ভারতবর্ষের সৌভাগ্য যে, সে সরকারে এবং সংসদে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন, যোগ্যতাসম্পন্ন ও দূরদর্শী নেতাসমূহকে পেয়েছে। এই দেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানাবিধ সাফল্যের জন্য যথেষ্ট গর্বিত হতে পারে। অনেকে অনুমান করেন ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষ বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে। কিন্তু গণতন্ত্র বা অর্থনৈতিক পুনরুত্থান কোনওটাই স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া উচিত নয়। অবিচল সতর্কতা হল স্বাধীনতার মূল্য। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং ব্যাবহারিক উপযোগিতা উপরিতলে যতই সন্তোষজনক মনে হোক-না কেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা এক জায়গায় স্থাণু হয়ে থাকতে পারে না এবং হওয়া উচিতও নয়। আমরা অতীতের সাফল্যে আত্মসন্তুষ্ট হয়ে থেমে থাকতে পারি না এবং যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে চালনা করি সেই পথের পরিবর্তনের জন্য যে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তাকে উপেক্ষা করতে পারি না। স্বাধীনতা লাভের পরে যে আর্থিক উন্নতি এবং ইতিবাচক বিকাশের ধারা বয়ে চলেছে তা প্রধানত সরকারি এবং জাতীয় সংস্থাগুলির বাইরে সংঘটিত হচ্ছে এবং আমাদের সামনে মহত্তম চ্যালেঞ্জ হল ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনঃসঞ্জীবিত করা ও পুনর্জীবিত করা।
সরকারি এবং সরকার অধীনস্থ ক্ষেত্রে শুধু উৎপাদন, লাভ এবং জনসঞ্চয়ের পরিপ্রেক্ষিতে নয়— শিল্প, স্বাস্থ্য, জল এবং পরিবহণের মতো অপরিহার্য জনসেবা ক্ষেত্রের সংস্থানের ভিত্তিতে আমরা চাই উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন। বহু প্রখ্যাত পণ্ডিত সংসদের ক্রিয়াকলাপ পর্যালোচনা করেন এবং ভারতীয় সংসদ যে ব্যাপক বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তা চিহ্নিত করেন। আমি মনোনিবেশ সহকারে তা পর্যালোচনা করে তাঁদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ এবং উদ্বেগ সম্বন্ধে কিছু বলব।
রাষ্ট্রে এক সর্বব্যাপী অনুভব বর্তমান যে জবাবদিহির দায়বদ্ধতা এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদের কার্যকারিতায় উন্নয়নের উপযুক্ত সময় এসে গেছে। সংসদ সরকারি কার্যক্রমের জবাবদিহির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে অনেকরকম হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে। যেমন সংসদ কক্ষে প্রস্তাব আনা, তত্ত্বাবধান ক্ষমতা এবং কমিটি গঠন প্রক্রিয়া। কিন্তু এই হাতিয়ারেরও বর্ধিত হারে পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন। ভারতীয় অর্থনীতির বিশ্বায়নের ফলে আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে একথা সত্য। রাষ্ট্র সমৃদ্ধতর, কিন্তু সংসদের ক্ষমতাকে দু’ভাবে বাড়ানোর জন্য ব্যাপক সতর্কতা প্রয়োজন। বেশিরভাগ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণ আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘বিশ্বের সামান্য কিছুসংখ্যক সংসদের মধ্যে ভারতীয় সংসদ হল অন্যতম যার কোনও কার্যকরী চুক্তির তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা নেই।’ সংসদে আসার আগেই চুক্তিগুলি সাধারণভাবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। তাই বিদেশি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে এই চুক্তি এবং সমঝোতাপত্র দেখাশোনা ও আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষমতা সংসদের পক্ষে খুব জরুরি।
অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো ভারতীয় রাষ্ট্রেও নিয়ন্ত্রক কাঠামো পুনর্গঠন করা হচ্ছে অনির্বাচিত সংগঠনগুলিতে আরও ক্ষমতা অভিযোজন করে। এই ক্ষমতা অভিযোজন কার্যকরীভাবে বহু বছর ধরে কার্যে পরিণত হয়ে স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করেছে, বিশেষত উদারীকরণের পর। অতএব সংসদীয় দায়বদ্ধতার সঙ্গে গতিময়তা বজায় রাখতে গেলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সংসদীয় তত্ত্বাবধান শক্তিশালী করতে হবে। সাংসদদের আরও কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধি করতে হবে ক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার জন্য আইন প্রণয়ন এবং দুর্বল আর্থিক তত্ত্বাবধানের ফলে বিকল্প অধ্যাদেশের সংখ্যা হ্রাস করে।
দৈনন্দিন আর্থিক বিষয়ে কার্যনির্বাহীতে সংসদীয় তত্ত্বাবধান এমন এক ক্ষেত্র যেখানে অধিকতর গুরুত্ব এবং চূড়ান্ত ফোকাসের দরুন সংসদীয় কার্যকলাপের মূল্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করবে এবং প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করবে বিশেষত বর্ধনশীল সংখ্যক তরুণ এবং প্রথমবারের নতুন সদস্যদের কাছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণপ্রাচুর্যের ফলে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেয়েছে— প্রথম লোকসভার পাঁচটি রাজনৈতিক দল থেকে ১৪তম লোকসভার প্রায় ৫০টি দলে পৌঁছনোর মাধ্যমে। সংসদে রাজনৈতিক দলগুলির সংখ্যাধিক্যর সুবিধা গ্রহণ করা উচিত; এবং সংসদে রাজনৈতিক দলগুলির ক্রিয়াকলাপ এমনভাবে সহজসাধ্য করা উচিত যার ফলে সংসদ এবং দল উভয়েরই শক্তিবৃদ্ধি করে এবং মিলিতভাবে কাজ করার প্রতিবন্ধকতা দূর হয়। একদিকে সাংসদদের ওপর জটিল চাহিদার দায়িত্ব অন্যদিকে সেই আইন অবধাবনে তাঁদের ধারণক্ষমতা ও প্রবণতার মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান পার্থক্য এই মানদণ্ডগুলি দ্বারা শীঘ্র হ্রাসপ্রাপ্ত হবে।
সংসদে ভাল কাজের জন্য সাংসদদের স্বতন্ত্রভাবে সচেতনভাবে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত এবং তাঁদের নিজের নির্বাচনক্ষেত্রে, রাজনৈতিক দল এবং জোটের পক্ষ থেকে রাজনৈতিকভাবে পুরস্কৃত করা প্রয়োজন। এর দ্বারা ভাল সংসদীয় কার্যকলাপের উদ্দীপনা বৃদ্ধি পাবে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যেরকম হয়েছিল সেইরকম সংসদকে আবার আর-একবার কার্যকরী কণ্ঠস্বর হতে হবে সরকারি রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনে, অর্থনীতিতে, সামাজিক নীতিতে এবং ভারতবর্ষের বিশ্ব অর্থনীতি একীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে। সংসদের কণ্ঠস্বর জোরালো করার বন্দোবস্তের পথে কোনও অনিয়ন্ত্রণযোগ্য, বহিরাগত উপকরণ বাধা সৃষ্টি করছে না। ইতিবাচক উৎসাহপ্রদান, দূরদর্শী নেতৃত্ব অবশ্যই সাংসদদের দায়বদ্ধতা ও দক্ষ শাসনব্যবস্থার জন্য নতুন এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণে উৎসাহিত করবে।