এ সময় অধ্যাপক সারাভাই একটা ভারতীয় এসএলভির জন্য তার স্বপ্ন পূরণ করতে একটা দল গড়ে ফেলেন। প্রকল্পের নেতা হতে পারায় নিজেকে আমি ভাগ্যবান মনে করতে পারি। অধ্যাপক সারাভাই এসএলভির চতুর্থ পর্যায়ের নকশা তৈরির অতিরিক্ত দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করেন। অন্য তিনটি পর্যায়ের নকশা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় ড, ভিআর গোয়ারিকর, এমআর কুরুপ এবং এই মুথুনায়াগামের ওপর।
এমন একটি বিশাল কাজে আমাদের কজন মাত্র কর্মীকে লাগানোর ভাবনা এসেছিল কীভাবে অধ্যাপক সারাভাইয়ের মাথায়? একটা কারণ হতে পারে আমাদের পেশাগত অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাদীক্ষা। ড, গোয়ারিকর অনন্যসাধারণ কাজ করছিলেন। কম্পোজিট প্রোপেল্যান্টের ক্ষেত্রে। এমআর কুরুপ একটা চমৎকার গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রোপেল্যান্ট, প্রপালসন ও পাইরোটেকনিকের জন্য। হাই এনার্জি প্রোপেল্যান্টের ক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন মুথুনায়াগাম। চতুর্থ স্তরটা ছিল একটা কম্পোজিট স্ট্রাকচার আর তাতে প্রয়োজন হয়েছিল ফেব্রিকেশন টেকনোলজির ব্যাপক নব-উদ্ভাবন। হয়তো এ জন্যই আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল।
চতুর্থ স্তরটার ভিত্তি স্থাপন করলাম আমি দুটো পাথরের ওপর নিশ্চিন্ত অবলম্বন। আমি সবসময় ভুলভ্রান্তিকে গ্রহণ করতাম শিক্ষাপ্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে। নিখুঁতভাবে কাজ করার জন্য আমি দুঃসাহসিক হতেও পছন্দ করি। আমার দলের সবার উদ্যোগগুলোর প্রতি সবার মনোযোগও শেখার অংশ হিসাবে আমি সমর্থন করি। সে তারা সফল হোক, বা ব্যর্থ।
আমার দলে প্রতিটা ক্ষুদ্র পদক্ষেপেই অগ্রগতির বিষয়টা স্বীকতি পেত আর নতুন শক্তি তাতে সন্নিবেশ করা হতো। চতুর্থ স্তর নির্মাণে আমার সহযোগী কর্মীদের আমি প্রয়োজনীয় সব তথ্য সরবরাহ করতাম। কিন্তু দরকারি উৎসের জন্য পুরোপুরি কাজে লাগতে পারছি কিনা তাতে আমার সন্দেহ ছিল। যে ভাবে আমি সময় ম্যানেজ করছিলাম তাতে কোনো ভুল থেকে যাচ্ছে কিনা, তা আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলল। এ পর্যায়ে অধ্যাপক সারাভাই আমাদের কাজের জায়গায় একজন ফরাসি ভিজিটরকে আনলেন, যিনি আমার কাছে সমস্যাগুলো তুলে ধরবেন। এই ভদ্রলোক ছিলেন ফ্রান্সে আমাদের সহযোগী CNES (Centre Nationale de Etudes Spatiales)-এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক কুরিয়েন। ওই সংস্থাটি তখন তৈরি করছিল ডায়মন্ট লঞ্চ ভেহিকল। অধ্যাপক কুরিয়েন ছিলেন আগাগোড়া পেশাদার। অধ্যাপক সারাভাই ও অধ্যাপক কুরিয়েন এক সঙ্গে মিলে আমাকে একটা লক্ষ্যস্থির করতে সাহায্য করেছিলেন। যে সব উপায় অবলম্বন করে আমি সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব তা নিয়ে আলোচনা করার সময় তারা আমাকে ব্যর্থতার সম্ভাবনা সম্পর্কেও সতর্ক করে দিলেন। অধ্যাপক কুরিয়েনের সহযোগিতামূলক শলাপরামর্শের ভেতর দিয়ে চতুর্থ স্তরের সমস্যাগুলো আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যেত। অধ্যাপক সারাভাইয়ের তাড়নায় অধ্যাপক কুরিয়েন তার নিজের ডায়মন্ট কর্মসূচির সাফল্য বার বার ব্যাখ্যা করে শোনাতেন আমাদের।
অধ্যাপক কুরিয়েন ছোটোখাটো কাজ থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বড়ো সাফল্য অর্জনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য অধ্যাপক সারাভাইকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমাদের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা দেখে তিনি এতটাই বিমোহিত হয়েছিলেন যে, আমরা ডায়মন্টের চতুর্থ স্টেজ নির্মাণ করতে পারব কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন। এতে অধ্যাপক সারাভাইয়ের মুখে কী রকম হাসি ফুটেছিল, আমার তা মনে পড়ে।
আসল ব্যাপারটা হলো, ডায়মন্ট ও এসএলভির এয়ারফ্রেম ছিল খাপ খাওয়ানোর অসাধ্য। ডায়ামিটার ছিল একেবারেই আলাদা আর পারস্পরিক বদলের জন্য বেশ কিছু আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। আমি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম যে ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু করব। আমার সহকর্মীরা সমাধান দিতে পারে কি না জানার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি সতর্কতার সঙ্গে সহকর্মীদের রুটিন পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম, যদি তাতে তাদের অবিরাম পরীক্ষানিরীক্ষার আকাক্ষার প্রতিফলন দেখতে পাই। এমনকি সামান্যতম সম্ভাবনাও যদি দেখতাম কারো মধ্যে, তাহলে তাকে প্রশ্ন করতে ও তার উত্তর শুনতে আরম্ভ করলাম। আমার কিছু বন্ধু আমাকে সতর্ক করে দিল একটা ব্যাপারে যেটাকে তারা আখ্যায়িত করেছিল আমার সাদাসিধে ভাব হিসাবে। ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডিজাইনে ব্যক্তিগত পরামর্শ ও সহকর্মীদের হাতে-লেখা নোট দেওয়া আমি প্রায় নিয়মিত বিষয়ে পরিণত করেছিলাম। তাতে পাঁচ বা দশ দিনের মধ্যে নিচ্ছিদ্র ফলো-আপ অ্যাকশনের অনুরোধ থাকত।
এই পদ্ধতি চমৎকারভাবে কাজে দিয়েছিল। অধ্যাপক কুরিয়েন প্রমাণ পেলেন, ইউরোপে আমাদের প্রতিপক্ষরা তিন বছরে যা অর্জন করেছে, আমরা তা অর্জন করেছি মাত্র এক বছরের মধ্যে। আমাদের প্লাস পয়েন্ট হিসাবে তিনি ধরেছিলেন যে, আমরা প্রত্যেকেই কাজ করেছি ওপর-নিচের সবাই মিলেমিশে। আমার হিসেবটা ছিল, প্রত্যেক সপ্তাহে অন্তত একবার দল বৈঠকে বসবে। যদিও এতে সময় ও শক্তি খরচ হতো, তা সত্ত্বেও এটা আমি অপরিহার্য বিবেচনা করতাম।
একজন নেতা কতটা ভালো? তার জনগণের এবং তাদের অঙ্গীকার ও পূর্ণ অংশীদার হিসাবে প্রকল্পে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি ভালো নয়! যেটুকু ছোটোখাটো সাফল্য অর্জিত হয়েছিল তা ভাগ করে নেওয়ার জন্য আমি তাদের এক সঙ্গে পেয়েছিলাম। ফলাফল, অভিজ্ঞতা, ক্ষুদ্র সাফল্য, আর এ ধরনের বিষয়গুলো এতে আমার সময় ও শক্তি খরচ মূল্যবান বলেই আমি মনে করতাম। এটা ছিল অঙ্গীকার ও টিমওয়ার্কের চেতনার সামান্য মূল্য। আমার ছোটো দলটার মধ্যেই আমি নেতা খুঁজে পেয়েছিলাম, আর জেনেছিলাম যে সকল পর্যায়েই নেতা আছে।