আমি তাঁদের জানিয়েছিলাম, যদি অধিকাংশ দল রাজি থাকে তবে আমি প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা বিবেচনা করে দেখতে পারি। নেতারা ফিরে এসে জানালেন শাসক দল আমার প্রার্থীপদে রাজি নয়। কিন্তু তাঁরা আমার সাফল্য সম্পর্কে এতটা নিশ্চিত ছিলেন যে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আমায় পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলেন। সমস্ত দ্বিধা সরিয়ে দিয়ে আমি তাঁদের বলেছিলাম, যদি তাই হয় আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবই না কারণ আমি বিশ্বাস করি রাষ্ট্রপতি ভবনকে কোনও দলীয় রাজনীতির মধ্যে নিয়ে আসা উচিত নয়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও নেতারা রাজি হলেন। প্রেস বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আমি প্রার্থী হচ্ছি না। শিক্ষা বিষয়ক এবং গবেষণা বিষয়ক কর্মজীবনে ফেরার জন্য এবং ভারতবর্ষকে ২০২০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী দেশে রূপান্তর করার তীব্র আবেগ-সহ কাজ চালানোর ইচ্ছে থেকে আমি সচেতনভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
.
আমি সব সময় বিশ্বাস করি কাপুরুষ কখনও ইতিহাস রচনা করতে পারে না, ইতিহাস সৃষ্টি করে মানুষ, যাদের মধ্যে সাহস এবং প্রাজ্ঞতা আছে। সাহসিকতা একক, প্রাজ্ঞতা আসে অভিজ্ঞতা থেকে।
০৪. মতভাব বিনিময়কারী রাষ্ট্রপতি
৪. মতভাব বিনিময়কারী রাষ্ট্রপতি
সক্ষমতা নিজের অন্তর থেকে আসে,
ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ তা দিতে পারে না
রাষ্ট্রপতি পদগ্রহণ আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল। ইন্ডিয়া ২০২০ কে রূপদান করার ক্ষেত্রে এটা একটা মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। আমি বিশ্বাস করি দেশের সকল নাগরিকের যেমন, সংসদ-অভিমুখী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, প্রশাসক, শিল্পী, লেখক এবং দেশের যুবসমাজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একে অর্জন করা সম্ভব। এই মিশন বা লক্ষ্যের প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করানোর জন্য মুখোমুখি আলোচনাই সবচেয়ে শ্রেয় উপায়, যা অন্যের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকেও এর সঙ্গে সম্মিলিত করতে সাহায্য করবে।
রাষ্ট্রপতি পদ আমায় এই সুযোগ দিয়েছিল। আমি সরাসরি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, বিশেষত যুবসমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদেরকে দেশের জন্য এই লক্ষ্য কার্যে পরিণত হওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে পারছিলাম।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার ভূমিকার এটা একটা অতিরিক্ত উদ্দেশ্য ছিল। সাংবিধানিক ভূমিকানুযায়ী সরকার এবং বিধানমণ্ডলের প্রতিটি কার্য যাতে ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী সম্পাদিত হয় সে-ব্যাপার রাষ্ট্রপতি সুনিশ্চিত করবেন। সরকারের প্রতিটি কার্য ভারতের রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয়। সংসদে বিল ও অধ্যাদেশ পাশ হলে সরকার রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর অনুমোদনের জন্য আসে। এবং তাঁকে নিশ্চিত হতে হয় যে, সেই আইন সংক্রান্ত নথি সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের মঙ্গলসাধনে সক্ষম। তাঁকে আরও দেখতে হয় যে, পক্ষপাতদুষ্ট কার্যে পরিণত হওয়ার মতো কোনও পূর্বদৃষ্টান্ত যেন স্থাপিত না হয়।
আমি রাষ্ট্রপতি প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির মধ্যে যাব না। যদিও এগুলো সংবিধান, ঐতিহ্য এবং পূর্বদৃষ্টান্ত দ্বারা পূর্বনির্দিষ্ট, আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি শুধু দেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হয়ে না থেকে আরও অনেক কিছু করার অপেক্ষা রাখেন।
সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করবার সুযোগ আছে, সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগে অনুঘটকের কাজ করে উন্নয়নখাতে যেমন অর্জন সম্ভব। রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁকে ক্ষমতাসীন দল বা জোটের শক্তি ব্যক্তিগতভাবে মূল্যায়ন করতে হয়, যাতে তারা সংখ্যায় যথেষ্ট না হওয়ার দরুন যে-কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারে। রাজ্যপাল এবং তাঁদের রাজ্যসমূহের কার্যকলাপের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিচক্ষণ পরামর্শদান এবং সামরিক শক্তির সর্বাধিনায়ক হওয়ায় তাদের অনুকরণীয় অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে উদ্বুদ্ধ করতে হয়।
উপরন্তু, দেশের প্রধান হওয়ায় তিনি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। আমার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি ভবনকে আরও বেশি মানুষের সহজগম্য করে তোলা যাতে তা মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকে। মানুষকে নিজেদের দেশের বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির অন্যতম অংশ হিসেবে বিবেচনা করানোর এবং শাসনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত করানোর এই ছিল আমার পদ্ধতি। ফলে, রাষ্ট্রপতি হয়েও আমি মানুষের জীবনযাত্রার অঙ্গ ছিলাম এবং এই প্রতিষ্ঠানটি অনেক বেশি পারস্পরিক প্রভাব বিস্তারকারী ছিল।
প্রথম যে কাজগুলো আমি রাষ্ট্রপতি ভবনে শুরু করি তার মধ্যে অন্যতম হল ই-গভর্ন্যান্স চালু করা। ওখানে কম্পিউটার ব্যবহার করা হত কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সেই প্রণালীকে আরও আধুনিক করার প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে যে-সমস্ত নথি, দস্তাবেজ এবং চিঠিপত্র আসত আমরা একটা ব্যবস্থা নিয়েছিলাম যে, প্রথমেই সেগুলো ডিজিটাইজ়ড বা আঙ্কিক করা ও তাতে বার কোড বসানো। কাগজের নথিগুলো তারপর মহাফেজখানায় সংরক্ষিত হবে। তারপর থেকে নথি বৈদ্যুতিনভাবে বিভিন্ন সরকারি আধিকারিক, অধিকর্তা, সচিবের দপ্তরে, রাষ্ট্রপতির কাছে গুরুত্বানুসারে পাঠানো হত।
আমার এমন এক প্রক্রিয়ার স্বপ্ন ছিল যার দ্বারা রাষ্ট্রপতি ভবন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, সমস্ত রাজ্যপালের দপ্তর এবং নানা মন্ত্রকের সঙ্গে সুরক্ষিত মেসেজিং নেটওয়ার্কের দ্বারা, সঙ্গে G২G ই-গভর্ন্যান্স অপারেশনে সক্ষম ডিজিটাল সিগনেচার সংযুক্ত থাকে। আমরা প্রক্রিয়াটি পরীক্ষা করেছিলাম এবং সেটা প্রয়োগের জন্য তৈরি ছিল। আশা করা যায় একদিন আমার স্বপ্ন সত্যি হবে। যখন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের নয়টি বিভাগে আমরা বৈদ্যুতিন শাসনব্যবস্থা বা ই-গভর্ন্যান্স প্রয়োগ করলাম, পরীক্ষা করে দেখলাম এটা সত্যি কার্যকারিতা সহায়ক কি না। সাধারণত নাগরিকদের কাছ থেকে দরখাস্ত পাবলিক-১ বিভাগে দাখিল হত। একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কুড়িটা দরখাস্তের সাধারণত সাতদিন সময় লাগত, কিন্তু বৈদ্যুতিন শাসনব্যবস্থা বা ই-গভর্ন্যান্স চালু হওয়ার পর দেখা গেল চল্লিশটা দরখাস্তের ফয়সালা মাত্র ৫ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে যায়। আমি আশা করি বিভিন্ন রাজ্যে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে গেলে এই ব্যবস্থাগুলি যে কেউ দেখতে পাবেন।