সবাই চলে যাবার পর গ্লস্টার বলল কেন্টকে, আমি অবশ্য ডিউককে অনুরোধ করব তার এই অন্যায় খেয়ালের পরিবর্তনের জন্য।
না স্যার, আপনি করবেন না, বলল কেন্ট, এই সুযোগে আমি কাটিয়ে দেব পথের ক্লান্তি।
গ্লস্টার চলে যাবার পর আপন মনে বলতে লাগল কেন্ট, হে মুখ, আমার এ চিঠি পাঠ করতে সাহায্য করুক তোমার প্রখর কিরণ রাশি। আমি কর্ডেলিয়াকে বিশদভাবে জানিয়েছি আমার সমস্ত কার্যকলাপ। আশা করছি যে কোনও মুহূর্তে তিনি এসে উদ্ধার করবেন আমাদের মহান রাজাকে। হে আমার দুনিয়ন, দীর্ঘদিনের পথশ্রমে তোমরা যে ধ্বস্ত ও ক্লাস্ত তা আমি জানি। এবার সময় এসেছে তোমাদের ভালোমতন বিশ্রাম নেবার। হে সৌভাগ্যের দেবী, তুমি আমাদের উপর বুলিয়ে দাও তোমার প্রসন্ন দৃষ্টি।
ঘরে ঢুকে পাগলের মতো বিড়বিড় করে বলতে লাগল এডগার, ভাইকে বিশ্বাস করে আজ আমার এই অবস্থা। পলাতক আসামীর মতো ঘৃণ্য পোশাকে,গরিবের মতো নগ্নপদে, রুক্ষ, অবিন্যস্ত চুল নিয়ে, গাছের কোটরে দিন যাপন করে, ছদ্মবেশে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাকে। আমার অবস্থােটা সেই গরিবভিখারি টম টার্লিগদের মতো, যারা নিরাশ্রয়–পরের উপর নির্ভরশীল। তাদেরও কিছু মূল্য আছে, কিন্তু আমার তাও নেই।
আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন রাজা লিয়ার, এতক্ষণে তো আমার অনুচরদের এখানে এসে যাবার কথা, অথচ তুমি বলছি কাল রাতেই হঠাৎ এ বাড়ি ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে আমার মেয়ে-জামাই। হঠাৎ তার চোখে পড়ল বন্দি অবস্থায় সামনে দাঁড়ান কেন্টকে। বিস্মিত হয়ে তিনি বললেন, এরূপ নির্মমভাবে কে তোমায় বন্দি করেছে?
বিদূষক বলল, এ ধরনের যন্ত্রণাদায়ক কাঠের লাগাম কেবল পরানো হয় ঘোড়ার মাথায় কুকুর, ভালুকের গলা নতুবা রাজদ্রোহীর পায়ে।
লিয়ার জানতে চাইলেন, বল, কে তোমায় আটকে রেখেছে। এ অবস্থায়?
কেন্ট উত্তর দিলে, প্ৰভু, সে অপরাধী আপনার মেয়ে-জামাই।
লিয়ার বললেন, না, না, এ কখনই হতে পারে না। ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বলছি, এরূপ ভয়ংকর কাজ করার সাহস তাদের কখনই হবে না।
কেন্ট বলল, হে প্ৰভু, আপনার প্রতি শ্ৰদ্ধা নিয়েই বলছি, তারাই করেছে এ কাজ।
লিয়ার বললেন, হায় ভগবান! এত মানুষ খুন করার চেয়েও জঘন্য কাজ। আমি তো তোমায় পাঠিয়েছিলাম। শুধু একটা চিঠি পৌঁছে দিতে। কিন্তু তুমি এমন কী করেছ যার জন্য তারা এই কঠিন
কেন্ট বলল, আমার চিঠি পাবার পর পরই গনেরিলের পক্ষ থেকে একজন দূত এসে তাকে চিঠি দিল একটা। দ্বিতীয় চিঠিটা পড়ার পরই আমার প্রতি চরম অবজ্ঞা দেখিয়ে তিনি চলে গেলেন ঘোড়ায় চড়ে। ওরা চলে যাবার পর আমি লোকটাকে চিনতে পেরে রাগের মাথায় তলোয়ার বের করে হত্যা করতে যাই ওকে। ওর চিৎকার শুনে আপনার মেয়ে-জামাই ফিরে এসে এই কঠিন শাস্তি দিয়েছেন আমায়।
বাবার টাকা-পয়সা কমে যাবার সাথে সাথে সস্তানের ভালোবাসাও ওঠা-নমা করে–বলল বিদূষক।
গভীর দুঃখে ভেঙে পড়ল রাজার লিয়ারের মন। দুঃখের সাথে তিনি বললেন, তোমরা দুজনে শান্ত হও। এভাবে অস্থির করে তুলোনা আমায়! আমি মিনতি করছি, তোমরা দুজনে শান্ত হও। কিন্তু আমার মেয়ে কোথায় গেল কেন্ট? বলে ফিরে গেলেন তিনি। তিনি ফিরে যাবার পর কেন্ট উৎসুক হয়ে বলল বিদূষককে, আচ্ছা, রাজার অন্যান্য অনুচরেরা কোথায় গেল?
বিদূষক হেঁয়ালি করে বলল, একটা পিঁপড়েও শীতকালে কাজ করে না। যার চোখ আছে রাস্তায় সে কখনও সোজাসুজি হাঁটে না। আর যে বুদ্ধিমান, সে কখনও পাহাড়ের ঢালু পথ বেয়ে নেমে আসা চাকার গতি রোধ করে সহজে বিপদে পড়তে চায় না। আর লোভী ও স্বার্থপর লোকেরা বিপদের গন্ধ পেলেই বন্ধুকে ত্যাগ করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু আমি তো সামান্য একজন বিদূষক মাত্র। কাজেই সে পথ যারা অনুসরণ করেছে তারা আমার পক্ষে উপযুক্ত নন।
এ কথা শুনে চমৎকৃত হয়ে বললেন কেন্ট, ভারি সুন্দর তোমার উপমাগুলি।
গ্লস্টারের সাথে একত্র ঢুকে আপন মনে বলতে লাগলেন লিয়ার, মিথ্যে কথা, অসুস্থতার ভান করে তারা বিদ্রোহ করেছে আমার বিরুদ্ধে। এবার বলে দাও আমি কী করব?
উঃ এত বড়ো অকৃতজ্ঞ ওরা! বলে দাও গ্লস্টার, রিগান আর কর্নওয়ালকে— আমার হুকুম, তারা যেখানেই থাকি যেন এখানে চলে আসে। আর সেই রাগী ডিউককেও বলে দিও, সে যেন এই রাগী বৃদ্ধ স্নেহময় সম্রাটের আদেশ অবিলম্বে পালন করে, নইলে.। তারপর যে কী ভেবে তিনি বললেন, না, না, আমি একী বলছি! হয়তো সে সত্যিই অসুস্থ। আর এত সবাই জানে যে মানুষ অসুস্থ হলে তার পূর্বের স্বভাবের কিছু পরিবর্তন হয়। কাজেই আমার মেজাজকে সংবরণ করে আমি অপেক্ষা করব তাদের সুস্থতার জন্য।
এরপর হঠাৎ কেন্টের দিকে তাকিয়ে পালটে গেল। লিয়ারের মনোভাব–হায় কী নির্বোধি আমি।আমার এই বৃদ্ধ ভূত্যের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছি,ইচ্ছাকৃত ভাবে চলে গেছে তারা। পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক এটা তাদের একটা চাল। কে আছ, ডিউক ও তার স্ত্রীকে শীঘ্ৰ ডেকে নিয়ে এস এখানে। তারা স্বইচ্ছায় না এলে, আমি নিজে গিয়ে তাদের টেনে আনিব এখানে।
আপনি এত উত্তেজিত হবেন না প্ৰভু। আমি যাচ্ছি—বলে চলে গেলেন গ্লস্টার।
লিয়ার বলতে লাগলেন, হে আমার মন! এত সহজেই তুমি ধৈর্যহারা হয়ে চঞ্চল করে তুলো না। আমাকে। রাজা লিয়ার করুণ মিনতি জানাচ্ছে তোমার কাছে, তুমি শান্ত হও, থামো।