আমাদের পরিচালিত শক্তির অভাব রয়েছে। আমি মনে করি, আমরা সুদীর্ঘ সময় ধরে হীনমন্যতায় ভুগে তাকে এখন এক বিশাল বিষবৃক্ষে পরিণত করেছি। আমার মনে হচ্ছে ভারতবর্ষকে যে বিষয়টি তিলে তিলে ধ্বংস করে ফেলছে তা হলো আমাদের পরাজয়প্রবণ নির্জীব শক্তি। এ মুহূর্তে আমাদের সবচে বেশী প্রয়োজন সাহসী ও তেজোদীপ্ত স্পৃহা। আমাদের প্রয়োজন এমন স্পৃহা যা সূর্যের নিচের এই ভোলা পৃথিবীর বুকে আমাদের নায্য অধিকারের জায়গায় আসীন করবে। প্রয়োজন এমন শক্তির যা আমাদের নিজেদেরকে চিনতে শেখাবে আর গৌরবময় এক সভ্যতার উত্তরসূরী হিসেবে এই গ্রহের নায্য ঠিকানায় আমাদের পৌঁছে দেবে। যদি সত্যিই আমরা সেই দুর্দমনীয় শক্তিকে জাগ্রত করতে পারি, তাহলে পৃথিবীর কোন শক্তিই আমাদের ঈপ্সিত গন্তব্যে পৌঁছবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
বিজ্ঞানের বাইরের অন্যান্য সম্মানজনক ক্ষেত্রের মহান ব্যক্তিত্বরাও একইভাবে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
খুব লক্ষনীয় ব্যাপার হলো সংগীত জগতের তিন সাধক, ত্যাগরাজা সায়গল, মাথুস্বামী দিক্ষিদার ও শ্যাম শাস্ত্রীগল ওই একই সময় দক্ষিণ ভারতের মাত্র ৫০ কিলোমিটার বৃত্তায়তনের এলাকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। আমাদের খেয়াল করতে হবে ওই সময়ে ভারতে কলা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, ইতিহাস ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভুবনবিখ্যাত কিছু পুরুষের জন্ম হয়েছিল যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি শক্তি যুগিয়েছেন।
এই নিকট সম্প্ৰতিতেও আমরা বড় বড় বিজ্ঞানীদের আবির্ভূত হতে দেখেছি।
বিশেষ করে তিনজন বিজ্ঞানীর জীবনী আমাকে সবচে বেশী টানে– ডক্টর ডি, এস, কোটারি, ডক্টর হোমি জে, ভাভা এবং ডক্টর বিক্রম সারাভাই। জাতীয় উন্নয়নে সহায়ক তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রের নেতৃত্বপূর্ণ গুণাবলী সম্পর্কে জানতে আমি বহুবার আগ্রহী হয়েছি। এই তিন বিজ্ঞানী ভারতের তিনটি বিশাল প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছিলেন ডিআরডিও, ডিএই এবং আইএসআরও।
ডক্টর ডি.এস. কোটারি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত একজন সুবিখ্যাত পদার্থবিদ ও জ্যোতিবস্তুবিদ্যা বিশারদ। গ্রহের মত শীতল ঘনীভূত কোন কিছুর দিকে বেতার তরঙ্গকে চাপের মাধ্যমে নামিয়ে আনা বা আয়োনাইজেশন (lonization)র সূত্র আবিষ্কারের জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিত।
ডি.এস, কোটারির এ থিওরিটি ছিল তার গুরু ড. মেঘনাদ সাহার আবিষ্কৃত নবযুগের সূচনাকারী তাপসংক্রান্ত আয়োনাইজেশন থিওরির এক পূরক সূত্র। ১৯৪৮ সালে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উপদেষ্টা নিযুক্ত হবার পর কোটারি ভারতের প্রতিরক্ষা কাজে বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বনের রীতি চালু করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতে তিনি প্রথম ডিফেন্স সায়েন্স সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন যাতে প্রতিরক্ষা বিভাগ সেখানে বৈদ্যুতিক বিষয়াদি, পারমাণবিক ওষুধপত্র ও ব্যালিস্টিক সায়েন্সের ওপর গবেষণা করতে পারে। তাকে একারণে ভারতের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ভারতীয় বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে তার সম্মানে একটি খালি চেয়ার রেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের ওপর গবেষণা করতেন ডক্টর ভাভা। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি মহাজাগতিক রশ্মি সম্পর্কিত গবেষণা করেন। ১৯৩৯ সালে ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত IIScতে স্যার সি. ভি. রমনের সংগে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করলেন। পরবর্তীতে তিনি গড়ে তোলেন টাটা ইন্সটিটিউট অব ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চ। এখানকার গবেষণার মূল বিষয় ছিল গণিত ও পরমাণু বিজ্ঞান। ১৯৪৮ সালে তিনি গড়ে তোলেন অ্যাটোমিক অ্যানার্জি কমিশন। তার মূল লক্ষ্য অনুযায়ী আরও বেশ কয়েকটি পরমাণু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হল যেখানে পরমাণু বিদ্যুত উৎপাদন অথবা পারমাণবিক ওষুধপত্র আবিষ্কারের গবেষণা শুরু হল।
এই বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি কেন্দ্রের জন্ম দিল যেখানে পরমাণু বিজ্ঞানকেই মূল গবেষণার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
এই তিনজনের মধ্যে বয়সে সবচে তরুণ ছিলেন ডক্টর সারাভাই। তিনি স্যার সি. ভি. রমনের সংগে পরীক্ষামূলক মহাজাগতিক রশ্মির ওপর গবেষণা করতেন। সারাভাই আহমেদাবাদে প্রতিষ্ঠা করেছেন ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি যেখানকার মূল গবেষণার বিষয় হলো স্পেস। ১৯৬৩ সালে বায়ু মণ্ডলীয় গবেষণার জন্য তার প্রতিষ্ঠিত থাম্বা ইকুয়েটরিয়াল রকেট লাঞ্চিং স্টেশন থেকে রকেট উৎক্ষেপন শুরু হয়। ডক্টর সারাভাই স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান স্যাটেলাইট রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা আইএসআরও। এ প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধানে এখন নভোযান ও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করা হচ্ছে, অভিযানগুলো ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করা হচ্ছে।
এই তিন ভারতীয় বিজ্ঞানী সবাই ছিলেন পদার্থবিদ। তারা পদার্থবিদ্যার গবেষণাস্থল হিসেবে যে সকল প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন আজ সেগুলো প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, পারমাণবিক প্রযুক্তি ও স্পেস প্রযুক্তির গবেষণা মন্দির হিসেবে বিকশিত হয়েছে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা প্রতিষ্ঠানে এখন প্রায় ২ হাজার বিজ্ঞানী গবেষণা করছেন।