.
সাত : শিক্ষক
দেশের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ধরে দেড় কোটির বেশি স্কুলপড়ুয়ার সঙ্গে আমার সংযোগ ঘটেছে। অরুণাচল প্রদেশ হোক, নাগাল্যান্ড হোক বা মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত বা কর্ণাটক হোক, অথবা জম্মু ও কাশ্মীর বা ভারতের অন্য যে-কোনও অংশ হোক— যুবকণ্ঠস্বরটি অনন্য এবং পরাক্রমী। তারা তাদের লক্ষ্যে দৃঢ় ও অচঞ্চল, এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে উদ্যোগী। তাদের সকলের স্বপ্ন, তারা বাস করবে এক সমৃদ্ধশালী ভারতে, এক সুখী ভারতে, এক শান্তির ভারতে, এবং এক নিরাপদ ভারতে। সমৃদ্ধি, সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তাকে মিলতে হবে এক বিন্দুতে, তবেই ভারত হবে এক আদর্শ উন্নত রাষ্ট্র। এবং আমাদের সন্তানদের স্বপ্ন ও লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে পারে যে চালকযন্ত্র তা হল শিক্ষকসমাজ। আমি যখনই কোনও শিক্ষার্থী আর শিক্ষকদের সমাবেশে ভাষণ দিতে যাই, আমি অনুভব করি যে আমি মিলিত হচ্ছি এমন একটি গোষ্ঠীর ছোট্ট এক অংশের সঙ্গে যারা ভারতের ভবিষ্যৎ গড়ার ভিত্তি তৈরি করবে। শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীর মনকে প্রজ্বলিত করে দেন। সরকারি হিসেবমতে দেশে সাড়ে ষাট লক্ষ স্কুলশিক্ষক আছেন। এঁরা প্রত্যেকেই এক একটি প্রজ্বলিত দীপ যা আলোকিত করে দেয় আরও বহুজনকে। ছেলেমেয়েরা গড়ে ২৫,০০০ ঘণ্টা অতিবাহিত করে তাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। সুতরাং শিক্ষকদের কাছে অনেকটাই সময় থাকে তাঁদের পড়ুয়াদের সামনে রোল মডেল হয়ে নিজেদের দাঁড় করাতে।
আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?
আমরা প্রত্যেকেই শিক্ষার বিভিন্ন স্তর পার হয়ে এসেছি। আমি কখনও কখনও ভাবি যে, ওই প্রতিটি স্তরে মানুষের চাহিদা সম্পর্কে আমাদের প্রতিক্রিয়া আমরা কেমনভাবে প্রকাশ করি? শিশু প্রশ্ন করে, ‘আমার জন্য তুমি কী করতে পার?’ কিশোর বলে, ‘আমি নিজেই করে নিতে চাই।’ যুবক সোচ্চারে বলে ওঠে, ‘চল সকলে মিলে করি।’ নেতা বলেন, ‘আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’ শিক্ষকরা, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বা প্রধান, তাঁরা এক শিশুকে এক নেতায় রূপান্তর করে দিতে পারেন— ‘আমার জন্য তুমি কী করতে পার?’ থেকে ‘আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’-তে। এটি করতে গেলে তাঁদের দ্রষ্টা হতে হবে। সঙ্গে থাকতে হবে অনুপ্রেরণা দেবার ক্ষমতা। অধ্যক্ষদের এটাও দেখতে হবে যে, শিক্ষকরা যেন এমনভাবে শিক্ষা দেন যাতে শিক্ষার্থীদের ভিতরের শ্রেষ্ঠ গুণগুলি প্রকাশ পেতে পারে। এটি করতে গেলে অধ্যক্ষকে এক আদর্শ শিক্ষক হতে হবে।
আমি নিশ্চিত যে, শ্রেষ্ঠ মনন প্রকাশ পেতে পারে একমাত্র অধ্যক্ষ, শিক্ষক আর অভিভাবকের এক যৌথ প্রভাবে।
ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময়
মানুষের মন এক অনন্য উপহার যেন। আপনার যদি অনুসন্ধিত্সা থাকে আর আপনি যদি চিন্তাশীল হন, তবেই আপনি, আমি যাকে বলি ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময়, তাতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবেন। আপনার জীবনযাপনে যতই চড়াই-উতরাই থাক, এই কৌতূহল আর চিন্তাশক্তি আপনার সব থেকে মূল্যবান সম্পদ। চিন্তাই প্রগতি। অ-চিন্তা একটা মানুষের জীবনে বা কোনও প্রতিষ্ঠানে বা দেশে এনে দেয় এক বদ্ধ অবস্থা। চিন্তাই জন্ম দেয় ক্রিয়াশীলতার। ক্রিয়া ছাড়া জ্ঞান অর্থহীন এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। জ্ঞানের সঙ্গে ক্রিয়া নিয়ে আসে সমৃদ্ধি।
শিক্ষকদের উচিত তরুণ মনের লালন করে মানবজীবনের প্রতিটি দিকের অন্বেষণ করা। আকাশের দিকে তাকান। আমরা সেখানে একা নই। সারা ব্রহ্মাণ্ড আমাদের সাথি। যাঁরা স্বপ্ন দেখতে চান তাঁদেরই সে দেয় তার শ্রেষ্ঠ দান। সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের ক্ষেত্রে যেমন। তারাদের বিবর্তন সম্পর্কে তাঁর গাণিতিক বিশ্লেষণ, বৃহদাকার তারাদের এবং কৃষ্ণ গহ্বরগুলির বিবর্তনের পরবর্তী পর্যায়গুলি সম্পর্কে এখনকার চলতি বেশ কয়েকটি তাত্ত্বিক মডেল তৈরিতে সাহায্য করেছে। কেন কিছু তারা জ্বলজ্বল করে আর কেন কিছু মরে যায়, তাঁর সেই কৌতূহলী প্রশ্ন থেকেই শুরু তাঁর অনুসন্ধান। আজ Chandrasekhar Limit ব্যবহার করে আমরা গণনা করতে পারি সূর্য আর কতদিন তার আলো বিচ্ছুরণ করতে পারবে।
অথবা নেওয়া যাক স্যার সি ভি রমনের উদাহরণ। সমুদ্র আর আকাশের দিকে চেয়ে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, সমুদ্রকে কেন নীল হতে হল। এর থেকেই জন্ম হল Raman Effect-এর। তিনি দেখলেন সমুদ্রের নীল রং আলোর অণুর বিচ্ছুরণের ফলে হয়। সাধারণ মানুষ যেমন ভাবেন আকাশের প্রতিফলনের কারণে হয়— তা কিন্তু নয়। কিংবা অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, যিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হল কীভাবে। তার থেকেই জন্ম হল সেই বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2, যা ঘটিয়ে দিল নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যায় এক বিপ্লব।
ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ১৯৬০-এর দশকে। প্রোফেসর বিক্রম সারাভাই ভারতকে দেখালেন সম্পূর্ণ দেশজ অন্তরিক্ষ প্রকল্পের স্বপ্ন। তিনি বললেন, ভারতের উচিত নিজস্ব রকেট সিস্টেম এবং যোগাযোগ ও রিমোট সেন্সিং উপগ্রহ নির্মাণ করে নিজস্ব কেন্দ্র থেকে তা উৎক্ষেপণ করা। তিনি যে স্বপ্নগুলি দেখেছিলেন আজ ভারতের কাছে সব কিছুই মজুত।
সকল শিক্ষককে অনুরোধ করতে চাই যে, তাঁরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের স্যার সি ভি রমন বা অ্যালবার্ট আইনস্টাইন অথবা সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর বা বিক্রম সারাভাইর মতো মহান চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন যদি। আমি তাঁদের উদ্দেশে বলব যে, ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময় অবলোকন করে উপলব্ধি করুন যে, আপনার মধ্যে আছে সেই ক্ষমতা যা বিরাট বিরাট চিন্তাবিদের জন্ম দিতে পারে।