সেসময় আমায় ভাবী রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করতে হয়েছিল।
সবরকম বিদায় সংবর্ধনা, সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা এবং আমার সামান্য ক’টি জিনিসপত্র দুটি সুটকেসে গোছানোর তদারকি করা— আমি বলে রেখেছিলাম ও-দুটোই শুধু আমি সঙ্গে নেব, এর মধ্যে বাতাসে যেন কোনও অব্যক্ত ভাবনা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। যারা যারা আমার সঙ্গে দেখা করেছে বা কথা বলেছে একটা প্রশ্ন তাদের সকলের মনে উঁকি মেরেছে যে, আমি এরপর কী করব? তা কি আমি চিন্তা করেছি? আমি কি আবার শিক্ষকতায় ফিরে যাব নাকি আমার সক্রিয় জীবন থেকে অবসর নেব? আমায় যে চেনে তার কাছে শেষের কথাটা অসম্ভব বলে মনে হবে। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি ভবনের শেষ পাঁচটা বছর আমার মনে ভীষণ সজীব। মুঘল গার্ডেনের ফুল দিয়ে আমায় অভ্যর্থনা জানানো আমার আজও মনে আছে। যে বাগানে ওস্তাদ বিসমিল্লা খান তাঁর শেষ অনুষ্ঠান করেছিলেন। এরকম অসংখ্য গুণী শিল্পী ওখানে গানবাজনা করে মানুষকে আনন্দ দান করেছিলেন। বাগানের সুন্দর সুবাস, নৃত্যরত ময়ূর, গ্রীষ্মের দাবদাহে প্রখর-দীপ্ত সূর্যের নীচে বা কনকনে শীতের দংশনে কর্তব্যে অবিচল প্রহরী আমার দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল। এই পাঁচ বছরে কী সমৃদ্ধ জীবন-অভিজ্ঞতা!
জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষজন দেশের উন্নতির জন্য নানা ধ্যানধারণার কথা আমায় শুনিয়েছে। তারা একে অপরকে ছাপিয়ে বলতে চেষ্টা করেছে যে, কীভাবে তারা দেশের জন্য নিজেদের যথাসাধ্য দিয়েছে। প্রতিটি স্তরের রাজনীতিকরা তাঁদের নির্বাচন ক্ষেত্রের উন্নতির জন্য নিজেদের চিন্তাভাবনার কথা আমায় জানিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা জরুরি বিষয়গুলির সমাধানের জন্য সুতীব্র আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ভারতবর্ষের প্রতি তাঁদের ভালবাসা গুণী শিল্পী এবং লেখকরা সুললিত ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। ধর্মীয় নেতারা এক সাধারণ মঞ্চ থেকে ধর্মীয় সামঞ্জস্য এবং অভিন্ন মনের কথা বলেছেন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা এক জ্ঞানসমাজ গড়ে তুলতে নিজেদের চিন্তা ভাগ করে নিয়েছেন। আইন এবং বিচার বিভাগ প্রায়শই নানা সাম্প্রতিক বিষয়, যেমন— সর্বসাধারণের প্রতি পক্ষপাতহীন বিচারব্যবস্থা, অমীমাংসিত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও ই-জুডিশিয়ারি বিষয়ে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। যখনই কোনও অনাবাসী ভারতীয়র সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে তাঁরা জন্মভূমি ভারতবর্ষের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য কিছু করতে চেয়েছেন।
দেশের নানা প্রান্তে ঘুরতে পারা, আমায় এক অনন্য অভিজ্ঞতার আস্বাদ দিয়েছে— বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের চাওয়া-পাওয়া, আকাঙ্ক্ষা আমি বুঝেছি। বুঝেছি কত ভাল কাজ হয়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা, উপলব্ধি করেছি যৌবনের অপরিসীম শক্তিকে।
চিকিৎসাশাস্ত্র সংক্রান্ত ক্ষেত্রে আমার বিস্তারিত যোগাযোগ, সেটা প্রত্যন্ত গ্রামের প্রতিটি মানুষের কাছে উপযুক্ত চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছনো হোক বা গবেষণায় উৎসাহ প্রদান, প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন সহজতর করা হোক বা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের প্রতি যত্নশীল হওয়া বা প্রতিষেধক স্বাস্থ্য পরিষেবার বার্তা প্রচারই হোক, সর্বত্র।
দেশে বা বিদেশে যে নার্সদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে তাঁরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে উন্নতমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র স্থাপন করেছেন, বিশেষত গ্রামবাসীদের জন্য।
কৃষক, বিশেষত দুঃস্থ তুলো-চাষিদের সঙ্গে আমার আলাপ হওয়ার দরুন তাঁদের সমস্যা এবং যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তাঁরা হয়েছিলেন তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাঁরা আমার ভাবনাগুলো সূত্রাকারে সাজাতে এবং কৃষিবিজ্ঞানীদের কাছে পেশ করতে সহায়তা করেছিলেন।
ডাকবাহক বা পোস্টম্যানদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার আমার মনে এই ভাবনা উসকে দিয়েছিল যে, ডাকসংযোগ ব্যবস্থা জ্ঞানসমাজে এক মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, যেখানে পোস্টম্যান গ্রামে-গঞ্জে জ্ঞান-আধিকারিক হতে পারেন।
পুলিশবাহিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পুলিশ বিভাগের সংস্কারের নানা পরিকল্পনার কথা আমায় জানিয়েছিল। পুলিশ স্টেশনের পরিকাঠামোর উন্নয়ন এবং পুলিশি ক্রিয়াকলাপে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ ইত্যাদি পরিকল্পনা, যা আমি পুলিশ বিভাগ পুনর্গঠন ফোরামে ভাগ করে নিয়েছিলাম।
পঞ্চায়েত সভাধিপতি, বিশেষত মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানরা গ্রামীণ উন্নয়ন ও বিকাশের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং বিশ্লেষণ করেছিলেন তাঁদের কী কী প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হয়।
যত জায়গায় আমি গেছি, সেখানকার শিক্ষকরা আমায় এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তাঁদের লক্ষ্য হল দেশগঠনের জন্য যুবসমাজকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। তাঁরা বলেছিলেন, তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করবেন যুবক-যুবতীদের মধ্যে সেই মূল্যবোধ জ্ঞাপন করার, যা তাদের আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক করে গড়ে তুলবে।
এসমস্ত সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা শপথ পরিকল্পনায় একত্রে জড়ো করা হয়েছিল, যা সমাজের বিভিন্ন অংশের দ্বারা গৃহীত আকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপের সংক্ষিপ্তসার। তা শিশু, অভিভাবক, শিক্ষক, সেনাকর্মী, প্রশাসন বিভাগের কর্মী, আইনজীবী, ডাক্তার, নার্স বা অন্যান্য যে-কেউ হোক না কেন। শপথের পরিচালনা এমনভাবে হয় যাতে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে আন্তঃক্রিয়া ঘটে। সাধারণত শপথে সমাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা প্রাসঙ্গিক পাঁচ, সাত বা দশটি বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত হয়। শপথ গ্রহণের সময় স্বাভাবিকভাবে অনেক মানুষ একত্রিত হন এবং শপথের কথাগুলি পাঠ করা সমস্ত শ্রোতাদের এক সাধারণ সূত্রে গ্রন্থিত করে। তাঁদের এমন কিছু মর্মবাণী দেওয়া হয় যা তাঁরা আজীবন বহন করতে পারেন।