যে মুহূর্তে রায় জানা গেল, আমি ইস্তফাপত্র লিখে স্বাক্ষর করে উপরাষ্ট্রপতি ভৈঁরো সিং শেখাওয়াতকে পাঠাবার জন্য তৈরি করে রাখলাম। ভৈঁরো সিং অত্যন্ত ঝানু রাজনীতিক ছিলেন। আমি চেয়েছিলাম ওঁর সঙ্গে কথা বলে হাতে হাতে ইস্তফাপত্র দিতে। তিনি তখন বাইরে ছিলেন। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে অন্য কোনও আলোচনার জন্য দেখা করতে চেয়েছিলেন। বেলার দিকে আমার দপ্তরে ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। আলোচনা শেষে আমি জানালাম যে, রাষ্ট্রপতি পদ থেকে আমি ইস্তফা দিতে চাই এবং তাঁকে সেই পদত্যাগপত্র দেখালাম। উপরাষ্ট্রপতির ফিরে আসার জন্য আমি প্রতীক্ষা করছিলাম। প্রধানমন্ত্রী চমকে গেলেন।
খুব মর্মস্পর্শী দৃশ্যর অবতারণা হল এবং আমি তা বর্ণনা করতে চাই না। প্রধানমন্ত্রী কাতর অনুরোধ জানালেন যেন এই জটিল পরিস্থিতিতে আমি ওই পদক্ষেপ না নিই। এর পরিণতিতে যে অস্থিরতার জন্ম হবে তাতে সরকারের পতনও ঘটতে পারে। আমার তখন বিবেক ছাড়া আর কারও সঙ্গে পরামর্শ করার ছিল না। বিবেক হল আত্মার আলো যা আমাদের হৃদয়ের কোটরে জ্বলে। সেই রাত্রে আমি ঘুমোতে পারিনি। নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম আমার বিবেক না দেশ, কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? পরদিন খুব সকালে রোজকার মতো আমি নমাজ পড়লাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ইস্তফা প্রস্তাব ফিরিয়ে নেব এবং সরকারকে বিচলিত করব না। কোনও ক্ষমতাসীন দল নির্বিশেষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হত।
দেশের খুব অল্পসংখ্যক মানুষই ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। আমার বিবেচনায় এ এক সীমাহীন বিশ্বকে আয়ত্ত করার মাধ্যম। দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকি-না কেন আমি ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার করি। যাঁরা আক্ষরিক অর্থে কাগজেকলমে কাজ করে অভ্যস্ত তাঁদের পক্ষে ই-গভর্ন্যান্সের ক্ষমতা উপলব্ধি করা কঠিন। বিহার বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে (যা তখন সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় ছিল) আমার বিবেকের কাছে ঠিক মনে হয়েছে তাই করেছি।
মনু প্রত্যেক ব্যক্তিকে দানগ্রহণ করার ক্ষেত্রে সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এর ফলে গ্রহীতা একটা বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে এবং ভ্রান্তপথে চালিত হয়।
বিস্তারিতভাবে বলা যায়, সংসদের অযোগ্যতার নিবারণ আইন ১৯৫৯ শর্ত দেয় সরকারের কিছু কিছু লাভজনক দফতর তার নির্বাচিত পদাধিকারী ভোক্তা বা সাংসদ হওয়ার দরুন অযোগ্য বিবেচনা করে না।
২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমি কয়েক জন সাংসদদের কাছ থেকে তাঁদের সহকর্মী সদস্যদের সম্বন্ধে অভিযোগ শুনলাম যে তাঁরা লাভজনক পদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। আমাকে এই অভিযোগগুলো নিয়ে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। আমি অভিযোগ মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের কাছে পর্যবেক্ষণের জন্য এবং যেখানে প্রয়োজন সেখানে অনুসন্ধান চালনার জন্য পাঠিয়েছিলাম। দু’জন সদস্য শ্রীমতী জয়া বচ্চন এবং শ্রীমতী সনিয়া গাঁধীর নামে যখন অভিযোগ এসেছিল তখন অনেক সদস্য আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন কেন রাষ্ট্রপতি এ ধরনের অনুসন্ধান শুরু করলেন? ইতিমধ্যে আমি সংসদ থেকে লাভজনক পদসংক্রান্ত বিল অনুমোদনের জন্য পেয়েছিলাম।
আমি বিল বিশ্লেষণ করে নানা অসংগতি খুঁজে পেয়েছিলাম। প্রস্তাবিত লাভজনক পদ বিলে, লাভজনক পদ বলতে কী বোঝায় এই প্রশ্নের মীমাংসার প্রতি আমি কোনও বিধিবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পাইনি। পরিবর্তে সাংসদ দ্বারা অধিকৃত পদের ক্ষেত্রে বর্তমান পদগুলোকে শুধু অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমি উচ্চতম ন্যায়ালয়ের পূর্বতন তিনজন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অসংগতিসমূহ ও আমার উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আমার সহকারীবৃন্দ এবং তিনজন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে একটা চিঠি তৈরি করেছিলাম। তাতে আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম বিলে অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে শর্তগুলি উল্লেখ করা উচিত, কেন কোনও বিশেষ পদকে লাভজনক পদের বিলের আওতা থেকে অব্যাহতি দেবে তার কারণগুলো যেন ‘সঠিক এবং যুক্তিপূর্ণ’ হয় এবং সমস্ত রাজ্যগুলি এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে তার প্রয়োগ যেন ‘স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ’ভাবে হয়। আরও একটা বিষয় আমি উত্থাপন করেছিলাম যে, পদের সঙ্গে সম্পর্ক খুঁজে নতুন আইন দ্বারা তাকে অব্যাহতি দিতে হবে। তাঁরা বলেছিলেন আমার উদ্বেগ অকৃত্রিম এবং কোনও বিশেষ পদ লাভজনক পদ বিলের এক্তিয়ারের মধ্যে আসছে কি না তা নির্ধারণ করার জন্য যথার্থ নিয়মনীতির প্রয়োজন আছে।
এবার প্রশ্ন হল আমার লাভজনক বিল সম্পর্কিত পত্র কি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় যাবে না সংসদে? সংবিধান ভাল করে পাঠ করে দেখলাম আর্টিকল III অনুযায়ী এটি আবার সংসদে পুনর্বিবেচনার জন্য পুনরায় উল্লিখিত হওয়া উচিত। অনুমোদনের জন্য লাভজনক পদ সংক্রান্ত বিল আমার কাছে মন্ত্রিসভা পাঠায়নি, পাঠিয়েছে সংসদ। তাই আমি বিলটি সংসদের উভয়কক্ষের পুনর্বিবেচনার জন্য লোকসভা ও রাজ্যসভার মহাসচিবের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। সংসদ বা রাষ্ট্রপতি ভবনের ইতিহাসে প্রথমবার এই ঘটনা ঘটল যে, একজন রাষ্ট্রপতি বিল পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠালেন। অবশ্যই পরের দিন, সংসদে বিল ফেরত পাঠানোর জন্য আমার চিঠিটি বৈদ্যুতিন আর সংবাদমাধ্যমে প্রধান আলোচ্য নিবন্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটা জোরদার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল। বিলে স্বাক্ষর করার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দল থেকে আমার ওপর খুব চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল।