- বইয়ের নামঃ ইগনাইটেড মাইন্ডস
- লেখকের নামঃ এ পি জে আবদুল কালাম
- প্রকাশনাঃ অন্যধারা
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, আত্মজীবনী
ইগনাইটেড মাইন্ডস
১. স্বপ্ন ও বাণী
ইগনাইটেড মাইন্ডস – এ পি জে আবদুল কালাম / অনুবাদ : সারফুদ্দিন আহমেদ
মিসাইল ম্যান খ্যাত বিজ্ঞানী রাষ্ট্রপতির আলোচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ
.
ইগনাইটেড মাইন্ডস্ অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি দুটো কারণে। এক. মূল গ্রন্থকার একই সংগে একজন বিজ্ঞানী, কবি, সংগীতজ্ঞ, সর্বোপরি একজন সত্যিকার দেশপ্রেমিক। এ পি জে আব্দুল কালামের বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ এ কাজটি করতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
দ্বিতীয় কারণ, ভারতের উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনার নেপথ্যে যে সুদূরপরিকল্পনা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা রয়েছে তার প্রায় সবগুলো দিক শনাক্ত করেছেন কালাম। একটি ভয়াবহ দুর্নীতিগ্রস্ত ও রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশের নাগরিক হিসেবে তার এ বইয়ের বক্তব্য আমাদের দেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে আমার। উন্নত দেশ হিসেবে না হলেও আমাকে একটি স্থিতিশীল দেশের নাগরিক হবার স্বপ্ন দেখিয়েছেন কালাম।
ইগনাইটেড মাইন্ডস বইটিতে ভারতের বহু দুর্লভ ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভবিষ্যত সম্ভাবনার তথ্য দিয়েছেন লেখক।
আমি আমার সর্বোচ্চ শব্দ সক্ষমতা দিয়ে বইটি অনুবাদের চেষ্টা করেছি।
এক্ষেত্রে আমাকে উৎসাহ, প্রেরণা ও সার্বিক সহায়তা দিয়েছেন সমকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক ও অনুবাদক প্রমিত হোসেন। আমি তার কাছে ঋণী।
এছাড়াও নানাভাবে যাদের সহযোগীতা পেয়েছি তাদের মধ্যে পীযুষকান্তি বিশ্বাস, এহসান শিকদার রনি, মাহমুদ খান, বাদল আহমেদ, মাসুদ সেজান, তরিক রহমানের নাম মনে পড়ছে।
আমি আশা করি স্বচ্ছ জাতীয়তাবোধ ও স্থিতিশীল অর্থনীতিসমৃদ্ধ জাতি গঠনে এপিজে আবদুল কালামের ইগনাইটেড মাইন্ডস বইটি শুধু ভারতীয়দের জন্যই নয়, বাংলাদেশী পাঠকদের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে।
সারফুদ্দিন আহমেদ
৪৩/৪/১ জিগাতলা,
ধানমন্ডি, ঢাকা।
২৭.০২.০৬
.
উৎসর্গ
দ্বাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এক শিশুকে আমি এ বই উৎসর্গ করছি। তার নাম স্নেহাল ঠাক্কার। ২০০২ সালের ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় সড়কপথে আমি আনন্দে পৌঁছাই, সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় তখন কার্ফিউ চলছে। পরদিন আনন্দালয় হাই স্কুলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার সময় একটা প্রশ্ন এল, আমাদের শত্রু কে?
অনেক রকম উত্তর শোনা গেল। কিন্তু সঠিক বলে আমরা সবাই যে উত্তরটি বিনাবাক্যে গ্রহণ করলাম, সেই উত্তরটি এল স্নেহালের কাছ থেকে, আমাদের শত্রু দারিদ্র্য।
হ্যাঁ, এটাই আমাদের সব সমস্যার মূল কারণ এবং নিজেদের মধ্যে হানাহানি না করে আমাদের উচিৎ এটার বিরুদ্ধেই লড়াই করা।
.
১. স্বপ্ন ও বাণী
Dream, Dream, Dream
Dream transformin to thoughts
And thoughts result in action.
২০০১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। ঝাড়খণ্ডের রাঁচি থেকে হেলিকপ্টার যোগে বোকারো যাচ্ছিলাম। ল্যান্ড করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তেই আমাদের কপ্টারটি ক্র্যাশ করলো। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে কপ্টারটি বিকট শব্দে ভূমিতে আঘাত করলো। অলৌকিকভাবে কপ্টারের সবাই সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলাম। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এ ঘটনা সত্ত্বেও আমি পূর্বনির্ধারিত কাৰ্যসূচী অনুযায়ী, বোকারোতে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গেলাম।
.
রাতে শারীরিক ও মানসিক আঘাত উপশমের জন্য একদল ডাক্তার আমাকে নিদ্রা উদ্রেককারী ওষুধ দিয়ে গেল। সাধারণত আমি রাত একটায় ঘুমাই। সেদিন ঘুমের ওষুধের কারণে তার কয়েক ঘণ্টা আগেই ঘুম এসে গেল। সাধারণত ঘুম থেকে উঠি ভোর ৬টায়। সেদিন উঠলাম সাড়ে আটটারও পরে। ওইদিন রাতে আমার কেমন জানি বিক্ষিপ্ত নিদ্রা হয়েছিল। ঘুমের মধ্যেই আমার বারবার মনে হচ্ছিল, এই যে মানব সম্প্রদায়, আশরাফুল মাখলুকাত এই মানুষ কেন হানাহানি করে এত ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়? আমার কল্পনায় আমি যেন পাঁচজন সর্বাপেক্ষা শুদ্ধ চরিত্রের মানুষের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলাম। তাদের ওই কথোপকথনের মধ্যে আমি আমার প্রশ্নের জবাব খুঁজছিলাম। আমার তখনকার সেই কল্পনার জগৎটা ছিল স্বপ্নের চেয়েও বেশী উজ্জ্বল, আরও বাস্তবময়। আমি দেখলাম আমি যেন সহস্ৰমাইলব্যাপী উষর মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে। আমার চারপাশে ধু ধু বালি। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। গলে পড়া জোৎস্নায় সমস্ত মরুভূমি যেন এক স্নানোৎসবে মেতে উঠেছে। আমি দেখলাম ওই ধবল জ্যোৎস্নার মধ্যে পাঁচটি পবিত্র মানুষ মহাত্মা গান্ধী, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, সম্রাট অশোক, আব্রাহাম লিঙ্কন এবং খলিফা ওমর। তারা বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছেন? জোৎস্নার মধ্যে দাঁড়ানো মানুষগুলোর শ্বেতশুভ্র বসন এলোমেলো বাতাসে উড়ছে।
সম্রাট অশোকের পাশে খর্বাকৃতির বামনের মত দাঁড়ালাম আমি। দিগ্বিজয়ী মহাপরাক্রমশালী সম্রাট অশোক। দুই ধরনের জীবন যাপন করতেন অশোক। একটি নিষ্ঠুর অভিযাত্রীর জীবন, আরেকটি হলো করুণাময় এক স্নেহশীল শাসকের জীবন। যে মুহূর্তে আমি অশোকের পাশে দাঁড়ানো সে সময় তিনি সবেমাত্র রাজ্যজয় করে ফিরেছেন। কিন্তু সে জয় এসেছে বহুমূল্যের বিনিময়ে। সদ্য অধিকৃত কলিঙ্গ রাজ্য জয় করতে ৩ লাখ সৈনিকের প্রাণহানি হয়েছে, আহত হয়েছে আরও ৩ লাখ। আমি দেখলাম উপস্থিত সবাই অশোকের দিকে চেয়ে আছেন। সম্রাট হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। শরীর থেকে বর্ম আর মাথার মুকুট খুলে ফেললেন। তার সারা মুখ বিবর্ণ, মৃত্যুর বিষণ্ণতা তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি আকাশের দিকে চাইলেন। তিনি দেখলেন, ঈশ্বরের নিস্তব্ধ পৃথিবীতে উঁকি দিচ্ছে প্রশান্ত পূর্ণিমার চাঁদ। ঈশ্বরের আশীর্বাদ এই স্বর্বংসহা জননীরূপী ধরিত্রীর বুকে গলে গলে পড়ছে। তিনি এবার নিচে তাকালেন– দেখলেন, ধরীত্রীবক্ষে তিনি কী ভয়ানক শোণিত স্রোত বইয়ে দিয়েছেন, কী বীভৎস রক্তসাগর বয়ে চলেছে তার চারপাশে।
সেই অপূর্ব সুন্দর আর বীভৎস নারকীয় মুহূর্তে, সেই রজতশুভ্র জ্যোত্সাময়ী ও বিষাদক্লিষ্ট ক্ষণে বিশ্বপ্রকৃতি যেন কথা বলে উঠলো। জন্ম হলো অহিংস ধর্ম। সম্রাট অশোক সে মুহূর্তে কম্পিত ও অবনত মস্তকে ঈশ্বরের নির্দেশ আঁকড়ে ধরলেন। শেষ দিন পর্যন্ত মানব অহিংসার মন্ত্রে মানবপ্রেমের কথা প্রচারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। অশোকের পাশে দাঁড়িয়ে আমি শিউরে উঠলাম। আমি বোবা বিস্ময়ে ভাবছিলাম, কেন এই কলিঙ্গ যুদ্ধ? মহাত্মা গান্ধী আর আব্রাহাম লিংকনের এই গুপ্তহত্যা কার জন্য? তাদের মত আর কত কত মানুষ মারা যাচ্ছে তা কেন? ঈশ্বরের সৃষ্টিতত্ত্বে কি তাহলে কোন ভুল ছিল? না কি দ্বিতীয় প্রজন্মে প্রয়োজনে মানবজাতি নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করছে?
সেই নন্দিত নিস্তব্ধতা ভেঙে মহাত্মা কথা বলে উঠলেন, বন্ধুরা! আমরা যে স্বর্গীয় বাণী শুনতে পাচ্ছি, সে বাণী সৃষ্টির বাণী। যেহেতু পৃথিবী নামক এ গ্রহটি আমাদের, সেহেতু পৃথিবীর তাবৎ মানবসম্প্রদায়ের কাছে আমরা এ বাণী ছড়িয়ে দিতে পারি যাতে ভিন্ন জাতির, ভিন্ন ধর্মের আর ভিন্ন ভাষার মানুষ এক সংগে শান্তির সংগে বসবাস করতে পারে।
মহান ঈশ্বর আমাদের যা কিছু অনুপম আর কল্যাণকর তা দিয়েছিলেন আমাদের কাজের উপহার হিসেবে। আমরা মানবতার জন্য সে সব উপহার রেখে এসেছি। কিন্তু আমাদের সেই বার্তা, সেই বাণী কি এখন কাজ করছে? পৃথিবীতে কি এখন কোন শান্তির বাণী অথবা মতবাদ আছে? স্বর্গীয় সৌন্দর্য মানবাত্মায় প্রবেশ করবে আর মানুষের দেহ ও মনে প্রশান্তি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে করা হয়। চোখ তুললেন সম্রাট অশোক। বললেন, বন্ধুরা, এতদিনে একটা মন্ত্রই আমি বুঝেছি। অশান্তি ছড়িয়ে কখনও বিজয়ী হওয়া যায় না। শান্তিরাজ্য স্থাপনই প্রকৃত বিজয়।
.
খলিফা ওমর বললেন, জেরুজালেমে পা রাখার পরই আমি জেনেছি জগতের সকল মানুষ সমান। নিজের পথে অন্যকে পরিচালিত করতে কাউকে তুমি জোর করতে পার না। তুমি ততটুকুই পাবে যা তুমি অর্জন করতে পারবে। আল্লাহই একমাত্র শ্বাশত সার্বভৌমত্ত্বের মালিক।
খলিফা ওমর কখনও তার খেলাফতকে কোন বিশেষ পদাধিকার বলে বিবেচনা করেননি। তার কাছে সরকার ছিল এক পবিত্রতম আমানত। সে আমানতের খেয়ানত এড়াতে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন।
.
এবার আইনস্টাইনের পালা। তিনি বললেন, আজ আমার বন্ধু ওয়ার্নার হিন্সেনবার্গের কথাই বার বার মনে পড়ছে। ওয়ার্নার বলেছিলেন, আপনারা সবাই জানেন পশ্চিমারা সুবিশাল আর অমিত সৌন্দর্যদীপ্ত এক জাহাজ বানিয়েছে। জগতের সকল সুযোগ সুবিধা রয়েছে সে জাহাজে। কেবল একটি জিনিস হারিয়ে গেছে, আর তা হলো কম্পাস। নাবিক জানে না তারা কোথায় চলেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী আর তাদের মতানুসারীদের কাছে রয়েছে সেই কম্পাস। এই কম্পাস কেন মানবতা নামের সেই জাহাজে প্রতিস্থাপিত হবে না যাতে পূর্ব আর পশ্চিম একই সংগে উভয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে বুঝতে পারে?
মহাত্মা গান্ধীর মত সাদামাটা জীবন যাপনকারী দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার যোদ্ধা মহান আমেরিকান নেতা আব্রাহাম লিংকন এবার মন্ত্রসপ্তক কণ্ঠে বলে উঠলেন, একটি কথাই আমি বলতে চাই, পারিবারিক উন্নয়ন ও সুসম্পর্কের মাঝেই সুখ আর শান্তি লুকিয়ে আছে। ঈশ্বরের আশীর্বাদ মানুষকে প্রশান্তি দেয়। পৃথিবীতে উত্তম জীবন যাপনের জন্য সুখ আর প্রশান্তি দুই অপরিহার্য বিষয়। আমরা যখন নিজেদের মূল্যবোধ ভুলে সম্পদ আর ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে যাই তখনই মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। কিন্তু অবশ্যই আমাদের নিজেদেরকেই প্রশ্ন করতে হবে, মনুষ্যবিবেকের কাজ কী? এটা কি রাজনৈতিক চিন্তার অংশ, না কি বৈজ্ঞানিক চিন্তার অংশ, না কি এ বিবেক শুধুই ধর্মতাত্ত্বিক দর্শনের খণ্ডিত অংশ? প্রতিদিনের ব্যস্তজীবনের আধ্যাত্মিক মনস্তত্ত্বে মনুষ্য বিবেক কতটা গ্রহণযোগ্য?
.
মহাত্মা গান্ধী মহামতি অষ্টবক্রর বাণী শোনালেন, হে আমার সন্তানগণ! এই সহস্র উপাদানবেষ্টিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অবিচ্ছেদ্য উপাদান তুমিও। তুমি তোমার বিবেকের বিষয়ে সতর্ক থাক। কোনটা গ্রহণীয় কোনটা বর্জণীয় তা তোমার বিবেকই তোমাকে নির্দেশ করবে। এসো এই নশ্বর জীবন শান্তি আর স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে তুলি। ধ্বংস আর সংঘাত ভুলে যাই।
এবার পাঁচজন সমস্বরে বললেন,
এই গ্রহের কাছে এই আমাদের বার্তা– আমরা যা কিছু করি, যে মতাবলম্বী হই তা যেন মানবতার জন্য কল্যাণকর হয়।
.
ঘুম থেকে উঠে সকালে চা খেয়ে গত রাতের স্বপ্নের কথা ভাবছিলাম।
যদি আরও উঁচুতে থাকতে হেলিকপ্টারটি বিকল হয়ে যেতো? আমার ওই দুর্ঘটনা ঘটার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে একজন উদীয়মান নেতা আর এক ঝাঁক তরুণ সাংবাদিক নিয়ে আরেকটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। আরোহী সবাই মারা পড়ে। সৌভাগ্যবশত আমি বেঁচে গেছি আর রাতের এক বিক্ষিপ্ত স্বপ্ন আমাকে কী এক বার্তা জানিয়ে গেল। আমি আনমনা হয়ে উঠি। এখন আমি কী করব? আমার আসলে কী করা উচিত?
আমি জানালার বাইরে তাকালাম। বেশ বেলা হয়েছে। ঝিরঝির বাতাস বইছে। প্রকৃতির কাছেই আমার থাকতে বেশী ভাল লাগে। প্রকৃতিই আমার প্রকৃত বন্ধু। প্রতিদিন একটি আমগাছকে প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে দেখি, যে গাছের ডাল মানুষ ভাঙে, পাতা মুড়ে নেয়। অথচ সে শ্রান্ত পথিককে ছায়া দিয়ে যায়। ক্ষুধার্তকে সুমিষ্ট ফলের আস্বাদে ক্ষুধামুক্ত প্রাণবন্ত করে তোলে। রামেশ্বরম, থুম্বা আর চণ্ডিপুরের সাগরসৈকত, পোখরানের মরুভূমি, হায়দরাবাদের বিস্তৃর্ণ আর বিশালকায় প্রস্তর ক্ষেত্র–যেখানেই আমি গেছি সবখানে প্রকৃতির প্রত্যক্ষ উপস্থিতি টের পেয়েছি। এরা সবাই আমাকে সেই স্বর্গীয় শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে শক্তিই সমস্ত সৃষ্টির আধার।
.
নিদ্রাভঙ্গের পর এই স্বপ্নদৃশ্য আমার মগজে স্থির হয়ে রইল। আমি জানি বিশ্ব ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে সত্য আর ন্যায়ের শক্তিমানুষের জীবনকে সুখী আর স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোেলার জন্য কিভাবে সংগ্রাম করেছে। এই ইতিহাসই আমাদের দেখিয়েছে এই মানুষের হাতেই কী ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী শক্তি রয়েছে। গান্ধীর মত বহু সাধক ও মুনিঋষি আমরা পেয়েছি যারা এক মহান ত্যাগের জীবন কাটিয়ে গেছেন। পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু-বোমার আঘাতে নগর বসতি ধ্বংস হয়ে কোটি কোটি মানুষকেও আমরা মরতে দেখেছি।
বসনিয়ার যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মরতে দেখেছি। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষে অগনিত মানুষ মরেছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্যভবন সন্ত্রাসীদের অভিনব হামলায় ধ্বসে যেতে দেখেছি। আমাদের এই ভারতের ভূগোলে একটি বহুজাতিক কোম্পানীর অসাবধানতার কারণে সংঘটিত গ্যাস বিস্ফোরণে ৩০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। কাশির উপত্যকায় চলমান সংঘর্ষে নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট ভবনে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে দেশকে নিষ্ক্রিয় করতে চেয়েছিল। এ সংঘাতের শেষ কোথায়? আমাদের নিজেদের ধ্বংস করতেই কি আমরা ক্রমাগত ধ্বংসের পথে যাচ্ছি?
না, এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মুক্তির জন্য আমাদের চূড়ান্ত সমাধানের পথ এখনই খুঁজতে হবে।
.
কয়েক বছর আগে দি ট্রি অব লাইফ বা জীবনবৃক্ষ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলাম–
আমার সৃষ্টির মাঝে মানুষ তুমিই তো সেরা
তুমিই থাকবে বেঁচে, বাঁচবে তুমি
যতক্ষণ তুমি যুথবদ্ধ, ততক্ষণ ক্রমাগত দিয়ে যাবে তুমি
সুখে আর দুঃখে
আমার শ্রদ্ধা জন্মাবে তোমার আত্মায়
ভালোবাসা অনাদি এক স্রোতবহমান ধারা
সেই তো চূড়ান্ত লক্ষ দীপ্ত মানবতার–
হররোজ, প্রতিদিন দেখ সেই জীবনতরু
মানুষ, তুমি সৃষ্টির সেরা
জানো আরো জানো, তুমি নিজেকে জানো।
মহাকালের বিভিন্ন সময়ে, পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে জন্ম নেওয়া ক্ষণজন্মা পাঁচ পুরুষোত্তমকে আমি স্বপ্নে আবিষ্কার করেছি। এই আধুনিক বিশ্বে খুব কম মানুষের দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে যারা প্রকৃত মানব মনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে পারেন। একবার একটি ছোট শিশু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি মহাভারত পড়েছি কিনা, আর যদি পড়ে থাকি তাহলে এর কোন চরিত্রটি আমার ভাল লেগেছে। মহাভারতের বহুমুখী মহাকাব্যিক চরিত্রগুলো মানব প্রকৃতির বিভিন্ন দিকের প্রতিনিধিত্ব করে। ভালো ও মন্দ দুটোরই প্রতিনিধিত্ব করে ওই চরিত্রগুলো। আমি শিশুটিকে বললাম, মহাভারতের বিদুর চরিত্রটি আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে।
এই চরিত্রটি রাজ্য পরিচালকের ভুল ও অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরোধীতা করার সাহস দেখিয়েছে এবং যখন অধর্মের উৎপীড়নের কাছে সকলে নতিস্বীকারে উদ্যত হয়েছিল তখন বিদুরই তাদের মতের বাইরে যাবার সাহস দেখিয়েছে।
আজ আমাদের রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে একজন বিদুরকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এমন আলোকিত মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমন আলোয় আলোকিত হওয়ার আশাও আজ দুরাশায় পর্যবসিত হয়েছে। আমাদের সামাজিক ও প্রাত্যহিক জীবনে হতাশাই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। আমি বুঝতে পারি তুচ্ছ আর হীন আলোচনা, অহমিকা, ক্রোধ, লোভ, ঈর্ষা, হিংস্রতা, লালসা, ভয়, উদ্বিগ্নতা, মোহ আমার ভেতরে এক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যায়।
.
আমার জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য ভারতের ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে সত্যিকার ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে সহায়তা করা, আমার সমস্ত কাজ এমন কি আমি নিজেও নিজেকে একাজে সমর্পন করেছি। আমার সব সায়েন্টিফিক ক্যারিয়ার, আমার বিশেষজ্ঞদল, আমার পুরস্কার-সম্মাননা সব এ লক্ষ্যের কাছে গৌণ। শিশুদের উজ্জ্বলতায় আমার সমস্ত সত্তা বিলীন করতে, তাদের আনন্দময় রাজ্যে আত্মসমর্পণ করতেই আমার যাবতীয় প্রত্যাশা পূর্ণতা পায়।
একজন মানুষকে সারাজীবনে কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। ড. ওয়াইন ডব্লিউ ডায়ার তার মেনিফেস্ট ইয়োর ডেস্টিনি বইতে মানবজীবনকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। তার ভাষায় জীবনের এই চারটি স্টেজ হলো অ্যাথলেট স্টেজ বা ক্রীড়াণক পর্যায়। ওয়ারিওর স্টেজ বা সগ্রামী পর্যায়, স্টেটসপার্সন স্টেজ বা দায়িত্বপ্রধান পর্যায় এবং স্পিরিট স্টেজ বা আধ্যাত্মিক তেজস্বী পর্যায়। আমার মনে হয় একটি জাতি ও মানুষের মত পরিবর্তনমূলক। আমি এ সাদৃশ্যটাকেই শিশুদের কাছে ব্যাখ্যা করি।
প্রথমত, অ্যাথলেট স্টেজে একটি জাতি সংগ্রাম ও সংঘাত থেকে মুক্ত থাকে। এই সময়টা জাতীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন ও সাফল্য অর্জনের সময়। এ বিষয়টির প্রতিফলন ঘটেছে জাপান, সিংগাপুর ও মালয়েশিয়ায়।
.
জাতি যখন এ পর্যায় অতিক্রম করে, স্বাভাবিকভাবেই সে সগ্রামী পর্যায় বা ওয়ারিওর স্টেজে প্রবেশ করে। অর্জিত সাফল্য সামনে নিয়ে ওই গর্বিত জাতি তখন অন্যদের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তারের জন্য সংগ্রাম শুরু করে। হয়তো তার জন্য তাকে অন্য জাতির ওপর অভিযানও চালাতে হয়। দম্ভ ও অহমিকা তখন হয়ে ওঠে ওই জাতির চালিকা শক্তি। এ পর্যায়ে এসে সে জাতির মানুষ অন্যদের সংগে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নামে এবং দ্রুত সাফল্য অর্জনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যক্তি ক্ষেত্রে এ পর্যায়টি ডায়ারের মতে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। নিজের প্রাধান্য অন্যকে মেনে নিতে বাধ্য করাই এ পর্যায়ের মূল প্রতিপাদ্য হয়ে ওঠে।
.
এর পরেই আসে স্টেটস্পার্সন স্টেজ বা বড়ভাইসুলভ পর্যায়। এ পর্যায়ে আত্মঅহমিকা নিয়ন্ত্রণ করে একটি দেশ একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিণতি লাভ করে এবং তার নেতৃত্বসূলভ আচরণকে অন্য দেশ ও সমাজের কাছে স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। বড়ভাইসূলভ এ পর্যায়ের জাতিটি সত্যিকার অর্থে সফল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিন্তু তার শক্তি প্রদর্শনের মোহ কমে না। তার উদ্ধত কার্যক্রম অন্যদের আরো ভালো কিছু অর্জনের শক্তি যোগায়। মহাশক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়ন কিছু দেশে তার উন্নয়নমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে সহায়তা করেছিল।
ব্যক্তি ও জাতির উভয় ক্ষেত্রেই সংগ্রামী পর্যায় থেকে বড়ভাইসুলভ পর্যায়ে উত্তরণ সম্মানজনক কিন্তু এ পর্যায়ের ক্ষমতা ব্যবহার খুবই কঠিন।
.
কিন্তু এই বড়ভাইসুলভ পর্যায়ের ওপরেও আরেকটি পর্যায় রয়েছে। এ পর্যায়ে একটি দেশ তার সত্যিকার ক্ষমতাসীমা সম্পর্কে সজাগ হয়। এ পর্যায়ে এসে সব দিক থেকে উন্নত দেশটির মধ্যে পরিণত প্রাজ্ঞতা জন্ম নেয়। দেশটি বুঝতে পারে পৃথিবী কেবল কোন নির্দিষ্ট একটি দেশের সম্পদ নয় বরং এ পৃথিবী সব দেশের সকল মানুষের। তখন দেশটি বিশ্বমানবতার প্রতি দায়িত্বপালনে ব্রতী হয়। এ পর্যায়ে উপলব্ধির পর্যায় বলা যেতে পারে এবং ভারত সে পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে।
.
আমার তেতাল্লিশ বছরের কর্মজীবনে আমি বহুবার প্রতিষ্ঠান বদল করেছি। কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে নতুন ভাবনার সৃষ্টি হয়। নতুন ভাবনা অভিনব কাজের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
২০০১ সালের ১৫ আগস্ট আমি কার্যক্ষেত্র পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে আমার সিদ্ধান্ত জানালাম। উনি আমাকে আবার ভেবে দেখতে বললেন। দায়িত্ব থেকে কিছুদিন মুক্ত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম তার কাছে কিন্তু তিনি আমাকে অবশেষে ছাড়লেন না।
.
একজন রকেট চালক হিসেবেও আমি ধারাবাহিক পর্যায়গুলো অতিক্রম করেছি। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান আই এস আর ও (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন) তে কাজ করেছি। ১৯৮০ সালে ভারত প্রথমবারের মত সফলভাবে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করে এবং কক্ষপথে রোহিনী স্যাটেলাইট প্রতিস্থাপন করে বিশ্বের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ স্পেস ক্লাবের সদস্য হয়। এসএলভি-৩ এর ওই মিশনে আমি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। আমাদের সেই সকল অভিযান জাতিকে স্যাটেলাইট প্রতিস্থাপক প্রযুক্তি অর্জনের গৌরব উপহার দিয়েছিল। স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণ, গাইডেন্স, জেট ইঞ্জিনের দ্বারা প্রচালন এবং বায়ু গতিবিদ্যার বিষয়েও ওই অভিযান আমাদের অভিজ্ঞ করে তোলে। এছাড়া বিভিন্ন রকেট সিস্টেম ডিজাইনেও এ অভিযান সহায়তা করেছে। সর্বোপরি আর অ্যান্ড ডি ল্যাবরেটরি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তথ্য প্রযুক্তি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নের এ প্রজেক্টটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছে।
আজ তারা বিভিন্ন স্পেস ও প্রতিরক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমার শ্রদ্ধেয় তিন গুরু ড. বিক্রম সারাভাই, অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান এবং ড. ব্ৰহ্ম প্রকাশ-এর কাছ থেকে আমি নেতৃত্বের শিক্ষা পেয়েছিলাম। এসময় আমি ছিলাম শিক্ষানবীশ। এটাই ছিল আমার অ্যাথলেট স্টেজ।
.
আমার দ্বিতীয় পর্যায় ধরা যেতে পারে ১৯৮২ সাল থেকে, যখন আমি ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন)তে যোগ দেই।
ডিআরডিওতে যোগদানের মধ্য দিয়ে দুটি স্ট্র্যাটেজিক মিসাইলের ডিজাইন করা, এর তৈরী পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটানো, উৎপাদন এবং তা উৎক্ষেপণের যাবতীয় কাজে যুক্ত থাকার সৌভাগ্য হয় আমার। এই দুটি সুকৌশলী ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি কোনওদিন কোন দেশকেই দেওয়া হবে না, তা সে যতই বন্ধুপ্রতীম দেশ হোক না কেন। এসময়ে আরও তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণাগার ও স্থাপনা তৈরী হয়। এর মধ্যে হায়দ্রাবাদে আরডিও (রিসার্চ সেন্টার ইমারত) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়।
আর দুটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয় বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী চণ্ডিপুরে। এ দুটি পরীক্ষা কেন্দ্রের একটি চণ্ডিপুরের প্রাণকেন্দ্রে, আরেকটি হল চণ্ডিপুর এলাকাভুক্ত একটি দ্বীপে। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ায় ভারত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উপরন্তু ভারতের এই গবেষণাগার ও একাডেমিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ কিছু জটিল প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয় যা এমটিসিআর (মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রিগাইম) ও এনপিটি (ননপ্রলিফারেশন ট্রিটি)র চাপ থেকে ভারতকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে। আমার অধীনস্থ ওই মিসাইল টিম আইসিবিএম (ইন্টারন্যাশনাল ব্যালিস্টিক মিসাইল) সহ বিশ্বের সর্বাধুনিক যেকোনও ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বানাতে সক্ষমতা অর্জন করে।
.
এ পর্যায়ে এসে আমাকে অনেক সফলতা ও ব্যর্থতার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ব্যর্থতা থেকে আমি শিক্ষা নিয়েছি। আবার সাহস নিয়ে সেই ব্যর্থতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। এটি ছিল আমার দ্বিতীয় পর্যায় যা আমাকে ব্যর্থতা সামলানোর মত জটিল ও কঠিন শিক্ষা দিয়েছিল।
আমার জীবনের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় তখন যখন আমি ভারতের পারমাণবিক অস্ত্রপ্রযুক্তি অর্জনের মিশনে যোগ দিই। ডিএই (ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি) এবং ডিআরডিওর সাথে পার্টনারশীপ করে ও সশস্ত্র সেনাবাহিনীর প্রহরায় ভারতের নিউক্লিয়ার মিশন শুরু হয়েছিল। আজ সে মিশন সফলভাবে শেষ হয়েছে।
যাহোক, কচিকাঁচা শিশুরা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে, গত চল্লিশ বছরে সংঘটিত কোন ঘটনা আপনাকে সবচে বেশী আনন্দ দিয়েছে? তখন তাদের বলি, আমি সবচে খুশি হই তখন যখন দেখি হৃদরোগীরা তাদের ধ্বমনীতে কেআর করোনারী স্টেন্ট সঞ্চালন করে সুস্থ্য বোধ করছে অথবা পঙ্গু শিশুরা এফআরও (ফ্লোর রিঅ্যাকশন অর্থোসিস) ক্যালিপারের সাহায্যে তাদের চলাফেরার কষ্ট কিছুটা লাঘব করছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই দুটি উপাদানই এসেছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি থেকে।
এ পর্যায়ে এসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়াধীন আমি একটানা আট বছর টিআইএফএসি (টেকননালজি ইনফরমেশন, ফোরকাস্টিং অ্যাণ্ড অ্যাসেসমেন্ট কাউন্সিল)র চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এ সময়ে ২০২০ সালের সম্ভাব্য প্রযুক্তির কথা মাথায় রেখে আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত ৫ হাজার বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের মধ্য থেকে ৫শ বিশেষজ্ঞ বাছাই করে একটি টিম গঠন করি। পরবর্তীতে ভারতের প্রযুক্তি ক্ষেত্র ও জাতীয় প্রতিরক্ষার যৌথ উদ্যোগে ইণ্ডিয়া মিলেনিয়াম মিশনস (আইএমএম ২০২০) এর উত্থান ঘটে। ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে ভারত সরকারের প্রধান বিজ্ঞান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করার পর আমার প্রধান কাজ ছিল সরকারের কাছে আইএমএম-২০২০ এর কর্মপরিকল্পনা ব্যাখ্যা করা। এ পরিকল্পনাটি ছিল মূলত ভারতকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার রোডম্যাপ। পাশাপাশি শিক্ষা, কৃষি ও পল্লী উন্নয়নও বর্তমান উন্নয়ন ধারায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। আমি দায়িত্বে থাকাকালে সরকারের অনুমোদনের জন্য কেবিনেটে একটি প্রযুক্তি বিষয়ক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। আমার জীবনের এই তৃতীয় পর্যায়ে অনুমোদনপ্রাপ্ত ওই কর্মপরিকল্পনার সহায়তায় অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে যা আমাদের সামাজিক চাহিদা পূরণেও যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
২০০১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পর আমি বুঝতে পারি আমি মানব জীবনের তৃতীয় পর্যায়ের পরিপাক অবস্থানে এসে পৌঁছেছি। আমার এ ধারণা আরও পোক্ত হল মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন ২ অক্টোবর যেদিন আমি কেরালার কোল্লামে অবস্থিত মাতা অমৃতানন্দময়ীর আশ্রম পরিদর্শন করলাম। মাতা ওই সময় প্রজ্ঞাবান ও ধীশক্তি সম্পন্ন ভবিষ্যত নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় আধ্যাত্মবাদ ও দর্শনের সন্নিবেশ ঘটানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
২০০১ সালের ১২ অক্টোবর, আমার ৭০তম জন্মদিনের মাত্র ৩দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি পদত্যাগের আবেদন করি। তিনি অনুমতি দিলেন না। আমি মেনে নিলাম।
যাহোক এখন আমি ভারতের বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শন করছি নিয়মিতই। বহু প্রদেশের বহু স্কুলে বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম ও ত্রিপুরা ছাড়াও ঝাড়খণ্ড ও তামিল নাড় র স্কুলগুলোতে অজস্র শিক্ষার্থীর মধ্যে আমি প্রায়ই বক্তব্য দিই। তামিল নাড়ু তে কিছুদিন আগে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর উদ্দেশ্যে আমি ভাষণ দিয়েছিলাম। আমি খেয়াল করে দেখেছি ছোট ছোট শিশুকিশোরদের সংগে আমার মেজাজ ভালো মেলে। আমি তাদের কল্পনার সংগে শেয়ার করতে পারি। সবচে বড় কথা হলো তাদের সংগে কথোপকথনের মাধ্যমে আমি তাদের ভেতরে বিজ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারি। এই গভীর আগ্রহই তাদেরকে ভবিষ্যতের উন্নত ভারত গড়তে সহায়তা করবে।
আজ জীবন সায়াহ্নের কাছাকাছি এসে মনে হচ্ছে, আমি কি মানবজীবনের চতুর্থ পর্যায়ে যেতে পারব? আমি আদৌ সফল হতে পারবো? এর উত্তর আমি জানি না। কিন্তু একটি বিষয় আমি ভালো করেই জানি, বড় হবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতির চেয়ে বড় শক্তি স্বর্গে-মর্তে কোথাও নেই। স্বপ্ন হলো এমন এক অমিত শক্তির আধার যা হৃদয়ে ধারণ করার সংগে সংগে মানুষের বস্তু জগৎ ও আধ্যাত্মিক জগত সক্রিয় হয়ে ওঠে।
বিগত কয়েক বছর ধরেই গবেষণা ও শিক্ষকতা করার নেশা আমার মাথায় ভর করেছে। এ কারণেই বারবার বিভিন্ন স্কুলে শিশুদের কাছে ছুটে যাই। সৃষ্টির উল্লাসে তরুণ প্রজন্ম মেতে উঠেছে, ভাবলেই এক শিহরণ অনুভব করি আমি। আগামী দিনের জাতি গঠনের এই প্রচণ্ড শক্তিগুলো যাতে সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে তার জন্য বয়স্কদের কাঁধে কত দায়িত্ব। তাদের পরিচর্যায় আমাদের ভাবতে হবে। ভাবতে হবে কী করে অতীতের ভুল ত্রুটিগুলো আবার শুধরে নেওয়া যায়।
২. আমাদের একজন ‘রোলমডেল’ দাও
২. আমাদের একজন ‘রোলমডেল’ দাও
Men of ten become what they believe themselves to be. If I believe I can not do something, it wakes me inca pable of doing it. But when I believe I can, then I acquire the ability to do it even if I didnt have it in the beginning.
–Mahatma Gandhi
কেন বারবার বিশেষ করে তরুণ শিক্ষার্থীদের সংগে আমি দেখা করি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাকে ছাত্রজীবনে ফিরে যেতে হয়। রামেশ্বরম দ্বীপ থেকে আমি উঠে এসেছিলাম। তারপর কী সুদীর্ঘ যাত্রা! আমার পেছনের দিনগুলোর দিকে তাকালে নিজের কাছেই তা অবিশ্বাস্য মনে হয়।
কিন্তু আমার আজকের এই অবস্থানের নেপথ্যে কী ছিল? কঠোর পরিশ্রম? উচ্চাকাক্ষা? কত উত্তরই তো আমার মনে আসে। তবে আমার মনে হয় এর নেপথ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আমার কর্মসাধনার মূল্য পরিমাপের মানসিকতা। মূল কথা হলো, ঈশ্বর তোমাকে যে এত ঐশ্বর্য দান করেছেন, তোমাকে অবশ্যই তার মূল্য বুঝতে হবে। যদি আমাদের তরুণ ছাত্র ছাত্রীরা বিশ্বাস না করে যে তারা আগামী দিনের উন্নত দেশ ভারতের গর্বিত নাগরিক তাহলে কি করে তারা আলোকিত নাগরিক হয়ে উঠবে?
উন্নত বিশ্বের অমিত ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদ অর্জনের পেছনে কিছুমাত্র রহস্য নেই। এর নেপথ্যের ঐতিহাসিক সত্য হলো জি-৮ বলে পরিচিত উন্নত দেশগুলোর মানুষ যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম পরম্পরায় দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি নিয়ে কল্পনা করেছে যে তারা একদিন উন্নত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এ কারণেই আমাদের একজন রোলমডেল দাও আজ তারা তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। সম্পদ ও প্রজ্ঞা লাভের আকাঙ্খ করা, জাগতিক ধনসম্পত্তি অর্জনের চেষ্টা করা ভুল– একথা আমি বিশ্বাস করি না। যদিও আমি খুব স্বল্প পরিমাণ সম্পদ নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছি। তথাপি আমি সম্পদ অর্জনের প্রশংসা করি, কারণ এতে জাতির নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। স্বাভাবিকভাবেই এই অর্জিত সম্পদ আমাদের স্বাধীনতা রক্ষায় সহায়তা করে। সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণেই সে লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয়। তুমি চারপাশে লক্ষ্য করলে দেখবে প্রকৃতিও নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে কিছু দেয় না। বাগানে গেলে দেখবে, বসন্ত মৌসুমে সারা বাগান ফুলে ফুলে ভরে যায়। আসমানের দিকে তাকাও- দেখ, এ মহাবিশ্ব তোমার কল্পনার চেয়েও বড় অসীম বিশাল।
পৃথিবীতে যা কিছু আমরা দেখি– এর সবই শক্তির প্রতীক। শ্রী অরবিন্দর ভাষায়, এ মহাবিশ্বের অসংখ্য শক্তির মত আমরাও একটি শক্তি। বহু দার্শনিক বলেছেন, আত্মা ও দেহের সম্মিলনেই অস্তিত্বের সৃষ্টি। শক্তি ও বস্তু একে অপরের পরিপূরক। আমরা যদি যুক্তি বিশ্বাস করি তাহলে বুঝতে পারবো প্রজ্ঞা ও ধী শক্তির পাশাপাশি বস্তুগত সম্পদ লাভের আকাঙ্ক্ষা করা ভুল বা অপরাধ নয়, বরং জরুরী।
এজন্য এই দর্শনেই আমাদের বিশ্বাসী হতে হবে। আবার এটাও খেয়াল রাখতে হবে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সম্পদ নিয়ে জীবনযাপনের ধারণাও ভুল নয়। মহাত্মা গান্ধীও এ ধরনের জীবন যাপন করতেন। সেটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। তুমিও চাইলে তাকে অনুসরণ করতে পার। তার মত জীবন যাপন করলে তুমিও সত্যিকার অভাব জিনিসটাকে উপলব্ধি করতে পারবে। তবে মনে রাখতে হবে ত্যাগের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে দারিদ্রকে বরণ করা আর সত্যিকার দারিদ্র্যে পতিত হওয়ার মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। এই বিষয়টিকে বোঝানোর জন্যই আমি বারবার স্কুল কলেজের তরুণ শিক্ষার্থী বন্ধুদের কাছে ছুটে যাই। তাদের স্বপ্নগুলো
জানার জন্য ছুটে যাই। তাদের বলতে যাই সুখ সমৃদ্ধি আর দারিদ্র্যমুক্ত স্বর্ণযুগের প্রত্যাশায় তাদের স্বপ্ন দেখতে হবে। কাজ করতে হবে। তাদের বলতে চাই, তোমাদের অন্তরে ভালোবাসা ও আনন্দের যে স্রোতধারা রয়েছে তা ছড়িয়ে দাও।
প্রথমবারের মত আমি ত্রিপুরার একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে প্রায় শপাঁচেক শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী জড়ো হয়েছিল। ভারতকে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন ও উদ্যোগ বিষয়ক আমার বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর আমার কাছে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে একের পর এক বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আসতে লাগলো।
এ বিষয়ে একটু বলতে চাই। আমার প্রতি তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, আমরা কোত্থেকে অনুসরণযোগ্য একটি রোল মডেল বা আদর্শ পাব, আপনি কীভাবে সেই মডেল পাবেন?
আমরা এ বিষয়ে সচেতন থাকি বা নাই থাকি, ছোটবেলা থেকেই জীবনের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রমণের সময় আমরা কিন্তু কাউকে না কাউকে মনের মধ্যে আদর্শ ব্যক্তির মডেল হিসেবে দাঁড় করাই।
আমি তাদের প্রশ্নের জবাবে বললাম, যতক্ষণ তোমরা বড় হচ্ছে, এই ধরো ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত, তোমাদের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রোল মডেল হবেন তোমাদের বাবা, মা এবং তোমাদের শিক্ষকরা। আমি মনে করি পিতামাতা ও শিক্ষক একটি শিশুর সর্বোত্তম পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন।
আমি শিশুদের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে উপস্থিত অভিভাবক ও শিক্ষক শিক্ষিকার দিকে চাইলাম। শিশুদের প্রতি তাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু কথা বললাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি এই মানুষগুলোর মাধ্যমেই শিশু প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব। শৈশবে আমার নিজের পরিবারে বড় হয়ে উঠতে উঠতে আব্বা আম্মাকে দেখেছি তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। আমাদেরও নামাজের জন্য উপদেশ দিতেন।
নিজেরা দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও আশে পাশের গরীব মানুষকে সাহায্য করতেন। আমার শিক্ষাগুরু শিবসুহ্মমানিয়া আয়ার আব্বাকে পরামর্শ দিয়ে আমাকে স্কুলে পাঠানোর ব্যাবস্থা করেন। প্রত্যেক বাবা-মার উচিত তাদের সন্তানকে এমনভাবে গড়ে তোলা যাতে তারা ভবিষ্যতে কঠোর পরিশ্রমী এক একজন আলোকিত মানুষ হয়ে উঠতে পারে।
একজন শিক্ষক একটি শিশুর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানলাভের দরোজা। শিশুর ভেতরে সৃষ্টিশীলতা জাগ্রত করতে শিক্ষককে অনুসরণীয় মডেল হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে। আমার বিশ্বাস বাবা, মা ও শিক্ষক এই তিনজনই একটি শিশুর ত্রি-মাত্রিক রোল মডেল। আর একটু বৃহৎ পরিসরে বলতে চাইলে বলা যায়, এরা যদি সম্মিলিতভাবে শিশুদের মনে সাধনার বীজ বুনে দিতে পারেন তাহলে এই ভারতবর্ষ নিঃসন্দেহে এক নবজন্ম লাভ করবে। যেমন বলা হয়ে থাকে?
পিতামাতার অন্যপ্রান্তে বিদ্যালয় আর বিদ্যালয়ের অন্যপ্রান্তে বাড়ী–এই হলো শিশুর ঠিকানা। শিক্ষা এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ
আমাদের একজন রোলমডেল দাও থেকে না দেখে জাতীয় উন্নয়ন হিসেবে আমাদের দেখতে হবে। সঠিক শিক্ষা পেলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আত্মসম্মান ও নৈতিক মূল্যবোধের জন্ম হবে। কোন আইন প্রয়োগ করে এই গুণাবলী সৃষ্টি করা যাবে না। আমাদেরই পরিচর্যা করে তা সৃষ্টি করতে হবে।
আমার মূল বক্তব্য অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, তবে আমার এ জবাবে বাচ্চারা খুব সন্তুষ্ট হয়েছিল বলে মনে হল।
আরেকটি মেয়ে খুব সিরিয়াসভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, প্রতিদিনই আমরা খবরের কাগজে পড়ি অথবা মা-বাবাকে আতঙ্ককারীদের বিষয়ে আলোচনা করতে শুনি। এরা কারা? তারা কি আমাদের দেশেরই লোক?
তার এ প্রশ্নটি সত্যিই আমাকে বিদ্ধ করলো। আমি নিজেই এর উত্তর খুঁজছিলাম।
তারা আমাদেরই লোক। কখনও কখনও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শূন্যতার মাধ্যমে আমরাই তাদের সৃষ্টি করেছি। কোন প্রতিক্রিয়াশীল জাতি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করার জন্য, সন্ত্রাসবাদীতার জন্য এদের ব্যবহার করছে। আমি এই ক্ষুদ্র বালিকার নিষ্ঠুর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উপস্থিত দর্শকদের দিকে, আমার পাশে বসা লোকদের দিকে, শিক্ষকদের দিকে এমন কি আকাশের দিকেও দৃষ্টির হাত বাড়ালাম। আমি বললাম, বাচ্চারা, এ মুহূর্তে আমার রামায়ন ও মহাভারত এ দুটি মহাকাব্যের কথা মনে পড়ছে। রামায়নে আমরা সত্যের পক্ষে ভগবান রামকে এবং মিথ্যা ও রিপুর পক্ষে রাজা রাবণকে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে দেখেছি। এটা ছিল সুদীর্ঘ এক জীবন-মরণ যুদ্ধ। কিন্তু শেষমেশ রামেরই জয় হয়েছে। মহাভারতে আমরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা পাই। সেখানেও ধর্ম ও অধর্মের লড়াই। সেখানেও ধর্মের জয় হয়েছিল। যুদ্ধ হয়েছে অনেক, অগনিত, অসংখ্য কিন্তু শান্তির জয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের সময়ে সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ভাল ও মন্দ দুটি পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে। আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে ভাল ও মন্দ স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উভয়ই জয়ী হয়েছে।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর উভয়কেই জ্ঞান ও সুচিন্তা দিয়ে সাহায্য করেছেন।
তামিল নাড়ুর ডিভিগুলে অবস্থিত সেন্ট মেরিস স্কুলের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত আরেকটি জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে আমাকে বক্তব্য রাখতে হয়েছিল। আমার সংগে দেখা করতে আসা অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে দুশিক্ষার্থী একটি প্রশ্নের জবাবের জন্য ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দুজনের একজন বলে উঠলো, আমি আপনার অগ্নি সিরাগুগাল (উইংস অব ফায়ারের তামিল সংস্করণ) বইটি পড়েছি। সেখানে আপনি কেবলই স্বপ্ন দেখার জন্য বাণী দিয়েছেন। এত কিছু থাকতে বার বার স্বপ্ন কেন?
জবাবে আমি উপস্থিত সমবেত শিক্ষার্থীদের এই বাণীটি আবৃত্তি করতে বললাম,
Dream, Dream, Dream.
Dream transform in to thoughts
Thoughts result in action.
আমি বললাম, বন্ধুরা, যেখানে কোন স্বপ্ন নেই, সেখানে বৈপ্লবিক কোন চেতনাও নেই। আর যেখানে চেতনা নেই, সেখানে কোন ভাল কাজও সংঘটিত হতে পারে না।
এ কারণেই পিতামাতা ও শিক্ষকের প্রধান কর্তব্য হলো তাদের শিশু কিশোরদের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করা। স্বপ্নের পথ পাড়ি দিয়েই সাফল্য আসে যদিও সেই পথে রয়েছে নানা বাধা বিপত্তি আর সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা।
ওই দিনই আরেকটি ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, স্যার, পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী কে? তার প্রশ্ন শুনে আমি সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম অগনিত প্রশ্নের মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানের জন্ম ও তার ক্রমবিকাশ। সমগ্র বিজ্ঞানের ভিত্তিই হল প্রশ্ন। পিতামাতা ও শিক্ষকরাই ভালো জানেন যে শিশুরাই সীমাহীন প্রশ্নের উৎসমুখ। আর এ কারণে আমি সেই ছেলের প্রশ্নের জবাবে বললাম, শিশুরাই পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী। আমার জবাব শুনে তুমুল করতালি বর্ষণ শুরু হল। ছেলেমেয়েরা আমার এ ভিন্নধর্মী চিন্তার বিষয়টিতে ভারি আনন্দ পেয়েছিল। আমার জবাব শুনে অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাও হেসে ফেললেন।
আসাম সফরের সময় আমি তেজপুর পরিদর্শন করেছিলাম। তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। সমাবর্তন শেষে আমি স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের সংগে দেখা করতে গেলাম। আমার সামনে অসংখ্য শিশু কিশোরের জটলা। তাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া আমার সেদিনের বক্তব্যের প্রতিপাদ্য ছিল দুর্দর্ষণীয় শক্তি। বক্তব্য শেষ করতেই কচিকাঁচারা আমাকে অটোগ্রাফের জন্য ঘিরে ধরলো। অটোগ্রাফ দেওয়া শেষ হলে আমি আমাদের একজন রোলমডেল দাও দুটো প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। এর একটি হলো : সারা বছরের থৈ থৈ ব্রহ্মপুত্রের স্রোত কেন বিশুষ্ক জলহীন রাজস্থান ও তামিল নাড়ু তে গতি পরিবর্তনের মাধ্যমে পাঠানো হয় না?
একমাত্র শিশুরাই এ ধরনের অভিনব ধারণার জন্ম দিতে পারে। বড় হওয়ার পর মানুষ তাদের আইডিয়া বাস্তবায়নের পথে নানা অসম্ভাব্যতা আবিষ্কার করে। এটি এত শক্তিশালী ও তীব্র প্রশ্ন ছিল যে আমি পুরোপুরি ধাক্কা খেলাম। আমি নিশ্চিত যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। আমি ওই বাচ্চাটিকে কীভাবে বোঝাবো যে নদী হলো রাজ্য সরকারের সম্পত্তি এবং আমাদের সরকার ওই পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
আমি বললাম, ইণ্ডিয়া ভিশন ২০২০ তোমাদের মত তরুণ কিশোরদের কাছে প্রত্যাশা করে তারা ২০২০ সালের মধ্যে রাজ্যগুলোর মধ্যে কৃত্রি করে এক নদীর সংগে আরেকটিকে সংযুক্ত করবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি তরুণদের মধ্যে সর্বোচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মেধা রয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আত্মকেন্দ্রীক নীতি ও নেতিবাচক পুঁজিবাদী চিন্তা পরিহারের শক্তি তরুণদের কাছে সবচে বেশী। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের সংগে রাজ্য সরকারগুলোর সমন্বয় প্রক্রিয়া তারাই উন্নত করতে পারে। আর অবশ্যই তারা তা করবেও।
আরেকজন ছাত্র আমাকে এমন একটি প্রশ্ন করেছিল যার জবাব দেবার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। সে বলেছিল, স্যার, বড় বড় নেতারা আমাদের কাছে আসেন না, আমাদের সংগে কথাও বলেন না। প্রধানমন্ত্রীজি প্রায়ই চেন্নাই, লক্ষ্ণৌ, আরও কত কত জায়গায় যান কিন্তু এখানে তো আসেন না। আমরা এখানে তাকে চাই, তার সংগে কথা বলতে চাই। আমি দেশনেতাদের সংগে তার যোগাযোগের স্পৃহা দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। আমি তাকে বললাম, দিল্লি পৌঁছে আমি নেতাদেরকে তোমার স্বপ্নের কথা বলবো। তোমার স্বপ্ন অবশ্যই সত্যি হবে।
দিল্লি ফিরে আমি সত্যি সত্যি প্রধানমন্ত্রীকে এ ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বিনীতভাবে বিষয়টি স্বীকার করে বললেন, আসলেই বাচ্চারা আমার সংগে কখনও কথা বলার সুযোগ পায় না। হয়তো নিরাপত্তা ব্যবস্থাই তাদের সংগে আমার দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত সৃষ্টির স্বার্থে শিশুদের সংগে বেশী বেশী যোগাযোগ রাখার জন্য আমি প্রায়ই বিভিন্ন ক্ষেত্রের নেতৃবৃন্দকে পরামর্শ দিয়ে থাকি।
ঝাড়খণ্ড সংস্কার উদ্যোগী হওয়ার পর আমি বহুবার সেখানে সফর করেছি। যতবার আমি সেখানে গেছি ততবারই সেখানকার উন্নয়ন ধারা দেখে হতবাক হয়েছি। বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের উদ্যোগ দেখে ভেবেছি এবার সেখানে কত সম্পদের সদ্ব্যবহার হবে। বোকারোতে অবস্থিত রামকৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে একবার ৩ হাজার ছাত্রছাত্রীর মাঝে বক্তব্য দিয়েছিলাম। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের হাতে আঁকা পেইন্টিং, পুতুল, খেলনা সামগ্রীর প্রদর্শনী দেখে তাদের সৃজনশীলতায় অবাক হয়েছি। তাদের সংগে কথোপকথনের এক পর্যায়ে এক ছাত্র আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদের এই ঝাড়খণ্ডের সবখানেই সবুজের সমারোহ। এখানে অরণ্য, নদী, পাহাড় সবই আছে। কিন্তু রাজস্থানে কেন মরুভূমি? তার এ প্রশ্ন আসামের সেই ছাত্রের প্রশ্নটির কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল। কেন ব্রহ্মপুত্রের পানি তামিলনাড় ও রাজস্থানে নেওয়া হচ্ছে না?
আমি বললাম, তোমরা জান, মাত্র ২০ বছর আগেও রাজস্থানে এখন যে চাষাবাদ হয় তাও হতো না। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী খাল খননের পর সেখানকার অনেক জায়গায় চাষাবাদ সম্ভব হয়েছে। মানুষের পক্ষেই একটি মরুভূমিকে উর্বর ভূমিতে পরিণত করা সম্ভব। আসামের ছাত্রদের যে কথা বলেছিলাম, এখানেও তার পুনরাবৃত্তি করলাম, ভারতের নদী সংযোগ বিষয়ক পরিকল্পনা আছে যাতে জলশূন্য এলাকায় পর্যাপ্ত পানি পৌঁছে দেওয়া যায়। তোমরা বড় হয়ে সরকারের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করবে।
একটি ছোট্ট সোনামণি গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে খুব সিরিয়াস এক্সপ্রেশন নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, আপনার বানানো অগি মিসাইল কি সাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় আঘাত করতে পারবে?
তার এ কথায় আমি হোঁচট খেলাম। আমি বললাম, আমাদের এমন কোন শত্রু দেশ নেই যেখানে অগ্নি মিসাইল দিয়ে আঘাত করতে হবে। তাছাড়া আমেরিকা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। অগ্নি আমাদের শক্তির প্রতীক। অগ্নি শুধু এটুকু প্রমাণের জন্য যে ভারতের সব ধরনের ক্ষমতা রয়েছে।
কটক সফরের সময় আমি স্বর্গীয় বিচারপতি হরিহর মহাপাত্রর জন্মদিন উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। বিচারপতি রঙ্গনাথ মিশ্রর নিমন্ত্রণে মূলত সেখানে যাই। সেখানে গিয়ে আমি মানবজীবনকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম। বিচারপতি হরিহর মহাপাত্র সেখানে মৃত্যুকে জয় করে যেন সবার মাঝে বেঁচে আছেন। ৯২ বছরের জীবনে কটকে তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন-কটক চক্ষু হাসপাতাল, উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং দারিদ্র্যবিমোচন বিষয়ক কয়েকটি
আমাদের একজন রোলমডেল দাও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে উড়িয়া ভাষায় আমার আত্মজীবনী প্রকাশ পেয়েছিল। আমার বক্তব্য শেষ হতেই কিশোর তরুণরা আমাকে ঘিরে ধরলো।
তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, স্যার কোন কোন বই আপনার প্রিয় যা আপনার মনন গঠনে সহায়তা করেছে?
আমি বললাম, আমার পড়া চারটি বই আমার আত্মার খুব কাছাকাছি। প্রথমটি হলো, নোবেল জয়ী লেখক ডক্টর অ্যালেন্সিস ক্যারেলের লেখা ম্যান দ্য আনোন। যেহেতু মন ও শরীর অবিচ্ছেদ্য বিষয় সেহেতু রোগীর চিকিৎসার জন্য মন ও শরীরের চিকিৎসা যুগপৎভাবে হওয়া উচিত। এ বইয়ে রোগীকে সারিয়ে তুলতে কীভাবে মন ও শরীরের চিকিৎসা করা দরকার তা নির্দেশ করা হয়েছে। একটিকে অবহেলা করে অপরটি সারিয়ে তোলা যায় না। যারা বড় হয়ে চিকিৎসক হবার স্বপ্ন দেখছে তাদের এটা পড়া উচিত। এটিপড়লে জানা যাবে মানবদেহ কোন যান্ত্রিক কাঠামো নয় বরং অত্যন্ত মেধাদীপ্ত উপায়ে নির্মিত ও স্পর্শকাতর ফিডব্যাক সিস্টেমে পরিচালিত একটি অর্গানিজম। দ্বিতীয় প্রিয় বইটি হল, তিরুভালুভারর লেখা থিরুকুরাল। এতে জীবনের অপূর্ব কিছু দিক নির্দেশনা রয়েছে। তৃতীয় বইটি হচ্ছে লিলিয়ান ইখলার ওয়াটসনের লেখা বই লাইট ফ্রম মেনি ল্যাম্পস্। আমাদের কীভাবে বাঁচতে হবে তার নির্দেশনা রয়েছে এ বইটিতে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে বইটি আমার অমূল্য পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। সর্বোপরি পবিত্র কোরান শরীফ আমার সার্বক্ষণিক সংগী।
গুজরাটের আনন্দতে শিশু সমাবেশে বক্তব্য দেবার পর চটপটে একটা ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদের শত্রু কে? আমি তার প্রশ্নটি অন্য ছাত্র ছাত্রীদের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম এবং তাদের কাছে উত্তর জানতে চাইলাম। ওদের একজন উত্তর দিল, দারিদ্র্য।
আমার কল্পনার আলোকিত শিশুদের মত তারা কি সুন্দর প্রজ্ঞাময় জবাব দিয়ে দিল।
সেখানকার শেষ প্রশ্নটি চমকাবার মতই। অন্য আরেকটি শিশু দাঁড়িয়ে বললো, স্যার, পাকিস্তানি অস্ত্র কি ভারতের চেয়ে শক্তিশালী? আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম কেন তার মাথায় এ ধরনের চিন্তা এল? সে জানাল সংবাদমাধ্যমগুলোই তাকে এভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। আমি বললাম, শক্তি সামর্থ্য প্রদর্শন করা আমাদের দেশের চরিত্রের এক অনুপম দিক। এটা হয়তো আমাদের জেনেটিক কারণেও হতে পারে। আমি তাকে বললাম, ভারত যেকোন ধরনের মিসাইল ও পারমাণবিক বোমার ডিজাইন করতে, তা উন্নত করতে ও প্রস্তুত করতে সক্ষম। সারাপৃথিবীতে এ ক্ষমতা মাত্র ৪টি দেশের আছে। আমি তাকে মন থেকে সমস্ত সন্দেহ ও উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলার জন্য বললাম। সে আমাকে খুব সুন্দর একটা বই উপহার দিয়েছিল।
আমি ভারতবর্ষের বহু স্কুল পরিদর্শন করে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর মুখোমুখি হয়েছি। তারা আমাকে যে শত শত প্রশ্ন করেছিল তার থেকে বেছে বেছে মাত্র ১১টি প্রশ্নের কথা আমি উল্লেখ করলাম। এ প্রশ্নের মধ্যে তাদের সারল্য ফুটে উঠলেও পরিস্কারভাবে বোঝা যায় তারা একটি উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য কত শক্তিশালী কল্পনা হৃদয়ে লালন করছে।
তাদের সংগে আলাপচারিতায় আরেকটি বিষয় আমি বুঝতে পারছি বিজ্ঞান, শিল্প বাণিজ্য, ক্রীড়া, বিনোদন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য রোল মডেল এখন কী ভয়ানক জরুরী।
এখন একটি প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমরা কি আমাদের সন্তানদের সামনে একজন রোল মডেল বা আদর্শ ব্যক্তিত্ব হাজির করতে পারব? যদি পারি তাহলে কীভাবে তা পারব?
নতুন সহস্রাব্দের সূচনালগ্ন জিন প্রযুক্তির সুসংবাদ বয়ে এনেছে। মানুষ যে বিশেষ ধরনের ৩০ হাজার জিন তার দেহে বহন করছে তা হাজার হাজার বছর আগে জন্ম নেওয়া প্রস্তর যুগের পূর্বপুরুষদের চরিত্র বহন করে।
লক্ষণ প্রকাশ পায় আমাদের সমৃদ্ধজীবন লাভের চেষ্টার মাধ্যমে। আমাদের পূর্বপুরুষদের মত আমরাও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য, একটি স্বচ্ছল জীবন অর্জনের জন্য লড়াই করে চলেছি।
বলা হয় প্রকৃতিই এত প্রয়োজন ও অভাবের সৃষ্টি করেছে। উৎপাদনের প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে, খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করেছে, নিঃশ্বাস নেবার প্রয়োজনীয়তা তৈরী করেছে। ইতিহাসে দেখা যায় ক্ষুধার জন্যই মানুষকে সবচেয়ে বেশী সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমরা হয়তো আমাদের পেছনের করুণ ইতিহাস ভুলে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস মনে রাখতেই হবে।
আমি তিন দশক ধরে ডক্টর বিক্রম সারাভাইর সাফল্য অর্জনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা দেখেছি। তার সংগে যারা কাজ করেছে তাদের সবারই স্বপ্ন ছিল বিক্রমকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার। আমরা তাকে রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করে কাজ করেছি। বিক্রম সারাভাইর কর্মস্পৃহা এত প্রখর ও শক্তিশালী ছিল যে মৃত্যুর বহু বছর পরেও তার ছাত্রছাত্রী তার স্বপ্নকে সফল করেছিল। তোমার জীবনের রোল আমাদের একজন রোলমডেল দাও মডেল হবে এমন কেউ যাকে তুমি সবচেয়ে বেশী ভালবাস ও যার কাজ তোমার সবচে বেশী ভাল লাগে– সে হতে পারে ক্রীড়াবিদ, শিক্ষক অথবা, যে কোনও সফল মানুষ।
সম্প্রতি একজন মূর্তিমান রোল মডেল ও জীবিত লিজেন্ড চরিত্রের সংগে আমার দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি ভারতের কীংবদন্তি শিল্পী লতা মুঙ্গেশকর।
লতার বাবা স্বর্গীয় ওস্তাদ দীননাথ মুঙ্গেশকরের স্মরণ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছিলেন তিনি। ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত লতাজি আমাকে তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত ৪৫০ শয্যার দীননাথ হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ জানানোয় আমি গর্ববোধ করেছিলাম। উদ্বোধনের কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালটি ঘুরে দেখেছি। দেখলাম হাসপাতালের প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী সেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবে। এ ঘটনা আমাকে মুগ্ধ করলো এজন্য যে অঢেল ঐশ্বর্য ও খ্যাতি পাওয়া সত্ত্বেও লতা মুঙ্গেশকর একজনের সহায়তায় দশজনের দুঃখ লাঘব হতে পারে। যুগ যুগ ধরে রেডিওতে তার গান শুনে অগনিত মানুষ আনন্দ উপভোগ করছে। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন সংঘাতের সময় তার অ্যায় মেরে বাতান কি লোগো গানটি পুরো জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিল। এমন আনন্দপূর্ণ উপায়ে লাখ লাখ মানুষকে খুব কম লোকই প্রভাবিত করতে পারে।
আদর্শ ব্যক্তিত্বরা বা (আমার ভাষায়) রোল মডেলরা আমাদেরকে ব্যক্তি হিসেবে দল হিসেবে এবং অবশ্যই জাতি হিসেবে কী করণীয় তার দিক নির্দেশনা দেন। সুবিশাল সাফল্যের ক্ষেত্রেও তারাই নেতৃত্ব দেন। তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি সফলতার পথে আসতে পেরেছি বলে মনে হয়। কিন্তু এর সংগে অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনা করা ঠিক হবে না বা বলা যাবে না আমরা অমুক অমুক ক্ষেত্রে পিছিয়ে।
প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল আদ্যোপান্ত একটি জ্ঞান সম্ভারপূর্ণ সমাজ। গণিতবিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, মহাকাশতত্ত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের অতুলনীয় নেতৃত্বের ইতিহাস রয়েছে। এই উচ্চ প্রযুক্তির যুগে সাধারণ শ্রমিকের কাজে আটকে না থেকে ভারতে এখনই এমন এক শিক্ষা বিপ্লব ঘটানো দরকার যাতে আবার আমরা জ্ঞানে ও মেধায় বিশেষ একটি সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারি।
৩. দূরদর্শী শিক্ষাগুরু–দূরদর্শী বিজ্ঞানী
৩. দূরদর্শী শিক্ষাগুরু–দূরদর্শী বিজ্ঞানী
Whatever you can do or dream you can, begin it. Boldness has genius, power and magic in it. Begin it now.
–Goethe.
এদেশের ক্ষণজন্মা মহাত্মাদের এমন কিছু ক্ষমতা ছিল যা দিয়ে তারা সাধারণ জনগণের মধ্যে নিজেদের আদর্শ প্রতিস্থাপন করে মোহনীয় স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে পারতেন। তাদের কাছে আপনার চেয়ে বড়, নিজের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেশ ও জাতি। স্বপ্নকে তারা হাজারবার বাস্তবে রূপ দিয়ে গেছেন।
২০০০ সালের ডিসেম্বরে আধিয়াপাকা রত্ন টি, তোতাদ্রি আয়েঙ্গারের জন্মশতবর্ষ পূর্তি উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম। ১৯৫৪ সালে তিরুচিরাপল্লীর সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করি। তরুণ ছাত্রবয়সে আমি অধ্যাপক টি. তোতাদ্রি আয়েঙ্গারকে দেখেছি। অনুপম আর ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ মানুষটি প্রতিদিন কী দৃপ্ত পদক্ষেপে কলেজ চত্ত্বর দিয়ে হেঁটে যেতেন। বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসির ছাত্রছাত্রীদের গণিত ক্লাস নিতেন তোতাদি স্যার। ছাত্ররা পরম শ্রদ্ধা ও সমীহ নিয়ে তাদের গুরু হিসেবে তার দিকে চেয়ে থাকতো। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেনও তাই। তিনি যখন হাঁটতেন, মনে হতো তার চারপাশে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ঝলমল করে উঠতো। ক্যালকুলাস শ্রীনিবাস ছিলেন আমাদের গণিতের শিক্ষক। তিনি প্রায়ই অধ্যাপক তোতাদ্রি আয়েঙ্গারের কথা বলতেন গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে।
তিনি চাইতেন বিএসসি (সম্মান)র প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা যেন তোতাদ্রি স্যারের সংস্পর্শে আসে, তার ক্লাসে ঠিকমত উপস্থিত হয়। তার বেশ কয়েকটি ক্লাসে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, বিশেষ করে আধুনিক আলজেব্রা ও পরিসংখ্যানের ক্লাসগুলোতে।
আমরা যখন বিএসসি প্রথম বর্ষে তখন ক্যালকুলাস শ্রীনিবাস স্যার আমাদের ক্লাস থেকে শীর্ষস্থানীয় দশজন মেধাবী ছাত্রকে বেছে নিয়ে সেন্ট জোসেফ কলেজের গণিত ক্লাবের সদস্য করান। তাদের মধ্যে তোতাদ্রী বেশ কয়েকটি লেকচার দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, ওই সদস্যদের মধ্যে আমিও ছিলাম।
১৯৫২ সালের কোন একদিন প্রাচীন ভারতবর্ষের গনিতবিদ ও জ্যোতির্বিদদের বিষয়ে একটি লেকচার দিয়েছিলেন। তিনি কথা বলেছিলেন টানা একঘণ্টা। তার সে বক্তব্য আজও আমার কানে বাজে। আমার শিক্ষক তোতাদ্রির মত প্রাচীন ভারতের অসংখ্য গণিতবিদ ও তাদের কর্মশক্তির ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত চিন্তা চেতনা পাঠকের সংগে শেয়ার করা যাক–
৪৭৬ সালে কুসুমপুরে (বর্তমান পাটনা) আর্যভট্ট নামে একজন জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞের জন্ম হয়েছিল। তখনকার সময় পর্যন্ত আবিষ্কৃত গণিতের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার ছিল অগাধ জ্ঞান। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি দুই খণ্ডে সমাপ্ত বই আর্যভট্টম লিখেছিলেন। এ বইয়ের বিষয় ছিল অ্যারিথমেটিক, অ্যালজেবরা, ত্রিকোণমিতি এবং অবশ্যই জ্যোতির্বিদ্যা। তিনি ত্রিভূজ ও বৃত্তের ক্ষেত্রফল সম্পর্কে ফর্মুলা দেন। এছাড়া গোলক ও পিরামিডের আয়তন ও ঘনত্ব পরিমাপের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এ বিজ্ঞানী। তিনিই প্রথম বৃত্তের জ্যা ও ব্যাসের অনুপাত হিসেবে ৩,১৪১৬ সংখ্যাটি উদ্ভাবন করেন। এই মহান জ্যোতির্বিদের স্মরণে ভারত ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মত যে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে পাঠিয়েছিল তার নাম দেওয়া হয় আর্যভট্ট।
রাজা হর্ষদত্তের শাসনামলে রাজস্থানের বিল্পমালায় ৫৯৮ সালে জন্মেছিলেন ব্রহ্মগুপ্ত নামের আরেক বিজ্ঞানী। তিরিশ বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক বই ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত।
তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি সাধন করেন। এছাড়া গণিত ও জ্যামিতিক্ষেত্রেও তার ছিল অগাধ জ্ঞান। গণিত শাস্ত্রের বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। একই সংগে চতুর্ভুজ সংক্রান্ত জটিল জ্যামিতিক সমস্যারও সমাধান দেন তিনি।
ভাস্করাচার্য নামের আরেক ভারতীয় বিজ্ঞানী তার সময়ের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এখনকার কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী অঞ্চল বিজ্জলবাড়াতে ১৯১৪ সালে জন্মেছিলেন এই মহান পুরুষ। চারটি অধ্যায় সম্বলিত তার লেখা বিখ্যাত বই সিদ্ধান্তশিরোমনি! জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বীজগণিত ছিল তার অধীত বিষয়। ভাস্করাচার্যই হলেন সেই ভারতীয় বিজ্ঞানী যিনি আর্যভট্টর আবিষ্কারগুলোর ভিত্তিতে সর্বপ্রথম গণিতে জিরো বা শূন্য সংখ্যাটির ধারণা দেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আইএসআরওর দ্বিতীয় দফায় নির্মিত দুটি স্যাটেলাইটের নাম রাখা হয় ভাস্কর-১ ও ভাস্কর-২ (প্রথমটি নির্মিত হয় ১৯৭৯ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯৮১ সালে)।
এই তিন ভারতীয় গণিতজ্ঞের কথা মাথায় রেখেই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, আমরা ভারতীয়দের কাছে বহুলাংশে ঋণী যারা আমাদের গুনতে শিখিয়েছে, যা ছাড়া আজকের এই বিশাল বিশাল জিনিসের আবিষ্কার কিছুতেই সম্ভব হতো না।
এদের পরে যার নাম আমার মনে আসছে তিনি উনবিংশ শতকের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও সর্বস্বীকত বিজ্ঞানী শ্রীনিবাস রামানুজ। মাত্র ৩৩ বছরের আয় নিয়ে। জন্মেছিলেন রামানুজ (১৮৮৭-১৯২০) এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও ছিল না তার। তারপরেও শুধুমাত্র তার অবিচল আগ্রহ ও গণিতের প্রতি ভালোবাসা তাকে গণিত শাস্ত্রের গবেষণায় অমূল্য অবদান রাখতে সহায়তা করেছিল। তার বহু সূত্র আনুষ্ঠানিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের জন্য গণিতজ্ঞরা অক্লান্ত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
রামানুজ এমন এক বিস্ময়কর মেধা যিনি কিনা ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক জিএইচ হার্ডির মত পণ্ডিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এটা মোটেই অতিরঞ্জিত বক্তব্য নয় যে জিএইচ হার্ডিই রামানুজকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা কেন আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আরেকটি রামানুজকে আবিষ্কার করতে পারছে না। ওহ আমার বন্ধুরা, তোমরা কেন তোমাদের স্ব স্ব ক্ষেত্র অন্তর দিয়ে আঁকড়ে ধরছে না আর কেন মহীরুহের মত আত্মপ্রকাশ করছে না?
কোন একজন গণিতজ্ঞ রামানুজের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন, প্রত্যেকটি পূর্ণ সংখ্যাই রামানুজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার এ কথা মোটেই অতিরঞ্জিত ফাপা বক্তব্য নয়। অধ্যাপক হার্ডি একবার সর্বোচ্চ মাত্রা ১০০ ধরে বিভিন্ন বিজ্ঞানীকে নম্বর দিয়েছিলেন। অধিকাংশই হার্ডির বিবেচনায় পেয়েছিলেন ৩০ নম্বর। শুধু রামানুজই পেয়েছিলেন ১০০র মধ্যে ৬০ নম্বর। হার্ডির মতে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা শাখার যেকোন ক্ষেত্রেই রামানুজ ১০০ শতাংশ উপযোগী। রামানুজ অথবা ভারতীয় ঐতিহ্যকে এত বড় সম্মান সম্ভবত আর কেউ দেয়নি।
রামানুজের পদচারণ ক্ষেত্র ছিল বিস্তীর্ণ ও বিশাল। মৌলিক সংখ্যা, জটিল জ্যামিতিক সিরিজ, কম্পিউটারের সংযোজনে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক গঠন উপাদানের একক বা মডিউলার ফাংশান, ম্যাজিক স্কোয়ার, উপবৃত্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে রামানুজের সূত্র অনুকরণ করা হয়।
আমি আশা করি আমাদের পণ্ডিত শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের শিক্ষকতার জীবন শেষ করে সরকারী উচ্চ পদে আসীন হলে তারা সেখানেও তাদের জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেবেন এবং স্ব স্ব বিষয়গুলোর অনুশীলন চালিয়ে যাবেন। এমনই একজন মানুষ অধ্যাপক এস, চন্দ্রশেখর। তিনি তার কাজের বাইরেও ভারতীয় ঐতিহ্যের গণিত চর্চা করেন। গণিত সন্দেহাতীতভাবেই বিশ্বজনীন। এখন আমাদের ঐতিহ্য অধ্যাপক সি, এস. শেষার্দি, অধ্যাপক জে. ভি. নারলিকর, অধ্যাপক এম. এস. নরসিমা, অধ্যাপক এস. আর. এস, বর্ধন, অধ্যাপক এম. এস, রঘুনাথ, অধ্যাপক নরেন্দ্র কর্মকার এবং অধ্যাপক অশোক সেনের মত জ্ঞানতাপসদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বিকশিত হচ্ছে।
স্যার সি, ভি, রমন কলকাতার একটি অফিসে অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেছিলন। কিন্তু তার হৃদয়ের মধ্যে যে আরেকজন বিজ্ঞানী সি. ভি. রমন ছিল তাকে তিনি বিশ্রাম নিতে দেননি। যেসব রহস্যময় সমস্যা ও প্রশ্ন তাকে আগ্রহী করেছে তিনি অসীম ধৈর্যের সংগে তা সমাধানের পথ খুঁজেছেন। সৌভাগ্যবশত তিনি মহান শিক্ষাবিদ স্বর্গীয় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। তিনি সি. ভি. রমনকে তার গবেষণা চালিয়ে যেতে অনিবার উৎসাহ যোগাতেন।
একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, স্যার সি, ভি. রমন যে আবিষ্কারের জন্য পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পেলেন সেই রমন ইফেক্ট কিন্তু বিশাল ব্যায়বহুল কোন প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগার থেকে আসেনি। একই ঘটনা দেখেছি আমরা অধ্যাপক এস, চন্দ্রশেখরের বেলাতেও। তিনিও নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ব্ল্যাকহোল বিষয়ে কাজ করার মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে তিনিও ব্যায়বহুল প্রযুক্তি ও গবেষণাগার ব্যবহার করেননি। কামেশ্বর সি, ওয়ালীর লেখা চন্দ্রশেখরের জীবনী গ্রন্থ চন্দ্রতে কিছু মজার তথ্য ও বিবৃতি পাওয়া যায়।
যেমন, বইটির এক জায়গায় বলা হয়েছে, চন্দ্র বড় হয়ে ছিলো এমন এক সময়ে যখন ভারতবর্ষ বিজ্ঞান, কলা ও সাহিত্যে এক স্বর্ণালী অবস্থানে ছিল, পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল। সে সময় জে. সি. বোস, সি. ভি. রমন, মেঘনাদ সাহা, শ্রীবাস রামানুজ এবং রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি জওহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধীর মত বহু মহাত্মা তাদের বৈজ্ঞানিক ও সৃজনশীল সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে জাতীয় বীর হয়ে উঠেছিলেন।
তাদের সুবিশাল সাফল্যসমূহ তখন ভারতে সৃষ্টিশীলতার পরিবেশ তৈরী করেছিল। চন্দ্রশেখরই ওই সময়টাকে সম্ভবত সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ভাষায়, ১৯১০ সালের আগের সেই আধুনিক যুগে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন (ভারতীয়) বিজ্ঞানীও ছিলেন না। ১৯২০ ও ১৯২৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এসে আমরা হঠাৎই পাঁচ ছয়জন বিশ্বখ্যাত (ভারতীয়) বিজ্ঞানীর সন্ধান পাই।
আমার আত্মপ্রকাশের প্রয়োজনেই আমি ওই সময়কার উল্লেখযোগ্য কিছু কাজের সংগে যুক্ত হয়েছিলাম। আমার সময়ে তরুণরা জেগে উঠেছিল জাতীয় বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে। বিজ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করাও তখন জাতীয় বিপ্লবের অংশ হয়ে উঠেছিল। ভারত সে সময় পরাধীন দেশ ছিল কিন্তু…. বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা তখন বুঝিয়ে দিয়েছিলাম আমরা তাদের চেয়ে কম নই।
এখানে আমি সি. ভি. রমনের একটি উদ্ধৃতি টানতে চাই। ১৯৬৯ সালে তরুণ স্নাতক ডিগ্রিধারীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমার সামনে উপস্থিত তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলতে চাই যে তারা যেন আশাহত না হয়, তারা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে। সাহসের সাথে সাধনা করলে সফলতা তোমাদের সামনে এসে ধরা দেবে। আমি সমস্ত মতবিরোধের ভয়কে প্রত্যাখ্যান করে, সমস্ত সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বলতে চাই ভারতীয়দের মেধা যে কোন টিউটোনিক, নর্ডিক অথবা অ্যাংলো-স্যাক্সনের মেধার সমান। কিন্তু আমাদের যে জিনিসের অভাব রয়েছে সেটি হল সাহস।
আমাদের পরিচালিত শক্তির অভাব রয়েছে। আমি মনে করি, আমরা সুদীর্ঘ সময় ধরে হীনমন্যতায় ভুগে তাকে এখন এক বিশাল বিষবৃক্ষে পরিণত করেছি। আমার মনে হচ্ছে ভারতবর্ষকে যে বিষয়টি তিলে তিলে ধ্বংস করে ফেলছে তা হলো আমাদের পরাজয়প্রবণ নির্জীব শক্তি। এ মুহূর্তে আমাদের সবচে বেশী প্রয়োজন সাহসী ও তেজোদীপ্ত স্পৃহা। আমাদের প্রয়োজন এমন স্পৃহা যা সূর্যের নিচের এই ভোলা পৃথিবীর বুকে আমাদের নায্য অধিকারের জায়গায় আসীন করবে। প্রয়োজন এমন শক্তির যা আমাদের নিজেদেরকে চিনতে শেখাবে আর গৌরবময় এক সভ্যতার উত্তরসূরী হিসেবে এই গ্রহের নায্য ঠিকানায় আমাদের পৌঁছে দেবে। যদি সত্যিই আমরা সেই দুর্দমনীয় শক্তিকে জাগ্রত করতে পারি, তাহলে পৃথিবীর কোন শক্তিই আমাদের ঈপ্সিত গন্তব্যে পৌঁছবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
বিজ্ঞানের বাইরের অন্যান্য সম্মানজনক ক্ষেত্রের মহান ব্যক্তিত্বরাও একইভাবে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
খুব লক্ষনীয় ব্যাপার হলো সংগীত জগতের তিন সাধক, ত্যাগরাজা সায়গল, মাথুস্বামী দিক্ষিদার ও শ্যাম শাস্ত্রীগল ওই একই সময় দক্ষিণ ভারতের মাত্র ৫০ কিলোমিটার বৃত্তায়তনের এলাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। আমাদের খেয়াল করতে হবে ওই সময়ে ভারতে কলা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, ইতিহাস ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভুবনবিখ্যাত কিছু পুরুষের জন্ম হয়েছিল যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি শক্তি যুগিয়েছেন।
এই নিকট সম্প্ৰতিতেও আমরা বড় বড় বিজ্ঞানীদের আবির্ভূত হতে দেখেছি।
বিশেষ করে তিনজন বিজ্ঞানীর জীবনী আমাকে সবচে বেশী টানে– ডক্টর ডি, এস, কোটারি, ডক্টর হোমি জে, ভাভা এবং ডক্টর বিক্রম সারাভাই। জাতীয় উন্নয়নে সহায়ক তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রের নেতৃত্বপূর্ণ গুণাবলী সম্পর্কে জানতে আমি বহুবার আগ্রহী হয়েছি। এই তিন বিজ্ঞানী ভারতের তিনটি বিশাল প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছিলেন ডিআরডিও, ডিএই এবং আইএসআরও।
ডক্টর ডি.এস. কোটারি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত একজন সুবিখ্যাত পদার্থবিদ ও জ্যোতিবস্তুবিদ্যা বিশারদ। গ্রহের মত শীতল ঘনীভূত কোন কিছুর দিকে বেতার তরঙ্গকে চাপের মাধ্যমে নামিয়ে আনা বা আয়োনাইজেশন (lonization)র সূত্র আবিষ্কারের জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিত।
ডি.এস, কোটারির এ থিওরিটি ছিল তার গুরু ড. মেঘনাদ সাহার আবিষ্কৃত নবযুগের সূচনাকারী তাপসংক্রান্ত আয়োনাইজেশন থিওরির এক পূরক সূত্র। ১৯৪৮ সালে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উপদেষ্টা নিযুক্ত হবার পর কোটারি ভারতের প্রতিরক্ষা কাজে বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বনের রীতি চালু করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতে তিনি প্রথম ডিফেন্স সায়েন্স সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন যাতে প্রতিরক্ষা বিভাগ সেখানে বৈদ্যুতিক বিষয়াদি, পারমাণবিক ওষুধপত্র ও ব্যালিস্টিক সায়েন্সের ওপর গবেষণা করতে পারে। তাকে একারণে ভারতের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ভারতীয় বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে তার সম্মানে একটি খালি চেয়ার রেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের ওপর গবেষণা করতেন ডক্টর ভাভা। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি মহাজাগতিক রশ্মি সম্পর্কিত গবেষণা করেন। ১৯৩৯ সালে ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত IIScতে স্যার সি. ভি. রমনের সংগে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করলেন। পরবর্তীতে তিনি গড়ে তোলেন টাটা ইন্সটিটিউট অব ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চ। এখানকার গবেষণার মূল বিষয় ছিল গণিত ও পরমাণু বিজ্ঞান। ১৯৪৮ সালে তিনি গড়ে তোলেন অ্যাটোমিক অ্যানার্জি কমিশন। তার মূল লক্ষ্য অনুযায়ী আরও বেশ কয়েকটি পরমাণু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হল যেখানে পরমাণু বিদ্যুত উৎপাদন অথবা পারমাণবিক ওষুধপত্র আবিষ্কারের গবেষণা শুরু হল।
এই বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি কেন্দ্রের জন্ম দিল যেখানে পরমাণু বিজ্ঞানকেই মূল গবেষণার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
এই তিনজনের মধ্যে বয়সে সবচে তরুণ ছিলেন ডক্টর সারাভাই। তিনি স্যার সি. ভি. রমনের সংগে পরীক্ষামূলক মহাজাগতিক রশ্মির ওপর গবেষণা করতেন। সারাভাই আহমেদাবাদে প্রতিষ্ঠা করেছেন ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি যেখানকার মূল গবেষণার বিষয় হলো স্পেস। ১৯৬৩ সালে বায়ু মণ্ডলীয় গবেষণার জন্য তার প্রতিষ্ঠিত থাম্বা ইকুয়েটরিয়াল রকেট লাঞ্চিং স্টেশন থেকে রকেট উৎক্ষেপন শুরু হয়। ডক্টর সারাভাই স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান স্যাটেলাইট রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা আইএসআরও। এ প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধানে এখন নভোযান ও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করা হচ্ছে, অভিযানগুলো ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করা হচ্ছে।
এই তিন ভারতীয় বিজ্ঞানী সবাই ছিলেন পদার্থবিদ। তারা পদার্থবিদ্যার গবেষণাস্থল হিসেবে যে সকল প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন আজ সেগুলো প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, পারমাণবিক প্রযুক্তি ও স্পেস প্রযুক্তির গবেষণা মন্দির হিসেবে বিকশিত হয়েছে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা প্রতিষ্ঠানে এখন প্রায় ২ হাজার বিজ্ঞানী গবেষণা করছেন।
একটি বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে যে এই তিন বিজ্ঞানী বুঝতে পেরেছিলেন বিজ্ঞান কীভাবে দেশের জন্য কাজ করে তা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বুঝতে হবে। তাদের বক্তব্য ছিল–
যে সকল প্রযুক্তি জনগণের জন্য দ্রুত উন্নয়ন বয়ে আনে সেগুলোর ব্যবহার প্রচলন করতে হবে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়, তা সে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন। এদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হলো প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বিজ্ঞান ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্বের উন্নয়নের ক্ষেত্রে মৌলিক বিজ্ঞানই হল মুখ্য। আন্তরিকভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মূল্য বুঝতে হলে তাদের কাছ থেকে আমাদের নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে হবে।
১৯৬২ সালে ডক্টর সারাভাই এবং ডক্টর ভাভা বিষুবীয় অঞ্চলে স্পেস রিসার্চ স্টেশন প্রতিষ্ঠার জন্য উপযোগী একটি জায়গা খুঁজছিলেন।
বিষুবীয় এলাকার নিকটবর্তী হওয়ার কারণে কেরালার থাম্ব অঞ্চলটাকেই তাদের কাছে অবশেষে আয়োনেস্ফেরিক গবেষণার জন্য সবচে উপযোগী মনে হল। হাজার হাজার দরিদ্র জেলের বাস ছিল থাম্বা জেলায়। সেখানে ছিল সেন্ট ম্যারি ম্যাগডালেন্স চার্চ নামে সুন্দর একটি গীর্জা আর বিশপদের কোয়ার্টার। রিসার্চ সেন্টার গঠনের জন্য ওই জমি অধিগ্রহণ করতে কোন বেগ পেতে হয়নি।
ডক্টর সারাভাই প্রধান ধর্মযাজক ডক্টর পিটার বার্নার্ড পেরেইরার সংগে এক শনিবার দেখা করে জায়গাটি গবেষণাগারের জন্য ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলেন। বিশপ প্রশান্তভাবে হেসে সারাভাইকে পরের দিন আবার আসতে বললেন। রোববার সারাভাইকে সাথে নিয়ে বিশপ তার সাপ্তাহিক ভাষণে বললেন, শিশুরা, আমার সংগে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী রয়েছেন। তিনি তার বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রের জন্য আমাদের এই গীর্জা ও আমার ভবনটি প্রার্থনা করছেন। বিজ্ঞান সত্যের অনুসন্ধান করে যা মানবজীবনকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তোলে। আধ্যাত্মিক সাধনাই সর্বোত্তম ধর্ম। ধর্মোপদেশ দাতারা মানবাত্মার শান্তির জন্য করুণাময় ঈশ্বরের সাহায্য চান। আসল কথা হলো, বিক্রম সারাভাই যা করছেন এবং আমি যা করছি–এ দুটোই এক অর্থে সমপর্যায়ের। বিজ্ঞান ও ধর্মের মূল কাজ হলো মানুষের দেহমনের কল্যাণ বয়ে আনার জন্য ইশ্বরের সহায়তা প্রার্থনা। আমার শিশুরা, আমরা কি বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য পূরণের জন্য ঈশ্বরের এ ঘর তাদের হাতে হস্তান্তর করতে পারি?
খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতার পরে অগনিত শিশুর সম্মতিসূচক আমেন ধ্বনিতে গীর্জা কক্ষ যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।
১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ডক্টর বিক্রম সারাভাইয়ের সংগে কাজ করার দুর্লভ অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। তরুণ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তার অধীনে থিরুভানানথাপুরাম স্পেস স্টেশনে আমি কম্পোজিট টেকনোলজি, এক্সপ্লোসিভ সিস্টেম এবং রকেট ইঞ্জিনিয়ারিং সিস্টেমের ওপর কাজ করেছি।
এ সময়টাতে তার নেতৃত্ব থেকে আমি এক দুর্লভ শক্তি সঞ্চয় করি। যদিও আমাদের দেশে তখন প্রযুক্তিগতভাবে শৈশবে নিজেদের নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের স্বপ্ন দেখছিলাম। তার স্বপ্ন ছিল ভারতের মাটি থেকে সানসিস্ক্রোনাস কক্ষপথে রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইট এবং জিওসিংক্রানাস কক্ষপথে কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট পাঠাতে হবে। আজ জিএসএলভি (জিওসিষ্ক্রোনাস লাঞ্চ ভেইকল) উৎক্ষেপনের মাধ্যমে তার সে স্বপ্ন সফল হয়েছে।
এছাড়াও কক্ষপথে ইণ্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন আইআরএস ও ইনস্যাট সিস্টেম প্রতিস্থাপন করেছে যাতে সাধারণ মানুষও স্পেস বা মহাকাশযানের সুফল ভোগ করতে পারে।
ডক্টর সারাভাইয়ে স্পেস প্রোগ্রাম সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। অবশ্য এ বিষয়ে আমি আমার উইংস অব ফায়ার বইয়ে সংক্ষিপ্তাকারে লিখেছি।
ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট মহাযান এসএলভি-৩-এর ডিজাইন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার (ভিএসএসসি) থেকে। রকেট, তাপরোধক প্রক্রিয়া এবং গাইডেন্স সিস্টেমের প্রত্যেকটি পর্যায়ের ডিজাইন নির্বাচিত প্রকল্প নেতৃবৃন্দের হাতে দেওয়া হয়েছিল। এসএলভি-৩ এর চতুর্থ পর্যায়ের ডিজাইন প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলাম আমি। আমার প্রকল্পাধীন পর্যায়টি ছিল রকেটের ওপরের দিকের অংশ যেটি মহাযান রোহিনীকে কক্ষপথে চূড়ান্ত ভাবে প্রতিস্থাপন করতে সহায়তা করবে। রকেটের এই অংশটি নির্মাণ করতে দরকার হয় সর্বাধুনিক শক্তিশালী ধাতব উপাদান যেটি প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন কিন্তু ওজনে হাল্কা। এটা সর্বোচ্চ পরিমাণ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জ্বালানীও বহন করার কাজ করে। ১৯৭০ সালে যখন আমি রকেটে এ অংশের ডিজাইনের কাজে ব্যস্ত, তখন খবর পেলাম ডক্টর সারাভাই ফরাসী স্পেস এজেন্সি সিএনইএসর চেয়ারম্যান হুবার্ট কিউরিয়েনকে সাথে নিয়ে থিরুভানানথাপুরাম পরিদর্শনে আসছেন।
কিউরিয়েনের টীমের কাছে চতুর্থ পর্যায়ের ডিজাইন সম্পর্কে আমাকে বলতে বলা হল। আমার ডিজাইন তাদের কাছে উপস্থাপনের পর জানলাম, ফ্রান্সের ডায়ামন্ট পি-৪ উৎক্ষেপন যানেও আমার ডিজাইনকৃত চতুর্থ পর্যায়টির মতো ডিজাইন ব্যবহৃত হচ্ছে।
সিএনইএস জানাল তাদের আমাদের চেয়ে দ্বিগুন ওজনের একটি অ্যাপোজি রকেট মটর এবং আমাদের ডিজাইনকৃত চতুর্থ অংশের মত একটি অংশ দরকার।
ওইদিনের বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল চতুর্থ অংশটি আবার এমনভাবে কনফিগার করতে হবে যাতে ওই অংশ ফরাসী রকেট ডায়ামন্ট পি-৪ এবং আমাদের এসএলভি-৩ উভয়টাতেই খাপ খায়। গল্পটা একারণে বললাম যে আমরা তখন মাত্র রকেটটির ডিজাইন পর্যায়ে, তারপরও ডক্টর সারাভাই পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।
ভারতীয় বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের ওপর কী অগাধ আস্থা ছিল তার। এসএলভি ৩র অন্যান্য অংশের ডিজাইনের আগে চতুর্থ অংশের ডিজাইন ডেভেলপ করা শুরু হল। আমাদের আত্মবিশ্বাস জেগে উঠলো এবং পূর্ণদ্যোমে কাজ এগুতে লাগল। দুটো পর্যবেক্ষক দল বেশ কয়েকবার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চতুর্থ অংশের কাজ ড্রইং বোর্ড থেকে ডেভেলপিং স্টেজে নেবার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ১৯৭১ সালে ডক্টর সারাভাই দেহত্যাগ করেন। ওই বছরই ফ্রান্স সরকার তাদের ডায়ামন্ট পি-৪ প্রকল্পও বাতিল ঘোষণা করে।
চতুর্থ পর্যায়ের ডিজাইন ডেভেলপ করার পর বেশ কয়েকবার তা পরীক্ষা করা হয় এবং আমরা সফল হই। ভারতে নির্মিত স্যাটেলাইটের মত আকৃতির স্যাটেলাইট ইউরোপীয়রা উৎক্ষেপনের চেষ্টা চালানোর সময় আমাদের এই চতুর্থ অংশটির প্রয়োজন পড়ে। ফ্রান্স সরকার এরিয়ান প্যাসেঞ্জার পেপোড় রকেট তাদের অ্যাপল নামক কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কক্ষপথে প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেয় এবং আমাদের ডিজাইনকৃত এসএলভি-৩ এর চতুর্থ অংশ ওই রকেটের জন্য সর্বোচ্চ উপযোগী প্রমাণিত হয়। অবশেষে ১৯৮১ সালে আমার ডিজাইনকৃত চতুর্থ অংশটি অ্যারিয়ান রকেটে লাগিয়ে ফ্রেন্সগায়ানার কুরু থেকে উৎক্ষেপন করা হয়। অ্যাপল স্যাটেলাইট জিওস্টেশনারী কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করার পর এবং তা পৃথিবীর সংগে যোগাযোগ শুরু করার পর সবাই ডক্টর বিক্রম সারাভাইর ৭০ সালের দূরদৃষ্টি সম্পর্কে সজাগ হয়। অ্যাপলর সফলতা প্রমাণ করলো নিবেদিত প্রাণ বৈজ্ঞানিক পৃষ্ঠপোষকতা সমৃদ্ধ ইচ্ছা অবশ্যই একদিন তার লক্ষ্যে পৌঁছবে। অ্যাপোলোর এ সফলতা এ দেশের রকেট টেকনোলজির ক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তন হিসেবে আবির্ভূত হল।
ডক্টর সারাভাইর স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন যিনি তার নাম সতীশ ধাওয়ান। ১৯৭২ সালে প্রফেসর ধাওয়ান আইএসআরওর দায়িত্ব নেবার পর তিনি আইএসআরওকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলেন। তার তৈরী পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেইকল ভারতসহ অন্যান্য দেশের বহু স্যাটেলাইটকে বিভিন্ন কক্ষ পথে প্রতিস্থাপন করেছে। এই রকেটটি একই সংগে একাধিক স্যাটেলাইট প্রতিস্থাপনে সক্ষম।
১৯৭২ সালে এসএলভি-৩এর প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট রোহিনীকে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপনের দায়িত্ব পাই। স্যাটেলাইট ডিজাইন করা, ডেভেলপ করা থেকে শুরু করে উৎক্ষেপনের দায়িত্ব আমার ওপর দেওয়া হয়। সে সময় প্রফেসর ধাওয়ানের কাছ থেকে আমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনেক শিক্ষা অর্জন করেছিলাম।
সে সময়ই বুঝতে পেরেছিলাম যখন একজন প্রজেক্ট ডিরেক্টরকে নিয়োগ করা হয় তখন আইএসআরওর চেয়ারম্যানসহ সমগ্র প্রতিষ্ঠানই তার সাফল্যের জন্য কাজ করে। অন্য প্রজেক্টগুলোতে কাজ করতে গিয়েও আমি এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। গত ৪০ বছর ধরে তিনটি বিভাগের দায়িত্বে থেকে বহু প্রজেক্ট ও প্রোগ্রাম পরিচালনা করে আরেকটি বিষয় বুঝেছি, যদি তুমি প্রজেক্টকে নিজের চেয়ে বেশী মূল্যবান মনে কর তাহলে প্রজেক্ট লিডার হিসেবে অবশ্যই সফল তুমি হবে। যখন একজন প্রকল্প প্রধান প্রকল্পের চেয়ে নিজেকে বড় করে দেখে, তখনই প্রতিষ্ঠান সমস্যার সম্মুখীন হয়।
আমার মনে পড়ছে ১৯৮০ সালের কথা। সে বছর ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত আইএসআরও সদরদফতরে লঞ্চ ভেইকল প্রোগ্রামস সিস্টেমসর পরিচালনা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। প্রথমে আমরা লঞ্চ ভেইকল বা রকেটের কর্মক্ষমতা ও সম্ভাব্য ব্যায় নিয়ে আলোচনায় বসলাম।
১৯৮১ সালে আইএসআরর অন্যান্য সেন্টারগুলোর বিজ্ঞানীদের সহায়তা নিয়ে থিরুভানানথাপুরামে অবস্থিত ভিএসএসসির বিজ্ঞানীরা দুটি বিশাল ও ভারী গতি সঞ্চালক ওয়ালা পিএসএলভি কোর ভেইকলের কনফিগারেশন দাঁড় করায়।
পিএসএলভি উৎক্ষেপনের সময় সেটির ওজন দাঁড়ায় ৪শ টন। অধ্যাপক ধাওয়ান আরও সহজ ও হাল্কা কোন বিকল্প কনফিগারেশন চাচ্ছিলেন। আমি এবং আমার কয়েকজন সহকর্মী এ. শিবতনু পিল্লাই, এন, সুন্দররাজন এবং কে. পদ্মনভ মেননকে ওই বিকল্প মিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আমাদের টিম এসএলভি-৩ রকেটের প্রথম অংশ ব্যবহার করে একটি নতুন ধরনের কোর ভেইকলের ডিজাইন করলো যাতে বেশ কয়েকটি অপশন ছিল। নতুন এ ডিজাইনে পিএসএলভির ওজন নেমে আসে ২৭৫ টনে। আমার অফিস রুম কাছাকাছি হওয়ায় অধ্যাপক ধাওয়ান প্রতিদিন একবার আমার রুমে আসতেন এবং সম্ভাব্য কনফিগারেশন চয়েস নিয়ে আলোচনা করতেন। গণিত ও সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তিনি নিজেই গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, তথাপি ব্ল্যাক বোর্ডে নিজের আইডিয়া এঁকে দেখাতেন এবং তার সংগে আরও কী কী সংযোজন করা যায় তা আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করতেন।
যাহোক, প্রফেসর ধাওয়ান পূর্বকৃত ও আমাদের ডিজাইনকৃত দুটি কনফিগারেশন আইএসআরওর বিশেষজ্ঞদের বিশেষ বৈঠকে উপস্থাপন করলেন। বিশেষজ্ঞরা দুটো কনফিগারেশনই গভীর মনযোগ দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন এবং অবশেষে পিএসএলভির কনফিগারেশন হিসেবে আমাদের করা ডিজাইনই গৃহীত হল।
মূলত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় ওই ডিজাইন অনুকূল ছিল বলে আমাদের কনফিগারেশন গৃহীত হয়। প্রফেসর ধাওয়ান দূরদর্শী ছিলেন বলেই আগামী ৫০ বছরের সময়োপযোগী ওই কনফিগারেশন নির্মাণের জন্য আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি ও প্রফেসর নরসিমা ডেভেলপমেন্ট ইন ফ্লুইড মেকানিকস অ্যান্ড স্পেস টেকনোলজি নামে একটি বই লিখেছি। সে বইতে পিএসএলভির কনফিগারেশন নিয়ে লেখাসহ প্রফেসর ধাওয়ানর ১৫ বছর ধরে হাতে লেখা স্পেস প্রোফাইল প্রকাশ করেছি।
১৯৮২ সালের ৩১ মে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। প্রফেসর ধাওয়ান আইএসআরওর একটি কাউন্সিল মিটিং ডাকলেন ভবিষ্যত রকেট উৎক্ষেপন বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। সে মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন পরিচালকবৃন্দ। আমি আমাদের লঞ্চ ভেইকলের ব্যয়ভার ও কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে বক্তব্য দিলাম।
আমার বক্তব্য শেষ হবার পর প্রফেসর ধাওয়ান কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই জানালেন, আমাকে ডিআরডিওর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার এই সিদ্ধান্ত আমার ক্যারিয়ারে ব্যাপক পরিবর্তন আনে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার অগ্রগতি হতে থাকে।
আজ আমরা যে স্বয়ংক্রিয় লঞ্চ ভেইকল বানাতে সক্ষম হয়েছি এবং যে পিএসএলভি অপারেশন সিস্টেম তৈরী করেছি তার প্রায় ৮০ শতাংশ কাজই করা হয়েছে ১৯৮০ সালে দেওয়া ধাওয়ানের ফর্মুলা অনুসরণ করে। শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তি ও স্পেস প্রোফাইলের কারণে আইএসআরও সফল সংস্থা হিসেবে পরিচিত। এ পরিচিতির নেপথ্যেও ধাওয়ানের কৃতিত্ব রয়েছে।
এছাড়াও আইএসআরওর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন অধ্যাপক ইউ.আর. রাও এবং ডক্টর কে কস্তুরিরঙ্গন। অবসর নেবার পরও প্রফেসর ধাওান স্পেস কমিশনের সদস্য ছিলেন এবং তার হাতে গড়া এ সংস্থার জন্য কাজ করেছেন আমরণ। তার জীবদ্দশাতেই তিনি আইএআরওর বহু ভবিষ্যত প্রোগ্রামের দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
ডিআরডিওতে যোগ দিয়ে আমি ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপমেন্টের কাজ শুরু করি। আইজিএমডিপি (ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম)র কাজ করার সময় আমি আমাদের স্থানীয় ডিজাইনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এ ডিজাইনের আওতায় নির্মিত হয় ভূমি থেকে ভূমিতে উৎক্ষেপনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র পৃথিবী। যথার্থ নির্ভুলতা, নির্ভরযোগ্য-কার্যপরিচালনা ও নির্ভুলভাবে ক্ষেপণাস্ত্রের বঙ্কিম পথ অনুসরণের জন্য পৃথিবী ভুবন বিখ্যাত মিসাইল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অগ্নিতে এসএলভি-৩র প্রথম পর্যায়টি জুড়ে দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে আমার টিমের অনুমোদিত রেক্স (রিএন্ট্রি এক্সপেরিমেন্ট) প্রোগ্রামের ভিত্তিতে অগ্নি নির্মিত হয়। পৃথিবী ও অগ্নি দুটো ক্ষেপণাস্ত্রই আমাদের ডিআরডিওর প্রথম প্রোডাকশন।
এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে নির্মিত হয় ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ত্রিশুল ও আকাশ।
তৃতীয় পর্যায়ে আমরা বানিয়েছি নাগ মিসাইল যেটি বিশ্বের সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানে ভারত পৃথিবীর যে কোন উন্নত দেশের সংগে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার ক্ষমতা রাখে।
ডিআরডিওতে দায়িত্বপালনকালে এক সময় আমার মনে হল ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের আইজিএমডিপির বাইরে চিন্তা করতে হবে। আমার এ ধারণা আমি সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল নির্মানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। অনেক দেশের হাতেই এখন যেসব ক্রুজ মিসাইল রয়েছে তা শব্দের গতির চেয়ে ধীরগামী।
আমাদের এসোসিয়েশন রাশিয়ার অন্যতম ইনস্টিটিউট এনপিও মাসিনোন্ত্ৰোয়নিয়ার সংগে যৌথভাবে কাজ করে একটি সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলের ডিজাইন করে। বন্ধুত্ব ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাশিয়ার সংগে আমাদের এ পার্টনারশীপ গড়ে ওঠে। আমি আমার সহকারীদের নিয়ে এনপিও মাসিনোস্ত্রোয়নিয়ার মহাপরিচালক ড. এইচএ ইয়েফ্রেমোভর সংগে দেখা করি। এরিমভ আমাদের সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন। তিনি প্রায় সাত প্রকারের ক্রুজ মিসাইল নির্মাণ করেন এবং সেগুলো রাশিয়ার নৌবাহিনীতে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। রাশিয়া ও ভারতের মধ্যকার মিসাইল প্রযুক্তি সংক্রান্ত যৌথ উদ্যোগ ১৯৯০ সালের একটি বিরাট ঘটনা যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এ উদ্যোগ আমার ও ইয়েফ্রেমোভের জন্য ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জও।
যখন আমি ইয়েফ্রেমোভের সংগে দেখা করি তখন আমার মনে হয় আমি যেন মহান বিজ্ঞানী ডক্টর সতীশ ধাওয়ান অথবা রকেট প্রযুক্তির পিতা ডক্টর ওয়ার্নার ভন ব্রাউনের সংগে কথা বলছি। ডক্টর ইয়েমোভ আমাকে তার টেকনোলজি সেন্টারে নিয়ে গেলেন। ওই সেন্টারে সাধারণত কোন বিদেশীকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তিনি সত্যিকার অর্থেই আমাকে তার বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং তার ল্যাবরেটরিতেই ভারতীয় খাবারের আয়োজন করলেন। আমিও তাকে হায়দ্রাবাদের মিসাইল প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্র ইমারত পরিদর্শনের সুযোগ দিই। আমাদের বন্ধুত্ব দৃঢ় হল।
আমরা আমাদের এ যৌথ প্রকল্পের নাম দিলাম ব্রাহমোস। আমাদের ব্ৰহ্মপুত্র নদ ও ওদের মস্কো নামের সংযোজন ঘটিয়ে এ নাম রাখা হল। শিবতনু পিল্লাই, রমানাথ, ভানুগোপাল এবং ভাইস অ্যাডমিরাল ভারত ভূষণ রুশ বিজ্ঞানীদের সংগে মিলিত হয়ে ভারত-রাশিয়ার যৌথ প্রোগ্রাম শুরু করেন। শিবতন পিল্লাইকে একই সংগে যৌথ প্রকল্পের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ও চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ও ডিআরডিওর ক্ষেপনাস্ত্র বিভাগের চীফ কন্ট্রোলার নিয়োগ করা হয়। যৌথ উদ্যোগ সফল করার জন্য সরকার তাকে যুগপভাবে দুটো বিভাগের দায়িত্ব দিয়েছিল। ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ল্যাবরেটরি, ডিআরডিএলর অন্যতম বিজ্ঞানী ভানুগোপালকে যৌথ উদ্যোগের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হল।
ভারত-রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে দুদেশের অস্ত্রপ্রযুক্তির ডিজাইন, অগ্রগতি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত তৈরী হল। এ প্রজেক্টের জন্য দুটো দল নির্ধারিত হওয়ায় আমি খুব খুশি হলাম। ২০০১ সালের ১২ জুন ব্রাহমোস চন্ডিপুর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারের মত উৎক্ষেপন করা হয়। ২০০২ সালের ২৮ এপ্রিল আরও উন্নত প্রক্রিয়ায় সফল পরীক্ষা হল ব্রাহমোসের। ড. ইয়েফ্রেমোভ ও আমি এই ভেবে খুব স্বস্তি ও আনন্দ পেলাম যে এই যৌথ উদ্যোগ সফল হওয়ায় ভারত ও রাশিয়া দুই দেশই বুঝতে পারে এই উন্নত প্রযুক্তির মিসাইল দুদেশের বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় করেছে এবং এটা বিশ্ববাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে। আমার স্বপ্ন ছিল তথাকথিত উন্নত বিশ্বে বাজারজাতকরনের এমন ধরনেরই একটি অস্ত্রপ্রযুক্তি আবিষ্কার করা। ব্ৰাহমোস আমার সে স্বপ্ন সফল করলো। যদিও তার নির্মাণপ্রক্রিয়া থেকে আমি দূরে ছিলাম। ব্রাহমোস নির্মাণ করেছে আমার দল। এতেই আমার শান্তি।
অ্যান আনফিনিশড ড্রিম নামে ভার্গেস কিউরিয়েনের লেখা একটি বই পড়েছিলাম। এতে তিনি বলেছেন, একটি ঘটনার কারণে আমাকে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী হতে হয়েছিল। একজন ব্রিটিশ দুগ্ধবিশেষজ্ঞ ভারতে উৎপাদিত দুধের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ভারতে উৎপাদিত দুধের চেয়ে লন্ডনের ব্যাকটেরিয়া মিশ্রিত পানি অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। তার ওই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে কিউরিয়েন দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত করণে আত্মনিয়োগ করেন এবং দশকের পর দশক ধরে তার নিরলস গবেষণার ফলস্বরূপ আজ ভারত পৃথিবীর প্রথম শ্রেণীর দুগ্ধ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে।
আনন্দ পরিদর্শনের সময় তার সংগে একটি দিন কাটানোর সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তার প্রতিষ্ঠিত আমূল দুগ্ধ গবেষণাগার আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি। দুধ থেকে সেখানে মাখন, ঘি আর আইসক্রিম তৈরী হচ্ছে আর বিশ্ববাজারে তা ছড়িয়ে পড়ছে।
কথা প্রসংগে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিভাবে দেশের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। তিনি বললেন, আমাদের এমন সব কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে যা দেশের তরুণ ও কষকশ্রেণীর প্রত্যক্ষ উপকারে আসে। তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া আমরা কোনভাবেই সফল হতে পারব না। তাদের অংশগ্রহণ থাকলে আমরা কখনই ব্যর্থ হবো না।
বিজ্ঞানীদের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে হায়দ্রাবাদের ইন্দো-আমেরিকান ক্যান্সার সেন্টারে কর্মরত চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাকরলা সুব্বা রাওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ক্যান্সার কি আমাদের ওপর আরোপিত কোন চরম অভিশাপ?
রেডিওলজির অ্যালবার্ট আইনস্টাইন সুব্বা রাও তার জবাবে হ্যাঁ এবং না দুটোই বললেন। হ্যাঁ একারণে যে জেনেটিকভাবেই আমাদের শরীরে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা ক্যান্সার আক্রান্ত হতে সহায়তা করে। আর না এজন্য যে আমরা ইতিমধ্যেই ক্যান্সার প্রতিরোধে সাংঘাতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছি।
আমরা সাইকো নিউরো ইমিউনোলজি (পিএনআই) নতুন একটি গবেষণা ক্ষেত্র তৈরী করেছি। মস্তিষ্ক কিভাবে শরীরের ইমিউন বা রোগ প্রতিরোধক শক্তি উৎপাদন করে এ প্রোগ্রামের আওতায় তার গবেষণা চলছে। ক্যান্সার, এইডস, সিফিলিসর মত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসজনিত রোগ থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে এ গবেষণা নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। সাইকো-নিউরো কার্ডিওলজি (পিএনসি) নামে আরেকটি গবেষণা চলছে যার মাধ্যমে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। কীভাবে মস্তিষ্ক রক্তচাপ সংশ্লিষ্ট সমস্যা তৈরী করে। রক্তকণিকা জমাট বেঁধে কীভাবে তা স্ট্রোকের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
.
আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা তাদের নিরলস পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন জাতিকে মরণগ্রাসী রোগ থেকে মুক্তি দেবার জন্য।
৪. মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা
৪. মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা
For the society to prosper there are two important needs. They are : Prosperity through wealth generation and cherishing the value system of the people. The Combination of the two will make the nation truely strong and prosperous.
আমি সব সময় তরুণদের স্বপ্ন দেখতে বলি। আমি তাদের সে অছিয়ত করি এই বিশ্বাসে যে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সাফল্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির সক্ষমতা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু তীব্র উন্মাদনাপূর্ণ আকাক্ষা সৃষ্টি করা।
শৈশবে আইনস্টাইন কম্পাসের কাঁটা দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন কম্পাসের কাঁটাটি তিনি যেদিকেই ঘোরান না কেন সে তার আপন জায়গায় চলে যাচ্ছে। গভীরভাবে তিনি কাঁটাটির অদৃশ্য শক্তির উৎস বোঝার চেষ্টা করলেন। তার মধ্যে প্রশ্ন এল, কম্পাসের এ শক্তি আসলে ঠিক কোন জায়গায়? এটা নিয়ন্ত্রণ করছে কে? এটা সব সময়ই কাজ করে কেন? এটা কী দিয়ে তৈরী? কম্পাস তার কাজ করবে না এমন কোনও জায়গা কি আছে? থাকলে সেটা কোথায়?
আমরা জানি এটা পৃথিবীর চৌম্বকীয় শক্তি যা ওই চুম্বক নির্মিত কম্পাসের কাটাটিকে উত্তর-দক্ষিণ মুখো করে রাখে, কারণ পৃথিবী উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর ম্যাগনেটিক ফিল্ড তাকে দুপাশ থেকে আকর্ষণ করে। কিন্তু এই কার্যকারণ বুঝতে পারাই কি আমাদের শেষ কথা?
মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা আমরা সহজেই এই ম্যাগনেটিক ফিল্ডের কার্যক্ষমতা দেখতে পাই কিন্তু এর সংগে আমাদের চিন্তাভাবনার সাদৃশ্য বুঝতে পারি না, যদিও আমাদের এই গ্রহের সর্বত্রই ম্যাগনেটিক ফিল্ডের অস্তিত্ব রয়েছে। যৌক্তিকভাবে আমাদের মধ্যেও রয়েছে এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা চৌম্বকীয় ক্ষেত্র।
একইভাবে আমাদের এই গ্রহ অন্তহীনভাবে সচল রয়েছে, আবর্তিত হচ্ছে তার কক্ষ পথে। এ গ্রহের সবকিছুই পৃথিবীর মুভমেন্টের অংশ, যদিও আমাদের কাছে মনে হয় আমরা স্থির ও গতিহীন অবস্থায় রয়েছি। আমি যেহেতু এ গ্রহেরই অংশ সেহেতু আমিও সচল শক্তির অংশ। এ গ্রহের যে মূল পরিচালনা শক্তি, তা আমার ভেতরেও রয়েছে।
ডায়ারের মতে, আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করতে এই শক্তিকে কাজে লাগাতে পারি। কারণ আমাদের ভেতরে যেমন আকাঙ্ক্ষা আছে তেমনি আকাঙ্ক্ষা পূরণের শক্তিও আছে। এটা মূলত একটা বিন্যাসের মত বিষয় যা আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে প্রচণ্ডভাবে কেন্দ্রীভূত করে।
এই দৃষ্টিভঙ্গির জায়গায় বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক দর্শন এক হয়েছে। আমি বেশ কয়েক বছর ধরে কিছু পবিত্র স্থান পরিদর্শনের সুযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে সাধক তাপস ও ভবিষ্যতদ্রষ্টাদের মাজার ও তীর্থস্থানে গিয়েছি। আমার ভেতরে যে দর্শন লুকায়িত ছিল সে সব স্থানে গিয়ে তা নিজেই আবিষ্কার করেছি। এসব জায়গায় ভ্রমন করে দেখেছি বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে এক অপূর্ব সুফী সাধক ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষের কাছে অনুসরণীয় হয়ে ওঠেন।
একবার এক ধর্মগুরুর সংগে বিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্বের সংমিশ্রণ বিষয়ে আলাপ করেছিলাম। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পন্ন এক পূণ্যাত্মা কীভাবে হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন। এমন কি সাধারণ মানুষের খাবার পানি সরবরাহের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।
তার আশ্রমের এক অংশে দেখলাম রোগীদের চিকিৎসা চলছে। অন্যত্র দেখলাম একটি ধ্যানাগার যেখানে মেডিকেল সায়েন্স ও যোগসাধনার তালিম দেওয়া হচ্ছে।
আহমেদাবাদে অবস্থিত স্বামী নারায়ণ সংস্থার আচার্য প্রমুখ স্বামী মহারাজার সংগে ২০০১ সালের ১৩ জুন আমি দেখা করেছিলাম। স্বামীজীর সংগে আমার আলোচনার বিষয় ছিল বিজ্ঞান ও ধর্মের সংমিশ্রন চিন্তা এবং এই চিন্তা কীভাবে জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রায় ১ ঘণ্টা আমাদের কথোপকথন হয়। স্বামীজীকে আমি যেসব প্রশ্ন করেছিলাম এবং তিনি উত্তরে যা যা বলেছিলেন তার কিছু অংশ উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না।
আব্দুল কালাম (আ: কা:) : স্বামীজি, ১৮৫৭ সাল থেকেই ভারত স্বাধীনতা লাভের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে আমাদের সময় লেগেছে ৯০ বছর। পরাধীনতার এই সময়ে গোটা জাতি তরুণ-বৃদ্ধ, ধনী-গরীব, শিক্ষিত-নিরক্ষর সবাই তাদের উদ্দেশ্য লাভের ক্ষেত্রে ছিল সম্মিলিত ও একান্নবর্তী।
তখন সবার লক্ষ্য ছিল একটাই, সবার সচেতন দাবি ছিল শুধুই স্বাধীনতা। স্বামীজি, আজ এই স্বাধীন ভারতের সবার প্রধান চাওয়া কি হতে পারে? গত পঞ্চাশ বছর ধরে ভারত উন্নয়নশীল একটি দেশ। কারণ আর্থিকভাবে এদেশ শক্তিশালী নয়, সামাজিকভাবে এটি সুস্থিত নয়, প্রতিরক্ষায় এদেশ এখনও স্বয়ং সম্পূর্ণতা পায়নি। এসব কারণেই ভারতকে বলা হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশ। টিআইএফএসি (টেকনোলজি ইনফরমেশন, ফোকাসিং অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট কাউন্সিল)র প্রায় ৫ শ সদস্য ভারতের পরবর্তী প্রধান পদক্ষেপ হিসেবে তাদের মতামত ব্যাখ্যা করেছেন। আগামী ২০ বছরের মধ্যে ভারতকে উন্নয়নশীল থেকে কীভাবে উন্নত দেশে পরিণত করা যায়? আমরা এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উন্নয়ন করা দরকার বলে মনে করছি। সেগুলো হল : শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা, কৃষি, তথ্য ও যোগাযোগ, ভৌত অবকাঠামো এবং উন্নত প্রযুক্তি। স্বামীজি, আমরা আমাদের কর্মপরিকল্পনা ও প্রকল্প সরকারের কাছে উপস্থাপন করতে পারি, কিন্তু আমাদের এই বিশাল পরিকল্পনায় জনগণকে কীভাবে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করব?
আমাদের দরকার দক্ষ ও সচেতন জনশক্তি। তা না হলে আমাদের জাতীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হবে না। এ লক্ষ্য অর্জনে আপনার পরামর্শও প্রয়োজন স্বামীজি!
স্বামীজি : এই পাঁচটির সংগে আরেকটি বিষয় যোগ করতে হবে। ষষ্ঠ বিষয়টি হলো ঈশ্বরে বিশ্বাস ও আধ্যাত্মবাদের মাধ্যমে জনগণকে গড়ে তোলা। এটা খুবই জরুরী। আমাদের প্রথমে একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের ক্ষেত্র গড়ে তুলতে হবে। আজকের এই দুর্নীতি ও অপরাধ কবলিত সমাজকে শুদ্ধ করতে পারে শুধুমাত্র নৈতিক মূল্যবোধ যা ধর্মপালনের মাধ্যমে অর্জন করা সহজ হয়। আমাদের এমন জনশক্তি তৈরী করতে হবে যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এবং তার অলিখিত আইন মেনে চলে। এজন্য দরকার এক পুনরুদ্দীপ্ত বিশ্বাস। এতে আমাদের লক্ষ্য পূরণ সহজ হয়ে পড়বে। আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারব।
আ: কা: স্বামীজি, ভারতভূমিকে উন্নত দেশে রূপান্তরের মত এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কি প্রথমে আমাদের ঈশ্বরে বিশ্বাসের মত স্পিরিচুয়াল ট্রেডিশান গড়ে তুলতে হবে? তারপর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজর দিতে হবে? নাকি যুগপৎভাবে সব বিষয়কে নিয়ে এগুতে হবেঃ
স্বামীজি : সবগুলো বিষয়কে একত্রে ধারণ করেই আমাদের সামনে এগুতে হবে। দেশের অগ্রগতির জন্য তোমার বিশেষজ্ঞদল যে পাঁচ বিষয়কে চিহ্নিত করেছে তার সবগুলোই একটি অন্যটির সহযোগী হিসেবে এগিয়ে যাবে। আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি আমাদের পারা (আধ্যাত্মিক) ও অপারা (পার্থিব) উভয় বিদ্যা অর্জনের শিক্ষা দেয়। সে মতে অপারা বিদ্যা অর্জনের সংগে সংগে একজন মানুষ পারা বিদ্যাও অর্জন করতে পারে। যে এই মন্ত্রের গুঢ়ার্থ বুঝতে পারবে তখন ধর্ম ও আধ্যাত্মিক ভিত্তির ওপর তার অপারা বিদ্যা প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমাদের বুঝতে হবে এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির নেপথ্যে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য একটাই। সেটা হল তার সৃষ্টির জন্য শান্তি ও সুখ নিশ্চিত করা।
আ:কা: ভারতকে উন্নত বিশ্বে পরিণত করতে আমার মনে হয় তিন শ্রেণীর লোক দরকার– পূণ্য আত্মা (সচ্চরিত্রবান লোক), পূণ্য নেতা (আদর্শবান নেতা) ও পণ্য অধিকারী নীতিবান অফিসার)। আমাদের সমাজে যদি এই তিন শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা বাড়ানো যায় তাহলে ভারতবর্ষ জগৎগুরুতে পরিণত হবে। কিন্তু স্বামীজি, তাদের সংখ্যা কীভাবে বাড়ানো সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?
স্বামীজি : সমাজে এজাতীয় লোকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য একাডেমিক ও বৈজ্ঞানিক ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি আমাদের স্কুল কলেজের পাঠ্যক্রমে আধ্যাত্মিক ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বর্তমানে ধর্মীয় স্কুল কলেজের সিলেবাস থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। যে নৈতিক শিক্ষাগুলো শৈশবেই একটি মানুষের জন্য দরকার সেটাই এড়িয়ে চলা হচ্ছে। কিন্তু জীবনের শুরু থেকে জন্মের পর থেকে নৈতিক শিক্ষা পেলে তবেই একটি শিশু আদর্শবান নাগরিক হয়ে উঠবে। নৈতিকমূল্যবোধ সম্পন্ন জাতিগঠনের জন্য আমাদের পাঠ্যসূচীর সিলেবাসে সাধু ও জ্ঞানতাপসদের জীবনী ও বাণী অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনীতির ক্ষেত্রে যেসব মহান নেতা সর্বজন শ্রদ্ধেয় তাদের সঠিক মূল্যায়নের জন্য তাদের মহানশিক্ষাও পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অতীতে, আমাদের গুরুকুল পদ্ধতির শিক্ষানীতিতে এ ধরণের পাঠ্য বিষয় চালু ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতেই সত্যবড়া, ধর্মছড়া, পারস্পরিক সহযোগিতা, ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয়গুলো পড়ানো হত।
আ: কা: সরকারের আইন ছাড়া কখনও উত্তম নাগরিক গড়ে তোলা যায়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কি একাজটি করতে পারছে? আপনি কি পিতামাতাকে তাদের বাচ্চাদেরকে পনেরো বছরের অধিক বয়সের মানুষের নাগরিক অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য নির্দেশ দিতে বলবেন? একইভাবে বাচ্চাদেরকে বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উপদেশ দেওয়া সমস্ত স্কুল শিক্ষকদেরও উচিত। যদি আমরা এক্ষেত্রে ব্যর্থ হই তাহলে সরকারও সৎ ও ভালো নাগরিক সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হবে। স্বামীজি কি আমার সংগে একমত হবেন?
স্বামীজি : অবশ্যই। একথা সত্যি। একথা সর্বাংশে সত্যি। প্রথম থেকেই তো আমরা বলছি বাড়িতে পিতামাতার কাছ থেকে, স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে এ শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আর পরবর্তী জীবনে গুরুর নির্দেশ মত জীবন গঠন করতে হবে।
আ: কা: স্বামীজি, আমি যখন প্রথম একটি রকেট উৎক্ষেপন করি– সেটি ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু আইএসআরওর সহযোগীতা ও প্রেরণায় দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে আমার টিম ব্যর্থতাকে সফলতায় পরিণত করে। একই ঘটনা ঘটেছিল তিরুয়াভালুবার উৎক্ষেপনের সময়। প্রথমে ব্যর্থ হয়ে, ব্যর্থতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সে মিশনেও সফল হয়েছিলাম।
স্বামীজি : এমন মহান উচ্চাশা ও আকাঙ্ক্ষা থাকলে দেশপ্রেম আপনিই জাগ্রত হয়। একারণেই আমরা বলি, জীবনের শুরুতে যদি কারও মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞানের জন্ম দেওয়া যায় তাহলে আপোসেই তার মধ্যে জাতির প্রতি, সমাজের প্রতি এবং ধর্মের প্রতি ভালোবাসা পয়দা হবে। মোট কথা, ধর্মীয় অনুভূতি জীবনের পোক্ত ভিত্তি রচনা করে।
আ: কা: ও আধ্যাত্মিক শক্তি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এর সংগে আমি মনে করি অর্থনৈতিক শক্তিও দরকার। মানে আমি বলতে চাইছি আধ্যাত্মিক শক্তি ও অর্থনৈতিক শক্তির সম্মিলন হওয়া জরুরী। আর এ দুটো অর্জনের জন্য অপরিহার্য বিষয় হলো শ্রম-ঘাম। কঠোর পরিশ্রম অবশ্যই দরকার।
স্বামীজি: আমরা প্রায়ই বলি, ঈশ্বরের আশীর্বাদ আর মানুষের কর্ম। এমন কি এই যে একটু আগে তুমি বললে তোমার প্রথম রকেট উৎক্ষেপন ব্যর্থ হয়েছিল; তার মধ্যেও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তোমার প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তুমি কাজটি আরও নিখুঁতভাবে করতে পেরেছিলে। ঈশ্বর স্বাভাবিকভাবেই অবশেষে তোমাকে সাফল্য দিয়েছেন।
আ: কা: ভারতবর্ষের উন্নয়নের জন্য পাঁচজন মহান ব্যক্তিকে সংগে নিয়ে আমি ভিশন ২০২০ নামে একটি গণমত আন্দোলন গড়তে চাচ্ছি। আমি আপনার আশীর্বাদ চাচ্ছি।
স্বামীজি: তোমার ওপর এমনিতেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ রয়েছে। আমি প্রার্থনা করি তোমার উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা যেন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। ভারতবর্ষ আধ্যাত্মিক ও অর্থনৈতিক ভাবে যেন উন্নত হয়। আমার প্রার্থনা ভারতবাসী যেন আধ্যাত্মিক ও নৈতিক সম্পদে ঐশ্বর্যবান হয়। ঐশ্বর্যশালী ইচ্ছাশক্তির মানুষের কাছে পৃথিবীর তাবৎ ঐশ্বর্য আপনিই ধরা দেয়। তুমি যদি শুধু পার্থিব ধনের পাহাড় গড়ে তোল তাহলে মানুষ জাগতিক ও পার্থিব ভোগবিলাসীতায় হারিয়ে যাবে। আধ্যাত্মিক শক্তি তার সহগামী হলে ধ্বংসের পথ থেকে তাকে তা রক্ষা করবে। বাস্তবতায় আমরা জনগণের ভাত, কাপড়, আশ্রয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এসবের সংগে তার আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের দিকেও আমাদের খেয়াল করতে হবে। যখন একজন মানুষ তার প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশী সম্পদের মালিক হয়ে ওঠে তখন সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনে।
তুমি এখানে আসাতে আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছি। আমাদের অতীতের ঋষি মুনিরা আমাদের বিজ্ঞান দিয়ে গেছেন, তুমিও দিচ্ছ। তুমিও অনেক বড় সাধক, তুমিও ঋষি।
২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আজমিরের সুফি সাধক গরীবে নওয়াজ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগাহ শরীফে গিয়েছিলাম। ১২৫৬ সালে ১১৪ বছর বয়সে তার ইন্তেকালের কিছুদিন আগে এই বুজর্গ ৬ দিনব্যাপী ইবাদতের জন্য এখানে নির্মিত তার প্রকোষ্ঠে ঢুকেছিলেন। আমি যখন দরগাহ ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, তখন মাজারের প্রতীকী স্থাপনার সৌন্দর্য দেখে বিমুগ্ধ ও হতবাক হয়েছিলাম।
আটশ বছর আগে শশ মাইল পাড়ি দিয়ে সৌদি আরব থেকে আজমির এসেছিলেন এই ওলী। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তার মাজারের চারপাশে সম্প্রীতির সাথে বাস করছে।
খাজা গরীব নওয়াজের শিক্ষা ও বাণী তাকে এক অনন্য চরিত্রে রূপায়িত করেছে। তার সাধারণ অছিয়ত পাথর হৃদয়ের মানুষকেও দ্রবীভূত করতো। তার স্নেহশীল দৃষ্টি তার জানের দুশমনকেও প্রশান্ত করে ফেলতো। তিনি বিশ্বশান্তি ও ভালোবাসার বার্তা নিয়ে এসেছিলেন ভারতবাসীর জন্য। চিশতী সুফিরা তার সে শিক্ষাকে এখনও ধারণ করে আছেন। জাতীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে তাদের অবদান ভুলবার নয়।
বিভিন্ন বইয়ে খাজা সাহেবের বাণী ও শিক্ষা লিপিবদ্ধ রয়েছে। খাজা সাহেব বলতেন, সেই ব্যক্তিই উত্তম চরিত্রের লোক যে দারিদ্র্য নিয়েও অবিচল, দুঃখের মধ্যেও সুখী, ক্ষুধার্ত থেকেও তৃপ্ত ও আক্রান্ত হয়েও বন্ধুবৎসল। এই ওলীকুল শিয়োমনির মতে, জাহান্নাম থেকে নিশ্চিত পরিত্রানের উপায় হলো ক্ষুধার্তকে মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা খাওয়ানো, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান এবং পীড়িতকে সেবাদান করা। খাজা সাহেব ছিলেন সত্যিকার ঈমানদার বা আরিফের একজন রোল মডেল : যিনি শত্রুর মাঝেও শংকামুক্ত ছিলেন এবং সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করতেন। একজন আরিফ আল্লাহভীত হন। লজ্জাবোধ তার চরিত্রের বিশেষ অলঙ্কার।
আমি চিন্তা করতে লাগলাম, আমরা কেন নিজেদের আরিফ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি না?
কোনও কাজ করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়, যা বলতে যাচ্ছি বা করতে যাচ্ছি তা কি আমার জন্য শান্তি বয়ে আনবে? ডায়ার বলেছেন, উত্তরটা যদি হ্যাঁ হয় তাহলে প্রাণমন দিয়ে সে কাজে এগিয়ে যাও। আর যদি না হয় তাহলে তুমি তোমার অহংবোধ থেকে সাবধানী হও। কারণ অহংবোধ বা আমিত্ব তোমাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলবে, এমনকি আল্লাহ থেকেও। খাজা সাহেবের মাজারে আমি সেদিন শুধু একটি ধ্বনিই শুনেছি, সর্বাবস্থায় তোমরা শান্তিতে থাকো।
দরগাহ শরীফের পাশেই পবিত্র পুষ্করণী নামে একটা লেকের মত জলাশয় রয়েছে। এ দুটি পবিত্র জায়গাকে আমার ভারতের ধর্ম সহিষ্ণু অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক বলে মনে হল। আজমির শান্তিপূর্ণ সমাজের আদর্শতম মডেল। আমি মাজারে শোকরানা নামাজ আদায় করলাম। এ দরগাহ শরীফের দৃশ্য আমাকে আরও দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দিল। এর একটি হলো নগর দরগাহ, আরেকটি ভেলানকান্নি গীর্জা।
২০০১ সালের ২ অক্টোবর ভিএসএসসির পরিচালক জি, মধুবন নায়ার এবং IISc-এর প্রফেসর এন বালাকৃষ্ণর সংগে কেরালার অমৃত ইনস্টিটিউট অব কম্পিউটার টেকনোলজি পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রায় ১হাজার তরুণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ব্রহ্মচারী ও স্বামীদের মধ্যে আমি বক্তব্য রেখেছিলাম।
আমার বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল, জ্ঞানের বহুমুখী ব্যবহার। আমি দেখলাম ছাত্রদের মধ্যে নতুন আইডিয়া গ্রহণের সাংঘাতিক প্রবণতা রয়েছে। আমার প্রতি তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তারা শুধু প্রযুক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রেই নয় বরং সঞ্জীবন যাপনের ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করলো। তাদের সংগে কথাবার্তা শেষ করে আমি আম্মার সংগে দেখা করলাম। এটি আমার জীবনের এক উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা।
সেখানকার প্রধান সাধ্বীকে সবাই আম্মা বলে ডাকে। একজন মানুষ কীভাবে নিজেকে ঈশ্বরের নিকটবর্তী করে গড়ে তুলতে পারে তিনি লোকজনের কাছে সেই বাণীই প্রচার করে থাকেন। ধর্মোপদেশদান ছাড়াও তিনি হাসপাতাল নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি উচ্চশিক্ষাদানকারী ব্যবস্থাপনা কলেজ। পরিদর্শনের এক পর্যায়ে আশ্রমের প্রধান আম্মা এবং অন্যান্য সন্ন্যাসীদের সংগে কথা হল। যদিও তার এ প্রতিষ্ঠানে আধুনিক সকল শিক্ষাই দেওয়া হয় এবং সেখান থেকে প্রতিবছর অসংখ্য প্রকৌশলী, চিকিৎসক, ব্যবস্থাপনা ও বিজ্ঞানের উচ্চতম ডিগ্রিধারী বেরিয়ে আসছে তারপরও তারা তাদের আধ্যাত্মিক শিক্ষার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্যুৎ হননি।
কথা বলার এক পর্যায়ে আম্মা বললেন, কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে। এই কিছু একটা আসলে কী? এই কিছু একটা বলতে তিনি পার্থিব ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার সমন্বয়কে বোঝাতে চাইছিলেন।
আমি যখন রাজকোটের খ্রীস্ট কলেজ পরিদর্শন করছিলাম, সে সময় রামকৃষ্ণ মিশন থেকে স্বামী নিখিলেশ্বরানন্দ আমাকে নেমন্তন্ন জানালেন। স্বামীজি তার আশ্রমটাতে একবার ঘুরে যাবার জন্য অনুরোধ পাঠালেন। আমিও না গিয়ে পারলাম না। খ্রীস্ট কলেজের অনুষ্ঠান শেষ করে আশ্রমে হাজির হলাম। আমি যখন আশ্রমে পৌঁছেছি তখন আশ্রমের সান্ধ্য আরতি ও ভজন শুরু হয়েছে। ভজন সংগীতের মুচ্ছনা আমাকে এত আপুত করলো যে প্রায় পনের মিনিট আমি তাদের সংগে বসে এক অতিলৌকিক ধ্যানের জগতে চলে গেলাম।
মহাত্মা গান্ধীর জন্মস্থান পোরবান্দারে অবস্থিত স্বামী বিবেকানন্দ হলে ধ্যান করার সময় আমার ভেতরে যে শিহরণ অনুভব করেছিলাম, এখানেও সেই আধ্যাত্মিক শিহরণ আমার সমস্ত দেহমনকে নাড়িয়ে গেল।
২০০১ সালের ৬ অক্টোবর কাঞ্চিতে প্রায় ১শ গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে কৃষক পরিবার তাদের গ্রামীন উন্নয়নের উদ্দেশ্যে শঙ্করাচার্য নামের একটি সভার মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা আয়োজন করেছিল। আমাকে নেমন্তন্ন করা হলো এবং সে সভায় যোগ দিলাম আমি। ওই সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ তাদের গ্রামাঞ্চলে শহরকেন্দ্রীক নাগরিক সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে মিলিত হয়েছেন। স্থানীয় পঞ্চায়েত সভাটির সভাপতিত্ব করলেন। একটি বিষয় দেখে আমি খুব অবাক ও আনন্দিত হলাম যে উন্নয়নমুখী কার্যক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতারাও এগিয়ে এসেছেন।
সভাশেষ হলে প্রধান দুই আচার্য আমার সংগে একান্ত আলোচনায় বসলেন। স্বামী বিজয়েন্দ্র স্বরস্বতীগল হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করলেন, আমার শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলেন ও আশীর্বাদ করলেন।
স্বামী বিজয়েন্দ্র স্বরস্বতীগল আমাকে জানালেন, সেখানকার ৩শ বছরের পুরনো একটি বিখ্যাত মসজিদের ইমাম আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন। স্বামীজি আমাকে মৌলভী সাহেবের দাওয়াত কবুল করার এবং সে মসজিদ পরিদর্শন করার পরামর্শ দিলেন।
তার কথা শুনে, সাবেক প্রেসিডেন্ট আর ভেঙ্কটরমনের কথা মনে পড়ে গেল। বছর দশেক আগে কাঞ্চি মঠের কাছে ভেঙ্কটরমন একবার আমাকে একটা বহু প্রাচীন মসজিদ দেখিয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে মসজিদ কর্তৃপক্ষ এবং জেলা কর্তৃপক্ষ মসজিদটি আরেক জায়গায় স্থানান্তর করার সিদ্ধন্ত নেয় কারণ মসজিদ ও মঠের অবস্থান কাছাকাছি হওয়ায় উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য কিছুটা অসুবিধা হচ্ছিল। তাছাড়া প্রতিদিন ওই মসজিদে হাজার হাজার মানুষ ইবাদত করার জন্য আসে; অন্যদিকে মঠেও হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু লোক আসে। এর ফলে ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মঠ কর্তৃপক্ষ ওই ঐতিহাসিক মসজিদটি অন্যত্র স্থানান্তর করবে তাদের অর্থায়নে। এ খবর পরমাচার্যের কাছে পৌঁছলে তিনি কঠিনভাবে এ সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেন। পরমাচার্য বললেন, ভোর সাড়ে চারটায় যে ফজরের আযান হয় সে আযান আমাদেরও উপাসনা করার জন্য জাগিয়ে দেয়। এ ছাড়াও নানা কারণে তিনি মসজিদ সরিয়ে নেবার বিরোধীতা করেন। তিনি জেলা কর্তৃপক্ষ ও মঠ পরিচালকদের তার বক্তব্য বুঝিয়ে বললেন এবং মাওনাদিম বা গভীর ধ্যানে মনঃসংযোগ করলেন। অবশেষে তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মসজিদ স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়।
পরমাচার্যের মঠ থেকে আমি মসজিদ পরিদর্শনে এলাম। সেখানকার কাজী ও মৌলভীর সংগে দেখা করলাম। সেখানে নামাজ আদায় করলাম। সেখানে প্রায় পঞ্চাশজন তালবে এলেম কোরান শরীফ শিখছিল। আমি তাদের পাশে বসলাম এবং কোরান শরীফের আত্মাখ্যাত আলহামদু সুরা পড়ার জন্য তাদের অনুরোধ করলাম।
এই কাঞ্চিতে এসেই আমি ছাত্রদের কোরান ও বেদ পাশাপাশি বসে পড়তে দেখেছি।
এখানেই ভারতের প্রকৃত মহত্ব লুকিয়ে আছে। কাঞ্চির এই ধর্মীয় সহিষ্ণুতা আমাদের জন্য এবং পরবর্তী পৃথিবীর জন্য এক মহান শিক্ষা।
শঙ্কর কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক, ছাত্র ও শিক্ষকদের এক আলোচনায় আমি উপস্থিত ছিলাম। বক্তাদের আলোচনায় সেদিন একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছিল যে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য বিজ্ঞান চেতনার এক অপূর্ব সম্ভার। এই সংস্কৃত সাহিত্যেই বিমান আবিষ্কারের ধারণা রয়েছে।
এছাড়া পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, আয়ুর্বেদীর বহু সূত্র রয়েছে সংস্কৃত পুঁথি ও পূরাণে। সে আলোচনায় তারা আমাদের প্রাচীন পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীদের মতামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে আধুনিক বিজ্ঞানের সংগে সমন্বয় ঘটানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
হোয়াইটফিল্ডে অবস্থিত শ্ৰী সত্যসাঈ ইনস্টিটিউট থেকে একবার প্রফেসর রমা রাও ও আমাকে দাওয়াত করা হয়েছিল।
ফজরের নামাজ শেষে আনুষঙ্গিক ইবাদত শেষ করে সকাল ৭টায় একটা কাব্যিক আবহে সেখানে ধর্মালোচনা শুরু হল। আলোচনার বিষয় ছিল কিভাবে অন্তর থেকে অহংকার উপড়ে ফেলে সেখানে ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করা যায়। দেখলাম, সঈ বাবা যখন তার অনুসারীদের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলেন তখন তার চেহারা মোবারকের নূরানী তাজাল্লিতে ভক্তকুলের সব দুঃখ কষ্ট যেন মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল।
২০০২ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইটফিল্ডের একটি চিকিৎসা প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। সকাল সাড়ে নটায় আলোচনা শুরু হল, শেষ হল রাত আটটায়। ওই সম্মেলনের পুরো আলোচনা অনুষ্ঠানে শ্রী সাঈ সত্যবাবা উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেক আলোচকের বক্তব্যেই তিনি সাধুবাদ
মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা জানাচ্ছিলেন। আমি আমার পাঁচ মিনিটের বক্তৃতায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম কীভাবে প্রযুক্তি মানুষের কাজে এসেছে–দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের আবিষ্কৃত কার্ডিয়াক স্টেন্টের উল্লেখ করলাম যা পঙ্গু রোগীদের হাঁটা-চলায় সাহায্য করে।
আমার বক্তব্য শেষ হতেই সত্যবাবা দর্শকদের চেয়ারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে হাত তুলে আমাকে আশীর্বাদ জানাতে লাগলেন। হোয়াইটফিল্ডের আগে তার আখড়ায় গিয়ে অভূতপূর্ব আতিথেয়তা পেয়েছি, বিস্মিত হয়েছি। এখানে এই আলোচনার প্রতি সাঈজীর আগ্রহ দেখে আবার বিস্মিত হলাম। আলোচনার আগে তিনি বলেছিলেন, চেন্নাইয়ে পানির আকাল চলছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ ভারী সমস্যায় পড়েছে। তিনি যখন তার বক্তব্যে ঘোষণা করলেন তিনি চেন্নাইয়ের এ জলসংকট নিরসন করবেন, তখন মনটা তার প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে গেল।
২০০২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অবু পাহাড়ে অবস্থিত ব্ৰহ্মকুমারী আশ্রমে ঘুরে আমার কিছু ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেখানে গিয়ে শুনলাম ধাধী গুর্জর নামে এক শিবভক্তের ওপর শিব ভর করেছে। ধাধী নামের সেই মহিলা আমাদের দিকে চাইল। তার চেহারা যেন একেবারে পাল্টে গেছে। মুখ রক্তিম হয়ে গেছে। জলদগম্ভীর কণ্ঠে সে জ্ঞান, যোগ, চরিত্র ও কর্ম, এই চারটি বিষয়ে আমাদের উপদেশ দেওয়া শুরু করলো।
আমাদের মানে আমি, শিবতনু পিল্লাই, ও সিলভামূর্তি এই তিনজনকে হঠাৎ সে কাছে ডাকল। ভয়ে ভয়ে তার কাছে গেলাম। সে গম্ভীর কণ্ঠে আমাদের আশীর্বাদ করে বললো, ভারতই হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দেশ।
ব্ৰহ্মকুমারী একাডেমী পরিচালিত গ্লোবাল হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ করতে আসা করোনারি আর্টারি ডিজিস (সিএডি)র রোগীদের সংগে আমি দেখা করলাম। এখানে একই সংগে রোগীর শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা সেবা দানের পাশাপাশি তাদের আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধিরও চেষ্টা চালানো হয়। আমার বন্ধু ডক্টর ডব্লিউ সিলভামূর্তি দীর্ঘদিন চিকিৎসা বিদ্যা চর্চার পর স্বীকার করেছেন, যোগ সাধনা ও ধ্যান রোগীর ব্যথা উপশমে সাংঘাতিক কার্যকর।
আমি যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তখন ডিআইপিএস (ডিফেন্স ইনস্টিটিউট অব ফিজিওলজি অ্যান্ড আলাইড সায়েন্স)-এ আমি মেডিটেশনের মাধ্যমে রোগীকে আরোগ্য করে তুলতে দেখেছি। কার্ডিয়াক রোগীদের চিকিৎসা করার জন্য ডা, প্রতাপ মৃধা ও ডা. সিলভামূর্তি দুজনে মেডিটেশন সংশ্লিষ্ট এক অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। দুবছর পরে খোঁজ নিয়ে শুনেছি অন্তত ৪শ রোগী আরোগ্যের পথে এবং ৬০ জন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে।
তাদের চিকিৎসা পদ্ধতির অংশ হিসেবে তারা রোগীদের প্রতিদিন যোগ সাধনা করাতেন, উচ্চ রক্তচাপ এড়ানোর জন্য স্বপ্নমাত্রার চর্বিযুক্ত খাবার দিতেন আর রোগিদের কার্ডিওভাসকুলার ও মেটাবোলিক এফিশিয়েন্সী বাড়ানোর জন্য কোন না কোন ব্যায়াম করাতেন। আমি আশা করি চিকিৎসাবিদ্যা শুধু শারীরিক রোগ উপসর্গ দূর করার প্রবণতা ছেড়ে মনের অসুখ সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হবে।
অবু পাহাড়ের ব্ৰহ্মকুমারী একাডেমী পরিদর্শনের সময় একাডেমীতে সদ্য যোগদানকারীনী ১৩ জন ব্ৰহ্মকুমারীর সংগে বাক বিনিময় করার সুযোগ দিয়েছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের সিস্টার ঊষা। রাতের খাবার শেষে তাদের সংগে আলোচনায় অংশ নিলাম। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম তাদের জীবনের লক্ষ্য কী? তারা জবাবে বলেছিল ধর্মীয় আদর্শের পথে থেকে বাকি জীবন তারা দেশবাসীর জন্য কাজ করে যেতে চায়। তাদের কথা শুনে আমি ও ডা. সিলভামূর্তি হাজার বছর আগে লেখা তামিল ভাষার কবি আওয়াইয়ারের লেখা একট কবিতা আবৃত্তি করলাম:
মানুষ হয়ে জন্মানোটা দুঃসাধ্য বটে
খুঁতহীন জন্ম নিয়েও নিখুঁত মানুষ
কজন হতে পারে?
অঢেল জ্ঞান আর শিক্ষা পেয়েও কজন
মানুষ শিক্ষিত আর জ্ঞানী?
সবার চেয়ে কঠিনতম কাজ
সত্যিকারের পুজো আর সত্যি আরাধনা
এ কাজ যারা করতে পারে
অথবা পেরেছিল–
তাদের জন্যে স্বর্গদুয়ার–চিরকালই খোলা
স্বর্গে তারা চিরকালই মহান অতিথি।
মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা। এর পর আমি ব্ৰহ্মকুমারীদের কাছে থাম্বার বিশপের ঘটনা খুলে বললাম, কেমন করে তিনি স্পেস রিসার্চ স্টেশনের জন্য তার উপসনালয় আমাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। (এ বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে এ ঘটনা বলেছি আমি)।
বলার পর ব্রহ্মকুমারীদের কাছে প্রশ্ন করলাম, এ ঘটনা সম্পর্কে তোমাদের মন্তব্য কী?
তারা বললো, আমাদের জাতি অনেক উন্নত। আমাদের সমৃদ্ধ সভ্যতা আমাদের উদারভাবে, সমঝোতার দৃষ্টিতে সব কিছু দেখতে শিখিয়েছে। এমন একটি সম্ভ্রান্ত জাতি হয়ে কেন আমরা বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক সংঘাতে যাবো? আমি বিশ্বাস করি যখন কোন জাতির ভবিষ্যত লক্ষ্য থাকবে না তখন সে জাতি হীনম্মন্যতায় ঢেকে যাবে। হারিয়ে যাবে কালের অতল গর্ভে।
মানবতার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে উপযোগী করতে হলে বিজ্ঞান ও ধর্মের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে। ১৯১১ সালে শ্রী অরবিন্দ তার মানবতার গানে বলেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে যেদিন নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পূর্ণ মুক্তির জন্য গোটা ভারতবর্ষ তার দেহের ওপর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা অন্ধকারকে ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেবে। দারিদ্র্যের এই শৃংখল থেকে মুক্তির জন্য আমাদের এখনই একযোগে কাজ করতে হবে।
আমি যতবার যেখানে গেছি, সবখানেই একটি সাধারণ মেসেজ প্রচারের চেষ্টা করেছি। সেটা হল তোমার মধ্যেই আরেকজন মহান তুমি রয়েছে যে এই দৃশ্যমান পৃথিবীর সীমান্ত ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমি আমার আব্বার মধ্যে এমন একটি সত্তার উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম।
আব্বার কাছ থেকেই আমি পারিপার্শ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও মনকে প্রশান্ত রাখার বিষয়টি শিখেছি। বহু দুঃখ ও ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েও নিজেকে পরাজিত হিসেবে বিবেচনা করিনি। বাকি জীবনটা আমি আমার ও আমার চার পাশের মানুষের সংগে শান্তিতে কাটাতে চাই। অন্যদের সংগে বিতন্ডায় জড়ানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই।
ব্যক্তি সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে বহুত্বে বিলীন হবার জন্য এটা অবশ্যই জরুরী বলে আমি মনে করি।
এ প্রসংগে আমি পবিত্র কোরান শরীফের একটি সুরার উল্লেখ করতে চাই:
হে রাসূল (সঃ), যারা ঈমান আনেনি তাদের কাছে আপনি দ্বীনের দাওয়াত প্রচার অব্যাহত রাখুন।
আপনি যার এবাদত করেন, আমি তার এবাদত করি না আর আমি যা করি আপনি তা করেন না।
আপনার কর্মফল আপনার কাছে।
আর আমার কর্মফল আমার কাছে।
আমরা নিজেরা নিজেদের ব্যাপারে যে মত পোষণ করি, আমরা নিজেরা যা বিশ্বাস করি আমাদের কাছে সেটাই সত্য। একদা আমরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে আস্থা এনছিলাম তাই আজ এতদূর আসতে পেরেছি। এই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করতে পারলে এই অবস্থাই আমাদের ব্যক্তি থেকে মহাকালে ছড়িয়ে দেবে।
ভারতীয়রা নিজেদের মর্যাদাশালী জাতি হিসেবে হাজার বছর ধরে ভেবে এসেছে। আমাদের পূর্বপুরুষরাও সেই বিশ্বাস নিয়ে তাদের জীবন কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকের দিনে ভারতের মানুষ তার সেই চেতনাকে ফেলে এমন গভীরভাবে বস্তুজগতের মোহে ছোটা শুরু করেছে যা প্রকৃত জীবনের জন্য অত্যন্ত পশ্চাৎপদ বলে আমি মনে করি।
একবার এক বিশেষ উপলক্ষ্যে আমাকে ব্যাঙ্গালোরে যেতে হচ্ছিল। আমার এক বন্ধুকে আমার সম্ভাব্য যাত্রা সম্পর্কে বললাম। তাকে জানালাম সেখানে গিয়ে আমি তরুণ-কিশোরদের সংগে দেখা করব, তাদের সংগে কথা বলবো। এ ব্যাপারে আমি তার পরামর্শ চাইলাম। তিনি সরাসরি আমাকে কোন পরামর্শ দিলেন না কিন্তু একগুচ্ছ প্রজ্ঞাময় হাদীসের বাণী শোনালেন—
যখন কথা বলবে, সত্য বলবে,
প্রতিশ্রুতি দিলে পূরণ করবে
কাউকে আঘাত করা এবং মন্দ ও বেআইনি জিনিস
গ্রহণ থেকে তোমার হাতকে বিরত রাখবে।
কোন কাজ সর্বাপেক্ষা উত্তম? মানুষের মনে শান্তি দেওয়া, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেওয়া, দুস্থকে সহায়তা করা, দুঃখীর দুঃখ হ্রাস করা আর আহতকে মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা সারিয়ে তোলাই সর্বাপেক্ষা ভাল কাজ।
আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি নিয়েই তার পরিবার এবং সেই ব্যক্তিই তার সবচে প্রিয় যে তার সৃষ্টির জন্য ভাল কিছু করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়।
এগুলোই রাসুলের হাদীস। এ হাদীসগুলো যিনি আমাকে শুনিয়েছিলেন তিনি হলেন তামিলনাড়ু র বিখ্যাত এক দীক্ষিদারের নাতির ছেলে এবং একজন গণপতিগল (বেদ বিশেষজ্ঞ)র নাতি। আমার এ ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি ওয়াই, এস, রাজন ছাড়া আর কেউ নন। এমন উদার মানসিকতা খুঁজে পাওয়া কেবল আমাদের দেশেই সম্ভব। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে,
আনো ভদ্রো ও কর্তব্য য়েনথু বিম্ব থা?-অর্থাৎ সর্বদিক হতে (তোমাদের দিকে) মহান জ্ঞান আসতে দাও।
আমার পরিবারের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমার দাদা ও তার বাবা রামেশ্বরের আম্বালাকারার বা সম্ভ্রান্ত নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কথিত আছে আমার জন্মভূমি এই রামেশ্বর দ্বীপেই ভগবান রাম রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এ ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করতে রামেশ্বরমবাসী প্রতি বছর রাম-সীতার বিবাহ উৎসব পালন করে থাকে।
এখানে রাম তীর্থম নামে একটি পবিত্র পুষ্করণী আছে। পুষ্করণীটি সাংঘাতিক গভীর। পুষ্করণীর মাঝখানে ছোট একটি ভাসমান মন্ডপ বানানো হয়েছে। উৎসবের দিন স্বর্ণালংকার শোভিত রাম-সীতার বিগ্রহ একটি সুসজ্জিত ভেলায় ওই মন্ডপে নিয়ে যাওয়া হতো এবং পুজো করা হতো। আমার দাদার বাবা প্রতিবছর ওই ভেলা সরবরাহ করতেন। বহু প্রাচীনকাল থেকে রামেশ্বরে ওই রাম-সীতার বিবাহ উৎসব আজ অবধি পালিত হয়ে আসছে।
এক বছর, আমার দাদার বাবা পুষ্করণীর পাড়ে দাঁড়িয়ে উৎসব দেখছিলেন। তখনই একটা দুর্ঘটনা ঘটে। হঠাৎ তিনি দেখলেন বিগ্রহটি ভেলা থেকে পড়ে ডুবে গেল। কোন ভাবনা চিন্তা না করেই তিনি পুষ্করণীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং ডুবন্ত সেই বিগ্রহ উদ্ধার করে আনলেন। ঘটনাটি ঘটলো পুরো রামেশ্বরমবাসীর সামনে।
এ ঘটনার পর–
মন্দিরের পুরুৎ আমার দাদার বাবার সম্মানে আমাদের পরিবারকে বিগ্রহে প্রথম শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদানের সুযোগ দিলেন। বিগ্রহ উদ্ধারের পর করুণাময়ের প্রশংসায় ও আমাদের পরিবারের শান্তি কামনা করে ওই দিন রামেশ্বরম মসজিদে বিশেষ মোনাজাত করা হয়েছিল।
আজকের বাস্তবতায় পারস্পরিক সম্প্রীতি ও মানবতার ক্ষেত্রে আমার কাছে। এ ঘটনা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে মনে হয়।
আমরা কি সবাই এমন সৌভ্রাতৃত্ত্বের মন্ত্রে জেগে উঠতে পারবো না?
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ শুনতে আমার হাইস্কুলের শিক্ষক ইয়াদুরাই সলোমন আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা এখন স্বাধীন এমন ঘোষণা শুনতে আমরা সবাই সেদিন জড়ো হয়েছিলাম।
পরের দিন সকাল বেলায় নেহেরুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ পত্রিকার প্রধান শিরোনামে ছাপা হল। তামিল ভাষায় প্রকাশিত ওই সংবাদপত্রে নেহেরুর ভাষণের সংবাদের পাশেই আরেকটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল যা আজও আমার স্মৃতিতে প্রোথিত হয়ে আছে। সংবাদটি ছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কবলিত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে মহাত্মা গান্ধী ১৫ আগস্ট নোয়াখালিতে পায়ে হেঁটে উপস্থিত হয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবেই জাতির জনক হিসেবে মহাত্মা গান্ধী সেদিন স্বাধীন ভারতের প্রথম পতাকা উত্তোলন করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে মানবাত্মার সেবায় তিনি তখন খালি পায়ে নোয়াখালিতে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। এমনই ছিল মহাত্মার মহত্ব। যে মহত্ব একজন স্কুলছাত্রের মনে কী ভীষণ এক অমোচনীয় রেখাপাত করেছিল।
তারুণ্যের শক্তি উপলব্ধি করে এবং বয়োজেষ্ঠ্যদের প্রজ্ঞাকে সম্বল করে আমি আমার প্রযুক্তি কেন্দ্রীক উন্নয়ন পরিকল্পনায় হাত দিয়েছি। যেখানে মানুষ নতুন নতুন বাধা অতিক্রম করবে নতুন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে।
সেখানে তারা বুঝতে চেষ্টা করবে কঠিন সমস্যা উৎরে কীভাবে সফলতার পথে আসতে হয়। আমরা আগেই আলোচনা করেছি কীভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়, কীভাবে প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়ন করতে হয়। আর কীভাবে আধ্যাত্মিক শক্তিকে জাগতিক সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করতে হয়। এতে কি সৃষ্টিচক্রের কিছুমাত্র ক্ষতি হতে পারে?
৫. দেশ প্রেম, রাজনীতি আর ধর্মের উর্ধ্বের ধর্ম
৫. দেশ প্রেম, রাজনীতি আর ধর্মের উর্ধ্বের ধর্ম
I do not care for liberation, I would rather go to a hun dred thousand hells, doing good to others (silently) like the spring, this is my religion.
–Swami Vivekananda
নিয়মিত হাঁটা আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। যেখানেই যাই না কেন প্রতিদিন ভোরে উঠে আমি অন্তত পাঁচ কিলোমিটার হাঁটি। সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য দর্শনের সংগে আমি যেন নিজেকে বেঁধে ফেলেছি। এ গ্রহের আরেকটি সকালকে স্বাগত জানাতে পাখিগুলো যখন গেয়ে ওঠে, তখন সে সুরে যেন আমার শ্রবণেন্দ্রিয় নতুন করে সঞ্জীবিত হয়।
প্রশান্ত বাতাস, পাখির গান, সূর্যোদয়–প্রকৃতির উপাদানগুলো প্রতিদিন উপভোগ করি আর ভাবি প্রকৃতি কী নিখুঁতভাবে এগুলোর সমন্বয় করে এমন একটি শান্তির মুহূর্ত উপহার দিয়েছে। আমি ভাবতে থাকি আর আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই।
আমি খুব ভাগ্যবান এ কারণে যে আমার কাজের কারণেই আমাকে বহু জায়গায় যেতে হয়েছে। এসকল সুন্দর সুন্দর জায়গা উপভোগের অভিজ্ঞতা আমার মনের দুয়ার খুলে দিয়েছে।
এমনই একটি মোহময়ী সুন্দর জায়গা উড়িষ্যার চন্ডিপুর। কলকাতা থেকে বালাসোরের দূরত্ব ২৩৪ কিলোমিটার আর বালাসোর থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরেই চন্ডিপুর।
চন্ডিপুর মানেই হলো দুর্গা বা চন্ডিদেবীর অধিষ্ঠান ক্ষেত্র। এখানকার সমুদ্র সৈকত নিঃসন্দেহে ভারতের অন্যান্য সৈকতগুলোর চেয়ে সুন্দর। মৃদু জোয়ারের সময় তটসংলগ্ন প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জোয়ার প্লাবিত হয়ে পড়ে।
নির্জন সৈকত, সৈকতসংলগ্ন তমরীক্ষ গাছের পাতার মর্মরধ্বনি, আর মৃদুমন্দ বাতাস এক অনন্য নৈঃশব্দতার সৃষ্টি করে। সুবর্ণরেখা নদীটি সাগরের যেখানে এসে মিশেছে তার পাশের তটভূমি দিয়ে আমি বহুবার হেঁটেছি।
বড় বড় ঢেউগুলো যখন তীরে এসে আছড়ে পড়তো তখন আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতাম। মনে হতো ঈশ্বরের আশীর্বাদ যেন ঝরে ঝরে পড়ছে।
ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন– আইএসআরওর শ্রীহরিকোটা রেঞ্জ থেকে আমরা আমাদের ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপন পরীক্ষা চালানো শুরু করি। কিন্তু আমাদের আলাদা একটি স্থায়ী মিসাইল টেস্ট রেঞ্জ দরকার ছিল।
ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপন, রকেট ও নভোযান উৎক্ষেপনের স্থায়ী পরীক্ষাক্ষেত্র আইটিআর (ইনটেরিম টেস্ট রেঞ্জ) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালে।
বহুমুখী ক্ষেপণাস্ত্র ত্রিশুল, একাধিক লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র আকাশ, ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র নাগ মিসাইল, ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত করতে সক্ষম পৃথ্বী এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অগ্নিসহ বিভিন্ন শ্রেণীর ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা হয়েছে এখানে।
ইন্দো-রুশ যৌথ উদ্যোগে বানানো সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ব্রাহমোস এর পরীক্ষা হয়েছে এই টেস্ট রেঞ্জে। এছাড়াও আইটিআর-এর সহায়তায় মাল্টিব্যারেল রকেট লঞ্চার পিনাকা ও পাইলটবিহীন এয়ার ক্র্যাফট লক্ষ্যর পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপন হয় এখানেই।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে আইটিআরকে এমনভাবে সজ্জিত ও সক্ষম করে তোলা হয়েছে যে এখন সেখানে যে কোন ধরনের এয়ারবর্ণ উইপনের পরীক্ষা করা সম্ভব।
এখানে পরীক্ষীত হয় দূরপাল্লার মিসাইল, এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম, হাল্কা যুদ্ধ বিমানের সমরাস্ত্র প্রযুক্তি ও মাল্টি টার্গেট উইপনস্ সিস্টেম।
সমুদ্র উপকূল থেকে সমুদ্রের দিকে ১৭ কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকা জুড়ে আইটিআরের ব্যাপ্তি। এই বিশাল এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে ট্র্যাকিং সিস্টেম বা সমরযানের পথ চিহ্ন শণাক্তকারী প্রযুক্তি। তাছাড়া উৎক্ষেপিত নভোযানের ফ্লাইট পথ বা উডডয়ন রেখা শনাক্ত করার যন্ত্রপাতিও এখানে স্থাপন করা হয়েছে। আইটিআরে যেসব প্রয়োজনীয় যন্ত্র বসানো হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– মোবাইল অ্যান্ড ফিক্সড ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল ট্র্যাকিং সিস্টেম, মোবাইল এস ব্যান্ড ট্র্যাকিং রাডার, ফিক্সড সিব্যান্ড ট্র্যাকিং রাডার, রেঞ্জ কম্পিউটার, ফটো প্রসেসিং সিস্টেম, মেটিওরোলজিক্যাল সিস্টেম এবং রেঞ্জ সেফটি সিস্টেম। রকেট অথবা অন্য কোন নভোযান উৎক্ষেপনের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সহায়তা করার জন্য সেখানে আরও আধুনিক প্রযুক্তির নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি বসানো হচ্ছে।
আইটিআর ধীরগতিতে হলেও নিশ্চিতভাবে বিশ্বমানের রেঞ্জ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
১৯৯৫ সালের জুলাই মাসের কোন এক নাতিশীতোষ্ণ রাতে ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপনাস্ত্র পৃথ্বীর সফল উৎক্ষেপনের পর সবাই খুব খোশ মেজাজে। প্রায় ১২শ টিম মেম্বারের ৩০ জন প্রতিনিধি আমরা। খুব গর্বভরে ভাবছিলাম–এর পরের প্রকল্প কী?
আর্টিলারির মহাপরিচালক লে. জেনারেল রমেশ খোশলা জানালেন, ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত করতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রের আসল পরীক্ষা করতে হবে যে পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত লক্ষ্যে আঘাতের পর চারপাশের ১৫০ মিটার জায়গায় কী প্রভাব পড়ে তা জানা যাবে। টেকনিক্যাল টার্ম অনুযায়ী এটাকে বলা হয়, সিইপি (সার্কুলার এরর প্রোবাবিলিটি)।
ভূমির ওপর দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা আগে হয়নি। (ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এর আগে করা হয়েছে সমুদ্রের ওপর)।
আমরা উপযুক্ত পরীক্ষা ক্ষেত্র খোঁজার জন্য ভারতের ভৌগলিক মানচিত্র নিয়ে বসলাম। ম্যাপে দেখলাম আইটিআরের ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিন্দুর মত দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। এগুলো আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ মিলে একটি ছোট দ্বীপপুঞ্জ। অনিবার্য কারণেই এ পরীক্ষার জন্য আমরা রাজস্থানের মরুভূমিতে যেতে পারছি না। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপও আইটিআর থেকে অনেক দূরে। রাত দুটোয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল এই ছোট দ্বীপপুঞ্জের কোন একটি দ্বীপেই আমাদের মিসাইল ইমপ্যাক্ট টেস্ট হবে। সবচেয়ে ভাল পরীক্ষা উপযোগী দ্বীপ খোঁজা শুরু হল।
একটি হেলিকপ্টার পাঠানো হল এলাকা পর্যবেক্ষণের জন্য। কেউ একজন প্রস্তাব করলো জেলেদের গাইড হিসেবে নিয়ে দ্বীপগুলো সশরীরে দেখে আসা যায়।
লোকেশন সার্ভে করার প্রাথমিক দায়িত্ব পড়লো আমার দুই সহকর্মী সরসবাত ও সালবানের ওপর। তারা দুজন উড়িষ্যার ধর্ম নামের একটি জায়গায় গাড়িতে চড়ে গেলেন। সেখান থেকে সারাদিনের জন্য আড়াইশ টাকায় মাঝিসহ নৌকা ভাড়া করে ওই দ্বীপে পৌঁছলেন। কিন্তু দ্বীপে পৌঁছতেই রাত হয়ে গেল। সালবান যাত্রাপথে খাওয়ার জন্য সংগে কিছু ফল নিয়েছিলেন। তাই দিয়েই রাতের খাবার সারতে হল। দ্বীপে রাত কাটানো ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। এদিকে দুজনের কেউই সাগর অথবা মরুভূমির সংগে পূর্ব-পরিচিত নন। ফলে সারারাত ভয়ে ভয়ে নৌকোয় শুয়ে কাটিয়ে দিলেন। ভোরে উঠেই তারা ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৮শ মিটার প্রশস্ত দ্বীপটি সার্ভে করা শুরু করলেন। হঠাৎ তারা দেখলেন দ্বীপের পূর্ব পাশে একটা গাছের ওপরে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। তার নিচে বেশ কয়েকটা কুঁড়ে ঘর। এটা সম্ভবত প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে আসা জেলেদের কাণ্ড। আমার বন্ধুরা তাড়াতাড়ি সে পতাকা সরিয়ে ফেললেন।
ওরা দুজন ফিরে এসে দ্বীপটিকে পরীক্ষার উপযোগী হিসেবে রিপোর্ট করার পর পরবর্তী পদক্ষেপগুলো খুব দ্রুত নেওয়া হল। বন ও পরিবেশ কর্মকর্তারাসহ জেলাকর্তৃপক্ষ দ্বীপটি পরিদর্শন করে এলেন। খুব সহজেই দ্বীপটি অধিগ্রহণের ব্যাপারে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া গেল।
বাকি থাকলো উড়িষ্যা সরকার ও বন মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর প্রক্রিয়ার কাজ। উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রীর ডেস্কে যাতে আমাদের ফাইলটি দ্রুত পাঠানো হয় সেজন্য আমি তার অফিসের কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের সংগে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করলাম। এছাড়া আমার জবানবন্দীতে মুখ্যমন্ত্রী বরাবরে একটি চিঠি লিখে দিলাম। ডিআরডিওর কোন কোন কাজের জন্য দ্বীপগুলো আমাদের তা চিঠিতে উল্লেখ করলাম। চিঠিতে আমি খোলাখুলিভাবেই তাকে জানালাম যে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জন্য রেঞ্জ হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আমাদের দ্বীপটি প্রয়োজন।
মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদনের আগেই আমরা যাবতীয় প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে রেখেছিলাম। আমাদের কাজের ব্যাপারে ছোটখাটো কিছু প্রশ্ন উঠবে জানতাম। যেমন দ্বীপগুলোর পাশে মাছ ধরা হয়, সেটা রেঞ্জ হিসেবে ব্যবহৃত হলে জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া কচ্ছপদের চলাচলেও বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। তাছাড়া দ্বীপের মূল্য তো চাওয়া হতেই পারে। যাহোক, ১০ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রীর সংগে দেখা করার সুযোগ পাওয়া গেল। আমি ইতিপূর্বেই মুখ্যমন্ত্রী বিজু পাটনায়েক সম্পর্কে মোটামুটি জানতাম। বিশেষ করে তার পাইলট জীবন ও ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্নের সংগে তার বন্ধুত্বের কথা আগেই শুনেছিলাম।
মেজর জেনারেল কে, এন, সিং এবং সালবানকে সংগে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বারে ঢুকতেই তিনি আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি প্রচ্ছন্ন উচ্ছ্বাসে বললেন, কালাম, আমার বন্ধু, ড. সারাভাই থেকে এপর্যন্ত আমি সব সময় তোমার কাজের খোঁজ খবর রাখি। তুমি যা চাইবে আমি তাই দেব।
আমাদের সামনেই তিনি উড়িষ্যার চারটি দ্বীপই ডিআরডিও তাদের পরীক্ষার কাজের জন্য রেঞ্জ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে–এই মর্মে সরকারী অনুমোদনপত্রে সই করে দিলেন। তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, কালাম, তুমি আমার কাছে যা চাইলে তা তোমাকে দিয়েছি। আমি জানি তুমি এর সদ্ব্যবহার করবে। তোমার মিশন–এই মিসাইল প্রোগ্রাম এখন দেশের জন্য সাংঘাতিক জরুরী হয়ে পড়েছে। তোমার কাজে লাগবে উড়িষ্যার এমন সব কিছু এখন থেকে তোমার। একথা বলে তিনি গভীর আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি আব্দারের স্বরে বললেন, কালাম, আমাকে তোমার প্রতিশ্রুতি দিতেই হবে আর এ জাতিকে আশ্বস্ত করতেই হবে যে তুমি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভারতকে উপহার দেবে। যেদিন ভারত নিজে আইসিবিএম তৈরী করবে সেদিন একজন ভারতীয় হিসেবে আমি নিজেকে অনেক বেশী শক্তিশালী মনে করবো।
কয়েক মুহূর্ত আমিসহ সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। আমি জানতাম বিজু পাটনায়েক অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং জনপ্রিয় একজন নেতা। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি রাজনীতিতে নেমেছিলেন।
আমি তার চোখের দিকে সরাসরি দৃষ্টি রেখে বললাম, স্যার, আপনার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অবশ্যই আমরা কাজ করব। আমি আপনার ইচ্ছের কথা দিল্লিকে জানাব।
যে সময়ের কথা বলছি তখন থেকে ৪০ বছর আগে অসমসাহসী বিজু পাটনায়েক কলিঙ্গ এয়ারওয়েজের পাইলট ছিলেন। ওই সময়ে প্রেসিডেন্ট সুকর্নের সংগে তার পরিচয় হয়। সুকর্নের স্ত্রী সবেমাত্র একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেছেন।
সুকর্ণ পরিবার কন্যার জন্য ভালো একটি নাম খুঁজছেন। এমন সময় বিজুদা ওই পরিবারের সংগে দেখা করেন।
সুকর্ন এই সমস্যার সমাধানের ভার দিলেন ভারতীয় নাগরিক বিজুকে। বিজু পাটনায়েক দেখলেন আকাশে ঘন মেঘ জমেছে। এই মেঘগুলো যেন নবজাতককে স্বাগত জানাবার জন্যই হাজির হয়েছে। তিনি মেঘের সংস্কৃত প্রতিশব্দের সংগে কন্যার নাম দিলেন মেঘবতী।
সুকর্নের মেয়ের নাম মেঘবতীই স্থির হল। আর এভাবেই ১০০ভাগ মুসলিম দেশের প্রধান নেতার কন্যাশিশু একটি হিন্দু নামে পরিচিত হয়ে উঠলো। যারা মহান, যারা বড়, তাদের কাছে ধর্ম হলো বন্ধুত্ব সৃষ্টির এক মধুর পন্থা। ক্ষুদ্র মানসিকতার লোকরাই ধর্মকে হানাহানির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।
বহু বছর পরে অনেক রাজনীতির চড়াই উত্রাই পেরিয়ে সেদিনের সেই মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পরে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
আমার বন্ধুরা, আমাদের এই সকল অনন্য রাজনীতিবিদরা দেশ থেকে, সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেখে আমাদের বিলাপ করা উচিত। যে ভারতের আজ বিশ্বে নেতৃত্ব দেবার কথা ছিল আজও সেই ভারত অন্ধ বিবর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। অথচ এদেশের রয়েছে ১শ কোটি মানুষের বিপুল জনশক্তি, অসংখ্য সম্ভাবনাময় শিল্প-কারখানা, রয়েছে অসংখ্য বিজ্ঞানী। এমনকি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারতকে যেভাবে উচিত ছিল সেভাবে উন্নত দেশগুলো বিবেচনা করছে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতকে যেভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে তা পৃথিবীর কোন দেশের ক্ষেত্রে হয়নি।
পোখরানে দ্বিতীয় দফা পারমাণবিক পরীক্ষার পর পশ্চিমা দেশগুলো ভারত ও পাকিস্তানকে এক পাল্লায় মাপা শুরু করলো। এতে কি আমাদের জাতীয়ভাবে প্রতিবাদ করা উচিত নয়। আমাদের কি বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে বিক্ষোভ করে বলা উচিত নয় যে পাকিস্তানের বাইরেও আমাদের চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রয়েছে; আমরা পাকিস্তানের চেয়ে বহুগুণে সবদিক থেকে উন্নত এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল?
২০০২ সালের মার্চ মাসে আন্না ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষের প্রায় ১শ ছাত্রের মধ্যে ক্লাস নিচ্ছিলাম। প্রযুক্তি ও তার ব্যাপ্তি এ বিষয়ে পর দশদিন ক্লাস নিলাম। শেষের দিনে প্রযুক্তির দ্বিমুখী ব্যবহার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সংগে বিস্তারিত আলোচনা শুরু হল। ওদের মধ্য থেকে একটি ছাত্র দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, সম্প্রতি আমি ড. অমর্ত্য সেনের একটি বিবৃতি পড়েছি যাতে তিনি বলেছেন ১৯৯৮ সালের মে মাসে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোয় ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ হয়েছে। অমর্ত্য সেন নোবেল বিজয়ী একজন বিরাট অর্থনীতিবিদ। উন্নয়ন পরিকল্পনাকারী হিসেবে সারাবিশ্বে তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। তার মত একজন ব্যক্তির এ মন্তব্য মোটেই উপেক্ষা করা যায় না। তার এ মন্তব্য সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?
আমি বললাম, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমি ড. অমর্ত্য সেনের বিশালত্বকে শ্রদ্ধা করি এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে দ্রুত অগ্রসর করার ক্ষেত্রে তিনি সরকারকে যে পরামর্শ দিয়েছেন আমি তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করি। ঠিক একইভাবে আমার মনে হয় ড. অমর্ত্য সেন ভারতকে দেখেছেন পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে। তার মতে ভারতের উচিত সব দেশের সংগে সদ্ভাব বজায় রাখা যাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। আমি তার সংগে একমত, তবে একই সংগে অতীতের ভারতের পূর্ব অভিজ্ঞতাও মন থেকে মুছে ফেলতে পারি না। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু জাতিসংঘে পরমাণু অস্ত্র বিস্তারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং সমস্ত দেশের পারমাণবিক অস্ত্র বিলুপ্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর ফলাফল কি হয়েছিল আমরা তা দেখেছি। আমরা দেখেছি তার এ জানে কোন দেশ সাড়া দেয়নি। আমেরিকার মাটিতে এখন ১০ হাজার পারমাণবিক ওয়ারহেড, রাশিয়ার মাটিতে আরও ১০ হাজার। এছাড়া ব্রিটেন, চীন, ফ্রান্স, পাকিস্তানসহ আরও বহু দেশে রয়েছে হাজার হাজার ওয়ারহেড। STSART-II এবং প্রত্যেকের ২ হাজার ওয়ারহেড ধ্বংস করার ব্যাপারে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তা থেকেও তারা পিছিয়ে এসেছে।
ওয়ারহেড হ্রাসের ব্যাপারে কেউ এখন পর্যন্ত কোন জোরালো পদক্ষেপ নেয়নি। আমাদের মনে রাখা দরকার যে আমাদের পার্শ্ববর্তী দুটি দেশ ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আছে। এসব দেখেও কি ভারত নিরব দর্শক হয়ে বসে থাকবে?
গত ৩ হাজার বছর ধরে ব্রিটিশ, ফরাসী, ডাচ, পর্তুগীজসহ আরও বহু জাতির দ্বারা ভারত উপনিবেশিকতার শিকার হয়েছে।
এদের কেউ এসেছে তাদের রাজ্যসীমা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, কেউ এসেছে ধর্মীয় মতাদর্শ সম্প্রসারণের ফিকির নিয়ে, আবার কেউ এসেছে ভারতবর্ষের সম্পদ চুরি ও লুটপাট করে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভারত কেন কোনদিন অন্যদেশে উপনিবেশ গড়েনি? এর কারণ কি এটা যে আমাদের রাজ্য শাসকরা সাহসী ছিলেন না? না। এর মূলকারণ ভারতবাসী চিরকালই একটি সহিষ্ণু জাতি। তারা কোন কালেই অন্য দেশে অভিযান চালিয়ে পরভূমে উপনিবেশ গড়তে চায়নি।
কিন্তু সুদীর্ঘ সংগ্রামের পর যখন আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, যখন ভারতের মানুষ এক হয়েছে, যখন আমরা একটি ভৌগলিক সীমারেখা সৃষ্টি করতে পেরেছি তখন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই কি আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে স্থির করতে পারি। আমাদের এদেশের শক্তি প্রদর্শনের একটিই পথ খোলা আছে। সেটি হল আমাদের প্রমাণ করতে হবে আত্মরক্ষার পূর্ণ সামর্থ্য আমাদের রয়েছে।
বলবান চিরকাল বলবানকেই সম্মান করে, দুর্বলকে নয়। রাষ্ট্রীয় শক্তি মানেই সামরিক সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত ও পলিসি সেই সব দেশের সেবায় নিয়োজিত যারা পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ। ইতিপূর্বে কেন আমাদের নিরাপত্তা পরিষদের আসন দেওয়া হয়নি আর কেনই বা এখন বিভিন্ন দেশ ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বানানোর জন্য নিরন্তর সুপারিশ করে যাচ্ছে?
এ প্রসংগে আরেকটা ঘটনার কথা বলি। আমার বন্ধু অ্যাডমিরাল এল, রামদাস, নৌ-বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যিনি অবসর নিয়েছেন, তিনি তার সমর্থকদের একটি দল নিয়ে ১৯৯৮ সালের মে মাসে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ করতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম তারা যেন ভারতীয় পার্লামেন্ট ঘেরাও করার আগে হোয়াইট হাউস এবং ক্রেমলিন ঘেরাও করেন, সেখানে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক ওয়ারহেড ও আইসিবিএমের পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে।
আমি আমার দেশের জনগণকে জেগে উঠতে বলি। আমার এ আহ্বান সমস্ত ভারতবাসীর প্রতি। তারা যেন তাদের সর্বোচ্চ শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কোন শক্তি একটি জাতির উত্থান অথবা পতন ঘটায় এবং কোন বিষয়গুলো একটি দেশকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলে? এটা আমাদের ভাবতে হবে।
আমার বিবেচনায় তিনটি বিষয় একটি জাতিকে সুদৃঢ় ও সংহত করে : বিগত সাফল্যের গৌরব, একতাবদ্ধতা এবং যৌথভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের সক্ষমতা।
একটি জনগোষ্ঠী অথবা জাতিকে উন্নতির শীর্ষ চূড়ায় আরোহন করতে হলে অবশ্যই তাদের অতীতের মহান নায়কদের মনে রাখতে হবে; অতীতের গৌরবময় আন্দোলন ও বিজয়কে মনে রাখতে হবে। ব্রিটিশ জাতি যদি উন্নতির চরম শিখরে উঠে থাকে তাহলে তা সম্ভব হয়েছে লর্ড নেলসন অথবা ডিউক অব ওয়েলিংটনের মত নেতাদের গৌরবময় সাফল্য ধরে রাখার আকক্ষার কারণে। জাতীয়তাবোধের দৃষ্টান্ত দিতে গেলে জাপানের নাম এক নম্বরে উঠে আসে। জাপানীরা এক মানুষ, একদেশ, এক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী একটি জাতি। শুধু এই জাতীয়তাবোধের কারণেই তারা একটি চরম অপমানজনক সামরিক পরাজয়কে আজ অর্থনৈতিক বিজয় হিসেবে রূপ দিতে পেরেছে।
পৃথিবীতে যত জাতিই উন্নতি লাভ করেছে তাদের সবাই একটি লক্ষ্যে সব সময় সচেতন থেকেছে। জাপানের মত জার্মানিদের মানুষও তাদের লক্ষ্যে অবিচল ছিল। মাত্র তিন দশকের মধ্যে জার্মানি দুদুবার ধ্বংস হয়েছে।
কিন্তু জার্মানদের উন্নতির লক্ষ্য থেকে তারা সরে আসেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভস্মাবশেষ থেকে জার্মানি আবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিশালী দেশ হিসেবে উত্থিত হয়েছে। জার্মানি যদি এত বিপদ কাটিয়ে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে তাহলে ভারত পারবে না কেন?
ভারতের দুর্ভাগ্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শক্তি ভারতবাসীকে তাদের অতীত সহস্রাব্দের গৌরবময় ইতিহাসকে তুলে আনবার মত সুযোগ সন্ধানী চেতনা দেয়নি। গত পঞ্চাশ বছরে তাদের ভেতরে ঐতিহাসিক চেতনা কেন্দ্রীভূত করার উল্লেখযোগ্য কোন প্রচেষ্টা করা হয়নি।
হাইস্কুলে ভর্তি হবার পর থেকে গত ৭০ বছর ধরে আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মের মৌলিক শিক্ষা গ্রহণের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এর মাধ্যমে আমি একটা বিষয় বুঝতে পেরেছি যেকোন ধর্মেরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো মানুষের আত্মিক উন্নয়ন সাধন করা।
বস্তুত, আমাদের বুঝতে হবে আমাদের আধ্যাত্মিক চেতনা থেকেই ভারতে ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তি গড়তে হবে। কারণ জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় চেতনা জাগ্রত করা প্রয়োজন। এজন্য ধর্মের সমন্বিত ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ এক একতাবদ্ধ সমাজ গড়তে হবে। আমরা যদি অতীতের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ধারণ না করে ইতিহাসের দিকে না তাকাই, যদি অনিবার্য সাফল্যের বিশ্বাস নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে না তাকাই তাহলে হতাশা, দুঃখ, অভাব আর নৈরাশ্য ছাড়া আমাদের জন্য আর কি অপেক্ষা করতে পারে?
ভারতের মূলসংস্কৃতি সময়কে অতিক্রম করেছে। ইসলামের আবির্ভাবে এ সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মের আগমনে এ সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। কেরালায় বসবাসরত বহু পূর্বে আসা সিরিয়ার খ্রিস্টানরা অত্যন্ত সম্ভ্রমের সংগে ভারতীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে।
তাদের বিবাহিত নারীরা মঙ্গলসূত্র পরার কারণে, তাদের পুরুষেরা কেরালা স্টাইলে ধুতি পরার কারণে কি তাদের খ্রিস্টানত্ত্ব খাটো হয়ে গেছে? কেরালার মুখ্যমন্ত্রী এ.কে, অ্যান্টনি নব্য তান্ত্রিক নন কারণ তিনি এবং তার সম্প্রদায়ের লোকজন এখন কেরালার সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছেন। খ্রিস্টান হওয়ায় তিনি সেখানে ম্লেচ্ছ হয়ে যাননি। বরং এটা তার ভারতীয়ত্বে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ আর রহমান একজন মুসলমান হতে পারেন কিন্তু তিনি যখন গেয়ে ওঠেন বন্দে মাতরম্ তখন তার সে সংগীত ভারতের প্রত্যেকটি মানুষের মনে অনুরণনের সৃষ্টি করে, তা তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন।
কিন্তু আমাদের একতাবদ্ধতার চেতনা ও লক্ষ্য অর্জনের চেতনার ক্ষেত্রে সেই সকল মতাবলম্বীরা সবচে বড় বাধা যারা মানুষের মধ্যে বিভেদ ঘটাতে চায়। প্রত্যেকটি নাগরিককে সমান নিরাপত্তার ছত্রছায়ায় রাখার অঙ্গীকার নিয়ে ভারতের সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এখন ধর্মীয় চেতনার অপব্যবহার করে গণমানুষে বিভাজন তৈরীর যে চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক। কিন্তু কেন আমরা সংস্কৃতিকে (ধর্মকে নয়) আমাদের ঐতিহ্যের খাতিরে ধারণ করে একতাবদ্ধ হচ্ছি না? বিভেদ ভুলে যাবার সময় এখন আমাদের সামনে। এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত কী করে আমরা এক হতে পারব তার উপায় খুঁজে বের করা।
আমাদের গৌরবময় অতীত আমাদের সংগে প্রবহমান। এটি আমাদের শুদ্ধ বিশ্বাসে পরিচর্যা করতে হবে। রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে তা ধ্বংস করলে চলবে না।
উন্নত ভারতের লক্ষ্য শহরে শহরে এ দেশটা ছেয়ে ফেলা নয়। বরং প্রযুক্তিকেন্দ্রীক টেলিমেডিসিন, টেলিএডুকেশন আর ই-কমার্স চালুর মাধ্যমে এ গ্রামগুলোকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসা।
কৃষিবিজ্ঞান ও শিল্পোন্নয়ন এবং জৈবপ্রযুক্তি ও জৈববিজ্ঞানের সমন্বয় থেকে নতুন ভারতের উদ্ভব হবে। সে ভারতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই চেতনা ধারণ করে তাদের কাজ করবে যে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ অনেক বড়। এতে গ্রাম ও শহরের বৈষম্য হ্রাস পাবে। গ্রামে আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তি সুবিধা পৌঁছে গেলে শহরপ্রিয় মানুষও গ্রামের উন্নত দ্রব্য সামগ্রীর জন্য গ্রামের দিকে মনোযোগী হবে।
এই লক্ষ্য অর্জনে এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্বে গঠনমূলক পরিবর্তন আনা এবং উন্নয়নকামী রাজনীতিক তৈরী করা যাদের ভবিষ্যত উন্নয়নের স্বপ্ন রয়েছে। ভারতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের, বিভিন্ন ধর্মের প্রায় ১শ কোটি লোক বাস করে। বিচিত্র ভৌগলিক সমাজ কাঠামো ও বিভিন্ন দর্শনে বিশ্বাসী এখানকার মানুষ। কিন্তু এটা আমাদের জন্য নেতিবাচক নয়। এই বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষেই এক অসাম্প্রদায়িক একতাবদ্ধ ভারত গড়ে তুলতে হবে।
৬. মেধাবী সমাজ
৬. মেধাবী সমাজ
Wisedome is a weapon to ward off destruction; It is an inner fortress which enemies can not destroy.
— Thirukkural 421 (200BC)
প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্বাধুনিক শিক্ষিতদের দেশ। আগ্রাসন ও উপনিবেশের ধ্বংসাত্মক শোষণে সেই ভারতবর্ষের আদি প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। একই সংগে ধ্বংস হয় সম্মিলিত মানুষের বৃহত্তর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এ অঞ্চলের মানুষকে বহু বছর ধরে সুপরিকল্পিতভাবে নিম্নস্তরের সমাজে নামিয়ে আনা হয়েছে। ব্রিটিশদের ভারত ছাড়ার সময় আমাদের তরুণদের মনমানসিকতা এত নিম্নমুখী পর্যায়ে চলে এসেছিল যে দুটো ডালভাত খেয়ে কোন রকমে জীবনযাপন করার চেয়ে বড় কোন আকাঙ্ক্ষাই তারা করতে পারত না।
ভারত ঐতিহাসিকভাবেই আধুনিক জ্ঞানের পীঠস্থান। সেই জ্ঞানের ঐতিহ্য আবার ভারতকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। যেদিন ভারত তার গৌরবময় ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার লাভে সক্ষম হবে সেদিন একটি উন্নত দেশের সার্বভৌমত্ব, উন্নতমানের জীবন ব্যবস্থা অর্জনে ভারতবাসীকে বেশী বেগ পেতে হবে না।
শিক্ষা বা জ্ঞানের হরেক রকম আঙ্গিক, নানা ধরনের আদল রয়েছে। প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি, তথ্য সংগ্রহ, বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান লাভ করে। আমরা জ্ঞানার্জন করি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছ থেকে, লাইব্রেরী থেকে, গবেষণাপত্র থেকে, সেমিনারের আলোচনা থেকে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন ও কর্মক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিক, ব্যবস্থাপক, কর্মচারিদের ড্রইং, প্রসেস শীট থেকে এমনকি দোকানের মেঝে থেকেও জ্ঞান অর্জিত হতে পারে। যদিও জ্ঞান অর্জনের সাধারণ ক্ষেত্র বলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই ভাবা হয়। এর মেধাবী সমাজ পাশাপাশি শিল্পী, ভাষ্কর, হেকিম, বৈদ্য, দার্শনিক, সাধক, কবি– এদের কাছ থেকেও সমানভাবে জ্ঞান আহরণ করে মানুষ। সার্বিক জ্ঞান মানুষকে সর্বোচ্চ কৃতিত্ব প্রদর্শনে সক্ষম করে তোলে।
গ্রন্থাগার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন আমাদের জ্ঞান আহরণের উৎস তেমনি আমাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস, আমাদের প্রত্নতত্ত্ব ও মহাকাব্যও আমাদের কাছে এক একটা বিশাল লাইব্রেরী। আমাদের অজ গ্রামগুলোতেও বহু গোঁড়ামিহীন জ্ঞানের বিষয় রয়েছে। আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ, আমাদের সুবিশাল মহাসাগর, আমাদের মরুভূমি আর বৃক্ষ ও প্রাণীজগতের জীবন প্রণালীর মধ্যে সীমাহীন গুপ্ত জ্ঞানের ঐশ্বর্য রয়ে গেছে। আমাদের দেশের প্রত্যেক রাজ্যেরই নলেজ সোসাইটি বা সুশীল সমজ হিসেবে নিজেদের গড়ার মত অন্তস্থ যোগ্যতা রয়েছে।
উন্নতি ও ক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে চিরকালই জ্ঞান অপরিহার্য অংশ হিসেবে কাজ করছে।
জ্ঞান অথবা শিক্ষার ধর্মই হল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া। পাশাপাশি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে জ্ঞানের আদান-প্রদান চর্চা হয়ে আসছে। এ আদান-প্রদান যে শুধু গুরু-শিষ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে তা নয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আশা শিক্ষার্থীরা ভারতীয় জ্ঞান আত্মস্থ করছে। পরবর্তীতে তারা সে জ্ঞান ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বজুড়ে।
অজস্র প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য আর প্রতিদ্বন্দ্বীতাসক্ষম পরিবেশে ভারত বহু পূর্ব থেকেই বিভূষিত। কিন্তু আমাদের এই সুযোগ সুবিধা আর প্রাকৃতিক সম্পদরাশি অবিন্যস্ত, ছড়ানো ছিটানো। গত শতকে শুধু কায়িক শ্রমনির্ভর কৃষিব্যবস্থা থেকে আধুনিক বিশ্ব শিল্প ভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে যেখানে প্রযুক্তি, আধুনিক ব্যবস্থাপনা এবং শ্রমের সমন্বয় ঘটিয়ে পণ্যের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা হয়।
প্রযুক্তি ভিত্তিক এই কৃষি ব্যবস্থাপনার সামনে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কৃষিপণ্য দাঁড়াতে পারেনি। একুশ শতকে এসে একটি নতুন সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হচ্ছে যেখানে মূলধন এবং শ্রমের পরিবর্তে মেধাকে প্রাথমিক উৎপাদন উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আমাদের মেধাকে সার্বিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এই মেধাই স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উন্নয়নের অন্যান্য সহযোগী বিষয়কে সমৃদ্ধ করবে। মেধাসম্পন্ন শিক্ষা অবকাঠামো সৃষ্টি এবং তা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করলে আমাদের উৎপাদনের পরিমাণও গুণগতমান বাড়বে। উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীতা সক্ষম পণ্য উৎপাদনের কোন বিকল্প রাস্তা নেই। একটি জাতি কতখানি মেধা সৃষ্টি করতে পারছে এবং সেই মেধাকে কাজে লাগাতে পারছে তার ওপর ভিত্তি করেই জাতিটি নলেজ সোসাইটি বা সুশীল সমাজ কীনা তা বিচার করা হয়।
নলেজ সোসাইটির দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এর একটি হলো উন্নত সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং অগ্রসর প্রজন্ম।
উন্নত সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য দরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং প্রশাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। এগুলোর উন্নয়ন ঘটানো গেলেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো ও সর্বোচ্চ উৎপাদন বাড়ানো যাবে। একই সংগে গ্রামোন্নয়ন সম্ভব হবে।
দেশের জন্য অগ্রসর প্রজন্মের প্রধান কাজ দেশের বিক্ষিপ্ত সম্পদকে এ করা। নলেজ সোসাইটি হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য কয়েকটি ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করার প্রস্তাব করেছে টিআইএফএসি। সেগুলো হল তথ্য প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, স্পেস প্রযুক্তি, ওয়েদার ফোরকাস্টিং, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, টেলিমেডিসিন এবং টেলিএডুকেশন। এ সমস্ত ক্ষেত্রগুলো দাঁড়িয়ে গেলে দেশে বহুমুখী প্রযুক্তি এবং যুৎসই ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো তৈরী হবে; এ দুয়ের সম্মিলিত উদ্যোগ আমাদের নলেজ সোসাইটি গঠন করতে সক্ষম হবে।
২০২০ সালের মধ্যে ভারতকে বিশ্বের শক্তিশালী মেধাবী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মিশন হাতে নিতে হবে। যখন ভারত উন্নত সমাজপ্রবর্তন ও মেধাবী প্রজন্ম গঠনের দ্বিমাত্রিক মিশনে সফল হবে তখন নলেজ সুপার পাওয়ার হিসেবে তৃতীয় আরেকটি মাত্রা যোগ হবে। তখন ভারতের মিশন হবে নলেজ প্রোটেকশন বা মেধা সংরক্ষণ এবং এটিই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ মিশন।
আমাদের কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক এবং ইনফরমেশন জেনারেটরকে ইলেক্ট্রনিক বা অনলাইন হামলা থেকে রক্ষা করা চরম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর জন্য প্রয়োজন সার্বক্ষণিক মনিটরিং।
তখন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর কড়া নজর রাখতে হবে। একইভাবে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও জ্ঞানকেও আমাদের সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে।
মনিপাল একাডেমি অব হায়ার এডুকেশনের আয়োজনে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে তারা আমাকে, সবুজ বিপ্লবের জনক সি, সুব্রামানিয়াম ও খ্যাতিমান আইনজীবী এন.এ.পালখিভালাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে নব্বই বছর বয়েসি সুব্রামানিয়ামের সঙ্গে কথা বলেছিলাম তার দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব সম্পর্কে। তিনি একটা জাতীয় কৃষি ফাউন্ডেশন বিষয়ে তার স্বপ্নের কথা মেধাবী সমাজ বলেছিলেন আমাকে, যেখানে উৎপাদন করা হবে হাইব্রিড বীজ। তার ফাউন্ডেশন পৃষ্ঠপোষকতা দেবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের এবং তাদের মৃত্তিকা পরীক্ষার জন্য গবেষণাগারের সুবিধা দেবে আর আবহাওয়া ও বাজার সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করবে। যাতে করে তারা উৎপাদিত ফসলের ভাল মূল্য পায় এবং অধিক পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারে। এই স্কিমের অধীনে দশ লাখ চাষীকে নিয়ে আসার লক্ষ্য তার। স্বপ্নদ্রষ্টারা বুড়ো হন না!
আরেকবার আমি কথা বলছিলাম কৈম্বাটুরের নিকটবর্তী পল্লাচিতে অবস্থিত ড. মহালিঙ্গম কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। মহান শিল্পপতি ও অ্যাকাডেমিসিয়ান ড. এন. মহালিঙ্গম বসে ছিলেন আমার পাশেই। কৃষি, রসায়ন ও টেক্সটাইল শিল্পের মাধ্যমে দেশ কীভাবে সমৃদ্ধশালী হতে পারে সে কথাই তিনি বলছিলেন আমাকে। শিল্পকারখানা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে তার সাফল্যে অভিভূত হয়ে আমি বিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আপনার পরবর্তী মিশন কী? এ কথা বলার পর আমি উপলব্ধি করলাম যে প্রশ্নটা করছি এমন একজনকে যার বয়স প্রায় আশি বছর!
ড. মহালিঙ্গম উত্তর দিলেন, আমি তামিল পান্ডুলিপি বিশ্লেষণ করেছি যা ২৫০০ বছরের পুরনো। এখন আমি ৫০০০ বছর আগের তামিল পান্ডুলিপি নিয়ে গবেষণা করতে চাই! সেবারও আমার মনে হয়েছিল স্বপ্নদ্রষ্টারা বুড়ো হন না।
শিল্পের ক্ষেত্রে, ১৯৬০ সালে, ক্ষুদ্র ও বৃহদায়তন কারখানায় যুক্ত ছিল জনসংখ্যার ১১ শতাংশ। ১৯৯২ সাল পর্যন্তও এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল। যাহোক, এ সংখ্যা ২৫ শতাংশে বৃদ্ধি করতে হবে ২০২০ সালের মধ্যে, এটা মাথায় রেখে যে জিডিপির প্রবৃদ্ধি শ্লথ আর বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর প্রতিযোগিতাও ক্রমবর্ধমান। কর্মসংস্থানের প্যাটার্নও একটা নতুন আকার নেবে। ১৯৬০ সালের ২৫ শতাংশ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্প ও পরিষেবায় নিয়োগ ১৯৯২ সালে বেড়েছে ২৭ শতাংশ। অবকাঠাম রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্র, আটটি খাত ও বিনোদনের চাহিদার দিক থেকে এটা আরও ৫০ শতাংশ বাড়বে। এসব বৃহৎ পরিবর্তনের ফলে প্রয়োজন হবে আরও অধিক প্রশিক্ষিত জনবল। বাণিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রে আমাদের নেতৃস্থানীয়দের প্রস্তুত হতে হবে এই রূপান্তরের জন্য।
গ্রাম থেকে শহরে আগমনের হার থেকে এ দুয়ের জীবনমান সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হয়। আদর্শিকভাবে গ্রামীণ ও শহুরে এলাকাই হতে হবে আকর্ষণীয় যাতে গ্রাম ছেড়ে শহরে আগমনের হেতু কমে। এই আগমন শূন্যের কোঠায় নেমে এলে তা হবে উন্নয়নের চিহ্ন। আমরা সুখময় সেই ভারসাম্য কীভাবে অর্জন করতে পারি? পল্লীর উন্নয়নই এর একমাত্র সমাধান। তার মানে হল জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় সব কিছু গ্রামাঞ্চলেও সুলভ করা যা এখন কেবল শহরেই পাওয়া যায়। এতে একই মাত্রায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, এবং শহরাঞ্চলের মত একই পর্যায়ে। আরেকটা চ্যালেঞ্জ হল এসব সুবিধা দিতে হবে আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রতিবেশিক খরচের ক্ষুদ্র একটা অংশ দিয়ে যা বহন করবে শহরগুলোই।
প্রত্যাশাটা হল পরিবেশের কথা মাথায় রেখে কর্মসংস্থান বিস্তৃত করার এই সমন্বয় পল্লী অঞ্চলকেও আকর্ষণীয় করে তুলবে শহরাঞ্চলের মতই, যদি না তা শহরের চেয়েও আকর্ষণীয় হয়। তারপর, পল্লী উন্নয়ন থেকে প্রত্যাশা করা যেতে পারে যে এতে শহরে আগমন বন্ধ হয়ে যাবে। এইভাবে পিইউআরএর লক্ষ্য হল ফলিত পদার্থবিদ্যাগত এবং ইলেক্ট্রনিক জ্ঞান ও অর্থনৈতিক সমন্বয়।
ভারতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে প্রতিবন্ধীরা অকিঞ্চিৎকর সমন্বয় ও ছোটখাটো বিষয়ে ভোগে। একটা রিংরোড আর উঁচু মানসম্পন্ন পরিবহন একগুচ্ছ গ্রামকে একসূত্রে গাঁথতে পারে। এভাবে সংযুক্ত গ্রামগুলো বিভিন্ন পরিষেবার সাহায্য প্রদানে একটা বড় বাজার সৃষ্টি করবে, কিন্তু এককভাবে তা সম্ভব নয়। রিংরোড আর পরিবহন একত্রে অবিলম্বে গ্রামগুলোকে একটা ভার্চুয়াল শহরে পরিণত করবে, যা হবে হাজার হাজার মানুষের একটা বাজার। এমন একটা অঞ্চল, যেখানে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও থাকবে, দ্রুত প্রবৃদ্ধির বিস্তর সম্ভাবনা ধারণ করবে- অধিক মানুষের মধ্যে যোগাযোগ থাকার ফলে অধিকহারে বিনিয়োগের আকর্ষণও তৈরি হবে, আবার অধিক বিনিয়োগে আকর্ষিত হবে অধিক সংখ্যক মানুষ ইত্যাদি। মূলত, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে একগুচ্ছ গ্রামের একটা বলয় বিনির্মাণ করা। উঁচু মানসম্পন্ন পরিবহন ও টেলিযোগাযোগ পদ্ধতি গড়ে ভোলার মাধ্যমে ওই বলয়ে গ্রামগুলোকে যুক্ত করা। আর বলয়ের মধ্যে অবস্থিত এলাকার স্কুল, হাসপাতাল ও অন্যান্য সামাজিক পরিষেবায় প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞদের আগমনে উৎসাহিত করা। এছাড়া ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসা।
এই মডেলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পল্লী অঞ্চলে উন্নত জীবন মানের একটা নকশা, আর এতে বিশেষ পরামর্শও রয়েছে শহরের জনসংখ্যার আধিক্য হ্রাসেরও। স্বাভাবিক ভাবেই এটি আমাদের সবচেয়ে উদ্বেগজনক শহুরে সমস্যা। পানি সরবরাহ আর পয়ঃনিষ্কাশন জরুরি নাগরিক চাহিদার অন্যতম। একটা ন্যূনতম আকৃতির নিচে কোথাও বসতি দৃশ্যগ্রাহ্য হয় না, আবার বিদ্যমান ভিড়াক্রান্ত শহরের সঙ্গে তুলনীয়ও নয়। একই সঙ্গে, বিদ্যমান ভিড়াক্রান্ত শহর অর্থনৈতিকভাবে নতুন একটা শহরের সঙ্গে তুলনীয় হয় না যার ন্যূনতম আকৃতি সম্প্রসারণের সীমারেখা অতিক্রম করে গেছে। এখানে হিসেবটা হচ্ছে-~~ প্রচলিত শহরের আয়তন ১০ থেকে ৬ কিলোমিটার আর আকৃতি চতুষ্কোণ, অন্যদিকে মডেলটার আকার বলয়ের মত যার মধ্যে থাকবে অন্তত আট থেকে দশটা গ্রাম, মেধাবী সমাজ আয়তন হবে ৬০ বর্গ কিলোমিটার। এতে দরকার হবে মাত্র একটা পরিবহন পথ, যা চতুষ্কোণ আকৃতির শহরের তুলনায় অর্ধেক। এতে জংশন থাকবে না, শহরাঞ্চলের আটটির বিপরীতে এতে থাকবে একটিমাত্র রুট, সুতরাং লোকজনকে একটা লাইন পরিবর্তন করে আরেক লাইনে যেতে হবে না। তাতে পরিবহনের সময় বাঁচবে। অধিকন্তু, যেহেতু সমস্ত ট্রাফিক যুক্ত থাকবে একটি মাত্র রুটে, অতি দক্ষ ব্যাপক পরিবহন পদ্ধতিও হবে সাশ্রয়ী। ফলে জনগণের খরচ কমবে।
ভারতকে জ্ঞানের পরাশক্তিতে রূপান্তরের জন্য পল্লী উন্নয়ন অপরিহার্য। নির্দিষ্ট এলাকায় উন্নয়নের রোডম্যাপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং আমাদের এ নিয়ে কাজ করতে হবে।
টাটা গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান মি. রতন টাটা নেমন্তন্ন করেছিলেন। পুনের টেলকো পরিদর্শনের। বিশেষ করে পুরোপুরি ভারতীয় একটি গাড়ি ইন্ডিকার ডিজাইন, উন্নয়ন ও তৈরির চ্যালেঞ্জ দেখার জন্য। পরিদর্শনের সূচি আমাকে পুলকিত করে। আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবো বলে ভাবলাম যা অনেক জায়গায় আমি জিজ্ঞাসা করেছি এর আগে।
১৯৮০ সালে আইএসআরওতে আমাদের টিম উৎক্ষেপণ করে স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেইকল আর রোহিনীকে স্থাপন করে কক্ষপথে। জাতির জন্য সেটা ছিল বিশাল ঘটনা। ৪ জানুয়ারি ২০০১ সালে আমি প্রথমবারের মত দেখি প্রটোটাইপ ফাইটার এয়ারক্র্যাফট– লাইট কমব্যাট এয়ারক্র্যাফট (এলসিও)। এর ডিজাইন ও উৎপাদন করেছিল অ্যারোনটিকাল ডেভলপমেন্ট এজেন্সি (এডিএ)।
যানবাহন উৎপাদন খাতে ভারতকে বিশ্বের অন্যতম দেশ হিসেবে গড়ে তোলার তার স্বপ্নের কথা বললেন রতন টাটা আমাকে সেই পরিদর্শনের সময়। তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বিভিন্ন দেশ থেকে গাড়ি তৈরির ইউনিট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন টাটা। বর্তমানের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি উৎপাদনের দিকেই নজর দিয়েছিলেন তিনি, যাতে তা বিশ্বব্যাপি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম হয়। এটা সুন্দর একটা আইডিয়া। আমি আরেকটু যোগ করব যে, প্রথম ধাপ হিসেবে ভারতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিৎ একটা কনসরশিয়ায় রূপান্তরিত হওয়া, তারপর তা বহুজাতিক কোম্পানি হয়ে উঠতে পারে।
আমি যেসব জাতীয় কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করেছি সেগুলোর অভিজ্ঞতা শুনতে আমাকে ও আমার টিমকে একগুচ্ছ বৈজ্ঞানিক, শিল্প, শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান দাওয়াত করত। মুম্বাইতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপকালে আমাকে একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল যা আমার কানে বাজে আজও।
ড. কালাম, ভারত নিজের এসএলভি ও স্যাটেলাইট নিজেই নির্মাণ ও উৎপাদন করতে পারে দেখে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। তাছাড়া কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক অস্ত্র ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে পারে দেখেও আমরা আনন্দিত। আপনি কি আমাকে বলতে পারেন, ভারত কবে নিজের ইঞ্জিনযুক্ত যাত্রীবাহী বগি তৈরি আর উৎপাদন করতে পারবে? যখন আমি টেলকোতে পরিদর্শন করি আর আমাকে বলা হয় যে এ কোম্পানি বার্ষিক প্রায় ৬০ হাজার গাড়ি তৈরি করছে, তখন আমার ওই প্রশ্নটা আবার মনে পড়েছিল। শুধু যে প্রশ্নটার উত্তর প্রত্যক্ষ করছিলাম তাই নয়, বরং আমাদের দেশের প্রযুক্তিগত শক্তির ছবিটাও দেখতে পাচ্ছিলাম।
একটা ধারণার বাস্তব আকার গ্রহণ দেখার একটা সুযোগও আমি পেয়েছিলাম উইপরোর আমন্ত্রণে ব্যাঙ্গাললারে একটা ভ্রাম্যমাণ হার্ট কেয়ার ক্লিনিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে। সেটা ২০০০ সালের অক্টোবর মাসের কথা। এটা ছিল উইপরো-জিই, কেয়ার ফাউন্ডেশন ও ক্লেইনজেইডস-এর একটা সহযোগিতামূলক উদ্যোগ। আমার বন্ধু অরুণ তিওয়ারী এবং আমি এই প্রকল্পের ধারণাটা প্রথম চিন্তা করেছিলাম। উদ্বোধন শেষে আমি উইপরো-জিই সেন্টার পরিদর্শন করি–
অগ্রসর প্রযুক্তির সাহায্যে তারা তৈরি করে বিশেষায়িত চিকিৎসা সরঞ্জাম। আমি প্রবেশ করা মাত্রই এক তরুণ এগিয়ে এল আর আমার শার্টে পিন দিয়ে জাতীয় পতাকা এঁটে দিল। আমি করমর্দন করে তাকে বললাম, ওহে তরুণ, তুমি কী এই দেশের জন্য থাকবে আর কাজ করবে? . সে উত্তর দিল, ড, কালাম, ডায়াগনসিসের কাজে ব্যবহৃত চিকিৎসা
সরঞ্জামের ওপর কাজ করছি আমি। ওটাই আমার পেশা। আমি এমন এক পেশার সঙ্গে অঙ্গীকারবদ্ধ যেখানে বেদনা প্রশমনের চেষ্টা করা হয়। আমার প্রয়োজন এখানেই। আমি তার উত্তরে উৎফুল্ল হলাম।
অনুষ্ঠানের শেষে উইপনোর প্রধান আজিম প্রেমজী আমার সঙ্গে ডিআরডিওর অতিথিশালায় এলেন। আসার পথে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, কর্নাটকের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সহযোগিতার জন্য তিনি কীরকম চেষ্টা করেছেন যাতে আরও অধিক বাচ্চা ছেলেমেয়েদের শ্রেণীকক্ষে নিয়ে আসা যায়।
অতিথিশালায় চা পান করার সময় তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যবসাজগতে উইপরো সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছল কীভাবে?
প্রেমজী স্মরণীয় উত্তর দিলেন, ড. কালাম, তিনটি বিষয় আমার মাথায় ছিল। এক : প্রজন্মের ঘাম আর টিমের কঠোর শ্রম। দুই : উইপরোতে আমরা কাজ করি ক্রেতার আনন্দের জন্য। তিন : ভাগ্য। প্রথম দুটি অর্জিত না হলে তৃতীয়টির অস্তিত্ব থাকত না।
এসব প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা একটি সুতোয় মিলে যায়। তাহল, আমরা উচ্চ প্রযুক্তি প্রচলন করতে সমর্থ। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের উপস্থিতি, মেধাবী সমাজ নেটওয়ার্কের সামর্থ আর তারুণ্যের দীপ্তিমান হৃদয় : একটা জ্ঞানের সমাজ বিনির্মাণে এসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
যোগসূত্র মহাঋষি পতঞ্জলি বলেছেন, তুমি যখন কোনও মহৎ উদ্দেশ্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত, তখন তোমার সব ভাবনার বাধ ভেঙে যায় : তোমার মন সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যায়, সবদিকে প্রসারিত হয় তোমার চেতনা, আর তুমি নিজেকে খুঁজে পাও এক নতুন, বিশাল বিস্ময়কর বিশ্বে। ধীশক্তি আর প্রতিভা জীবন্ত হয়ে ওঠে, এবং তুমি স্বপ্নে নিজেকে যতটা বড় বলে ভাব তার চেয়েও বেশি বড় দেখতে পাও নিজেকে।
আমাদের সবার জন্যই এই বাণী। জনগণই একটা দেশকে মহান করে তোলে। তাদের চেষ্টার দ্বারা জনগণ নাগরিকে পরিণত হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ দীপ্তিমান হৃদয়, আর আমাদের জাতির এক বিলিয়ন হৃদয় অবশ্যই এক বিশাল শক্তি– যা ঝংকৃত হওয়ার অপেক্ষায়।
৭. শক্তিগুলো এক হচ্ছে
৭. শক্তিগুলো এক হচ্ছে
Determine the things can and shall be done, and then we shall find the way.
— Abraham Lincoln
যখন আমাদের জ্ঞানলব্ধ অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে তখন দেশ দ্রুত প্রগতির পথে ত্বরান্বিত হবে; যেখানে থাকবে উচ্চশিক্ষিত প্রশাসকমণ্ডলী; আর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে রাজনীতিকদের ন্যূনতম উদার হস্তক্ষেপ।
আমার বিবেচনায় উন্নয়ন হলো একটি নিরাপত্তামূলক বিষয় যা দারিদ্র্য থেকে নিরাপত্তা দেবে। খাদ্য সংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়, সামাজিক নিরাপত্তা দেয় এবং সর্বোপরি যা জাতীয় প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে।
২০২০ সালের মধ্যে উন্নত ভারত গঠনে ৫টি ক্ষেত্রকে আমরা আমাদের প্রধান কর্মলক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছি।
পাঁচটির মধ্যে আমরা কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর জোর দিয়েছি যার আওতায় বছরে ৩৬০ মিলিয়ন টন খাদ্য ও কৃষিজাত পন্য উৎপাদনের টার্গেট হাতে নেওয়া হয়েছে। কৃষি এবং কৃষি নির্ভর খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রকল্প গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন সাধন করবে যা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখবে।
দ্বিতীয় সংস্কার ক্ষেত্র হল বিদ্যুৎ। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সারাদেশে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা চালু অবশ্য জরুরী।
আমাদের তৃতীয় সংস্কারমূলক ক্ষেত্র হল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা। আমরা গবেষণা করে দেখেছি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, কেরালার মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক শিক্ষিত ও স্বাস্থ্য সচেতন, যে কারণে সে এলাকায় জন্মহার কমে এসেছে এবং সেখানকার মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। ঠিক একইভাবে তামিল নাড়তেও জন্মহার অনেক কমে এসেছে যার প্রধান কারণ হিসেবে শিক্ষাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্ধ্র প্রদেশেও শিক্ষার প্রসার ঘটায় সেখানকার জনসং রি কমেছে। জীবন যাত্রার মান আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। এই সমস্ত রাজ্যগুলোর শিক্ষা প্রবণতা বিহার ও উত্তর প্রদেশের এলাকাগুলোতে সম্প্রসারিত করা দরকার, কারণ বিহার ও উত্তর প্রদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখনও অনেক বেশী।
আমাদের চতুর্থ পরিকল্পনাধীন সংস্কার ক্ষেত্র হলো তথ্য প্রযুক্তি। দ্রুত শিক্ষা বিস্তার ও উন্নত জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্য পূরণে তথ্য প্রযুক্তি ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও পশ্চাৎপদ এলাকাগুলোকে দ্রুত আধুনিকায়নের আওতায় আনতে তথ্য প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করতেই হবে।
আমাদের পঞ্চম লক্ষ্য কৌশলগত ক্ষেত্রের উন্নয়ন। এক্ষেত্রে অবশ্য আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছি। পরমাণু, স্পেস এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রযাত্রা আশাব্যঞ্জক।
এই পাঁচটি ক্ষেত্রে আমাদের সমন্বিত অগ্রযাত্রা আমাদের খাদ্য, অর্থনীতি, সামাজিক ও জাতীয় প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সর্বস্তরের মানুষের সংগে সরকারী অধিদপ্তর ও পরিশক প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতামূলক বন্ধন তৈরী করা দরকার। সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবেই এই পারস্পরিক যোগাযোগ দরকার। ছোট পরিবার ও অধিক কর্মশক্তির নিশ্চয়তা বিধানের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এটা কর্মসংস্থান ও সামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ কৃষি ক্ষেত্রের উন্নয়ন খাদ্যসংস্থাপনের নিরাপত্তা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রের অগ্রগতি দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ শক্তি উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। শিল্প কারখানা ও কারিগরি উন্নয়নের পেছনে প্রকৌশলগত ও কারিগরি সহায়তা ব্যবস্থা জরুরী। মোটকথা একটি ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য এই পাঁচটি ক্ষেত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি এই পাঁচ ক্ষেত্রের একটি সমন্বিত সংস্কার করা সম্ভব হয় তাহলে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী ৩০ থেকে ৪০ কোটি লোকের জীবনযাপনের মানে অভাবনীয়ভাবে উন্নতি আসবে।
আমি টিফাক (টিআইএফসি) টিমের সংগে একটা তিন বছর কৃষি, আধুনিক শিক্ষা এবং গ্রামীণ সংযোগ ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে কাজ করেছি। একাজ করতে গিয়ে আমি চিনি, ফ্লাইঅ্যাশ এবং সুতা উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমার বিগত অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করেছি। বিখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী এস কে সিনহার নেতৃত্বে টিফাঁক মধ্য বিহার ও পূর্ব ভারতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। ১৯৯৮ সালের খরিফ ঋতুতে একটি রাজ্যের ৬টি ও অন্য রাজ্যের ৯টি গ্রাম এ প্রকল্পের অধীনে আনা হয়। প্রকল্পের বিজ্ঞান পদ্ধতিতে জমির মাটি পরীক্ষা, বীজ নির্ধারণ, চাষের মৌসুম, সার নির্ধারণ এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা হয়।
সে বছর বিজ্ঞানী ও স্থানীয় কৃষকদের পারস্পরিক সহযোগীতায় প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদন আড়াই টন থেকে ৫ টনে উন্নীত হয়েছিল। সে বছর আমি এবং আমার বন্ধু ওয়াই এস রাজন সেখানকার কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখেছি কৃষকরা দ্রুত ফসল কাটার যন্ত্রপাতি, গুদামজাতকরণ ব্যবস্থাপনা, বাজারজাতকরণ এবং ব্যাংক লোন সংগ্রহের বিষয়ে অনেক আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ওই প্রকল্পের কাজে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, কৃষকরা যদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে দলীয় পদ্ধতিতে চাষ করে তাহলে উৎপাদনের খরচ এবং সময় দুইই বাঁচে।
আরেকটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প বর্তমানে চালু রয়েছে। সেটির নাম রিচ (আরইএসিএইচ-রিলেভেন্স অ্যান্ড এক্সিলেন্স অব অ্যাচিভিং নিউ হাইটস্ ইন এডুকেশন ইনস্টিটিউশনস্)। এ প্রকল্পে ৮০ থেকে ১০০টি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সেন্টারগুলো সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠক্রম অনুসরণ করছে এবং সর্বোচ্চ সফলতা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজ করছে। এ লক্ষ্য অর্জনে সেন্টারগুলো সম্মিলিতভাবে কাজ করছে, একে অন্যের সংগে মতামত আদান প্রদান করছে এবং প্রয়োজনে সম্মিলিত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে পাতিয়ালা, ডিব্ৰুগড়, মুম্বাই, থানজাবুর এবং সুরাটের শিল্পভিত্তিক জৈব প্রযুক্তি, আধুনিক কম্পিউটিং ও ইনফরমেশন প্রসেসিং, পেট্রোলিয়াম মজুদকরণ কারখানার নিরাপত্তা, এনভায়রোনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ কারখানার আশেপাশে গড়ে উঠছে কোর (সিওআরই–সেন্টারস্ অব রিলেভেন্স অ্যান্ড এক্সিলেন্স)।
কৃষি বিষয়ক রিচ প্রকল্পের সাফল্য দেখে উৎপাদন ও শিল্প বিষয়ক কোর প্রোগ্রামে শিল্প-কারখানাগুলো যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন কিন্তু আশে পাশের এলাকার শিল্প-কারখানার মালিকরা তাদের এলাকায় কোর প্রতিষ্ঠার মোট খরচের ৪০ শতাংশ স্বেচ্ছায় ব্যয় করতে চাইছে। কোর প্রতিষ্ঠিত হলে এর বিনিময়ে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে দক্ষ জনশক্তি পাবে, অন্যদিকে গবেষণাগারে সর্বাধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তিও তাদের কাজে লাগাতে পারবে। প্রযুক্তি উন্নয়ন ও শিক্ষাক্ষেত্রে শিল্পপতিদের অংশীদারী হবার আগ্রহে আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে। সমন্বিত শিক্ষা পদ্ধতির নেতৃস্থানে প্রধান বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে ড. এম. এস. বিজয় রাঘবনকে পাওয়ায় আমরা আরও বেশী আশাবাদী হয়েছি। তার অভিনব আইডিয়া এই শিক্ষা প্রকল্পের প্রতি সবার প্রতিশ্রুতিশীল মানসিকতা গড়তে সহায়তা করেছে।
আরেকটি গ্রাম ভিত্তিক সহযোগীতামূলক প্রকল্পের উদাহরণ গড়ে উঠেছে মাদ্রাজের আইআইটির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক পি.ভি. ইন্দিরেসানকে ঘিরে। পূর্বোল্লেখিত আধুনিক ব্যবস্থাপনায় গ্রামে শহরের আধুনিক সুবিধা সৃষ্টি করে আরও বেশী কর্মসংস্থানের সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের ব্যাবধান কমানোর জন্য তার প্রোগ্রাম কাজ করে যাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে তার প্রোগ্রামের মডেল অনুযায়ী অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হবে না। ক্রমশ গ্রামগুলো আরও উন্নত হয়ে উঠবে। বর্তমানে গ্রামগুলোকে পারস্পরিক সহযোগীতায় এগিয়ে আসার মাধ্যম হিসেবে বহু প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং গ্রামগুলোর মধ্যে সার্বিক যোগযোগের দূরত্ব কমে আসছে।
গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে আমরা পুরা নামের একটি প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। গ্রামগুলোর মধ্যে বহুমুখী সংযোগ ব্যবস্থা চালুর জন্য আমরা চারটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছি। সেগুলো হল : পদার্থ বিদ্যা, ইলেক্ট্রনিক্স, অর্থনীতি ও সমন্বিত শিক্ষা। এক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় বিষয় হলো তথ্যপ্রযুক্তি পরিচালিত টেলিমেডিসিন।
গত বছর মে মাসে আমি হায়দ্রাবাদের কেয়ার হাসাপাতাল পরিদর্শন। করেছিলাম। টেলিমেডিসিন সিস্টেমের উদ্বোধনী দিন উপলক্ষ্যে হাসপাতালের হল রুমে সেদিন ডাক্তার, কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞদের মিলন মেলা বসেছিল। টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে বহু দূরের রোগীকে পরীক্ষা করার ও ব্যবস্থাপত্র দেবার আয়োজন চলছিল। এ পদ্ধতিতে পাকস্থলির জটিলতা বিষয়ক কোন রোগীকে ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাফী যন্ত্রের নিচে শুইয়ে দেওয়া হবে। মজার ব্যাপার হল রোগী থাকবে বহু দূরে কিন্তু হায়দ্রাবাদে বসেই তার রোগ ডায়াগনোসিস করা হবে ইলেক্ট্রোমেডিসিন পদ্ধতিতে। ডাক্তার ও রোগী স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কথোপকথন করবে। হাই রেজুলেশন ইমেজ ট্রান্সফারের মাধ্যমে ইসিজি ডাটা এবং ক্লিনিক্যাল ইনফরমেশন সঠিক সময়ে পাঠানো সম্ভব হয়।
আমি মনিটরে বহুদূরের একটি হাসপাতালের কোন এক রোগীর পাকস্থলি ও হৎপিন্ডের জীবন্ত ছবি দেখলাম। দেখলাম দূরবর্তী সেই হাসপাতালের রোগীর চিকিৎসক ও হায়দ্রাবাদের বিশেষজ্ঞরা কীভাবে রোগীর সংকট নিয়ে আলোচনা করছেন। যেসব শহরে উন্নত চিকিৎসার ও বিশেষজ্ঞদের অভাব রয়েছে তাদের সেবা দানের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি আশাবহ পদ্ধতি। টেলিমেডিসিন পদ্ধতি অজ গ্রামেও আধুনিক চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে পারে এবং গ্রামের প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে আঞ্চলিক হাসপাতাল এবং জেলা হাসপাতালের সংগে রাজধানীর সর্বোন্নত হাসপাতালের যোগাযোগ স্থাপন করে দিতে পারে। আধুনিক স্যাটেলাইট কম্যুনিকেশন এবং তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে, প্রকৌশল বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সম্মিলন ঘটিয়ে কয়েকশ মাইল দূরের একজন রোগীকে কীভাবে চিকিৎসা করা হচ্ছে- এটা দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।
এক বন্ধুর পরামর্শ অনুযায়ী আমার চোখ পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য ১৯৯০ সালে মাদুরাইয়ে অবস্থিত অরবিন্দ চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে দেখি অসংখ্য চোখের রোগী ভর্তি হবার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ লম্বা লাইন। কিন্তু লাইন লম্বা হলেও দ্রুতগতিতে তা শেষ হচ্ছিল এবং ওই লাইনে দাঁড়িয়ে আধঘণ্টার মধ্যেই ড. জি. নাচিয়ারের সাক্ষাত পেলাম। তিনি হাসপাতালে ভর্তির জন্য সুপারিশ করলেন। হাসপাতালের ভর্তি ফি দিতে গিয়ে এক বিপত্তি বাধল। আমি কাউন্টারে চেক দিতেই ক্যাশ কাউন্টারে বসা মেয়েটি তা গ্রহণে অস্বীকার করলো। বললো চেক তাদের সেখানে গ্রহণযোগ্য নয়, অথচ আমার কাছে তখন নগদ টাকা নেই। আমি আবার ডা. নাচিয়ারের কাছে ফিরে এলাম এবং আমার সমস্যা তার কাছে খুলে বললাম। ভদ্রমহিলা সহজেই আমার সমস্যা বুঝতে পারলেন এবং আমাকে ভর্তি করতে রাজী হলেন। কয়েকদিনের চিকিৎসা শেষে আমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হল। এর কদিন পরে ডা. নাচিয়ারের কাছ থেকে একটি চিঠি পেলাম। ভদ্রমহিলা আমাকে চিনতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। হাসপাতাল ছাড়ার দিন আমার নিরাপত্তা কর্মীরা হাসপাতালে আমার খোঁজ করতে যাওয়ার পর তিনি আমার সম্পর্কে জানতে পারেন।
প্রথম ভিজিট করার পরে আমি অরবিন্দ হাসপাতালে আরও বেশ কয়েকবার গেছি। আমার চিকিৎসক ডা. নাচিয়ারের ভাই ডা. জি ভেঙ্কটস্বামী ওই হাসপাতালে কর্মরত। তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। মাদুরাইয়ে গেলে প্রতিবারই ভেঙ্কটস্বামীর সংগে দেখা করি।
এবার ভেঙ্কটস্বামী ও তার কাজ সম্পর্কে একটু বলি। ২০০১ সালে অরবিন্দ হাসপাতালে শুধু বহিরাগত রোগীর সংখ্যাই ছিল ১৩ লাখ। ওই হাসপাতালের পক্ষ থেকে সে বছর ১৫শ চক্ষু ক্যাম্প করা হয় এবং প্রায় ১১ হাজার চক্ষু অপারেশন করা হয়। এ কৃতিত্বের স্বীকৃতি বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ইতিমধ্যেই তাকে দিয়েছে।
বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিখ্যাত বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এ হাসপাতালে প্রশিক্ষণ নেবার জন্য আসছে।
ডা. ভেঙ্কটস্বামীর হাত দুটি স্বাভাবিক না থাকলেও তিনি অস্ত্রোপচারে অপ্রতিদ্বন্দী অবস্থানে চলে এসেছেন। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় তার হাতের কয়েকটি আঙুল আথ্রাইটিসে আক্রান্ত হয়ে শুকিয়ে কুঁকড়ে যায়।
একদিন আলোচনার সময় তিনি জানালেন, একদিন দিল্লি থেকে একজন শিল্পপতি ভেঙ্কটস্বামীর কাছে এসে বললেন, আমি দিল্লিতে নতুন একটি হাসপাতাল বানাতে চাই। আপনার হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনি কি আমাকে এই নতুন হাসপাতাল তৈরীতে সহায়তা করবেন? ডা, ভেঙ্কটস্বামী তাকে বললেন, আপনার অগাধ অর্থ রয়েছে। ইচ্ছে করলে এখনই তো কাজ শুরু করতে পারেন। কেন করছেন না? শিল্পপতি বললেন, না, আমি ঠিক এই অরবিন্দ হাসপাতালের মডেলে হাসপাতালটি করতে চাই। এখানকার লোকজন, চিকিৎসকরা অত্যন্ত আন্তরিক। তারা অর্থের চেয়ে মানুষকে বেশী সম্মান করে বলেই আমার মনে হয়েছে। আমি নতুন হাসপাতালে এখানকার আবহ প্রতিস্থাপন করতে চাই।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়ও তাই মনে হয়েছে। অরবিন্দ হাসপাতালে থাকাকালীন আমি দেখেছি সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সেখানকার চিকিৎসকরা কীভাবে আন্তরিকতার সংগে প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে।
চিকিৎসাবিদ্যার পাশাপাশি কৃষির মত আরও অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সমন্বিত প্রয়োগ আমরা অদূর ভবিষ্যতেই দেখতে পাব। কিন্তু সমস্ত কর্মপরিকল্পনার পূর্বশর্ত হতে হবে জনকল্যাণ ও তাদের অভাব মেটানো।
সমৃদ্ধ প্রজন্ম এবং সমৃদ্ধ নিরাপত্তা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ–এই বিবেচনাবোধ ধারণ করতে পারলেই আমরা উন্নত ভারতের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বুঝতে পারবো। জনগণের শ্রম ও ঘামের সাফল্যের প্রতিনিধিত্ব করে সে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
ভারতের ১৩ জন বৈষ্ণব কবির অন্যতম তামিল মহিলা কবি আন্দাল তার তিরুপ্লাভাই কবিতায় ঈশ্বরের প্রতি আহ্বান করেছেন ঈশ্বর যেন এ ধরীত্রীতে নিনগাথা সেলভাম (সম্পদের বৃষ্টি) বর্ষণ করেন। তার এ সম্পদের বর্ষণ হতে পারে শুধুমাত্র সবাই একত্রিত হয়ে উন্নতির ক্ষেত্রে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আলাদা আলাদাভাবে তাদের স্ব স্ব মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনার অনুমোদন করছে। তা না করে যদি কয়েকটি মন্ত্রনালয় একত্রিত হয়ে বহুমুখী পরিকল্পনা অনুমোদন করে তাহলে তার ফলাফলও হবে বহুমুখী। আরও শক্তিগুলো এক হচ্ছে বেশী মানুষ বেশী সেবা পাবে। এজন্য দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা। ঠিক একইভাবে অন্যান্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও যৌথ উদ্যোগের প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। যৌথ ও সমন্বিত উপায়ে ভারতের সর্বস্তরের উন্নয়ন কাজ ত্বরান্বিত হলে ভারত দ্রুত উন্নত বিশ্বের সারিতে চলে আসবে।
উন্নত দেশের আরেকটি প্রধান উপজীব্য হল সে দেশের শিল্পকারখানা গুলোকে বিশ্ববাজারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সক্ষম হতে হবে। শুধু দেশের বাজারে প্রাধান্য বিস্তারের চিন্তা মাথায় রাখলে হবে না। বিশ্ববাজারের কথা চিন্তা করে এদেশের শিল্প কারখানাগুলোকে দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করতে হবে।
জিডিপির ক্ষেত্রে এই রফতানীযোগ্য পণ্যের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। উন্নয়নের জন্য ভারতের এটা অতি অবশ্য জরুরী হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতকে প্রমাণ করতে হবে যে উন্নত দেশগুলোর মত পণ্য উৎপাদনে অভিনবত্ব আনার সক্ষমতা তার রয়েছে। এতে স্থানীয়ভাবেই আমরা বহুজাতিক পণ্য উৎপাদনে সক্ষম হব।
সত্যিকার উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য আরেকটি জিনিস দরকার। সেটি হল বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ভাষা ও শিক্ষা অর্জনের সক্ষমতা। এটি উন্নয়নের জন্য একটি মৌলিক চাহিদার পর্যায়ে চলে এসেছে। শিক্ষার মাধ্যমে একটি বিপুল শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরী করতে হবে যারা বিশ্ববাজারের সর্বশেষ প্রযুক্তি ও সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে পারে।
বর্তমানে দুঃখজনক হলেও সত্য ভারতে শিক্ষাক্ষেত্রে এখনও ব্যাপক ফারাক রয়ে গেছে। বহু শিক্ষার্থী আছে যারা উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করতে চায় কিন্তু সে অনুযায়ী এদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একেবারেই কম। এজন্য সুদক্ষ জনশক্তি এদেশের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তথ্য প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, পরিবেশ প্রকৌশলবিদ্যা এবং প্রস্তুতকরণ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতে উচ্চশিক্ষার মান আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। মুক্ত অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ শিক্ষার ক্রমাগ্রগতি মোটেও প্রতুল নয়। আরও উন্নত সমাজ ও শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে আরও শক্তিশালী ও উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়া দরকার।
যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে তারা নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানকে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তবে এসব কাজ হতে হবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে। মিশন মুড নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন এগিয়ে না আসলে সামগ্রিকভাবে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
২০০০ সালের ১৫ অক্টোবর পোন গ্রুপের বন্ধুরা আমার জন্য একটি ওয়েব সাইটের ডিজাইন করেছিল। IISc.র অধ্যাপক বলকৃষ্ণর উপস্থিতিতে পোন গ্রুপের চেয়ারম্যান এন.আর, নারায়ণমূর্তি ওই ওয়েবসাইটের উদ্বোধন করেন। আমার কয়েকজন বন্ধু ওই ওয়েবসাইটে আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন জুড়ে দিতে বলেন। সাইটে আমার তিনটি প্রশ্ন ছিল। প্রথম প্রশ্ন হল, পঞ্চাশ বছর ধরে ভারত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত। তোমরা যারা তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থী তারা উন্নত ভারত গঠনে কী কী করণীয় আছে বলে মনে করছ? দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, কখন, কবে আমি ভারতের জয়গান গাইতে পারব? তৃতীয় প্রশ্নটি ছিল, বিশ্বের অন্য দেশগুলো যেখানে তাদের তৈরী পণ্যের প্রশংসা করছে সেখানে আমরা কেন বিদেশের সবকিছু পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি? আমার ওয়েব সাইটে আমি উল্লেখ করেছি উত্তরদাতাদের বয়স হতে হবে ২০ বছরের নিচে। কয়েকদিনের মধ্যে দেশের ও দেশের বাইরে থেকে শতাধিক উত্তর ও পরামর্শ পাওয়া গেল। এদের মধ্যে পাঁচটি উত্তর আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে।
চন্ডিগড়ের এক তরুণ তার উত্তরে লিখেছে, আমি বড় হয়ে একজন শিক্ষক হতে চাই (বিশেষ করে প্রকৌশলবিদ্যার অধ্যাপক হতে চাই), কারণ শিক্ষকতার বিষয়টি আমার কাছে উপভোগ্য এবং আমি বিশ্বাস করি জাতির সর্বোচ্চ সেবা করার দুটি মাধ্যম রয়েছে। হয় শিক্ষকতা নয়তো সেনাবাহিনীতে যোগদান করা। পন্ডিচেরী থেকে একটি মেয়ে লিখেছে, আমি জানি একটি ফুলে মালা গাঁথা হয় না। ভারতকে উন্নত দেশে পরিণত করতে গাঁথা মালার মত অগণিত মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমিও নিজেকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করতে চাই। গোয়া থেকে ২০ বছরের এক তরুণ উত্তর দিয়েছে, ইলেক্ট্রন তার সুক্ষ্ম কক্ষপথে যেভাবে ঘুরতে থাকে, আজ থেকে আমিও আমার দেশের উন্নয়নের জন্য বিরামহীনভাবে ঘুরতে থাকবো।
আমি কবে ভারতের জয়গান গাইতে পারব?–এ প্রশ্নের জবাবে আটলান্টা থেকে এক তরুণ লিখেছে, যেদিন প্রয়োজনবোধে ভারত যে কোন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে সেদিন আমি ভারতের গান গাইব। অর্থাৎ সে তরুণ বোঝাতে চেয়েছে রাষ্ট্ৰীয় শক্তির সংগে অর্থনৈতিক শক্তি মিলিত হয়েই উন্নত ভারতভূমি গড়ে তোলা সম্ভব। প্রায় ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা লিখেছে, আমাদের ভারতে ৩৫ বছরের কম বয়সের লোকের সংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি। এই ৭০ কোটি জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম ও কর্মক্ষমতার পূর্ণবিকাশ ঘটিয়ে তাদের একতাবদ্ধ করতে পারলেই ভারত উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটা একটা বিশাল শক্তি।
এখন কথা হলো তরুণ মনগুলেকে কিভাবে জাগিয়ে তোলা যাবে? জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসার আগ্রহ কীভাবে তাদের মধ্যে সৃষ্টি করা যাবে? শুধুমাত্র সম্মিলিত ও একতাবদ্ধ একটি নবায়িত চেতনা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের পুনর্জাগরণ ঘটানো সম্ভব। তারাই দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে।
দুর্নীতিহীন স্বচ্ছতা ও মূল্যায়নের শিক্ষাও আমি গান্ধীর জীবন থেকে পেয়েছি। একবার দিল্লিতে গান্ধীজির নাতি সুমিত্রা কুলকার্নির সংগে আমাকে দেখা করতে হয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সুমিত্রাজি, আপনার ঠাকুরদার এমন কোন জীবনাচরণের কথা কি আমাদের বলবেন যা আপনি সব সময় স্মরণ করেন?
তিনি উত্তর দিতে গিয়ে একটা গল্প বললেন। তিনি বললেন, আপনার মত সকলেই জানেন, তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রার্থনায় বসতেন। প্রার্থনার পর হরিজন সম্প্রদায়সহ অন্যান্যদের জন্য সাহায্য তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি জনগণের স্বেচ্ছাসেবামূলক দান গ্রহণ করতেন। গান্ধীজির সেবকদের কয়েকজন সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে সংগৃহিত ওই সাহায্য অর্থ রাতে হিসাবনিকাশ করে রাখতেন। রাতের খাবারের আগে সারাদিনে কত অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে তা গান্ধীজিকে জানানো হত। পরের দিন ওই অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার জন্য ব্যাংক থেকে লোক আসত।
একদিন ব্যাংকের লোক এসে গান্ধীজিকে বললেন, গতরাতে তিনি যে পরিমাণ অর্থের কথা জানিয়েছেন তার চেয়ে সামান্য কিছু কম পয়সা ব্যাংকে জমা করা হয়েছে। কারণ সেবকদের একজন ওই পয়সা ধার হিসেবে রেখে দিয়েছেন। পরে তা ফেরত দেবার আশ্বাস দিয়ে তিনি ওই অর্থ গ্রহণ করেছেন। এটা শুনে গান্ধীজি সাংঘাতিক আঘাত পেলেন এবং বললেন, এ টাকা জনগণের। এ থেকে এক কানাকড়ি খরচ করারও অধিকার আমাদের নেই।
সাধারণ জীবনের স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে এ ঘটনা নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা আজ সেই গান্ধীজির দেশেই সততা ও দুর্নীতি দেখতে পাচ্ছি। আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে স্বচ্ছভারত গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে; যেভাবে আমাদের পূর্বসূরীরা করে গেছেন। উন্নয়নের অপরিহার্য ভিত্তি হল অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা।
স্বাধীনতার পর থেকে আমরা অগ্রগতির কথা বলে আসছি। কৃষিক্ষেত্রে আমরা এখন অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। দুগ্ধ উৎপাদনকারী হিসেবে বিশ্ববাজারে আমরা প্রথম শ্রেণীতে রয়েছি। এমন বহু ক্ষেত্রে আমাদের শিল্পকারখানা এগিয়ে এসেছে। এর পরেও আমরা শ শ উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ভুক্ত দেশ।
আমাদের এখন বিবেচনা করে দেখতে হবে বিশ্বের প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কোন পর্যায়ে রয়েছে। একটি দেশের প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক অবস্থান নির্ধারিত হয় তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিচার করে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্ব প্রতিযোগীতার দৌড়ে সিংগাপুর প্রথম, যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয়, হংকং তৃতীয়, তাইওয়ান চতুর্থ, কানাডা পঞ্চম, ব্রিটেন অষ্টম, ফ্রান্স তেইশতম, জার্মানি পঁচিশতম এবং ভারত উনষাটতম অবস্থানে রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল এ বিশ্বপ্রতিদ্বন্দ্বীতা নির্ধারণ করে কে? এটা আসলে শিল্প কারখানার উন্নয়নমুখীতা, উন্নত প্রযুক্তির অগ্রসরতা, সরকারের সুস্থির চালিকাশক্তির একটি সম্মিলিত ফলাফল। গড় জিডিপি অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্বে আমাদের অবস্থান দ্বাদশ পর্যায়ে। পার ক্যাপিটা জিডিপির ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান সাতান্নতম।
এ অবস্থান কি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য? বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে? আমি বিশ্বাস করি আমাদের এমনভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো উচিত যাতে জিডিপির ক্ষেত্রে চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে আমরা চলে আসতে পারি। একই সংগে বিশ্ব প্রতিযোগীতার দৌড়েও আমরা চতুর্থ থেকে পঞ্চম অবস্থানে শক্তিগুলো এক হচ্ছে আসতে চাই। আর এ সাফল্য অর্জনের জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি ২০২০ সাল। এ সাফল্য অর্জনের জন্য আমরা আগেই বেশ কয়েকটি পন্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছি।
এ সকল সমাজ গড়ার জন্য আমাদের একটি বলিষ্ঠ শিক্ষিত সমাজ গডে তুলতে হবে। আমি প্ল্যানিং কমিশনের এই শিক্ষিত প্রজন্ম সৃষ্টির রোডম্যাপ প্রণয়নের উদ্যোগে খুব খুশি হয়েছি।
আমরা কোত্থেকে আমাদের কার্যক্রম শুরু করব? সম্প্রতি নতুন কিছু রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে। সেসব অঞ্চল থেকেই আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারি। অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চলগুলোর খুব কমই উন্নতি হয়েছে। সেখানকার মানুষ অনেক পরিশ্রম করছে কিন্তু দারিদ্র তাদের ছাড়ছে না। এই চরম বঞ্চনাপূর্ণ দারিদ্র্যের পথ থেকে কে আমাদের নতুন পথের সন্ধান দেবে? কে আমাদের এ পরিস্থিতিতে রেখেছে সেটি বড় প্রশ্ন নয়। এখন আমাদের সামনে মুখ্য জিজ্ঞাসা, কে এই দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটাতে পারে?
৮. নতুনভাবে দেশগঠন
৮. নতুনভাবে দেশগঠন
If I were to look over the whole world to find out the country most richly endowet with all the wealth, power and beauty that nature can bestow- is some parts a very paradise on earth–I should point to India.
–F. Max muller
২০০১ সালের ঝাড়খণ্ড সফরের উল্লেখ করে এ বইয়ের লেখা শুরু করেছিলাম। যে সফরটির কথা বইয়ের শুরুতে উল্লেখ করেছি সেটা ছিল চতুর্থবারের মত আমার ঝাড়খণ্ড সফর। ঝাড়খণ্ড রাজ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক উন্নয়ন বিপ্লব চলছে, প্রথম দুই সফরেই আমি তা টের পেয়েছিলাম। এ রাজ্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাউন্সিল গঠনে আমি পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলাম।
চতুর্থবারের মত আমার ঝাড়খণ্ড সফরের উদ্দেশ্য ছিল এ রাজ্যের পল্লী ও বনজ সম্পদসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়নের বিষয়ে একটি প্রকল্প চালু করা। এ কারণে আমি ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বাবুলাল মারান্ডি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী সমরেশ সিং এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সংগে বৈঠক করি। ঝাড়খন্ডের আগে আমার সফর ছিল রাচিতে। রাঁচিতে পৌঁছানো মাত্র ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাকে ফুল দিয়ে অভিবাদন জানাল। আমার মত একজন সাধারণ তুচ্ছ বিজ্ঞানী এবং তার স্বপ্নের প্রতি তাদের এত আস্থা দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম।
এছাড়া ওই সফরের সময় আমি ঝাড়খন্ডের গভর্ণর প্রভাত কুমারের সংগে দেখা করলাম। তিনি আমাকে এ এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিশ্রমী মানুষদের ব্যাপারে নানা তথ্য দিলেন।
তারও আগে আমি রাচি থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরবর্তী একটি পাহাড়ি গ্রামে গিয়েছিলাম। শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয়ক একটি প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য প্রফেসর বসু আমাকে সেখানে নিয়ে যান। যখন আমি সেই পাহাড়ি আবাল বৃদ্ধবণিতার সংগে মাটিতে বসে কথা বলছিলাম তখন আমার পরিষ্কার মনে হচ্ছিল সেখানে আমার উপস্থিতি ছিল একেবারে ভবিতব্য। উন্নয়নের উপযোগী এক একজন সাহসী সৈনিক আমার সামনে। ওখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। সারা এলাকা জুড়ে আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষরাজি আর ঊর্বর ফসলের মাঠ। সবচেয়ে বড় কথা হলো ওই মানুষগুলো সবাই কৃষির জন্য নিবেদিত প্রাণ পরিশ্রমী কৃষক।
তাদের চোখেমুখে যে অকৃত্রিম হাসির ঝিলিক আমি দেখেছিলাম তা সচরাচর আর চোখে পড়ে না। অন্তত এই শহুরে জীবনে তো নয়ই। তবে সেই হাসির আড়ালেও ঢের বোঝা যাচ্ছিল, বেঁচে থাকার তাগিদে সহ্যক্ষমতার চেয়ে বেশী তারা পরিশ্রম করছিল।
ওই সফরের সময়ই আমরা সেখানে উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আয়ুর্বেদীয় ওষুধ কারখানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করলাম। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল হার্বাল ওষুধ ও প্রসাধনী পণ্য সেখানেই উৎপাদন করে সেখান থেকে সরাসরি বাজারজাতকরণের মাধ্যমে এলাকাবাসীর রোজগার ও জীবনযাত্রার মান বাড়ানো। আমাদের এ উদ্যোগ এলাকাবাসীর জন্য ছিল একটা নতুন পরীক্ষামূলক বিষয় এবং আমাদের জন্য ছিল নতুন পরীক্ষামূলক মিশন। কিন্তু এই মিশন পরিচালনা করতে গিয়ে দেখলাম ঝাড়খন্ডে ঔষধি দ্রব্য সামগ্রী, আয়ুর্বেদিক ওষুধ ও প্রসাধনীর সুবিশাল সম্ভাবনা।
রাঁচির বৈঠক শেষ করে ঝাড়খন্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হব হব করছি, এমন সময় দেখলাম আকাশে মেঘ। ফ্লাইট বাতিল করা হবে কি হবে না তা নিয়ে ইতিমধ্যে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়ে গেছে। হলোও তাই। খবর এল খারাপ আবহাওয়ার কারণে রাচি থেকে ফ্লাইট চলাচল আপাতত বন্ধ। রাজ্য সরকার আমার যাবার জন্য একটা পবন হ্যাঁন্স হেলিকপ্টার ভাড়া করে আনল। এ আবহাওয়ায় চালানো যাবে কি না আমি পাইলটকে এ প্রশ্ন করতেই সে সহ সবাই উষ্ণ হাসিতে আমার সকল ভাগ্যবিড়ম্বনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেন। পাইলট আমাকে খুব ভাল একটি ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিলেন। খুব ঝক্কিহীনভাবে আমিসহ আমার বেশকয়েকজন সাথী নিয়ে উড়ল কপ্টারটি।
আমাকে প্রায়ই হেলিকপ্টারে চড়তে হয়। কিন্তু এ ধরনের মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় কখনও আমাকে পড়তে হয়নি।
কপ্টারটির পাইলটকে খুব দক্ষ মনে হল। ছন্দময়ভাবে, ঝাঁকির হাত এড়িয়ে চালানোর জন্য বেশ কয়েকবার তাকে ধন্যবাদও দিলাম। অরণ্য, পাহাড় আর নদী ছুঁই ছুঁই করে আমরা যখন এগুচ্ছিলাম সে দৃশ্য আমার কাছে এক বিরল অভিজ্ঞতা। আমি বিভোর হয়ে এই নির্মল শ্যামল শোভা দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, সাময়িক লাভের আশায় যারা আমাদের এই বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করছে তাদের হাত থেকে এ সম্পদরাশি আমাদের বাঁচাতেই হবে। ভাবতে ভাবতে খেয়াল হল আমরা নিচের দিকে নামা শুরু করেছি।
হঠাৎ খেয়াল করলাম পাইলট দুজন আরপিএম পতনের বিষয় নিয়ে উত্তেজিত ভাবে কী যেন বলাবলি করছে। আমি সতর্ক হয়ে বসলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি অসংখ্য গাড়ি। আর চারদিকে পিঁপড়েসারির মত মানুষ। ঠিক পরমুহূর্তেই ক্র্যাশ করলো কপ্টারটি। কপ্টারটি বিকটশব্দে মাটিতে আঘাত করলো। ভাঙাচোরা যন্ত্রাংশ আশপাশ দিয়ে উড়ে গেল। দেখলাম আমাদের দিকে ছুটে আসছে অগ্নি নির্বাপনী কয়েকটি গাড়ি।
আমি স্বাভাবিকভাবেই হেলিকপ্টার থেকে নেমে এলাম। একেবারে মরা মানুষের মত ধপাস করে মাটিতে পড়েছিল কপ্টারটি।
আমাদের ভাগ্য ভাল ল্যান্ড করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কপ্টারে যান্ত্রিক জটিলতা দেখা দিয়েছিল। ভূমি থেকে সামান্য ওপরে থাকতে ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ায় সেদিন আমরা বেঁচে গেছি।
পাইলট দুজন অসহায়ের মত আমার দিকে তাকালো। তারাও এ ঘটনায় বড় ধরনের মানসিক ধাক্কা খেয়েছে। আমি তাদের সংগে করমর্দন করে বললাম ফ্লাইং মেশিন চালাতে গেলে এরকম দুএকটা দুর্ঘটনা তো ফেস করতেই হবে।
সেদিন রাঁচিতে চিন্ময় বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সংগে আমার দেখা করার কথা ছিল। তাদের সংগে যোগ দিতে কপ্টার দুর্ঘটনার আঘাত ও ভয় ফেলে ছুটলাম চিন্ময় বিদ্যালয়ে। স্কুলের প্রিন্সিপাল কৃষ্ণস্বামী আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন এবং অডিটরিয়ামের মাঝখান দিয়ে বক্তব্য মঞ্চে যাবার সময় ছেলে মেয়েরা আমার মাথায় বৃষ্টির মত গোলাপের পাপড়ি ছড়াতে লাগলো। আমি আসার আগেই কপ্টার ক্র্যাশের খবর চলে এসেছিল। বাচ্চারা সব পিনপতন নিরবতায় আমার সামনে বসেছিল।
পরিস্থিতি সহজ করার উদ্দেশ্যে শিশু-কিশোরদের উদ্দেশ্যে বললাম, বন্ধুরা, রাচি থেকে এখানে আসবার সময় আমি তোমাদের প্রতি ঈশ্বরের দেওয়া উপহার দেখতে দেখতে তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম।
তোমাদের পায়ের নিচে এবং পায়ের ওপরে ঈশ্বর তোমাদের সীমাহীন সম্পদ দিয়েছেন। ঝাড়খন্ডের উর্বর মাঠ তোমাদের শস্যের সম্পদ দিতে পারে। যখন আমি তোমাদের পাহাড়, উপত্যকা, অরণ্য আর নদীর ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারে উড়ে উড়ে আসছিলাম তখনই ভাবছিলাম তোমাদের এ এলাকা হার্বাল সামগ্রী উৎপাদনের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক। তোমাদের এখানে দেখলাম পুরোমাত্রায় চলছে একটি সম্ভাবনাময় স্টীল প্ল্যান্ট। আমি আমার দিব্যদৃষ্টিতে এ এলাকাকে একটি উন্নত শিল্প এলাকা হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। উন্নত ও সমৃদ্ধ রাজ্যের জন্য যা যা থাকা দরকার তার সবই এখানে আছে। এখানকার ভূমিগুলোকে শুধু সেই পর্যায়ে পরিবর্তন করা দরকার। আমি দেখতে পাচ্ছি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তোমাদের গ্রামগুলো শহরের যাবতীয় সুযোগসুবিধা অর্জন করতে পারবে। আজকের এই দুর্ঘটনা আমাকে বাকি জীবনের মিশন নির্ধারণে আরও বেশী প্রেরণা দিয়েছে। তোমাদের সামনে সমৃদ্ধির অপার সম্ভাবনা। উন্নত রাজ্য হিসেবে তোমাদের রাজ্যকে গড়ে তুলতে কীভাবে তোমরা সমন্বিত প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নামবে? এ সফলতার জন্য সবাইকে মিশন মুড নিয়ে কাজ করতে হবে।
একদিন এই শিশুগুলোই বড় হবে। বিভিন্ন পদে আসীন হবে। এরাই সুশীল সমাজের অংশ হয়ে উঠবে। দেশের প্রতি তাদের অবদান তখন উন্নত রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। একদিন এদেরই প্রধান লক্ষ্য হবে ঝাড়খণ্ডকে মহান ও উন্নত রাজ্যে পরিণত করা।
শিশুদের হাতে তৈরী বিভিন্ন খেলনা, আঁকা ছবির প্রদর্শনী দেখে এবং তাদের পরিবেশিত ময়ূরনাচ সহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দেখে আমার মনে হচ্ছিল সৃষ্টিশীলতা বিকাশ ও উন্নত শিক্ষার জন্য তাদের এ কার্যক্রম খুবই আশাবহ অবদান রাখবে। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম এমন একটি সম্ভাবনাময় রাজ্যের সংগে অবশ্যই আমি কাজ করে যাবো।
চিন্ময় বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে টাউন হলের একটি পূর্ব নির্ধারিত মিটিংয়ে যোগ দিতে গেলাম। অবশ্য বোকারো স্টিল প্লান্টের জেনারেল ম্যানেজারের পাঠানো একদল ডাক্তার আমাকে সেখানে না গিয়ে বারবার বিশ্রাম নেবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমি তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেই টাউন হলের মিটিংয়ে উপস্থিত হই। সেখানে আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল, ঝাড়খন্ডের সুপ্ত সামর্থ্য ও শিল্প কারখানা। পরবর্তী আলোচনা ও বাকবিনিময়ে আলোচ্য বিষয়ের গভীরতা তলিয়ে দেখা যাবে একথা বিবেচনা করেই আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলাম।
ইতিমধ্যেই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া যা করার করে ফেলেছে। আমাদের আগমন। উপলক্ষ্যে বাছা বাছা সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা আমাদের সংগে এসেছিলেন। ফলে হেলিকপ্টার ক্র্যাশের ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশে প্রচারিত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর পর আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠতে লাগল। আমি সুস্থ্য আছি কিনা তা জানার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফোন করছিলেন। আমি মিটিংয়ের আলোচনায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রাচি থেকে আমার সহগামী হওয়া বন্ধু ড. বিজয় রাঘবনকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, কলগুলো রিসিভ করে তিনি যেন সবাইকে জানিয়ে দেন আমি সুস্থ্য আছি। একই সংগে রামেশ্বরমে বসবাসরত আমার ছিয়াশি বছর বয়স্ক বড়ভাইকে ফোন করে আমার সুস্থতার কথা জানাতে বললাম। দিল্লিতে অবস্থানরত আমার আরেকজন একান্ত সচিব শেরিডনকে ফোন করে জানাতে বললাম সে যেন বাইরের ফোনগুলো রিসিভ করে আমার সুস্থ্যতার খবর সবাইকে জানায়।
আমি মিটিংয়ে কথা বলছি, এ সময় বিজয় রাঘবন আমার সামনে একটা চিরকুট রাখলেন, তাতে লেখা, আপনার ভাই কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছেন না যে আপনি সুস্থ্য। তিনি আপনার সংগে কথা বলতে চাইছেন। বড় ভাইরা চিরকালই বড়ভাই থেকে গেলেন। আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে তার সংগে কথা বলতে হল আমাকে।
মত বিনিময় সভায় একজন প্রশ্নকারী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ড. কালাম, আপনি আমাদের বলবেন কেন বিশেষ পূর্বপরিকল্পিতভাবে আমাদের বন্দরগুলো থেকে কাঁচামাল রফতানি করা হচ্ছে?
এই ঝাড়খন্ডে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকায় এবং তা বাইরের দেশে রফতানি করায় প্রশ্নটি প্রাসংগিক ও সময়োপযোগী হয়েছে। তার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমি গোয়াতে বন্ধুদের সংগে আলোচনার একটি বিষয় খুলে বললাম। একবার গোয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখতে যাচ্ছিলাম, আমার সহগামী হয়েছিলেন ড. হোসে পল। তিনি গোঁয়ার মারগুয়াও বন্দরের চেয়ারম্যান।
আমরা আমাদের ভারতের লোহা রফতানির বিষয়ে কথা বলছিলাম। আমাদের কথাবার্তার মূল বিষয় ছিল ভারতের অপরিশোধিত লৌহ আকর জাপানে রফতানি নিয়ে। পল জানালেন, প্রতি বছর ৩ কোটি টন লৌহ আকর চারটি বন্দর থেকে জাপানে রফতানি করা হয়। এর মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ টন রফতানি হয় এই মারগুয়াও বন্দর থেকে। বিদেশী ক্রেতা দেশগুলো এই কাঁচা লোহাকে অত্যন্ত নিম্নমানের বিবেচনা করায় প্রতিটন লোহা মাত্র কয়েক ডলারে বিক্রি করা হয়। অথচ ওই কাঁচা লোহা রফতানি না করে যদি তা দেশে কাজে লাগানো যায় তাহলে তাকে আরও বেশী স্থানীয় আয় বাড়বে। তবে এর জন্য সঠিক মূল্য সংস্কার করা দরকার।
এটুকু বলতেই বোকারোর মতবিনিময় সভার একজন দাঁড়িয়ে বললো, মূল্য সংস্কার বলতে আপনি কী বোঝাতে চান? একটা উদাহরণ দেবেন কি?
আমার একটা সুন্দর উদাহরণের কথা মনে পড়লো।
১৯৭০ সালের স্যাটেলাইট অভিযানের জন্য আমরা যখন কাজ করছিলাম, তখন বেরিলিয়াম ডায়াফ্রাজমস নামের একটি জিনিসের দরকার পড়লো। এটি এক ধরনের তাপনিয়ন্ত্রক সাদা ধাতুতে তৈরী হয়। রকেট অথবা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপনের পর তার গতি এবং প্রকৃতি সম্বন্ধে তথ্য দানকারী জোরাস্কোপ ও সেন্সর মেশিনে এ বিশেষ ধাতু ব্যবহৃত হয়। যেহেতু আমাদের দেশে ওই ধাতু ছিল না সেজন্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তা কিনে আনবার জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করা হল।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশানের নেতৃত্বে মাধব নায়ার, ড. এস. সি. গুপ্ত এবং আমি বেরিলিয়াম কেনার জন্য নিউইয়র্কের একটি কোম্পানীর কাছ থেকে ১শ বেরিলিয়াম ডায়াফ্রামের আমদানির চুক্তি করলাম।
তিন মাস পর ওই কোম্পানী থেকে একটি মেসেজ এল যাতে বলা হয়েছে, যেহেতু বেরিলিয়াম ধাতুটি উপমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইলে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, সেহেতু ভারতে তা রফতানির অনুমতি দিচ্ছে না মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সমস্যা সমাধানে আমরা তড়িঘড়ি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কোন একটা উপায় খুঁজে বের করতেই হবে।
অবশেষে প্রযুক্তির প্রত্যাখ্যানই আমাদের প্রযুক্তি সফলতার পথ দেখাল।
একটি খবর বেরুল ভারতে বিশ্বের সবচে বড় বেরিলিয়াম আরকের খনি রয়েছে। ভারত থেকে যে কাঁচা লোহার আরক জাপানে রফতানি হচ্ছে, তারা তা শোধন করে বেরিলিয়াম রড অথবা শীট তৈরী করছে। জাপান আবার সেই শীটগুলো বিক্রি করছে আমেরিকার কাছে। আমেরিকান কোম্পানী সেগুলো দিয়ে ডায়াফ্রাজম চোঙসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বানাচ্ছে।
ঘটনা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। চিন্তা করতে লাগলাম, ভারতের খনির বেরিলিয়াম নিম্নমানের লৌহআকর হিসেবে যাচ্ছে জাপানে, জাপান সেটা প্রসেসিং করে পাঠাচ্ছে আমেরিকায় আর সেই ভারতের কাছে প্রক্রিয়াজতকৃত দ্রব্য বেচতে অস্বীকার করেছে আমেরিকা। আমাদের চিন্তার পশ্চাৎপদতা দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। এ বিষয় নিয়ে পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি শুরু হল এবং বেরিলিয়াম রফতানি বন্ধ করা হল।
এই একই ঘটনার প্রতিফলন ঘটেছে অন্যান্য ক্ষেত্রেও। প্রচুর সম্পদ থাকার পরও ভারত অর্থনৈতিক সফলতা পাচ্ছে না এই মূল্য সংস্কার করতে না পারার কারণে।
এটা শুধু খনিজ সম্পদের কারণে তাই নয় বরং কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও ঘটছে একই ঘটনা। একেকটি পণ্যকে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীতে রূপান্তরের সংগে সংগে তার দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এমনকি বেরিলিয়ামের মত তা ১শ গুণ বেশী দামেও বিক্রি হতে পারে। আমাদের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের মূল্য সংস্কারের উপায় জানতে হবে, নয়তো আমাদেরই জিনিস ওরা পরিবর্তন করে অর্থাৎ মূল্য সংস্কার করে আমাদের কাছে কয়েকগুণ বেশী দামে বিক্রি করবে।
ওই একই মতবিনিময় সভায় আমাকে আরেকটি মজার প্রশ্ন করা হল, আপনি কি রাজনীতিতে স্বচ্ছতা তৈরী করা সম্ভব বলে মনে করেন? যদিও তাৎক্ষণিকভাবে আমি এ প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, তথাপি আমার মনে একটি জবাব ভেসে উঠলো। আমি বললাম, আমাদের দেশ রাজনীতি, শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য সর্বক্ষেত্রেই কৃতিত্ব দেখিয়েছে যে কারণে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিলাম। মহাত্মা গান্ধী, সি.ভি. রমন, জে. আর. ডি. টাটা, ফিরোজ শাহ বি. গোদরেজ, লক্ষনরাও কিরলস্কর, রামকৃষ্ণ বাজাজ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডি. আর. এস. রাধাকৃষ্ণন, মদনমোহন মালবী এসব মহাত্মার তালিকা অনেক দীর্ঘ।
সে সময় এতগুলো প্রতিভা একত্রিত হওয়ায় ভারতভূমি জেগে উঠেছিল। সে সময় ভারত স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়েছিল বলেই রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য সবক্ষেত্রে একটি আবহ তৈরী সম্ভব হয়েছিল।
আমি বিশ্বাস করি, স্বাধীনতার লক্ষ নিয়ে মানুষ যেভাবে জেগেছিল ঠিক সেভাবে যদি আরেকটি দ্বিতীয় গণজাগরণ সৃষ্টি করা যায় তাহলে রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব।
পরের দিন আমি বোকাবরা স্টীল প্ল্যান্ট পরিদর্শনে গেলাম। এটি ভারতের সর্ববৃহৎ স্টীল প্ল্যান্ট। প্ল্যান্টের জেনারেল ম্যানেজার মিস্টার তিওয়ারি আমার সংগে ছিলেন। প্ল্যান্টের আয়তন দেখে যে কারও ভিরমি খাওয়ার কথা। প্ল্যান্টের ভেতরে গিয়ে দেখলাম বিশাল ড্রেনের মত জায়গা দিয়ে গলিত লোহার স্রোত আগুনের নদীর মত বয়ে যাচ্ছে। কয়েক শ মানুষ সেই প্রচন্ড গরমের মধ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের শরীর থেকে দর দর করে ঘাম ঝরছে।
মিস্টার তিওয়ারি জানালেন, এখানকার খনির লোহা শেষ হতে অনেক বছর লেগে যাবে। শুনে খুব ভাল লাগল। কিন্তু যখনই জানলাম এ প্ল্যান্টের ওপর ভিত্তি করে এখানে এখনও কোন কলকারখানা গড়ে ওঠেনি তখন কেমন খারাপ লাগল। আমি আমার সঙ্গীদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম এই লোহার ওপর ভিত্তি করে এখানে তো অনেক লৌহ ও লৌহজাতুদ্রব্যের কারখানা গড়ে ওঠার কথা ছিল, উঠছে না কেন? তারা জানালেন কেন্দ্রীয় সরকারের এখানে কারখানা গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাই স্থানীয়রা এগিয়ে আসছে না।
আমার মনে হল এটা কেন হবে? স্থানীয় কোম্পানীগুলো যদি প্ল্যান্টের আশে পাশে তাদের কারখানা গড়ে তুলতে পারে তাহলে তা সবার জন্যই মঙ্গলজনক হবার কথা।
দিল্লি ফিরে ভাবতে লাগলাম ঝাড়খন্ডকে কীভাবে সাহায্য করা যায়। আমার মনে হল একেকটা নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ঝাড়খন্ডে কয়েকটি মিশন চালু করতে হবে। এই মিশনগুলো সফল করার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার একজোট হয়ে কাজ করবে। এটা কি সম্ভব?
২০০১ সালের অক্টোবর মাসে দিল্লির গুরু গোবিন্দ সিং ইন্দ্রপ্রস্থ বিশ্ববিদ্যালয় সফরের সুযোগ হয় আমার। ছাত্রদের প্রতি দেওয়া আমার ভাষণের বিষয়বস্তু ছিল, দায়িত্বশীল তরুণ নাগরিক। এ বক্তব্যে আমি ভারতকে একটি নলেজ সোসাইটি বা সুশীল সমাজ হিসেবে গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলাম। আমার বক্তব্য শেষ হলে একটি ছাত্র জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি বলবেন কেন ভারতীয়রা, বিশেষ করে শিক্ষিত ভারতীয়রা ইউরোপ আমেরিকায় গেলে খুব ভাল কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে পারে? তারা কিন্তু সেসব দেশে গিয়ে ধনীও হচ্ছে।
আমি বললাম, সম্প্রতি আমি বিদ্যানন্দ রাজঘট্টের লেখা দি হর্স দ্যাট ফ্লিউ নামে একটি বই পড়েছি। যেসব ভারতীয় বিদেশে বিশেষ করে আমেরিকায় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছে এ বইটি তাদের নিয়ে লেখা।
আমি খুব গভীরভাবে খেয়াল করে দেখেছি বইয়ে বিদেশে অবস্থানরত যেসব সফল ভারতীয়র কথা বলা হয়েছে তারা কেউ এককভাবে কাজ করে উন্নতি লাভ করতে পারেনি। তারা সবাই একটা ভিন্ন দেশে, ভিন্ন মানুষের মধ্যে কাজ করার ঝুঁকি নিতে পেরেছে শুধু যুথবদ্ধ সাহসের কারণে।
একবার আমি বি. চন্দ্রশেখরের সংগে দেখা করেছিলাম। তিনি মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির প্রতিষ্ঠাতা। এখানেই প্রথম ভারতের ইন্টারনেট টেকনোলজি সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। একদিন সকালে চন্দ্রশেখর তার সমগ্র প্রতিষ্ঠান ১ হাজার কোটি ডলারে বিক্রি করে দিলেন এবং অন্য প্রতিষ্ঠান শুরু করার উদ্যোগ নিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম নতুন প্রকল্প চালু করার জন্য কী করে তিনি এত বড় ঝুঁকি নিতে গেলেন?
চন্দ্রশেখর আমাকে জানালেন, তিনি ঝুঁকি নিতেই ভালবাসেন। তবে সে ঝুঁকিকে অবশ্যই পরিকল্পিত হতে হবে।
১৯৫৫ সালে মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার বিষয় ছিল অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। আমাদের পরিচালক ছিলেন ড. শ্রীনিবাস। শ্রীনিবাস নিজেও বড় অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। আমরা তার তত্ত্বাবধানে থেকে একটি ছোট যুদ্ধ বিমানের ডিজাইন করছিলাম। এর মধ্যে বিবেকানন্দ, মহাবলেশ্বর ভাট এবং আমি এই তিনজনের দায়িত্ব ছিল একটি সিস্টেম ইনটিগ্রেশনের কাজ। তিন মাসের মধ্যে আমাদের ডিজাইন জমা দিতে হবে এবং সেটা এক্সটারনাল শিক্ষকরা পরীক্ষা করবেন।
ইঞ্জিন, কন্ট্রোল সিস্টেম এবং আরও কিছু সাব সিস্টেমের তথ্য বন্ধুরা দুই সপ্তাহ দেরীতে জমা দিল। ফলে ড্রইং জমা দিতে আমারও দেরী হয়ে গেল।
আগস্ট মাসের এক আদ্ৰ সন্ধ্যায় আমি ড্রইং বোর্ডে কাজ করছি। ড. শ্রীনিবাস তার টেনিস কোর্টে যাবার সময় উঁকি দিয়ে আমার কাজ দেখছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন আমার কাজ শেষ হতে এখনও অনেক বাকি। তিনি বললেন, কালাম, তিন দিনের মধ্যে ড্রইং শেষ না হলে তোমার স্কলারশীপ বন্ধ হয়ে যাবে।
তার এ কথায় আমি প্রচণ্ডভাবে নাড়া খেলাম। স্কলারশীপ আমার জীবনের প্রধান সাধনা। এমআইটিতে পড়ানোর সামর্থ্য আমার বাবার নেই। কাজটা তিনদিনের মধ্যে আমাকে শেষ করতেই হবে। এ চিন্তা মাথায় রেখে একটানা কাজ শুরু করলাম। শুধু খাওয়া ছাড়া ওই তিনদিন আমি রুমের বাইরে যাইনি এবং ঘুম এলে বেঞ্চিতে বসে ঘুমিয়ে নিয়েছি। এভাবে রাতদিন পরিশ্রমের পর অবশেষে আমি ড্রইং শেষ করলাম।
তিনদিন পরে ড. শ্রীনিবাস ড্রইংবোর্ড দেখতে এলেন। এক ঘন্টা ধরে পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর বললেন, খুব ভাল হয়েছে, যে কাজ করতে কয়েক সপ্তাহ লাগার কথা, তুমি তা কয়েক দিনে করলে। তার একথা আমার কাজের বিরাট স্বীকৃতি বলে আমি সেদিন বিবেচনা করেছি।
সেদিনই আমি বুঝেছি প্রচন্ড মানসিক শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করলে হাজারও ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও সফলতা অনিবার্য। ভাল কিছু করতে হলে ঝুঁকি মোকাবেলা করতেই হবে। জন্মের প্রক্রিয়াটাই তো ঝুঁকির। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ দিয়ে একটা শিশু সংগ্রামের মুখোমুখি হয়ে জন্ম নেয়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চালু হলে, যখন সে কান্নার মাধ্যমে স্বীয় অস্তিত্ব ঘোষণা করে তখন সবাই স্বস্তি পায়। সকলের মুখ আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। এজন্য সাফল্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে কাজ করলেও সফলতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
৯. দেশবাসীর প্রতি
৯. দেশবাসীর প্রতি
Where the mind is without fear and
the head is held high
Where knowledge is free Where the world has not been broken up in to fragments…
My father let my Country awake.
-Rabindranath Tagore
সমগ্র বইটিতে আমি ইচ্ছা শক্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এটি সৃজনশীল কাজের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং এটিই আমাদের জীবনের খুব প্রয়োজনীয় অংশ; এর একত্রিত শক্তি আমাদের আকাংখার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এই শক্তিই বিজয়ী এবং বিজেতার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আমি আগামী বিশ বছরের মধ্যে ভারতকে শিক্ষিত এবং দারিদ্র্যমুক্ত জাতি হিসেবে দেখতে চাই। আমি আদর্শ নেতাদের পরিচালিত ভারতের স্বপ্ন দেখি। আমি এমন এক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি যেখানে বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদের কর্মকান্ড পরিচালিত হবে সাধারণ মানুষের মঙ্গলার্থে। কিভাবে এই স্বপ্ন সত্যি হবে?
আমাদের অনুধাবন করা দরকার যে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মিশন কোন সংগঠনের চেয়ে অনেক বড়, যেমন একটা সংগঠন তার পরিচালকের চেয়ে বড়। কোন মিশন পরিচালনার জন্য দরকার উদ্যম এবং তা আমাদেরকে সরবরাহ করে মন। ভেবে দেখুন, কোন বিভাগ বা মন্ত্রণালয় কি মানুষকে মঙ্গল গ্রহে নিয়ে সেখানে বসতি গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারবে? ২ লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদন কি তাপশক্তি, জলবিদ্যুৎ শক্তি, পারমাণবিক শক্তি এবং অনিয়মতান্ত্রিক ক্ষেত্রগুলোর সমন্বিত কার্যক্রম ছাড়া সম্ভব? কৃষি বিজ্ঞানী, জীব প্রযুক্তিবিদ এবং সেচ বিশেষজ্ঞদের একত্রিত কর্মকান্ডের সমন্বয় ছাড়া কি দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব সম্ভব?
আমাদের ক্লিনিকগুলোতে সঠিক ডায়াগনোসিস সুবিধা এবং সাধারণের ক্রয়যোগ্য ওষুধ না রাখতে পারলে এই জৈব প্রযুক্তির গবেষণাগার আর মেডিকেল কাউন্সিল গঠন করে কোন লাভ নেই। এসব নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যই হল সর্বাধুনিক চিকিৎসা সেবার আবিষ্কার এবং ন্যুনতম অর্থের বিনিময়ে সে সেবা রোগীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
আমার অভিজ্ঞতার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি সচেতন থেকেছি। ভবিষ্যত লক্ষ্য স্থির করে সামনে চলার শক্তি আমার মধ্যে এক প্রবল আশাব্যঞ্জক তেজ সৃষ্টি করেছে। এ এমনই এক শক্তি যা তোমার ভেতর থেকে জ্বলে ওঠে। স্বাধীনতার সময় এই শক্তিকে আমরা জ্বলে উঠতে দেখেছিলাম। যখনই কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই তখনই স্বাধীনতার সেই সময়ের শক্তিকে আমি ধারণ করি।
আজকের ভারতের পুনর্জাগরণের জন্য স্বাধীনতার সময়কালীন সেই তেজদীপ্ততার আজ বড় প্রয়োজন।
জামশেদজি নুসরাবানজি টাটা ভারতে প্রথম ইস্পাত শিল্পের সূচনা করেছিলেন, যদিও ব্রিটিশ সরকার তার এ আইডিয়া সমর্থন করেনি। আচার্য পি. সি. রায় ভারতের কেমিকেল ও ফার্মাসিউটিক্যালস্ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচর্যা করেছিলেন। এসব মহাত্মাদের হাতেই আমরা ভারতের ভুবন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো সৃষ্টি হতে দেখেছি। জে. এন. টাটা ব্যাঙ্গালোরে প্রতিষ্ঠা করেছেন ভারতীয় বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। পন্ডিত মদনমোহন মালবী বানারসে গড়ে তুলেছিলেন বানারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়।
বরোদার মত বিভিন্ন স্থানেও কিছু কিছু প্রগতিশীল মহারাজারাও বহু বিশ্ববিদ্যালয় গড়েছেন। এমন বহু দৃষ্টান্ত বহু স্থানে ছড়িয়ে আছে। এসব কাজের পেছনে তাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল সেটা হল ভারতের জাগরণ। বিশ্বে ভারতের উত্থান নিশ্চিত করা। বিশ্বে অন্যদের মত ভারতও সব কিছু করতে পারে- এটাই তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।
আমরা কি তাদের সেই আদর্শের অবস্থানে এখনও আছি? তাদের সেই তেজোদীপ্ত আকাঙখা সফল করার বাসনা কি আমরা লালন করতে পেরেছি? আমরা কি এ দৃশ্য দেখে যেতে পারব না যে ভারতের তৈরী গাড়িগুলো ফ্রাঙ্কফুর্ট অথবা সিউলের রাজপথে আমাদের সাফল্য গাঁথা এঁকে দিয়ে যাচ্ছে?
অথবা আমরা কি কোনদিন দেখতে পারব না যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান অথবা চীনে ভারত পাওয়ার স্টেশন নির্মাণ করে দিচ্ছে? যদি আমাদের উচ্চাশাগুলোকে নিম্নগামী করে রাখি তাহলে সে সম্ভাবনা অনেক দূরবর্তী হয়ে পড়বে।
তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আজকে ভারতের সফটওয়ার সেক্টর খুব ভাল অবস্থানে চলে এসেছে, কিন্তু হার্ডওয়ার যন্ত্রপাতির প্রায় সবকিছুই আনতে হচ্ছে বিদেশ থেকে।
আমরা কি এই অনগ্রসরতা কাটিয়ে উঠতে পারব না? ভারত কি এমন কোন অপারেটিং সিস্টেমের ডিজাইন আবিষ্কার করতে পারবে না যা বিশ্বের কম্পিউটার মার্কেটে একচ্ছত্র আধিপত্য চালাতে পারে? আমাদের রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে কাঁচা লোহা ও অ্যালুমিনিয়ামের মত জিনিস যার মূল্য বিশ্ববাজারের অন্যান্য দ্রব্যের তুলনায় খুবই কম। আমরা এই কাঁচামালগুলোকে সদূর প্রসারী ও ব্যাপক চাহিদাভিত্তিক পণ্য সামগ্রীতে কি রূপান্তর করতে পারি না যা বিশ্ববাজারে আধিপত্য গড়ে তুলতে পারে?
আমাদের কয়েকশ প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনকারী ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। তারপরও ভারত কেন মেইন ব্যাটল ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র, এয়ারক্র্যাফট, বন্দুক ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা সামগ্রী তৈরী করে বিশ্ব বাজারে ছাড়তে পারছে না?
আমাদের মেধাবী ও কর্মঠ জনশক্তি ও মৌলিক ভৌত অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও কেন আমরা তা পারছি না? আমাদের মূল অভাবটা কীসের?
আসুন, আমরা সবাই ভেবে দেখি এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কী কী বিষয় আমাদের অনগ্রসর করে তুলছে? কোন ব্যক্তি স্বার্থ নয়, কোন একক শিল্প প্রতিষ্ঠান, সংগঠনের স্বার্থে নয়, সকলের সম্মিলিত স্বার্থে এবং সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় অগ্রগতির কথা মাথায় রেখে অগ্রসর হলে ভারতের উন্নয়ন সম্ভব। আমাদের মূল শক্তিকে উত্থিত হতে হবে দেশপ্রেম থেকে। আমাদের এমন একটি ভিশন থাকতে হবে যার সংগে সমগ্র জাতীয় স্বার্থ জড়িত।
উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে কোন কোন প্রদেশ অন্যান্য প্রদেশ অপেক্ষা ভাল করছে। জাতীয় প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তরুণরা বেশ সাফল্য অর্জন করছে। ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, মুম্বাই, দিল্লি এবং হায়দ্রাবাদ বাণিজ্যিক কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছে। কিন্তু তথাপি দেশের সামগ্রিক তথ্য-প্রযুক্তির বিচারে এ উন্নয়ন এখনও অপ্রতুল। আপনি যদি তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রকে মিশন হিসেবে নিতে চান তাহলে প্রথমেই দরকার জনশক্তি। এই সর্বোচ্চ মেধার ক্ষেত্রে কাজ করতে হলে ওই শহরগুলোয় আরও বেশী শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে।
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো–ত্রিপুরা, আসাম ও ঝাড়খণ্ড সফর করে সেখানে অজস্র প্রাকৃতিক সম্পদ উপযোগীতা সৃষ্টির অভাবে নষ্ট হতে দেখেছি। বাঁশ ও বাঁশজাতীয় পণ্যসহ বনজ সম্পদের ওপর নির্ভর করেই ত্রিপুরার অর্থনীতি চলছে। এখানে প্রাকৃতিক গ্যাসসহ নানা ধরনের খনিজ সম্পদ রয়েছে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। এ রাজ্যে ভ্রমণ, যোগাযোগ ভিত্তিক ব্যবসা করা খুবই কঠিন। রাজ্যটি একরকমের এক ঘরে অবস্থায় রয়েছে। ঝাড়খন্ডেও খনিজ ও বনজ সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে। কিন্তু সে সম্পদের সঠিক উপযোগীতা এখনও তৈরী করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। স্থানীয় সম্পদ সঠিকভাবে পণ্য সামগ্রীতে রূপান্তর করে রাজ্যটি সংস্কার করা জরুরী।
আসামে কোন সম্পদের ঘাটতি নেই এবং সেখানে বেশ মজবুত শিক্ষা অবকাঠামো রয়েছে। উন্নত দেশ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও জনশক্তি থাকার পরও সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সহিংস কার্যক্রমের জন্য অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। সবার যৌথ উদ্যোগ আসামের মানুষকে এক ছাতার নিচে আনতে পারে।
তামিল নাড়, অন্ধ্র প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং কর্নাটকের আজকের এই উন্নয়নমুখী অগ্রগতির পেছনে রাজ্যের সার্বিক ও সমন্বিত পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে তারা স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হিসেবে এ রাজ্যগুলোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনগুলো, রাজনৈতিক প্লটফর্ম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চেম্বার অব কমার্স একের পর এক সভা সেমিনার, আলোচনা, বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে আলোচনার নামে আসলে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি আর গলাবাজিই হচ্ছে বেশী। অবিরাম সেখানে তত্ত্ব, মহাতত্ত্ব, থিওরি নিয়ে আলোচনা করেও অগ্রগতি হচ্ছে খুবই সামান্য।
আমার বক্তব্য হল বোর্ড রুম আর প্রযুক্তি সম্মেলনে উন্নত ভারত গঠনের আলোচনা, বিতর্ক ও থিওরি কপচালে চলবে না। এ আলোচনা হতে হবে সমস্ত প্রতিষ্ঠানে, সংগঠনে, পরিবারে এমন কি ব্যক্তি পর্যায়েও। সমাজের প্রত্যেকটি পর্যায়কে দেশের ভালমন্দের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। দেশের জন্য কোনটা ভাল কোনটা খারাপ সমাজের প্রত্যেককেই তা বুঝতে হবে।
আমি সমগ্র বইয়ে একটা বিষয়ই তুলে ধরতে চেয়েছি। সেটা হল আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতার ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে আর নিজেদেরকে উন্নত ভারতের নাগরিক হিসেবে ভাবতে শিখতে হবে। আমরা একটা বিশাল উন্নত সভ্যতার মধ্যে জন্ম নিয়েছি আর এই সভ্যতার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আমাদের পূর্ণবিশ্বাসী হওয়া দরকার। আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে উন্নত বিশ্ব ও আমাদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। আমাদের অন্তর্জগতে যে বিশ্ব রয়েছে সেটাই আমাদের কাছে বড় সত্য।
স্বাধীনতা কেউ এসে আমাদের উপহার দিয়ে যায়নি। সমগ্র জাতি যুগের পর যুগ সংগ্রাম করে এ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সুতরাং এ স্বাধীনতা রক্ষার দায় দায়িত্ব আমাদের সকলের। এদেশের প্রতিরক্ষা ও উন্নয়নের চেয়ে বড় কোন মতাদর্শ নেই।
জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেয়ে বড় কোন ইসু আমাদের সামাজিক জীবনে থাকতে পারে না।
উন্নত ভারত গড়ে ছাত্র শিক্ষার্থীদের এখনই তৈরী হতে হবে। তাদের প্রতি আমার জোরালো আহবান, তোমাদের হৃদয়কে উচ্চাকাঙ্ক্ষার আগুনে প্রজ্জ্বলিত করো। বড় বড় স্বপ্ন দেখো, বৃহৎ চিন্তায় নিজেকে সমর্পণ কর।
এক শিক্ষককে একদিন বলতে শুনেছিলাম, আমাকে পাঁচ বছরের একটি শিশু দাও। সাত বছর শিক্ষা দেবার পরে কোন ঈশ্বর অথবা শয়তানের ক্ষমতা নেই–তাকে আদর্শচ্যুত করে। আমাদের সমস্ত শিক্ষকরা সেই গুরুর মত হতে পারবে?
আমাদের রাষ্ট্রপরিচালকদের সামনে দেশের রাজনীতিবিদ ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। জনগণের সার্বিক মঙ্গল সাধিত হয় এমন সিদ্ধান্তই তাদের নিতে হবে।
স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলেও বিজ্ঞানের আশীর্বাদ আমরা এখনও সফলভাবে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। গ্রামাঞ্চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সেবা দ্রুত পৌঁছে দেবার এখনই সময়।
বিশ্বের তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চগুলো ইতিমধ্যে ভারতের আইটি সেক্টরকে সম্মানজনক স্বীকৃতি দিয়েছে। আজকে ভারত আইটি ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম শ্রেণীর প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ। টেলিমেডিসিন, ই-গভর্নেন্স এবং টেলিএডুকেশন সারা দেশে চালু করার ক্ষেত্রে এই আইটি ক্ষেত্রকে ব্যবহার করতে হবে।
কৃষি ক্ষেত্রে আমাদের একযোগে কাজ করে কৃষকদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের কৃষিজাত পণ্যের মান ও উৎপাদন বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিদ্বন্দ্বীতা সক্ষম করে তুলতে হবে। একই সংগে পণ্য বাজারজাত করণের ক্ষেত্রেও সচেতন হতে হবে যাতে কৃষকরা তাদের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পায়।
সর্ব শেষে পরমকরুণাময়ের কাছে আমার প্রার্থনা তিনি যেন আমার দেশের মানুষকে কর্মঠ করে তোলেন। তিনি যেন তাদের আরও অসংখ্য অগ্নি তৈরীর সক্ষমতা দেন যাতে তারা শয়তানের বিষদৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারে।
তার কাছে আমার অন্তিম প্রার্থনা, হে আল্লাহ! আমার জনগণকে তুমি সম্প্রীতির বন্ধনে পরস্পরের সংগে বেঁধে দাও। ভারতের একটা ধুলিকণা হয়ে আমাকে গর্ব করার সুযোগ দাও, যে ধুলিকণা আবার জেগে উঠবে। পূর্ণ স্বাধীনতায় আবার যে উড়ে বেড়াতে পারবে।
.
শেষকথা
আমার ব্যক্তিগত চিন্তা ও দর্শনের সার সংক্ষেপ এ বইয়ে তুলে ধরেছি। আমার মনে পড়ছে ইন্টারনেট থেকে একবার একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটি রূপক। মাতৃগর্ভে থাকা দুটি চরিত্র অহঙ্কার ও তেজস্বী আত্মার কথোপকথনে লেখা হয়েছে এ গল্পের কাহিনী।
তেজস্বী আত্মার নাম স্পিরিট আর অহঙ্কারের নাম ইগো। স্পিরিট ইগোকে বললো, আমি জানি একথা তোর বুঝতে কষ্ট হবে, কিন্তু তবু বলছি, শোন্– জন্মের পর কিন্তু আমাদের একটা নতুন জীবন শুরু হবে।
ইগো বললো, বোকার মত কথা বলবি না। তোর চারপাশে চেয়ে দ্যাখ। এখানে যা দেখছিস এটাই জীবন, এটাই বাস্তবতা। কেন মিছেমিছি এই বাস্তবতার বাইরে ভাবতে যা? এই জীবন নিয়েই সুখী হ।
ইগোর কথায় স্পিরিট খানিকক্ষণের জন্য দমে গেল, কিন্তু বেশীক্ষণের জন্য নয়। স্পিরিট বললো, দ্যাখ ইগো, তুই রাগ করিস না। আমার মনে হচ্ছে আমাদের মা বলে কিছু একটা আছে।
ইগো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, মা! একথা তুই ভাবছিস কি করে? তুই কোনদিন মাকে দেখিসনি, মা কী জিনিস তাও জানিস না! তোর এই জীবন নিয়ে কেন সুখী হতে পারছিস না? এখানে তুই আর আমি ছাড়া কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। এটাই তোর বাস্তব জীবন।
ইগো, স্পিরিট মরিয়া হয়ে বলে, খেয়াল করে শোন। মাঝে মাঝে দুজনই কি একধরনের চাপ অনুভব করি না? আমাদের ব্যথা লাগে। আমার ধারণা এটা আমাদের জন্ম নেবার পূর্বলক্ষণ। আমার মনে হয় আমরা শীগগিরই কোন নতুন জীবনে পা রাখতে যাচ্ছি। তখন আমরা আলো দেখতে পাব।
ইগো বললো, তুই কোনদিন আলো কী জিনিস তা দেখিসনি। তাহলে কেমন করে জানলি আলো দেখবো? এই পার্শ্বচাপ আর অন্ধকার আমাদের জীবনের অংশ। এটা মেনে নে। স্পিরিট ইগোকে বিরক্ত করতে চাইল না। আবার কথা না বলেও পারলো না। সে বললো, ইগো, আমার ধারণা এই পার্শ্ব-চাপ শেষ হবার পর আমরা শুধু আলোই নয় আমাদের মাকেও দেখতে পাব।
ইগো বললো, তোর মাথা সত্যিই গ্যাছে।
এ গল্পের উদ্ধৃতি দিয়ে আমি আমার দেশবাসীকে বলতে চাই তারা যেন স্বাধীনতার পর থেকে পঞ্চাশ বছরের এই প্রাপ্তি নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে বিভোর হয়ে না যায়। এ বই যখন লেখা প্রায় শেষ করে এনেছি তখন কেউ কেউ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। চেন্নাইয়ের প্রেসিডেন্সী কলেজের ১৫শ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রত্যেক জাতির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হবে এ বিষয়ে বক্তব্য দেবার পর জাতীয় উন্নয়ন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান, শিক্ষা লাভের উপায় বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে অসংখ্য প্রশ্ন করা হল। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হবার পর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী ঠেলাঠেলি করে আমার সংগে করমর্দন করছিল। যখন আমি তাদের মধুর উপদ্রব থেকে মুক্তি নিয়ে বের হতে যাচ্ছিলাম, তখন দেখলাম একটা ছেলে সবল হাতে ভীড় সরিয়ে দ্রুত আমার কাছে চলে এল এবং আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। চিরকুটটি আমি পকেটে রেখে দিলাম।
গাড়িতে বসে যেতে যেতে প্রেসিডেন্সী কলেজে জুলজিতে এমফিল পর্যায়ে অধ্যয়নরত টি, সরাভানানের চিঠিটা পড়লাম। তার চিঠি পড়ে আমি এত মানসিক শক্তি পেয়েছি যে চিঠিটা উল্লেখ না করে পারছি না। সরাভানান লিখেছে, প্রিয় স্যার, মহামহীরুহ বটবৃক্ষের শক্তি আর তার বীজের সুপ্ত দ্রুণবৃক্ষের শক্তি একই। এদিক থেকে আপনি এবং আমি এ দুজনের ক্ষমতাই সমান সমান। আমরা দুজনে আলাদা আলাদাভাবে আমাদের মেধার বিকাশ ঘটাচ্ছি।
সামান্য কিছু বীজ অঙ্কুরিত হয়ে বড় হয়ে ওঠে আর বেশীর ভাগ মারা যায়। প্রতিকূল পরিবেশ ও আবহাওয়ার কারণে বড় হতে না পেরে মারা যায়। কিন্তু তাদের শক্তি শেষ হয় না। তারা মরে গিয়ে সার হয় এবং ভবিষ্যত বৃক্ষটির শক্তিবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এভাবেই সে তার বিশালত্বের আকাক্ষার মাঝে বেঁচে থাকে। আপনি দেশের জন্য সারাজীবন কাজ করেছেন এবং বহু বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমিকদের সহায়তা করেছেন। আপনি কি মনে করেন তাদের এই কর্মদক্ষতা ও পরিশ্রম বিফলে যাবে না? এক্ষেত্রে আপনি তাদের কাছ থেকে কত শতাংশ সাফল্য আশা করেন?
ওই দিনই সরাভানানকে একটি জবাব লিখলাম,
প্রিয় সরাভানান,
আমি বেশ কয়েকবার তোমার চিঠি ও প্রশ্নটি পড়েছি। আমি দীর্ঘ কুড়ি বছর আইএসআরওতে কাজ করেছি। রকেট তৈরী, লঞ্চ ভেইকল এবং মিসাইল তৈরীর ব্যাপারে আরও কুড়ি বছর ডিআরডিওতে কাজ করেছি। আমি জীবনে বহু সাফল্য দেখেছি। কিছু ব্যর্থতার সম্মুখীনও আমাকে হতে হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে সাফল্য অর্জনের জন্য আমি অনেক বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার এবং টেকনিশিয়ানের সংগে কাজ করেছি। একতাবদ্ধ ওই দল ওই সাফল্য দেখেছে এবং ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে। আমারই এমন বহু শিক্ষানবীশ আজ জ্ঞানে ও মেধায় আমাকে ছাড়িয়ে গ্যাছে। এ আমার জন্য বড় আনন্দের।
সরাভানানের চিঠি আমাদের এক কঠিন দায়িত্বে ফেলে দিয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠদের বুঝতে হবে তাদের চেয়ে পরবর্তী প্রজন্ম অনেক বেশী মেধাবী ও এগিয়ে। তাদের এগিয়ে যাবার কোন বাধা সৃষ্টি করা নেতৃস্থানীয়দের জন্য শোভনীয় নয়। পরন্তু বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টা যেন ব্যর্থ না হয় সে চেষ্টা করতে হবে। বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদদের এই নতুন প্রজন্ম আকস্মিক ব্যর্থতায় যেন হতাশ না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও বড়দের।
আইডিতে আমাকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার শেষ প্রশ্নটি উল্লেখ করে আমি এ বইয়ের সমাপ্তি টানতে চাই। প্রশ্নটি ছিল, আপনার লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপনি কী কী প্রার্থনা করেন?
উত্তরে আমার শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাক্ষিদের সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমি দোআ করতে লাগলাম, হে সর্বশক্তিমান, আমার দেশের মানুষের মনে সৃজনশীলতা ও কর্মস্পৃহা দাও যাতে তারা একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারে।
বিভাজন ও ভেদাভেদের বিরুদ্ধে জনগণকে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমার দেশের ধর্মীয় নেতাদের সাহায্য কর।
আমাদের জননেতাদের মনে এই মন্ত্র গেঁথে দাও ব্যক্তির চেয়ে দেশ অনেক অনেক বড়।
হে আল্লাহ! আমার দেশের মানুষের কাজের ওপর রহমত বর্ষণ কর আর এ দেশকে উন্নত দেশে পরিণত কর।
আমার এ বার্তা চেন্নাই, পোরবন্দর, রাজকোট, জামশেদপুর, ভুবনেশ্বর, ডিঙ্গিগাল, অবু রোড, আনন্দ, উদিরপুর ও আরও বহু জায়গার প্রায় ৪০ হাজার স্কুল শিশুকে পৌঁছে দিয়েছি। আমি আগামী ২০০৪ সালের আগস্টের মধ্যে এ সংখ্যা ১ লাখে নিয়ে যেতে চাই।
যেদিন এদেশের হাজার হাজার তরুণের এ প্রার্থনাবাণী ভারতের আকাশে বাতার্সে ধ্বনিত হবে, সেদিনই আমরা ভারতবর্ষকে উন্নত দেশ হিসেবে দেখতে পারবো।
.
যৌবনের গান
আমি আর আমার ভারতবর্ষ
ভারতের এক তরুণ নাগরিক হিসেবে
প্রযুক্তি, জ্ঞান আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ
আমি উপলব্ধি করি, ক্ষুদ্র লক্ষ্য একটা অপরাধ।
আমি কাজ আর পরিশ্রম করব এক মহান লক্ষ্য নিয়ে,
ভারতকে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্য
মূল্যায়ন পদ্ধতিযুক্ত অর্থনৈতিক শক্তি হবে যার ভিত্তি।
আমি কোটি কোটি নাগরিকের একজন,
এ লক্ষ্যই পারে কোটি মানুষের অন্তরে আলো জ্বালাতে।
এটা প্রবেশ করেছে আমার মধ্যে,
যে-কোনও শক্তির তুলনায় আলোকিত অন্তর
আকাশ-পাতাল-পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় শক্তি।
উন্নত ভারত–এ লক্ষ্য অর্জনে
জ্ঞানের প্রদ্বীপ আমি জ্বালিয়ে রাখব চিরদিন।