এ-সমস্ত কিছু মনে রেখে আমার প্রেজেন্টেশন মূল্যসংযোজিত কর্মসংস্থান উদ্ভাবনার মাধ্যমে মাথাপিছু উপার্জন বর্তমান ২৬,০৫১ টাকা থেকে ১০০,০০০ টাকারও বেশি বৃদ্ধি করার উপায়, ১০০ শতাংশ হারে সাক্ষরতা প্রসার, শিশু মৃত্যু হার বা আইএমআর (ইনফান্ট মর্টালিটি রেট) ১০-এর নীচে নামিয়ে আনা এবং কুষ্ঠরোগ, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু এবং যক্ষ্মার মতো ব্যাধি রাজ্য থেকে নির্মূলীকরণ করার কথা বিবেচনা করেছিল।
২০০ মিলিয়ন মানুষকে সক্ষম করার এই লক্ষ্যগুলো কীভাবে সম্পাদন করা সম্ভব আমি তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলাম।
আমি যে পরামর্শগুলি দিয়েছিলাম তার মধ্যে একটি ছিল উত্তরপ্রদেশের এক কর্মদক্ষতার মানচিত্র তৈরি করা। অর্থাৎ এমন মানচিত্র তৈরি করা যা রাজ্যের প্রতিটি জেলার শিল্প, সংগীত, হস্তশিল্প, কৃষিজাত দ্রব্য এবং বিশেষ ধরনের রন্ধনপ্রণালী প্রভৃতির দিকগুলো দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা চিহ্নিত করবে।
প্রেজেন্টেশনে আরও অনেক নির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা ছিল। আমার মনোবাসনা দ্রুত উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনক্ষম পরিকল্পনাসমগ্র রাষ্ট্রে প্রযুক্ত হোক যাতে প্রক্রিয়া পারস্পরিক এবং ফলভিত্তিক হয়।
আমেরিকা এবং ভারতের মধ্যে যে ১২৩ চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা ইন্দো-ইউ এস পারমাণবিক চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত তার সামরিক ও অসামরিক পারমাণবিক ব্যবস্থা পৃথক করতে রাজি হয় এবং তার যাবতীয় অসামরিক পারমাণবিক ব্যবস্থাগুলিকে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি বা IAEA (International Atomic Energy Agency)-র সুরক্ষা বন্দোবস্তের অধীনে নিয়ে আসে। এর পরিবর্তে আমেরিকা ভারতের সঙ্গে ‘সম্পূর্ণ’ অসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতার লক্ষ্যে কাজ করতে সম্মত হয়। দীর্ঘমেয়াদি আলাপ-আলোচনার পর IAEA-র সঙ্গে সুরক্ষা বন্দোবস্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে ঐক্যবদ্ধ প্রগতিশীল জোট বা ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স) সরকারকে ২০০৪ সালের ২২ জুলাই এক আস্থা ভোটের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
এই আস্থা ভোটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল বাম দলগুলি যারা ইউপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন জানাচ্ছিল। এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরতা বিষয়ে অংশীদার হতে তারা অসম্মত হয়। সমাজবাদী দলের সভাপতি মুলায়ম সিং যাদব এবং তাঁর পূর্বতন সহকারী অমর সিং পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে মানসিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন এবং সরকারকে সমর্থন বজায় রাখবেন কি না সে-বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। এই চুক্তি ভারতের পক্ষে অনুকূল হবে নাকি পশ্চিমের বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক মুনাফা বিবেচনা করে করা হচ্ছে, সে-বিষয়ে তাঁদের মনে অনিশ্চয়তা ছিল। এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মুলায়ম সিং যাদব এবং অমর সিং উভয়েই আমার সঙ্গে আমার ১০ রাজাজি মার্গ-এর বাড়িতে দেখা করতে এবং এই চুক্তি স্বাক্ষর করলে ভারতের পক্ষে ভাল ও খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। আমি তাঁদের বলেছিলাম, ভারতবর্ষকে থোরিয়ামভিত্তিক পারমাণবিক রি-অ্যাক্টরে স্বনির্ভর হতে হবে। এর অর্থ, আমাদের উন্নয়নমূলক কার্যের জন্য পরিচ্ছন্ন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন। এই চুক্তি ইউরেনিয়ামের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বর্তমান অভাব অনেকটা মিটিয়ে দিতে সাহায্য করবে।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছিল ২০১১ সালের মার্চে, জাপানের ফুকোসিমায় সুনামি তাণ্ডবের পরে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র, বিশেষত তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলামে নির্মীয়মাণ পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে ক্রমাগত বিক্ষোভ প্রদর্শন। বিক্ষোভকারীরা স্থানীয় গ্রামবাসী, তাঁরা চাইছিলেন কুড়ানকুলামের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া হোক এবং সেখানকার ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। এঁদের সমর্থন করছিল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলি বা এনজিও। অবস্থার গুরুত্ব বুঝে ভারতের পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের সুরক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে এবং এই নিয়ে অগ্রসর হওয়া কাঙ্ক্ষিত কি না সেই সম্পর্কে এক বিশদ বিস্তৃত পর্যালোচনা করেছিলাম। ইংরেজি ও আঞ্চলিক সংবাদপত্রে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে বিশ্লেষিত হয়েছিল ভারতের প্রয়োজনীয় উন্নয়নের জন্য কেন এই প্রযুক্তি এত জরুরি।
পাশাপাশি, আমি আমার টিম নিয়ে ২০০০ মেগাওয়াট থার্ড জেনারেশন প্লাস প্ল্যান্ট (third generation plus plant) পর্যবেক্ষণ করতে কুড়ানকুলাম গিয়েছিলাম। শক্তিকেন্দ্রের সুরক্ষা বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে এবং কীভাবে মানুষের আশঙ্কা সম্বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, বিশেষত আলোড়ন সৃষ্টিকারী ফুকোসিমা ঘটনার পর তা আমি উপলব্ধি করতে চেয়েছিলাম। আমি সারাদিন বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম এবং শক্তিকেন্দ্রের নানান ধরনের সুযোগসুবিধা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। সুরক্ষাব্যবস্থায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দেখে আমি উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের সুরক্ষা ব্যবস্থার চারটে মূল দিক আছে— গঠনগত অখণ্ড সুরক্ষাব্যবস্থা (Structural integrity safety), তাপীয় জলপ্রবাহ সুরক্ষা ব্যবস্থা (Thermal hydraulic safety), বিকিরণ সুরক্ষা ব্যবস্থা (Radiation safety), নিউট্রনিক সুরক্ষা ব্যবস্থা (Neutronic safety) এবং এই চারটে প্রয়োজনীয়তা পূরণ করেছিল।