কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কয়েক বছর ধরে সংসদের কার্যকলাপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তার মধ্যে কিছু কিছু প্রয়োগের জন্য গভীরভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
১. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে
ক. যেমনভাবে বিশেষ কোনও দলের এক বা একাধিক সদস্যর দলত্যাগ রোধ করতে যে বিধিনিয়ম বর্তমান আছে, তেমনিভাবে কোনও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলের জোট সরকারকে অস্থায়ীকরণের ভীতি প্রদর্শনের প্রতিবাদে বন্দোবস্ত অধিগ্রহণ করা দরকার। একটি ক্ষুদ্র দল (মনে করা যাক, লোকসভায় ১০ বা ১৫ শতাংশের কম আসনসংখ্যা-সহ) প্রথমে জোট সরকারে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নেবে, এবং পরে বেরিয়ে যাওয়া মনস্থ করলে, অযোগ্য বিবেচিত হবে।
খ. সমস্ত দলগুলি যখন জোটবদ্ধ তখন সংসদীয় কার্যপ্রণালী পরিচালনার ক্ষেত্রে একক সংসদীয় দল হিসেবে কর্মপ্রক্রিয়া চালানো উচিত।
গ. মন্ত্রকসমূহ বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে নেবে এবং মন্ত্রীগণ অবশ্যই সংসদে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার দিকে লক্ষ রেখে প্রকৃত কার্য নিষ্পন্ন করতে দায়বদ্ধ থাকবেন।
ঘ. সংবিধানের সংশোধনী সম্পাদন করে যাতে সংসদের সংখ্যাগুরু সরকার ইচ্ছা হলে ক্যাবিনেটের ২৫ শতাংশ সদস্য সংসদের বাইরে থেকে নিযুক্ত করতে সক্ষম হবে।
ঙ. নির্বাচনের বেসরকারি তহবিল প্রচলন করা উচিত।
চ. আইন প্রণয়ন করা উচিত যে, তালিকাবদ্ধ কার্যপ্রণালী যদি সমাপন না হয় তবে কোনও কক্ষই সপ্তাহে দু’দিনের বেশি মুলতুবি রাখা যাবে না।
ছ. কোনও বিল অনুমোদন বা আইনগত কার্যপ্রণালীতে ‘ধ্বনি ভোট’-কে পদ্ধতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়। ভোটগণনা আবশ্যিক করা উচিত।
জ. স্পিকার/চেয়ারম্যানের উচিত যে-সমস্ত সদস্যরা প্রায়শই কক্ষে কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটান তাঁদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত বা বহিষ্কার করা।
২. শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে
ক. কেন্দ্রীকরণ: অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষমতা রাজ্য থেকে কেন্দ্রে স্থানান্তর করা।
খ. বিকেন্দ্রীকরণ: আর্থিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব কেন্দ্র থেকে রাজ্যে স্থানান্তরণ।
গ. একটি কেন্দ্রীয় কমিশন গঠিত করা যা কেন্দ্রীয় সহায়তা প্রাপ্ত সমস্ত অনুমোদিত দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রম রাজ্য সরকারকে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এবং এই হস্তান্তর প্রকৃত বাস্তব কার্যনির্বাহের ভিত্তিতে গঠিত হবে।
ঘ. স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, সরকারি ক্ষেত্রের জন উদ্যোগ, ব্যাঙ্কসমূহ, আর্থিক, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে সবরকম নিয়োগের জন্য UPSC-র মতো স্বশাসিত নিয়ামক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রয়োজন।
ঙ. বেসরকারি ক্ষেত্র পুনরুত্থানশীল হয়ে ওঠার দরুন সামগ্রিক বিকাশের হার ত্বরান্বিত হয়েছে বলে সরকারের অভ্যন্তরীণ সংস্কার জরুরিভিত্তিতে করা দরকার।
চ. সরকারি পরিষেবার সুদক্ষতা প্রয়োগের জন্য একজন মন্ত্রীকে দায়িত্বশীল করার ক্ষেত্রে নতুন প্রতিষ্ঠানগত পদক্ষেপ করা জরুরি।
ছ. প্রস্তাবিত বার্ষিক প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বাস্তবায়িত কর্মসম্পাদনের রিপোর্টের জন্য সংসদের কাছে পরিকল্পনা কমিশনকে দায়বদ্ধ রাখা উচিত।
জ. অন্ততপক্ষে মন্ত্রীত্ব পর্যায়ে দুর্নীতি বিষয়ে সহনশীলতায় একটা ইতি টানা উচিত।
ঝ. সবশেষে বিচার সংক্রান্ত ক্ষেত্রে আইনব্যবস্থার কোনও সংস্কার দীর্ঘকাল ধরে মুলতুবি থাকতে পারে না।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে কর্মসম্পাদনে বহুদলীয় জোটের বিধিসম্মত সরকার গঠনের উত্থানের এক তাৎপর্যময় ইঙ্গিত আছে। সংসদীয় কার্যপ্রণালীর ভূমিকা এবং কার্যকারিতা এতে আনুপাতিক হারে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। সংসদের মহিমাময় ভূমিকা বর্ধন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যাতে সংসদের তত্ত্বাবধানে বৃহত্তর দায়িত্বভার গ্রহণের মাধ্যমে এর কার্যনির্বাহকরা তার বিষয়গুলি পরিচালনায় আরও মূল্য যোগ করতে পারে। অতএব, আমাদের সংবিধানের চরম প্রত্যাশাপূরণের জন্য সংসদীয় ব্যবস্থাকে আরও স্থিতিশীল ও বাস্তবোপযোগী করার জন্য এই ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। সর্বোপরি, এই ধরনের উদ্বেগ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস এবং দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতার সঙ্গে মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার শক্তি বর্ধনের জরুরি আবশ্যকীয়তাকে গুরুত্বহীন করে দিচ্ছে।
উচ্চহারে বিকাশ পর্যায়ে অর্থনৈতিক অসাম্য আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে। শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীগণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে ফলে তাঁদের দায়বদ্ধতাও বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়া অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বাণিজ্য সংক্রান্ত এবং অন্যান্য বিধিবদ্ধ নিয়ম সংক্রান্ত ক্ষমতার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের বিস্তৃত সতর্কতায় যাতে সরকারি তহবিলের অপব্যবহার এবং গতিমুখ পরিবর্তন না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। শাসনব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস করতে হবে যাতে রাজনৈতিক পদগুলির উচ্চপর্যায়ে চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা না থাকে যার ফলে এই পদগুলির দুষ্প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
আর্থসামাজিক লক্ষ্যসমূহের পরিকল্পনা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাংসদদের আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণে উৎসাহদানের ফলে আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র থেকে সংসদীয় নেতাদের আগমন ঘটবে এবং ক্ষমতা ব্যবহার এবং লাভের ‘একচেটিয়া’ উপভোক্তাদের প্রভাব হ্রাস পাবে। এর ফলে ইতিবাচক নেতৃত্বদানের পরিস্থিতি তৈরি হবে, যা দণ্ডনীয় অপরাধ এবং অন্যান্য আইন লঙ্ঘনের মতো অপরাধে অপরাধী ব্যক্তির রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ কমিয়ে দেবে। সাংসদদের আরও কার্যকরীভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়সাধন করায় আর্থসামাজিক বিকাশ নিশ্চিত হবে। এবং এও সুনিশ্চিত হবে বহুবিধ এজেন্সি এবং সরকারি বিভাগগুলো যাতে কার্যক্ষেত্রে একে অপরের বিরুদ্ধে কাজ না করে। প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতিগত পার্থক্য সঠিক সময় এবং সঠিক পর্যায়ে বসে মীমাংসা করতে হবে এবং প্রস্তাবের জন্য উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এর ফলে ক্যাবিনেট কমিটি এবং গ্রুপ অফ মিনিস্টারস যথার্থ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির প্রতি মনোযোগ নিয়োগ করতে পারবে যেখানে ক্ষমতাপ্রাপ্ত সাংসদদের পক্ষেও বিষয়গুলোর সমাধান সম্ভব হয় না। ঘন ঘন রাষ্ট্র-রাজ্য এবং প্রতিষ্ঠানব্যাপী নির্বাচন এবং কোনও দলের স্বল্পমেয়াদি অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সাংসদদের বর্ধিত ভূমিকা সামগ্রিক শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কার্যকরী কর্মসম্পাদনে নিশ্চয়তা দেবে এবং আশ্বস্ত করবে যে, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা বারংবার সংকটের সম্মুখীন হওয়ার প্রয়োজন নেই।