রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালের প্রথম দিকে আমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রাতরাশকালীন আলোচনায় রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সংসদ সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো, যাতে আমি সেখানকার উন্নয়ন অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারি। ২০০৩ সালে এই বৈঠক ১১ মার্চ থেকে ৬ মে এই তিন মাস হয়েছিল। আমার মনে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।
প্রতিটা বৈঠকের উদ্দেশ্য পরিকল্পনামাফিক সাজানো হত। আমি এবং আমার সহযোগীরা তার জন্য বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় নিতাম। আমরা প্রতিটা রাজ্যের সামর্থ্য এবং উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটা গবেষণার ব্যবস্থা করতাম। প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি পরিকল্পনা কমিশন, কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারি বিভাগ, রাজ্যগুলির জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক দস্তাবেজ থেকে সংগ্রহ করা হত।
তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করে গ্রাফিক্স এবং মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে উপযুক্তভাবে পেশ করা হত। বৈঠকগুলোতে সংসদের সদস্যদের জন্য পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানানো হত তিনটি ক্ষেত্রের ওপর জোর দিয়ে। ১. উন্নত ভারতের স্বপ্ন ২. বিশেষ কয়েকটা রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের উত্তরাধিকার এবং ৩. তাদের মূল দক্ষতা।
উদ্দেশ্য ছিল দেশের উন্নতি অর্জনের জন্য লক্ষ্যের ওপর জোর দেওয়া। এইসমস্ত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে উন্নতি অর্জন অত্যন্ত জরুরি ছিল। এর ফলে চতুর্থ দিকটাও তৈরি করা হল— প্রতিটি রাজ্যর জন্য উন্নয়নসূচক নির্বাচন করা হল। সমস্ত দলের সংসদ সদস্যদের প্রস্তুতি এবং নিবেদনের দ্বারা কী অসামান্য সমৃদ্ধসাধন ঘটল। ওঁদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সমৃদ্ধি সম্বন্ধে উপলব্ধি করতে আমাকে সাহায্য করেছিল।
আমার প্রথম বৈঠক বিহার থেকে আগত সাংসদের সঙ্গে ছিল। প্রেজেন্টেশনের বিষয়ে সদস্যদের উদ্দীপনা দেখে আমি প্রবল উৎসাহিত হয়ে পড়লাম— প্রেজেন্টেশনে বিহার সম্পর্কিত জাতীয় উন্নয়নে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, রাজ্যের মূল দক্ষতা এবং কীভাবে রাজ্যকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব অন্তর্ভুক্ত হয়। সাংসদদের মনে হয়েছিল বৈঠক অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। ফলে আমরা প্রাতরাশকালীন আলোচনা ৬০ মিনিট থেকে বাড়িয়ে ৯০ মিনিট করেছিলাম। আমাদের সন্তোষজনক অভিজ্ঞতা হয়েছিল যখন বৈঠকে মীমাংসা হওয়ার পরেও বা প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হয়ে গেলেও অনেক সদস্য তাঁদের নিজেদের রাজ্যে প্রেজেন্টেশনের প্রযোজ্যতা নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এই বৈঠকগুলো নথিবদ্ধ করে রাখা হত।
ব্যক্তিগতভাবে আমি বৈঠকগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতাম। প্রতিটি অঞ্চলের চাহিদা আমার পক্ষে প্রকৃত শিক্ষা ছিল। এই প্রস্তুতি সাংসদদের আয়ত্তাধীন ক্ষেত্র থেকে পরিযোজনের দ্বারা সম্পূরিত হত। অনেক সদস্য আমায় এও বলেছিলেন, এই ধরনের বিস্তৃত প্রস্তুতি তাঁদের পক্ষে খুব কার্যকরী হয়েছিল। আসল কথা হল এই খুঁটিনাটি এবং আলোচনা রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালে বা পরবর্তী সময়ে আমার এবং সাংসদদের মধ্যে বিশেষ যোগাযোগবন্ধন হয়ে উঠেছিল। এখনও, যখন ওঁদের সঙ্গে আমার দেখা হয়, আমাদের কথোপকথন এবং আলোচনা উন্নয়নভিত্তিক হয়ে থাকে।
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাওয়া পরিযোজন-সহ ইন্ডিয়া ২০২০ ক্রমবিবর্তন আমাকে সমাজ সংক্রান্ত রূপান্তরের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে মনোনিবেশ করাত। প্রাতরাশকালীন বৈঠকে রাজ্যগুলির বিস্তারিত আলোচনা আমাকে উন্নয়নের জন্য পথপ্রদর্শনে অতিরিক্ত নিশ্চয়তা দিয়েছিল। সাংসদরা অনেক প্রয়োজনীয় ধারণার কথা আমায় জানাতেন। সংসদে অন্ততপক্ষে ন’বার আমি ২০২০ সালে ভারতের স্বপ্ন নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছি এবং বারোটা রাজ্য বিধানসভায় কোনও একটা বিশেষ রাজ্যের উন্নয়নের উপায় নিয়ে অভিভাষণ দিয়েছিলাম। প্রাতরাশকালীন বৈঠকে যে ধরনের প্রশ্ন ও পরামর্শ আমার কাছে আসত, তার দ্বারা রাজ্যগুলির উন্নয়নে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয়তাকে একত্রিত করার রাস্তা তৈরি হত, যেমন কর্মসংস্থান বাড়ানো, জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র সক্রিয়করণ, গ্রামীণ অঞ্চলের যোগাযোগের উন্নতিসাধন এবং আমার ডাটাবেস বা তথ্যসংগ্রহে শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষসাধন। আমি সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে যা বক্তব্য রেখেছিলাম তা এই ডাটাবেস-এ অন্তর্ভুক্ত ছিল। যখন আমি জাতীয় এবং রাজ্য বণিকসভা, শিল্প মহল, পরিচালন সংঘ, কারিগরি প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতাম তখন কীভাবে ইন্ডিয়া ২০২০ অর্জন করতে পারব সে-বিষয়ে উদাহরণযোগে ব্যাখ্যা করতে এই ডাটাবেস বা সূত্রসংগ্রহ সহায়ক হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে যুক্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় এই স্বপ্নের অংশ হিসেবে উন্নয়নের দশটা স্তম্ভের উদ্ভব ঘটেছিল। আজ আমি পেশাদার, বণিকনেতা এবং গবেষকদের উদ্দেশে বলি এই দশ স্তম্ভ অর্জন করতে কীভাবে তাঁরা উদ্ভাবনী ধারণা নিবেদন করতে পারেন, যেমন—
১. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে গ্রামীণ এবং নাগরিক বিভাজন এক ক্ষীণরেখায় অবনমিত হয়।
২. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে শক্তি এবং উৎকৃষ্ট জলের যথাযথ বণ্টন এবং যথেষ্ট অধিগম্যতা থাকে।
৩. এমন এক রাষ্ট্র যেখানে কৃষি, শিল্প এবং সেবাবিভাগ এক ছন্দে কাজ করে।