আমি যখন রাষ্ট্রপতি ছিলাম তখন যে বিপুল পরিমাণ চিঠিপত্র, ই-মেল বা ওই ধরনের অন্যান্য বার্তা আসত তা দেখে আমি আশ্চর্য না হয়ে পারতাম না। কার কাছ থেকে না-আসত! বাচ্চা, যুবসমাজ, বয়স্ক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী সবার কাছ থেকে। অবিশ্বাস্যভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার চিঠি আসত। প্রতিটি চিঠির উত্তর দেওয়া বা প্রতিটি সাহায্যপ্রার্থীকে উপযুক্ত সাহায্য করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমরা চেষ্টা করতাম। বহু ক্ষেত্রে চিঠি নির্দিষ্ট বিভাগে, নির্দিষ্ট পদাধিকারীর কাছে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য পাঠাতাম। যদি কোনও চিকিৎসা সংক্রান্ত ঘটনা হত, আমরা উপযুক্ত হাসপাতালের খোঁজ জানাতাম। ক্ষেত্র বিশেষে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম যথার্থ উপদেশ বা পরামর্শ দেবার। এমনকী সামান্য আর্থিক সহায়তাও দেবার চেষ্টা করেছি। চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশের মানুষের আশা, বিশ্বাস এবং ইতিবাচক মনোভাবের যে পরিচয় পেতাম তা আমায় খুব আশ্চর্য করত। এর পাশাপাশি অবশ্যই যন্ত্রণাভোগ, বেদনা এবং দারিদ্র্যের বিশাল বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছিল। একজন তরুণীর লেখা একটা চিঠি আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। ওর পরিবার যে বিশেষ আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত সেকথা ও চিঠিতে জানিয়েছিল। আমি ওর লেখার মধ্যে একটা উদ্দীপনার আভাস পেয়েছিলাম এবং মনে হয়েছিল ওর জীবনের পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা আছে। আমরা চিঠিটা এক যোগ্য ব্যক্তিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম যার ফলে বিষয়টি একটি আশ্চর্যজনক পরিণতি হয়েছিল। চিঠিতে লেখা ছিল—
‘আমার পরিবার ভীষণ অশান্তির মধ্যে আছে। গত তেইশ বছর ধরে নানা সমস্যায় আমার পরিবার জর্জরিত। এমন একটা দিন নেই যেদিন আমি বা আমার পরিবার এক মুহূর্তের জন্য সুখের মুখ দেখেছি। আমি পড়াশোনায় ভাল ছিলাম— আমার সেন্টারে পঞ্চম শ্রেণিতে আমি প্রথম হয়েছিলাম। আমি ডাক্তার হতে চাইতাম কিন্তু পরে আর কখনও আমি প্রথম হইনি, সবসময় দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান পেতাম। বি এ পরীক্ষায় আমি মাত্র ৫০% নম্বর পেয়েছি। আমি ডাক্তারিতে ভর্তি হতে পারিনি, কেননা সবসময় আমি নানা সমস্যার চাপে থাকতাম। চোদ্দো বছর ধরে আমার এইভাবে কাটছে…।’
এ ধরনের অজস্র চিঠি আসত। রাষ্ট্রপতি দপ্তরের সাহায্য করার ক্ষমতার ওপর মানুষের বিশ্বাস, তাদের সততা এবং কপটতাহীনতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করত।
এর বিপ্রতীপে বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান থেকে আসা চিঠিপত্রও ছিল— ‘প্রিয় রাষ্ট্রপতি কালামজি, আমরা অ্যাডভান্সড ন্যানো টেকনোলজির ওপর (বা অন্যান্য কোনও বিশিষ্ট বিষয়, যেমন— জীব বৈচিত্র্য, কার্বন কম্পোসিটস, মহাকাশযাত্রা পুরশ্চালন প্রযুক্তি, কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি, সংক্রমণশীল রোগ আদালতে অমীমাংসিত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির কৌশল বা বৈদ্যুতিন শাসনপ্রক্রিয়া) একটা অধিবেশনের আয়োজন করেছি। এবং আমরা আশা করছি যে আপনি মূল বক্তব্য রাখুন…’ অবশ্যই এগুলোর উত্তর দেওয়া অনেক সহজতর ছিল আমার কাছে— কারণ এগুলো শুধুমাত্র তারিখনির্ভর এবং বিষয়টি সম্বন্ধে আমার জ্ঞান সম্পর্কিত। জীবনের সফল হওয়ার জন্য একটা সুযোগ প্রত্যাশী তরুণী এবং আধুনিক প্রযুক্তি অধিবেশন উভয়েই বিশেষ দুটি দিক যা ২০২০-এর ভারতবর্ষর উদ্দেশে বলা প্রয়োজন।
এইসব ভাবনাচিন্তা থেকে আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমার এর পরে কী করা উচিত? আমার কি উচিত শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করা, নাকি অন্য কিছুর চেষ্টা করা? স্থির করতে পারছিলাম না। একটা মূল ঘটনা সেদিন কাজটাকে একটু সহজতর করে দিয়েছিল— জাতির উদ্দেশে আমার বিদায়ী ভাষণের প্রস্তুতি।
আমি ঠিক করেছিলাম— বিদায়ী ভাষণে আমি ভারতবর্ষের সমস্ত নাগরিককে ধন্যবাদ জানাব এবং তাঁদের সঙ্গে ভারতের উন্নয়নের রেখাচিত্র সম্বন্ধে মত আদানপ্রদান করব। যা গত পাঁচ বছরে তাঁদের সঙ্গে এবং তাঁদের জন্যই বিকশিত হয়েছে।
মূল কথা, আমি তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলাম— আমার প্রিয় নাগরিকবৃন্দ আমাদের দেশের লক্ষ্য উপলব্ধি করে আসুন সকলে মিলে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার সংকল্প করি। আমাদের দেশের লক্ষ্য হল সমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ এবং সুখী হওয়া ও নিরবচ্ছিন্নভাবে উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া, যেখানে গ্রামীণ আর নাগরিক বিভাজন একটা সূক্ষ্মরেখায় পর্যবসিত হয়— প্রশাসন যেখানে সংবেদনশীল, পরিচ্ছন্ন এবং দুর্নীতিমুক্ত হয়। উন্নত ভারতবর্ষের জন্য দশ দফা রেখাচিত্রের মধ্যে আরও অন্য কিছু বিষয় আমি কল্পনা করেছিলাম, সেগুলি এই বইতে বলেছি।
আমার জীবনের ব্রত হল, ভারতবর্ষের মতো বহু সংস্কৃতি সম্পন্ন সমাজের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ও মনন উন্নয়নের দশটা স্তম্ভের মধ্য দিয়ে সংযোগ স্থাপন করা এবং ‘আমরা করতে পারি’ এই আত্মবিশ্বাস মানুষের মধ্যে প্রোথিত করা।
২০২০ সালের আগেই ভারতবর্ষকে এক উন্নত দেশ তৈরি করার যে মহান ব্রত নেওয়া হয়েছে তা সফল করার জন্য হে নাগরিকবৃন্দ আমি সবসময় আপনাদের সঙ্গে থাকব।
.
কিছু ঘটনা আমার দিগন্তকে আলোকিত করেছিল। আমার মুখে হাসি ফুটিয়েছিল, আমায় শিক্ষাদান করেছিল এবং দেশের মানুষের ভালবাসা আমায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছিল।
০২. আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নবম ভাষণ
২. আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নবম ভাষণ