধ্যে সারল্য বজায় রাখব। রাষ্ট্রপতি হিসেবে যে-কোনও জটিল বিষয়ে দেশের নেতৃত্বস্থানীয় সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করব। রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার মতো বিষয়ে কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ কী চাইছে তার পরিবর্তে দেখা হবে মানুষ কী চায়।
আমি যখন ১০ জুলাই চেন্নাই থেকে এশিয়াড ভিলেজে আমার ফ্ল্যাটে ফিরলাম, তখন প্রস্তুতি জোরকদমে শুরু হয়ে গেছে। ভারতীয় জনতা দলের প্রমোদ মহাজন আমার নির্বাচন-প্রতিভূ ছিলেন। আমি আমার ফ্ল্যাটে একটা ক্যাম্প বা অস্থায়ী দপ্তর বসিয়েছিলাম। ফ্ল্যাটটা যদিও বিশাল কিছু ছিল না, কিন্তু এর মধ্যে রদবদলের কিছু সুবিধা ছিল। আমি দর্শনার্থীদের জন্য একটা ঘর বানিয়েছিলাম, অধিবেশনকক্ষটি ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হল। পরে একটা ইলেকট্রনিক ক্যাম্প অফিসও গড়ে তোলা হয়েছিল— তারপর থেকে সমস্ত তথ্য বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রেরণ করা হত। একটা চিঠির খসড়া করা হয়েছিল সাংসদদের জন্য। লোকসভা এবং রাজ্যসভা উভয়ের সদস্যদের জন্য লেখা চিঠির সংখ্যা প্রায় ৪০০-র কাছাকাছি ছিল। এই চিঠিতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও সেই সঙ্গে আমাকে ভোট দেবার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। মহাজনের পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে ব্যক্তিগতভাবে কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করেও প্রতিটি রাজ্যের নির্বাচন মণ্ডলীর কাছে আমার চিঠি পাঠিয়ে দিতে পারি। এটা কার্যকর হওয়ায় ১৮ জুলাই বিপুল সংখ্যাধিক্য ভোটে আমাকে জয়ী ঘোষণা করা হল।