আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে, যখন বিচারালয় মৃত্যুদণ্ড মামলায় শুনানি করছে তখন তাদের উচিত আইন বলবৎকারী সংস্থাকে সতর্ক করে দেওয়া যাতে তারা বুদ্ধিপ্রয়োগ করে শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধী এবং তার পরিবারের জীবিকানির্বাহের সূত্রটি খুঁজে বার করে। এই ধরনের বিশ্লেষণ হয়তো আসল মানুষটি এবং তার অপরাধের কারণ খুঁজে বার করবে।
আমরা সবাই ঈশ্বরের সৃষ্টি। মানুষের তৈরি বিধি-নিয়ম বা একজন ব্যক্তির কৃত্রিম এবং গড়ে তোলা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কারও জীবনকে শেষ করে দিতে কতটা উপযুক্ত সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন হওয়ার পর অথবা পরিবর্তনের দরুন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা রাষ্ট্রপতির অন্যতম কর্তব্য। এসব ক্ষেত্রে স্থিতিশীল সরকার গঠন করার জন্য যেন দল বা জোট সরকারের যথেষ্টসংখ্যক সদস্য থাকে সে-বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে নিশ্চিত হতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে যায় যখন একাধিক দল সরকার গঠনের দাবি করে, যেখানে কক্ষে কোনও দলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালের নির্বাচন বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। নির্বাচন সমাপ্ত হওয়ার পর, ফলাফল ঘোষিত হয়ে গিয়েছিল এবং কোনও একটি দলের সরকার গঠনের সামর্থ্য ছিল না।
কংগ্রেস দলের সর্বাধিক নির্বাচিত সদস্য ছিল। তা সত্ত্বেও তিনদিন চলে গেল অথচ কোনও দল বা জোটদল সরকার গঠন করতে এগিয়ে এল না। ঘটনাটি আমায় উদ্বিগ্ন করে এবং আমি আমার সচিবের সঙ্গে আলোচনা করে বৃহত্তম দলের, এখানে কংগ্রেস দলের নেতাকে একটা পত্র পাঠিয়েছিলাম যাতে সরকার গঠনের দাবির স্বার্থে তারা অগ্রসর হয়।
আমাকে বলা হয়েছিল সনিয়া গাঁধী আমার সঙ্গে ১৮ মে দুপুর ১২.১৫-তে দেখা করতে চান। কিন্তু দেখা গেল, একা আসার পরিবর্তে তিনি মনমোহন সিং-এর সঙ্গে এসেছিলেন আমার সঙ্গে আলোচনা করতে। শ্রীমতী গাঁধী বলেছিলেন, তাঁর আবশ্যিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে কিন্তু তিনি দলের সদস্যদের স্বাক্ষরিত প্রয়োজনীয় সমর্থনপত্র সঙ্গে আনেননি। পরদিন অর্থাৎ ১৯ তারিখ তিনি সেই সমর্থনপত্র নিয়ে আসবেন। আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন আপনি পিছিয়ে দিচ্ছেন। আমরা আজ দুপুরের মধ্যে কার্যসম্পাদন করতে পারতাম। তিনি চলে গেলেন। পরে একটি বার্তা পেলাম যে, তিনি আমার সঙ্গে সন্ধে ৮.১৫টায় সাক্ষাৎ করতে চান।
যখন এই বার্তা আদান-প্রদান চলছিল, আমি কোনও কোনও ব্যক্তি, সংগঠনগুলি এবং দলসমূহ থেকে অসংখ্য ই-মেল, চিঠিপত্র পেয়েছিলাম যে আমি যেন শ্রীমতী সনিয়া গাঁধীকে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুমতি না দিই। আমি কোনওরকম মন্তব্য না করেই সেগুলো বিভিন্ন সরকারি দফতরকে তাদের তথ্যসমূহের জন্য প্রেরণ করেছিলাম। এই সময়ে অনেক রাজনৈতিক নেতা আমার সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কোনও চাপের কাছে নতিস্বীকার করে যেন শ্রীমতী গাঁধীকে প্রধানমন্ত্রী না করি। তাঁরা যে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তা সাংবিধানিকভাবে গ্রহণীয় নয়। যদি শ্রীমতী গাঁধী দাবি করতেন আমায় তাঁকে নিয়োগ করা ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় থাকত না।
পূর্বনির্ধারিত সময়, সন্ধে ৮.১৫-এ শ্রীমতী গাঁধী ড. মনমোহন সিং-এর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে এসেছিলেন। কুশল বিনিময় করার পর ওই বৈঠকে শ্রীমতী গাঁধী বিভিন্ন দলের সমর্থনপত্র দেখালেন। তৎক্ষণাৎ আমি তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বললাম, রাষ্ট্রপতি ভবন আপনার সুবিধামতো সময়ে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত। ঠিক তখনই তিনি বললেন, তিনি ড. মনমোহন সিং-এর নাম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রস্তাব করতে চান, যিনি ১৯৯১-এ অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের স্থপতি ছিলেন এবং নিষ্কলঙ্ক চরিত্র-সহ কংগ্রেস দলের একজন বিশ্বাসী সহযোদ্ধা। এ ঘটনা অবশ্যই আমায় আশ্চর্য করেছিল এবং রাষ্ট্রপতি ভবনের সচিবালয় ড. মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করার জন্য নতুনভাবে নথিপত্র তৈরি করেছিল এবং তাঁকে যত শীঘ্র সম্ভব সরকার গঠন করার জন্য আহ্বান করেছিল।
অবশেষে, ২২ মে জাঁকজমকপূর্ণ অশোক হলে ড. মনমোহন সিং এবং ৬৭ জন মন্ত্রীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
অবশেষে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাপন করার স্বস্তিতে আমি নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। যদিও, আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম কেন তিনদিনের জন্য কোনও দল সরকার গঠনের দাবিদার হয়নি।
.
রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালে আমাকে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আইনি এবং সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মতামত উদ্রিক্ত করে আমি আমার মনকে সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীনভাবে প্রয়োগ করেছিলাম। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সংবিধানের পবিত্রতা এবং কাঠিন্যকে সুরক্ষিত করা এবং লালন করা।
১৪. রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালের পরে
১৪. রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালের পরে
ফুলকে দেখো, কী অকৃপণভাবে সুগন্ধ আর মধু দান করে,
কিন্তু যখন তার কাজ শেষ হয়ে যায়, নিঃশব্দে ঝরে পড়ে যায়।
—ভগবদ্গীতা।
রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন আমার খুব ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। আমাদের এই সুন্দর দেশ ঘুরে ঘুরে প্রতিটি রাজ্যে গিয়ে কীভাবে মানুষ সেখানে বেঁচে থাকে, তাদের পরিবেশ এবং সমস্যা স্বচক্ষে দেখা আর তারা জীবনে কতটা সুখী তা উপলব্ধি করা ছিল প্রথম বছরে আমার অন্যতম লক্ষ্য। কেরল উপকূলের নিকটবর্তী লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জ একমাত্র স্থান যেখানে পরিদর্শনে যেতে পারিনি বলে আমি অনুতপ্ত। প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব আকর্ষণ থাকে। সরলতা আর উষ্ণতার যে অন্তঃসলিলা প্রবাহিত হয় তা কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ভারতীয়।