‘মনুস্মৃতি’তে লাভ বা দান বলতে কী বোঝায় তার অর্থ আমি তখনই কেবলমাত্র বুঝতে পেরেছিলাম: ‘দান গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যেকার ঐশ্বরিক রশ্মি নির্বাপিত হয়ে যায়।’ একজন হাদিস বলেছেন, ‘পরমেশ্বর যখন কাউকে কোনও পদে নিযুক্ত করেন তখন তিনি তাঁর প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখেন। যদি কোনও ব্যক্তি এর বাইরে কোনও কিছু গ্রহণ করেন তবে তা হয় অবৈধপ্রাপ্তি।’
এই ছিল লাভজনক পদ বিল ফেরত পাঠানোয় আমার উদ্বেগ এবং যুক্তি। বিল পুনর্বিবেচিত হয়ে আমার অনুমোদনের জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সাধারণত আমি বিল-সংক্রান্ত অনুমতি পরের দিনই পাঠিয়ে দিই, কিন্তু সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলে যাওয়ার পরেও যখন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হল না তখন প্রধানমন্ত্রী চিন্তিত এবং আশ্চর্যান্বিত হয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, সংসদের পক্ষ থেকে কিছু করা প্রয়োজন এবং সে-বিষয়ে আমি কিছু শুনিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সংসদ আমার পরামর্শমতো লাভজনক পদ বিলের সমস্ত দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনা করার জন্য ইতিমধ্যে যুগ্মসংসদীয় সমিতি বা জেপিসি (জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি) গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ইত্যবসরে, বিলম্বের কারণে সমালোচনার ঝড় তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল। অবশ্যই, আমি পরিষ্কার ছিলাম যে, বিল অনুমোদন করার আগে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো যেন নেওয়া হয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে বহু প্রতিনিধি আমার সঙ্গে দেখা করে এ-বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমি সেসময় উত্তর-পূর্বাঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। দিল্লি আসার পথে আমি যখন কোহিমা থেকে গুয়াহাটি যাচ্ছি তখন বার্তা পেলাম যে সংসদ লাভজনক পদ বিল বিবেচনার জন্য একটা জেপিসি গঠন করার অনুমোদন দিয়েছে। যে মুহূর্তে আমি সংসদের কাছ থেকে আমার কাজের অনুমোদন পেলাম তৎক্ষণাৎ লাভজনক পদ বিলে স্বাক্ষর করলাম।
বেশ কয়েক মাস পরে, সংসদ জেপিসি-র যে রিপোর্ট মঞ্জুর করল সেটা অসম্পূর্ণ ছিল এবং আমি যে সমস্যাগুলো তুলে ধরেছিলাম সেগুলোর সম্বন্ধে কিছুই বলা হয়নি। সংসদের উচিত এই ধরনের বিষয়গুলি খুব গুরুত্ব সহকারে চর্চা করা, নয়তো জনগণের কাছে এই বার্তা পৌঁছয় যে, রাষ্ট্রের উচ্চতম দায়িত্বাধিকারী সংগঠন ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার প্রচার করছিলেন এবং সরকারের বিশেষ স্তরের ব্যক্তিদের কাছে এ একজাতীয় প্রবণতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
এই মত লাভজনক পদ বিলের ফেরত পাঠানো সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করে, যে-সমস্ত প্রথা জনগণের সততার স্তরে পৌঁছতে পারে না তা সংসদীয় স্তরে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব সহকারে বিচার-বিবেচনা ও পর্যালোচনা করা দরকার। ত্রুটিপূর্ণ প্রথা গ্রহণের ক্ষেত্রে সূচনা হিসেবে একে গণ্য করা যায় যা জাতীয় মান গঠন এবং প্রথার ক্ষেত্রে সমঝোতার দিকে নিয়ে যাবে।
সাম্প্রতিককালে আমরা দেখি দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুটো অনশন আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে এবং এতে অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম— আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেন এই আন্দোলন হচ্ছে। বস্তুত, এর পেছনে কারণ হল, সংসদ নিজেই নিজের মানের অবনমন ঘটাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে আমি পরামর্শ দিই, সংসদ অন্ততপক্ষে দু’সপ্তাহ সময় নিয়ে, দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদে কক্ষ ত্যাগ না করে আলাপ-আলোচনা করুক এবং জনজীবন থেকে এ পাপ মুক্ত করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা স্থির করুক। এর অংশ হিসেবে সংসদীয় সদস্যদের জন্য একটা আচরণবিধির প্রয়োজনীয়তা আছে। যদি জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের লক্ষ্যপূরণে অসমর্থ হন তবে তাঁদের যাঁরা নির্বাচন করেছেন তাঁরা নানা উপায়ে নিজেদের হতাশা এবং অসম্মতি প্রকাশ করতে পারেন। প্রতিটা রাজনৈতিক দলকে সংসদের মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ করতে বা দুর্নীতি মুক্ত করতে নিজস্ব কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। সময় এসে গেছে, সংসদের উভয় কক্ষের উচিত দুর্নীতির বিষয় নিয়ে সতর্কভাবে চিন্তা করার এবং একটা সময়সীমানির্দিষ্ট সাংবিধানিক সমাধান খুঁজে বার করা, যা এই বিপজ্জনক প্রবণতা অপসারিত করবে, যার মধ্যে বিদেশে সঞ্চিত অর্থ পুনরুদ্ধার অন্তর্ভুক্ত। যথাসময়ে সংসদের এই ধরনের সক্রিয়তা নাগরিকদের মধ্যে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবে এবং সমাজের শান্তি ও সামঞ্জস্যতার প্রচার করবে যা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে জরুরি।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার পক্ষে অন্যতম কঠিন কাজ ছিল, আবেদনের সমস্ত বিকল্প প্রক্রিয়াসমূহ রুদ্ধ হওয়ার পর বিচারবিভাগ দ্বারা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। রাষ্ট্রপতি ভবনে এরকম প্রচুর আবেদন অমীমাংসিতভাবে রয়েছে। এ পূর্বসূরিদের থেকে প্রাপ্ত এমন একটি কাজ, যে কোনও রাষ্ট্রপতি এতে আনন্দিত হবেন না। আমি ভেবেছিলাম মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির অপরাধ, অপরাধের গুরুত্ব এবং ব্যক্তিটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে একজন সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলি পরীক্ষা করব। এই পর্যালোচনার ফলে আমি আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম— যে-সমস্ত অমীমাংসিত মামলাগুলো রয়েছে সেগুলো বেশিরভাগ সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। এর ফলে আমার মনে এই ধারণার জন্মাল যে, আমরা এমন মানুষকে শাস্তি দিচ্ছি, যার সঙ্গে শত্রুতার খুব সামান্যই সম্পর্ক এবং কোনও উদ্দেশ্যমূলক অপরাধ করেনি। অবশ্যই, এমন একটি মামলা আছে যেখানে দেখা গেছে লিফটম্যান একটি কিশোরীকে ধর্ষণ এবং হত্যা করার মতো অপরাধ ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে। সে মামলার ক্ষেত্রে আমি মৃত্যুদণ্ড জারি রেখেছিলাম।