Site icon BnBoi.Com

ঈগল ইন দ্য স্কাই – উইলবার স্মিথ

ঈগল ইন দ্য স্কাই - উইলবার স্মিথ

ঈগল ইন দ্য স্কাই

১. হল্যান্ডের পর্বতমালা

ঈগল ইন দ্য স্কাই – উইলবার স্মিথ / অনুবাদ : জেসি মেরী কুইয়া

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

এই উপন্যাসটা লেখার সময় আমি একাধিক লোকের কাছ থেকে মূল্যবান সহযোগিতা পেয়েছি। মেজর ডিক লর্ড আর লেফটেনান্ট পিটার কুক যুদ্ধ বিমানের প্রযুক্তি এবং কৌশলগত নানা বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। ড. রবিন স্যানডল এবং ড. ডেভিড ডেভিস চিকিৎসা বিদ্যার নানা খুঁটিনাটি তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। শৌখিন মৎস্য শিকারি রেভারেন্ড অব রেডরাপ বইটির নাম বাছাই করতে সাহায্য করেছেন।

আমি তাদের সবার কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। ইস্রায়েলের অনেক নাগরিক আমাকে সাহায্য এবং আতিথিয়তা দিয়ে কৃতজ্ঞতার বাঁধনে জড়িয়েছে। কিন্তু আমি দুঃখিত-তাদের সবার নাম এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না।

আর বরাবরের মতো আমার বিশ্বস্ত গবেষক দরকারি প্রয়োজনের মুহূর্তে সমালোচনা, সাহস আর স্বস্তি যুগিয়েছে। আমার সৎ ছেলে-তার পুত্র-ডিয়েটার স্মিডটকে বইটা উৎসর্গ করলাম।

.

তিনটি জিনিস আমাকে বিস্মিত করে তোলে,
বুঝতে পারি না চতুর্থটি :
আকাশে ঈগল,
পাথরের উপরে সাপ,
গভীর সমুদ্রে জাহাজ,
আর একজন পুরুষের সাথে কুমারী।

প্রবাদ, ৩০-১৮-২০

তুষারাবৃত হটেনটটস্ হল্যান্ডের পর্বতমালা থেকে বয়ে আসা বাতাসটুকু আর্তনাদ করতে লাগল হারিয়ে যাওয়া পশুর মতো। নিজের ছোট্ট অফিসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে প্রশিক্ষক। কূজো হয়ে ফ্লাইট জ্যাকেটের নোম দিয়ে বানানো পকেটে পুড়ে রেখেছে হাতের মুঠি।

দেখতে পেল লৌহ নির্মিত বিশাল হ্যাঙ্গারে নেমে এলো ড্রাইভার চালিত ক্যাডিলাক। নিগ্রো ড্রাইভার দেখে জাকুটি করে উঠল আনমনেই। সম্পদের ফাঁদে আটকা পড়ে বার্নি ভেন্টার সবসময়ে গভীর দ্বেষ অনুভব করে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে হ্যাঙ্গারের দেয়ালের বিপরীতে দর্শনার্থীদের জন্যে নির্ধারিত স্থানে পার্ক করা হলো ক্যাডিলাক। বালকসুলভ চপলতা নিয়ে পিছনের দরজা খুলে লাফ দিয়ে নামল এক বালক। নিগ্রো ড্রাইভারের সাথে সংক্ষিপ্ত বাক্যালাপ সেরে ত্রস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো বার্নির দিকে।

চলার মাঝে এমন একটা কিছু আছে যা সচরাচর কিশোরদের মধ্যে দেখা যায় না। লম্বা, ঋজু পদক্ষেপে এগিয়ে এলো ছেলেটি। এই তরুণ রাজকুমারকে এগোতে দেখে মনের মাঝে বিদ্বেষ ঘনীভূত হলো বার্নির। এসব আদরের পুটুলিদেরকে ঘৃণা করে সে আর দেখো এমনই ভাগ্য যে এদের সংস্পর্শে কাটাতে হয় দিনের বেশির ভাগ সময়। অসম্ভব বিত্তবানরাই কেবল ক্ষমতা রাখে সন্তানদের উড্ডয়নের রহস্য শেখানোর।

দু’বছর আগে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে, মেডিক্যাল টেস্টে অনুত্তীর্ণ হয় বার্নি। এর উপর নির্ভর করছিল সিনিয়র এয়ারলাইন ক্যাপ্টেন হওয়া। এখন সে নেমে যাচ্ছে পাহাড়ের অপর পাশে। সম্ভবত এর সমাপ্তি হবে গতানুগতিক উড়ে গিয়ে। ক্লান্ত হয়ে লাইসেন্সবিহীন নীতিবোধ বর্জিত চার্টার কোম্পানির বেতনভূক্ত কর্মচারী হিসেবে।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে গর্জন করে উঠল বার্নি, মাস্টার মরগ্যান, ঠিক বলছি কিনা?

‘ইয়েস, স্যার। কিন্তু আপনি আমাকে ডেভিড নামে ডাকতে পারেন। ছেলেটা হাত বাড়াতেই অভ্যাসবশে করমর্দন করল বার্নি–তৎক্ষণাৎ মনে হলো না করলেই ভালো হত। হাতটা শুকনো কিন্তু বজ্রকঠিন মুষ্টি।

‘ধন্যবাদ, ডেভিড। হতাশায় মুষড়ে গেল বার্নি। আর তুমি আমাকে “স্যার” ডাকতে পারো।

সে জানতো যে ছেলেটার বয়স চৌদ্দ। কিন্তু বার্নির পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি দেহের একেবারে মাথায় মাথায় ছেলেটার উচ্চতা। হাসল ডেভিড আর প্রায় সাথে সাথে তার শারীরিক সৌন্দর্যে চমকে উঠল বার্নি। মনে হলো স্বর্গীয় ভাস্কর নিজ হাতে সযতনে গড়েছেন ছেলেটার শরীরের প্রতিটি অংশ। পুরো প্রভাবটা মনে হলো অপার্থিব, নাটকীয়। মনে হলো হয়তো বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কোঁকড়া চুলের গাঢ় উজ্জ্বলতা, স্যাটিনের মতো ত্বক, গভীর চোখে আগুনের খেলা।

বার্নি সচেতন হয়ে খেয়াল করল যে সে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। এমনই মুগ্ধ হয়ে গেছে যে–তাড়াতাড়ি ঘুরে অন্য দিকে ফিরল।

‘এসো।’ পথ দেখিয়ে নিজের অফিসের দিকে হাঁটা ধরল বার্নি। দেয়ালে ঝুলছে মাছির ডিমে ভর্তি ন্যড ক্যালেন্ডার আর হাতে লেখা কয়েকটা নোটিশ।

‘ওড়াউড়ি সম্পর্কে কিছু জানো? হ্যাঙ্গারের শীতল বিষাদের মাঝে ঢুকতে ঢুকতে ডেভিডকে প্রশ্ন করল বার্নি। লম্বা সারিতে পড়ে আছে এয়ারক্রাফট সমূহ। দরজা দিয়ে বের হতেই হালকা শীতের উজ্জ্বল রোদে চোখ ধাঁধিয়ে গেল।

‘কিছুই না, স্যার।’ সত্যি কথা স্বীকার করল ডেভিড। ঠিক হতে শুরু করল বার্নির মুড।

‘কিন্তু শিখতে চাও?

“ওহ্, হ্যাঁ স্যার। জোরাল উত্তরে ফিরে তাকাল বার্নি। ছেলেটার চোখ এত গাঢ় যে প্রায় কালোই বলা চলে। শুধুমাত্র সূর্যের আলো পড়লেই গাঢ় নীল হয়ে ওঠে।

‘ঠিক আছে–চললো শুরু করি। সামনেই কংক্রিটের উপর অপেক্ষা করে আছে এয়ারক্রাফট। এটা একটি সেসনা ১৫০ হাই-উইং মনোপ্লেন। চারপাশে ঘুরে চেক্ করতে লাগল বার্নি। অনুগত ছাত্রের মতো অনুসরণ করছে ডেভিড। কিন্তু কন্ট্রোল আর লিফট এবং উইং-ললাডিং সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে বলা শুরু করতেই বার্নি টের পেল যে ছেলেটা মোটামুটি ভালোই জানে। বার্নির প্রশ্নের উত্তরে ডেভিড একেবারে ঠিকঠাক জবাব দিয়েছে।

‘তুমি এ ব্যাপারে পড়াশোনা করেছে, মন্তব্য করল বার্নি।

‘হ্যাঁ, স্যার।’ হেসে উত্তর দিল ডেভিড। দাঁতগুলো অদ্ভুত রকম সাদা আর সমান সারিতে বসানো। হাসি থেকে চোখ ফেরানো দায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বার্নি বুঝতে পারল যে সে ছেলেটাকে পছন্দ করা শুরু করেছে।

‘রাইট, চলো ঢুকে পড়ি।

ছোট্ট ককপিটে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসে বার্নি ব্যাখ্যা করল কন্ট্রোল আর ইনস্ট্রমেন্ট সম্পর্কে, এরপর চালানোর পালা।

‘মাস্টার, সুইচ অন করো।’ লাল বোতামে চাপ দিল সে। ঠিক আছে, এবার এই চাবি–ঠিক একটা গাড়ি চালানোর মতো।

সামনে ঝুঁকে নির্দেশ মতো কাজ করল ডেভিড। ইঞ্জিন চালু হয়ে খানিক লাফালাফি করে অবশেষে নিয়মিত স্বরে গর্জন শুরু করল। ধীরে চলা শুরু করতেই রাডারস্ আর ফাইনাল চেক্ করা শিখে নিল ডেভিড। এরপর রেডিওর কাজ দেখে রানওয়েতে চলা শুরু করল প্লেন।

‘রাইট, রানওয়ের শেষ মাথায় কোন কিছুর প্রতি মনোযোগ দাও। একে নিশানা করে থ্রটল খুলে দাও আস্তে করে।

মেশিনের গতি দ্রুত হয়ে উঠল। দূরে বেড়ার দাগ বরাবর এগিয়ে চলল দ্রুত।

আস্তে আস্তে হুইলে ফিরে এসো।’ আর উপরে উঠে গেল তারা। মাটি থেকে শূন্যে।

‘ধীরে বৎস, ধীরে’, জানাল বার্নি।

কন্ট্রোলে জমে যেও না। এভাবে তার সাথে আচরণ করো’থেমে গেল সে। এতদিন পর্যন্ত এয়ারক্রাফটকে একজন নারীর সমতুল্য মনে করতো। কিন্তু উপলব্ধি করল এবারের যাত্রায় এর অসামঞ্জস্য। মনে করো এটি একটি ঘোড়া। হালকা চালে দৌড়াও।

বুঝতে পারল হুইলের উপর থাকা ডেভিডের হাত আলগা হয়ে গেল। নিজের কন্ট্রোলেও একই কাজ করল সে।

‘এই, এই ডেভিড। আড়চোখে ডেভিডের দিকে তাকাল বার্নি। কিন্তু অসম্ভষ্টি দেখা দিল মনে। কেন যেন নিজের মাঝে একেবারে গভীরে মনে করেছিল যে এই ছেলেটা হয়তো একটা পাখি, ঠিক তার মতে, আকাশের নীল যার ঠিকানা। উড্ডয়নের প্রথম কয়েক মুহূর্ত জমোট বাঁধা ভয় লেপ্টে ছিল ছেলেটার চোখেমুখে। ঠোঁট আর নাকে সাদা মার্বেলের ছোঁয়া। গাঢ় নীল চোখে ছায়া; যেন নিচে গ্রীষ্মের সাগরে রয়েছে হাঙ্গরের দল।

‘বাম দিকের পাখা তুলে ফেলল। অসন্তুষ্ট বার্নি ডেভিডকে শান্ত করতে চাইল। উঠে এলো পাখা।

‘সমান করো তাকে’, নিজের হাত টেনে নিল বার্নি কন্ট্রোল থেকে। দিগন্ত বরাবর নাক সোজা করল প্লেন।

‘থ্রটল ব্যাক। ছেলেটা ডান হাতে টেনে দিল থ্রটল। আরো একবার তার দিকে তাকাল বার্নি। অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হয়নি। আর তখনই বার্নি বুঝতে পারল যে এটা ভয় নয়, আনন্দ। অত্যধিক আনন্দ।

‘ছেলেটা একটা পাখি, পাখিই। তৃপ্ত হলো বার্নি। কথাবার্তার মাঝে বার্নি ফিরে গেল ত্রিশ বছর আগে। মনে পড়ে গেল হলুদ একটা টাইগার মথের কথা, আর উড়ে যাবার জন্যে ছোট্ট একটা ছেলের আকুতির কথা।

কর্কশ নীল পর্বতমালার উপর দিয়ে উড়ে বেড়াল তারা। সূর্যের আলো পিছলে পড়ছে তুষারের গায়ে। পিছু ধাওয়া করল বন্য বাতাস।

বাতাস সমুদ্রেরই মতো, ডেভিড উপরে ঘুরে বেড়ায়–আর ভেঙ্গে পড়ে। এর দিকে খেয়াল রেখো। মাথা নাড়ল ডেভিড। কিন্তু পুরো মনোযোগ সামনের দিকে। অভিজ্ঞতার প্রতিটি মুহূর্ত আত্মস্থ করে নিচ্ছে সে।

উত্তরে শূন্য জমির উপর গিয়ে ঘুরে গেল এয়ারক্রাফট। ধরল ফিরতি পথ। নগ্ন গোলাপি জমি বাদামি ধোয়ায় আচ্ছন্ন। সোনালি শস্য কাটা হয়ে গেছে।

তাদের সামনে সাদা বালুতটে সমুদ্র ভেঙ্গে পড়েছে ক্রিমের সারি নিয়ে। আটলান্টিক এখানে ঠাণ্ডা সবুজ। বাতাসের তোড়ে ভাঁজ হয়ে সাদা হয়ে নৃত্যরত।

আবারো দক্ষিণে, উপকূলে সদ্য বালির উপর ছোট ছোট দেহ থেমে তাকিয়ে আছে উপরে তাদের দিকে, দক্ষিণে বিশাল পর্বতমালা, যেখানে থেমে গেছে ভূমি, এখান থেকে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে সবকিছু। বন্দরে গাদাগাদি ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে জাহাজের সারি। পর্বতমালার নিচে সাদা দালানগুলোর জানালার কাঁচে লেগে ঝলকাচ্ছে শীতের রোদ।

আরো একটা টার্ন। আত্মবিশ্বাসী আর নিশ্চিত হয়ে কোলের উপর হাত রেখে বসে রইল বার্নি। রাডার বার থেকে তুলে নিয়েছে পা। টাইগারবার্গের উপর দিয়ে এয়ারফিল্ডের দিকে এগিয়ে চলল প্লেন।

‘ও, কে। জানাল বার্নি। চলে এসেছি। টাচ ডাউনের পর ট্যাক্সিং করে হ্যাঙ্গারে এসে থামলো এয়ারক্রাফট। মিকস্কার কন্ট্রোলকে পুরো টেনে দিতেই ইঞ্জিন মরে গেল।

এক মুহূর্ত চুপচাপ বসে রইল দু’জনে। কেউই নড়লো না বা কথাও বলল না। দুজনেই বুঝতে পারল যে গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু ঘটেছে, যা একে অন্যকে বলা দরকার।

“ঠিক আছে? শেষপর্যন্ত জানতে চাইল বার্নি।

“ইয়েস, স্যার।’ মাথা নাড়ল ডেভিড। স্ট্র্যাপ খুলে দু’জনেই মাটিতে নেমে এসে দাঁড়াল। কোন কথা না বলে দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে হ্যাঁঙ্গার পার হয়ে অফিসে এলো। দরজার কাছে এসে থেমে গেল।

‘পরের বুধবার? জানতে চাইল বার্নি।

‘হ্যাঁ, স্যার।’ বার্নিকে ছেড়ে অপেক্ষারত ক্যাডিলাকের দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। কয়েক কদম গিয়ে থেমে গেল। খানিকটা দ্বিধা সত্ত্বেও ফিরে এলো আবার।

‘এর চেয়ে সুন্দর কোন কিছু এর আগে আর ঘটেনি আমার সাথে, লজ্জিত স্বরে জানাল ডেভিড। ধন্যবাদ, স্যার।’ তাড়াতাড়ি আবার চলে গেল সে। পিছনে তাকিয়ে রইল বার্নি।

গতির ঝড় তুলে চলে গেল ক্যাডিলাক। গাছের ভিড়ে শেষ দালানটার পেছনে বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল। খানিকটা শোকাভিভূত হয়ে মাথা নাড়ল বার্নি। ফিরে গেল অফিসে। প্রাচীন সুইভেল চেয়ারে ধপ করে বসে ডেস্কের উপর জোড়া পা তুলে দিল। প্যাকেট থেকে একটা দোমড়ানো সিগারেট বের করে সোজা করে জ্বালিয়ে নিল।

‘সুন্দর?’ হেসে নিজেও স্বীকার করল। ক্র্যাপ!’ ময়লার ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলল ম্যাচ বক্স। নিশানা ব্যর্থ হলো।

.

টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল মিটজি মরগ্যানের। বালিশের নিচে থেকে বের হয়ে অন্ধের মতো হাতড়াতে লাগল শব্দের উৎস।

‘লো।

‘মিটজি?

‘হাই ড্যাড, তুমি আসছো? বাবার গলা শুনে ঘুম ভেঙে অর্ধেক জেগে উঠল মিজি। মনে পড়ে গেল আজ তাদের পরিবারের সাথে হলিড়ে হোমে যোগ দেবার কথা বাবার।

‘সরি, বেবি। একটা ঘটনা ঘটেছে। আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত আসতে পারব না আমি।’

“ওহ ড্যাড!’ নিজের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করল মিটজি।

‘ডেভি কোথায়? আর কোন অভিযোগ শোনার আগে তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করল মিটজির বাবা।

“ওকে, বলব তোমাকে ফোন করতে?

‘না, আমি অপেক্ষা করছি। ওকে ডেকে দাও বেবি।

বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়াল মিটজি। হাত দিয়ে চাইল চুলগুলোকে খানিক আঁচড়ে নিতে। উস্কোখুস্কো চুল এমন হয়ে আছে যেন সূর্যের আলো অথবা লবণাক্ত পানি বা ঝড়ো বাতাস বয়ে গেছে এগুলোর উপর দিয়ে। তার চেয়েও বাজে দেখাচ্ছে ছোট ছোট তিল। নিজের উপর অসন্তুষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল সে।

‘তোমাকে দেখাচ্ছে একটা পোকার মতো’, উঁচুস্বরে নিজেকে শোনাল  মিটজি, ‘একটা মোটাসোটা ছোট্ট পোকা….তিলওয়ালা। পরিবর্তনের সব চেষ্টা। ছেড়ে গায়ের উপর ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে নিল। ডেভিড তাকে এভাবে জিলিয়ন সময়ের চেয়েও বেশি বার দেখেছে। প্যাসেজে বের হয়ে এলো সে। বাবা মায়ের স্যুইট পার হয়ে এলো। মা এখন একা শুয়ে আছে সেখানে। বাসার লিভিং এরিয়ায় চলে এলো।

বাসা ভর্তি খোলা জায়গা, গ্যালারি, গ্লাস, স্টিল আর সাদা স্তম্ভ, সমুদ্রতটের কাছে বালিয়াড়ি থেকে উপরে উঠে গেছে। মিশে গেছে সমুদ্র আর আকাশের সাথে। গ্লাস শুধুমাত্র আলাদা করে রেখেছে। প্রভাতের অদ্ভুত আলোয় ভরে আছে চারপাশ।

প্লে-রুমের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে গত রাতের পার্টির নিদর্শন সমূহ, বিশজন অতিথি আর বালিয়াড়ির পাশে বড় হলিডে হোমস্ থেকে আগত সমান সংখ্যক জন ছাড়িয়ে গেছে নিজেদের সীমা-বিয়ার ফেলেছে, যত্রতত্র ছড়িয়েছে অ্যাশট্রে আর সিগারেটের মোড়ক।

আবর্জনার মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে অতিথি কক্ষের গোলাকার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল মিটজি। ডেভিডের দরজা চেক্ করে দেখল খোলা, ঢুকে পড়ল ভেতরে। বিছানা একেবারে নিপাট ভাঁজ হলেও চেয়ারের উপর পড়ে আছে ডেনিম আর ভেজা শার্ট। জুতো জোড়াও ফেলে রাখা হয়েছে অনাদরে।

হেসে ব্যালকনিতে পা বাড়ালো মিটজি। সমুদ্রতট থেকে অনেক উপরে ঝুলে আছে এটি। ঠিক গাংচিলদের বরাবর, ইতিমধ্যে রাতের বেলা সমুদ্রে ভেসে আসা পরিত্যক্ত আবর্জনা আর খাদ্যাবশেষের সন্ধানে উড়তে শুরু করেছে তারা।

দ্রুত গাউন তুলে কোমরে পেঁচিয়ে নিল মিটজি। ব্যালকনির রেইলে উঠে পাশের ব্যালকনির রেইলে লাফ দিল। নিচে নেমে পর্দা সরিয়ে ঢুকে পড়ল ম্যারিয়নের বেডরুমে।

ম্যারিয়ন ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। গোপনে গোপনে সে জানে যে এই আনন্দময় সম্পর্কের পেছনে কাজ করেছে ম্যারিয়নের পুতুলসুলভ সৌন্দর্যের জন্যে মিজির উপহার, পার্টি, ফ্রি হলিডে আর অন্যান্য আরো অনেক কিছু।

ঘুমের মাঝেও অসম্ভব সুন্দরী দেখাচ্ছে ওকে। নরম সোনালি চুল ছড়িয়ে আছে ডেভিডের বুকে। মিটজি মনোযোগ দিল নিজের কাজিনের দিকে। অনুভব করল বুকের মাঝ থেকে পেট পর্যন্ত নেমে গেল মোলায়েম একটা অনুভূতি। ডেভিডের বয়স এখন সতেরো। কিন্তু ইতিমধ্যেই পূর্ণাঙ্গ পুরুষে রূপান্তরিত হয়েছে সে।

মনে মনে ভেবে দেখল যে ডেভিডই ছিল পুরো পৃথিবীতে তার সবচেয়ে পছন্দের জন। ও এতো সুন্দর, এত লম্বা, ঋজু, সুন্দর আর চোখ জোড়া তো হৃদয়কে ভেঙ্গে দিতে পারে।

রাতের উষ্ণতায় নিজেদের চাদর একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল জোড়া দেহ। ডেভিডের বুকে দেখা যাচ্ছে ঘন, গাঢ় আর কোঁকড়া চুল। পেশীবহুল হাত-পা, চওড়া বুক।

‘ডেভিড, আলতো স্বরে কাঁধ ঝাঁকালো মিটজি। ওঠো।

চোখ মেলে তাকাল ডেভিড। জেগে উঠল তৎক্ষণাৎ। হয়ে উঠল সচেতন।

‘মিটজি? কি হয়েছে?

‘প্যান্ট পড়ে নাও, বাছা। পাপা লাইনে তোমার অপেক্ষায়।

‘গড। উঠে বসল ডেভিড। বালিশে ফেলে দিল ম্যারিয়নের মাথা।

কয়টা বাজে?

‘অনেক। উত্তর দিল মিজি। তোমার উচিৎ অ্যালার্ম সেট করে ঘুমানো।

বিড়বিড় করে চাদরের খোঁজে হাত বাড়ালো ম্যারিয়ন।

‘ফোন কোথায়?

‘আমার রুমে–কিন্তু তুমি তোমার এক্সটেনশন লাইনে কথা বলতে পারো।

ব্যালকনির রেলিং টপকে ডেভিডের পিছুপিছু তার রুমে এলো মিটজি। শুটিসুটি মেরে উঠে বসল ডেভিডের বিছানায়। রিসিভার তুলে নিয়ে এক্সটেনশন কর্ডের সাথে ঘন কার্পেটের উপর অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করল ডেভিড।

‘আংকেল পল? কথা বলল ডেভিড। কেমন আছো তুমি?

গাউনের পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট খুঁজে পেল মিটজি। সোনালি ডানহিল দিয়ে আগুন ধরালো। কিন্তু তৃতীয় বার টান দিতেই হাঁটা থামিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল ডেভিড। হেসে মিজির দুঠোঁটের ফাঁক থেকে সিগারেট নিয়ে টান দিল গভীরভাবে।

ডেভিডের নগ্নতা তার উপর কী প্রভাব ফেলেছে লুকোতে চাইল মিটজি। আরেকটা সিগারেট খুঁজে নিল নিজের জন্য।

‘ও মরে যাবে আমি কী ভাবছি জানতে পারলে। মনে মনে বলল মিটজি। খানিকটা আনন্দ পেল এ ভাবনা থেকে।

কথা বলা শেষ করল ডেভিড। ফিরে তাকাল মিটজির দিকে।

‘সে আসছে না।

‘আমি জানি।

‘কিন্তু বার্নিকে পাঠাচ্ছে আমাকে তুলে নিতে।

এর মানে মাথা নেড়ে পিতাকে অবিকল অনুকরণ করল মিটজি।

‘তোমার ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদেরকে ভাবতে শুরু করতে হবে এখন, মাই বয়। নিয়তি তোমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে তার জন্যে প্রশিক্ষণ দিতে হবে তোমাকে।

বিড়বিড় করতে করতে ড্রয়ার হাতড়াতে লাগল ডেভিড রানিং শর্টসের খোঁজে।

‘আমার মনে হয় এখন তাকে বলা উচিৎ আমার।

হ্যাঁ। মিজি ও একমত হলো।

‘তোমার অবশ্যই তা করা উচিত। শর্টস পরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড।

‘আমার জন্যে প্রার্থনা করো ডল।

‘প্রার্থনার চেয়েও বেশি কিছু দরকার তোমার হে সৈনিক। আয়েশ করে বলল মিটজি।

সমুদ্রের ঢেউ এসে বেলাভূমিকে মসৃণ করে রেখে গেছে। এত সকালে আর কারো পা পড়েনি এখানে। স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে দৌড়ানো শুরু করল ডেভিড। পেছনে রেখে গেল ভেজা পায়ের ছাপ।

সমুদ্রের উপর গোলাপি আভা ছড়িয়ে উদয় হলো সূর্য। অটেনিকা পর্বতমালা স্পর্শ করতেই উড়তে লাগল ধোয়া কিন্তু কিছুই দেখল না ডেভিড। অভিভাবকের সাথে সম্ভাব্য সাক্ষাৎকারের ভাবনায় চিন্তিত সে।

জীবন এখন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়েছে। হাই স্কুল শেষ হয়েছে। সামনে তাই অসংখ্য খোলা পথ। সে জানে যে সে যে পথ বেছে নিতে চায় তার বিরোধিতা করবে সবাই। তাই এই শেষ কয়েক ঘণ্টা নিজের সংকল্প দৃঢ় করে নিতে চাইল মনে মনে।

একটা মৃত মাছের উপর ঝাক বেঁধে বসে আছে সামুদ্রিক পাখির দল। ডেভিড কাছে আসতেই উড়ে গেল মেঘের কাছে। সূর্যের কাছাকাছি গিয়েই ডেভিড জায়গাটা পার হতেই আবারো ফিরে এলো আগের জায়গায়।

লিয়ার জেটের শব্দ শোনার আগে এটাকে উড়ে আসতে দেখল সে। সূর্যোদয়ের বিপরীতে নিচ দিয়ে উড়ে এসে প্রায় নিঃশব্দে ডেভিডের কাছে এগিয়ে আসতে লাগল।

থেমে গেল ডেভিড। দীর্ঘক্ষণ দৌড়ানোর পরেও হালকাভাবে শ্বাস ফেলে দু’হাত মাথার উপর তুলে অভিবাদন করল। দেখতে পেল বার্নিও তাকে দেখে মাথা ঘুরিয়ে হেসে হাত তুলে প্রতিউত্তর জানাল।

লিয়ার প্রায় সমুদ্রে গিয়ে পড়ল। একটা পাখা প্রায় ঢেউয়ের মাথা ছুঁয়ে দিল। এরপর ফিরে এলো ডেভিডের কাছে। ডেভিড শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লিয়ারের স্টিলের নাক নিচু হতে হতে মনে হলো বর্শার মতো এগিয়ে আসতে লাগল তার দিকে।

ভয়ঙ্কর শিকারি পাখির মতন এসে থামলো তার পাশে। একেবারে শেষ মুহূর্তে ডেভিডের ধৈর্য ভেঙ্গে ভেজা বালিতে পড়ে গেল সে। লিয়ার উঠে নাক ঘুরিয়ে শুকনো এয়ারফিল্ডের দিকে চলে গেল।

‘সন অব আ বিচ’, বিড়বিড় করতে করতে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। নগ্ন বুক থেকে ঝেড়ে ফেলতে লাগল ভেজা বালি। মনে ভেসে উঠল বার্নির হাসি মুখ।

‘ভাল শিক্ষা দিয়েছি ওকে,’ ভাবল বার্নি, লিয়ারের কো-পাইলটের সিট থেকে দেখল ডেভিডকে।

মরগ্যানদের অন্ন ভোজনের পর থেকে ওজন বাড়তে শুরু করেছে বার্নির। বেল্টের উপর দিয়ে লজ্জিত ভাবে উঁকি দিচ্ছে মেদ। মুখটাও চওড়া হয়ে ঝুলে পড়ছে নিচের দিকে। মাথা ঢেকে রাখা টুপির আশপাশ দিয়ে রুপালি ঝলক দেখা যাচ্ছে।

ডেভিডকে উড়তে দেখে ছেলেটার জন্যে আবারো স্নেহ অনুভব করল বার্নি। তিন বছর ধরে মরগ্যান গ্রুপের চিফ পাইলটের দায়িত্ব পালন করছে সে। আর ভালো ভাবেই জানে যে কার তদারকিতে এটা হয়েছে। এখন তার সম্মান এবং নিরাপত্তা উভয়ই আছে। আরামদায়ক মেশিনে বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের নিয়ে উড়ে বেড়ায় সে। জানে নিজের জন্যেও চিন্তা নেই। মরগ্যান গ্রুপ নিজেদের খেয়াল রাখে।

এই জ্ঞান পাকস্থলিতে জমে যাবার সাথে সাথে খেয়াল করল তার শিষ্য জেট চালাচ্ছে নির্বিঘ্নে। এভাবে উড়ে যেতে পুরো মনোযোগ দরকার পড়ে। আর ছেলেটার চোখের তারায় এর কোন অভাব দেখল না বার্নি।

তাদের নিচে সমান্তরালে পড়ে আছে আফ্রিকার দীর্ঘ সোনালি সমুদ্রতট। মাঝে মাঝে পাথরের বাড়ি, ছোট রিসর্ট, মাছ ধরার গ্রামগুলো উপকূলরেখা ধরে এগিয়ে চলেছে লিয়ার জেট।

সামনে পড়ে আছে আরো একটা সমুদ্রভূমি। কিন্তু নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ায় দেখতে পেল এ তটে মানুষের অভাব নেই।

একজোড়া নারী দেহ সার্ক করতে এগিয়ে গেছে। হাই ওয়াটার মার্কের কাছে পড়ে থাকা তোয়ালে আর বিকিনির দিকে দৌড় লাগাল দ্রুত। কফি ব্রাউন ট্যান্ড চামড়ার সাথে অসামঞ্জস্য ঠেকল সাদা পশ্চাৎদেশের, আনন্দিত ভঙ্গিতে হাসল তারা।

‘তাদেরকে এভাবে দৌড়ে যেতে দেখাটা তোমার জন্যে ভালোই হলো ডেভিড।’ ছোট শরীরগুলো পেছনে ফেলে আসতেই হাসল বার্নি। উড়ে চলল দক্ষিণে।

কেপ আগুলহাস থেকে স্থলভূমিতে প্রবেশ করল তারা। পর্বতমালার উপর দিয়ে খাড়া উঠে গিয়ে থ্রটল হালকা করল ডেভিড। শহরের উপর দিয়ে এগিয়ে গেল ধীরগতিতে।

পাশাপাশি হেঁটে হ্যাঙ্গারে যেতে যেতে বার্নি খেয়াল করল ডেভিড এখন তার চেয়ে ছয় ইঞ্চি উঁচু।

‘ও যাতে তোমাকে ভয় দেখাতে না পারে, মাই বয়। সতর্ক করে দিল বানি। তুমি তোমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। দেখো যেন এর নড়চড় না হয়।’

ডেভিড নিজের ব্রিটিশ রেসিং সবুজ এম.জি নিয়ে দে ওয়াল ড্রাইভে উঠে এলো। পর্বতের উপর থেকে নিচে শক্তি আর সম্পদের অন্যান্য নিদর্শনের মাঝে চারকোনা মরগ্যান বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

বাইরে থেকে দেখলে একে পছন্দ করে ডেভিড। পরিষ্কার এবং কার্যকরী–ঠিক যেন একটা এয়ারক্রাফটের পাখা। কিন্তু স্বাধীনতার ব্যাপারটা প্রহেলিকা। এটা একটা দুর্গ আর জেলখানা।

নিজের রেসিং কার নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে তাকিয়ে দেখল টাওয়ারের মতো মরগ্যান বিল্ডিংয়ের কাঠামোকে। এরপর র‍্যাম্পে উঠে গেল, যেখান থেকে পথ চলে গেছে নিচে আন্ডার গ্রাউন্ড গ্যারেজে।

একটু পরেই প্রবেশ করল এক্সিকিউটিভ অ্যাপার্টমেন্টে টপ ফ্লোর। পাশ কাটিয়ে গেল ডেস্কের লম্বা সারিতে বসে থাকা বাছাই করা সুন্দরী ও দক্ষ টাইপ রাইটারদের। প্রত্যেককে অভিবাদন জানাল ডেভিড। সুন্দর মুখগুলোতে হাসি ফুটে উঠল, যেন একসাথে ফুটে আছে বাগানের প্রতিটি ফুল। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে মরগ্যান বিল্ডিংয়ের মাঝে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ডেভিড।

অভ্যন্তরীণ অংশের রক্ষক মার্থা গুডরিখ নিজের অফিসে টাইপরাইটার থেকে মুখ তুলে তাকাল। কঠিন আর বিজনেস লুক।

‘সুপ্রভাত মিস্টার ডেভিড। আংকেল অপেক্ষা করছেন আপনার জন্যে আর আমার মনে হয় আপনার একটা স্যুট পরে এলে ভালো হতো।

‘তোমাকে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছে মার্থা। ওজন কমেছে আর তোমার চুলের ধরনটাও বেশ ভালো দেখাচ্ছে। কাজ হয়েছে, যেমনটা সব সময় হয়। মার্থার অভিব্যক্তি নরম হয়ে গেল।

‘আমাকে তেল দেবার চেষ্টা না করাই ভালো। সতর্ক করে দিল মার্থা।

পল মরগ্যান জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল নিচে মানচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকা শহরের দিকে। কিন্তু ডেভিড ঢোকামাত্র ঘুরে তাকাল তাকে অভিবাদনের জন্যে।

‘হ্যালো, আংকেল পল। আমি দুঃখিত, চেঞ্জ করার সময় পাইনি। মনে হয়েছে সরাসরি আসাই ভালো।

“ঠিক আছে, ডেভিড। নাভী পর্যন্ত উন্মুক্ত ডেভিডের ফুলের নকশা করা শার্ট, চওড়া লেদার বেল্ট, সাদা টিলা পাজামা আর ভোলা স্যান্ডেলের উপর চোখ বুলিয়ে নিলো পল মরগ্যান। ভালোই দেখাচ্ছে ছেলেটাকে, মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো পল। এরকম অদ্ভুত আধুনিক কাপড়েও ভয়ঙ্কর লাবণ্যময় লাগছে তাকে।

‘তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। নিজের গাঢ় রঙের সনাতন কাটের স্যুটের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে ভ্রাতুস্পুত্রের দিকে তাকাল মরগ্যান।

‘এসো, বসো। এখানে, ফায়ার প্লেসের কাছের চেয়ারে। সব সময়কার মতো খেয়াল করে দেখল তার নিজের যেটার কমতি আছে তাই আছে ছেলেটার উচ্চতা। খাটো পলের কাঁধ বেশ ভারী, সুগঠিত, মোটা পুরুষালি ঘাড় আর চৌকোনা মাথা। মেয়ের মতই তারও চুল নিকৃষ্ট, তারের মতো আর তার দৈহিক কাঠামোও কুমড়া ও পশুর মতো।

প্রায় সব মরগ্যানই এরকম। কিন্তু ডেভিডের অভিজাত অবয়ব এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছে। নিঃসন্দেহে সে তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে এহেন সৌন্দর্য। গাঢ় চুল আর উজ্জ্বল চোখ জোড়া আর এর পাশাপাশি দীপ্তিময় চলনবলন।

‘ওয়েল ডেভিড, প্রথমেই আমি তোমাকে অভিবাদন জানাতে চাই, তোমার ফাইনাল রেজাল্টের জন্যে। আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। গভীরভাবে বলে উঠল পল মরগ্যান, এছাড়াও আরো যোগ করতে পারতো-চিন্তা দূর হয়েছে এতে। ডেভিড মরগ্যানের শিক্ষার্থী জীবন ভরে আছে প্রবল সব ঝড়ে। অসম্ভব ভালো সাফল্যের পাশাপাশি এমন সব কদর্য কাণ্ড ঘটিয়েছে সে যে মরগ্যান পদবী আর সম্পদই একমাত্র পরিত্রাণ ছিল এক্ষেত্রে। গেমস মাস্টারের তরুণী স্ত্রীর। সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল সে। কতটুকু সত্যি জানে না পল, কিন্তু ভেবেছে এ ব্যাপারটার মসৃণ সমাপ্তির জন্যে বিদ্যালয়ের চ্যাপেলে অনুদান আর বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেমস্ মাস্টারের জন্যে স্কলারশিপ হতে পারে চমৎকার পদক্ষেপ। এর পরপরই ডেভিড গণিতে জিতে নেয় ওয়েসেলস প্রাইজ। তাই ভুলে যাওয়া হয় সবকিছু–যতক্ষণ পর্যন্ত না ডেভিডের ইচ্ছে হয় হাউজমাস্টারের নতুন স্পোর্টস কার পরীক্ষা করে দেখার। ভদ্রলোকের অজ্ঞাতে ঘণ্টায় নব্বই মাইল বেগে চালানো হয় এটি। বলাবাহুল্য, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি গাড়িটা। ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে কব্জিতে কাটা দাগ সমেত বের হয়ে আসে ডেভিড। পল মরগ্যানের সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগেই কেবলমাত্র হাউজমাস্টারের রাগ প্রশমিত হয়। এর সাথে আরো যুক্ত হয় নতুন দামী মডেল কার আর মরগ্যান গ্রুপ ইস্ট হাউজের স্নানের অংশকে নতুন করে তৈরি করতে আর্থিক অনুদান প্রদান করে।

পল ভালো করেই জানে যে ছেলেটা বন্য প্রকৃতির আর এটাও জানে যে একমাত্র সেই তাকে বশ মানাতে পারবে। আর তাহলেই হয়ে উঠবে ক্ষুরধার অস্ত্র। পল মরগ্যান তার উত্তরাধিকারীর মাঝে যেসব গুণ দেখতে চায় তার সবগুলোই বিদ্যমান ডেভিডের মাঝে। জ্যোতি আর আত্মবিশ্বাস, উজ্জ্বল, দ্রুত মস্তিষ্ক, অভিমানপ্রিয়তা–কিন্তু সবকিছুর উপরে হলো তার দুর্ধর্ষ মনোভাব, প্রতিযোগিতার স্পৃহা, যেটা পলের মতে খুনীর মনোভাব।

‘ধন্যবাদ, আংকেল পল’, চিন্তিত মনে আংকেল পলের অভিবাদন গ্রহণ করল ডেভিড। নিঃশব্দে একে অন্যকে মেপে দেখছে। দুজন দুজনের সাথে কখনোই সহজ হতে পারে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রেই একে অপরের ঠিক বিপরীত আবার কিছু ক্ষেত্রে পুরোপুরি এক রকম। সবসময় তাই মনে হয় যে দু’জনের পছন্দ পরস্পরের সাথে যুদ্ধে নেমেছে।

পল মরগ্যান এগিয়ে গেল জানালার কাছে। তাই পেছন থেকে আলো ছড়াতে লাগল সূর্য। এটা তার একটা বেশ পুরোনো কৌশল, অপরপক্ষ পড়ে যায় অস্বস্তিতে।

‘এমন না যে আমরা তোমার কাছ থেকে এর চেয়ে কম আশা করি।’ হাসল পল মরগ্যান, উত্তরে ডেভিডও হাসল। স্বীকার করল যে আজকাল সহজ হয়ে গিয়েছে।

‘আর এখন ভাবতে হবে তোমার ভবিষ্যত নিয়ে। বলে উঠল পল মরগ্যান, শীঘ্রি পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। যদিও আমার মনে হয় আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা বিজ্ঞান আর আইন-ই হবে উপযুক্ত। এই স্পষ্ট লক্ষ্যের কথা মাথায় রেখে আমি আমার পুরোন কলেজে তোমার ভর্তির ব্যাপারে প্রভাব খাঁটিয়েছি।’

‘আংকেল পল, আমি উড়তে চাই। নরম স্বরে বলে উঠল ডেভিড। থেমে গেল পল মরগ্যান। অভিব্যক্তি খানিকটা পরিবর্তন হয়ে গেল।

‘তুমি তোমার পেশাগত জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিচ্ছ মাই বয়। কোন আমোদ সম্পর্কে আলোচনা নয়।’

‘না, স্যার। আমি বলতে চেয়েছি যে আমি উড়তে চাই–জীবনের পথে।

‘তোমার জীবন এখানে-মরগ্যান গ্রুপ। এটি এমন কিছু নয় যে তোমার কাজের স্বাধীনতা আছে।’

‘আমি আপনার সাথে একমত নই, স্যার।

জানালা ছেড়ে ফায়ার প্লেসের কাছে গেল পল মরগ্যান। হাতে একটা সিগার তুলে নিয়ে ডেভিডের দিকে না তাকিয়েই কথা বলা শুরু করল নরম স্বরে।

তোমার বাবা বেশ রোমান্টিক ধাঁচের ছিল ডেভিড। এটা পেয়েছিল প্রথার বাইরে গিয়ে মরুভূমিতে ট্যাংক নিয়ে ঘুরে বেড়নোর সময়ে। মনে হচ্ছে। উত্তরাধিকার সূত্রে এই রোমান্টিসিজম পেয়েছো তুমি। এমন ভাবে বলল যেন কোন অসহ্যকর রোগ। ফিরে এলো যেখানে ডেভিড বসে আছে।

‘আমাকে বলল তোমার প্রস্তাব কী?

‘আমি এয়ারফোর্সে নাম লিখিয়েছি স্যার।

করে ফেলছো? সাইন করে ফেলেছা?”

‘হ্যাঁ, স্যার।’

কত দিন?

‘পাঁচ বছর। শর্ট সার্ভিস কমিশন।

‘পাঁচ বছর’ ফিসফিস করল পল মরগ্যান। ওয়েল ডেভিড, জানি না কী বলব। তুমি জানো তুমিই শেষ মরগ্যান। আমার কোন পুত্র নেই। তাই এই বশাল কর্মযজ্ঞে আমাদের কোন প্রতিনিধি না থাকাটা অতীব দুঃখের ব্যাপার হবে। আমি ভাবছি তোমার বাবা থাকলে কী ভাবতেন

‘এর কোন মানে হয় না, আংকেল পল।’

‘আমার তা মনে হয় না, ডেভিড। আমার মনে হয় তুমি প্রতারণা করছে। মরগ্যান শেয়ারে তোমার ট্রাস্ট ফান্ড একটা বিশাল বাধা। এছাড়া আছে অন্যান্য সম্পত্তি। তোমার দায়িত্ব আর কর্তব্য নিয়ে ভাবছো না তুমি’

যদি সে চিৎকার করতো তবেই, ভয়ঙ্কর ভাবে ভাবল ডেভিড, জানে যে বার্নি যেমনটা বলেছে তাকে ভয় দেখানো হচ্ছে। যদি সে আমাকে এটা করতে বলতো তবেই আমি তাকে বলতাম এটা ঠেলে ফেলে দিতে। কিন্তু সে জানে যে দক্ষ লোকের পাল্লায় পড়েছে সে। এমন এক মানুষ যে সারা জীবন ধরে মানুষ আর অর্থ দিয়ে অনর্থ ঘটিয়েছে। যার হাতে সতেরো বছর বয়সী একটা বালক ময়দার তাল ছাড়া আর কিছুই নয়।

‘দেখো ডেভিড, এর মাঝেই তোমার জন্ম। অন্য যে কোন কিছু হবে কাপুরুষোচিত, আত্মমর্যাদা লঙ্ঘন’ শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে গেছে মরগ্যান গ্রুপ। কোন একটা মাংশাসী গাছের মতে, গিলে ফেলবে, হজম করে ফেলবে। –তোমার ভর্তির কাগজ হাওয়া করে দেয়া কোন ব্যাপারই না। মাত্র একটা ফোন কল’ই এক্ষেত্রে যথেষ্ট।

‘আংকেল পল, প্রায় চিৎকার করে উঠল ডেভিড, চেষ্টা করছে শব্দের স্রোত বন্ধ করে দিতে।

‘আমার বাবা। সেও এটা করেছিল। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল।”

‘হ্যাঁ, ডেভিড। কিন্তু সময় তখন ভিন্ন ছিল। আমাদের একজনকে যেতেই হতো। ও ছিল ছোেট–আর অবশ্যই ব্যক্তিগত কারণও ছিল। তোমার মা এক মুহূত থেমে গিয়ে আবারো বলে চলল,—আর যখন এটা শেষ হয়েছে তখন ফিরে এসে এখানে নিজের সঠিক দায়িত্ব পালন করেছে। আমরা তাকে এখন মিস্ করি ডেভিড। তার শূন্যস্থান পূরণ করার ক্ষমতা কারো নেই। আমি সবসময় আশা করি তুমি হয়তো তা পারবে।

কিন্তু আমি তা চাই না। মাথা নাড়াল ডেভিড। আমি আমার জীবন। এখানে অপচয় করতে চাই না। চারপাশের ম্যামথের সুবিশাল গ্লাস আর ইট, কাঠের কাঠামো দেখিয়ে বলল, আমি প্রতিটি দিন কাগজের স্তূপের উপর উবু। হয়ে কাটাতে চাই না’

‘এটা এমন নয়, ডেভিড। এটা বেশ চমকপ্রদ, চ্যালেঞ্জিং, পরিবর্তনশীল–’

‘আংকেল পল।’ আবারো গলার স্বর উঁচুতে উঠে গেল ডেভিডের।

‘এমন কোন লোককে তুমি কী বলবে যার পেট ভরে আছে ভালো খাবারে তার পরেও সমানে খেয়ে চলেছে?

শান্ত হও, ডেভিড। প্রথমবারের মতো বিরক্ত শোনাল পল মরগ্যানের কণ্ঠস্বর। অধৈর্য ভাবে একপাশে ঠেলে দিল প্রশ্নটা।

কী বলবে সে মানুষটাকে? আবারো জোর করল ডেভিড।

‘আমার মনে হয় তুমি তাকে পেটুক বলবে। উত্তর দিল পল মরগ্যান।

‘আর এমন কোন লোককে কী বলবে যার কোটি কোটি অর্থ থাকার পরেও জীবন কাটাচ্ছে আরো তৈরির আশায়?

পাথরের মতো জমে গলে পল মরগ্যান। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল নিজের রক্তের দিকে উত্তর দেবার আগে।

‘তুমি উদ্ধত হয়ে উঠছে। অবশেষে বলে উঠল পল মরগ্যান।

না, স্যার। আমি এটা বোঝাতে চাইনি। তুমি পেটুক নও–কিন্তু আমি হয়তো হয়ে যাবো।

ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের ডেস্কের কাছে গেল পল মরগ্যান। পিছনে অত্যাধিক উঁচু চামড়ার চেয়ারে বসে অবশেষে আগুন ধরালো সিগারে। আবার দীর্ঘ সময় ধরে চুপ করে রইল দুজনে। অবশেষে কথা বলল পল মরগ্যান।

তুমি ঠিক তোমার বাবার মতোই করবে। কিন্তু কীভাবে আমি তোমার পাঁচটা বছর বাঁচাবো অপচয়ের হাত থেকে।

‘অপচয় হবে না আংকেল পল। আমি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হয়ে ফিরব।’

‘আমার মনে হয় এ এতটুকু নিয়েই খুশি থাকতে হবে আমাদেরকে। ডেভিড উঠে আংকেলের চেয়ারের পাশে দাঁড়াল।

‘ধন্যবাদ। আমার জন্যে এটাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

‘পাঁচ বছর, ডেভিড। এরপর তোমাকে চাই আমি।’ এরপর হেসে খানিকটা কৌতুক করল পল মরগ্যান, ‘অন্তত তোমার চুল কাটবে তারা।

উষ্ণ মাংসের মতো রঙের পৃথিবী থেকে চার মাইল উপর দিয়ে তরুণ দেবতার মতো স্বর্গের দিকে উড়ে চলল ডেভিড মরগ্যান। হেলমেটের সূর্য প্রতিরোধক অংশ বন্ধ। তাই চোখের রহস্যময় দৃষ্টি ঢেকে আছে। মিরেজ প্লেনে উড়ে চলে যে শক্তির আবেগ আর বিচ্ছিন্ন হবার উদগ্র বসানা জেগে উঠেছে, তা থেকে পাঁচ বছর কিছুতেই টলাতে পারেনি তাকে।

এয়ারক্রাফটের উপর সরাসরি পড়ছে সূর্যের আলো। নিচে পৃথিবীর উপরে নেকড়ের মতো বাতাসের তাড়া খেয়ে মেষের মতো উড়ে চলেছে মেঘের দল।

আজকের ফ্লাইটে কেমন একটা মন খারাপ ভাব, বিষণ্ণতা মিশে আছে। আগামীকাল তার শেষ দিন। দুপুর বেলায় কমিশন শেষ হয়ে যাবে আর যদি পল মরগ্যান চায় তাহলে সে হয়ে যাবে মিস্টার ডেভিড-মরগ্যান গ্রুপের নতুন বালক।

চিন্তাকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে চাইল শেষ মুহূর্তের এই মূল্যবান মিনিটগুলো উপভোগ করতে। কিন্তু আবেশ কেটে গেল শীঘ্রিই।

জুলু স্ট্রাইকার ওয়ান, রেঞ্জ কন্ট্রেল থেকে বলছি। তোমার পজিশন রিপোর্ট করো।’

‘রেঞ্জ কন্ট্রোল, জুলু স্ট্রাইকার ওয়ান বলছি, রেঞ্জ পঞ্চাশ মাইল। স্ট্রাইকার ওয়ান, রেঞ্জ পরিষ্কার। তোমার টার্গেট চিহ্ন আট এবং বারো। উড়ে চলো সামনে।

হঠাৎ করে মিরেজের নাকের সামনে দিগন্ত বদলে গেল।

ডেভিড ডান হাতে দ্রুত উইপন সিলেক্টর প্যানেলের উপর এসে রকেট সার্কিট ল করে দিল।

সামনের দৃশ্য পুরোপুরি বৈচিত্র্যহীন। নিচু কাঁটা ঝোপে পূর্ণ মিরেজ নিচু করে আনায় পাখার মাথায় লাগছে। এ ধরনের উচ্চতায় গতি সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি। আর প্রথম টার্গেট চিহ্নটা এসে প্রায় সাথে সাথে আবার রুপালি নাকের আড়ালে চলে গেল।

পাঁচ, ছয়, সাত-সাদা ভূমিতে কালো অক্ষরগুলো হারিয়ে গেল একে একে।

বামপাশে রাভারের উপর স্পর্শ আর লেগে থাকা, প্রতিটি কাজ হয়ে গেল অবচেতনে। সামনে রকেটের রেঞ্জের গোলাকার কাঠামো। এটিই ‘ কোক, উড্ডয়নের কলাকৌশলের কয়েকটা অর্থহীন শব্দের একটি, এটাই তাই টার্গেট।

ভয়ঙ্কর মেশিনটাকে দ্রুত আর নিচুতে নিয়ে এলো ডেভিড, ওর দণ্ড মিটার এমন একটা স্পিড রেকর্ড করল যা প্রায় সব সৈনিক পর্যায়ের। সরাসরি ট্র্যাকে থেকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল। কাছে আসতেই মিরেজের নাক গুতো দিল “পিচ আপ” অংশে। এরপর টার্গেটের উপর ট্রিগার টেনে দিল ডান হাতের অংশ।

কাঁপতে থাকা রূপালি মেশিনটা ঠিকঠিক নাক-নিচু করে রকেট চালানোর অলটিচ্যুড খুঁজে পেল একেবারে নির্দিষ্ট সময়ে। ডায়মন্ড আকৃতির রিফ্লেক্টর সাইটের একেবারে মাঝখানে দেখা গেল ‘কোক’ এর সাদা ধোঁয়া।

এ ধরনের বৈপ্লবিক কাণ্ড ঘটানোর জন্য নানা রকম দক্ষতা প্রয়োজন। স্প্রিং লোডে ট্রিগারে চাপ দিয়েছিল সে। এয়ারক্রাফটে বসে কোন কিছু বোঝা গেল না। জেটের গর্জনের নিচে রকেটের হিস্ শব্দটাও ঢেকে গেল। কিন্তু তার পাখার নিচ দিয়ে ধোয়ার লাইন টার্গেটে লাগাল। আর নিশ্চিন্তে ডেভিড থ্রটল টেনে দিল।

‘হোয়াইট আ ওয়ে টু গো।

উজ্জ্বল নীলে ভেসে গেল মিরেজের নাক। নিচের সিটে আরামে গা এলিয়ে বসল ডেভিড। হাসল। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি চাইছে তাকে সিটে ধরে রাখতে।

হ্যাল্লো, স্ট্রাইকার ওয়ান। রেঞ্জ কন্ট্রোল থেকে বলছি। একেবারে ঠিক ঠিক শুতে দিয়েছে নাক। এবার ডান পাশে। মানুষটাকে একটা কোক দাও। নাইস শ্যটিং। তোমাকে হারাতে খারাপ লাগছে ডেভি। রেঞ্জ ডিসিপ্লিন ছুঁয়ে গেল ডেভিডকে। ও অনেক মিস করবে–সবাইকে। নিজের জয়স্টিকের মাথায় লাগানো ট্রান্সমিট বাটনে চাপ দিল ডেভিড। কথা বলল হেলমেটের মাইক্রোফোনে স্ট্রাইকার ওয়ান থেকে বলছি, ধন্যবাদ আর বিদায়।’ ‘ওভার অ্যান্ড আউট।

গ্রাউন্ড ক্রুরাও ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। সবার সাথে হাত মেলালো সে। আজগুবি করদর্মন আর জঘন্য সব জোকস ঢেকে রেখেছে বছরের পর বছর ধরে তাদের মাঝে গড়ে ওঠা সত্যিকারের স্নেহকে। এরপর তাদেরকে ছেড়ে গায়ে গ্রীজ আর তেলের গন্ধ নিয়ে এয়ারক্রাফটের সারির ধাতব অংশ দিয়ে চলে এলো ডেভিড।

থেকে একটির ঠাণ্ডা শরীরে চাপড় দিল। আর্দালি এসে দেখল উঁচু টেইল প্লেনের গায়ে আঁকা ফ্লাইং কোবরার দিকে তাকিয়ে আছে ডেভিড।

‘সি.ও.র কমপ্লিমেন্টস স্যার, এখনি ওনার কাছে রিপোর্ট করুন।

কর্নেল রাসটাস নড শুকিয়ে যাওয়া কাঠের মতো একজন মানুষ। বানরের মতো চেহারা। গায়ের ইউনিফর্মে মেডেল আর রিবনের অদ্ভুত ছড়াছড়ি। তিনি ব্যাটেল অব ব্রিটেনে হারিকেন, ইটালিতে মুসটাঙস, প্যালেস্টাইনে স্পিটফায়ার আর মেসারম্মিট ১০৯ আর কোরিয়াতে স্যাবারস চালিয়েছেন। বর্তমান। দায়িত্বের পক্ষে তার বয়স বেশি হলেও কেউই সাহস করে তাকে একথা বলতে পারে না। কেননা স্কোয়াড্রনের অনেক তরুণ সৈন্যের চেয়েও দক্ষ পাইলট আর যোদ্ধা তিনি।

‘তো অবশেষে তুমি আমাদের ছেড়ে যাচ্ছো ডেভিড। অভিবাদন জানালেন কর্নেল।

‘মেস পার্টি পর্যন্ত নয়, স্যার।

হ্যাঁ। মাথা নাড়লেন কর্নেল। এই পাঁচ বছর আমার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছো তুমি। আমার কাছে এক বালতি হুইস্কি পাওনা আছে তোমার। ডেস্কের পাশে শক্ত গদিওয়ালা চেয়ার দেখালেন ডেভিডকে। বসো ডেভিড।

এই প্রথম ডেভিডের ডাক নাম ধরে ডাকলেন তিনি, পদবী নয়। ডেস্কের কর্ণারে ফ্লাইং হেলমেট রেখে চেয়ারে বসল ডেভিড, আঁটসাঁট জি-স্যুটে অস্বস্তি হচ্ছে।

সময় নিয়ে নিজের পাইপে ভয়ঙ্কর ম্যাগলিসবার্গ তামাক ভরলেন কর্নেল। মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে দেখতে লাগলেন বিপরীত প্রান্তে বসা তরুণটিকে। পল মরগ্যান যে গুণ দেখতে পেয়েছিল একই জিনিস লক্ষ্য করলেন কর্নেল রাসটাস। উদ্ধত আর প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব। একজন পাইলটের জন্য যা গুণ হিসেবে অনন্য।

অবশেষে পাইপ ধরিয়ে ঘন নীল ধোঁয়ার মেঘ ছেড়ে ডেস্কের উপর দিয়ে ডেভিডের দিকে ঠেলে দিলেন একতোড়া কাগজ।

‘পড় আর সাইন করো’, বললেন তিনি। এটা অর্ডার। দ্রুত কাগজগুলোতে চোখ বোলালো ডেভিড। এরপর মুখ তুলে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে হাসল।

‘আপনি এত সহজে ছাড়বেন না, স্যার।’ স্বীকার করল সে।

একটা দলিলে লেখা আছে ডেভিডের শর্ট সার্ভিস কন্ট্রাক্ট আরো পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে। অন্যটি পদোন্নতির দলিল ক্যাপ্টেন থেকে মেজর।

‘তোমাকে আজকের তুমি’তে তৈরি করার জন্য আমাদের অনেক সময় আর অর্থ অপচয় হয়েছে। তোমার মাঝে আছে কিছু অসাধারণ প্রতিভা, আর আমরা একে বাড়িয়ে উন্নত করেছি আমি শব্দের অপচয় করব না–তুমি, এখন পুরো দস্তুর পাইলট।

‘আমি দুঃখিত, স্যার।

সত্যি কথাই বলল ডেভিড।

‘ধুত্তোরি। রেগে উঠল রাসটাস।

কী দরকার ছিল তোমার মরগ্যান হয়ে জন্ম নেবার। এত অর্থ–তারা তোমার পাখা দুটোকে আটকে ডেস্কের সাথে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবে।’

‘এটা অর্থ নয়।’ তাড়াতাড়ি বাধা দিল ডেভিড। অনুভব করল নিজের রাগ মিশে গেল এ অভিযোগে।

মাথা নাড়ল রাসটাইস। হ্যাঁ।’ বলে উঠলেন তিনি। এই ব্যাপারটাকেও ঘৃণা করি আমি।’ ডেভিডের ফিরিয়ে দেয়া দলিল তুলে নিয়ে রেখে দিলেন কর্নেল। তোমাকে প্রলোভিত করার জন্য যথেষ্ট নয়, তাই না?

কর্নেল, এটা ব্যাখা করা বেশ কঠিন। আমার শুধু মনে হয় যে আরো বেশি কিছু আছে করার। গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা সম্পর্কে খোঁজ করতে হবে আমাকে আর এটা এখানে নয়। আমাকে এটার খোঁজে যেতে হবে।’

গভীরভাবে মাথা নাড়লেন রাসটাস। “ঠিক আছে, তাহলে আমি চেষ্টা করেছি। এখন তুমি তোমার বহুদিন ধরে কষ্ট করা কমান্ডিং অফিসারকে মেসে নিয়ে যাও আর মরগ্যান মিলিয়ন খরচ করে তাকে হুইস্কি দিয়ে ভরে তোলো। উঠে দাঁড়িয়ে ধূসর মাথায় চড়ালেন ইউনিফর্ম ক্যাপ। আজ রাতে তুমি আর আমি একসাথে মাতাল হবো। দুজনেই আমরা কিছু হারাচ্ছি। সম্ভবত তোমার চেয়ে আমি বেশি।

.

সব দেখে মনে হচ্ছে যে সুন্দর আর শক্তিশালী মেশিনের প্রতি ভালোবাসা ডেভিড পেয়েছে তার বাবার কাছ থেকে। ক্লাইভ মরগ্যান স্ত্রীকে নিয়ে নিজের নতুন কেনা ফেরারি স্পোর্টসকার চালিয়ে যাচ্ছিল একটা রসদ বোঝাই ট্রেনের পাশাপাশি। লেভেল ক্রসিংয়ের আলো ছিল নেভানো। ট্রাফিক পুলিশ হিসেব কষে জানিয়েছে যে সংঘর্ষের সময় গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় দেড়শ মাইল।

এগারো বছর বয়সী পুত্রের জন্য বিস্তারিত আর বিস্তৃত বন্দোবস্ত করে গেছে ক্লাইভ মরগ্যান। বাচ্চাটা তৎক্ষণাৎ চলে যায় চাচা পাল মরগ্যানের হেফাজতে। লালন-পালনের জন্য রাখা হয়েছে ট্রাস্ট ফান্ডের সিরিজ।

স্নাতক হবার পর ফান্ডের প্রথমটিতে ডেভিডের সরাসরি ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। যার আয় প্রায় একজন সুপ্রতিষ্ঠিত সার্জনের সমকক্ষ। এই দিনে পুরাতন সবুজ এম.জি.র জায়গা নেয় পাউডার নীল মাজেরাতি, সত্যিকারের মরগ্যান প্রথানুযায়ী।

তেইশতম জন্মদিনে কারো ভেড়ার র‍্যাঞ্চের মালিকানা, দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকায় ক্যাটেল র‍্যাঞ্চ আর জাবুলানি, সাবি স্যান্ড ব্লকে গেম, র‍্যাঞ্চ সমস্তই। চলে আসে তার হাতে। ট্রাস্টিরা এগুলো পরিচালনা করতে থাকে দক্ষ ভাবে।

পঁচিশ বছর জন্মদিনে দু’নম্বর ফান্ডের সুদও তার হাতে আসবে। এর পাশাপাশি দুটি বিশাল শহর-দালানের আলোচনাযোগ্য কাগজ ও পদবী– অফিস, সুপার মার্কেট কমপ্লেক্স, হাই-রাইজ হাউজিং প্রজেক্ট।

ত্রিশ বছর বয়সে পরবর্তী ফান্ডের পথ খুলে যাবে তার জন্য। প্রথম দুটি একত্রিত করলে যত বড় হবে ততটাই বড়। আর শুরু হবে মরগ্যান স্টকের প্রথম পাঁচটি তাকে দেয়ার প্রক্রিয়া।

এরপর থেকে প্রতি পাঁচ বছরে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত অন্যান্য ফান্ড খোলার পাশাপাশি মরগ্যান স্টকের অন্যান্য অংশও সে পেতে থাকবে। তাই সামনে পড়ে আছে সম্পদের পাহাড়, জমকালো বিত্ত, যেন সুস্বাদু খাবারের প্রদর্শনী, ফলে ক্ষুধাই মরে যায়।

দ্রুত দক্ষিণ দিকে ছুটে চলেছে ডেভিড। টারম্যাকে হিসহিস শব্দে গর্জে চলেছে মিশেলিন চাকা। ডেভিডের মনে বইছে চিন্তার ঝড়; এত সম্পত্তি; বিশাল স্বর্ণের খাঁচা, মরগ্যান গ্রুপ কোন প্রাগৈতিহাসিক দানবের মতো বিশাল মুখ হাঁ করে এগিয়ে আসছে তাকে গিলে খাবার জন্য। মনে হলো কোন জেলি ফিশের গহ্বরে যাবে সে। নিজের প্রাচুর্যের মাঝে বন্দী।

এহেন সম্ভবনায় মুষড়ে পড়ল ডেভিড। পেটের মাঝে কেমন শূন্য একটা অনুভব হলো।

আরো জোরে হোটতে লাগল মাজেরাতি। শক্তি আর গতির দ্বৈত মিশ্রণে শান্তি খুঁজতে চাইল। মন দিয়ে ছন্দের তালের মতো দ্রুত চালাতে লাগল। মাইলের মতই দ্রুত বেগে ঘণ্টাও পার হয়ে গেল। তাই দিনের আলো থাকতেই পৌঁছে গেল ক্লিফটন বীচ আর স্বচ্ছ সবুজ আটলান্টিকের দিকে মুখ করে থাকা মিটজির অ্যাপার্টমেন্টে।

বিশৃঙ্খল মিটজির অ্যাপার্টমেন্টে সবকিছুই প্রায় আগে মতই আছে। আগন্তুকদের জন্য খোলা আছে তার ঘর, যারা ওর দেয়া ড্রিংক পান করে, খাবার খায় আর কে কার চেয়ে বেশি উন্মাদ হতে পারে তার প্রতিযোগিতা করে।

প্রথম বেডরুমে ঢু মেরে ডেভিড দেখল অদ্ভুত একটা মেয়ে কোঁকড়া চুল। ছড়িয়ে ছেলেদের পাজামা পরে ঘুমিয়ে আছে বিছানায়, মুখে আবার বুড়ো আঙুল।

দ্বিতীয় রুমে ভাগ্য খুলে গেল তার। কেউ নেই। যদিও বিছনার অবস্থা যাচ্ছে-তাই আর কেউ একজন পাশের টেবিলের উপর নাশতার ডিম ফেলে চলে গেছে।

কাঁধের ব্যাগ বিছানার উপর রাখল ডেভিড। স্নানের জিনিসপত্র বের করে নিল। দ্রুত বেশবাশ বদলে পাশের সিঁড়ি যেটা ধাপে ধাপে নেমে গেছে সমুদ্রতটে, দৌড়ানো শুরু করল–প্রথম দিকে হালকা পায়ে; তারপর হঠাৎ করেই এত জোরে দৌড়াতে লাগল যেন ভয়ঙ্কর কোন জন্তু তার পিছু ধাওয়া করে আসছে। চতুর্থ বিচের শেষে যেখান থেকে শুরু হয়েছে পাথর, বরফ শীতল পানিতে নেমে গেল ডেভিড। বাকোভেন পয়েন্টের কিনার পর্যন্ত চলে এলো। খোলা হাতে সাঁতার কাটায় হাড় পর্যন্ত যেন জমে গেল ঠাণ্ডায়। তাই তীরে উঠে এলে দেখা গেল ও নীল হয়ে কাঁপছে। কিন্ত বিমর্ষতা কেটে গেল পুরোপুরি। আর মিটজির অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশে জগিং করার সময় আবারো উষ্ণ হয়ে উঠল শরীর।

বাথরুম জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মেয়েদের অন্তর্বাসের পাহাড় ছড়িয়ে তবেই স্নান শেষ করল ডেভিড। বের হতেই সামনের দরজা খুলে উত্তরের বাতাসের মতে এগিয়ে এলো মিটজি।

‘কোথায় ছিলে তুমি, ওয়ারিওর?’ দরজার গায়ে তাল বাজাচ্ছে মিটজি। আমি গ্যারাজে তোমার গাড়ি দেখেছি। বুঝতে পেরেছি তুমি এখানে এসেছে!’

‘এখানেই আছি, ডল। জানাল ডেভিড। দরজায় দাঁড়িয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল তারা। ওজন বেড়ে গেছে মিটজির। স্কার্টের ভাঁজ শক্ত হয়ে এঁটে আছে শরীরে। শরীর ভারী। বেগুনি সোয়েটারের নিচে যৌবন উঁকি দিচ্ছে। অবশেষে হার মেনেছে মায়োপিয়ার কাছে। ছোট্ট নাকের শেষ মাথায় বসে আছে মেটাল ফ্রেমের চশম। ইতস্তত ছড়িয়ে আছে চুল।

‘তুমি অনেক সুন্দর হয়ে গেছ।’ চিৎকার করে এগিয়ে এসে ডেভিডকে কি করল মিটজি। সোয়েটারে লেগে গেল ডেভিডের সাবান। সে অবস্থায় তাকে জড়িয়ে ধরল মিটজি।

‘ড্রিংক না কফি? জানাতে চাইল মিটজি। অ্যালকোহলের চিন্তায় বিবমিষা বোধ হলো ডেভিডের। কফিই ভালো হবে, ডল।

মগ ভর্তি কফি নিয়ে এসে বাথরুমের টয়লেট সিটে বসল মিটজি। বাথটাবে স্নানরত ডেভিড।

‘এবার বলল সবকিছু! আদেশ দিল মিটজি। কথার মাঝেই সুন্দরী কালো চুলের মেয়েটা ঢুকলো রুমে। এখনো পায়জামা পরিহিত অবস্থায় মুখে নিদ্রার আবেশ।

‘আমার কাজিন, ডেভিড। ও খুব সুন্দর তাই না? মিটজি পরিচয় দিল ডেভিডের। আর ও হো লিজ, ডেভিড।

কর্ণারে রাখা নোংরা ঝুড়ির উপর গিয়ে বসল মেয়েটা। আর এমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে যে সাবধান করে দিল মিটজি। ধীরে ডার্লিং। এখান থেকেও আমি টের পাচ্ছি যে তোমার ওভারি নাচানাচি করছে পিং পং বলের মতো।

কিন্তু মেয়েটা এমন চুপ করে আছে যে শীমিই তার অস্তিত্ব ভুলে কথা বলা শুরু করল ডেভিড আর মিটজি। হঠাৎ করে কোন ভূমিকা না করেই বলে উঠল সে, ‘পাপা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ঠোঁট চাটছে লতা পেঁচানো রাক্ষসের মতো। শনিবার রাতে তাদের সাথে ডিনার করেছিলাম আমি–এক কোটিরও বেশি বার তোমার নাম নিয়েছে। ওখানে টপ ফ্লোরে তোমাকে দেখাটা বেশ অদ্ভুত হবে। ধূসর রঙের স্যুট, সোমবার সকালের কনফারেন্স

হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়াল ডেভিড। গায়ে থেকে ঝরে পড়ছে পানি। সবেগে সাবান ঘসতে লাগল নিম্নাগ্নে। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েরা। কালো চুলের মেয়েটার চোখ দুটো এত বড় হয়ে গেল যেন সারা মুখে আর কিছু নেই।

আবারো বসে পড়ে গায়ে পানি দিল ডেভিড। বাথটাব উপচে পড়ছে পানি।

‘আমি যাচ্ছি না।’ ঘোষণা করল সে। নেমে এলো দীর্ঘ নীরবতা!

“মানে কী–তুমি যাচ্ছো না?’ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলে মিটজি।

‘এটাই। ব্যাখা করল ডেভিড।

‘আমি যাচ্ছি না মরগ্যান গ্রুপে।

‘কিন্তু তোমাকে যেতেই হবে!

কেন? জানতে চাইল ডেভিড।

‘ওয়েল, আমার কথার অর্থ যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে তুমি বাবার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলে এয়ারফোর্সের পড়াশোনা শেষে ফিরে আসবে।

না।’ জানাল ডেভিড। আমি কোন প্রতিজ্ঞা করিনি। সে এমনিতেই মেনে নিয়েছিল। এক মুহূর্ত আগে তুমি যেমন বলছিলে সোমবার সকালে কনফারেন্সে উজ্জ্বল উপস্থিতি–আমি জানি আমি এসব পারব না। আমার ধারণা আমার সম্পর্কে ভালোই জানা আছে সবার।’

‘তাহলে কী করবে তুমি? প্রথম শোকের ধাক্কা কাটিয়ে উঠল মিটজি। গালগুলো উত্তেজনায় হয়ে উঠল গোলাপি।

‘আমি জানি না। আমি শুধু জানি যে আমি অন্যদের অর্জন পাহারা দিতে পারব না। মরগ্যান গ্রুপ মানে আমি নই। এটা তৈরি করেছে পূর্বপুরুষ, বাবা আর আংকেল পল। এটা অনেক বড় আর বেশ ঠাণ্ডা

উজ্জীবিত হয়ে উঠল মিজি, উজ্জ্বল চোখে নিজের সম্মতি জানাল। বিদ্রোহের সম্ভাবনায় নেচে উঠল তার মন।

ডেভিড নিজেও এটা ভেবে গরম হয়ে উঠল। আমি আমার নিজের পথ খুঁজে বের করব চলার জন্য। আরো অনেক কিছু আছে করার। এর চেয়ে বেশি কিছু থাকতেই হবে।

‘হ্যাঁ, এত জোরে মাথা নাড়ল মিটজি যে আরেকটুকু হলে নাক থেকে চশমা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। তুমি ওদের মতো নও। কোন একটা এক্সিকিউটিভ স্যুইটে ঢুকিয়ে দিলে তুমি বোধ হয় মারাই যাবে।’

‘আমাকে এটা খুঁজে বের করতে হবে মিটজি। কোথাও না কোথাও নিশ্চয় আছে।

বাথটাব থেকে উঠে এলো ডেভিড। লাল-বাদামী বর্ণ ধারণ করেছে শরীর, ধোয়ার রেশ উঠছে শরীর থেকে। কথা বলতে বলতে টেরি রোব জড়িয়ে নিল গায়ে। মেয়েরাও তার পিছুপিছু বেডরুমে এসে বিছানার ধারে বসল পাশাপাশি। সানন্দে মাথা নেড়ে একমত হলো ডেভিডের স্বাধীনতা ঘোষণায়। আবারো বাদ সাধলো মিটজি।

বাবাকে কী বলবে তুমি? জানতে চাইল সে। ডেভিডের উত্তেজনা বাধা পেল এ প্রশ্নে। বুকের লোমে হাত রেখে ভাবতে লাগল সে। মনোযোগ দিয়ে অপেক্ষা করল মেয়েরা।

‘ও তোমাকে আবারও চলে যেতে দেবে না।’ সর্তক করে দিল মিটজি। ‘কোন যুদ্ধ ছাড়া।’

এই সংকটের মুহূর্তে সাহস উবে গেল ডেভিডের। আমি তাকে একবার বলেছি। আবার বলার তো দরকার নেই।

‘তুমি এমনিই দৌড় লাগাবে?’ আবারো জানতে চাইল মিজি।

‘আমি পালাচ্ছি না। আত্মমর্যাদা মাথায় রেখে বলে উঠল ডেভিড। বিছানার পাশের টেবিল থেকে ক্রেডিট কার্ডে ভর্তি শুয়োরের চামড়ার ফোল্ডার তুলে নিল।

‘নিজের ভবিষ্যত নির্ধারণের অধিকার নিশ্চয় আছে আমার। টেলিফোনের কাছে গিয়ে ডায়াল করা শুরু করল সে।

কাকে ফোন করছো?

‘এয়ালাইন।

কোথায় যাবে?

তাদের প্রথম ফ্লাইট যেখানে যায়।’

“ঠিক আছে। আমি তোমাকে কাভার দেবো।’ বিশ্বস্ত ভাবে ঘোষণা করল মিটজি। তুমি ঠিক কাজটাই করছে ওয়ারিওর।

‘এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ থাকতে পারে।’ একমত হলো ডেভিড। আমার রাস্তা–তাদের কথা বাদ দাও। আমি দেখে নেবো সবাইকে।

‘এ জন্য তোমার সময় আছে? দাঁত কিড়মিড় করল মিটজি। আর প্রথমবারের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় কথা বলে উঠল কালো চুলের মেয়েটা। একবারের জন্যও ডেভিডের উপর থেকে চোখ সরায়নি সে। আমি অন্যদের কথা জানি না, কিন্তু আমি কী প্রথম জন হতে পারি?

কানে টেলিফোনের রিসিভার নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল ডেভিড। অবাক হয়ে দেখল মেয়েটা অসীম আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।

শিপোল এয়ারপোর্টের কাঁচ ঘেরা হল থেকে বের হয়ে এলো ডেভিড। লোভীর মতো চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল নিজের মুক্তির পথ, কেউ তাকে খেয়াল করছে না দেখে আনন্দ নেচে উঠল মন। ঠিক তখনি কুনইতে হালকা স্পর্শ। ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল লম্বা আর হাসিমুখে এক ডাচ তরুণ তাকে দেখছে রীমলেস চমশার ফাঁক দিয়ে।

‘মি. ডেভিড মরগ্যান? হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল ডেভিড।

হল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ান স্টিভ ডেরিং থেকে আমি ফ্রেডরিক ভ্যান গেন্ট বলছি। হলান্ডে মরগ্যান শিপিং লাইনস-এর হয়ে কাজ করতে পেরে আমরা গর্বিত। আপনার আগমনে আমরা সত্যি আনন্দিত।

‘গড, নাহ! তিক্ততায় ফিসফিস করে উঠল ডেভিড।

প্লিজ?

না, আমি দুঃখিত। আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল। বিদায় দেয়ার ভঙ্গিতে হাত মেলালো ডেভিড।

‘আপনাকে দেয়ার জন্য আমার কাছে দু’টো গুরুত্বপূর্ণ টেলেক্স মেসেজ আছে মি, মরগ্যান।’ এগিয়ে দিল ভ্যান গেন্ট। আমি আমস্টারডাম থেকে বিশেষ ভাবে এ দুটো নিয়ে এসেছি।

প্রথমটি এসেছে মিজির কাছ থেকে যে ডেভিডের কথা লুকিয়ে রাখার শপথ নিয়েছিল।

‘তোমার পাত্তা বলে দেয়ার জন্য দুঃখিত। সিংহের মতো সাহসী আর ঈগলের মতোই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠো। লাভ, মিটজি।’

‘বিশ্বাসঘাতক ডাইনী!’ বলে উঠেই দ্বিতীয় খাম খুলে ফেলল ডেভিড।

‘তোমার দ্বিধার কারণ বোঝা গেছে, পদক্ষেপ ক্ষমা করা হলো। বিশ্বাস করি দায়িত্ব পালনে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। এখানে তোমার স্থান সর্বদা উন্মুক্ত। স্নেহের সাথে পল মরগ্যান।

‘ধূর্ত বৃদ্ধ শিয়াল!’ বলেই উভয় মেসেজ চালান করে দিল পকেটে ডেভিড।

‘কোন উত্তর? জানতে চাইলে ভ্যান গেন্ট।

‘ধন্যবাদ, না। এত কষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ।

‘কোন সমস্য নেই, মি. মরগ্যান। আমি কোনভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে? আপনার কিছু প্রয়োজন আছে কী?

‘কিছুই না। কিন্তু আবারো ধন্যবাদ।’ করমর্দন করতেই মাথা নিচু করল ভ্যান গেন্ট আর চলে গেল। ডেভিড এগিয়ে গেল কাউন্টারের দিকে। হাসিমুখে তাকাল মেয়েটা।

‘শুভ সন্ধ্যা, স্যার।’

ডেস্কের উপর দিয়ে নিজের অ্যাভিস কার্ড ঠেলে দিল ডেভিড।

‘আমি একটু দৌড়ঝাঁপ করতে চাই।’

‘দেখা যাক আমি কী করতে পারি। আমাদের একটা মুস্তাং মাক ওয়ান আছে?’ ক্রিম আর গোলাপি নিখাদ ত্বকের অধিকারী মেয়েটার চুল পুরো সোনালি।

এতেই কাজ হবে। নিশ্চয়তা দিল ডেভিড। ফর্ম ফিলআপ করতে করতেই জানতে চাইল,’ আমস্টারডামে কি এটা আপনার প্রথমবার আসা স্যার?”

‘তারা। আমাকে বলেছে ইউরোপের মধ্যে এই নগরীই সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল। ঠিক?’

‘যদি আপনার জানা থাকে কোথায় যেতে হবে।’ বিড়বিড় করল মেয়েটা।

‘তুমি আমাকে দেখাতে পারো?’ ডেভিড প্রশ্ন করতেই মুখ তুলে নিরপেক্ষ অভিব্যক্তি বজায় রেখে কিছু একটা হিসাব করল মেয়েটা চোখের দৃষ্টি দিয়ে। সিদ্ধান্ত নেয়া হলে আবারো শুরু করল তার কাজ।

‘এখানে সাইন করুন স্যার। আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে কাটা হবে। এরপরই গলা নামিয়ে বলে উঠল, এই ব্যাপারে কিছু জানার থাকলে এই নম্বরে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন কাজের শেষে। আমার নাম গিলডা।’

বাইরের খালের ওপারে কোন পথে হাঁটা যায় এমন এক জায়গায় আরো তিনটা মেয়ের সাথে থাকার জায়গা শেয়ার করে গিলডা। সরু সিঁড়ি বেয়ে একটাইমাত্র স্যামসোনাইট স্যুটকেস নিয়ে ডেভিডকে উঠে আসতে দেখেও কোন বিস্ময় ফুটলো না তাদের চোখে। কেউ কোনরূপ বাধাও দিল না। যাই হোক নগরীর প্রাণচঞ্চল্য বলতে একের পর এক ডিসকো আর কফি বারে নিয়ে গেল তাকে গিল; যেখানে নেশায় বুঁদ হয়ে বিপ্লবের বাণী আওড়ায় ঘরপোড়া মানুষেরা। দু’দিনের মাঝেই ডেভিড আবিষ্কার করে ফেলল যে এ সব মদের স্বাদ কতটা বিস্বাদ, কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। আর গিলডার ভেতরটাও ঠিক তার বাইরেরটার মতই স্নিগ্ধ আর দাগহীন। ডেভিড শুনেছিল যে এ শহরের পুলিশ বাহিনী নাকি সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে করিঙ্কৰ্মা, মনে পড়ে অস্বস্তি হলো তার। প্রকৃতপক্ষে তাদের মাঝে নিজের মতোই দিশেহারা ভাব লক্ষ্য করল ডেভিড। মনে হলো তারই মতো কিছু একটার অন্বেষনে নেমেছে তারাও। এর সাথে আবার খালের উপর থেকে নিচু ভূমির স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া মনে হলো যেন শেষবিচারের দিনে মৃতদের আত্মা উঠে আসছে। এছাড়া তোমার জন্ম যদি হয় আফ্রিকার সূর্যের নিচে তাহলে উত্তরের শীতল জলবায়ু ধূসর লাগবে বৈকি।

বিদায় জানানোর সময় দৃশ্যত কোন অভিব্যক্তি ফুটলো না গিলডার মাঝে। মুস্তাং ক্যাবের হিটার চালু করে দক্ষিণে ছুটলো ডেভিড। নামুর-এর বাইরের দিকে রাস্তার পাশে দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। এত ঠাণ্ডাতেও তার পা উনুক্তি আর বাদামী। খাটো ফেডেড নীল ডেনিমের নিচে আকর্ষণীয়ই দেখাচ্ছে তা। সোনালি মাথা নাড়িয়ে বুড়ো আঙুল দেখাল মেয়েটা।

রাবার টায়ারের ঘর্ষণ তুলে ব্রেক করল ডেভিড। পিছিয়ে গেল মেয়েটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে। দেহাবয়ব পুরোপুরি স্লাভিক সমতল ভূমি। চুল সাদা সোনালি, মোটা হয়ে পিছনে ছড়িয়ে আছে, ডেভিড অনুমান করল মেয়েটার বয়স হতে পারে উনিশ।

ইংরেজি বলতে পারো?’ জানালা দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল ডেভিড। পাতলা ফ্যাব্রিকের শার্টের উপর দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে যৌবনের ছোঁয়া।

‘না’, জানাল মেয়েটা, কিন্তু আমি অ্যামেরিকান জানি–কাজ হবে এতে?

‘রাইট অন!’ প্যাসেঞ্জার ডোর খুলে দিল ডেভিড। ব্যাগ ছুঁড়ে দিয়ে স্লিপিং ব্যাগ ঠেলে দিল সীটের উপরে মেয়েটা। নাম জানাল ডেভিডকে।

‘আমি ফিলি।

‘ডেভিড।

“তুমি কি শোবিজে আছো?

‘গড, না–কেন মনে হলো এমনটা?

‘গাড়ি চেহারা-কাপড় চোপড়।

‘গাড়ি। ভাড়া নেয়া কাপড় চুরির মাল আর আমি মুখোশ পরে আছি।’

ফানি ম্যান।’ বলেই সিটের উপর গুটিসুটি মেরে একটা বিড়াল ছানার মতো ঘুমিয়ে পড়ল মেয়েটা।

আর্ডেনসের জঙ্গল যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেখানে একটা গ্রামে থামলো ডেভিড। কিনে আনল লম্বা মুচমুচে রুটি, ধোয়ায় ঝলসানো বন্য শুকরের মাংস আর মম্যাত শ্যাফনের বোতল। গাড়ির কাছে ফিরে আসতে–দেখল জেগে উঠেছে ফিলি।

‘ক্ষুধা পেয়েছে? জানতে চাইল ডেভিড।

হ্যাঁ, আড়ামোড়া ভাঙ্গলো ফিলি।

জঙ্গলের মধ্যে কাঠের গুঁড়ির একটা পথ চলে গেছে দেখতে পেল ডেভিড। অনুসরণ করতেই সবুজ রঙ ক্যাথেড্রালে পৌঁছে গেল তারা। সোনালি সূর্যের আলো চুঁইয়ে পড়ছে গম্বুজ থেকে।

চত্বরে উঠে চারপাশে তাকিয়ে দেখল ফিলি। আগ্রহে আর উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল, “খুব ভালো হয়েছে, ডেভি, বেশ সুন্দর চারপাশ!

পেপার কাপে দু’জনের জন্যে শ্যাম্পেন ঢেলে নিল ডেভিড। পেন নাইফ দিয়ে মাংসের ফালি কেটে নিল। এই ফাঁকে পাউরুটি টুকরো করল ফিলি। পড়ে থাকা একটা গাছের গুঁড়ির উপর পাশাপাশি বসে খেতে শুরু করল, দুজনে।

চারপাশ এতো নির্জন আর শান্ত–খুনোখুনির কোন চিহ্নই নেই। ‘এখানেই জার্মানিরা তাদের শেষ চেষ্টা করেছিল–জানো তুমি এটা?

মুখ ভর্তি রুটি আর মাংস নিয়েও উত্তর দিল ফিলি। আমি দেখেছি মুভিটা। হেনরি ফোল্ডা, রবার্ট রায়ান–পুরোপুরি ভোলামকুচির মতো আচরণ হয়েছে এখানে।

‘সমস্ত কুৎসিত আর মৃত্যুর স্মৃতি সরিয়ে আমাদের উচিৎ এখানে সুন্দর কিছু করা। স্বপ্নাতুর দৃষ্টিতে বলে উঠল ডেভিড। রুটি গলাধকরণ করে এক চুমুক ওয়াইন খেয়ে উঠে দাঁড়াল ফিলি। ফিরে গেল মুস্তাং-এর কাছে। স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে এসে কচি পাতার উপর পেতে নিল।

‘কিছু বিষয় নিয়ে শুধু কথা বলাই ভালো–অন্যগুলো কাজ করার জন্য। ডেভিডকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল ফিলি।

প্যারিসে গিয়ে কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছিল যে এটা হয়তো দরকার, হয়তো পরস্পরের জন্য তারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। গোঁয়ার সেন্ট লাজারের কাছে সুন্দর পরিষ্কার একটা রুম খুঁজে পেল শাওয়ার সহ। কনকডে থেকে ইটোলি পর্যন্ত সারাদিন হেঁটে বেড়ালো পথ থেকে পথে। এরপর আইফেল টাওয়ার পার হয়ে ফিরে এলো নটরডেমে। রাতের খাবার খেল রাস্তার পাশের ক্যাফে বাউল মিকে কিন্তু খাবার অর্ধেক পর্যায়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ল দু’জনে। হঠাৎ করেই ফুরিয়ে গেল কথা, একই মুহূর্তে টের পেল দুজনেই, একে অপরের পুরোপুরি অজানা হলেও উত্তেজনা কম হলো না। একসাথে রাত কাটিয়ে কেজো প্রেম আর শূন্য ভালোবাসার পরে সকালে শাওয়ার সেরে বের হতেই ডেভিডকে জানিয়ে দিল ফিলি, তুমি ভেঙ্গে চুরে যাচ্ছ। এটা কোন প্রশ্ন নয়, বক্তব্য, তাই কোন উত্তরও দরকার হলো না।

‘রুটিতে কোন সমস্যা হবে তোমার? জানতে চাইল ডেভিড। মাথা নাড়াল ফিলি। হাজার ফ্রাংকের দু’টো নোট বের করে পাশের টেবিলে রাখল ডেভিড।

‘নিচে বিল পরিশোধ করে দেব আমি।’ ব্যাগ তুলে নিল ডেভিড।

প্যারিসের আকর্ষণ শেষ হয়ে গেছে তার জন্য। তাই আবারো দক্ষিণের পথ ধরল সূর্যের উদ্দেশে। আকাশ ভরে আছে কালো মেঘে ফন্টেন’তে যাবার আগেই বৃষ্টি শুরু হলো। এত বৃষ্টি হলো যে ওর ধারণা ছিল হয়তো গ্রীষ্ম মণ্ডলেই এমন ধারা বৃষ্টি হয়। কংক্রিটের হাইওয়ে ভেসে গেল বন্যায় আর গাড়ির উইন্ডস্কিন এতটাই ঝাপসা হয়ে গেল যে ওয়াইপার পর্যন্ত ব্যর্থ হলো স্বচ্ছ দৃষ্টির ব্যবস্থা করতে।

একাকী ডেভিড আর কোন জনমনিষ্যি সাথে না থাকায় বিমর্ষ বোধ করল। অন্যান্য গাড়িগুলো বৃষ্টিতে গতি ধীর করলেও দ্রুতগতিতে চলতে লাগল ডেভিড। ভেজা রাস্তায় পিছলে যেতে লাগল চাকা। এবার ব্যর্থ হলো গতির ঝড়। বৃষ্টি পিছনে রেখে দক্ষিণে বিউনিতে এসে মনে হলো একাকিত্বের দল নেকড়ের মতো ছুটে আসছে তার পিছনে।

যাই হোক, প্রথম সূর্যরশ্মি মন ভালো করে দিল তার। পাথরের দেয়ালের অনেক উপরে সবুজ আঙুরের ক্ষেতের ক্লান্তিকর সীমানা ছাড়িয়ে চোখ পড়ল সাদা-সবুজের মতো নরম বাতাস এগিয়ে আসছে মেরুপ্রান্তর থেকে। আরো আধা মাইল সামনে যাবার পর রাস্তা থেকে চোখে পড়ল সাইনবোর্ড। ক্লাব অ্যারোনোটিক দে প্রভেঙ্গে। অনুসরণ করতেই দেখতে পেল আঙুর ক্ষেতের মাঝখানে ছোট্ট পরিষ্কার একটা এয়ারফিল্ড। একটা এয়ারক্রাফট মারচেত্তি অ্যারোবেটিক একটু সিক্সটি মুস্তাং থেকে লাফ দিয়ে বের হলো ডেভিড। এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন মাতালের সামনে রাখা হয়েছে দিনের প্রথম ঢোক হুইস্কি।

ক্লাব অফিসে বসে থাকা ফরাসী লোকটাকে দেখে মনে হল অসফল সৎকারক। লগ বুক আর এক তোড়া লাইসেন্স দেখানোর পরেও কিছুতেই ডেভিডকে মারচেত্তি ভাড়া দিতে রাজি হলো না লোকটা। অন্যান্যগুলো থেকে ভাড়া দেয়া গেলেও মারচেত্তি কিছুতেই ভাড়া দেবে না। দলিলপত্রের উপর ৫০০ ফ্রাংকের নোট রাখল ডেভিড। মুহূর্তে এটা হাওয়া হয়ে গেল ফরাসীটার পকেটে। তারপরেও কিছুতেই শুধু মারচেত্তি একাকী দেবে না। উপরন্তু ডেভিডকে জোর দিল তার সাথে প্রশিক্ষকের আসনে বসতে।

সীমানার বেড়া টপকাবার আগে ধীরে ফোর পয়েন্ট রোল ঘুরালো ডেভিড। এটা হলো আদেশ লঙ্ঘন করার মতো। ফুরফুরে মেজাজের কাজটা করল সে। স্যাক্রেব্লিউ!’ বলে চিৎকার করে উঠল ফরাসি লোকটা; সিটে বসে জমে গেল যেন। কিন্তু বুদ্ধি খাঁটিয়ে কন্ট্রোলে হাত দিল না। কাজ শেষ করে তৎক্ষণাৎ উল্টো দিকে ঘুরে গেল মারচেত্তির পাখা। আঙুরের মাথা থেকে খুব বেশি হলে পঞ্চাশ ফুট উপরে। শব্দ করে শ্বাস ফেলল ফরাসি লোকটা, বুঝতে পারল দক্ষ লোকের পাল্লায় পড়েছে সে। এক ঘন্টা পড়ে মাটিতে নেমে এলে হাসল ডেভিডের দিকে তাকিয়ে।

‘অসাধারণ!’ ডেভিডের প্রশংসা করে তার সাথে লাঞ্চ শেয়ার করল। রসুনের চাটনি, রুটি আর এক বোতল লাল ওয়াইন। মাদ্রিদ পর্যন্ত ডেভিডের সঙ্গী হলো আবারো উড়তে পারার আনন্দ আর রসুনের সুস্বাদু গন্ধ।

মাদ্রিদে এসে হঠাৎ করেই ঘটতে লাগল সব। মনে হলো যেন বহুকাল আগে থেকে ঠিক করে রাখা হয়েছে সবকিছু। মনে হলো অর্ধেক ইউরোপ ঘুরে আসার অর্থ মাদ্রিদে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা অপেক্ষা করছে তার জন্য।

শহরে পৌঁছালো সন্ধ্যাবেলা। গত রাতে তাড়াহুড়া করেছে, কেননা এই সিজনে ষাড়ের দৌড়ের জন্য সময় মতো আসতে পারে যেন। এর উপরে হেমিংওয়ে, কনরাডসহ অন্যান্য রোমান্টিক সাহিত্যও পড়া আছে তার। বিস্মিত হয়ে ভাবে, জীবনের এই ক্ষেত্রেই কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য! বই পড়তে দারুণ লাগে-সৌন্দর্য, উত্তেজনা, সাহস আর সত্যের চরম ক্ষণ। ডেভিড চায় এই বিশাল প্লাজা ডে টরোসে বসে এটা দেখতে মূল্যায়ন করতে আর তারপরেও ইচ্ছে হলে পরে এই সিজনের পামপ্লোনা উৎসবে যাবে।

গ্রান ভিয়া’তে উঠল ডেভিড। পরের দিনের জন্যে টিকিট জোগাড় করে দিল পোর্টার। এত দীর্ঘ পথ ড্রাইভ করে আসায় ক্লান্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে চলে গেল। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে বেশ তাজা মনে হলো নিজেকে। রিংয়ের বাইরে এসে পার্কিং লটে এরই মাঝে ভিড় করে থাকা ট্যুরিস্ট বাসের মাঝে পার্ক করল মুস্তাংকে। এই সিজনে ভিড় জমে উঠেছে বেশ আগেভাগেই।

রিং বাইরেটা দেখে চমক লাগল। দেখে মনে হলো মূর্তি পূজারী বা বর্বর কোন ধর্মের মন্দির, কিন্তু ভেতরটা সম্পর্কে জানে সে। ফিল আর ছবিতে অনেক দেখেছে। বালির রিং মসৃণ আর পরিষ্কার, মেঘে ঢাকা আকাশে উড়ছে পতাকা, গান বেজে চলেছে অর্কেস্ট্রায়, মানুষের মাঝে চিৎকার, উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।

এই ভিড়ের মতো এত উত্তেজনা এর আগে কোন পুরস্কার বিতরণী বা আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলাতেও দেখেনি ডেভিড। সবাই মিলে চিৎকার করছে, সারির উপর সারি আগ্রহী সাদা সব চেহারা সুরের তালে যেন মাতাল হয়ে উঠেছে।

একদল তরুণ অস্ট্রোলিয়দের মাঝে বসেছে ডেভিড; যারা বিভিন্ন স্যুভেনির পোশাক পরে আছে আর মেয়েগুলো। পাখির ঝাঁকের মতই কিচিরমিচির করছে। তাদের একজন ডেভিডের উপর নজর দিল। সামনের দিকে ঝুঁকে তার কাঁধে টোকা দিয়ে নিজেদের মাঝে ছাগলের চামড়ার থলেতে রাখা ওয়াইন ভাগাভাগি সময়ে ডেভিডের দিকে এগিয়ে দিল একবার। একটা বিড়ালের মতই সুন্দরী মেয়েটা। চোখ দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল শুধুমাত্র ওয়াইন নয় অন্য আরো অনেক কিছুর আমন্ত্রণ জানালো ডেভিডকে। কিন্তু কোন নিমন্ত্রণই গ্রহণ করল না ডেভিড। উঠে গিয়ে এক ক্যান বিয়ার নিয়ে আসলো সে। প্যারিসের মেয়েটার সাথে কাটানো অভিজ্ঞতা এখনো বেশ চনমনে করে তুলল তাকে। সিটে ফিরে আসতেই অসি মেয়েটা তাকিয়ে রইল তার বিয়ারের ক্যানের দিকে। উজ্জ্বলভাবে হাসল ডেভিড।

দেরীতে আসা মানুষগুলো ভিড়ের মাঝে জায়গা খুঁজে নিচ্ছে আর উত্তেজনা একেবারে তুঙ্গস্পর্শী। দু’জন উঠে এলো ডেভিড যেখানে বসে সেখানকার কাছাকাছি। কমবয়সী একজোড়া বালক-বালিকা বয়স বোধ হয় বিশের গোড়ায়। কিন্তু যেটা ডেভিডের নজর কাড়লো তা হলো এই জোড়ার চারপাশে শুদ্ধ সম্পর্ক আর ভালোবাসার একটা আবেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হলো কোন স্বর্গীয় আভা তাদের পৃথক করে রেখেছে।

ডেভিড যেখানে বসে আছে তার পাশ দিয়ে হাত ধরাধরি করে উঠে গেল দু’জনে। পেছনে এক সারি উপরে গিয়ে বসল। উচ্চতা ভালো মেয়েটার লম্বা পা দু’খানায় খাটো কালো বুট। গাঢ় রঙের প্যান্টের উপরে আপেল সুবজ রঙা স্লয়েড জ্যাকেট, দামী না হলেও রুচির ছাপ আছে যথেষ্ট। সূর্যের আলোয় কয়লার মতো চকচক করছে চুল। কাঁধ ছাপিয়ে উপচে পড়ছে নরম ঝরনার মতো। চেহারা বেশ বড়সড় আর রোদে পোড়া বাদামী। মুখটা বড় হওয়ায় বেশি সুন্দরী না হলেও চোখ দুটো বেশ প্রশস্ত। গাঢ় বাদামী, বন্য মধুর রঙ তাতে, মনে হলো সোনা মিশিয়ে তৈরি করেছেন সৃষ্টিকর্তা। মেয়েটার মতই ছেলেটাও লম্বা। সোজা-সাপ্টা দেহাবয়ব, গাঢ় দেহতৃক আর শক্তিশালী। বাদামী পেশীবহুল হাত দিয়ে মেয়েটাকে তার আসন দেখিয়ে দিল। হঠাৎ করেই ছেলেটার উপর কেমন রাগ আর হিংসা হলো ডেভিডের।

‘সন অব আ গান মনে মনে ভাবল ডেভিড। মাথা ঝুঁকিয়ে গোপন কথা বলতে লাগল তরুণ জোড়া। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড। তার নিজের একাকিত্ব যেন বেড়ে গেল তাদের নৈকট্য দেখে।

ষাঁড়-চালকদের প্যারেড শুরু হলো। তাদের গায়ের স্যুটের সিকুইন আর অ্যামব্রয়ডারিতে সূর্যের আলো পড়ে চকচক করে উঠল, মনে হলো কোন বিশাল চকচেক সরীসৃপ এগিয়ে চলেছে। অর্কেস্ট্রী বেজে উঠতেই ষাড়দের খাঁচা খুলে দেয়া হলো।

একটু সুযোগ পেতেই তরুণ জোড়ার দিকে তাকাল ডেভিড। অবাক হয়ে দেখল যে ছেলে-মেয়ে দুটো তাকেই দেখছিল। মেয়েটা ঠোঁট প্রায় ছেলেটার কানের কাছে এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল কিছু একটা। ডেভিডের মনে হলো তার পাকস্থলীর নিচে কিছু একটা গুড়গুড় করে উঠল সোনালি চোখ জোড়া দেখে। এক মুহূর্তের জন্য মেয়েটা আর ডেভিড তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে। তারপরই অপরাধীর চোখ সরিয়ে নিল মেয়েটা। কিন্তু ছেলেটার সঙ্গী তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে, সহজভাবেই হাসল। এবার চোখ সরিয়ে নেবার পালা ডেভিডের।

তাদের নিচে রিংয়ে সবেগে বেরিয়ে এলো যড়। মাথা উঁচু করে ঘুরতে লাগল বালির উপর।

কালো চকচকে, সুন্দর ঘাড়টার ঘাড় আর কাঁধে পেশী নাচাতে লাগলে এক পাশ থেকে আরেক পাশে মাথা ঘোরানোর সময়। ষাঁড়ের গতি আর লাফালাফি দেখে ভিড়ের দর্শকেরা যেন পাগল হয়ে উঠল। পুরো রিং জুড়ে ঘুরে ঘুরে নিজের কসরত দেখাতে লাগল ষাড়টা। মাথায় শিংয়ের চমৎকার প্রদর্শনীর পর নিয়ে আসা হলো ঘোড়া।

ট্রাম্পেট বেজে উঠল ঘোড়ার আগমনে, এসব কিছুই হাস্যকর মনে হলে হতভাগ্য টাই ঘোড়াটার জন্য সাহসী অভ্যর্থনা, এক চোখ দিয়ে পিচুটি পড়ায় অবোধ জন্তুটা দেখতেই পারল না সামনে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে।

ক্লাউনের মতো দেখাতে লাগল ঘোড়াটাকে। পিঠে মস্ত বড় সশস্ত্র মানুষ নিয়ে বাইরে এলো ঘোড়াটা, পড়ল ষাঁড়ের সামনে আর এখানেই শেষ হয়ে গেল সমস্ত সৌন্দর্য।

মাথা নিচু করে সামনে ছুটে গেল ষাড়টা। কালো বিশাল পিঠের উপর কুজোতে চাবুকের বাড়ি দিয়ে শরীরের সমস্ত ওজন দিয়ে ষ্টিলের বাড়ি মারা হলো ষাড়ের পায়ে। সাথে সাথে বের হয়ে এলো রক্তের ধারা। কালো, কুড অয়েলের মতো ঝরে পড়ল বালির উপর।

লোহার বাড়ি খেয়ে রাগে উন্মত্ত ষাড় ঘোড়ার উপর রাখা আসনে গুতো মারল। মনে হলো থিয়েটারের পর্দা সরে গেল। এমন ভাবে ঘোড়ার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ষাড়। ভয়ঙ্কর শিংয়ের তো খেয়ে আর্তনাদ করে উঠল ঘোড়া। বেচারা পশুটার পেট চিরে বেগুনি আর গোলাপি নাড়িভূড়ি বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বালির উপর।

ঘটনার বিমর্ষতায় মুখ শুকিয়ে গেল ডেভিডের। চারপাশের ভিড় রক্ত হিম করা চিৎকার করে উঠল। গায়ের যন্ত্রপাতি আর নিজের অন্ত্রের উপর পড়ে গেল ঘোড়া।

ষাঁড়টাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। পড়ে যাওয়া ঘোড়াটার লেজ ধরে টেনে জোর করে শেষবারের মতো উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করা হলো। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো হতভাগ্য জটা। শরীরে আঘাত করে আবারো চলতে বাধ্য করা হলো। নিজের নাড়িভূড়ি থেকে টলতে টলতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘোড়া।

এরপর ষাঁড়ের দিকে এগিয়ে গেল লোকেরা। ধীরে ধীরে জমকালো পশুটা হয়ে গেল ঘর্মাক্ত, রক্ত বের হওয়া মাংসপিণ্ড মুমূর্ষ ফুসফুস থেকে বের হতে লাগল ক্রিম রঙা ফেনা।

ডেভিড চাইল চিৎকার করে তাদেরকে থামাতে। কিন্তু নিজেকে মনে হলো তার অসুস্থ। এ ধরনের প্রথায় নিজের উপস্থিতি নিয়ে জমে গেল যেন। বাকি সময় বসে রইল নীরবে। রিংয়ের মাঝখানে উঠে দাঁড়াল আঁড়টা। চারপাশে বালিতে মনে হলো জমি চাষ করা হয়েছে। নিজেকে নিয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করতে লাগল ষড়। উঠে দাঁড়াল মাথা নিচু করে, প্রায় বালির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে এমতাবস্থায় নাক আর ভোলা মুখ দিয়ে বের হতে লাগল ফেনা। ভিড়ের চিৎকার ছাপিয়েও ষাঁড়টার নিঃশ্বাসের যন্ত্রণার শব্দ কানে এলো ডেভিডের। পা হড়কাতে লাগল আঁড়টার। পিছনের পায়ের মাঝে থেকে বের হয়ে এলো হলুদ মল। এর থেকে বেশি আর কোন নির্যাতন হতে পারে না। উঁচু স্বরে ফিসফিস শুরু করে দিল ডেভিড।

না! না! থামাও! প্লিজ এটা থামাও!’

চকচকে স্যুট আর ব্যালে জুতা পরিহিত একটা লোক এগিয়ে এলো সমাপ্তি টানতে। ষাঁড়ের মেরুদণ্ডে আঘাত করল তরবারি দিয়ে। সূর্যের আলোয় দেখা গেল চিরে দু’ভাগ হয়ে গেছে হাঁড়। একপাশে হেলে গেল ষড়। আবারো উঠে দাঁড়ানোর আগে উগড়ে দিল মোটা রক্তের ধারা।

বালির উপর থেকে আবারো তরবারি তুলে নিল লোকগুলো তুলে দিল একজনের হাতে। মৃত্যুপথযাত্রী জন্তুটার দিকে তাকিয়ে আবারো আঘাত করল হাঁড়ের উপর। অবশেষে গলার স্বরে দৃঢ়তা খুঁজে পেল ডেভিড। চিৎকার করে উঠল:

‘থামাও! অসভ্য বর্বর কোথাকার।’

মাঝখানে দাঁড়িয়ে বারোবার তরবারি হাতে চেষ্টা করল লোকটা। প্রতিবার হাত থেকে ছুটে গেল সেটা। আর শেষ বার পড়ে গেল ষড়। ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ল রক্ত হারানোয় নির্যাতনে ভেঙ্গে পড়ে অবশেষে রণেভঙ্গ দিল। আবারো উঠে দাঁড়ানো দুর্বল চেষ্টা সত্ত্বেও শক্তি না থাকায় মেরে ফেলা হলো ষাড়টাকে। ঘাড়ের পেছনে ছুরি দিয়ে আঘাত করে বালির উপর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো–বালির উপর পড়ে রইল বাদামি রক্তের লম্বা ধারা।

এ ধরনের দানবীয় নিষ্ঠুরতায় বোবা হয়ে গেল ডেভিড। আস্তে করে পিছু ফিরে তাকাল মেয়েটার অবস্থা দেখতে। মেয়েটার সঙ্গী খুঁকে ফিসফিস করে কথা বলে চেষ্টা করছে ওকে শান্ত করতে।

আস্তে করে মাথা নাড়াল মেয়েটা, যেন বুঝতে পারছে না যে কী হচ্ছে চারপাশে আর মধু রঙা চোখ ভেসে যাচ্ছে পানিতে। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আছে, দুঃখের ভারে কাঁপছে আর গাল বেয়ে পড়ছে চকচকে চোখে জল।

মেয়েটার সঙ্গী তাকে সাবধানে ধরে দাঁড় করিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে আসল। এমনভাবে চলে যেতে লাগল যেন সদ্য বিধবা তার স্বাধীর কবর ছেড়ে যাচ্ছে।

চারপাশে ভিড়ের মানুষ রক্ত আর ব্যথা দেখে হাসছে, চিৎকার করে আনন্দ করছে আর এতসব কিছুর মাঝে নিজেকে ডেভিডের মনে হলো সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। মন চলে গেছে কান্নারত মেয়েটার কাছে, এত মানুষের মাঝে একমাত্র মেয়েটাকেই মনে হলো সত্যিকারের মানুষ। যথেষ্ট দেখা হয়েছে, বুঝতে পারল, পামপ্লোনায় যেতে পারবে না আর। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটার পিছু পিছু রিং থেকে বের হয়ে এলো ডেভিড। চাইল মেয়েটার সাথে কথা বলতে, বলতে চাইল সেও ব্যথিত। কিন্তু পার্কিংয়ে পৌঁছে দেখল তারা দুজনে ইতিমধ্যে একটা পুরোনো সিটরোন সিভি.১০০-তে চড়ে বসেছে। দৌড় দিল ডেভিড কিন্তু চলে গেল গাড়িটা। নীল ধোয়া ছেড়ে মিশে গেল উত্তরের পথে।

গাড়িটার চলে যাওয়া দেখে মনে হলো তার অনেক বড় কোন ক্ষতি হয়ে গেল। হারিয়ে গেল গত কয়েকদিনের সুখস্মৃতি। কিন্তু দুদিন পরে আবারে দেখা হলো পুরোনা সিটরোনটার সাথে, যখন যে পামপ্লোনা উৎসবের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে দক্ষিণে চলেছিল। আগের থেকে বৃদ্ধ মনে হলো সিটরোনটাকে। মোটা ধুলার আস্তরণে ঢেকে আছে গাড়িটা আর মাঝের টায়ারের উপর দেখা গেল ক্যানভাস। একপাশ এমন ভাবে হেলে আছে গাড়িটা যেন পাড় মাতাল।

বার্সেলোনা যাবার পথে জারাগোজার বাইরের দিকে একটা ফিলিং স্টেশনে পার্ক করা গাড়িটা নজরে এলো ডেভিডের। রাস্তা থেকে নেমে নিজের গাড়ি গ্যাসোলিন পাম্পের পিছনে পার্ক করল ডেভিড। তেল মাখা ওভারওল পরনে একটা অ্যাটেনড্যান্ট সিটরোনের ট্যাংক ভরছে, তত্ত্বাবধান করছে রিংয়ে দেখা সেই পেশীবহুল তরুণ ছেলেটা। তাড়াতাড়ি মেয়েটোর খোঁজে চোখ বুলালো ডেভিড। কিন্তু গাড়িতে ছিল না মেয়েটা। এরপরই তাকে দেখতে পেল ডেভিড।

রাস্তার ওপাশে একটা ক্যান্টিনে বসে আছে মেয়েটা। কাউন্টারের পেছনে থাকা বৃদ্ধ মহিলার পেছনে। যদিও ডেভিডের দিকে পিছু ফিরে বসে আছে, কিন্তু মাথা ভর্তি কালো চুলের রাশি দেখে চিনতে পারল ডেভিড। রাস্তা পার হয়ে তাড়াতাড়ি দোকানে মেয়েটার পিছনে গেল সে। নিশ্চিত ভাবে নিজেও জানে না সে সে কী করছে।

খাটো, ফুলের নকশা করা একটা ড্রেস পরে আছে মেয়েটা, কাঁধ আর পিঠ পুরো উন্মুক্ত। পায়ে খোলা স্যান্ডেল। কিন্তু বাতাসে তুষারকনা থাকায় কাঁধে শাল। কাছ থেকে দেখা গেল ত্বকে প্লাস্টিকের মসৃণতা। মনে হলো যেন হালকাভাবে তেল লাগিয়ে পালিশ করা হয়েছে। পিছনে উন্মুক্ত ঘাড়ে কোমল, সুন্দর চুল। মনে হল ডাটির উপর ফুল।

ডেভিড কাছে এগিয়ে গেল। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে শুকনো ফিগ কেনা শেষ করে খুচরো পয়সা নিচ্ছে মেয়েটা। বুক ভরে গন্ধ নিল ডেভিড। মনে হল মেয়েটার চুল থেকে ভেসে এলো গ্রীষ্মের গন্ধ। ইচ্ছে হলো মুখ ডুবিয়ে স্বাদ নিতে। বহু কষ্টে নিজেকে নিবারণ করল ডেভিড।

হাসিমুখে পেছনে ফিরতেই দাঁড়িয়ে থাকা ডেভিডকে দেখতে পেল মেয়েটা। চিনতে পারল সাথে সাথে, কেননা ডেভিডের চেহারা এমন যে চট করে ভুলে যাবে না কোন মেয়ে। অবাক হয়ে গেল মেয়েটা। হাসি মুছে ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে। অভিব্যক্তিতে কিছু বোঝ না গেলেও ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে রয়েছে আর চোখ জোড়া নরম উজ্জ্বল সোনালি এই অদ্ভুত নীরবতার সাথে ভবিষ্যৎ আরো বহুবার দেখা হবে ডেভিডের।

‘মাদ্রিদে দেখেছি তোমাকে। জানাল ডেভিড। ষাড়ের লড়াইয়ে।

হ্যাঁ, মাথা নাড়াল মেয়েটা। কণ্ঠে উচ্ছ্বাস বা বিরক্তি কিছুই নেই।

‘তুমি কাঁদছিলে।’

‘তুমিও’, নিচুস্বরে পরিষ্কার করে কথা বলছে মেয়েটা, উচ্চারণে কোন খামতি নেই। বিদেশী নয়।

‘না’, অগ্রাহ্য করল ডেভিড।

‘তুমি কাঁদছিলে। নরম স্বরে জোর দিয়ে বলল মেয়েটা, ভেতরে ভেতরে কাঁদছিলে। এবার সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়াল ডেভিড। হঠাৎ করেই ফিগের ব্যাগ এগিয়ে দিল মেয়েটা।

‘নাও একটা। হেসে ফেলল মেয়েটা। উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি। একটা নিয়ে মিষ্টি ফলে কামড় বসালো ডেভিড। মেয়েটা এগিয়ে গেল দরজার কাছে। মনে হলো একটা আমন্ত্রণ ভেসে এলো বাতাসে। পিছ নিল ডেভিড। একসাথে হেঁটে দরজার বাইরে গিয়ে রাস্তার ওধারে সিটরোনের দিকে তাকাল দু’জনে। অ্যাটেনড্যান্ট ট্যাংক ভরে দিয়েছে। মেয়েটার সঙ্গী অদ্ভুত পুরোন গাড়িটার বনেটের গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে। সিগারেট ধরাতে গিয়ে চোখ তুলেই দেখল তাদেরকে। সাথে সাথে বোঝা গেল চিনতে পেরেছে ডেভিডকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফেলে দিল জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি।

নরম হুস একটা আওয়াজ হয়েই বাতাসে ভাসলো ধোঁয়া। কংক্রিটের উপর পড়ে থাকা গ্যাসোলিনের উপর পড়েছে ম্যাচের কাঠি। মুহূর্তের মধ্যেই দাউদাউ আগুন। চোখের পলকে সিটরোনকে প্রায় ঢেকে ফেলল আগুন। ক্ষুধার্তের মতো এগিয়ে আসছে। মেয়েটাকে ছেড়ে রাস্তার উপর দিয়ে দৌড় দিল ডেভিড।

‘পাম্প থেকে সরে যাও গর্দভ কোথাকার।’ চিৎকার করে উঠল সে। ড্রাইভার যেন জমে আছে।

নভেম্বর হাসিখুশি পাঁচ তারিখে ঘটল এই ঘটনা–হ্যান্ডব্রেক বন্ধ করে গিয়ারবক্স নিউট্রালে নিয়ে আসল ডেভিড। এরপর ড্রাইভার আর ও দু’জনে মিলে জ্বলন্ত গাড়িটাকে ঠেলে ফিলিং স্টেশনের বাইরের পার্কিংয়ে নিয়ে এলো। মনে হলো মাটি ফুড়ে উদয় হলো মানুষ, ভিড় জমে গেল চারপাশে। চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে, উপদেশ দিচ্ছে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে।

ভেতরের সিট থেকে ব্যাগেজও উদ্ধার করা গেল শিখা গ্রাস করার আগেই তখনি পেট্রল অ্যাটেনড্যান্ট পৌঁছালো বিশাল বেগুনি রঙা আগুন নির্বাপক যন্ত্র নিয়ে। ভিড়ের জনতা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। ফেনার মেঘ ঢেকে ফেলল ছোট গাড়িটাকে, সাথে সাথে উত্তেজনা ও হারিয়ে গেল। মানুষজন চলে গেল যে যার পথে; তারপরেও হাসছে, কথা বলছে, নাস্তানাবুদ ফায়ার ফাইটারকে প্রশংসা করছে। অন্যদিকে নিজেদের পোড়া কালো সিটরোনের নিকে হতাশা দিয়ে তাকিয়ে রইছে তিনজন।

‘আমার মনে হয় ব্যাপারটা ভালোই হলো-বেচারা অনেক ক্লান্ত হয়ে। পড়েছিল। অবশেষে বলল মেয়েটা। যেন পা ভাঙা ঘোড়া নিয়ে শ্যাটং।

ইনস্যুরেন্স করা আছে? জানতে চাইল ডেভিড। হাসল মেয়েটার সঙ্গী।

মজা করছো–কে করবে এটার ইনস্যুরেন্স? আমি মাত্র একটা একশ ইউ এস ডলারের নোট দিয়েছি ওর জন্য।’

আগুনের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া জিনিসপত্রের ছোট্ট একটা স্তূপ জড়ো করল তিনজনে মিলে। মেয়েটা দ্রুত সঙ্গীর সাথে কোন এক বিদেশী ভাষায় কী যেন আলোচনা করে নিল। বুঝতে না পারলেও মর্মার্থ ঠিকই ধরতে পারল ডেভিড। তাই মেয়েটা যখন তার দিকে তাকাল একটুও অবাক হলো না সে।

‘আজ সন্ধ্যায় বার্সেলোনায় একজনের সাথে দেখা করতে হবে আমাদেরকে। জরুরি প্রয়োজন।’

‘চলো তাহলে। জানাল ডেভিড।

মুস্তাংয়ে এনে ভোলা হলো সব লাগেজ। মেয়েটার সঙ্গী লম্বা পা দু’খানা ভাঁজ করে বসল গিয়ে পেছনের সিটে। নাম যোসেফ–কিন্তু মেয়েটা ডেভিডকে জানাল ছেলেটাকে জো নামে ডাকতে। মেয়েটার নাম ডেবরা আর পদবী নিয়ে কেউই মাথা ঘামালো না। ডেভিডের পাশের আসনেই বসল ডেবরা। দুই হাঁটু পরস্পরের সাথে এঁটে কোলের উপর রেখেছে হাত। একবার নজর বুলিয়েই দেখে নিল মুস্তাং আর এর সব সম্পত্তি। ডেভিড দেখতে পেল ডেবরা দেখে নিল দামী লাগেজ, নাইকন ক্যামেরা, জিস বাইনোকুলার রাখা গ্লোভ কম্পার্টমেন্টে আর সিটের উপরে অনাদরে ফেলে রাখা দামী জ্যাকেট। এরপর আড়চোখে তাকাল ডেভিডের দিকে, মনে হলো প্রথমবারে মতো খেয়াল করল সিল্কের শার্ট আর কব্জিতে লাগান চিকন স্বর্ণের গয়না।

‘দরিদ্ররাই আর্শিবাদপ্রাপ্ত। বিড়বিড় করল ডেবরা, তারপরেও ধনী হওয়াটা এখনো আনন্দময়।

ব্যাপারটা উপভোগ করল ডেভিড। চাইল ডেবরা মুগ্ধ হোক, চাইল ডেভিড আর পিছনের সিটে বসা বড়সড় পেশীবহুল তরুণের মাঝে তুলনা করুক।

‘চলো তাহলে যাই বার্সেলোনা। হাসল ডেভিড।

নিঃশব্দে গাড়ি চালিয়ে শহরের বাইরে এলো। কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে জোর দিকে তাকাল ডেবরা।

“ঠিক আছে তুমি? আগের বারের মতেই অচেনা ভাষায় জিজ্ঞেস করল ডেবরা জোকে।

‘যদি তা না হয়—ও পেছনে পেছনে দৌড়াতে পারে। একই ভাষায় উত্তর দিল ডেভিড। বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাল ডেবরা। এরপরই খুশি হয়ে উঠল চেহারা।

‘এই! তুমি হিব্রু বলতে পারো!

‘বেশি একটা না।’ স্বীকার করল ডেভিড। বেশির ভাগটাই ভুলে গেছি। মনে পড়ে গেল দশ বছর বয়সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুদ্ধ করতে অদ্ভুত আর রহস্যময় একটা ভাষা নিয়ে। যেটা লিখতে হতো পিছনে থেকে সামনে, এমন একটা বর্ণমালা দেখতে মনে হয়–ব্যাঙাচি আর বেশির ভাগ উচ্চারণ গলার পেছন থেকে করতে হয়, অনেকটা গার্গল করার মতো।

‘তুমি ইহুদি? জানতে চাইল ডেবরা। সিট ঘুরিয়ে ডেভিডের মুখোমুখি হলো। হাসছে না, প্রশ্নের উত্তরটা যে ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বোঝা গেল তা।

মাথা নাড়ল ডেভিড।

না।’ হেসে ফেলল। আমি অর্ধ বিশ্বাসী, বিনা পালনকারী–একেশ্বরবাদী, বড় হয়ে উঠেছি প্রোটেস্ট্যন্ট খ্রিস্টান ঐতিহ্যনুযায়ী।

তাহলে হিব্রু কেন শিখলে?

‘আমার মা চাইতো, তাই। ব্যাখা করল ডেভিড। অনুভব করল পুরোন অপরাধবোধ।

‘আমি একদম ছোট ছিলাম যখন আমার মাকে খুন করা হয়। তারপর থেকে আর শেখা হয়নি। মা চলে যাবার পর ব্যাপারটা আর গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি।’

‘তোমার মা জোর দিল ডেবরা, এগিয়ে এলো ডেভিডের দিকে, উনি কী ইহুদি ছিলেন?

‘হত্যা’, একমত হলো ডেভিড, কিন্তু বাবা ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট। নরক ভেঙ্গে পড়েছিল যখন তারা বিয়ে করেছিল। সবাই এর বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু আমার বাবা-মা পিছপা হয়নি।’

ডেবরা জো র দিকে তাকাল।

‘শুনেছে–ও আমাদের মতো একজন।

“ওহ বাদ দাও! হাসতে হাসতে বাধা দিল ডেভিড।

মাজালটোভ,’ বলে উঠল জো, মাঝে মাঝে জেরুজালেমে এসে আমাদের সাথে দেখা করো।

‘তোমারা ইস্রায়েলী? আগ্রহ জন্মালে ডেভিডের মাঝে।

‘আমরা দুজনেই।’ গর্ব আর সন্তুষ্টি ফুঠে উঠল ডেবরার স্বরে।

‘আমরা এখানে ছুটি কাটাতে এসেছি।

“নিশ্চয় মজাদার দেশ হবে এটা।’ দ্বিধা ফুটলো ডেভিডের কণ্ঠে।

‘জো যেমনটা বলেছে, সময় বের করে আসো না একবার। পরামর্শ দিল ডেবরা। ফিরে আসার অধিকার আছে, তোমার। এর পরই আবার বিষয়টা পরিবর্তন করে ফেলল। এই মেশিনটা কী এতটুকু গতিতেই দ্রুত ছুটতে পারে? সাতটার মাঝে বার্সেনোলায় পৌঁছাতে হবে আমাদেরকে।

সবার মাঝে খানিকটা সহজ ভাব এলো, মনে হলো কোন কোন অদৃশ্য বাধা ভেঙ্গে পড়েছে, মেয়েটা যেন কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শহরের বাইরে চলে এসেছে তারা। সামনের খোলা রাস্তা চলে গেছে এব্রো উপত্যকা হয়ে সমুদ্রের দিকে।

দয়া করে সিগারেট নেভাও আর সিট বেল্ট বেঁধে নাও।’ সাবধান বাণী দিয়ে গতির ঝড় তুলল ডেভিড।

চুপচাপ হাত কোলে নিয়ে ডেভিডের পাশে বসে রইল ডেবরা। তাকিয়ে রইল সামনে বাকের দিকে। মুস্তাংয়ের শরীরের নিচে এগিয়ে চলেছে সোজা মসৃণ রাস্তা। মুখে অল্প একটু আনন্দের হাসি, চোখে সোনালি আলোর নাচানাচি আর বুঝে গেল ডেভিড–যে তারই মতো গতিপাগল হলো এই মেয়েটা।

চারপাশের সবকিছু বিস্মৃত হয়ে গেল ডেভিড। মনে রইল কেবল পাশে বসা মেয়েটার কথা। একই সাথে ঠিকঠাক এগিয়ে নিয়ে চলল গর্জনরত মেশিন।

শুকনো ধূলিধূসরিত উপত্যকায় একের পর বাঁক আসছে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে মুস্তাং নিয়ে এগিয়ে চলেছে ডেভিড। হুইল থেকে গিয়ার লেভেল নাচানাচি করছে, হাত-পায়ের আঙুল আর গোড়ালি দ্রুত প্যালের উপর জায়গা বদল করছে পুরো ব্যাপারটার উত্তেজনায় উঁচু স্বরে হেসে উঠল ডেবরা।

গ্রামের ক্যান্টিন থেকে চিজ, রুটি আর হোয়াইট ওয়াইন কিনে এনে পাথরের ব্রিজের উপর বসে লাঞ্চ শেষ করল তিনজনে। নিচে বয়ে চলল নদী। পর্বত থেকে নেমে এসেছে দুধসাদা তুষারকণা।

পাশাপাশি বসে থাকায় ডেভিডের উরুতে ডেবরার ছোঁয়া লাগল। উষ্ণ বোধ হলো ডেভিডের। ঠাণ্ডা বাতাস সত্ত্বেও মনে হলো ডেবরার গাল দুটো একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

কিন্তু ডেভিড অবাক হলো জোর আচরণে। মনে হলো ডেভিডের কাজকর্ম নিয়ে বা ডেবরার মিশতে চাওয়ার চেষ্টার দিকে ওর কোন নজর নেই। বরঞ্চ বাচ্চাদের মতো আনন্দ করছে নিজের পানিতে ছুটে চলা ট্রাউটের উপর পাথর ফেলে। হঠাৎ করেই ডেভিডের মনে হলো যে জো খানিকটা বাধা দিলে ভালো হতো, ডেভিড উপভোগ করতে নিজের বিজয়-এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে মনস্থির করে ফেলেছে সে।

আরো এক টুকরো সাদা চিজের উদ্দেশে ডেবরার দিকে ঝুঁকে এলো ডেভিড। জো মনে হলো খেয়ালই করল না।

কাম অন, যুদ্ধ করো, এমনি এমনি বসে থেকো না। মনে মনে বলল ডেভিড।

নিজেকে পরীক্ষা করতে চাইল সে। ছেলেটা বেশ বড়সড় আর শক্তিশালী। আর হাবভাব দেখে ডেভিড বুঝতে পারল যে জো নিজের প্রতি আস্থাশীল আর তার সাথে সমতুল্য মুখমণ্ডল মাংসল আর এতত একটা খারাপ নয়। ডেভিড জানে যে কোন কোন নারী এই রকম পছন্দ করে আর জোর অলস আর ধীর হাসি দেখে ভোলার কিছু নেই—চোখ দুটো দ্রুত আর তীক্ষ্ম।

‘তুমি ড্রাইভ করতে চাও, জো? হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে বসল ডেভিড। হালকা হাসিটা তেলের মতো ছড়িয়ে চকচক করে উঠল জোর চেহারা। কিন্তু চোখে সন্দেহ।

কিছু মনে করবে না যদি আমি ড্রাইভ করি?’ জিজ্ঞেস করল জো। কিন্তু সংকীর্ণ পিছনের সিটে বসে নিজের কাজে আফসোস হলো ডেভিডের। প্রথম পাঁচ মিনিট সংযত ভাবে গাড়ি চালালো জো। ব্রেকে স্পর্শ করে ঠিকঠাক দেখে নিল, গিয়ার দিয়ে ট্রাভেলের মজা নিতে চাইল।

‘ভয় পেও না। জানাল ডেভিড। কপাল কুঁচকে মনোসংযোগ করল ডেভিড। এরপর মাথা নেড়ে দৃঢ় হলো হাত। নব উদ্যমে গাড়ি চালানো শুরু করল। মুখ দিয়ে ফুস করে বাতাস ছাড়ল ডেবরা। প্রথম বাকের মুখে এসেই এমন ভাবে গাড়ি কাত হলো যে ডেভিডের ডান পা অবচেতনে ব্রেক প্যাডাল খুঁজতে গিয়ে ব্যথা পেল আর গলার কাছে মনে হলো শ্বাস আটকে গেল।

বার্সেলোনা বিমানবন্দরের বাইরে পার্কিং লটে জো যখন গাড়ি পার্ক করে ইঞ্জিনের চাবি বন্ধ করল, কয়েক মিনিট নিশ্চুপ রইল সবাই। এরপর আলতে করে বলে উঠল ডেভিড।

‘সন অব আ গান!

হেসে ফেললো সবাই। মনে মনে অনুশোচন হলো যে সে মেয়েটাকে ছিনিয়ে নেবে তার কাছে থেকে আস্তে আস্তে ছেলেটাকে পছন্দ করা শুরু করল সে। ছেলেটার কথাবার্তার অলস ভঙ্গি, চলাফেলা, হাসিতে আনন্দ খুঁজে পেল। নিজের প্রতিজ্ঞা আরো দৃঢ় করল সে।

প্লেন আসারও এক ঘন্টা আগে চলে এসেছে তারা। রেস্টোরেন্টে একটা টেবিলে বসে তাকিয়ে রইল সবাই রানওয়ের দিকে। ডেভিড সাংগ্রিয়ার মাটির কলসের অর্ডার দিল। ডেবরা বসল জোর পাশে আর কথা বলার সময় একটা হাত তুলে দিল তার হাতে। এ ভঙ্গিতে সদ্য আসা জো’র প্রতি ভালোলাগা উঠে গেল ডেভিডের।

ওয়েটার সাংগ্রিয়া এনে রাখতেই ল্যান্ড করল একটা প্রাইভেট প্লেন। তাকিয়ে রইল জো।

নতুন এক্সিকিউটিভ গাষ্ট্ৰিষগুলোর একটা, ওরা বলেছিল যে মেয়েটা সুন্দরী হবে। এর এয়ারক্রাফটের বর্ণনা দেয়া শুরু করল কারিগরী ভাষায় আর বুদ্ধিদীপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল ডেবরা।

‘এয়ারক্রাফট সম্পর্কে কিছু জানো নাকি?” চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল ডেভিড।

‘কিছু কিছু। স্বীকার করল জো। কিন্তু উত্তর দিতে চাইল ডেবরা।

‘জো এয়ারফোর্সে আছে।’ গর্বিত স্বরে উত্তর দিল সে। দু’জনের দিকেই তাকিয়ে রইল ডেভিড।

‘ডেবসও, হেসে ফেলল জো। ডেভিড মনোযোগ দিল মেয়েটার দিকে। ‘ডেবরা সিগন্যাল লেফটেন্যান্ট।

‘রিজার্ভে শুধুমাত্র। শুধরে দিল ডেবরা। কিন্তু জো উড়ে বেড়ায়। ফাইটার পাইলট।

‘উড়ে বেড়ায়। বোকার মতো বলল ডেভিড। জো’র পরিষ্কার আর স্থির দৃষ্টি দেখে আন্দাজ করা উচিৎ ছিল যে, এটা ফাইটার পাইলটের চিহ্ন। যেভাবে ও মুস্তাং চালিয়েছে বোঝা উচিৎ ছিল ডেভিডের। যদি সে একজন ইস্রায়েলী পাখি হয়–তাহলে ও অসংখ্য অভিযানে অংশ নিয়েছে। হেল, যতবার তারা উড়ে যায়। অসাধারণ সব কাজ করে। নিজের ভেতরে শ্রদ্ধার ঢেউ টের পেল সে।

‘কোন স্কোয়াড্রনে আছো তুমি–ফ্যান্টমস?

‘ফ্যান্টমস! ঠোঁট বাকাল জো।

‘এটা তো ওড়েই না। এটা কম্পিউটার চালায়। না, আমরা সত্যি উড়ি। তুমি মিরেজের নাম শুনেছো?

চোখ পিটপিট করে মাথা নাড়াল ডেভিভ।

হ্যাঁ। জানাল সে। শুনেছি তাদের সম্পর্কে।

‘ওয়েল, আমি মিরেজ চালাই।’ হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকাতে লাগল ডেভিড।

কী হয়েছে? জানতে চাইল জো। হাসি মুছে গেছে তার।

‘এখানে হাসার কী হলো?

‘আমিও তাই।’ জানিয়ে দিল ডেভিড। আমিও মিরেজ (Mirage) চালাই।’ এই ছেলের সাথে দ্বন্দ্বে যাবার কোন উপায় নেই। হাজারো ঘণ্টা কাটিয়েছি আমি মিরেজে। এবার অবাক হবার পালা জো’র। এরপর হঠাৎ করেই দুজনে একসাথে কথা বলা শুরু করল। ডেবরা একবার এর দিকে একবার ওর দিকে তাকাতে লাগল মাথা ঘুরিয়ে।

আরেক জগ সাংগ্রিয়ার অর্ডার দিল ডেভিড। জো আবার তাকে কিছুতেই বিল দিতে দেবে না। পনের বারের মতো আবারো বলে উঠল, “ওয়েল, ভালোই হলো। ডেভিডের কাঁধে চাপড় মেরে বলে উঠল, ‘কী বলল ডেবস?

দ্বিতীয় জগের মাঝামাঝি এসে অ্যাভিয়েশনের উপর যখন আলোচনা জমে উঠেছে, বাধা দিল ডেভিড। কার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আমরা? প্রায় অর্ধেক স্পেন ভ্রমণ করে চলে এসেছি অথচ এখনো জানি না যে লোকটা কে?

‘লোকটা একটা মেয়ে’ হেসে ফেলল জো। উত্তর পূর্ণ করে দিল ডেবরা।

হান্নাহ। হেসে তাকাল জোর দিকে। ওর ফিয়াসে। হাদাস্মা হাসপাতালে নার্সিং সিসটার আর আসছে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য।’

‘তোমার ফিয়াসে?’ ফিসফিস করে উঠল ডেভিড।

‘ওরা জুন মাসে বিয়ে করতে যাচ্ছে। ডেবরা তাকাল জোর দিকে। পুরো দুই বছর লেগেছে সিদ্ধান্ত নিতে।’

অস্বস্তিতে নড়েচড়ে উঠল জো। হাতে চাপ দিল ডেবরা।

‘তোমার ফিয়াসে?’ আবার জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

‘তুমি কেন বারবার একই কথা বলছো?’ জানতে চাইল ডেবরা। ডেভিড প্রথমে জোর দিকে নির্দেশ করে তাকাল ডেবরার দিকে।

‘কী, শুরু করল সে, আমি বুঝতে চাইছি। কে কী হচ্ছে এসব?’

হঠাৎ করেই বুঝতে পারল ডেবরা। হাঁ করে তাকিয়ে থেকে মুখ ঢাকল দুই হাতে। চোখ জ্বলছে। তুমি মানে তুমি ভেবেছো? ওহ্ না। বিড়বিড় করে উঠল ডেবরা। জোর দিকে তারপর নিজেকে দেখিয়ে বলে উঠল ‘এটাই ভেবেছো তুমি? মাথা নাড়ল ডেভিড।

‘ও আমার ভাই।‘ ধিক্কার দিয়ে উঠল ডেবরা। জো আমার ভাই, ইউ ইডিয়ট। যোসেফ ইস্রায়েল মোরদেসাই আর ডেবরা রুথ মোরদেসাই-ভাই বোন।

প্রথম নজরে দেখলে হান্নাহও বেশ বড়সড় একটি মেয়ে। উজ্জ্বল তামাটে রঙের চুল আর সোনালি তিল ভর্তি মুখমণ্ডল। জো থেকে খুব বেশি হলে এক থেকে দুইঞ্চি পরিমাণ খাটো। কিন্তু কাস্টমস গেইট দিয়ে বের হয়ে আসার পর সহজেই তাকে তুলে নিল জো, মেয়েটার পা উঠে গেল মাটি থেকে, বিশাল বক্ষবন্ধনে আবদ্ধ হলো দু’জনে।

তাই ব্যাপারটা স্বাভাবিক দেখল যখন তারা চারজন একসাথে রয়ে গেল। কাকতালীয়ভাবে সবার লাগেজ এঁটে গেল মুস্তাংয়ে। পেছনের সিটে প্রায় জোর কোলের উপর বসে রইল হান্নাহ।

‘আমাদের হাতে আছে এক সপ্তাহ। জানাল ডেবরা। পুরো একটি সপ্তাহ। কী করব আমরা এটি নিয়ে?’

সকলে একমত হলো যে টোরেমোলিনস শেষ। এটা বেশ অনেক দূর দক্ষিণে। আর যখন থেকে মিশেনার দ্যা ড্রিফটারস রচনা করেছে তখন থেকেই এটা এলেবেলে মানুষদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে।

‘প্লেনে একজনের সাথে কথা হয়েছে আমার। উপকূলের কাছে একটা জায়গা আছে। নাম কোলেরা। সীমান্তের কাছেই।‘

পরের দিন সকালবেলার মাঝামাঝি সময়ে কোলেরা পৌঁছাল সকলে। আর সিজনের একেবারে প্রথম দিকে হওয়ায় ছোট্ট হোটেলে সুন্দর রুম খুঁজে পেতে কোন সমস্যা হলো না। প্রধান রাস্তার পাশেই হলো হোটেল। মেয়েরা রুম শেয়ার করতে রাজি হলো। কিন্তু ডেভিড নিজের জন্য আলাদা রুম নিতে চাইল। ইতিমধ্যে ডেবরাকে নিয়ে নানান পরিকল্পনা করে ফেলেছে সে।

ডেবরার নীল রঙের সংক্ষিপ্ত বিকিনি দেখে মনে হলো তার যৌবন ঢাকতে ব্যর্থই হয়েছে এ পোশাক। দেহতৃক স্যাটিনের মতো আর ট্যানড় হয়ে রঙ হয়েছে গাঢ় মেহগনি। যদিও কস্টিউমের পেছন দিকে উঁকি দিচ্ছে সাদা ঝলক। ভোয়ালে নেয়ার জন্য নিচু হতে স্পষ্ট বোঝা গেল তা। কোমর আর যথেষ্ট লম্বা পা নিয়ে ডেবরা একজন শক্তিশালী সাঁতারু–ঠাণ্ডা নীল জলে ডেভিডের সাথে একত্রে তাল মেলালো যখন তীর থেকে আধ মাইল দূরে পাথুরে দ্বীপে গেল দু’জনে।

ছোট্ট দ্বীপটা মনে হলো তাদের নিজস্ব। মসৃণ একটা পাথর খুঁজে বের করে পাশাপাশি বসল আঙুলে আঙুল পেঁচিয়ে। লবণাক্ত জলে চুল ভিজে লেপ্টে আছে ডেবরার কাঁধে।

সূর্যের নিচে শুয়ে পুরো দুপুর জুড়ে কথা বলল দু’জনে। একে অপরের সম্পর্কে অনেক কিছুই আছে জানার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান এয়ারফোর্সের একজন তরুণ কর্নেল ছিল ডেবরার বাবা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চলে যায় ইস্রায়েলে। তারপর থেকে সেখানেই আছে। বর্তমানে মেজর জেনারেল। জেরুজালেমের যে অংশে তাদের বাসা, তা প্রায় পাঁচশ বছরের পুরাতন যদিও আনন্দের কোন কমতি নেই সেথায়।

হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির সিনিয়র লেকচারার ডেবরার বিশেষ একটি গোপন ব্যাপার হলো যে সে লিখছে চায়। তার রচিত কবিতার ছোট্ট একটা ভলিউম ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। মুগ্ধ হয়ে গেল ডেভিড। এক কুনইয়ের উপর সোজা হয়ে তাকিয়ে রইল শ্রদ্ধাভরে ডেবরার দিকে। খানিকটা ঈর্ষাও হলো। সামনেটা যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ডেবরা।

সূর্যের কারণে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ডেবরা। ঘন গাঢ় চোখের পাতায় উজ্জ্বল রত্ন পাথরের মতো জমে আছে জলের ফোঁটা। মেয়েটা সুন্দরী নয়, সিদ্ধান্ত নিল ডেভিড। কিন্তু বেশ সুশ্রী আর অনেক, অনেক সেক্সী। তাকে তার পেতেই হবে। এ ব্যাপারে ডেভিডের মাঝে কোন দ্বিধা না থাকলেও মনে হলো তাড়াতাড়ি করা দরকার। ডেবরার কথা উপভোগ করতে লাগল ডেভিড। নিজেকে প্রকাশের জন্য ওর চমৎকার কিন্তু অদ্ভুত একটা পথ আছে। পুরোপুরি মেলে ধরার পর উচ্চারণ হয়ে গেল নিরপেক্ষ যদিও তার আমেরিকান ব্যাকগ্রাউন্ডের ছোঁয়া খানিকটা রয়ে গেল। ডেবরা জানাল যে কবিতা রচনা মাত্র শুরু। ইস্রায়েলে বেড়ে ওঠার উপর একটা উপন্যাস রচনা করবে। খসড়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে আর শোনার পর গল্পটা বেশ চমকপ্রদ লাগল ডেভিডের কাছে। এরপর বলতে লাগল ওর দেশ আর সেখানে বসবাসরতে মানুষের কথা। শুনতে শুনতে মনে হলো কিছু একটা চাঙ্গা হয়ে উঠল ডেভিডের মনের মাঝে নস্টালজিয়া, গভীরে থাকা গোত্রীয় স্মৃতি। আবারো হিংসা হলো তার। কোথা থেকে এসেছে আর কোথায় যাচ্ছে তার নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত ডেবরা। ডেবরা জানে কোথার তার জায়গা, কোথায় তার নিয়তি। এই কারণে মেয়েটাকে বেশ শক্তিশালী মনে হলো। ডেবরার পাশে বসে হঠাৎ করেই নিজেকে বেশ তুচ্ছ আর উদ্দেশ্যহীন মনে হলো ডেভিডের।

হঠাৎ করেই চোখ খুলে ফেলল ডেবরা। সূর্যের আলোয় পিটপিট করল একটু। এর পরই দেখল ডেভিডকে।

‘ওহ ডিয়ার। হেসে ফেলল ডেবরা। আমরা খুব দুঃখিত, ডেভিড আমি অনেক কথা বলি?’ মাথা নাড়ল ডেভিড। কিন্তু মেয়েটার হাসি দেখে কোন উত্তর দিল না। ডেবরা ও হয়ে গেল চুপচাপ।

সাবধানে তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে। মনোযোগ দিল। সূর্যের তেজে শুকিয়ে এলোমেলো হয়ে আছে চুল। তারপরেও বেশ মসৃণ সুন্দর আর গাঢ় কালো। গালের হাড় আর চোয়াল সযত্নে নির্মিত হয়েছে যেন, চোখ জোড়া স্বচ্ছ আর খানিকটা এশিয়াটিক ভাব, ঠোঁট পরিপূর্ণ আর দৃঢ়, লম্বা সুশ্রী নাক।

এগিয়ে এসে ডেভিডের গালে হাত রাখল ডেবরা।

‘তুমি খুব সুন্দর ডেভিড। তোমার মতো সুন্দর কোন মানুষ আমি আর দেখিনি।’

নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে ডেভিড। গাল বেয়ে গলা থেকে বুকে নামল ডেবরার হাত।

আস্তে করে সামনে এসে উষ্ণ আর লবণাক্ত ঠোঁটের স্বাদ নিল ডেভিড।

কিন্তু মসৃণ বাদামী পিঠে কস্টিউমের ভাজ খোলার চেষ্টা করতেই হতাশ হতে হলো ডেভিডকে। তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়ে গেল ডেবরার শরীর। ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল ডেভিডকে।

এরপরও ভদ্রভাবে কিন্তু দৃঢ়ভাবে ডেবরাকে আলিঙ্গন করে রাখল ডেভিড। কানে কানে কথা বলে চাইল তাকে শান্ত করতে। ধীরে ধীরে সহজ হলো ডেবরা। আবারো হাত রাখল ডেভিডের গলায়।

দক্ষ ডেভিড বিদ্রোহ দমনে অভ্যস্ত। তারপরেও স্তব্ধ হয়ে গেল যখন ডেবরা তার কাঁধে হাত রাখল পুনরায় যখন ডেভিড চেষ্টা করতে চাইল। শক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয়ায় ভারসাম্য হারিয়ে পাথর থেকে পড়ে গেল ডেভিড। কনুই দিয়ে পড়ে গড়িয়ে গিয়ে থামলো পানির কিনারায়।

রাগান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। কিন্তু কস্টিউম ঠিক করে লম্বা পা দিয়ে পাথরের উপর উঠে দাঁড়াল ডেবরা। এরপর এক লাফে পড়ল পানির উপর। ডেভিডকে ডেকে বলল,

‘চলো বিচ পর্যন্ত রেস লাগাই।

চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল না ডেভিড। নিজের মতো করে সাঁতার কেটে অনুসরণ করল ডেবরাকে। এরপর গোমড়া মুখে পানি থেকে উঠতেই এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ডেবরা। তারপরই হেসে ফেলল।

‘মনে হচ্ছে তোমার বয়স মাত্র দশ।‘ কিন্তু কোন কাজ হলো না। চুপচাপ নিজের রুমে হেঁটে চলে গেল ডেভিড।

সন্ধ্যাবেলা ‘২০০১ A.D’ নামে ডিসকোথেক আবিষ্কার করার পরেও চুপচাপ রইল ডেভিড। সমুদ্রের দিকে মুখ করে থাকা ডিসকোটা চালায় কয়েকটা ইংরেজ তরুণ। এমন একটা টেবিলের পাশে জড়ো হলো তারা যেখানে ইতিমধ্যে দুজন বি.ই.এ. হোস্টেস আর কঠিন মুখের দাড়িওয়ালা বসে আছে। গান বাজাছে উচ্চ স্বরে আর সুরটাও এমন যে কিছুতেই শরীর সহজ করা যায় না। হোস্টেস দু’জন প্রায় ধর্মীয় ভক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে। তাই দেখে ডেবরা আমন্ত্রণ জানাল ডেভিডকে। নারীসুলভ দ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে মজা পেল ডেভিড। নিজের বরফশীতল মনোভাব ঝেড়ে ফেলে নাচতে শুরু করল ডেবরার সাথে।

একসাথে চমৎকার নাচলো দু’জনে। কর্কশ গানের তালে ও তাল মিলালো। আফ্রিকার পুরাতন একটি মুদ্রা এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলল যে অন্যান্য নাচিয়েরাও তাকিয়ে রইল।

গান পরিবর্তন হলো। ডেবরা এগিয়ে এসে ডেভিডের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ডেভিডের মনে হল যেন কোন একটা শক্তি আসছে ডেবরার শরীর থেকে, যার ফলে জাগ্রত হয়ে উঠছে ওর শরীরের প্রতিটি ইন্দ্রিয় আর এও বুঝতে পারল যে এই নারীর সাথে যে কোন ধরনের সম্পর্কের পথ এত সহজ হবে না। এত গভীর ছিল এ উপলব্ধি যে প্রায় দ্রুতই আবার ভুলে গেল তা।

রেকর্ড শেষ হতেই হান্নাহ আর জোকে রেখে নীরব রাস্তায় নেমে এলো দু’জনে। পথ নেমে গেছে নিচে বিচের দিকে।

আকাশে চাঁদ থাকায় বিচের উপর জড়ো হয়ে থাকা চুড়াগুলোও দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের গায়ে মনে হলো অসংখ্য হলুদ চিত্র। পাথুরে বিচে ভেসে আসছে সমুদ্রের ঢেউ। জুতো খুলে রেখে গোড়ালি অব্দি পা পানিতে ডুবিয়ে হাঁটতে লাগল দুজনে।

কয়েকটা পাথরের কাছে এসে খানিক গোপন জায়গা পেয়ে থেমে গেল একে অপরকে কিস করার জন্য। ডেবরার নরম অভিব্যক্তিতে দুপুরের অসমাপ্ত কাজের সমাপ্তি হবে বলে ভাবল ডেভিড।

এই ভুলের পরিণামে আবারো ধাক্কা খেল ডেবরার হাতে। কিন্তু এবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর রাগের গলায় বলে উঠল ডেবরা।

‘ধুত্তোরি! তুমি এখনো শেখোনি? আমি এটা করতে চাই না। যতবার আমরা একা হবো ততবারই এমন চেষ্টা করবে তুমি?

‘সমস্যা কী তাতে?’ ডেভিডও গলা তুলল। রেগে উঠছে ক্রমে। এটা বিংশ শতাব্দী ডালিং। কুমারী মেয়ে এই সিজনের স্টাইল নয়–তুমি শোননি?

‘আর বখে যাওয়া ছোট্ট ছেলেগুলোর উচিৎ বড় হয়ে ওঠা, যখন তারা নিজের দায়িত্ব নেবে। জ্বলন্ত দৃষ্টি হানলো ডেবরা।

থ্যাংকস!’ গড়গড় করে উঠল ডেভিড।

‘কোন পেশাদার কুমারীর কাছ থেকে অপমান পাবার জন্য আমি আশেপাশে থাকতে চাই না।’

ভালোই তো, চলে যাও তাহলে।’ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল ডেবরা।

হুম, দ্যাটস আ গ্রেট আইডিয়া! ডেবরার দিকে পেছন ঘুরে বিচ থেকে চলে গেল ডেভিড। এতটা আশা করেনি ডেবরা। ছুটতে শুরু করল ডেভিডের পিছুপিছু-কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধ থামালো তাকে। থেমে গিয়ে হেলান দিল একটা পাথরের গায়ে।

দুঃখে কাতর ডেবরা ভাবল, ওর উপর জোর করা উচিৎ হয়নি ডেভিডের। আমি ডেভিডকে চাই, সত্যি চাই, কিন্তু ভুডুর পর ডেভিডই হবে প্রথম। শুধু একটু সময় পেলেই ঠিক হয়ে যেত সবকিছু। জোর করা উচিৎ হয়নি। যদি ডেভিড ডেবরার গতিতেই এগোত তাহলে সঠিক কাজটাই করতে পারতো সে।

কেমন হলো ব্যাপারটা যে আমি ডুডু সম্পর্কে অনেক কিছু এখন ভাবতেও পারি না। মাত্র তিন বছর হয়েছে। কিন্তু ওর স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এমনকি মুখটাও মনে নেই ঠিকভাবে। অথচ ডেভিডের প্রতিটি অংশ একেবারে নিখুঁত ভাবে মনে আছে- প্রতিটি রেখা।

আমার হয়তো উচিৎ ডেভিডের পিছুপিছু গিয়ে ওকে ডুডুর কথা খুলে বলা। ওকে বলা যে, ধৈর্য ধরে আমাকে যেন একটু সাহায্য করে। এটাই হয়তো করা উচিৎ ভাবলেও কাজটা করল না ডেবরা। ধীরে ধীরে হেঁটে বিচ্ থেকে বের হয়ে আসল। নীরব শহরের মাঝ দিয়ে চলে গেল হোটেলের দিকে।

রুমের মাঝে হান্নাহর বিছানা একদম খালি। নিশ্চয় জোর সাথে। ডেবরা ভাবল আমারও তো কথা ছিল ডেভিডের সাথে থাকার। ডুডু মারা গেছে, আমি বেঁচে আছি। আমি ডেভিডকে চাই, ওর সাথেই আমার হওয়া উচিৎ কিন্তু ধীরে ধীরে কাপড় খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ল ডেবরা, যদিও ঘুম হলো না মোটেই।

‘২০০১ A.D ডিসকোর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ডেভিড। একটা হোস্টেস বেশ লম্বা, সোনালি চুল, গায়ের রঙ ইংরেজদের মতো, চোখ চায়না ডলের। চোখ তুলে ডেভিডকে দেখতে পেল মেয়েটা, চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিল ডেবরা আছে কিনা। হাসল।

একটা রেকর্ড শেষ না হওয়া পর্যন্ত একে অন্যকে স্পর্শ করা ছাড়াই নাচলো দু’জনে। এরপর ঝুঁকে কাছে গেল ডেভিড। জানতে চাইল,

‘তোমার কোন রুম আছে? মাথা নাড়ল মেয়েটা।

‘চল,’ জানালো ডেভিড।

ডেভিড যখন নিজের রুমে ফিরে এলো বাইরে তখন আলো। শেভ করে ব্যাগ গুছিয়ে নিল। রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ দেখে নিজেই হতবাক হয়ে গেল। কাউন্টারের কাছে লাগেজ জড়ো করে ডাইনারস ক্লাব কার্ড দিয়ে পরিশোধ করে দিল বিল।

ব্রেকফাস্ট রুম থেকে জো আর হান্নাহর সাথে বাইরে বের হয়ে এলো ডেবরা। বিচে যাবার জন্য পোশাক পরে আছে সকলে। বাদিং গিয়ারের উপর। টেরি রোব জড়ানো। হাসিখুশি দেখাল সকলকেই–তারপরই ওরা দেখতে পেল ডেভিডকে।

‘অ্যাই!’ ডাক দিল জো। কোথায় যাচ্ছো তুমি?

যথেষ্ট দেখা হয়েছে স্পেন। জানাল ডেভিড। কয়েকটা ভালো উপদেশও পেয়েছি। চলে যাচ্ছি। এরপরই দেখতে পেল ডেবরার চোখে সরে গেল ব্যথার দ্রুত ছায়া। খানিকটা আত্মশ্লাঘা বোধ করল সে। হান্নাহ আর জো দুজনেই ঘুরে তাকাল ডেবরার দিকে। তাড়াতাড়ি ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নিল ডেবরা। খানিকটা উজ্জ্বল ভাবে হেসে, এগিয়ে এলো সামনে। বাড়িয়ে দিল হাত।

‘তোমার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ ডেভিড। আমি দুঃখিত যে তোমাকে চলে যেতে হচ্ছে। ভালো লেগেছে তোমার সঙ্গ।’ এরপরই গলার স্বর নেমে গেল খাদে। আশা করি যা খুজছো তা পেয়ে যাবে। গুডলাক।’

এরপর দ্রুত ঘুরে নিজের রুমে চলে গেল সে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল হান্নাহ। ডেভিডের দিকে বক্র দৃষ্টি হেনে চলে গেল ডেবরার পিছুপিছু।

ভালো থাকো, জো।

‘আমি তোমার ব্যাগ নিচ্ছি।

‘ঠিক আছে, লাগবে না। ডেভিড চেষ্টা করল জোকে থামাতে।

‘কোন সমস্যা নেই।’ জো লাগেজ নিয়ে নিল ডেভিডের হাত থেকে। মুস্তাং পর্যন্ত নিয়ে গেল। পেছনের সিটে রেখে দিল সব।

‘পাহাড়ের উপর পর্যন্ত যাবো তোমার সাথে আর হেঁটে ফিরে আসব।’ প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসল জো, আরাম করে বসল। আমার একটু শরীরচর্চা করা দরকার।’

দ্রুত গাড়ি চালাতে লাগল জো। দুজনেই রইল চুপচাপ। ইচ্ছে করে সিগারেট জ্বালালো জো তারপর দিয়াশলাই ফেলে দিল জানালা দিয়ে।

‘আমি জানি কোথায় ভুল হয়েছে ডেভি। কিন্তু আমি অনুমান করতে পারছি।’

উত্তর দিল না ডেভিড। পথের দিকে নজর।

‘ও একটা খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছে কিছুদিন আগে, মাত্র গত কয়েকদিনে এর একটু পরিবর্তন হলো। বেশ হাসিখুশি, আমারই তাই মনে হয়েছে সব হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।

তারপরেও চুপ করে রইল ডেভিড। কোন পাত্তাই দিল না জোর কথায়। মাথা মোটাটা নিজের ব্যাপারে নাক গলায় না কেন।

‘ও অসাধারণ একজন মানুষ ডেভি। এমন নয় যে আমার বোন বলে বলছি। ও সত্যিই তাই আর আমার মনে হয় ওর সম্পর্কে জানা উচিৎ তোমার-শুধু শুধু খারাপ ভেবো না।’

উপসাগর আর শহরের উপর পাহাড়ের মাথায় পৌঁছালো তারা। ডেভিড গাড়ি থামালো কিন্তু ইঞ্জিন চালু রাখল। তাকিয়ে রইল নিচে অনিন্দ্যসুন্দর নীল সাগরের দিকে। একসাথে মিলে গেছে পাথরের চূড়া আর পাইনের পাহাড়।

‘ডেবরার বিয়ের কথা চলছিল। নরম স্বরে বলতে লাগল জো। ছেলেটা ছিল চমৎকার, ডেবরার চেয়ে বড়। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে কাজ করতে তারা। এছাড়াও রিজার্ভের ট্যাংক ড্রাইভার ছিল ছেলেটা। সিনাইতে অভিযানের সময় ট্যাংকসহ পুড়ে যায়।’

ঘুরে জোর দিকে তাকাল ডেভিড। খানিকটা নরম হয়েছে চোখের দৃষ্টি।

‘ডেবরা ভেঙ্গে পড়ে একেবারে।’ একগুয়ে ভাবে বলতে থাকে জো। মাত্র গত কয়েক দিন ধরে আমি ওকে সত্যিকারের খুশি আর সহজ স্বাভাবিক দেখছি।’

কাঁধ ঝাঁকাল জো আর এমনভাবে হাসল যেন বিশাল সেন্ট বার্নারড কুকুর। পরিবারিক ইতিহাস বলার জন্য দুঃখিত ডেভি। শুধু ভেবেছি হয়তো এতে কোন উপকার হবে। বড়সড় বাদামী হাত বাড়িয়ে দিল জো। আমাদের ওখানে বেড়াতে এসো। তুমি জো জানো ওটা তোমারও দেশ। তোমাকে ঘুরিয়ে দেখাতে ভালোই লাগবে আমার।’

হাত বাড়ালো ডেভিড। আমি হয়তো আসব কখনো জানিয়ে দিল সে।

‘শালোম।

‘শালোম জো। গুড লাক।’ গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেল জো। রাস্তার পাশে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল ডেভিডের চলে যাওয়া। হাত নাড়াল সে আর প্রথম বাকের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল গাড়ি।

২. ফর্মুলা ওয়ান রেসিং ড্রাইভার

ভবিষ্যতে ফর্মুলা ওয়ান রেসিং ড্রাইভার হতে চায় এমনতরদের জন্য রোমের পথে অস্টিয়াতে পরিত্যক্ত একটা কংক্রিট সার্কিটে গড়ে উঠেছে স্কুল। তিন সপ্তাহের কোর্সের খরচ ৫০০ ইউ এস ডলার

ভিয়া ভেনেতোতে উঠল ডেভিড আর প্রতিদিন গেল ট্রাকে। যদিও ও পুরো কোর্সটাই শেষ করল তারপরেও প্রথম সপ্তাহের শেষেই জেনে গিয়েছিল এটা ওর গন্তব্য নয়। অবারিত আকাশে ছুটে বেড়ানোর পর ট্র্যাক মনে হলো সংকীর্ণ। এমনকি একটা জেটের ইঞ্জিনের কাছের টাইরেল ফোর্ডের গড়গড় করা শক্তি কিছুই নয়। যদিও ক্লাশের অন্যদের তুলনায় ওর মনোসংযোগ কমই ছিল, কিন্তু গতি আর সামঞ্জস্য সম্পর্কে জন্মগত প্রতিভার জোরে সবার উপরেই থাকল ওর ফলাফল। একটা কোম্পানির কাছ থেকে ড্রাইভিং করার প্রস্তাবও পেয়ে গেল। বেতন তত একটা ভালো না হলেও সিজনের জন্য প্রায় কন্ট্রাক্ট সাইন করেই ফেলেছিল সে। একেবারে শেষপর্যায়ে মন পরিবর্তন করে আবারো শুরু হয় চলা।

এথেন্সে এক সপ্তাহ কাটায় পিরাউস আর গ্লাইফাড়ার ইয়ট বেসিনের কাছে ঘোরাঘুরি করে। একটা মোটর ইয়ট কিনে দ্বীপ সমূহে চার্টার করে ঘুরে বেড়ালে কেমন হবে ব্যাপারটা, এ সম্পর্কে ও খোঁজখবর নিল। সূর্য, সমুদ্র আর সুন্দরী মেয়েদের মিলনমেলা দেখে মনে হলে ভাল হবে ব্যাপারটা। ইয়টগুলোও বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল তুষারের মতো পেইন্ট-ওয়ার্ক আর বার্নিশ করা কাঠের কাজের জন্য। কিন্তু সপ্তাহখানেকের মাঝে বুঝে গেল যে চার্টার করে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো মানে একদল বিরক্তিকর রোদে পোড়া সী-সিক টুরিস্টদের বোর্ডিং হাউজ বয়ে বেড়ানো।

সপ্তম দিনে এথেন্স বন্দরে নোঙ্গর ফেলল আমেরিকান ষষ্ঠ বহর। বিচের দিকে মুখ করে থাকা একটা ক্যাফের টেবিলে বসেছিল ডেভিড। সূর্যের নিচে বসে ওজো পান করতে করতে বাইনোকুলার চোখে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে। বিশাল সমতল উপরতলায় পাখা ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি ক্রুসেডারস আর ফ্যান্টমস্। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো কেমন একটা তৃষ্ণা জেগে উঠল। অনেক দিনের পিপাসার্ত যেন সে। আত্মার গহীন থেকে উঠে এলো দীর্ঘশ্বাস। মনে হলো সারা পৃথিবী খুঁজে নিজের জন্য কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। বাইনোকুলার রেখে দিল একপাশে। তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। অনেক উঁচুতে একটা মেঘখণ্ড। নীলের গায়ে উজ্জল রুপালি।

দুধের মতো ওজোর গ্লাস তুলে নিল ডেভিড। সূর্যের তাপে গরম হয়ে আছে পানীয়টুকু। গলায় ঢেলে দিল মিষ্টি তরল।

পূর্ব অথবা পশ্চিম, ঘরই হলো আসল।

উঁচুস্বরে বলে উঠল ডেভিড। মনশ্চক্ষে দেখতে পেল গ্লাস আর স্টিল দিয়ে ঘেরা উঁচু অফিসে বসে আছে পল মরগ্যান। ধৈর্য নিয়ে বসে আছে যেন একটা জেলে। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে তার জাল। ঠিক এই সময়ে এথেন্সে ছড়িয়ে থাকা জালটা গুটাতে শুরু করে দিল। পল মরগ্যানের চোখে মুখে ফুটে ওঠা তৃপ্তির ছাপটাও যেন স্পষ্ট দেখতে পেল ডেভিড। টেনে নিচ্ছে ডেভিডকে। ধুত্তোরি, আমি তো এখনো রিজার্ভ অফিসার হিসেবে ফ্লাই করতে পারি, মনে মনে ভাবল সে। আর সবসময়ের জন্য লিয়ার তো আছেই যদি বার্নির থেকে নেয়া যায়, তবেই।

গ্লাস রেখে দ্রুত উঠে দাঁড়াল ডেভিড। আত্মরক্ষার ক্ষীণ আশা জেগে উঠেছে মনের মাঝে। ক্যাব থামিয়ে ছুটে চলল সিনডাগমা স্কোয়ারে গ্রান্ডে ব্রেটাগনেতে নিজের রুমে।

অথচ সব সংকল্প উবে যেতে খুব বেশি একটা সময়ও লাগেনি। কেননা রাতের ডিনারে ডেভিডের সঙ্গী হয় জন ডিনোপোলাস, মরগ্যান গ্রুপের গ্রীস এজেন্ট। কৃশকায় রোদে পোড়া বলিরেখাহীন অভিজাত চেহারার জনের চুলে সাদার ছোঁয়া আর বেশভূষাতেও আড়ম্বরহীন।

ডেভিডের সাথে এক টেবিলে বসার জন্য জন নির্বাচন করল বেশ কয়েকটি ইটালিয় স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্সের নারী-তারকাকে। উদ্ধত যৌবন তরুণী নারীর চোখ দুটি ঘন কালো আর উজ্জ্বল। জন ডেভিডকে আফ্রিকা থেকে আগত একজন হীরক কোটিপতি হিসেবে প্রমাণ দেয়ার পর থেকে কালো চোখ দুটোতে রীতিমত আন্দোলন আর ব্যাকুলতা শুরু হয়ে গেল।

ডায়মন্ড যদিও সবচেয়ে সুন্দর, তথাপি মরগ্যান গ্রুপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়।

কোমল সন্ধ্যায় ডায়োনি সিয়াসের ছাদে বসল তারা। লাইকা বেটাস-এর পাথর কেটে ধাপে ধাপে তৈরি করা হয়েছে রেস্টুরেন্টটি; সেন্ট পল গির্জার নিচে।

এঁকেবেঁকে পথ বেয়ে পাইন বনের মাঝখান দিয়ে শান্ত রাতের বাতাসে হাতে মোমবাতি নিয়ে মিষ্টি গান গেয়ে এগিয়ে চলেছে ইস্টার শোভাযাত্রাকারীদের দল। এর অনেক উপরে পাহাড়ের মাথায় অ্যাক্রোপলিসের সোজা কলামগুলো ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়। প্রাচীন আইভরির মতই মাখন রঙা হয়ে আছে এগুলো। এর নিচে মধ্যরাতের পানিতে আলোর মালা গলায় দিয়ে ভাসছে আমেরিকান রনপোত।

‘গ্রিসের বিজয়গাথা ছিল। বিড়বিড় করে উঠল ইটালিয় তারকা। মনে হল যেন প্রাচীন আমলের কোনো তাপসীর গলা। ভারী রত্ন পরা একটা হাত রাখল ডেভিডের উরুতে। আরেকটা হাত দিয়ে লাল সামোস ওয়াইন তুলে ধরল ডেভিডের উদ্দেশে আর এমন ভাবে তাকাল যে ঘন চোখের পাতার নিচের ভাষা বুঝতে সমস্যা হলো না ডেভিডের।

মহিলার ধৈৰ্যশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ডেভিড। ক্রিম দেয়া লেমন সসে ডুবিয়ে রাখা আঙুর পাতায় মোড়ানো মাংস দিয়ে মেইন কোর্স খাবার পরই কেবলমাত্র ইটালিয় তারকা পরামর্শ দিল যে ডেভিড হয়তো তার পরবর্তী ছবিতে অর্থলগ্নী করতে রাজি হয়ে যাবে। চলুন এমন কোন জায়গা খুঁজে বের করি যেখানে বসে এ ব্যাপারে কথা বলতে পারব আমরা। বিড়বিড় করে উঠল নারী তারকা আর তার স্যুইট ছাড়া ভালো জায়গা আর কোনটা হতে পারে?

জুন ডিনোপোলাস হাত নেড়ে বিদায় জানাল তাদেরকে। জনের মুখে হাসি আর বিরক্তিকর একটা ভঙ্গি থেকে পুরো ব্যাপারটার অসাড়তা টের পেল ডেভিড।

নারী তারকার সুইট বেশ চিত্তাকর্ষক। মোটা সাদা কার্পেট আর বড়সড় চামড়ার কালোসোফা। নিজের জন্য ড্রিংক নিল ডেভিড। এই ফাঁকে বেশ পরিবর্তন করতে গেল নারী তারকা। ড্রিংক মুখে নিয়েই ডেভিড বুঝতে পারল যে এটা তার পছন্দ নয়। বার কাউন্টার ছেড়ে চলে আসল সে।

বেডরুম থেকে বের হয়ে এলো নারী তারকা। পরনে সাদা সাটিনের বেডরোব। হাতা কাটা রোবের স্বচ্ছ কাপড় ভেদ করে গোলাপী উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে দেহত্বক। চুল খোলা, আবেদনময়ী ভঙ্গিতে কুঁকড়ে আছে কাঁধের চারপাশে হঠাৎ করেই পুরো ব্যাপারটাতে অসুস্থ বোধ করল ডেভিড।

‘আমি দুঃখিত। জানাল ডেভিড। জন মজা করছিল–আমি কোন মিলিয়নিয়ার নই আর ছেলেদের ক্ষেত্রেই আগ্রহী বোধ করি শুধু।

দরজা বন্ধ করে বের হয়ে এলো ডেভিড। সাথে সাথে শুনতে পেল দরজার গায়ে গ্লাস ভাঙার শব্দ।

নিজের হোটেলের রুমে ফিরে কফির অর্ডার দিল ডেভিড। কী মনে হতেই আবারো টেলিফোন তুলে নিয়ে কেপ টাউনে কল করল। অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে লাইন পেয়ে গেল সে। ঘুম জড়ানো মেয়েলি কণ্ঠ শোনা গেল অপর পাশ থেকে।

‘মিটজি? হেসে ফেলল ডেভিড। কেমন আছে মেয়েটা

? ‘তুমি কোথায় ওয়ারিওর? বাসায়?

‘আমি এথেন্সে, ডল।

‘এথেন্স–গড! যুদ্ধের খবর কী?

টানা হেচড়া করে এগোচ্ছে।

ইয়াহ! আমারই তাই মনে হয়। কাশি দিল মিটজি। গ্রিক গার্লস আর আগের মতো নেই–ডিয়ার।

কেমন আছো মিটজি?’

‘আই অ্যাম ইন লাভ, ডেভি। মানে সত্যিকারের প্রেম। অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি। অদ্ভুত না ব্যাপারটা?’

হঠাৎ করেই রেগে গেল ডেভিড। মিটজির গলার কণ্ঠে মনে হলো হিংসাও এলো ওর মাঝে।

‘দ্যাটস গ্রেট, ডল। আমি কি চিনি ওকে?

‘সিসিল ললি। তুমি চেনো। ড্যাডির অ্যাকাউন্ট্যান্টদের একজন।

বিশালদেহী, বিবর্ণ চেহারা, চশমা পরা আর সিরিয়াস টাইপের একটা মানুষের কথা মনে পড়ে গেল ডেভিডের।

কনগ্রাচুলেশনস,’ বলল ডেভিড। নিজেকে খুব একা মনে হলো। বাড়ি থেকে এত দূরে, তাকে ছাড়াও জীবন সেখানে ঠিকই এগিয়ে চলেছে।

‘তুমি ওর, সাথে কথা বলতে চাও?’ জানতে চাইল মিটজি। আমি তাকে জাগিয়ে দিচ্ছি।’ বিড়বিড় শব্দে কিছু শোনা গেল অপরপাশে। তারপরই লাইনে এলো সিসিল।

‘নাইস ওয়ার্ক, সত্যি কথাই বলল ডেভিড। তার তুলনায় মিটজির শেয়ার নিঃসন্দেহে বেশি মরগ্যান গ্রুপে। নিজেকে তেলের কূপে ফেলে দিয়েছে সিসিল।

‘ধন্যবান, ডেভি। পাঁচ হাজার মাইল পার হয়েও টেলিফোনের তার বেয়ে ঠিকই ভেসে এলো সিসিলের কণ্ঠের অস্বস্তি।

‘শোন, লাভার যদি মেয়েটাকে তুমি একটুও আঘাত দাও, আমি নিজে তোমার কলজে ছিঁড়ে গলা দিয়ে ঢুকিয়ে দেবো, বুঝলে?

‘ঠিক আছে। নিজের কণ্ঠের সতর্কতা ভাব লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো সিসিল। আমি মিটজিকে ফোন দিচ্ছি।

রাখার আগে আরো বকবক করল মিটজি। পঞ্চাশ ডলার খরচ করিয়ে তবেই ছাড়লো সে। মাথার পেছনে হাত দিয়ে শুয়ে রইল ডেভিড। ভাবতে লাগল নরম মনের গাড়ল বোনটা আর নতুন পাওয়া খুশির কথা। এরপর হঠাৎ করেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল ডেভিড। স্পেন ছাড়ার পর থেকেই অবচেতন ভাবে কাজটা করতে চাইছে সে। আবারো ফোন তুলে নিয়ে পোর্টারের ডেস্কে ফোন করল।

‘এত সকালে তোমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু যত শীঘ্ন সম্ভব ইস্রায়েলের ফ্লাইট ধরতে চাই আমি। অ্যারেঞ্জ করতে পারবে প্লিজ?

.

মরুভূমি থেকে আসা মোলায়েম সোনালি কুয়াশায় ঢেকে আছে আকাশ। এর মাঝ দিয়েই উড়ে চলল বিশাল টি.ডব্লিউ.এ. ৭৪৭। টাচ্ ডাউনের ঝাঁকুনি খাবার আগে ঘন সবুজ সিটরাস বাগানের একঝলক দেখতে পেল ডেভিড। পৃথিবীর অন্য সব বিমানবন্দরের সাথে কোন পার্থক্য নেই লডের। কিন্তু এর দরজার বাইরের এমন জায়গা আর কখনো দেখেনি সে। বিশাল এক ভিড়ের সাথে যুদ্ধ করে বড়সড় কালো কন্যুনাল ট্রাক্সির মাঝে একটা সিট পেল ডেভিড। ট্রাক্সির গায়ে প্লাস্টার লাগান আর বিভিন্ন অলংকারও ঝুলছে। এমনকি ভদ্র-সভ্য ইটালিয়দের মাঝেও দেখা গেল উজ্জ্বলতা।

ট্যাক্সিতে উঠে বসার পর মনে হল পরিবারের সবাই মিলে মিশে ঘুরতে বের হয়েছে আর ডেভিডও এই পরিবারেরই সদস্য। তার একপাশে বসে আছে বুকে সেনাবাহিনীর চিহ্ন সম্বলিত প্যারাট্রুপার, গলা থেকে ঝুলছে উজি সাব-মেশিনগান; সিগারেট সাধলো লোকটা ডেভিডকে। অন্যপাশে বসেছে খাকি ইউনিফর্ম পরিহিত এক বালিকা। হরিণ চক্ষু ইস্রায়েলী বালিকার চোখ দুটো হয়ে উঠল আরো ঘন কালো আর সুন্দর, যখন ডেভিডের দিকে ঘুরে তাকাল। প্রায়ই স্যান্ডউইচ আর ভাজা মটরশুটির বল সাধলো ডেভিডকে। পিঠাও নিতে বলল সাথে। আবার নিজের ইংরেজিও ঝালাই করে নিতে লাগল ডেভিডের উপর। সামনের আসনে বসা সবাই ঘুরে তাকাল এই আলোচনায় অংশ নিতে। এদের মাঝে ড্রাইভারও অন্তর্ভূক্ত হলো। যদিও সে তার গতি এতটুকু কম হতে দিল না আর কথার ফাঁকে ফাঁকে যতিচিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করল বিকট শব্দের হর্ন আর পথচারী ও অন্য ড্রাইভারদের উপর গালি-গালাজ।

উপকূলীয় নিচু ভূমিতে কুয়াশার মতই ভারী হয়ে আছে কমলার সুগন্ধ। এরপর থেকে ইস্রায়েলের পরিচিতি হিসেবে এই গান্ধটাই পাবে ডেভিড।

জুদাইয়ান পাহাড়ে উঠে এলো ট্যাক্সি। নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসল ডেভিডকে। পাইনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাইওয়ে, শো শো বাতাস, চারপাশে উজ্জ্বল-ধূসর গড়ানে ভূমি পার হওয়া যেখানে সূর্যের আলোয় সাদা পাথর চকচক করে হাড়ের মতো রুপালি জলপাই গাছগুলো শাখা মেলে রেখেছে ছাদের উপর–যা স্বাক্ষী হয়ে আছে ছয় হাজার বছর ধরে মানুষের ধৈর্যশীল পরিশ্রমের। ডেভিডের মনে হচ্ছে সবকিছুই তার অনেক পরিচিত। যদিও দক্ষিণের অন্তরীপের যেসব পাহাড়ের চেয়ে একেবারে ভিন্ন, যাদেরকে সে ঘর বলে জানে। অনেক ধরনের ফুল দেখা গেল, ঠিক ভাবে নাম বলতে পারবে না সে। ক্রিমসন ফুটে ওঠে রক্তের মতো লাল হয়ে। হঠাৎ করেই ঝাঁকি খাওয়ায় মনে হলো শরীরে ব্যথা পেল সে। এমন সময় চোখ পড়ল গাছের ফাঁকে থাকা চকোলেট রঙের ঝটপটানি আর সাদা পাখা। চিনতে পারল আফ্রিকান হুপির নড়াচড়া–এমন একটা পাখি যার অর্থ ঘরে পৌঁছে গেছে সে।

ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা বোধ করল সে। নাম-ঠিকানাবিহীন এ উদ্বেগ বেড়েই চলল, যত সে পৌঁছে যাচ্ছে সেই নারীর কাছে যাকে দেখতে সে এসেছে–আর এমন কিছু যার ব্যাপারে সে এখনো সন্দিহান।

অবশেষে নিজের শিকড় খুঁজে পেয়েছে সে, এমন বোধ হল তার। কাছাকাছি বসে থাকা তরুণীর জন্য সমবেদনা জাগল।

‘দেখো, চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। ডেভিডের হাত ধরে দেখাতে লাগল রাস্তার পাশে পড়ে থাকা যুদ্ধের আবর্জনার দিকে, পোড়া ট্রাক আর সশস্ত্র বাহন, জেরুজালেমের পথে মারা যাওয়া মানুষের স্মরণার্থে সাজিয়ে রাখা। হয়েছে এগুলো। এখানে যুদ্ধ হয়েছিল।’

সিটের উপর ঘুরে বসে মেয়েটার চোখ-মুখ পরীক্ষা করতে লাগল ডেভিড। দেখতে পেল একই শক্তি আর নিশ্চিন্তের ভাব; ডেবরার যে গুণের প্রশংসা করে সে। এরা এমন মানুষ যারা পুরো দিনটাই উপভোগ করে আর এর কাছাকাছিটুকুই পরের দিন বলে বিবেচনা করে।

“আর যুদ্ধ হবে এখানে? জানতে চাইল ডেভিড।

‘হ্যাঁ। কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই উত্তর দিল মেয়েটা।

“কেন?”

‘কারণ–যদি এটা ভালো হয়–তুমি অবশ্যই এর জন্য লড়বে। এরপরে মেয়েটা হাত দুটো ছড়িয়ে এমন ভঙ্গি করল যেন ঢেকে ফেলবে পুরো ভূমি, আর এর মানুষকে।

আর এটা আমাদের অনেক ভালো এটা।

‘রাইট অন, ডল। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসল ডেভিড আর মেয়েটা।

তো, জেরুজালেমে পৌঁছে গেছে তারা। কাস্টার্ড হলুদ রঙের পাথর দিয়ে বানানো লম্বা সব অ্যাপার্টমেন্ট, পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ স্তম্ভের মতো বিশাল দেয়াল ঘেরা দুর্গ প্রাচীরের মাঝে, এটিই হচ্ছে জেরুজালেমের হৃদয়।

ফ্লাইটে থাকা অবস্থাতেই ডেভিডের জন্য ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে রুম বুক করে দিয়েছে টি.ডব্লিউ.এ.। রুমের জানালা দিয়ে পুরাতন শহরে গেৎশিমানি বাগানের দিকে তাকাল ডেভিড। দেখা যাচ্ছে ছোট গম্বুজ, সুক্ষাগ্র চূড়া আর সোনালি আভা মণ্ডিত পাথরের গম্বুজ। জুদাইজম আর খ্রিস্টিয়ানিটির কেন্দ্রস্থল মুসলিমদের পবিত্র স্থান, দু’হাজার বছরব্যাপী যুদ্ধের ক্ষেত্র, প্রাচীন ভূমি সব মিলিয়ে কেমন অদ্ভুত বোধ জাগলো ডেভিডের মনে। জীবনে প্রথমবারের মতো নিজের মাঝে এমন একটা অংশ উন্মোচিত হলো যা ইহুদি, মনে হল এ শহরে আসাটা কোন মতেই ভুল হয়নি।

‘সম্ভবত, চিৎকার করে বলে উঠল সে, এখানে আছে সবকিছু যা আমি খুজঁছি।’

সন্ধ্যার খানিকটা আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার পার্কিংয়ের জায়গায় ট্যাক্সি ক্যাব ছেড়ে নামলো ডেভিড। মেইন গেইটের কাছে সারা শরীর সার্চ করে দেখল গার্ড। এখানে এভাবে সার্চ করাটা রুটিনের মতো, তাই কয়েক দিনের মাঝেই ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল ডেভিড। কিন্তু ভেতরে ঢুকে খালি ক্যাম্পাস দেখে অবাক হয়ে গেল সে। কোথাও কেউ নেই। তারপর মনে পড়ল যে আজ শুক্রবার-সাব্বাতের জন্য কিছুই আজ ধীর গতিতে চলবে।

প্রধান প্লাজার চারপাশে ফুটে আছে লাল-পাপড়ির গাছ। অনিন্দ্যসুন্দর পুলের চারপাশেও তাই। অ্যাডমিন ব্লকে ঢুকে ডেবরার কথা জানতে চাইল ডেভিড। আরেকটু হলে পোর্টার প্রায় চলেই যাচ্ছিল ডেস্ক থেকে।

মিস মোরদেসাই– নিজের লিস্ট চেক করে দেখল পোর্টার। হ্যাঁ ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে, লটারম্যান বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায়।’ কাঁচের দরজা দিয়ে দিক নির্দেশ করে দেখাল লোকটা। আপনার ডানদিকের তৃতীয় বিল্ডিংটা। সোজা ভেতরে চলে যান।

শিক্ষার্থীদের টিউটোরিয়ালে ব্যস্ত, ডেবরা। অপেক্ষার সময়টুকু ছাদে সূর্যের উষ্ণতায় চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিল ডেভিড। হঠাৎ করেই অনিশ্চয়তার শীতল স্রোত বয়ে গেল যেন মেরুদণ্ড বয়ে। এথেন্স ছাড়ার পর এই প্রথম মনে। হলো যে, ডেবরা মোরদেসাইয়ের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাবার কোন কারণ কী আছে তার? এমনকি মেয়েটার প্রতি নিজের আচরণ ব্যাখা করতেও হিমশিম খেয়ে গেল সে। আত্মসমালোচনা এমন একটা ব্যাপার যেটা ডেভিড খুব বেশিবার চেষ্টা করেনি আগে। এছাড়া তার যে ভাগ্য আর চেহারা তাতে খুব বেশি প্রয়োজনও পড়েনি ব্যাপারটার। তাই বসে থাকতে থাকতে মনে হলো পছন্দ না হলেও কথাটা হয়তো সত্যি। ডেবরা তাকে বখে যাওয়া হিসেবে উল্লেখ করেছে। তা হয়তো মিথ্যে নয়। চিন্তায় ছেদ ঘটিয়ে ছাদের দিকে এগিয়ে আসল শিক্ষার্থীদের জুতার শব্দ। এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে উঠে এলো উপরে। বুকের মাঝে ধরা বই আর বেশির ভাগ মেয়েরাই পথ চলতে গিয়ে দ্রুত নজর বুলিয়ে নিল ডেভিডের উপর।

আরো খানিক বিরতির পর এগিয়ে এলো ডেবরা। বগলের নিচে বই, এক কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে। কাঁধের উপর জড়ো করে বাঁধা চুল, মুখে কোন মেক-আপ নেই, কিন্তু স্কার্টে গ্রীষ্মের উজ্জ্বল কমলা রঙ। উন্মুক্ত পায়ের পদযুগল চামড়ার স্যান্ডেলে মোড়ানো। দু’জন শিক্ষার্থীদের সাথে গভীর আলোচনায় মগ্ন ডেবরা প্রথমটাতে খেয়ালই করেনি ডেভিডকে। উঠে দাঁড়াল ডেভিড। তারপরই তার বিখ্যাত নীরবতা নিয়ে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল ডেবরা। এর আগে ও জারাগোজার ক্যান্টিনে যার সাথে পরিচয় হয়েছিল ডেভিডের।

হঠাৎ করে মনে হলো হাত-পা ভারী হয়ে গেল, ডেভিড নিজেও অবাক হয়ে গেল নিজের আচমকা ভারী হওয়া বোধ নিয়ে। হেসে কাঁধ ঝাঁকাল সে।

‘হ্যালো, ডেবস।’ নিজের কানেই অদ্ভুত ঠেকল ডেভিডের গলা। নড়ে উঠল ডেবরা, চাইল দ্রুত হাত দিয়ে অন্তত চুলটা ঠিক করে নিতে। কিন্তু হাতে বই থাকায় পারল না সে।

‘ডেভিড’ এগিয়ে আসতে গিয়েও অস্বস্তি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীর দিকে তাকাল ডেবরা। বুঝতে পেরে চলে গেল তারা। ডেবরা তাকাল ডেভিডের দিকে।

‘ডেভিড’–আবারো একই কথা বলল ডেবরা, এরপর হঠাৎ করেই অভিব্যক্তি বদলে গেল। ওহ গড! আমি একটু লিপস্টিকও লাগাইনি।’

হেসে ফেলল ডেভিড। মনে হলো কাঁধ থেকে বিশাল একটা বোঝা নেমে গেল যেন। এগিয়ে গেল সে। হাত বাড়িয়ে দিল আলিঙ্গন করতে। ডেবরাও এগিয়ে এলো কিন্তু হাতের বই আর ব্যাগ নিয়ে কী করবে বুঝতে পারল না। নিচে পড়ে গেল সব। আহত হয়ে সেগুলো কুড়িয়ে নিতে গেল। অবশেষে আলিঙ্গন করল দু’জন-দু’জনকে।

‘ডেভিড। শক্ত করে ডেভিডের গলা জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করল ডেবরা। ‘তুমি একটা যাচ্ছেতাই এত সময় লাগল কেন? আমি তোমার চিন্তা প্রায় ছেড়েই দিয়ে ছিলাম।’

ডেবরার একটা মোটর স্কুটার আছে, সেটা নিয়ে জেরুজালেমের রাস্তায় এমনভাবে ছুটে বেড়ায় সে যে তার পথে পড়া ট্যাক্সি ড্রাইভাররাও ভিরমি খেয়ে যায়- স্টিলের মতো শক্ত নার্ভ আর বিপদে ভয় না পাবার ব্যাপারে যাদের সুখ্যাতি প্রবাদতুল্য।

পিছনের সিটে বসে ডেবরার কোমর ধরে রাখল ডেভিড। এত ভিড়ের মাঝেও ঠিকই পথ করে নিয়ে এগিয়ে চলল ডেবরার স্কুটার। লেপ্টে বসে রইল ডেভিড। এমনকি বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির ভিড়কেও হাসিমুখে উড়িয়ে দিল স্কুটার।

‘আমার অনেক আনন্দ হচ্ছে।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল ডেবরা।

‘খুব ভালো! এই মুহূর্ত উপভোগের জন্য চলল বেঁচে থাকি।’

‘জো তোমাকে দেখলে অবাক হয়ে যাবে।

‘যদি কখনো পৌঁছাই তবেই না।

‘তোমার নার্ভ নষ্ট হয়ে গেছে নাকি?

মাত্র এই মিনিটখানেকের মাঝে হারিয়ে ফেলেছি এটা।

ইন কারেম উপত্যকার আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল ডেবরা। মনে হলো যেন ও একটা মিরেজ প্লেন চালাচ্ছে আর ওর পেছনে বসে আছে ভ্রমণ পিপাসু একটা মানুষ। এমনভাবে ডেভিডকে চারপাশের বর্ণনা দেয়া শুরু করল ডেবরা।

‘এটা মেরির কূয়ার আশ্রম। এখানেই তিনি জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট মায়ের সাথে দেখা করেছিলেন। খ্রিস্টান রীতি অনুযায়ী–এ ব্যাপারে তো তুমি বিশেষজ্ঞ।’

‘ইতিহাস বাদ দাও।’ আর্তনাদ করে উঠল ডেভিড। সামনের বাকের মুখে একটা বাস।

জলপাই গাছগুলোর মাঝে গ্রামটাকে দেখে মনে হলো এখানে সময় বোধহয় থমকে গেছে। গড়ানে ভূমির মাঝে গির্জা, আশ্রম, উঁচু দেয়াল ঘেরা বাগান, ছবির মতো সুন্দর মরূদ্যান আর অন্যদিকে আকাশের ওপারে দেখা যাচ্ছে আধুনিক জেরুজালেমের সু-উচ্চ সব বহুতল ভবনের বিশৃঙ্খলা।

প্রধান রাস্তা ছেড়ে সরু একটা গলির মুখে ঢুকে গেল ডেবরা। দু’পাশে বয়সের কোন গাছপাথর না থাকা পাথরের দেয়াল। লোহার দরজার সামনে ব্রেক কষলে স্কুটার।

‘হোম।’ জানিয়ে দিল ডেবরা। একটু দূরে গেইট হাউজের মাঝে স্কুটার লক্ করে দেয়ালের কোনায় থাকা ছোট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো তারা।

বিশাল একটা বাগানে পৌঁছ গেল দু’জনে। চারপাশে চুনকামের ফলে সাদা যেখানে উঁচু প্লাস্টারের দেয়াল। মোটা মোটা কাওলা জলপাই গাছ দাঁড়িয়ে আছে বাগানের মাঝে। দেয়াল বেয়ে উঠে গেছে আঙুরলতা। থোকা থোকা আঙুর ও দেখা গেল ঝুলছে।

‘বিগ একজন আগ্রহী কিন্তু পাগল তরুণ প্রত্নতত্ত্ববিদ। জলপাই গাছগুলোর ভেতর ভেতরে থাকা রোমান আর গ্রিক মূর্তিগুলো দেখিয়ে বলল ডেবরা। দেয়ালের চারপাশেরও মাটির পাত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রাচীন আমলের মোজাইক টাইলস্ বিছানো রাস্তা চলে গেছে ঘরের দিকে। এটা আইন বিরুদ্ধ কিন্তু তারপরেও সে তার পুরো অবসর সময়টুকু পুরাতন জায়গা খুঁড়ে কাটায়।

রান্নাঘরে বিশাল খোলা চুল্লি, যেখানে আধুনিক ইলেকট্রিক স্টোভ মনে হলো বেমানান। কিন্তু তামার পাত্রগুলো যে নিয়মিত ঘষে মেজে পরিষ্কার রাখা হয়, তা স্পষ্টই বোঝা গেল। টাইলস করা মেঝেও বেশ পরিষ্কার আর সুগন্ধও ছড়াচ্ছে।

চুপচাপ স্বভাবের ডেবরার মা লম্বা আর কৃশকায়। দেখে মনে হলো ডেবরার বড় বোন। পারিবারিক আবহ বেশ আনন্দময়, সকলকে অভিবাদন জানাল ডেবরা। মনে মনে ব্যাপারটা ভেবে ডেভিড খুশিই হলো যে এই বয়সে ডেবরাকে এমনই দেখাবে। সকলের সাথে ডেভিডের পরিচয় করিয়ে দিয়ে ডেবরা ঘোষণা করল যে আজ রাতে ডেভিড তাদের সাথে ডিনার করবে। এক মুহূর্ত আগ পর্যন্তও এটা জানতো না ডেভিড।

‘প্লিজ।’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল ডেভিড। আমি অনধিকার প্রবেশ করতে চাই না। সে জানে যে ইহুদী বাড়িতে শুক্রবারের রাত বিশেষ একটা সময়।

‘তুমি অনাধিকার প্রবশে করছে না। আমরা সম্মানিত বোধ করব যদি তুমি থাকো। ডেভিডের দাবি উড়িয়ে দিল ডেবরা। জোর স্কোয়াড্রনের বেশিরভাগ ছেলের এটাই ঘর। আমাদের ভালোই লাগে ব্যাপারটা।

ডেভিডকে একটা গোল্ডস্টার বিয়ার এনে দিল ডেবরা। এরপর ছাদে গিয়ে বসল দু’জনে। এমন সময় এলো ডেবরার বাবা। ছোট্ট গেইট দিয়ে ঢুকে পাথরে চৌকাঠের নিচে এসে দাঁড়াল ঋজু দেহ। বাগানে ঢুকে ইউনিফর্মের টুপি খুলে হাতে নিয়ে নিল ডেবরার বাবা।

গলার কাছে ভোলা সাধারণ ছটের ইউনিফর্ম পরে আছে ডেবরার বাবা। বুকপকেটের কাপড়ের গায়ে লাগানো সেনাবাহিনীর র্যাংকের চিহ্ন আর পদক সমূহ। কাঁধ সামান্য গোলে ধাচের, হতে পারে চওড়া দেহ সরু ফাইটার এয়ারক্রাফটের মাঝে থাকতে থাকতে এমন হয়ে গেছে। মাথা বাদামি। আর সন্তদের মতো হালকা চুল। কিন্তু গোঁফ বেশ বাঁকানো, যার ফাঁক দিয়ে চকচক করছে স্বর্ণের দাঁত। লম্বা, বাঁকানো নাক, প্রাচীন আমলের যোদ্ধাদের মতো। চোখজোড়া কালো আর ঠিক ডেবরার মতো সোনালি আভা ছড়াচ্ছে। পুরো অভিব্যক্তিটাই এমন যে সাথে সাথে শ্রদ্ধা ভাব এলো ডেভিডের মনে। স্বাভাবিকভাবেই তাই উঠে দাঁড়িয়ে জেনারেলের সাথে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ডেভিড, সম্বোধন করল স্যার বলে।

খুব দ্রুত ডেভিডের উপর চোখ বুলিয়ে নিল বিগ। নিজের মন্তব্য অবশ্য প্রকাশ করল না। হাবে-ভাবে তাই আনন্দ বা হতাশা কিছুই ফুটে উঠল না।

পরবর্তীতে ডেভিড জানতে পারে যে ডেবরার বাবাকে তারা ‘দ্য ব্রিগ’ নামে ডাকে। যেটা ‘দ্য ব্রিগান্ড’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ১৯৪৮ সালের আগে প্যালেস্টাইনে হাগানাহর জন্য যুদ্ধজাহাজ আর অস্ত্র ছিনতাইয়ের জন্য ব্রিটিশরা এই উপাধি দেয় ডেবরার বাবাকে। সবাই এমন কী ছেলেমেয়েরাও তাকে এই নামেই ডাকে। শুধুমাত্র তার স্ত্রী ডাকে নিজস্ব নাম–জোশুয়া।

‘ডেভিড আজ রাতে আমাদের সাথে সাব্বাথ ভোজনে অংশ নেবে। ব্যাখা করল ডেবরা।

‘ইউ আর ওয়েলকাম।’ ডেভিডকে স্বাগত জানিয়ে স্ত্রী আর কন্যার দিকে হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে আলিঙ্গন করল ব্রিগ। গত সাবাথের পর থেকে কারো সাথে দেখা হয়নি তার। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এয়ার বেস কন্ট্রোলের দায়িত্ব পালন করেছে ব্রিগ এসময়।

একটু পরে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় এসে পৌঁছালো জো। গ্রীষ্মকালীন খোলা গলার খাকি ড্রেস। ডেভিডকে দেখতে পেয়েই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল জো। ভালুকের মতো বিশাল বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরল ডেভিডকে। কাঁধের উপর দিয়ে ডেবরাকে বলল আমি ঠিক বলেছিলাম, তাই না?

‘জো বলেছিল যে তুমি আসবে।’ ব্যাখা করল ডেবরা।

‘মনে হচ্ছে একমাত্র আমিই ব্যাপারটা জানতাম না। অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিল ডেভিড।

ডিনারের টেবিলে জড়ো হলো সব মিলিয়ে পনেরো জন। পলিশ করা বিশাল টেবিল আর রুপার থালা-বাসনের উপর প্রতিফলিত হচ্ছে মোমবাতির আলো। সংক্ষিপ্ত করে প্রার্থনা সারলো ব্রিগ। টাক মাথার উপর খানিকটা হাস্যকর লাগল সাটিনের গোল্ড অ্যামব্রয়ডারি করা ইয়ামুলকা, নিজের হাতে ওয়াইন ঢেলে বিড়বিড় করে স্বাগত জানাল উপস্থিত সব অতিথিকে। জো’র সাথে হান্নাহও এসেছে। সুন্দর দেখাচ্ছে ওর তামাটে চুল। ডেভিডকে দেখেও কিছু বলল না সে। ব্রিগের নিজের পরিবার ছাড়াও আরো উপস্থিত হয়েছে ওর দু’ভাই, তাদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী। সবাই বেশ উঁচুস্বরে কথা বলছে আর ভাষা দ্রুত হিব্রু আর ইংরেজিতে অদল-বদল হচ্ছে। খাবারের স্বাদ বেশ মসলাদার কিন্তু মুখরোচক! যদিও ডেভিডের কাছে ওয়াইনের স্বাদ একটু বেশি মিষ্টি মনে হল। ডেবরার পাশে চুপচাপ বসে তৃপ্তি নিয়ে উপভোগ করতে লাগল এহেন হাসি-খুশি পরিবেশে নিজের উপস্থিতি। হঠাৎ করেই চমকে গেল, যখন দেখল যে, ডেবরার কাজিন ঝুঁকে এলো তার সাথে কথা বলতে।

‘তোমার জন্য ব্যাপারটা নিশ্চয় বেশ দ্বিধার মতো–ইস্রায়েলের মতো দেশে তোমার প্রথম দিন আর হিব্রুও বুঝতে পারো না, তুমি তো ইহুদি নও।

যদিও কথাগুলোতে খারাপ কিছু ছিল না, কিন্তু মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল সব কোলাহল। চোখ তুলে তাকাল বিগ, তার ঘরে বেড়াতে আসা অতিথির মর্যাদাহানিকর কিছু করতে চায় না সে।

ডেভিড বুঝতে পারল যে ডেবরা মনোযোগ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই তার মনে চিন্তা এলো যে কেমন করে তিন ধরনের প্রতিবাদ কোন ইস্যুকে সঠিক রূপ দেবে–নতুন টেস্টামেন্ট, মোহামেডান আইন আর সম্ভবত মোশির বিধানও। ডেভিড বুঝতে পারল সে এই ঘর থেকে বিতাড়িত হতে চায় না। এই মানুষগুলোর কাছ থেকে আলাদা হতে চায় না। আবারো একা হয়ে যেতে চায় না। বেশ ভালো লাগছে এখানে।

কাজিনের দিকে তাকিয়ে হাসল ডেভিড। মাথা নেড়ে বলল, এটা অদ্ভুত, সত্যি–কিন্তু তুমি যতটা ভাবছো ততটা খারাপও না। আমি হিব্রু বুঝতে পারি যদিও তেমন ভালো বলতে পারি না। আর শোন আমি কিন্তু ইহুদিও।

পাশে বসা ডেবরার চেহারায় খুশির মোলায়েম আলো ফুটে উঠতে দেখল ডেভিড। জো’র সাথে দৃষ্টি বিনিময় ও করল দ্রুত।

‘ইহুদি? জানতে চাইল ব্রিগ। তোমাকে তেমন দেখায় না। ব্যাখ্যা করল ডেভিড। মাথা নাড়ল ব্রিগ।

‘শুধু তাই না, ডেভিড বিমানও চালায়। ডেবরা বলে উঠতেই জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ে উঠল ব্রিগের গোঁফ জোড়া। ন্যাপকিন দিয়ে গোঁফ ঠিক করে সর্তকতার সাথে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে রইল ব্রিগ।

‘কতটা অভিজ্ঞ? বিস্তারিত জানতে চাইল ব্রিগ।

‘বারোশ ঘণ্টা স্যার। জেট’এ প্রায় হাজার।

‘জেট?

‘মিরেজ।

‘মিরেজ! গোপনে ঝিক করে উঠল বিগের স্বর্ণের দাঁত।

‘কোন স্কোয়াড্রন?

‘কোবরা।

‘রাসটাস নড’সের শিক্ষার্থী? হাঁ করে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে রইল ব্রিগ। পাল্টা প্রশ্ন করল ডেভিড।

‘আপনি রাসটাসকে চেনেন? অবাক হয়ে গেল সে।

‘আমরা একসাথে প্রথম স্পিট ফায়ার্সে উড়েছিলাম চেকোশ্লোভাকিয়াতে– ৪৮এর দিকে। আমার ওকে ডাকতাম বুচ বেন ইয়ক।

জেন্টিলি’দের পুত্র। কেমন আছে সে?

সবসময় যেমন ছিলেন তেমনই চঞ্চল। কৌশলে উত্তর দিল ডেভিড।

‘ওয়েল, যদি রাসটাস তোমাকে উড়তে শেখায় তাহলে তুমি মোটামুটি ভালো। সিদ্ধান্তে পৌঁছালো ব্রিগ।

সাধারণ একটা নিয়ম হলো যে ইস্রায়েলি এয়ারফোর্স কখনো বিদেশী পাইলট ব্যবহার করবে না। প্রথম শ্রেণীর ফাইটার পাইলট হিসেবে ইহুদিই বেশি মার্ক পায়। ডেভিডের ভেতরে একই গুণ দেখতে পেল ব্রিগ, যা খুঁজে পেয়েছে পল মরগ্যান। মোমবাতির আলোয় আবারো তরুণটিকে খেয়াল করে দেখল ব্রিগ। চোখ এড়ালো স্থির আর পরিষ্কার ডেভিডের দৃষ্টি যা খুঁজে বেড়াচ্ছে দূরের দিগন্ত। এটা একটা গান ফাইটারের চোখ আর ব্রিগের সব পাইলটরাই গান ফাইটার।

এ জাতীয় একটা পাইলটকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করতে বহু বছর আর প্রায় মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়। সময় এবং অর্থ নির্ভর করতে তার দেশের উপর–নিয়মও তাই বদলানো যায়।

ওয়াইন বোতল তুলে নিয়ে সাবধানে ডেভিডের গ্লাস পূর্ণ করে দিল ব্রিগ। ‘আমি রাসটাস নড়কে ফোন করব।’ নীরবে সিদ্ধান্ত নিল ব্রিগ। এই তরুণ সম্পর্কে আরো জানতে হবে।’

ব্রিগ যখন ডেভিডকে ইস্রায়েলে আসার কারণ, কারণ না থাকা আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করল, তাকিয়ে রইল ডেবরা।

ব্রিগের মনে কী চিন্তা চলছে তা পরিষ্কার বুঝতে পারল ডেবরা। এই সন্দেহই করেছিল সে। ডেভিডকে ডিনারের দাওয়াত দেয়া, ব্রিগের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া সবকিছু নিয়ে হিসাব কষা শুরু হয়ে গেল।

মনোযোগ ফিরিয়ে নিল ডেভিডের দিকে। পাকস্থলীতে কেমন অদ্ভুত উত্তেজনা এলো। ডেভিডের দিকে তাকালেই মনে হয় দেহত্বকে বৈদ্যুতিক শকের মতো কিছু একটা হচ্ছে।

‘হুম, বড়সড় স্ট্যালিয়ন একটা।’ আনন্দিত মনে ভাবতে লাগল ডেবরা। এবার আর এত সহজে পালাতে পারবে না। এবার আমি বুদ্ধি করেছি ধরে রাখার জন্য আর ব্রিগকেও লাগিয়ে দিয়েছি।’

গ্লাস তুলে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে চশমার উপর দিয়ে মিষ্টি করে হাসল ডেবরা।

তুমি যার পেছনে ছুটছে তা অবশ্যই পাবে; কিন্তু কাঠ-কয়লা পুড়িয়ে তবেই। মনে মনে হুমকি দিল ডেবরা; কিন্তু সবার সামনে উঁচুস্বরে বলে উঠল

‘লিচেইম! জীবনের জন্য!’ একই কথা উচ্চারণ করল ডেভিডও।

‘এবার এত সহজে হাল ছাড়ছি না আমি।’ প্রতিজ্ঞা করল ডেভিড মনে মনে। তাকিয়ে দেখল ডেবরার চোখে সোনালি আলোর ফোঁটা। আমি তোমাকে পাবই, যত সময় লাগুক, যাই করতে হোক।’

.

ভোরবেলা বিছানার পাশে রাখা টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো ডেভিডের। চনমনে স্বরে কথা বলে উঠল ব্রিগ। মনে হলো ইতিমধ্যে দিনের কাজ সাড়া হয়ে গেছে তার।

‘আজকের জন্য যদি তোমার জরুরি কোন পরিকল্পনা না থাকে আমি তোমাকে কিছু দেখাতে চাই। জানিয়ে দিল ব্রিগ।

‘অবশ্যই স্যার।’ ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে ডেভিড।

পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাঝে তোমাকে হোটেল থেকে তুলে নেবো আমি। এই সময়ের মাঝে নাস্তা করে ফেলল। লবিতে অপেক্ষা করো আমার জন্য।

ছোট, অনাড়ম্বর আর সাধারণ একটা গাড়ি ড্রাইভ করে এলো ব্রিগ। দ্রুত আর স্বচ্ছন্দ্য গতিতে চলতে লাগল গাড়ি। ব্রিগের সময়ানুবর্তিতা আর কর্মতৎপরতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ডেভিড। কম করে হলে ডেবরার বাবার বয়স পঞ্চাশের ঘরে। এই বয়সে নিজের কথা ভেবে ভয়ঙ্কর লাগল তার।

প্রধান হাইওয়ে ধরে দক্ষিণে তেল আবিবের দিকে এগিয়ে চলল গাড়ি। দীর্ঘ নীরবতা ভাঙ্গলো ব্রিগ।

‘গত রাতে তোমার পুরাতন সি.ওর সাথে কথা বলেছি আমি। তুমি কোথায় তা জানতে পেরে অবাক হয়ে গেছে সে। আমাকে জানিয়েছে যে নেমে আসার আগে তোমাকে স্টাফ র‍্যাঙ্কে পদোন্নতির প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।

‘এটা ছিল ঘুষ’ ডেভিড তাড়াতাড়ি বলে উঠল। মাথা নেড়ে আবারো কথা শুরু করল ব্রিগ। চুপচাপ তার কথা শুনতে লাগল ডেভিড। খুশি মনে দেখতে লাগল পাহাড় থেকে নেমে যেতে যেতে কেমন করে পরিবর্তীত হয়ে যাচ্ছে চারপাশের দৃশ্যবলী। নিচু সমভূমি দিয়ে দক্ষিণে বারসেবা আর মরুভূমির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি।

‘আমি তোমাকে একটা এয়ারফোর্স বেসে নিয়ে যাচ্ছি। আর এ সাথে যুক্ত করতে চাই যে, এই কারণে সব ধরনের সিকিউরিটি রেগুলেশন্ ভাঙ্গতে হচ্ছে আমায়। রাসটাস আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে তুমি উড়তে জানো। আমি দেখতে চাই ও সত্যি কথা বলছে কিনা।

দ্রুত একবার ব্রিগের উপর চোখ বুলিয়ে নিল ডেভিড।

‘আমরা প্লেন চালাতে যাচ্ছি?

ব্রিগ ইতিবাচক মাথা নাড়াতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল ডেভিড। উত্তেজনা বোধ করতে লাগল মনে মনে।

‘আমাদের এখানে যুদ্ধ হচ্ছে। তাই কমব্যাট প্লেন চালাবে তুমি আর সেই সাথে বইয়ের সব নিয়ম-কানুন ভেঙ্গেচুরে ফেলবে। কিন্তু বইয়ের কথা মতো সব সময় তো চলাও যায় না।

এরপর আস্তে আস্তে ইস্রায়েল সম্পর্কে, এর যুদ্ধ আর সফলতার সুযোগ সম্পর্কে নিজের মতামত ব্যাখ্যা করল ব্রিগ। ডেভিডের কানে বাজতে লাগল কয়েকটা অদ্ভুত বাক্য।

–আমরা একটা জাতি গঠন করছি আর ফাউন্ডেশনে যে রক্ত মিশিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি আমরা, তা একে আরো মজবুত করবে’

–আমরা একে শুধুমাত্র দুনিয়াজুড়ে মার খাওয়া ইহুদিদের আশ্রয়স্থল বানাতে চাই না। আমরা শক্তিশালী উজ্জ্বল ইহুদিদেরও চাই’।

আমরা আছি তিন মিলিয়ন আর শত্রুর সংখ্যা দেড়শ মিলিয়ন। যাদের লক্ষ্যই হলো আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া

যদি তারা একটা যুদ্ধে হেরে যায় তাহলে হয়তো মরুভূমির কয়েক মাইল হারাবে মাত্র আর যদি আমরা হেরে যাই তাহলে হয়তো অস্তিত্বই মুছে যাবে

‘–তাদেরকে আরো একবার হারাতে হবে আমাদের। অন্যকিছু গ্রহণ করবে না তারা। তারা বিশ্বাস করে যে ১৯৪৮ সালে তাদের অস্ত্রে সমস্যা ছিল। সুয়েজের পর লাইন ঠিক হয়ে যাওয়াতে কিছুই হারাতে হয়নি তাদের। ৬৭’তে তারা ভেবেছে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। আরো একবার তাদেরকে হারাবো আমরা আর আমাদেরকে একা ছেড়ে যাবে তারা—-

মনে হলো কোন মিত্র বা বন্ধুর সাথে কথা বলছে এমনভাবে মনের কথা ডেভিডকে খুলে বলল ব্রিগ। তার প্রতি বিশ্বাস দেখে খুশি হয়ে গেল ডেভিড আর আবারো প্লেন চালাবার সম্ভাবনায় তো রীতিমত রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল তার।

রাস্তার পাশে ঘন করে লাগিয়ে রাখা ইউক্যালিপটাসের ফলে দৃষ্টিগোচর হলো না কিছুই। তারের বেড়ার গায়ে লাগানো গেইটের কাছে এসে গাড়ি থামালো ব্রিগ। উভয় ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড দেখা গেল ঝুলছে : ‘চেইম ওয়েইসম্যান কৃষি পরীক্ষণ কেন্দ্র।

গেইটের ভেতরে ঢুকে আবার সাইড রোডে নেমে গেল গাড়ি, দ্বিতীয় আরেকটা বেড়া আর গার্ড পোস্ট দেখা গেল গাছ-পালার মাঝে।

গেইটে থাকা গার্ড দ্রুত ব্রিগের কাগজপত্র চেক করে দেখল। ভালোভাবেই ওকে চেনে তারা। আবারো চলতে শুরু করল গাড়ি বেরিয়ে এলো পরিষ্কার ভাবে ব্লক করা বিভিন্ন শস্যক্ষেতের মাঝে। ওটস, বার্লি, গম, ভুট্টা চিনতে পারল ডেভিড-বসন্তের উষ্ণ তাপে চমৎকার দেখাচ্ছে সবকিছু। প্রতিটি ক্ষেতের মাঝে চওড়া রাস্তা। এই দুই মাইল লম্বা মসৃণ রাস্তার মাঝে কিছু একটা আছে যা ঠিক স্বাভাবিক নয়। সঠিক কোনা করে কাটা হয়েছে। প্রতিটি রাস্তা, যদিও ডেভিডের কাছে তেমন অপরিচিত নয় পথটুকু। বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল ব্রিগ। হ্যাঁ’ ব্যাখা দিল ব্রিগ, ‘রানওয়ে ৬৭’তে যে কৌশল ব্যবহার করেছি তা নয় কিন্তু।

ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল ডেভিড। গাড়ি দ্রুত এগিয়ে গেল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কংক্রিটের কাঠামোর দিকে। ক্ষেতে বেগুনি রঙের ট্রাক্টরগুলো কাজে ব্যস্ত, উপরের বাতাসে অস্ট্রিসের পাখার মতো স্প্রে ছিটাচ্ছে সেচের যন্ত্র।

কংক্রিটের তৈরি শস্যাগারের কাছে পৌঁছালো গাড়ি। চওড়া দরজা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ঢুকে গেল ব্রিগ। অবাক হয়ে ডেভিড দেখতে লাগল সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা বাস আর আটোমোবাইলের দিকে। না হলেও শত শত মানুষের যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে এখানে। অথচ মাত্র কয়েকজন ট্র্যাক্টর ড্রাইভার ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়েনি বাইরে।

আবারো গার্ড এগিয়ে এলো, প্যারাট্রুপার ইউনিফর্ম পরা শস্যাগারের গোলাকার কাঠামোর কাছে ডেভিডকে নিয়ে গেল ব্রিগ। হঠাৎ করেই পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল ডেভিডের কাছে। বুঝতে পারল শস্যাগার আসলে একটা জমি। সলিড কংক্রিট দিয়ে বানানো বিশাল বোমাপ্রুফ কাঠামো। আধুনিক ফাইটার বেসের সমস্ত অস্ত্র আর রাডার যন্ত্রপাতির সব বন্দোবস্ত আছে এখানে। চারটি সম্পূর্ণ মিরেজ ফাইটারদের স্কোয়াড্রন আছে এঁটে যাবে এই যৌথ কন্ট্রোল টাওয়ারে। এলিভেটর করে ব্রিগের সাথে মাটির নিচে নেমে যেতে যেতে সব জানা হয়ে গেল ডেভিডের।

এলিভেটর থেকে বের হয়ে রিসেপশন এরিয়ায় বেরিয়ে এলো তারা। আবার পরীক্ষা করা হলো ব্রিগের কাগজপত্র। একজন প্যারাট্রুপার মেজরকে ডেকে ডেভিডকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হলো। খুশি মনেই দায়িত্ব পালন করল মেজর। এরপর পথ দেখিয়ে কার্পেটে মোড়া এয়ারকন্ডিশন্ড আন্ডার গ্রাউন্ড টানেলে পাইলটদের ড্রেসিংরুমে ডেভিডকে নিয়ে এলো ব্রিগ। দাগবিহীন টাইলস করা মেঝে টয়লেট, শাওয়ার, লকার সবকিছু মিলিয়ে মনে হলো কাউন্টি ক্লাবের চেঞ্জিংরুম।

ডেভিডের সাইজ অনুমান করে তার জন্য কাপড় আনার আদেশ দিল ব্রিগ। আনার পর দেখা গেল অনুমান একেবারেই নির্ভুল হয়েছে। কর্পোরাল ডেভিডকে পরিয়ে দিল ওভার অল, বুটস, জি-স্যুট গ্লাভস, হেলমেট।

নিজের লকার থেকে কাপড় বের করে পরে নিল ব্রিগ। এরপর দুজনেই প্রস্তুতি রুমে গেল। জি-স্যুটের খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে গেল চলাফেরা, বগলের নিচে হেলমেট।

দু’জনে ঢুকতেই দাবা খেলা আর ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে তাকাল কর্তব্যরত পাইলট। জেনারেলকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়াল কিন্তু পুরো পরিবেশটাই বেশ সহজ আর অনানুষ্ঠানিক। ছোট্ট একটা জোক্স বলল ব্রিগ। হেসে ফেলল সবাই। এরপর ডেভিডকে ব্রিফিং রুমে নিয়ে এলো ব্রিগ।

দ্রুত কিন্তু কোন কিছুই চোখ এড়ায়নি এমনভাবে উড়তে যাওয়া পুরো পেট্রোলকে ব্রিফ করল ব্রিগ। ডেভিডকে চেক করে দিল রেডিও চালনা, এয়ারক্রাফটের পরিচিতি, অন্যান্য জরুরি বিষয়।

‘সব ঠিক আছে? অবশেষে জানতে চাইল সে। ডেভিড মাথা নাড়াতেই আবারো বলে চলল ‘মনে রাখবে তোমাকে যা বলেছি। আমরা যুদ্ধ করছি। যখনি এমন কিছু খুঁজে পাবে যেটা আমাদের নয়, সজোরে আঘাত করবে, ঠিক আছে?

‘ইয়েস স্যার।

‘গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সবকিছু সুন্দর চুপচাপ ছিল। কিন্তু মাত্র গতকাল ইন যাদবের কাছে নিচে খানিকটা সমস্যা হয়েছে। আমাদের একটা বর্ডার পেট্রোলের সাথে অসদাচারণ করেছে তারা। তাই পরিবেশ খানিকটা থমথমে হয়ে আছে এই মুহূর্তে। নিজের হেলমেট আর মানচিত্রের কে তুলে নিয়ে ডেভিডের দিকে ফিরল ব্রিগ। কাছে এসে তাকিয়ে রইল ভয়ঙ্কর বাদামী সোনালি চোখজোড়া দিয়ে।

‘আজই দফারফা হয়ে যাবে সব। চল্লিশ হাজারে গেলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার কাছে। রোজ হানিক্রা থেকে সুয়েজ, মাউন্ট হারমন থেকে এইলাতের প্রতি ইঞ্চি দেখতে পাবে তুমি। দেখবে এটি কতটা ছোট আর চারপাশের শত্রুর কাছে কতটা অসহায়। তুমি বলেছিলে এমন কিছু খুঁজছে যেটার জন্য জান বাজি রাখা যায়। তাই তিন মাইল মানুষের ভাগ্য পাহারা দেয়ার কাজ কী এর উপযুক্ত কিনা এই সিদ্ধান্ত নেবার ভার তোমার উপরেই ছেড়ে দিচ্ছি আমি।’

লম্বা আন্ডার গ্রাউন্ড প্যাসেজে ছোট ইলেকট্রিক পার্সোনেল ক্যারিয়ারে করে নিচে নেমে এলো তারা। প্রবেশ কংক্রিটের বাঙ্কারে লাফ দিয়ে নামল গাড়ি থেকে।

এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে ছয়টি মিরেজ। মসৃণ চকচকে শরীর, সুচের মতো নাক। অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে ওঠা পশুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। মনে রাখতে কোন সমস্যাই হবে না এমন আউটলাইনে তৈরি। কিন্তু মরুভূমির মতো বাদামী আর মেটে সবুজের ক্যামোফ্লেজের ফলে চট করে অন্য কেউ বুঝতেও পারবে না। লেজের কাছে ডেভিডের স্মারক চিহ্ন নীল তারা।

দুইটা মেশিনের জন্য সাইন করল ব্রিগ। ডেভিডের নাম্বারের কাছে এসে হেসে ফেলল, লিখলো বুচ বেন ইয়ক।’

‘যেমন ভালো নাম তেমনি ভালো তার অধীনে উড়তে পারাটা। রায় দিয়ে দিল ব্রিগ।

ছোট ককপিটে ঢুকে বসল ডেভিড। মনে হলো যেন নিজের ঘরে ফিরে এসেছে। এখানকার সবকিছুই ওর পরিচিত। একগাদা সুইচ ইনস্ট্রমেন্টস্ আর কন্ট্রোলের উপর উড়ে বেড়াতে লাগল আঙুল। চেক করে নিল ফ্লাইটের আগের সবকিছু।

বাঙ্কারের সংকীর্ণ জায়গায় কামান দাগার মতো গুরুগম্ভীর শব্দ করতে লাগল জেট। কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। এখনো সবাই টিকে আছে পুরো বেস্ কাঠামোর মাঝে স্টিলের গায়ে ছিদ্র থাকার ফলে।

ব্রিগ তাকালো ডেভিডের দিকে। জমকালো পেইন্টিং করা হেলমেট পরে আছে মাথায়। হাই-সাইন দেখাল ডেভিডকে। একই ভাবে উত্তর দিল ডেভিড। বন্ধ করে দিল ক্যানোপি। সামনে দ্রুত উপর দিকে ভাঁজ হয়ে উঠে গেল স্টিলের ব্লাস্ট ডোর। উপরে আলো জ্বলে উঠল লাল থেকে সবুজ।

টেক-অফের জায়গায় ট্যাক্সিং করার কোন জায়গা নেই, অপ্রয়োজনীয় এতটুকুও জায়গা নেই। সরাসরি একের পর এক বাঙ্কার থেকে সূর্যের আলোয় বেরিয়ে এলো তারা। সামনে বাদামী দীর্ঘ রানওয়ে। ডেভিড থ্রটলে চাপ দিল, আফটার বার্নারস জ্বালিয়ে দিল। নিজের সিটের কুশন ভেদ করে অনুভব করল শক্তিশালী জেটের স্পন্দন। সবুজ শস্যের ক্ষেতের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলল তারা। উড়ে গেল আকাশে। আরো একবার বিমোহিত হয়ে পড়ল ডেভিড।

চল্লিশ হাজার ফিটের সামান্যে নিচে স্থির হলো সকলে। কোন ফ্লাইট প্যাটার্নও নেই তাদের। ব্রিগের লেজের কাছে নিজের মেশিনকে স্থির করল ডেভিড। থ্রটল টেনে সহজ হলো, ফ্লাইটের পরিচিত কাজ করতে পেয়ে বেজায় খুশি হাত দুটো, হেলমেট পরিহিত মাথাটা ক্লান্তিহীনভাবে ঘুরছে এদিক সেদিক রুটিন মোতাবেক সার্চের জন্য। আকাশের প্রতিটি ইঞ্চিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে চোখ।

অসম্ভব শুদ্ধ বাতাসে চারপাশ এতটাই স্বচ্ছ যে দূরের পবর্তমালা ও দেখা যাচ্ছে একেবারে পরিষ্কারভাবে, আরো দূরের নীলের ছায়া। উত্তরে সূর্যের আলোয় গলিত রূপার মতো ঝকঝক করছে ভূমধ্যসাগরের পানি। অন্যদিকে গালিলি সাগর নরম ঠাণ্ডা সবুজ আর আরো দূরে দক্ষিণে দেখা যাচ্ছে ঘন ডেড সী, নিষিদ্ধ মরুভূমি।

কামেলের উপর দিয়ে উত্তরে উড়ে গেল তারা। নিচে আরো পড়ল হাইফার সাদা বিল্ডিংগুলো, কমলা সোনালি বিচ্ যার গায়ে আছড়ে পড়ছে ক্রিম রঙা লেসের মতো মসৃণ, ছোট ছোট ঢেউ। এরপর একসাথে ঘুরে গিয়ে আস্তে আস্তে নেমে এলো প্যাট্রলিংয়ের জন্য বিশ হাজার ফিট নিচুতে। মাউন্ট হারমানের চূড়া পার হলো সকলে। তুষারের শেষ কণা চিকচিক করছে এখনো।

নরম স্বপ্নময় সবুজ রঙের প্রকৃতি মনে হলো কেউ এঁকে রেখেছে রঙিন পেন্সিল দিয়ে। আনন্দিত হয়ে উঠল ডেভিড। কেননা আফ্রিকার একঘেয়ে বাদামী রং দেখতেই অভ্যস্ত সে। পাহাড়ের মাথায় ঝুলে আছে গ্রামগুলো। ঘন কৃষি জমি আর ঢালের উপর সাদা দেয়ালগুলো উজ্জ্বলভাবে চোখে পড়ছে।

আবারো দক্ষিণ দিকে ঘুরে গেল তারা। জর্দান উপত্যকা বেয়ে নামতে শুরু করল। গালিলি সাগরের স্বচ্ছ সবুজ জলের চারপাশে দেখা গেল খেজুর গাছের সারি আর পরিষ্কারভাবে চাষ করা কিবুতজিমের ক্ষেত। পাহাড়ের চারপাশে ওয়াদিকে মনে হলো কোন ভয়ঙ্কর শিকারি পশুর থাবা। | বাম পাশে উঠে গেছে ইডম পর্বত। এই রুক্ষ্ম প্রকৃতির নিচে জেরিকো শহরকে মনে হচ্ছে বনের মাঝে সবুজ মরূদ্যান। সামনে পড়ে আছে ডেডসির চকচকে পরিবেশ। নিচে নেমে গেল ব্রিগ। লবণাক্ত পানির উপর নিচু শব্দে উড়ে চলল জেট।

ডেভিডের কানে ভেসে এলো ব্রিগের কণ্ঠস্বর–এত নিচু দিয়ে আর কখনোই উড়ে যাওনি তুমি–বারোশ ফিট নিচেই সমুদ্র।

সমুদ্রের দক্ষিণ অংশে খনির কাজ চলায় আবারো উপরে উঠে এলো তারা। মুখোমুখি হলো দুর্ধর্ষ মরুভূমির।

‘হ্যালো, ক্যাকটাস ওয়ান, মরুর ফুল বলছি।’ আবারো ভঙ্গ হলো রেডিওর নীরবতা। কিন্তু এবার কমান্ড নেটের কল সাইন চিনতে পারল ডেভিড। সরাসরি এয়ারফোর্স কমান্ডের অপারেশনস সেন্টার থেকে কল করা হয়েছে তাদেরকে। এত গোপন একটি আন্ডার গ্রাউন্ড বাঙ্কারে এর অবস্থান যা ডেভিড কখনোই জানতে পারেনি। রাডারের মাধ্যমে তাদের অবস্থান সঠিকভাবেই জেনে যাচ্ছে কমান্ড সেন্টার।

হ্যালো, মরুর ফুল। উত্তর দিল ব্রিগ। তৎক্ষণাৎ এমনভাবে আলোচনা শুরু হলো যেন বহুদিন পর দেখা হয়েছে দুই বন্ধুর। যদিও এই অনানুষ্ঠানিক আলোচনা মোটেও তা নয়।

‘ব্রিগ, মোটি বলছি, এই মাত্রই তোমার অঞ্চলে গ্রাউন্ড সাপোর্টের অনুরোধ পেয়েছি আমরা। দ্রুত কো-অডিনেশন বলে গেল লোকটা।

‘সীমান্ত পুলিশের মোটর প্যাট্রলে অচেনা এয়ারক্রাফট নাক গলিয়েছে। একটু দেখে আসবে না?’

“ঠিক আছে, মোটি। ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সিতে ফিলে এলো ব্রিগ।

ক্যাকটাস টু, আমি দিক বদল করছি। সাথে থাকো। ডেভিডকে জানানো শেষ করেই নতুন দিকে ঘুরে গেল প্লেনের নাক।

রাডার স্ক্যানের চেষ্টা করার কোন মানে হয় না। চিৎকার করে বলে উঠল ব্রিগ। নিচেই কোথাও আছে এটা। ঐ পর্বতগুলো থেকে বের হতে দেয়া যাবে না শুকরটাকে। শুধু চোখ দুটো খোলা রাখো।

‘ঠিক আছে। ডেভিড ইতিমধ্যেই বুঝে গেছে যা ববাঝাতে চেয়েছে ব্রিগ। সবার পছন্দের এই হিব্রু শব্দটা এমন একটা দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে যেখানকার খুব কম জিনিসই ‘ঠিক আছে।’

সবার আগে দেখতে পেল ডেভিড। উজ্জ্বল নীল দিগন্তে বাতাস না থাকলেও দেখা গেল ধোয়ার চিকন কালো একটি রেখা। মনে হলো পেন্সিল দিয়ে লাইন টানা হয়েছে।

গ্রাউন্ড স্মোক। হেলমেট মাইক্রোফোনে কথা বলল ডেভিড। নিচে ঘড়ির এগারো কাটার ঘরে।

নিঃশব্দে সামনে তাকিয়ে আঁতিপাতি করে খোঁজা শুরু করে দিল ব্রিগ। অবশেষে দৃষ্টিসীমার একেবারে শেষ মাথায় দেখতে পেল এটিকে। মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে ছেলেটার অন্তত একটা দিক পুরোপুরি নির্ভুল, রাসটাস ঠিক কথাই বলেছে-শকুনের মতো চোখ।

‘আক্রমণের গতিতে যাচ্ছি আমি।’ ব্রিগের কথা শুনতে পেয়ে আফটারবার্নারস জ্বালিয়ে নিল ডেভিড। সিটের পেছন দিকে যেন তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়ে গেল। সনিক ব্যারিয়ারের মাঝ দিয়ে শু্যটিং শুরু করল মিরেজ।

ধোঁয়ার রেখার পাশে বাদামী মাটির গায়ে চকচক করে উঠল কিছু একটা। চোখ সরু করে তাকাল ডেভিড। দৃষ্টি নিবদ্ধ করল ছোট্ট আকৃতিটার উপর। পাখির মতো দ্রুত চলতে থাকা আকৃতিটা মরুভূমির সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে মিলে গেছে। একটা ছায়া ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।

‘ঘুরে যাচ্ছে দুবৃর্তটা। দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠল ডেভিড।

আমি পেয়েছি তাকে। জানিয়ে দিল বিগ। কমান্ড নেটের সুইচ অন করল।

‘হ্যালো, মরুর ফুল। আমি ওর পিছু নিয়েছি। আঘাত করার অনুমতি দাও প্লিজ।’ এই সিদ্ধান্ত একমাত্র কমান্ড লেভেল থেকেই আসতে হবে। সাদামাটা উত্তরটা শোনা গেল পরিষ্কার ভাবে।

‘ব্রিগ, মাটি বলছি। আঘাত করো!’

কথা বলতে বলতেই দ্রুত নিচে নেমে এলো তারা। ফলে ছোট্ট নাটিকাটা মনে হলো চোখের পলকে ঘটে গেল।

সীমান্তের ধূলি মাখা রাস্তায় থেমে গেছে বর্ডার পুলিশের তিনটি টহলদার গাড়ি। রাস্তার সাথে প্রায় একই রঙের আঁকা গাড়িগুলোতে। বিশাল মরুভূমিতে গাড়িগুলো দেখাচ্ছে বাচ্চাদের খেলনার মতো।

পথের অর্ধেকটাই পুড়ে গেছে। তেলতেলে কালো ধোঁয়া উঠে আসছে বাতাসে। রাস্তায় পড়ে আছে একটা মানব শরীর। কোন কারণ ছাড়াই মৃত্যু এসে নিয়ে গেছে তাকে। এই দৃশ্য দেখে তিক্ততার ভাব এলো ডেভিডের মনে। যেমনটা শেষবার অনুভব করেছিল মাদ্রিদের ষাড়ের লড়াইয়ের জায়গায়।

রাস্তার পাশে কাত হয়ে পড়ে আছে আরেকটা গাড়ি। আরোহীদেরকে পাথর আর ধুলার মাঝে কাতরাতে দেখতে পেল ডেভিড। তাদের কেউ কেউ আবার ছোট অস্ত্র দিয়ে আততায়ীর উপরে পরবর্তী আঘাতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এই ধাচের প্লেন আগে কখনো দেখেনি ডেভিড। কিন্তু আগে অনেকবার ছবিতে দেখায় সাথে সাথে চিনতে পারল। সিরিয়ান এয়াফোর্সের রাশান মিগ ১৭, লম্বা লেজ ভুল হবার কোন কারণ নেই। মরুভূমির বাদামী রঙের সাথে মিলিয়ে ছদ্মবেশের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে আছে লাল, সাদা আর কালো রং। ফিউজিলাজে সবুজ রং আর পাখা মোটা ও বেটে।

দ্রুত নিচের দিকে নামতে লাগল মিগ। এগিয়ে যাচ্ছে পার্ক করে রাখা গাড়িগুলোর দিকে। পাথরের কাছে পড়ে থাকা অসহায় মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে পাইলট। তাই উপর থেকে নেমে আসা বিপদ সম্পর্কে একটুও আঁচ করতে পারল না সে।

সিরিয়ান প্লেনের লেজের উপর নেমে এলো ব্রিগ। ক্লাসিক স্টাইলে আঘাত করল পেছন থেকে আর উপর থেকে। মাঝামাঝি অবস্থান নিল ডেভিড। ব্রিগকে কাভার দেয়ার পাশাপাশি প্রথম আঘাত ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় আঘাত করার দায়িত্ব তার।

আবারো আক্রমণ করল সিরিয়ান পাইলট। নিচে থাকা মানুষ আর ট্রাকগুলোর উপর গর্জে উঠল কামান। ড্রাগনের বিষাক্ত নিঃশ্বাসের মতো ধোঁয়া আর আগুনের শিখা নিয়ে বিস্ফোরিত হলো আরেকটা ট্রাক।

‘বেজন্মা, কুত্তা, ব্রিগের পেছনে থেকে ফিসফিস করে উঠল ডেভিড। তাকিয়ে দেখল নিজের লোকদের উপর নেমে এলো নরক। এই প্রথমবারের মতো তাদেরকে আপন মনে হলো তার। ঠাণ্ডা রাগের স্রোত নেমে গেল শরীর বেয়ে, মনে হলো সে একজন মেষপালক আর তার মেষের পালের উপর আঘাত এসেছে।

কোথা থেকে একটা কবিতার লাইন চলে এলো মাথার মাঝে “আসিয়ীররা এমন ভাবে নেমে এলো যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে নেকড়ের পাল।” স্বেচ্ছায় নিজের কামানকে লক করল ডেভিড। জয়স্টিকের ট্রিগার টেনে দিল সামনে। নরম সবুজ আলো জ্বলে উঠল কামানের পাশে, হয়ে উঠল জীবন্ত। চোখ পিটপিট করল ডেভিড।

খুব কাছে থেকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিল ব্রিগ। কিন্তু ঠিক যে মুহূর্তে মনে হল সে আঘাত করবে ডেভিড পেল সিরিয়ান প্লেনটার পাখা উল্টে গেল। নিজের কাজের ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত ডেভিড তৎক্ষণাৎ যা গুরুতুপূর্ণ সেটাই করবে বলে ঠিক করল। নিজের গতি কমিয়ে নিল রাতারাতি। ফলে এক দিকের পাখা কাত হয়ে মাটির দিকে ঝুঁকে গেল একশ ফিট নিচে।

ব্রিগের গোলা লক্ষ্যচ্যুত হলো। ঠিক সে সময় নিচে নেমে গেল সিরিয়ান প্লেন। মনে হলো কোন এক মুষ্টিযোদ্ধা প্রতিপক্ষের ভয়ঙ্কর পাঞ্চ এড়িয়ে নেমে গেছে। ধুলা রঙের এয়ারক্রাফটের অনেক উপরে বিস্ফোরণ দেখতে পেল ডেভিড। এরপরেও মিস্ করল ব্রিগের প্রতিটি শেল। ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে উঠল ব্রিগ।

ঠিক তখনই মিগ প্লেনের কাঠামো দেখে পুরোপুরি অবচেতনে ঠিক কাজটাই করল ডেভিড। নিজের পাওয়ার বন্ধ করে দিয়ে মিরেজের গতি বন্ধ করে দিল।

মিগ চেষ্টা করল দ্রুত ফিরে যেতে যেখান থেকে এসেছে সেখানে। হঠাৎ করেই ঘূর্ণায়মান দুটি এয়ারক্রাফটের সামনে পথ রোধ করে দাঁড়াল খাড়া পাহাড়ের চূড়া।

পাহাড়ের উপরে ওঠার কোন চেষ্টাই করল না মিগ। এর বদলে পাহাড়ের মাঝে সরু একটা গলি ঠিক করে ঢুকে গেল। পালিয়ে যাবার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে মিগ।

কিন্তু এই ধরনের কাজের জন্য উপযুক্ত নয় মিরেজ। ডেভিড অনুভব করলো তার উচিত আফটারবার্নারস জ্বালিয়ে পাহাড় শ্রেণীর উপর উঠে যাওয়া–কিন্তু এর মানে হবে মিগটাকে পালিয়ে যেতেই দেয়া আর এটা চিন্তা করেই রেগে গেলে সে।

পাথরের গলির ভেতর সিরিয়ানটার পিছু নিল ডেভিড। দুই পাশের পাথরে ঘষা খাচ্ছে মিরেজের পাখার মাথা। তাড়াতাড়ি পাখা নামিয়ে অনুসরণ করে চলল ডেভিড। সতর্কবার্তা হিসেবে লাল আলো জ্বলে উঠল মিরেজের মাঝে।

অথচ সামনে ঠিকই পথ করে নিয়ে এগিয়ে পেছনে তাকাল পাইলট। দেখতে পেল অনুসরণ করে আসছে মিরেজ। ধীরে ধীরে প্রায় সিরিয়ানের ঘাড়ের উপর চলে এসেছে। আবারো কন্ট্রোলের উপর মনোযোগ দিল পাইলট। নিচে নামিয়ে আনল নিজের মেশিনকে পাথরের দেয়ালে প্রায় ঘষটে ঘষটে চলেছে পাখা।

পাহাড়ের ভিতর বাতাস ক্রমেই গরম আর দূষিত হয়ে উঠছে। এদিকে মিরেজও অস্থির হয়ে উঠেছে মুক্ত হবার জন্য। অন্যদিকে এখনো ডেভিডের গান সাইটের কেন্দ্রবিন্দুতে এদিক-ওদিক দুলছে সিরিয়ান মিগ।

আবারো মোড় এলো উপত্যকার মাঝে। হয়ে গেল আরো সরু। হঠাৎ করেই দেখা গেল সামনে পাথরের কঠিন কিন্তু মসৃণ দেয়ালে পথ হয়ে গেছে বন্ধু।

ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে সিরিয়ান প্লেন। চেষ্টা করল উপর দিকে উঠে যাবার। কিন্তু দু’পাশে আর সামনে সব দিকেই পথ আটকে ফেলেছে পাথরের দেয়াল।

থ্রটল টেনে আফটারবার্নারস জ্বালিয়ে দিল ডেভিড। গর্জে উঠল শক্তিশালী ইঞ্জিন; সামনে ঠেলে দিল ডেভিডকে। সিরিয়ান মিগের স্টার্নের দিকে এগিয়ে গেল মিরেজ।

মনে হলো অনন্তকাল ধরে চলতে লাগল এই মাইক্রো সেকেন্ড। অলস ভঙ্গিতে মিরেজের গান সাইটে উঠে এলো সিরিয়ান মিগ। কেন্দ্র দখল করে এমনভাবে মূর্ত হয়ে উঠল, মনে হলো মিরেজের নাকটা হয়তো মিগের লেজের মাঝে ঢুকে যাবে।

কামানের ট্রিগার চাপ দিল ডেভিড। কেঁপে উঠল মিরেজ। ফায়ারের সাথে সাথে ধোয়া আর শেল ছুটলো সামনের দিকে।

রূপালি ধোয়ার ভস্মীভূত হয়ে গেল সিরিয়ান মিগ। উজ্জ্বল সাদা আলো জ্বলে উঠল আকাশপানে। ফিউজিলাজ দিয়ে পরিষ্কার দেখা গেল পুড়ছে পাইলটের শরীর। এক মুহূর্তের জন্য স্পষ্ট করে সব দেখা দিল ডেভিডের স্ক্রিনে। হাত আর পাগুলো দুই পশে ছড়িয়ে দিল পাইলট। মনে হলো ক্রুশে দেয়া হচ্ছে তাকে। মাথায় হেলমেট আর পরনের কাপড় বেলুনের মতো উড়ছে বাতাস পেয়ে। এরপরই অদৃশ্য হয়ে গেল সব। কেননা দ্রুত উপত্যকা থেকে উপরে উঠে খোলা আকাশে বের হয়ে এলো মিরেজ।

নিজেদের গাড়ির মাঝে মাঝে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে সৈন্যরা। নিজেদের ক্ষত বেঁধে নিচ্ছে, মৃতদেহ ঢেকে দিচ্ছে। কিন্তু রাস্তার খুব নিচু দিয়ে ডেভিডকে উড়ে আসতে দেখে চোখ তুলে তাকাল সকলে। এত কাছ দিয়ে উড়ে গেল ডেভিড যে পরিষ্কার দেখতে পেল সবার চেহারা। রোদে পোড়া বাদামী ত্বক, কারো আছে দাড়ি, কারো মোচ, শক্তিশালী তরুণ চেহারা, হাত নেড়ে ডেভিডকে ধন্যবাদ জানিয়ে উল্লাসে চিৎকার করে উঠল সকলে।

এরা সবাই আমার আপনার লোক; ভাবল ডেভিড। ঝড়ের গতিতে এখনো রক্তে মিশে যাচ্ছে অ্যাড্রেনালিন। কেমন অদ্ভুত বোধ হলো নিজেকে তার। নিচে মানুষের দিকে তাকিয়ে হাসল সে ও। গ্লাভস পরা এক হাত তুলে স্যালুট জানাল তাদের উদ্দেশে। এরপর উঠে গেল উপরে ব্রিগ চক্রাকারে ঘুরে অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

সূর্যের উজ্জ্বল আলোর তুলনায় স্নান দেখাল বাঙ্কারের কৃত্রিম আলো। একজন ইঞ্জিনিয়ার এগিয়ে এসে ককপিট থেকে নামতে সাহায্য করল ডেভিডকে। অন্যরা এসে মিরেজের রিফুয়েল আর বি-আর্মের কাজ শুরু করল। এই ছোট্ট এয়ারফোর্সের এটাই বড় গুণ, যুদ্ধের জন্য প্লেনকে প্রস্তুত করতে খানিকটা সময় লেগে যায়। কিন্তু এই মিরেজ ভগ্নাংশের মাঝে প্রস্তুত হয়ে যায়। তাই প্রয়োজনের সময় শক্রর বহু আগেই যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে যায় মিরেজ।

ককপিটের আড়ষ্টতা থেকে মুক্তি পেয়ে ডেভিড এগিয়ে গেল ব্রিগের দিকে। ফ্লাইট কন্ট্রোলারের নিচে হেলমেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিগ। হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে তাকিয়ে দেখল এগিয়ে আসছে ডেভিড। হাসল দ্বিগ। ঝিকঝিক করে উঠল স্বর্ণের দাঁত।

আস্তে করে চাপড় দিল ডেভিডের কাঁধে। কেন! ইয়েস!’ বলে উঠল জেনারেল জোশুয়া মোরদেসাই। তুমি পারবে।’

.

সন্ধ্যায় ডেবরার সাথে ডিনারে দেখা করতে দেরি করে ফেললো ডেভিড। যদিও আগেই বাবার কাছে কারণটা শুনতে পেয়েছে ডেবরা।

ডেভিডের টাওয়ারের পেছনে সিলেক্টে গেল তারা পুরোনো শহরের জাফো গেটের ভেতরে। এর আটপৌরে অন্দর সজ্জা, দেয়ালের উপর দড়ির সজ্জা কিছুই একটু পরে পরিবেশিত হওয়া সুস্বাদু খাবারের আভাস দিতে পারল না

ডেভিডকে। একটুও তেমন দেরী না করে খাবার দিয়ে গেল আরবীয় পরিবেশক—মৌশাখা চিকেন, কুসকুসের উপর ছড়ানো বাদাম আর মসলা।

প্রায় নিঃশব্দে খেতে লাগল দুজনে। ডেভিডের মড বুঝতে পেরে শ্রদ্ধা জাগলো ডেবরার মনে। যুদ্ধ পরবর্তী আবেশে মগ্ন হয়ে আছে ডেভিড। উদ্বেগ আর উত্তেজনায় বয়ে গেছে অ্যাড্রেনালিন। কিন্তু পেটে ভালো খাবার পড়ায় আর ভারী কামেল ওয়াইন সাহায্য করল রিল্যাক্স হতে। এরপর এলাচি দানার ঘ্রাণওয়ালা কালো, টার্কিশ কফি শেষ করার পরেই কেবল ডেবরা ফুরসত পেল কথা বলার।

‘আজ কী হয়েছে, ডেভিড?

উত্তর দেবার আগে এক চুমুক কফি খেল ডেভিড।

‘আমি একজন মানুষকে মেরে ফেলেছি। নিজের কাপ নামিয়ে রেখে মনোযোগ দিয়ে ডেভিডের চেহারা দেখতে লাগল ডেবরা। এরপর পুরো ঘটনা তাকে খুলে বলল ডেভিড। পিছু ধাওয়া করা, মেরে ফেলা; এরপর শেষ করল অনুতাপের স্বরে। ঐ সময়ে আমি কেবল তৃপ্তিই বোধ করেছি। কিছু একটা পেয়েছি মনে হয়েছিল। আমি জানি সে সময় যা করেছি সেটাই ছিল সঠিক।

‘আর এখন? আরেকটু জানতে চাইল ডেবরা।

এখন আমার খারাপ লাগছে।’ কাঁধ ঝাঁকালো ডেভিড। খারাপ লাগছে। এটা ভেবে যে কাজটা করতে হয়েছে আমাকে।

‘আমার বাবা, সব সময়ে যাকে সৈন্য হিসেবেই দেখেছি, বলে যে যারা সত্যিকারের যুদ্ধ করে তারাই শুধু জানে যে যুদ্ধকে ঘৃণা করা বলতে কী বোঝায়।

মাথা নাড়াল ডেভিড, হ্যাঁ। এখন আমিও বুঝতে পারছি এটা। আমি উড়তে পছন্দ করি। কিন্তু ঘৃণা করি ধ্বংস করতে।’

আবারো চুপচাপ হয়ে গেল দু’জনে। দু’জনেই মনে মনে ভাবছে যুদ্ধ নিয়ে নিজস্ব ভাবনা। দু’জনেই শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছে একে প্রকাশ করার।

‘আর তারপরেও এটা জরুরি। নীরবতা ভাঙ্গলো ডেবরা। আমাদেরকে যুদ্ধ করতেই হবে আর কোন পথ নেই।’

‘আর কোন উপায় নেই–পেছনে সমুদ্র আর গলার মাঝে আরবীয়।

‘তুমি একজন ইস্রায়েলির মতোই কথা বলছো। নরম স্বরে জানাল ডেবরা।

‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ–অথবা এমনো বলা যায় যে তোমার বাবাও এতে ভূমিকা রেখেছে। তিন সপ্তাহ সময় দিয়েছে আমার হিব্রু ঝালাই করে নেয়ার আর অভিবাসনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার।

আর তারপর? ডেভিডের দিকে ঝুঁকে এলো ডেবরা।

‘এয়ারফোর্সে একটা কমিশন। শুধুমাত্র এই কারণেই রয়ে যাচ্ছি আমি। আমি ঠিক সেই র্যাংক চাই যা হয়তো স্বদেশে ফিরে গেলে পেতাম। মনে হয়েছিল সে সেকেন্ডহ্যাণ্ড কাপড় বিক্রেতার মতো আচরণ করছিল। কিন্তু আমিও তাকে বশ করে ফেলেছি। তাই অবশেষে মেনে নিয়েছে। অ্যাক্টিং মেজর। এক বছর পরে র্যাংকের নিশ্চয়তা।

‘এটা তো বেশ ভালো খবর, ডেভি। সার্ভিসে একেবারে তরুণ মেজরদের একজন হবে তুমি।

হ্যাঁ, একমত হলো ডেভিড।

‘আর পরে ট্যাক্স দেয়ার পরে আমার বেতন হবে স্বদেশে একটা বাস ড্রাইভারের চেয়ে সামান্য কম।’

কিছু মনে করোনা। প্রথমবারের মতো হাসল ডেবরা। হিব্রু শিখতে আমি সাহায্য করব তোমাকে।

‘এই ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলতে যাচ্ছিলাম আমি। ডেবরার হাসির উত্তর দিল ডেভিড।

‘চলো এখান থেকে বেরিয়ে যাই। আজ রাতে কেমন যেন লাগছে হাঁটতে চাই আমি।’

খ্রিস্টান কোয়ার্টারের ভেতরে হেঁটে বেড়ালো তারা। রাস্তার দু’পাশের দোকানগুলোও খোলা। পূর্ণ হয়ে আছে কাপড়, চামড়া আর গয়নার সম্ভারে। একই সাথে সরু গলিটাতে পাওয়া গেল বিভিন্ন মসলা, খাবার, নর্দমা আর মানবতার অপচয়ের গন্ধ, প্রায় মাথার উপরেই খিলানগুলো।

ডেবরা, ভিয়া ডলোরোজাতে একটা অ্যান্টিক শপে নিয়ে গেল ডেভিডকে। খুশিতে গদগদ দোকানি এগিয়ে এলো সামনে।

‘আহ মিস মোরদেসাই–আর তোমার বাবা কেমন আছে?’ এরপরই দ্রুত বেগে পিছনের দরজায় অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা তাদের জন্য কফি আনার উদ্দেশ্যে।

‘অর্ধেকটাই সৎ, এমন লোকদের একজন এই দোকানি আর ব্রিগকে যমের মতো ভয় পায়।

ডেভিডের জন্য সরু চেইনের মাঝে অ্যান্টিক সোনার তারা পছন্দ করল ডেবরা। এর আগে যদিও এভাবে কোন গয়না পরেনি ডেভিড, তারপরেও মাথা নামিয়ে দিল ডেবরার সামনে। চেইন পরিয়ে দিল ডেবরা। বুকের ঘন কালো কেশের মাঝে ফুটে রইল সোনালি তারা।

‘এইটাই একমাত্র পেলে তুমি-সাধারণত মেডেল দিই না আমরা।’ হাসতে হাসতে বলে উঠল ডেবরা।

কিন্তু যাইহোক, ইস্রায়েলে স্বাগতম।

‘এটা অনেক সুন্দর। আবেগ আপ্লুত হয়েও অস্বস্তি বোধ করল ডেভিড। ‘ধন্যবাদ।’ তাড়াতাড়ি শার্টের বোতাম লাগিয়ে নিল। এরপর ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল ডেবরার দিকে। বুঝতে পেরে সরে গেল ডেবরা। সাবধান করে দিল ডেভিডকে।

‘এখানে নয়। দোকানি মুসলিম। ভালোভাবে নেবে না ব্যাপারটা।

‘ঠিক আছে।’ বলে উঠল ডেভিড। চলো এমন কোথাও যাই যেখানে আমাদের জন্য কারো মর্যাদাবোধ আহত হবে না।

বিশাল দেয়ালের লায়ন গেইট দিয়ে বের হয়ে এলো তারা। মুসলিম কবরস্থানে জলপাই গাছগুলোর ভিড়ে খুঁজে পেল একটা পাথরের বেঞ্চ। আকাশে আধখানা চাঁদ, চারপাশে রহস্যময় রূপালি আলো, উষ্ণ রাত অপেক্ষা করছে কিছু একটার জন্য ঠিক যেন নব পরিণীতা বধূ।

ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকতে পারো না। ডেবরার কথা শুনে দু’জনেই মাথা তুলে উপত্যকার উপরে থাকা হোটেলটার খিলান আর আলো-ছায়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘কেন নয়?

‘ওয়েল, প্রথমত এটা বেশ ব্যয়বহুল। তুমি যে বেতন পাবে কখনোই টিকতে পারবে না।’

‘তুমি ভাবছো আমি বেতনের টাকায় চলতে পারব না? ডেভিডের অভিযোগ পাশ কাটিয়ে ডেবরা বলে উঠল।

‘আর সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তুমি কোন মতেই আর ট্যুরিস্ট নও। তাই তুমি সেভাবে থাকতে পারো না।

তাহলে তোমার পরামর্শ কী?

‘আমরা তোমাকে একটা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে দিতে পারি।’

‘তাহলে ঘরের কাজ, রান্না, কাপড় ধোয়া এগুলো কে করবে?’ প্রায় চিৎকার করে অভিযোগ জানাল ডেভিড। এইসব কাজে আমার তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই।

‘আমি করব।’ জানিয়ে দিন, ডেবরা। এক মুহূর্তের জন্য জমে গেল। ডেভিড। এরপর আস্তে করে ঘুরে তাকাল ডেবরার দিকে।

কী বলছো তুমি?

‘আমি বলেছি আমি করব। স্থিরপ্রতিজ্ঞা সহযোগে উত্তর দিল ডেবরা। এরপর হঠাৎ করে শান্ত হয়ে গেল কণ্ঠস্বর। যদি তুমি চাও আমি করি।’ বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো ডেভিড।

‘দেখো ডেবস, তুমি কী লিভিং টুগেদারের কথা বলছো? মানে আমি বলতে চাইছি ফুল-টাইমের জন্য ঘরবাড়ি খেলা খেলা?

“ঠিক এই জিনিসটাই বলতে চাইছি আমি।’

‘কিন্তু’ আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না ডেভিড। পরিকল্পনাটা চমৎকার, শ্বাসরুদ্ধকর আর আরো অনেক কিছুর সম্ভাবনাও থকে যায়। এর আগে বিপরীত সেক্সের সাথে অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর। কিন্তু কোনটাই তেমন গভীর ছিল না। তাই মনে হলো অজানা কোন দেশের সীমান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে।

“ওয়েল?’ অবশেষে জানতে চাইল ডেবরা।

তুমি বিয়ে করতে চাও?’ শব্দগুলো কেমন ভেঙ্গে ভেঙ্গে বের হলো ওর গলা দিয়ে। কেশে গলা পরিষ্কার করল ডেভিড।

‘ডার্লিং, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই যে, বিয়ের বাজারে তুমি সেরা কিনা। সকালের মতই সুন্দর তুমি আর মজা করে বলতে চাইল–তুমি স্বার্থপর নাবালক আর বখে যাওয়া।

‘ধন্যবাদ, তোমার অনেক দয়া।

‘ওয়েল, আমার ভেতর ঢং করে কথা বলার কোন প্রবণতা নেই। তখনো হয়তো থাকবে না যখন সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে তোমার মিসট্রেস হয়ে যাবো।

‘ওয়াও!’ আনন্দিত হয়ে উঠল ডেভিড। সমস্ত আড়ষ্টতা উধাও হয়ে গেল কণ্ঠ থেকে। এভাবে সরাসরি যখন কথা বললো আমার মাথায় প্রায় বিস্ফোরণের মতো ঘটে।

‘আমারও’, স্বীকার করল ডেবরা। কিন্তু শর্ত একটাই–আমাদের নিজেস্ব বিশেষ জায়গা না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমরা। তোমার হয়তো মনে আছে জনসমক্ষে বীচে বা পাথুরে দ্বীপে তেমন সহজ নই আমি।

‘আমি কখনোই ভুলবো না।’ একমত হলো ডেভিড। এর মানে কী তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও না?

‘আমি এটা বলিনি। বিড়বিড় করে উঠল ডেবরা। কিন্তু দু’জনেই যখন প্রস্তুত হবো এই সিদ্ধান্ত তখনকার জন্যই মুলতবী থাক।

‘রাইট অন ডল। সারা মুখে প্রায় বোকার মতো হাসি নিয়ে উত্তর দিল ডেভিড।

‘আর এখন, মেজর মরগ্যান, তুমি চাইলে আমাকে কিস করতে পারো। কিন্তু শর্তের কথা মনে রেখে আমাকে সাহায্য করবে।’ জানিয়ে দিল ডেবরা।

অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ করে একটা চিন্তা এসে আতঙ্কিত করে তুলল ডেভিডকে।

মাই গড! প্রায় চিৎকার করে উঠল সে। ব্রিগ কী বলবে?

‘সে নিশ্চয় আমাদের সাথে থাকতে আসবে না। হেসে ফেলল দু’জনেই।

না সিরিয়াসলি, কী বলবে তোমার মা-বাবা কে? জানতে চাইলে ডেভিড।

‘আমি খুব সুন্দরভাবে মিথ্যা কথা বলব; তারাও এমন অভিনয় করবে যে আমার কথা বিশ্বাস করেছে। এ ব্যাপারে আমাকেই মাথা খাটাতে দাও।

“ঠিক আছে। তৎক্ষণাৎ একমত হলো ডেভিড।

‘এই তো তুমি শিখে যাচ্ছে সব।’ হাততালি দিয়ে উঠল ডেবরা।

‘আই লাভ ইউ। হিব্রুতে জানাল ডেভিড।

‘লক্ষ্মী ছেলে। বিড়বিড় করে উঠল ডেবরা।

কিছুদিনের মাঝেই ডেভিড আবিষ্কার করল যে জেরুজালেমে অ্যাপার্টমেন্ট খোঁজা আর হলি গ্রেইল খোঁজার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। যদিও অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে সুউচ্চ সব দালান। তারপরেও চাহিদারর তুলনায় তা কিছুই না।

ডেবরার এক ছাত্রের বাবা এস্টেট এজেন্ট। হৃদয় দিয়ে গৃহহীনদের আর্তি অনুভব করে ভদ্রলোক। নতুন ব্লকের জন্য অপেক্ষমান তালিকা কেবল বড় হতে থাকে। কিন্তু কোন কারণে পুরাতন একটি দালানের একটা অ্যাপার্টমেন্ট খালি হয়ে যাওয়ায় সব প্রভাব খাঁটিয়ে ডেবরাকে সাহায্য করে সে।

হঠাৎ করেই যখন আসার কথা নয় এমন সময়ে ডেবরার মেসেজ পায় ডেভিড। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্যাক্সি সহযোগে তাড়াতাড়ি শহরের উদ্দেশে রওনা হয় দু’জনে। ড্রাইভারকে তাড়া লাগিয়ে দেখে আসতে চায় নতুন পাওয়া সুযোগ।

জায়গাটা দেখার সাথে সাথে ডেভিডের মনে পড়ে গেল লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার মুভি সেটের কথা। সামনের দিকে তাল গাছের সারি, প্রতিটি ব্যালকনিতে আর জানালাতে ঝুলছে রঙিন কাপড়-চোপড়, ভেসে আসছে আরবীয় উটের বাজারের গন্ধ আর শব্দ আর উঠানের একপাশে নার্সারি স্কুলের খেলার জায়গা।

অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে দুইটা রুম আর লাগোয়া একটা বাথরুমও আছে। ওয়ালপেপারের গোলাপগুলো ইতিমধ্যে ঝাপসা হয়ে গেছে। শুধুমাত্র যেসব জায়গায় অন্য কোন আসবাব ঝোলানো ছিল সেখানে এখনো অক্ষত আছে ওয়ালপেপারের সত্যিকারের নকশা আর রং।

বাথরুমের দরজা খুলে উঁকি দিল ডেভিড। ভেতরে না ঢুকেও নজর বুলিয়ে দেখে নিল এবড়ো-থেবড়ো মেঝে, সস্তা দামের বাথটাব। এরপর দরজাকে আরো একটু ধাক্কা দিতেই দেখতে পেল টয়লেট বোলের বেহাল দশা। এমন ভাবে হাঁ করে আছে যেন কোন মাতাল পরীর শূন্য মুখ।

‘তুমি আর জো নিশ্চয়ই এতে কাজ চালাতে পারবে। অনিশ্চয়তার সুরে বলে উঠল ডেবরা। এটা এত একটা খারাপও নয়।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে এমনভাবে বাথরুমের দরজা আটকে দিল ডেভিড, যেন কোন কফিনের ঢাকনা।

তুমি নিশ্চয়ই মজা করছে–তাই না।’ ডেভিড বলতেই দেখা গেল ডেবরার মুখে নিশ্চিন্তের হাসি।

“ওহ, ডেভিড। আমরা আর কোন জায়গা পাবো না।’

“আর আমি বেশিদিন অপেক্ষা করতে পারব না।

‘আমিও না।’ স্বীকার করল ডেবরা।

“ঠিক আছে। দুই হাত ঘসলো ডেভিড। সময় হয়েছে প্রথম দল পাঠানোর।

জেরুজালেমে মরগ্যান গ্রুপের পরিচয় নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ডেভিড। কিন্তু ডিরেক্টরীতে মরগ্যান ইনড্রাষ্ট্রিয়াল ফিন্যান্স নামে খুঁজে পেল অবশেষে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর, অ্যারন কোহেন। প্রধান পোস্ট অফিসের পেছনে লিউমি ব্যাংক বিল্ডিংয়ে অফিস। গত দশ দিন ধরে জেরুজালেমে বাস করছে মরগ্যান পরিবারের সদস্য, জানতে পেরে হতভম্ব হয়ে যায় অ্যারন। যদিও দ্রুতই আবার সামলে নেয় নিজেকে।

কী চায় ডেভিড জানিয়ে দিতেই মাত্র বিশ ঘন্টার মাঝে সাইন করিয়ে টাকা পরিশোধের ঝামেলাও মিটিয়ে দেয় অ্যারন। পল মরগ্যান অনেক ভেবে-চিন্তেই নিজের এক্সিকিউটিভদের নিয়োগ দেয় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো অ্যারন কোহেন। আর এই কাজের জন্য ডেভিডের যা পরিশোধ করতে হলে তা হলো পরদিন সকালবেলা পল মরগ্যানের ডেস্কে পৌঁছে গেল তার সাম্প্রতিক অবস্থান, আর্থিক লেনদেন আর ভবিষ্যত পরিকল্পনা–কিন্তু এতটুকু দিতে কার্পণ্য করল না ডেভিড।

হিন্নম গভীর খাদের উপরে, মাউন্ট জিয়নের দিকে মুখ করে থাকা মন্টেফিওরে কোয়ার্টারকে সম্পূর্ণ নতুন করে গড়ে তুলেছে কয়েকজন ব্যবসায়ী। প্রায় পুরোটাই তৈরি অনিন্দ্যসুন্দর সোনালি জেরুজালেম পাথর দিয়ে। আর এর নকশা করা হয়েছে প্রাচীনতার ছাপ দিয়ে। যার কোন বয়স নেই। কিন্তু যাইহোক অভ্যন্তরের নকশায় আছে অত্যাধুনিক লম্বা-শীতল রুম, মোজাইক টাইলসের বাথরুম আর সিলিংয়ের খিলান দেখে মনে হবে ক্রুসেডীয় আমলের গির্জা। কোয়ার্টারের বেশিরভাগ বাড়িগুলোর নিজস্ব ছাদ আর সীমান্ত দেয়াল আছে।

মালিক স্ট্রিটের দিকে মুখ করে থাকা বাড়িগুলোর একটি ডেভিডের জন্য নির্বাচন করল অ্যারন কোহেন। দামটাও বেশ ভারিক্কি চালের। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়ে এটাই ছিল ডেবরার প্রথম প্রশ্ন। ছাদে একটা মাত্র জলপাই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেল সে। ছাদের পাথরগুলোকে কেটে এমন পালিশ করা হয়েছে যে দেখতে মনে হচ্ছে পুরোনো আইভরি খোদাই করা সদর দরজার উপর হালকা ভাবে হাত বুলাতে লাগল ডেবরা। স্তম্ভিত ডেবরার কণ্ঠস্বর হয়ে গেল ফ্যাসফ্যাসে আর শোনার অযোগ্য।

‘ডেভিড! ডেভিড! এর দাম কত?

‘এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা?

‘এটা অনেক সুন্দর। অনেক বেশি, ডেভিড। আমরা এতটা খরচ করতে পারব না।

ইতিমধ্যে এর দাম পরিশোধ করা হয়ে গেছে।

হয়ে গেছে? হাঁ করে তাকিয়ে রইল ডেবরা। কত ডেভিড?

যদি আমি এক মিলিয়ন বা আধা মিলিয়ন ইস্রায়েলী পাউন্ডস, কী যায় আসে তাতে? এটা শুধুমাত্র অর্থ।

দুই কানে হাত চাপা দিল ডেবরা। না!’ চিৎকার করে উঠল। আমাকে বলো না। আমার খুব খারাপ লাগবে। আমি এখানে থাকতে পারব না।

‘ওহ, কী! তুমি ইতিমধ্যে সম্মতি দিয়েছে এখানে থাকার।’

‘চেষ্টা করে দেখো।’ জোর দিয়ে বলে উঠল ডেবরা। চেষ্টা করে দেখো।’

মাঝখানের রুমে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তারা। সামনে খোলা ছাদ। যদিও ভয়ঙ্কর গরমের কথা মাথায় রেখে এখানে বাতাস চলাচলের যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়েছে আর রংও হালকা; তারপরও নতুন রং আর কাঠের বার্নিশের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

ফার্নিচার সম্পর্কে কী করতে চাও?’ জানতে চাইল ডেভিড।

ফার্নিচার? একই প্রশ্ন করল ডেবরা। আমি, এতটা এগিয়ে ভাবিনি এখনো।

আমার যেটা মনে হয় আমাদের একটা বড়সড় বিছানা প্রয়োজন।

গম্বুজের মত ছাদ বা পাথরের মেঝের উপর কোন আধুনিক ফার্নিচার ভালো লাগবে না। তাই অ্যান্টিক শপ আর বাজার ঘুরে ঘুরে ফার্নিচার কেনা শুরু করল দুজনে।

প্রধান সমস্যার সমাধান করে দিল ডেবরা। একটা অপরিত্যক্ত মালের গুদামে পেয়ে গেল বিশাল একটা খাট; যদিও ধুলা ময়লা পরিষ্কার করে নিতে হলো। চকচক না করা পর্যন্ত পালিশ করা হলো এটিকে। নতুন কেনা হলো ভেতরের দিকে স্প্রিং দেয়া ম্যাট্রিস। আর খাটটাকে ঢেকে দেয়ার জন্য ডেবরার ড্রয়াল থেকে বের করা হলো ক্রিম রঙা লেসের চাদর।

পুরোন শহরের আরবীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে নিল উল দিয়ে বোনা রাগ। পাথরের মেঝের উপর মোটা করে বিছিয়ে দিল। সাথে থাকল বসার জন্য চামড়ার কুশন আর খাবার-দাবারে জন্য ইবোনি আর মাদার অব পার্ল দিয়ে তৈরি, জলপাই কাঠের নিচু টেবিল। অন্যান্য আসবাব কেনা হবে যখন বিক্রির জন্য নোটিশ লাগানো কিছু পাবে অথবা এতেও কাজ না হলে ডেবরার পরিচিত আরবীয় কেবিনেট মেকার তো আছেই। খাট আর টেবিল দু’টোরই ওজন অসম্ভব ভারী। তাই শক্তিশালী কাউকে দরকার এ দু’টো বহন করার জন্য। এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় জোকে ডাকা। তাই করল তারা। জোর ছোট্ট জাপানি গাড়িতে করে এসে পৌঁছালো জো আর হান্নাহ। মরগ্যান প্রাসাদ দেখে তো দুজনের ভিরমি খাবার জোগাড়। যাই হোক একটু ধাতস্থ হতেই আগ্রহ নিয়ে কাজ শুরু করল তারা। আর সবকিছুর তত্ত্ববধানের দায়িত্বে রইল ডেভিড। কাজ করতে শুরু করল জো, অন্যদিকে ডেবরার সাথে আধুনিক আমেরিকান রান্নাঘরে হারিয়ে গেল হান্নাহ। ওয়াশিং মেশিন, ড্রয়ার, ডিশ ওয়াশার আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি দেখে একই সাথে শ্রদ্ধা আর হিংসা ফুটে বের হলো হান্নাহর গলা চিরে। প্রথম খাবার রান্না করায় ডেবরাকে সাহায্য করল সে।

এককেস গোল্ডস্টার বিয়ার নিয়ে এলো ডেভিড। নিজ নিজ কাজ শেষ করে জলপাই কাঠের টেবিলের চারপাশে জড়ো হলো সবাই ঘর গরম করতে আর ছাদ ভিজাতে।

ডেভিড ভেবেছিল জো হয়তো খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে থাকবে। যেহেতু এটা তার দুগ্ধপোষ্য বোনের রূপকথার বাসা। কিন্তু সবসময়কার মতো প্রাণবন্ত রইল জো। বিয়ার আর সবার সঙ্গে এতটাই মশগুল হয়ে পড়ল যে অবশেষে বাধ সাধলো হান্নাহ।

‘দেরি হয়ে গেছে। দৃঢ়গলায় ঘোষণা করল সে।

‘দেরি? অবাক হয়ে জানতে চাইল জো। মাত্র নয়টা বাজে।

‘আজকের রাতের মতো একটা রাতে এইটাই অনেক দেরি।

মানে?’ মানে হলো কিছুই বুঝতে পারছে না জো।

‘যোসেফ মোরদেসাই, অসাধারণ কূটনীতিবিদ। ভারী গলায় জ্বিপের স্বরে বলে উঠল হান্নাহ। হঠাৎ করে বদলে গেল জোর অভিব্যক্তি। অপরাধীর ভঙ্গিতে তাকাতে লাগল ডেভিড আর ডেবরার দিকে। একচুমুকে শেষ করে ফেলল নিজের বিয়ার। আর এক হাত দিয়ে দাঁড় করিয়ে নিল হান্নাহকে।

‘চলো। আমরা এখানে বসে আছি কেন?’ বোধোদয় হলো জো’র।

ছাদের আলো জ্বালিয়ে রাখলো ডেভিড। খোলা জানালা দিয়ে সেই আলোর রেশ আসছে ঘরে। রুম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল নরম আলো। পাথরের দেয়াল আর দূরত্ব থাকায় শহরের কোলাহলও শোনা যাচ্ছে না তেমন। আর এই মৃদু শব্দ তাদের একাকিত্বকে ভেঙ্গে দেয়ার বদলে বাড়িয়েই তুলল কেবল।

হালকা আলো ছড়াচ্ছে ক্রিম রঙা বেডকাভার। আইভরি লেসের কাজ থেকে ভেসে আসছে ল্যাভেন্ডার আর মথ বলসের গন্ধ।

বিছানায় শুয়ে ডেবরার পোশাক খোলার দৃশ্য দেখতে লাগল ডেভিড। নিজের উপরে ডেভিডের দৃষ্টি আর পূর্বে কখনো এমন না করায় লজ্জিত হয়ে উঠল ডেবরা।

কৃশকায় শরীরে লম্বা কোমর আর শিশুর মতো লাবণ্য মাথা পদযুগল; তারপরেও এতটুকু হারায়নি নারীসুলভ কমনীয়তা।

বিছানার কিনারে এসে বসল ডেবরা। ওর দেহত্বকের চকচকে মসৃণ ভাব দেখে আবারো চমৎকৃত হলে ডেভিড। কোন কোন জায়গায় সূর্যের তাপে পোড়া তুক ক্রিম থেকে হয়ে গেছে মধু-রঙা। আস্তে আস্তে ডেভিডের দিকে ঝুঁকে এসে গালে হাত রাখল ডেবরা।

তুমি অনেক সুন্দর। ফিসফিস করে উঠল ডেবরা। দেখল এর পুরোটাই সত্যি। লম্বা, ঋজু দেহে পেশীবহুল কাঁধ, কোমর আর সরু পেট। নিখুঁত মুখমণ্ডল। এতটাই অপার্থিব সৌন্দর্য যে মনে হলো এটাই ওর খুঁত। মনে কোন দেবদূত অথবা পুরাণ থেকে উঠে আসা দেবতার পাশে শুয়ে আছে ডেবরা।

পা ভাঁজ করে বিছানায় উঠে এলো সে। চাদরের নিচে একে অন্যকে স্পর্শ না করেও কাছকাছি শুয়ে দু’জনে তাকিয়ে রইল দু’জনের দিকে।

তৃপ্তি আর খুশির শ্বাস বের হয়ে এলো ডেবরার গলা চিরে। মনে হলো বহুদূর একাকী ভ্রমণ করে এসে গন্তব্যে পৌঁছেছে কোন পরিব্রাজক।

‘আই লাভ ইউ, প্রথমবারের মতো উচ্চারণ করল ডেবরা।

.

পুরো একটা সন্ধ্যা ব্যয় করে ডেভিডকে বোঝাতে লাগল ডেবরা–যে এয়ার বেস আর মালিক স্ট্রিটের ঘরে পৌঁছানোর জন্য উচ্চ শক্তি সম্পন্ন স্পোর্টস কারের কোন প্রয়োজন নেই। এতদিনে ডেভিডের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে বুঝে গেছে সে ভালোভাবেই। ডেভিডকে বোঝাতে লাগল যে এত জাকজমক আর ব্যয়বহুলতা ভালো দেখায় না। একমত হলো ডেভিড। জানে যে অ্যারন কোহেন আর ওর সঙ্গোপাঙ্গোরা নজরদারী করছে।

জোর মতোই জাপানিজ কার নিতে বলল ডেবরা। ডেভিড জানাল যে এ। ব্যাপারে অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে ভাববে সে।

অ্যারন কোহেনের লোক তেল আবিবে অবস্থানরত জার্মান চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ারসের কাছে একটা মার্সিডিজ বেঞ্জ ৩৫০ এস এল দেখে এলো। এই ভদ্রলোক আবার বার্লিনে ফিরে যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যে। তাই আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ক্যাশ পেলে অটো ছেড়ে দিতে রাজি আছে। একটা মাত্র ফোনকলের মাধ্যমে জুরিখের সুইস ক্রেডিটের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা হয়ে গেল।

গাড়ির রং সোনালি ব্রোঞ্জ। ঘড়িতে দেখা গেল বিশ হাজার কিলোমিটারের খানিকটা নিচে কাটা। আর মালিক যে যথেষ্ট যত্নের সাথে এর দেখভাল করেছে তা বুঝতে কোন কষ্ট হলো না।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজের মোটর স্কুটারে ফিরে মালিক স্ট্রিটের শেষ মাথায় এই মহার্ঘ্য মেশিন বাধা দেখতে পেল ডেবরা। একটা মোটাসোটা শিকল গ্রামে সকল ধরনের মোটর চালিত বাহনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে।

একবার তাকিয়ে দেখল ডেবরা। আর সাথে সাথেই বুঝে গেল যে এটা কার হতে পারে। অসম্ভব রেগেমেগে ছাদে উঠে এলো সে। কিন্তু হাবে ভাবে চাইল আরো বেশি রাগ দেখাতে।

‘ডেভিড মরগ্যান, তোমাকে নিয়ে আসলে কিছুই করার উপায় নেই।

‘তুমি সত্যিই দ্রুত বুঝতে পারো সব।’ ঘঁদের উপর সূর্য স্নান করছে। ডেভিড।

কত টাকা দিয়েছে এর জন্যে?”

অন্য কোন প্রশ্ন করো, ডল। বেশ একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা।

‘তুমি সত্যি একটা’-থেমে গিয়ে উন্মত্তের মতো উপযুক্ত শব্দ খুঁজতে লাগল ডেবরা। অবশেষে খুঁজে পেয়ে তৃপ্তির স্বরে উগরে দিল গলা দিয়ে ‘অধোপতনে যাচ্ছো!

‘এই শব্দের সঠিক অর্থই জানো না তুমি।’ কুশন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্র ভাবে ডেবরাকে উত্তর দিল ডেভিড। অলস ভাবে ঘুরে দাঁড়াল ডেবরার দিকে। যদিও মাত্র তিনদিন ধরে একে অন্যের এতটা সান্নিধ্যে এসেছে তারা, তারপরেও ডেভিডের চোখের ভাষা বুঝতে পারল ডেবরা।

‘তোমাকে অর্থটা বুঝিয়ে দেবো আমি।’ বলে উঠল ডেভিড। হাতে কলমে অধপতনে যাবার এমন উদাহরণ দিয়ে দেবো অনেক দিন মনে রাখবে।’

ডেভিড এগোনো শুরু করতেই জলপাই গাছের পিছনে চলে গেল ডেবরা। সারা ছাদে ছড়িয়ে পড়ল বইখাতা।

‘ছাড়ো আমাকে হাত সরাও জানোয়ার কোথাকার।

ডানদিকে লাফ দিল ডেভিড সহজেই তুলে নিল ডেবরাকে। ডেভিড মরগ্যান আমি সর্তক করে দিচ্ছি তোমাকে, এই মুহূর্তে আমাকে নিচে নামাও নয়তো চিৎকার করব আমি।’

‘চলো শোনা যাক! করো চিৎকার। তাই করল ডেবরা, কিন্তু প্রতিবেশীদের কোন নিদ্রাই ভঙ্গ হলো না তাতে।

অন্যদিকে ৩৫০ দেখে যারপরনাই খুশি হলো জো। চারজনে মিলে ট্রায়াল দিতে চলে গেছে। ডেড সীর তীরে অবস্থিত জুদায়ার বন্য অঞ্চলের আঁকাবাঁকা রাস্তায়। গাড়ির সহ্য ক্ষমতা আর ড্রাইভার হিসেবে ডেভিডের দক্ষতার পরীক্ষা হয়ে গেল। প্রতিটি বাকের মুখে উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল সকলে। এমনকি নিজের প্রাথমিক বিরোধিতা মনোভাব কাটিয়ে ডেবরা স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে গাড়িটা সত্যিই সুন্দর–তারপরেও অধোপতনোম্মুখ।

ইন জেদির মরূদ্যানের ঠাণ্ডা সুবজ পানিতে সাঁতার কাটলো সবাই। এরপর সমুদ্রের ঘন লবণাক্ত পানিতে চলে গেল। সবাই মিলে এর আগে বানালো পাথরের গভীর পুল।

নিজের ক্যামেরা নিয়ে এসেছিল হান্নাহ। পুলের পাথরের পাশে বসা ডেভিড আর ডেবরার ছবি তুলে নিল তাতে।

গোসলের উপযোগী পোশাক পরে আছে সবাই। ডেভিডের দিকে তাকিয়ে হাসছে ডেবরা। বিকিনি ফুটে বেরিয়ে পড়েছে সুন্দর তনু। ডেভিডও হাসল, কপালের উপর এসে পড়েছে চুল। মরুভূমির আলোয় বিশুদ্ধভাবে ফুটে উঠেছে তার পুরুষালী সৌন্দর্য।

দু’জনকেই এই ছবির একটা করে প্রিন্ট দিয়ে দিল হান্নাহ। পরবর্তীতে এই ছবির চকচকে কাগজটুকু রইল কেবল সেসব দিনের হাসি-আনন্দের সাক্ষী হয়ে। মনে হলো জীবনের গাছ থেকে ছিঁড়ে নেয়া হলো একটা ফুল শুকিয়ে হয়ে পড়ল কদর্য, চলে গেল বর্ণ আর গন্ধ।

কিন্তু এই উজ্জ্বল দিনে তাদের খুশির উপর কোন ছায়া ফেলতে পারল না ভবিষ্যত। জেরুজালেম ফেরার পথে ড্রাইভ করল জো। পথিমধ্যে ট্যাংক কোর’ এর একদল ছেলে বাড়ি ফেরার সময় কিছু না পেয়ে ডেভিডের গাড়ির উদ্দেশে হাত তুলে নাচানাচি শুরু করাতে ডেবরার পীড়াপিড়িতে গাড়ি থামালো জো। যদিও ডেভিড প্রচণ্ড আপত্তি করেছে, দেখা গেল চেপেচুপে ছোট্ট ক্যাবে ঠিকই জায়গা করে নিল তিনজনে। নিজেকে অপরাধী মনে হওয়ায় পেছনের সিটে ডেবরার কাঁধে হাত রেখে বসে রইল ডেবরা। সবাই মিলে গাইতে লাগল এ বছর ইস্রায়েলের তরুণদের কাছে জনপ্রিয় গান ‘লেট দেয়ার বি পিস।

শেষের দিনগুলোতে যখন এয়ারফোর্সে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করছে। ডেভিড, এ সময় সময় কাটানোর জন্য ঘরের ছোটখাটো কাজ করতে লাগল সে। যেমন নিজের ইউনিফর্ম ঠিকঠাক করা। ডেবরার পরামর্শ, যা হলো রেগুলেশন যদি তার বাবার জন্য ঠিক হয় তাহলে ডেভিডের জন্যও তা ঠিক হবে। কিন্তু সবকিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল ডেভিড। অ্যারন কোহেন নিজের টেইলরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ডেভিডকে। ডেভিডের স্টাইল সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ জাগতে শুরু করল অ্যারনের মনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটলেথিক ক্লাবে ডেভিডের সদস্যপদের ব্যবস্থা করে দিল ডেবরা। প্রতিদিন প্রথম শ্রেণীর আধুনিক জিমে যাওয়া শুরু করল ডেভিড। আর শেষ করল নিজের গঠনকে ধরে রাখার জন্য অলিম্পিকের সাইজের চওড়া বিশটি সুইমিং পুলে সাঁতার কাটা।

যাইহোক, অন্য সময় সে ব্যস্ত রইল ছাদের সূর্যস্নান অথবা ইলেকট্রিক প্লাগ বা ঘরের এ জাতীয় অন্যান্য টুকটাক কাজে, যা চাপিয়ে দিতে লাগল ডেবরা।

ঘরের মাঝে ঘুরে বেড়ানোর সময় হয়তো হাতের কাছে পেলো ডেবরার ব্যবহৃত কোন জিনিস–একটা বই বা পিন, তৎক্ষণাৎ সেটা হাতে তুলে নিয়ে আদর করে দেয় ডেভিড। একবার তো এমন হলো যে ডেবরার বোব এলোমেলো ভাবে পড়ে রইল খাটের কিনারে। বিশেষ এই গন্ধ ডেভিডকে এতটাই বিবশ করে ফেলল যে অপেক্ষা করতে লাগল কখন আসবে ডেবরা।

যাইহোক, অন্য কিছু নয়, বইয়ের মাঝে এমন কিছু আবিষ্কার করল ডেবরা সম্পর্কে যা বুঝতে হয়তো লেগে যেত বছরের পর বছর। ফার্নিচার বিহীন দ্বিতীয় বেডরুমের ক্রেট ভর্তি বই রেখে দিয়েছে ডেবরা। কাবার্ড আর শেষ্য পাবার আগে এটা তাদের অস্থায়ী স্টোররুম। এক বিকেলে ক্রেট হাতড়াতে লাগল ডেভিড। মিশ্র সাহিত্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ গিবন আর ভিদাল শেক্সপিয়ার আর মেইলার, সলজোনিৎসিন আর মেরী স্টুয়ার্ট, আরো আছে অন্যান্য অদ্ভুত লেখকরা। আছে গল্প, জীবনী ইতিহাস, কবিতা, হিব্রু, ইংরেজি নরম বাধাই আর চামড়ায় মোড়ানো সংখ্যা। আর আছে পাতলা সবুজ মোড়কে বাধাই ভলিউম যেটা প্রায় ফেলেই দিচ্ছিল সে এমন সময় লেখকের নাম দেখে হাতে তুলে নিল। ডি মোরদেসাই। আবিষ্কারের নেশায় পাতা উল্টালো ডেভিড।

“দিস ইয়ার, ইন জেরুজালেম, কবিতার সংকলন, লেখক ডেবরা মোরদেসাই।

হাতে করে বইটা নিয়ে বেডরুমে এলো ডেভিড। ভুলে গেল লেস কাভারের উপর শোয়ার সময় জুতা খুলে রাখতে–এ ব্যাপারে বেশ কড়া ডেবরা প্রথম পৃষ্ঠা উল্টালো ডেভিড।

পাঁচটা কবিতা। প্রথমটি টাইটেলে থাকা নাম। বাস্তব হয়ে উঠল দুই হাজার বছরের প্রতিজ্ঞা করা নেক্সট ইয়ার ইন জেরুজালেম। নিজের দেশের প্রতি দেশত্ববোধ ফুটে উঠেছে এতে। এমনকি ডেভিড যে কিনা ম্যাকলিন আর রবিনস পড়ে অভ্যস্ত, সেও স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে অত্যন্ত উন্নতমানের লেখা হয়েছে এটি। প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠল চমকে যাবার মতো সৌন্দর্য, শব্দের অসাধারণ ব্যবহার। ভালো বেশ ভালো হয়েছে আর নিজের ভিতর কেমন অদ্ভুত গর্ব বোধ করতে লাগল ডেভিড। ডেবরার হৃদয় আর চেতনার এতটা গভীরতা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না তার।

শেষ কবিতায় এসে দেখল এটা বাকিগুলোর মাঝে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত আর ভালোবাসা নিয়ে লেখা–অথবা এমন কাউকে নিয়ে লেখা যাকে অনেক ভালোবাসা দিয়ে ঘিরে রাখা হলেও চলে গেছে সে। আর হঠাৎ করেই ডেভিড বুঝলে পারল যে ভালো আর জাদুকরী বলতে কী বোঝায়, এদুটোর পার্থক্য কী।

ডেবরার লেখার শব্দমালা পড়ে কেঁপে উঠল ডেভিড। খেয়াল করে দেখল যে এমন অদ্ভুত একটা সৌন্দর্য যে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল আর অবশেষে এই বিষাদে ভেসে গেল সেও। মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে। সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে যেন ডেভিড। এমন দুঃখের মাঝে পড়ে চোখ বেয়ে নামতে লাগল অশ্রুকণা। আর দ্রুত চোখ মুছতে হলো বারবার, কেননা কবিতার শেষটুকু একেবারে হৃদয় বিদীর্ণ করে দিল তার।

বুকের উপর নামিয়ে রাখল বই, মনে পড়ে গেল জো’র কাছে শোনা সৈন্যের কথা, যে মারা গেছে মরু। হঠাৎ করে একটা আওয়াজ পেয়ে উঠে বসে তাড়াতাড়ি চাইল বইটাকে লুকিয়ে ফেলতে। এমন একটা ব্যক্তিগত জিনিস এটা, এই কবিতা, নিজেকে চোর বলে মনে হলো তার।

বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল ডেভিডকে।

বিছানায় উঠে বসে হাতে বই তুলে নিল ডেভিড। এটা বেশ সুন্দর। অবশেষে কোনক্রমে বলে উঠল ডেভিড। কণ্ঠস্বরে কান্নার রেশ।

তুমি পছন্দ করেছে শুনে আমার ভালো লাগছে।’ বলল বটে ডেবরা কিন্তু ডেভিড বুঝলে পারল যে সে লজ্জিত হয়েছে।

‘আমাকে আগে দেখাওনি কেন?

‘ভয় পেয়েছি যে হয়তো তুমি পছন্দ করবে না।’

‘ওকে অনেক ভালোবাসতে, তাই না? নরম স্বরে জানতে চাইল ডেভিড।

হ্যাঁ। তাই করতাম। বলে উঠল ডেবরা। কিন্তু এখন আমি তোমাকে ভালোবাসি।

***

অবশেষে নির্ধারিত হলো ডেভিডের পোস্ট। পরিষ্কার বোঝা গেল যে এর সব ক্ষেত্রেই ব্রিগের হাত রয়েছে। যদি জো স্বীকার করল যে সে তার সব পারিবারিক ক্ষমতা ব্যবহার করে এই আদেশকে প্রভাবিক করেছে।

ডেভিডকে আদেশ দেয়া হলো যেন মিরেজ স্কোয়াড্রন ‘ল্যান্স’তে রিপোর্ট করে। এটি একটি ইন্টারসেক্টর আউটফিট বেস আর অবস্থান একই গোপন এয়াফিল্ডে যেখান থেকে সে প্রথমবার উড়ে গিয়েছিল। একই স্কোয়াড্রনে আছে জো মোরদেসাই। মালিক স্ট্রিটে ডেভিডকে সংবাদটা দিতে এসে নিজের মনোভাব না লুকালেও জো আশা করল যে শীঘ্রই তারা একসঙ্গে উড়তে পারবে রেগুলার দল হিসেবে। সন্ধ্যায় বসে পুরো স্কোয়াড্রনের সবার সম্পর্কে ডেভিডকে জানিয়ে দিল জো। ‘লে ডফিন’ কমান্ডিং অফিসার থেকে শুরু করে সবচেয়ে নিচু পদমর্যাদার মেকানিক পর্যন্ত। সামনের সপ্তাহগুলোতে ডেভিড টের পাবে যে জোর পরামর্শ আর সাহায্য কতটা অমূল্য ওর জন্য।

পরের দিন টেইলর নিয়ে এলো ডেভিডের ইউনিফর্ম। ডেবরাকে সারপ্রাইজ দিতে ইউনিফর্ম পরে নিল ডেভিড। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ঘুরে ঢুকলো ডেবরা। হাত ভর্তি বই আর বাজার সদাই। শরীরের নিচের অংশ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো। পেছনে খোলা চুল, মোটা চশমা মাথার উপরে তুলে রাখা।

সিঙ্কের উপর ঢেলে দিল হাতের বোঝা। এরপর কোমরে হাত রেখে ধুরে ঘুরে চারপাশ থেকে দেখল ডেভিডকে।

‘আমি চাই তুমি এই পোশাক পরে কাল বিকালে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিতে আসবে। প্লিজ। অবশেষে বলে উঠল ডেবরা।

‘কেন?’

‘কেননা কয়েকটা ডাইনী ঘুরে বেড়ায় লটারম্যান বিল্ডিংয়ে। তাদের কেউ কেউ আমার ছাত্রী, কেউ কেউ সহকর্মী। আমি চাই ওরা তোমাকে ভালোভাবে দেখুক আর তাদের ছোট্ট হৃদয়টা খেয়ে ফেলুক।

হেসে ফেলল ডেভিড। তো আমাকে নিয়ে কোন লজ্জা নেই তোমার?

মরগ্যান, একজনের পক্ষে তুমি একটু বেশিই সুন্দর। তোমার উচিৎ ছিল যমজ নিয়ে জন্ম নেয়া।

একসাথে আজই তাদের শেষ দিন। তাই ডেবরার কথামতো ইউনিফর্ম পরে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে তাকে নিতে এলো ডেভিড। আর অবাক হয়ে দেখল যে কেমন করে এই পোশাক রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী সকলের মনোযোগ কেড়ে নিলমেয়েরা তার দিকে তাকিয়ে হাসল, বৃদ্ধরা বলে উঠল শালোম, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে থাকা প্রহরীও হাসি মুখে হাত নেড়ে কৌতুক বলল ডেভিডকে।

তাদের সবার কাছে ডেভিড হলো রক্ষাকারী দেবদূত।

তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে তাকে কিস করল ডেবরা। এরপর হাঁটতে লাগল পাশে পাশে গর্বের সাথে আর অধিকার বলে জড়িয়ে রাখল ডেভিডের কনুই। গোলাকার কাঁচের বেলজিয়াম বিল্ডিংয়ে তাড়াতাড়ি ডিনার করতে নিয়ে গেল ডেভিডকে।

খেতে খেতে একটা মাত্র সাধারণ প্রশ্নে ডেভিড জেনে গেল নিজের খ্যাতি বজায় রাখার জন্য কোন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে ডেবরা।

‘আমি সম্ভবত প্রথম কয়েক সপ্তাহ বেস থেকে বের হতে পারব না। কিন্তু মালিক স্ট্রিটে লিখবো তোমাকে।

‘না। তাড়াতাড়ি বলে উঠল ডেবরা। আমি ওখানে থাকবে না। বিশাল বিছানাটাতে তুমি ছাড়া বেশি একাকী লাগবে।’

তাহলে কোথায়? তোমার বাবা-মায়ের কাছে?

‘এটা হবে আরো খারাপ। যতবার তুমি শহরে আসবে আমাকে বাসা ছাড়তে হবে! না, তারা ভাবছে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে হোস্টেলে আছি। আমি তাদের জানিয়েছি যে আমি ডিপার্টমেন্টের কাছাকাছি থাকতে চাই’

‘এখানে তোমার একটা রুম আছে? ডেবরার দিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড।

‘অবশ্যই ডেভিড। আমাকে একটু আলাদা হতে হবে। আমি আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা চাকুরিদাতাকে তো বলতে পারি না যে আমাকে মেজর ডেভিড মরগ্যানের ঠিকানায় চিঠি লেখো। হতে পারে এটা বিংশ শতাব্দী আর আধুনিক ইস্রায়েল, কিন্তু তারপরেও এখনো আমি একজন ইহুদি, মমতা আর তার ঐতিহ্যে মোড়ানো।’

প্রথম বারের মতো ডেভিড আনন্দিত হয়ে উঠল যে তার কাছে এসেছে ডেবরা। ডেবরার তুলনায় সে নিজে ব্যাপারটাকে বেশ হালকা ভাবে নিয়েছিল।

আমি তোমাকে মিস করব।’ জানিয়ে দিল ডেভিড।

আর আমি তোমাকে’, উত্তর দিল ডেবরা।

‘চলো বাসায় যাই।

‘হ্যাঁ, একমত হলো ডেবরা। ছুরি কাঁটাচামচ রেখে দিল একপাশে। আমি যেকোন সময় খেতে পারব।’

যাইহোক বেলজিয়াম হাউজ থেকে বের হবার সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল ডেবরা- ‘ধুত্তোরি, আমাকে এই বইগুলো আজকেই ফেরৎ দিতে হবে। আমরা লাইব্রেরি হয়ে যাই? আমি দুঃখিত ডেভি। এক মিনিটের বেশি লাগবে না।’

তো, তারা আবারো উঠে এলো প্রধান ছাদে। পার হয়ে গেল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন রেস্টুরেন্টের আলো। দু’জন একসাথে এগিয়ে চলল চৌকোনা লাইব্রেরি টাওয়ারের দিকে। দ্রুত নেমে আসা অন্ধকারের জন্য ইতিমধ্যে আলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে লাইব্রেরির জানালাগুলোতে। লাইব্রেরির সিঁড়ি দিয়ে উঠে কাঁচের দরজার কাছে থেমে যেতে হলো তাদেরকে। একদল ছেলেমেয়ে বের হয়ে আসল ভেতর থেকে। একপাশে সরে তাদেরকে জায়গা দিল। ডেভিড ও ডেবরা।

যে পথ দিয়ে তারা এসেছে সেদিকে তাকিয়েছিল দু’জনে। প্লাজা, ছাদ, লাল-কলির গাছগুলো দেখা যাচ্ছে রেস্টুরেন্টের দিকে।

হঠাৎ করে সন্ধ্যার অন্ধকার চিরে দিল প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের সাদা আলো রেস্টুরেন্টের কাঁচের জানালা ভেঙ্গে কাঁচ উড়তে লাগল বৃষ্টির মতো। মনে হলো যেন পাথর চূড়ায় ঝড় শুরু হয়েছে। ফোয়ারার মতো চারপাশে ছুটছে ভয়ঙ্কর কাঁচের কণা। সেই মুহূর্তে জানালার নিচে দিয়ে চলা দুটা মেয়েকে ভয়ঙ্কর ভাবে আঘাত করল এই ফোয়ারা।

বিস্ফোরণের আলোর সাথে সাথে সারা ছাদ লণ্ডভন্ড হয়ে গেল। বিস্ফোরণের ধাক্কা লাল-কলির গাছে হয়ে ডেভিড আর ডেবরার দিকেও ধেয়ে এলো। লাইব্রেরি বারান্দার পিলারের সাথে ধাক্কা খেলো দু’জনে। বাতাসের ধাক্কায় মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাবে ফুসফুস থেকে সব বাতাস গেল বের হয়ে।

নিজের কাছে ডেবরাকে টেনে নিল ডেভিড। বিস্ফোরণের পরেও ধরে রাখল। চারপাশ হঠাৎ করে মনে হলো ঢেকে গেল নৈশব্দের অন্ধকারে। খানিকটা ধাতস্থ হয়েই তাকিয়ে দেখল যে রেস্টুরেন্টের ভাঙা জানালা দিয়ে বের হচ্ছে ফসফরাসের সাদা ধোয়ার মেঘ; গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে চললো ছাদের দিকে।

এরপরই বিভিন্ন শব্দ শুনতে পেল দু’জনে। কাঁচ ভাঙার মচমচ শব্দ, প্লাস্টার আর ফার্নিচার ভাঙার শব্দ। চিৎকার ভেসে এলো নারীকণ্ঠ থেকে আর এতেই ভঙ্গ হলো আতঙ্কের নীরবতা।

চারপাশ জুড়ে শোনা গেল চিৎকার আর দৌড়াদৌড়ির শব্দ। ডেভিড আর ডেবরার পাশ দিয়ে দৌড়ে যাবার সময় একটা ছাত্র হিস্টিরিয়ার মতো চেঁচাতে লাগল, ‘বোমা! ক্যাফেতে বোমা মেরেছে ওরা।

ভাঙা কাঁচের টুকরার বৃষ্টির কবলে পড়া একটা মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ছোটাছুটি শুরু করে দিল আর নাকি সুরে কান্নাও করছে। মনে হলো বোধবুদ্ধি সব হারিয়ে গেছে মেয়েটার। প্লাস্টারের ধুলাতে পুরো সাদা হয়ে যাওয়া মেয়েটার স্কার্ট বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গাঢ় রঙের রক্ত।

ডেভিডের হাতের মাঝে কাঁপতে শুরু করল ডেবরা। শুয়োরের দল ফিসফিস করে উঠল সে। ওহ শুয়োরের দল খুনের নেশায় মেতেছে।’

ধোয়ার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো আরো মানব শরীর। বিস্ফোরণের জন্য শরীরের কাপড় ছিঁড়ে গেছে। ছেঁড়া কাপড় এমনভাবে ঝুলে আছে যে দেখতে হাস্যকর কাকতাড়ুয়ার মতো মনে হচ্ছে। ছাদে উঠে আস্তে করে বসে পড়ল। চোখের উপর থেকে সরিয়ে নিল চশমা। কাকতালীয়ভাবে চশমা ঠিকঠাক জায়গা মতো রয়ে গেছে এখনো। চেষ্টা করল শার্টের টুকরা দিয়ে কাঁচ দুটো পরিষ্কার করে নিতে। চিবুক থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।

‘চলো।’ তাড়া দিল ডেভিড।

‘আমাদের সাহায্য করা দরকার। দুজনে মিলে একসাথে নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে।

ছাদের একটা অংশ প্রায় ধসে পড়েছে বিস্ফোরণে আটকে ফেলে ছারখার করে দিয়েছে তেইশ জন ছাত্র-ছাত্রীকে, যারা সান্ধ্য খাবার আর আড্ডার আশায় এসেছিল এখানে।

সবাই ছুটে গেল বড় নিচু হলটাতে। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল মেঝে। তাদের কেউ হামাগুড়ি দিচ্ছে, কেউ কাঁদছে। ভাঙা প্লেট-বাটি, ছড়িয়ে থাকা খাবার, এলোমেলো ফার্নিচারের মাঝে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছে কেউ কেউ। কেউ কেউ এমন বিকৃত হয়ে পড়ে আছে যেন মৃত্যুর নিষ্ঠুর কৌতুকে নিঃশব্দে হাসছে।

পরবর্তীতে সবাই জানতে পারে যে আল ফাতাহ’র দু’জন তরুণী নারী সদস্য ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে ভর্তি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর প্রতিদিন একটু একটু করে বিস্ফোরক এনে জড়ো করেছে ক্যাম্পাসে। অবশেষে এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সবটুকু বিস্ফোরক জড়ো করে। একটা টেবিলের নিচে পড়ে আছে। টাইমিং ডিভাইস বাধা স্যুটকেস আর সন্ত্রাসী দু’জন হেঁটে হাওয়া হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ পরে দামাস্কাস টেলিভিশনে নিজেদের সফলতায় গর্ব করতেও দেখা গেল তাদেরকে।

কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে এই বিস্ফোরণের কারণ বা কোন ব্যাখা জানা নেই কারোরই। এতটাই অপ্রত্যাশিত আর এতটাই করুণ যে অবাক হয়ে গেল সকলে। দিশেহারা হয়েও যারা সুস্থ আছে স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে চেষ্টা করল আহতদের সেবা করতে, মৃতদেহ সরিয়ে নিতে।

লাল-কলির গাছের নিচের লনে সবাইকে শুইয়ে দেয়া হলো। তাড়াতাড়ি কাছের হোস্টেলের চাদর এনে ঢেকে দেয়া হলো সবাইকে। সবুজ ঘাসের উপর সাদা কাপড়ের লম্বা সারি এমন এক স্মৃতি হয়ে রইল ডেভিডের মাঝে যা মনে হয় না কখনো ভুলবে।

সাইরেন বাজিয়ে ছাদের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে এসে গেল অ্যাম্বুলেন্স। বিস্ফোরণস্থল কর্ডন করে দিল পুলিশ। ডেভিড আর ডেবরা আস্তে আস্তে হেঁটে এগিয়ে গেল পার্কিং লটে থাকা মার্সিডিজের দিকে। দু’জনেরই গায়ে মাখামাখি হয়ে আছে রক্ত আর ধুলা; বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে যন্ত্রণাকাতর শব্দ শুনে আর মৃত্যুদৃশ্য দেখে। চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেল মালিক স্ট্রিটে। গোসল করে ধুয়ে ফেলল ময়লা আর মৃত্যুর গন্ধ। রক্ত ধোয়ার জন্য ঠাণ্ডা পানিতে ডেভিডের ইউনিফর্ম ভিজিয়ে দিল ডেবরা। এরপর কফি বানিয়ে আনল। বিশাল বিছানায় পাশপাশি বসে কফি পান করল দুজনে।

‘ভালো আর শক্তিশালী ছিল এমন অনেক কিছু মারা গেছে এখানে, আজ রাতে।’ বলে উঠল ডেবরা।

‘মৃত্যু ততটা খারাপ নয়। এটি একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার আর সবকিছুর যৌক্তিক উপসংহার। কিন্তু আমাকে ভাবাচ্ছে ভাঙাচোরা দেহ নিয়ে যারা বেঁচে গেল তারা। মৃত্যুর প্রতি তা ও শ্রদ্ধা হয় কিন্তু পঙ্গুত বড় কষ্ট।

চোখে ভয় নিয়ে তাকাল ডেবরা, ‘এটা বেশ নিষ্ঠুর ডেভিড।

‘আফ্রিকাতে একই সাথে সুন্দর আর ভয়ঙ্কর একটা প্রাণী আছে নাম কৃষ্ণবর্ণ অ্যান্টিলোপ। দলবদ্ধ হয়ে প্রায় একশ একসাথে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু তাদের কেউ যদি আক্রান্ত হয় কোন শিকারির হাতে বা সিংহের হাতে, দলপ্রধান সে সদ্যসকে দল থেকে বের করে দেয়। আমার মনে আছে আমার বাবা আমাকে বলেছিল যে, যদি তুমি বিজয়ী হতে চাও তাহলে তোমার পরাজিত সঙ্গীদের এড়িয়ে যেতে হবে। কেননা হতাশা সংক্রামক।

‘ঈশ্বর, ডেভিড, এটা তো জীবনকে দেখার বেশ শক্ত একটা পথ।’

সম্ভবত’, একমত হলো ডেভিড। কিন্তু দেখো জীবন সত্যিই কষ্টের।’

প্রথমবারের মতো তাদের ভালোবাসায় যোগ হলো নিরাশা। কেননা বিচ্ছেদের ঘণ্টা বাজছে। সারা জীবন এটি তাড়িয়ে বেড়াবে তাদের।

সকালবেলা নিজের স্কোয়াড্রনে যোগ দিতে গেল ডেভিড। মালিক স্ট্রিটের ঘরে তালা লাগাল ডেবরা।

.

সতেরোদিন ধরে প্রতিদিন দু’বার ওড়াউড়ি করল ডেভিড। আবার কখনো তিনবার। সন্ধ্যাবেলা যদি রাতের জন্য কোন ফ্লাইং না থাকতো, তাহলে লেকচার শোনা আর ট্রেনিং ফিলস দেখতে হতো। আর এরপর তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুম।

কর্নেল লে, ডফিন, একদিন একসাথে প্লেন চালালো ডেভিডের সঙ্গে। দ্রুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর শান্ত স্বভাবের মানুষটা ছোটখাটো। দ্রুত নিজের সিন্ধান্ত নিয়ে নিল কর্নেল।

প্রথম দিনের পরে জো আর ডেভিড একসাথে প্লেন চালালো। ডেভিড জোর লকার থেকে নিজের জিনিস আন্ডারগ্রাউন্ড কোয়ার্টারের স্ট্যান্ডবাই ক্রুদের লকারে নিয়ে গেল।

এই সতেরো দিনের শেষদিনগুলোতে লৌহকঠিন বন্ধুত্ব নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে গেল। ডেভিডের উজ্জ্বলতা আর আঘাতের প্রচণ্ডতা দক্ষভাবে ভারসাম্য তৈরি করলো জো’র পাথরের মতো কঠিন নির্ভরতার সাথে।

ডেভিড সবসময় একটা স্টার হিসেবেই থাকে; অন্যদিকে জোর জন্মই হয়েছে সংগত প্রদানের জন্য। সোজা সাপ্টা মানুষ, যার উপর চোখ বন্ধ করে নির্ভর করা যায়। এমন একজন উইংম্যান যার নিজের কোন উচ্চাকাংখা নেই। যার প্রতিভা হলো আঘাত করার জন্য নাম্বার ওয়ানকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়া।

দ্রুত অলঙ্ঘনীয় একটা দল গড়ে তুলল দুজনে মিলে। এতটাই সুদক্ষ হলো যে বাতাসের মাঝে যোগাযোগের ক্ষেত্র প্রায় একস্ট্রা সেনসরী। যেন পাখির দুটি পালক বা মাছের আঁশ।

পেছনে জো বসে থাকা ডেভিডের জন্য মিলিয়ন ডলারস ইনস্যুরেন্সের মতো। ডেভিড জানে যতক্ষণ জো আছে ওর পেছনে কোন ভয় নেই। তাই সে মনোযোগ দেয় তার বিশেষ ক্ষমতাধর দৃষ্টিশক্তি আর তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতার উপর। ডেভিড একজন গান ফাইটার। আর এই সার্ভিসে গান ফাইটারদেরই জয় জয়কার।

আই.এ.এফ. সর্বপ্রথম এয়ার-টু এয়ার মিসাইলের খামতি নিয়ে আলোচনা। শুরু করে। আর তাই ফিরে যায় ক্লাসিক টাইপের আকাশযুদ্ধে। কখনো কখনো মিসাইল নির্বোধের মতো আচরণ করতে পারে। এমনও হতে পারে কম্পিউটার এক ধরনের প্যাটার্ন সেট করল আর বাস্তবে ঘটল উল্টো। এয়ার টু- এয়ার কমব্যাটে তিনশ মিসাইল নিক্ষেপ করা হলে মাত্র একটা হয়তো টার্গেটে লাগবে।

যাই হোক, যদি এমন হয় যে ঘড়ির ষষ্ঠ কাঁটার মতো অবস্থানে গান ফাইটার এগিয়ে আসছে তোমার দিকে, যার আঙুল জোড়া ৩৩-এমএম কামানের ট্রিগারের উপর, মাত্র এক মিনিটে যে কিনা বারো হাজার শেল ঢেলে দিতে পারবে তোমার উপর, তাহলে তোমার সুযোগ আরো হালকা হয়ে যাবে তিনশ থেকে একের তুলনায়।

এছাড়াও জোর আরো একটা বিশেষ গুণ আছে। মিরেজের সামনের দিকের স্ক্যানিং রাডার বেশ জটিল আর নাজুক ধাচের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস দিয়ে তৈরি। পুরো মেকানিজম চালাতে হয় বাম হাত দিয়ে। আর বাম হাতের আঙুলগুলো এত দ্রুত জায়গা বদল করে যেন পিয়ানো বাজাচ্ছে কোন পিয়ানিস্ট। কিন্তু এর চেয়েও জরুরি হচ্ছে এ যন্ত্রকে ‘অনুভব করা। এর কাছ থেকে সর্বোচ্চ কাজ আদায়ের জন্য ভালোবাসার স্পর্শ। এই অনুভব আছে। জোর কাছে। ডেভিডের নেই।

দিনে-রাতে ট্রেনিং ইন্টারস্পেশন চালানো শুরু করলো তারা। এতে থাকল অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যাবার পাশাপাশি নিচু লেভেলের টার্গেট প্র্যাকটিস করা। এ ছাড়াও নিচু লেভেলের ট্রেনিং স্ট্রাইকও চালালো তারা। অন্যান্য সময় ভূমধ্যসাগরের উপর একে অন্যকে এনগেজ করে প্লেন টু প্লেন ডগ ফাইটও প্র্যাকটিস হলো।

এত সব কিছুর পরেও মরুর ফুল কৌশলে তাদেরকে সত্যিকার বা সম্ভাবনাময় যুদ্ধাবস্থা থেকে সরিয়ে রাখল। সবাই মিলে খেয়াল করছিল ডেভিডকে।

পিরিয়ডের শেষে মেজর জেনারেল মোরদেসাইয়ের ডেস্কে পাঠানো হলো ডেভিডের সার্ভিস রিপোর্ট। প্রতিজন অফিসার সম্পর্কে দেখভাল করা ব্রিগের বিশেষ দায়িত্ব। আর যেহেতু প্রতিটি অফিসারের রিপোর্ট নিয়মিত চেক করতে হয় ব্রিগকে। এবার বিশেষ ভাবে তাকে বলা হলো ডেভিডের রিপোর্ট চেক করে দেখতে।

রিপোর্টের স্বাস্থ্য এখনো বেশ পাতলা। দ্রুত প্রাথমিক ভাবে দেয়া সুপারিশ আর ডেভিডের বর্তমান কমিশনের ডকুমেন্ট দেখে নিল ব্রিগ। এরপর পড়ে ফেলল পরবর্তী রিপোর্ট আর রেজাল্ট। গানারি রিপোর্ট দেখে হেসে ফেলল। তৃপ্তি নিয়ে ভাবল যে তাদেরকে ভিড়ের মাঝে থেকে তুলে আনতে এখনো দক্ষ সে। অবশেষে পড়ল লে, ডফিনের ব্যক্তিগত প্রশংসাবাক্য: ‘পাইলট হিসেবে মরগ্যানের দক্ষতা অসাধারণ। সুপারিশ জানানো যাচ্ছে যে বর্তমান ব্যাঙ্কে বহাল থাকুক আর সামনে তাকে পুরোপুরি অপারেশন কাজে লাগানো হোক।

নিজের বিশেষ লাল কলম তুলে নিল ব্রিগ। রিপোর্টের নিচে লিখে ফেলল। আমিও এতে একমত আছি।’

এভাবেই শুরু পাইলট মরগ্যানের যাত্রা। এখন তাকে পুরুষ, মরগ্যান হিসেবেও বিবেচনা করা হবে। নিজের অভিব্যক্তি অনাবৃত হয়ে গেল ওর কাছে। আর তাই কাকতালীয়ভাবে হঠাৎ করে ডেবরার ঘর ছাড়ার ইচ্ছে আর ডেভিডের জেরুজালেমে পৌঁছানো, সব ঘটে গেল এক সঙ্গে।

পুরো দুই দিন আর কয়েকটা ফোন কলের পরে ডেভিড জানতে পারল যে ডেবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলকে কেবলমাত্র ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করতো। বাস্তবে তার সত্যিকারের বাসায় সবকিছু ছিল দুর্দান্ত।

প্রথম দিকটায় অনুমতি দেয়নি ব্রিগ। তারপরেও সে জানে যে এক্ষেত্রে বলার কিছু নেই তার। ব্রিগ ভালো করেই জানে যে তার মেয়ের ইচ্ছাশক্তি আর পছন্দ অপছন্দ কতটা কঠিন। তাদের মাঝে মতবিরোধ প্রায় বৈপ্লবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝে এমনকি পরিবারের ভিত নাড়িয়ে দেয়া এসব বাদানুবাদ অবশ্য সন্তুষ্টিজনক ফলাফলই বয়ে এনেছে।

যদিও নিজের বেশির ভাগ সময় তরুণদের সাথেই ব্যয় করে, তারপরেও নতুন মূল্যবোধগুলো মাঝে মঝে মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। স্বীকার করে নিতে তো আরো কষ্ট হয়।

‘ওয়েল, মেয়েটার অন্তত এতটুকু জ্ঞান আছে যেন কোন বিদ্রূপ বা হাসাহাসি না হয়। তাদেরকে যেন লজ্জায় না পড়তে হয়। এতটুকু সন্তুষ্টি দিয়েছে মাকে। রিপোর্ট বন্ধ করে দিল ব্রিগ।

৩. নতুন পদমর্যাদা

নিজের অফিসে ডেভিডকে ডেকে পাঠিয়ে তার নতুন পদমর্যাদা জানিয়ে দিল লে ডফিন। এখন থেকে নিয়মিত সবুজ’ স্ট্যান্ডবাই হিসেবে কাজ করবে ডেভিড। যার অর্থ প্রতি সপ্তাহে চারদিন কাটাতে হবে বেসে।

এবার, প্যারাট্রুপার ট্রেনিং নিতে হবে ডেভিডকে। অস্ত্রবিহীন যুদ্ধের শিক্ষা পাবে এতে। এই ধরনের যুদ্ধ শিক্ষা পেলে আরবীয় ভূমিতে আটকা পড়া যে কোন পাইলটের বেঁচে যাবার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।

লে ডফিনের অফিস থেকে বের হয়ে সোজা কু-রুমে টেলিফোনের কাছে গেল ডেভিড। লাঞ্চের জন্যে লটারম্যান বিল্ডিং ত্যাগ করার আগেই ধরে ফেলল ডেবরাকে।

‘আমার বিছানা গরম করো বালিকা’, বলে উঠল ডেভিড। আগামীকাল রাতেই বাসায় পৌঁছে যাচ্ছি আমি।’

মার্সিডিজ চালিয়ে জেরুজালেমে পৌঁছালো জো আর ডেভিড। নিচু কণ্ঠে কথা বলে চলল জো। যদিও কিছুই শুনতে পেল না ডেভিড। তাই শেষমেশ পাঁজরে বুড়ো আঙুলের শুতে দিল জো

‘দুঃখিত জো। আমি কী যেন ভাবছিলাম। তোমার কথা শুনতে পাইনি।

“ঠিক আছে, এবার তাহলে থামাও চিন্তা। তোমার ভাবনা গিয়ে জানালায় কুয়াশা বানাচ্ছে।

কী বলছিলে তুমি?

‘আমি বিয়ের কথা বলছিলাম– হান্নাহ আর আমার।

ডেভিডের মনে পড়ে গেল যে বিয়ের আর মাত্র মাসখানেক বাকি। বুঝতে পারল এটা নিয়ে মেয়েরা কতটা উত্তেজিত হয়ে আছে। যেমন সবাই গ্রীষ্মের পরে বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে। ডেবরার চিঠিগুলোতেও শুধু বিয়ের প্রস্তুতির কথাই লেখা থাকতো।

‘আমি খুব খুশি হবো, যদি তুমি আমার সাথে এসে দাঁড়াও আর আমার সাক্ষী হও। খানিকটা পরিবর্তন আসবে। এবার তুমি হবে উইংম্যান আর আমি টার্গেটে লাগাবো।’

ডেভিড বুঝতে পারল যে এই অনুরোধের মাধ্যমে ওকে কতটা সম্মান জানানো হয়েছে। তাই যথাযথ মর্যাদার সাথে অনুরোধ গ্রহণ করল সেও। মনে মনে অবশ্য বেশ খুশিও হলো। অন্যান্য যতো তরুণ ইস্রায়েলিয়দের সাথে সে কথা বলেছে তাদের মতোই জো আর ডেবরাও নিজেদেরকে ততটা ধর্মপ্রাণ মনে করে না। ডেভিড এখন জানে যে এটা একটা স্টাইল। নচেৎ তারা সবাই তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন। ইতিহাস আর জুদাইজম চর্চাতেও সিদ্ধহস্ত।

তাদের কাছে ধর্মপ্রাণ মানে কালো রোব গায়ে চাপিয়ে, লম্বা কানাওয়ালা টুপি পরিহিত অর্থডক্সের পরাকাষ্ঠা মিয়া শিয়ারিম হওয়া অথবা প্রতিদিনের জীবনে এমন আইন মেনে চলা যা কেবল পদে পদে বাধা দেবে তাদেরকে।

কিন্তু বিয়ে হবে ঐতিহ্য অনুযায়ী। প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠান মেনে তবেই। একটা মাত্রই জটিল যে ব্যাপার তা হলো কড়া নিরাপত্তা বলয়ের ব্যবস্থা করা।

ব্রিগের বাগানে হবে বিয়ের মূল অনুষ্ঠান। কেননা হান্নাহ পিতা-মাতাহীন সন্তান। এছাড়াও দুর্গের মতো দেয়াল আর বিচ্ছিন্ন বাগানটাকে নিরাপত্তা দেয়া সহজতর হবে।

অতিথিতের মাঝে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারাও উপস্থিত থাকবে।

সবশেষ হিসেবে দেখা গেছে অতিথির তালিকায় আছে পাঁচজন জেনারেল আর আঠারোজন কর্নেল। জানাল জো, এদের মাঝে ক্যাবিনেট মন্ত্রীরাও থাকবে। এমনকি গোল্ডা নিজেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে উপস্থিত হতে চেষ্টা করবে। তাই বুঝতেই পারছো ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরে আমাদের বন্ধুদের জন্য এর চেয়ে সহজ টার্গেট আর হতেই পারে না।’ হেসে ফেলে দুটো সিগারেট জ্বালিয়ে নিল জো। ডেভিডের দিকে বাড়িয়ে দিল একটা। যদি হান্নাহ’র জন্যে না হতো, তুমি তো জানই বিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে মেয়েরা কতটা উৎসুক থাকে, তাহলে আমি শুধু রেজিস্ট্রি অফিসে চলে যেতাম।

‘বোকা বানাবার চেষ্টা করো না।’ হেসে ফেলল ডেভিড, “তুমি নিজেও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।’

‘হ্যাঁ, তাই।’ হেসে ফেলল জো। নিজেদের জায়গা পাবার মজাই অন্যরকম। যেমনটা তৈরি করেছো তুমি আর ডেবস্। আমার মনে হয় হান্নাহ। যথেষ্ট লক্ষ্মী আচরণ করেছে। প্রায় এক বছরের ভনিতার পর, থ্যাংকস্ গড়, শেষ হচ্ছে অপেক্ষা।

ইন কারেমে ব্রিগের বাসার বাইরের লেনে জোকে নামিয়ে দিল ব্রিগ।

‘আমি তোমাকে ভেতরে আসার কথা বলে বিরক্ত করব না। আমার মনে হয় তোমার অনেক পরিকল্পনা আছে।’ বলে উঠল জো।

‘ঠিক-টাই ভেবেছো।’ হেসে ফেলল ডেভিড। তোমাকে আর হান্নাহকে পাওয়া যাবে? আগামীকাল রাতে ডিনারে এসো।

আবারো মাথা নাড়াল জো। আমি হান্নাহকে অ্যাশকেশন নিয়ে যাবো ওর বাবা-মায়ের কবর পরিদর্শন করে আসতে। বিয়ে করার আগে এ ঐতিহ্য মানতে হয়। হতে পারে শনিবারে দেখা করব তোমাদের সঙ্গে।

‘ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব। ডেবরা নিশ্চয়ই তোমাকে দেখতে চাইবে। শালাম, জো।

শালাম’, শালাম। বিদায় জানিয়ে চলে এলো ডেভিড। রেসিং কারের গতিতে মার্সিডিজ নিয়ে ছুটলো পাহাড় অভিমুখে। হঠাৎ করেই কিসের তাড়া অনুভব করছে যেন নিজের মাঝে।

ছাদের দরজা স্বাগত জানানোর জন্য হাট করে খোলা। ডেবরা অপেক্ষা করছে ডেভিডের জন্য। আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে নতুন কেনা চামড়ার চেয়ারে পা ভাঁজ করে বসে আছে। মাত্রই চুল ধুয়ে এসেছে তাই চমৎকার চকচকে পাখার মতো ঝিকঝিক করছে কেশরাজি। হালকা সিল্কের ফোলা কাফতান পরে চোখের তারায় সোনালি মধু নিয়ে বসে আছে। সিল্কের ঝড় তুলে খালি পায়ে দৌড়ে গেল ডেভিডের কাছে। ডেভিড! ডেভিড! চিৎকার করে উঠল ডেবরা। কোলে তুলে এক পাক ঘুরে হাসতে লাগল ডেভিড।

এরপর গর্বিত ভঙ্গিতে রুমগুলো ডেভিডকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল ডেবরা। তার অনুপস্থিতিতে অনেক কিছুই পরিবর্তন আর সংযোজন হয়েছে দেখতে পেল ডেভিড আর এখন সত্যিকারের ঘরের আবহও অনুভব করল। ডেভিড ডেবরাকে বুঝিয়েছে যে দামটা মোটেও কোন মুখ্য ব্যাপার নয়। একসাথে তাই ফার্নিচারের নকশা পছন্দ করেছে তারা। এ সমস্তই নির্মাণ করে ডেলিভারি দিয়ে গেছে ডেবরার বংশব্দ আরবীয় ব্যবসায়ী আর তাদের পরিকল্পনানুযায়ী দাঁড়িয়েছে ডেবরা। সমস্ত কিছুই বানানো হয়েছে নরম চামড়া আর কালো কাঠ দিয়ে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উজ্জ্বল তামা আর পিতল। রাগের চারপাশে বসানো হয়েছে এসব ফার্নিচার। যাইহোক, একটামাত্র জিনিস চোখে পড়ল যা আগে দেখেনি ডেভিড। বড়সড় ক্যানভাসে অয়েল পেইন্টিং। ছাদের দিকে মুখ করে থাকা সদ্য রং করা সাদা দেয়ালে ফ্রেমবিহীন পেইন্টিংটা ঝুলিয়ে রেখেছে ডেবরা। দেয়ালে এই একটামাত্র পেইন্টিং এর চারপাশে অন্য কিছু খুবই বেমানান লাগতো। ছবিটাতে ফুটে উঠেছে কর্কশ একটা দৃশ্য। মরুভূমি, যাতে ফুটে উঠেছে বন্যতা। রঙগুলো বেশ তীব্র আর রুম জুড়ে মনে হলো মরুভূমির সূর্যই আলো ছড়াচ্ছে।

ডেভিডের হাত ধরে রেখে উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে রইল ডেবরা। দেখতে চায় ডেভিডের প্রতিক্রিয়া।

“ওয়াও! অবশেষে বলে উঠল ডেভিড।

“তোমার পছন্দ হয়েছে? ভারমুক্ত হলো ডেবরা।

‘অসম্ভব। কোথায় পেয়েছো?

‘আর্টিস্ট উপহার দিয়েছে। আমার অনেক দিনের বন্ধু।

‘মেয়ে?

‘হ্যাঁ। আগামীকাল আমরা তিবেরিয়াস যাবো ওর সাথে লাঞ্চ করতে। আমি ওকে তোমার কথা বলেছি। তোমাকে দেখতে চেয়েছে।

কী পছন্দ করে সে?”

সে আমাদের প্রথম সারির আর্টিস্টদের একজন। নাম ইলা কাঁদেশ। কিন্তু এছাড়া আর কিছু বলতে পারব না। একটাই প্রমিজ করতে পারি যে অসম্ভব মজার একটা দিন পাবে তুমি।’

ভেড়ার মাংস আর জলপাইয়ের বিশেষ খাবার বানিয়েছে ডেবরা। জলপাই গাছের নিচে ছাদে বসে খাবার খেলো দু’জনে। কথাবার্তা আবারো শুরু হলো জোর বিয়ে নিয়ে। এর মাঝেই হঠাৎ করে ডেভিড জিজ্ঞেস করে বসল, আমার কাছে আসার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিয়েছো তুমি বিয়ে ছাড়া?

একটুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিল ডেবরা, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এও জানি যে, অপেক্ষার খেলা খেলার ব্যাপারে তোমার তেমন ধৈর্য নেই। আমি জানতাম যে যদি আমি এমনটা না করতাম তাহলে তোমাকে আবারো হারাতাম।

‘কিছুদিন আগপর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি যে এটা কত বড় একটা সিদ্ধান্ত। চুপচাপ ভাবতে লাগল ডেভিড। কোন কথা না বলে ওয়াইনে চুমুক দিল ডেবরা।

‘চলো বিয়ে করে ফেলি ডেবস। নীরবতা ভাঙলো ডেভিড।

হ্যাঁ। মাথা নাড়াল ডেবরা। বেশ ভালো আইডিয়া।

‘খুব তাড়াতাড়ি।’ তাড়া দিল ডেভিড। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।’

হান্নাহর আগে নয়। আমি ওর কাছ থেকে ওর দিনটা কেড়ে নিতে চাই না।’

‘ঠিক আছে।’ একমত হলো ডেভিড। কিন্তু ঠিক তার পরপরই। যোগ করল সে।

মরগ্যান, তুমি নিজেই একটা তারিখ ঠিক করে নাও।’ জানিয়ে দিল ডেবরা।

পুরো তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে তবেই পৌঁছানো যাবে তিবেরিয়াসে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ল তারা। পিতলের কাজ করা বিছানার উপর এসে পড়ল সূর্যের প্রথম আলো। ডোরাকাটা দাগ পড়ল দেয়ালে। সময় বাঁচাতে গোসলও সেরে ফেলল একসাথে মুখোমুখি বসে।

ইলার মতো এমন খারাপ কারো সাথে আগে দেখা হয়নি তোমার। ডেভিডকে সাবধান করে দিল ডেবরা। সকালবেলা গোলাপি রিবন দিয়ে মাথার উপর চুড়ো করে চুল বেঁধে রাখায় ডেবরাকে দেখাচ্ছে ছোট্ট বাচ্চা মেয়ের মতো। যত তুমি তাকে পছন্দ করতে চাইবে সে ততই খারাপ ব্যবহার করবে। তাই ধৈর্য হারিয়ো না তুমি।’ বলে চলল ডোবরা।

এক আঙুলে সাবানের ফেনা নিয়ে ডেবরার নাকের মাথায় বসিয়ে দিল ডেভিড। জানাল, আই প্রমিজ।

জেরিকো পর্যন্ত গিয়ে উত্তরে জর্দান উপত্যকা ধরে এগিয়ে চলল তারা। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়াও চলল পাশাপাশি। মাইন ফিল্ডের গায়ে ঝুলছে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি আর পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে নিয়মিত টহলদার মোটরগাড়ি।

উপত্যকার উপরে আবহাওয়া বেশ গরম। তাই জানালা খোলাই থাকল গাড়ির। লম্বা বাদামী পায়ে বাতাস লাগার জন্য স্কার্ট কোমর পর্যন্ত তুলে নিল ডেবরা।

যদি তুমি সঠিক সময়ে লাঞ্চে পৌঁছাতে চাও, তাহলে এমনটা না করলেই ভালো।’ সতর্ক করে দিল ডেভিড। তাড়াতাড়ি স্কার্ট নামিয়ে নিল ডেবরা।

তুমি আশেপাশে থাকলে কিছুই নিরাপদ না। অভিযোগ করল ডেবরা।

অবশেষে শুষ্ক-শূন্যস্থান পার হয়ে গালিলির নিচে কিবুতজিমের উর্বর ভূমিতে পৌঁছালো তারা। আবারো বাতাসে ভেসে এলো কমলার তীব্র সুগন্ধ, এতটাই বেশি যে মনে হলো নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।

এরও পরে দেখা মিললো তাল আর খেজুর গাছের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া লেকের জল। ডেভিডের হাত স্পর্শ করল ডেবরা।

‘আস্তে চালাও, ডেভি। তিববরিয়াসের এই আর কয়েক মাইল গেলেই ইলার বাসা। সামনে বাক নাও।

এই রাস্তাটা চলে গেছে লেকের তীরে। শেষ হয়েছে প্রাচীন পাথরের ব্লকের কাছে গিয়ে। ইতিমধ্যে আরো পাঁচড়ি গাড়ি পার্ক করে আছে পার্কিং লটে।

‘লাঞ্চ পার্টি দিয়েছে ইলা। দেয়ালের মাঝে গেইটের কাছে ডেভিকে নিয়ে গেল ডেবরা। ওপাশে ছোট্ট একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গ। হেলেপড়া দেয়ালগুলো কেমন অদ্ভুত লাগছে দেখতে। পাথরগুলোও বয়সের ভারে কালো রং ধারণ করেছে, তাদের গায়ে জন্মে আছে উজ্জ্বল রঙের বোগেনভেলিয়া আর লম্বা তাল গাছের ডগাগুলো। লেক থেকে আসা বাতাসের কল্যাণে কাঁপছে একটু একটু করে। সবুজ লনে ফুটে আছে আরো সুন্দর সব উদ্ভিদ।

ভেঙ্গেপড়া বাড়িটার একটা অংশকে ঠিকঠাক করে ছবির মতো সুন্দর লেক সাইড হোম বানানো হয়েছে। চওড়া বারান্দা আর পাথরের জেটি দেখা যাচ্ছে সেখানে, আবার একটা মোটর বোটও আছে নোঙর করা। লেকের সবুজ পানির ওপারে উঠে গেছে গাঢ় রঙের গোলান হাইটস্।

‘এটা ক্রুসেডার দুর্গ ছিল। ব্যাখ্যা করে বলল ডেবরা। লেকের ওপারে চলাচলের সময় ট্রাফিক পোস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আর ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছিল হর্নস অব হিতেমের দিকে, যেটি মুসলিমরা পবিত্র ভূমি থেকে ক্রসেডারদেরকে তাড়িয়ে দেয়ার সময় ধ্বংস করে দেয়। অ্যালেনবি প্রশাসনের সময় কিনে নিয়েছিল ইলার দাদা। কিন্তু তারপর ধ্বংস হয়ে যায় আর স্বাধীনতার পর আবারো ঠিকঠাক করে নেয় ইলা।

পুরো জায়গাটার রোমান্টিক সৌন্দর্যটুকু যাতে নষ্ট না হয় সেটার কথা মাথায় রেখেই কাজ করা হয়েছে। তাই ইলার নন্দন চিন্তা ফুটে উঠেছে। পরিষ্কারভাবে। যদিও এই নারীকে স্বচক্ষে দেখে ব্যাপারটা দুর্বোধ্যই ঠেকল।

ইলা বেশ বড়সড়; শুধু মোটা বা লম্বার জন্য নয়, সব মিলিয়েই বিশাল। হাত আর পাগুলো বড় বড়, আঙুল ভর্তি দামী পাথরের আংটি, খোলা স্যান্ডেল ভেদ করে পায়ের লম্বা নখ দেখা যাচ্ছে লাল রঙে রঞ্জিত। দাঁড়ানোর পর দেখা গেল লম্বায় ডেভিডের সমান। কিন্তু শরীরের ফোলা আর চোখ ধাঁধানো নকশা করা পোশাক এতটাই ফুলে রইল যে মনে হলো দু’জন ডেভিডের জায়গা হয়ে যাবে স্বচ্ছন্দে। মাথায় কোঁকড়ানো চুলের পরচুলা লাগানো। লাল রঙের পরচুলা আর উজ্জ্বল সোনার কানের দুল। দেখে মনে হচ্ছে ইচ্ছেমতো চোখের মেক-আপ করেছে। মুখ থেকে পাতলা কালো চুরুট সরিয়ে কিস্ করল ডেবরাকে। এরপর মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল ডেভিডকে। কণ্ঠস্বরের সঙ্গে বের হলে এলো চুরুট আর ব্যান্ডির গন্ধ।

‘আমি আশা করিনি যে তুমি এতটা সুন্দর হবে।’ জানিয়ে দিল ইলা। ‘আমি সৌন্দর্য পছন্দ করি না। প্রায়শই এটি ধোকাবাজ হয়। সাধারণত এর আড়ালে ঢাকা থাকে ভয়ঙ্কর কোন কিছু যেমন কোবরার উজ্জ্বলতা অথবা ক্যান্ডি বারের মোড়ক, মিষ্টি আর নরম। নিজের কোকড়ানো শক্ত পরচুলায় হাত বুলালো ইলা। ছোট চোখজোড়া স্থির করল ডেভিডের ওপর। না আমি বরঞ্চ কুৎসিতকেই বেছে নেবো।

নিজের সমস্ত সৌন্দর্য দেখিয়ে হেসে ফেলল ডেভিড। হ্যাঁ।’ একমত হলো সেও। তোমার সাথে দেখা হয়ে আর তোমার কিছু কাজ দেখে একথা পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছি আমি।’

অদ্ভুত শব্দ করে হেসে আবারো চুরুট মুখে পুরে দিল ইলা। যাই হোক অন্তত কোন চকোলেট সৈন্যের সাথে দেখা হয়নি আমার। বিশাল পুরুষালি হাত তুলে দিল ডেভিডের কাঁধে। নিয়ে গেল অন্য অতিথিদের সাথে পরিচয় করাতে।

বারো জন মানুষের সংমিশ্রণ, প্রায় সবাই বুদ্ধিজীবী চিত্রকর, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক–ডোর পাশে বসে নরম রোদে বীয়ার আর মজার আলোচনাতে সন্তুষ্টই হলো ডেভিড। যাই হোক, এ শান্ত ভাব স্থায়ী হতে দিল না ইলা। একসাথে বসে চমৎকার অ্যালফ্রেসকো খাবার, ঠাণ্ডা মাছ আর ডিম নিয়ে বসে আবারো আক্রমণ করে বসল ডেভিডকে।

তোমার সামরিক গর্বিত ভাব আর স্নেহ, আড়ম্বরতা আর সৌন্দর্য। আমার যেমনটা মনে হয় তোমার দেশপ্রেমের উপর গুটি আর সাহস তোমার নির্ভরতা আর শিষ্টাচারের আদেশ–এ সমস্তই ভড়ং। পৃথিবীকে গলানো মাংস দিয়ে ভরে দেবার জন্য তোমার বাহানা।

‘আমার অবাক লাগে ভেবে যে যদি এক প্লাটুন সিরিয়ান সৈন্য এখানে হামলে পড়ে তোমার সম্ভ্রমহানি ঘটানোর জন্য, তখনো কী তুমি এমনটাই

ভাববে কিনা। জানিয়ে দিল ডেভিড।

‘মাই বয়, আমি তো এরকম একটি সুযোগের জন্য স্বর্গের দিকে দুহাত তুলে প্রার্থনা করতেও প্রস্তুত আছি। এমন জোরে হেসে উঠল ইলা যে মাথার পরচুলা আরেকটু হলে পড়েই যেত। ঠিকঠাক মতো এটিকে যথাস্থানে বসিয়ে আবারো কথা বলা শুরু করল সে।

‘তোমার পুরুষালি বোমা, স্বার্থপর ঔদ্ধত্য, তোমার কাছে এই নারী টার্কির মতো পা দিয়ে ডেবরাকে দেখিয়ে দিল ইলা, তোমার কাছে হয়তো ও স্পার্ম গ্রহীতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই নারী যে ভবিষ্যতের ধারক, তা তোমার কাছে কোন গুরুত্ব বহন করে না। ওর ভেতরে আছে চমৎকার লেখনী শক্তি। তোমার কাছে ও শুধুমাত্র

এবার বাধা দিয়ে উঠল ডেবরা। যথেষ্ট হয়েছে। আমার বেডরুম নিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতা চাই না আমি। যুদ্ধ করার প্রস্তুতি চোখে নিয়ে ডেবরার দিকে তাকাল ইলা।

‘তোমার প্রতিভা এমন কোন উপহার নয় যা তুমি যেভাবে খুশি ব্যবহার করবে। সমস্ত মানব জাতির সম্পত্তি এটি, তাদের প্রতি দায়িত্ব আছে তোমার। এই দায়িত্ব হলো তোমার প্রতিভাকে কাজে লাগাও, একে বাড়িয়ে তোল। ডেবরার বিরোধিতাকে একেবারেই আমল না দিয়ে বলে চলল ইলা, ‘এই তরুণ মঙ্গল দেবতাকে হৃদয় দেয়ার পর থেকে এক লাইনও লিখেছো তুমি? এই ছাদের উপর এক বছর আগে আমরা যে উপন্যাসের কথা আলোচনা করেছিলাম তার কী হলো? তোমার সব আবেগ উবে গেল? তোমার ওভারির নাচন

‘থামো ইলা!, ডেবরা প্রায় রেগে উঠল। গাল হয়ে উঠল লাল। বাদামী চোখ জ্বলছে।

হা! হা!’ মাংসের হাড় রেখে দিয়ে শব্দ করে আঙুল চুষে নিল ইলা। ‘নিজের উপর লজ্জা হওয়া উচিৎ তোমার

‘ধুত্তেরি। ভয়ঙ্কর খেপে উঠল ডেবরা।

যা খুশি বলল আমাকে কিন্তু না লিখলে তুমিই পস্তাবে! লেখো নারী, লেখো?’ চেয়ারে হেলান দিল ইলা। ক্যাচক্যাচ করে আওয়াজ তুলল ভারী শরীর বহন করে। ঠিক আছে এখন তোমরা সাঁতার কাটাতে যেতে পারো। ডেভিড এখনো আমাকে বিকিনি পরিহিত অবস্থাতে দেখেনি যখন দেখবে তখন নিশ্চয়ই এই ছোট্ট মেয়েটার প্রতি সদয় হবে আরো!’

রাতের বেলা জেরুজালেমে ফিরে এলো তারা। সূর্যের আলো আছে তখনো। এছাড়াও মার্সিডিজের আসন প্রেম করার উপযুক্ত নয়। তারপরও ডেভিডের কাছ ঘেঁসে বসল ডেবরা।

‘ইলা ঠিক কথাই বলেছে। দীর্ঘ নীরবতার পর বলে উঠল ডেভিড। ‘তোমার লেখা উচিৎ, ডেবস।

‘ওহ, আমি করব। হালকা স্বরে জানাল ডেবরা।

কখন?’ জোর দিল ডেভিড। আরো একটু কাছে এগিয়ে এলো ডেবরা।

‘এই তো কয়েকদিনের মাঝেই। ডেভিডের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল ডেবরা।

‘এই তো কয়েকদিনের মাঝেই। ডেবরার ভঙ্গি নকল করে বলে উঠল ডেভিড।

‘জ্বালাতন করো না তো মরগ্যান। প্রায় ঘুমিয়েই পড়ল ডেবরা।

‘ভান করা বন্ধ করো।’ মুক্ত হাত দিয়ে ডেবরার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিল ডেভিড। আর আমি কথা বলার সময় ঘুমাবে না।’

‘ডেভিড, মাই ডার্লিং, সারা জীবন পড়ে আছে সামনে তার চেয়েও বেশি। বিড়বিড় করে উঠল ডেবরা। তুমি আমাকে মৃত্যুঞ্জয়ী করে তুলেছে। তুমি আর আমি হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকবো আর সবকিছুর জন্যেই যথেষ্ট সময় পাবো।

সম্ভবত অন্ধকারের দেবতারা শুনতে পেয়েছে ডেবরার অহংবাণী। বিদ্রুপাত্মকভাবে তাই মাথা নেড়েছে একে অপরের দিকে তাকিয়ে।

শনিবারে মালিক স্ট্রিটের বাসায় এলো জো আর হান্নাহ। লাঞ্চের পর সবাই মিলে ঠিক করল ডেভিডকে নিয়ে ট্যুরে যাবে। আর তাই চারজন মিলে গেল উপত্যকার ওপরে জিয়ন পর্বতে। প্রবেশ করল করিডোরের গোলক ধাঁধায়, যার মাধ্যমে যেতে হয় ডেভিডের কবরে। অসাধারণ অ্যামব্রয়ডারি করা কাপড় আর রূপার মুকুট আর টোরা কাভার দিয়ে ঢাকা। কয়েক ধাপ সামনে এগিয়ে গেলেই একই দালানে দেখা মিলবে যীশুর শেষ ভোজের কক্ষ। তাই এই দূর্গে জুদাইজম আর খ্রিস্টান তত্ত্ব একসাথে মিলে গেছে।

এর পরে জিয়ন গেইট দিয়ে পুরোন শহরে প্রবেশ করল তারা। অনুসরণ করে চলল জুদাইজমের কেন্দ্রের দেয়াল। বিশাল পাথরের ব্লকের লম্বা চুড়া যা তৈরি হয়েছে সেই হেরোদের আমলে, ফলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তখনকার নান্দনিক ঐতিহ্য। হেরোদের দ্বিতীয় মন্দির যা দুই হাজার বছর আগে রোমানরা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।

প্রধান ফটকের কাছে সার্চ করে দেখা হলো তাদের। এরপর ধর্মপ্রাণ পূজারীদের সাথে মিশে এগিয়ে চলল দেয়ালের দিকে। বাধার কাছে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। ডেভিডের মনের মাঝে জেগে উঠল গহীনে থাকা গোত্রীয় স্মৃতি। কেমন শূন্য একটা অনুভূতি যা পূর্ণ হবার অপেক্ষায় আছে।

দেয়ালের মুখ দিয়ে প্রার্থনা করছে সকলে। এদের অনেকেই ইহুদিদের লম্বা কালো কোট পরে এসেছে। অন্যদিকে এ পুরুষদের তুলনায় ডান দিকে মোটামুটি চুপচাপ নিজেদের প্রার্থনা উৎসর্গ করছে নারীরা।

অবশেষে কথা বলে উঠল জো। গলার স্বরে খানিকটা অস্বস্তি। আমার মনে হয় আমারও গিয়ে শ’মা বলা উচিৎ।

হ্যাঁ। একমত হলো হান্নাহ। আমার সাথে আসবে ডেবরা?

একটু দাঁড়াও।’ ডেভিডের দিকে তাকাল ডেবরা। হ্যান্ডব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে এগিয়ে দিল ডেভিডের দিকে। আমি বিয়ের জন্য তৈরি করেছিলাম এটা। কিন্তু এখনই পরে নাও।

একটা ইয়ামুলকা এগিয়ে দিল ডেবরা। কালো সাটিনের উপর অ্যামব্রয়ডারি করা প্রার্থনা টুপি।

‘জোর সাথে যাও। ও তোমাকে দেখিয়ে দেবে কী করতে হবে। ডেভিডকে জানাল ডেবরা।

নারীদের ভিড়ের কাছে চলে গেল মেয়েরা। মাথায় টুপি পরে নিল ডেভিড আর জোকে অনুসরণ করে নিচে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। একজন শামাস এগিয়ে এলে তাদের দিকে। লম্বা, রূপালি দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ। ডেভিডকে সাহায্য করল তার ডান বাহুতে ছোট্ট একটা চামড়ার থলে বেঁধে নিতে। এতে আছে টোরাহর একটা অংশ।

‘তো এখন তুমি এই শব্দগুলোকে তোমার হৃদয় আর আত্মায় ধারণ করে নাও আর তোমার ডান বাহুতেই তাদেরকে রাখবে।’

এরপর একটা টালিট ছড়িয়ে দিল ডেভিডের কাঁধে, উল দিয়ে বোনা একটা শাল। এরপর পথ দেখিয়ে দেয়ালের কাছে নিয়ে গেল আর শামাসদের সাথে সাথে বলতে লাগল ডেভিড :

‘শোন, ও ইস্রায়েল, প্রভু, আমাদের ঈশ্বর, প্রভু মাত্র একজন

বহুদিন আগে শেখা শব্দ মনে পড়ে গেল ডেভিডের। চোখ তুলে তাকাল বিশাল পাথরের ব্লক দিয়ে বানানো দেয়ালের দিকে। টাওয়ারের মতো উঁচু দেয়াল উঠে গেছে উপরের দিকে। ওর পূর্বে আসা হাজারো ধর্মপ্রাণ কাগজে নিজেদের প্রার্থনা লিখে গুঁজে রেখে গেছে পাথরের জয়েন্টের মাঝে। চার পাশে গুনগুন করে প্রার্থনা করছে সবাই। ডেভিডের মনে হলো যেন সে কল্পনা করতে পারছে যে প্রার্থনার সোনালি স্তম্ভ উঠে গেছে এই পবিত্র ভূমি থেকে স্বর্গপানে।

এরপর ইহুদি কোয়ার্টারে যাবার সিঁড়িতে উঠল তারা। পেটের মাঝে কেমন যে ভালো লাগার একটা অনুভূতি শিরশির করে উঠল।

সেই সন্ধ্যায় ছাদে বসে গোল্ডস্টার বিয়ার পান করার সময় অবচেতনেই কথা বলার বিষয় হয়ে উঠল ঈশ্বর আর ধর্ম।

জো বলে উঠল, আমি একজন ইস্রায়েলি, তারপর একজন ইহুদি। প্রথমে আমার দেশ; তারও অনেক পরে আসবে ধর্ম।

কিন্তু দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করার সময় তার মুখের অভিব্যক্তি মনে পড়ে গেল ডেভিডের।

বহু রাত পর্যন্ত চলল গল্প। নিজের ধর্মীয় ঐতিহ্যের বিশালত্ব উপলব্ধি করল ডেভিড।

‘আমি এ সম্পর্কে আরো বেশি কিছু জানতে চাই।’ স্বীকার করল সে। ডেবরা কিছুই বলল না। কিন্তু ডেভিডের লাগেজ গুছিয়ে দেয়ার সময় পরিষ্কার ইউনিফর্মের উপর রাখল হারমান ওকের এক কপি “দিজ ইজ মাই গড।”

এটা পড়ে ফেলল ডেভিড। এরপর যখন মালিক স্ট্রিটে এলো জানতে চাইল আরো কিছু। প্রতিবারই বই নির্বাচন করে দিল ডেবরা। প্রথমটাতে ইংরেজি, এরপর হিব্রুতে। ধীরে ধীরে এ ভাষার উপর দখল বেড়ে যেতে লাগল ডেভিডের। এ সমস্ত বই সবই যে ধর্মের উপর লেখা তা নয়। এদের মাঝে ইতিহাস আর ঐতিহাসিক উপন্যাসও থাকায় আস্তে আস্তে সভ্যতার এই প্রাচীন কেন্দ্রভূমি নিয়ে ডেভিডের আগ্রহ বৃদ্ধি পেল। তিন হাজার বছর ধরে যুদ্ধভূমি আর নানান দোলাচলে দুলছে এই ভূমি।

ব্যাগের মাঝে ডেবরা যাই ভরে দিত, তাই পড়ে ফেলা অভ্যাস হয়ে গেল ডেভিডের। যোসেফাস ফ্লেভিয়াস থেকে লিওন ইউরিস পর্যন্ত।

এর মাধ্যমে ঘুরে বেড়ানোর আগ্রহও বেড়ে গেল। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সময় পেলেই দু’জন একসাথে ঘুরে বেড়াতে লাগল ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলোতে। এর শুরু হলো মাসাডার পাহাড়ের মাথায় থাকা দুর্গ থেকে। যেখানে রোমের কাছে আত্মসমর্পণ না করে একে অন্যকে খুন করেছিল গোড়ারা। এরপর তেমন একটা পরিচিতি নেই–এমন ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতেও ঘুরে বেড়াতে লাগল তারা।

বহুক্ষণ পর্যন্ত সূর্যের আলো থাকা লম্বা দিনগুলোতে দু’জনে লাঞ্চ করতে কোন রোমান ধ্বংসাবশেষের উপরে বসে, তাকিয়ে দেখতে মরুভূমির উদরে জন্ম নেয়া ছোট্ট কাঁটা গাছের উপর বসে আছে শকুন। এরপর হয়তো দু’জনে মিলে খুঁজে দেখতো শেষবারের বৃষ্টিতে কোন প্রাচীন কয়েন বা পুরাতত্ত্ব উঠে এসেছে কিনা।

তাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে কমলা আর সোনালি পাথরের লম্বা চূড়া। এত পরিষ্কার ঝকঝকে আলোয় মনে হচ্ছে বহুদিন ধরেই এসব দেখছে তারা। চারপাশ এতটাই নীরব যেন পৃথিবীর শেষ আর একমাত্র মানব-মানবী তারা দু’জনে।

এই দিনগুলোর মতো এত সুন্দর দিন আর আসেনি ডেভিডের জীবনে। স্কোয়াড্রনের স্টান্ডবাই থাকাকালীন কষ্টকর ঘণ্টাগুলোতে এর অর্থ আর উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছে ডেভিড। আর দিন শেষে সব সময়েই আনন্দ, উঞ্চতা আর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করতে মালিক স্ট্রিটে তার ঘর।

বিয়ের জন্য বেস থেকে ছুটি নিয়েছে জো আর ডেভিড। এখন চারপাশ বেশ শান্ত আর লে ভফিনও কোন বাধা দিল না। কেননা অতিথি তালিকায় সেও আছে।

আগের দিন জেরুজালেমে পৌঁছে গেল তারা আর তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে গেল। ট্যাক্সি-ড্রাইভার আর ট্রাকার হিসেবে পরিশ্রম করতে হলো ডেভিডকে। ফুল থেকে শুরু করে বাদ্যযন্ত্র, দূরের থেকে আসা আত্মীয়স্বজন সবাইকে বহন করল মার্সিডিজ।

ব্রিগের বাগান সাজানো হলো তালপাতা আর রঙিন ফেস্টুন দিয়ে। মাঝখানে রাখা হলো প্লাহ। নীল আর সোনালি রঙ দিয়ে তৈরি করা ধর্মীয় চিহ্ন, ডেভিডের তারকা, আঙুর, গম, তরমুজসহ উর্বরতার সমস্ত চিহ্ন বা প্রতীক। এই চাদোয়ার নিচে অনুষ্ঠিত হবে বিয়ের অনুষ্ঠান। জলপাই গাছের নিচে লম্বা টেবিলে সাজানো রয়েছে ফুলের বোল আর ফল দিয়ে বানানো খাবার। তিনশ অতিথির আসন পাতা হয়েছে। এছাড়াও নাচের জন্য রাখা হয়েছে খোলা জায়গা। বাদক দলের জন্যও উঁচু কাঠের স্ট্যান্ডের গায়ে পতাকা লাগানো হয়েছে।

পেশাদার খামার থেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সতর্কতার সাথে মেন্য ঠিক করেছে রাঁধুনী আর নারীরা। প্রধান পদ দুটি বিশাল স্টাফ করা টুনা, উর্বরতার চিহ্ন আর পিতলের থালার উপর সাজানো বেদুইন ধাঁচে রান্না করা ভেড়ার মাংস।

বিয়ের রবিবারে ডেভিড ডেবরাকে নিয়ে গেল হাদাসা হাসপাতালের প্রধান শল্যবিদের বাসায়। হানা তার একজন থিয়েটারের বোন আর ভদ্রলোকের ইচ্ছে হান্নাহ বিয়ের পোশাক পরা থেকে প্রস্তুত হওয়া সবই করবে তার বাসায়। ডেবরা হান্নাহকে সাহায্য করবে। ডেভিড তাকে রেখে ইন কারেমে ফিরে গেল। বাসায় যাবার রাস্তা ইতিমধ্যে নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে ফেলা হয়েছে। পাহারায় আছে সিক্রেট সার্ভিসের দল আর প্যারাট্রুপার।

জোর বিছানায় আধশোয়া হয়ে ডেভিড দেখতে লাগল কেমন করে কাপড় পরছে জো। এদিকে আবার আংটি হারিয়ে ফেলেছে, খুঁজেও পেয়েছে সাথে সাথে। অন্যদিকে নার্ভাস হয়ে ঘামতে ঘামতে শেষ। সুযোগ পেয়ে নানান আজেবাজে উপদেশ দিতে লাগল ডেভিড। নিচের বাগানে জড়ো হওয়া অতিথিদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেল ডেভিড। দেখতে পেল মূল ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে সতর্কতার সাথে তল্লাশি চালাচ্ছে একজন এয়ারফোর্স কর্নেল, যদিও পুরোপুরি ভাবে সারা হচ্ছে কাজগুলো।

তারা বেশ তৎপর।’ মন্তব্য করল ডেভিড।

হান্নাহ বলেছে বাগানে যতটা সম্ভব কম পাহারা রাখতে। তাই কে ঢুকছে এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক তারা। অবশেষে সাজগোজ শেষ করল জো। কিন্তু ইতিমধ্যে ইউনিফর্মের বগলের নিচে ঘামের দাগ ফুটে উঠেছে।

কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল জো।

‘গড, যথেষ্ট হ্যান্ডসাম তুমি।’ জানিয়ে দিল ডেভিড।

‘গোল্লায় যাও তুমি, মরগ্যান। জো হেসে ফেলল। মাথায় টুপি বসিয়ে নিল ঠিকঠাকভাবে। ঘড়ির দিকে তাকাল। চলো।’

সেনাবাহিনীর প্রধান রাব্বি ব্রিগ আর অন্যান্যদের সাথে ব্রিগের স্টাডিতে অপেক্ষা করছে। চুপচাপ স্বভাবের রাব্বি ব্যক্তিগতভাবে ‘৬৭-এর যুদ্ধে মুক্ত করেছে দেশপ্রেমিকদের সমাধি। হেব্রনে এগিয়ে যাবার সময় ছত্রভঙ্গ আরবীয় লাইনের উপর দিয়ে জিপ চালিয়ে ঢুকে সমাধিস্থলের গেইট খুলে ফেলে রাব্বি। সাথে ছিল সাব-মেশিনগান। পিছু ধাওয়া করে ক্রন্দরত আরবীয় গার্ডকে ভেতরের দেয়ালের কাছে নিয়ে যায়।

বিগের ডেস্কে এসে বসে জো। সাইন করে কিতুব্বা, বিয়ের কন্ট্রাক্ট। এরপর জোর হাতে সিল্কের কাপড় তুলে দেয় রাব্বি। আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থিত দর্শনার্থীরা সবাই মাজাল টোভস’ গেয়ে অভিবাদন জানায় জোকে।

দলবলসহ বর নিচে এসে বাগানে অপেক্ষা করতে থাকে কনের আগমনের জন্য। প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মৃত বাবার জায়গায় প্রধান সার্জনকে নিয়ে হাজির হয় হান্নাহ। সাথে আসে উৎসবের সাজে সজ্জিত নারীগণ। এদের মাঝে ডেবরা আর ওর মা-ও আছে। সবার হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি।

ডেভিডের কাছে হান্নাহকে কখনোই তেমন আকর্ষণীয় মনে হয়নি। মেয়েটা বেশি লম্বা আর অভিব্যক্তি বা শরীরের দিক থেকেও কেমন কাঠখোট্টা। কিন্তু আজ সাদা বিয়ের পোশাক আর ওড়নায় পুরোপুরি বদলে ফেলেছে নিজেকে।

ফোলা সাদা স্কার্টের উপর দিয়ে একখণ্ড মেঘের মতো ভেসে এলো যেন হান্নাহ। ওড়নার কারণে মোলায়েম হয়ে আছে চেহারা। ভেতরের খুশি উপচে পড়ছে সবুজ চোখের তারায়। লাল-সোনালি চুল গালের দু’পাশে। ডেবরার দক্ষ হাতের মেক-আপে ঢাকা পড়েছে মুখের তিল। হান্নাহর হাড়সর্বস্ব নাকটাকেও সুন্দর করে দিয়েছে ডেবরা। তাই যতটুকু সম্ভব ততটুকুই সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে আজ।

এয়ারফোর্সের কল্যাণে বাদামী চামড়ার জোকে বেশ বড়সড় আর হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে। আগ্রহ নিয়ে বাগানের দরজায় এগিয়ে গেল হান্নাহকে এগিয়ে আনতে। এখানে আবার কনের মুখের উপর ওড়না নামানোর অনুষ্ঠান বেদেকেন ডিকালেও সম্পন্ন হলো।

এরপর জো চূপাহ চাঁদোয়ার নিচে গেল। এখানে কাঁধে টালিট নিয়ে অপেক্ষা করছে রাব্বি। জোর পেছনে হান্নাহকে নিয়ে এলো রমণীকুল।

সবার হাতেই জ্বলন্ত মোমবাতি। গুনগুন করে বিয়ের আশির্বাদ মন্ত্র উচ্চারণ করল রাব্বি। জোকে ঘিরে সাতবার ঘুরে মেজিক্যাল সার্কেল পূরণ করল কনে আর তার সঙ্গী নারীরা। পুরাতন নিয়মে এর অর্থ পাপাত্মাকে দূর করা। অবশেষে পাশাপাশি দাঁড়াল বর এবং কনে। মন্দিরের দিকে মুখ করা। অতিথি আর দর্শনার্থীরাও তাদের কাছাকাছি এগিয়ে আসার পর শুরু হলো বাকি আনুষ্ঠানিকতা।

ওয়াইনের পাত্র আশির্বাদ করে দিল রাব্বি। এখান থেকেই একত্রে পান করল বর-কনে। এরপর জো তাকাল হান্নাহর দিকে। ওর মুখের উপরের অংশ এখনো ওড়না দিয়ে ঢাকা। হান্নাহর ডান হাতের বুড়ো আঙুলে সোনার আংটি পরিয়ে দিল জো।

‘মোশি এবং ইস্রায়েলের নিয়মানুসারে এই আংটির মাধ্যমে আমার অংশ হলে তুমি।

এরপর নিজের গোড়ালির নিচে গ্লাস ভেঙ্গে দিল জো। আর এই তীক্ষ্ণ শব্দের সাথে সাথে শুরু হলো গান-সুর আর আনন্দ-উল্লাস। জোর পাশ থেকে সরে ভিড়ের মাঝে পথ করে ডেবরার দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড।

হলুদ রঙের গাউন পরে এসেছে ডেবরা। কালো চুলের মাঝে গুঁজে দিয়েছে তাজা ফুল। কোমর ধরতেই সুঘ্রাণ পেল ডেভিড। বিড়বিড় করে ডেবরার কানে কানে বলল, এরপর তুমি, আমার সুন্দরী! একইভাবে উত্তর দিল ডেবরাও ‘হ্যাঁ, প্লিজ!

হান্নাহর হাত ধরে সাজিয়ে রাখা নাচের মঞ্চে উঠে গেল জো। হালকা। সুরের সাথে বাদক দল বাজানো শুরু করল আর উপস্থিত সব তরুণ-তরুণীর দলও উঠে গেল নাচতে। বয়ষ্করা তালপাতার নিচে সাজানো লম্বা টেবিলের চারপাশে গিয়ে বসে পড়ল।

সমস্ত হাসি-আনন্দের মাঝেও খানিকটা নিরানন্দ যোগ করল ইউনিফর্মের দল। প্রতি দুই জনের একজন এসেছে যুদ্ধ সাজে। বাগানের প্রধান ফটক আর রান্নাঘরের প্রবেশদ্বারে কাঁধে উজি মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্যারাট্রুপার প্রহরী। সিক্রেট সার্ভিসের লোকদেরকে খুঁজে পাওয়াটাও সহজ। সিভিলিয়ান পোশাকে হাসি-বিহীন, সতর্ক চোখ-মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অতিথিদের মাঝে।

একসাথে নাচলো ডেভিড আর ডেবরা। ডেভিডের হাতের মাঝে বেশ হালকা আর উষ্ণ মনে হলো ডেবরাকে। বাজানো থেমে গেলে পর অপেক্ষাকৃত চুপচাপ একটা কোণায় গেল দুজনে। একসাথে দাঁড়িয়ে অন্য অতিথিদের নিয়ে কথা বলতে লাগল।

‘তুমি একটা যাচ্ছেতাই। ডেভিডের কাঁধে ভর দিল ডেবরা। আমি তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছি। কিছু এনে দেবে না?

‘এক গ্লাস ঠাণ্ডা সাদা ওয়াইন?’ পরামর্শ দিল ডেভিড।

হুম, তাই ভালো।’ হাসল ডেবরা। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে একে অন্যকে দেখল দু’জনে। হঠাৎ করেই কেমন একটা দুঃখবোধ জেগে উঠল ডেভিডের মাঝে। কেমন একটা হতাশা। মনে হলো কিছু একটা হারাতে বসেছে সে। এটি এমন একটি অনুভূতি যে মনে হলো বুকের মাঝে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। মুছে যেতে লাগল সব হাসি-আনন্দ।

‘কি হয়েছে, ডেভিড?’ ডেবরার নিজের অভিব্যক্তিও বদলে গেল। শক্ত করে ধরল ডেভিডের হাত। কিছু না। তাড়াতাড়ি ডেবরার কাছ থেকে সরে এলো। চেষ্টা করছে নিজেকে সামলাতে। কিছু না। আবারো বলে উঠল ডেভিড। কিন্তু শক্ত কিছু একটা মনে হলো আটকে গেছে পেটের মাঝে। ‘আমি তোমাকে ওয়াইন এনে দিচ্ছি। ডেবরার কাছ থেকে সরে এলো ডেভিড।

বারের দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। চোখে চোখ পড়তেই হাসল ব্রিগ। আড়চোখে তাকাল বাগানের দিকে। বাবার সাথে দাঁড়িয়ে আছে জো। এক হাতে পত্নীকে ধরে রেখে হাসছে। মুখের কাপড় সরিয়েছে হান্নাহ। মেক আপের নিচ থেকে উঁকি দিতে শুরু করেছে তিল। তুষার-শুভ্র লেসের ফাঁক গলেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ওদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল ডেভিড। কিন্তু থামলো না। এগিয়ে গেল খোলা বারের দিকে। বাগানের শেষমাথায় অবস্থিত বারে যেতে যেতেও টের পেল যে দুঃখের অনুভূতিটা এখনো তার ভেতরে দুমড়ে কাঁদছে। এই মুহূর্তে জোর সাথে কথা বলতে চায় না সে।

যেই মুহূর্তে ডেবরার কাছ থেকে সরে এলো ডেভিড, ঠিক সেই মুহূর্তেই বাগানের লোহার গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সাদা জ্যাকেট পরা ওয়েটারের দল। সবার হাতেই সুস্বাদু খাবারের থালা। সূর্যের আলোতেও দেখা গেল গরম ধোঁয়া উড়ছে। মাছ-মাংস আর মসলার গন্ধে ম ম করে উঠল বাতাস। হর্ষধ্বনি ভেসে হলো অতিথিদের কাছ থেকে।

টেবিল, রান্নাঘরের দরজা আর ঘর পর্যন্ত রাস্তা পাতা হয়েছে ওয়েটারদের জন্য।

ডেভিডের খুব কাছ দিয়ে হেঁটে গেল ওয়েটারের দল। হঠাৎ করেই খাবারের উপর থেকে লাইনের দ্বিতীয় ওয়েটারের দিকে মনোযোগ দিল ডেভিড। মাঝারি উচ্চতা আর গাঢ় গাত্রবর্ণ লোকটার মেহগনির মতো চেহারায় ঘন মোচ।

ঘামছে লোকটা। এ কারণেই ভালো করে তাকিয়ে রইল ডেভিড। ঘামে চকচক করছে লোকটার মুখ। মোচের উপর দিয়ে চিবুকে গড়িয়ে পড়ল ঘামের ফোঁটা। বিশাল উঁচু করে ধরতেই দেখা গেল সাদা জ্যাকেটের বাহুমূলে ঘামের দাগ।

ডেভিড তাকাতেই মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হলো দু’জনের। ডেভিড বুঝতে পারল লোকটার মনের মাঝে কিছু একটা চলছে–ভয়, সম্ভবত অথবা প্রফুল্লতা। ওয়েটার বুঝতে পারল ডেভিড তাকিয়ে আছে। তাই চট করে চোখ সরিয়ে নিল।

ডেভিড বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কেন যেন সন্দেহ এলো মনে। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ত্রি-মূর্তি এগিয়ে টেবিলের দিকে।

ওয়েটার আবারো ফিরে তাকাল ডেভিডের দিকে। দেখল এখনো তাকিয়ে আছে ডেভিড। আস্তে করে লোকটা নিজের সঙ্গীদেরকে কিছু একটা বলে উঠল, দেখতে পেল ডেভিড। সে লোকটাও ফিরে তাকাল, ডেভিডের দিকে। আর এই দৃষ্টি দেখে ডেভিডের মাথা আর বুকের মাঝে বাজতে লাগল সতর্ক ঘণ্টা। বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বিপজ্জনক আর দুর্বিসহ। এ ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ রইল না তার।

হন্যে হয়ে প্রহরীদের খোঁজে চারপাশে তাকাল ডেভিড। ওয়েটারদের লাইনের শেষে দেখা যাচ্ছে দু’জনকে। একজন ডেভিডের পাশে গেইটের কাছে।

তাড়াতাড়ি তার দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। পথিমধ্যে কে কী বলল কিছুই কানে গেল না তার। তাকিয়ে রইল ওয়েটার তিনজনের দিকে। দেখতে পেল ঘটনার শুরু করতে যাচ্ছে তারা।

এ ব্যাপারে বারংবার রিহার্সাল করে এসেছে তারা নিঃসন্দেহে। তিনজন ওয়েটার একসাথে হাসি-আনন্দে মত্ত অতিথিদের মাঝে টেবিলের উপর রাখল খাবারের থালা। খাবারের উপর থেকে প্লাস্টিক সরাতেই দেখা গেল কালো বস্তুগুলো।

বাদামী-চেহারার ওয়েটার পিস্তল বের করল প্লাস্টিকের নিচ থেকে। সাথে সাথে ঘুরে দু’জন প্যারাট্রুপারকে গুলি করল পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে। দেয়াল ঘেরা বাগানে অটোমেটিক পিস্তলের শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। দু’জন প্রহরীর উপর বুলেট-বৃষ্টির ফলে মনে হলে কোন দানব প্রায় কেটে অর্ধেক করে ফেলল তাদেরকে।

ডেভিডের বাম পাশের ওয়েটারের চোখ দুটো উজ্জ্বল কালোজামের মতো। বানরমুখো লোকটা নিজের থালা থেকে পিস্তল তুলে নিল। গেইডের কাছে দাঁড়ানো প্যারাট্রুপারদের লক্ষ্য করে গুলি চালালো।

গার্ডদের উপর প্রথমে আক্রমণ চলল। হাতের মুঠোয় গর্জে উঠল পিস্তল। রাবারের মতো থপ করে শব্দ করে ছিটকে পড়ল শরীরের মাংস।

নিজের উজি বের করার চেষ্টা করল গার্ড। কিন্তু মুখে ঢুকে গেল গুলি। মাথা পিছনে হেলে গেল বুলেটের থাক্কায়। প্যারাট্রুপারের বেরেট পিস্তল গোত্তা খেলো আকাশে। হাত থেকে পড়ে গেল মেশিনগান। টাইলসের উপর দিয়ে। গড়িয়ে এলো ডেভিডের কাছে। নিচু হয়ে ঝাঁপ দিল ডেভিড। এরপর অতিথিদের দিকে পিস্তল তাক করল আরবীয় বন্দুকধারীরা। বুলেট-বৃষ্টি শুরু করল। বন্দুকের শব্দের সাথে মিশে গেল চিৎকার, চেঁচামেচি আর কান্না।

বাগানের অপর পাশে একটা সিকিউরিটি এজেন্ট পিস্তল তুলে নিল হাতে। দু’বার গুলি করল বানরমুখো ওয়েটারকে লক্ষ্য করে। দেয়ালের দিকে পিছু হটলো ওয়েটার। কিন্তু ভারসাম্য হারালো না। নিজের মেশিন পিস্তল দিয়ে গুলি করল এজেন্টের দিকে। গড়িয়ে পড়ে গেল সিকিউরিটি এজেন্ট।

বাগান জুড়ে ছোটাছুটি শুরু করল আতঙ্কিত অতিথিরা। গুলির মুখে চিৎকার করছে, পড়ে যাচ্ছে, মারা যাচ্ছে।

হান্নাহর বুকে লাগল দু’টো গুলি। ধাক্কা খেয়ে পিছনে থাকা টেবিলের গ্লাস আর বোতলের উপর পড়ে গেল সে। সাদা বিয়ের গাউন ভেসে যেতে লাগল উজ্জ্বল রক্তে।

নিজের পিস্তল খালি হয়ে যাওয়ায় সেটা ফেলে দিল মাঝখানের ওয়েটার। তাড়াতাড়ি তামার থালা থেকে দু’হাতে গ্রেনেড নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছুঁড়ে মারলো মানুষের ভিড়ে। জোড়া বিস্ফোরণের সাদা ধোয়ার সাথে তীক্ষ্ণ শার্প নেল ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।

নারীদের তীব্র চিৎকার শোনা গেল চারপাশে আবারো নিচু হলো বন্দুকধারী। হাতে তুলে নিল আরো গ্রেনেড।

মাত্র সেকেন্ডের মাঝে ঘটে গেল এতকিছু।

দ্রুত গড়িয়ে গিয়ে উজি হাতে তুলে নিল ডেভিড। হাঁটু গেড়ে কোমরের কাছে ধরল মেশিনগান, প্যারাট্রুপারের ট্রেনিং থাকায় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো কাজ শুরু করল সে।

আহত ওয়েটার দেখতে পেল তাকে। ডেভিডের দিকে ফিরে দুর্বলতা সত্ত্বেও ঘসটে-ঘসটে এগোতে লাগল দেয়ালের পাশ থেকে। একটা হাত পুরো গুঁড়ো হয়ে গেছে। কাঁধ থেকে রক্ত মাখা জ্যাকেটের মাঝে ঝুলছে। কিন্তু অন্যহাতে মেশিন পিস্তল তুলে নিয়ে তাক করল ডেভিডের দিকে।

প্রথমে গুলি করল ডেভিড। আরবীয়টার পেছনের দেয়ালের পাস্টার উঠে গেলে সঠিকভাবে গুলি করল সে। পেছনে ধাক্কা খেল দস্যটা। শরীর ঝাঁকি দিয়ে দেয়ালের সাথে লেগে আটকে রইল লোকটা। সাদা প্লাস্টারের উপর বইতে লাগল রক্তের ধারা।

রান্নাঘরের দরজার পাশে থাকা আরবীয়ের উপর বন্দুক তাক করল ডেভিড। লোকটা মাত্রই একটা গ্রেনেড ছোঁড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ডান হাত পেছনের দিকে, দুই হাতের মুঠিতে ধরা ভয়ঙ্কর লোহার বল। চিৎকার করে বলল কিছু একটা, চ্যালেঞ্জ অথবা যুদ্ধের ডাক, বিজয়ের চিৎকার যা আহতদের চিৎকার ছাপিয়েও শোনা গেল।

কিন্তু লোকটা গ্রেনেড ছোঁড়ার আগেই আক্রমণ করল ডেভিডের বন্দুক। ডজনখানেক বুলেট ঢুকে গেল লোকটার পেটে আর বুকে। পায়ের উপর গ্রেনেড দুটি ফেলে দিল আরবীয়টা। থপ করে বসে পড়ে শূন্যহাতে আটকাতে চাইল নিজের রক্তবন্যা।

গ্রেনেড গুলির ফিউজ শর্ট থাকায় প্রায় তৎক্ষণাৎ বিস্ফোরিত হলো। মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটার কোমরের নিচ থেকে নেই হয়ে গেল। একই বিস্ফোরণের ধাক্কায় ছাদের শেষপ্রান্তে থাকা দুবৃত্তটাও পড়ে গেল। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ডেভিড।

আর শেষ আরবীয়টা ইতিমধ্যেই মাথা আর বুকে গ্রেনেডের অংশের কারণে আহত হয়েছে। কিন্তু তারপরেও বেঁচে আছে লোকটা। চেষ্টা করল পাশে নিজের রক্তের মাঝে পড়ে থাকা মেশিন পিস্তলটাকে তুলে নেবার।

ভয়ঙ্কর রেগে উঠল ডেভিড। পাগলের মতো চিৎকার করা শুরু করল সে। তাড়াতাড়ি সিঁড়ির মাথায় উঠে নিশানা করল আরবীয়ের দিকে।

আরব লোকটার হাতে মেশিন পিস্তল আর মাতালের মতোই হাত কাঁপছে তার। গুলি করল ডেভিড। একটা মাত্র বুলেট বের হয়েই খালি চেম্বার পড়ে গেল নিচে।

অন্যদিকে ছাদের উপরে রক্ত আর ঘামে চকচক করছে আরবীয়ের মুখ। চেতনা হারাবার আগে চেষ্টা করল মেশিন পিস্তলটাকে ঠিকভাবে নিশানা করার। দ্রুত মারা যাচ্ছে লোকটা। তারপরেও চেষ্টা করল শেষ শক্তিটুকু কাজে লাগাবার।

হাতে খালি অস্ত্র নিয়ে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ডেভিড। পিস্তলের শূন্য চোখ খুঁজে নিল তাকে। ডেভিড দেখল আরবীয়ের চোখ সরু হয়ে গেল আর হঠাৎ করেই খুনীর মতো হয়ে উঠল লোকটা। বুঝতে পারল হাতের মুঠোয় পেয়েছে ডেভিডকে। ট্রিগারে চেপে বসল আঙুল।

ঠিক এই রেঞ্জে হোস পাইপের মতো আঘাত করবে বুলেট। নড়ে উঠল ডেভিড, লাফ দিল সিঁড়ির নিচে; কিন্তু জানে যে দেরি হয়ে গেছে। আরবীয় লোকটা যেই মুহূর্তে গুলি করল ঠিক সেই মুহূর্তে ডেভিডের পাশ থেকে গর্জে উঠল একটা রিভলবার।

অর্ধেক মাথা কেটে গেল লোকটার। পিছনের সাদা দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ল খুলির মাঝে থাকা হলুদ পদার্থ। ট্রিগারে চেপে বসা আঙুল ঝাঁঝড়া করে দিল মাথার উপরে থাকা আঙুল লতা।

পাশে তাকিয়ে ব্রিগকে দেখতে পেল ডেভিড। মৃত সিকিউরিটি গার্ডের পিস্তল হাতে। এক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল দু’জনে। এরপরই নেমে গিয়ে অন্য দুই মৃত আরবের কাছে গেল ব্রিগ। প্রতিবারে একজনের খুলিতে ঢুকিয়ে দিল একটা করে বুলেট।

ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত থেকে উজি ফেলে বাগানের দিকে দৌড় দিল ডেভিড।

মৃত আর আহতরা পড়ে আছে পাশাপাশি। মানবতার খণ্ডিত অংশ। আহতদের মৃদু গোঙানি, একটা শিশুর তারস্বরে কান্না, মায়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল সব চিৎকার ছাপিয়ে।

সারা বাগানময় ছড়িয়ে আছে রক্ত। সাদা দেয়ালের উপরেও ছোপ ছোপ রক্ত। ব্যান্ডস্ট্যান্ডে একজন বাদকের গায়ের উপর দিয়ে ধুলামাখা রক্ত বেরিয়ে আসছে। মসলাদার খাবার আর ছড়িয়ে পড়া ওয়াইনের গন্ধের সাথে রক্তের গন্ধও মিশে গেল। আরো পাওয়া গেল প্লাস্টার, ধুলা আর পোড়া বিস্ফোরকের গন্ধ।

ধোয়া আর ধুলার পর্দায় ঢাকা পড়লেও বাগানের ভগ্নদশা চোখ এড়ালো না। উড়ন্ত লোহার কল্যাণে গোড়া থেকে উঠে এসেছে জলপাই গাছ, ভিতরের সাদা কাঠ দেখা যাচ্ছে। আহতরা হামাগুড়ি দিচ্ছে ভাঙা গ্লাস আর প্লেটের টুকরার উপর। কাঁদছে লোকগুলো, চিৎকার করছে, ফিসফিস করে প্রার্থনা করছে পরিত্রাণের জন্যে।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ডেভিড। পা দুটো মনে হলো আপনাতেই চলছে। পেশী সব বোবা হয়ে গেছে। বোধশক্তি লোপ পেয়েছে যেন তার।

ভেঙেপড়া অলিভ গাছগুলোর একটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে জো। তাকে পূর্বের চেয়েও প্রকাণ্ড দেখাচ্ছে। শক্তিশালী পাদুটো দুপাশে ছড়িয়ে আছে, মাথা পিছন দিকে হেলে আছে আর মুখ আকাশপানে। কিন্তু চোখ দুটো বন্ধ আর চেহারায় ফুটে আছে নিঃশব্দ কান্না হাতের মাঝে হান্নাহর মৃতদেহ।

হান্নাহর মাথা থেকে খসে পড়েছে বিয়ের ওড়না, উজ্জ্বল তামাটে রঙের চুলের গোছা ঝুলে আছে পেছনে মাটিতেই পড়ে গেছে প্রায়। পাদুটো আর একটা হাত প্রাণহীনভাবে ঝুলে আছে পাশে। দুধ-সাদা মুখমণ্ডলে পরিষ্কারভাবে ফুটে আছে সোনালি তিলগুলো। ওয়েডিং গাউনের মাঝে ফুলের পাপড়ির মতো ফুটে আছে রক্তাক্ত ক্ষত।

চোখ সরিয়ে নিল ডেভিড। জোকে এ অবস্থায় দেখতে পারছে না ও। তার চেয়ে বরঞ্চ আস্তে আস্তে বাগানের এপাশে এসে আতঙ্ক নিয়ে খুঁজতে লাগল ডেবরাকে। ডেবরা! চাইল গলা উঁচিয়ে ডাকতে। কিন্তু খসখস শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হলো না। ঘন কালো রক্তে হড়কে গেল পা। ডেভিড হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল অজ্ঞান নারীদেহের উপর। ফুলের নকশা করা পোশাকে নারীদেহটি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। হাত দুটো দুপাশে ছড়ানো। ডেবরার মাকে চিনতে পারল না ডেভিড।

ডেবরা।’ তাড়াতাড়ি করতে চাইল সে। কিন্তু পা দুটো কথা শুনল না। এরপরই ডেবরাকে দেখতে পেল সে। ঠিক দেয়ালের কোণে যেখানে রেখে গিয়েছিল তাকে, সেখানেই আছে ডেবরা।

‘ডেবরা! ডেভিড নিজের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন শুনতে পেল যেন। দেখে মনে হচ্ছে অক্ষত আছে ডেবরা। মার্বেল গ্রেসিয়ান মূর্তির নিচে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। চুলে তখনো ফুল, পোশাক উজ্জ্বল, পরিপাটি।

দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে আছে ডেবরা। চট করে দেখে মনে হলো যেন প্রার্থনা করছে। কালো চুলের ঢল মুখের সামনের অংশ ঢেকে রেখেছে। মুখের উপর দু’হাত দিয়ে রেখেছে ডেবরা।

‘ডেবরা। ডেবরার পাশে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল ডেভিড। আস্তে করে হাত রাখল কাঁধে।

‘তুমি ভালো আছো তো? আস্তে করে হাত নামালো ডেবরা মুখের উপর থেকে। সাথে সাথে যেন বরফের মতো জমে গেল ডেভিড। ডেবরার হাত ভর্তি রক্ত। উজ্জ্বল লাল রক্ত। ঠিক ক্রিস্টালের গ্লাসে ওয়াইনের মতোই উজ্জ্বল।

‘ডেভিড’, ফিসফিস করে উঠল ডেবরা। আস্তে করে ঘুরলো ডেভিডের দিকে। তুমি এসেছো?”

শব্দ করে হতাশার শ্বাস বের হয়ে এলো ডেভিডের বুক চিরে। দেখতে পেল ডেবরার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। ঘন চোখের পাপড়িতে জড়িয়ে আছে জেলির মতো পদার্থ। অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী হয়ে উঠেছে রক্তাক্ত মুখোশ।

‘তুমি এসেছো ডেভিড?’ আবারো জানতে চাইল ডেবরা। অন্ধের মতো কিছু শোনার আশায় কান পেতে রইল ডেরা।

‘ওহ, ঈশ্বর ডেবরা।’ ডেবরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড।

‘আমি দেখতে পাচ্ছি না ডেভিড!’ হাত বাড়ালো ডেবরা। ওহ ডেভিড আমি দেখতে পাচ্ছি না।’

নিজের হাতে ডেবরার ভেজা হাত তুলে নিল ডেভিড। মনে হলো বুক ভেঙ্গে গেল তার।

.

ইন কারেম গ্রামের উপর আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে হাদাস্সাহ হাসপাতালের আধুনিক ভবন। দ্রুতগতিতে এসে পৌঁছালো অ্যামবুলেন্সের দল। ফলে বেঁচে গেল অনেক সংকটাপন্ন রোগী। হাসপাতাল ভরে গেল হঠাৎ যুদ্ধে আক্রান্ত আহতে-নিহতে।

তিনজন পুরুষ ব্রিগ, জো আর ডেভিড–সারারাত কাটিয়ে দিল হাসপাতালের ওয়েটিং রুমের কাঠের শক্ত বেঞ্চিতে বসে। আক্রমণের পেছনের কাহিনী জানতে পারার সাথে সাথে ব্রিগের কানে এসে তা ফিস ফিস করে জানিয়ে দিয়ে গেল সিকিউরিটি এজেন্ট।

গুপ্তঘাতকদের একজন ক্যাটারিং ফার্মের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কর্মচারী। আর অন্য দুজন তার চাচাতো ভাই, অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে যোগ দিয়েছিল তারই সুপারিশে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে তাদের কাগজপত্র জালিয়াতি হয়েছে।

হঠাৎ করে আসা কাজের কারণে প্রধানমন্ত্রী আর তার কেবিনেট বিয়ের আসরে আসতে দেরি করেছেন। কিন্তু আক্রমণের সময় রাস্তায় ছিলেন তারা। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তারা। ব্যক্তিগতভাবে আহত-নিহতের পরিবারের কাছে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

দশটার সংবাদে দামাস্কাস রেডিও একটি রিপোর্ট প্রচার করল। সাথে আল-ফাতাহ এ আক্রমণের দায়িত্ব স্বীকার করেছে। সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যরা করেছে কাজটি।

মধ্যরাতের খানিক আগে প্রধান অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এলো প্রধান সার্জন। তখনো থিয়েটারের সবুজ পোশাক আর জুতা পায়ে, মুখোশ ঝুলছে গলার কাছে। ব্রিগকে জানাল রুথ মোরদেসাইয়ের বিপদ কেটে গেছে। লাঞ্চ ফুটো করে কাঁধের নিচ দিয়ে বের হওয়া বুলেট ফেলে দিয়ে ফুসফুসকে সারিয়ে তুলেছে চিকিৎসকরা।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। বিড়বিড় করে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল ব্রিগ। পঁচিশ বছর ধরে একসাথে থাকা নারী ছাড়া কেমন অদ্ভুত মনে হলো জীবন। এরপরই তাকাল চোখ তুলে। “আমার মেয়ে?

মাথা নাড়ল সার্জন। চিকিৎসকরা এখনো ব্যস্ত তাকে নিয়ে। দোনোমনো করে উঠল সার্জন। কর্নেল হালমান কয়েক মিনিট আগে মারা গেছে।

এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল এগারোতে। আর চারজনের অবস্থা বেশ গুরুতর।

ভোরবেলা সৎকার বাহকেরা এসে পৌঁছালো কালো লিমুজিনে করে বাক্স নিয়ে। মৃতদেহ নিয়ে যাবে। ডেভিড মার্সিডিজের চাবি দিল জোর হাতে। যেন হান্নাহর মৃতদেহ নেয়া থেকে শুরু করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার যোগাড় করতে পারে সে।

পাশাপাশি বসে আছে ডেভিড আর ব্রিগ। চিন্তামগ্ন, নিঘুম চোখ। কাগজের কাপে করে কফি পান করছে।

সকাল পার হবার পরে চক্ষু বিশেষজ্ঞ এলো তাদের দিকে। চল্লিশ বছর বয়সী হলেও মসৃণ চেহারার তরুণ ভদ্রলোক। বলিরেখাহীন চেহারা আর পরিক্ষার নীল চোখের সাথে খাপছাড়া লাগল চুলের সাদাটে ভাব।

‘জেনারেল মোরদেসাই?”

শক্তভাবে উঠে দাঁড়াল ব্রিগ। মনে হলো এক রাতেই বয়স বেড়ে গেছে দশ বছর।

‘আমি ডাক্তার ইদেলমান। আমার সাথে আসুন দয়া করে।

ডেভিডও উঠে দাঁড়াল। কিন্তু ডাক্তার থেমে তাকিয়ে রইল ব্রিগের দিকে।

‘আমি ওর বাগদত্তা। ব্যাখ্যা করল ডেভিড।

‘প্রথমে আমরা একা কথা বললেই ভালো হবে জেনারেল। ইদেলমান চোখ দিয়ে পরিষ্কার সতর্কবাণী উচ্চারণ করল। মাথা নাড়ল ব্রিগ।

“প্লিজ, ডেভিড।

“কিন্তু’ আবারো কিছু বলতে চাইল ডেভিড। আস্তে করে তার কাঁধে হাত রাখল ব্রিগ। এই প্রথমবারের মতো কোন স্নেহবাৎসল্য প্রকাশ পেল দু’জনের মাঝে।

প্লিজ মাই বয়। ঘুরে দাঁড়িয়ে শক্ত বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড। নিজের ছোট্ট অফিসে গিয়ে কোণের ডেস্কের ওপাশে বসে সিগারেট জ্বাললো ইদেলমান। ভদ্রলোকের হাত দুটো মেয়েদের মতো চিকন আর লম্বা। একজন পেশাদার সার্জনের মতোই দ্রুত লাইটার জ্বেলে নিল।

‘আমার মনে হচ্ছে আপনি কোন ভণিতা পছন্দ করবেন না। সাবধানে প্রশংসা করল ব্রিগের। উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই বলে চলল ভদ্রলোক,

‘আপনার মেয়ের কোন চোখই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু হাত তুলে ব্রিগের ঠোঁটের কাছে স্বস্তির শব্দকেও থামিয়ে দিল ডাক্তার। ঘুরে তাকাল স্ক্যানারে ঝোলানো এক্স-রে প্লেটের দিকে। পিছনের লাইট জ্বালিয়ে দিতেই স্পষ্ট হয়ে উঠল ছবি।

‘চোখ দুটো পুরোপুরি অক্ষত, বাইরের দিকে প্রায় কোন ক্ষতিই হয়নি– কিন্তু, ক্ষতিটা হয়েছে এখানে, এক্স-রে প্লেটের এক জায়গায় ধোঁয়াটে অংশে শক্ত একটা কিছু দেখাল ডাক্তার। এটি একটি ইস্পাতের টুকরো, খুবই ছোট্ট, নির্ঘাৎ গ্রেনেড় থেকে এসেছে। একটা পেন্সিলের মাথার চেয়ে বড় নয়। ডান দিক দিকে খুলির ভেতরে ঢুকে পড়েছে। বড় একটা শিরা কেটে ফেলায় রক্তপাত হয়েছে। আই-বলের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ায় বিশেষ কোন টিস্যুর। গায়ে আঁচড়ও পড়েনি। কিন্তু অপটিক চিয়াশমা’র হাঁড়ের অংশে ঢুকে গেছে।

এক্স-রের উপর ছোট্ট ইস্পাতের টুকরো কোন পথে ডেবরার মাথায় ঢুকে গেছে দেখিয়ে দিল ডাক্তার। চিয়াশমা ফুড়ে বের হয়ে গেছে এটি। সিগারেটে লম্বা একটি টান দিয়ে ব্রিগের দিকে তাকাল ডাক্তার। কোন অনুভূতি বুঝতে পারল না।

এর মানে আপনি বুঝতে পারছেন জেনারেল?’ ডাক্তারের প্রশ্নে অদ্ভুতভাবে মাথা নাড়ল বিগ। এক্স-রে স্ক্যানারের লাইট বন্ধ করে দিল ডাক্তার। ফিরে এলো ডেস্কে। ব্রিগের সামনে একটি স্ক্র্যাপ খাতা টেনে নিয়ে নিজের পকেট থেকে পেন্সিল বের করল। একের পর এক টান দিয়ে এঁকে ফেলল অপটিক্যাল চার্ট, আই বস, ব্রেইন, অপটিক্যাল নার্ভ।

‘অপটিক্যাল নার্ভ প্রতিটি চোখ থেকে বের হয়ে এই সরু পথে গিয়ে ফিউজে পৌঁছায়। এরপর শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে যায়।

মাথা নাড়ল ব্রিগ। নিজের পেন্সিল দিয়ে নার্ভের ফিউজ দেখাল ডাক্তার। ব্রিগের ক্লান্ত চেহারায় ফুটে উঠল হতাশা।

‘অন্ধত্ব?’ বিগ্রের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ল ইদেলমান।

দুই চোখ?

‘আমার তাই মনে হচ্ছে।’

মাথা নামিয়ে নিজের চোখে হাত বুলাতে লাগল ব্রিগ। এরপর কথা বলল ইদেলমানের দিকে না তাকিয়ে।

‘চিরতরে? জানতে চাইল ব্রিগ।

‘ও আর কখনো রং, আকৃতি, আলো, অন্ধকার বুঝতে পারবে না? ছোট্ট ইস্পাতের টুকরা অপটিক চিয়াশমা ভেদ করে গেছে। সব দেখে মনে হচ্ছে নার্ভের বারোটা বেজে গেছে। মেডিকেল সায়েন্সে এমন কোন কৌশল এখনো নেই যা এটি ফিরিয়ে আনতে পারে। এক মুহূর্ত থেমে শ্বাস ফেলল ইদেলমান। সোজা কথায় বলতে গেলে আপনার মেয়ে আর কখনোই দুই চোখে দেখতে পাবে না।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে আস্তে করে মাথা তুলল ব্রিগ। তাকে জানিয়েছেন এ কথা? তাকাতে পারল না ইদেলমান।

‘আমি আশা করছিলাম যে আপনি বলবেন।

হ্যাঁ। মাথা নাড়ল ব্রিগ। এই-ই ভালো হবে। এখন দেখা করতে পারব ওর সাথে? জেগে আছে?’

‘হালকা সিডেটিভ দেয়া হয়েছে। কোন ব্যথা নেই শুধু একটু অস্বস্তি। বাইরে দিয়ে কিছুই বোঝা যাবে না। আর ইস্পাতের টুকরোটা বের করার কোন চেষ্টাও করা যাবে না। এর জন্যে বড় আকারের নিউরো সার্জারি লাগবে।’ উঠে দাঁড়িয়ে দরজা দেখিয়ে দিল ডাক্তার।

‘আপনি এখন দেখা করতে পারবেন। চলুন আমিই নিয়ে যাচ্ছি।’

ইমারজেন্সি থিয়েটারের বাইরের করিডোরের উভয় পাশের দেয়ালে স্ট্রেচারের সারি। নিজের অনেক অতিথিকে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকতে দেখতে পেল ব্রিগ! মাঝে মাঝে থেমে এক-দু’জনের সাথে কথা বলল সে। এরপর ইদেলমানের সাথে এগিয়ে গেল করিডোরের শেষ মাথায় রুমের দিকে।

জানালার নিচে লম্বা একটি বিছানায় শুয়ে আছে ডেবরা। চুলে লেগে আছে শুকনো রক্ত, বিবর্ণ দেখাচ্ছে ডেবরাকে। দুই চোখের উপরে মোটা তুলার ব্যান্ডেজ।

‘তোমার বাবা এসেছেন, মিস মোরদেসাই।’

ইদেলমানের কণ্ঠ শুনে আস্তে করে মাথা ঘুরালে ডেবরা।

‘ড্যাডি?

‘এই তো আমি, বাবা।

ডেবরার বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরল ব্রিগ। নিচু হয়ে কি করল হাতে। কড় জীবাণুরোধক ওষুধের গন্ধ আসছে।

“মাম্মা?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল ডেবরা।

‘বিপদমুক্ত। ব্রিগ আশ্বস্ত করল ডেবরাকে। কিন্তু হান্নাহ’ হ্যাঁ। ওরা জানিয়েছে আমাকে।’ বাবাকে থামিয়ে দিল ডেবরা। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে।

‘জো ভালো আছে?

‘ও অনেক শক্ত। ঠিক হয়ে যাবে।

‘ডেভিড? জানতে চাইল ডেবরা।

‘এই তো এখানে।

আগ্রহে এক কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে উঠে বসতে চাইল ডেবরা। চেহারায় ফুটে উঠেছে আশার আলো। চোখ বাঁধা অবস্থাতেও চারপাশে খুঁজছে। ডেভিড।’ ডেকে উঠল ডেবরা। কোথায় তুমি? ধুত্তোরি। এই ব্যান্ডেজ … কিছু ভেবো না ডেভিড। এগুলো শুধু চোখকে আরাম দেয়ার জন্য দেয়া হয়েছে।’

না। ডেবরার কাঁধে হাত রেখে শান্ত করতে চাইল ব্রিগ। ও বাইরে অপেক্ষা করছে। সাথে সাথে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠল ডেবরা।

‘ওকে আমার কাছে আসতে বলো প্লিজ।’ ফিসফিস করে উঠল ডেবরা।

‘হ্যাঁ। কিন্তু একটু পরে। প্রথমে কিছু কথা বলা প্রয়োজন-আমি কিছু বলতে চাই তোমাকে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা কথা।

মনে হলো বুঝতে পেরেছে ডেবরা। বাবার গলার আওয়াজে এমন কিছু টের পেয়েছে সে যে একেবারে চুপ করে গেল। সেই চিরাচরিত নৈঃশব্দ।

ব্রিগ একজন সৈন্য। যদিও চেষ্টা করল যতটা সম্ভব মোলায়েম স্বরে জানাতে; কিন্তু নিজের কষ্টের ভারে সেটুকুও পারল না ব্রিগ। বাবার হাতের মাঝে থাকা ডেবরার হাত কাঁপতে লাগল। তারপর হয়ে গেল নিস্পন্দ।

কোন প্রশ্ন করল না ডেবরা। পিতা-কন্যা বসে রইল চুপচাপ। প্রথমে কথা বলল ব্রিগ।

‘আমি ডেভিডকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। জানাল ব্রিগ। দ্রুত কথা বলে উঠল ডেবরা।

না। শক্ত করে বাবার হাত ধরল সে। না। আমি এখন ওর সাথে দেখা করব না। প্রথমে আমাকে সবকিছু নিয়ে ভাবতে হবে।’

ওয়েটিংরুমে ফিরে গেল ব্রিগ। আগ্রহ নিয়ে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। নিখাদ মুখশ্রীতে বিবর্ণ ছাপ।

ওকে থামিয়ে দিল ব্রিগ। নো ভিজিটরস। ডেভিডের হাত ধরল ব্রিগ। কাল পর্যন্ত ওর সাথে দেখা করতে পারবে না তুমি।

‘খারাপ কিছু হয়েছে? কী হয়েছে? ডেভিড চাইল ছাড়া পেতে। কিন্তু ব্রিগ তাকে ছাড়ল না।

‘খারাপ কিছু নয়। ও ভালো হয়ে যাবে কিন্তু কোন ধরনের উত্তেজনা সহ্য করতে পারবে না এখন। আগামীকাল ওর সাথে দেখা করতে পারবে তুমি।

.

অলিভস্ মাউন্টেনের উপর পারিবারিক ভূমিতে সমাহিত করা হলো হান্নাহকে। ছোট অন্তেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিল তিনজন পুরুষ আর কয়েকজন আত্মীয়, যাদের অনেককেই যেতে হলো আরো শোকসভায়।

হাই-কমান্ডের সাথে মিটিং আছে ব্রিগের। অফিসের গাড়ি তাই অপেক্ষা করছে বাইরে। পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হবে। কোন না কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে নির্ঘাৎ। সমস্যায় জর্জরিত ভূ-খণ্ডে আবারো শুরু হবে। হাঙ্গামা।

মার্সিডিজে উঠে নিঃশব্দে বসে রইল জো আর ডেভিড। ইঞ্জিন চালু করার কোন চেষ্টাই করল না ডেভিড। জো সিগারেট ধরালো দুজনের জন্য। দু’জনেরই মনে হলো কোন উদ্দেশ্য নেই জীবনের, কোথায় যাবার তাড়া নেই।

কী করবে এখন তুমি? জোর কাছে জানতে চাইল ডেভিড।

‘আমাদের হাতে দুই সপ্তাহ সময় ছিল। নিচে অ্যাশকেলনে যাবার কথা রুদ্ধ হয়ে গেল জোর গলা। আমি জানি না। কিছু করারও নেই, তাই না।’

‘চলো কোথাও বসে একটু ড্রিংক করি? মাথা নাড়ল জো। আমার ইচ্ছে করছে না। আমার মনে হয় বেসে ফিরে যাওয়াটাই ভালো হবে। আজ রাতে নাইট ইন্টারসেপশন হবার কথা।’

‘হ্যাঁ। ডেভিডও রাজি হয়ে গেল দ্রুত, ‘আমিও যাবো তোমার সাথে। আগামীকাল পর্যন্ত ডেবরার সাথে দেখা করতে পারবে না। মালিক স্ট্রিটের বাসাও শীতল আর শূন্য মনে হবে। হঠাৎ করে তাই তারও মনে হলো বেসে যাবার কথা।

মোলায়েম অন্ধকারে আকাশে চাঁদকে মনে হচ্ছে বাঁকানো সারাসিন ব্লেডের ফলা। আর উজ্জ্বল তারাগুলোকে দেখাচ্ছে মোটামোটা রূপালি পাথরের ন্যায়।

পৃথিবীর অনেক উপরে উড়ে বেড়ালো তারা। উঠে গেল দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে। হারিয়ে গেল নাইট ইন্টারসেপশনের প্রাত্যহিক দায়িত্বে।

টার্গেট হিসেবে ঠিক করা হলো নিজেদের স্কোয়াড্রনের মিরেজ। নেগেত এর অনেক উপরে স্ক্যানারে ধরাও পড়ল এটি। লক্ করল জো, জানিয়ে দিল ট্যাক আর রেঞ্জ। খুঁজে পেয়ে অবশেষে টার্গেট জেটের বিস্ফোরণ ঘটালো ডেভিড। মখমলের মতো কালো রাতের বুকে লাল হয়ে জ্বলতে লাগল এটি।

নিঃশব্দে টার্গেটের পেটের নিচে চলে গেল ডেভিড নিজের প্লেন নিয়ে। এরপরই খাড়া ভাবে উঠতে লাগল উপরে। ঠিক যেমন ভাবে একটা বারাকুজা নিচ থেকে উঠে সমূদ্রের উপরে হুটোপুটি করে। এতটাই কাছ দিয়ে গেল ডেভিড যে টার্গেট মিরেজ হন্যে হয়ে ঘরে ফিরতে চাইল। এক মুহূর্ত আগপর্যন্ত ও টের পায়নি ডেভিডের অস্তিত্ব।

দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিঃশেষিত হয়ে অসাড়ে ঘুমোলো জো। কিন্তু তার নিচের বাঙ্কেই জেগে রইল ডেভিড। খুব ভোরবেলা উঠে শাওয়ার সেরে জোকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে বের হয়ে আসল সে। গাড়ি চালিয়ে যখন জেরুজালেমের হাসপাতালে পৌঁছালো, ঠিক তখন উদয় হলো সূর্য। পাহাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়ল নরম সোনালি আর গোলাপি মুক্তার মতো আলো।

ডেস্কে নাইট সিস্টার জানাল, দুপুরবেলা ভিজিটিং আওয়ার্সের আগে ভেতরে যেতে পারবেন না আপনি। কিন্তু নিজের সবটুকু সৌন্দর্য ঢেলে দিয়ে হাসার চেষ্টা করল ডেভিড।

‘আমি শুধু জানতে চাই ও ভালো আছে তো? আমাকে সকালবেলা স্কোয়াড্রনে ফিরতে হবে।

কিন্তু মনে হলো ডেভিডের হাসি আর এয়ারফোর্সের ইউনিফর্ম কিছুই কাবু করতে পারেনি সিস্টারকে। নিজের লিস্ট চেক করে জানাল, আপনার ভুল হচ্ছে। আমাদের এখানে একজনেই মোরদেসাই আছেন। মিসেস রুথ মোরদেসাই।

‘ওর মা। জানিয়ে দিল ডেভিড। নিজের শীটে আবারও চোখ বুলাতে লাগল সিস্টার।

এই কারণেই আমি খুঁজে পাইনি।’ বিরক্তির স্বরে বিড়বিড় করে উঠল সিস্টার। গত রাতেই ডিসচার্জ হয়ে গেছে সে।’

‘ডিসচার্জড? হা করে তাকিয়ে রইল ডেভিড।

হ্যাঁ। গত রাতেই বাসায় ফিরে গেছে সে। এখন মনে পড়ল। তার বাবা এসে নিয়ে গেছে। আমি তখন মাত্র ডিউটিতে এসেছি। সুন্দর মতন মেয়েটার চোখে ব্যান্ডেজ।

‘হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল ডেভিড। ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

দৌড়ে সিঁড়ি টপকে মার্সিডিজের কাছে ছুটলো সে। পা দুটো মনে হচ্ছে বেশ হালকা। দুঃচিন্তার বোঝা নেমে গেছে অবশেষে মাথা থেকে।

ডেবরা বাসায় গেছে। ডেবরা ভালো আছে। নিরাপদ আছে।

দরজা খুলে দিল ব্রিগ। ডেভিড ঢুকলো প্রাণহীন বাড়িটাতে। এখনো ইউনিফর্ম পরে আছে। কিন্তু পোশাকের ভাঁজ নষ্ট হয়ে কুঁচকে আছে। ব্রিগের মুখের চারপাশে বলিরেখা; চিন্তা, কষ্ট আর ঘুমের অভাবে রক্তাক্ত চোখ।

‘ডেবরা কোথায়? আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল ডেভিড। কাঁধ নেড়ে একপাশে সরে ডেভিডকে ভেতরে ঢোকার জায়গা দিল ব্রিগ।

‘কোথায় ও? আবারো জানতে চাইল ডেভিড। নিজের স্টাডিতে নিয়ে ডেভিডকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল ব্রিগ।

‘কেন আমাকে কিছু বলছেন না? রেগে উঠতে লাগল ডেভিড। বড়সড় রুমটা ভর্তি বই আর পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহে। একটা চেয়ারে বসল ব্রিগ নিজে।

‘গতকাল তোমাকে বলতে পারিনি ডেভিড। ও আমাকে বলতে মানা করেছিল। আমি দুঃখিত।

কী কথা?’ সতর্ক হয়ে উঠল ডেভিড।

‘ও চিন্তা করার সময় নিয়েছিল–নিজের মন ঠিক করার। আবারো উঠে দাঁড়াল ব্রিগ। পায়চারি শুরু করল। শূন্য কাঠের মেঝেতে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল পদশব্দ। মাঝে মাঝেই থেমে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল কোন সংগ্রহ। মনে হলো সান্ত্বনা পেতে চাইছে তার মন।

চুপচাপ শুনে গেল ডেভিড। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ল। এমন ভাবে মাথা নাড়ল মনে হলো যা শুনছে সেটা সত্যি বলে মানতে নারাজ সে।

‘সুতরাং বুঝতেই পারছো, এটাই সত্যি। আর কোন আশা নেই। ও অন্ধ। হয়ে গেছে ডেভিড, পুরোপুরি অন্ধ। ও এমন একটা জগতে চলে গেছে যেখানে কেউ ওর সঙ্গী হতে পারবে না।

‘কোথায় ও? আমি ওর কাছে যেতে চাই।’ ফিসফিস করে উঠল ডেভিড। কিন্তু ব্রিগ মনে হলো শুনতেই পেল না। বলে চলল, ‘ও সিদ্ধান্ত নিতে সময় চেয়েছিল–আমি সে সময় দিয়েছি তাকে। গতরাতে, অন্তেষ্টিক্রিয়ার পরে আমি ওর কাছে ফিরে গিয়েছি, দেখেছি ও তৈরি হয়ে গেছে। সে এটা মেনে নিয়েছে, ভেবে দেখেছে কী করা দরকার।

‘আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই।’ আবারো বলে উঠল ডেভিড। আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।’

এবার ব্রিগ তাকাল ডেভিডের দিকে। গলা ধরে এলো সহানুভূতিতে। না, ডেভিড। এই তার সিদ্ধান্ত। তুমি আর কখনো ওর সাথে দেখা করবে না। তোমার কাছে ও মৃত। এগুলো তারই কথা। ওকে বলো আমি মারা গেছি। শুধু মনে রাখবে আমার জীবন্ত স্মৃতি।

বাধা দিল ডেভিড। উঠে দাঁড়াল। কোথায় ও? ধুত্তোরি বলছেন না কেন? গলা কাঁপছে তার। আমি এখনি ওর সাথে দেখা করতে চাই।’ দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। ঝটকা মেরে খুলে ফেলল দরজা। কিন্তু ধরে ফেলল ব্রিগ।

‘ও এখানে নেই।

তাহলে কোথায়? ফিরে তাকাল ডেভিড।

‘আমি তোমাকে বলতে পারব না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি ওর কাছে।

‘আমি ওকে খুঁজে বের করব

হয়তো যদি সাবধানে খোঁজো–কিন্তু এতে করে নিজের সম্মান আর ভালোবাসা হারাবে।’ বলে চলল ব্রিগ। আবারো ওর কথা পুনরাবৃত্তি করছি আমি ওকে বলল যে আমাদের মাঝে ভালোবাসা বা একে অপরের কাছে আমরা যা ছিলাম তার দাবি দিয়ে বলছি, ও যেন আমাকে আমার মতো থাকতে দেয়, কখনো আমার খোঁজ না করে।”

‘কেন? কিন্তু কেন?’ নাছোড়বান্দার মতো চিৎকার করতে লাগল ডেভিড। ‘ও কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে? ও জানে যে ও সব ধরনের আশার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। ও জানে যা ছিল অতীত আর কখনোই ফিরে আসবে না তা। ও জানে যেমনটা আশা করার অধিকার আছে তোমার তেমনটা আর হতে পারবে না সে। রেগে উঠে হাত ঝাড়া দিল ব্রিগ। শোন আমার কথা, ও জানে এটা স্থায়ী হবে না। ও আর কখনো তোমার স্ত্রী হতে পারবে না। তুমি এখনো অনেক তরুণ, প্রাণশক্তিতে ভরপুর’ তাকিয়ে রইল ডেভিড ও জানে ধীরে ধীরে এ ভালোবাসা নষ্ট হয়ে যাবে। এক সপ্তাহ, এক মাস অথবা এক বছর; তারপর এটা ধ্বংস হয়ে যাবে। একজন অন্ধ নারীর কাছে বাঁধা পড়বে তুমি। ও এটা চায় না। ও চায় এটা এখনই শেষ হোক, তাড়াতাড়ি টানাহেঁচড়া না করে এভাবেই ভালো’

‘থামুন। চিৎকার করে উঠল ডেভিড। দয়া করে চুপ করুন। অনেক হয়েছে।

চেয়ারে লাথি মারতেই গড়িয়ে পড়ে গেল ডেভিড। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দু’জনেই। দু’হাতে মুখ ঢেকে উঠে বসল ডেভিড। ছোট্ট জানালার নিচে দাঁড়িয়ে রইল ব্রিগ। বৃদ্ধ সৈন্যের মুখে এসে পড়ল সকালের আলো।

ও আমাকে বলেছে তোমাকে প্রতিজ্ঞা করাতে দ্বিধা করল ব্রিগ, মুখ তুলে তাকাল ডেভিড, প্রতিজ্ঞা করো তুমি কখনো ওকে খোঁজার চেষ্টা করবে না।’

না। গোয়াড়ের মতো মাথা নাড়ল ডেভিড।

কাধ ঝাঁকালো ব্রিগ। যদি তুমি না মানো, আমি তোমাকে বলব_ও আমাকে বলেছে তুমি বুঝবে, যদিও আমার মনে হয় বুঝবে না–ও বলেছে যে আফ্রিকাতে অ্যান্টিলোপ নামে সুন্দর একটা প্রাণী আছে। কখনো কখনো তাদের একজনকে শিকারি ধরে নিয়ে যায়–যা সিংহ খেয়ে ফেলে।

মনে হলো চাবুকের বাড়ি খেল ডেভিড। মনে পড়ল কোন এক সময় সে নিজেই কথাগুলো বলেছিল ডেবরাকে। তারা দুজনেই তখন ছিল তরুণ আর নির্ভার।

‘ঠিক আছে। অবশেষে বিড়বিড় করল ডেভিড। যদি এটাই চায় সে তাহলে আমি প্রতিজ্ঞা করছি ওকে খোঁজার চেষ্টা করব না। যদিও এটা প্রতিজ্ঞা করছি না যে ওকে বোঝাতে চেষ্টা করব যে ও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সম্ভবত আরো ভালো হয় যদি তুমি ইস্রায়েল ছেড়ে চলে যাও। পরামর্শ দিল ব্রিগ। সম্ভবত তোমার উচিৎ তোমার আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া; যেখান থেকে তুমি এসেছে। আর যা হয়েছে সব ভুলে যেও।

একমুহূর্ত থেমে কী যেন ভাবল ডেভিড। এরপর উত্তর দিল, না, আমার যা সবকিছুই এখানে। আমি এখানেই থাকবো।

‘ভালো। সিদ্ধান্তটা মেনে নিল ব্রিগ। এই ঘর তোমার জন্যে সব সময়েই খোলা।

‘ধন্যবাদ, স্যার।’ মার্সিডিজ যেখানে পার্ক করে এসেছে সেখানে চলে গেল ডেভিড। মালিক স্ট্রিটের বাসায় গেল। পা দিয়েই বুঝতে পারল কেউ এসেছিল।

আস্তে আস্তে হেঁটে বেড়ালো লিভিং রুমে, অলিভ-কাঠের তৈরি টেবিল থেকে উধাও হয়ে গেছে বইগুলো। চামড়ার কাউচের উপরে ঝোলানো নেই কাঁদেশ পেইন্টিং। বাথরুমে গিয়ে দেয়াল কেবিনেট খুলতেই দেখা গেল ডেবরার সব টয়লেট্রিজ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সমস্ত এক্সোটিক বোতল, টিউব, পট এমনকি ডেভিডের টুথব্রাশের পাশে থাকা ডেবরার টুথব্রাশও আর নেই।

ডেবরার ড্রয়ার শূন্য, ড্রেসগুলো নেই, তাগুলো খালি, ওর সমস্ত উপস্থিতির চিহ্নই মুছে ফেলা হয়েছে। শুধুমাত্র বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ওর পারফিউমের ঘ্রাণ আর রয়ে গেছে বিছানার উপরে আইভরি লেস কাভার।

বিছানার উপর গিয়ে বসল ডেভিড। লেসের উপর হাত বুলাতেই মনে পড়ে গেল অতীতের দিনগুলো।

বালিশের উপর পাতলা, চৌকোণা কিছু একটা পড়ে আছে। লেস্ কাভারের নিচে। কাভার তুলে সবুজ রঙের বইখানা হাতে তুলে নিল ডেভিড।

দিজ ইয়ার, ইন জেরুজালেম, বিচ্ছেদ হবার উপহারস্বরূপ পড়ে আছে বইটি। ঝাপসা হয়ে এলো ডেভিডের চোখ। নিজের এইটুকুই ফেলে গেছে ডেবরা।

.

অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো ইন কারেমে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সূচনা করল নতুন যুদ্ধ আর ভয়াবহতার। আন্তর্জাতিকভাবে বেড়ে গেল উদ্বেগ-উত্তেজনা। আরবীয় জাতিসমূহ বের করে আনল তেল বিক্রির অর্থে কেনা চমৎকার সব অস্ত্রের ভাণ্ডার। আরো একবার শপথ নিল যে তাদের কাছে প্যালেস্টাইন নামে পরিচিত ভূ-খণ্ডে আর একজনও ইহুদির ঠাই হবে না।

বিভিন্ন নাজুক টার্গেটের উপর শুরু হলো নির্দয় আক্রমণ, অরক্ষিত দূতাবাস আর দুনিয়া জোড়া কনস্যুলেটগুলোও এর হাত থেকে রেহাই পেল না। বিচ্ছিন্ন জনপদে পত্ৰবোমা আর স্কুলবাসে নাইট অ্যামবুশের সংখ্যাও বেড়ে গেল।

এরপর অবস্থা দাঁড়াল আরো গুরুতর। একেবারে সরাসরি ইস্রায়েলের হৃৎপিণ্ডে আঘাত নেমে এলো। সীমান্ত লঙ্ন, কমান্ডো ধাঁচের লুটপাট, আকাশ সীমা লঙ্ঘন, শেল নিক্ষেপ, হুমকিস্বরূপ জনসভা আর অস্ত্রের ঝনঝনানি সবকিছু মিলিয়ে ছোট ভূ-খণ্ডের ভূমিটুকু হয়ে উঠল অশান্ত।

ইস্রায়েলিরা অপেক্ষা করতে লাগল, শান্তির জন্য প্রার্থনা করতে লাগল– কিন্তু আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ল যুদ্ধে।

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ডেভিড আর জো উড়ে বেড়াতে লাগল। যেখানে যৌক্তিক চিন্তা আর কাজকর্মের উপর প্রধান হয়ে দাঁড়াল স্বভাবজাত পদক্ষেপ।

খুঁজে বের করা, চিনে নেয়া, কাছে যাওয়া, ধ্বংস করে দেয়া–এসব কাজে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল সকলে যে দুঃখ-শোকে কাতর হবার সময়টুকু পর্যন্ত রইল না।

তারপরেও ক্ষোভ আর যাতনা, যা বয়ে বেড়াচ্ছে জো আর ডেভিড, মনে হলো চড়ে রইল তাদের ঘাড়ের উপর। প্রতিশোধের নেশায় মত্ত রইল দু’জনে।

শীঘ্রিই তারা দুজনে যোগ দিল সাবধানে বাছাই করা অর্ধ-ডজন স্ট্রাইক দলে। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার জন্য তাদের ডেকে পাঠাল মরুর ফুল। বারংবার যুদ্ধের নির্দেশ এলো তাদের উপর। আর প্রতিবারই তাদের উপর হাই কমান্ডের বিশ্বাস হলো আরো পাকাঁপোক্ত।

নিজের ককপিটে বসে থাকে ডেভিড। পা থেকে মাথা পর্যন্ত গাড়ে জড়ানো ফুল-প্রেশার স্যুট। বন্ধ ফেইস-মাস্ক থেকে নিতে হয় অক্সিজেন। যদিও মিরেজ তখনো মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে। তার ককপিটের নিচে ফিউজিলাজের গায়ে চারটি কালো, লাল আর সাদা, ক্ষুদ্রাকৃতির গোলাকার চিহ্ন আঁকা রয়েছে। শত্রুর খুলি।

এর অর্থ মরুর ফুল ব্রাইট ল্যান্স ফ্লাইটকে বিশ্বাস করে উচ্চ আকাশে ‘রেড’ স্ট্যান্ডবাই’র দায়িত্ব অর্পণ করেছে। স্টার্টার লাইন প্লাগ-ইন করে তৈরি কমপ্রেসারে বাতাস ভরার জন্য আর বিশাল ইঞ্জিনকে জীবিত করে ভোলার জন্য। মোটরের চারপাশে জড়ো হয়েছে গ্রাউন্ড ক্রুরা। মাত্র সেকেন্ডের নোটিশেই উড়ে যাবার জন্য প্রস্তুত আছে মিরেজ বহর। ডেভিড আর জো উভয়েই প্রায় ষাট হাজার ফুট উপরেও সক্ষম থাকার মতো পোশাক পরে নিয়েছে। কেননা এতটুকু উচ্চতাতে যথাযথ প্রস্তুতি না থাকলে যে কোন মানুষের অংশে শ্যাম্পেনের মতো বুদবুদের নাচন শুরু হবে।

নিজের ছোট্ট ককপিটের মাঝে আটকে থেকে দিন-তারিখ-ঘণ্টার হিসেব করা ভুলে গেছে ডেভিড। শুধু মাত্র রেগুলার পনের মিনিট ব্রেক নিয়ে রুটিন চেক-আপ শেষ করে।

‘চেকিং ১১.১৫ আওয়ারসপনের মিনিটের বিরতি। মাইক্রোফোনে বলে উঠল ডেভিড। একই সাথে কানে ভেসে এলো জোর নিঃশ্বাসের শব্দ।

নিচে নামার সাথে সাথে যখন অন্য-ক্রু স্ট্যানড়বাইতে থাকা অবস্থায় অপেক্ষা করছিল, ডেভিড নিজের ট্রাক-স্যুট পরে দৌড়ে আসে পাঁচ থেকে ছয় মাইল। কেটে যায় শরীরের শক্তভাব। জড়তা ভাসিয়ে নেয় ঘাম। এরপরই শুনতে পায়–ইয়ারফোনে তীক্ষ্ণ চিৎকার আর কোন নতুন কণ্ঠস্বর,

‘রেড স্ট্যান্ডবাই—গো! গো!”

আদেশটি লাউডস্পিকারের মাধ্যমে আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারেও প্রতিধ্বনি তোলে। সাথে সাথে গ্রাউন্ড ক্রুরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজে। মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায় প্রি-ফ্লাইট রুটিন চেক-আপ। স্টার্টিং পজিশনে থ্রটল ঠেলে দেয় ডেভিড। জেগে উঠে ইঞ্জিন। সর্বশক্তি দিয়ে শুরু হয় ছুটে চলা।

সামনে ওঠে যায় ব্লাস্ট ডোর। ব্রাইট ল্যান্স, টু। লিভার পাওয়ার টেক অফ করছে।’

‘টু কনফর্মিং। উত্তর দেয় জো। উভয়ে উঠে যায় আকাশে।

ব্রাইট ল্যান্স, ব্রিগ বলছি? ব্রিগের গলা শুনেও অবাক হয় না ডেভিড। তার মনেই হয়েছিল যে কমান্ডের দায়িত্বে নির্ঘাৎ বিগ থাকবে। পৃথক কণ্ঠস্বর আর ব্যক্তিগত নামের ব্যবহার শত্রুকে কোনরকম মিথ্যে গুজব ছড়ানো থেকে বিরত রাখবে।

‘ডেভিড, উচ্চ আকাশে অনুপ্রবেশকারীর অস্তিত্ব টের পেয়েছি আমরা। চার মিনিটের মাঝেই আমাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করবে। যদি বর্তমান কোর্স অক্ষুণ্ণ রাখে। পঁচাত্তর হাজার ফুট উপরে এটির অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। তার মানে এটি একটি আমেরিকান ইউ টু। যদিও এটি হবার সম্ভাবনা বেশি তারপরেও রাশান স্পাই প্লেনও হতে পারে, যেটি আমাদের সাম্প্রতিক অস্ত্রের খোঁজে এসেছে।

“ঠিক আছে, স্যার। উত্তর দিল ডেভিড।

‘আমাদের আকাশ-সীমার বিরুদ্ধাচারণ করলেই স্টর্ম-ক্লাইম্ব করব আমরা।’

“ঠিক আছে, স্যার।

‘বিশ হাজার ফুট উপরে সমান্তরাল হয়ে যাও। ১৮৬ ডিগ্রি ঘুরে স্টর্ম ক্লাইম্বের জন্যে সর্বোচ্চ গতিতে উড়ে যাও।’

বিশ হাজার ফুট উপরে উঠে সোজা এগিয়ে যেতে লাগল ডেভিড। আয়নায় তাকিয়ে দেখল লেজের কাছে জোর মিরেজ। ব্রাইট ল্যান্স টু, লিডার বলছি। দৌড় লাগাও।’

টু কনফর্মিং।

নিজের লেজ জ্বালিয়ে নিল ডেভিড। থ্রটস খুলে সবোর্ড এয়ারবর্ন পজিশনে প্রস্তুত হলো। লাফ দিল মিরেজ। নাক খানিকটা নিচু করে গতি বাড়িয়ে নিল ডেভিড।

দ্রুত তাদের গতি বেড়ে হলো মাক ১.২, মাক ১.৫।

সবকিছুই আছে মিরেজে। শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ দুটি জিনিস মিসাইল আর উদ্বৃত্ত ফুয়েল ট্যাঙ্ক নেই। একমাত্র যে অস্ত্র বহন করছে তারা তা হলো দুটি ৩০ এম. এম. কামান।

হালকা ভাবে উড়ে গিয়ে পৌঁছে গেল বীরসেবা থেকে এইলাত পর্যন্ত। এ সময়ে একজন মানুষ হেঁটে হয়তো একটা ব্লক পার হতে পারবে বড়জোর। অবশেষে ১.৯ মাকে স্থির হলো তাদের গতি।

‘ডেভিড, ব্রিগ বলছি। তোমার গতিবিধি নজরে রাখছি আমরা। সঠিক কোর্স আর গতি ধরে এগোচ্ছো তুমি। ষোল সেকেন্ডের মাঝে ক্লাইম্ব করার জন্য প্রস্তুত হও।

“ঠিক আছে স্যার।

‘গণনা শুরু করছি, আট সাত, ছয় … দুই, এক। গোয় গোয়।

শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল ডেভিডের। মিরেজের নাক তুলতেই মুখ খুলে চিৎকার করে উঠল যুদ্ধ উত্তেজনায়। কিন্তু প্রেশার স্যুট সত্ত্বেও হঠাৎ করে দিক পরিবর্তনের ফলে সিট থেকে প্রায় পড়ে যাবার উপক্রম হলো। মাথার মাঝে ছলকে উঠল রক্ত। দৃষ্টি হয়ে গেল ধূসর থেকে কালো।

তারপর ও ঠিক-ঠাকভাবে উড়ে যেতে লাগল মিরেজ। ঝাপসা ভাব কেটে গিয়ে স্বচ্ছ হয়ে এলো দৃষ্টি। জি-মিটারের দিকে তাকাল ডেভিড। বুঝতে পারল গতি না হারিয়েও এতটা উচ্চতায় পৌঁছাতে গিয়ে নয়বার ধাক্কা খেয়েছে ওর শরীর।

এবার শান্ত হয়ে বসে সামনে তাকাল খোলা আকাশের দিকে। অলমিটারের কাঁটা ছুটছে ঊর্ধ্বমুখী।

নিচে পাথরের মতো অনড় জো’র মিরেজ। ঠাণ্ডা আর নিশ্চিত সুরে জানাল জো, ‘লিডার টু জানাচ্ছি, আমি টার্গেট দেখতে পেয়েছি।

এমনকি স্টর্ম ক্লাইম্বের মাঝে নিজের রাডার কাজে লাগিয়ে অনেক উপরে স্পাই প্লেনকে খুঁজে পেয়েছে সে।

তারা দু’জনে মিলে তীরের মতো ছুটে চলল সামনের দিকে। ধনুক তাদেরকে ছুঁড়ে দিয়েছে বহুদূরে। আকাশে কিছু সময়ের জন্য ঝুলে রইল দু’জনে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আবারো নেমে আসে মাটিতে। এই কয়েক মুহূর্তের মাঝেই শত্রুকে খুঁজে খুন করতে হবে তাদের।

নিজের সিটে হেলান দিল ডেভিড। অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেল আকাশ হয়ে গেল গাঢ় নীল। এরপরই আস্তে করে দেখা গেল মধ্যরাতের মতো কালো আবছায়া। মাঝে মাঝে তারার ঝিকিমিকি।

স্টাটোস্ফিয়ারের একেবারে উঁচু ধাপে উঠে গেছে তারা। পথিবীতে পরিচিত সবচেয়ে উঁচু মেঘেরও উপরে। ককপিটের বাইরে বাতাস হয়ে উঠল হালকা আর দুর্বল। জীবন ধারণের জন্য অপর্যাপ্ত। শুধুমাত্র কোনরকমে জ্বলতে লাগল মিরেজের ইঞ্জিন। ঠাণ্ডা বেড়ে দাঁড়াল ষাট ডিগ্রির মতো ভয়ঙ্কর বরফ অবস্থা।

ধীরে ধীরে দু’টো এয়ারক্রাফটের জীবনীশক্তি ফুরিয়ে এলো। উড়ে বেড়াবার সমস্ত সৌন্দর্য যেন হারিয়ে গেল। মহাকাশের অনন্ত নক্ষত্ৰ বীথির কোলে ঘুরে বেড়াতে লাগল তারা। বহুদূরে নিচে অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে উজ্জ্বল হয়ে রইল পৃথিবী।

কিন্তু চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করার এতটুকুও সময় নেই। হালকা বাতাসে হাচোড়-পাচোড় শুরু করল মিরেজ। নষ্ট হয়ে যেতে লাগল কন্ট্রোল সিস্টেম।

টার্গেটের পিছনে লেগে রইল জো। সাবধানে, দৃঢ় পদক্ষেপে অনুসরণ করে চলল নিঃশব্দে। কিন্তু হঠাৎ করেই এত উচ্চতায় খেই হারিয়ে ফেলল দুজনে।

সামনের দিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড। স্থির করার জন্য মিরেজের নাক সোজা করতে চাইল। কিন্তু সতর্ক সংকেত বেজে উঠল লাল আলো জ্বেলে। সময় আর উচ্চতা দুটোই বের হয়ে যাচ্ছে হাত গলে।

এরপরই হঠাৎ করে টার্গেটকে দেখতে পেল সে। মনে হলো একেবারে কাছে। বিশাল পাখা মেলে ভূতের মতো সামনে পড়ল, সামনে তাদের থেকে খানিকটা নিচে।

মরুর ফুল, ব্রাইট ল্যান্স বলছি। টার্গেট দেখতে পেয়েছি। আক্রমণের অনুমতি চাইছি।’ ডেভিডের ঠাণ্ডা গলার স্বর লুকিয়ে ফেলল হঠাৎ করে আসা রাগ আর ঘৃণা। টার্গেট প্লেনটাকে দেখার সাথে সাথে খেপে উঠল সে।

টার্গেট সম্পর্কে রিপোর্ট করো।’ ইতস্তত করতে লাগল ব্রিগ। একটা অচেনা টার্গেটের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়ে উঠতে পারে ভয়াবহ। মরুর ফুল, এটি একটি ইলুশিন মার্ক ১৭-১১। সেরকম দৃশ্যত কোন চিহ্ন নেই।’

আসলে কোন স্পষ্ট চিহ্নের দরকার নেই। একটা মাত্র জাতিরই হতে পারে এটা। খুব দ্রুত কাছে চলে যেতে লাগল ডেভিড। এর চেয়ে কম গতিতে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্য মেশিনের প্রায় ঘাড়ের উপর পৌঁছে গেল সে। প্রকাণ্ড পাখাগুলো এমন ভাবে নকশা করা হয়েছে যেন স্টাটোস্ফিয়া দুর্বল বাতাসেরও সমস্যা না হয়।

দ্রুত কাছে চলে যাচ্ছি। মরুর ফুলকে সাবধান বাণী জানিয়ে দিল ডেভিড। প্রায় দশ সেকেন্ডের মাঝে শেষ হয়ে যাবে আক্রমণের সুযোগ।

হেডফোনের নীরবতা ভঙ্গ হলো। নিজের কামান প্রস্তুত করে নিল ডেভিড। চোখের সামনে বড় হয়ে উঠতে লাগল স্পাই প্লেনটা।

তৎক্ষণাৎ হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল ব্রিগ। হতে পারে দেশের হয়ে বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। কিন্তু জানে যে এরই মাঝে স্পাই প্লেনের ক্যামেরা সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রেকর্ড করে নিয়েছে; যা শত্রু দেশের হাতে পড়লে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।

‘ডেভিড। কাটা কাটা স্বরে চিৎকার করে উঠল ব্রিগ। ‘ব্রিগ বলছি, আঘাত করো!

‘ঠিক আছে। নিজের মিরেজের নাক খানিকটা নিচু করল ডেভিড। বাধ্য মেয়ের মতো দায়িত্ব পালন করল মিরেজ।

টু, লিডার বলছি, আক্রমণ করছি।

“ঠিক আছে, লিডার।

খুব দ্রুত ইলুশিনের দিকে তেড়ে গেল মিরেজ। জানে যে হাতে মাত্র ‘ কয়েক সেকেন্ড আছে ফায়ার করার জন্য।

স্পাই প্লেনের পাখার উপর তাক করে ট্রিগারে চাপ দিল ডেভিড। সামনে তাকিয়ে যা দেখল মনে হলো বড়সড় একটা মাছের গায়ে আঘাত করেছে হারপুন।

তিন সেকেন্ড ধরে কামানের গোলা উগরে দিল ডেভিড স্পাই প্লেনের। কালো আকাশের পটভূমিতে উজ্জ্বল গোলা কাটতে লাগল পরপর। এরপর সামনে এগিয়ে বিশাল স্পাই দানবের পেটের নিচে চলে এলো ডেভিড। নিজের শক্তিও ফুরিয়ে এসেছে। মনে হলো কোন রকেট।

পাশে চলে এলো জোর মিরেজ। কাভার করতে লাগল ডেভিডকে। অসহায়ের মতো ঝুলতে লাগল স্পাই প্লেন। লম্বা গোলাকৃতি নাক নিয়ে কালো আকাশের বুকে শীতল তারার পানে ছুটতে লাগল।

ট্রিগারে চাপ দিল ডেভিড। কামানের গোলার সাথে সাথে বিস্ফোরিত হলো স্পাই প্লেন। একটা পাখা পুরোপুরি ছিটকে গেল। বাকি কাঠামোটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগল স্বর্গপানে।

‘হ্যালো, মরুর ফুল, ব্রাইট ল্যান্সের লিডার বলছি। টার্গেট খতম। নিজের কণ্ঠস্বর সংযত করতে চাইল ডেভিড। কিন্তু দেখল হাত কাঁপছে। এতটাই ঘৃণা জমে আছে যে শত্রুর মৃত্যুতেও শীতলতা কাটছে না।

আবারও ফায়ার ওপেন করার বোতামে চাপ দিল সে। জো, এটা হান্নাহর জন্য। কিন্তু মাত্র এবারই আর কোন উত্তর এলো না। এরপর ক্যারিয়ার বীমের ঝনঝনানি শুনে নিজের হোমিং সিগন্যাল অ্যাকটিভেট করল সে। নিঃশব্দে অনুসরণ করে বেসে ফিরে চলল জো।

.

ডেবরার প্রভাবে খানিকটা ধাতস্থ আচরণ করতে শিখেছিল ডেভিড। কিন্তু ওর প্রস্থানে আবারো খ্যাপাটে স্বভাব ফিরে এলো ডেভিডের মাঝে। তাই বেসে না থাকলেও উইং ম্যানের দায়িত্ব পালন করতে হয় জোকে।

নিজেদের অবসরের বেশির ভাগ সময় একত্রেই কাটায় তারা। যদিও নিজেদের ক্ষতি নিয়ে কখনো কথা বলে না; তারপরেও এর মাধ্যমেই আরো কাছাকাছি পৌঁছে গেল ডেভিড আর জো।

প্রায়ই মালিক স্ট্রিটেই ঘুমিয়ে পড়ে জো। নিজের বাসা এর চেয়েও সুনসান, মৃত্যুপুরী। এই সংকটে বিগ বাসায় যাবার তেমন সময় পায় না। ডেবরাও চলে গেছে। তাই মাও নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ভারে হয়ে পড়েছে বয়সের চেয়েও বুড়ো আর অথর্ব। শরীরে বুলেটের ক্ষত বুজে গেছে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষতগুলো সারাবার কোন ঔষধ নেই।

ডেভিডের উন্মত্ততার একমাত্র দাওয়াই হলো সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ভুলে থাকা। আকাশে থাকাকালীনই একমাত্র শান্তি খুঁজে পায় সে। মাটিতে নামলেই হয়ে ওঠে অস্থির। তার পাশে বিশাল চেহারার জো শান্ত হয়ে থাকে। হালকা হাসি আর সহজ কথা বলে কৌশলে সমস্যা থেকে দূরে রাখে ডেভিডকে।

স্পাই প্লেন বিস্ফোরণের ঘটনাতে সিরিয়া উস্কানিমূলক পন্থা অবলম্বন করল। হিসাব কষে ইস্রায়েলী আকাশ সীমানায় অনুপ্রবেশ করা, আইন অমান্য করতে লাগল। যখনি আবার আক্রমণের আশঙ্কা দেখতে লাগল, লেজ গুটিয়ে পালাতে লাগল নিজেদের সীমানায়।

দু’বার নিজের স্ক্যানিং রাডারে এহেন আচরণের সবুজ লুমিনাস আলো জুলতে দেখল ডেভিড। প্রতিবারই নিজের ভেতর বরফ শীতল রাগের কম্পন অনুভব করে অবাক হয়ে গেল আর ঘৃণা যা ভারী পাথরের মতো বোঝা হয়ে আছে তার বুকের উপর। তৎক্ষণাৎ জোকে নিয়ে আক্রমণে রওনা হয় ডেভিড। কিন্তু প্রতিবারই নিজেদের রাডারের মাধ্যমে সতর্ক হয়ে যায় সিরীয়রা। ঘুরে গিয়ে গতি বাড়িয়ে হাস্যকর ভাবে পালিয়ে যায়।

ব্রাইট ল্যান্স, মরুর ফুল বলছি। টার্গেট আক্রমণাত্মক নয়। আক্রমণের ধরণ পরিবর্তন করো।’ সিরিয়ান মিগ ২১ নিজেদের সীমান্ত অতিক্রম করে এসেছিল। প্রতিবারই নিঃশব্দে উত্তর দিয়েছে ডেভিড, টু লিডার বলছি, আক্রমণ ত্যাগ করে স্ক্যান পুনরায় শুরু করো।

এই কৌশল করা হয়েছিল ডিফেন্ডারদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য। ইন্টারসেপটর স্কোয়াড্রনে টেনশন তাই মারাত্মক হয়ে উঠল। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল তারা। অল্পের জন্য রক্ষা পেল কয়েকটি ঘটনা। রক্ত গরম হয়ে উঠতে লাগল সকলের। অবশেষে উপর থেকে হস্তক্ষেপ এলো। কেননা মরুর ফুল চাইল নিজের ছেলেদেরকে বশে রাখতে। নিজের ক্রুদের সাথে কথা বলার জন্য পাঠানো হলো ব্রিগকে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ব্রিফিং রুমের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে ব্রিগ বুঝতে পারল যে বাজপাখিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে চোখের উপর পট্টি বেঁধে পা ধরে রাখলেই ব্যাপারটা শেষ হয় না। কেননা মাথার উপর উড়ে বেড়াচ্ছে বুনোহাঁসের দল।

দার্শনিকের বেশ ধারণ করল ব্রিগ। তরুণ পাইলটদের কাছে থাকা নিজের সম্মানের সুবিধাটুকু নিতে চাইল।

‘যুদ্ধের উদ্দেশ্য শান্তি, যে কোন নেতার সবচেয়ে জরুরি যে রণকৌশল তা হলো শান্তি’ দর্শকদের মাঝ থেকে কোন সাড়া এলো না। নিজের পুত্রের কথা স্মরণ করল ব্রিগ। কেমন করে একজন প্রশিক্ষিত যোদ্ধার সামনে শান্তির কথা বলবে সে যে কিনা সদ্যই সমাহিত করে এসেছে নিজের নব পরিণীতা বধূকে? আবারো বলা শুরু করল ব্রিগ।

‘শুধুমাত্র একজন বোকাই শত্রুভূমিতে নিজেকে মৃত্যুর হাতে ছেড়ে দেবে। এবার সবার কাছাকাছি পৌঁছতে পারল ব্রিগ। আমি চাই না, তোমরা কেউ একজন এমন কিছু ঘটাও যার জন্য আমরা প্রস্তুত নই, আমি তাদেরকে কোন অযুহাত দিতে চাই না। তারা এটাই চায়’ সবাই মনোযোগী হয়ে উঠল। এমন কী একজনকে মাথা নেড়ে সম্মতিসূচক ভাবে বিড়বিড় করতেও দেখল বিগ।

যদি তোমরা কেউ বড়সড় কোন সমস্যা পেতে চাও তোমাদেরকে দামাস্কাসে যেতে হবে না, আমার বাসার ঠিকানা জানো সবাই। প্রথমবার হাসানোর চেষ্টা করল ব্রিগ আর পেরেও গেল। সবাই মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। তো এটাই ঠিক হলো যে আমরা সমস্যা চাই না। আমরা এর উল্টো পথেই হাঁটতে চাই—কিন্তু নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরে নয়। সময় যখন আসবে, আমিই তোমাদেরকে বলব, কোন নরম স্বর হবে না সেটা সবাই গর্জন করে উঠল, চাপা গরগরের শব্দ পেল ব্রিগ, শেষ করল, কিন্তু তোমাদেরকে এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’

উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চে এলো লে ডফিন।

যাই হোক তোমাদের সবাইকে একসাথে পেয়ে আমি একটা খবর দিতে চাই। এতে হয়তো সীমান্তে ওপারে মিগ ধাওয়া করতে চাও এমন গরম মাথাগুলো ঠাণ্ডা হবে। ব্রিফিং রুমের শেষে থাকা প্রোজেকশন বক্স খুললো লে ডফিন। বাতি বন্ধ করে দেয়া হলো, পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল, কয়েকজন কাশতে লাগলো, অভিযোগের সুরে বলে উঠল কেউ একজন।

‘কোন ফিল্ম শো দেখতে চাই না!’

হ্যাঁ। কর্নেল বলে উঠল, ‘আরো একটা ফিল্ম শো। এরপর পর্দায় ভেসে ওঠা ছবির সাথে সাথে বলে চলল কর্নেল, এটা একটা সামরিক গোয়েন্দা চলচ্চিত্র। বিষয়, নতুন গ্রাউন্ড-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম। যেটা আরব ইউনিয়নের সেনাবাহিনীকে দিয়েছে সোভিয়েট ইউনিয়ন। এই সিস্টেমের কোড নেম সার্পেন্ট। এটি বর্তমান স্যাম থ্রি’ সিস্টেমের উন্নত সংস্করণ। যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি তাতে দেখা গেছে যে সিরিয়ান প্রতিরক্ষা ব্যুহতে ব্যবহার হচ্ছে এটি। এছাড়া মিশরীয়রাও ব্যবহার করছে। পরিচালনা করছে রাশান প্রশিক্ষক দল। কর্নেল যখন কথা বলে চলল তখন নিজের চেয়ারে বসে সবার মুখের দিকে তাকাল ব্রিগ। পর্দার রূপালি আলোয় পড়তে চাইল তাদের ভাষা। সবাইকে বেশ মনোযোগী মনে হলো। তন্ময় হয়ে প্রথমবারের মতো দেখতে পাওয়া নতুন অস্ত্রের দিকে তাকিয়ে আছে যা কিনা হতে পারে ওদের মৃত্যুর কারণ।

‘একটি নির্দিষ্ট বাহন থেকে ছোঁড়া হবে মিসাইল। এখানে আকাশ থেকে ভোলা মোবাইল কলামের ছবি দেখতে পাচ্ছো তোমরা। খেয়াল করে দেখো প্রতিটি বাহনে এক জোড়া করে মিসাইল আছে। তাই বুঝতেই পারছো কতবড় হুমকি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে’।

ডেভিড মরগ্যানের সুদর্শন চেহারায় চোখে পড়ল। ব্রিগ দেখতে পেল সামনের দিকে ঝুঁকে পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে ডেভিড। সহানুভূতি আর দুঃখবোধ জেগে উঠল ছেলেটার জন্য–এর মাধ্যমে নতুন করে শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য হলো ছেলেটা, প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করে চলেছে ডেভিড।

সার্পেন্টের উন্নত নকশা সম্পর্কে এখনো তেমন কিছু জানা যায়নি। কিন্তু বিশ্বাস করা হচ্ছে যে অসম্ভব দ্রুত গতি সম্পন্ন এই মিসাইল সম্ভবত মাক ২.৫ গতিতে ছুটতে পারে। আর গাইডিং সিস্টেমে ইনফ্রা রেড হিট সীকার আর কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রাডার কন্ট্রোল উভয় ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে।

সুদর্শন তরুণের চেহারাটা দেখে ব্রিগ ভাবতে লাগল ডেবরা ভুল করেনি তো। হতেও তো পারে যে ডেভিড ব্যাপারটা মেনে নিতে পারতো না, পরক্ষণেই মাথা নাড়ল বিগ। সিগারেটের জন্য পকেটে হাত ঢোকালো। ছেলেটা একেবারে তরুণ, জীবনের স্বাদ এখনো ঢের বাকি, সুদর্শন চেহারা আর দৌলতের দাপটে অনেকটাই বখে যাওয়া। ও কখনোই মেনে নিয়ে চলতে পারতো না। সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে ডেবরা। বেশিরভাগ সময় তাই করেছে মেয়েটা। ঠিক পথটাই বেছে নিয়েছে। ডেবরা কখনোই ডেভিডকে ধরে রাখতে পারতো না। মুক্তি দিয়ে ভালই করেছে।

‘ধারণা করা হচ্ছে যে ১৫০০ থেকে ৭৫০০০ ফুট উচ্চতাতে টার্গেট খতম করতে সক্ষম সার্পেন্ট।

নড়েচড়ে বসল শ্রোতারা। এতক্ষণে পুরোপুরি বুঝতে পারল কতটা হুমকি সৃষ্টি করতে সক্ষম এই সার্পেন্ট।

ওয়ারহেডের মাধ্যমে টনখানেক বিস্ফোরণ বহন করা সম্ভব। এছাড়া একটা ফিউজ আছে। যদি টার্গেট ১৫০ ফুটের নিচে দিয়ে পার হয় তাহলে গুলি ছুড়বে এই ফিউজ। এই রেঞ্জের মাঝে তাই ভয়ানক হয়ে উঠবে এই সার্পেন্ট।’

তখনো ব্রিগ তাকিয়ে রইলো ডেভিডের দিকে। রুথ আর সে অনেক মাস হয়ে গেল বাসায় আসতে দেখেনি ছেলেটাকে। ঘটনাটা ঘটার পরে মাত্র দু’বার জোর সাথে সাবাথ সন্ধ্যায় গিয়েছিল। কিন্তু বাসার পুরো পরিবেশ ছিল আড়ষ্ট। সবাই খুব সাবধান ছিল যেন ভুলেও ডেবরা নাম না ওঠে। দ্বিতীয়বারের পর আর কখনোই যায়নি ডেভিড। তাও প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল

‘এই স্টেজে “স্যাম থ্রি”-র মতোই কৌশল ব্যবহার করতে হবে।’

‘প্রার্থনা করো আর সবাইকে গুড লাক!’ ছোট্ট আর্তনাদ করে উঠল কেউ কেউ। হেসে উঠল বাকিরা।

‘–যতটা সম্ভব মিসাইলের দিকে ঘুরে যাওয়া, নিজের জেটে ব্লাস্টের রেডিয়েশন নজরে রাখা। সার্পেন্টকে বাধ্য করো উপরে গুলি ছুঁড়তে। যদি কখনো এমন হয় যে মিসাইল পিছু ছাড়ছে না তাহলে সরাসরি সূর্যের দিকে ঘুরে যাবে। মিসাইল তখন সূর্যের রেডিয়েশনকে টার্গেট করবে।’

আর যদি এটা কাজ না করে?’ জিজ্ঞেস করে উঠল একটা কণ্ঠ। আরেকজন উত্তর দিল হালকা চালে, ‘নিচের বাক্যটা বলতে থাকবে বারবার : “শোন ও ইস্রায়েল, প্রভু আমাদের ঈশ্বর, প্রভু মাত্র একজনই।” পুরাতন রসিকতা শুনেও এবার কেউ আর হাসল না।

ব্রিফিং রুম থেকে বের হবার সময় ডেভিডের কাছে এলো ব্রিগ।

‘আমরা তোমাকে আবার কখন দেখতে পাবো ডেভিড? অনেক দিন হয়ে গেল।’

‘আমি দুঃখিত স্যার। আশা করি জো জানিয়েছে আমার অপারগতার কথা।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু জোর সাথে আজকেই আসো না কেন? ঈশ্বর জানে, খাবারে কমতি হবে না।

‘আজ রাতে আমার একটু ব্যস্ততা আছে স্যার।’ কৃতজ্ঞচিত্তে পাশ কাটলো ডেভিড।

‘বুঝতে পেরেছি।’ ও সি’র অফিসে যাবার সময় আবারো বলে উঠল ব্রিগ, ‘মনে রাখবে তোমার জন্য দরজা সবসময় ভোলা আছে।

‘স্যার!’ ব্রিগকে ডেকে উঠল ডেভিড। দ্রুত, অপরাধীর ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, ‘ও কেমন আছে স্যার? তারপর আবারী, ডেবরা কেমন আছে? ওর সাথে দেখা হয়েছে আপনার–মানে এর মাঝে?

‘ও ভালো আছে।’ ভারী স্বরে উত্তর দিল ব্রিগ। যতটা ভালো থাকা সম্ভব।’

‘ওকে বলবেন যে আমি জানতে চেয়েছি?

না।’ গাঢ় নীল চোখের আকুতি অগ্রাহ্য করে উত্তর দিল ব্রিগ। না, তুমি জানো আমি এটা করতে পারব না।’

মাথা নেড়ে ঘুরে চলে গেল ডেভিড। এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে নিঃশ্বাস ফেলে কর্নেলের রুমে ঢুকে গেল ব্রিগ।

ইন কারেমে জোকে নামিয়ে দিল ডেভিড। এরপর গাড়ি চালিয়ে পূর্ব জেরুজালেমের শপিং সেন্টারে এলো। নতুন সুপার মার্কেট মেলেখ জর্জ পঞ্চম এর সামনে পার্ক করে নামল সপ্তাহের বাজার করতে।

ফ্রিজারের ট্রের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল ল্যাম্ব কাটলেট নিবে নাস্টেক। তারপরই খেয়াল হলো যে তাকে কেউ দেখছে।

তাড়াতাড়ি ঘরে তাকাল ডেভিড। ঘন সোনালি চল ভর্তি মাখা নিয়ে মর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। দূরের একটা তাকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। বোঝা গেল চুল রঙ করা হয়েছে। কেননা গোড়ার দিকে কালো ছায়া দেখা যাচ্ছে। ডেভিডের থেকে নিঃসন্দেহে বড় হবে মহিলা। কোমর আর শরীরের উপরিভাগ বেশ স্ফীত। চোখের কোনে হালকা বলিরেখা। একদষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডেভিডের দিকে। এতই নগ্ন আগ্রহ চোখে যে হঠাৎ করে ডেভিডের নিজের নিঃশ্বাস হয়ে উঠল গরম। ঘুরে আবারো ফ্রিজারে মনোযোগ দিল ডেভিড। নিজের ওপরেই রেগে গেল আর অপরাধবোধ হলো মনে। অনেক অনেক দিন পর শরীরী আগ্রহ বোধ করল সে। ভেবেছিল আর কখনোই হবে না এমনটা। চাইল হাতের স্টেকের প্যাকেটকে ফ্রিজে ছুঁড়ে ফেলে চলে যেতে। কিন্তু পেটের মাঝে গুড়গুড় বোধ করছে। মনে হলো শিকড় গজিয়ে গেছে। তার। বুঝতে পারল তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মহিলা। নিজের হাতে মনে হলো নারী উপস্থিতির ছ্যাকা লাগল। নিঃশ্বাসে নারীসুলভ গন্ধ পেল

‘স্টেক’ই ভালো।’ মন্তব্য করে উঠল অচেনা নারী। হালকা মিষ্টি স্বরে ভেসে এলো কথাগুলো। চোখ দুটো সবুজ। দাঁতগুলো খানিকটা এলোমেলো হলেও সাদা। যতটা ভেবেছিল দেখা গেল বয়স তার চেয়েও বেশি। প্রায় চল্লিশ। সামনের দিকে অনেকটা উন্মুক্ত পোশাক।

মাঝে মাঝে মাশরুম রসুন আর লাল ওয়াইন দিয়ে রান্না করে দেখতে পারেন, ভাল লাগে।’

তাই?’ ফ্যাসফ্যাসে গলায় জানতে চাইলো ডেভিড।

হ্যাঁ। হেসে মাথা নাড়ল মহিলা ‘কে রান্না করবে? মা? স্ত্রী?

না। আমিই রান্না করব। একা থাকি আমি।’ জানিয়ে দিল ডেভিড। হেলে ডেভিডের খানিকটা কাছে এলো মহিলা।

মাথা ঘুরতে লাগল ডেভিডের। সুপারমার্কেটে আসার সময় ব্রান্ডি খেয়ে এসেছিল। সাথে খানিকটা আদা মিশিয়ে নিয়েছিল। খুব দ্রুত শেষ করেছে পুরো বোতল। বাথরুমে দৌড়ে গিয়ে বেসিনের উপর উগরে দিল সব। মনে হলো চারপাশের ঘরবাড়ি দুলছে চোখের সামনে। বেসিনের কোণা ধরে সামলালো নিজেকে।

মুখে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিল। পানির কণা ঝেড়ে ফেলে বেসিনে লাগানো আয়নায় নিজের চেহারা দেখে হাসতে লাগল বোকার মতো। চুলগুলো ভিজে গেছে। এসে পড়েছে কপালের উপর। এক চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো আয়নায় থাকা চেহারা ভেংচি মারছে তাকে।

হাই দেয়ার, বয়। বিড়বিড় করে তোয়ালের জন্য হাত বাড়ালো। দেখল পানি পড়ে টিউনিক ভিজে গেছে। বিরক্ত হলো মনে মনে। টয়লেট সিটের উপর ছুঁড়ে ফেলল তোয়ালে। ফিরে এলো লিভিং রুমে।

নেই নারী দেহ। চামড়ার কাউচে এখনো খানিকটা অংশ ডেবে আছে মহিলার ভারে। জলপাই কাঠের টেবিলে পড়ে আছে নোংরা কাপ প্লেট। সিগারেটের ধোঁয়া আর মহিলার সুগন্ধিতে আচ্ছন্ন রুমের বাতাস।

‘কোথায় তুমি?’ তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে উঠল ডেভিড।

‘এখানে বিগ বয়। বেডরুমে এলো ডেভিড। বিছানার উপর শুয়ে আমন্ত্রণ জানাল মহিলা।

‘কাম অন, ডেভি। ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে আছে মহিলার কাপড়।

লেস কাভারের উপর শুয়ে আছে মহিলা যা কিনা ডেবরার-রাগে উন্মুক্ত হয়ে উঠল ডেভিড।

‘ওঠো। কাটা কাটা স্বরে বলে উঠল ডেভিড।

‘ওঠো এই বিছানা থেকে। ডেভিডের শক্ত ভাব টের পেয়ে সতর্ক ভঙ্গিতে উঠে বসল মহিলা।

কী হয়েছে ডেভি?’

চলে যাও এখান থেকে। খেপে উঠল ডেভিড। যাও এখান থেকে বেশ্যা কোথাকার।’ কাঁপতে লাগল ডেভিড। চেহারা হয়ে উঠল বিবর্ণ, চোখ ভয়ঙ্কর নীল।

আতঙ্কিত হয়ে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে এলো মহিলা। চলে যাবার পর আবারো বাথরুমে ছুটে গিয়ে টয়লেট বোলে বমি করে দিল ডেভিড। এরপর বাসার সবকিছু পরিষ্কার করল। ধুয়ে ফেলল বাসন কোসন। চকচক না করা পর্যন্ত ঘষতে লাগল গ্লাসগুলো। অ্যাশট্রে পরিষ্কার করে জানালা খুলে তাড়িয়ে দিল সিগারেট আর পারফিউমের গন্ধ। এরপর সবশেষে বেডরুমে ঢুকে চাদর পাল্টে নতুন করে গোছালো বিছানা। লেস কাভারকে টানটান করে পেতে দিল আবারো।

পরিষ্কার টিউনিক আর ইউনিফর্মের টুপি পরে নিল। গাড়ি চালিয়ে গেল জাফা গেইট। বাইরের লটে গাড়ি পার্ক করে হেঁটে ঢুকলো পুরাতন শহরে। ইহুদি কোয়ার্টারের প্রার্থনা মন্দির বানানো হয়েছে নতুন করে।

উঁচু গম্বুজওয়ালা হলরুম হয়ে আছে শান্ত আর নিস্তব্ধ। শক্ত কাঠের বেঞ্চে বহুক্ষণ বসে রইল ডেভিড।

৪. ডেভিডের বিপরীত প্রান্তে

ডেভিডের বিপরীত প্রান্তে তাকিয়ে রইল জো। আরও তিন চারজন পাইলট নিজেদের চেয়ার টেনে এনে টেবিলের পাশে বসে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। ডেভিড আর জোর মাঝে দাবা খেলা প্রায় পৌরাণিক কাহিনীর সমতুল্য। হয়ে গেছে অন্যদের কাছে। সবাই তাই বেশ আগ্রহ নিয়েই তাকিয়ে আছে।

প্রায় আধডজন চাল দিয়ে জোর রুককে আটকে ফেলেছে ডেভিড। আর দু’বার চাল দিলেই ভেঙে যাবে রাজার প্রতিরক্ষাব্যুহ। তৃতীয় চালে নির্ঘাৎ পরাজয়। হাসতে লাগল ডেভিড। সিদ্ধান্ত নিয়ে নাইটকে বের করে আনল জো।

মাত্র এইটুকুতেই তুমি বাঁচতে পারবে না ডিয়ার। নাইটের দিকে প্রায় তাকালই না ডেভিড। রুককে আবারো আঘাত করল সাদা বিশপ দিয়ে।

কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেখতে পেল নাটকীয় ভাবে জোর মুখ থেকে উধাও হয়ে গেল দুঃশ্চিতার রেখা। হোসেফ মোরদেসাই এতক্ষণ কৌশল করেছে প্রতিপক্ষকে ফাঁদে ফেলার জন্য। তাড়াতাড়ি সতর্ক চোখে নাইটের দিকে তাকাল ডেভিড। বুঝতে পারল জোর দুর্গ পুরোপুরি অক্ষত। ওহ’ দেখেছো কতবড় চালাক। গুঙ্গিয়ে উটলো ডেভিড।

‘চেক!’ হাসিমুখে ঘোষণা করল জো। সৈন্যদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়ল ডেভিডের রানী।

‘চেক!’ বোর্ড থেকে সাদা রানী তুলে নিল জো। সাথে সাথে নড়বড়ে রাজা আর সামনের খোলা পথ বেছে নিল পালাবার জন্যে।

‘অ্যান্ড মেট। পেছন দিক থেকে আক্রমণে ছুটলো তার রানী। হাততালি দিয়ে হেসে উঠল উপস্থিত দর্শকেরা। ডেভিডের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো জো।

‘আবার?’ জিজ্ঞেস করতেই মাথা নাড়ল ডেভিড।

অন্যদের কাউকে ডেকে নাও। আমি এক ঘণ্টার জন্য বাইরে যাচ্ছি। নিজের আসন খালি করে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। বোর্ড আবার নতুন করে সাজালো জো। হেঁটে কফি মেশিনের কাছে গেল ডেভিড। জি স্যুট পরণে থাকায় আড়ষ্ট হলো চলা-ফেরা। কালো ঘন তরলে চার চামচ চিনি নিয়ে কু রুমের কোণার দিকে শান্ত একটা অংশ গিয়ে বসল।

একই টেবিলে বসে আছে কোঁকড়ানো চুলের পাতলা শরীরের একজন কিবুজনিক ছেলে। ডেভিডের সাথে ইতিমধ্যেই খানিকটা সখ্যতা গড়ে উঠেছে ছেলেটার। মোটাসোটা একটা উপন্যাস পড়ছে বসে বসে।

‘শালোম, রবার্ট কেমন আছো?

বই থেকে চোখ না তুলেই হাঁ সূচক মাথা নাড়ল রবার্ট। মিষ্টি গরম কফিতে চুমুক দিল ডেভিড। তার পাশে নিজের আসনে বসে অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল রবার্ট। আস্তে করে কাশলো। নিজের ভাবনায় ডুবে গেল ডেভিড। এত মাসের মাঝে প্রথমবারের মতো মনে পড়লো নিজের বাড়ির কথা। ভাবতে লাগল মিউজি আর বানি ভেন্টারের কথা। মনে পড়ল এই সিজনে ফলস বেতে ইয়ালো টেইল চলছে কিনা। কে জানে কেমন আছে হিল্ডারবার্গে প্রোটিয়ারা।

নিজের চেয়ারে বসে আবারো উসখুস করে উঠল রবার্ট। গলা পরিষ্কার করল কেঁশে নিয়ে। তার দিকে তাকাল ডেভিড। বুঝতে পারল বেশ আবেগ আপুত হয়ে পড়েছে ছেলেটা। ঠোঁট দুটো কাঁপছে, চোখ দুটোও বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

কী পড়ছো তুমি? অবাক হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে ‘টাইটেলে চোখ বোলালো ডেভিড। বইয়ের গায়ে লাগানো ধুলার জ্যাকেটের ছবিটা তৎক্ষণাৎ চিনতে পারল। খুব মনেযোগ দিয়ে দেখা একটি মরুভূমির ল্যান্ডস্কেপ। ভয়ঙ্কর সব রঙ আর বিশাল ভূমি। দুটি শরীর নারী আর পুরুষ, মরুভূমির মাঝ দিয়ে হেঁটে চলেছে হাতে হাত রেখে; পুরো আবহটাই বেশ রহস্যময়। ঝিম ধরা। ডেভিড বুঝতে পারলো কেবল একজনই এটা আঁকতে পারে ইলা কাঁদেশ।

বইটা নিচু করল বরার্ট। অদ্ভুত!’ আবেগে থরথর করছে ওর গলা। আমি তোমাকে বলছি ডেভি। একটা অসাধারণ। এত সুন্দর বই খুব কমই লেখা হয়েছে।

কেমন করে কী যেন টের পেল ডেভিড। পুরোপুরি নিশ্চয়তার ভার নিয়ে রবার্টের হাত থেকে নিল বই। চোখ রাখল টাইটেলে, ‘আ প্লেস অব আওয়ার ওন।’

তখনো কথা বলে চলেছে রবার্ট। আমার বোন আমাকে বলেছে এটা পড়তে। প্রকাশকের হয়ে কাজ করে সে। এটা পড়ে পুরো রাত কেঁদেছে। আমার বোন। একদম নতুন বই। মাত্র গত সপ্তাহেই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু নির্ঘাৎ এদেশে লেখা সবচেয়ে অসাধারণ বইগুলোর মাঝে একটি হতে যাচ্ছে এটি।’

মনে হলো কিছু শুনতেই পেল না ডেভিড। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। টাইটেলের নিচে ছোট করে লেখা লেখকের নামের দিকে।

‘ডেবরা মোরদেসাই।

আলতো করে বইয়ের মোড়কের গায়ে অক্ষরের উপর হাত বুলালো ডেভিড।

‘আমি এটা পড়তে চাই।’ বলে উঠল আস্তে করে।

‘আমার শেষ হলেই তোমাকে দেবো আমি। প্রতিজ্ঞা করল রবার্ট।

“আমি এখনি পড়তে চাই!

“উঁহু হবে না। প্রায় আতঙ্কিত হয়ে ডেভিডের কাছ থেকে বইটা কেড়ে নিল রবার্ট।

‘তোমার সময়ের জন্য অপেক্ষা করো কমরেড। জানিয়ে দিল সে।

চোখ তুলে তাকাল ডেভিড। রুমের ওপাশ থেকে তাকিয়ে আছে জো। অভিযোগের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল ডেভিড। তাড়াতাড়ি দাবা বোর্ডের দিকে চোখ নামিয়ে নিল জো। ডেভিড বুঝতে পারল বইয়ের কথা জানে জো। উঠে দাঁড়াল ওর কাছে যাবে বলে। গিয়ে কারণ জানতে চাইবে ওকে না জানাবার কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাঙ্কারে বেজে উঠল সাইরেন।

ল্যান্স স্কোয়াড্রনের ‘রেড স্ট্যান্ডবাই-এর সবাই। রেডিনেস বোর্ডে বিভিন্ন পদবীর পাশে লাল আলো জ্বলে উঠল।

ব্রাইট ল্যান্স।

‘রেড ল্যান্স।

ফায়ার ল্যান্স।’

নিজের ফ্লাইং হেলমেট ছো করে তুলে জি স্যুট পরিহিত ছুটতে থাকা শরীরগুলোর সাথে ছুটলো ডেভিড। কু-রুমের দরজার বাইরে কংক্রিটের টানেলে থাকা ইলেকট্রিক পার্সোনেল ক্যারিয়ারের উদ্দেশে ছুটছে সবাই। ঠেলেঠুলে তুলে জোর পাশে গিয়ে দাঁড়াল ডেভিড।

‘আমাকে বলনি কেন?’ জানতে চাইল জোর কাছে।

‘আমি বলতেই যাচ্ছিলাম, সত্যি।

হ্যাঁ। বুঝতে পেরেছি আমি।’ বিদ্রুপের স্বরে উত্তর দিল ডেভিড। ‘পড়েছো তুমি?

মাথা নাড়ল জো। আবারও জানতে চাইল ডেভিড, কী সম্পর্কে?

‘আমি তোমাকে বলব না। তুমি নিজেই পড়ো।

‘এটা নিয়ে ভেব না।’ বিড়বিড় করে উত্তর দিল ডেভিড। আমি পড়বো।’

হ্যাঙ্গারে পৌঁছে লাফ দিয়ে নিচে নেমেই ছুটলো মিরেজের দিকে।

বিশ মিনিটের মাঝে আকাশে উঠে পড়ল সবাই। তড়িঘড়ি আদেশ পাঠাল মরুর ফুল, যেন ভূমধ্যসাগরে ইন্টারস্পেশনে অংশ নেয় তারা। একটা এল আল ক্যারাভেল থেকে মে ডে কল এসেছে। তার পিছু নিয়েছে। মিশরীয় মিগ ২১ জে।

মিরেজ বহর আসতে দেখে পিছু হটে উপকূলের দিকে চলে গেল মিশরীয় মিগ। এয়ারলাইনারকে নিরাপত্তার চাদরে ঘিরে ফেলল মিরেজ বহর। বেসে ফিরে আসার আগে পাহারা দিয়ে লডে পৌঁছে দিয়ে এলো।

জি স্যুট আর ওভারঅল পরা অবস্থাতেই লে ডফিনের অফিসের সামনে থামলো ডেভিড। জোগাড় করে নিল চব্বিশ ঘণ্টার পাশ।

বন্ধ হবার মাত্র দশ মিনিট আগে পৌঁছালো জাফো রোডের একটা বুক স্টোরে।

দোকানের মাঝখানের টেবিলে পিরামিড আকৃতিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আ প্লেস অব আওয়ার ওয়ন।

‘অসাধারণ একটা বই। প্যাকেটে ভরতে গিয়ে জানাল সেলসগার্ল।

.

গোল্ডস্টার খুলে জুতা ছুঁড়ে ফেলে বিছানার লেইস কাভারের উপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল ডেভিড।

শুরু করল পড়া। শুধুমাত্র একবার বিরতি দিয়ে মাথার উপরের বাতি জ্বালিয়ে আরেকটা বিয়ার নিয়ে এলো। বইটা বেশ মোটাসোটা। ধীরে ধীরে পড়তে লাগল ডেভিড- প্রতিটি শব্দ আলাদা করে, মাঝে মাঝে একই অংশ দু’বার পড়ল।

এটা তাদের দুজনের কাহিনী। ডেবরা আর তার। শুরু হয়েছে। কোস্টাব্রাভার দ্বীপ থেকে। চমৎকার ভাবে উঠে এসেছে এ ভূমি আর মানুষের কথা। দ্বিতীয় সারির অনেক চরিত্রকে চিনতে পারল ডেভিড। জোরে জোরে প্রাণ খুলে হাসল মজার আর আনন্দের অংশগুলোতে। সব শেষে দুঃখের ভারে মনে হলো গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে এলো। গল্পের মেয়েটা মারা যাচ্ছে হাদ্দাসা হাসপাতালে। সন্ত্রাসীদের বোমার আঘাতে নষ্ট হয়ে গেছে তার অর্ধেক চেহারা। মেয়েটা চায় না ছেলেটা তার কাছে আসুক। শুধু চায় জীবিত অবস্থায় সে যেমন ছিল তেমন স্মৃতিই থাকুক ছেলেটার মনের মাঝে।

ভোর হয়ে এসেছে। কোথা দিয়ে রাত কেটে গেল টেরই পেল না ডেভিড। উঠে দাঁড়াল বিছানা থেকে। ঘুম হয়নি তাই মাথা পুরোপুরি হালকা। বিস্মিত হয়ে ভাবল ডেবরা কত সুন্দরভাবে তুলে এনেছে সবকিছু। ডেভিডের ভেতরটা কত গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে সে। এত সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছে অনুভূতিগুলো যে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

গোসল করে, শেভ সেরে আটপৌরে পোশাক পরে নিল ডেভিড। এরপর আবার এলো বিছানার উপর বইটার কাছে। মোড়ক পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবার জন্য পাতা উল্টালো। যা ভেবেছিল তাই। প্রচ্ছদ ডিজাইনে ইলা কাঁদেশ।’

এত সকালবেলা রাস্তা পুরো খালি। খুব দ্রুত গাড়ি চালাতে লাগল ডেভিড। সূর্য মাত্র উঠি উঠি করছে। জেরিখো গিয়ে উত্তর দিকে ঘুরে সীমান্তের রাস্তায় চলতে লাগল গাড়ি। মনে পড়লো আগেরবার তার পাশে বসে ছিল ডেবরা।

মার্সিডিজের গায়ে বাতাসের ঝাপটা যেন বলতে লাগল তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি করো।’ টায়ারের ঘর্ষণ নিয়ে এলো লেকের উপর।

প্রাচীন ক্রুসেডার দেয়ালের পাশে গাড়ি পার্ক করল ডেডিভ। লেকের তীরে বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটা শুরু করল।

চওড়া বারান্দায় নিজের ইজেলের সামনে বসে আছে ইলা। মাথায় পরে আছে প্রায় একটা ওয়াগন হুইলের মতো বড় স্ট্র হ্যাট। প্লাস্টিকের চেরী আর অস্ট্রিচের পাখা গোজা তাতে। এত বড় ওভারঅল পরে আছে যে দেখাচ্ছে সার্কাসের তাঁবুর মতো। আর সবকিছুর উপরে পড়ে আছে শুকনো ছোপ ছোপ রঙ।

শান্তভাবে ব্রাশ থামিয়ে চোখ তুলে তাকাল ইলা।

‘জয় হো হো তরুণ দেবতা। অভিবাদন জানাল ইলা। ভালই হলো দেখা হয়ে, কিন্তু আমার ছোট্ট অঙ্গিনায় পদধূলির কারণটা বলবে?

‘থামো ইলা, তুমি ভালই জানো আমি কেন এসেছি।’

‘ভালোই বলেছো। বুঝতে পারল কথা এড়িয়ে যাচ্ছে ইলা। উজ্জ্বল চোখে পরিষ্কার ফুটে উঠল দুষ্টুমি। এত সুন্দর ঠোঁট জোড়াতে কঠোর কথা মানায় না। বীয়ার খাবে, ডেভি?

না আমি বীয়ার চাই না। আমি জানতে চাই ও কোথায়?

‘কার কথা বলছি আমরা?

‘কাম অন, আমি বইটা পড়েছি। কাভার দেখেছি। ধুত্তোরি তুমি জানো আমি কার কথা বলছি।

একটুক্ষণ চুপচাপ থেকে ডেভিডের দিকে তাকাল ইলা। আস্তে করে জানাল,

‘হ্যাঁ। আমি জানি। একমত হলো ইলা।

‘আমাকে বলো কোথায় আছে ও?

‘এটা আমি করতে পারব না ডেভি। তুমি আর আমি দু’জনেই প্রমিজ করেছি। হ্যাঁ আমি তোমারটা জানি।

ইলা দেখল কেমন স্থবির হয়ে পড়ল ডেভিড। উদ্ধত স্বভাবের সুন্দর তরুণ দেহ কেমন শীতল হয়ে ঝুলে পড়ল। সূর্যের আলোয় অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল ডেভিড।

‘বিয়ারের চিন্তাটা কেমন মনে হয়, ডেভি? ফুল থেকে নিজের পাহাড় প্রমাণ শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াল ইলা। ছাদের দিকে গেল। ফিরে এসে লম্বা একটা গ্লাস ধরিয়ে দিল ডেভিডের হাতে। ছাদের শেষপ্রান্তে তেমন বাতাস নেই এরকম একটা জায়গায় একসাথে বসল দু’জনে। শীতের নরম রোদ এসে পড়ল গায়ে।

‘এক সপ্তাহ ধরে তোমার অপেক্ষা করছি আমি। বইটা প্রকাশিত হবার পর থেকে। আমি জানি দৌড়ে চলে আসবে তুমি-অসাধারণ হয়েছে। এমনকি আমি নিজেও অনেকদিন কেঁদেছি নষ্ট হয়ে যাওয়া কলের মতো। লজ্জিত স্বরে জানাল ইলা। তুমি নিশ্চয় ভাবতেও পারছে না যে এমনটা হতে পারে তাই না?

‘এটা আমাদের বই–ডেবরা আর আমার।’ জানাল ডেভিড। ও আমাদের কথা লিখেছে।

‘হ্যাঁ, একমত হলো ইলা। কিন্তু এতে সিদ্ধান্ত বদলায়নি। যে সিদ্ধান্তটা আমার মনে হয় ঠিক আছে।

‘আমার নিজের কথাই বর্ণনা করেছে সে, ইলা। যা কিছু আমি অনুভব করতাম এবং এখনো করি কিন্তু যা কখনো ভাষায় বলতে পারতাম না।’

‘এটা বেশ সুন্দর আর সত্যি। কিন্তু কেন বুঝতে পারছে না যে এতে ওর সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়েছে।

কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসি। ইলা আর ও আমাকে। চিৎকার করে উঠল ডেভিড।

‘ও চায় এনভাবেই সব ঘটুক। ও চায় না সব শেষ হয়ে যাক। ও চায় না সব নষ্ট হয়ে যাক।আবারো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ডেভিড। কিন্তু শক্ত হাতে তাকে থামিয়ে দিল ইলা। ও জানে আর কখনোই তোমার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারবে না। নিজের দিকে তাকাও ডেভিড, তুমি এখনো তরুণ আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর ও তোমাকে পিছনে ধরে রাখবে আর কোন এক সময় বিরক্ত হয়ে উঠবে তুমি।

আবারো বাধা দিতে চাইল ডেভিড। কিন্তু বিশাল মুঠি দিয়ে হাত চেপে ধরল ইলা। তুমি শিকলে বাঁধা পড়ে যাবে, কখনো ছেড়ে যেতে পারবে না ওকে। ও অসহায়। তোমার সারা জীবনের বোজা হয়ে যাবে ও–চিন্তা করো ডেভিড।’

‘আমি ওকে চাই।’ জেদী স্বরে বিড়বিড় করে উঠল ডেভিড। ওর সাথে দেখা হবার আগে কিছুই ছিল না আমার জীবনে আর এখনো নেই।

‘আস্তে আস্তে বদলে যাবে সব। হতে পারে ও তোমাকে কিছু শিখিয়েছে। তরতাজা অনুভূতি তরুণ বয়সের মতোই হারিয়ে যায়। ও চায় তুমি খুশি হও, ডেভিড। ও তোমাকে এতটাই ভালোবাসে যে মুক্তিই তোমাকে উপহার দিয়েছে। ও তোমাকে এতটাই ভালোবাসে যে তোমার খাতিরে এটুকুও ছেড়ে দিতে রাজি সে।’

‘ওহ গড।’ গুঙ্গিয়ে উঠল ডেভিড। যদি একবার তাকে দেখতে পেতাম। ছুঁতে পেতাম কয়েক মিনিট কথা বলতে পারতাম।

বিশাল ধড় নাড়াতে লাগল ইলা। ঝনঝন করে উঠল সব গহনা।

‘ও এতে একমত হবে না কিছুতেই।

‘কেন ইলা আমাকে বল কেন?’ আবারো গলা চড়ালো ডেভিড।

‘ও ততটা শক্ত নয়। জানে যে তুমি কাছে গেলে ও ভেঙ্গে পড়বে আর দু’জনের জন্য আরো বড় কোন বিপর্যয় ডেকে আনবে।’

এরপর পাশাপাশি চুপচাপ বসে রইল দু’জনে। তাকিয়ে রইল লেকের দিকে। গোলান হাইটসের উপর দিয়ে উঠে গেছে মেঘের সারি, শীতের রোদ পড়ে আরো সাদা হয়ে ভাসছে। নীল আর ধূসরের ছায়া মেখে উড়ে আসছে লেকের উপরে। ছাদের ওপাশ থেকে একঝলক ঠাণ্ডা বাতাসে খানিকটা কেঁপে উঠল ডেভিড।

নিজের অবশিষ্ট বীয়ার শেষ করল সে। আস্তে আস্তে আঙুল দিয়ে হাতের মাঝে ঘুরাতে লাগল গ্লাস।

‘আমি যদি কোন মেসেজ দেই, ওকে পৌঁছে দেবে প্লিজ?

‘আমার মনে হয় না’

‘প্লিজ ইলা, শুধু এই মেসেজটা।

মাথা নাড়ল ইলা।

‘ওকে বলো ও বইতে যতটা লিখেছে ঠিক ততটাই ভালোবাসি আমি ওকে। ওকে বলো যে এর উপরে ওঠাটাই যথেষ্ট হয়েছে। ওকে বলল যে আমি অন্তত একবারের জন্য চেষ্টা করার সুযোগ চাই।

চুপচাপ ডেভিডের কথা শুনল ইলা। মনে হলো শব্দের সন্ধানে বাতাসে হাত বাড়ালো ডেভিড, যা বললে রাজি হবে ডেবরা।

‘ওকে বলে’ থেমে গিয়ে মাথা নাড়ল। না এতটুকুই হবে। শুধু বলল যে আমি ওকে ভালোবাসি আর ওর সাথেই থাকতে চাই।’

ঠিক আছে ডেভিড আমি বলব ওকে।

আর আমাকে জানাবে ওর উত্তর?

‘কোথায় পাবো তোমাকে?’ ক্রু রেডি রুমের নাম্বার ইলাকে দিল ডেভিড।

‘আমাকে তাড়াতাড়ি ফোন করবে ইলা। অপেক্ষায় রেখো না।

আগামীকাল। প্রতিজ্ঞা করল ইলা।

সকালবেলা।

দশটা বাজার আগে। দশটা বাজার আগেই জানিয়ো।’

উঠে দাঁড়াল ডেভিড। তারপর হঠাৎ করেই সামনে ঝুঁকে কোঁচকানো চামড়ায় গালে চুমু খেলো।

‘ধন্যবাদ।’ জানিয়ে দিল ডেভিড।

‘তুমি ততটা খারাপ পুরাতন কোন ব্যাগ নও।’

‘ধূর হও আমার সামনে থেকে। চারপাশ থেকে ওডেসি ধেয়ে আসছে তোমার দিকে। আস্তে করে নাক টানলো ইলা। আমার মনে হচ্ছে আমি কান্না করে দেবো। আমি একা রেখে এ মুহূর্ত টুকু উপভোগ করতে চাই।’

খেজুর আর তাল গাছের নিচে লন পার হয়ে ডেভিডকে চলে যেতে দেখল ইলা। দেয়ালের গেইটের কাছে গিয়ে থেমে ফিরে তাকাল ডেভিড। এক সেকেন্ডের জন্য একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থেকে বের হয়ে গেল ডেভিড।

সে শুনতে পেল মার্সিডিজের ইঞ্জিন গর্জে উঠে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল দূরে। এরপর হাইওয়েতে উঠতেই চলে গেল। দক্ষিণে ছুটে চলল তীরের মতো। ভারী মন নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছাদ থেকে নামল ইলা। জেটির দিকে চলে যাবার জন্য নিচে নামল।

ঘাটে নোঙ্গর বাঁধা অবস্থায় দুলছে স্পিডবোট। এটাতে চড়ে ওপাশের সবচেয়ে বড় আর দূরের বোটহাউজে গিয়ে খোলা দরজায় দাঁড়াল ইলা।

ভেতরটা নতুন করে রঙ করে পুরো সাদা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আসবাবপত্রগুলোর সাধারণ আর সংখ্যায় কম। পাথরের মেঝেতে ঠাণ্ডা ভাব কাটানোর জন্য পাতা হয়েছে মাদুর। পুরোপুরি উল দিয়ে বোনা, মোটা আর ঘন। ফায়ারপ্লেসের পাশে পর্দা ঘেরা অংশে রাখা হয়েছে বিশাল বিছানা।

বিপরীত পাশের দেয়ালে একটা গ্যাস স্টোভ রাখা। ডাবল কুকিং রিং লাগানো। আমার বেশ কয়েকটা রান্নার পাত্র ঝোলানো আছে দেখা যাচ্ছে। ভেতরের দিকে একটি দরজা দিয়ে বাথরুমে যেতে হয়। মাত্র কয়েকদিন আগেই এগুলো বানিয়েছে ইলা।

মালিক স্ট্রিটের বাসা থেকে আনা একমাত্র আসবাব ইলা কাদেশের আঁকা ছবিটা সাদা দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দরজার দিকে মুখ করে। মনে হলো এতেই আলোকিত হয়ে উঠেছে সারা রুম। এর নিচে ওয়ার্কিং টেবিলে বসে আছে একটা মেয়ে। টেপ রেকর্ডার থেকে নিজের গলায় হিব্রুতে কিছু একটা শুনছে তন্ময় হয়ে। শূন্য অভিব্যক্তি নিয়ে পুরো মনোযোগ দিয়ে সামনের সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে।

মাথা নাড়ল। যা শুনল, হাসল। বন্ধ করে দিল রেকর্ডার। সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে দ্বিতীয় রেকর্ডারের দিকে ফিরল। চাপ দিল ট্রান্সমিট বোতামে। মুখের কাছে ধরল মাইক্রোফোন। অনুবাদ করা শুরু করল হিব্রু থেকে ইংরেজিতে।

দরজার কাছে এসে দাঁড়াল ইলা। দেখতে লাগল মেয়েটার কাজকর্ম। একজন আমেকিান প্রকাশক ইংরেজি স্বত্ব কিনে নিয়েছে। বইটার জন্য ডেবরাকে অগ্রিম ত্রিশ হাজার আমেরিকান ডলার দিয়েছে। আর বাড়তি পাঁচ হাজার ডলার অনুবাদের জন্য। কাজটা প্রায় শেষ করে এনেছে সে।

যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে ডেবরার মাথায় ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাচ্ছে ইলা। মুখের তামাটে চামড়ার তুলনায় জায়গাটা সাদা গোলাপি হয়ে আছে। মনে হলো ছোট কোন শিশু এঁকে রেখেছে উড়ন্ত সি-গালের ছবি। ভি আকারের দাগটা তুষার কণার চেয়ে তেমন বড় নয়। মনে হলো এতে মেয়েটার সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেছে। প্রায় একটা বিউটি স্পটের মতো।

এটা ঢাকার কোন চেষ্টাই করেনি সে। কালো চুলগুলো ঘাড়ের পেছনে টানটান করে বাঁধা। চামড়ার ফিরে দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কোন মেকআপ নেয়নি মেয়েটা তারপরেও মুখের চামড়া দেখাচ্ছে পরিষ্কার, উজ্জ্বল, টানটান আর মসৃণ।

ফিশারম্যানদের বিশাল জার্সি আর উলের স্ন্যাক্স থাকা সত্ত্বেও দেহ দেখাচ্ছে দৃঢ় আর কৃশকায়। প্রতিদিন নিয়ম করে সাঁতার কাটে মেয়েটা। এমনকি উত্তরে ঠাণ্ডা বাতাসও তাকে থামাতে পারে না।

দরজা পার হয়ে নিঃশব্দে ডেস্কের কাছাকাছি গেল ইলা। তাকিয়ে থাকল ডেবরার চোখে। যা সে প্রায়ই করে। কোন একদিন এই ছবিটা আঁকবে সে। বাইরে থেকে আঘাতের কোন চিহ্নই নেই। কিছুতেই বোঝা যায় না যে মেয়েটা দেখতে পায় না। উপরন্তু অনিন্দ্যসুন্দর চোখ দুটো দেখে মনে হয় যে সবকিছু গভীর পর্যন্ত দেখতে পায় ওদুটো। এতটাই স্বচ্ছ চোখ দুটো যে রহস্যময় মনে হয় এই প্রশান্ত ভাব। এই গভীরতা আর সবকিছু বুঝে নেবার ভাবটাকে মেন অদ্ভুত মনে হয় ইলার কাছে।

মাইক্রোফোনের সুইচ অফ করল ডেবরা। রেকর্ডিং বন্ধ করে মাথা না ঘুরিয়েই বলে উঠল,

‘ইলা, এসেছো তুমি?

‘কেমন করে এটা করো তুমি? বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল ইলা।

‘তুমি হাঁটার সময় বাতাসে তার শব্দ পাই আমি আর তারপর তোমার গন্ধ।

‘ঝড় তোলার মতো যথেষ্ট বড়সড় আমি। কিন্তু আমার গায়ের গন্ধ কী এতটাই বাজে?’ কিড়মিড় শব্দে অভিযোগ জানাল ইলা।

‘তোমার গা থেকে তারপিন, রসুন আর বীয়ারের গন্ধ আসে। নাক টেনে হাসল ডেবরা।

‘আমি ছবি আঁকছিলাম। রোস্টের জন্য রসুন কেটেছি আর একজন বন্ধুর সাথে বীয়ারও পান করেছি। একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল ইলা। বইয়ের কাজ কতদূর হয়েছে?

‘প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আগামীকাল টাইপিস্টের কাছে যেতে পারবে। কফি খাবে?’ উঠে দাঁড়িয়ে গ্যাস ষ্টোভের কাছে গেল ডেবরা। ইলা জানে সাহায্য করতে চাইলে কী ঘটবে। প্রতিবার আগুন আর গরম পানির কাছে ডেবরাকে যেতে দেখলে দাঁত ঠকঠক করতে থাকে ইলা। মেয়েটা ভয়াবহ রকমের স্বাধীনচেতা। অন্য কারো সাহায্য আর সহানুভূতি চায় না কিছুতেই।

ঠিকঠিক ভাবে সাজানো আছে রুমটা। প্রতিটি জিনিস জায়গামত রাখা আছে যেন ডেবরা হাত দেয়ার সাথে সাথে জিনিসটি পেয়ে যায়। নিজের এই ছোট্ট দুনিয়ায় নিঃসংকোচে চলাফেরা করে ডেবরা। স্বচ্ছন্দে নিজের কাজ করে, নিজের খাবার নিজেই তৈরি করে, মাথা উঁচু করে নিজের মতো বাঁচতে শিখে গেছে মেয়েটা।

সপ্তাহে একবার, জেরুজালেমে প্রকাশকের অফিস থেকে ড্রাইভার এসে ডেবরার লেখা আর টেপ নিয়ে যায়।

এছাড়াও সপ্তাহে একবার ইলার সাথে স্পিডবোটে করে লেকের ওপারে টিবেরিসে যায় ডেবরা। একসাথে কেনাকাটা সারে দু’জনে আর প্রতিদিন পাথরের জেটিতে একঘণ্টা সাঁতার কাটে। প্রায়ই একজন পুরোন জেলে যার সাথে ইতিমধ্যেই বেশ সখ্যতা জমে গেছে ডেবরার, এসে ওকে নিয়ে যায়। তারপর দুজনে মিলে মাছ ধরে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায় ডেবরাকে।

জেটির পাশে থাকা লনে, ক্রুসেডের প্রাসাদে আছে ইলার বন্ধুত্ব আর বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা আর এখানে নিজের ছোট্ট কুটিরে আছে নৈঃশব্দ আর নিরাপত্তা, দীর্ঘকালব্যাপী করার জন্য কাজ। রাতে সঙ্গ দেয় একাকিত্ব আর নিঃশব্দ কান্না। একমাত্র বালিশটা ভিজে নকশা হয়ে যায়, যার কারণ একমাত্র জানে ডেবরা।

ইলার চেয়ারের পাশে এক মগ কফি রেখে দিল ডেবরা। নিজের কফি নিয়ে বসলো বেঞ্চে।

এখন বল’, বলে উঠল ডেবরা।

‘নিজের চেয়ারে এরকম আড়ষ্ট হয়ে বসে আছো কেন? চেয়ারের হাতলে আঙুল কৈছো। ইলার দিকে তাকিয়ে হাসল ডেবরা। বুঝতে পারল অবাক হয়েছে ইলা।

‘আমাকে কিছু একটা বলতে চাও তুমি। তাই না?

‘হ্যাঁ।’ একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিল ইলা। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো। ডিয়ার’ লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলে উঠল। ও এসেছিল ডেবরা। আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। যেমনটা ভেবেছিলাম আমরাও।

টেবিলের উপর মগ নামিয়ে রাখল ডেবরা। একটুও হাত কাঁপল না, মুখে কোন ভাব ফুটলো না।

‘আমি ওকে বলিনি তুমি কোথায় আছো।

‘ও কেমন আছে ইলা? কেমন দেখাচ্ছিল ওকে?’

‘শুকিয়ে গেছে, খানিকটা। আমার মনে হয়েছে আর শেষবার যেমন দেখেছিলাম তার তুলনায় বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। কিন্তু এটাও মানিয়ে গেছে তাকে। ও এখনো আমার দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ।

‘ওর চুল’, জানতে চাইল ডেবরা।

‘হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়েছে। নরম, ঘন আর গাঢ় রঙের। কানের পাশে বেশি। পিছনে কোকড়া।

মাথা নেড়ে হাসল ডেবরা। ভাল লাগল শুনে যে ও চুল কাটেনি। দু’জনেই আবার চুপচাপ হয়ে গেল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলে উঠল ডেবরা, কী বলেছে ও? কী চায়?

‘তোমাকে একটা মেসেজ দিয়েছে।

‘কী?

পুরোপুরি ডেভিডের ভাষায় হুবহু বলে গেল ইলা। শেষ করার পর নিজের ডেস্কের সামনের দেয়ালের দিকে ঘুরে তাকাল ডেবরা।

‘প্লিজ এখন যাও, ইলা। আমি একটু একা থাকতে চাই।’

ও আমাকে বলেছে তোমার উত্তর জানাতে। আমি ওর কাছে প্রমিজ করেছি যে আগামীকাল সকালে ওকে ফোন করব।’

‘আমি পরে যাবো তোমার কাছে কিন্তু এখন আমাকে একটু একা থাকতে দাও প্লিজ। ইলা দেখল উজ্জ্বল অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল ডেবরার বাদামী গালের উপর।

চলমান পাহাড়ের মতো উঠে দাঁড়াল ইলা। চলে গেল দরজার কাছে। পেছনে শুনতে পেল কান্নার শব্দ, কিন্তু তাকাল না সে। পাথরের জেটি পার হয়ে ছাদে উঠে গেল। নিজের ক্যানভাসের সামনে বসে হাতে তুলে নিল ব্রাশ। শুরু করল ছবি আঁকা। বড় বড় আঁচড়ে ফুটে উঠল রাগ আর নিষ্ঠুরতা।

নিজের প্রেশার স্যুটের ভেতর ঘেমে নেয়ে উঠল ডেভিড। উদ্বিগ্ন মুখে অপেক্ষা করছে টেলিফোনের পাশে। কু-রুমের দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির প্রতিটি কাটা অনুসরণ করছে চোখ দিয়ে।

দশটার দিকে সে আর জো চলে যাবে রেড স্ট্যান্ডবাই হিসেবে হাই অলটিচড়ে হাতে মাত্র সাত মিনিট সময় আছে আর। এখনো ফোন করেনি ইলা।

হতাশায় ছেয়ে গেল ডেভিডের মন। বুকের মাঝে জমে উঠল রাগ আর ক্ষোভ। ইলা প্রতিজ্ঞা করেছিল দশটার আগেই ফোন করবে।

কাম অন, ডেভি। দরজার কাছ থেকে ডেকে উঠল জো। ভারী মন নিয়ে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। জোর পিছন পিছন চলল ইলেকট্রিক ক্যারিয়ারের দিকে। জোর পাশের আসনে উঠে বসতেই শুনতে পেল কু-রুমের ফোন বেজে উঠল।

‘দাঁড়াও।’ ড্রাইভারকে থামিয়ে দিল ডেভিড। দেখতে পেল রবার্ট ফোন তুলে কথা বলছে আর কাঁচের প্যানেলের মাঝ দিয়ে হাত নেড়ে ওকে ডাকছে।

‘তোমার ফোন ডেভি। দৌড়ে কু-রুমে গেল ডেভিড।

‘আমি দুঃখিত, ডেভিড। বহুদূর থেকে যেন ভেসে এলো ইলার কণ্ঠস্বর।

‘আমি অনেকক্ষণ থেকে চেষ্টা করছি। কিন্তু এখানকার এক্সচেঞ্জ

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। ইলাকে থামিয়ে দিল ডেভিড। এখনো রেগে আছে সে।

কথা বলেছিলে ওর সাথে?

‘হ্যাঁ ডেভিড। বলেছি। তোমার মেসেজ দিয়েছি ওকে।

কী উত্তর দিয়েছে ও?’ তাড়াতাড়ি জানতে চাইলো ডেভিড।

‘কোন উত্তরই দেয়নি।

‘এসব কী ইলা! নিশ্চয় বলেছে কিছু একটা।

‘ও বলেছে’ দ্বিধায় ভুগছে ইলা,

–আর এগুলোই ওর শব্দ–”মৃত কেউ জীবিতের সাথে কথা বলতে পারে না। ডেভিডের জন্য আমি এক বছর আগেই মৃত্যুবরণ করেছি।”

দুই হাত দিয়ে রিসিভার আঁকড়ে ধরল ডেভিড। তারপরও কাঁপতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে আবারো কথা বলে উঠল ইলা।

‘তুমি এখনো লাইনে আছো?

হাঁ, ফিসফিস করে উত্তর দিল ডেভিড।’ ‘আমি আছি এখানে।

আবারো চুপ করে গেল দুজনে। অবশেষে কথা বলল ডেভিড।

‘তো তাহলে এটাই।

হ্যাঁ। আমার বলতে ভয় লাগছে যে এটুকুই সব, ডেভি।

দরজার ওপাশ থেকে কাঁচের ভিতর দিয়ে মাথায় টোকা দিল জো।

‘অ্যাই ডেভি। শেষ করো এবার। সময় হয়ে গেছে চলো।’

‘আমাকে যেতে হবে, ইলা। ধন্যবাদ, যা করেছে সব কিছুর জন্য।’

‘গুড বাই, ডেভিড। ফোন রেখে দেবার পরেও ইলার কণ্ঠের সহানুভূতির ভাষা কানে বাজতে লাগল ডেভিডের। মিরেজের বাঙ্কারে জোর পাশের সিটে বসে মনে পড়ল আগুনে ঘি পড়ল। ধা ধা করে মাথায় চড়ে গেল রাগ।

জীবনে প্রথমবারের মতো মিরেজের ককপিটে বসেও শান্তি পেল না সে। ফাঁদে আটকা পড়া জন্তুর মতো হাসফাস করতে লাগল। রাগের চোটে ঘামতে লাগল দরদর করে। আর প্রতিটি পনের মিনিটের প্রস্তুতিপর্ব মনে পড়ল ঘণ্টার চেয়েও দীর্ঘ।

নিচে গ্রাউন্ড ক্রুরা খেলা করছিল। ডেভিড দেখতে পেল তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসছে, মজা করছে। তদের খুশি দেখে রাগে মনে হলো অন্ধ হয়ে যাবে ডেভিড।

‘মাথা মোটা গর্দভের দল! মাইক্রোফোনে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। মাথার উপরে থাকা লাউড স্পিকারে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল শব্দগুলো। ল্যান্স স্কোয়াড্রনের চীফ ইঞ্জিনিয়ার তাড়াহুড়ো করে ককপিটে তার পাশে উঠে তাকিয়ে রইল। আমার স্ক্রিনে ধুলা পড়েছে। হাত দিয়ে ইশারা করল ডেভিড। ‘তুমি কেমন করে ভাবলে যে তোমার ব্রেকফাস্টের নোংরা লেগে আছে এমন একটা স্ক্রিন নিয়ে আমি মিগ চালাব।’

ডেভিডের এহেন আচরণের কারণ ছোট্ট একটু কার্বন কণা যেটা ক্যানোপির চকচকে ভাবকে খানিকটা ধোঁয়াশা করেছে। চীফ ইঞ্জিনিয়ার তাবি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পরিষ্কার করল সবকিছু।

কিন্তু ডেভিড়ের মতো টপ বয়ের পক্ষে ব্যাপারটা বেশ অশোভন হয়ে গেল। হাঁ হয়ে গেল সবাই। যাই হোক, রেড স্ট্যান্ডবাইয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে জানে সবাই। তাই এর পাইলটদের নার্ভ সম্পর্কেও সচেতন সবাই।

“ঠিক আছে।’ ডেভিড বুঝতে পারল খানিকটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। নিচে নেমে যাবার আগে হাসল তাবি।

ঠিক সেই মুহূর্তে ইয়ারফোনে ক্লিক শব্দের সাথে সাথে শোনা গেল ব্রিগের কণ্ঠ। “রেড” স্ট্যান্ডবাই, যাও! গো!

পুরোপুরি মনোযোগ ঢেলে দিয়ে উত্তর দিল ডেভিড, হ্যালো, মরুর ফুল, ব্রাইট ল্যান্স, এয়ারবরণ অ্যান্ড ক্লাইম্বিং।

‘হ্যালো, ডেভিড। ব্রিগ বলছি। আমাদের আকাশসীমায় অনধিকার প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে কেউ। মনে হচ্ছে আরেকটা সিরিয়ান। ছাব্বিশ হাজারে আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি আসছে আর প্রায় তিন মিনিট লাগবে। আমরা গিডন প্ল্যানে অ্যাটাক করব। তোমার নতুন হেডিং ৪২° আর আমি চাই তুমি ডেকের ডান পাশে থাকবে।’

মাথা নেড়ে তৎক্ষণাৎ ঘুরে মিরেজের নাক নিচে নামিয়ে দিল ডেভিড। গিডন প্ল্যান মানে হলো অনেক নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া। ফলে শত্রুর রাডার খানিকটা অস্পষ্ট কাজ করবে পৃথিবীর উপরিভাগের নোংরা’র জন্য। ফলে একেবারে টার্গেটের নিচে স্টর্ম ক্লাইম্ব করার আগপর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব বোঝা যাবে না।

প্রায় মাটির কাছাকাছি নেমে এলো ডেভিড। পাহাড়ের উপর দিয়ে ওঠানামা করতে করতে এগোচ্ছে। এতটাই নিচু দিয়ে যে স্পষ্ট দেখা গেল কালো পারসীয় জাতের ভেড়া। ভয় পেয়ে পূর্ব দিকে জর্দানের দিকে দৌড় লাগাল ভেড়াগুলো।

‘হ্যালো ব্রাইট ল্যান্স, মরুর ফুল বলছি-আমরা তোমাকে ট্র্যাক করছি না। ভালোই হলো। মনে মনে ভাবল ডেভিড। তার মানে, শত্রুও তার দেখা পাচ্ছে না। টার্গেট খানিকটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। কো-অর্ডিনেট জানিয়ে দিল ব্রিগ–’নিজের কনট্যাক্ট স্ক্যান করো।’

প্রায় সাথে সাথে কথা বলে উঠল জো। লিডার, আমি টু বলছি। দেখতে পেয়েছি।’

নিজের রাডার স্ক্রিনে চোখ নামালো ডেভিড। জোর কথা মতো রেঞ্জ আর বিয়ারিং মিলিয়ে দেখল। এতটা নিচু দিয়ে উড়ে যাবার সময় এরকম মনোসংযোগে ব্যাঘাত হয়ে উঠতে পারে অত্যন্ত বিপজ্জনক। যাই হোক স্পষ্ট দেখতে পেল ডেভিড নিজেও।

আরো কয়েক সেকেন্ড উড়ে গেল তারা। এরপরই নিজের লুমিনাস চশমা তুলে নিল ডেভিড।

‘পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। রেঞ্জ ৯৬ নটিক্যাল মাইল। সমান তালে এগিয়ে আসছে। উচ্চতা ২৫৫০০ ফুট।

নিজের অতি পরিচিত রাগের দেখা পেল ডেভিড। মনে হলো পেটের ভেতর নড়াচড়া শুরু করল কুণ্ডুলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকা সাপ।

‘টু, টার্গেট ল করেছি। ইন্টারসেপ শন স্পিডে ছুটে যাচ্ছি।’

সুপারসনিক গতিতে ছুটে চলল মিরেজ। সামনে অনিন্দ্যসুন্দর পর্বতমালার সারি রূপালি আর ধূসর বর্ণ নিয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে চাইলে যে কোন কিছু কল্পনা করে নেয়া যায় সুউচ্চ কোন টাওয়ার, গর্বিত কোন মানব শরীরের উদ্ধত ভঙ্গি, দাবার বোর্ডের ঘোড়া সওয়ার, একপাল নেকড়ে, এরকম আরো বহু কিছু–তাদের মাঝে গভীর খাদগুলোতে ব্রিজ তৈরি করেছে রঙিন রংধনু। শত শত আছে এমন। হরেক রকমের রং, যেন পিছু ধাওয়া করল মিরেজের। এর অনেক উপরে অসহ্য রকমের নীল হয়ে আছে আকাশ। দ্রুত ধাবমান যুদ্ধপ্লেনের উপর চমকাচ্ছে সূর্যের আলো। এখানে টার্গেটের দেখা পাওয়া গেল না। তার মানে উপরে পর্বতের মেঘের ভাঁজে লুকিয়ে আছে। আবারো রাডার স্ক্রিনে তাকাল ডেভিড। স্ক্যান থেকে রাডার বের করে টার্গেটের উপর লক করল। আর যত এগিয়ে আসছে অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হচ্ছে সে।

তাদের সমান্তরালে উড়ছে টার্গেট প্লেন। স্টারবোর্ড সাইড থেকে বিশ মাইল সামনে। তাদের অনেক উপরে তাদের গতির অর্ধেকের খানিকটা বেশি, গতি নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। টার্গেটের পেছন দিকে সূর্য। আক্রমণের হিসেব কষতে লাগল ডেভিড।

‘স্টারবোর্ডের দিকে ঘুরে যাচ্ছি।’ জোকে সতর্ক করে দিল ডেভিড। পাশাপাশি চলে এলো দু’জনে। রেঞ্জ আর বিয়ারিং বলে চলল জো। বোঝ গেল এটা হেলেদুলে পেট্রোলে বের হয়েছে। খোশমেজাজে টহলদারি করছে। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে পেটের নিচে শিকারির অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই তার।

টু, দিস ইজ লিডার। সার্কিটে অস্ত্র ভরে নাও।

রাডার স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই উইপন কনসেলের মাস্টার সুইচে চাপ দিল ডেভিড। চালু করল এয়ার টু-এয়ার সাইড উইন্ডার মিসাইল, প্রতিটি পাখার নিচে ঝুলে আছে এগুলো। আর সাথে সাথে ইয়ারফোন শুনতে পেল নরম স্বরে হিসহিস শব্দ শুরু হলো। এর মানে মিসাইলগুলো এখন সুবোধ বালক হয়ে আছে কোন রকম ইনফ্রারেড জাতীয় রশ্মির দেখা পায়নি এখনো। পাবার সাথে সাথে শব্দ বেড়ে যাবে, গরগর করতে করতে ঘুরতে শুরু করবে। শিকারি কুকুরের মতো লম্ফঝম্ফ শুরু করে দেবে। ভলিউম কমিয়ে দিল ডেভিড, যেন তার নিজের কান ঝালাপালা হবার হাত থেকে বেঁচে যায়।

এরপর কামানের সুইচ সিলেক্ট করল ডেভিড। ঠিক তার সিটের নিচে রাখা জোড়া ৩০ এমএম অস্ত্রকে নিজ নিজ পড়ে প্রস্তুত করে রাখল। জয়স্টিকের মাথায় রাখা ট্রিগার আগে বাড়লো। আঙুল দিয়ে স্পর্শ করল ডেভিড।

‘টু, দিস ইজ লিডার। আমি সামনে বাড়ছি। এটা জোর জন্য সতর্কতা। এর মানে হলো জো যেন তার পুরো মনোসংযোগ রাডার স্ক্রিনে ঢেলে দেয় আর ডেভিডকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করে।

টার্গেট এখন দশটার ঘরে। রেঞ্জ ২-৭ নটিক্যাল মাইল।

সতর্কতার সাথে তল্লাশি শুরু করল ডেভিড। চারপাশে খোঁজা শেষ করে পৃথিবী পৃষ্ঠের কোন উঁচু মাথা অথবা মেঝের ভেতরেও নাক ঢুকিয়ে দিল। যেন শিকারি নিজেই না আবার শিকার বনে যায়।

এরপরই দেখতে পেল তাদের। হঠাৎ করেই অনেক উপরে মেঝের মাঝ থেকে বের হয়ে এলো পাঁচটি প্লেন। আর সাথে সাথে নিজ পরিপাটি চাদরের মতো সমান্তরাল হয়ে গেল। তখনি আবার রেঞ্জ জানিয়ে দিল জো।

১-৩ নটিক্যাল মাইল।’ কিন্তু টার্গেটের অডিটলাইন এতটাই তরতাজা যে কোন সন্দেহই রইল না যে দলটা মিগ ২১ জে।

‘টার্গেট দেখতে পেয়েছি আমি।’ জোকে জানিয়ে দিল ডেভিড। পাঁচটা মিগ ২১ জে। সাদামাটা কণ্ঠে ঘোষণা করল ডেভিড। কিন্তু এটা মিথ্যে হলো। অন্তত এবার তার বোবা রাগ ভাষা খুঁজে পেল। আকার আর রং বদলে হয়ে গেল কালো থেকে উজ্জ্বল আর ছুরির মতো তীক্ষ্ণ।

‘টার্গেট এখনো আক্রমণাত্মক। জো নিশ্চিত করল যে ওগুলো এখনো ইস্রায়েলি ভূমিতে আছে। কিন্তু ডেভিডের মতো নিরুত্তাপ শোনাল না ওর গলা। ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে ডেভিড বুঝে গেল জোর মনের মাঝেও ঝড় বইছে।

আরো পনের সেকেন্ড পরে শত্রুর পশ্চাদদেশে ঘুরে যাবে তারা। অবস্থানটুকু চিহ্নিত করে ডেভিড তাকিয় দেখল যে সামনে ভালো জায়গা রয়েছে এর জন্য।

শান্তভাবে এগিয়ে চলেছে শত্রু প্লেনবহর। লেজের নিজে বিপদ সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে আছে এখনো। সামনের স্ক্যানিং রাডারে কোন অস্তিত্বই নেই। ডেভিড বা জোর সূর্যের দিকে এগিয়ে চলেছে দলটা। ওখানে পৌঁছে ডেভিডও আক্রমণে নামবে। খাড়া উঠে গিয়ে শক্রর বহরের গায়ে আঘাত করবে। সামনের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল যে এক্ষেত্রে ভাগ্যও তাকে সহায়তার জন্যে এগিয়ে এসেছে। বিশাল উঁচু একটা মেঘ এমনভাবে এগিয়ে আসছে যে তার আড়ালে ঢাকা পড়ে ভালোভাবেই লাফ দিতে পারবে ডেভিড। নিজেকে কাভার করে এগোবে সে, ঠিক যেমনভাবে আফ্রিকার বোয়া শিকারিরা বন্য ষাড় নিয়ে লড়াই করে।

‘টার্গেট ফোর্স বদল করছে স্টার বোর্ডের দিকে। সাবধান করে দিল জো। সামনের দিকে ঘুরে যাচ্ছে মিগের বহর। সিরিয়ান সীমান্তে ধার ঘেঁষে চলতে শুরু করল। নিজেদের কাজ শেষ করেছে। অবিশ্বাসীদের মুখে ইসলামের রঙের ছিটে মেরেছে। এখন ফিরে যাচ্ছে নিরাপত্তা বলয়ে।

নিজের ভেতর ঠাণ্ডা রাগের ছোঁয়া পেল ডেভিড। মনোযোগ হয়ে উঠল আরো তীক্ষ্ণ। লাফ দেবার আগে আরো কয়েক সেকেন্ড সময় নিল। তারপর এসে পড়ল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। গলার স্বর একটুও কাঁপল না। ডেকে উঠল জো। কে ‘টু লিডার বলছি, ক্লাইম্ব দিতে যাচ্ছি।’

‘টু কনফর্মিং।

কন্ট্রোলে হালকা হয়ে বসল ডেভিড। আর এত দ্রুত প্লেন লাফ দিল যে মনে হলো পেট থেকে পশ্চাৎদেশ আলাদা হয়ে যাবে। প্রায় তৎক্ষণাৎ রাডার ইমেজ দেখতে পেল মরুর ফুল। যেহেতু ডেভিড প্লেন নিয়ে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠে গেল।

হ্যালো, ব্রাইট ল্যান্স। আমরা তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। বন্ধু বা শত্রুকে দেখাও।

ডেভিড আর জো দু’জনেরই বসে স্টার্ম-ক্লাইম্বের চাপ সহ্য করছে। কিন্তু নির্দেশ পেয়ে নিজেদের আইএফএফ সিস্টেম চালু করতেও ভুলল না। আইডেন্টিফিকেশন ফ্রেন্ড অর ফো এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে তাদের চারপাশের রাডার ইমেজ যে কোন গড়ন আলাদা আলাদা ভাবে ফুটে উঠবে।

“ঠিক আছে–তোমাদের আই এফ এফ পেয়েছি।’ জানাল ব্রিগ। মেঘের মাঝে ঢুকে সামনে এগোতে লাগল ডেভিড আর জো। এতটাই কাছে দেখাতে লাগল রাডার ইমেজ যে শক্র বহরের প্রতিটি প্লেন স্পষ্ট দেখতে লাগল ডেভিড।

‘টার্গেড গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্টারবোর্ডের দিকে টার্ন নিচ্ছে। তাড়াতাড়ি সতর্ক করে দিল জো।

ডেভিড নিশ্চিতভাবে জানে যে শত্রু বহর তাদের অস্তিত্ব টের পায়নি। কাকতালীয় ভাবেই মোড় নিয়েছে। স্কিনে তাকিয়ে দেখতে পেল প্রয়োজনমতো উচ্চতা পেয়ে গেছে সে। শত্রু বহরের থেকে দুই মাইল উপরে আছে সে। পেছনে সূর্য। এটাই মোক্ষম সময়।

ফাইনাল অ্যাটাক প্যার্টানের জন্য ঘুরে যাচ্ছি। জোকে জানাল ডেভিড। এগোতে লাগল দুজনে।

সামনে নির্ভার মনে উড়ে যাচ্ছে টার্গেট। সাইড উইডার মিসাইল শত্রুর উপস্থিতি স্বরূপ হালকা ইনফ্রারেড টের পেয়েছে। ডেভিডের ইয়ারফোনে মৃদু গর্জন শুরু করল তারা।

এখনো চারপাশে ঘন ধূসর মেঘ; এরপর হঠাৎ করেই খোলা পরিষ্কার আকাশে বের হয়ে এলো দু’জনে। তাদের ঠিক নিচেই সূর্যের আলোয় চকচক করছে রূপালি মিগ বহর। সুন্দর খেলনার মতো দেখতে প্লেনগুলোর গায়ে লাল, সাদা আর সবুজ রঙের নকশা। জ্যামিতিক নকশা কাটা পাখা।

ধীরেসুস্থে ভি-ফর্মেশনে উড়ছে প্লেনগুলো। সেকেন্ডের মাঝে তাদেরকে দেখে নিল ডেভিড। চারজন উইংম্যানই সিরিয়ান { বোঝা গেল যে তেমন কোন কন্ট্রোলের ধার ধারছে না। ওড়ার ভঙ্গিতেও কোন দেখনসই, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি নেই। খুব সহজেই কাবু করা যাবে এগুলোকে।

যাই হোক, লিডারের প্লেনের ফিউজিলাজে তিনটা লাল রিং দেখে বোঝা গেল যে এটা রাশান ইনস্ট্রাকটর। শিরার বয়ে চলেছে বাজপাখির রক্ত। শক্ত আর ধূর্ত আর কালো মাম্বার মতই রাগ।

‘পোর্ট টার্গেট দুটো এনগেজ করছি। জোকে নির্দেশ দিল ডেভিড। হেডফোনে মিসাইলের গর্জন বেড়ে গেল। নিজে শক্রর অস্তিত্ব টের পেয়ে খুনের নেশায় পাগল হয়ে উঠেছে ওগুলো।

কমান্ড নেটের সুইচ অন্ করল ডেভিড। হ্যালো মরুর ফুল, টার্গেটের উপর আঘাত করার নির্দেশ চাইছে ব্রাইট ল্যান্স।

প্রায় সাথে সাথে উত্তর এলো। ডেভিড ব্রিগ বলছি– দ্রুত কথা বলছে ব্রিগ,_আক্রমণ করবে না। আমি আবারো বলছি, টার্গেট ছেড়ে দাও তারা আমাদের জন্য হুমকি নয়। আক্রমণ স্থল ত্যাগ করো।’

হতভম্ব হয়ে গেল ডেভিড। নিচে মেঘের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল পেছনে পড়ে আছে জর্দানের বাদামী ভূমি। ভূমির উপর দিয়ে মাত্র একটা লাইন পার হওয়ায় বদলে গেছে তাদের ভূমিকা। কিন্তু টার্গেট এখনো হাতের কাছে। সহজেই আঘাত করা যাবে।

‘আমরা তাদেরকে আঘাত করব। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল ডেভিড। কমান্ড নেট বন্ধ করে জোর সাথে কথা বলল।

‘টু’ লিডার আক্রমণ করছি।

‘নেগেটিভ। আমি আবারো বলছি নেগেটিভ!’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল জো। টার্গেট বিধ্বংসী নয়।’

‘হান্নাহর কথা স্মরণ করো।’ মাস্কের ভেতরে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। ‘আমাকে নিশ্চিত করো। ট্রিগারের উপর চেপে ধরল আঙুল। স্পর্শ করল বাম পাশের রাডার।

জো মনে হলো দম বন্ধ করে বসে রইল খানিকক্ষণ। তরপরই কঠিন স্বরে ঘোষণা করল,

টু কনফর্মিং।’

‘তাদেরকে মেরে ফেলো জো। দাঁত কিড়মিড় করে ট্রিগারের স্প্রিং আলগা করে টেনশনমুক্ত হলো। মৃদু হিসহিস শব্দ শোনা গেল। কেঁপে উঠে পিছনে বের হয়েই ছোটা শুরু করল টার্গেটের দিকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই সচেতন হলো মিগ বহর।

চিৎকার করে সাবধান করল তাদের লিডার। পুরো কাঠামো পাঁচ ভাগে ভাগ হয়ে গেল। মনে হলো যে বারাকুড়াকে দেখতে পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল রূপালি সার্ডিনের দল।

সবচেয়ে কিনারে থাকা সিরিয়ানটা একটু ধীর গতিতে মোড় ঘুরলো। তখনি লেজে বাড়ি খেল সাইডইডার মিসাইল একসাথে দুটিই যাত্রা করল দূর আকাশে স্বর্গপানে।

শক ওয়েভের ধাক্কায় কেঁপে উঠল ডেভিডের মেশিন। কিন্তু শব্দ থেমে গেল দ্রুত; কেননা চোখের পলকে ভগ্নাংশে ভেঙ্গে গিয়ে মেঘের আঁধারে হারিয়ে গেল মিগ। একটা পাখা অনেক উপরে উঠে ছাইয়ের মতো ঝরে পড়তে লাগল নিচে। অল্পের জন্য বেঁচে গেল ডেভিডের মাথা।

দ্বিতীয় মিসাইল নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নিল লাল রিং আঁকা প্লেনটাকে। কিন্তু দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাল রাশান লিডার। শক্তভাবে মোড় ঘোরায় অল্পের জন্য হাত ফসকে গেল মিসাইলের। মিগকে আর অনুসরণ করতে পারলো না। ডেভিড নিজের মিরেজ নিয়ে ছুটলো রাশানের পিছনে। দেখতে পেল বহুদূরে মেঘের ভিড়ে সবুজ ধোঁয়া ছড়িয়ে বিস্ফোরিত হয়ে গেল মিসাইল।

ডান দিকে কাত হয়ে মোড় নিল রাশান। পিছু নিল ডেভিড। শত্রুর মেশিনের সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। পাইলটের বেগুনি রঙের হেলমেট, আইডেনটিফিকেশন মার্ক হিসেবে থাকা আরবী হরফ–এমনকি মিগের চকচকে ধাতব গায়ের প্রতিটি ধূলিকণা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে।

নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জয় স্টিককে পেছন দিকে টেনে ধরল ডেভিড।

এদিকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি টেনে ধরতে চাইছে ডেভিডকে। ফলে মনে হলো মাথা থেকে সব রক্ত বের হয়ে যাবে, চোখের সামনেটা হয়ে গেল ঝাপসা। শত্রুর পাইলটের হেলমেটের রং হয়ে গেল তামাটে বাদামী। ডেভিডের মনে হলো নিজের আসনে বসেই ভেঙেচুড়ে চুড়মার হয়ে যাবে সে।

কোমর আর পায়ের কাছে জি-স্যুট এঁটে বসে আছে। মনে হলো চেপে ধরে আছে কোন নিষ্ঠুর অজগর; চেষ্টা করছে কপালের খুলি চিড়ে ফেলে রক্ত শুষে নিতে।

ডেভিড চাইল শরীরের পেশীগুলোকে পাড়াতে। উপরের দিকে সামান্য কাত করল মিরেজ। চেষ্টা করল নিজের উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে আরো একবার শত্রুর উপর আঘাত হানতে।

চোখের দৃষ্টি আবারো ঝাপসা হয়ে এলো। নিজের সিটে পিন দিয়ে কেউ যেন আটকে দিল তাকে। মুখ হাঁ হয়ে গেল আপনাতেই। চোখের মণি মনে হলো ঠিকরে বের হয়ে আসবে। কন্ট্রোল কলামের উপর ডান হাত রাখতেই হিমশিম খেতে লাগল সে।

চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল স্টল ইন্ডিকেটরের কাঁটা নড়ছে। লাল বিন্দু জানিয়ে দিল যে এতটা সুপারসনিক গতি বিপদ বয়ে আনতে পারে তার জন্য।

ফুসফুস ভর্তি করে নিজের সমস্ত শক্তি এক করে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। ধূসর কুয়াশায় শুনতে পেল নিজের প্রতিধ্বনি। এই চেষ্টার ফলে মনে হলো ব্রেইনে রক্ত ফিরে এলো খানিকটা। চোখের দৃষ্টিও একটু স্বাভাবিক হলো। স্পষ্ট দেখতে পেল যে মিগ আবার চলে এসেছে তার নিচে।

ঘুরে গিয়ে রাশানের কামানের মুখ থেকে পালানো ছাড়া আর কোন পথ রইল না ডেভিডের। গড়িয়ে গিয়ে বের হয়ে আনল মিরেজকে। আফটারবার্নারস এখনো জ্বলছে। অসম্ভব রকমের ফুয়েল খরচ করছে।

একজন ব্যালে নর্তকীর মতোই ভারসাম্য বজায় রেখে ডেভিডের পিছু নিল রাশান মিগ। রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে ডেভিড দেখতে পেল তাকে আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে রাশান। আবারো গড়িয়ে উপরে উঠে ডান দিকে সরে গেল ডেভিড।

গড়িয়ে ঘুরে যাওয়া, জীবনের জন্য মোড় নেয়া। রাশানটাকে ভালই বুঝে নিল ডেভিড। প্রতিপক্ষ হিসেবে দুর্ধর্ষ রাশান দ্রুত আর নিখুঁতভাবে অনুসরণ করছে ডেভিডের প্রতিটি বাঁক আর মোড়ঘোরা। প্রতিবারই আঘাত করার চেষ্টা করছে।

কন্ট্রোল নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে ডেভিডের কাঁধ আর হাত ব্যথা হয়ে গেল। মাধ্যাকর্ষণের চাপ, ব্রেইনে রক্তের অভাব, নিজের ভেতর অ্যাড্রেনালিনের প্রবাহ সব কিছু মিলিয়ে অসুস্থ বোধ করতে লাগল ডেভিড। নিজের ভেতরের ঠাণ্ডা রাগটা মনে হলো জমাট বাঁধা হতাশায় রূপ নিল। কেননা প্রতিবারই ওর কোন চেষ্টা ব্যর্থ হতে লাগল রাশানের কাছে। প্রতিবারই ওর প্রায় কাঁধ অথবা পেট ছুঁয়ে বের হয়ে যেতে লাগল মিগ। সমস্ত দক্ষতা, পাইলট হিসেবে সহজাত বোধ, সবকিছু মনে হলো নষ্ট হয়ে যেতে লাগল। বোঝা গেল শক্রর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আরো বেশি।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একবার যখন তারা প্রায় পাখায় পাখায় লেগে আছে মাঝখানের ফাঁকটুকু দিয়ে মানুষটার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেল ডেভিড। অক্সিজেন মাস্কের উপর দিয়ে কপাল আর চোখ। হাড়ের মতো ধূসর আর বিবর্ণ চামড়া। চোখগুলো খুলির একেবারে গর্তের মাঝে বসানো। আবারো মোড় নিল ডেভিড। ঘুরতে লাগল আর চিৎকার করতে লাগল। মাধ্যাকর্ষণের চাপ, ভয় সবকিছু চাইল চিৎকার করে তাড়িয়ে দিতে।

মাত্র অর্ধেক ঘোরা শেষ করে তারপরেই আবার কোন চিন্তা না করে উল্টো দিকে ঘুরে গেল। প্রতিবাদ জানাতে চাইল মিরেজ। গতি গেল কমে। রাশানটা দেখতে পেয়েই চলে এলো ডেভিডের স্টারবোর্ড কোয়ার্টারের দিকে। জয়স্টিক পুরো সামনের দিকে ঠেলে দিল ডেভিড। মাধ্যাকর্ষণের চাপে মাথা থেকে যে রক্ত সরে গিয়েছিল এখন সেটা শরীরের উপর দিকে বইতে লাগল। চোখের সামনে নাচতে লাগল বিভিন্ন রং। প্রেশারের ফলে নাকের নিচে একটি শিরা দপদপ করতে লাগল। তারপরই তার অক্সিজেন মাস্ক ভরে গেল রক্তে।

রাশানটা এখনো তার পেছনে লেগে আছে।

মুখ ভর্তি রক্ত নিয়েই চিৎকার করে উঠল ডেভিড। আবারো সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ধরল জয়স্টিক। আবারো মনে হলো রক্ত সরে গেল মাথা থেকে। সেকেন্ডের মাঝে লাল থেকে সব কালো রং ভাসতে লাগল চোখের সামনে। রাশান মিগ এখন ওর উপরে। উপরের দিকে গুতো দিল ডেভিড। শত ভাগের এক ভাগ সেকেন্ড সময় দেরি করাতেই নিজের কামান থেকে গুলি ছুড়লো ডেভিড। খোলা আকাশে মনে হলো বাগানের হোস পাইপ থেকে পানির মতো গুলিবৃষ্টি শুরু হলো। পাইলটের কেবিনে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠতে দেখল ডেভিড। ঘুরে উল্টো দিকে চলতে লাগল ডেভিড। রাশান ককপিট থেকে উড়তে দেখা গেল সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডুলি।

আমি পেরেছি; উচ্ছস্বিত হয়ে ভাবতে লাগল ডেভিড। ভয় চলে গিয়ে আবারো ফিরে এলো রাগ। ভয়ঙ্কর রাগ। আবারো মিরেজ নিয়ে উপরে উঠে গেল ডেভিড। কামানের গান সাইটের মাঝখানেই দেখা গেল রাশান মিগ।

এক সেকেন্ডের জন্য গুলি ছুড়লো ডেভিড। শেল গিয়ে আঘাত করল মিগ এর রূপালি ফিউজিলাডে।

একটু মোড় ঘুরেই সোজা ছুটলো রাশান মিগ। সম্ভবত কন্ট্রোলে বসে আছে মৃত পাইলট।

আবারো এক সেকেন্ডের জন্যে গুলি ছুড়লো ডেভিড। ভেঙ্গে চুরে পড়তে লাগল মিগ। ডেভিডের দিকে উড়ে আসতে লাগল অচেতন কিছু আবর্জনার অংশ। কিন্তু মেশিনের সাথে রয়ে গেল রাশান। আবারো দুই সেকেন্ডের জন্য গুলি ছুড়লো ডেভিড। এবার নিচের দিকে নেমে গেল মিগের নাক। রূপালি বর্শার মতো নেমে যেতে লাগল নিচে। ডেভিড তাকিয়ে দেখতে লাগল অন্তত মার্ক ২ এর বেশি গতি নিয়ে ছুটতে লাগল রাশান মিগ। এরপরই ধুলা আর ধোঁয়া ছুটিয়ে বোমার মতো আঁছড়ে পড়ল সিরিয়ার সমভূমিতে।

আফটারবার্নার বন্ধ করে ফুয়েল গজের দিকে তাকাল ডেভিড। শূন্য হবার কাটার খানিকটা উপরে হালকা রেখা দেখা গেল। বিপদ টের পেল ডেভিড। শত্রুভূমির উপর মাত্র পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে আছে সে।

মূল্যবান ফুয়েলটুকু নষ্ট করে পশ্চিমে ছুটলো ডেভিড। ইন্টারসেপশন স্পিড় নিয়ে উড়তে লাগল। চেষ্টা করছে দ্রুত সরে যেতে আর উপরে স্বর্গের দিকে তাকিয়ে চাইল খুঁজে দেখতে জো বা অন্য কোন মিগের দেখা পাওয়া যায় কিনা। যদিও সে ধারণা করল যে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আল্লাহর সাথে মোলাকাত হয়ে গেছে সিরিয়ানগুলোর। অথবা মায়ের সাথে ফিরে গেছে।

ব্রাইট ল্যান্স, টু, দিস ইজ লিডার। শুনতে পাচ্ছো?

‘লিডার, দিস ইজ টু’, প্রায় সাথে সাথে উত্তর দিল জো।

‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। ঈশ্বরের দোহাই ওখান থেকে সরে এসো।’

‘আমার অবস্থান কী?

‘আমরা সিরিয়ার ভেতর পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত চলে এসেছি। বেসের জন্য ফোর্স ২৫০°।

‘তোমার কী অবস্থা?

‘আমি একটাকে খতম করেছি। আরেকটার পিছনে আছি। এরপর ব্যস্ত হয়ে গেছি তোমার উপর চোখ রাখতে।

চোখ পিটপিট করল ডেভিড। অবাক হয়ে খেয়াল করল যে কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে হেলমেটে পড়ছে। আর পুরো মাস্ক চটচটে হয়ে গেছে নাকের ক্ষত থেকে পড়া রক্তে। হাত আর কাঁধ এখনো ব্যথা হয়ে আছে। মাতালের মতো হালকা লাগছে মাথা। কন্ট্রোলের উপর থাকা হাত দুটো কাঁপতে লাগল। দুর্বল বোধ হলো।

‘আমি দুটো মেরেছি–একটা ডেবরার জন্য আর আরেকটা হান্নাহর জন্য।’

‘চুপ করো, ডেভি।’ চিন্তিত স্বরে জানাল জো। এখান থেকে কীভাবে বের হবে সে চিন্তা করো। তুমি এখনো ফ্ল্যাক আর গ্রাউন্ড মিসাইলের রেঞ্জে আছে। লেজ জ্বালিয়ে নাও আর চলল।

‘নেগেটিভ।’ উত্তর দিল ডেভিড। আমার ফুয়েল শেষ হয়ে এসেছে। কোথায় তুমি?

ছয়টার কাঁটার ঘরে, ২৫০০০ ফুট উঁচুতে। উত্তর দিতে দিতে নিজের সিটে বসে সামনে ঝুঁকে অনেক নিচে ডেভিডের দিকে তাকাল জো। ধীরে ধীরে উঠে আসছে এটি অনেক ধীরে আর অনেক নিচুতে।।

ডেভিডের জন্য ভয় পেল জো। নিজের মাস্কের ভেতরে হাসফাস করতে লাগল। দ্রুত চারপাশে চোখ বুলাতে লাগল বিপদের আশংকায়। দুই মিনিটের মাঝে নিরাপদ স্থানে চলে যাবে তারা। কিন্তু এই দুই মিনিট মনে হলো হয়ে গেল শত বছরের মতো দীর্ঘ।

প্রথম মিসাইলটা অল্পের জন্য মিস্ করল ডেভিডকে। গ্রাউন্ড ক্রুরা নির্ঘাৎ ভুল করে ডেভিডকে সুযোগ দিয়েছে লঞ্চ প্যাড দিয়ে উড়ে যাবার।

‘মিসাইল, বামে চলে যাও। মাস্কের ভেতর গর্জন করে উঠল জো। যাও। গো! গো!’ দেখতে পেল তৎক্ষণাৎ ঘুরে গেল ডেভিড।

‘এটা তোমাকে হারিয়ে ফেলেছে!’ পাগলের মতো শূন্যপানে মিসাইলটাকে এগোতে দেখে মন্তব্য করল জো।

শিকারের খোঁজে একটুখানি এদিক-ওদিক হেলেদুলে অবশেষে বিস্ফোরিত হয়ে গেল মিসাইলটা।

‘চলতে থাকো, ডেভি। উৎসাহ দিল জো। কিন্তু খেয়াল রেখো, আরো আসছে।’

দু’জনেই দেখতে পেল মাটি ছাড়ল দ্বিতীয় মিসাইলটা। আরো দেখা গেল একগাদা জড়ো হয়ে আছে ভূমির উপর। পাথরের খাঁজ থেকে ডেভিডের ছোট্ট মেশিন লক্ষ্য করে উড়ে আসতে লাগল সার্পেন্ট।

‘লেজে আলো জ্বালিয়ে এটার জন্য অপেক্ষা করো!’ বলে উঠল জো। তাকিয়ে দেখতে লাগল পূর্ণ গতিতে ডেভিডের মিরেজের দিকে ধেয়ে আসছে মিসাইল।

‘ডানে ব্রেক চাপো। যাও! যাও! গো! জোর গর্জন শুনেই মোড় নিল ডেভিড। আবারো অল্পের জন্যে মিস করল মিসাইল। কিন্তু এবার আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না। ঘুরে আবার ডেভিডের পিছু নিল।

‘ও এখনো তোমার পেছনে লেগে আছে। চিৎকার করে উঠল জো। সূর্যের দিকে উঠে যাও ডেভি। চেষ্টা করো। মিরেজ সাথে সাথে নাক উঁচু করে কালো মেঘের উপর জ্বলতে থাকা নক্ষত্রপানে ছুটে চলল। সার্পেন্ট সাথে সাথে উপরে উঠে অন্ধের মতো অনুসরণ করে চলল।

‘ও এখনো পিছু ছাড়েনি ডেভি। যাও! যাও! গো।’

হঠাৎ করেই ধুপ করে নিচের দিকে পড়তে শুরু করল মিরেজ। সার্পেন্ট ও সামনে সূর্য থেকে আসা ইনফ্রারেডের দিকে ধেয়ে চলল। আবারো বেঁচে গেল ডেভিড।

‘তুমি এটাকে হারিয়ে দিয়েছে। বাইরে যাও, ডেভি! বাইরে যাও। আকুতি জানাতে লাগল জো। কিন্তু অসহায় হয়ে পড়েছে মিরেজ। প্রাণভয়ে সূর্যের দিকে উঠে যাওয়ায় সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে অলস ভাবে পড়ে যাচ্ছে। এখন নিচের দিকে। এদিকে জো দেখতে পেল তৃতীয় মিসাইলটাকে। ধোঁয়ার পাখা ছড়িয়ে এগিয়ে আসছে ডেভিডের মিরেজের দিকে।

জো নিজেও ঠিকভাবে জানে না যে সে কী করতে চলেছে। শুধুমাত্র পুরো শক্তি নিয়ে নিচের দিকে ডাইভ দিল প্লেন নিয়ে। শব্দের চেয়েও দ্বিগুণ গতি নিয়ে ডেভিডের লেজের সমান্তরাল চলে এলো জো। চাইল আড়াআড়ি ভাবে থেকে সার্পেটের নাক ভোঁতা করে দিতে।

নিজের ছোট্ট গোলাকার রাডার চোখ দিয়ে জোকে দেখতে পেল সার্পেন্ট। টের পেল এর থেকে বের হওয়া তাপ ডেভিডের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় মনে হলো এটি। বিকল্প টার্গেট ধরে নিয়ে ডেভিডের পিছু নেয়া বাদ দিয়ে জোর দিকে ঘুরে গেল মিসাইল।

জোর এয়ারক্রাফটের পাখা সরে যেতে দেখল ডেভিড। একটু পরেই দেখল সার্পেন্টও তার পিছু নিল। এক সেকেন্ড লাগল বুঝতে যে ইচ্ছে করেই মিসাইলের গতি ঘুরিয়ে নিয়েছে জো, কেননা ডেভিডের বাঁচার কোন সম্ভাবনাই থাকতো না নইলে।

আতঙ্কিত হয়ে ডেভিড দেখল নিজের গতি বাড়িয়ে সূর্যের দিকে ছুটলো জো। মসৃণভাবে তার পিছু নিল মিসাইলটাও। নিজের আয়নায় পিছনের মিসাইলটাকে দেখল জো। কিন্তু মনে হলো ছলনার আশ্রয় নিয়েও লাভ হয়নি। ডেভিডের মতো অসহায় বোধ করল জো নিজেও। মিসাইল খুঁজে পেয়েছে তাকে আর ধোয়ার পুচ্ছ ছড়িয়ে এগিয়ে আসছে। জো আর তার মিরেজ একসাথে চলে গেল না ফেরার দেশে।

একা উড়ে চলল ডেভিড। ভয়, দুঃখ আর আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ। জোরে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। জো, না জো। ওই ঈশ্বর না! তুমি এটা করতে পারো না।

সামনে মেঘের ফাঁকে দেখা গেল জর্দানের ভূমি।

‘ঘরে ফেরার কথা ছিল তোমার জো। তোমার। গলার মাঝে দলা পাকিয়ে উঠল কান্না।

কিন্তু বেঁচে থাকার আদিম বোধের কল্যাণে তাকিয়ে দেখতে পেল শেষ মিসাইলের আগমন। অনেক দূরে ছোট্ট কালো একটা বিন্দু। ঘন ধোয়ার লেজ। কিন্তু রাক্ষসের মতো তাকিয়ে দেখছে ডেভিডকে ছোট্ট চোখ দিয়ে।

দেখা মাত্র ডেভিড বুঝতে পারল যে এর হাতেই লেখা রয়েছে তার নিয়তি। এতক্ষণ পর্যন্ত এত কিছু ঘটার পরে স্নায়ু অবশ হয়ে আসতে চাইল। তার পরে শেষ চেষ্টা করল সে।

চোখ ভেঙ্গে আসতে চাইছে। পুরো মাস্ক ভিজে গেছে ঘামের ফোঁটায়। বাম হাতে থ্রটল খুলে দিল পুরোপুরি। ডান হাতে চেপে ধরল কন্ট্রোল কলাম। হতাশা নিয়ে ভাবতে লাগল নিজের কথা।

মিসাইল প্রায় তার ঘাড়ের উপরে পৌঁছে গেছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। চাইল মিরেজকে ঘুরাতে কিন্তু সেকেন্ডের জন্য ভুল হয়ে গেল। মোড় নেয়ার সময় তার পাশ দিয়ে গেল মিসাইল। নিজের ফিউজিং ডিভাইসের ফটো ইলেকট্রিক চোখ দিয়ে দেখে ফেলল মিরেজের ছায়া। বিস্ফোরিত হলো মিসাইল।

বিস্ফোরণের ঠিক মাঝখানে পড়ল ককপিট ক্যানোপি। শক ওয়েঙের ধাক্কায় কাঁপতে লাগল প্লেন। ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল মিরেজ।

ক্যানোপির চারপাশে পড়তে লাগল উড়ন্ত স্টিলের অংশ। ডেভিডের সিটে। ধাক্কা দিল একটা অংশ। বাম হাতে কনুইয়ের উপর আঘাত করল এটি। নিখুঁতভাবে কেটে গেল হাড়। ভারসাম্যহীনভাবে ঝুলতে লাগল হাতটা।

ভাঙা ক্যানোপিটার মাঝে ঢুকে গেল হিম শীতল বাতাস। আত্মহত্যা করার ভঙ্গিতে গোত্তা খেতে খেতে নামতে লাগল প্লেন পূর্ণ গতিতে। সিট বেল্ট থেকে ছিটকে পড়ল ডেভিড। পাঁজর ভেঙ্গে গেল। কাঁধের চামড়া ছিঁড়ে গেল।

চেষ্টা করল সিটের উপর ধরে রাখতে নিজেকে। ইজেক্টর মেকানিজমের হ্যান্ডেল ধরে রইল সুস্থ হাতে। ভাবল সিটের নিচে চার্জ বিস্ফোরিত হয়ে মিরেজ থেকে মুক্তি মিলবে তার। কিন্তু কিছুই ঘটল না।

তাড়াতাড়ি হ্যান্ডেল ছেড়ে সামনে ঝুঁকে সেকেন্ডারি ফায়ারিং মেকানিজম ধরতে চাইল তার সিটের নিচে দুপায়ের ফাঁকে। কিন্তু হতাশ হয়ে দেখল কোন কাজই করছে না এটি। সিট কাজ করছে না। বিস্ফোরণের ফলে এর গুরুতৃপূর্ণ কোন অংশের ক্ষতি হয়েছে। এক হাতে এভাবেই মিরেজ চালাতে হবে তাকে। আর খুব বেশি উচ্চতাও বাকি নেই। জয়স্টিকের উপর ডান হাতের মুঠি রাখল। আর পাগলের মতো হচড়পাঁচড় করে চেষ্টা করল কন্ট্রোলের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে। সহজাত অভ্যাসবশে এখনো উড়ে চলেছে সে। নইলে চোখের সামনে ঝুলছে আকাশ আর পৃথিবী একসাথে।

বুঝতে পারল দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। যতবার চোখ দিচ্ছে বাইরে দেখতে পাচ্ছে মাটি আরো কাছে চলে এসেছে।

মাটির খুব কাছাকাছি এসে মনে হলো মিরেজ তার কথা শুনল। জয়স্ট্রিক আর রাডার একসাথে হয়ে উত্তর দিল। আস্তে করে সোজা হলো মিরেজ। ছুটতে লাগল সামনের দিকে। মিসাইলের আঘাতে অসুস্থ হয়ে গেছে বেচারা মিরেজ। ডেভিড অনুভব করল ইঞ্জিনের যন্ত্রণাকাতর ঘড়ঘড়ানি শব্দ। বুঝতে পারল কমপ্রেসর গেছে। হয়তো আর মিনিটখানেক বা সেকেন্ডের মাঝেই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। উপরে চেষ্টা করেও লাভ নেই আর।

তাড়াতাড়ি নিজের চারপাশে তাকাল ডেভিড। এমনভাবে দুলতে থাকতে আকাশের কোথায় গিয়ে পড়বে ভয় পেল সে। মাটির থেকে মাত্র দুইশ থেকে তিনশ ফুট উপরে আছে। নিজের পতনের দিক সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই তার। কিন্তু নিজের উপলার কম্পাস চেক করে খানিকটা বিস্মিতই হলো; ঘরের দিকেই উড়ে যাচ্ছে।

ইঞ্জিনের কাপন গেল বেড়ে। ধাতুর ঘর্ষণও শুনতে পাচ্ছে সে। মনে হয় না ঘর পর্যন্ত টিকতে পারবে। আর ক্যানোপিকে ঠিকঠাক করার মতো যথেষ্ট উচ্চতাও নেই। তাই স্ট্র্যাপ খুলে ককপিট থেকে বের হবার সম্ভাবনাও নেই। মাত্র একটা কোর্স বাকি আছে। মিরেজকে তাই চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে ভেতরের দিকে।

সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথে সুস্থ হাত লেগে গেল কাজে। হাঁটুর মাঝে ধরল জয়স্ট্রিক। ল্যান্ডিং গিয়ার নামিয়ে দিল।

সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল পাথুরে ভূমি আর তারপর সবুজ ক্ষেত। সেখানেই শুয়ে আছে তার সমাপ্তি কিন্তু তার আরেকটু পরেই দেখা যাচ্ছে খোলা মাঠ, ফসলি জমি, ফলের বাগান, দালানের সারি–তার মানে, খুশি হয়ে উঠল ডেভিডের মন, ইস্রায়েলের সীমান্তে পৌঁছে গেছে সে।

ভাঙা পাথরের কিনারা দিয়ে উড়ে গেল ডেভিড। গ্রানাটের হাঁ করা মুখের উপর থেকে অল্পের জন্যে বেঁচে গেল। সামনে পড়ে আছে ক্ষেত। স্পষ্ট দেখা গেল ফল বাগানে কাজ করছে মহিলারা। থেমে তাকিয়ে রইল তার দিকে। এত কাছ থেকে দেখল ডেভিড যে পরিষ্কার পড়তে পারল তাদের মুখের বিস্মিত ভাব।

নীল ট্রাক্টরের উপর বসে আছে একজন পুরুষ। সিট থেকে লাফ দিয়ে মাটির উপর পড়ে গেল লোকটা। মাথার সামান্য ফুটখানেক উপর দিয়ে উড়ে গেল ডেভিড।

ফুয়েল ট্যাঙ্কের চাবি বন্ধ, সমস্ত সুইচ বন্ধ, মাস্টার সুইচ বন্ধ–ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করতে চলেছে ডেভিড।

সামনে দিগন্ত বিস্তৃত মসৃণ বাদামী ক্ষেত। ভাগ্যই বলতে হবে শেষ হয়ে এসেছে তার যাত্রা।

গতি কমে আসছে মিরেজের। নাক নিচু হয়ে এসেছে নিচের দিকে। এয়ারস্পিডের কাঁটা উলটো দিকে ঘুরছে। ঘণ্টায় ২০০ মাইল, ১৯০, ১৮০, ১৫০-এর ঘরে এসে কাঁপতে লাগল।

হঠাৎ করেই সামনের ভূমিতে দেখা গেল কংক্রিটের সেচের যন্ত্রাংশ। বিশ ফুট চওড়া, দশ ফুট গভীর–একটা সেঞ্চুরিয়ান ট্যাংক ধ্বংস করার জন্যে যথেষ্ট।

খোলা মুখ এড়িয়ে যাবার কোন পদ্ধতিই জানা নেই তার। নিচে নামল মিরেজ। এতটাই সাবধানে যে, মনে মনে ভাবল বার্নি নিজেও গর্ববোধ করবে আমাকে এভাবে দেখলে।’ ভূমি কর্কশ হলেও ঠিকঠাকভাবে এগোতে লাগল মিরেজ। ককপিটে বসে ভয়ঙ্করভাবে কাঁপছে ডেভিড। তারপরেও এখনো তিন চাকার উপর দাঁড়িয়ে আছে প্লেন। সেচের নালার দিকে এগোবার সময় দেখা গেল ছোটার গতি ঘণ্টায় ৯০ মাইল। নালার মাঝে লেগে ভেঙ্গে গেল প্লেনের অংশ। নাক ডুবিয়ে দিল মিরেজ। ফিউজিলাজ সরসর করে এগিয়ে গেল মাঠের উপর। ভেতরে ডেভিড এখনো স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে। পাখা ভেঙ্গে নরম মাটির উপর খানিকটা ঘষটে গিয়ে অবশেষে স্থির হলো মিরেজ।

ডেভিডের বাম পাশ পুরো অবশ হয়ে আছে। হাত বা পায়ে কোন বোধ নেই। কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছে স্ট্র্যাপ। হঠাৎ নেমে আসা নীরবতার স্থানুর মতো বসে রইল সে।

বেশ কিছু সেকেন্ড পার হলো এভাবে। নড়াচড়া বা চিন্তা করার শক্তিটুকুও মনে হলো নেই আর। এরপরই গন্ধ পেল নাকে। ট্যাংক আর লাইনের জেট ফুয়েলের গন্ধ। আগুনে পুড়ে যাবার ভয় জেঁকে ধরল তাকে।

ডান হাত দিয়ে চেপে ধরল ক্যানোপি রিলিজ লিভার। টানাটানি করে চেষ্টা করল খুলে ফেলতে। কিন্তু মূল্যবান দশটি সেকেন্ড নষ্ট হলো কেবল। পুরো জমে গেছে লিভার। এরপর লিভারের নিচে থাকা স্টিলের ক্যানোপি ব্রেকারে চোখ পড়ল। এই যন্ত্রটি এ জাতীয় কোন বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছিল। টেনে ধরল ডেভিড। কাজ হলো না। মাথার উপরের গম্বুজ আঘাত করল। টের পেল জেট ফুয়েলের গন্ধে ভারী হয়ে উঠছে ককপিটের বাতাস।

বাম হাতে কোন কাজই করতে পারছে না সে। এদিকে স্ট্রাপ গুলোও শক্ত করে আটকে রেখেছে সিটের সাথে।

আবারো শুরু করল চেষ্টা। মাথার উপরের কাঁচের ঢাকনিতে হাত সমান ফুটো করতে পারল অবশেষে। চাইল আরেকটু বড় করা যায় কিনা। এমন সময় চিড় ধরা ফিউজিলাজের কোন অংশ থেকে ফিনকি দিয়ে আকাশে উঠে পড়ল ফুয়েল। ঝরে পড়তে লাগল বৃষ্টির মতো। ক্যানোপির উপরে বাগানের ফোয়ারার মতো ভারী হয়ে পড়তে লাগল। ডেভিডের তৈরি করা ফুটো প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম। ফুয়েল গড়িয়ে পড়তে লাগল চোখে মুখে, গাল বেয়ে। কাঁধ থেকে গড়িয়ে প্রেশার স্যুটের ভেতরেও পড়ল ফুয়েল। প্রার্থনা করতে লাগল ডেভিড। জীবনে প্রথমবারের মতো শব্দগুলো অর্থবহ হয়ে উঠল তার কাছে। বুঝতে পারল ভয় কমে আসছে প্রার্থনার শক্তিতে।

‘শোন ও ইস্রায়েল, প্রভু আমাদের ঈশ্বর, প্রভু একমাত্র।

জোরে জোরে চিৎকার করে প্রার্থনা শুরু করল ডেভিড। আস্তে আস্তে ভেঙ্গে পড়া কাঁচের ঢাকনিতে আঘাত করতে করতে মনে হলো মৃত্যু চুঁইয়ে পড়ছে চোখ মুখ বেয়ে। হাত দিয়ে কাঁচের ফাটলকে চেষ্টা করল আরো বড় করতে। হাত কেটে রক্ত পড়তে লাগল।

‘পূজিত হোক তার নাম, যার রাজতু চিরকালের

বেশ বড় হলো মুখটা। সিট থেকে উঠতে চাইল। দেখা গেল অক্সিজেন আর রেডিও লাইন জড়িয়ে গেছে হেলমেটের সাথে। অথর্ব বাম হাত দিয়ে কিছু করতেও পারছে না সে। তাকিয়ে দেখল স্যুটের হাতা ছিঁড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে ঝুলছে বিবশ পেশী। অথচ কোন রকম ব্যথাও বোধ করল না সে।

‘তোমার প্রভু। তোমার ঈশ্বরকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসো=

ফিসফিস করল ডেভিড, ডান দিয়ে চেষ্টা করে চিবুকের স্ট্র্যাপ খুলে হেলমেট খুলে ফেলল মাটিতে। চুল বেয়ে কানের পেছন দিয়ে ঘাড়ে পড়ছে ফুয়েল। মনে পড়লো নরকের আগুনের কথা।

ব্যথায় জর্জরিত হয়ে ক্যানোপির ভাঙা অংশ দিয়ে বের হয়ে আসল ডেভিড। আর এখন এমনকি প্রার্থনার শক্তিও পারল না বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা ভয় তাড়াতে।

ঈশ্বরের রোষানলে পড়বে তুমি

পিচ্ছিল ধাতুর গা বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল পাখার দিকে। পড়ে গেল মাটিতে। মাটিতে মুখ দিয়ে শুয়ে রইল বহুক্ষণ। আতঙ্ক আর পরিশ্রমে নিঃশেষ হয়ে গেছে।

‘ঈশ্বরের আদেশ স্মরণ করো।’

‘ধূলিমাখা মাটির উপর মুখ দিয়ে শুয়ে থাকার সময় শুনতে পেল মানুষের কণ্ঠস্বর। অতি কষ্টে মাথা তুলে দেখতে পেল খোলা মাঠ দিয়ে দৌড়ে আসছে নারীদের দল। শব্দগুলো বুঝতে পারল হিব্রু। জেনে গেল ঘরে পৌঁছে গেছে সে।

মিরেজের ভাঙা শরীরের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চাইল ডেভিড। ভাঙা হাত ঝুলছে পাশে। চেষ্টা করল চিৎকার করে তাদেকে থামাতে।

পিছনে যাও! সাবধান! কিন্তু গলা দিয়ে ফ্যাসফাসে আওয়াজ ছাড়া আর কোন স্বর ফুটলো না। সবাই দৌড়ে আসতে লাগল তার দিকে। শুকনো বাদামী মাটির উপর রং-বেরঙের উড়ন্ত অ্যাপ্রন আর পোশাক দেখে মনে হলো আলোর ফুলকি নাচছে।

ঘষটে ঘষটে এয়ারক্রাফটের সামনে থেকে সরেমহিলাদের কাছে যাবার চেষ্টা করতে লাগল ডেভিড।

‘পিছনে যাও!’ ব্যাঙের মতো আওয়াজ বের হয়ে এলো গলা চিরে। জি স্যুট মনে হলো হাত-পা টেনে ধরেছে আর চুলে আর মুখের নিচে হিম শীতল ফুয়েল।

জেট কমপ্রেসরের সাদা-গরম শেলের কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠল মিরেজের হাল।

ভয়ঙ্কর গর্জন করে ঘন লাল রঙের ধোঁয়া ছড়িয়ে বিস্ফোরিত হলো মিরেজ। বাতাস বাইরের দিকে ধেয়ে নিয়ে গেল ধোয়া। জ্বলন্ত আগুনের মাঝে এগোতে চেষ্টা করল ডেভিড।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল সে যদি এমনটা না করতো তাহলে ফুসফুস ফুটো করে দিত ধোঁয়া। চোখ বন্ধ করে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে লাগল ডেভিড। শরীরে ফায়ারপ্রুপ প্রেশার স্যুট পরা। বুট আর গ্লাভও আছে–কিন্তু মাথা উন্মুক্ত আর ফুয়েলে ভিজে আছে।

দৌড়ানোর সময় মাথা জ্বলতে লাগল মশালের মতো। কুঁচকে গেল সব চুল। গন্ধের সাথে সাথে ধোয়া ছড়িয়ে মাথার চামড়া, মুখ আর ঘাড় হয়ে পড়লো উন্মুক্ত। আগুনের শিখায় পুড়ে গেল কান আর নাকের বেশির ভাগ অংশ। চামড়ায় পড়ল অসংখ্য ফোঁসকা। তারপরই দেখা গেল ফোঁসকা গলে তাজা মাংস। পুড়ে গেল ঠোঁট, দাঁত বের হয়ে গেল। চোয়ালের হাড় দেখা গেল। চোখের পাতা পুড়ে গেল। গাল থেকে মাংস পুড়ে খসে পড়তে লাগল।

জ্বলন্ত বাতাস আর ধোঁয়ার মাঝে পড়ে গেল ডেভিড। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো যে এতটা ব্যথাও সহ্য করা যায়। চিন্তা-চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে এলো। কিন্তু জানে যে চিৎকার করা চলবে না। চোখ বন্ধ করে রইল শক্তভাবে। কানের উপর মনে হলো ড্রাম বাজাতে লাগল বাতাস। চামড়া পুড়ে নরকের কথা মনে এলো তার। কিন্তু জানে যে এই ভয়ঙ্কর আগুন শরীর ছুঁতে দেয়া যাবে না। তাই চিৎকার না করেই এগিয়ে চলল সে।

ফল বাগান থেকে দৌড়ে আসা নারীরা এসে পড়ে। ওরা দেখল সামনে ধোয়ার দেয়াল, এয়ারক্রাফটের শরীর পুড়ে যাচ্ছে আর এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে দৌড়ে আসতে চাইছে পাইলট!

তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে উত্তাপ আর ঘন ধোয়ার দেয়াল। বাধ্য হলো তারা পিছু হটতে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল লেলিহান শিখা।

হঠাৎ করেই বাতাসের একটা ঝাপটা এসে ধোয়ার তেলতেলে পর্দাটা দিল সরিয়ে। এর ভেতর থেকে বের হয়ে এলো পুড়ে যাওয়া ধোঁয়াওয়ালা মাথা নিয়ে ডেভিড!

অন্ধের মতো বের হয়ে এলো ধোঁয়ার দেয়াল ভেদ করে। একটা হাত ঝুলছে নরম মাটির উপর। পা ঘষে প্রায় হামাগুড়ির মতো ভঙ্গি করে এগিয়ে আসছে মানব দেহ। ভয় পেয়ে জমে গেল নারীর দল।

এরপরই সাহস সঞ্চয় করে বাদামী দেহত্বকের মাথা ভর্তি চুল নিয়ে চিৎকার করে সামনে এগিয়ে ডেভিডের কাছে এলো একটি মেয়ে।

দৌড়াতে গিয়েই নিজের মোটা উলের স্কার্ট খুলে ফেলল। শক্তিশালী বাদামী পা হয়ে পড়লো উলঙ্গ। ডেভিডের কাছে পৌঁছে মাথায় পেঁচিয়ে দিল স্কার্ট। মাংস কামড়ে থাকা শিখাগুলো নিভে গেল। অন্য নারীরাও এগিয়ে এসে নিজেদের কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলল ডেভিডকে। মাটিতে শুয়ে পড়ল ডেভিড।

এতক্ষণে চিৎকার শুরু করল সে। ঠোঁটবিহীন মুখে দেখা যাচ্ছে সব দাঁত। এই শব্দ কখনোই ভুলতে পারবে না উপস্থিত নারীর দল। চিৎকার করতে গিয়ে খুলে গেল চোখ। চোখের পাপড়ি, আই ব্রো আর পাতার বেশিরভাগ অংশই পুড়ে গেছে। ভেজা পুড়ে যাওয়া মাংসের মাঝে ঘন নীল হয়ে আছে চোখ জোড়া। চিৎকার করতে গিয়ে নাকের ফুটো থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। যদিও নাক বলতে আর কিছুই নেই প্রায়। সারা শরীর কাঁপিয়ে ব্যথার পর ব্যথার ঢেউ আঘাত করতে লাগল তাকে।

নারীরা চেপে ধরে চেষ্টা করল তাকে শান্ত করতে। নখ দিয়ে মুখ আঁচড়াতে চাইল ডেভিড। সবাই মিলে থামাতে চেষ্টা করল।

কিব্বুইজ ডাক্তার এসে প্রেশার স্যুটের হাতা কেটে ফেলল। তখনো এক নাগাড়ে চিৎকার করে চলেছে ডেভিড। লাফাতে থাকা পেশীর উপর মরফিন ইনজেকশনের সুই ঢুকিয়ে দিল ডাক্তার।

.

প্লট থেকে রাডারের সর্বশেষ উজ্জ্বল ছবিটাকেও হারিয়ে যেতে দেখল ব্রিগ। শুনতে পেল তরুণ রাডার অফিসার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল, কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। কমান্ড বাঙ্কারে নেমে এলো ভয়ঙ্কর এক নীরবতা।

সবাই মিলে দেখতে লাগল তাকে। প্লটের উপরে কুঁজো হয়ে দাঁড়াল ব্রিগ। পাশে ঝুলে আছে বিশাল হাত। শক্ত মুখে কোন আবেগ ফুটে উঠল না। কিন্তু চোখ দুটো জ্বলছে ধকধক করে।

মনে হলো মাথার উপরে এখনো ভাসছে দুই পাইলটের কথোপকথনের শব্দ, প্রচণ্ড যুদ্ধের মাঝে একে অন্যকে ডেকে চলেছে তারা।

কান্না আর ভয় মেশানো ডেভিডের গলা শুনতে পেয়েছে সবাই।

‘জো! না জো! ওহ্ ঈশ্বর না! সবাই জানে এর মানে কী। দু’জনকেই হারিয়েছে তারা। আর স্থানুবৎ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ব্রিগ ভাবছে কী থেকে কী হয়ে গেল।

যেই মুহূর্তে নিজের যোদ্ধাদের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সেই মুহূর্ত থেকে বুঝতে পেরেছে যে ঝড় ঘনিয়ে আসছে–আর এখন পুত্রহারা হয়ে গেছে। ইচ্ছে করল চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। অভিযোগ জানায় সবকিছুর বিরুদ্ধে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য শক্ত করে চোখ বন্ধ করে রইল। খোলর পর দেখা গেল নিজের উপর আবারও নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে সে।

‘সাধারণ সতর্ক সংকেত।’ বলে উঠল ব্রিগ। “রেড” স্কেয়াড্রনের সব স্ট্যান্ডবাই জানে আন্তর্জাতিক সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে তারা। তারা যেখানে পড়েছে সে অংশের আকাশ কাভার করা হোক। হতে পারে পড়ে গেছে তারা। দুটি ফ্যান্টম ফ্লাইট নিয়ে ঢেকে ফেলো তাদেরকে। আমি চাই এই মুহূর্তে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে দেয়া হোক। সাথে প্যারাট্রুপার গার্ড আর মেডিকেল টিম

সাধারণ সংকেত জারি করায় তৎপর হয়ে উঠল কমান্ড বাঙ্কার।

‘প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলব আমি। অনেক রকমের ব্যাখ্যা দিতে হবে তাকে। মূল্যবান কয়েকটা সেকেন্ড ব্যয় করল ডেভিড মরগ্যানের উপর গালিবর্ষণ করে।

***

ডেভিডের ক্ষত আর পুড়ে যাওয়া মাথার দিকে তাকিয়ে এয়ারফোর্সের ডাক্তার বলে উঠল, ‘একে বাঁচাতে পারলে নিজেদেরকে ভাগ্যবানই বলতে হবে।’

হালকা করে ভ্যাসলিনের ব্যান্ডেজ করে দিল ডাক্তার ডেভিডের মাথায়। বাগানে অপেক্ষারত বেল ২০৫ হেলিকপ্টারের স্ট্রেচারের উপর তাড়াতাড়ি উঠানো হলো কম্বল মোড়া শরীর।

হাদ্দামা হাসপাতালের নিচে হেলিপ্যাডে নামল হেলিকপ্টার। একটা মেডিকেল দল প্রস্তুত হয়েই আছে। হাসপাতালের তৃতীয় তলার বিশেষ বার্ণ ইউনিটে ঢুকলো ডেভিড। সেচ নালায় মিরেজ ভেঙ্গে পড়ার এক ঘণ্টা তিপ্পান্ন মিনিট পর। শান্ত, গোছানো একটি পৃথিবী যেখানে সবাই মাক্স পরে আছে। গায়ে লম্বা সবুজ বোব। বাইরের পৃথিবীর দেখা পাওয়া যাবে একমাত্র কাঁচের জানালা দিয়ে। এমনকি নিঃশ্বাস নেবার বাতাসটুকুও পরিষ্কার করা হয়েছে।

হালকা মরফিনের কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে ডেভিডের চেতনা। তার উপর ঝুঁকে কাজ করতে থাকা মুখোশ পরিহিত মুখগুলোর গলার শব্দ তাই কিছুই বুঝতে পারল না সে।

‘পুরো অঞ্চলের উপর তিন ডিগ্রি

‘এটা স্থির না হওয়া পর্যন্ত পরিষ্কার করার বা ছোঁয়ার কোন চেষ্টাই করা যাবে না সিস্টার। আমি ইপিগার্ড স্প্রে করে দিচ্ছি। এছাড়া চার ঘন্টা পর পর ইন্ট্রী মাসকুলার টেটরাসাইক্লিন দেবব আমরা–যাতে ইনফেশন না হয়।’

‘দুই সপ্তাহ কাটলে তবেই আমরা ছুঁতে পারব।’

‘ঠিক আছে ডাক্তার।

‘ওহ, আরেকটা কথা সিস্টার। প্রতি ছয় ঘণ্টায় ১৫ মিলিগ্রাম মরফিন। একে নিয়ে অনেক ব্যথা সহ্য করতে হবে।’

এই ব্যথার বোধ মনে হলো কখনো শেষ-ই হবে না। সীমাহীন সমুদ্রে ব্যথার ঢেউ একটু পরপর ধাক্কা মারছে ডেভিডের হৃদয়ের বালুতটে। অনেক সময় এমন মনে হয় যে ব্যথার চোটে বুদ্ধি-বিবেচনা সব লোপ পেয়ে যায়। মাঝে মাঝে আবার এমন সময় আসে যখন কিছুটা কম থাকে ব্যথার বোধ। মনে হয় যেন ভাসতে ভাসতে মরফিনের কুয়াশার চাদরে হারিয়ে যায় সে। এরপরই আবার মনে হয় কুয়াশার চাদর ভেদ করে মাথার উপর চলে পড়ে সূর্যের তেজ। চিৎকার করে ওঠে ডেভিড। মাথা মনে হয় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

এরপরই হঠাৎ করে মাংসের মাঝে ঢুকে যায় সুইয়ের মাখা। কুয়াশা এসে ঘুমের দেশে নিয়ে যায় তাকে।

‘এর দিকে তাকাতে পারি না আমি। কালচার নিয়েছি আমরা সিস্টার?”

হ্যাঁ ডাক্তার।

‘কেমন মনে হচ্ছে?

আমার ভয় হচ্ছে জীবাণু বেড়ে যাচ্ছে।

‘হ্যাঁ আমারো তাই মনে হয়। আমার মনে হয় ক্লোক্সাসিলিনে ফেরা উচিৎ-দেখা যাক ভাল কোন ফলাফল পাওয়া যায় কিনা।

ব্যথার মাঝেই নতুন এক ধরনের গন্ধ পেল ডেভিড। অনেক আগে মারা যাওয়া কোন কিছুর গন্ধ, নোংরা কম্বলে পোকার গন্ধ, বমি আর বিষ্টার গন্ধ। আর ভেজা আবর্জনার গন্ধ। অবশেষে পেল নিজের মাংস পচার গন্ধ। ব্যাকটেরিয়া এসে আক্রমণ করেছে উক্ত টিস্যুকে।

ঔষধ দিয়ে ব্যাকটেরিয়ার সাথে যুদ্ধে নামল ডাক্তারের দল। ইনফেকশনের ফলে জ্বর আসায় কমে গেল ব্যথা। পোড়ার অংশে দগদগে ঘাকে কোন তরলই শুকাতে পারছে না।

জ্বরের সাথে এলো দুঃস্বপ্ন। কল্পনার রাজ্যে বহু দূরে ভেসে যেতে লাগল ডেভিড।

‘জো’ আক্ষেপে চিৎকার করে উঠে ডেভিড। সূর্যের দিকে এগিয়ে যাও, জো। বাম দিকে ব্রেক কষে যাও! যাও!’ এরপরই কেঁদে ওঠে, ভাঙা গলায় বলে ওঠে, “ওহ, জো! ওহ, ঈশ্বর? না! জো।

রাতে ডিউটিরত সিস্টার সহ্য করতে পারে না। এগিয়ে আসে সিরিঞ্জ নিয়ে। চিৎকার পরিণত হয় বিড়বিড়ানিতে, এরপর আস্তে আস্তে গুঙ্গিয়ে উঠে ওষুধের ঝাঁঝে ঘুমিয়ে পড়ে ডেভিড।

‘এখন ড্রেসিং শুরু করব আমরা সিস্টার।

প্রতি আটচল্লিশ ঘণ্টায় ড্রেসিং করার সময় পুরো মাথায় জেনারেল অ্যানেসথেশিয়া দেয়া হতো। কাঁচা মাংস, বাচ্চাদের ড্রইংয়ের মতো টাক মাখা। চুল নেই, কান নেই, নিষ্ঠুর সব আঁক টানা।

‘ক্লোক্সাসিলিন মনে হয় কাজ করছে। আগের তুলনায় বেশ ভালো দেখাচ্ছে। তাই না সিস্টার?

চোখের পাতার নগ্ন চামড়া নতুন করে ভরতে শুরু করেছে। গোলাপি গোলাপের মতো পাঁপড়ি বের হয়েছে। চোখের কোটরে হলুদ মলম লাগিয়ে আরাম দেয়ার ব্যবস্থা করেছে ডাক্তারেরা। মাথার ইনফেকশন যাতে চোখে না ছড়িয়ে পড়ে সেটাও একটা কারণ। মলমের কারণে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে গেছে।

‘আমার মনে হয় এখন আমরা পেটের ব্যাপারে কিছু একটা করতে পারি। বিকেলে থিয়েটার তৈরি করে রাখবেন প্লিজ, সিস্টার?

এখন ছুরি চালানোর সময় হয়েছে। ডেভিড শিখতে চলেছে যে ভয়ঙ্কর পাপের মাঝে ছুরি আর ব্যথা একত্রে বাস করে। পেট থেকে বড়সড় এক টুকরো চামড়া তুলে নিল ডাক্তারেরা। মোটাসোটা সসেজের মতো করে রোল করে নিল। এরপর ভালো হাত বেঁধে ফেলল। এরপর সসেজের এক অংশ হাতের এক অংশে লাগিয়ে রক্ত চলাচলের ব্যবস্থা করল। এরপর থিয়েটার থেকে নিয়ে আসা হলো তাকে।

যাক বাবা, দুটো চোখই বাঁচাতে পেরেছি আমরা।’ গর্বিত স্বরে ঘোষণা করল একটি কণ্ঠ।

প্রথম বারের মতো চোখ মেলে তাদেরকে দেখতে পেল ডেভিড। তার চারপাশে এসে জড়ো হয়েছে সবাই। সবার মাথা, নাক আর মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক। কিন্তু মলমের কারণে এখনো ঝাপসা হয়ে আছে দৃষ্টি।

‘এখন চোখের পাতার ব্যবস্থা করতে হবে।’

আবারো সক্রিয় হলো ছুরি। চোখের পাতা কেটে-ছেটে, সেলাই করে, ছুরি আর ব্যথা কাজ করে চলল একত্রে। চামড়ার একেবারে গভীর থেকে বোধ করল যন্ত্রণাবোধ।

‘খুব সুন্দর হয়েছে, সত্যিই ইনফেকশনকে খুব সুন্দর ভাবে ঢেকে দিয়েছি। আমরা। এখন আমরা শুরু করতে পারব।’

মাথার উপরে এখন একটা চকচকে ভেজা ভাব তৈরি হয়েছে। নতুন টিস্যু গজানোতে রং হয়েছে উজ্জ্বল লাল, ককটেল চেরীর মতো। কানের জায়গায় কুঁচকানো চামড়া। দাঁতের সারি উজ্জ্বল সাদা। শুধুমাত্র ঠোঁট দুটো নেই। চোয়ালের জায়গায় সাদা হাড়ের ব্লেড। নাকের জায়গায় শট গানের মতো নাকের ফুটো। শুধুমাত্র চোখ দুটো এখনো আগের মতো উজ্জ্বল–ঘন নীল আর সাদা। লাল চোখের পাতার উপর পরিষ্কার কালো সেলাই।

‘ঘাড়ের পেছনে কাজ শুরু করব আমরা। এই কারণে সন্ধ্যায় থিয়েটার তৈরি রাখবেন সিস্টার।

ছুরির মাঝেও কত রকম বৈচিত্র্য আছে। থাই থেকে সমান করে চামড়া কেটে নেয়া হলো। এরপর এগুলো বিছিয়ে দেয়া হলো উন্মুক্ত মাংসের উপর। এরপর ভালোভাবে মাংসের উপর। এরপর ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হলো ব্যথাতুর ডেভিডের প্রতিটি পদক্ষেপ।

‘এটা দেখে ভালো মনে হচ্ছে না। আমার মনে হয় আমাদের আবার চেষ্টা করতে হবে।’

থাই-তে নতুন করে চামড়া গজানো শুরু হতেই গোড়ালি থেকে নতুন করে চামড়া কেটে নেয়া হলো। প্রতিটি জায়গা হয়ে উঠল নতুন করে ব্যথার উৎস।

চমৎকার! একেবারে খাপে খাপে মিশে গেছে এবারে।

ধীরে ধীরে ঘাড়ের উপর, মাথার উপর চামড়া বসে গেল।

এবার আমরা হাত খুলবো।’

সন্ধ্যার থিয়েটারে, স্যার?

‘হা, প্লিজ তৈরি রাখবেন সিস্টার।

ডেভিড পরবর্তীতে জানতে পারে যে প্রতি বৃহস্পতিবার বার্ন ইউনিটের অপারেশন থিয়েটারে কাজ অপারেশন করা হয়। তাই প্রতি বৃহস্পতিবারে আতঙ্ক নিয়ে দেখে যে বিছানার চারপাশে জড়ো হয় ডাক্তার দল। এমন ভাবে পুনরায় চামড়া প্রতিস্থাপন নিয়ে কথা বলতে থাকে যে শিউরে ওঠে ডেভিড।

পেট থেকে মোটা সসেজটাকে মুক্ত করল তারা। হাত থেকে সরানোর পর দেখা গেল সাদা লেসের মতো নিজের জীবন শুরু করেছে যেন রক্ত পেয়ে।

হাত তুলে বুকের সাথে বেঁধে দেয়া হলো। আরো একটু চামড়া কেটে চোয়াল আর নাকে লাগানো হলো।

‘খুব সুন্দর হয়েছে কাজটা। আজ সন্ধ্যায় একে ঘষামাজা করা হবে। থিয়েটার লিস্টে সবার আগে যাবে তার নাম। এদিকে খেয়াল রাখবেন সিস্টার।

পেট থেকে কাটা মাংস নিয়ে নাক, সরু ঠোঁট আর চোয়ালের হাড়ের জন্য নতুন কাভার তৈরি করা হলো।

‘ফোলা ভাবটা মিশে গেছে। আজ সন্ধ্যায় চোয়ালের হাড় সমান করা হবে।’

বুক খুলে ফেলে চতুর্থ পাঁজরে ভেঙে নেয়া হলো। এখান থেকে হাড় নিয়ে চোয়ালের হাড় ঠিক করা হলো। এরপর পেটের মাংস দিয়ে ঠিকঠাক ভাবে ঢেকে দেয়া হলো।

বৃহস্পতিবার কাটে ছুরি আর অ্যাশেথেটিক গন্ধে। আর বাকি দিনগুলোতে আচ্ছন্ন করে কাটা আর জোড়া লাগানো মাংসের ব্যথা।

নতুন নাক সুন্দর করে জোড়া লেগে গেল নাশাররে সাথে। চোখের পাতাও ঠিক হয়ে গেল। শেষ কাজ করা হলো কানের পেছনে। চোয়ালের কাছে জিগ-জাগ করে কেটে ফেলে অপরিষ্কার টিস্যু ফেলে দেয়া হলো। পুরোন পেশীর সাথে সংযুক্ত হয়ে গেল নতুন ঠোঁট। আস্তে আস্তে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলল ডেভিড। ফলে পুনরায় আগের মতো কথা বলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠল সে।

উক্ত মাংসের শেষ অংশটুকু জোড়াতালি দিয়ে ঢেকে দিল ডাক্তারেরা। হাই ইনফেকশন রিস্ক কেটে গিয়ে একটু একটু চলাফেরার স্বাধীনতা দেয়া হলো তাকে। আবারো সাধারণ মানুষের চেহারা দেখতে পেল সে। এ পর্যন্ত তো শুধু সার্জিক্যাল মাস্ক পরিহিত চোখ দেখতে পেত। মুখগুলো বেশ বন্ধুবৎসল আর হাসি খুশি। মৃত্যুর মুখ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে পেরে বেশ খুশি সবাই। গর্বিত হয়ে উচ্চারণ করল ওর মাথা বাঁচানোর আনন্দ ধ্বনি।

‘তোমার কাছে দশনার্থীরা আসতে পারবে এখন। আর আমি আসা করি তুমিও উপভোগ করবে ব্যাপারটা।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জানাল ডেভিডকে। এই তরুণ সার্জনকে শত ভিড়ের মাঝেও আলাদা করে চোখে পড়তে বাধ্য। সুইস ক্লিনিকের মোটা বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান হয়েছে ভদ্রলোক।

‘আমার মনে হয় না যে আমাকে কেউ দেখতে আসবে।’ বার্ন ইউনিটে থাকাকালীন এই নয় মাসে বাইরের পৃথিবীর সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে ডেভিডের।

‘ওহ হ্যাঁ অবশ্যই আসবে’; বলে উঠল সার্জন। অনেকেই নিয়মিত তোমার শারীরিক অবস্থার উন্নতি সম্পর্কে খোঁজ খবর করেছে আমাদের কাছে। তাই না সিস্টার?

‘ঠিক তাই, ডাক্তার।

তাদেরকে জানিয়ে দিন যে তারা চাইলে এখন ওর সাথে দেখা করতে পারবে।’

বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আর তার দলবদল বিদায় নিল।

‘ডাক্তার পেছন দিকে ডাক দিল ডেভিড। আমি আয়না দেখতে চাই।’

সবাই চুপ হয়ে গেল। বোঝা গেল অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। গত কয়েক মাসে ওর এই অনুরোধ অনেকবার ফিরিয়ে দিয়েছে তারা। ধুত্তোরি।’ রেগে উঠল ডেভিড। এভাবে চিরকাল আমাকে মানা করে যেতে পারেন না আপনারা।’

অন্যদেরকে হাত ইশারা করে চলে যাবার নির্দেশ দিয়ে ডেভিডের বিছানার ধারে এলো ডাক্তার।

‘ঠিক আছে, ডেভিড। নম্রভাবে একমত হলো ডাক্তার। আমরা তোমাকে একটা আয়না খুঁজে এনে দেবো। যদিও আমরা এটা তেমন ব্যবহার করি না এখানে।’ বহু মাসের মাঝে এই প্রথমবার একে অন্যকে বোঝার সুযোগ পেল তারা। ডাক্তারের সহানুভূতি টের পেল ডেভিড। একটা মানুষ প্রতিনিয়ত ব্যথা সহ্য করেও ঠিকই একদিন কাটিয়ে উঠতে পারে তা।

‘তোমাকে মনে রাখতে হবে যে এখন তোমাকে যা দেখাচ্ছে সব সময় তেমন দেখাবে না। আমি যা করতে পেরেছি তা হলো খোলা মাংস ঢেকে আবারো কাজ করার উপযোগী করে তুলতে চেয়েছি। তুমি আবারো একজন মানুষ হিসেবে ফুটে উঠেছে তোমার শরীরের কোন অংশ হারানোর বেদনা পাওনি তুমি–তবে আমি এই অভিনয়ও করব না যে তোমাকে অসাধারণ দেখাচ্ছে। যাই হোক, আরো অনেক কিছু করার আছে আমার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় তোমার কান ঠিক করার জন্যে উপাদান জোগাড় করে রেখেছি আমি।’ ডেভিডের হাত থেকে ঝুলতে থাকা মাংস পিণ্ড দেখাল ডাক্তার। ‘এখনো চাইলে চোখ নাক আর মুখের উপর অনেক কাজ করা যাবে।’ ওয়ার্ডের মাঝে আস্তে আস্তে হেঁটে বাইরের সূর্যালোকের দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে আবারো ডেভিডের কাছে ফিরে এলো ডাক্তার।

‘কিন্তু তোমাকে সত্যি কথাটাই বলতে চাই আমি। আমার কাজের ক্ষেত্রেও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। চোখ আর মুখের চারপাশের অনেক নাজুক পেশী নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তাদেরকে পুনরায় গঠন করতে পারবো না। তোমার চোখের পাপড়ি ব্রো আর খুলির হেয়ার ফলিকেলগুলোও পুড়ে গেছে। তুমি একটা উইগ ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু

নিজের বেডসাইড লকারের দিকে ফিরে ড্রয়ার থেকে ওয়ালেট বের করল ডেভিড। ভেতর থেকে বের করল একটা ছবি। অনেক আগে এ ছবিটা তুলেছিল হান্নাহ। ইন জেদির রক পুল ও পাশাপাশি বসে আছে ডেভিড আর ডেবরা। হাসছে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। সার্জনের হাতে ছবিটা দিল ডেভিড।

তুমি এরকম দেখতে ছিলে ডেভিড? আমি কখনো জানতামই না।’ চোখের মাঝে দ্রুত ভেসে উঠল অনুতাপের ছায়া।

‘আবারো আমাকে এরকম করে তুলতে পারবেন আপনি?

বহুক্ষণ ধরে ছবিটা দেখল ডাক্তার। তরুণ দেবতার মতো চেহারায় পরিষ্কার সব রেখা আর মাথায় চুলের মেঘ।

না। জানিয়ে দিল ডাক্তার।

‘এমনকী কাছাকাছিও যেতে পারব না আমি।

‘আমি এটাই জানতে চেয়েছি। ডাক্তারের কাছ থেকে ছবিটা নিয়ে নিল। ডেভিড। আপনি বলেছেন আমি কর্মক্ষম এখনো। তাই না? ঠিক আছে। একটুকুই থাক।

তুমি আর কোন কসমেটিক সার্জারি চাও না? আমরা এখনো অনেক কিছু।’

‘ডাক্তার আমি নয় মাস ধরে ছুরির নিচে বেঁচে আছি। মুখে এখনো শুধু অ্যান্টিবারোটিক আর অ্যানেশথেশিয়ার স্বাদ। এখন আমি ব্যথা থেকে মুক্তি চাই। একটু শান্তি আর নাকে বিশুদ্ধ বাতাসের গন্ধ।

“ঠিক আছে।’ তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল ডাক্তার। এটা এমন কোন গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় নয় যে এখনি করতে হবে। ভবিষ্যতে যে কোন সময় আসতে পারো তুমি।’ ওয়ার্ডের দরজার কাছে চলে গেল ডাক্তার। চলো। আয়না খুঁজে বের করা যাক।

প্যাসেজের শেষে ডাবল দরজার পেছনে নার্সরুমে পাওয়া গেল একটি। রুমটা একেবারে খালি। ওয়াশ বেসিনের উপর দেয়ালের সাথে লাগানো আছে আয়নাটা।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল সার্জন। সিগারেট জ্বালিয়ে দেখতে পেল হেঁটে আয়নার সামনে গেল ডেভিড। নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ করে।

পায়জামার উপর নীল রঙের হাসপাতালের ড্রেসিং গাউন পরে আছে ডেভিড। লম্বা-চওড়া শরীর, সরু কোমর আর পুরুষালি শরীর।

যাই হোক, এর উপরে মাথা দেখে মনে হলো দুঃস্বপ্ন দেখছে ডেভিড। আপনাতেই হাঁ হয়ে গেল মুখ। শক্ত, ঠোঁট বিহীন মুখ, মনে হলো কোবরা।

আতঙ্কে জমে গেলেও আয়নার আরো কাছে এগিয়ে গেল ডেভিড। চুলের গোছা না থাকায় অদ্ভুত দেখাচ্ছে ক্ষতবিক্ষত খুলি। কখনো আগে ভাবেনি যে চুল না থাকলে এমন দেখাবে মাথা।

মুখের চামড়া আর মাংসে হাজারো কাটাকুটির মতো চিহ্ন। গালের উপর চামড়া টানটান হয়ে আছে। অনেকটা এশিয়াটিক ভাব এসেছে চেহারায়। কিন্তু চোখগুলো দেখাচ্ছে গোলগাল, নাজুক চোখের পাতা আর ভয়াবহ ফোলা ফোলা মাংসপিণ্ড।

নাকের কোন গড়ন বোঝা যাচ্ছে না। মাথার পাশে কানের জায়গায় হাস্যকর কিছু একটা ঝুলে আছে। পুরোটাই নগ্ন আর সেদ্ধ কিছু একটা দেখাচ্ছে।

হাসতে গেলে ভয়ঙ্কর ভাবে মোচড় খায় চামড়া। তারপর আবার শক্ত হয়ে যায়।

‘আমি হাসতে পারছি না।’ বলে উঠল ডেভিড।

না।’ একমত হলো সার্জন। তোমার অভিব্যক্তির উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না তোমার।

ব্যাপারটা চিন্তা করতে গেলে সত্যিই ভয়াবহ। এটা কোন মোচড় খাওয়া বা নির্যাতিত মাংসপিণ্ড নয়। দেখা যাচ্ছে যেসব সেলাইয়ের দাগ সেসবও মুখ্য নয় পুরোটা মনে হচ্ছে একটা অভিব্যক্তিহীন মুখোশ জমে যাওয়া মুখখানা দেখে মনে হলো বহু আগেই মারা গেছে সে, মানবিক কোন অনুভূতি বা উষ্ণতা ফুটে উঠল না চেহারায়।

‘ইয়াহ! কিন্তু অন্যদেরকে দেখা উচিৎ আপনার!’ নরম স্বরে জানাল ডেভিড।

‘আগামীকাল তোমার কানের পেছনে থাকা বাকি সেলাইগুলোও কেটে দেব আমরা। হাত থেকে বাকি মাংসপিণ্ডও সরিয়ে ফেলবো। এরপর ছেড়ে দেয়া হবে তোমাকে। প্রস্তুত হলেই আমাদের কাছে ফিরে এসো।

টাক মাথার উপর আলতো করে হাত বুলালে ডেভিড।

‘এখন থেকে আর চুল কাটা লাগবে না। রেজার ব্লেড ব্যবহার করতে হবে না। ডেভিডের কথা শেষ হতেই তাড়াতাড়ি উল্টো দিকে ঘুরে তাকাল সার্জন। চলে গেল প্যাসেজ ধরে। ডেভিডকে রেখে গেল নিজের নতুন চেহারার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে।

ডেভিডের জন্য খুঁজে পেতে যে পোশাক আনা হলো তা হলো বেশ সস্তা আর ঢিলেঢালা। স্লাকস, খোলা গলার শার্ট, হালকা জ্যাকেট আর স্যান্ডেল। মাথা ঢাকার জন্যে কিছু একটা চাইল ডেভিড। খুলির এই নতুন গড়ন অন্তত যেন ঢেকে রাখা যায়। একজন নার্স কাপড়ের টুপি এনে দিল তাকে। এরপর জানাল হাসপাতাল সুপারিনটেন্ডেন্টের অ্যাপার্টমেন্টে একজন অপেক্ষা করছে ডেভিডের সাথে দেখা করার জন্য।

মিলিটারি প্রভোস্ট মার্শাল অফিস থেকে এসেছে একজন মেজর। হালকা পাতলা গড়ন, ধূসর চুল, ঠাণ্ডা ধূসর চোখ আর শক্ত কঠিন মুখাবয়ব। হ্যান্ড শেকের কোন প্রস্তাব না করেই নিজের পরিচয় দিল মেজর। এরপর সামনে রাখা ডেস্কে একটা ফাইল খুললো।

‘আমাকে অফিস থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন ইস্রায়েলী এয়ারফোর্সের তোমার কমিশনে পদত্যাগপত্র নিয়ে যাই। শুরু করল মেজর। হা করে তাকিয়ে রইল ডেভিড। গভীর যন্ত্রণাদায়ক জ্বরতপ্ত রাতগুলোতে মনে হলো আরেকবার ওড়ার সুযোগ পেলে হাতে স্বর্গ পাবে সে।

বুঝতে পারলাম না আমি। তোতলাতে লাগল ডেভিড। সিগারেটের জন্য হাত বাড়ালো। প্রথম দিয়াশলাই ভেঙে গেলে দ্বিতীয়টি দিয়ে তাড়াতাড়ি আগুন জ্বেলে নিল। আপনি আমার পদত্যাগপত্র চাইছেন কিন্তু যদি আমি দিতে অস্বীকৃতি জানাই?

‘তাহলে কোর্ট মার্শাল ডাক ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই আমাদের হাতে। অভিযোগ হবে শত্রু সম্মুখে উপরওয়ালার আইনাদেশ অমান্য করেছো তুমি।

‘তাই। ভারী মনে মাথা নাড়ল ডেভিড। সিগারেটে টান দিল। চোখে ঢুকে গেল ধোয়া।

মনে হচ্ছে আমার কোন অপশন নেই।

‘আমি প্রয়োজনীয় কাগজ তৈরি করে এনেছি। এখানে আর এখানে স্বাক্ষর দাও, সাক্ষী হিসেবে আমি স্বাক্ষর করব।

কাগজগুলোর উপর নিচু হয়ে স্বাক্ষর দিল ডেভিড। নীরব রুমে কলমের ঘসঘস শব্দই শোনাল জোরালো হয়ে।

‘ধন্যবাদ।’ কাগজগুলো তুলে নিজের ব্রিফকেসে গুছিয়ে রাখল মেজর। ডেভিডের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে দরজার দিকে হাঁটা ধরল।

‘তো এখন আমি অচ্ছুত। আস্তে করে বলে উঠল ডেভিড। থেমে গেল মেজর। এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল দুজন দুজনের দিকে। এরপরই বদলে গেল মেজরের অভিব্যক্তি। ধূসর চোখ দুটো হয়ে উঠল হিংস্র।

‘তোমার কারণে দুটো যুদ্ধ প্লেন এমনভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে যে কিছুই করার নেই। অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে আমাদের। তোমার কারণে মৃত্যু হয়েছে ভ্রাতৃসম অফিসারের। তোমার কারণে একটা যুদ্ধ প্রায় শুরু হবার উপক্রম, যাতে মূল্য দিতে হবে আরো হাজারো তরুণের জীবন হয়তো আমাদের অস্তিত্বই নড়ে উঠবে। আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুদেরকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে তুমি। শক্তি দিয়েছো শত্রুর হাতে।’ থেমে গিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিল মেজর। ‘আমার অফিস থেকে সুপারিশ করা হয়েছিল যেন তোমাকে ট্রায়ালে ফেলা হয় আর বিচার বিভাগ মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে যেন। কিন্তু শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ আর মেজর জেনারেল মোরদেসাই তোমাকে বাঁচিয়েছে এর হাত থেকে। আমার মনে হয় ভাগ্যকে দোষ না দিয়ে নিজেকে তোমার ভাগ্যবানই ভাবা উচিত।’

ঘুরে হাঁটা ধরল মেজর। পাথরের মেঝেতে জুতার শব্দ শোনা গেল পরিষ্কার।

হাসপাতালের সরু লবিটাতে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করেই ডেভিডের ইচ্ছে হলো কাঁচের সুইং ডোর ঠেলে চলে যায় বাইরে, বসন্তের নরম রোদের তাপ পোহাতে। আগে একবার শুনেছিল যে বহুদিন ধরে কয়েদ থাকা কয়েদীর যখন মুক্তির সময় হয়ে আসে তখন নাকি এমন লাগে।

দরজার কাছে পৌঁছে পাশ ফিরে দেখল হাসপাতালের ছোট্ট প্রার্থনার জায়গা। নীরব চৌকোনো হলের এক কোণায় গিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো ডেভিড। অনেক উঁচু পর্যন্ত উঠে গেছে কাঁচের জানালা। রঙিন কাঁচের ভেতরে দিয়ে এসে পড়েছে সূর্যের আলো হলের মেঝেয়। একটুখানি শান্তি আর জায়গাটার সৌন্দর্য ভরে তুললো তাকে। সাহস করে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। হেঁটে বের হয়ে চলে এলো রাস্তায়। জেরুজালেমগামী একটা বাসে উঠে বসে। পড়ল।

বাসের মাঝবরাবর জানালার পাশে একটা সিটে বসে পড়ল ডেভিড। আস্তে আস্তে চলতে লাগল বাস। পাহাড়ের উপর উঠে ছুটে চলল শহর। অভিমুখে।

একটু পরেই খেয়াল হলো যে তাকে কেউ দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে। মাথা তুলতেই দেখতে পেল তার সামনের সিটেই দুই বাচ্চা নিয়ে বসে আছে এক তরুণী মা। মলিন কাপড় পরিহিত তরুণীকে দেখে বোঝা গেল তার জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বহু ঝড় বয়সের আগেই তাকে বুড়ো বানিয়ে দিয়েছে। কোলের কাছে ধরা ছোট্ট শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে। দ্বিতীয় বাচ্চাটার চেহারা একেবারে স্বর্গদূতদের মতো। বয়স হবে চার কী পাঁচ। বড় বড় কালো চোখ আর মাথাভর্তি ঘন কোঁকড়া চুল। সামনের সিটে বসলেও পেছন ফিরে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। বুড়ো আঙুল পুরে দিয়েছে মুখের ভেতর। মনোযোগ দিয়ে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। পর্যবেক্ষণ করছে শিশুসুলভ কৌতূহল নিয়ে। হঠাৎ করেই মেয়েটার প্রতি কেমন মায়া জেগে উঠল তার মনে। মানুষের সংস্পর্শে আসার তাগিদ অনুভ করল। এত মাস ধরে এর অভাব বোধ করেছে সে।

ঝুকে সামনের দিকে গেল ডেভিড। হাসার চেষ্টা করে এক হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করল মেয়েটাকে।

মুখ থেকে হাত বের করে তাড়াতাড়ি সরে গেল মেয়েটা। মায়ের দিকে ফিরে হাত ধরে মুখ লুকালো মায়ের ব্লাউজের ভেতর।

পরের স্টপেজে বাস থেমে নেমে গেল ডেভিড। রাস্তা ছেড়ে পাথুরে পাহাড়ের পথ বেয়ে ওঠা শুরু করল।

দিনটা বেশ উষ্ণ আর কেমন ঝিম ধরা ভাব চারপাশে। পীচ্ ফলের বাগান থেকে মৌমাছির গুঞ্জন আর ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। ছাদে উঠে গেল ডেভিড। কিনারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বুঝতে পারল কাঁপছে; অস্থির লাগছে তার। মাসের পর মাস হাসপাতালে কাটানোতে বহুদূর পর্যন্ত হাঁটার অভ্যেস নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু শুধু এটাই যে কারণ নয় তাও বেশ বুঝতে পারল। বাচ্চা মেয়েটার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটুকু তাকে বেশ নাড়া দিয়েছে।

মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো ডেভিড। একেবারে পরিষ্কার উজ্জ্বল নীল রঙে ছেয়ে আছে চারপাশ। উত্তরের দিকে অনেক উঁচুতে খানিকটা মেঘ। মনে হলো ওখানে যেতে পারলেই শান্তি খুঁজে পেত সে।

মালিক স্ট্রিটের উপর একটা ট্যাক্সি নামিয়ে দিয়ে গেল ডেভিডকে। সদর দরজা খোলা। তালায় চাৰি ঢোকানোর আগেই ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।

বিস্মিত আর সতর্ক হয়েই লিভিং রুমে পা দিল সে। ঠিক তেমনটিই আছে যেমনটা সে বহু মাস আগে রেখে গিয়েছিল। কিন্তু কেউ এসে নিয়মিত ঝাড় দিয়েছে, পরিষ্কার করেছে। জলপাই কাঠের টেবিলের উপরে রাখা ফুলদানিতে তাজা ফুল-হলুদ আর বেগুনি রঙের ডালিয়া ফুলের বড়সড় একটা তোড়া।

খাবারের গন্ধ পেল ডেভিড। গরম গরম আর মসলাদার। হাসপাতালের দিনগুলোর তুলনায় একেবারে ভিন্ন আবহ এখানে।

“হ্যালো।’ ডেকে উঠল ডেভিড। কে এখানে?

‘ওয়েলকাম হোম! বন্ধ বাথরুমের দরজার ভেতর থেকে পরিচিত কণ্ঠে কথা বলে উঠল কেউ। আমি ভাবিনি তুমি এত তাড়াতাড়ি আসবে–আমার স্কার্ট উপরে আর প্যান্ট নিচে।

এরপর বজ্রগর্জনে বাথরুমের ফ্লাস টানা হলো আর দরজা গেল খুলে। জমকালো ভাবে বের হয়ে এলো ইলা কাঁদেশ। তার বিশাল কাফতানগুলোর একটা পরনে, প্রাথমিক রংগুলোর মিশেল দেখা গেল তাতে। মাথার টুপিতে আপেল সবুজ রঙ, পাশের আবার একটা মুরগির পাখা গোঁজা। মনে হলো যেন অস্ট্রেলিয়ান বুশ হ্যাট। সাথে আরো আছে বিশাল জেড পাথরের ব্রোচ আর উটপাখির পালকগুচ্ছ।

স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে নড়ে উঠল বিশাল হাত দুটো। মুখে ভেসে উঠল সন্দেহের হাসি। ডেভিডের দিকে এগিয়ে এলো ইলা। সন্দেহ চলে গিয়ে উজ্জ্বল ছোট ছোট চোখে দানা বাঁধলো ভয়। চলার গতি হয়ে গেল শ্লথ।

‘ডেভিড?’ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলে উঠল ইলা। এটা তুমি, ডেভিড?

‘হ্যালো ইলা।’

“ওহ, ঈশ্বর। ওহ, ঈশ্বর। ওরা কী করেছে তোমার সাথে, হে তরুণ দেবতা

‘শোন ত্যাঁদড়ের ছানা কর্কশ স্বরে বলে উঠল ডেভিড, যদি এরকম বিড়বিড় করা শুরু করো তাহলে সিঁড়ি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবো।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করল ইলা। চোখে আসা পানি চেষ্টা করল আবারো ফেরৎ পাঠাতে। কিন্তু ঠোঁট কেঁপে উঠল, গলা ভারী হয়ে এলো। নাক টেনে এগিয়ে এসে বিশাল হাতে বুকে চেপে ধরল ডেভিডকে।

‘রেফ্রিজারেটরে এক কেস ঠাণ্ডা বীয়ার রেখে দিয়েছি আর আমাদের জন্য কারী রান্না করেছি। আমার রান্না পছন্দ হবে তোমার। এই কাজটা আমি সত্যিই ভাল পারি।’

চেটেপুটে সব সাবাড় করে দিল ডেভিড। ঠাণ্ডা বীয়ার দিয়ে এমন ভাবে খেলো যেন কতদিনের অনাহারী সে। শুনতে লাগল সাথে ইলার বকবকানি। মরণার মতো ছিটকে বের হতে লাগল শব্দের বহর। ইলা চেষ্টা করল এর মাধ্যমে নিজের অস্বস্তিকে ঢেকে রাখতে।

‘তারা আমাকে তোমার সাথে দেখা করতে দেয়নি। কিন্তু আমি প্রতি সপ্তাহে ফোন করে খবর নিয়েছি। সিস্টার আর আমার মাঝে বেশ বন্ধুত্বও হয়ে গেছে। সে আমাকে জানিয়েছে যে তুমি আজ আসবে। তাই আমি চেষ্টা করেছি তোমার জন্য তৈরি থাকার

এমন ভাবে কথা বলছে ইলা যেন সরাসরি ডেভিডের দিকে তাকাতে না হয়। তারপরেও চোখে চোখ পড়লেই দেখা গেল ছায়া। যদিও সেটা লুকাতে সদা সচেষ্ট ইলা। অবশেষে খাওয়া শেষ করল ডেভিড। জানতে চাইল ইলা; ‘এখন তুমি কী করবে ডেভিড?’

‘আমার যেটা ইচ্ছে তা হলো ফিরে গিয়ে আকাশে উড়ে যাওয়া। এটা করতেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমি–কিন্তু তারা আমাকে বাধ্য করেছে। কমিশন থেকে পদত্যাগ করতে। আমি আইন অমান্য করেছি। জো আর আমি ওদের অনুসরণ করে সীমান্ত পর্যন্ত গিয়েছিলাম তাই তারা আমাকে আর চায় না।’

‘যুদ্ধ প্রায় শুরু হয়েই যাচ্ছিল ডেভিড। তুমি আর জো সত্যিই পাগলামী করেছে।

মাথা নাড়ল ডেভিড। আমি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমি সেদিনের পর থেকে সোজা ভাবে আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না– ডেবরা_

তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিল ইলা। হ্যাঁ, আমি জানি। আর একটা বীয়ার নেবে?

বাধা দেবার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল ডেভিড। ও কেমন আছে, ইলা?’ পুরো সময় ধরে এই প্রশ্নটাই করতে চাইছে সে।

‘ও ভালো আছে। ডেভি। নতুন বই শুরু করেছে আর মনে হয় প্রথমটার চেয়েও ভালো হবে। আমার মনে হয় ও খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক হয়ে উঠবে।

‘ওর চোখ? কোন উন্নতি হয়েছে?

মাথা ঝাঁকালো ইলা। ও এটা মেনে নিয়েছে। এখন মনে হয় না এতে কিছু আর যায় আসে। যেভাবে তুমিও যা হয়েছে তাকে মেনে নেবে’।

কিছুই শুনছিল না ডেভিড। ইলা এই সময়টুকুতে, যতদিন আমি হাসপাতালে ছিলাম শুধু এটুকুই আশা করেছি যে–আমি জানি যে এটা অনর্থক কিন্তু তারপরেও আশা করেছি ও আমার সাথে কথা বলবে। একটা কার্ড, একটা শব্দ–’

‘ও জানেই না ডেভি।

জানে না?’ তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল ডেভিড। টেবিলের ওপাশ থেকে বঁকে ইলার হাতের কব্জি চেপে ধরল, এর মানে কী?

‘জো মারা যাবার পর ডেবরার বাবা অনেক রেগে গেছে। সে বিশ্বাস করে যে এর জন্য তুমিই দায়ী।

মাথা নাড়ল ডেভিড। মুখের শূন্য মুখোশেও ফুটে উঠল অপরাধবোধ।

‘ডেবরার বাবা ওকে জানিয়েছে যে তুমি ইস্রায়েল ছেড়ে চলে গেছে। আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করেছি যে এ ব্যাপারে নীরব থাকবো। ডেবরা এটাই বিশ্বাস করে এখন।

ইলার কব্জি ছেড়ে দিল ডেভিড। নিজের বীয়ারের গ্লাস তুলে নিয়ে চুমুক দিল।

‘তুমি এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি ডেভিড? এখন কী করবে তুমি?

‘আমি জানি না ইলা। আমাকে ভাবতে হবে মনে হয়।

পাহাড়ের দিক থেকে বয়ে আসছে গরম বাতাসের হল্কা। লেকের দিকটা প্রায় কালোই দেখাচ্ছে। নোঙ্গরে বাঁধা অবস্থায় দুলছে ফিশিং বোটগুলো। ঝুলিয়ে রাখা জালের সারি উড়ছে নববধূর ওড়নার মতো।

ডেবরার চুলে এসে লাগল বাতাসের ঝাপটা। খুলে গিয়ে মনে হলো মেঘ জমেছে। শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে গায়ের সিঙ্কের পোশাক।

ক্রুসেডার দুর্গের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে নিজের লাঠির মাথার উপর হালকা ভাবে রাখল দুই হাত। তাকিয়ে রইল পানির দিকে। যেন সত্যিই দেখতে পাচ্ছে সে।

পাশে বসে আছে ইলা। মিস্ত্রিদের ফেলে যাওয়া একটা ব্লকের উপর বসে আছে ইলা। কথা বলার সময় এক হাত দিয়ে ধরে রাখল মাথার টুপি। ডেবরার মুখের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ওর মনোভাব বুঝতে চাইল ইলা।

‘একটা সময় মনে হয়েছিল এরকম করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমিও রাজি হয়েছিলাম সত্যিটা তোমার কাছে থেকে লুকিয়ে রাখার পক্ষে। কারণ আমি চাইনি যে তুমি নিজেকে কষ্ট দাও–

তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল ডেবরা আর কখনো এরকম করবে না।

মাথা নেড়ে একমত হয়ে বলে চলল ইলা, আমার জানার কোন উপায় ছিল না যে ও কতটা আঘাত পেয়েছে। কেউ আমাকে ওর সাথে দেখা করতে দেয়নি।

রাগতভাবে মাথা নাড়ল ডেবরা। কিন্তু চুপ করে রইল। ইলা আবারো অবাক হলো দেখে যে দৃষ্টিহীন চোখেও এতটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে পারে। ইলার দিকে মাথা নাড়তেই মধুরঙা চোখের বিদ্যুৎ স্পষ্ট বোঝা গেল।

‘এ সময় তোমাকে আঘাত করা উচিত ছিল। তাই না ডিয়ার? তুমি এত সুন্দর ভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছো–বই নিয়ে কাজ করছে। আমার মনে হয়েছে তোমাকে বলে কোন লাভই হবে না। আমি তাই তোমার বাবার সাথে সাহায্য করার প্রতি মনস্থির করেছি। দেখো কেমন করে সব হয়ে গেল।

‘তাহলে এখন কেন বলছো আমাকে’, জানতে চাইল ডেবরা। তাহলে এখন কেন তোমার মত পরিবর্তন করেছ? কী হয়েছে ডেভিডের?

‘গতকাল দুপুরবেলা হাদ্দাসা হাসপাতালে থেকে রিলিজ দেয়া হয়েছে ওকে।

হাসপাতাল? হতভম্ভ হয়ে গেল ডেবরা। তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাইছে না যে ও এতদিন হাসপাতালে ছিল? নয় মাস–এটা অসম্ভব!

‘এটাই সত্যি।

‘তার মানে ও অনেক আঘাত পেয়েছে। ডেবরার রাগ পরিণত হয়ে গেল উদ্বিগ্নতায়। “ও কেমন আছে ইলা? কী হয়েছে? এখন সুস্থ হয়েছে?

এক মুহূর্ত চুপ করে রইল ইলা। ডেবরা এগিয়ে এলো তার কাছে। কী জানতে চাইল সে।

‘ডেভিডের প্লেন পুড়ে গেছে। আর মাথায় খুব বাজে ভাবে পোড়র আঘাত পেয়েছে সে। এখন পুরোপুরি সুস্থ। পোড়া ক্ষত শুকিয়ে গেছে কিন্তু

দ্বিধা করতে লাগল ইলা। ডেবরা ওর হাত চেপে ধরল। বলো ইলা! কিন্তু?’

‘ডেভিড আর আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষটি রইল না।’

‘আমি বুঝতে পারছি না।’

‘ও আর আগের মতো দ্রুত আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর নেই–যে কোন নারী ওকে এখন দেখতে পেলে ভালোবাসা তো দূরের কথা কাছেই যেতে চাইবে না।’

মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ডেবরা। এখন মুখের ভাব হয়ে গেল নরম।

‘ও এখন নিজের ব্যাপারে সচেতন। লুকিয়ে যাবার মতো কোন জায়গা খুঁজছে, আমার মনে হয়। ও উড়ে যাবার কথা বলছে যেন এভাবেই পালাতে চায়। ও জানে ও এখন একা, মুখোশের কারণে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন’

কুয়াশা দেখা গেল ডেবরার চোখে। গমগমে কণ্ঠস্বর খানিকটা শান্ত করে বলে চললো ইলা।

‘কিন্তু একজন আছে যে কখনো এই মুখোশ দেখতে পাবে না।’ মেয়েটাকে নিজের দিকে টেনে নিল ইলা। একজন কেউ ওকে আগের মতোই মনে রেখেছে। ইলার হাতে ডেবরার চাপ বাড়লো। হাসতে শুরু করল সে এটা এমন একটা অভিব্যক্তি যা একেবারে তার ভিতর থেকে উঠে আসে।

‘ওর এখন তোমাকে দরকার ডেবরা।’ নরম স্বরে জানাল ইলা। এই একমাত্র জিনিস আছে ওর জন্য। তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে তুমি?

‘ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো ইলা। কেঁপে গেল ডেবরার গলার স্বর। ‘যত তাড়াতাড়ি পারো ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’

৫. দীর্ঘ সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে

দীর্ঘ সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে ইলার স্টুডিওতে উঠে এলো ডেভিড। বাইরে উজ্জ্বল সূর্যের আলো। ওর পরনে খোলা স্যান্ডেল আর ব্রোঞ্জ রঙের হালকা স্ন্যাক, চওড়া ভি-গলার খাটো হাতার শার্ট। সূর্যের আলো না পাওয়ায় বিবর্ণ হাতের রঙ। নরম ক্রীমের তুলনায় গাঢ় দেখাচ্ছে বুকের লোম। মাথার সূর্যের তাপ না লাগার জন্য আর মুখের উপর ছায়া রাখার জন্য পরে আছে চওড়া কানাওয়ালা টুপি।

থেমে গেল সে। বুঝতে পারল শার্টের নিচে ঘামছে। ফুসফুস লাফাচ্ছে। ছাদে উঠে আসতেই শারীরিক ভাবে দুর্বল বোধ করল। পা দুটো কাঁপছে, পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে জায়গাটা। বন্ধ দরজা খুলে ভেতরের অন্ধকারে পা রাখল ডেভিড।

ঘরের মাঝখানে মেঝেতে সমরকন্দ থেকে আনা কার্পেটের উপর বসে আসে ইলা কাঁদেশ। তার পরনে সংক্ষিপ্ত বিকিনি। পদ্মাসনে বসে যোগ ব্যায়াম করছে সে। অজগরের মতো পেঁচিয়ে আছে ওর বিশাল পা দুটো। হাত দুটো সামনে তালুতে তাল ঠেকিয়ে রাখা ধ্যানস্থ হওয়ায় চোখ বন্ধ; মাথার উপরে টুপি চারটে চৌকোনা তৈরি করেছে বিচারকদের মতো।

দরজার কাছে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়াল ডেভিড। কিন্তু নিঃশ্বাস নেবার আগেই হাসতে শুরু করল। শুরু হলো ছোট্ট বুদবুদের মতো হিসহিস শব্দ করে; তারপর হঠাৎ করেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সে। হাসির দমকে কাঁপতে লাগল সে। বুঝতে পারল আগের মতো আর ফিট নয় সে। এভাবেই বেঁচে থাকা শিখতে হবে তাকে।

ইলা বুঝতে পারল সবকিছু। নড়াচড়া না করলেও আনন্দরত বুদ্ধের ন্যায় ছোট্ট একটা চোখ খুলে তাকাল। এখন ব্যাপারটা হয়ে গেল আরো মজাদার আর হাস্যকর। দরজা থেকে গড়িয়ে হাসতে হাসতে একটা চেয়ারের উপর। পড়ে গেল ডেভিড।

‘তোমার আত্মা একেবারে শুকনো, ডেভিড মরগ্যান’, বলে উঠল ইলা। ‘তোমার কোন সৌন্দর্য বোধ নেই, সমস্ত আকর্ষণ শুধুমাত্র- বাকিটুকু আর বলতে পারল না সে। হাসতে হাসতে জেলির মতো গলে যেতে লাগল। প্রায় হেঁচকি ওঠার মতো অবস্থা হলো দু’জনের।

‘আমি জমে গেছি। অবশেষে থামলো ইলা। সাহায্য কর ডেভি’, ওফ

তাড়াতাড়ি ইলার দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। হাঁটু গেড়ে বসে চেষ্টা করল ভাঁজ করা পা খুলে দিতে। একটু পরেই নানা কসরতের পর খুলে গেল পা। মট করে শব্দ হয়েই কার্পেটের উপর পড়ে গেল ইলা। একই সাথে খিকখিক করে হাসতেও লাগল।

‘সরো এখান থেকে।’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল ইলা। আমাকে শান্তিতে একটু মরতে দাও। যাও তোমার নারীর কাছে, জেটির উপরে আছে।

তাকিয়ে দেখল দ্রুতপায়ে চলে গেল ডেভিড। বহু কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে গেল ইলা। হাসি থামিয়ে বিড়বিড় করে উঠল, আমার ছোট্ট দুটো বিড়াল ছানা-ভেবে অবাক লাগছে ঠিক কাজটাই করেছি কিনা। চেহারায় খানিকটা চিন্তার ছায়া এসেও মুছে গেল। যাই হোক, দেরি হয়ে গেছে কাঁদেশ, আর হাত দিও না এতে। আগেই ভাবা উচিত ছিল যা ভাবার।

.

রঙিন তোয়ালে আর বীচ্ জ্যাকেট পড়ে আছে জেটির উপর। আরো আছে উঁচু ভলিউমে বাজাতে থাকা একটা ট্রানজিষ্টার রেডিও। ভারী রক টিউন বেজে উঠছে। খানিকটা দূরে উপসাগরে একা সাঁতার কাটছে ডেবরা, স্থির হয়ে শক্ত ভাবে উলটো সাঁতার কাটছে সে। প্রতিটি স্ট্রোকের সাথে সূর্যের আলোয় ঝিক করে উঠছে ওর বাদামী পা। পায়ের শব্দে পানি ছিটছে ফোয়ারের মতো।

থেমে ভেসে রইল ডেবরা। গোসলের টুপি একেবারে সাদা। ডেভিড দেখতে পেল খানিক থেমে রেডিওর শব্দ শুনল ডেবরা; আবার সাঁতার কাটতে লাগল। সরাসরি-জেটির দিকে ফিরে আসছে এখন।

পানি থেকে উঠে এসে মাথার টুপি খুলে চুল ঝাড়া দিল। শরীরের ত্বকের রং হয়ে গেছে গাঢ়, সূর্যের তাপে নিশ্চয়ই এই অবস্থা আর সারা শরীরে মুক্তোর মতো পানির ফোঁটা। দেহের প্রতিটি পেশী শক্ত আর দৃঢ়। আত্মবিশ্বাসীর ভঙ্গিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে সে। প্রতি পদক্ষেপে ফুটে উঠল মানসিক শক্তির পরিচয়।

গা মোছার সময় কাছেই দাঁড়িয়ে রইল ডেভিড মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল ডেবরাকে। মনে হলো এত মাসের বিচ্ছেদ এক মিনিটেই মিটিয়ে নিতে চাইছে। পরিষ্কার ভাবে ডেবরার কথা মনে করতে পারতো ডেভিড। তার পরেও বুঝতে পারল অনেক কিছুই ভুলে গিয়েছিল সে। যেমনটা মনে পড়ে তারচেয়েও নরম আর ঘন মেঘের মতো হয়ে গেছে ডেবরার চুল। দেহত্বকের চিক্কন ভাব ভুলে গিয়েছিল ডেভিড। আগের চেয়েও গাঢ় বর্ণের হয়ে গেছে। প্রায় তার চোখের মতো। নিশ্চয়ই প্রতিদিন অনেকটুকু সময় সূর্যের নিচে কাটায় সে। হঠাৎ করেই তোয়ালে ফেলে দিল ডেবরা। ঠিক করে নিল নিজের সংক্ষিপ্ত পোশাক। ডেভিড বুঝতে পারল কতটা প্রয়োজন তার এই মেয়েটাকে। এতটাই আকুতি জেগে উঠল যে বুকের মাঝে কিছুতেই তা আটকে রাখতে পারল না সে। হালকা পায়ে এগিয়ে গেল সে। তারপরেও জুতার নিচে শব্দ হতে লাগল অল্প অল্প।

সাথে সাথে তার দিকে ঘুরে তাকাল অনিন্দ্যসুন্দর একটা মুখ। কিছু শুনতে পাবার ভঙ্গিতে থেমে দাঁড়াল। চোখ দুটো হয়ে গেল বড় বড়। চোখের তারায় ফুটে উঠল বুদ্ধির ঝিলিক। মনে হলো ডেভিডকে দেখতে পেল ও দুটো। ডেভিডের মনে হলো ঘুরে চলে যেতে উল্টো দিকে।

‘ডেভিড? নরম স্বরে কথা বলে উঠল ডেবরা। তুমি এসেছো ডেভিড?

উত্তর দিতে চেষ্টা করল ডেভিড। কিন্তু স্বর ফুটলো না গলায়। দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে এলো ডেবরা। দ্রুত, লম্বা লম্বা পা ফেলে। হাত বাড়িয়ে হাসি মুখে জানতে চাইল।

ধরে ফেলল ডেভিড। শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরল ডেবরা। কিছুটা রাগের ভঙ্গিতেও মনে হলো অনেকদিন ধরে অবহেলা করা হয়েছে তাকে।

‘আমি তোমাকে অনেক মিস্ করেছি ডেভিড। গলার স্বরে ফুটে উঠল রাগ। ওহ ঈশ্বর, তুমি কখনোই বুঝতে পারবে না আমি তোমাকে কতটা মিস করেছি।’

এই প্রথম কোন মানুষ তাকে দেখে দূরে সরে যায়নি–কোন সহানুভূতি বা অনুতাপ দেখায়নি–এত মাসের মধ্যে ডেভিডও বুঝতে পারল ও নরম হয়ে পড়েছে। শক্ত হাতে আলিঙ্গন করল ডেবরাকে।

অবশেষে দাঁড়িয়ে রইল ডেবরা। ডেভিডের মুখের উপর হাত বুলিয়ে নতুন রং নতুন আদল অনুভব করতে চাইল ডেবরা।

বুঝতে পারল মুখ সরিয়ে নিতে চাইছে ডেভিড। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজের মতো করে হাত বুলাতে লাগল ডেবরা।

‘আমার আঙুলগুলো বলছে যে তুমি এখনো অনেক সুন্দর–

‘মিথ্যে কথা বলছে তারা। ফিসফিস করে উঠল ডেভিড। কিন্তু ডেভিডের কথাকে পাত্তাই দিল না ডেবরা। কোমর দিয়ে ধাক্কা মারলো তাকে।

‘দক্ষিণ দিক থেকে আরো শক্তিশালী মেসেজ ভেসে আসছে আমার দিকে।’ নিঃশব্দে হাসল ডেবরা।

‘আমার সাথে দয়া করে আসুন স্যার।

ডেভিডের হাত ধরে হালকা পায়ে সিঁড়ি বাইতে লাগল ডেবরা। হাত ধরে যেন টেনে নিয়ে যেতে লাগল ডেভিডকে। অবাক হয়ে ডেভিড দেখল মেয়েটার স্বাচ্ছন্দ আর আত্মবিশ্বাসীর ভাব। কুঁড়েঘরে নিয়ে গেল ডেবরা ডেভিডকে। ঢোকার সাথে সাথে রুম হয়ে গেল আলো আঁধারে অন্তরঙ্গতাপূর্ণ।

লেক থেকে উঠে আসায় এখনো ভেজা আর ঠাণ্ডা ডেবরার শরীর। কিন্তু ডেভিডের স্পর্শে জেগে উঠতে সময় লাগল না। এমনভাবে মিলিত হলো দু’জনে যেন এতেই তাদের মুক্তি। এতদিনকার একাকিত্ব আর অন্ধকার কেটে গেল নিমেষের মাঝে।

শারীরিক ভালোবাসাও মনে হলো তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারল না। এমনি সময়েও একে অন্যের হাত ধরে রাখল দু’জনে। একসাথে গায়ে গা ঠেকিয়ে ঘুমালো। ঘুমের মাঝেও মনে হলো সচেতন রইল যেন আবার আলাদা না হয়ে যায়। কথা বলে, হাত ধরে রেখে, মাঝে মাঝেই ডেভিডের মুখে হাত বুলিয়ে দেয় ডেবরা। সোনালি রঙা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে ডেবরা। এমনকি খাবার তৈরি করার সময়েও ডেবরার কাছে বা পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে ডেভিড। মনে হলো যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ভয়ে একে অন্যের কাছ থেকে কিছুতেই আলাদা হতে চাইল না তারা।

দুই দিন কেটে যাবার পর কটেজ থেকে বের হলো দু’জনে। লেকের পাড়ে একসাথে হেঁটে বেড়ালো, জেটি থেকে সাঁতার কাটলো, সূর্যের তাপে স্নান করল। কিন্তু ইলা ছাদ থেকে তাদেরকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়লেও প্রতিক্রিয়া হলো ডেবরার। ডেভিড জানতে চাইল।

‘ওর কাছে যাবো আমরা?’

না।’ তাড়াতাড়ি উত্তর দিল ডেবরা। এখনো না। আমি এখনো কারো সাথে তোমাকে শেয়ার করতে প্রস্তুত নই। আর একটু সময়, প্লিজ ডেভিড।

এরপর কেটে গেল আরো তিনটি দিন। সিঁড়ি বেয়ে দু’জনে উঠে এলো ইলার স্টুডিওতে। গগ্যার ছবির সামনে বসে আছে ইলা। আর কোন অতিথি নেই দেখে খুশি হলো ডেভিড আর ডেবরা।

‘আমি আরো ভাবছিলাম তোমার জন্য স্ট্রেচার আনাতে হবে ডেভিড। কিচিরমিচির শব্দে ডেভিডকে অভ্যর্থনা জানাল ইলা।

‘এভাবে বলো না তো ইলা।’ জানিয়ে দিল ডেবরা। লজ্জা পেয়ে গোলাপি হয়ে গেল সে। হেসে উঠল ইলা। এমনভাবে যে অন্য দু’জনও যোগ দিতে বাধ্য হলো।

তালগাছের নিচে বসল সবাই। মাটির জগ থেকে ওয়াইন নিয়ে নিল সকলে। আর বিরতি ছাড়াই চলল খাওয়া। হাসি-গল্প। ডেভিড আর ডেবরা একে অন্যকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে ইলা’র মন্তব্যে কিছুই মনে করল না।

ডেবরার পরিবর্তন হলো একেবারে নাটকীয়। সমস্ত শীতলতা চলে গেছে কোথায় যেন। যে আবরণে ঢেকে রেখেছিল নিজের অনুভূতি সেটাও খসে পড়েছে। ভালোবাসার স্পর্শে আবারও প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে মেয়েটা।

ডেভিডের একেবারে পাশ ঘেঁষে বসে আছে সে। হাসছে প্রাণ খুলে, একটু পরপরই ঝুঁকে যাচ্ছে ডেভিডের দিকে। মনে হলো যেন নিজেকেই নিশ্চিত করতে চাইছে ডেভিডের উপস্থিতি সম্পর্কে।

আবারো ডেভিডের দিকে তাকাল ইলা। চাইল স্বাভাবিকভাবে হাসতে। কিন্তু অপরাধীর মতো মনে এলো আরো নানা ভাব–বিতৃষ্ণা আর অনুতাপ দানবীয় মাথাটাকে দেখলেই এমন লাগছে তার। মনে হলো প্রতিদিন এভাবে যদি বিশ বছর ধরে ও এটা দেখতে থাকে, এখনকার মতোই লাগবে তার।

ডেভিডের কোন একটা কথায় আবারো হেসে উঠল ডেবরা। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল ডেভিডের দিকে।

বিধ্বস্ত মাথা নিয়ে ডেভিডও ঝুঁকলো ডেবরার দিকে।

অসাধারণ সুন্দর একটি মুখের উপর এরকম ক্ষত-বিক্ষত মাংসাল মুখোশটা দেখে অবাক হলো ইলা।

ঠিক কাজটাই হয়েছে। একবারের জন্য হলেও সঠিক কাজটিই করেছি আমি। ওদের দুজনকে দেখতে দেখতে কেমন হিংসা বোধ করল ইলা। এই দু’জন দুজনের কাছে পুরোপুরি বাধা পড়ে গেছে। পারস্পরিক আচরণ দিয়ে হয়ে উঠেছে অবিচ্ছেদ্য।

মন খারাপ করে ইলা ভাবল স্মৃতির কোণে থাকা প্রেমিকদের লাইনের ছায়া। মনে হলো এরকম কোন বন্ধনে যদি সে নিজেও আবদ্ধ হতে পারতো। নাক টানলো ইলা। ডেভিড আর ডেবরা দুজনেই প্রশ্নবোধক ভাবে তাকাল তার দিকে।

‘বেদনার শব্দ, ইলা ডার্লিং!’ বলে উঠল ডেভরা। আমরা স্বার্থপরের মতো আচরণ করছি। প্লিজ কিছু মনে করো না।

‘কোনই বেদনা নেই, বাছারা আমার।’ ব্যাপারটাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল ইলা। হাত ঝেড়ে বিদায় করে দিল নিজের স্মৃতির বোঝ। আমি তোমাদেরকে নিয়ে খুশি। তোমাদের মাঝে বেশ চমকপ্রদ কিছু ব্যাপার আছে–সুন্দর, শক্তিশালী আর অসাধারণ। নিজের জীবনের মতোই একে আগলে রেখো।’

নিজের ওয়াইন গ্লাস তুলে নিল সে। আমি টোস্ট করছি। আমি তোমাদেরকে দিয়েছি ডেভিড আর ডেবরা। কষ্ট সহ্য করেই এ ভালোবাসা হয়ে উঠেছে দুর্ভেদ্য।

সিরিয়াস ভঙ্গিতে টোস্ট করল সকলে। সোনালি হলুদ সূর্যালোকের নিচে বসে সোনালি হলুদ তরল পান করতে লাগল তিনজনে। আবারো অবশ্য অ্যাড ফিরে এলো। হাসিখুশি হয়ে উঠল তিনজনে।

অবশেষে শারীরিক চাহিদা মেটার পর আত্মিক দিকে এগিয়ে গেল দু’জনে। এর আগে এভাবে কখনো কথা বলেনি দু’জনে। এমনকি মালিক স্ট্রিটের বাসাতেও বাহূল্যমণ্ডিত সব শব্দ ব্যবহার করতো।

এখন সত্যিকার অর্থেই কথা বলা শিখেছে তারা। কোন কোন রাতে একেবারেই ঘুমোতো না তারা। জেগে থেকে অন্ধকারের মাঝে আবিষ্কার করে চলল একে অন্যের শরীর আর চেতনাকে। আনন্দের সাথে আবিষ্কার করল যে এ অভিযান বোধহয় কখনো শেষ হবে না। দুজনের মানসিক গণ্ডি কোন সীমানা দ্বারা আবদ্ধ নয়।

দিনের বেলা অন্ধ মেয়েটা ডেভিডকে শেখাতে লাগল কেমন করে দেখতে হয়। ডেভিড বুঝতে পারল যে নিজের চোখ আসলে কখনো ব্যবহারই করেনি সে। এখন দু’জনের হয়ে দেখার কাজ করার জন্য চোখকে সর্বোচ্চ ভাবে ব্যবহার করা শিখে গেল সে। প্রতিটি রঙ, গড়ন আর চলন হতে হবে একেবারে নিখুঁত। কেননা ডেবরার দাবি অগ্রাহ্য করা যাবে না। সবকিছু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা চাই তার।

অন্যদিকে ডেভিড, যার নিজের আত্মবিশ্বাসই প্রায় টলে উঠেছিল, মেয়েটাকে শেখাতে থাকল কেমন করে নিজের উপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হয়। ডেভিডের উপর বিশ্বাস বেড়ে যেতে লাগল ডেবরার আর ওর চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হলো ডেভিড। সাহস নিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে ডেভিডের পাশে চলতে থাকল ডেবরা। জানে স্পর্শ বা ছোট্ট শব্দ দিয়ে তাকে পথ দেখাবে, সতর্ক করবে ডেভিড। ওর জীবন নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল কটেজ আর জেটি–এটুকুর মাঝে। এখন ডেভিড পাশে থাকায় আবারো বাইরের দুনিয়ায় আসার সাহস পেল মেয়েটা।

তারপরেও প্রথমে প্রথমে সাবধানে বের হতে লাগল দুজনে। একসাথে লেকের পাশে বেড়ানো বা পাহাড় বেয়ে নাজারেথের দিকে উঠে যাওয়া। প্রতিদিন সবুজ লেকের পানিতে সাঁতার কাটা আর মশারি ঘেরা বিছানায় আলিঙ্গন।

আবারো কৃশকায়, শক্তপোক্ত আর সান ট্যানড় হয়ে উঠল ডেভিড। মনে হলো তারা পূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমন একদিন ইলা জানতে চাইল

‘ডেবরা, নতুন বইয়ের কাজ শুরু করবে কবে?’ হেসে হালকা স্বরে উত্তর দিল ডেবরা।

‘আগামী এক বছরের মাঝে যে কোন সময়ে।

এক সপ্তাহ পর ডেভিডের কাছে জানতে চাইল, এখন তুমি কী করবে, ঠিক করেছে ডেভি?

‘ঠিক এখন যা করছি, তাই।’ উত্তর দিল ডেভিড। তাড়াতাড়ি ডেবরাও সায় দিল। সব সময়। ঠিক এভাবেই কাটবে চিরকাল।

এরপর এ সম্পর্কে কোন কিছু না ভেবেই, নিজেদেরকে এর জন্য প্রস্তুত না করেই গির্জা, যেখানে আরো অনেকের সাথে তাদের দেখা হবে যাবার প্রস্তুতি নিল তারা।

স্পিডবোট ধার নিল ডেভিড। ইলার কাছ থেকে নিল বাজারের ফর্দ। পরিকল্পনা করল লেক থেকে তিবেরিয়াসে যাবে।

লিডোর ছোট্ট পোর্টে নোঙ্গর করল তারা। তারপর হেঁটে প্রবেশ করল শহরে। ডেবরার সাহচর্যে এতটাই উৎফুল্ল ছিল ডেভিড যে তার চারপাশে খানিকটা উৎসুক দৃষ্টির ভিড় দেখলেও গ্রাহ্য করল না।

সিজন এখনো ভালো ভাবে শুরু হয়নি। তারপরেও শহর ভরে গেছে ভ্রমণার্থীতে। পাহাড়ের পায়ের কাছে স্কয়ারে পার্ক করে রাখা আছে অনেক বাস। লেকের সামনেও বাস আছে। তাই বোঝা গেল এ রাস্তা ভর্তি হয়ে আছে ভ্রমণার্থিতে।

হাতে প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে কেনাকাটা শুরু করল ডেভিড। একটু পরেই দেখা গেল ভারী হয়ে উঠেছে ব্যাগটা। এরপর তো উপচে ওঠার জোগাড় প্রায়।

‘রুটি আর হয়েছে। অনেক কিছু হয়ে গেছে। আর লাগবে না। নিজের মনেই ফর্দতে টিক চিহ্ন দিচ্ছে ডেবরা।

ইউকালিপটাস গাছের নিচ দিয়ে পাহাড়ের নিচে গেল দুজনে। পোতাশ্রয় দেয়ালের দিকে রঙিন ছাতার নিচে বসল একটা টেবিলে।

এমন ভাবে বসল যেন একে অন্যকে স্পর্শ করে রাখা যায়। পেশতা বাদাম খেতে খেতে ঠাণ্ডা বীয়ার পান করতে লাগল। সবকিছু সম্পর্কে কেমন উদাসীন মনে হলো তাদের। যদিও চারপাশের টেবিল ভরে আছে টুরিস্টে। চকচক করছে লেকের পানি। নরম আর গোলাকৃতি পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছে একেবারে কাছে। একবার উপত্যকার ওপাশে নামল একটা ফ্যান্টম প্লেন। খুব নিচু দিয়ে উড়ে গেল রহস্যজনকভাবে। এরপর কোন কিছু ছাড়াই আবার চলে গেল দক্ষিণে।

সূর্য নিচে নেমে এলে নোঙ্গড়ে বাঁধা স্পিডবোটের কাছে গেল দুজনে। হাত ধরে ডেবরাকে নামতে সাহায্য করল ডেভিড। তাদের উপরের দেয়ালে বসেছিল একদল টুরিস্ট। হতে পারে প্যাকেজের আওতায় তীর্থে এসেছে।

মোটর স্টার্ট দিয়ে দেয়াল থেকে সরে আসতে লাগল ডেভিড বোট নিয়ে। ষ্টিয়ারিং ধরে পোতাশ্রয়ের মুখে নিয়ে যাচ্ছে স্পিডবোট। পাশে বসে আছে ডেবরা। নরম স্বরে শব্দ করতে লাগল বোট।

বড়সড় লালমুখো একটা টুরিস্ট তাকাল দেয়ালের উপর থেকে নিচে। মনে করল মোটরের গুঞ্জনে চাপা পড়ে যাবে তার গলার স্বর। এমন ভাবে বলে উঠল স্ত্রীকে।

‘দু’জনের দিকে তাকিয়ে দেখো মেবিস। বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট, তাই না?

‘বাদ দাও বার্ট। তারা হয়তো বুঝতে পারবে।’

‘আরে ধূর! ওরা শুধুমাত্র হিব্রু বোঝে।

ডেবরা অনুভব করল তার হাতের নিচে শক্ত হয়ে গেল ডেভিডের হাত। বুঝতে পারল ঝটকা মেরে ছাড়া পেতে চাইছে ডেভিড। বুঝতে পারল রেগে উঠছে। কিন্তু শক্ত করে হাত ধরে শান্ত করতে চাইল ডেবরা।

‘চলো ডেভি, ওদের কথা ছাড়ো ডার্লিং, প্লিজ।

এমনকি কটেজের নিরাপত্তায় একা হবার পরেও চুপচাপই রইলো ডেভিড। শরীরে টেনশনের আভাস পেল ডেবরা। বাতাসও ভারী হয়ে আছে এতে।

একই ভাবে চুপচাপ নিঃশব্দে চিজ, রুটি, মাছ আর ফিগ দিয়ে রাতের খাবার শেষ করল দু’জনে। কী বলে ডেভিডের মন ভালো করে দেবে বুঝতে পারল না ডেবরা। কেননা শব্দগুলো তাকেও সমান ভাবে আঘাত করেছে। এরপর শুয়ে পড়ল তারা। দু’জনেই জানে জেগে আছে তারা। ডেবরাকে না ছুঁয়ে দুই হাত পাশে রেখে শুয়ে পড়ল ডেভিড। আর সহ্য করতে পারছে না ডেবরা। পাশ ফিরে ডেভিডের মুখে হাত বুলাতে লাগল। এখনো জানে না কী বলবে। কিন্তু নীরবতা ভাঙলো প্রথমে ডেভিড।

‘আমি মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে চাই–আমাদের কাউকে দরকার নেই, তাই না?

না। ফিসফিস করল সে। আমাদের কাউকে দরকার নেই।’

জাবুলানি নামে একটা জায়গা আছে। আফ্রিকান জঙ্গলের মাঝে, কাছের শহরটাও বেশ দূরে। ত্রিশ বছর আগে আমার বাবা এটা কিনেছিল হান্টিং লজ হিসেবে। এখন এটা আমার…।’

‘বলো এ সম্পর্কে। ডেভিডের বুকের উপর মাথা রাখল ডেবরা। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে কথা বলতে লাগল ডেভিড। কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে এখন।

অনেক বড় একটা সমভূমি অঞ্চল আছে। যেখানে খোলা জায়গায় জঙ্গলের মতো জন্মে থাকে মোপানি, মোহোবাহোবা, মোটাসোটা বাবারস আর কয়েকটা আইভরি তাল। এছাড়াও আছে হলুদ রঙের ঘাস। সমভূমির শেষে পাহাড়ের সারি। দূর থেকে দেখতে মনে হয় নীলের সারি। পাহাড়ের মাথাগুলো দেখে মনে হবে রূপকথার কোন প্রাসাদের গ্রানাইটের চূড়া। পাহাড়ের মাঝে আছে ঝরনা; যার জল কখনো শুকায় না; আর পানিও বেশ পরিষ্কার আর মিষ্টি

‘জাবুলানি কথাটার অর্থ কী? জানতে চাইল ডেবরা।

এর মানে আনন্দের জায়গা। জানাল ডেভিড।

‘আমি যেতে চাই ওখানে তোমার সাথে।

‘আর ইস্রায়েল? তুমি মিস করবে না?’ ডেবরার উত্তরে প্রশ্ন করল ডেভিড।

না। মাথা নাড়ল ডেবরা। দেখো আমার সাথেই যাবে এটি, আমার হৃদয়ে থাকবে।’

তাদের সাথে জেরুজালেমে গেল ইলা। গাড়ির পেছনের সিটের পুরোটা জায়গাই দখল করল সে। বাসা থেকে কোন কোন ফার্নিচার নেয়া হবে সে ব্যাপারে মনস্থির করতে ডেবরাকে সাহায্য করবে ইলা। পরে সেগুলো বেঁধে জাহাজে তুলে দেয়া হবে। বাকি আসবাবপত্র ওদের হয়ে বিক্রি করে দেবে ইলা। অ্যারন কোহেন বাড়ি বিক্রির তদবির করবে। ডেভিড আর ডেবরা দু’জনেরই মন খারাপ হয়ে গেল এটা ভেবে যে তাদের ঘরে থাকবে অন্য কেউ।

বাড়িতে মহিলাদের রেখে মার্সিজিড নিয়ে ইন কারেমে গেল ডেভিড। বাগানের পাশের দেয়ালের কাছে পার্ক করে রাখল গাড়ি।

আঙ্গিনার কাছের ঘরটাতে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল ব্রিগ। দরজার কাছে ডেভিডের সম্ভাষণের উত্তরেও ঠাণ্ডা ভাবে তাকিয়ে রইল ব্রিগ। লৌহকঠিন অবয়বের মাঝে কোন সহজ ভাব নেই। নিষ্ঠুর যোদ্ধার চোখগুলোতে নেই কোন আন্তরিকতার চিহ্ন।

‘আমার ছেলের রক্ত হাতে নিয়ে এখানে এসেছো তুমি। বরফের মতো জমে গেল ডেভিড ব্রিগের চাহনি দেখে আর কথা শুনে। কিছুক্ষণ পরে দেয়ালের সাথে লাগানো উঁচু পিঠওয়ালা চেয়ার ইঙ্গিত করে দেখাল ব্রিগ। আড়ষ্ট পায়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসল ডেভিড।

‘যদি তুমি আরেকটু কম ভুগতে তাহলে আমি হয়তো আরো একটু বলার সুযোগ পেতাম। জানাল ব্রিগ। কিন্তু তুমি বুঝতেই পারছো যে প্রতিশোধ আর ঘৃণা কোন কাজের কথা নয়।’

মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে রাখল ডেভিড।

‘আমার হৃদয় বলা সত্ত্বেও হয়তো তোমার জায়গায় আমি হলে ওদের পিছু নিতাম না। এ কারণেই তোমাকে দোষারোপ করছি আমি। তোমার মাথা গরম। ভায়োলেন্স হলো বোকাদের আনন্দ আর বুদ্ধিমানদের শেষ ভরসা। এটি করার একমাত্র কারণ হলো যা তোমাকে তা রক্ষা করা–ভায়োলেন্সের অন্য কোন ব্যবহার কখনোই কাম্য নয়। তোমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছি আমি, তার অপব্যবহার করেছো তুমি। আর এর মাধ্যমে আমার ছেলেকে খুন করেছ, আমার দেশকে যুদ্ধের দোড়গোড়ার দাঁড় করিয়ে দিয়েছ।

নিজের ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়াল ব্রিগ। হেঁটে গিয়ে জানালার নিচে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল বাগানের দিকে। দু’জনেই চুপ করে রইল। মোচের উপর হাত বুলাতে বুলাতে ছেলের কথা ভাবতে লাগল ব্রিগ।

অবশেষে ভারী হৃদয়ে কাঁধ নাড়িয়ে রুমের মাঝখানে আবারো ফিরে এলো।

‘কেন আমার কাছে এসেছে তুমি? ডেভিডের কাছে জানতে চাইল ব্রিগ।

‘আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই– স্যার।

‘আমাকে জিজ্ঞেস করছো নাকি জানাচ্ছো? আবারো প্রশ্ন করল ব্রিগ। এরপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই ডেস্কের কাছে গিয়ে বসে পড়ল, যদি তুমি এই ক্ষমতার অপব্যবহার করো–ওকে ব্যথা দাও বা অসুখী রাখো, মনে রেখো আমি তোমাকে খুঁজে বের করব।’

উঠে দাঁড়িয়ে মাথার উপর কাপড়ের টুপিটা ঠিক ঠিক বসিয়ে নিল ডেভিড।

‘আমরা চাই আপনি বিয়েতে আসুন। ডেবরা বিশেষ ভাবে এটা চেয়েছে– আপনি আর ওর মা।

মাথা নাড়ল ব্রিগ। ওকে জানিয়ে আমরা আসব।

.

জেরুজালেম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রার্থনার স্থানটি উজ্জ্বল সাদা রঙে নির্মিত।

লাল পাপড়ির গাছটা ছেয়ে গেছে ফুলে। আর যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও বড় হয়ে গেছে বিয়ের পার্টি। পরিবারের একদম কাছের মানুষ ছাড়াও এসেছে ডেবরার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী, স্কোয়াড্রন থেকে রবার্ট আর আরো জনা কয়েক ছেলে, ইলা কাঁদেশ, ডাক্তার ইদেলমান আর শিশুসুলভ চেহারার চোখের সার্জন, যিনি ডেবরাকে নিয়ে কাজ করেছেন, অ্যারন কোহেন আর আরো ডজনখানেক ব্যক্তি।

সাধারণ আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনা পেরিয়ে ডেভিডের ভাড়া করে রাখা অভ্যর্থনাকক্ষে পৌঁছায় সকলে। সবাই বেশ চুপচাপ। কোন হাসি তামাশা নেইই প্রায়। ডেভিডের পুরোন স্কোয়াড্রনের তরুণ পাইলটেরা তাড়াহুড়া করে ফিরে গেল বেসে। আর তাদের সাথে সাথে শেষ হয়ে গেল আনন্দের অভিনয়।

ডেবরার মা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। আর ডেবরার আসন্ন প্রস্থানের কথা ভেবেও কাঁদতে লাগল মহিলা। শান্ত করার চেষ্টা করলো ডেবরা। যদিও কোন লাভ হলো না।

চলে যাবার আগে ডেভিডকে ডেকে একপাশে নিয়ে গেল ডাক্তার ইফেলমান।

‘ওর চোখের দিকে খেয়াল রেখো, কোন ঝাপসা ভাব, অতিরিক্ত লাল ভাব–কোন ধরনের ব্যথা, মাথাব্যথা–

‘আমি খেয়াল রাখবো।

করমর্দন করল দু’জনে। নতুন জীবনের জন্যে শুভ কামনা রইল। জানাল ডাক্তার।

এ পর্যন্ত সমস্ত কিছুর উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখল ডেবরা। কিন্তু একেবারে শেষমুহূর্তে আর পারল না। সে, তার মা আর ইলা কাঁদেশ হঠাৎ করেই লড বিমানবন্দরের বহির্গমন ফটকের কাছে এসে একে অন্যের কাঁধে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

শক্ত আর অপ্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল ব্রিগ আর ডেভিড। মনে হলো ক্রন্দনরত কাউকে তারা চেনেই না। প্রথমবার সাবধানবাণী ভেসে আসতেই সংক্ষিপ্ত করমর্দন সেরে আস্তে করে ডেবরার হাত ধরে ঢুকে গেল ডেভিড, দরজার ভেতরে।

অপেক্ষারত বোয়িংয়ের সিঁড়িতে উঠে গেল একবারও পেছন দিকে না তাকিয়ে। বিশাল উড়োজাহাজ উড়ে গেল আকাশে। ঘুরে গেল দক্ষিণ দিকে। আর মনে হলো হারানো কিছু একটা খুঁজে পেল ডেভিড; শেষ ক’দিনের উদ্বেগ পড়ে রইল বহু নিচে, মাটির কাছাকাছি। নতুন কিছুর সম্ভাবনায় আচ্ছন্ন করে তুলল তাকে।

আস্তে করে চাপ দিল ডেবরার হাতে।

হ্যালো দেয়ার, মরগান। ডেভিডের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি মুখে হাসল অন্ধ মেয়েটা।

.

উত্তরে জাবুলানিতে যাবার আগে কেপ টাউনে সময় কাটানোর প্রয়োজন হলো।

মাউন্ট নেলসন হোটেলে স্যুইট নিল ডেভিড। আর এখানে বসেই অনুপস্থিতির জন্য জমে যাওয়া হাজারো কাজ শেষ করতে উদ্যত হলো ডেভিড।

তার ট্রাস্ট ফান্ডের দায়িত্বে থাকা অ্যাকাউন্ট্যান্ট দশ দিন সময় চাইল। এই দশ দিন সিটিং রুমে বসে কাগজপত্রের উপর কাজ করেই সময় কাটালো।

এই দুই বছরে ব্যয়ের তুলনায় আয়ের পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে। আর এই অর্থ পুনরায় কোথাও বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি তৃতীয় ট্রাস্ট ফান্ড ও শীঘি বুঝিয়ে দেয়া হবে তাকে। সেসব আনুষ্ঠানিকতাও বাকি আছে।

ডেভিডের সম্পদের পাহাড় দেখে হতম্ভব হয়ে গেল ডেবরা।

‘তুমি তো প্রায় একজন মিলিয়নিয়ারই হয়ে গেছ।’ বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল ডেবরা।

‘হুম, আমি তো আর যেমন তেমন নই।’ একমত হলো ডেভিড। নিজের সম্পর্কে ওর রসিকতা শুনে স্বস্তি পেল ডেবরা।

মিটজি এলো তার নতুন স্বামীকে নিয়ে। যাই হোক ভাল কাটলো না সন্ধ্যাটা! মিটজি চেষ্টা করল এমন ভাব করতে যেন কিছুই বদলায়নি। কিন্তু পরিষ্কার বোঝা গেল যে “ওয়ারিওর ডেকে চললেও তার মনোভাবের পরিবর্তন। হয়েছে।

সন্তানসম্ভবা মিটজি এতটাই বেসাইজ হয়ে গেছে শারীরিক ভাবে যে। অবাক হয়ে গেল ডেভিড। প্রায় অর্ধেক সময় কেটে যাবার পর প্রকৃত কারণ উপলব্ধি করল ডেভিড।

প্রথম দিকে সে ভেবেছিল যে তার শারীরিক পরিবর্তন আড়ষ্ট করে রেখেছে মিটজিকে। কিন্তু একটু পরেই ব্যাপরটা খোলাসা করে দিল মিটজি। সিসিল মরগ্যান গ্রুপে ইতিমধ্যেই পল মরগ্যানের হাত ধরে কেউকেটা টাইপের কেউ একজন হয়ে উঠেছে। কিছুই জানে না এমন ভঙ্গিতে সিসিল জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী গ্রুপে যোগ দেবার ব্যাপারে কিছু ভাবছো? আমি নিশ্চিত তুমি করার মতোও কিছু না কিছু নিশ্চয় পাওয়া যাবে হা, হা!”

আস্তে করে তাদেরকে নিশ্চয়তা দিল ডেভিড।

‘না, ধন্যবাদ। আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই সিসিল। আংকেল পল থেকে সব বুঝে নিতে পারো তুমি। আমার আশীর্বাদসহ।

‘গুড লর্ড, আমি এটা বলতেই চাইনি।’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল সিসিল। কিন্তু বোকা মিটজি বলে উঠল, ‘ও সত্যিই বেশ ভালো করবে, ওয়ারিওর আর তোমার তো কখনোই এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল না, তাই না।’

এই সন্ধ্যার পর এ সম্পত্তির সাথে আর দেখা হয়নি তাদের। আর পল মরগ্যান নিজে আছেন ইউরোপে। তাই বেশি যন্ত্রণা ছাড়াই পারিবারিক কাজ শেষ করল ডেভিড। জাবুলানি যাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করল সে।

বার্নি ভেন্টার এক সপ্তাহ তাদের সাথে কাটিয়ে জঙ্গলে এয়ারস্ট্রিপ ঠিক করে দিল এয়ার ক্রাফটের জন্য। এছাড়াও মনমত পারফরমেন্স দিল ডেভিডকে। অবশেষে জোড়া ইঞ্জিন বিশিষ্ট পাইপারি নাঙাজো পছন্দ করল তারা। ছয় আসন বিশিষ্ট বিমানটাতে আছে দুটো বড় বড় ৩০০ এইচ পি. লিকোমিং ইঞ্জিন আর ট্রাইসাইকেল আন্ডারকার্ট। কোমরে হাত রেখে চারপাশে থেকে জরিপ করল বার্নি।

যাক, সে মিরেজ নয়। ল্যান্ডিং হুইলে লাথি মেরে নিজের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি আবার ডেভিডের দিকে তাকাল বার্নি।

‘আমি মিরেজ নিয়ে যথেষ্ট খেলা করেছি।’ জানিয়ে দিল ডেভিড। ওরা কামড় দেয়!

শেষ দিনে পার্লের কাছে একটা ফার্মে গাড়ি চালিয়ে ডেবরাকে নিয়ে গেল ডেভিড। কুকুরের বাচ্চা প্রসব করায় মালিকের স্ত্রী। কুকুরের ঘরগুলোর কাছে যেতেই একটা ল্যাব্রাডর কুকুরছানা সরাসরি এগিয়ে এলো ডেবরার কাছে। ডেবরার পায়ে ঠাণ্ডা নাক ঘসে গন্ধ শুঁকতে লাগল। মাথায় হাত বুলাতে চাইল ডেবরা। কয়েক মিনিট পর সামনে ঝুঁকে কুকুরছানার লোমের গন্ধ নিল।

‘পুরোন চামড়ার গন্ধ আসছে ওর গা থেকে। বলে উঠল ডেবরা। কেমন গায়ের রঙ ওর?

কালো। জানাল ডেভিড। জুলুদের মতো কালো।

‘এই নামেই ওকে ডাকবো আমরা।’ জানিয়ে দিল ডেবরা।

‘জুলু।

তুমি ওকে পছন্দ করতে চাও?’ জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

না।’ হেসে ফেলল ডেবরা। ও আমাদেরকে পছন্দ করেছে।’

পরদিন সকালে উত্তর দিকে উড়ে যাবার সময় পেছনের সিটে বসে মনে হলো মন খারাপ করল জুলু। এক লাফ দিয়ে উঠে এলো ডেবরার কাঁধের উপর দিয়ে কোলে। এবার মনে হলো দু’জনের ভালই জমবে।

‘মনে হচ্ছে আমাকে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। করুণ সুরে জানাল ডেভিড।

বাদামী মালভূমি পার হয়ে মাটি ধপ করে খাড়া নেমে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে।

বুশ বাক রিজ আর চিকন সাপের মতো আঁকাবাঁকা সারি নদী দেখে পথ চিনে নিল ডেভিড। সমভূমি মাঝ দিয়ে পথ এগিয়েছে। খানিকটা উত্তরে কোর্স পরিবর্তন করল ডেভিড। দশ মিনিটের মাথায় দেখতে পেল নীল পাহাড়ের সারি।

‘এই তো আমাদের সামনেই। ডেবরাকে জানাল ডেভিড। বোঝা গেল তার উত্তেজনা প্রশমিত হলো ডেবরার মাঝেও। কুকুরটাকে নিজের কাছে চেপে ধরে ডেভিডের দিকে ঝুঁকে এলো।

কেমন লাগছে দেখতে?

বড় বড় কাঠের গাছ সারা পাহাড় জুড়ে। আর নিচে ধূসর পাথরের গম্বুজ। সেখানে ঘন আর অন্ধকার ঝোঁপঝাড়। আঁধারের মাঝে নরম আলো ছড়াচ্ছে পুল। ডেবরার কাছে বর্ণনা দিল ডেভিড।

‘আমার বাবা এদের নাম রেখেছিল “মুক্তোর মালা…।” এরকমই দেখতে তারা। পাহাড়ের পেছনে গড়নে জমি বেয়ে বৃষ্টির জল যাবার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এগুলো। আবার ঠিক হঠাৎ করে সমভূমির বালুর অংশে হারিয়ে গেছে। পাহাড়ের উপর দিয়ে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে নিচে নামতে লাগল ডেভিড। এর মাধ্যমেই জাবুলানির চরিত্রে বিশেষজ্ঞ যোগ হয়েছে। সমভূমির সমস্ত বন্য প্রাণীরা পানি পায় এখান থেকে। পশুপাখিরা শত মাইল পার হয়েও মুক্তোর তীরে আসে। প্লেন সমান করে থ্রটল পেছন দিকে টেনে দিল ডেভিড। নিচে নেমে আসতে লাগল এয়ারক্রাফট। এখানে আছে খড়ের চাল, সাদা দেয়াল। ফলে আবাসভূমি গরমকালে ঠাণ্ডা থাকে; ছায়া ঢাকা বারান্দা আর উঁচু উঁচু রুম-তোমার ভালো লাগবে।’

এয়ারস্ট্রিপ দেখে মনে হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর নিরাপদ। তার পরেও খানিকক্ষণ চক্রাকারে ঘুরে ল্যান্ডিংয়ে কাজ শুরু করল ডেভিড। গাছের ফাঁকে থাকা ছোট্ট পাকা ইমারতের তৈরি হ্যাঙ্গারে ট্যাক্সিইং করে গেল। হুইল ব্রেকে লাথি কষিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল।

চলে এসেছি।’ ঘোষণা করল সে।

.

ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ককে ব্লক করে রেখেছে যে কয়টি এষ্টেট, তার একটি হলো জাবুলানি। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক অঞ্চল। এই এস্টেটগুলো উৎপাদনক্ষম নয়। শস্য ফলানোর উপযুক্ত নয়, কয়েকটিতে তো শুধু বন্য প্রাণী চড়ে বেড়ায়। কিন্তু অমূল্য হচ্ছে এর প্রাণিজগত আর বনভূমি এতটাই খালি জায়গা আর শান্তি এখানে যে ধনী ব্যক্তিরা কার্পণ্য করেনি।  এখানে নিজেদের জন্য ভূমি ক্রয় করতে।

ডেভিডের পিতামহ যখন জাবুলানি ক্রয় করেছিল তখন প্রতি একরের জন্য মাত্র কয়েক শিলিং খরচ করতে হয়েছিল।

এরপর থেকে বছরের পর বছর ধরে পারিবারিক শিকার এস্টেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এটি। পল মরগ্যানের এসব ব্যাপারে কোন আগ্রহ না থাকায় উত্তরাধিকার সূত্রে ডেভিডের বাবা তারপর এখন ডেভিড হয়েছে এ ভূমির মালিক। আর এখন এই আঠারো হাজার একর আফ্রিকান বনভূমির মূল্য ছাড়িয়ে গেছে কল্পনার সীমা।

তারপরেও গত পনের বছরে মরগ্যান পরিবার এটি তেমনভাবে ব্যবহার করেনি। ডেভিডের বাবা উৎসাহী আর আগ্রহী প্রকৃতির শিকারি ছিল। তার সাথেই এখানে কেটেছে ডেভিডের বেশির ভাগ ছুটি। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর জাবুলানি আসা ধীরে ধীরে কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

শেষবার আসার পরেও প্রায় সাত বছর কেটে গেছে। সেবার কোবরা স্কোয়াড্রন থেকে তার সঙ্গী অফিসাররা এসেছিল এখানে।

তখনকার সময়ে এ জায়গার সর্বময়কর্তা ছিল স্যাম। কৃষ্ণ ওভারসিয়ার, বাটলার আর গেম রেঞ্জার।

স্যামের তদারকিতে সবসময় বিছানায় থাকতো পরিষ্কার নিজ পরিপাটি লিনেন, পালিশ করা মেঝে। দালানের বাইরের দেয়াল ছিল তুষারশুভ্র খড়ের চাল ও পরিচ্ছন্ন আর গোছানো। ডিপ ফ্রিজে সবসময় ভর্তি থাকতো স্টেক আর লিকার পূর্ণ থাকতে যত রকমের সম্ভব সব রকমের বোতল দিয়ে।

শক্ত হাতে ক্যাম্প চালাতো স্যাম। সাথে ছিল অর্ধডজন আগ্রহী আর প্রাণচঞ্চল সাহায্যকারী।

‘স্যাম কোথায়? ঘর থেকে হুড়োহুড়ি করে এয়ারক্রাফটের দিকে দৌড়ে আসা দু’জন ভূতত্যর কাছে এই ছিল ডেভিডের প্রথম প্রশ্ন।

‘স্যাম চলে গেছে।

‘কোথায়? উত্তরে দুর্বোধ্য আফ্রিকান কাঁধ ঝাঁকানি ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। লোকগুলোর পরণের কাপড় নোংরা আর সেলাইও প্রয়োজন। আচরণও কেমন কেমন, নিরুত্তাপ।

‘ল্যান্ড রোভার কোথায়?

‘মারা গেছে।

ঘরের কাছে হেঁটে গেল ডেভিড। সেখানে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তার জন্য।

দালান দেখে মনে হলো এখনি ভেঙ্গে পড়ে যাবে। কালো খড় দেখে ফুটে উঠলো হতদরিদ্র দশা। দেয়ালগুলোতে শ্যাওলা। জায়গায় জায়গায় প্লাস্টার খসে পড়ায় ধূসর বাদামী দাগ। ভেতরে সর্বত্র ধুলা। এখানে-ওখানে পাখি আর সরীসৃপের মল। ছাদে বাসা বেধেছে এগুলো।

মশার জালে–যার মাধ্যমে চওড়া বারান্দায় কোন পোকা–মাকড় ঢুকতে পারতো না–মরিচা পড়েছে। জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে।

সবজি বাগানেও কোন ফসল নেই। পাশের বেড়া টুকরো টুকরো অবস্থায় ভেঙে পড়ে আছে। বাসার চারপাশেও বড় বড় আগাছা। শুধুমাত্র ল্যান্ড রোভারই নয় পুরো বাড়ির কোন যন্ত্রাংশই ঠিক ভাবে কাজ করছে না। পানির পাম্প, টয়লেট ফ্লাশ, বৈদ্যুতিক জেনারেটর, মোটর ভেহিকেল–কিছুই ঠিক নেই।

‘ভয়াবহ অবস্থা হয়ে আছে সবকিছুর সামনের সিঁড়িতে বসে মগ থেকে মিষ্টি চা খেতে খেতে ডেবরাকে জানাল ডেভিড। ভাগ্যিস নিজেদের সাথে জরুরি কিছু রসদ নিয়ে এসেছিল ডেভিড।

“ওহ, ডেভি। আমি দুঃখিত। আমিই তো আসতে চেয়েছি এই জায়গায়। চারপাশ এত চুপচাপ যে বেশ শান্তি এখানে। আমার মনে হচ্ছে আমার নার্ভগুলো নির্ভার হয়ে গেছে এখানে এসে।

‘দুঃখিত হয়ো না। আমি তো তা নই। বিশেষ দশকের দিকে এই পুরোন কুঁড়েঘরগুলো বানানো হয়েছিল–তখনো সেভাবে যত্ন নিয়ে বানানো হয়নি। গলার স্বরে বোঝা গেল নতুন প্রেরণা খুঁজে পেয়েছে ডেভিড। অনেক দিন যাবৎ ওর কণ্ঠে একটা দৃঢ়তা ভাব আর টের পায়নি ডেবরা। ভালোই হলো এতে। পুরোটা ভেঙে নতুন করে বানানোর অযুহাত পাওয়া গেল।

‘আমাদের নিজেদের মতো করে? জানতে চাইল ডেবরা।

‘ঠিক তাই। আনন্দ ঝরে পড়লো ডেভিডের কণ্ঠে। তাই হবে। ঠিক তাই।’

পরের দিন কাছাকাছি সবচেয়ে বড় শহর নেলস্ট উড়ে গেল তারা। এর পরের সপ্তাহ পরিকল্পনা আর জোগাড় যন্তর নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ভাবে কেটে গেল যে, তারা তাদের সব বড় বড় সমস্যার কথা ভুলেই গেল। একজন স্থাপত্যবিদের সহায়তায় অনেক যত্ন নিয়ে নিজেদের বিশেষ প্রয়োজনগুলোর কথা মাথায় রেখে নতুন বাসার নকশা ঠিক হলো-বাতাস চলাচল করে এরকম বড় সড় একটা স্টাডি ডেবরার জন্যে। ডেভিডের জন্য ওয়ার্কশপ আর অফিস। একজন অন্ধ রাধুনির জন্য সহজ ভাবে চলাচল যোগ্য নিরাপদ রান্নাঘর। রুম গুলোতে কোন বিপজ্জনক মোড় রইল না। সহজেই চেনা যায় এমন আকার আর সবশেষে একটা নার্সারি সেকশন। এ অংশের কথা ডেবরাকে জানাবার পর ডেভিডকে সে চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোন একটা প্ল্যান করছে, যা আমাকে জানাওনি।

‘ধীরে ধীরে জেনে যাবে। ঠিক আছে? নিশ্চয়তা দিল ডেভিড।

গেস্ট হাউজ করা হলো আলাদা আর স্বয়ংসম্পূর্ণ। মূল বাসা থেকে দূরে রইল এটি। এর থেকেও প্রায় কোয়ার্টার মাইল পেছনে তৈরি করা হলো ভূত্যদের থাকার কোয়ার্টার। সামনে গাছের পর্দা আর পাথুরে ভূমি।

নেলস্প্রুটে একজন বিল্ডিং কন্ট্রাকটরকে ঘুষ দিল ডেভিড। ফলে সব কাজ ফেলে রেখে চারটা ভারী ট্রাকে করে নিজের লোকদের নিয়ে জাবুলানিতে এসে হাজির হলো কন্ট্রাকটর।

মূল ঘর নিয়ে কাজ শুরু করল তারা। এই ফাঁকে ডেভিড ব্যস্ত হয়ে পড়ল এয়ারস্ট্রিপ নিয়ে। এছাড়াও খানিকটা বেঁচে বর্তে আছে এমন যন্ত্র আর ওয়াটার পাম্পও ঠিক করে ফেলল। কিন্তু ল্যান্ড রোভার আর বৈদ্যুতিক জেনারেটর পুরো বদলে ফেলতে হলো।

দু’মাসের মাঝেই বসবাসযোগ্য হয়ে গেল নতুন ঘর। সামনে বাগানের দিকে মুখ করে থাকা বিশাল জানালার নিচে নিজের টেপ রেকর্ডার বসালো ডেবরা। সন্ধ্যার বাতাস এসে শীতল করে তোলে রুম। ভরে ওঠে ফ্রাঞ্জিপানি আর পইনসেটিয়ার সুভাসে।

জাবুলানিকে আরামদায়ক করে তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ডেভিড। এ সুযোগে নিজের কাজ গুছিয়ে নিল ডেবরা।

খুব দ্রুত চারপাশ সম্পর্কে সব জেনে নিল সে স্পর্শ আর অনুভূতির মাধ্যমে। মনের মধ্যে গেঁথে নিল পুরো জায়গার ছবি। সপ্তাহখানেকের মাঝেই স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানুষের মতো হাঁটাচলা করায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল। এছাড়া ভৃত্যদেরকেও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হলো যেন সেখানকার জিনিস সেখানেই রাখা থাকে। আর এই সব কাজে জুলু ল্যাব্রাডর কুকুরছানা চকচকে কালো ছায়া হিসেবে ঘুরতে লাগলরা ওর পিছুপিছু। অচিরেই বুঝে গেল যে ডেবরার প্রতি ওর সর্বক্ষণ নজর রাখা প্রয়োজন। তেমনি ভাবে ডেবরাই হয়ে উঠল তার প্রাণশক্তি।

শীঘ্রিই বুঝে গেল যে ডেবরার দিকে তাকিয়ে থাকা বা লেজ নাড়ানো অনর্থক। ডেবরার মনোযোগ পাবার জন্য ওকে কুই কুই আওয়াজ করতে হবে বা হাঁপানোর শব্দ করতে হবে। অন্যদিকে ভুলো মনা ডেবরা। কিছু বোকামি যেমন সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়া বা হাঁটার রাস্তার কোন বেকুব ভৃত্যের রেখে যাওয়া বালতিতে যে পা বেঁধে পড়ে না যায় ডেবরা তাই কাঁধ দিয়ে গুতো দেয়া বা নাক ঘষার মতো কাজগুলো করতে হয় জুলুকে।

এরই মাঝে প্রতিদিন দুপুর পর্যন্ত নিজের রুমে বসে কাজ করার অভ্যেস তৈরি গেল ডেবরার। পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতো জুলু।

ডেবরার রুমের বাইরের জানালার নিচে পাখির বড়সড় একটা গোসলের জায়গা ঠিক করে দিল ডেভিড। ফলে যে টেপ তৈরি করল তার ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে শোনাতে অসংখ্য বন্য পাখির কিচিরমিচির। নেলঙ্কটে একটা টাইপিস্ট আবিষ্কার করে ফেলল ডেবরা, যে কিনা হিব্রু বলতে পারে। যতবার রসদ আনতে শহরে যেত সাথে করে ডেবরার রেকর্ড করা টেপ নিয়ে যেত ডেভিড। নিজের চিঠিপত্রের সাথে প্রতিবার আসার সময় টাইপ করা কাগজ নিয়ে আসতো ডেবরাকে পড়ে শোনানোর জন্যে।

এই কাজে একত্রে কাজ করতো তারা। জোরে জোরে প্রতিটি শব্দ ডেবরাকে পড়ে শোনাতো ডেভিড। ডেবরার কথা মতো ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে দিত। এভাবে দেখা গেল সবকিছু চিৎকার করে পড়ার অভ্যেস হয়ে গেল ডেভিডের। খবরের কাগজ থেকে শুরু করে উপন্যাস, সবকিছুই চেঁচিয়ে পড়তে লাগল ডেভিড।

‘তুমি আশেপাশে থাকলে ব্রেইলির কী দরকার।’ মন্তব্য করে উঠল ডেবরা। কিন্তু শুধুমাত্র যে লিখিত শব্দই শুনতে চাইতো ডেবরা, তা নয়। চারপাশ সম্পর্কে প্রতিনিয়ত ডেভিডকে বলতে হতো ওর কাছে। তার জানালার নিচে পানি খেতে, গোসল করতে আসা, একটা পাখিও কখনো দেখেনি ডেবরা। কিন্তু অচিরেই প্রতিটির আওয়াজ পরিচিত হয়ে গেল তার কাছে। নতুন কোন পাখি এলে চট করে বুঝে ফেলতে।

‘ডেভিড, নতুন একটি পাখি এসেছে। কেমন দেখতে, নাম কী?

আর শুধু পাখা নয়, প্রতিটি খুঁটি-নাটি জিনিস বর্ণনা করতে হলো ডেভিডকে। এছাড়াও তাদের নতুন বিল্ডিং দেখতে কেমন হয়েছে, জুলুর কথা, ভৃত্যদের সুস্পষ্ট চলন বলন, জানালা দিয়ে দেখা বাইরের দৃশ্য সবকিছু মিলিয়ে নতুন জীবনের শত শত প্রশ্নের নিরন্তর উত্তর দিয়ে চলতো ডেভিড।

সময় মতো দালানের কাজ শেষ হলো আর অপরিচিত লোকজন জাবুলানি ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু ইস্রায়েল থেকে মালিক স্ট্রিটের বাসার ফার্নিচার আর অন্যান্য জিনিস না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত মনে হলো সত্যিকার অর্থে ঘর করা শুরু হলো না তাদের।

ডেবরার কাজ করার ঘরের জানালার নিচে পাতা হলো জলপাই কাঠের টেবিলটা।

‘আমি ঠিকভাবে কাজ করতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিল কী যেন নাই’ টেবিলের চারপাশে কারুকার্যের উপর হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠল ডেবরা,–এখন পর্যন্ত।

টেবিলের পাশের দেয়ালের শেষ্যে রাখা হলো ওর সব বই। আর নতুন লাউঞ্জে চামড়ার সোফা সুন্দর মানিয়ে গেল পশুর চামড়ার রাগ আর উল দিয়ে বোনা কার্পেটের সাথে।

ফায়ারপ্লেসের উপর ইলা কাদেশের আঁকা ছবিটাকে ঝুলিয়ে দিল ডেভিড। স্পর্শ করে করে এটার সঠিক অবস্থান মনের মাঝে গেঁথে নিল ডেবরা।

‘তোমার মনে হয় না এটা আরেকটু উপরে উঠলে ভালো হতো?

আর কোন কথা বলবে না মরগ্যান। আমাকে জানতে হবে যে এটি ঠিক কোথায় আছে।

এরপর বেডরুমে পাতা হলো বিশাল খাট। ঢেকে দেয়া হলো আইভরি রঙের বিছানার চাদর দিয়ে। এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুশি খুশি কণ্ঠে ডেবরা বলে উঠল।

‘এখন এখানে শুধু আরেকটা জিনিস বাকি আছে।’ ঘোষণা করল ডেবরা।

কী?’ ছদ্ম উদ্বিগ্নতার স্বরে জানতে চাইল ডেভিড। জরুরি কিছু?

এসো, এদিকে। হাত নেড়ে ডেভিডকে ডাকলো ডেবরা। “আমি তোমাকে দেখাচ্ছি এটা কতটা জরুরি।

.

এ ক’দিনের দৌড় ঝাঁপের মাঝে বাসা ছেড়ে আর কোথাও যায়নি তারা। কিন্তু হঠাৎ করেই এখন থেমে গেল সমস্ত কাজ।

‘আঠারো হাজার একর আর অসংখ্য চারপেয়ে প্রতিবেশী আছে আমাদের। চলো দেখে আসি সবাইকে।’ পরামর্শ দিল ডেভিড।

ঠাণ্ডা লাঞ্চের প্যাকেট সাথে নিয়ে নতুন ল্যান্ড রোভারে উঠে বসল তিনজন। জুলুকে জোর করে বসিয়ে রাখা হলো পেছনের সিটে। রাস্তাটা নেমে গেছে মুক্তোর ছড়ার দিকে। কেননা এস্টেটের সমস্ত প্রাণীর জীবনের কেন্দ্র হলো এটিই।

গাছপালার ফাঁকে ল্যান্ড রোভারকে পার্ক করে প্রধান পুলের কাছে তীরের উপর বানানো গ্রীষ্মের খড়ে ছাওয়া ঘরগুলোর দিকে নেমে গেল তারা।

পানি দেখে খুশি হয়ে উঠল জুলু। দু’জনের মাঝখানে খুশিতে লাফ-ঝাঁপ দিতে লাগল। বাতাসের মতোই পরিষ্কার পানি, কিন্তু গভীরে দেখা গেল কালো ছায়া।

মাটির মাঝে নখ ঢুকিয়ে গোলাপি একটা মোটাসোটা কেঁচো তুলে আনল ডেভিড। পানির গভীরে ছুঁড়ে ফেলতেই নিঃশব্দে উঠে এসে পানিতে আলোড়ন তুলল প্রায় তার হাতের সমান লম্বা একটা আকৃতি।

‘ওয়াও!’ হেসে ফেলল ডেভিড। চারপাশে এখনো এগুলো আছে। আমাদের উচিত ছিল সাথে করে বঁড়শি নিয়ে আসা। বালক বয়সে বহুদিন কাটিয়েছি আমি এখানে।

স্মৃতিতে পূর্ণ হয়ে আছে এ জঙ্গল। চারপাশে বেড়াতে বেড়াতে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল তার। এরপর আস্তে আস্তে চুপচাপ হয়ে গেল ডেভিড। জানতে চাইল ডেবরা : কী হয়েছে ডেভিড? বুঝলল কিছু একটা হয়েছে।

‘কোন প্রাণী দেখতে পাচ্ছি না। অবাক কণ্ঠে বলে উঠল ডেভিড। পাখি, হ্যাঁ আছে। কিন্তু একটাও পশু দেখিনি এখন পর্যন্ত। বাসা ছাড়ার পর থেকে একটাও না। একটা জায়গায় এসে থেমে গেল ডেভিড। এ জায়গাটা পানি খাবার জন্য চমৎকার ছিল। সারা দিন-রাত ব্যস্ততা থাকতো এখানে পশুর পাল সত্যিকার অর্থেই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে।’

ডেবরাকে ছেড়ে আরো খাদের দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। সতর্কতার সাথে উপুড় হয়ে বসে পরীক্ষা করতে লাগল মাটি। অল্প কয়েকটা কুদু আর ছোট্ট একটা বেবুনের দল। বহু মাস ধরে এখানে বড় কোন পাল আসেনি বা বছর খানেক ধরে।

ডেবরার কাছে ফিরে আসার পর জানতে চাইল মেয়েটা, তোমাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

‘পশুপাখি ছাড়া জাবুলানিকে কল্পনা করা যায় না। বিড়বিড় করে উঠল ডেভিড। চলল বাকি অংশে ঘুরে আসি। এখানে কিছু একটা আছে যা বোঝ যাচ্ছে না।

অলসভাবে ঘুরে বেড়াতে এসে পুরোদস্তুর শিকারির চোখে খোঁজা শুরু করল চারপাশ ডেভিড। প্রতিটি ঝোঁপ-ঝাড়ে চোখ বুলিয়ে দেখল। শুকিয়ে যাওয়া পানির নালা ধরে এগিয়ে গিয়ে হেঁটে দেখে এলো। এমনকি মাঝে মাঝেই ল্যান্ড রোভার থামিয়ে বন্য প্রাণীর সন্ধানে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল বালুভূমি।

‘এমনকি একটা ইম্পালাও নেই। উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত স্বরে বলে উঠল ডেভিড। এখানে হাজারে হাজারে থাকার কথা ছিল। আমার মনে আছে প্রায় প্রতিটি গাছের নিচে চকচকে বাদামী আর ব্যালে ড্যান্সারদের মতোই সুন্দর সব দল থাকতো।’

ল্যান্ড রোভারকে উত্তরদিকে ঘুরিয়ে নিল ডেভিড। গাছপালার ভিড়ে একটা ট্রাক লক্ষ্য করে ছুটে চলল।

‘এখনে একটা চারণ ভূমি আছে। যেটা অক্ষত থাকার কথা।’

দুপুরের একটু আগে ধুলায় ভর্তি পাকা রাস্তায় পৌঁছালো গাড়ি। জাবুলানির উত্তর সীমান্ত দিয়ে ছুটে চলেছে এ রাস্তা। রাস্তার পাশের বেড়া দেখা গেল ভাঙা। মাঝে মাঝেই কিছু কিছু অংশ আবার বোঝা গেল যে মাটি থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে।

‘হেল, নরক শুলজার হয়ে আছে চারপাশে। বেড়ার দিকে তাকিয়ে ডেবরাকে উদ্দেশ করে বলে উঠল ডেভিড। সীমান্ত ঘেঁষে আরো দুই মাইল এগিয়ে চলল।

এমনকি পাথরের পিলারের উপর ব্রোঞ্জের সাইনবোর্ড, যেটা ডেভিডের বাবা শখ করে লাগিয়েছিল ও যেটা নিয়ে বেশ গর্ব বোধ করতো ডেভিড— ভেঙে চুড়ে ঝুলে আছে।

‘ওয়েল, অনেক কাজ করতে হবে এখানে আমাদেরকে। নিশ্চিন্তির স্বরে বলে উঠল ডেভিড।

গেইটের বাইরে অর্ধেক মাইল গিয়েই হঠাৎ করে তীক্ষ্ণ একটা মোড় নিল গাড়ি। দুপাশে লম্বা লম্বা ঘাস। বালুময় রাস্তার পুরোটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল কুদু ষড়। ভূতের মতো বিবর্ণ আর সারা গায়ে মনে হলো চক দিয়ে লাইন টেনে রাখা হয়েছে। একনজরেই বোঝা গেল কতটা শক্তি এর গায়ে। উঁচু মাথা, কালো শিং আছে এতে, বিশাল কান দুটো এমনভাবে ঝুলে আছে যে বোঝা গেল মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনছে সে।

মাত্র সেকেন্ডের জন্যে দেখা গেল এ ভঙ্গি, এরপরই ল্যান্ড রোভার দুইশ গজ দূরে থাকলেও ধোয়ার মতো মিলিয়ে যাবার জন্য উধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল জটা। এত দ্রুত ঘটে গেল ব্যাপারটা যে মনে হলো স্বপ্ন দেখছে ডেভিড। ডেবরাকে সবটুকু বর্ণনা করে সে।

‘আমাদেরকে দেখার সাথে সাথে চলে গেল। আমার মনে আছে আগে। ওরা কতটা শান্ত টাইপের ছিল। আমরাই বরঞ্চ লাঠি নিয়ে সবজি ক্ষেত থেকে তাড়া করতাম ওদেরকে।

আবারো মূল ট্র্যাকে ফিরে এলো ডেভিড। এরপর আরো একটা নতুন পথে চালিয়ে নিয়ে এলো ল্যান্ড রোভারকে। নতুন গজানো চারাগাছগুলো ইতিমধ্যেই ঘন আর লম্বা হয়ে উঠেছে। ছোট্ট গাড়িটা নিয়ে এগুলোর উপর দিয়ে চলতে লাগল তারা।

‘কী করছোটা কী তুমি? গাছের ডাল ভাঙার শব্দে চিৎকার করে উঠল ডেবরা।

‘এদেশে রাস্তা থেকে নেমে পড়লে তোমাকেই তোমার রাস্তা তৈরি করে নিতে হবে।

আরো চার মাইল যাবার পর, জাবুলানির পূর্ব সীমান্তে চলে এলো তারা; তাদের আর ন্যাশনাল পার্কের মাঝের বিভেদ রেখা, যে পার্ক কিনা গোটা ইস্রায়েল ভূমির চেয়েও বড়। মিলিয়ন একর পর্যন্ত বনভূমি এখনো পুরোপুরি অক্ষত। তিনশ পঁচাশি কি.মি. লম্বা আর আশি কি. মি. চওড়া এ বনভূমি এক মিলিয়নের বেশি বন্যপ্রাণীর আবাসভূমি। এটিই আফ্রিকাতে বেঁচে যাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য।

ল্যান্ড রোভার থামালো ডেভিড। ইঞ্জিন বন্ধ করে লাফ দিয়ে নামল। কিছু সময় রেগেমেগে চুপ করে থাকার পর হঠাৎই হেসে উঠল সে।

কী দেখে এত খুশি হয়ে উঠেছো তুমি? জানতে চাইল ডেবরা।

‘দেখো_শুধু দেখো একবার। বলে উঠল ডেভিড।

‘পারলে তো তাই করতাম।

সরি ডেবস্। খেলার বেড়া একটা। আট ফুট লম্বা একটা বেড়া। উপরের দিকে শক্ত কাঠের পোলটা বেশ চওড়া।

‘ওরা আমাদের জন্য বেড়া দিয়েছে। ন্যাশনাল পার্কের লোকজন আমাদের জন্য বেড়া দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে এখানে কোন জন্তু জানোয়ার নেই।

বাসার দিকে ফিরতে ফিরতে ডেবরাকে ব্যাখ্যা করল ডেভিড যে গার ন্যাশনাল পার্কে আগে কোন বেড়া ছিল না। সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকতে। জাবুলানির মিষ্টি পানি খেয়ে শুকনো মৌসুমে টিকে থাকতে জানোয়ারের দল।

বন্যপ্রাণীদের এই বিষয়টা মনে হচ্ছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তোমার কাছে। চুপচাপ ডেভিডের কথা শোনার পর জুলুর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে উত্তর দিল ডেবরা।’

হ্যাঁ, হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ব্যাপারটা। ওরা যখন ছিল, আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে সব সময় থাকবে। কিন্তু এখন নেই। এই না থাকাটা সত্যিই গুরুতৃপূর্ণ’ তিক্ত স্বরে হেসে উঠল ডেভিড।

‘আমার অবাক লাগছে যে আফ্রিকাতে এরকমটা সচরাচর হয় না– ব্যাপারটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।’

আরো প্রায় এক বা দুই মাইল এগিয়ে গেল তারা কোন কথা না বলে। এরপরই দৃঢ়স্বরে জানিয়ে দিল ডেভিড : ‘আমি ওদেরকে বাধ্য করব এই বেড়া। সরাতে। ওরা আমাদের সাথে এভাবে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। আমি এখনি হেড ওয়ার্ডেনের সাথে কথা বলব।’

ছেলেবেলার ছবি মনে করে কনরাডবার্গের কথা স্মরণ করল ডেভিড। সে সময় পার্কের দক্ষিণাংশের ওয়ার্ডেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে ভদ্রলোক। কিন্তু তখনো প্রধান হয়নি। মানুষটা সম্পর্কে বছরের পর বছর ধরে অনেক কল্প-কাহিনী গড়ে উঠেছে। এর মাঝে দুটো গল্পই পরিষ্কার বলে দেবে লোকটা কেমন।

রাত নামার পর পার্কের জনমানবহীন একটা জায়গায় ট্রাক নষ্ট হয়ে যায় কনরাডের। এরপর হেঁটে ঘরে ফেরার সময় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সিংহ আক্রমণ করে তাকে। ধস্তাধস্তির মাঝে ভয়ঙ্কর ভাবে আহত হয় কনরাড। পিঠের অর্ধেক মাংস খুবলে তুলে সিংহ। এছাড়া কাঁধের হাড় আর হাতও কামড়ে দেয় জঘন্য ভাবে। তারপরেও মাত্র ছোট্ট একটা ছুরি দিয়ে পশু রাজকে মেরে ফেলে কনরাড। গলার মাঝে উপর্যুপরি আঘাতে প্রধান শিরা কেটে যায়। এরপরও আবার উঠে দাঁড়িয়ে পাঁচ মাইল হেঁটে ঘরে ফিরে আসে কনরাড। পেছন পেছন এসেছে হায়েনার দল, কখন সে পড়ে যাবে এই আলায়। যদিও সে পড়ে যায়নি।

অন্য আরেকটা ঘটনায় পার্কের পাশের এক এস্টেটের মালিক বার্গের একটা সিংহকে গুলি করে মেরে ফেলে। সীমান্তের অর্ধেক মাইলের মাঝে ঘটে এ ঘটনাটা। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কাজ করতে লোকটা। বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। কনরাডের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠল।

‘এ ব্যাপারে তুমি কী করবে? বন্ধু। চাকরিটা তোমার পছন্দ নিশ্চয়ই?

নাকি? কিন্তু উপরের সব রকম চাপ অগ্রাহ্য করেও নিজের পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করে বার্গ। কোর্ট থেকে শুনানীর আদেশ আসে। কোর্টের তারিখ যত কাছে আসে, চাপ ততই বাড়ে। কিন্তু দমবার পাত্র নয় বার্গ। অবশেষে কোর্টে দাঁড়িয়ে সাফাই দেয় সেই গুরুতুপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তা। আদেশ ধার্য হয় এক হাজার পাউন্ড ফাইন অনাদায়ে ছয় মাস সশ্রম কারাদণ্ড।

পরে বার্গের সঙ্গে করমর্দন করে লোকটা। জানায়, সাহসের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। হয়তো এই একটি কারণে এখন প্রধান ওয়ার্ডনের দায়িত্বে আছে বার্গ।

টেলিফোনে কথা বলার পর গেম ফেন্সের কাছে ডেভিডের সাথে দেখা করার জন্য সম্মত হয়েছে বার্গ। বড়সড়, চওড়া আর লম্বা কনরাড বার্গ পেশীবহুল হাতে এখনো বহন করছে সিংহের কামড়ের দাগ। মুখের চামড়া রোদে পড়া লাল রঙের। পার্ক সার্ভিসের পক্ষ থেকে সানট্যান আর লম্বা টুপি পরে আছে সে। পরনের পোশাকে সবুজ ব্যাজ।

পেছনে সবুজ রঙের শেভি ট্রাক। দরজায় পার্কের স্মারক চিহ্ন আঁকা। পেছনে বসে আছে দু’জন কৃষ্ণ গেম রেঞ্জার। একজনের হাতে ভারী রাইফেল।

কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে বার্গ। টুপি পেছনে ঠেলে রাখা আর চাহনিতে ভয়ঙ্কর ভাব। বোঝাই গেল নিজের অঞ্চলের উপর শক্ত হাতে রাশ টেনে রেখেছে লোকটা। ডেবরার উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে উঠল ডেভিড, এই রে, সমস্যা এসেছে।

বেড়ার ধার ঘেঁষে গাড়ি পার্ক করল ডেভিড। এরপর ডেবরাসহ নেমে এগিয়ে গেল।

মি. বার্গ। আমি ডেভিড মরগ্যান। আমার বাবা যখন জাবুলানি ক্রয় করেছিল তখন আপনাকে দেখেছিলাম আমি। আমার স্ত্রীর সাথে পরিচিত হলে খুশি হবো আমি।

একটু হতচকিত হয়ে পড়ল বার্গ। বোঝাই যাচ্ছে জাবুলানির নতুন মালিক সম্পর্কে অনেক কিছুই শুনেছে সে। এ জায়গাটা একেবারে বিচ্ছিন্ন চারপাশ থেকে। আর তার কাজই হলো সব খবর রাখা। তারপরেও এই বিভৎস চেহারার তরুণ আর তার অন্ধ কিন্তু সুন্দরী স্ত্রীর জন্য প্রস্তুত ছিল না কনরাড।

টুপি খুলতে গেল কনরাড। তারপর মনে হলো কী দরকার, মেয়েটা তো দেখতে পাবে না। বিড়বিড় করে কিছু একটা উচ্চারণ করল বার্গ। হাত বাড়িয়ে দিল ডেভিড। চিন্তিত ভঙ্গিতে হাতটা ধরল বার্গ।

ডেবরা আর ডেভিড কাজ করছে একটা দল হিসেবে। অচিরেই নিজেদের ব্যবহার দিয়ে মুগ্ধ করে ফেলল বার্গকে। কনরাড নিজেও বেশ সহজ-সরল মানুষ। কথা বলতে বলতে আরো নরম হয়ে এলো সে। জুলুকে বেশ প্রশংসা করল সে। ল্যাব্রাডর নিয়ে কথাও শুরু হলো। থার্মস কফি বের করল ডেবরা। সবার জন্য মগ ভর্তি করে নিল ডেভিড।

‘ও স্যাম, তাই না? বার্গের রাইফেল নিয়ে বসে থাকা গেম রেঞ্জারকে দেখাল ডেভিড।

হ্যাঁ। সাবধানে উচ্চারণ করল বার্গ।

‘ও জাবুলানিতে কাজ করতো।

‘ও নিজের ইচ্ছেয় আমার কাছে এসেছে। ব্যাখ্যা করল বার্গ, যেন বিব্রতকর কিছু শুনতে না হয়।

‘ও আমাকে মনে করতে পারবে না। এখন যেমন দেখাচ্ছে তাতে তো নয়ই। কিন্তু ও রেঞ্জার হিসেবে ভালো। তাছাড়া ও না থাকায় দেখভালও হচ্ছে না ঠিক ভাবে। কাজের কথা বলার আগে ভূমিকা করল ডেভিড। আমাদেরকে ধ্বংস করেছে আপনার এই বেড়া। আস্তে করে লাথি কষালো ডেভিড মাটিতে।

‘কেন জানতে চাইছো?’ কফির মগ হাতে নিয়ে চারপাশে তাকাল বার্গ, হাত থেকে ছিটকে পড়ল কফি।

‘কেন করেছেন এমনটা?

কারণ আছে।

‘আমার বাবার সাথে বোর্ডে, একটা চুক্তি হয়েছিল। আগে সবসময় ভোলা থাকতে সীমান্ত। আমাদের জায়গাতে চারণভূমি আর পানি আছে, যা আপনার প্রয়োজন।

‘প্রয়াত মি, মরগ্যানের উপর শ্রদ্ধা রেখে বলছি’, ভারী কণ্ঠে বলে উঠল কনরাড বার্গ, ‘আমি কখনোই সীমান্ত খোলা রাখার পক্ষে ছিলাম না।’

‘কেন?

‘তোমার বাবা ছিল খেলোয়াড় মনোভাবের। এমন ভাবে শব্দটা মুখ থেকে ছিটকে বের করল বার্গ, যেন পচা মাংস ফেলল থু করে। যখনই আমার সিংহেরা এ লাইনের পাশ এসে তাকে জানার সুযোগ পেল তখনি একদল গাধা লেলিয়ে দিল তাদেরকে সরে যাবার জন্য।’

প্রতিবাদ করার জন্য মুখ খুলতে চাইলেও ধীরে ধীরে আবার বন্ধ করে ফেলল ডেভিড। অনুভব করল তার মুখের মাংস পেশীগুলো লজ্জিত ভাবে কুঁকড়ে গেল। সত্যি বলেছে কনরাড, মনে পড়ল গাধার কথা, বাসার পেছনে রোদে শুকাতে দেয়া নরম ভেজা সিংহের চামড়ার কথাও মনে পড়ল।

‘উনি অনধিকার চর্চা করেননি। আত্মপক্ষ সমর্থনে বলে উঠল ডেভিড। ‘আমার বাবার লাইসেন্স ছিল। ওগুলো আমাদের অংশে গুলি খেয়েছে।

না, তিনি পশু অপহরণকারী ছিলেন না। স্বীকার করল বার্গ। এ ব্যাপারে তিনি আরো চালাক ছিলেন। তিনি জানতেন যে আমি হয়তো রকেট পাঠাবো আর তিনিই হবেন চাঁদে পা রাখা প্রথম ব্যক্তি।

‘তো এই কারণে আপনি বেড়া দিয়েছেন?

না।’

‘তাহলে?

কারণ চৌদ্দ বছর ধরে জাবুলানি একজন বেপরোয়া মালিকের হাতে আছে। যেখানে যাই ঘটুক না কেন তাতে আর কিছু যায় আসে না। বৃদ্ধ স্যাম এখানে-’ ট্রাকের ভেতরে থাকা গেম রেঞ্জারের দিকে দৃষ্টি ইশারা করল বার্গ, সাধ্যমতো করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারপরও এ জায়গা হয়ে উঠেছে অপহরণকারীদের স্বর্গ। যত সহজে তুমি উচ্চারণ করলে যে পানি আর চারণ ভূমি আমার উপকারে লেগেছে তত দ্রুত ট্রিগার টিপেছে শিকারিদের আঙুল। স্যাম যখন এ ব্যাপারে কিছু করতে চেয়েছে, ওকে বেধড়ক মারধোর খেতে হয়েছে। তারপরেও ওকে থামাতে না পেরে এক রাতে ওর কুড়েঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে পুড়ে মারা গেছে ওর দুই সন্তান

ডেভিড অনুভব করল আগুনের শিখার তীব্রতা, স্মৃতি উসকে দিল যন্ত্রণা।

‘আমি জানতাম না। ব্যথিত স্বরে জানাল ডেভিড।

না, তুমি ব্যস্ত ছিলে অর্থ তৈরিতে বা তোমার নিজস্ব আনন্দ উদযাপনে। রেগে উঠল বার্গ। তো সবশেষে আমার কাছে এলো স্যাম আর ওকে একটা কাজ দিলাম আমি। এরপর এ বেড়া লাগালাম।

‘জাবুলানিতে আর কিছুই নেই। কয়েকটা কুদু, একটা দুটা ডুকার ব্যস এইই। আর সবাই চলে গেছে।

“ঠিক বলেছো।

‘আমি সবাইকে ফেরত চাই।’

‘কেন?’ জবাবদিহি চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠল বার্গ। যেন তোমার বাবার মতো খেলা করতে পারো? যেন তোমার বন্ধুদেরকে সপ্তাহান্তে ডেকে আমার সিংহগুলোকে মেরে ফেলতে পারো?’ বার্গ তাকাল ডেবরার দিকে। সাথে সাথে লাল চেহারা বদলে হয়ে উঠল ধূসর। আমি দুঃখিত মিসেস মরগ্যান। আমি এভাবে বলতে চাইনি।

‘ঠিক আছে মি. বার্গ। আমি বুঝতে পেরেছি আপনার কথা।

‘ধন্যবাদ, ম্যাম। এরপর আবারো হিংস্র ভাবে তাকাল ডেভিডের দিকে। মরগ্যান’স প্রাইভেট সাফারি সার্ভিস এটাই কী তোমার লক্ষ্য?

‘আমি জাবুলানিতে আর কোন গুলির শব্দ হতে দেব না।’ বলে উঠল ডেভিড।

‘আমার সন্দেহ আছে। সবাই একই কথা বলে। দেখা যাবে আবারো ওয়াটারলুর মতো যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এখানে।

না।’ বলে উঠল ডেভিড। এরকম হবে না।

‘তোমরা কসাইয়ের মাংস খাবে না পটের মাঝে যেটা থাকে। আবারো কাটা কাটা স্বরে প্রশ্ন করল বার্গ।

দেখুন, মি. বার্গ। যদি আপনি বেড়া সরিয়ে নিন, তাহলে আমি জাবুলানিকে ব্যক্তিগত প্রাকৃতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করব’

বার্গ হয়তো আরো কিছু বলতো। কিন্তু ডেভিডের কথা শুনে চুপ করে গেল। হাঁ হয়ে রইল সে। ধীরে ধীরে মুখ বন্ধ করে বলল, তুমি জানো এর মানে কী? অবশেষে প্রশ্ন করল কনরাড। তুমি পুরোপুরি ভাবে আমাদের আওতায় চলে আসবে। আইনজীবী দিয়ে কাগজ বানিয়ে তোমাকে বেঁধে ফেলবো আমরা কোন মালিক সুলভ লাইসেন্স থাকবে না, কোন সিংহ গুলি করবে পারবে না।’

‘হ্যাঁ, আমি জানি। আমি পড়েছি আইনগুলো। আরো কিছু আছে এখানে। আমি আরো তিনদিকে বেড়া বসাবো আর ব্যক্তিগত গেম রেঞ্জার বাহিনী তৈরি করব–আর এসবই হবে আমার খরচে!

মাথা থেকে টুপি নামিয়ে রাখল কনরাড। তালুতে থাকা অল্প কয়েকটা ধূসর চুলকে হাত দিয়ে আঁচড়ে নিল।

‘দেখো বাছা, দুঃখিত স্বরে উচ্চারণ করল বার্গ, এরকম হলে আমি কেমন করে মানা করবো। এরপরই হাসল বার্গ। দেখা হবার পর এই প্রথম। মনে হচ্ছে এবার তুমি সত্যিই সিরিয়াস।

‘আমি এবং আমার স্ত্রী এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে এসেছি। আমরা কোন মরুভূমিতে বাস করতে চাই না।’

হ্যাঁ, মাথা নাড়ল বার্গ। পুরোপুরি অনুভব করতে চেষ্টা করল ডেভিডের কথা। তার সামনে থাকা সুন্দর মুখটার প্রতি প্রথম দিকের বিদ্বেষ ভাব কেটে গেল পুরোপুরি।

‘আমার মনে হয় প্রথমে আপনি যে বললেন পশু অপহরণকারী, তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে আমাদেরকে। কয়েকজনকে শায়েস্তা করে উদাহরণ তৈরি করা যাক। বলে চলল ডেভিড। বার্গের লাল চেহারা ভেসে গেল খুশির হাসিতে।

‘আমার মনে হয় প্রতিবেশী হিসেবে ভালই হবে তুমি। জানাল বার্গ।

আবারো বেড়ার উপর দিয়ে হাত মেলালো দুজনে। বিশাল মুঠির ভেতর মনে হলো ভেঙে যাবে ডেভিডের হাত।

‘আগামীকাল রাতে আমাদের সাথে ডিনার করতে আসবেন না? আপনি এবং আপনার স্ত্রী স্বস্তির স্বরে জিজ্ঞেস করল ডেবরা।

‘আমাদের জন্য এটা অনেক আনন্দের ব্যাপার হবে, ম্যাম।

‘আমি হুইস্কির বোতল বের করব। জানাল ডেভিড।

মহানুভবতা’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল বার্গ। কিন্তু মিসেসরা, আমি শুধু পুরাতন বাক ড্রাই জিন পান করি। একটু পানি মিশিয়ে।’

‘এ ব্যাপারে খেয়াল রাখবো আমি।’ সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানিয়ে দিল ডেভিড।

.

কৃশকায় নারী জেন বার্গ বয়সে কনরাড বার্গের মতোই হবে। শুকিয়ে যাওয়া চেহারা, বলিরেখা আছে আর সূর্যের দৌলতে বাদামী, চুলেও কটা রং সূর্যের কল্যাণে। মাঝে মাঝে ধূসরতার ছোঁয়া। আর যেমনটা ডেবরা মন্তব্য করল– সারা পৃথিবীতে সম্ভবত এই একজনকেই ভয় পায় কনরাড।

‘আমি কথা বলছি কনি। এই একটামাত্র বাক্যই যথেষ্ট। বিশালদেহী কনরাডের বাক্যবাণ থেমে যায় নিমেষের মাঝে। অথবা নিজের খালি গ্লাসের দিকে তাকালেই হাতির মতো দ্রুত ভঙ্গিতে সেটা ভর্তি করে আনতে ছোটে কনরাড। ফলে যে কোন গল্প বা কথা শেষ করতে বেশ বেগ পেতে হয় বার্গকে। বলার সময় প্রতিটি কথা শুধরে দেবে জেন, ধৈর্য ধরে আবারো শুরু করার অপেক্ষায় থাকে কনরাড।

বেশ সতর্কতার সাথে মেইন কোর্স তৈরি করেছে ডেবরা। ডিপ ফ্রিজ থেকে বের করা হয়েছে বীফ স্টেক। চারটা খেয়ে ফেলল কনরাড একা। খুবই মজা করে যে খেলো তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু ওয়াইন দেখে খানিকটা আঁতকে উঠল।

‘এটা বিষ ছাড়া আর কিছু নয়। আমার এক আংকেলকে মেরে ফেলেছে। ওল্ড বাক জিন নিয়েই মেতে রইল। এমনকি ডেজার্ট খাবার সময়েও।

এরপরে বিশাল ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে গল্পে মেতে উঠল চারজন। কাঠের গুঁড়ি পুড়তে লাগল আর স্বষ্টচিত্তে জেনের সহায়তায় কনরাড বর্ণনা করতে লাগল যে জাবুলানিতে ডেভিডকে কোন কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।

‘উত্তর দিক থেকে গোত্রলোর কৃষ্ণরা আসে এদিকে

‘অথবা নদী পার হয়ে যোগ করল জেন।

অথবা নদী পার হয়ে। কিন্তু তারা মোটেই লক্ষ্মী নয়। অবশ্য তেমন ঝামেলাও করে না। বেশির ভাগ সময় জাল পাতে, তেমন হত্যা করে না’

‘কিন্তু ব্যাপারটা ঘটে ভয়াবহ ভাবে। বেচারা জন্তুগুলো দিনের পর দিন বন্দী থাকে। তার কেটে হাড়ে ঢুকে যায়! বিস্তর ব্যাখ্যা দিল জেন।

‘আমি যেমনটা বলছিলাম। কয়েক জন রেঞ্জারকে কাজে লাগালেই–এটা থেমে যায়। সমস্যা হচ্ছে শ্বেত পশু অপহরণকারীদের নিয়ে। এদের কাছে আধুনিক রাইফেল আর হান্টিং ল্যাম্প

‘কিলিং ল্যাম্প,’শুধরে দিল জেন।

–কিলিং ল্যাম্প, এরাই বেশি ক্ষতি করে। মাত্র কয়েকটা ঋতুর মাঝে জাবুলানি একেবারে শেষ করে দেবে।

‘কোথা থেকে আসে এরা? জানতে চাইল ডেভিড। আবারো রেগে উঠছে সে। একই ভাবে রেগে উঠেছিল ইস্রায়েলের আকাশসীমা রক্ষা করার সময়েও।

‘এ জায়গা থেকে উত্তরে বড় একটা তামার খনি আছে। ফালাবোরা নামক জায়গায়। শত শত খনি শ্রমিক স্বাদ বদনোর জন্য এখানে আসে। এদিকে হামলা করে জীবিত যা পায় ধরে নিয়ে যায়—কিন্তু এখন এটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। যাই হোক এ কাজে তারা তেমন দক্ষও নয়।’

‘তাহলে দক্ষ কারা?

যেখানে ধুলার রাস্তাটা জাবুলানি থেকে গিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়েতে মিশেছে, এখান থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল হবে’ ব্যান্ডোলিয়ার পাহাড় নামে একটা জায়গা। নাম বলে দিল জেন।

সেখানে একটা জেনারেল ডিলারের অফিস আছে। এটা একটা ট্রেডিং পোস্ট হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সাধারণত উপজাতিরা গোত্রগুলো থেকেই আসে। মালিক আর পরিচালকের কাজ করে যে লোকটা, এ পদে তার প্রায় ৮ বছর হয়ে গেছে। পুরো সময় জুড়ে তার পেছনে লেগে আছি আমি। কিন্তু এত চালাক এই শয়তানটা–আমি দুঃখিত, মিসেস মরগ্যান-আমি তাকে বাগে পাইনি।’

‘সেই-ই একমাত্র?’ জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

‘হ্যাঁ। সেই-ই। মাথা নেড়ে স্বীকার করল কনরাড। তাকে ধরতে পারলেই অর্ধেক দুঃশ্চিতা কমে যাবে তোমার।

কী নাম?

‘আক্কারস। জোহান আক্কারস।’ সাহায্য করল জেন। পুরাতন বাক খেয়ে চোখ খানিকটা ঢুলু ঢুলু করছে তার।

কীভাবে পাবো তাকে? গভীর চিন্তা থেকে জেগে উঠল ডেভিড। জাবুলানিতে এমন কিছু নেই যা তাকে আগ্রহী করবে–যে কয়েকটা কুদু আছে তা বেশি বন্য, চেষ্টায় কাজ হবে বলে মনে হয় না।

না, এই মুহূর্তে তাকে উসকানি দেয়ার মতো কিছু নেই তোমার হাতে। কিন্তু সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে

‘বেশি ভালো হয় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।’ দৃঢ় স্বরে ঘোষণা করল জেন। মাথা থেকে চুল খুলে কানের চারপাশ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।

–সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তোমার পুলের কাছের মারুলা গাছগুলোতে ফল এলে আমার হাতিরা তোমাকে দেখতে আসবে। একমাত্র মারুলা জামের লোভ তারা সামলাতে পারে না। আমার বেড়া ভেঙ্গে চলে আসবে তারা। এটাকে মেরামত করার আগেই তোমার পাশে দেখবে মেলা বসে গেছে। তুমি যে কোন বাজি ধরতে পারো যে ঠিক সেই মুহূর্তে বন্দুকে তেল ঘষে প্রস্তুত হয়ে নেবে আমাদের বন্ধু আক্কারস। বেড়া ভাঙার ঘণ্টখানেকের মাঝে খবর পেয়ে যাবে সে।’

‘এই বার হয়তো সে একটা সারপ্রাইজও পাবে।’

‘তাই আশা করা যাক।

‘আমার মনে হয় নরম স্বরে জানাল ডেভিড’–আমরা হয়তো আগামীকাল ব্যান্ডোলিয়ার পাহাড়ে নেমে এই ভদ্রলোককে দেখে আসতে পারি।

‘একটা ব্যাপার নিশ্চিত’ অসংলগ্ন ভাবে বলে উঠল জেন, সে মোটেও ভদ্রলোক নয়।

.

ব্যান্ডোলিয়ার পাহাড়ে যাবার রাস্তাটা ভর্তি সাদা ধুলায়। স্যান্ড রোভারের পেছনে সারাক্ষণ দেখা গেল ধুলার ব্যানার ঝুলে আছে। পাহাড়টার আকৃতি গোলকার। ঘন গাছ ভর্তি আর ঠিক মহাসড়কের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

রাস্তা থেকে চার থেকে পাঁচশ গজ দূরে ট্রেডিং পোস্ট। আম বাগানের পেছনে এর গাঢ় সবুজ আর চকচকে অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আফ্রিকার প্রায় সব জায়গায় এমন দেখা যাবে মাটির ইট দিয়ে বানানো দালানে লোহার ছাদ দেখা যায় নগ্ন ভাবে। দেয়ালে একের পর এক সাটা হয়েছে চা থেকে শুরু করে ফ্ল্যাশ লাইট ব্যাটারী সবকিছুর বিজ্ঞাপন।

সিঁড়ির সামনে, ধূলি-মলিন আঙ্গিনাতে ল্যান্ড রোভার পাক করল ডেভিড। সামনের সিঁড়ির গোড়ায় দেখা যাচ্ছে সাইন বোর্ড: ব্যান্ডোলিয়ার হিল জেনারেল ডিলার।

দালানের এক পাশে একটা পুরাতন সবুজ রঙের এক টন ওজনের ফোর্ড ট্রাক পার্ক করে রাখা। লাইসেন্স প্লেট ও স্থানীয় সিঁড়ির সামনের শেডের নিচে ডজন খানেকের বেশি সম্ভাব্য ক্রেতা ভিড় করে আছে। গোত্র অঞ্চলগুলো থেকে এসেছে আফ্রিকান নারীরা, পরনে লম্বা সুতির নকশা করা কাপড়, ধৈর্যের বাঁধ মনে হচ্ছে তর সইছে না, ল্যান্ড রোভারের দিকে তেমন মনোযোগই দিল না তারা। একজন তো আবার দাঁড়িয়েই বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। মুখ থেকে নিপেল না সরিয়েই বাচ্চাটা তাকিয়ে রইল আগন্তুকের দিকে।

আঙ্গিনার মাঝখানে মোটা সোজা হয়ে উঠে গেছে একটা পোল। ১৫ লম্বা। এর মাথার কাঠের একটা বাক্স মতন। মনে হচ্ছে কুকুরের ঘর। অস্ফুট শব্দ বের হলো ডেভিডের গলা দিয়ে। কেননা বাক্সের মাঝে থেকে দেখা দিল বড়সড় বাদামী আর লোমশ একটা প্রাণী। এক লাফে নেমে এলো মাথা থেকে, একেবারে পাখির মতো হালকা চালে লাফ দিল পশুটা। পোলের এক মাথা থেকে পশুর গায়ের শিকলটা লাগানো হয়েছে আরেক মাথায়। কোমরে স্ট্রাপ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।

এর মতো এত বড় বৃদ্ধ পুরুষ বেবুন আমি আর দেখিনি।

তাড়াতাড়ি ডেবরাকে এর বর্ণনা দিল ডেভিড। শিকল যতটুকু তার মাঝেই ঘুরে বেড়াচ্ছে বেবুন। পোলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে মাটি কামড়াচ্ছে। শিকলের ঝনঝন শব্দ হচ্ছে তার পিছুপিছু। বোঝা গেল কতটা উদ্ধত তার স্বভাব। ঘাড়ের উপর উড়ছে ঘন কেশর। পোলের চারপাশে ঘোরা শেষ করে ল্যান্ড রোভারের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। মনে হলো মানুষের মত সব বুঝতে পারছে সে। ছোট বাদামী চোখ দুটো দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঝুলে গেল নিচের চোয়াল।

কদাকার পশু। ডেবরাকে জানাল ডেভিড। ওজন না হলেও নব্বই পাউন্ড। কুকুরের মতো লম্বা মুখ, মুখের চোয়াল ভর্তি হলুদ বিষদাঁত। হায়েনার পরে এটিই সবচেয়ে ঘৃণিত প্রাণী এ অঞ্চলে। চতুর, নিষ্ঠুর আর লোভী। মানুষের সব বদগুণ আছে এটার মাঝে, একটাও সদগুণ নেই। চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে রইল পশুটা আর প্রতি সেকেন্ডে অগ্নিমূর্তির মতো মাথা ঝাঁকাতে লাগল জটা।

ডেভিড যখন পুরো মনোযোগ দিয়ে বেবুনকে দেখছে এমন সময় দোকান থেকে বের হয়ে বারান্দার পিলারে দাঁড়াল একজন লোক।

‘আপনার জন্য আমি কী করতে পারি, মি, মরগ্যান? ঘন একরকম উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল লোকটা। লম্বা গড়ন, পুরোপুরি পরিষ্কার নয় এমন দলা মোচড়া খাকি স্ন্যাকস পরে আছে লোকটা। শার্টের গলা খোলা, পায়ে ভারী জুতা, প্যান্টের সাথে লাগানো ব্রেস আড়াআড়ি ভাবে কাঁধে উঠে গেছে।

‘আমার নাম জানেন আপনি? চোখ তুলে লোকটার দিকে তাকাল ডেভিড। মধ্যবয়স্ক লোকটার গম্বুজাকতির মাথায় অল্প কিছু ধূসর চুল। উজ্জ্বল গোলাপি প্লাস্টিক গাম দিয়ে লাগানো দাঁত, গালের কাছে চামড়া উঠে গেছে। গভীরে বসানো চোখ দুটো দেখে মড়ার খুলির মতো দেখাচ্ছে তাকে। হাসি মুখে ডেভিডের দিকে তাকাল লোকটা।

‘একমাত্র আপনিই হতে পারেন ক্ষতচিহ্ন ভর্তি মুখ আর অন্ধ স্ত্রী, জাবুলানির নতুন মালিক। শুনেছি নতুন ঘর বানিয়ে পুরোপুরি বসবাস শুরু করেছেন।

মানুষটার হাতগুলো বিশাল। পুরো শরীরের তুলনায় বোঝা গেল ও দুটোই বেশি শক্তিশালী। আর কব্জির চিকন রগগুলো দেখে বোঝা গেল ওগুলো দড়ির চেয়েও বেশি শক্ত।

পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে পকেট থেকে ছুরি বের করল সাথে কালো শুকনো মাংস উত্তর আমেরিকার জার্কি, ক্যারিবিয়ার বোকন অথবা আফ্রিকার বিলটং যেকোন কিছুই হতে পারে। এমন ভাবে এক টুকরো কেটে নিল যেন তামাকের টুকরা, পুরে দিল মুখে।

‘যেমনটা জিজ্ঞেস করেছি, কী করতে পারি আপনার জন্য? ধীরে ধীরে চিবোতে লাগল লোকটা। প্রতিটি কামড়ে দাঁতের আওয়াজ পাওয়া গেল।

‘আমার পেরেক আর রং দরকার। ল্যান্ড রোভার থেকে নামল ডেভিড।

‘শুনেছি নেলস্প্রুটে সব কেনাকাটা সেরেছেন আপনি। হিসেবী দৃষ্টিতে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে রইল আক্কারস। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল ডেভিডের ক্ষত-বিক্ষত চেহারা। ডেভিড দেখল লোকটার গর্তে বসানো চোখ দুটোর রং মেটে সবুজ।

‘আমার মনে হয় বন্যপ্রাণীকে খাঁচায় পুরে রাখা বা শিকলে বেঁধে রাখা নিয়ে আইন আছে। প্রায় সাথে সাথে আক্কারসের উপর রেগে গেল ডেভিড। কণ্ঠে পরিষ্কার বোঝা গেল তার ঝাঁঝ। আবারো ধীরেসুস্থে চিবোতে চিবোতে হাসল আক্কারস।

“আপনি আইনজীবী-তাই না?

‘এমনি জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমার অনুমতিপত্র আছে–দেখবেন?

মাথা নাড়ল ডেভিড। ফিরে হিব্রুতে কথা বলতে লাগল ডেবরার সাথে। দ্রুত লোকটার বর্ণনা দিল ডেভিড।

‘আমার মনে হয় লোকটা বুঝতে পেরেছে যে আমরা কেন এখানে এসেছি। সমস্যা বাধাতে চাইছে।’

‘আমি গাড়িতেই থাকছি। জানাল ডেবরা। ঠিক আছে। বারান্দার সিঁড়িতে পা দিল ডেভিড।

‘পেরেক আর রং?’ আক্কাসকে জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

‘ভেতরে যান।’ হাসছে এখনো লোকটা। কাউন্টারের পেছনে একজন নিগার সাহায্যকারী আছে আমার। সেই-ই আপনার দেখাশোনা করবে।

একটু দ্বিধা করেও ভেতরে ঢুকলো ডেভিড। কার্বালিক সাবান, কেরোসিন আর গমের গন্ধ আসছে ভেতর থেকে। তাকগুলো পূর্ণ হয়ে আছে সস্তা দরের মুদি মালামালে। আরো আছে ওষুধ, কম্বল, সুতির ফুলেল নকশা করা কাপড়। ছাদ থেকে ঝুলছে সেনাবাহিনীর মতো বড় জুতা, কোট, কুড়ালের মাথা, ঝড়ের সময় ব্যবহার উপযোগী লণ্ঠন। মেঝে ভর্তি হয়ে আছে টিনের ট্রাংক, ময়দার পাত্র, গম আরো শ’খানেক জিনিস, যে কোন গ্রামের ডিলারের কাছেই সাধারণত যা থাকে। আফ্রিকান অ্যাসিস্ট্যান্টকে খুঁজে পেয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিল ডেভিড।

বাইরে সূর্যের আলোয় ল্যান্ড রোভার থেকে নেমে গাড়ির গায়ে হালকা ভাবে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ডেবরা। সাথে লাফ দিয়ে নামল জুলু। বারান্দার কাছের দেয়ালের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল। সাদা প্লাস্টারের গায়ে হলুদ ইউরিনের জেট চালাচ্ছে অন্যান্য কুকুর।

নাইস উগ। বলে উঠল আকারস।

‘ধন্যবাদ।’ নগ্ন ভাবে মাথা নাড়ল ডেবরা।

আক্কারস তাড়াতাড়ি তার পোষা বেবুনের দিকে তাকাল। অভিব্যক্তি হয়ে উঠল শিয়ালের মতো ধূর্ত। মানুষ আর জটার মাঝে চোখাচোখি হয়ে গেল বিশেষ একটা ফন্দি। নার্ভাস ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল বেবুন। এরপর উঠে নিজের ঘরে চলে গেল পোলের মাথায়।

হেসে সাবধানে আরেক স্লাইস মাংস কেটে নিল আক্কারস।

‘জাবুলানি ভালো লাগছে আপনার?’ ডেবরাকে প্রশ্ন করল আক্কারস। একই সাথে মাংসের টুকরাটা বাড়িয়ে ধরল জুলুর দিকে।

‘আমরা বেশ ভালো আছি এখানে। শক্তভাবে উত্তর দিল ডেবরা। বাড়িয়ে ধরা মাংস ওকলো জুলু। লেজ নাড়তে লাগল। কোন কুকুরই আসলে এর মায়া ছাড়তে পারবে না। আগ্রহ ভরে নিল কুকুরটা। আরো দু’বার জুলুকে মাংসের টুকরো দিল আক্কারস্। চকচকে চোখে নরম সিল্কের মতো মুখ বেয়ে গড়াতে লাগল লালা।

বারান্দার শেডের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলারা মনে হলো মজা পেতে শুরু করল এবার। আগেও এরকম হতে দেখেছে একটা কুকুরের সাথে। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল সকলে। ডেভিড দালানের ভেতরে, তাকে দেখা যাচ্ছে না। কিছুই জানে না ডেবরা, দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।

আক্কারস বড়সড় একটা মাংসের টুকরা কেটে ধরল জুলুর সামনে। কিন্তু জুলু নিতে এলে হাত সরিয়ে নিল। এতক্ষণে মাংসের স্বাদ বুঝে গেছে জুলু। চাইল নিয়ে নিতে। আবারো শেষমুহূর্তে তার সামনে থেকে সরিয়ে নিল আক্কারস। জুলুর ভেজা কালো নাকে অস্বস্তি ফুটে উঠল। নরম কানগুলো দাঁড়িয়ে গেল।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো আক্কারস। হাঁটা ধরল, পিছু নিল জুলু। আবারো তার সামনে ধরা হলো মাংসের টুকরা। এরপর নরম স্বরে বলে উঠল আক্কারস, নাও তো দেখি বাছা।’ আর মাংসের টুকরাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল বেবুনের ঘরের নিচে। সামনের দিকে লাফ দিল জুলু। এখনো শক্ত হয়ে উঠেনি ওর পা তাই খানিকটা টালমাটাল হলো। গিয়ে পড়ল বেবুনের মাটি খামচে তৈরি করা বৃত্তের ভেতর। পোলের নিচে গিয়ে ক্ষুধার্ত ভাবে মাংসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল জুলু।

ঘর থেকে বের হয়ে এলো বেবুন। বাতাসে ভেসে নেমে এলো পনের ফুট লম্বা পোল থেকে নিচে। পা ফাঁক করে চোয়াল খুলে গিয়ে গরগর শব্দ করতে লাগল। বাঁকানো, ধারালো, হলুদাভ দাঁতগুলো হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর। নিঃশব্দে মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়াল বেবুন। এগিয়ে গেল বেচারা অসহায় কুকুর ছানাটার দিকে। ঘাড়ে উঠেই জুলুর উপর চাপিয়ে দিল পুরো নব্বই পাউন্ডের বোঝা।

পড়ে গেল জুলু। বিস্মিত হয়ে গড়াতে লাগল কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর আগেই আবারো তাকে ধরল বেবুনটা।

ডেবরা শুনতে পেল জুলু কেঁদে উঠল। এগোতে লাগল সামনে, অবাক হয়েছে কিন্তু কী ঘটছে বুঝতে পারছে না।

পেট উপর দিকে দিয়ে শুয়ে আছে জুলু। পেট হয়ে গেল উন্মুক্ত। সিঙ্কের মতো কালো কালো পশমে ভর্তি। পেনিস তখনো পুরোপুরি প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি। এক লাফে তার উপর চড়ে বসল বেবুন। শক্তিশালী পা দিয়ে চেপে ধরে রাখল জুলুকে মাটির সাথে। জুলুর পেটে বসিয়ে দিল লম্বা হলুদ বিষদাত।

ভয়াবহ মরণ চিৎকার করে উঠল জুলু। সাথে সাথে চিৎকার করে আগে বাড়লো ডেবরা।

এক পা সামনে বাড়িয়ে দিল আক্কারস। ফলে হাত আর কনুই দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল ডেবরা।

বাদ দিন, লেডি।’ হাসতে হাসতে ডেবরাকে মানা করল আক্কারস। বাধা দিতে গেলে আপনিও ব্যথা পাবেন।’

নরম পেটের মাঝে চোখা দাঁত ঢুকিয়ে মোচড় দিল বেবুন। এরপর সর্বশক্তি দিয়ে টান দিল। পাকস্থলীর পাতলা চামড়া ছিঁড়ে গেল সাথে সাথে। বেগুনি রঙের নাড়িভুড়ি বাইরে বের হয়ে এলো। ঝুলে রইল বেবুনের চোয়ালে।

আবারো আর্তনাদ করে উঠল কুকুরছানা। অন্ধের মতো নিজের পায়ের উপর উঠে দাঁড়াল ডেবরা।

‘ডেভিড!’ চিৎকার করে কেঁদে উঠল সে। ডেভিড সাহায্য করো।

দৌড় দালানের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো ডেভিড। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে ফেলল পুরো দৃশ্য। দরজার পাশে স্তূপ করে রাখা লাকড়ি থেকে একটা তুলে নিয়ে এক লাফে পার হলো বারান্দা। তিন লাফে পৌঁছে গেল কুকুরছানার কাছে।

বেবুনটা ডেভিডকে আসতে দেখেই ছেড়ে দিল জুলুকে। আবারো এক লাফে উঠে গেল পোলের ভেতর। চোয়াল লাল হয়ে আছে রক্তে। উত্তেজনা আর বিজয়ীর ভঙ্গিতে লাফ ঝাঁপ শুরু করে নিল পশুটা।

হাতের লাকড়ি ফেলে দিয়ে আস্তে করে অসহায় কুকুরছানার দেহটা তুলে নিল ডেভিড। ল্যান্ড রোভারের কাছে গিয়ে নিজের বুশ জ্যাকেট দিয়ে বেঁধে দিল পেট। নিজের হাত দিয়ে নাড়িভুতি আবার ঢুকিয়ে দিল ভেতরে।

‘ডেভিড, কী হয়েছে? আকুতি জানাল ডেবরা। হাঁটতে হাঁটতে হিতে তাকে জানাল ডেভিড।

‘ভেতরে বসো।’ ডেবরাকে জানাতেই ল্যান্ড রোভারের প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসল ডেবরা। কোলে তুলে নিল আহত জুলুকে। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসল ডেভিড।

নিজের দোকানের দরজায় ফিরে গেল আক্কারস। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। নকল দাঁত খুলে পড়ে গেল হাসির দমকে।

নিজের ঘরে বসে বেবুনটাও লাফাচ্ছে মাস্টারের মতো খুশিতে। মি. মরগ্যান। আপনার পেরেক নিতে ভুলবেন না।

ঘুরে আক্কারসের দিকে তাকাল ডেভিড। শক্ত আর গরম হয়ে উঠল তার চেহারা। গাল আর কপালের চামড়ায় যেন আগুন ধরে গেল। রাগে জ্বলে উঠল ঘন নীল চোখ জোড়া। নেমে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল সে। পাশে ঝুলছে মুষ্টিবদ্ধ হাত।

তাড়াতাড়ি পেছন দিকে চলে গেল আক্কারস। দোকানের কাউন্টারের পেছনে পৌঁছে পুরাতন ডাবল ব্যারেলের শটগান হাতে তুলে নিল। মোটা মোটা বুড়ো আঙুল দিয়ে দুটো হ্যামার টেনে প্রস্তুত করে নিল গুলি করার জন্য।

‘সেল্ফ ডিফেন্স মি. মরগ্যান, উপস্থিত স্বাক্ষী আছে আমার। স্যাডিস্ট এর মতো তৃপ্তির স্বরে চিৎকার করে উঠল আক্কারস। আরেক ধাপ সামনে এগোলেই আপনাকে দেখে নেবো আমি।’

সিঁড়ির মাথায় থেমে গেল ডেভিড। বন্দুকটা ঠিক তার পেটের দিকে তাক করা।

‘ডেভিড তাড়াতাড়ি-ওহ, প্লিজ তাড়াতাড়ি। ল্যান্ড রোভার থেকে উদ্বিগ্ন স্বরে চিৎকার করে উঠল ডেবরা, কোলের কাছে দ্রুত নিস্তেজ হয়ে আসছে কুকুর ছানাটার শরীর।

‘আবার দেখা হবে আমাদের।’ রাগের চোটে কণ্ঠ জড়িয়ে গেল ডেভিডের।

মজাই হবে তাহলে।’ বলে উঠল আক্কারস। ঘুরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল ডেভিড।

রাস্তা দিয়ে ধুলার মেঘ উড়িয়ে ল্যান্ড রোভারকে চলে যেতে দেখার পর শটগান সরিয়ে একপাশে রাখল আকারস। সূর্যের আলোর নিচে উঠানে এলো। ঘর থেকে বের হয়ে এসে লাফ দিয়ে নিচে নামল বেবুন। কোমর উঁচিয়ে নাচতে লাগল বাচ্চাদের মতো।

পকেট থেকে মিষ্টি বের করে ভয়ঙ্কর হলুদ বিষদাঁতের মাঝে ঢুকিয়ে দিল আক্কারস।

বাছা আমার। দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল। ছোট ছোট কুতকুতে বাদামী চোখ দিয়ে তাকিয়ে রইল বেবুনটা।

.

এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা সত্ত্বেও ত্রিশ মাইল পেরিয়ে মাত্র পঁচিশ মিনিটে জাবুলানিতে পৌঁছে গেল ডেভিড। হ্যাঙ্গারের পাশে স্কিড করে গাড়ি থামলো। হাতে কুকুরছানা নিয়ে দৌড় দিল এয়ার ক্রাফটের দিকে।

ফ্লাইটের মধ্যে কোলের উপর রেখে জুলুকে আদর করতে লাগল ডেবরা। কিন্তু গাঢ় রক্তে ভিজে গেল ওর স্কার্ট। চুপচাপ পড়ে রইল জুলু, মাঝে মাঝে একটু একটু ফোপানি ছাড়া আর কোন শব্দ হলো না। ওয়ারলেস টেলিফোনের মাধ্যমে কথা বলে নেলস্প্রুটে নিজেদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে নিল ডেভিড। টেক অফ করার পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর পশু সার্জনের ক্লিনিকের অপারেশন থিয়েটার শুইয়ে দেয়া হলো জুলুকে।

প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে অখণ্ড মনোযোগে কাজ করল সার্জন। ছিঁড়ে যাওয়া ধমনী আর পেটের পেশী সেলাই করা হলো।

খুব খারাপ ভাবে আহত হয়েছে জুলু। আর ইনফেকশনের ভয়টাই বড় হওয়ায় জাবুলানিতে ফেরার সাহস হলো না তাদের। পাঁচ দিন পরে আবার জাবুলানিতে উড়ে আসার পরেও দুর্বল রইল জুরু। কিন্তু বিপদ কেটে গেছে। ফ্লাইট কোর্স বদলে ব্যান্ডোলিয়ার হিলের ট্রেডিং স্টোরে এলো ডেভিড।

সূর্যের আলোয় আয়নার মতো চকচক করছে টিনের চাল। নিজের মাঝে ঠাণ্ডা রাগ আর প্রত্যয়ের ভাব টের পেল ডেভিড।

মানুষটা আমাদের জন্য হুমকি।’ জোরে জোরে উচ্চারণ করল সে। আমাদের প্রতি আর জাবুলানিতে আমরা যা করতে চাইছি তার প্রতি সত্যিকারের হুমকি এই লোক।

মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল ডেবরা। জুলুর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। কেননা ডেভিডের মতোই সে নিজেও ভয়ঙ্কর রেগে আছে।

আমি তাকে দেখে নেব।’ নরম স্বরে বলে উঠল ডেভিড। স্মৃতিতে ভেসে উঠল ব্রিগের কণ্ঠস্বর।

‘ভায়োলেন্সের একমাত্র অযুহাত হলো তোমার যা, তাকে নিরাপত্তা দেয়া।

খাড়া ভাবে আবার উল্টো দিকে ঘুরে গেল প্লেন। ফিরে গেল জাবুলানির ল্যান্ডিং স্ট্রিপে।

.

কনরাড বার্গ ডেকে পাঠাল ওল্ড বাক জিন খাবার জন্য। এছাড়াও ডেভিডকে জানাল যে বোর্ড জাবুলানিকে প্রাইভেট নেচার রিজার্ভ ঘোষণার জন্য তার আবেদন মঞ্জুর করেছে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও শীঘ তৈরি হয়ে যাবে।

‘তুমি কী চাও আমি বেড়াটা এখনি সরিয়ে নেই?

না।’ চিন্তিত স্বরে উত্তর দিল ডেভিড। থাকুক। আমি চাই না আক্কারসকে ভয় দেখাতে।

ঠিক আছে। একমত হলো কনরাড।

‘তাকে দেখে নেব আমরা। জুলুকে নিজের কাছে ডেকে নিল আর ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে দেখল। বাঞ্চোত, কোথাকার।’ বিড়বিড় করে অপরাধীর ভঙ্গিতে তাকাল ডেবরার দিকে।

‘স্যরি, মিসেস মরগ্যান।

‘আমি এ ব্যাপারে একমত নই, মি. বার্গ। নরম স্বরে জানাল ডেবরা। কথা বলার সময় তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকে জুলু। এক পাশে মাথা নাড়ল সেও।

প্রতিটি তরুণ জিনিসের মতো, দ্রুত সেরে উঠল জুলু।

মুক্তোর ছড়ার কাছে পাহাড়ের পাদদেশে ঘন হয়ে থাকা মারুলা গাছে ফুল এলো। লাল লাল ফুলগুলো সত্যি দেখার মতো দৃশ্য বটে।

প্রায় প্রতিদিন ডেভিড আর ডেবরা দুজনে একসাথে ঘুরে আসে মারুলা বন থেকে। পুল পর্যন্ত হেঁটে আসে। ধীরে ধীরে নিজের শক্তি ফিরে পাচ্ছে জুলু। তাই প্রায় সময়ই পানি নিয়ে খেলা করে সেও।

এরপর আস্তে আস্তে নারী মারুলার গায়ে সবুজ রঙের তাল আকৃতির ফলগুলো পেকে হলুদ হয়ে গেল আর সেই সুগন্ধে ভারী হয়ে উঠল সন্ধ্যার বাতাস।

সাবি থেকে নেমে এলো প্রথম দলটা। সবার প্রথমে বৃদ্ধ দুটো পুরুষ। চল্লিশ বছর ধরে মুক্তার ছড়ার কাছে বাৎসরিক তীর্থে আসে এগুলো। সাথে আছে পনেরোটা শাবকসহ গাভী, পায়ে পায়ে দৌড়াতে লাগল আর কম বয়সী অনেকগুলো।

দক্ষিণ দিক থেকে নেমে এলো ওগুলো। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল। খোলা জায়গা থেকে দেখে মনে হয় ভূতের মতো ধূসর রঙের ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে ফলের চারপাশে। সাধারণত লম্বা একটা গাছে নজর আটকে যায় পুরুষ হাতির। মোটা কান্ডের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে এপাশ-ওপাশ করতে করতে হঠাৎ করে হেঁচকা টানে মাটির দিকে টেনে ধরে গাছটা। উপরের দিকের কয়েকটা কচি পাতাতেই তার মন ভরে যায়। এরপর দু’একটা বাকল মুখে পুরে উত্তরে হাঁটা ধরে।

এরপর কনরাড বার্গের বেড়ার কাছে এসে পুরুষ দুটো পরীক্ষা করে দেখে সব কিছু। কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়ায় যেন আলোচনা করছে। বিশাল ধূসর কানগুলো নাড়তে থাকে। আর কয়েক মিনিট পর পর শুড় দিয়ে বালি তুলে নিজেদের পিঠে ছুঁড়ে ফেলে মাছি তাড়ায়।

এই চল্লিশ বছর ধরে যাতায়াতের কল্যাণে নিজেদের রিজার্ভের সব চেনা হয়ে গেছে তাদের। গেম ফেন্সের কাছে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারল যে এটা ভাঙা অপরাধ হবে। এছাড়া তাদের সুখ্যাতিও নষ্ট হবে।

কনরাড বার্গ ডেভিডের সাথে নিজের হাতিদের বুদ্ধি বিবেচনা নিয়ে কথা বলার সময় প্রচণ্ড সিরিয়াস ছিল। এমন ভাব করল যেন তারা স্কুল বয়।

চিন্তিত মুখে বৃদ্ধ পুরুষ হাতি দুটি ফিরে গেল নিজের বাহিনীর কাছে। কী করা যায় এ ব্যাপারে ধৈর্য সহকারে আলোচনা শুরু করল তারা। তিন দিন ধরে হাতির পালটা বেড়ার কাছে এলো আর গেল। অপেক্ষা করল। বিশ্রাম নিল এরপর হঠাৎ করেই পশ্চিমা বাতাস ধেয়ে এলো তদের দিকে। বয়ে নিয়ে। এলো মারুলা জামের সুগন্ধ।

রাস্তার ধারে ল্যান্ড রোভার পার্ক করে আনন্দে হেসে উঠল ডেভিড।

কনির বেড়ার জন্য এত কিছু।

নিজের সম্মানবোধে বা ধ্বংসের আনন্দে একটাও বয়স্ক হাতি অন্যের তৈরি করা ফুটো দিয়ে ঢুকলো না।

সবাই নিজের মতো করে বেড়ার জায়গা ঠিক করে নিল। কংক্রিটের মাঝে শক্ত কাঠ পুঁতে রাখা। কোন সমস্যা ছাড়াই মাটির সাথে মিশে গেল সবগুলো। প্রায় এক মাইল জুড়ে ভেঙে পড়ে গেল সব বেড়া।

প্রতিটি হাতি পুলের কাউকে ব্যবহার করে পেঁচানো তারের নগ্ন ফলা এড়িয়ে এলো।

এরপর সারারাত ধরে পুলের পাশে চলল ভোজ। হলুদ জামগুলো খেয়ে নিয়ে ভূরিভোজ শেষ হলো সকালবেলা। এরপর আবারো সুশৃংখল ভাবে বেড়ার কাছে ফিরে এলো দলটা। চাইল বেড়া ঠিক করে দাঁড় করিয়ে দিতে। হয়তো অপরাধবোধে ভুগতে লাগল অথবা আশা করল পুরো কাটার জন্য অন্য কোন দলকে অভিযুক্ত করবে কনরাড বার্গ।

যাই হোক, ভাঙা বেড়া দিয়ে সহজেই এপাশে চলে এলো অন্য দলগুলো।

এলো শক্তিশালী বাফেলার মতো শিংওয়ালা নীল রঙের মোটা মাথা আর কেশবওয়ালা প্রাণী। এরপর এল জেবরা।

অবশিষ্ট বেড়ার কাছে এসে ডেভিডের সাথে দেখা করল কনরাড বার্গ। নিজের ট্রাক থেকে লাফিয়ে নেমে সতর্কতার সাথে পার হলো বেড়া। তাকে অনুসরণ কলো আফ্রিকান রেঞ্জার স্যাম।

ধ্বংসলীলা দেখে মাথা নাড়তে লাগল কনরাড।

‘এটা বৃদ্ধ মাহোম্মেদ আর ওর একচোখওয়ালা বন্ধুর কাজ। আমি যেখানেই দেখি চিনবো তাদের পায়ের ছাপ। এমন শয়তান একেকটা তাড়াতাড়ি ল্যান্ড রোভারে বসে থাকা ডেবরার দিকে তাকাল কনরাড।

‘ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই মি. বার্গ।’ ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে তাকাল ডেবরা।

আগুপিছু হয়ে পুরো বেড়া দেখল স্যাম। তারপর এসে তাদের কাছে। দাঁড়াল।

‘হ্যালো, স্যাম। অভিবাদন জানাল ডেভিড। অনেক সাধ্য-সাধনার পর সে বিশ্বাস করল যে এই ক্ষত-বিক্ষত বিভৎস চেহারার লোকটাই হলো সেই সুদর্শন ডেভিড যে কিনা শিখেছিল কেমন করে বন্য একটা মৌমাছির চাকে হাত ঢুকাতে হয় মৌমাছিকে বিরক্ত না করে।

হাসিমুখে ডেভিডকে স্যালুট করল স্যাম। নিজের ইউনিফর্মকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে সে। তার বয়স ধারণা করা বেশ কঠিন, কেননা নাগুনিদের মতো বড়সড় মসৃণ চাঁদপানা মুখ–আফ্রিকার অভিজাত যোদ্ধা জাতি–কিন্তু মাথার উপরে পুরো সাদা চুল। ডেভিড শুনেছে যে জাবুলানিতে চল্লিশ বছর কাজ করেছিল সে। তাই ধরে নেয়া যায় যে বয়স ষাটের কাছাকাছি।

দ্রুত কনরাডের কাছে রিপোর্ট দিল সে। প্রাণীদের বর্ণনা আর সংখ্যাও বলে দিল যেগুলো জাবুলানিতে ঢুকেছে।

বাফেলোর একটা দলও এসেছে। তেতাল্লিশটা আছে। সাধারণ জুলু ভাষায় বর্ণনা করল স্যাম, ডেভিড যেটা শিখতে চেষ্টা করছে। এগুলোই লাঙ্গুলেনের কাছে রিপাপ বাঁধে পানি খেয়েছিল এর আগে।

তার মানে এগিয়ে আসছে আক্কারস। এদের যে কোন বাফেলোই সুস্বাদু বিলটংয়ের জন্য যথেষ্ট। শুকনো মুখে তাকিয়ে রইলো কনরাড।

‘কতক্ষণ পরে সে জানতে পারবে যে বেড়া ভেঙ্গে পড়েছে? জানতে চাইল ডেভিড। দ্রুত র‍্যাপিড ফায়ারের ভঙ্গিতে স্যামের সাথে আলোচনা সেরে নিল কনরাড। প্রথম কয়েকটা বাক্য তো বুঝতেই পারল না ডেভিড। যাই হোক অবশেষে তর্জমা করে দিল কনরাড।

‘স্যাম বলছে যে ইতিমধ্যেই ওহ জানতে পেরেছে যে তোমার সব ভূত্য আর তাদের স্ত্রীরা আক্কারসের দোকান থেকে সদাইপাতি কেনে। লোকটা ভূতদেরকে টাকা দেয় এ তথ্য জানানোর জন্য। এর মানে স্যামের ধারণা যে তাকে মারার বন্দোবস্তও আক্কারস করেছিল। গভীর রাতে সুনসান রাস্তায়। তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে স্যামকে এছাড়া ঘর পুড়িয়ে দিয়ে জাবুলানি ছাড়া করতে চেয়েছে স্যামকে, আক্কারস।

এর মানে স্যাম আমাদের সাথে, তাই না? একমত হলো ডেভিড। বৃদ্ধ স্যাম চায় আমরা যেন আক্কাসকে ধরি—এ ব্যাপারে ও একটা প্ল্যানও করে রেখেছে।

তাই নাকি, শুনি তো কী?

‘যেহেতু রাতে তুমি আছো জাবুলানিতে তাই রাতের বেলা কিলিং ল্যাম্প নিয়ে অপহরণের চেষ্টা হয়তো করবে না আক্কারস। এ ব্যাপারে সব কৌশল সে জানে। আমরা তাকে কখনোই পাকড়াও করতে পারব না।’

‘তো?

তাই তুমি তোমার চাকরদেরকে বলবে যে দুই সপ্তাহের জন্য কেপটাউন যাচ্ছে। ব্যবসার কাজে। তুমি বাসা ছাড়ামাত্র খবর পাবে আক্কারস। বিশ্বাস করবে পুরো জাবুলানি তার হাতের মুঠোয়। এক ঘণ্টা ধরে প্রতিটি খুঁটিনাটি আলোচনা সেরে মাথা নেড়ে আলাদা হলো সকলে।

বাসায় গাড়ি চালিয়ে ফিরে আসার সময় খোলা জঙ্গল থেকে বের হবার সময়ে লম্বা ঘাসের মাঝে দিয়ে তুষারকণার মতো উজ্জ্বল সাদা কিছু একটা উড়তে দেখল ডেভিড।

‘কিছু একটা আছে এখানে। তাড়াতাড়ি ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল ডেভিড। চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল। এরপরেই ঘাসের মাঝে নড়াচড়া দেখল সে।

‘আহ, বাফেলো!’ উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল ডেভিড। গাছের কিনারে ল্যান্ড রোভার দেখে থেমে গেল চারজনের ছোট্ট দলটা। মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখল ল্যান্ড রোভার। কিন্তু ভয় পেল না।

এরপর লম্বা লম্বা ঘাসের মাঝ দিয়ে একের পর এক বের হয়ে এলো দলের বাকিরা। প্রত্যেকে একবার করে ল্যান্ড রোভার দেখে নিয়ে নিজের কাজে লেগে গেল। মোট তেতাল্লিশটা। যেমনটা ধারণা করেছিল স্যাম। এদের মাঝে সুদর্শন কয়েকটা পুরুষের ওজন না হলেও ২০০০ এল বি হবে আর লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট। বিশাল শিংগুলো মাথার মাঝ থেকে উঠে নিচের দিকে বেঁকে গেছে। মাথাগুলো কালো আর চকচকে।

আলো না মরা পর্যন্ত পুরো লিটার ছবি তুলল ডেভিড। সন্ধ্যা নামার পর চলে গেল তারা। রাতের খাবারের আগে ওয়াইনের বোতল খুললো ডেভিড। সিঁড়ির ধাপে বসে একসাথে দুজনে মিলে পান করল আর শুনল রাতের গুঞ্জন নিশাচর পাখির ডাক, উড়ন্ত পোকার শব্দ, অন্যান্য ছোট-ছোট প্রাণীর নিঃশব্দ চলাচলের আওয়াজ।

‘তোমার মনে আছে একবার আমি বলেছিলাম যে তুমি হচ্ছ বখে যাওয়া ছেলে, বিয়ের জন্য মোটেই উপযুক্ত নও? মোলায়েম স্বরে জানতে চাইল ডেবরা। চুল ভর্তি মাথা রাখল ডেভিডের কাঁধে।

‘আমি কখনোই ভুলবো না এটা।

‘আমি আনুষ্ঠানিকভাবে এ মন্তব্য তুলে নিতে চাই।’ বলে চলল ডেবরা। আস্তে করে নিজের দিকে ডেবরার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল ডেভিড। নিজের চেহারার উপর ডেভিডের দৃষ্টি অনুভব করে হাসলো সে। লজ্জা মেশানো হাসি। আমি একটা ছোট্ট ছেলের প্রেমে পড়েছিলাম। বখে যাওয়া ছোট ছেলে যে কিনা শুধুমাত্র তীব্র গতির গাড়ি আর স্টার্টের কথা চিন্তা করতো।–’ বলে উঠল ডেবরা। কিন্তু এখন আমার পাশে আছে মানুষ, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।’ আবারো হাসল সে। আর আমি তার এদিকটাই বেশি পছন্দ করছি।’

নিজের দিকে টেনে নিয়ে ডেবরাকে কিস করল ডেভিড। একটু ক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবারো কথা বলে উঠল ডেবরা।

‘এই বন্য প্রাণীরা—এগুলো তোমার কাছে অনেক কিছু

‘হ্যাঁ?’ উৎসাহ দিল ডেভিড।

‘আমি বুঝতে পারছি। যদিও আমি কখনো এগুলোকে দেখিনি, আমার কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

‘ভাল লাগল শুনে।

‘ডেভিড, আমাদের এই জায়গাটা–বেশ শান্তির, একেবারে পরিপূর্ণ। মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা স্বর্গোদ্যান।

‘আমরা এটিকে তাই করে তুলবো। প্রতিজ্ঞা করল ডেভিড। কিন্তু রাতের বেলা বন্দুকের আওয়াজে জেগে উঠল সে। তাড়াতাড়ি উঠে ডেবরাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে।

আবারো শোনা গেল। নীরব রাতে হালকা শোনাল। অনুভব করল রেগে উঠছে সে। কল্পনার চোখে যেন দেখতেও পেল লম্বা সাদা কিলিং ল্যাম্পের আলো। জঙ্গলের মাঝে ঘুরে ঘুরে হঠাৎ করে স্থির হচ্ছে কোন হতবাক অসহায় প্রাণীর উপর। অন্ধ চোখগুলো জ্বলছে রত্ন পাথরের মতো। টেলিস্কোপিক রাইফেলের জন্য চমৎকার শর্ট।

এরপরই হঠাৎ করে শোনা গেল রাইফেলের বিস্ফোরণ। মাজল ফ্ল্যাশের লম্বা ধোঁয়া। শক্ত মাটির উপর নরম শব্দে মৃতদেহ আছড়ে পড়ার শব্দ আর খুড়ের ঘসটানি আওয়াজ, তারপর আবারো চুপচাপ চারপাশ।

ডেভিড জানে যে এখন পিছু ধাওয়া করে কোন লাভ নেই। পাহাড়ের উপর নিশ্চয় বন্দুকবাজের দোস্ত থাকবে যেন কোন বাড়িতে আলো জ্বলে উঠলেই তাকে সংকেত দিতে পারে। অথবা কোন অটো ইঞ্জিন যদি জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিলিং ল্যাম্প বন্ধ করে অপহরণকারী নিঃশব্দে পালিয়ে যাবে। বৃথাই মাঝরাতে জাবুলানিতে ঘুরে মরবে ডেভিড। ধুরন্ধর শত্রু একমাত্র বুদ্ধির জোরেই কুপোকাত হবে।

আর ঘুম এলো না তার। ডেবরার পাশে জেগে বসে রইল আর শুনতে লাগল তার হালকা নিঃশ্বাসের শব্দ। মাঝে মাঝে দূরে রাইফেলের আওয়াজ। বোবা প্রাণীগুলো অসহায়ের মতো একটু পর পর ছুটে পালিয়ে গিয়েও তাকিয়ে দেখে তার দিকে ধেয়ে আসা অদ্ভুত আলোটাকে।

সারারাত রাগের চোটে এপাশ-ওপাশ করল ডেভিড। সকালবেলা দেখা গেল শুকুন উড়ছে।

ভোরের গোলাপি আকাশে কালো বিন্দু। একের পর এক আসতে লাগল। চক্রকারে ঘুরে ঘুরে নামার প্রস্তুতি নিতে লাগল।

সকুকুজা ক্যাম্পে কনরাড বার্গকে টেলিফোন করল ডেভিড। এরপর ডেবরা আর জুলুকে নিয়ে উঠে বসল ল্যান্ড রোভারে। সকালের ঠাণ্ডা বাতাসের জন্য নরম কাপড় জড়িয়ে নিল গায়ে। পাখিদের অনুসরণ করে পৌঁছে গেল যেখানে বাফেলোর দলের উপর আঘাত হেনেছে অপহরণকারীর দল।

প্রথম শবদেহের কাছে পৌঁছাতেই পাখির দল সরে গেল গাড়ির শব্দ পেয়ে। হায়েনার দল গিয়ে পালালো গাছের মাঝে। উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আবার দেখতে লাগল কী করে গাড়ি। ছোট লাল শিয়ালগুলো রুপালি পৃষ্ঠদেশ আর সাবধানী কান তুলে সম্মানজনক দূরত্ব পার হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে তাকাল।

শকুনগুলো মনে হলো অধৈর্য হয়ে উঠেছে। উড়ে উড়ে খেতে লাগল যা যা সম্ভব। ল্যান্ড রোভার একেবারে কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত ভ্রূক্ষেপ করল না। এরপর উড়ে গেল কাছের গাছের ডালে।

ষোলটা মৃত বাফেলোর দেহ দেখা গেল। দলটা পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। এক লাইনে পড়ে আছে সব। প্রতিটি মৃত পশুর পেট দেখা গেল উন্মুক্ত। তারপর কোমরের মাংস কেটে নেয়া হয়েছে নিপুণ হাতে।

কয়েক পাউন্ড মাংসের জন্যে খুন করল এ অবোধ পশুগুলোকে। অবিশ্বাসীর ভঙ্গিতে বলে উঠল ডেবরা।

‘হম, তাই’, চিন্তিত স্বরে জানাল ডেভিড। কিন্তু এটা হয়তো এতটা খারাপ নয়–কখনো কখনো তো ওয়াইল্ড বিস্টকে মেরে ফেলে লেজ দিয়ে ফ্লাই উইক বানাতে আর জিরোফকে গুলি করে হাড়ের মাঝে থাকা মজ্জার জন্যে।

‘আমি বুঝতে পারছি না। নিরাশ ভঙ্গিতে বলে উঠল ডেবরা। একটা মানুষ কীভাবে এমনটা করতে পারে? মাংসের এত তো অভাব পড়ে যায়নি।

‘না’, একমত হলো ডেভিড। এর কারণ আরো বড়। এই ধরনের হত্যা করতে সাহস লাগে। এই মানুষটা হত্যার আনন্দেই হত্যা করে। দেখে মজা পায় কীভাবে অসহায় প্রাণীটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করে তাজা রক্তের গন্ধ পছন্দ করে’–গলা ধরে গেল তার। এই একবার তুমি ঈশ্বরকে ধন্যবান জানাতে পারো যে তুমি চোখে দেখতে পারো না। নরম স্বরে জানাল ডেভিড।

কনরাড বার্গ দেখতে পেল তাদেরকে। নিজের রেঞ্জারদেরকে পাঠিয়ে দিল পশুদের মৃতদেহগুলো পরিষ্কারের কাজে। এত মাংস নষ্ট করার কোন মানে হয় না। অনেক লোকের খাদ্যের সংস্থান হবে এতে।

এরপর স্যামকে ডাকলো। পা গুনে দেখা গেল চারজন এসেছিল। একজনের পায়ে ছিল হালকা রাবারের সোলওয়ালা জুতা। বাকিদের খালি পা।

‘একজন সাদা লোক, কেননা লম্বা পা আর বড়সড় শরীর বোঝা যাচ্ছে। কালো তিনজন মাংস বহন করে নিয়ে গেছে। এখানে-সেখানে রক্ত পড়ে আছে ফোঁটায় ফোঁটায়।

সবাই স্যামকে অনুসরণ করে আস্তে আস্তে উঠে এলো জঙ্গল থেকে বাইরের রাস্তায়।

এখান থেকে পিছন দিকে গেছে তারা। পর্যবেক্ষণ করে জানাল স্যাম। চিন্তিত স্বরে ব্যাখা করল কনরাড।

‘পুরাতন কৌশল ব্যবহার করেছে তারা। সীমান্ত না পার হওয়া পর্যন্ত পেছন দিকে গেছে। বেড়ার কাছে গেলে তোমার মনে হবে তারা অন্যপথে গেছে- ভেতরে ঢোকেনি। তাই তাদের পিছু নিতে চাইবে না তুমি।

বেড়ার কাছে গিয়ে দেখা গেল একটা অংশে কিছু নেই। রাস্তা পার হয়ে পেছনে উপজাতিদের গ্রাম। বোঝা গেল সেখানে কোন একটা মোটর ভেহিকেল পার্ক করা ছিল। এরপর বালির রাস্তা ধরে আবারো মহাসড়কে গিয়ে মিশেছে চাকার দাগ।

‘টায়ারের দাগ প্লাস্টার কাস্ট করা যায় না? জানতে চাইলে ডেভিড। ‘সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না। মাথা নাড়াল কনরাড। তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো যে প্রতিবার বের হবার আগে চাকা বদলায় তারা। আর এ সেট বিশেষ ভাবে এ কাজের জন্যে। কাজ শেষ হবার পর লুকিয়ে রাখবে।

কার্টিজ শেল খরচের কথা কেমন মনে হয়? জোর দিয়ে বলল ডেভিড।

হালকা ভাবে হাসল কনরাড। এগুলো তার পকেটেই থাকে। এটা বেশ চালাক পাখি। পুরো দেশে সে তো তার প্রমাণ ছড়িয়ে রাখবে না। যখন কাজ করে তখনি তাকে ধরতে হবে। না আমাদেরকে ওকে এর মাঝে টেনে আনতে হবে। ব্যবসায়ী সুলভ মনোভাব দেখা গেল তার মাঝে। ঠিক আছে, তুমি এমন কোন জায়গার কথা ভেবেছো যেখানে স্যামকে রাখা যায়?

‘আমার মনে হয় ওকে একটা কোপজেতে রাখতে হবে। মুক্তোর ছড়ার কাছে। রাস্তায় একটু ধুলা দেখতে পেলেও আমাদেরকে সিগন্যাল দেবে। জায়গাটার উচ্চতা টু-ওয়ে রেডিওকে প্রয়োজনীয় রেঞ্চ দেবে।’

লাঞ্চ করার পর নাভাজোর লাগেজ কম্পার্টমেন্টে নিজেদের ব্যাগ রাখল ডেভিড। ভৃত্যদেরকে দুই সপ্তাহের বেতন দিয়ে দিল অগ্রিম ‘ভাল থাকবে তোমরা।’ জানাল তাদেরকে। এই মাস শেষ হবার আগেই ফিরে আসব আমি।’

খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেল ইগনিশনে চাবি ঝুলছে। এমন ভাবে ল্যান্ড রোভার নিয়ে হ্যাঙ্গারে পার্ক করল ডেভিড। প্রস্তুত হয়ে আছে যাত্রার জন্যে। এরপর উঠে পশ্চিমে হেডিং সেট করল। ব্যান্ডেলিয়ার হিল আর আমগাছগুলো পার হয়ে গেল। জীবনের কোন চিহ্ন দেখা গেল না। কিন্তু নিজের কোর্স ধরে রাখল ডেভিড। যতক্ষণ পর্যন্ত না দিগন্ত থেকে হারিয়ে গেল পাহাড় সারি। এরপর আবার ঘুরে দক্ষিণে ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কের সকুকুজা ক্যাম্পে এলো।

এয়ারস্ট্রিপে নিজের ট্রাকে অপেক্ষা করছিল কনরাড বার্গ সেসনার জন্যে। গেস্টরুমে তাজা ফুল রেখে দিল জেন। এখান থেকে উত্তর-পশ্চিমে পঞ্চাশ মাইল গেলেই জাবুলানি।

৬. লাল স্ট্যান্ডবাই হিসেবে

মনে হলো আবারো ‘লাল’ স্ট্যান্ডবাই হিসেবে স্কোয়াড্রনের কাজে নেমেছে ডেভিড। বড় গাছের শেডের নিচে নাভাজো পার্ক করা। রেডিও সেটও রাখা হয়েছে সুইচ অন অবস্থায়। সামের ট্রান্সমিটারের সিগন্যাল আসছে ভাসা ভাসা। পুলের উপরে পাহাড়ের মাথায় ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করছে সে।

বেশ গরম পড়েছে। পূর্ব দিক থেকে ঝড়ের আভাসও পাওয়া যাচ্ছে।

এয়ারক্রাফটের উইংয়ে ছায়ায় বসে আছে ডেভিড, ডেবরা আর কনরাড বার্গ। ককপিটে গরমের জন্যে বসাই যাচ্ছে না। হালকা চালে খোশগল্পে মেতে থাকলেও সবার কান খাড়া হয়ে আছে স্যামের কাছ থেকে সংকেতের আশায়।

‘লোকটা আজ আসবে না। দুপুর হবার খানিক আগে জানাল ডেবরা। আসবে, নির্ঘাৎ আসবে। কনরাড শুধরে দিল ডেবরাকে। এই বাফেলোগুলোর লোভ সামলানো সোজা কথা নয়। হয়তো আজ না—-কিন্তু আগামীকাল বা তার পরে সে আসবেই।

উঠে দাঁড়াল ডেভিড। কেবিনের খোলা দরজা দিয়ে উঠে পড়ল। ককপিটের দিকে এগিয়ে গেল।

‘স্যাম?’ মাইক্রোফোনে ডেকে পাঠাল সে। আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? অনেকক্ষণ বিরতি। বোঝা গেল রেডিও ব্যবহার করতে হিমশিম খাচ্ছে স্যাম। এরপর আস্তে হলেও পরিষ্কার ভাবে শোনা গেল ওর গলা ‘আমি শুনতে পাচ্ছি নখোসি।’

‘কিছু দেখতে পেয়েছো?

কিছু না।

নজর রাখো তাহলে।

ইয়েবো, নখোসি।’

এয়ারস্ট্রিপে ঠাণ্ডা পিকনিক লাঞ্চ নিয়ে এলো জেন। টেনশন থাকা সত্ত্বেও পেট পুরে খেলো সকলে। এরপর হাত দিতে যাবে মিল্ক টার্টের প্লেটে, হঠাৎ করেই জীবন্ত হয়ে উঠল রেডিও। পরিষ্কার কণ্ঠে ঘোষণা করল স্যাম :

‘এসে গেছে!

‘রেড স্টান্ডবাই গো! যাও!”

চিৎকার করে উঠল ডেভিড। সবাই হুড়মুড় করে ঢুকলো কেবিনের দরজা দিয়ে। জেনের মিল্ক টার্টের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল ডেবরা। তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে সিটে নিয়ে বসিয়ে দিল ডেভিড।

ব্রাইট ল্যান্স এয়ারবর্ন হয়ে উঠে পড়ছে। উত্তেজনায় হেসে উঠল ডেভিড। এরপর স্মৃতি এসে যেন ছুরি বসিয়ে দিল মুখে। মনে পড়ল ছয়ের কাটার ঘরে ঝুলে আছে জো। জোর করে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। শূন্য চোখে তাকাল হেডিংয়ের দিকে। অলটিচ্যুডের জন্যে সময় নষ্ট না করে গাছের উপরে ডান দিকে রইল সমান্তরালভাবে।

তাদের পেছনে সিটে কুঁজো হয়ে বসে আছে কনরাড বার্গ। সবসময়ের চেয়েও বেশি লাল হয়ে আছে তার চেহারা। মনে হচ্ছে বেশি পেকে যাওয়া একটা টমেটোর মতো যে কোন মুহূর্তে বিস্ফোরিত হয়ে যাবে। ল্যান্ড রোভারের চাবি কোথায়? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল সে। ইগনিশনে আর ট্যাঙ্কিও ভর্তি হয়ে আছে।

‘আরো জোরে চালাতে পারো না? গর্জন করে উঠল কনরাড।

‘ওয়াকি টকি এনেছেন? মনে করিয়ে দিল ডেভিড।

‘এই যে! বিশাল হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে কনরাড। আরেক হাতে জোড়া ব্যারেলের ৪৫০ ম্যাগনাম দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার ভাবে।

উঁচু গাছগুলোর মাথায় উঠে পড়ল ডেভিড। সীমান্ত বেড়ার উপর পৌঁছে গেল। সামনে পড়ে আছে জাবুলানির পাহাড়।

প্রস্তুত হোন, কনরাড়কে জানাল ডেভিড। নাভাজো নিয়ে উড়ে গেল এয়ারস্ট্রিপে; ট্যাক্সিইং করে এগিয়ে গেল পার্ক করে রাখা ল্যান্ড রোভারের দিকে।

ডেভিড ব্রেক কষে থামার সাথে সাথে লাফ দিয়ে নেমে গেল কনরাড। কেবিনের দরজা খুলেই দৌড় দিল ল্যান্ড রোভারের দিকে। সাথে সাথে থ্রটল খুলে দিল ডেভিড। এয়ারক্রাফটকে ঘুরিয়ে নিল। নাভাজো আবারো শক্তি ফিরে পাবার আগেই টেক-অফ করল।

উপরে উঠে পড়তেই দেখতে পেল এয়ারস্ট্রিপ ধরে ধুলার মেঘ উড়িয়ে গর্জনে ছুটে চলেছে ল্যান্ড রোভার।

‘ডু ইউ রিড মি, কনি?”

‘লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। স্পিকারে গমগম করে উঠল কনরাডের কণ্ঠস্বর। ডেভিড মোড় নিয়ে পাহাড়ের পেছনে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া পাবলিক রোডের দিকে ঘুরে গেল।

অনুসরণ করে চলল সে। প্রায় পাঁচশ ফুট উপরে আছে। ভোলা পার্ক ল্যান্ডের চারপাশে খুঁজতে লাগল।

মাটি থেকে সবুজ ফোর্ড ট্রাককে দেখা না গেলেও আকাশ থেকে পরিষ্কার ভাবে চোখে পড়ল। আক্কারস ভাবতেই পারল না কী ঘটতে চলেছে।

কনি, পেয়েছি ট্রাককে লুজান স্ট্রিম থেকে তীরের দিকে আধা মাইলের মাঝে। ভাল হবে তুমি যদি ব্রিজের দিকে এগিয়ে যাও। এরপর শুকনো নদীর মাঝে নেমে গিয়ে চেষ্টা করা ট্রাক আসার আগেই ধরতে।

“ঠিক আছে, ডেভিড।’

মুভ ইট, ম্যান।

হুম। গাছের উপর দিয়ে ও ল্যান্ড রোভারের ধুলা দেখতে পেল ডেভিড। কনরাড নির্ঘাৎ প্যাডেলে পা চেপে রেখেছে শক্ত করে।

‘আমি চেষ্টা করব লোকটাকে হাতেনাতে ধরে তোমার হাতে তুলে দিতে।

‘তুমি পারবে।’

পাহাড়ের দিকে লম্বা টান নিল ডেভিড। চারপাশ দেখতে লাগল নিচে চকচক করছে পুল। হালকাভাবে প্রটল খুলে দিল ডেভিড। অনেক উপর থেকে দেখা গেল ছোট্ট একটা বিন্দু পাগলের মতো নাচানাচি করছে।

‘স্যাম।’ দেখতে পেল ডেভিড। যুদ্ধের নাচ নাচছে। কোর্স বদলে স্যামের একেবারে কাছ দিয়ে উড়ে গেল ডেভিড। উইন্ডমিলের মতো ঘোরা বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে পশ্চিম দিকে দেখাল স্যাম। হাত নেড়ে স্বীকৃতি জানাল ডেভিড। এরপর পশ্চিমে নেমে গেল খানিকটা।

সামনের ছড়িয়ে আছে সমভূমি, ঠিন যেন চিতা বাঘের পিঠ। ঘন ঝোঁপঝাড় আর সোনালি ঘাস। আরো এক মিনিট উড়ে গিয়ে কালো একটা জমায়েত দেখতে পেল। তার সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। বাকি বাফেলোগুলো একত্রিত হয়েছে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে।

বাফেলো। ডেবরাকে জানাল ডেভিড। দৌড়াচ্ছে। কিছু একটা সচকিত করে তুলেছে তাদেরকে। ডেভিডের পাশে চুপচাপ বসে আছে সে। কোলের উপর হাত রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

আহ! চিৎকার করে উঠল ডেভিড। পেয়েছি তাকে-হাতে রক্ত!

সামনের খালি জায়গাগুলোর একটার ঠিক মাঝখানে পোকার মতো দেখাচ্ছে মৃত বাফেলোর দেহটাকে। পেট অনাকৃত, পা ঝুলে আছে একপাশে।

চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এর চারপাশে। নির্ঘাৎ কসাইয়ের কাজ শুরু হবে এখন। তিনজন আফ্রিকান, একজনের হাতে ছুরি।

চতুর্থজন হলে আক্কারস। এত লম্বা-চওড়া দেহ ভুল হবার কোন কারণ নেই। পরনে কালো ফেদোরা, টুপি আছে মাথায়। যে কাজে লেগেছে তার তুলনায় পোশাকটা  বড় বেশি আনুষ্ঠানিক মনে হল। কিন্তু শার্টের উপর ব্রেস আছে আড়াআড়ি ভাবে।

ডান হাতে ধরে আছে একটা রাইফেল। এয়ারক্রাফটের শব্দ পেয়ে তাকাতে লাগল চারপাশে। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়েই জমে গেল যেন।

‘শুয়োর কোথাকার। ওহ, কী যে করতে ইচ্ছে করছে আমার!’ ফিসফিস করে উঠল ডেভিড। রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল সে।

‘হোল্ড অন! সাবধান করল ডেবরাকে। ঠিক খাড়াভাবে নেমে যেতে লাগল মানুষটার উপর। মৃত বাফেলোর চারপাশে জড়ো হওয়া দলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এয়ারক্রাফট নেমে যেতে লাগল তাদের উপর। কিন্তু ডেভিড নির্বাচন করল টুপিওয়ালাকে। পোপেলারের পাখা স্পর্শ করল ঘাসের মাথা। দৌড়ে গেল আক্কারসের দিকে।

মনে হলো আক্কারসের উপর দিয়ে প্লেন চালিয়ে দেবে সে। অসম্ভব রেগে উঠল নিজের অবোধ প্রাণীদের উপর এহেন নির্যাতন দেখে। চাইল প্রপেলারের ব্লেড দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে দুষ্ট লোকটাকে।

কাঁধের উপর দিয়ে পেছনে তাকাল আক্কারস। ভয়ে সাদা হয়ে গেল তার মুখ। গভীর আর গর্তে বসানো চোখগুলোতে ভয়ার্ত ছায়া দেখতে পেল- খুনীর মতো এগিয়ে আসছে ব্লেডগুলো। আর হয়তো ফুটখানেক দূরে। ঘাসের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল লোকটা।

এক ইঞ্চি উপর দিয়ে উড়ে গেল নাভাজো। আবার ঘুরিয়ে এদিকে আসতে লাগল ডেভিড। এবার পাখার মাথা দিয়ে ঘাসের ডগা কাটতে কাটতে এগোতে লাগল। আসার সময় দেখতে পেল উড়ে যাবার মতো দৌড় লাগাল আক্কারস। আর গাছের কিণার থেকে পঞ্চাশ কদম দূরে আছে।

সমান্তরাল ভাবে উঠে গেল ডেভিড। রাগে এখনো কাপঁছে সে। কিন্তু বুঝতে পারল গাছগুলোর কাছে পৌঁছানোর আগে তাকে ধরতে পারবে না সে।

বড়সড় একটা গাছের মোটা গুঁড়ির কাছে পৌঁছে কাঁধে রাইফেল তুলে নিল আক্কারস। এগিয়ে আসা এয়ারক্রাফটের দিকে তাক করল, যদি হাত কাঁপছে, কিন্ত রেঞ্জ কম আছে।

‘নিচে’, চিৎকার করে উঠল ডেভিড। উইন্ডশিল্ডের নিচে নামিয়ে দিল ডেবরার মাথা। থ্রটল খুলে খাড়াভাবে উঠে গেল উপর দিকে।

ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়েও ডেভিডের কানে এলো এয়ারক্রাফটের ফিউজিলাজে আঘাত করা বুলেটের শব্দ।

‘কী হচ্ছে ডেভিড?’ আর্তনাদ করে উঠল ডেবরা। ও আমাদের দিকে গুলি ছুঁড়ছে। কিন্তু আমরা তাকে দৌড়াতে বাধ্য করেছি। নিশ্চয় ট্রাকের কাছে যাবে এখন। এতক্ষণে সেখানে পৌঁছে গেছে কনরাড।

গাছের ফাঁকে ফাঁকে কাভার নিয়ে দৌড়াতে লাগল আক্কারস। উপরে কর দিচ্ছে ডেভিড। বুঝতে পারল পালানোর জন্যেই দৌড়াচ্ছে প্রাণপণে আক্কারস।

‘ডেভিড, শুনতে পাচ্ছো আমার কথা?’ ককপিটের মাঝে গমগম করে উঠল কনরাডের স্বর।

কী হয়েছে, কনি?

‘আমরা সমস্যায় পড়েছি। ল্যান্ড রোভার পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগেছে। পুরো জায়গা ভরে যাচ্ছে তেলে। পাম্প ফুটো হয়ে গেছে।

‘কীভাবে হলো এমনটা? জানতে চাইল ডেভিড।

‘আমি একটা শর্ট-কাট রাস্তা দিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কনরাডের কাতরতা বুঝতে পারল ডেভিড। লজুন স্ট্রিম থেকে কতদূর আপনি?

‘প্রায় তিন মাইল।

‘ঈশ্বর, পার হয়ে যাবে শয়তানটা এতক্ষণে। জানিয়ে দিল ডেভিড। ট্রাক থেকে দুই মাইল দূরে আছে। আর এমন ভাবে দৌড়াচ্ছে যেন পিছনে ট্যাক্স কালেকটর ছুটে আসছে।

‘তুমি এখনো জানো না বৃদ্ধ কনি কী করতে পারে। আমি ওখানে অপেক্ষা করব ওর জন্যে। তুমি শুধু দেখো৷ প্রমিজ করল কনরাড।

গুড লাক, ডেভিড জানাতেই যোগায়োগ কেটে গেল।

নিচে পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে গেছে আক্কারস। গাছের নিচে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার টুপি। নিজের স্টারবোর্ড উইং তার দিকে তাক করে রাখল ডেভিড। ধীরে ধীরে তার উপরে চক্কর কাটছে নাভাজো।

আক্কারসকে ছাপিয়ে আরেকটা মূর্তি নজরে এলো এবার। এক মুহূর্তের জন্যে ভাবল বোধ হয় কোন জম্ভ। এরপরই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারল ওর ভুল হয়েছে।

কী হয়েছে? ডেভিডের চিন্তা বুঝতে পেরে জানতে চাইল ডেবরা।

‘স্যাম। ওই গাধা কোথাকার। কনি বারবার বলেছে ওর জায়গা থেকে না নড়তে। ওর কাছে কোন অস্ত্র নেই—কিন্তু নিচে নেমে আসছে আক্কারস’কে ধরতে।

ওকে থামতে পারো না তুমি?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল ডেবরা। উত্তর দেবার সময়ও নেই ডেভিডের।

প্রতি উত্তরের আগে চারবার কল করল কনরাডকে। দৌড়ানোর কারণে মোটা হয়ে আসছে তার স্বর।

‘স্যাম আক্কারসের সামনে পড়তে যাচ্ছে। বোধ হয় মোকাবেলা করতে চায়।’

‘ওহ ঈশ্বর। গুঙ্গিয়ে উঠল কনরাড।

‘আমি পেলে ওকে মেরে ফেলবো।

‘দাঁড়ান, জানাল ডেভিড। আমি কাছে যাচ্ছি কী ঘটে দেখার জন্যে।

পরিষ্কারভাবে সব কিছু ঘটতে দেখল ডেভিড। মাত্র তিনশ ফুট উপরে সে। আক্কারস বুঝতে পারলো কেউ একজন দৌড়ে আসছে। পুরো থেমে রাইফেল তুলে নিল। হয়তো সর্তকবাণী দিয়েছেও; কিন্তু দৌড়ানো বন্ধ করল না স্যাম। পাথুরে জমি পেরিয়ে দৌড়ে এসে ধরতে চাইল মানুষটাকে। যে কিনা তার ছেলেমেয়েকে পুড়িয়ে মেরেছে।

কাঁধে রাইফেল তুলে নিল আক্কারস। ইচ্ছে করে তাক করল। রাইফেল নেচে উঠল। ভারী নরম নাকওয়ালা বুলেট আঘাত করল স্যামের গোড়ালিতে।

ছোট্ট বাদামী রঙের দেহটা গড়িয়ে পড়তে লাগল ঢালু বেয়ে।

ডেভিড দেখতে পেল রাইফেল রিলোড করল আক্কারস। নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিল কার্টিজ শেল। এরপর চোখ তুলে তাকাল তাকে ঘিরে চক্কর দিতে থাকা এয়ারক্রাফটের দিকে। হয়তো ডেভিডের ভুল হয়েছে কিন্তু মনে হলো হাসছে আক্কারস। ভয়ঙ্কর দেখতে কুৎসিত দাঁতগুলো ঝিক দিয়ে উঠল। এরপর লাফিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল ট্রাকের দিকে।

‘কনি’ কর্কশ ভাবে নিজের হ্যান্ডসেটে বলে উঠল ডেভিড, স্যামকে খুন করেছে ব্যাঞ্চোতটা।

.

এবড়ো-খেবড়ো বালিময় ভূমির উপর দিয়ে বহু কষ্টে দৌড়ে এলো কনরাড বার্গ। টুপি হারিয়ে গেছে। বিশাল লাল মুখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে ঘাম। চোখ জ্বালা করছে, ধূসর চুলগুলো লেপ্টে আছে কপালের সাথে। পিছনে লাফাচ্ছে ওয়াকি টকির সেট। কোমরে তালে তালে দুলছে রাইফেলের বাট।

পুরো মনোযোগ দিয়ে দৌড়াচ্ছে সে। চেষ্টা করল হৃৎপিণ্ডের লাফানি ভুলে যেতে, নিঃশ্বাসের কষ্ট উপেক্ষা করতে। কাটা গাছ লেগে কেটে গেল হাতের উপরের অংশ। চামড়া দিয়ে গড়াতে লাগলো চিকন রক্তের ধারা। কিন্তু দৌড়ানো থামালো না সে।

আকাশের দিকে লাল মুখ তুলে তাকাল। দেখতে পেল ডেভিডের এয়ারক্রটাকে। তার সামনে চক্কর দিচ্ছে। খানিকটা বাম পাশে। এর মানে হলো আক্কারস সেদিকে আছে। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে পালাবার আগে তাকে ধরতে পারবে কনরাড।

পিঠের রেডিও সেট বাজতে লাগল। কিন্তু কল ধরল না সে। এখন থামতে পারবে না সে। দৌড়ানো থামানো মানে হলো নিঃশেষ হয়ে পড়ে যাবে সে। বিশালদেহী মানুষ সে, বাতাস বেশ গরম, তিন মাইল দৌড়ে এসেছ সে, আরেকটু এগিয়ে যাওয়া মনে হচ্ছে কিছুতেই সম্ভব না। শেষ শক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছে সে।

হঠাৎ করেই পায়ের তলার মাটি মনে হলো সরে গেল। সামনে ঝুঁকে অর্ধেক পড়িয়ে অর্ধেক গড়িয়ে লুজানে স্ট্রিমের খাড়াই বেয়ে নেমে যেতে লাগল। সাদা নদীর বুকে এসে থামলো। পরিষ্কার একেবারে চিনির মতো। মাংসের মাঝে খোঁচা মারছে পিঠের রেডিও, বহুকষ্টে বের করল।

তখনো নদীর বুকে শুয়ে কুকুরের মতো হাঁপাতে লাগল সে। ঘামে ভেজা চোখে মনে হলো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অনেক কসরত করে ট্রান্সমিট বাটনে চাপ দিল।

‘ডেভিড’ ব্যাঙের মতো স্বর বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। আমি স্ট্রিমের কাছে শুয়ে আছি–দেখতে পাচ্ছো আমাকে?

পুরোপুরি মাথার উপর চলে এলো এয়ারক্রাফট। তৎক্ষণাৎ শোনা গেল ডেভিডের কণ্ঠস্বর।

‘আমি দেখতে পাচ্ছি, কনি। ট্রাক থেকে একশ গজ নিচে আছেন। আপনি। আক্কারস এসে পড়েছে কনি। যে কোন মুহূর্তে চলে আসবে।

হাঁপাতে হাঁপাতে মনে হলো নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। কনরাড বার্গ হাঁটু গেড়ে উঠে বসল আর ঠিক সেই মুহূর্তে ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেল। ভারী রেডিও খুলে ফেলে একপাশে ফেলে রাখল। এরপর রাইফেলও ফেলে দিল কাঁধ থেকে। ব্রিচ খুলে লোড চেক করল। নিজেকে তুলে দাঁড় করালো।

নিজের শরীরের এই দুর্বলতায় অবাক হয়ে গেছে সে নিজেও। আস্তে আস্তে এগোতে লাগল মাঝখানে।

শুকনো নদীবক্ষ বন্যার পানির জন্যে আট ফুট গম্ভীর হয়ে আছে। এখানে পনের মিটার চওড়া ও। মেঝে ঢেকে আছে নরম সাদা বালিতে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট পাথর। বেসবলের চেয়ে বড় নয়। এটি জাবুলানিতে পৌঁছানোর জন্যে চমৎকার একটি অবৈধ রাস্তা। নরম মাটিতে এখনো দেখা যাচ্ছে আক্কারসের ট্রাকের চাকার দাগ।

স্ট্রিমের একটা বাকের মুখে ট্রাকের এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেল কনরাড।

নদীবক্ষের মাঝখানে চারকোনা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কনরাড। কোমরের কাছে আড়াআড়ি ভাবে ধরে রেখেছে রাইফেল। চেষ্টা করছে নিজের নিঃশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে। এগিয়ে আসা ট্রাক পাগলের মতো বাঁকের কাছের স্কিড করল। এরপর দ্রুত নেমে আসতে লাগল তার দিকে। রিয়ার হুইল থেকে বালির ফোয়ারা ছিটকে আসছে।

স্টিয়ারিং হুইলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে জন আক্কারস। আইব্রোর উপর নেমে এসেছে টুপি। ঘামে চকচকে সাদা হয়ে আছে চেহারা। দেখতে পেল রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে কনরাড।

‘থামো!’ রাইফেল নাড়িয়ে চিৎকার করে উঠল কনরাড। থামো নয়তো আমি গুলি করব

এলোমেলো ভাবে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে ট্রাক। হাসতে শুরু করল আক্কারস। হাসির দমকে তার কাঁধ কাঁপছে দেখতে পেল কনরাড। বের হয়ে গেছে বিভৎস দাঁতের সারি। ট্রাকের গতি একটুও কমলো না।

রাইফেল তুলে নিয়ে জোড়া ব্যারেল দিয়ে তাকাল কনরাড। এই রেঞ্জে একটা করে বুলেট জোহান আক্কারসের গভীরে বসানো ব্যাপারই নয়। কিন্তু মানুষটার মনে হলো এ ব্যাপারে কোন চিন্তাই নেই। মাড়ির সাথে আলগা ভাবে ঝুলন্ত দাঁত নিয়ে হেসে চলেছে সে। পঞ্চাশ ফুট দূর আছে ট্রাক। উঠে আসছে কনরাডের গায়ের উপর।

মাথা খারাপ না হলে ইচ্ছে করে একটা মানুষ আরেটা মানুষের উপর গুলি চালাতে পারে না। এটা হতে হবে সৈন্যের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া অথবা আইন পালনকারী অফিসারের কাজ। অথবা কোন শিকারির হাত নতুবা বদ্ধ উন্মাদ কোন অপরাধী।

এদের একজনও নয় কনরাড বার্গ। বেশির ভাগ বিশালদেহী মানুষের মতো সেও একজন নম্র-ভদ্র মানুষ। তার সমস্ত চিন্তা-ভাবনা ঘিরে আছে জীবনকে নিয়ে–ট্রিগারে চাপ দিতে পারল না সে।

ট্রাক পনের ফুট দূরে থাকতে ছিটকে একপাশে লাফ দিল কনরাড। জোহান আক্কারস ইচ্ছে করে তার দিকে চালিয়ে দিল ট্রাক।

ট্রাকের পাশের অংশ দিয়ে ধাক্কা মারলো কনরাডের কোমরে। স্ট্রিমের মাটির দিকের তীরের কাছে ছিটকে পড়ল সে। আরো একটু নিচে গিয়ে আলগা পাথরসহ আরো একবার হড়কে গেল ট্রাকের চাকা। হুইল নিয়ে যুদ্ধ শুরু করল আক্কারস। অ্যাক্সেলেটরে পা চেপে ধরে উঠে আসল নদীর বুকে। তীরে নরম বালির উপর পড়ে রইল কনরাড।

ট্রাকের ধাক্কা খাবার সাথে সাথে কনরাড বুঝতে পারল কোমরের কাছের হাড় ভেঙ্গে গেল গ্লাসের মতো। পাজরের খাঁচার সাথে ধাতুর ঘর্ষণে ফুসফুস থেকে বের হয়ে গেল সবটুকু বাতাস।

একপাশে কাত হয়ে বালির উপর শুয়ে রইল সে। ধীরে ধীরে মুখ থেকে বের হয়ে এলো রক্তের ধারা। তিক্ত লবণাক্ত স্বাদ। বুঝতে পারল ভাঙা পাজর বর্শার মতো আঘাত করেছে ফুসফুস। শরীরের অনেক গভীর থেকে বের হয়ে আসছে রক্ত।

মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেল দশ কদম দূরে পড়ে আছে রেডিও সেট। নিজেকে টেনে হেঁচড়ে এগোতে লাগল এর দিকে। ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া পা ঝুলছে পেছনে।

‘ডেভিড, মাইক্রোফোনে ফিসফিস করে উঠল কনরাড। আমি থামাতে পারি নি। চলে গেছে। সাদা বালির উপর থু দিয়ে ফেলল মুখ ভর্তি রক্ত।

লুজানের পাকা ব্রিজের নিচ থেকে নদীবক্ষ পেরিয়ে উঠে এলো ট্রাক, দেখতে পেল ডেভিড। ড্রেন পার হয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে এলো রাস্তায়। দ্রুত গতি বাড়ালো, পশ্চিমে ধেয়ে চলল ব্যান্ডেলিয়ার পাহাড় আর মহাসড়কের দিকে। সবুজ চেসিসের পেছন থেকে ধুলার মেঘ উড়তে লাগল। পরিষ্কার চিহ্ন রেখে গেল ডেভিডের জন্যে।

সুজান পার হবার পর রাস্তা তীক্ষ্মভাবে মোড় নিয়ে পাথুরে জায়গা পার হলো। তারপর ধনুকের মতো হয়ে এগোলো আরো দুই-মাইল।

নিজের ল্যান্ডিং গিয়ার নামিয়ে থ্রটল পেছনে টানলো ডেভিড। নাভাজো নেমে এলো মাটির উপর। ধুলি মাখা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল যেন এটা একটি ল্যান্ডিং স্ট্রিপ।

ঠিক সামনেই ট্রাকের ধুলা দেখা যাচ্ছে। সোজাসুজি এগিয়ে চলেছে পরম্পর। কিন্তু ডেভিড চাইছে গাছের উঁচু দেয়ালের মাঝে সরু লেনের মধ্যে নামিয়ে আনতে প্লেনকে। আস্তে আস্তে কথা বলল ডেবরার সাথে। নিশ্চয়তা নিয়ে ব্যাখা করল ও কী করতে চলেছে।

সরু রাস্তায় আস্তে করে মাটি স্পর্শ করল নাভাজো। এরপর আবারো থ্রটল খুলে দিল। রাস্তার মাঝ বরাবর এগিয়ে গেল। নাভাজোকে আবার উঠিয়ে নেয়ার মতো প্রয়োজনীয় গতি আছে। যদি আক্কারস আত্মসমর্পণ না করে সংঘর্ষ বাধাতে চায়।

তাদের সামনে রাস্তার আরেকটা বাঁক। এর দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতেই হঠাৎ করে ধেয়ে আসতে লাগল ট্রাক। খুব বেশি হলে একশ গজ দূরত্ব।

দুইটি বাহনই একে অপরের দিকে মুখোমুখি এগিয়ে যাচ্ছে। যৌথভাবে গতি হবে ঘণ্টায় দুইশ মাইল। আর এই ধরনের দৃশ্য তো জোহান আক্কারসের কল্পনারও বাইরে।

রাস্তার ঠিক মাঝখানে এয়ারক্রাফট। প্রোপেলারের ঘূর্ণনশীল অবস্থা দেখে ভিরমি খাবার জোগাড় হলো তার।

হুইল শক্ত করে টেনে ধরল সে। শুকনো মাটিতে স্কিড করে উঠল ট্রাক। অল্পের জন্যে মিস করল নাভাজোর পোর্ট-উইংয়ের মাথা।

সামনের চাকাগুলো ঘুরে পড়ে গেল ড্রেনে। জানালা থেকে গ্লাস ভেঙ্গে দরজা গেল খুলে। একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেল ট্রাক।

থ্রটল বন্ধ করলো ডেভিড। হুইল ব্রেকের উপর চেপে ধরল পা। এখানে অপেক্ষা করো।’ চিৎকার করে ডেবরাকে জানিয়েই রাস্তায় লাফিয়ে নামালো ডেভিড। ক্ষত-বিক্ষত টিস্যু জমে মুখোশের মতো সেটে আছে তার মুখে। কিন্তু চোখ জোড়া জ্বলছে ধকধক করে, এক দৌড় লাগল সবুজ ট্রাকের দিকে।

ডেভিডকে দৌড়ে আসতে দেখল আকারস। চেষ্টা করল উঠে দাঁড়াতে। দেখতে পেল ক্যাবের মাঝে পড়ে আছে তার রাইফেল। বহুকষ্টে উঠে খোলা দরজা দিয়ে চাইল সেটা নিতে। কপালে গভীর ভাবে কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে লাগল চোখের মাঝে। মনে হলো অন্ধ হয়ে গেছে সে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে পিটপিট করে তাকাল চারপাশে।

কাছে চলে এসেছে ডেভিড। সেচ নালা পার হয়ে তার দিকে দৌড়ে আসছে। বিধ্বস্ত সবুজ গাড়ির উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল আক্কারস। বেল্টে থাকা হান্টিং নাইফ নিতে উদ্যত হলো। শেফিল্ড স্টিল দিয়ে বানানো আট ইঞ্চি ফলা, হ্যান্ডেলও আছে আর রেজারের মতোই ধার।

ছুরি নিয়ে যুদ্ধ করে যারা তাদের মতোই বাগিয়ে ধরল ছুরিটা। তারপর হাতের তালু দিয়ে মুছলে চোখ।

আস্তে আগে বেড়ে ডেভিডের মুখোমুখি হলো। বিশাল হাতের মুঠির মাঝে লুকিয়ে ফেলল ছুরি।

তার একটু দূরে থাকতেই থেমে গেল ডেভিড। চোখ আটকে গেল ছুরিতে। আবারো হাসতে শুরু করল আক্কারস। এমন গুড়গুড় শব্দ হতে লাগল বোঝাই গেল যে, নিষ্ঠুরতার চরম সীমা অতিক্রম করেছে সে বহু আগেই।

কোবরার মতো মোহনীয় ভঙ্গিতে ফলা এদিক-ওদিক করতে লাগল আক্কারস। সূর্যের আলো পড়ে চকচকে করে উঠল স্ট্রিলের ফলা। তাকিয়ে থেকে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে প্যারাট্রুপারের সমস্ত ট্রেনিং স্মরণ করে নিল। ডেভিড।

দ্রুত আগে বেড়ে পোচ দেয়ার ভঙ্গি করল আক্কারস। ডেভিড সরে যেতেই আরো উঁচু শব্দে হেসে উঠল।

আবার চক্রকারে ঘুরতে শুরু করল দুজনে। মুখ অল্প খোলা রেখে অদ্ভুত ভাবে কিড়মিড় শব্দ করছে আক্কাস। তাকিয়ে আছে গভীরে বসা চোখ জোড়া দিয়ে। ধীরে ধীরে আবারো তার সামনে গেল ডেভিড। আক্কাস খেদিয়ে তাকে নিয়ে গেল ট্রাকের দিকে। এক কোণায় আটকে ফেলতে চাইল ডেভিডকে।

এরপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আহত চিতাবাঘের মতো। এতটা গতি আর শক্তি সত্যিই অবিশ্বাস্য। হিসহিস শব্দে ডেভিডের পেটের কাছে থেকে ঘুরে এলো ছুরির ফলা।

কব্জি দিয়ে ছুরিটা ধরে ফেলল ডেভিড। বাধ্য করল ছুরি ধরা হাত নিচে নামাতে। বুকে বুক ঠেকে গেছে, দুর্গন্ধ আসছে আক্কারসের নোংরা দাঁত থেকে।

নিঃশব্দে যুদ্ধ করছে দু’জনে। একে অন্যের শক্তি আর সামর্থ্যের পরীক্ষা নিচ্ছে যেন।

ডেভিড অনুভব করে তার হাতের মাঝে ধরা ছুরি হাত মোচড় খাচ্ছে। মানুষটার হাত বাহু যেন স্ট্রিল দিয়ে তৈরি। আর বেশি সময় আক্কাসকে ধরে রাখতে পারবে না বুঝলো সে। সেকেন্ডের মাঝেই মুক্ত হয়ে যাবে হাত আর পেটের মাঝে ঢুকে যাবে।

এবার লোকটার পা আটকে একপাশে কাত করে ফেলতে চেষ্টা করল ডেভিড। ফলে খানিকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ল আক্কারস। আরেক হাত দিয়ে ধরে ফেলল ছুরির হাত। কিন্তু দুই হাত দিয়েও ধরে রাখতে পারছে না সে।

দুজনেই হাপাচ্ছে, পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আটকে রইল ট্রাকের গায়ে। উত্তপ্ত ধাতব শরীর থেকে আসছে তেলের গন্ধ।

ছুরির উপরই নিজের মনোযোগ আটকে রাখল ডেভিড। কিন্তু বুঝতে পারল আরেকটা হাত দিয়ে ওর গলা ধরতে চাইছে আক্কারস। মাথা দিয়ে কাঁধের উপর বাড়ি মারলো তাকে ডেভিড। চিবুক দিয়ে বুকে খোঁচা মারলো। কিন্তু হুড়কোর মতো আটকে যাওয়া আঙুল কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না ছুরি থেকে। মনে হলো গলার মাংসে বিধে গেল আক্কারসের হাতের আঙুল। চেষ্টা করল তার জীবন টেনে বেরে করে আনতে।

মরিয়া হয়ে ছুরি ধরা হাতে হেঁচকা টান মারলো ডেভিড। বুঝতে পারল কাজ হয়েছে। কেননা আক্কারস এখন মনোযোগ দিয়েছে ওর গলা চেপে ধরার কাজে।

ডেভিডের কাঁধের পাশেই খোলা উইন্ডস্ক্রীন দেখা যাচ্ছে। কাঁচ ভেঙ্গে গেছে আগেই। কিন্তু ধাতব খাঁচার মতো চারপাশ রয়ে গেছে। দেখতে লাগছে ভয়ঙ্কর করাতের মতো।

গলার মাঝে আঙুলের চাপ বাড়ছে অনুভব করল ডেভিড। চেষ্টা করছে। ব্রেইনে যাওয়া ধমনীকে ভেঙ্গে ফেলতে। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। মনে হলো ডগ ফাইটে এইট জির সাথে লড়ছে সে।

শেষ চেষ্টা স্বরূপ ভাঙা কাঁচের গায়ে ধাক্কা দিলো ডেভিড ছুরি ধরা হাতকে। নিচে নামিয়ে টেনে নিল কাঁচের ভাঙা কিনারের দিকে।

চিৎকার করে ডেভিডের গলা ছেড়ে দিল আক্কারস। আগে-পিছে করে হাত চেপে ধরল ডেভিড ভাঙা কাঁচের উপর। ছেঁড়া গোলাপ পাপড়ির মতো ক্ষত তৈরি হতে লাগল মাংস কেটে। আঙুল থেকে খসে পড়ল ছুরি। মেয়েদের মতো নাকিকান্না জুড়ে দিল আক্কারস।

ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল ডেভিড। হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়েও কান্না করে যেতে লাগল আক্কারস। নিজের গলায় হাত বুলিয়ে নিল ডেভিড। নিঃশ্বাস নিয়ে অনুভব করল ব্রেইনে পৌঁছালো তাজা রক্ত।

ঈশ্বর জেসাস, আমি মারা যাচ্ছি, রক্ত পড়েই মারা যাবো আমি। ওহ, সুইট জেসাস, আমাকে সাহায্য করো!’ চিৎকার করে উঠল আক্কারস। পেটের কাছে ধরে রাখল আহত হাত। সাহায্য করো, ওহ ঈশ্বর, আমাকে মরতে দিও না। আমাকে বাঁচাও জেসাস, আমাকে বাঁচাও।

বন্যার মতো রক্ত বইছে হাত থেকে। ভিজে গেল ট্রাউজারের সামনের অংশ। চিৎকারের সাথে মুখ থেকে খসে পড়ল নকল দাঁত। চকচকে মুখের মাঝে দেখাচ্ছে কালো গন্ধের মতো। তুমি আমাকে মেরে ফেলেছে। আমি রক্ত পড়ে মারা যাচ্ছি!’ ডেভিডের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। ‘আমাকে বাঁচাও আমাকে মরতে দিও না।’

ট্রাক থেকে উঠে দাঁড়ালো ডেভিড। দুই কদম দৌড়ে গেল আক্কারসের কাছে। এরপর ডান পা ঘুরিয়ে সারা শরীরের শক্তি দিয়ে লাথি মারলো আক্কারসের চিবুকের নিচে। মাথা ঝুলে গেল পিছন দিকে লোকটার।

পিছনের দিকে পড়ে গিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে রইল আক্কারস। উঠে দাঁড়িয়ে শ্বাস টানলো ডেভিড।

.

রায় ঘোষণার জন্যে সুপ্রিম কোর্টের মি: জ্যাস্টিস বার্নাড প্রাক্তন চারটা ব্যাপার মাথায় রাখালো–এর মাঝে দু’টি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায়, একটি দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় প্রাণহরণ ও চতুর্থটি ইচ্ছেকৃত ভাবে শারীরিক ক্ষতি।

জোহান আক্কাসকে বন্যাপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হলো। এই কারণে জরিমানার ব্যবস্থা না রেখেই তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। কেননা এ কাজে মোটর ভেহিকেল আর গোলা-বারুদও ব্যবহার করেছে সে।

ইচ্ছেকৃতভাবে আক্রমণের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে তিন বছরের আরো সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তি পেল সে।

শারীরিক ক্ষতি করার অপরাধে অভিযুক্ত জোহান আক্কাসকে পাঁচ বছরের কারাবাসের শাস্তি দেয়া হলো।

সবশেষে খুনের দায়ে অপরাধী জোহান আক্কারসকে জাস্টিস বার্নাড খোলা কোর্টরুমে সবার সামনে শাস্তি প্রদান করলেন:

‘এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা উচিত হলেও একটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়েছে যে হতভাগ্য লোকটা ফাঁদে আটকা পড়া পশুর ন্যায় আচরণ করে ছিল।

এক্ষেত্রে দণ্ড হলো আঠারো বছরের কারাবাস আর সব শাস্তিই একের পর এক ভোগ করতে হবে তাকে।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্লাস্টার করা পা আর এক হাতে ওল্ড বাক জিনের গ্লাস নিয়ে কনরাড বার্গ জানাল, যাই হোক আগামী আটাশ বছর এই বাঞ্চোতকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না আমাদের। আমি ক্ষমা চাইছি মিসেস মরগ্যান। উনত্রিশ বছর, প্রিয়তম আমার, দৃঢ় কণ্ঠে তাকে শুধরে দিল জেন কনরাড বার্গ।

.

জুলাই মাসে আ প্লেস অব আওয়ার ওন-এর আমেরিকা সংস্করণ প্রকাশিত হলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় অন্যান্য অনেক ভালো বইয়ের মতোই হারিয়েও গেল। কেউ কোন উচ্চবাচ্য করল না। একটুও সাড়া পেল না ডেবরা।

ববি ডুগান, আমেরিকাতে ডেবরার লিটারির এজেন্ট জানাল সে কতটা দুঃখিত, কতটা হতাশ। আশা করেছিল অন্তত সমালোচকরা কিছু লিখবে।

ব্যক্তিগত ভাবে অপমানিত বোধ করল ডেভিড। সপ্তাহখানেক ধরে নিজের ঘরে রেগেমেগে ঘুরে বেড়ালো সে। এক পর্যায়ে তো মনে হলো যে আমেরিকাতে গিয়ে হয়তো দেশটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে–একক ভাবে ভিয়েতনাম হয়ে উঠবে সে।

‘এগুলো গাধার দল ছাড়া আর কিছু নয়। প্রতিবাদ করে উঠল সে। এরকম সুন্দর বই আর কখনো লেখা হয়নি।’ ‘ওহ ডেভিড!’ নরম স্বরে বোঝাতে লাগল ডেবরা।

“হুম, এটাই সত্যি! আমার ইচ্ছে করছে সেখানে গিয়ে বই দিয়ে তাদের নাক ঘষে দিতে।

ডেবরা কল্পনাতে দেখতে পেল যে নিউইয়র্কের সব প্রকাশকের দরজা হাট করে খুলে গেল। আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল সকলে। উঁচু দালানের জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হলো বা ডেভিডের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে পালালো মেয়েদের টয়লেটে।

‘ডেভিড মাই ডার্লিং, তুমি আমার কাছে অনেক সুন্দর। খুশিতে খিকখিক করে হেসে উঠল ডেবরা। কিন্তু সে ও আঘাত পেয়েছে। সত্যি অনেক আঘাত পেয়েছে। ভেতরে মনে হলো দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ইচ্ছে করছে কিছু একটা গরম গরম লিখতে।

নিজেরে ডেস্কে ঠোঁটের কাছে মাইক্রোফোন নিয়ে বসল ডেবরা। শব্দগুলো জুড়িয়ে গেল না। চিন্তাগুলো একে অন্যের সাথে হারিয়ে গেল না। আগে যেখানে মনে হতো সব কিছুই চোখের সামনে ঘটতে দেখছে সে। দেখছে তার চরিত্রগুলো হাসছে, কাঁদছে, গান গাইছে। এখন সেখানে সেখানে শুধু কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে তার চোখে। বর্ণহীন আকারহীন।

মাঝে মাঝে ঘণ্টার পর পর ঘণ্টা এমনিই ডেস্কে বসে কাটিয়ে দেয় ডেবরা। চুপচাপ বসে শুনতে থাকে জানালার নিচে পাখির ডাক।

ওর হতাশা বুঝতে পারল ডেভিড। চেষ্টা করল ডেবরাকে সাহায্য করতে। ডেস্কে বসে কিছু না করার চেয়ে ডেভিড চাইল ডেবরা উঠে যাক সেখান থেকে। ডেবরাকে নিয়ে নতুন বেড়ার ধারে বেড়াতে যেতে চাইল সে। অথবা বলল পুলে বড় নীল মোজাম্বিক মাছ ধরতে যেতে।

এতদিনে বাসা আর এর আশে-পাশের পুরো পরিবেশ মুখস্ত হয়ে গেছে ডেবরার। ডেভিড চাইল ডেবরার পৃথিবী যেন আরো বড় হয়। প্রতিদিন একসাথে হেঁটে পুল পর্যন্ত বেড়াতে যায় তারা। ফলে এ রাস্তাটুকুও চিনে নিতে শুরু করল ডেবরা। ডেভিডের তৈরি করে দেয়া ওয়াকিং ষ্টিক নিয়ে হেঁটে হেঁটে সব চিনে নিতে লাগল ডেবরা। এ কাজে নিজের কর্তব্য ঠিক করে নিল জুলু। ডেভিডের পরিকল্পনা মতো জুলুর গলায় বেঁধে দেয়া হলো রুপালি ঘণ্টা। ফলে ডেবরা সেই শব্দ শুনে সহজেই অনুসরণ করে চলল। কয়েকদিনের মাঝেই ডেভিডকে ছাড়াই বের হওয়া শুরু করল ডেবরা। জুলুকেও তেমন বলতো না কোথা ও যেতে চায়। এভাবে নিজের পরীক্ষা নিজেই নিতে লাগল ডেবরা।

ডেভিড এ সময় ব্যস্ত রইল কনরাডের গেমফেন্স ঠিক করার কাজে। এখনো পা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে বেচারা। এছাড়া জাবুলানির অন্য তিন পাশেও বেড়া দেবার কাজ করতে হচ্ছে তাকে। এর সাথে আবার আফ্রিকার রেঞ্জার বাহিনীও চাপ দিচ্ছে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজে সাহায্য করার জন্য। তাদের জন্যে বিশেষ ভাবে ইউনিফর্মের নকশা করেছে ডেভিড। এছাড়াও এস্টেটে ঢোকার সবগুলো প্রবেশপথে অডিট পোস্ট বানিয়েছে রেঞ্জারদের জন্যে। এসব কাজে কনরাড বার্গের সাথে পরামর্শ করে নেবার জন্য নিয়মিত নেলস্প্রুটে যায় ডেভিড। তার পরামর্শ মতো এস্টেটে ওয়াটার সার্ভে করা শুরু করল ডেভিড। পুল থেকে দুরে থাকা অন্যান্য নদী বা খাল দিয়ে ভ্রমণ করে এলো ডেভিড। পরীক্ষা করে দেখল বাঁধ নির্মাণের বাস্তবতা। সক্রিয় কাজে ব্যস্ত থাকায় পরিশ্রমী কৃশকার আর রোদে পোড়া ত্বকের অধিকারী হয়ে উঠল ডেভিড। তারপরেও বেশির ভাগ ঘণ্টা কাটতো ডেবরার সাহচর্যে।

৩৫-এমএম রঙিন ছবি যেগুলো জোহান আক্কাস আক্রমণ করার আগেই তুলেছিল ডেভিড, সেই বাফেলো দলের ছবিগুলো এলো প্রিন্ট হয়ে। কিন্তু দেখা গেল যে একটাও মনমতো হলো না। বিশাল বাফেলোর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে দিগন্তের কাছে দাঁড়িয়ে আছে আর গায়ে থাকা অক্স-পেকারগুলোকে মনে হচ্ছে ছোট ছোট পোকা। হতাশায় মুষড়ে পড়ল ডেভিড। আবার নেলস্প্রুটে গিয়ে কিনে আনল ৬০০ এমএম টেলিস্কোপিক লেন্স।

যখন ডেবরা কাজ করতে বসে ডেস্কে, তার পাশে ক্যামেরা সেট করে দেয় ডেভিড। খোলা জানালা দিয়ে পাখির ছবি ভোলা হয়ে যায়। ফলাফল হলো মিশ্র। ছত্রিশটি ছবির মাঝে দেখা গেল পঁয়ত্রিশটি ফেলে দিতে হয়। কিন্তু একটা ছবি হয় অসাধারণ। ঠিক উড়ে যাবার ভঙ্গিতে ধরা পড়ল ধূসর পাখির ছবি। পাখা ছড়িয়ে উজ্জ্বল চোখে সূর্যের আলোয় চকচক করা পাখা নিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখিটা।

এ কাজে মনপ্রাণ ঢেলে দিল ডেভিড। আরো লেন্স, ক্যামেরা, ট্রাই-পড কিনে নিয়ে এলো। এরপর অভিযোগ করে উঠল ডেবরা। এই শখ পুরোপুরি দৃষ্টি শক্তির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এক্ষেত্রে সে অক্ষম।

ডেভিড চেষ্টা করল ডেবরাকে উৎসাহী করে তুলতে। লোক পাঠিয়ে জুন স্টানার্ডের বার্ড সং কিনে নিয়ে এলো। শুনে চমকিত হলো ডেবরা। মনোযোগ দিয়ে শুনল সে। পুরো মুখ ভেসে গেল আনন্দের বন্যায় যখন পরিচিত একটা আওয়াজ শুনতে পেল সে।

তখন থেকে শুরু করল নিজের মতো করে পাখির গান রেকর্ড করা। এর সাথে যুক্ত হলো জুলুর ঘণ্টার শব্দ, ডেভিডের ল্যান্ড রোভারের গুঞ্জন, রান্না ঘরের আঙিনাতে ভৃত্যদের চেঁচামেচি, আর খুব সূক্ষ্মভাবে চকচকে স্টালিংয়ের কিচিরমিচির।

‘একটুও ভালো হচ্ছে না।’ তিক্ততায় ভরে গেল ডেবরার মন। আমি বুঝতে পারছি না জুন কীভাবে এত পরিষ্কার ভাবে রেকর্ড করতে পেরেছে।’

কয়েকটা বইপত্র পড়ে ডেবরার জন্যে প্যারাবোলিক রিফেক্টর তৈরি করল ডেভিড। দেখতে ততটা সুন্দর না হলেও কাজ করল জিনিসটা। শব্দের উৎস রেকর্ড করে সাউন্ড ওয়েভকে মাইক্রোফোনে পাঠাল।

ডেবরার স্টাডি থেকে জানালার মাধ্যমে পুরো ব্যাপারটা আরো অভিযান সুলভ হয়ে উঠল। পুলের পাশে যেখানে পাখিরা পানি খেতে আসে, আরামদায়ক আর স্থায়ী হাইড আউট বানালো ডেভিড। রেঞ্জারদের এনে দেয়া তথ্যানুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বাসার কাছে ও গাছের ডালে বানানো হল এমন সব হাইড আউট। এসব জায়গায় একত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে লাগল ডেভিড আর ডেবরা। একসাথে বসে ছবি তোলা, রেকর্ড করা হয়ে উঠল নেশার মতো। এসব সময়ে এমনকি জুলুও শিখে গেল কীভাবে ঘণ্টার শব্দ না করে চুপচাপ করে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকতে হয়।

ধীরে ধীরে পেশাদারদের মতো দক্ষ লাইব্রেরি তৈরি হলো, যেখানে জমা হতে লাগল ছবি আর রেকর্ডি। অবশেষে সাহস করে এসব ছবি থেকে ডজনখানেক শ্ৰেষ্ঠ ছবি বাছাই করে পাঠিয়ে দিল আফ্রিকান ওয়াইল্ড লাইফ ম্যাগাজিনের কাছে। দুই সপ্তাহ পরে একশ ডলারের চেকসহ স্বীকৃতিপত্র এলো তার কাছে। এই অর্থ দেখা গেল যন্ত্রপাতির পেছনে ব্যয় হওয়া অর্থের বিশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। তারপরেও খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল ডেভিড। একই অবস্থা ডেবরার। ডিনারে দুই বোতল ভেভ ক্লিকোট পান করল দু’জনে। আর উত্তেজনা ও শ্যাম্পেনের বদৌলতে ঐ রাতে ভালোবাসা-বাসি পেল নতুন মাত্রা।

ওয়াইল্ড লাইফ’তে ডেবরার লেখাসহ ডেভিডের ছবি প্রকাশিত হবার পর অভাবনীয় সাড়া পেল দু’জনে। সারা পৃথিবীতে এ কাজে আগ্রহী এমন সব লোকজন চিঠি লেখা শুরু করল তাদেরকে। প্রকাশক নিজে অনুরোধ করল যেন জাবুলানির উপর ছবিসহ আর্টিকেল আর এ জায়গা নিয়ে মরগ্যানদের পরিকল্পনা লিখে পাঠানো হয়।

ডেভিডের ছবিতে মডেল হিসেবে কাজ করল ডেবরা। এছাড়া অনেক যত্ন করে বর্ণনা লেখা শুরু করল ডেবরা বিভিন্ন সমালোচনা আর নতুন ধারণা দিয়ে তাকে সাহায্য করল ডেভিড।

ডেবরার নতুন বইয়ের কাজ পড়ে রইল অনাদরে। কিন্তু নিজের দুঃখ ভুলে গিয়ে একসাথে কাজ করার আনন্দে মেতে উঠল সে।

অন্যান্য সংরক্ষণবাদীদের সাথে পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ হতে থাকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন বুদ্ধি পেতে লাগল তারা। আর মাঝে মাঝেই কনরাড বার্গ আর জেন বার্গের সাহচর্য পাওয়ায় মানব সংসর্গ থেকেও বঞ্চিত হলো না। এখনো পর্যন্ত বাইরের মানুষের সাথে মেশার ব্যাপারে যথেষ্ট সংবেদশীল তারা। এভাবে ব্যাপারটা এড়িয়ে চলাও সম্ভব হলো।

ওয়াইল্ড লাইফ আর্টিকেল প্রায় শেষ হয়ে গেল। পোস্ট করার জন্যেও প্রস্তুত। এমন সময়ে নিউইয়র্কের ববি ডুগানের কাছ থেকে পত্র এলো ডেবরার কাছে। কসমোপলিটন ম্যাগাজিনের প্রকাশক আ প্লেস অব আওয়ার ওন-এর কপি পড়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে নিজের ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশ করার জন্যে। এছাড়া সম্ভব হলে ডেবরার জীবনীও ছাপতে চায়। ববি চাইল ডেবরা যেন নিজের কিছু ছবি আর চার হাজার শব্দের মধ্যে আত্মজীবনী লিখে পাঠায়।

ছবি তৈরিই আছে। ওয়াইল্ড লাইফে যাবার জন্যে প্রস্তুত। তিন ঘন্টার মাঝে ঝড়ের বেগে চার হাজার শব্দ লিখে শেষ করল ডেবরা। সাহায্য করল ডেভিড।

একই সাথে টেপ, ছবি আর আর্টিকেল চলে গেল নিউইয়র্কে আর ওয়াইল্ড লাইফের জন্যে প্রায় মাসখানেক কেটে যাবার পরে কোথাও থেকে কোন খবর এলো না। এরপর এমন একটা ঘটনা ঘটল যে এ ব্যাপারে ভুলেই গেল তারা।

প্রধান পুলের কাছে লুকানোর জন্যে তৈরি কুঁড়েঘরে বসে আছে তারা। চুপচাপ বসে সন্ধ্যা হওয়া দেখছে। জানালার কাছে ট্রাইপ ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে ডেভিড। ছাদের উপর লাগানো আছে ডেবরার রিফ্লেক্টর। রং লাগিয়ে ছদ্মবেশের মাধ্যমে লুকিয়ে রাখা হয়েছে আর অপারেট করার জন্যে হ্যান্ডেল ডেবরার মাথার উপর।

ঠাণ্ডা, শান্ত আর কালো হয়ে আছে পানি। দূরের একটা তীরে মাথা তুলল একটা মাছ। পানির ধারে নেচে বেড়াচ্ছে কয়টা ঘুঘু। পানিতে চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে ঠোঁট তুলে গলা দিয়ে নামিয়ে নেয় পানি।

হঠাৎ করে ডেবরার হাতে চাপ দিয়ে সাবধান করল ডেভিড। ডেবরা বুঝতে পারল যে ডেভিড অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। তাই তাড়াতাড়ি ডেভিডের কাছে ঘেসে বসল ডেবরা, যেন ফিসফিসে বর্ণনা শুনতে পায়। ডান হাতে রেকর্ডার অন করল সে। এরপর রিফ্লেক্টরে হাত দিল।

আস্তে আস্তে পানি খেতে এগিয়ে আসছে লাজুক প্রকৃতির দুর্ভল নায়লা অ্যান্টিলোপ। কান দুটোর সাবধানী ভঙ্গিতে খাড়া হয়ে আছে। নাক টেনে বাতাসে গন্ধ শুকলো বিপদের আশঙ্কায়। হালকা আলোতে লণ্ঠনের মতো জ্বলছে বড়ঘন চোখজোড়া।

শিংবিহীন নয়জন স্ত্রী, গায়ের রং চেস্টনাটের মতো, সাদা ডোরাকাটা দাগ, সন্দেহ বাতিকগ্রস্তের মতো পা ফেলছে। অনুসরণ করছে শক্তিশালী পুরুষ দু’টির। এ দুটোকে দেখতে একদম আলাদা। কোন সাদৃশ্যই নেই। বেগুনি আর কালো রঙের মিশেল। কানের পাশ থেকে কেশর পর্যন্ত এবড়ো খেবড়ো। মোটা শিং, মাথা ক্রিম রঙা আর চোখ জোড়ার মাঝখানে উজ্জ্বল দাগ।

একবার মাত্র এক পা করে আগে বাড়ছে। এরপর থেমে চারপাশ দেখে নিচ্ছে। বিপদের চিহ্নের জন্যে সাবধান ভাবে আস্তে আস্তে নেমে এলো তীরে।

ডেভিডদের থেকে এত কাছ দিয়ে গেল যে ভয় পেলও। মনে হলো শাটার টেপার ক্লিক শব্দ শুনতে পেলেও হয়তো ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে।

বরফের মতো জমে গিয়ে বসে রইল সে আর ডেবরা। হরিণের দল গেল পানির কাছে। খুশিতে হেসে ফেলল ডেবরা। কেননা ওর রেকর্ডিংয়ে পুরুষ হরিণের পানি খাবার আগের শব্দটা স্পষ্ট ধরা পড়েছে। একই সাথে পানির কলকল আওয়াজ রেকর্ড হয়ে গেছে।

সবাই যখন একসাথে পানি খেতে নামল অনেক যত্ন করে ফোকাস করল ডেভিড। কিন্তু শাটারের ক্লিক শব্দ হতেই ওর পাশে থাকা পুরুষ হরিণটা ভয় পেয়ে এক দৌড় লাগল। সাথে সাথে পুরো দলটা ঘন গাছপালার মাঝে দিয়ে এমন ভাবে হাওয়া হয়ে গেল যেন ভূতে তাড়া করেছে।

‘আমি পেরেছি। আমি পেরেছি।’ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল ডেবরা। ওয়াও! এত কাছে এসেছিল যে মনে হচ্ছিল আমার কানের পর্দা ফেটে যাবে।

পুরো জাবুলানিতে ছড়িয়ে পড়ল এ উত্তেজনা। এর আগে এস্টেটে নালনা অ্যান্টিলোপ আর আসেনি। এমনকি ডেভিডের বাবার সময়েও নয়। তাই এ দলটা যাতে থেকে যাওয়ার উৎসাহ পায়, সে রকম বন্দোবস্ত করা হলো। পুলের কাছাকাছি সব রেঞ্জার আর ভৃত্যদের চলাচল নিষিদ্ধ করা হলো। যেন এখানে নিজের বসতি গড়ে তোলার আগেই ভয় পেয়ে চলে না যায় তারা।

কনরাড বার্গও পৌঁছে গেল খবর পেয়ে। এখনো হাঁটার সময় ওয়াকিং স্টিক ব্যবহার করে আর বেশ খানিকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। বাকি জীবন এভাবেই কাটাতে হবে বেচারাকে। ডেভিড আর ডেবরার সাথে হাইড আউটে বসে আরেকদিন দেখল অ্যান্টিলোপের দলটাকে। এরপর তাদের সাথেই ঘরে ফিরে ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে বীফ স্টেক আর ওল্ড বাক জিন খেতে খেতে নিজের মন্তব্য জানাল।

এরা পার্ক থেকে আসেনি। আমার যতদূর মনে হচ্ছে। আমি যদি আগে কখনো এই পুরুষ অ্যান্টিলোপকে দেখতাম আমি ঠিক চিনতে পারতাম– সম্ভবত আশেপাশের এস্টেট থেকে এসেছে। তুমি তো এখনো দক্ষিণ দিকে বেড়া দাওনি, তাই না?

না, এখনো না।’

“ঠিক আছে। এদিক থেকেই তারা এসেছে। মনে হয় টুরিস্টদের সামনে দর্শন দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখানে এসেছে শান্তির খোঁজে। চুমুক দিল জিনের গ্লাসে। তুমি এখানে ভাল জিনিসই জড়ো করেছো ডেভিআর কয়েক বছরের মাঝে এ জায়গা সত্যি দেখার মতো কিছু একটা হয়ে উঠবে। দর্শনার্থীদের জন্যে তোমার কোন প্ল্যান আছে–এই জায়গা থেকে তুমি অনেক কিছুই পাবে। যেমনটা আছে মালা-মালাতে। ইকোনমি প্রাইস দিয়ে পাঁচ তারকা সাফারি’ কনি, আমি বেশ স্বার্থপর, কেননা এ জায়গা আমি অন্য কারো সাথে সহভাগিতা করতে চাই না।’

সময় আর মনোযোগ অন্য কাজে লেগে যাওয়ায় আ প্লেস অব আওয়ার ওনের আমেরিকান ব্যর্থতার অংশটুকু ভুলে যাবার সুযোগ পেল ডেবরা। এক সকালে আবারো বসল নিজের ডেস্কে। কাজ শুরু করল দ্বিতীয় উপন্যাস নিয়ে। সেই সন্ধ্যাতেই ডেভিডকে বলল:

‘একটা সমস্যা হয়েছিল যে আমি কোন নাম খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যেন এটা একটা শিশু-নাম না দেয়া পর্যন্ত ব্যক্তি হিসেবে বোঝা যাবে না।’

‘এখন নাম পেয়েছ? জানতে চাইল ডেভিড।

‘হ্যাঁ।

বলবে আমাকে?

একটা দোনমোন করল ডেবরা। প্রথম বার কাউকে বলতে গিয়ে একটু লজ্জাও পেল। আমি ভাবছি “আ ব্রাইট অ্যান্ড হলি থিং” নামে ডাকবো। কিছুক্ষণ ভাবল ডেভিড। আস্তে করে নিজের মনে আউড়াল নামটা।

‘পছন্দ হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানাতে চাইল ডেবরা।

‘অসাধারণ। আমার পছন্দ হয়েছে। সত্যি।

আরো একবার ডেবরার সাথে উপন্যাসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ডেভিড। মনে হল দিনগুলি এত ছোট কেন। আরো একটু ভালোবাসা-বাসি, হাসাহাসি কাজকর্ম করতে মন চাইল দু’জনেরই।

সামনের বাগানে বারবিকিউ করতে বসেছে ডেভিড আর ডেবরা। এমন সময় ফোন বেজে উঠল।

‘মিস মোরদেসাই? অবাক হয়ে গেল ডেভিড। এ নামটা তো ততটা পরিচিত নয় এখানে।

‘হ্যাঁ। মিস ডেবরা মোরদেসাইয়ের সাথে ব্যক্তিগত ভাবে আলাপ করতে চান নিউইয়র্ক থেকে আগত একজন।’ অধৈর্য স্বরে বলে উঠল অপারেটর। তখনি ডেভিড বুঝতে পারল ব্যাপারটা। ও আসছে। ডেবরার নাম ধরে ডাকলো। ববি ভুগান ফোন করেছে। প্রথম বারের মতো লোকটার গলার স্বর শুনতে পেয়েছে ডেবরা।

‘ওয়ান্ডার গার্ল। ফোনের মাঝে চিৎকার করে উঠল ববি ডুগান। বসো যেন পড়ে না যাও। বিগ ড্যাডি এখন তোমাকে এমন সংবাদ জানাবে যে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। দুই সপ্তাহ আগে তোমার উপর আর্টিকেল প্রকাশ করেছে কসমোপলিটন। পুরো পৃষ্টজুড়ে তোমার ফটোগ্রাফ দিয়েছে ডার্লিং–গড়, তোমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে–’

নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসল ডেবরা। হাত ইশারা করে ডেভিডকে কাছে ডেকে বলল কান পেতে শুনতে।

‘শনিবারের সবকিছুকে হারিয়ে দিয়েছ তুমি। আর সোমবার সকালে বইয়ের দোকানগুলোতে দাঙ্গা লেগে গেছে। সবাই দরজা ভেঙ্গে ফেলতে চাইছিল। তুমি কল্পনা করতে পারছে ডার্লিং? মাত্র পাঁচ দিনে সতেরো হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। তুমি একলাফে নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার লিস্টের পাঁচ নম্বরে উঠে গেছ। এমন একটা অবস্থা যেন সবাই পাগলের মতো খুঁজছে তোমাকে। ডার্লিং আমরা এই বইয়ের হাফ মিলিয়ন কপি বিক্রি করতে যাচ্ছি। সব বড় বড় সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিন রিভিউ কপি চাইছে–তিন মাস আগে যে কপিগুলো পাঠিয়েছিলাম যেগুলো তারা হারিয়ে ফেলেছে। প্রতি দুই দিনে পঞ্চাশ হাজার করে কপি ছাপতে হচ্ছে। আর আমার কথা শুনে রাখো, ওরা যেন পাগল হয়ে গেছে–এটা শুধুমাত্র শুরু–পরের সপ্তাহে দেখবে ওয়েস্ট কোস্টে আগুন লেগে গেছে, সারা দেশ জুড়ে কপির জন্যে হাহাকার পড়ে যাবে। আরো অনেক কথা বলেই চলল ববি ভুগান। চিৎকার করে বলতে লাগল নিজের আশা আর পরিকল্পনার কথা। আর দুর্বলভাবে হেসে ডেবরা শুধু বলতে লাগল না। আমি এটা বিশ্বাস করি না। আর এটা সত্যি নয়।’

এই রাতে তিন বোতল ভেভ ক্লিকট খেয়ে ফেলল তারা। আর মধ্যরাতের খানিক আগে ডেভিড মরগ্যানের সন্তান গর্ভে ধারণ করল ডেবরা।

.

মিস মোরদেসাই ভাষার দক্ষ ব্যবহারের পাশাপাশি সাহিত্যের ছোঁয়া দিয়ে এই বইয়ের মাধ্যমে বেস্টসেলারের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছেন।’ মন্তব্য করল নিউইয়র্ক টাইমস।

‘কে বলেছে যে সাহিত্যকে নিষ্প্রাণ হতে হবে? জিজ্ঞেস করল টাইম ম্যাগাজিন। পরিষ্কার সাদা ধোয়ার মতো জ্বলে উঠেছে ডেবরা মোরদেসাইয়ের প্রতিভা।

‘মিস মোরদেসাই তোমার গলা টিপে ধরবে, দেয়ালের সাথে পিষে ফেলবে, মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলবে আর পশ্চাৎদেশে লাথি কষাবে। সে তোমাকে এত দুর্বল বানিয়ে ফেলবে যে তোমার মনে হবে তুমি গাড়ি দুর্ঘটনায় ছাতু হয়ে গেছ। যোগ করল ফ্রি প্রেস।

গর্বিত ভঙ্গিতে অটোগ্রাফসহ আ প্লেস অব আওয়ার ওন-এর একটি কপি কনরাড বার্গকে দিল ডেভিড। অবশেষে মিসেস মরগ্যান বলা ছেড়ে দিল কনরাড। তার বদলে ডেবরাকে নাম ধরে ডাকা শুরু করল। বই দেখে এতটাই আশ্চর্য হয়ে গেল যে তৎক্ষণাৎ বলে বসল।

‘এসব জিনিস আপনি কীভাবে ভেবেছেন, মিসেস মরগ্যান?’

‘ডেবরা’, তাকে শুধরে দিল ডেবরা।

‘সে ওগুলো চিন্তা করেনি। সাহায্য করল জেন বার্গ। এটা ওর কাছে আপনাতেই এসেছে–এর নাম inspiration. ববি ডুগান সত্যি কথাই বলেছে আর পঞ্চাশ হাজার কপি প্রকাশ করতে হল।

.

ঘটনা এমন হয়ে দাঁড়াল যে মনে হল ভাগ্যদেবী ডেভিড আর ডেবরার উপর নিজের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য উঠেপড়ে লাগল উপহার দিয়ে দু’জনকে ভরে দেবার জন্য।

নিজের জলপাই কাঠের টেবিলের কাছে বসে আছে ডেবরা। সন্তানের কল্যাণে দিনকে দিন ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে, আরো একবার শব্দের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল তার মনের মাঝে। যেন মুক্তোর ছড়ার ঝরনার পানি। যাই হোক এর পরেও ডেভিডকে পাখি নিয়ে করা তার বইয়ের কাজে সাহায্য করে চলল ডেবরা। এছাড়া প্রতিদিন জাবুলানির বিভিন্ন অংশে ডেভিডের সঙ্গী হওয়া তো ছিলই। এর সাথে আরো যুক্ত হলো শূন্য নার্সারিতে ফার্নিচার বসানো আর ভরে তোলার পরিকল্পনা।

গোপনে কনরাড বার্গ এসে ডেবরার সাহায্য নিতে লাগল যেন ডেভিড বোর্ড অব দ্য ন্যাশনাল পার্ক কমিটিতে মনোনয়ন পায়। সবিস্তারে আলোচনা করল দু’জনে। বোর্ডে একটা আসন মানে মানুষটা বেশ সম্মানীত হবে আর ডেভিডের চাইতেও বয়সে বড় আর প্রভাবশালী হবে। কিন্তু কনরাড এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী যে ডেভিডের সম্পদ আর নামের শেষে মরগ্যান পদবী, জাবুলানির মালিকানা, সংরক্ষণের প্রতি তার আগ্রহ আর এ সমস্ত কাজে যোগদানের জন্যে অফুরন্ত সময় দেখে নিশ্চয়ই বোর্ড সদস্যদের মন গলবে।

‘হা। সিদ্ধান্ত নিল ডেবরা। এটা ওর জন্যে ভালই হবে। আরো একটু বাইরে যাওয়া, বাইরের মানুষের সাথে মেশা, এখানে একা থাকলেই বরঞ্চ বিপদে পড়ব আমরা।’

করতে চাইবে সে?

‘চিন্তা করবেন না। এ ভার আমার উপর ছেড়ে দিন।

ডেবরার সিদ্ধান্তই সঠিক হয়েছে। বোর্ডের সাথে প্রথমবার সাক্ষাতের জড়তা কাটিয়ে ওঠার পর অন্যান্য সদস্যরাও যখন অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল এরকম অদ্ভুত বিভৎস চেহারা দেখতে আর বুঝতে পারল যে ডেভিড কতটা আন্তরিক আর উদ্যমী মানুষ, নিজের উপর আস্থা ফিরে পেল ডেভিড। এরপর প্রায়ই প্রিটোরিয়াতে বোর্ডের সাথে দেখা করতে লাগল সে। ওর সাথে উড়ে বেড়াত ডেবরা। আর বোর্ড মিটিংয়ের সময় জেন বার্গের সাথে ঘুরে ঘুরে সন্তান আর গৃহস্থালির আরাম আয়েশের সব কেনাকাটা সারতো। সাধারণত এসব জিনিস পাওয়া যেত না নেলটে।

কিন্তু নভেম্বর নাগাদ খারাপ লাগা শুরু করল ডেবরার। আর বেশ বড়সড় ভারী হয়ে গেল শরীর। বুঝতে পারলো নাভাজোর ককপিটে বসে লম্বা ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এমন সময়ে যখন-তখন বৃষ্টি হতে পারে বাতাসে ভরে উঠল মেঘের গুরুগুরু ডাক আর কালো মেঘে বেশির ভাগ সময় আচ্ছন্ন থাকে আকাশ। আর এরই মাঝে নিজের বইয়ের শেষ অংশ নিয়েও ব্যস্ত হয়ে গেল ডেবরা। আমি এখানে ভালোই থাকবো। ডেভিডকে আশ্বস্ত করল যে ‘আমার কাছে একটা টেলিফোন আছে, ছয়জন গেম রেঞ্জার, চারজন ভৃত্য আর ভয়ঙ্কর একটা হাউন্ডও আছে পাহারা দেবার জন্যে।

কিছুই মানতে চাইলো না ডেভিড। মিটিংয়ে যাবার আগে ঝগড়া করল পুরো পাঁচ দিন। অবশেষে রাজি হল।

‘আমি ভোর হবার আগেই বের হয়ে যাবো। নয়টার মাঝে মিটিংয়ে পৌঁছে যাবো। তিনটার ভেতরে আমাদের অধিবেশন শেষ হয়ে যাবে আর আমার এখানে ফিরে আসতে আসতে খুব বেশি হলে সাড়ে ছয়টা বাজবে।’ বিড়বিড় করল ডেভিড। আর যদি দেখি যে বাজেট তৈরি হয়নি, ফিনালশিয়াল অ্যাফেয়ারস ভোট দিয়েছে, তাহলে আমি অসুস্থ বলে চলে আসব।

‘এটা বেশি জরুরি, ডার্লিং। তুমি যাও।

‘তুমি ঠিক বলছো তো?’

‘আমি তো এমনকি বুঝতেও পারব না যে তুমি এখানে নেই।

‘এটা নিয়ে খুশি হয়ো না।’ ডেবরাকে জানালো ডেভিড। এমনো তো হতে পারে যে তোমাকে শাস্তি দেবার জন্যে থেকেও গেলাম।

সকালবেলা ওয়াইন রঙের বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। মাঝে মাঝে মনে হলো আকাশ ঢেকে গেল ধোয়ায়, কখনো মনে হল পাকা ফলের মতো টসটসে হল রং। ছোট্ট এয়ারক্রাফটটা এই জমকালো আবহাওয়ার হাতে পড়ে নাজেহাল হতে লাগল।

খোলা আকাশে একাই উড়ে বেড়াতে লাগল ডেভিড। আর নিজের মাঝে এই সান্ত্বনা ছিল যে আকাশে কখনো কিছু হয়নি তার। মাঝে মাঝেই কোর্স বদল করে পর্বত প্রমাণ সব মেঘমালা পার হল সে। এগুলোর মাঝে লুকিয়ে আছে মৃত্যু আর ধ্বংস। ঘূর্ণিবাতাস মেশিন থেকে পাখা খুলে নিয়ে যাবে। টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দিবে উপরে। এত উপরে অক্সিজেন ছাড়া একটা মানুষকে টিকে থাকার কোন আশাই থাকবে না।

গ্রান্ড সেন্ট্রালে ল্যান্ড করল সে। ভাড়া করা গাড়ি এখানে অপেক্ষা করছিল তার জন্য। সকালের সংবাদপত্র পড়তে পড়তে প্রিটোরিয়া পৌঁছালো ডেভিড। শুধুমাত্র তখন অস্বস্তি হতে লাগল যখন আবহাওয়ার পাতায় দেখতে পেল মোজাম্বিক চ্যানেল থেকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসছে একটি ঝড়।

কনফারেন্সরুমে ঢোকার আগে রিসিপসনিস্টকে বলল জাবুলানিতে ফোন লাগাতে।

‘দুই ঘণ্টা দেরি হবে, মি: মরগ্যান।

ঠিক আছে লাইন পাওয়া গেলেই জানাবে আমাকে।

লাঞ্চের সময় আবারো মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল।

আমার ফোনের কী হল?

‘আমি দুঃখিত মি: মরগ্যান। আমি আপনাকে জানাতেই যাচ্ছিলাম, লাইন নষ্ট হয়ে গেছে। নিচু জায়গাতে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে।

অস্পষ্ট অস্বস্তি বয়ে নিয়ে এলো মৃদু চিন্তা।

‘আবহাওয়া অফিসে ফোন করা যাবে?

আবহাওয়ার অবস্থা একেবারে বেহাল দশা বলা যায়। বাবারটন থেকে মপুভা মিলিয়া এবং লরেঙ্কো মারকুইস থেকে মাকাদোৰ্ডপ পর্যন্ত চলছে অবিরাম বৃষ্টিপাত। মাত্র বিশ হাজার ফুট উপরেই মেঘ। মনে হচ্ছে এখনি ভেঙ্গে পড়বে মাটিতে। নাভাজোতে কোন অক্সিজেন আর ইলেকট্রনিক নেভিগেশনাল যন্ত্রপাতি নেই।

‘কতক্ষণ পর্যন্ত আবহাওয়া অফিসে অফিসারের কাছে জানতে চাইল ডেভিড।

কতক্ষণ লাগবে পরিষ্কার হতে?

‘বলা কঠিন স্যার। দুই থেকে তিন দিন।

‘ধুত্তোরি! তিক্তভাবে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। দৌড় দিল গভর্নমেন্ট বিল্ডিংয়ের নিচতলায় থাকা ক্যান্টিনে। কোণায় একটা টেবিলে অন্য আরো দু’জন বোর্ড মেম্বারের সাথে বসে আছে কনরাড বার্গ। কিন্তু ডেভিডকে দেখার সাথে সাথেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে যত দ্রুত সম্ভব চলে এলো কাছে।

‘ডেভিড’, হাত ধরল কনরাড। গোলাকার লাল মুখটা বেশ সিরিয়াস দেখাচ্ছে। আমি এই মাত্র শুনলাম–গত রাতে জেল থেকে পালিয়েছে জোহান আক্কারস। একজন গার্ডকে খুন করে হাওয়া হয়ে গেছে। সতেরো ঘণ্টা হয়ে গেছে কোন পাত্তা নেই।

হাঁ করে তাকিয়ে রইল ডেভিড। এতটাই ধাক্কা খেয়েছে যে মুখে কথা ঝরছে না।

‘ডেবরা কী একা?’ জানতে চাইল কনরাড়। মাথা নাড়াল ডেভিড। ক্ষত বিক্ষত টিস্যু ঢাকা মুখটা শক্ত হয়ে আছে। কিন্তু চোখগুলোতে বাসা বেঁধেছে

তুমি এখনি চলে যাও।

আবহাওয়া–সব এয়ারক্রাফট কে নামিয়ে আনা হয়েছে।’

‘আমার ট্রাক নিয়ে যাও!’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল কনরাড।

এর চেয়েও দ্রুতগতির কিছু প্রয়োজন আমার।

“তুমি কি চাও আমিও আসি তোমার সাথে?

না, জানাল ডেভিড। আপনি আজ সন্ধ্যায় এখানে না থাকলে তারা নতুন বেড়ার জন্যে বরাদ্দ দেবে না। আমি একাই চলে যাবো।

.

ডেস্কে বসে কাজ করছে ডেবরা, এমন সময় বাতাসের শব্দ শুনতে পেল। টেপ রেকর্ডার বন্ধ করে বারান্দায় গেল। কাছে কাছে রইল কুকুরটা।

দাঁড়িয়ে গর্জন শুনল খানিকক্ষণ। বুঝতে পারল না কিসের আওয়াজ। কেমন যেন একটা শব্দ, মনে হল পাথুরে সমুদ্রতীরে আছড়ে পড়ছে ঢেউ।

কুকুরটা সরে এলো ডেবরার পায়ের কাছে। উবু হয়ে পাশে বসে কুকুরের গলায় হাত বুলাতে লাগল ডেবরা। শুনতে লাগল বাতাসের গর্জন। বুঝতে পারল ক্রমশ বাড়ছে। মারুল্লা বনে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ার শব্দ পাওয়া গেল।

নাক দিয়ে শব্দ শুরু করল জুলু। নিজের আরো কাছে টেনে নিল ডেবরা।

‘কিছু হবে না। এইতো এইতো’, ফিসফিস করল ডেবরা। সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাতাস। গাছের মাথা ভেঙ্গে পড়ার পটপট শব্দ পাওয়া গেল।

বারান্দায় পোকা-মাকড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য যে জাল লাগানো হয়েছিল তার উপর পড়ল এসে গাছের ভাঙা অংশ। মনে হলো নৌকার বড় পাল ছিঁড়ে পড়েছে। কামানের গোলার মতো ছিটকে গেল দরজা জানালার হুড়কো।

লাফ দিয়ে পিছন ফিরে নিজের কাজের রুমে ফিরে এল ডেবরা। জানালার পাল্লা বাড়ি খেতে লাগল এপাশ-ওপাশ ধুলা। ময়লা সব ঢুকে যেতে লাগল-এর মাঝ দিয়ে কাধ ঠেকিয়ে আটকে ফেলল ডেবরা জানালা। এরপর একই ভাবে দৌড়ে গিয়ে আটকালো আরো একটি জানালা। এর মাঝে দৌড়ে এলো ভৃত্য।

ম্যাডাম বৃষ্টি আসবে এখন। অনেক বৃষ্টি।

যাও, তোমার পরিবারের কাছে যাও।’ ভৃত্যকে জানাল ডেবরা।

‘ডিনার ম্যাডাম?’

‘চিন্তা করো না। আমি তৈরি করে নেব।’

কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ভূত্যের দল দৌড় লাগাল তাদের ঘরের দিকে।

পনের মিনিট ধরে স্থায়ী হল এই দমকা বাতাস। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল ডেবরা। বুঝতে পারল তার শরীর কাঁপছে। উত্তেজিত হয়ে হাসতে শুরু করল ডেবরা। ঝড়ের তাণ্ডব উপলব্ধি করে।

এরপর হঠাৎ করেই থেমে গেল বাতাস। যেভাবে হঠাৎ এসেছিল সেভাবে হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেল চারপাশ। শুনতে পেল পুলের উপর দিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেল বাতাসের গর্জন।

নিঃশব্দতার মাঝে মনে হল পুরো পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে যে কিছু একটা ঘটবে। ঠাণ্ডা লাগল ডেবরার, তাপমাত্রা হঠাৎ করে কমে গেল। মনে হল হঠাৎ করে বরফের বাক্স খুলে গেছে। কাঁপতে লাগল ডেবরা। কিন্তু দেখতে পেল না যে বিশাল বড় একটা কালো মেঘ অন্ধকার ছড়িয়ে দিল জাবুলানির উপর। কিন্তু তারপর কীভাবে যেন খানিকটা অনুভব করলো যে কী ঘটতে চলেছে।

প্রথম বিদ্যুৎ চমকের সাথে সাথে এত শব্দ হল যে ডেবরা নিজেও বুঝতে পারল না যে ও কাঁদতে শুরু করেছে। এত জোরে বাজ পড়ল যে মনে হল সারা আকাশ ভেঙ্গে চুড়ে পড়বে। পৃথিবীর ভূমিতল পর্যন্ত কেঁপে উঠল।

ঘুরে দাঁড়িয়ে আরো ভেতরের দিকে সরে যেতে চাইল ডেবরা। নিজের বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। কিন্তু বৃষ্টি আসার পর মনে হল দেয়ালের বাধাও মানতে চাইছে না পানির স্রোত। ড্রামের মতো শব্দ হতে লাগল চারপাশে। মনে হলো কানে তালা লেগে যাবে। জানালার কাঁচ ভেঙ্গে কাঠামো শব্দ করে বাড়ি ভেসে গেল পানিতে।

এত বৃষ্টির পরেও বজ্রপাতের কড়কড় শব্দে নার্ভাস বোধ করতে লাগল ডেবরা। প্রতিবার ভয়ে কেঁপে উঠতে লাগল ডেবরা। আর মনে হল সরাসরি ওর উপরই পড়তে লাগল বজ্রপাত।

নিজের বিছানার উপর গুটিসুটি মেরে বসে রইল সে। কাছে জড়িয়ে ধরল জুলুকে। মনে হলো ভূত্যদেরকে চলে যেতে বলাটা ঠিক হয়নি। মনে হল বোমার মতো বজ্রপাতের আঘাতে কিছু একটা হয়ে যাবে ওর।

অবশেষে আর ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। লিভিংরুমের দিকে পা বাড়ালো। অবস্থা এমন হলো যে, মনে হলো নিজের রুমের পথঘাট ভুলে গেছে সে, তারপরও টেলিফোন হাতে পেয়ে কানের কাছে তুলল।

সাথে সাথে বুঝতে পারল ফোন ডেড হয়ে আছে। কোন শব্দ নেই। তারপরেও পাগলের মতো ডায়াল করতে লাগল। কিন্তু শেষমেশ বাধ্য হলো ছেড়ে দিতে। তারের সাথে ঝুলতে লাগল রিসিভার।

নিজের কাজের রুমে ফিরে আসতে আসতে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগল ডেবরা। নিজের পেটে হাত বুলিয়ে অনুভব করল সন্তানের উপস্থিতি। বিছানার উপর ধপ করে বসে দুই হাতে কান ঢাকালো। বন্ধ করো চিৎকার করে উঠল ডেবরা। বন্ধ করো। ওহ, প্লিজ গড়, বন্ধ কর।

.

নতুন তৈরি করা ন্যাশনাল হাইওয়ে যেটা কয়লার খনির শহর উইটবাঙ্ক পর্যন্ত গেছে, বেশ চওড়া আর মসৃণ। ছয় লেন ধরে গাড়ি-ঘোড়া চলছে। প্রথম লেনে ভাড়া করা পন্টিয়াক চালাতে লাগল ডেভিড। পা শক্ত করে চেপে বসে রইল। ঘন্টায় একশ ত্রিশ মাইল বেগে চলতে লাগল গাড়ি। রাস্তার উপর এতটাই স্বচ্ছন্দে চলতে লাগল গাড়ি যে মনে হলো ড্রাইভ না করলেও চলবে। মনের মাঝে সব ভয়ের কাহিনী ভাসতে লাগল। মনে পড়ে গেল কোর্ট রুমে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কেমন শীতল চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল জোহান আক্কারস। গভীরে কোটরে বসা কাদার মতো চোখ, মুখ খোলা মানে হল এখনি থুথু মেরে বসবে। ওয়ার্ডার এসে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে জেলেখানায় নিয়ে যাবার সময় পিছন ফিরে চিৎকার করেছিল আক্কারস, ‘আমি তোকে দেখে নিব। এর জন্যে যদি উনত্রিশ বছরও লেগে যায় আমি অপেক্ষা করব।’ এরপর জেলে কক্ষে ঢুকিয়ে দেয়া হল আক্কাসকে।

উইটবাঙ্কের পর রাস্তা হয়ে গেল সরু। গাড়িতে গাড়িতে ভিড় জমে গেছে। আর প্রতিটি মোড় হয়ে উঠল বিপজ্জনক। ডেভিড মনোযোগ দিল রাস্তার উপর। জোর করে মন থেকে তাড়িয়ে দিল জনের ভুতকে।

লিনডেনবার্গে টার্ন নেয়ার পর চারপাশে গাড়ির সংখ্যা কমে গেল। মাঝে মাঝে একটা দুটো ট্রাক। আবারো গতির ঝড় তুলে এগোতে লাগল গাড়ি। এরপর হঠাৎ করে রাস্তা আবার মোড় নিয়ে নিচু ভূমিতে চলা শুরু করল।

ইরাসমাস টানেল থেকে বের হবার পর বৃষ্টির দেখা পেল ডেভিড। বাতাসে ভরে আছে কালো মেঘ। রাস্তা ভেসে যাচ্ছে পানিতে। ফলে গতি কমাতে বাধ্য হলো পিচ্ছিল রাস্তায় ডেভিড। উইন্ডশীল্ড পর্যন্ত পানির ধারা মুছে শেষ করতে পারছে না।

নিজের গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে নিল ডেভিড। এর ভেতরেও যত জোরে সম্ভব ছুটতে লাগল। নিজের সীটের উপর বসে গলা বাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে রইল বৃষ্টি ভেদ করে দেখতে পাবার আশায়।

বৃষ্টির কারণে সন্ধ্যা এলো তাড়াতাড়ি। ভেজা রাস্তায় নিজের হেডলাইটের প্রতিবিম্ব মনে হল চোখ ধাধিয়ে দেবে। আর বৃষ্টির ফোঁটা মনে হল পাথরের মতো সশব্দে আড়ছে পড়তে লাগল। বাধ্য হলো গতি আরো খানিকটা কমাতে। সামনের রাস্তা চলে গেছে ব্যান্ডেলিয়ার হিলের দিকে।

অন্ধকারের কারণে আরেকটুকু হলেই মিস করে যেত মোড়। গাড়ি ঘুরিয়ে আবারো ফিরে এলো সে।

কাদামাটিতে পুরো রাস্তা ভরে গেছে। আবারো গতি কমাতে বাধ্য হলো সে। একবার তো ভুল করে চাকা হড়কে পাশের নালার মাঝেই পড়ে যাচ্ছিল আরেকটুকু হলে। এরপর চাকার নিচে আলগা পাথর বসিয়ে ইঞ্জিন চালিয়ে কোনমতে পার হলো এ রাস্তা।

লুজান স্টিমের ব্রিজের উপর যখন পৌঁছালো তখন ছয় ঘণ্টা হয়ে গেছে যে সে একনাগাড়ে বসে আছে পন্টিয়াকের হুইলের উপর। ঘড়িতে তখন আটটা বেজে আরো কয়েক মিনিট।

ব্রিজে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হঠাৎ করেই আবার থেমে গেল বৃষ্টি। আবহাওয়া মনে হলো খেলা করতে লাগল তাকে নিয়ে। মাথার উপরেই দেখা গেল তারাদের মিটমিটে রহস্যময় আলো। চারপাশে অলস ভাবে ভাসছে কয়েক টুকরো মেঘ।

অন্ধকার চিরে দিল ডেভিডের হেডলাইট। দূরে একশ গজ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার ভাবে। পনের ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে ব্রিজ। পানির স্রোত এত বেশি যে নিচের পাথরগুলো দেখা যাচ্ছে চকচক করছে। এর সাথে সাথে ভাসছে উপড়ে যাওয়া গাছের গুঁড়ি।

এখনকার অবস্থা দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে এখানেই নদীবক্ষে বালির উপর দিয়ে সবুজ ফোর্ড নিয়ে জোহান আক্কারস তাড়া করেছিল কনরাড বার্গকে।

পন্টিয়াক থেকে নেমে পানির কিনারে গিয়ে দাঁড়াল ডেভিড। দাঁড়াতেই বুঝলে পারল যে পানি আরো বাড়বে।

চোখ তুলে তাকাল আকাশের দিকে। হিসাব কষে দেখল।

সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল তৎক্ষণাৎ। দৌড়ে গেল পন্টিয়াকের দিকে। রিভার্স করে যতদূর যাওয়া যায় গেল। হেডলাইট এখনো নদীর কিনারে আলো ফেলছে। এরপর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে শার্ট খুলে ফেলল। ট্রাউজার থেকে বেল্ট খুলে নিয়ে কোমরে পেঁচালো। জুতা জোড়া বেল্টের সাথে বেঁধে নিল।

খালি পায়ে দৌড়ে গেল পানির কিনারে। বুঝতে পারল নদীতীরে পা পিছলে যাচ্ছে। আরো কয়েক কদম এগিয়ে হাঁটু পানিতে যেতেই স্রোত ভাসিয়ে নিল তাকে। সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে ঠিক দিকে ধরে রাখল ডেভিড।

এভাবেই খানিক দাঁড়িয়ে রইল সে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল একটা গাছের গুঁড়ি আসছে ভেসে ভেসে। শাখা-প্রশাখা এমন ভাবে ছড়িয়ে আছে যে শিকড় দেখে মনে হচ্ছে গাছের হাত-পা। এখনি পার হয়ে যাবে তার কাছে দিয়ে।

সময় হিসেবে করে ঝাঁপ দিল ডেভিড। অর্ধডজন শক্তিশালী স্টোক তাকে পৌঁছে দিল গুঁড়িটার কাছে। সাঁতার কেটে ধরে ফেলল একটা শিকড়। তৎক্ষণাৎ হেডলাইটের আলো থেকে ভয়ঙ্কর স্রোতশীল নদীর বুকে পড়ল সে। গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে একবার ডুবে, একবার ভেসে কাশতে কাশতে এগিয়ে চলতে লাগল ডেভিড, একের সময় মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে।

হঠাৎ করেই কিছু একটা খোঁচা মারলো তাকে। কোমরের বেল্টের সাথে পেঁচানো শার্ট ছিঁড়ে চামড়াও কেটে গেল। আবারো পানিতে ডুবে গেল সে। তারপরেও ছাড়লো না গাছের গুঁড়ি।

চারপাশে অন্ধকারের মাঝে শুধু পানির বয়ে চলার শব্দই পাওয়া যাচ্ছে। এর শক্তির কাছে নিঃশেষ হয়ে যেতে লাগল ডেভিড। হাত-পা ছুঁড়ে জ্বালা করতে লাগল পাথরের টুকরা গাছের ভাঙা অংশের আঘাতে।

হঠাৎ করেই মনে হলো কোন কিছুর গায়ে আটকে গেছে গাছের গুঁড়ি। কেমন করে আবারো ছাড়া পেয়ে আবারো স্রোতে ভেসে যেতে লাগল।

কাদা জল চোখে গিয়ে মনে হলো অন্ধ হয় গেছে সে। জানে যে এভাবে বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। বুঝতে পারল মাথা কাজ করছে না। শরীর চলতে চাইছে না। মনে হলো কোন দৌড় প্রতিযোগিতায় দশম রাউন্ড শেষ করেছে সে।

বহুকষ্টে কাছাকাছি তীরের কাছে গিয়ে ঝাঁপ দিল ডেভিড। হাত থেকে সরে গেল গাছের গুঁড়ি। টান দিয়ে ধরল একটা কাটা গাছ। সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ধরে উঠে এলো পাড়ে। হাতের তালু ছিঁড়ে গেল ছাঁটার খোঁচায়। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল ডেভিড। তারপরেও ছাড়ল না। আস্তে আস্তে পানি থেকে উঠল হামাগুড়ি দিয়ে। কাশতে কাশতে ফুসফুস থেকে উগড়ে দিল পানি। নদীর তীরে কাদার উপর মুখ দিয়ে পড়ে গেল। বমির তোড়ে ভিজে গেল নাক মুখ।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল সে। কাশি থামলে পর ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে লাগল স্বাভাবিক ভাবে। স্রোতের টানে জুতো খুলে গেছে বেল্ট থেকে। হারিয়ে গেছে নদীতে। বহুকষ্টে পা টেনে টেনে অন্ধকারে উঠে হাঁটতে লাগল ডেভিড। একটু পরেই দৌড়াতে শুরু করল। মুখের সামনে হাত এনে তালু থেকে দাঁত দিয়ে টেনে টেনে বের করে ফেলতে লাগল কাটার ভাঙা অংশ।

মাথার উপরে এখনো আলো ছড়াচ্ছে তারার দল। এই আলোতে রাস্তা দেখে এগোতে লাগল ডেভিড। প্রতি কদমের সাথে আরো জোরে দৌড়াতে লাগল। চারপাশ একেবারে চুপচাপ। মাঝে মাঝে নীরবতা ভঙ্গ করছে গাছের পাতা থেকে ঝড়ে পড়া পানির ফোঁটা বা বহুদূর থেকে ভেসে আসা বিদ্যুৎ চমকের শব্দ।

বাসা থেকে দুই-মাইল দূরে রাস্তার পাশে কিছু একটা গাঢ় ছায়া দেখল ডেভিড। এর কাছ থেকে কয়েক কদম দূরে থাকতেই বুঝতে পারল যে, এটা একটা গাড়ি বহু পুরাতন শেভি। এখানে এমনিই পড়ে আছে গাড়িটা, নিশ্চয় কোন একটা মাটি-কাদার গর্তে ছিল। বৃষ্টি এসে গর্তের মুখ ধুয়ে দেয়ায় এখন দেখা যাচ্ছে।

দরজা খোলা। ভেতরের আর পার্কিং লাইট জ্বালালে ডেভিড। সিটের উপর পড়ে আছে শুকনো রক্ত। গাঢ় রং। পিছনের সিটে কাপড়ের বান্ডেল। তাড়াতাড়ি খুলে ফেলল সে। তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল জেলেখানার কয়েদীর পোশাক এটা। বোকার মতো খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। এরপর যেন মাথার উপর বাজ পড়ল।

চুরি করা হয়েছে গাড়িটা। রক্ত সম্ভবত দুর্ভাগা মালিকের শরীরের। কয়েদীর পোশাক বদল করা হয়েছে এখানে। সম্ভবত শেভির মালিকের পোশাকের সাথে।

জোহান আক্কারস এখন জাবুলানীতে, এ ব্যাপারে আর কোন সন্দেহই রইল না। যখন এসেছে তখন নিশ্চয়ই লুজান স্ট্রিমের ব্রিজ ঠিক ছিল। না হয় এ গাড়িটা এখানে থাকতো না–তার মানে তিন থেকে চার ঘণ্টা পার হয়ে গেছে এর মাঝে।

গাড়ির পিছনে কয়েদীর পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দৌড় লাগাল ডেভিড।

.

জোহান আক্কারস শেভি নিয়ে পৌঁছে গেল লুজান স্ট্রিমের কাছে। পানি তখনো ততটা বাড়েনি। গাড়ির গায়ে লেগে আছে কাদা-পানি। স্টিয়ারিং ঘুরতে চাইছে না। দরজার নিচ দিয়ে আক্কারসের পায়ে লাগছে পানি। কিন্তু তারপরে নিরাপদে পৌঁছালো সে অপর তীরে। নরম মাটিতে ঘুরতে লাগল চাকা। স্কিড করতে লাগল শেভি। জাবুলানি যত কাছে এগিয়ে আসছে ততই মনে হলো অধৈর্য হয়ে উঠল সে। জেলে যাবার আগে আক্কারস ছিল ধীরস্থির স্বভাবের মানুষ। নিজের ইন্দ্রিয়ের উপর পূর্ণ দখল তার।

কিন্তু গত দুই বছরে জেলখানার পরিশ্রম আর প্রতিশোধের আগুন এখন সহ্যের শেষ সীমায় নিয়ে এসেছে তাকে।

বেঁচে থাকার একমাত্র কারণই হচ্ছে প্রতিশোধ নেয়া। প্রতিদিন না হলেও শত বার ব্যাপরটা আগা-গোড়া প্রতিটি অংশ রিহার্সাল করেছে সে। এমনভাবে পরিকল্পনা করেছে যেন জেল ভেঙ্গে তিনদিনের জন্যে মুক্তিলাভই যথেষ্ট হয়। এর মাঝেই যা করার করে ফেলবে সে। তারপর যা হয় হোক।

নিজের চোয়ালে নিজেই ব্যথা সৃষ্টি করেছে সে। দূষিত সুইয়ের খোঁচা দিয়ে পচন ধরিয়েছে। তারপর তার পরিকল্পনা মতো তাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গার্ডকে কাবু করতে কোন বেগ পেতে হয়নি। আর গলায় স্কালপেল ধরতেই ডেন্টিস্টও সাহায্য করতে দ্বিধা করেনি।

জেলখানা থেকে বের হবার সাথে সাথেই স্কালপেলটা ব্যবহার করেছে আক্কারস। অবাক হয়ে গেছে দেখে যে একটা মানুষের গলার শিরা দিয়ে কতটা রক্ত চলাচল করে। ময়লা ফেলার একটা জায়গাতে নিজের গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের উপর ফেলে এসেছে ডেন্টিস্টের মৃতদেহ। নিজের কয়েদীর পোশাকের উপর চাপিয়েছে সাদা গাউন। এরপর অপেক্ষা করছে ট্রাফিকের লাইটের জন্য।

লাল আলো দেখে থেমে গিয়েছিল চকচকে নতুন শেভি গাড়িটা। আক্কারস প্যাসেঞ্জার ডোর খুলেই গিয়ে বসল ড্রাইভারের গা ঘেঁষে।

লোকটা উচ্চতাতে আক্কারসের চেয়ে খাটো, মাংসল, সুখী-সুখী চেহারা, মসৃণ ত্বক, স্টিয়ারিং হুইল রাখা ছোট ছোট হাতে তেমন পশম নেই। আক্কারসের আদেশ হাসিমুখে মেনে নিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল।

তুলতুলে সাদা শরীরের কাছে গড়িয়ে গেল আক্কারস। একটু পরেই তেমন ব্যবহার করা হয় না এমন একটা রাস্তায় ফেলে দিল মৃতদেহ। এরপর মাত্র চল্লিশ মিনিটের মাথায় শহরের বাইরের প্রথম রোড ব্লকে চলে এলো।

পাশের রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে এগিয়ে এলো। চোয়ালে ইনফেকশনের ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ডেন্টিস্ট অবশ্য অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। গিয়ার লিভারের উপর তেমন কাজ করতে পারছে না অর্থব একটা হাত। ছিঁড়ে যাওয়া পেশী আর নার্ভগুলো আর জোড়া লাগেনি। মৃতের মতো হয়ে গেল হাতটা, নির্জীব।

প্রাকৃতিক ভাবেই একজন শিকারি সে। তার উপর রেডিওতে প্রচারিত হওয়া আবহাওয়ার সংবাদ শুনে মনে হচ্ছে ভাগ্য তার সহায় আছে। এখন জাবুলানিতে পৌঁছে আর তর সইছে না তাই।

চল্লিশ মাইল গতিতে কাদার গর্তে পড়ে গেল শেভি। পড়ে ঘুরতে লাগল চাকা। পেছন দিক কাদার গভীরে দেবে গেল।

সেখানেই গাড়িটাকে রেখে দিল আক্কারস। বৃষ্টি মাথায় হাঁটা শুরু করল যত দ্রুত সম্ভব। একবার মনে হল ঠাণ্ডায় দাঁতে দাঁত বাড়ি খেল। তারপর আবারো নিঃশব্দে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোতে লাগল।

জাবুলানিতে বাসার পেছনের কোপজেতে সে পৌঁছালো ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। এরপর দুই ঘণ্টা চুপচাপ বসে বৃষ্টি দেখল, অপেক্ষা করল রাত নামার জন্য। রাত নামার পর অবশ্য একটু চিন্তায় পড়ে গেল কোথাও আলো জ্বলছে না, এতক্ষণে আলো জ্বেলে দেবার কথা।

কোপজে ছেড়ে সাবধানে পাহাড়ের নিচে এগোতে লাগল। আস্তে করে পার হয়ে গেল ভৃত্যদের কোয়ার্টার, গাছের ফাঁক দিয়ে পৌঁছে গেল ল্যান্ডিং স্ট্রিপে।

হ্যাঙ্গারের পাশের দেয়াল অনুসরণ করে দরজার কাছে পৌঁছাল।

উন্মাদের মতো হাত বাড়িয়ে খুঁজতে লাগল এয়ারক্রাফটকে, যেটা সেখানে থাকার কথা। যখন বুঝতে পারল যে এটা নেই, হতাশায় মুষড়ে পড়ল সে।

তারা চলে গেছে। এত কষ্ট, এত পরিকল্পনা, এত প্রচেষ্টা সব মাঠে মারা গেল।

জন্তুর মতো গর্জন করে সুস্থ হাতের মুঠি পাকিয়ে দেয়ালে মারলো আক্কারস। হতাশার চোটে ব্যথাও খারাপ লাগল না। এতটাই ঘৃণা তার আর এতটাই রেগে উঠল সে জ্বরতপ্ত রোগীর মতো কাঁপতে লাগল শরীর। চিৎকার করে উঠল, যেন বোধবুদ্ধিহীন জড় কোন জন্তু চিৎকার করছে।

হঠাৎ করেই থেমে গেল বৃষ্টি। হ্যাঙ্গারের লোহার ছাদের উপর ড্রামের বাজনার মতো বৃষ্টি শব্দ থেমে গেল। অবাক হয়ে গেল আক্কারস। খোলা জায়গায় গিয়ে বাইরে তাকাল। উপরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারকারাজি শব্দ বলতে কেবল পানি বয়ে চলার কুলকুল ধ্বনি আর পাতা থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ার শব্দ।

আলোর আভা দেখা গেল। গাছ-পালার ফাঁকে বাসার সাদা দেয়াল উজ্জ্বলতা ছড়াতে লাগল। আক্কারস বুঝতে পারল যে এখনো কিছু করতে পারবে সে। নিজের হতাশা মেটানোর জন্য কিছু না কিছু তো করবেই সে। ফার্নিচার আছে, ভেঙ্গে ফেলবে। ঘরের চাল জ্বালিয়ে দেবে-ভেতর থেকে আগুন লাগিয়ে দিলে এই আবহাওয়াতেও দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠতে কোন সমস্যাই হবে না।

অন্ধকারের মাঝে গাছের মধ্য দিয়ে পথ করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো আক্কারস।

.

নীরবতার মাঝে ঘুম ভাঙ্গলো ডেবরার। ঝড়ের মাঝামাঝি সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। হয়তো ভয়ের হাত থেকে পালাবার জন্য ক্লান্ত দেহ আপনাতেই ঘুমিয়ে গেছে।

হাত বাড়ালো জুলর দিকে কিন্তু নেই কুকুরটা। ডেবরার পাশে বিছানার যে অংশে কুকুরটা ছিল সেখানটা এখনো গরম হয়ে আছে।

মনোযোগ দিয়ে শুনল ডেবরা। পানির মৃদু শব্দ আর অনেক দূরে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। এ সময়ে পরার জন্য টিলা ধরনের ফোলানো পোশাকের মাঝে কাঁপছে শরীর। বুড়ো আঙুল ঠেকালো মেঝেতে। পাথরের মেঝেতে হালকা ব্যালে পাম্প সু পেয়ে পা গলিয়ে দিল।

ড্রেসিংরুমের দিকে যেতে লাগল সোয়েটারের জন্য। এরপর ঠিক করল নিজের জন্য গরম এক কাপ স্যুপ তৈরি করে নেবে।

ঘেউ ঘেউ করে উঠল জুলু। সামনের বাগানে আছে কুকুরটা বোঝা গেল। নিশ্চিত বারান্দার দেয়ালের মাঝে তার জন্য তৈরি করা বিশেষ দরজা দিয়ে বের হয়ে গেছে কুকুরটা।

বিভিন্ন রকম ভাবে ঘেউ ঘেউ করে কুকুরটা। প্রতিটার নির্দিষ্ট অর্থ আছে যা ডেবরা ঠিকই বুঝতে পারে।

নিজের মতো করে উফ শব্দ যেটা শুনে মনে হয় ওয়াচম্যানের-জুন মাসের রাতে দশটা বেজেছে–সবকিছু ঠিক আছে।

অথবা লম্বা একটা একটানা শব্দ। যেটার মানে আজ রাতে পূর্ণিমা আর আমার রক্তে থাকা নেকড়ের রক্ত আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না।

একটা তীক্ষ্ণ, অর্থবহ ঘেউ ঘেউয়ের মানে হচ্ছে, পাম্প হাউজের কাছে কিছু একটা ঘুরছে। হতে পারে এটা একটা সিংহ।

আর এছাড়া আছে জরুরি কোরাস, ভয়াবহ বিপদ আসছে। সাবধান! সাবধান!

এখন এভাবেই চিৎকার করছে কুকুরটা। এর সাথে সাথে চোয়াল বন্ধ করে গরগর করছে। তার মানে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে।

বারান্দায় এলো ডেবরা। অনুভব করল পায়ের জুতা ভিজে গেছে পানিতে। সামনের বাগানে কিছু একটা দেখছে জুলু। গর্জন শুনতে পাচ্ছে। ডেবরা। কিছু একটা নিয়ে যুদ্ধ করছে জুলু।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে। কী করবে বুঝতে পারছে না। জানে যে ইচ্ছে করলেই যেতে পারবে না জুলুর কাছে। অচেনা শত্রুর সামনে অন্ধ ডেবরা ভয়ঙ্কর অসহায়। দ্বিধার মাঝেই শুনতে পেল ভারী কিছু একটা দিয়ে বাড়ি মারার শব্দ। হাড়ের উপর পড়ে ভাঙার শব্দও পেল সে। থপ করে পড়ে গেল একটা শরীর। হঠাৎ করেই থেমে গেল জুলুর শব্দ। আবার নেমে এলো নীরবতা। কিছু একটা হয়েছে কুকুরটার। এবার সে সত্যিকারের একা হয়ে গেল।

না, পুরোপুরি নীরব নয়। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে–জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কেউ।

পিছু হটে বারান্দার দেয়ালের গায়ে সেঁটে গেল ডেবরা। চুপচাপ শুনছে। আর অপেক্ষা করছে।

শুনতে পেল পায়ের শব্দ। বাগানের মাঝে দিয়ে কেউ একজন এগিয়ে আসছে সদর দরজার দিকে। বৃষ্টির কাদায় মাঝে মাঝে পিছলে যাচ্ছে শব্দ।

চিৎকার করে আগন্তুকের পরিচয় জানতে চাইতে ইচ্ছে করল তার। কিন্তু মনে হলো গলার কাছে জমে গেছে কিছু একটা। মনে হলো দৌড় লাগাবে। কিন্তু সামনের সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে নিজের পা দুটো মনে হল জমে গেছে।

বারান্দার জালের নেটের দিকে হাত বাড়ালো কেউ একজন। হ্যাঁন্ডেলে হাত রেখে আস্তে করে মোচড় দিল।

অবশেষে স্বর খুঁজে পেল ডেবরা ‘কে?’ ভয়ার্ত স্বরে কেঁদে উঠল সে। রাতের নীরবতায় কানে বাজালো ঝনঝন করে।

সাথে সাথে থেমে গেল হাতল ঘুরানোর শব্দ। থেমে গেল লোকটা। ডেবরা স্পষ্ট কল্পনা করতে পারল যে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার বারান্দায় তাকে দেখতে চেষ্টা করছে লোকটা। তৎক্ষণাৎ গাঢ় রঙের পোশাক পরায় নিজেকে ধন্যবাদ দিল সে।

চুপচাপ নড়াচড়া না করে কান পেতে শুনতে লাগল ডেবরা। শুনতে পেল বাতাস এসে নড়ে উঠল গাছের মাথা, টুপটুপ করে অনেকগুলো ফোঁটা একসাথে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। বাঁধের কাছে ডেকে উঠল একটা শিকারি পেঁচা। পাহাড়ের কাছে কড়াৎ কড়াৎ করে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল, পয়েনসেটিয়া ঝোঁপ থেকে কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল একটা নিশাচর পাখি।

আরো অনেকক্ষণ চুপচাপ রইল চারপাশ। বুঝতে পারল বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারবে না সে। অনুভব করল ঠোঁট কাঁপছে। ঠাণ্ডা আতঙ্ক, সন্তানের ভার সব মিলিয়ে চাপ পড়েছে ব্লাডারের উপর। ইচ্ছে করল দৌড়ে পালায়—কিন্তু কোথায় যাবে।

এরপরই নীরবতা ভেঙ্গে গেল। অন্ধকার খিকখিক করে হেসে উঠল কেউ। এত কাছে আর এত উন্মাদের মতো শোনাল হাসিটা–আতঙ্কে মনে হলো হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে তার। পা দুর্বল হয়ে গেল, কাঁপতে শুরু করল ডেবরা। ব্লাডারের উপর চাপ আর নিতে পারছে না সে–কেননা এই হাসি পরিষ্কার ভাবে চিনতে পারছে সে। মনের গহীনে থেকে যাওয়া ভয়ঙ্কর স্মৃতি স্মরণে এলো।

দরজার হাতল ঘোরাতে লাগল হাতটা। বাঁকাতে লাগল জোরে জোরে। এরপর কাধ দিয়ে বাড়ি মারলো কাঠামোর গায়ে। এটা পাতলা একটা দরজা, ভার সহ্য করার মতো তৈরি হয়নি। ডেবরা জানে যে কোন মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়বে এটা।

আবার চিৎকার করে উঠল ডেবরা, আতঙ্কে ভয়াবহ শব্দ বের হলো গলা চিরে। আর মনে হল এতেই কাজ হল। সব ধরনের জড়তা কেটে গেল। পা আবার নড়ে উঠল, ব্রেইন কাজ করা শুরু করল।

তাড়াতাড়ি উঠে নিজের ওয়ার্করুমে দৌড় দিল সে। দরজা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি লক্ করে দিল।

এরপর বিছনার কাছে গিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে চিন্তা করতে লাগল কী করা যায়। জানে যে ঘরে ঢোকার সাথে সাথে আলো জ্বেলে দিবে আক্কারস। বৈদ্যুতিক জেনারেটর অটোম্যাটিক্যালি জ্বলে উঠলেই পুরোপুরি আক্কারসের হাতে পড়ে যাবে সে। অন্ধকার ডেবরার একমাত্র ভরসা এখন। এতে তার সুবিধা হবে, কেননা অন্ধকারেই অভ্যস্ত সে।

আবারো নিশাচর পাখি আর পেচার ডাক শুনতে পেল। বুঝতে পারল রাত নেমেছে বাইরে। আর সম্ভবত মেঘ এখনো ঢেকে রেখেছে চাঁদ আর তারাদের। বাইরের জঙ্গলেও এখন অন্ধকার। এখন যা করতে হবে তা হলো বাইরে গিয়ে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে পৌঁছানো।

তাড়াতাড়ি আবার উঠে রুমের মাঝখানের দরজা দিয়ে আরো ভেতরের রুমে চলে গেল সে। যেতে যেতে ভাবতে লাগল অস্ত্র হিসেবে কী ব্যবহার করা যায়। ডেভিডের অফিসের স্টিলের কেবিনেটে গোলাবারুদ রাখা আছে। রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিল ডেবরা। দরজার কাছে জায়গা মতেই রাখা আছে তার ওয়াকিং স্টিক। হাতে নিয়ে দরজা খুলে ফেলল।

ঠিক তখনি শুনতে পেল সামনের দরজা ভেঙ্গে গেল। তালার উপর ভারী পায়ে লাথি মেরে লিভিং রুমে ঢুকে গেল আক্কারস। পেছনে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিল ডেবরা। তাকাল উঠানের দিকে। চেষ্টা করল নিজেকে শান্ত করতে। ভয় পেলে চলবে না। পথ হারানো যাবে না। প্রতিটি পা গুনেগুনে ফেলতে লাগলা। কোপজেতে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে যাবার রাস্তা খুঁজে পেতে হবে তাকে।

ওর প্রথম ল্যান্ডমার্ক হলো বেড়ার গায়ের দরজাটা যেটা বাড়ির চারপাশে ঘিরে আছে। এর কাছে পৌঁছানোর আগেই শুনতে পেল ইলেকট্রিসিটি জেনারেটর গ্যারাজের পেছনে স্বশব্দে চলা শুরু করল। আক্কারস লাইটের সুইচ খুঁজে পেয়েছে।

পথ থেকে সরে গেল ডেবরা। দৌড়াতে লাগল কাটাতারের বেড়ার দিকে। উন্মাদের মতো চেষ্টা করল দরজাটা খুঁজে পেতে। মাথার উপরে শুনতে পেল বাতির চড়চড় শব্দ। তার মানে এখনি আলোর বন্যায় ভেসে যাবে পুরো বাগান।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই রান্নাঘরের দরজার পাশে থাকা বাতির সুইচের গায়ে চোখ পড়েছে আক্কারসের। মনে হল আলোর নিচে তাকে নিশ্চয় দেখে ফেলেছে লোকটা।

শুনতে পেল তার পেছনে চিৎকার করছে আক্কারস। বুঝতে পারল তাকে দেখতে পেয়েছে। সেই মুহূর্তে গেইট পেয়ে গেল ডেবরা। স্বস্তির শ্বাস ফেলে গেইট খুলেই দৌড়াতে লাগল।

তাকে আলো থেকে সরে যেতে হবে। অন্ধকারে হারিয়ে যেতে হবে। আলোই এখন বিপদ ডেকে আনবে, অন্ধকার তাকে রক্ষা করবে।

রাস্তাটা হচ্ছে আঁকাবাকা, পুলের বাম পাশ দিয়ে ডানদিকে ভৃত্যদের কোয়ার্টার ডানহাতি রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে লাগল ডেবরা। পেছনে খুলে গেল গেইট। তার পেছনেই আসছে আক্কারস।

দৌড়াতে গিয়েও গননা করতে ভোলেনি ডেবরা। পাঁচশো কদম সামনে গেলেই নতুন মোড়। কিন্তু পড়ে গেল বেচারা।

হাঁটুতে বেঁধে গড়িয়ে গেল। হারিয়ে গেল ওয়াকিং স্টিক। এটা খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। আবারো দৌড়াতে শুরু করল।

আরো পঞ্চাশ কদম গিয়েই বুঝতে পারল যে সে ভুল পথে এসেছে। এই পথ পাম্পহাউজের দিকে গেছে-এই রাস্তা সে ততটা ভালো চেনে না। এই পথে তেমন আসে না সে।

একটা মোড় নিতে ভুলে যাওয়ায় এবড়ো-খেবড়ো মাটিতে চলে গেল সে। পায়ে ঘাস জড়িয়ে এক পাশে কাত হয়ে পড়ে গেল। পুরোপুরি দিশেহারা অবস্থা তার। জানে যে পথ ভুলে বসে আছে। কিন্তু এটুকু সান্ত্বনা যে আলোর কাছ থেকে সরে এসেছে। ভাগ্যক্রমে চারপাশে একেবারে অন্ধকার–কিন্তু এত দ্রুত হার্টবিট হচ্ছে যে বুঝতে পারল ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবার জোগাড়।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে করতে কান পেতে রইল কিছু শোনার আশায়।

এরপরই শুনতে পেল আসছে আক্কারস। ভারী পায়ের শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল, ভেজা মাটিতেও কান এড়ালো না। মনে হলো সরাসরি ডেবরার কাছেই আসছে সে। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখে নিজেকে শান্ত করতে চাইল ডেবরা।

একেবারে শেষ মুহূর্তে ডেবরার কাছ দিয়ে চলে গেল পদশব্দ। মনে হল অসুস্থ হয়ে যাবে সে। কিন্তু আবার ফিলে এলো পদশব্দ। এতটা কাছে যে আক্কারসের হাঁপানির শব্দও পাচ্ছে সে।

ডেবরার জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল আকারস। একেবারে কাছাকাছি। দাঁড়িয়ে আছে দু’জনে। কিন্তু অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না। আর মনে হলো সময়গুলো হয়ে গেল ভীষণ দীর্ঘ। মিনিট যেতে লাগল ঘণ্টার মতো করে। অবশেষে কথা বলল আক্কারস।

‘আহ্! এই তো পেয়েছি তোমাকে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। খিকখিক করে হাসতে লাগল আক্কারস।

হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি বেড়ে গেল ডেবরার। যতটা কাছে ভেবেছিল তার চেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে আছে আক্কারস। আরেকটু হলেই আবারো দৌড় লাগাতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু মনের গভীরে কেউ একজন আশ্বস্ত করল যেন।

‘এই তো দেখতে পাচ্ছি তুমি লুকিয়ে আছে। আবার বলে উঠল আক্কারস। আমার কাছে বড়সড় একটা ছুরি আছে। এখনি ধরে জবাই করে ফেলবো দাঁড়াও।

কুলকুল করে কাঁপতে লাগল ডেবরা। আতঙ্কিত হয়ে শুনতে লাগল আক্কারস কথা। এরপর হঠাৎ করেই বুঝতে পারল যে ও এখনো নিরাপদ। আক্কারস তাকে এখনো দেখেনি। রাতের অন্ধকারে ঢেকে আছে ডেবরা। ঘন গাছপালার আবরণ থাকাতেও তাকে দেখতে পাচ্ছে না আক্কারস। লোকটা তাকে ভয় দেখাতে চাইছে শুধুমাত্র। চাইছে আবারো দৌড়াতে শুরু করলেই ধরে ফেলবে ডেবরাকে। তাই মনোযোগ দিয়ে একেবারে স্থির পাথরের মতো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ডেবরা।

আবারো চুপ করে রইল আক্কারস। শিকারির মতো ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। আবারো কাটতে লাগল মিনিটের পর মিনিট।

ব্লাডারের চাপে মনে হল কেউ গরম লোহা চেপে ধরেছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠতে মন চাইল ডেবরার। এর সাথে আরেক যন্ত্রণা, চটচটে আঠালো কিছু একটা হাতের উপর দিয়ে উঠে আসছে। চামড়ার উপর হাজারো পায়ের সিড়সিড়ানি অনুভূতিতে মনে হলো আতঙ্কে মরেই যাবে সে। কিন্তু তারপরেও এতটুকু নড়লো না।

জিনিসটা মাকড়সা বা বিছা যাই হোক না কেন, গলার কাছে উঠে এলো। বুঝতে পারল যে কোন মুহূর্তে সব ভুলে গিয়ে চিৎকার করে উঠবে সে।

হঠাৎ আবারো চিৎকার করে উঠল আক্কারস- “ঠিক আছে। আমি গিয়ে একটা ফ্লাশ লাইট নিয়ে আসছি। দেখবো কত দূরে যেতে পারো। শীঘ্রিই ফিরে আসব আমি। ভেব না বৃদ্ধ আক্কারসকে কাবু করতে পারবে তুমি। তুমি শিখতে পারবে না এরকম হাজারো কৌশল জানা আছে আমার।’

শব্দ করে সরে গেল আক্কারস। ডেবরা চাইল তৎক্ষণাৎ গাল থেকে পোকাটাকে ফেলে দৌড় লাগাতে। কিন্তু আবারো কেউ একজন মনের গহীনে ফিসফিস করে বলে উঠল, সবকিছু ঠিক আছে, তুমি শান্ত হও। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল ডেবরা। এরপর দশ। পোকাটা পৌঁছে গেল তার চুলে।

আবারো অন্ধকারে ঠিক তার পাশেই চিৎকার করে উঠল আক্কারস। ঠিক আছে?’ বেশি চালাক হয়েছিস তাই না শয়তানী দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। এবার সত্যি চলে গেল আক্কারস।

চুল থেকে ঝেড়ে পোকাটাকে ফেলে দিল ডেবরা। ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। এরপর আস্তে আস্তে হাঁটা ধরল আরো বনের ভেতরে। আঙুলগুলো শক্ত হয়ে গেছে ঠাণ্ডায় আর জোর করে কাপড় ধরে রাখায়। হাত ছেড়ে তলপেটের ভারমুক্ত হল ডেবরা।

আবারো উঠে দাঁড়াল। অনুভব করল পেটের মাঝে নড়ে উঠল তার সন্তান। এর সাথে জেগে উঠল মাসুলভ সব বোধগুলো। নিরাপদ স্থানে সরে যাবার তাগিদ অনুভব করল ডেবরা। নিজের সন্তানকে অবশ্যই নিরাপত্তা দিতে হবে। কিছু হতে দেবে না সে। চিন্তা করল পুলের পাশে গিয়ে লুকিয়ে থাকবে।

কিন্তু কীভাবে যাবে? পুরোপুরি পথ হারিয়ে ফেলেছে সে। এরপর মনে পড়ল ডেভিড বলেছিল বাতাসের কথা। পশ্চিম দিক থেকে বয় বৃষ্টির বাতাস। এখন খানিক হালকা হয়েছে বাতাসের গতি। অপেক্ষা করল গালের উপর আবার কখন স্পর্শ পাওয়া যায়। তাহলে পথ পেয়ে যাবে সে। তাই হলো, দিকনিদের্শনা পেল সে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দুই হাত পাশে ছড়িয়ে দিল। আবারো হাঁটা শুরু করল। শুধুমাত্র পুলের কাছে পৌঁছাতে পারলেই লুকানো তীরে যেতে পারবে।

কিন্তু সাইক্লোনের বাতাস ঝড়ের মতো করে দিক পরিবর্তন করতে লাগল অথচ বিশ্বস্ততার সাথে এর পিছুপিছু যেতে লাগল ডেবরা। ফলে জঙ্গলের মধ্যে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল শুধু।

জাবুলানির আলোকিত রাস্তা ধরে ঘরের মধ্যে ঝড়ের বেগে ঢুকলো আক্কারস। খোলা ড্রয়ার ধরে টান দিল, লাখি মারতে লাগল আটকানোগুলোতে।

ডেভিডের অফিসে বন্দুকের কেবিনেট খুঁজে পেল। চাবির জন্য হাতড়াতে লাগল ভোয়গুলো। কিছুই না পেয়ে হতাশায় দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল।

এ রুম থেকে গেল বিল্ট ইন কার্বাড ইউনিটে। ডজনখানেক প্যাকেট করা শটগান শেল আর ইলেকট্রিক লণ্ঠন আছে একটা। তাড়াতাড়ি লণ্ঠন তুলে সুইচ জ্বালালো। সাদা আলো বের হল–খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল আক্কারস।

আবারো দৌড়ে গেল রান্নাঘরে। কাটলারি ড্রয়ার খুলে লম্বা বাঁকানো ছুরি নিল একটা, স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে তৈরি। তারপর তাড়াহুড়া করে উঠান পার হয়ে গেইটের দিকে ছুটল।

লণ্ঠনের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল ভেজা মাটিতে ডেবরার পায়ের ছাপ। পাশাপাশি নিজের পায়ের ছাপও দেখতে পেল আক্কারস। অনুসরণ করে গেল সে। যেখানে বসে মূত্রত্যাগ করেছে খুঁজে পেল সে জায়গাও।

‘চালাকের হাড়ি কোথাকার। বিড়বিড় করে উঠল আক্কারস। বনের গভীরেও অনুসরণ করে চলল ডেবরাকে। পরিষ্কার ছাপ আর চিহ্ন রেখে গেছে ডেবরা। বৃষ্টিস্নাত ঘাসের বুকে। গাছের গায়ে থেকে পানি মুছে গেছে ডেবরার হাতের চাপে। শিকারির চোখে এ পরিষ্কার চিহ্ন ভুল হবার কথা নয়।

প্রতি মিনিট অন্তর অন্তর থেমে দাঁড়িয়ে লণ্ঠন বাড়িয়ে নিজের সামনের অংশও দেখে নিচ্ছে আক্কারস। শিকারি সুলভ উত্তেজনা জেগে উঠল। আদিম এই বোধটুকুই এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে তাকে। প্রথমবার ব্যর্থ হওয়ায় এবার আরো বেশি উত্তেজনা বোধ করছে সে।

সাবধানে এগোতে লাগল সে। বিশাল একটা চক্রাকারে ঘুরতে লাগল ডেবরার উদ্দেশ্যহীন পায়ের ছাপ।

আবারো থেমে গেল আক্কারস! খাদের মাথাগুলো পরীক্ষা করে দেখল লণ্ঠন বাড়িয়ে। দেখতে পেল আলোর শেষ মাথায় গোলগোল কিছু একটা ছুটে গেল।

আলো ধরে রাখল এটার উপর। দেখতে পেল পাণ্ডুর আতঙ্কিত এক মুখ আস্তে আস্তে দ্বিধাভরা পায়ে সামনে এগোচ্ছে। মনে হল ঘুমের ঘোরে হাঁটছে। ডেবরা। হাত দুটো সামনে বাড়ানো।

সরাসরি আক্কারসের দিকে এগিয়ে আসছে মেয়েটা। আলোর মাঝে ধরা পড়ে গেছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। একবার থেমে নিজের পেটে হাত বুলিয়ে ভয়ের চোটে ফোঁপাতে লাগল।

পায়ের ট্রাউজার ভিজে গেছে বৃষ্টির পানিতে। জুতা এরই মাঝে ছিঁড়ে একাকার। যতই কাছে এলো আক্কাস দেখল হাত আর ঠোঁট নীল হয়ে গেছে ঠাণ্ডায়।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে ডেবরাকে দেখতে লাগল আক্কারস। মনে হল মুরগি দেখে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে আছে একটা কোবরা।

কাধ জুড়ে নেমে গেছে ভেজা দড়ির মতো কালো চুল, মুখেও লেপ্টে আছে কিছু। পাতলা ব্লাউজটাও গাছের গায়ে থেকে পানি পড়ে ভিজে গেছে। পুরো কাপড় লেপ্টে আছে পর্বতপ্রমাণ পেটের উপর।

মেয়েটাকে আরো কাছে আসতে দিল আক্কারস। উত্তেজনায় মনে হল ফেটে পড়বে এত সহজে তাক হাতে পাওয়ায়। অবশেষে প্রতিশোধ নিতে পারবে সে। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে চায় সে।

মাত্র পাঁচ কদম দূরে থাকতেই ডেবরার ঠিক মুখের উপর আলো ফেলল আক্কারস। খিকখিক করে হাসতে লাগল।

চিৎকার করে উঠল ডেবরা। পুরো মুখ বিকৃত হয়ে উঠল। বন্য পশুর মতো ঘুরে দাঁড়িয়েই অন্ধের মতো দৌড় লাগাল, বিশ কদম সামনে গিয়ে পা বেঁধে পড়ে গেল মারুলা গাছের শিকড়ের সাথে।

পড়ে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। হাত বুলাতে লাগল গালের ক্ষতে।

হাচোড়-পাচোড় করে আবারো উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। শুনতে চাইল পরবর্তী শব্দ।

নিঃশব্দে ডেবরার চারপাশে ঘুরে ঘুরে কাছে এগিয়ে গেল আক্কারস। তারপর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আবারো খিকখিক করতে লাগল।

আবারো চিৎকার করে উঠে দৌড়াতে লাগল ডেবরা। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গেল পিপড়ার গর্তে পা দিয়ে। সশব্দে মাটির উপর আছাড় খেল। শুয়ে ফোঁপাতে লাগল বেচারা।

অলসভাবে হেলেদুলে তার কাছে এগিয়ে গেল আক্কারস গত দুই বছরের মাঝে এই প্রথমবার বেশ আনন্দ হচ্ছে তার। বিড়ালে মতো পুরো ব্যাপারটাকে এত তাড়াতাড়ি শেষ করতে চায় না সে। বহুক্ষণ ধরে খেলাতে চায়।

ডেবরার গায়ের উপর গিয়ে উচ্চারণ করল কুৎসিত সব শব্দ। তৎক্ষণাৎ আবার উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করল ডেবরা। পেছন থেকে ছুটতে লাগল আক্কারসও। মনে পড়ে গেল তার শিকার করা হাজারো জন্তুর কথা।

.

রাস্তার ভেজার নরম মাটির উপর দিয়ে খালি পায়ে দৌড়াতে লাগল ডেভিড। নিজের ব্যথা প্রায় ভুলেই গেল। এমনকি হৃৎপিণ্ডের নিস্তেজ ভাব বা ফুসফুসের জ্বলুনিও টের পেল না।

পাহাড়ের গায়ে ঘুরে গেল পথ। ঘরের কাছে এসে থেমে দাঁড়াল। হাপাতে হাপাতে তাকিয়ে রইল বাড়ি উজ্জ্বল করে জুলতে থাকা আলোর দিকে। জাবুলানির বাগান ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়। এ সময় ফ্লাডলাইট জ্বলার কোন কারণ নেই। নতুন করে সর্তক ঘণ্টা বেজে উঠল মনের মাঝে। পাহাড়ের গা বেয়ে লাফিয়ে নামাতে লাগল।

শূন্য, তছনছ হওয়া ঘরের মাঝে ডেবরার নাম ধরে ডাকতে লাগল ডেভিড। কিন্তু নিজের শব্দের প্রতিধ্বনি শুনল কেবল।

সামনের বারান্দায় পৌঁছে কিছু একটা দেখতে পেল। অন্ধকারে নড়ছে কিছু একটা।

‘জুলু! সামনে দৌড়ে গেল ডেভিড, ‘হিয়ার বয়! হিয়ারডেবরা কোথায়?

সিঁড়ি দিয়ে ঘসটে ঘসটে উঠে এল জুলু। বোঝা গেল অনেক আঘাত পেয়েছে কুকুরটা। মাথার একপাশে ভারী কিছুর বাড়ি খাওয়ায় চোয়াল ভেঙ্গে গেছে। অথবা জায়গা থেকে সরে গেছে। তাই হাস্যকরভাবে ঝুলছে এটা। নিস্তেজ হয়ে আছে জুলু।

হাঁটু গেড়ে বসল ডেভিড। ডেবরা কোথায় জুলু, কোথায়?

কুকুরটা মনে হল চেষ্টা করছে নিজেকে প্রকাশ করতে। কোথায় সে বয়? ও ঘরে নেই। কোথায় তাহলে? ফাইন্ড হার বয়! ফাইন্ড হার। আকুতি জানাল ডেভিড।

উঠানে কুকুরটাকে ফেলে এল ডেভিড। কিন্তু তার পিছুপিছু ঘুরতে লাগল জুলু। পিছনের দরজায় ভেজা মাটির গন্ধ পেল কুকুরটা। ফ্লাডলাইটের আলোয় পায়ের চিহ্ন দেখতে পেল ডেভিড। ডেবরার আর তার পিছনে বড় বড় পুরুষালী পা।

উঠানে গেল জুলু। নিজের অফিসে গেল ডেভিড। লণ্ঠন নেই। কিন্তু পিছনে পাঁচ ব্যাটারীর ফ্লাশ লাইট আছে। পকেটে ভরে নিল ডেভিড। হাত ভর্তি করে নিল শটগান শেল। এরপর তাড়াতাড়ি করে গান কেবিনেটে গিয়ে খুলে ফেলল তালা। পার্ডে শট গান হাতে নিয়েই দৌড়াতে দৌড়াতে লোড করতে লাগল।

গেইটের বাইরের রাস্তা ধরে হেঁচড়ে হেঁচড়ে এগিয়ে যাচ্ছে জুলু। কুকুরটার পেছনে ছুটল ডেভিড।

.

জোহান আক্কারস আর মানুষ রইল না। পশু হয়ে উঠল। শিকারের দৌড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে শিকারির সুলভ মনোভাব চাঙ্গা হয়ে উঠল। পেছনে দৌড়ে গিয়ে খুন করো। ক্ষত-বিক্ষত আহত শিকার নিয়ে খেলতে লাগল সে, যতক্ষণ পর্যন্ত ইচ্ছে তাড়া করে বেড়াবে মেয়েটাকে তারপর নিজের খুশিমতো খুন করবে।

অবশেষে এলো এই মাহেন্দ্রক্ষণ শিকারের সমস্ত নিয়ম মেনে খেলছে সে প্রতিটি খেলার নির্দিষ্ট সময় আছে। বিদায় ঘণ্টা বাজার–আক্কারস বুঝতে পারল শেষ করার সময় এসেছে।

ছুটন্ত দেহের পিছনে চলে এলো সে। হাত বাড়িয়ে মুঠি দিয়ে কব্জিতে পেঁচিয়ে মাথা পেছনে টেনে ধরল। পাণ্ডুর গলা উন্মুক্ত হয়ে গেল ছুরি বসানোর জন্য।

কিন্তু সমান শক্তি আর হিংস্রতা নিয়ে আক্কারসের দিকে ফিরে তাকাল ডেবরা। এতটা আশা করেনি আক্কারস। ভেজা শক্ত শরীর নিয়ে তার উপর আক্রমণ করল ডেবরা। বাঁচার জন্য মরীয়া এখন সে।

প্রস্তুত ছিল না আক্কারস। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। ডেবরাকে বুকের উপর নিয়ে পিছনে আছাড় খেল। ছুরি ফেলে দিল হাত থেকে। চোখ বাঁচাতে লণ্ঠন তুলে ধরল মুখের উপর। তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে খোঁচা দিতে চাইছে ডেবরা। নাক আর গালে ঢুকে গেল নখ। বিড়ালের মতো আঁচড় কাটতে লাগল ডেবরা। এই মুহূর্তে ওকেও দেখতে পশুর মতোই মনে হচ্ছে।

হাত থেকে চুলের মুঠি ছেড়ে দিল আক্কারস। ডান হাতে চেপে ধরলো ডেবরাকে আঘাত করল। কাঠের কুঠারের মতো ভীষণ ভারী আর শক্ত সে আঘাত। এর একটি আঘাতেই নিস্তেজ হয়ে গেছে ল্যাব্রাডর জুলু। চোয়াল ভেঙ্গে গেছে কুকুরটার। ডেবরার মাথার উপর মারলো আক্কারস। এমন শব্দ হল মনে হল গাছের গুঁড়ির গায়ে কোদালের কোপ পড়ল। সব শক্তি শেষ হয়ে গেল মেয়েটার। হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ল। সুস্থ হাতে ডেবরাকে ধরে রেখে অন্য হাতে একের পর এক তাকে মারতে লাগল আক্কারস। নির্দয় সেই মারের চোটে কালো রক্ত ছিটকে বের হল নাক থেকে। খুলির উপর উপযুপরী আঘাত করতে লাগল আক্কারস। ডেবরা একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ার পরেও থামলো না সে। নিজের স্বাদ মিটিয়ে মারার পর উঠে দাঁড়াল। পড়ে রইল ডেবরা। হেঁটে গিয়ে লণ্ঠন হাতে তুলে নিল আক্কারস। চকচক করে উঠল ছুরির ফল। প্রাচীন একটি পদ্ধতি আছে যার মাধ্যমে এ শিকারযজ্ঞ শেষ করতে চায় আক্কারস।

জোহান আক্কারস হাতে তুলে নিল লণ্ঠন। এরপর এমন ভাবে রাখল যেন আলো পড়ে ডেবরার উপর। হাতে তুলে নিল ছুরি।

ডেবরার কাছে এগিয়ে গিয়ে পা দিয়ে গড়িয়ে দিল নিস্তেজ শরীরটাকে। ঘুরে গেল ডেবরা। মুখের উপর লেপ্টে গেল ভেজা চুলের রাশি।

হাঁটু গেটে তার পাশে বসল আক্কারস। ব্লাউজের সামনে ঢুকিয়ে দিল বজ্র কটিন হাত। একটানে খুলে ফেলল। লণ্ঠনের আলো ভেসে উঠল স্ফীত উদর সাদা পেটের মাঝে শিশু পুরোপুরি ভাবে প্রস্তুত পৃথিবীত আসার জন্য। কালো বিন্দুর মতো দেখা গেল নাভি।

খিকখিক করে হেসে হাত দিয়ে চেহারা থেকে মুছে ফেলল ঘাম আর বৃষ্টির ফোঁটা। এর ছুরি ধরা হাতে তৈরি হল। ঘুরিয়ে নিল ফলা। ইনটেস্টিন না কেটে পাঁজর পর্যন্ত নামিয়ে আনা ছুরির মাথা। একজন সার্জনের মতো দক্ষ হয়ে উঠেছে এ কাজে সে। এর আগে না হলেও দশ হাজার বার করেছে একই কাজ।

আলোর কিনারে ছায়া পড়ায় চোখ তুলে তাকাল আক্কারস। দেখতে পেল নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে কালো একটা কুকুর। লণ্ঠনের আলোয় ধকধক করে জ্বলছে চোখ।

তাড়তাড়ি হাত দিয়ে গলায় হাত দিতেই লোমশ শরীর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তার উপর। একসাথে গড়াগড়ি খেতে লাগল জুলু আর আকারস। আহত চোয়ালে সুবিধা করতে পারছে না জুলু।

আবারো হাতের মুঠোয় ছুরির দিক পরিবর্তন করল। আক্কারস জুলুর পাজরে খোঁচা দিল। প্রথম বারেই পেয়ে গেল হৃৎপিণ্ড। একবার নড়ে উঠেই নিস্তেজ হয়ে গেল জুলু। ধাক্কা দিয়ে একপাশে ফেলে দিল জুলুকে আক্কারস। ছুরি বের করে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল ডেবরার কাছে।

জুলু এসে পড়ায় আক্কারস মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। এই ফাঁকে পৌঁছে গেছে ডেভিড।

আক্কারসের দিকে দৌড় দিল সে। লণ্ঠনের আলোয় কাদার মতো রঙের চোখ জোড়া নিয়ে তাকাল আক্কারস। হাতে জুলুর রক্ত লেগে থাকা লম্বা ফলার ছুরি নিয়ে গর্জন করে উঠল। পায়ের উপর উঠে দাঁড়াতে লাগল। ঠিক পুরুষ বেবুনের মতো করে মাথা ঝাঁকাতে লাগল হিংস্র ভাবে।

ঠিক আক্কারসের মুখের উপর জোড়া ব্যারেলের শটগান ধরে ট্রিগার টেপে দিল ডেভিড। সলিড ভাবে উড়ে গিয়ে আঘাত করল শেল। কোন দিক না ছড়িয়ে সোজা ছিটকে বের হল থকথকে হলুদ পদার্থ। আক্কারসর পুরো মাথা পেছন দিকে হেলে গেল। পা জোড়া দিয়ে এলোমেলো ভাবে লাথি মারতে মারতে মাটিতে শুয়ে পড়ল আক্কারস। একপাশে শটগান ছুঁড়ে ফেলেই ডেবরার দিকে দৌড় দিল ডেভিড।

ডেবরার উপর উপুর হয়ে ফিসফিস করে উঠল, ‘মাই ডার্লিং, ওই মাই ডার্লিং, প্লিজ ক্ষমা করো। তোমাকে একা রেখে যাওয়া উচিৎ হয়নি আমার। আস্তে করে সাবধানে তুলে নিয়ে বুকের কাছে ধরল স্ত্রীকে। এরপর নিয়ে গেল ঘরে।

ভোরের দিকে জন্মগ্রহণ করল ডেবরার সন্তান। সময়ের আগেই এসেছে ছোট্ট কন্যাশিশু। দক্ষ চিকিৎসকের সহায়তা পেলে হয়তো বাঁচতে শিশুটি। কিন্তু এ ব্যাপারে পুরোপুরি অনভিজ্ঞ ডেভিড। উন্মত্ত নদী সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে তাদেরকে আর টেলিফোন তখনো মৃত। ডেবরারও জ্ঞান ফিরেনি।

সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পর ছোট্ট নীল শরীরটাকে পরিষ্কার শিটে জড়িয়ে তার জন্যে তৈরি দোলনায় শুইয়ে দেয়া হল। তাকে যাদের দরকার তাদের জন্য কিছু করতে না পেরে-বিবশ বোধ করতে লাগল ডেভিড।

সেই দিন দুপুর তিনটায় নিজের বিশাল ট্রাকের চাকার উপরেও পানি এমন অবস্থায় চলে এল জোর করে গাড়ি চালিয়ে। তিন ঘণ্টা পরে নেলট হাসপাতালের প্রাইভেট ওয়ার্ডে ভর্তি করা হল ডেবরাকে। দুই দিন পর জ্ঞান ফিরল তার। কিন্তু মুখটা ভয়ানকভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে।

৭. প্রাকৃতিক ছাদ

কোবজের কাছে জাবুলানি ঘরের উপরে প্রাকৃতিক ছাদ মতন একটা জায়গা আছে। যেখান থেকে দেখা যায় পুরো এস্টেট। জায়গাটা বেশ খানিকটা দূরে আর একেবারে শান্ত। সন্তানকে সেখানে সমাহিত করল তারা। কোবজের পাথর দিয়ে নিজের হাতে কবর তৈরি করল ডেভিড।

ভালোই হল যে ডেবরা বাচ্চাকে কখনো হাত দিয়ে ছুঁতে পারেনি বা দুধ খাওয়ানি। ওর কান্না শোনেনি বা শরীরের ঘ্রাণ নেয়নি।

যাই হোক, ভেতরের বেদনা মুখ ফুটে প্রকাশ করলো না কেউই। নিয়মিত সমাধি স্থানে যায় ডেভিড আর ডেবরা। এরপর এক রবিবারে পাথরের বেঞ্চিতে বসে প্রথম বারের মতো দ্বিতীয় বাচ্চার কথা উচ্চারণ করল ডেবরা।

‘প্রথমবার তুমি অনেক সময় নিয়েছে মরগ্যান। অভিযোগ করে বলল ডেবরা।

‘আমার মনে হয় এখন শিখে গেছ কৌশলটা, তাই না?

আবারো পাহাড় বেয়ে নেমে এলো দুজনে। ল্যান্ড রোভারে বঁড়শি আর পিকনিক বাস্কেট নামিয়ে রেখে নেমে গেল পুলের পানিতে।

দুপুর হবার ঠিক এক ঘণ্টা আগে বঁড়শিতে খাবার গিলল মোজাম্বিক ব্রিম। কষ্ট হল ডেভিডের ধরা মোটাসোটা মাছটাকে তুলতে। পাঁচটা তুলল ডেবরা, প্রতিটার ওজন তিন পাউন্ডের কাছাকাছি। এরপর ও আরো ডজনখানেক নীল মাছ ধরল ডেভিড। অন্ধকার নামার আগপর্যন্ত এভাবেই চলল। তারপর ঠাণ্ডা লাঞ্চবক্স খুলল দু’জনে।

ফিভার গাছের নিচে পড়ে থাকা পাতার উপর বিছানো কার্পেটে শুয়ে পড়ল দু’জনে। আইস বক্সে থাকা সাদা ওয়াইন নিল।

কখন যেন কেটে গেল আফ্রিকার বসন্ত এসে গেল গ্রীষ্মকাল। ঝোঁপঝাড়ে বেড়ে গেল নিঃশব্দ পদচারণা। পাখিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজেদের ঘর বানানো নিয়ে। উজ্জ্বল হলুদ রঙের পাখা ছড়িয়ে কালো মাথা নেড়ে যখন ঘর বানায় দেখার মতো দৃশ্য হয় সেটি। পুলের ওপারে ছোট্ট একটি মাছরাঙা পাখি বসে আছে শান্ত পানির উপর ভাসতে থাকা মড়া ডালের উপর। হঠাৎ করেই উড়ে গিয়ে ছো মারল নীল পানিতে। ঠোঁটে উঠে এলো সিলভার সিলভার। যেখানে তারা শুয়ে আছে তার পাশেই লাইন করে উড়ে বেড়াতে লাগল হলুদ, ব্রোঞ্জ আর সাদা প্রজাপতির দল। মৌমাছিরও গুঞ্জন তুলে চূড়ার উপরে বাসার দিকে যাচ্ছে।

পানির কারণেই চারপাশে জীবনের স্পন্দন ছড়িয়ে পড়েছে। তাই পুলই হল জাবুলানির প্রধান সম্পদ। দুপুরের একটু পরে, ডেবরার হাত ধরল ডেভিড। নায়লারা এসেছে’–ফিসফিসিয়ে উঠল সে।

পুলের ধার ঘেঁষে এলো অ্যান্টিলোপের দল। সহজ ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো দলটা। বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল ডেভিড আর ডেবরার দিকে। কান ছড়িয়ে বিপদ আঁচ করতে চাইছে।

‘হরিণীগুলোর পেটে শাবক।’ জানাল ডেভিড। সামনের কয়েক সপ্তাহের মাঝেই প্রসব করবে। সবকিছুই ঠিক ভাবে চলছে। অর্ধ-পাশ ফিরে ডেবরার দিকে তাকাল ডেভিড। বুঝতে পেরে কাছে গেল ডেবরা। পানি পান করে চলে গেছে নায়লার দল, সাদা মাথাওয়ালা মাছ ধরা ঈগল অনেক উপরে চক্কর মারছে মাথার উপর চেস্টনাট রঙের পাখা ছড়িয়ে, গুঞ্জন করছে অদ্ভুত সুরে আর এরই মাঝে শান্ত পুলের পাশে ছায়ার মাঝে ভালোবাসা-বাসি করল দু’জনে।

ডেবরার মুখের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখল ডেভিড। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মেয়েটা। কার্পেটের উপর উজ্জ্বল কালো কাপড়ের মতো ছড়িয়ে আছে চুল। কপালের উপর রং হালকা হয়ে হয়ে হলুদ আর নীল হয়ে আছে। হাসপাতাল থেকে আসার পর কেটে গেছে দুই মাস। হালকা কাটার দাগের পাশে বড় বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ডেভিডের গ্রেনেড দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হওয়া মুখমণ্ডল। সাদা হয়ে উঠল ডেবরার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। উপরের ঠোঁট খুলে গেল, আরামদায়ক সুরেলা ধ্বনি বের হয়ে এলো মুখ থেকে।

তাকিয়ে তাকিয়ে খুব কাছ থেকে দেখল ডেভিড। বুকের মাঝে ভালোবাসায় ভরে গেল মেয়েটার জন্য। উপর থেকে পাতার চাদোয়া ভেদ করে নেমে এলো সূর্যের আলোর সরু একটি রেখা। পড়ল এসে ডেবরার মুখের উপর। উষ্ণ সোনালি একটি আভা ছড়িয়ে পড়ল যেন, মনে হল মধ্যযুগীয় কোন গির্জার জানালায় দেখা ম্যাজনার মুখ। আর সহ্য করতে পারল না ডেভিড। শুরু হল প্রস্রবণ। চিৎকার করে উঠল ডেবরা। চোখ খুলে বড় বড় হয়ে গেল। সোনালি মধুরঙা চোখের গভীর পর্যন্ত দেখতে পেল ডেভিড। পিউপিলগুলো মনে হলো বড় একটা কালো পুল। কিন্তু সূর্যের আলো পড়া মাত্র ছোট ছোট কালো কালো ফুটকি দেখা গেল।

এমনকি এই সময়েও বিস্মিত হয়ে গেল চোখ দেখে। এর অনেক পরেও চুপচাপ শুয়ে রইল যখন দু’জনে ডেবরা জানতে চাইল, কী হয়েছে ডেভিড? বলল আমাকে।

না, কিছু হয়নি ডার্লিং, কী হবে?

‘আমি জানি ডেভি। কিছু একটা হয়েছে পৃথিবীর ও মাথায় থাকলেও আমি ঠিক টের পাবো।’

হাসল ডেভিড। অপধারীর ভঙ্গিতে সরে এলো ডেবরার কাছ থেকে। সম্ভবত এটা তার কল্পনা, ছোট্ট একটু আলোর শিখা। চেষ্টা করল জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে দিতে এই চিন্তা।

সন্ধ্যার ঠাণ্ডা নেমে এলে বঁড়শিগুলো গুছিয়ে নিলি ডেভিড। তারপর কার্পেট ভাজ করে পার্ক করা গাড়ির পাশে গিয়ে চড়ে বসল। বাড়ির উদ্দেশে গাড়ি ছোটাল। পথে যাবার সময় দক্ষিণ দিকের বেড়া চেক করে দেখল ডেভিড। এরপর নিঃশব্দে মিনিট বিশেক ড্রাইভ করার পর ডেভিডের হাত স্পর্শ করল ডেবরা।

যখন তুমি তৈরি হবে আমাকে জানাতে যে কী হয়েছে-আমি শুনবো। এরপর অনবরত বকবক করে চেষ্টা করল ডেভিডকে একই সাথে নিজের মনকেও অন্য দিকে ফিরিয়ে নিতে।

রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গেল ডেভিড। ফিরে আসার পর অনেকক্ষণ বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল ডেবরার ঘুমন্ত মুখের দিকে। ঠিক যখন সরে যেতে চাইল সে তখনই পুলের কাছে থেকে চিৎকার করে ডেকে উঠল একটা সিংহ। দুই মাইলের ব্যবধান সত্ত্বেও পরিষ্কার শোনা গেল স্পষ্ট সেই ডাক।

এই অজুহাতটুকুই দরকার ছিল ডেভিডের। নিজের বেডসাইড টেবিল থেকে পাঁচ ব্যাটারির ফ্ল্যাশ লাইট তুলে নিল হাতে। আলো ফেলল ডেবরার মুখের উপর। এত সুন্দর নিষ্পাপ মুখশ্রী ইচ্ছে হল ঝাঁপিয়ে পড়ে আদর করতে। এর বদলে ডাক দিল ডেবরাকে।

‘ডেবরা! চোখ খোল ডার্লিং। নড়েচড়ে চোখ খুললো ডেবরা। ফ্ল্যাশ লাইটের পুরো আলো ফেলল ওর চোখে ডেভিড। দেখা গেল আর কোন সন্দেহ নেই। সত্যিই নড়াচড়া করতে লাগল কালো রঙের পিউপিল।

কী হয়েছে ডেভিড? ঘুম জড়ানো স্বরে জানাতে চাইল ডেবরা। উত্তর দিতে গিয়ে খসখসে শোনাল ডেভিডের স্বর।

‘একটা সিংহ পুলের কাছে কনসার্ট করছে। ভেবেছে হয়তো তুমি পছন্দ করবে, ঘুমের মাঝে গান শুনতে চাইবে। মাথা ঘুরিয়ে নিল ডেবরা। মনে হল ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় অস্বস্তি লাগছে চোখে। কিন্তু সন্তুষ্টির স্বরে বলে উঠল, “ওহ, হ্যাঁ ভালোই লাগছে এ গর্জন। তোমার কী মনে হয় কোথা থেকে এসেছে এটা?

ফ্ল্যাশ লাইট বন্ধ করে বিছানায় তার পাশে ফিরে গেল ডেভিড।

হতে পারে দক্ষিণ দিক থেকে এসেছে। আমি নিশ্চিত বেড়ার নিচ দিয়ে এত বড় একটা গর্ত করেছে যে তুমি ট্রাক ঢুকিয়ে দিতে পারবে।

ডেবরা কাছে এগিয়ে আসায় নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাইল ডেভিড। শুনতে লাগল সিংহের গর্জন। এরপর আস্তে আস্তে দূরে চলে গেল ডাকটা। কিন্তু এরপর আর ঘুমালো না ডেভিড। হাতের উপর ডেবরার মাথা নিয়ে জেগে রইল ভোর পর্যন্ত।

এরপর আরো এক সপ্তাহ কেটে যাবার পর সাহস করে চিঠি লিখতে বসল ডেভিডঃ

ডিয়ার ডা. ইদেলমান,

আমরা একমত হয়েছিলাম যে ডেবরার চোখ বা ওর স্বাস্থ্যের কোন পরিবর্তন হলেই আপনাক জানাবো।

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যাওয়ায় মাথায় বারংবার ভারী জিনিসের আঘাত সহ্য করতে হয়েছে ওকে। এর ফলে প্রায় আড়াই দিন অচেতন অবস্থায় ও ছিল।

হাসপাতালে নিতে হয়েছিল খুলি ফেটে যাওয়ার ভয়ে। কিন্তু দশ দিন পর বাসায় নিয়ে আসতে পেরেছি। প্রায় দুই মাস আগে হয়েছে এ ঘটনা।

যাই হোক, এরপর থেকে আমি দেখছি যে আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে ওর চোখ। যেমনটা আপনি জানেন, আগে এমন হত না। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি ওর মাঝে। মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড মাথা ব্যথার অভিযোগও করে সে।

আমি একের পর এক সূর্যের আলো আর টর্চের আলো দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে শক্তিশালী আলো ফেললে ওর চোখের পিউপিল সাড়া দেয়। যেমনটা হয় যে কোন স্বাভাবিক চোখে।

এখন মনে হচ্ছে যে আপনার প্রাথমিক পরীক্ষা আরো একবার করতে হবে। কিন্তু এর উপড়েই বেশি জোর দিব আমি–এই কাজে সাবধানে এগোতে হবে আমাদেরকে। আমি কোন মিথ্যে বা ভিত্তিহীন আশা জাগাতে চাই না।

এই ব্যাপারে যে কোন পরামর্শ পেলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। আর অপেক্ষা করছি আপনার কাছ থেকে শোনার আশায়। ইতি

—ডেভিড মরগ্যান

.

ঠিকানা লিখে খামে ঢোকাল ডেভিড। কিন্তু পরের সপ্তাহে ও নেলস্প্রুটে থেকে বাজার করে ফেরার পর দেখা গেল এখনো তার চামড়ার জ্যাকেটের উপরের পকেটে রয়ে গেছে চিঠিটা।

নিরুত্তাপ শান্তভাবে কাটতে লাগল দিন। নতুন উপন্যাসের প্রথম খসড়া শেষ করলা ডেবরা। ববি ডুগান অনুরোধ করল যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় পাঁচটা শহরে বক্তৃতা দিতে যাবার জন্য। নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেস্টেসেলার লিস্টে বত্রিশ সপ্তাহ পার করেছে আ প্লেস অব আওয়ার ওন। এজেন্ট জানিয়েছে ডেবরাকে পিস্তলের চেয়েও হট লাগছে বেশি।

এ ব্যাপারে ডেভিডের মন্তব্য হল যতটা তার মনে হয় যে এর চেয়ে বেশি হট ডেবরা। ডেভিডকে লম্পট বলে গাল দিল ডেবরা। আরো জানল কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না যে ওর মতো সাধাসিধা একটা মেয়ে কেমন করে জড়িয়ে গেল ডেভিডের সাথে। এরপর এজেন্টের কাছে চিঠি লিখে বক্তৃতার ট্যুর বাতিল করে দিল।

‘মানুষকে কী দরকার?’ একমত হল ডেভিড। জানে যে তার জন্যেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডেবরা। আবার এটাও জানে যে ডেবরার মতো সুন্দরী অন্ধ, বেস্ট সেলিং লেখক কোথাও গেলে সাড়া পড়ে যাবে। আর একটা টুর হয়তো তাকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দেবে।

এর মাধ্যমে আবার টালমাটাল হয়ে গেল ওর দুনিয়া। নিজেকেই বোঝাতে চাইল যে আলোর প্রতি সংবেদনশীল মানেই এই নয় যে ডেবরা তার দৃষ্টিশক্তি আবার ফিরে পাবে। ও এখন এখানেই খুশি আছে। নিজের মতো করে পৃথিবী তৈরি করে নিয়েছে। মিথ্যে আশা বা নিষ্ঠুর একটা সার্জারি হয়ত হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।

নিজের সমস্ত চিন্তায় চেষ্টা করল ডেবরার প্রয়োজনকেই বেশি গুরুত্ব দিতে। কিন্তু আবার এও জানে যে নিজের সাথে ছলনা করছে সে। এই আকুতি জানাচ্ছে ডেভিড মরগ্যান। ডেভিড মরগ্যানেরই জন্য যদি ডেবরা তার দৃষ্টিশক্তি খুঁজে পায়—-নিজের খুশি হয়তো ধ্বংস করে ফেলবে সে।

এক সকালে জাবুলানির শেষ মাথা পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে গেল ডেভিড। এরপর কাটা গাছ ভর্তি একটা জায়গায় পার্ক করল গাড়ি। ইঞ্জিনের সুইচ অফ করে ড্রাইভিং সিটে বসে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল নিজের মুখমণ্ডল। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে পরীক্ষা করল নিজের চেহারা। মানুষ হিসেবে ভাবাই যায় না শুধু চোখ দুটো ছাড়া–এত কুৎসিত দেখতে ক্ষতবিক্ষত মুখটার প্রতি সে জানে কোন নারীই আকর্ষণ বোধ করবে না। কাছাকাছি আসতে চাইবে না, স্পর্শ করতে চাইবে না, ভালোবাসতে চাইবে না। আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরে এল ডেভিড। উচছুসিত ভঙ্গিতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল ডেবরা। তার পরনে রং-চটা ডেনিম আর উজ্জ্বল গোলাপি ব্লাউজ। ডেভিডের কাছে এসে মুখ তুলে ধরল কিস্ করার জন্য।

এই সন্ধ্যায় বারবিকিউ করার আয়োজন করল ডেবরা। গাছের নিচে আগুনের পাশ বসল দুজনে। শুনতে লাগল নিশাচর পাখিদের গান। রাতটা বেশ ঠাণ্ডা। কাঁধের উপড়ে হালকা ভাবে সোয়েটার ফেলে রেখেছে ডেবরা। নিজের ফ্লাইং জ্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ডেভিড।

বুকের কাছে রয়ে গেছে এখনো চিঠিটা। মনে হল মাংসের মাঝে গেঁথে যাবে। চামড়ায় জ্যাকেটের পকেট খুলে চিঠিটা হাতে নিল ডেভিড। পাশে বসে কলকল করে চলেছে আনন্দিত ডেবরা। হাত বাড়িয়ে রেখেছে আগুনের শিখার দিকে। হাতের মাঝে চিঠিটা আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল ডেভিড।

হঠাৎ করে মনে হল জীবন্ত একটি বিছা বা এ জাতীয় কিছু, এমন ভাবে আগুনের মাঝে হাতের চিঠিটা ছুঁড়ে মারল ডেভিড। তাকিয়ে দেখতে লাগল আগুনে পুড়ে এটা ছাই হয়ে যাবার দৃশ্য।

এত সহজে শেষ হয়ে যায়নি ব্যাপারটা। সে রাতে ঘুমাতে যাবার পর মাথার মধ্যে কেবল ঘুরতেই লাগল চিঠির কথাগুলো। এতটুকু স্বস্তি পেল না ডেভিড। চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে এলেও ঘুমাতে পারল না।

এরপর থেকে দিনের বেলা অধিকাংশ সময় চুপচাপ বসে থাকতে শুরু করল ডেভিড। বুঝতে পারল ডেবরা যে কিছু একটা হয়েছে, যদিও অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও কিছুই জানতে পারল না ভয় পেয়ে গেল সে। ভাবল ডেভিড তার সাথে রাগ করেছে। আরো বেশি করে করে ডেভিডকে ভালোবাসা দিয়ে চেষ্টা করল ব্যাপারটা ভুলিয়ে দিতে।

কিন্তু ফল হল উল্টো। নিজের কাছে আরো বেশি করে অপরাধী হয়ে গেল ডেভিড।

হতাশায় মুষড়ে উঠে এক সন্ধ্যায় যখন মুক্তোর ছড়ার কাছে একসাথে গেল দুজনে, ল্যান্ড রোভার ছেড়ে দিয়ে হাতে হাত ধরে পানির কিনারে গেল। পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ি পেয়ে পাশাপাশি বসল চুপচাপ। এই প্রথমবারের মতো মনে হলো একে অপরকে বলার মতো কোন কথা নেই।

গাছের পাতায় ডুবে গেল বিশাল লাল সূর্য। বনের ভিতর নেমে এলো সন্ধ্যা। হালকা পায়ে এগিয়ে এলো নায়লার দল। মনে হল ছায়ার মাঝে নড়াচড়া শুরু করল।

ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করল ডেভিড। কাছে এগিয়ে এসে মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল ডেবরা।

‘আজ কেন যেন বেশ সচকিত হয়ে আছে নায়লার দল। মনে হচ্ছে বৃদ্ধ। পুরুষটার নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়েছে। এত মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনছে যে স্বাভাবিকের চাইতে দ্বিগুণ লম্বা হয়ে গেছে কান। মনে হয় আশেপাশে নিশ্চয় চিতাবাঘের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে কোথাও তারপরই থেমে গিয়ে আস্তে করে চিৎকার করে উঠল।

‘ওহ এই তো এসে গেছে!

উত্তেজনায় নড়েচড়ে বসল ডেবরা। ডেভিডের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল, কী হয়েছে ডেভিড?

‘একটা নতুন শাবক! গলার স্বরে ফুটে উঠল উত্তেজনা। একটা হরিণী শাবক প্রসব করেছে। ওহ্ গড ডেবরা! এখনো পা নাড়াতে পারছে না ঠিকমত’ শাবকের বর্ণনা দিতে শুরু করল ডেভিড। মা হরিণের সাথে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। পুরো মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল ডেবরা। বোঝা গেল নিজের ভেতরের মাতৃত্বকে টের পেল। সম্ভবত ভাবতে লাগল নিজের মৃত সন্তানের কথা। ডেভিডের হাতে থাকা হাত শক্ত হয়ে গেল। সন্ধ্যার আলোতে দেখা গেল উজ্জ্বল দেখাচ্ছে মধুরঙা চোখ জোড়া। হঠাৎ কথা বলে উঠল সে। নিচু স্বরে কিন্তু পরিষ্কারভাবে ব্যথিত গলায় বলে উঠল, “আমার ইচ্ছে করছে দেখতে। ওহ গড! গড! আমাকে দেখার শক্তি দাও। প্লিজ আমি আবার দেখতে চাই। হঠাৎ করেই কাঁদতে লাগল ডেবরা। পুরো শরীর কাঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

পুলের কাছে ভয়ে পেয়ে গেল নায়লার দল। দ্রুত পালিয়ে গেল গাছের আড়ালে। ডেবরাকে ধরে শক্ত করে বুকের কাছে চেপে ধরল ডেভিড। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। চোখের পানিতে ভিজে গেল তার শার্ট আর বুকের অনেক গভীরে অনেক অনেক গভীরে ছড়িয়ে পড়ল হতাশার ঠাণ্ডা ভাব।

সেই রাতেই গ্যাসবাতির আলোয় বসে আবারো চিঠি লিখতে বসল ডেভিড। রুমের ওপাশে বসে শীতকালে ডেভিডকে দেবার জন্য জার্সি সেলাই করতে বসল ডেবরা। ভাবল ডেভিড নিশ্চয়ই এস্টেটের অ্যাকাউন্টস নিয়ে ব্যস্ত 1 ডেভিড দেখল প্রথম চিঠিটার শব্দগুলো হুবহু মনে করতে পারল সে। তাই মাত্র কয়েক মিনিটের মাঝে চিঠি লিখে খাম বন্ধ করার কাজও শেষ হয়ে গেল।

‘কাল সকালে বইয়ের কাজ করবে তুমি? হালকাস্বরে জানাল যে সে করবে। আবারো বলে চলল ডেভিড, ‘আমি এক বা দুই ঘণ্টার জন্য নেলটে যাবো।’

এত উঁচু দিয়ে উড়ে গেল ডেভিড যেন মাটিতে আর ফিরে আসতে চায় না।

নিজেও বিশ্বাস করতে পারল না যে সে সত্যিই এটা করতে চলেছে। এতটা আত্মত্যাগ করতে পারে তা তার ধারণাতেও ছিল না। অবাক হয়ে ভাবল, কেউ কী কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে যে সেই মানুষটার ভালোর জন্য ভালোবাসাটুকুও ভুলে যেতে পারবে? দক্ষিণে উড়ে যেতে যেতে বুঝতে পারল যে সে পারবে এর মুখোমুখি হতে।

আর সকলের মতো ডেবরারও অধিকার আছে পৃথিবী দেখার আর এই কারণে নিজের প্রতিভার পুরো ব্যবহার করতে পারছে না সে। যতক্ষণ পর্যন্ত না দেখবে কিছু একটা বর্ণনা করতে পারবে না সে। একজন লেখক হবার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে সে, কিন্তু এর অর্ধেক ক্ষমতাই কেড়ে নেয়া হয়েছে তার কাছ থেকে। ডেবরার কান্না বুঝতে পারল ডেভিড। ওহ গড! গড! আমি দেখতে চাই। প্লিজ আমাকে দেখতে দাও। ডেভিড নিজেও একই আকুতি জানাল মনে মনে ঈশ্বরের কাছে। প্রার্থনা করল : “প্লিজ গড, তাকে আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দাও।

এয়ারস্ট্রিপে নাভাজো নিয়ে ল্যান্ড করল ডেভিড। ট্রাক্সি নিয়ে সোজা চলল পোস্ট অফিসে। অপেক্ষা করে নিজের বক্স থেকে চিঠিও তুলে নিল।

‘এখন কোথায় যাবেন? জানতে চাইল ট্যাক্সি ড্রাইভার। আরেকটু হলে বলেই ফেলছিল এয়ারফিল্ডের কথা। তারপর মাথা নেড়ে বলে উঠল, আমাকে দোকানে নিয়ে চলুন। এক কেস ভেভ ক্লিকট শ্যাম্পেন কিনল ডেভিড।

বাসায় ফেরার পথে বেশ হালকা লাগল নিজেকে। চাকা গড়িয়ে গেছে, বলে লাথি মারা শেষ। এখন আর কিছুই করার নেই তার। আর কোন দ্বিধা নেই। অপরাধবোধ নেই। ফলাফল যাই আসুক না কেন, মেনে নেবে সে।

প্রায় তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলল ডেবরা যে কিছু একটা হয়েছে। স্বস্তির সাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠল। গলা ধরে ঝুলে পড়ল ডেভিডের বুকে।

কী হয়েছে জানতে চাইল সে।

‘সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে তুমি চুপচাপ ছিলে। চিন্তা করতে করতে আমি অসুস্থ হয়ে গেছি–আর মাত্র এক-দুই ঘন্টার জন্য বাইরে গিয়েই প্রাণশক্তি ফিলে পেলে তুমি। কী ঘটেছে মরগ্যান?

‘আমি মাত্রই বুঝতে পেরেছি যে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, ডেবরাকে জড়িয়ে ধরে জানাল ডেভিড।

‘অনেক?’ আবারো জানতে চাইল ডেবরা।

‘অনেক! অনেক!’ একমত হল ডেভিড।

‘এই তো আমার বাছা!’ হাততালি দিল ডেবরা।

খোলা হল ভেভ ক্লিকট। নিজের সাথে নিয়ে আসা চিঠিতে ববি ডুগানের চিঠি পেল ডেভিড, ডেবরার পাঠানো নতুন উপন্যাসের প্রথম চ্যাপ্টার পড়েই দারুশ আশাবাদী হয়ে উঠেছে ববি আর প্রকাশক। অগ্রিম ডেবরাকে এক লক্ষ ইউ এস ডলারের চেকও পাঠিয়ে দিয়েছে।

‘তুমি তো ধনী হয়ে গেছ!’ হাসল ডেভিড।

এর একমাত্র কারণ তুমি আমাকে বিয়ে করেছ। ভাগ্য শিকারি!’ উত্তেজনায় হাসতে লাগল ডেবরা। বুক ভরে গেল ডেভিডের।

‘ওরা এটা পছন্দ করেছে, ডেভিড।’ সিরিয়াস হয়ে উঠল ডেবরা। ওরা সত্যিই পছন্দ করেছে। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এত বড় অংকের চেক পেয়ে নিজেরে কাজের স্বীকৃতিও পেল ডেবরা।

‘এটা পছন্দ না করলে পাগল বলতে হতো তাদেরকে’, মন্তব্য করল ডেভিড।

এর পরের সপ্তাহগুলো কাটতে লাগল প্রচণ্ড আনন্দে। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ডেভিডের-সন্দেহ। দিগন্তে ঝড়ের ছায়া দেখেও মনে হল সামনে বছর খরা হবে। এরপর আরো পাঁচ সপ্তাহ কেটে যাবার পর নেলপ্রটে যাবার প্রস্তুতি নিল সে। কেননা ডেবরা অস্থির হয়ে ছিল প্রকাশকের কাছ থেকে কোন নতুন খবর এসেছে কিনা জানার জন্য। এছাড়া টাইপিং করা শেষ হলে খসড়াও দেখার প্রয়োজন আছে।

‘আমি আমার চুল কাটতে চাই, আর যদিও আমি জানি যে এটা তেমন প্রয়োজন নেই। তারপরেও ডেভিড, মাই ডার্লিং আমাদের মানুষের সাথে মেশা দরকার–মাসে অন্তত একবার তাই না?

‘এতটা দেরি হয়ে গেছে? কিছুই জানে না এমন সরল ভঙ্গীতে জানাতে চাইল ডেভিড। যদিও প্রতিটি দিন পুরোপুরি উপভোগ করতে চাইছে সে। যেন ভবিষ্যতের জন্যে স্মৃতি সঞ্চিত হয়।

বিউটি স্যালনে ডেবরাকে রেখে পোস্ট অফিসে গেল ডেভিড।

চিঠিতে ভরে আছে বক্স। তাড়াতাড়ি করে বাছাই করল ডেভিড। তিনটি এসেছে ডেবরার আমেরিকান এজেন্টের কাছ থেকে আর দু’টিতে ইস্রায়েলীয় ষ্ট্যাম্প। এ দুটি একটার খামের উপর আবার ডা. এর প্রেশক্রিপশনের ছাপ দেয়া। অবাক হয়ে গেল ডেভিড যে ঠিকঠিক ডা. এর হাতে পৌঁছেছিল চিঠিটা। দ্বিতীয় খামের উপর হাতের লেখা দেখে ভুল হবার কোন কারণ নেই। প্রতিটি শব্দ ঠিকঠিক নিয়ম মেনে লেখা। আর এমন ভঙ্গিতে যে বোঝাই গেল গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত কোন ব্যক্তির হাতের লেখা।

ডেভিড বেগুনি জাকারান্ডা গাছের নিচে বসল একটা বেঞ্চিতে, পোস্ট অফিসের পাশের পার্কে। প্রথমেই খুললো ডা, এর লেখা চিঠি। হিব্রুতে লেখা।

‘ডিয়ার ডেভিড,

তোমার চিঠি পেয়ে খুব অবাক হয়েছি আমি। এরপর এক্স-রে প্লেটগুলো আরো একবার পরীক্ষা করে দেখেছি আমি। প্রথমবারের মতোই একই কথা আবার বলতে চাইবে আমি।’

নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেন যে স্বস্তি পেল ডেভিড।

যাই হোক যদি আমি গত পঁচিশ বছর এই পেশা থেকে কিছু শিখে থাকি, তা হল নম্রতা। আমি মেনে নিচ্ছি যে তোমার পর্যবেক্ষণ ঠিক হয়েছে। তাহলে আমাকে এও মানতে হবে যে চোখের অপটিক নার্ভের একটা অংশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তার মানে নার্ভগুলো আগেই পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। আর এখন সম্ভবত ডেবরা মাথায় যে আঘাত পেয়েছে–কিছু কাজ করা শুরু করেছে অংশগুলো।

কঠিন প্রশ্ন হচ্ছে? কতটা, আর এ ব্যাপারে আমি সাবধান করতে চাই যে হয়তো বর্তমানে যা দেখছে ততটুকুই অর্থাৎ আলোর প্রতি সংবেদনশীল মানেই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া নয়। তাই এটুকু হয়তো বলা যায় যে চিকিৎসার মাধ্যমের আংশিক দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার সম্ভবনা আছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এ অংশ খুবই সামান্য। হয়তো আলো বা আকৃতির প্রতি সামান্য সাড়া পাওয়া যাবে। কিন্তু নাজুক এ অংশে যে কোন সার্জারির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে খুবই ভেবেচিন্তে।

আমি নিজের হাতে ডেবরাকে পরীক্ষা করতে চাই। কিন্তু তোমার পক্ষে এতটা আসা হয়তো সম্ভব হবে না। তাই আমি কেপটাউনে আমার একজন সহকর্মীর কাছে চিঠি লিখে দিচ্ছি। তিনি নিজেও একজন পৃথিবীখ্যাত অপটিক্যাল ট্রমা বিশেষজ্ঞ। নাম ডা, রুবেন ফ্রাইডমান। আমি আমার একটা কাগজও পাঠিয়ে দিচ্ছি। ডেবরা’র এক্স-প্লেট আর চিকিৎসার পূর্ব ইতিহাসও পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আমি সুপারিশ করব যে, তুমি ডেবরাকে ডা. ফ্রাইডম্যানের কাছে নিয়ে যাও। তাহলে তার উপর তোমার নির্ভরযোগ্যতা বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে নিশ্চিত থাকতে পারো যে গ্রুট শূর হাসপাতাল পৃথিবী বিখ্যাত এবং যে কোন চিকিৎসা দেবার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা আছে। তারা এমনকি হার্ট ট্রান্সপ্লাটও করে থাকে।

আমি তোমার চিঠি নিয়ে জেনারেল মোরদেসাই এর সাথে কথা বলব–

.

সাবধানে চিঠি ভাঁজ কলে রাখল ডেভিড। ব্রিগ’কে এর ভেতরে টানার কী দরকার ছিল? মনে মনে ভাবল ডেভিড। এরপর খুললো ব্রিগের চিঠি।

ডিয়ার ডেভিড,

ডা. ইদেলমানের সাথে কথা হয়েছে আমার। আমি কেপটাউনে ফ্রাইডম্যানের সাথে কথা বলেছি। তিনি ডেবরাকে দেখতে রাজি হয়েছেন।

কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকাতে এস.এ জিয়েনিস্ট কাউন্সিল আমাকে বক্তৃতা দেবার জন্যে ডাকছে। কিন্তু আমি যাচ্ছি না। কিন্তু আজকে তাদেরকেও চিঠি লিখে সব ব্যবস্থা করতে বলেছি। এর মাধ্যমে ডেবরাকে অজুহাত দেখিয়ে কেপ টাউনে নিয়ে আসা যাবে। তাকে বলল তোমার খামারবাড়িতে গিয়ে ওর সাথে দেখা করার মতো সময় হবে না আমার। কিন্তু তাকে দেখতে চাইছি আমি।

আমি তোমাকে পরে আমার তারিখ জানিয়ে দেব। আশা করি তখন দেখা হবে।

চিরাচরিত আদেশমূলক মনোভাব ব্রিগের মাঝে। পুরো ব্যাপারটা ডেভিডের হাতের বাইরে চলে গেছে এখন। ফিরে আসার আর কোন পথ খোলা নেই। কিন্তু সম্ভাবনা আছে যে হয়তো কোন কাজ হবে না। এই আশাই করতে চাইল সে নিজের এ স্বার্থপরতার মনোভাব দেখে হতচকিত হয়ে গেল সে। চিঠিটা উল্টে ওপর পৃষ্ঠায় ডেবরাকে পড়ে শোনানোর জন্য চিঠির খসড়া করল। খানিকটা মজা পেল এভাবে ব্রিগের ভঙ্গি নকল করতে গিয়ে।

খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ডেবরার মুখ। বাবার চিঠির কথা শুনে নিজের ভনিতার উপর খানিকটা আস্থা পেল ডেভিড।

‘বাবাকে দেখতে পাবো, অনেক মজা হবে। ইস, মাও যদি আসতো বাবার সাথে।

‘যদিও জানায়নি কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে আমার। এরপর একে একে আমেরিকা থেকে আসা চিঠিগুলো পড়ল ডেভিড। তারিখ মিলিয়ে প্রথম দুটো বার্নিং ব্রাইটের উপর সম্পাদকীয়- কিন্তু তৃতীয়টি আরেকটা শক্ত খবর বয়ে আনল।

ইউনাইটেড আর্টিস্ট, আ প্লেস অব আওয়ার ওন নিয়ে সিনেমা বানাতে চায়। সম্পত্তি ক্রয় করতে চায় বারো মাসের জন্য আর লাভের সামান্য একটা অংশ। যদি ডেবরা ক্যালিফোর্নিয়া গিয়ে স্কিনপ্লে লিখে দেয়, তাহলে চিত্রনাট্যসহ পুরো ব্যাপারটার জন্য ববি ডুগান নিশ্চিত কোয়ার্টার মিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ তৈরি হয়ে যাবে। তাই জোরে দিয়ে জানাল যেন ডেবরা পুরো ব্যাপরটা ভেবে দেখে। কেননা অনেক সময় দেখা যায় প্রতিষ্ঠিত উপন্যাস রচয়িতাগণও চিত্রনাট্য লেখার সুযোগ পায় না। তাই হালকা ভাবে না নিয়ে এ প্রস্তাব গ্রহণ করার অনুরোধ জানালো ডেবরাকে।

‘মানুষদের কী দরকার?’ তাড়াতাড়ি হেসে ফেলল ডেবরা। তারপর খুব দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল–এত দ্রুত যে ডেভিড বুঝতে পারল তার আগ্রহের কথা। তোমার কাছে আর শ্যাম্পেন আছে মরগ্যান? আমার মনে হয় আমরা সেলিব্রেশনের আরো একটা বাহানা পেয়ে গেলাম, তাই না?

‘তুমি যেভাবে এগোচ্ছ, এই জিনিসের দোকান দিতে হবে আমাকে। উত্তর দিল ডেভিড। এরপর এগিয়ে গেল রেফ্রিজারেটরের দিকে। ওয়াইন ঢালার সাথে সাথে গ্লাস পূর্ণ হয়ে গেল ফেনায়। পড়ে যাবার আগেই নিয়ে গেল ডেবরার কাছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে।

চলো, ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা করা যাক। ধরে নাও যে তুমি হলিউডে যাচ্ছো।’ ডেবরার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিল ডেভিড।

‘ভাবার কী আছে? জানতে চাইল ডেবরা। আমরা এখানেই ঠিক আছি।’

না, উত্তর দেবার আগে আরো একটু ভেবে দেখ।

কী বলতে চাও তুমি? ওয়াইনে চুমুক না দিয়েই গ্লাস নামিয়ে রাখল ডেবরা।

‘আমরা অপেক্ষা করব, যতক্ষণ পর্যন্ত না–এর বদলে বলা যায়, ব্রিগ আগে আসুক কেপ টাউনে।

‘কেন?’ বিস্মিত হয়ে গেছে ডেবরা।

কী? ঘটবে তখন?

‘কিছু না। এটা সত্যিই একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর দিল ডেভিড।

“ঠিক আছে!’ রাজি হয়ে গেল ডেবরা। এরপর গ্লাস তুলে টোস্ট করল।

‘আই লাভ ইউ।’ জানাল ডেভিডকে।

‘আই লাভ ইউ।’ প্রতি উত্তরে বলে উঠল ডেভিড। খেতে খেতে খুশিই হল যে মেয়েটার হাতে কয়েকটা পথ খোলা থাকবে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য।

আরো তিন সপ্তাহ সময় পেল ডেভিড। কেপটাউনে ব্রিগের আগমনের আগে নিজের গড়া ইডেনে ডেবরাকে নিয়ে সময় কাটানোর।

দিনগুলো কাটতে লাগল অসম্ভব আনন্দে আর মনে হলো প্রকৃতিও নিজের সব সম্পদ সৌন্দর্য ঢেলে দিল তাদের জন্য। সুন্দরভাবে বৃষ্টি হলো, শুরু হতো সন্ধায়, শেষ হত সকাল বেলা। মেঘের ভেলায় ভেসে বিদ্যুৎ চমক আর বাতাসে ভরে থাকত সারাদিন। সূর্যাস্তের সময় মেঘের ফাঁক গলে দেখা যেত নানা রঙের খেলা। রাগী সূর্যমামা তখন হয়ে যেত ব্রোঞ্জ আর কুমারীর লজ্জারাঙা মুখের মতো। রাত নেমে এলে গুরু গুরু মেঘ ডাকত। জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়ত চৌকোনা সাদা আলো। পাশে ডেভিড থাকায় নিশ্চিন্তে ঘুমোত ডেবরা।

সকালবেলা ঠাণ্ডা চারপাশে দেখা যেত উজ্জ্বল আলো। গাছগুলো বৃষ্টিতে ধুয়ে আরো সবুজ হয়ে উঠত যেন।

বন্যপ্রাণীদের জীবনে প্রাণসঞ্চার করল এই বৃষ্টি। প্রতিদিনই তাই নতুন কিছু না কিছু দেখা যেত।

মোবাহোবা গাছে তৈরি বাসা থেকে মা ঈগল নিয়ে গেল নিজের ছানাদের। এরপর ছেড়ে দিল পুলের উপরে পড়ে থাকা গাছের শাখার উপর। দিনের পর দিন বসে থেকে সাহসী হয়ে উঠল ছানা দু’টো। ঈগল দম্পত্তি শেখাতে লাগলা কীভাবে উড়তে হয়।

এরপর এক সকালে ডেভিড আর ডেবরা যখন সকালের নাস্তা করছে, পাখিদের উল্লাসিত চিৎকারে ভরে গেল চারপাশ। তাড়াতাড়ি ডেবরার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে খোলা জায়গায় নিয়ে গেল ডেভিড। চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেল চারটা বড় বড় পাখা মেলে পাখি দুটো উড়ে বেড়াতে লাগল পরিষ্কার নীল আকাশে। উত্তরে দুই হাজার মাইল দূরে জাম্বোজি নদীতে না যাওয়া পর্যন্ত মাথার উপর কিছুক্ষণ চক্রাকারে উঠে উড়াউড়ি করল পাখির দল।

কিন্তু শেষ দিনগুলোতে এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে দুজনেরই মন খারাপ হয়ে গেল। একদিন সকালবেলা উত্তর দিকে চার মাইল হেঁটে এল দু’জনে। বড় বড় লিডউড গাছ উঠে গেছে এ পথ ধরে।

বিশাল মার্শাল ঈগলের একটা জোড়া একটা লিডউড গাছকে চিহ্নিত করেছে নিজেদের মিলিত স্থান হিসেবে। স্ত্রী পাখিটা বেশ সুন্দর আর তরুণী। কিন্তু পুরুষ পাখিটা তত সুন্দর নয়। অনেক উঁচু ডালের উপর নিজেদের বাসা বানাতে লাগল এ জোড়া। কিন্তু আরো একটা পুরুষ ঈগল এসে ভেস্তে দিল কাজ। বিশাল বড়সড় অন্য একটা পুরুষ পাখি। কিন্তু নিজের সীমানাতে রইল পাখিটা প্রথম দিকে। পাহাড়ের উপর নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল। যতদূর সম্ভব নিজের অংশেই থাকার চেষ্টা করত সে। নিচে ছিল সমতল ভূমি।

ডেভিড একদিন ঠিক করল সমতল ভূমিতে যাবে। পাখির বাসার ছবি তোলার জন্য যুতসই একটা জায়গা খোঁজার জন্য। আর একই সাথে পুরুষ দু’জনের মাঝে আদিম এই বিরোধটুকুও দেখার ইচ্ছে আছে তার। ঠিক সেইদিনই ঘটল ঘটনাটা।

পাহাড়ের উপর উঠে এলো ডেভিড আর ডেবরা। পাথরের উপর বসে নিচে তাকিয়ে রইল। নিচে পড়ে রইল যুদ্ধক্ষেত্র।

পুরুষ পুরাতন পাখিটা তখন নিজের ঘরে। সাদা বুক আর মাথা নিচে নামানো। শক্তিশালী কাধ দেখা যাচ্ছে। চোখে বাইনোকুলার দিয়ে অপর পুরষ পাখিটাকে খুঁজলো ডেভিড। কিন্তু পেল না। বুকের কাছে বাইনোকুলার নামিয়ে রেখে ডেবরার সাথে খানিক গল্প করে কাটাল ডেভিড।

এরপর হঠাৎ করে পুরোনো ঈগলের দিকে চোখ পড়ল তার। হঠাৎ করেই আকাশে উঠে এল এটি। বেশ তাড়াহুড়া করে সে উড়ে চলেছে বোঝাই গেল।

প্রায় তাদের মাথায় উপর চলে এল পাখি। ডেভিড স্পষ্ট দেখতে পেল বাঁকানো ঠোঁট। আর রাজকীয় সাদা বুকে কালো রঙের ছিটে।

হলুদ ঠোঁট ফাঁক করতেই কর্কশ স্বরে ডাক বের হয়ে এলো। তাড়াতাড়ি আকাশের চারপাশে চোখ বুলালো ডেভিড। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী পাখিটাকে দেখা গেল। বেশ চতুরের মতো পরিকল্পনা করেছে সে। সূর্যের কাছে গিয়ে উঁচু ভবনের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাখা ছড়িয়ে। বৃদ্ধ পাখিটার জন্যে সমবেদনা অনুভব করল ডেভিড।

তাড়াতাড়ি উধ্বশ্বাসে ডেবরাকে পুরো ঘটনা জানাল ডেভিড। ডেরা নিজেও সহানুভূতি প্রকাশ করল বৃদ্ধ পুরুষ ঈগলের প্রতি।

আমাকে বলো কী হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল ডেবরা।

শান্ত হয়ে অপেক্ষা করছে কম বয়সী পাখিটা। মাথা ঝুঁকিয়ে শত্রুর পদক্ষেপ দেখছে।

‘এই তো এসে গেছে! আড়ষ্ট হয়ে গেল ডেভিডের গলা। নেমে আসছে। কম বয়সী শিকারি পাখিটা।

‘আমি শুনতে পাচ্ছি ওকে।’ ফিসফিস করে উঠল ডেবরা, পাখার বাতাস কাটার হিসহিস শব্দ পরিষ্কার ভাবে শুনতে পেল তারা। কম বয়সী পাখিটা বৃদ্ধ পাখির গায়ের উপর ডাইভ দেয়ার সাথে সাথে মনে হল শুকনো ঘাসে আগুন লেগে যাবার শব্দ হল।

বাম পাশে! গো! গো!

ডেভিড এমন ভাবে বৃদ্ধ ঈগলের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল, যেন সে তার উইংম্যান। আর ডেবরার হাতে চাপ দিতে লাগল। মনে হল ওর কথা শুনতে পেল পাখিটা। পাখা খানিকটা ভাজ করে চলে এল সে পথ ছেড়ে। তার পাশ দিয়ে উড়ে গেল কম বয়সী পাখিটা।

ধরো ওটাকে! চিৎকার করে উঠল ডেভিড ‘আবার মোড় নেবার সময় ওকে ধারো! এখনি!

গাছের মাথার দিকে উড়ে গেল কম বয়সী পাখিটা। পাখা ঝাঁপটে চেষ্টা করল না পড়ে যেতে। তাড়াতাড়ি মোড় ঘুরে চেষ্টা করল শত্রুকে এড়াতে। এই ফাঁকে হঠাৎ করে এগিয়ে এলো বৃদ্ধ পাখিটা। আর আঘাত করল।

পাহাড়ে বসে থাকা দর্শনার্থীরা পরিষ্কার ভাবে দেখতে পেল মুহূর্তটা। মনে হল বিস্ফোরণ ঘটেছে। এমন ভাবে উড়তে লাগল সাদা পাখার স্তূপ। পাখনা থেকে কালো পালক আর বুক থেকে সাদা।

নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরল বৃদ্ধ পাখিটা, কম বয়সী পাখিটাকে একে অন্যের পাখা নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগল। বাতাসে ভাসতে লাগল পালক।

এভাবেই পাখি দু’টি পড়ে গেল লিডউড গাছের মাথায়। এরপর অবশেষে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল।

ডেবরাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি কী ঘটেছে দেখতে গেল ডেভিড।

‘দেখতে পাচ্ছো?” উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল ডেবরা। নিজের বাইনোকুলার ফোকাস করল ডেভিড।

‘দু’জনেই ফাঁদে পড়ে গেছে। ডেভিড জানলো ডেবরাকে। বৃদ্ধ পাখিটা নখ দিয়ে ওপরটার পিঠ খামচে ধরেছে। আর ছোটাতে পারেনি। একে অন্যের সাথে জড়াজড়ি করতে করতে গাছের নিচে নেমে এসেছে।

পাহাড়ের মাঝে ভেসে বেড়াতে লাগল তীক্ষ্ণ চিৎকার। লিডউডের উপরে উদ্বিগ্ন ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে স্ত্রী পাখিটা। যুদ্ধের শব্দের সাথে যুক্ত হল তার কিচির-মিচির। কম বয়সী পাখিটা মারা যাচ্ছে। লেন্সের মাঝে দিয়ে পরীক্ষা করে বলল ডেভিড। দেখতে পেল হলুদ ঠোঁট বেয়ে সাদা বুকের উপর রুবি পাথরের মতো পড়ছে বিন্দু বিন্দু রক্তের ফোঁটা।

‘আর বৃদ্ধ পাখিটা—’ মুখ উপরে তুলে শব্দ শুনতে লাগল ডেবরা। চিন্তায় কালো ছায়া জমেছে চোখে। নখগুলো আলগা করতে পারছে না। আপনাতেই আটকে গেছে নখগুলো। সে ও মারা যাবে। তুমি কিছু করতে পারো না? ডেভিডের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল ডেবরা। ওকে সাহায্য করো।

আস্তে আস্তে ডেবরাকে বোঝাতে চাইল ডেভিড যে পাখিগুলো একে অন্যের সাথে মাটি থেকে সত্তর ফিট ওপরে যুদ্ধ করছে। লিউডের মাথা বেশ মৃসণ আর প্রথম পঞ্চাশ ফিটের মাঝে কোন ডালপালা নেই। সারাদিন লেগে যাবে পাখিগুলোর কাছে পৌঁছাতে আর তাতেও লাভ হবে বলে মনে হয় না।

আর যদি কেউ ওদের কাছে পৌঁছাতেও পারে ডার্লিং, এগুলো বেশ হিংস্র। এই তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে চোখ তুলে নিবে বা হাড় থেকে মাংস। প্রকৃতি তার মাঝে অনাধিকার প্রবেশ পছন্দ করে না।

‘কিছুই করার নেই আমাদের? আকুতি জানালো ডেবরা।

হ্যাঁ। আস্তে করে উত্তর দিল ডেভিড।

‘আমরা সকালবেলা ফিরে এসে দেখব এটা নিজেকে উদ্ধার করতে পেরেছে কিনা। নয়তো আমাদের সাথে আনা বন্দুক কাজে লাগাতে হবে।’

সকালবেলা আবারো একসাথে লিডউডের কাছে এল দু’জনে। কমবয়সী পাখিটা মারা গেছে। কিন্তু বৃদ্ধ পাখিটা এখনো বেঁচে আছে। নখ এখনো অপর পাখিটার মৃতদেহে আটকে আছে। কিন্তু চোখ জ্বলছে হলুদ শিখার মতো। ডেভিডের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে মাথা নেড়ে ঠোঁট ফাঁক করে চিৎকার করে উঠল।

নিজের শটগান লোড করল ডেভিড। ব্যারেলে চোখ দিয়ে তাকাল বৃদ্ধ পাখিটার দিকে।

তুমি একা নও, বন্ধু, চিন্তা করল সে। কাঁধে বন্দুক তুলে পরপর দুবার গুলি ছুড়ল। রক্ত ঝরে পড়তে লাগল ফোঁটায় ফোঁটায়। ওভাবে পাখিটাকে রেখে চলে এল তারা। ডেভিডের মনে হল এই বিস্ফোরণে তার নিজের একটা অংশ উড়ে গেল। আর এর ছায়া পড়ল পরবর্তী উজ্জ্বল দিনগুলোতে।

কয়েকটা দিন খুব দ্রুত কেটে গেল। যখন একেবারে যাওয়ার সময় কাছে চলে এসেছে ডেবরাকে সাথে নিয়ে জাবুলানিতে ঘুরে বেড়াল ডেভিড। সব বিশেষ জায়গাগুলোতে ভ্রমণ করল। খুঁজে খুঁজে বের করল প্রতিটি দলকে বা বিভিন্ন বন্য জন্তুকে। মনে হল যেন বিদায় নিল বন্ধুদের কাছ থেকে। সন্ধ্যায় এলো পুলের পাশে। অদ্ভুত বেগুনি আর মেটে গোলাপি রং নিয়ে পৃথিবী থেকে সূর্যের বিদায় না হওয়া পর্যন্ত বসে রইল দু’জনে। এরপর মাথার উপরে গুনগুন শুরু করল মশার ঝাঁক। হাতে হাত রেখে অন্ধকারে ঘরে ফিরে এলো তারা।

রাতের বেলা ব্যাগ গুছিয়ে সিঁড়ির কাছে রেখে দিল। যেন যাবার সময় তাড়াহুড়া না হয়। এরপর বারবিকিউর আগুনের পাশে বসে শ্যাম্পেন পান করল। ওয়াইনের প্রভাবে হালকা হয়ে গেল মূড। আফ্রিকার রাতের মাঝে নিজেদের ছোট্ট দ্বীপে বসে হাসতে লাগল দু’জনে। কিন্তু ডেভিডের কাছে মনে হল বিদায় ঘণ্টা বাজছে কোথাও।

খুব সকাল বেলা ল্যান্ডিং স্ট্রিপ থেকে টেক অফ করল এয়ারক্রাফট। এস্টেটের উপর দিয়ে দু’বার ঘুরে এলো ডেভিড। এরপর আস্তে আস্তে উঠে গেল উপরে। সবুজের বিভিন্ন রঙের মিশেল নিয়ে ভরে উঠেছে বন। উত্তরের অঞ্চল থেকে একেবারে আলাদা। বাসার উঠানে দাঁড়িয়ে আছে ভৃত্যের দল। চোখে হাতচাপা দিয়ে হাত নাড়ল তাদের উদ্দেশে। মাটিতে দীর্ঘ ছায়া পড়ল মানুষগুলোর। কোর্স ঠিক করল ডেভিড।

‘কেপটাউন, আসছি আমরা’, বলে উঠল। সে হেসে তার উরুর উপর হাত রাখল ডেভিড।

মাউন্ট নেলশন হোটেলে সুইট ভাড়া করা হল তাদের জন্য। প্রাচীন একটা অভিজাত্য আছে এ স্থানটার। সাথে আছে চওড়া বাগান আর আধুনিক কাঁচ ঘেরা জায়গা সি পয়েন্টের উপরে। দুই দিন স্যুইটে রইল তারা। অপেক্ষা করল ব্রিগের আগমনের জন্য। মানুষের ভীড়ে না আসাটাই অভ্যেস হয়ে গেছে ডেভিডের জন্য। তাই চোরাচাহনি আর দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে বলা মন্তব্য হজম করতে কষ্টই হলো তার।

দ্বিতীয় দিনে পৌঁছালো ব্রিগ। স্যুইটের দরজায় টোকা দিল। এরপর নিজের স্বভাবসুলভ গটগট ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকে এলো। আগের তুলনায় কৃশকায়, শক্ত আর বাদামী হয়ে গেছে ভদ্রলোক। যেমন স্মরণ করতে পারল ডেভিড। পিতা-কন্যা অলিঙ্গন করল পরস্পরকে। এরপর ব্রিগ তাকাল ডেভিডের দিকে। শুকনো চামড়ার মতো হাত দিয়ে করমর্দন করল–কিন্তু মনে হল নতুন এক ধরনের হিসেব কষা চাহনি দিয়ে পরিমাপ করল ডেভিডকে।

ডেবরা গোসল সেরে সন্ধ্যার জন্যে তৈরি হয়ে নিল। ডেভিডকে নিজের স্যুইটে জেকে নিল ব্রিগ। কিছু না জিজ্ঞাসা করেই ড্রিংকস হিসেবে হুইস্কি নিল ডেভিডের জন্য। ডেভিডের হাতে গ্লাস দিয়েই নিজের ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিল।

রিসেপশনে থাকবে ফ্রাইডম্যান। আমি ডেবরার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেব। কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ দেব। এরপর ডিনার টেবিলে ডেবরার পাশেই বসবে সে। এর ফলে পরবর্তীতে চেকআপে রাজি হবে ডেবরা।

আমরা এর বেশি এগোনের আগে স্যার, বাধা দিয়ে উঠল ডেভিড, “আমি আপনার নিশ্চয়তা চাই যে কখনোই ডেবরাকে এ আশ্বাস দেয়া হবে না যে ও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে।’

“ঠিক আছে।

‘আমি বলতে চাইছি কখনোই না। এমনকি ফ্রাইডম্যান যদি নিশ্চিত হয় ও যে সার্জারি দরকার, এর অন্য কোন কারণ থাকবে, দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া নয়।’

‘আমার মনে হয় না এটা সম্ভব। রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল ব্রিগ। যদি ঘটনাটা এতদূর এগোয় তাহলে ডেবরাকে জানাতেই হবে। এটা ঠিক হবে না।

এবার রেগে ওঠার পালা ডেভিডের। যদিও তার সুখের বরফের মতো জমে থাকা মাংসপেশী এতটুকু পরিবর্তন হল না। ঠোঁটবিহীন মুখ ফ্যাকাশে হয়ে চোখে নীল আলো জ্বলে উঠল।

‘আমাকে ভাবতে দিন যে কোনটা ঠিক। আমি তাকে যতটা জানি ততটা আপনি জানেন না। আমি জানি ও কী ভাবে, কীভাবে চিন্তা করে। কী অনুভব করে। যদি আপনি তাকে দৃষ্টিশক্তির সুযোগ দেন তাহলে প্রথমে আমি যে উভয় সংকটে পড়ে গিয়েছিলাম ওর মাঝেও তা তৈরি হবে। আমি তা চাই না।’

‘আমি বুঝতে পারছি না। শক্ত ভাবে জানাল ব্রিগ। দু’জনের মাঝে বৈরিতা এমন হল যে মনে হল রুমের মাঝে ব্ৰজপাতসহ বৃষ্টি শুরু হবে।

তাহলে শুনুন। চোখ বন্ধ করল ডেভিড। চায় না এই বৃদ্ধ সৈনিকের ভ্রুকুটি সহ্য করতে। আপনার মেয়ে আর আমি এক অসাধারণ আনন্দের খোঁজ পেয়েছি।

মাথা নেড়ে স্বীকার করল ব্রিগ। হ্যাঁ, এ ব্যাপারে তোমার সাথে একমত আমি। কিন্তু এটা কৃত্রিম। এটা হচ্ছে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। সত্যিকারের পৃথিবীর সাথে এর কোন যোগাযোগ নেই। এটা স্বপ্নিল ভুবন।’

রাগের চোটে মনে হল বোধ-বুদ্ধি গুলিয়ে ফেলবে ডেভিড। সে চায় না। কেউ ডেবরা আর তার জীবন নিয়ে প্রভাবে কথা বলুক কিন্তু একই সাথে যুক্তি দিয়েও ব্যাপারটা বুঝল সে। আপনি এভাবে বলতেই পারেন স্যার। কিন্তু ডেবরা আর আমার জন্য সত্যি স্যার। এর অসম্ভব মূল্য আছে আমাদের কাছে।’

চুপ করে রইল ব্রিগ।

‘আমি আপনাকে সত্যি বলছি অনেক আগেই আমি টের পেয়েও আমার নিজের কথা ভেবে

‘এখনো সভ্যভাবে কথা বলছে না তুমি। ডেবরার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া তোমাকে কীভাবে প্রভাবিত করবে?

‘তাকান আমার দিকে। নরম ভাবে বলে উঠল ডেভিড। হিংস্রভাবে তাকাল ব্রিগ। আশা করল অনেক কিছু। কিন্তু দেখল কিছুই ফুটে উঠল না ডেভিডের মুখে। এরপর চোখ ফিরিয়ে নিল সে। প্রথম বারের মতো সত্যিকার অর্থে দেখতে পেল ক্ষত-বিক্ষত বিভৎস মুখ। মানবিক কোন আকুতি নেই। হঠাৎ করেই বুঝতে পারল ডেভিডের কথা। অথচ প্রথম থেকে শুধুমাত্র মেয়ের কথাই ভেবে এসেছেন।

চোখ নামিয়ে হুইস্কির গ্লাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্রিগ।

যদি আমি তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারি, আমি তা করব। যদিও এটা আমার জন্য বেশ মূল্যবান হয়ে যাবে। ওকে এটা নিতে হবে।

ডেভিড বুঝতে পারল তার গলা কাঁপছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস আছে যে ও আমাকে এতটাই ভালোবাসে যে এটা ফিরিয়ে দেবে। যদি তাকে অপশন দেয়া হয়। কিন্তু এই সুযোগে আমি তাকে বিমর্ষ হতে দিতে চাই না।’

গ্লাস তুলে গভীরভাবে চুমুক দিল ব্রিগ। লম্বা চুমুকে একেবারেই গলায় ঢাললো অনেকটুকু।

‘যেমন তোমার ইচ্ছে। অবশেষে রাজি হল ব্রিগ। হতে পারে হুইস্কির প্রভাব। কিন্তু এমন এক গলায় কথা বলে উঠল বিগ যা আগে কখনো শোনেনি ডেভিড।

ধন্যবাদ, স্যার। নিজের গ্লাস নামিয়ে রাখল ডেভিড। এখনো একটুও ছোঁয়ানি। যদি আপনি কিছু না মনে করেন আমি বেশ বদল করে আসি।’ দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। ডেভিড!’ ডেকে উঠল ব্রিগ! ফিরে তাকাল সে।

গোঁফের ফাঁকে ঝিক করে উঠল স্বর্ণের দাঁত। অদ্ভুত অস্বস্তি মেশানো হাসি হাসতে লাগল ব্রিগ।

‘তুমি পারবে। জানাল সে।

.

হিরেনগ্রাচ হোটেলের ব্যানকোয়েট রুমে হল রিসেপশন। এলিভেটরে একসাথে চড়ে বসল ডেভিড আর ডেবরা। অনুভব করল কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত ডেভিড। ওর হাতে চাপ দিল ডেবরা।

‘আজ রাতে আমার কাছাকাছি থেক। ফিসফিস করে জানাল সে। আমার তোমাকে দরকার। ডেভিড বুঝতে পারল ওর মনোসংযোগ অন্য দিকে হটাতে এ কথা বলল ডেবরা। মেয়েটার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল সে। ঝুঁকে পড়ে নিজের গাল দিয়ে ডেবরার গালে স্পর্শ করল সে।

ডেবরার এলোমেলো চুল নরম আর ঘন, চকচক হয়ে আছে–সূর্যের আলো পড়ে সোনালি দেখাচ্ছে মুখমণ্ডল। সবুজ রঙের সাধারণ একটা পোশাক পরেছে। মেঝে ছুঁয়েছে পাড়। হাত আর কাধ খোলা। শক্তিশালী কিছু মসৃণ। বিশেষ একধরনের চিক্কন ভাব সবসময় দেখা যায় মেয়েটার গাত্রবর্ণে।

খুবই কম মেকআপ করেছে ও, ঠোঁটে শুধুমাত্র একটুখানি ছোঁয়া। চোখের শান্ত আর স্নিগ্ধ ভাবটাই আলো ছড়িয়েছে সাদা দেহে। আর এই সাহস সঞ্চারিত হল ডেভিডের মাঝেও। রুম ভর্তি মানুষের মাঝে পা দিল তারা।

বেশ ভালোই লোক সমাগম হয়েছে চারপাশে। দামী-দামী সিল্ক আর গহনা পরে এসেছে নারীরা, গাঢ় রঙের স্যুট পরে পুরুষেরা, শরীরে এমন একটা ভারী ভাব যে ঘোষণা করছে তাদের অর্থ-বিত্তের পরিমাণ। সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিগ। সিভিলিয়ান স্যুট পরা থাকলেও মনে হচ্ছে সুন্দর সব পাখির ভীড়ে একটা চিল।

রুবেন ফ্রাইডম্যানকে সাথে করে নিয়ে এসে ডেভিড আর ডেবরার সাথে স্বাভাবিক ভঙ্গীতে পরিচয় করিয়ে দিল ব্রিগ। ছোটখাটো হলেও ভারী শরীর ডা, ফ্রাইডম্যানের। শরীরের তুলনায় মাথাটা আরো বড়। চুল ছোট করে কাটা, লেপ্টে আছে গোলকার খুলিতে। কিন্তু এক নজরেই লোকটাকে ভাল লেগে গেল ডেভিডের। ডাক্তারের চোখ দুটো পাখির মতো শ্যেন আর হাসি দেখে বোঝা গেল যে কোন কিছুর জন্য সদা প্রস্তুত সে। বাড়ানো হাতে উষ্ণতা আছে, কিন্তু শক্ত আর দৃঢ়, ডেবরাও বোঝা গেল পছন্দ করেছে তাকে। কেননা কণ্ঠের দৃঢ়তা আর ব্যক্তিত্বের উষ্ণতা অনুভব করে হাসল।

ডিনারে যাবার পথে ডেভিডের কাছে জানতে চাইল ডেবরা যে ডা. দেখতে কেমন। হেসে ফেলল যখন বর্ণনা দিল ডেভিড।

‘ঠিক একটা কোলা ভালুকের মতো। মাছের পদগুলো আসার আগপর্যন্ত হাসিমুখে কথা বলতে লাগল দু’জনে। ফ্রাইডম্যানের স্ত্রী কৃশকায় মহিলার চোখে চশমা। সুন্দরীও না আবার একেবারে সাদামাটা নয়। কিন্তু স্বামীর মতোই বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে আগে বেড়ে ডেভিডকে আর ডেবরাকে বলল আগামীকাল আমাদের বাসায় লাঞ্চে এসো। অবশ্য যদি এক দঙ্গল দুষ্ট ছেলেমেয়েকে সহ্য করতে পারো।

‘আমরা আসলে উত্তর দিল ডেবরা। কিন্তু হঠাৎ করে ডেভিডের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল।

‘আমরা কী যাবো?’ ডেভিড একমত হতেই পুরোনো বন্ধুর মতো হাসতে লাগল দু’জনে। চুপচাপ ডেভিড ভাবতে লাগল চারপাশের তুলনায় কেমন একা বোধ করছে সে। জানে যে এসবই ভনিতা। হঠাৎ করে আরো খারাপ লাগল চারপাশে মানুষের চিৎকার আর বাসন-কোসনের শব্দ। ইচ্ছে হল নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে রাতের নিস্তব্ধতা অনুভব করতে।

এরপর অনুষ্ঠানের সঞ্চালক উঠে গিয়ে স্পিকারে নাম ঘোষণা করল। স্বস্তি পেল ডেভিড।

সূচনা বক্তব্য হল সাধারণ আর পেশাদার কথাবার্তায় পূর্ণ। একটা কৌতুক শুনে আবার হাসির রোল উঠল চারপাশে। কিন্তু এখানে সারবস্তু কিছু ছিল না। পাঁচ মিনিট পরে আর কিছুই মনে থাকবে না যে কী বলা হয়েছিল।

এরপর উঠে এলো ব্রিগ। চারপাশে তাকিয়ে ডেভিড বুঝতে পারল সে ব্রিগের দৃষ্টি দেখে শান্ত হয়ে এলো ধনীদের দল। সবাই আসলে উপভোগ করতে শুরু করল। অদ্ভুত এক ধরনের আনন্দ পেল সকলে। কেননা তাদের বিশ্বাস আর অস্তিত্বের ভিত্তি নিয়ে কথা বলা শুরু করল ব্রিগ। যা একধরনের গভীর আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত করল সকলের সামনে। তাদের একজন হয়েও ভিন্ন, ব্রিগ। মনে হল যেন পুরো জাতির অহমিকা আর শক্তি ধারণ করছে ব্রিগ নিজের মাঝে।

এমনকি বৃদ্ধ সৈনিকের মুখ নিঃসৃত বাণী শুনে ডেভিড নিজেও বেশ অবাক হয়ে গেল। পুরো কক্ষ জুড়ে অনুভূত হলো তার উপস্থিতি। মনে হল কখনো পরাজিত হবে না সে, মৃত্যু হবে না তার। নিজের অনুভূতি চাঙ্গা হয়ে উঠছে বুঝতে পারল ডেভিড, তার নিজের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। মনে হল কোন এক বন্যায় ভেসে চলেছে সে।

কিন্তু সবকিছুর জন্যই মূল্য দিতে হবে। এক ধরনের মূল্য হল সব সময় সজাগ থাকা, প্রস্তুত থাকা, আমাদের সবাইকে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে যা আমাদের তাকে রক্ষা করার জন্য। আর আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে যা প্রয়োজন সে আত্মত্যাগ করার জন্য। এটা হতে পারে জীবন, হতে পারে আমার প্রিয় কিছু।

হঠাৎ করেই ডেভিড বুঝতে পারল যে ব্রিগ আসলে তাকে লক্ষ্য করেই বলেছে কথাগুলো। একে অন্যের দিকে তাকাল দু’জনে। ব্রিগ চাইছে তাকে সাহসী করে তুলতে, উৎসাহ দিতে–কিন্তু উপস্থিত অন্যরা নিশ্চয়ই এর ভিন্ন অর্থ করবে।

সবাই তাকিয়ে দেখল ডেভিড আর ব্রিগের চাহনি। তাদের অনেকেই জানে যে ডেবরার অন্ধত্ব আর ডেভিডের কুৎসিত মুখমণ্ডল যুদ্ধের ফসল। আত্মত্যাগ বলতে ব্রিগ কী বুঝিয়েছে তা বুঝতে পারল না কেউ, একজন তো আবার হাততালিই দিতে শুরু করল।

তৎক্ষণাৎ অন্যরাও শুরু করল। প্রথমে আস্তে তারপর হঠাৎ করে সবাই ভীষণ গর্জনের মতো করে উঠল। হাততালি দিতে দিতে ডেভিড আর ডেবরার দিকে তাকাল সকলে। মাথা ঘুরিয়ে অন্যরাও তাকাতে লাগল। চেয়ার সরিয়ে নারী-পুরুষ আসতে লাগল তাদের দিকে। হাসিমুখে হাততালি দিচ্ছে সকলে। সবাই উঠে দাঁড়াল।

পুরো ব্যাপরটা কী ঘটছে বুঝতেই পারল না ডেবরা। হঠাৎ করে ওর হাত ধরে টানতে লাগল ডেভিড। বলে উঠল, “চলো এখান থেকে, তাড়াতাড়ি। সবাই দেখছে। সবাই আমাদেরকেই দেখছে’।

ডেভিডের হাত কাঁপছে অনুভব করল ডেবরা, এহেন আচরণে কৌতূহলী হয়ে উঠল অন্যরা।

‘চলো, চলে যাই।’ ভেতরে ভেতরে কেঁদে উঠল ডেবরা, ডেভিডের জন্য। অনুসরণ করল ডেভিডকে। বুঝতে পারল ডেভিডের ক্ষত-বিক্ষত মুখের উপর সেঁটে আছে চোখগুলো। কিছুই করার নেই ডেভিডের।

এমনকি নিজের স্যুইটে ফেরার পরেও জ্বরতপ্ত রোগীর মতো কাঁপতে লাগল ডেভিড।

‘বাঞ্চোত কোথাকার। ফিসফিস করে উঠল ডেভিড। গ্লাসে ঢেলে নিল হুইস্কি। ক্রিস্টাল গ্লাসের কিনারায় লেগে ঠাশ ঠাশ শব্দ করতে লাগল বোতল।

‘শয়তান বাঞ্চোত, কেন এরকম করেছে আমাদের সাথে?

‘ডেভিড’, এগিয়ে এসে ডেভিডের হাত ধরল ডেবরা। সে আঘাত করার জন্য এটা বলেনি। আমি জানি যে ভালোটাই বোঝাতে চেয়েছে। আমার মনে হয় সে বোঝাতে চেয়েছে যে সে তোমাকে নিয়ে গর্বিত।

ডেভিডের মনে হল উড়ে চলে যেতে জাবুলানিতে নিজের গৃহে। বহু কষ্টে নিজেকে থামিয়ে গেল। কেননা ইচ্ছে হল ডেবরাকে বলতে ‘চলো আমরা চলে যাই। সে জানে শোনার সাথে সাথে তাই করবে ডেবরা। নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু করল ডেভিড। যেন কোন শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে সে।

হুইস্কির স্বাদ মনে হল ধোয়াটে। পালিয়ে যেতে একটুও সাহায্য করল না। তাই প্রাইভেট বারের উপর ঠক করে রেখে দিল গ্লাস। এরপর ফিরে তাকাল ডেবরার দিকে।

‘হ্যাঁ। ডেভিডের মুখের কাছে এসে ফিসফিস করল ডেবরা। হ্যাঁ, মাই ডার্লিং, এটাই সত্যি।’ বোঝা গেল নারী হিসেবে তার স্বার্থকতা অনুভব করল সে। ডেভিডকে শান্ত করতে পেরে তৃপ্তি পেল। যেমনটা সে সবসময় করে থাকে। ঝড়ের সময় উড়ে যায় ডেভিডকে নিয়ে। নিজের বন্যভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দেয় সবকিছু। অবশেষে শান্তির নীড়ে ফিরে আসে দুজনে।

ডেবরাকে ঘুমন্ত রেখে বিছানায় জেগে উঠে বসল ডেভিড। ফ্রেঞ্জ উইন্ডো দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে রুপালি চাঁদ। মেয়েটার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড। কিন্তু এর পরেও মন ভরলো না তার। আস্তে করে বিছানার পাশের আলো জ্বালালো।

ঘুমের মাঝেও নড়ে উঠল ডেবরা। হালকা শব্দ করে উঠল। চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিল ঘুম জড়ানো হাতে। নিজের ক্ষতির পরিমাণ অনুভব করল ডেভিড। সে জানে আলো জ্বালাতে গিয়ে একটুও শব্দ করেনি সে বা বিছানা থেকে নড়েওনি। তার মানে কোন সন্দেহই নেই যে আলো নিজেই মেয়েটাকে বিরক্ত করেছে—আর এবার এমনকি ভালোবাসাতেও মন বসল না তার।

.

রুবেন ফ্রাইডম্যানের আবাসও তার মতোই বিখ্যাত। সমুদ্রের কাছেই তৈরি বাড়ির লন নেমে গেছে বীচের দিকে। সুইমিং পুলের চারপাশে বড়সড় সবুজ মিল্কহুত গাছ। আরো আছে প্রশস্ত কাবানা ও বারবিকিউ জায়গা। ম্যারিয়ন ফ্রাইডম্যানের ছেলেমেয়ের দল ঘরে নেই। কেবল ছোট দু’জন আছে। কয়েক মিনিট ভয়ার্ত চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে। কিন্তু সাথে সাথে মায়ের বকুনি খেয়ে উড়ে গেল সুইমিং পুলের কাছে। ব্যস্ত হয়ে গেল নিজেদের খেলায়।

আরো একটা বক্তৃতার অনুষ্ঠানে গেছে ব্রিগ। তাই তারা চারজন বস্তুত একা। খানিকক্ষণ পরেই সহজ হয়ে গেল চারপাশ। রুবেন একজন ডাক্তার। কোন না কোন ভাবে এ বোধ হালকা হতে সাহায্য করল ডেভিড আর ডেবরাকে। নিজের এ মন্তব্য প্রকাশ করল ডেবরা। যখন তাদের আঘাত নিয়ে কথা বলা শুরু করল রুবেন। স্বরে জানতে চাইল।

‘এটা নিয়ে কথা বলতে খারাপ লাগবে তোমার?

না। আপনার সাথে না। একজন ডাক্তারের সামনে নিজেকে মেলে ধরা সহজ।’

‘এরকম করো না মাই ডিয়ার। ম্যারিয়ন সাবধান করে দিল। রুবির দিকে না–তাকাও আমার দিকে, ছয়জন ছেলেমেয়ে ইতিমধ্যে।’ হেসে ফেলল সবাই।

আজ সকলেই বাইরে গিয়ে স্বচ্ছ পানি থেকে নিয়ে এসেছে অর্ধডজন ক্রে ফিশ। পাথরের খাঁজে থাকা এ অংশকে নিজের ব্যক্তিগত ফিশিং গ্রাউন্ড বলতে ভালবাসে রুবেন।

তারপর কেল্কা পাতা দিয়ে মুড়ে কয়লার উপর স্ট্রিম করা হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত না বেগুনি রঙের হয়ে উঠেছে মাছগুলো। মাংস হয়ে উঠেছে সাদা আর তুলোর মতো নরম, সুস্বাদু।

‘এখন, এটা যদিও না হয় তোমার দেখা সবচেয়ে মজার চিকেন রেসিপি শেলফিশ হাতে নিল রুবেন। খেয়ে সকলেরই মনে হবে যে এর দুই-পা আর পালক আছে।

ডেভিড স্বীকার করতে বাধ্য হল যে এতটা মজার ডিশ কখনো খায়নি সে আগে। এরপর ড্রাই কেপ রিজলিং দিয়ে খেতে খেতে আরেকটার জন্য হাত বাড়ালো সে। ডেবরা আর সে দুজনেই আনন্দ পেল ব্যাপারটাতে। এরপর নিজের আসল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল রুবেন।

ডেবরার দিকে ঝুঁকে ওয়াইন গ্লাস পূর্ণ করে দিল। এরপর জানতে চাইল।

কতদিন আগে তোমার চোখ শেষ চেকআপ করেছে, ডিয়ার?’ আস্তে হাত রাখল ডেবরার চিবুকে। এরপর তাকাল মেয়েটার চোখের দিকে। নড়ে উঠল ডেভিড। তাড়াতাড়ি চেয়ার ঘুরিয়ে মনোযোগ দিয়ে তাকাল ডেবরার দিকে।

ইস্রায়েল ছাড়ার পরে আর নয়। যদিও হাসপাতালে থাকাকালীন কয়েকবার এক্স-রে করা হয়েছে।

‘কোন মাথা ব্যথা? জানতে চাইল রুবেন। মাথা নাড়ল ডেবারা, চিবুক থেকে হাত নামিয়ে নিল রুবেন।

‘আমার মনে হয় তোমার চোখজোড়া আমার সব কাজ নষ্ট করে দেবে। যাই হোক মাঝে মাঝেই পরীক্ষা করা উচিৎ। দুই বছর অনেক বড় সময়। এছাড়া তোমার মাথা ভর্তি হয়ে গেছে বিদেশী জিনিসে।

‘আমি এর সম্পর্কে কখনো ভাবিনি। আস্তে করে নিজের কপালের ক্ষতের দাগে হাত বোলালো ডেবরা। নিজের উপর অস্বস্তি হলো ডেভিডের। কেননা এ ষড়যন্ত্রে তারও অংশ আছে।

‘এতে কোন ক্ষতি হবে না ডার্লিং। এখানে যখন এসেই পড়েছি, রুবি একবার পরীক্ষা করে দেখুক না হয়। ঈশ্বর জানে পরে আবার কখন সুযোগ পাবো।

‘ওহ ডেভিড, উড়িয়ে দিতে চাইল ডেবরা ব্যাপারটাকে। আমি জানি তুমি ঘরে ফেরার জন্য পাগল হয়ে আছ। আমিও।

‘আরেকটা দিন বা দুই দিন এমন কোন সমস্য হবে না। এখন আমরা যেহেত চিন্তা করছি। পরে আরো বেড়ে যাবে চিন্তা।

রুবির দিকে তাকাল ডেবরা। কতক্ষণ লাগবে?

‘একদিন। সকালে একটা পরীক্ষা করব। তারপর সন্ধ্যায় কয়েকটা এক্স-রে।

কত তাড়াতাড়ি দেখতে পারবেন তাকে?’ জানতে চাইল ডেভিড। এমন ভাবে বলল যেন কিছু জানে না সে। অথচ ঠিকই জানে যে পাঁচ সপ্তাহ আগেই ঠিক করা হয়েছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

“ওহ, আমি ভাবছি কালই। যদিও একটু তাড়াহুড়া হয়ে যায়, কিন্তু তোমাদের কথা ভিন্ন।

হাত বাড়িয়ে ডেবরার হাত ধরল ডেভিড। ঠিক আছে ডার্লিং?

“ঠিক আছে। একমত হল ডেবরা।

 ৮. পোতাশ্রয়ের উপরে সুউচ্চ টাওয়ারে

পোতাশ্রয়ের উপরে সুউচ্চ টাওয়ারে অবস্থিত মেডিকেল সেন্টারে রুবেনের কলটিং রুম। টেবিল বে’র দিকে মুখ করে বানানো চেম্বার। পরিষ্কার দেখা যায় সাদা ফেনারাশি–দূরের মেঘ।

খুব যত্ন করে সাজানো হয়েছে রুমটি। পিয়ারনিফের আঁকা দুটি সত্যিকারের ছবি, কয়েকটা ভালো কার্পেট। সামারকন্দ আর গোল্ড ওয়াশ করা আবিদা–এমনকি রুবির রিসেপসনিস্টকে দেখে মনে হচ্ছে প্লে-বয় ক্লাবের হোস্টেস। ঝোলানো কান আর লেজ নেই অবশ্য। এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে ডা, ফ্রাইডম্যান জীবনের ভালো দিকগুলিকেই পছন্দ করে।

তাদের জন্য প্রস্তুত ছিল রিসেপনিস্ট। কিন্তু তারপরেও চোখ বড় বড় করে তাকানো পরিহার করতে পারল না আর ডেভিডের চেহারার দিকে তাকিয়ে মুখের রক্ত সরে গেল তার। ডা. ফ্রাইডম্যান আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন মি: ও মিসেস মরগ্যান। সরাসরি ভেতরে চলে যান প্লিজ।

পুরোদস্তুর পোশাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে ডেভিডকে। তারপরেও উষ্ণ আর আন্তরিক ভাবে ডেবরার হাত ধরল।

‘ডেভিড কী আমাদের সাথে থাকতে পারবে?’ ছদ্ম ভঙ্গিতে ডেবরার কাছে জানতে চাইল রুবেন।

‘হ্যাঁ, থাকবে।’ উত্তর দিল ডেবরা। এরপর ক্লিনিক্যাল ইতিহাস পড়ে দেখল রুবেন। এরপর গেল এক্সজামিনেশন রুমে। চেয়ার দেখে ডেভিডের মনে হলো এটা ডেন্টিস্টের রুমে থাকে। ডেবরাকে নিজের আরাম মতো শুইয়ে দিল রুবেন। এরপর সরাসরি দু’চোখের পিউটিলে আলো ফেলল।

‘সুন্দর সুস্থ, চোখ। অবশেষে মন্তব্য করল রুবেন। আর বেশ সুন্দর, তাই না ডেভিড?’

‘বিধ্বংসী।’ একমত হল ডেভিড। সামনের দিকে তুলে বসানো হল ডেবরাকে তারপর হাতে লাগানো হল ইলেকট্রডস। এরপর সামনের দিকে আনা হল জটিল একটা যন্ত্র। ই-সি-জি। অনুমান করল ডেভিড। মাথা নাড়ল রুবেন।

না-এটা বলতে পারো আমার আবিষ্কার। আমি এটা নিয়ে বেশ গর্বিত। কিন্তু সত্যিকারে যদি বল তাহলে এটা পুরাতন লাই-ডিডেক্টরের আধুনিক সংস্করণ।

প্রশ্ন-উত্তর পর্ব? জানতে চাইল ডেবরা।

না। আমরা তোমার উপর ফ্ল্যাশ লাইট ফেলবো। আর দেখবো অবচেতনে তুমি কীভাবে প্রতিক্রিয়া কর।

‘আমরা এটা জানি। জানাল ডেবরা। কণ্ঠের ধার কান এড়ালো না কারো।

‘সম্ভবত। কিন্তু এটা একটা রুটিন চেক-আপ আমাদেরকে করতে হবে। তাকে শান্ত করতে চাইল রুবি। এরপর ডেভিডকে বলল।

‘এখানে এসে দাঁড়াও প্লিজ। আলো বেশ কড়া। তাকাতে ভাল লাগবে না তোমার।

পিছনে সরে গেল ডেভিড। মেশিন অ্যাডজাস্ট করল রুবি। মনে হল কোন ধরনের গ্রাফ পেপার ঘোরা শুরু করল। আর প্রায় সাথে সাথে ছন্দের ভঙ্গিতে ওঠা-নামা শুরু করল। অন্য একটা পৃথক কাঁচের পর্দায় সবুজ বিন্দুর মতো আলো একই গতিতে স্পষ্ট হতে লাগল। ধূমকেতুর মতো পুচ্ছ আঁকা হতে লাগল স্ক্রিন জুড়ে। এটা দেখে ডেভিডের মনে পড়ে গেল মিরেজ জেটের ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলে থাকা ইন্টারসেপটার রাভার স্কিন। উপরের আলো বন্ধ করে দিল রুবি। পুরো রুম হয়ে গেল অন্ধকার। শুধু স্কিনে সবুজ বিন্দুগুলো দেখা গেল।

‘আমরা প্রস্তুত আছি ডেবরা? চোখ খোলা রেখে সামনের দিকে তাকাও ডেবরা। প্লিজ।

নিঃশব্দে নীল আলোয় ভরে গেল ঘর। সাথে সাথে সবুজ বিন্দুগুলো দৌড়াদৌড়ি শুরু করল দেখতে পেল ডেভিড। প্রথমে এক দু’বার দৌড়াদৌড়ি করে আবারো আগের মতো একই গতিতে চলতে লাগল। ডেবরা আলো দেখতে পেয়েছে। যদিও সে জানে না ব্যাপারটা। মস্তিস্ক ঠিকই গ্রহণ করেছে। আলোর সংকেত। প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করেছে মেশিন।

আরো বিশ মিনিট ধরে উজ্জ্বল আলো নিয়ে খেলা করা হল। রুবি এর ভেতরে বিভিন্ন ভাবে অ্যাডজাস্ট করল ফোকাস। এরপর অবশেষে সন্তুষ্ট হয়ে উপরের আলো জ্বেলে দিল।

‘তো? জানতে চাইল ডেবরা তড়িঘড়ি। আমি পাশি করেছি?’ এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না আমি। জানাল রুবি। তুমি অসাধারণ ব্যবহার দেখিয়েছ, আমরা তো এটাই চেয়েছি।’

‘এখন যেতে পারি আমরা?

‘ডেভিড তোমাকে লাঞ্চ করতে নিয়ে যাবে। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা রেডিওলজিস্টের কাছে যাবে। আমার রিসেপসনিস্ট ২.৩০ মি. অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে। কিন্তু তারপরেও আবার জেনে নিও তোমরা পরিষ্কার ভাবে।’ রবি জানিয়ে দিল যে তার সাথে এখন কথা বলতে পারবে না ডেভিড।

‘আমি এক্স-রের ফলাফল পাওয়া মাত্রই জানাব তোমাদেরকে। এখানে আমি রেডিওলজিস্টের ঠিকানা লিখে দিচ্ছি।’ নিজের প্রেশক্রিপশনের প্যাডে ঠিকানা লিখে ডেভিডের দিকে বাড়িয়ে দিল ডাক্তার।

‘আগামীকাল সকাল দশটায় আমার সাথে দেখা করবে, একা।

মাথা নেড়ে ডেবরার হাত ধরল ডেভিট। এক মিনিটের জন্যে চেষ্টা করল রুবির দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বুঝতে। কিন্তু শুধুমাত্র কাঁধ ঝাঁকাল ডাক্তার। কমেডিয়ানের মতো অনিশ্চিত ভঙ্গিতে চোখ নাচালো।

.

মাউন্ট নেলসনের সুইটে লাঞ্চে আসল ব্রিগ। কেননা এখন পর্যন্ত পাবলিক প্লেসে সহজ হতে পারে না ডেভিড। ব্রিগ চেষ্টা করল দুজনকে সহজ করতে। তাই ডেবরার ছেলেবেলা আর আমেরিকা ছাড়ার পর প্রথম দিককার কাহিনী বলতে শুরু করল। প্রাণ খুলে হাসল ডেভিড আর ডেবরা।

কৃতজ্ঞ বোধ করল ডেভিড। সময় কেটে গেল দ্রুত। আর তারপর ডেবরাকে কে তাড়া দিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে বলল ব্রিগ।

‘আমি দু’ধরনের কৌশল ব্যবহার করব, মাই ডিয়ার

ডেভিড অবাক হয়ে ভাবতে লাগল যে চল্লিশের উপরে যে কোন পুরুষ ডেবরাকে এমন ভাবে ডাকে যেন সে বারো বছরের খুকী। প্রথমত আমরা পাঁচ রকম ভঙ্গী করব যাকে পুলিশরা বলে, শটস, ফ্রন্ট, ব্যাক, সাইড অ্যান্ড টপ রেডিওলজিস্ট লাল-মুখো, সাদা চুলের এক পুরুষ হাত দুটো বেশ বড়সড় আর কাধ বেশ চওড়া, ব্যায়ামবীরের মতো। আমরা এমনকি তোমার কাপড় খুলতেও বলব না’ বিড়বিড় করল লোকটা। কিন্তু ডেভিডের মনে হল খানিকটা মন খারাপ করল লোকটা। এরপর আমরা খুব দ্রুত তোমার মাথার ভেতরের কয়েকটা ছবি তুলব। এর নাম টমোগ্রাফী। তোমার মাথা স্থির হয়ে থাকবে। ক্যামেরা তোমার চারপাশে ঘুরতে থাকবে। ঠিক যেখানে সমস্যা সেখানেই ফোকাস করবে। তোমার সুন্দর মাথার মাঝে কী ঘটছে তা বের করে আনবো আমরা।’

আমি আশা করব এতে খুব বেশি অবাক হবেন না আপনি, ডাক্তার। বলে উঠল ডেবরা। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল জমে গেল ডাক্তার। তারপর কাজ শুরু করল। দীর্ঘ ক্লান্তিকর হল পুরো ব্যাপারটা। এরপর হোটেলে ফিরে আসার সময় ডেবরা ডেভিডের কাছে ঝুঁকে এলো। বলল, “চলো বাসায় ফিরে যাই ডেভিড। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’

‘ঠিক আছে যত তাড়াতাড়ি পারি।’ একমত হল ডেভিড।

ডেভিড চায় নি ব্যাপারটা এভাবে ঘটুক। তার পরেও জোর করে পরদিন সকালে ব্রিগও এলো তার সাথে ফ্রাইডম্যানের চেম্বারে। ডেবরার সাথে মিথ্যে কথা বলল ডেভিড। যেটা সে সচরাচর করে না। জানাল মরগ্যান ট্রাস্ট অ্যাকাউন্টান্টের সাথে দেখা করতে চলেছে সে। হোটেলের সুইমিং পুলে পাশে লেবু-সবুজ বিকিনি পরে শুয়ে রইল ডেবরা। সূর্যের আলোয় অসম্ভব সুন্দর দেখাল বাদামী, কৃশকায় রঙের দেহ।

রুবি ফ্রাইডম্যান বিজনেসম্যান সুলভ আচরণ করল। নিজের ডেস্কে বসে সোজা চলে এলো মূল আলোচনাতে।

‘জেন্টেলম্যান’, শুরু করল ডাক্তার। আমরা একটা সমস্যায় পড়েছি। কঠিন সমস্যা। প্রথমে এক্স-রে প্লেটগুলো দেখাতে চাই–’ রুবি চেয়ার ঘুরিয়ে বুক লাইট জ্বালিয়ে প্রিন্টগুলো স্পষ্ট করে তুলল। এই পাশের প্লেটগুলো আমাকে জেরুজালেম থেকে ইদেলমান পাঠিয়েছে। এখানে গ্রেনেড ফ্লাগমেন্ট দেখা যাচ্ছে। বেশ শক্ত একটা অংশ। হাড়ের মাঝে ছোট ত্রিকোণাকৃতির একটা বস্তু। এখানে অপটিক চিয়াসমার গতিপথ। হাড়ের মাঝে যেখানে বাধা পেয়েছে তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ইদেলম্যানের সত্যিকারের প্রাথমিক পরীক্ষা-~ এ প্লেটগুলোর উপর নির্ভর করে যেগুলো তৈরি, সেটা ছিল আলো ও আকার বুঝতে না পারাটা। এটাই চিরস্থায়ী ধরে নেয়া হয়েছিল। অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানেই সব কিছু শেষ ধরে নেয়া হয়েছে। দ্রুত প্লেটগুলো খুলে ফেলল ডাক্তার। অন্যগুলো স্ক্যানারে লাগিয়ে নিল। ঠিক আছে। এখন দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় এক্স-প্লেটগুলো। গতকাল ভোলা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে গ্রেনেডের অংশটা কীভাবে সংকুচিত হয়ে গেছে।’ তিক্ষ্ণ দাগটুকু মসৃণ হয়ে গেছে চারপাশে নতুন করে হাড় তৈরি হওয়ায়। এটা বেশ ভালো। এরকমটাই আশা করা হয়ে ছিল। এখানে চিয়াশমার চ্যানেল হাড়ের নতুন করে বৃদ্ধি যে কোন ভয় ডেকে আনতে পারে। স্ক্যানারে নতুন এক সেট প্লেট লাগিয়ে নিল ডাক্তার। অবশেষে এখানে দেখা যাচ্ছে টমোগ্রাফীর মাধ্যমে পাওয়া ছবি। এখানে চিয়াশমা চ্যানেলের গতিপথ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, শুধু ছোট্ট একটা অর্ধ গোলাকার অংশে স্পর্শ করল ডাক্তার এই ছোট্ট দাগটা খুলির প্রধান কেন্দ্রে চলে গেছে। মনে হচ্ছে বেঁকে গেছে ইউ। হতে পারে আমাদের পুরো পরীক্ষার প্রধান আবিষ্কার এটিই।’ স্ক্যানারে লাইট বন্ধ করে দিল রুবি।

‘আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারিনি।’ তিক্ষ কণ্ঠে বলে উঠল ব্রিগ। অন্য কোন পুরুষের বিশেষ জ্ঞান দক্ষতার কাছে নতি স্বীকার করতে নারাজ সে।

না, অবশ্যই। নরম হল রুবি।

‘আমি শুধুমাত্র আলোচনার ক্ষেত প্রস্তুত করলাম। আবারো ডেস্কে তাকাল। বদলে গেল ব্যবহার। এখন আর লেকচার দিচ্ছে না। এখানেই সে-ই যে প্রভু তা বোঝা গেল স্পষ্ট।

‘এখন আমার উপসংহার বলি। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে অপটিক নার্ভের কিছু অংশের সক্রিয়তা নষ্ট হয়নি। এখনো মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে সক্ষম। অন্তত কিছু অংশ এখনো অক্ষত। প্রশ্ন হচ্ছে কতটুকু। অথবা কতটুকু উন্নতি করা যাবে। হতে পারে নার্ভের মাঝে কেটে ফেলেছে গ্রেনেড—ছয়টা দড়ির পাঁচটিই ক্ষতি করেছে অথবা চারটা কী তিনটা। আমরা জানি না কতটা। আমরা শুধু জানি যে এই ধরনের আঘাত প্রতিহত করা কঠিন। এর থেকে বেঁচে থাকবে এখন যতটুকু আছে প্রায় কিছুই না।

.

থেমে গিয়ে একেবারে চুপ হয়ে গেল রুবি। অপর পাশে বসে থাকা পুরুষ দু’জন মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইল। নিজের আসন ছেড়ে সামনে ঝুঁকে বসে আছে দু’জনেই।

‘এটা হচ্ছে অন্ধকার দিক–যদি এটা সত্যি হয় ডেবরা তাহলে ব্যবহারিক অর্থে বলা যায় অন্ধই থাকবে। কিন্তু এ প্রশ্নের আরো একটি দিক আছে। এটাও হতে পারে যে অপটিক নার্ভ আদতে কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। প্লিজ গড়

‘তাহলে ও দেখতে পায় না কেন? রেগে গিয়ে প্রশ্ন করল ডেভিড। অনেক আগেই উন্মা জমেছে তার মনে। একসাথে দুরকম কথা তো বলা যায় না।

ডেভিডের দিকে তাকাল রুবি। প্রথমবারের মতো ক্ষত-বিক্ষত বিভৎস মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যথা উপলব্ধি করল। গাছ চোখে রাইফেলের স্টিলের মতো নীল বেদনা।

‘আমাকে ক্ষমা করো, ডেভিড। আমি পুরো ব্যাপারটাকে আমার মতো করে অ্যাকাডেমিক ওয়েতে চিন্তা করেছি। তোমার মতো ভাবিনি। আমি এখন চেষ্টা করব সোজা ভাবে বলতে। নিজের চেয়ারে হেলান দিল ডাক্তার। বলতে শুরু করল, “নিশ্চয়ই মনে আছে চিয়াশমাতে থাকা দাগের কথা। আমার মনে হয় এটা নার্ভ নিজে। জায়গা থেকে সরে গেছে। ধাতব বস্তুর কারণে চাপ পড়ায় মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে পারছে না।

‘মাথায় আঘাত?’ জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

‘হা। মাথায় আঘাতের ফলে হাড়ের জায়গা থেকে সরে গেছে সেটা। তাই আবারো মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাবার মতো জায়গা পেয়েছে। যেমনটা হয় হোস পাইপের বেলায়। পাইপের উপর কিছু রেখে দিলে পানির প্রবাহ বাধা পায়। তারপর বাধা সরিয়ে নিলে আবারো নিয়মিত হয়।

সবাই চুপ করে গেল। প্রত্যেকে নিজের মাঝে ওজন করে দেখতে চাইলো শোনা কথাগুলো।

‘চোখ জোড়া? অবশেষে জিজ্ঞেস করল ব্রিগ। সুস্থ আছে?

‘একদম। মাথা নাড়ল রুবি।

কীভাবে বুঝবেন আপনি–মানে আমি বলতে চাইছি পরবর্তীতে কোন পদক্ষেপ নিতে চান আপনি? আস্তে করে জিজ্ঞেস করল ডেভিড।

‘একটাই পথ আছে কেবল। আমাদেরকে ট্রমার জায়গায় যেতে হবে।’

‘অপারেশন?’ আবারো জানতে চাইল ডেভিড।

‘হ্যাঁ।

‘ডেবরার মাথা উন্মুক্ত করে ফেলবেন?’ চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখা দিল

হ্যাঁ। আবারো মাথা নাড়ল রুবি।

‘ওর মাথা নিষ্ঠুর ছুরির কথা স্মরণ করল নিজের মাংসের উপর। মনের পর্দায় দেখতে পেল সুন্দর মুখটা কাটা-ছেঁড়া করা হচ্ছে। অন্ধ চোখ দুটোতে ব্যথা। ওর চেহারা’ কাঁপতে লাগল ডেভিডের গলা। না, ওকে কাটতে দেব না আমি। আমি.ধ্বংস করতে দেব না, যেভাবে আমার সাথে করেছে ওরা।’

‘ডেভিড! বরফ ভাঙার মতো কড়মড় করে বলে উঠল ব্রিগ। নিজের চেয়ারে হেলান দিল ডেভিড।

‘আমি বুঝতে পারছি তোমার কেমন লাগছে। নম্র ভাবে কথা বলে উঠল রুবি। ব্রিগের একেবারে উল্টো। আমরা চুলের পেছন থেকে এগোব। কোন কিছুই বোঝা যাবে না। চুল উঠে গেলে দাগ ঢেকে যাবে। কাঁটতেও হবে না বেশি।

‘আমি ওকে আর কষ্ট দিতে চাই না। নিজের গলার স্বর নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল ডেভিড। কিন্তু তেমন পারল বলে মনে হল না। ও এমনিতেই অনেক আঘাত সহ্য করেছে

‘আমরা ওকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে চাইছি।’ আবারো কথা বলে উঠল ব্রিগ। ভারী আর ঠাণ্ডা তার স্বর। একটুখানি ব্যথা দিয়েও বড় মূল্য পাবে এখানে।

ব্যথা তেমন হবেই না, ডেভিড।’ আবারো চুপ হয়ে গেল তারা। দু’জন বৃদ্ধ পুরুষ তাকিয়ে রইল কম বয়সী ডেভিডের দিকে।

‘সম্ভাবনা কতটুকু? সাহায্যের আশায় তাকাল ডেভিড। চাইছে তার হয়ে সিদ্ধান্ত অনন্যরা নিয়ে নিক। চাইছে তার কাছ থেকে সরে যাক ব্যাপারটা।

‘এটা বলা কঠিন। মাথা নাড়ল রুবি।

‘ওহ গড, আমি যদি খারাপ দিকগুলো নাই জানি, তাহলে বিচার করব কীভাবে?’ চিৎকার করে উঠল ডেভিড।

ঠিক আছে। যেমন ধর–এখানে সম্ভাবনা আছে, নিশ্চয়তা নয় যে, সে তার দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করার মতো করে ফিরে পাবে।’ নিজের কথা শেষ করল রুবি। আর এ সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ যে দৃষ্টিশক্তির পুরোটা সে ফিরে পাবে।’

‘খুব বেশি হলে এটুকু হবে।’ একমত হল ডেভিড। আর যদি না হয়?

হতে পারে কোন পরিবর্তনই হবে না। একটুখানি ব্যথা পাবে। আর কিছু না।

নিজের চেয়ার থেকে প্রায় লাফ দিয়ে উঠল ডেভিড। এগিয়ে গেল জানালার কাছে। তাকিয়ে রইল উপসাগরের দিকে। যেখানে নোঙ্গড় করে আছে বিশাল সব ট্যাঙ্কার। আর তারও পরে নীল আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাইগারবার্গের পাহাড়।

তুমি জানো কোন পথ বেছে নিতে হবে, ডেভিড।’ নির্দয় হয়ে উঠল ব্রিগ। কোন পথ দিল না ডেভিডকে, বাধ্য করল ভাগ্য বরণ করে নিতে।

‘ঠিক আছে।’ আত্মসমর্পণ করল ডেভিড। ফিরে তাকাল। কিন্তু এক শর্তে। এর উপরেই জোর দিব আমি। ডেবরাকে জানান হবে না যে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার সম্ভাবনা আছে।

রুবি ফ্রাইডম্যান মাথা ঝাঁকালো। ওকে বলতেই হবে।

ভয়ঙ্করভাবে নড়ে উঠল ব্রিগের গোঁফ জোড়া। কেন নয়? কেন ওকে জানতে দিতে চাও না তুমি?

আপনি জানেন কেন। না তাকিয়ে উত্তর দিল ডেভিড।

কীভাবে আনবে তাকে তুমি যদি তাকে নাই বলো? জানতে চাইল রুবি।

‘ওর মাথা ব্যথা হয়–আমরা বলব যে কোন একটা যে আপনি কোন একটা কিছু খুঁজে পেয়েছেন–যেটা সরিয়ে ফেলতে হবে। এটাই তো সত্যি তাই না?

না। মাথা নাড়ল রুবি। আমি তাকে এটা বলতে পারব না। ওর সাথে ভণিতা করতে পারব না আমি।’

‘তাহলে আমি বলব।’ বলে উঠল ডেভিড। এখন বেশ দৃঢ় শোনাল তার কণ্ঠস্বর। যখন অপারেশনের পর ফলাফল পাওয়া যাবে তখন তাকে সব খুলে বলব আমি। ভাল অথবা মন্দ যাই হোক না কেন। আমিই ওকে জানাবো ঠিক আছে? এ ব্যাপারে একমত সবাই?

একটু পরে বাকি দুজন মাথা নাড়ল। বিড়বিড় করে মেনে নিল ডেভিডের শর্ত।

.

হোটেলের শেফের কাছ থেকে পিকনিক বাস্কেট তৈরি করিয়ে নিল ডেভিড। আর সার্ভিস বার থেকে দুই বোতল ঠাণ্ডা শ্যাম্পেন নিল।

ইচ্ছে হল আকাশে উড়ে বেড়াতে আবার একই সাথে এ কথাও মনে রাখল যে ডেবরাকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই বারবার নিজের মনকে বোঝাতে বাধ্য হল যে এখন ডেবরার সাথে উড়ে বেড়ানোর সময় নয়। এর বদলে টেবল পর্বতের উপর কেবল ওয়েতে চড়লো দু’জনে। একদম উপরের স্টেশন থেকে মালভূমিতে যাবার পথ পেয়ে গেল। হাতে হাত রেখে চুড়ার কিনারে গিয়ে শহরের অনেক উপরে পাশাপাশি বসল দু’জনে। নিচে অসীম সমুদ্র।

দুই হাজার ফুট পার হয়েও শহরের শব্দ ঠিকই পৌঁছালো তাদের কাছে। বয়ে নিয়ে এলো বাতাস। বিভিন্ন ধরনের শব্দ। অটোমোবাইলের শব্দ, ট্রেন লাইনের উপর লোকোমোটিভ, মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি, শ্রেণীকক্ষে ছেলে মেয়েদের চিৎকার–এ সমস্ত শব্দ সত্ত্বেও মনে হলো তারা বড় একা। শহরের দূষিত বাতাসের চেয়ে ঠাণ্ডা মনে হল দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আসা মিষ্টি বাতাস।

একসাথে ওয়াইন খেল দু’জনে। কাছাকাছি বসে সাহস সঞ্চয় করল ডেভিড। কথা বলতে যাবে এমন সময় তাকে থামিয়ে দিল ডেবরা।

‘এভাবেই বেঁচে থাকা আর ভালোবাসাই ভালো, মাই ডার্লিং।’ বলে উঠল ডেবরা। আমরা অনেক ভাগ্যবান। তুমি এটা জানো ডেভিড?

একমত হবার মতো একটা শব্দ বের হতে চাইল গলা দিয়ে। কিন্তু পারল না।

‘যদি তুমি পারো, তাহলে পরিবর্তন করতে চাও কিছু? অবশেষে জিজ্ঞেস করল ডেভিড। হাসল ডেবরা।

‘ওহ্, নিশ্চয়ই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কেউ কী পুরোপুরি তৃপ্ত হয়? আমি ছোট ছোট অনেক জিনিস বদলে দেব–কিন্তু বড় কিছু নয়। তুমি আর আমি।

‘কী পরিবর্তন চাও?’

‘আমি, আরো ভালো করে লিখতে চাই।’

চুপচাপ ওয়াইনে চুমুক দিল দু’জনে।

সূর্য দ্রুত অস্ত যাচ্ছে। ডেভিড জানাল ডেবরাকে।

বলো।’ জানতে চাইল ডেবরা। সূর্যাস্তের রং বর্ণনা করার জন্য শব্দ খুজতে লাগল ডেভিড। মেঘের উপরের রং, সমুদ্রে রক্ত আর সোনার মতো রঙের মিশেলে তৈরি উজ্জ্বলতা জানে কখনো বলতে পারবে না। একটা বাক্যের মাঝেই থেমে গেল ডেভিড। বুঝিয়ে বলতে পারল না।

‘আমি রুবি ফ্রাইডম্যানের সাথে দেখা করেছি সকালবেলা। তাড়াহুড়া করে বলে উঠল ডেভিড। এর চেয়ে ভালো আর কোন পথ মাথায় এলো না। স্বভাবসুলভ নীরবতার ভঙ্গীতে চুপচাপ বসে রইল ডেবরা। মনে হল যেন শিকারির ভয়ে জমে গিয়ে স্থির হয়ে আছে কোন ছোট্ট বন্যপশু।

‘খারাপ হয়েছে ব্যাপারটা। অবশেষে বলে উঠল ডেবরা।

‘কেন?’ তাড়াতাড়ি জানতে চাইল ডেভিড।

কারণ এ কথা বলতে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে আর তুমি অনেক ভয় পাচ্ছ।

না। ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল ডেভিড।

হ্যাঁ। আমি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি। তুমি আমার জন্যে ভয় পাচ্ছ।’ ‘এটা সত্যি না।’ ডেভিড চাইল মেয়েটাকে আশ্বস্ত করতে। আমি একটু চিন্তিত এই-ই।

বলো আমাকে সবকিছু। জোর দিল ডেবরা।

‘ছোট্ট একটা জিনিস বেড়ে গেছে। এটা তেমন ক্ষতিকর কিছু না–এখন পর্যন্ত। কিন্তু তারা ভাবছে যে এ ব্যাপারে কিছু করা দরকার।’ সাবধানে পরিকল্পনা মতো ব্যাখ্যা করল ডেভিড। শেষ করার পর এক মুহূর্ত চুপ করে রইল ডেবরা।

‘এটা দরকারী, বেশি দরকারী?

জানতে চাইলে ডেভিডের কাছে।

‘হা। জানালো ডেভিড, মাথা নাড়লো, বিশ্বাস করল ডেভিডের কথা। হেসে, হাত ধরে রাখল।

‘ভয় পেয়ো না ডেভিড, মাই ডার্লিং। ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। দেখবে আমাদের কিছু হবে না। আমরা এমন একটা জায়গায় থাকি যে ওরা আমাদের কিছু করতে পারবে না। এবার ডেবরা চাইছে ডেভিডকে শান্ত করতে।

‘অবশ্যই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। নিজের কাছে ডেবরাকে টেনে নিল ডেভিড। গ্লাস উপচে পড়ে গেল এক ফোঁটা ওয়াইন।

কখন?’ প্রশ্ন করল ডেবরা।

‘আগামীকাল যাবে তুমি। তার পরদিন সকালবেলা অপারেশন হবে।’

‘এত তাড়াতাড়ি?

‘আমার মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি হওয়াই ভালো।

‘হ্যাঁ। ঠিক বলেছো।’

ওয়াইনে চুমুক দিল ডেবরা। মনে হল সাহসী হওয়া সত্ত্বেও খানিকটা ভয় পেয়েছে।

‘ওরা আমার মাথা কেটে ফেলবে?”

‘হ্যাঁ। জানালো ডেভিড। কাঁধ ঝাঁকালো ডেবরা।

‘কোন রিস্ক নেই, ডিয়ার। আবারো আশ্বস্ত করতে চাইলো ডেভিড।

না। আমি নিশ্চিত এ ব্যাপারে। তাড়াতাড়ি একমত হয়ে গেল ডেবরা।

***

মাঝরাতে ঘুম ভেঙেই মনে হল ডেবরা পাশে নেই, ও একা শুয়ে আছে।

তাড়াতাড়ি উঠে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গেল ডেভিড। খালি। এরপর দ্রুত গিয়ে সিটিংরুমের আলো জ্বালালো ডেভিড।

সুইচের ক্লিক শব্দ শুনতে পেল ডেবরা। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। কিন্তু গালের উপর মসৃণ মুক্তোদানার মতো অশ্রুবিন্দু দেখতে পেল ডেভিড। তাড়াতাড়ি ডেবরার কাছে এগিয়ে গেল।

‘ডার্লিং’, ডেকে উঠল ডেভিড।

‘আমি ঘুমাতে পারছিলাম না। জানাল ডেবরা।

“ঠিক আছে।’ ডেবরার কাউচের সামনে হাঁটু মুড়ে বসল ডেভিড। কিন্তু ডেবরাকে স্পর্শ করল না।

‘আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।’

বলে উঠল ডেবরা। ‘স্বচ্ছ পানির একটা পুল, তাতে সাঁতার কাটছে তুমি। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নাম ধরে ডাকছে। আমি তোমার সুন্দর মুখটা পরিষ্কারভাবে দেখেছি, হাসছ–

ডেভিড বুঝতে পারল প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে সে নিজের মাঝে। কেননা পূর্বের ডেভিডকে স্বপ্নে দেখেছে ডেবরা, সুদর্শন ডেভিডকে। এখনকার কুৎসিত বিভৎস ডেভিডকে নয়। এরপর হঠাৎ করে ডুবে যেতে শুরু করেছ তুমি। নিচেঅনেক নিচে গলা ধরে এলো ডেবরার। এক মুহূর্ত চুপ করে রইল।

‘এটা ভয়ঙ্কর একটা স্বপ্ন। আমি চিৎকার করে কেঁদে তোমার কাছে যেতে চাইছি, কিন্তু নড়তে পারছিলাম না। আর তুমি ধীরে ধীরে গভীরে তলিয়ে গেছ। পানি হয়ে গেছে গাঢ় আর আমি জেগে উঠেছি মাথার মাঝে শূন্যতা আর অন্ধকার নিয়ে। কিছুই না, শুধু অন্ধকার আর কুয়াশা।

‘এটা শুধু একটা স্বপ্ন, আর কিছু না ডিয়ার ডেভিড বলে উঠল।

‘ডেভিড’, ফিসফিস করে উঠল ডেবরা। আগামীকাল যদি আগামীকাল কিছু হয়—

‘কিছু হবে না। প্রায় উঠে পড়তে যাচ্ছিল ডেভিড। কিন্তু হাত বাড়িয়ে ডেভিডের মুখে হাত রাখল ডেবরা। ঠোঁট খুঁজে পেয়ে হালকাভাবে স্পর্শ করল।

‘যাই ঘটুক না কেন, বলে উঠল ডেবরা, আমাদের আনন্দের দিনগুলো স্মরণ করবে। মনে রাখবে আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম।

.

গ্রুট শূর হাসপাতাল ডেভিলস পীকের নিচের দিকে অবস্থিত। এর চূড়া ধূসর রঙের পাথরে তৈরি। নিচে ঘন পাইনের বন আর খোলা এস্টেট। যেটা সিসিল জন রোডস্ জাতিকে দিয়ে গেছেন। খোলা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণ আর দেশীয় অ্যান্টিলোপের দল। দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উড়ে আসা মেঘ ঢেকে রাখে পালকের মতো এ অঞ্চলকে।

উজ্জ্বল সাদা রঙের দালান দিয়ে তৈরি বিশাল কমপ্লেক্স এই হাসপাতাল। চার্জে থাকা সিস্টার অপেক্ষা করছিল ডেবরার জন্য। ডেভিডের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হল ডেবরাকে। একা দাঁড়িয়ে রইল ডেভিড। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় যখন ডেবরার সাথে দেখা করতে এলো ডেভিড, তখন বিছানার উপর নরম কাশ্মিরি জ্যাকেট পরে বসে ছিল ডেবরা। পুরো রুম ফুল দিয়ে ভর্তি করে ফেলল ডেভিড। ডেবরার হাতেও ধরিয়ে দিল একগুচ্ছ।

‘বেশ সুন্দর গন্ধ। ধন্যবাদ জানাল ডেবরা। মনে হচ্ছে বাগানে বসে আছি।’

মাথায় পাগড়ির মতো একটা কাপড় জড়িয়ে রেখেছে ডেবরা। শান্ত সোনালি চোখ জোড়া যেন বহুদূরের কিছু দেখছে তন্ময় হয়ে। রহস্যময়ীর মতো দেখাল মেয়েটাকে।

‘ওরা তোমার চুল কেটে ফেলেছে?’ একটু হতাশার ভাব এলো ডেভিডের মাঝে। মেনে নিতে পারছে না যে উজ্জ্বল গাঢ় রঙের কেশরাজি আর নেই। মনে হল ডেবরারও একই মনোভাব। উত্তর দিল না সে। এর পরিবর্তে ডেভিডকে জানাল সবাই তার সাথে কতটা ভালো আচরণ করছে। আর ওর জন্য কতটা কষ্ট করছে। মনে হচ্ছে আমি যেন একজন রানী।’ হেসে ফেলল ডেবরা।

ডেভিডের সাথে ব্রিগও এসেছে। চুপচাপ, গম্ভীর হয়ে আছে। মনে হলো সে নেই-ই। তার উপস্থিতিতে খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে আছে ডেভিড আর ডেবরা। তাই রুবি ফ্রাইডম্যান এলে স্বস্তি পেল দুজনে। হাসি-খুশিভাবে ডেবরাকে জানাতে লাগল সব প্রস্তুতি।

‘সিস্টার বলল তুমি ভালো আছো। সব কিছু প্রস্তুত। দুঃখিত তুমি কিছু খেতে পারবে না বা পান করতেও পারবে না। শুধু আমার দেয়া স্লিপিং পিল ছাড়া।

‘আমাকে থিয়েটারে কখন নেয়া হবে?

তাড়াতাড়ি। আগামীকাল সকাল আটটায়। আমি খুব খুশি হয়েছি যে সার্জন হিসেবে আসবেন বিলি কুপার। আমরা অনেক ভাগ্যবান যে তাকে পেয়েছি। আমি তাকে সাহায্য করব। আর তার সাথে থাকবে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ সার্জিক্যাল টিম।

রুবি, আপনি জানেন যে কোন কোন নারীর সাথে তাদের স্বামীরাও থাকে যখন তারা

হা। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে তাকাল রুবি। অবাক হয়ে গেছে প্রশ্ন শুনে।

‘তো। কাল আমার সাথে ডেভিড থাকতে পারবে না? আমরা একসাথে থাকতে পারব না, আমাদের দুজনের খাতিরে?

‘আমি সমস্ত শ্রদ্ধা বজায় রেখে বলতে চাই ডিয়ার, তুমি তো সন্তান প্রসব করতে যাচ্ছে না।’

‘আপনি ব্যবস্থা করতে পারেন না যেন ডেভিড সেখানে থাকতে পারে? আকুতি জানাল ডেবরা। এমন চোখ জোড়া দেখে পাথর হৃদয়ও গলে যেতে বাধ্য।

‘আমি দুঃখিত।’ মাথা নাড়ল রুৰি। এটা একেবারেই সম্ভব নয়– এরপরই উজ্জ্বল হয়ে উঠল চেহারা। কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি। আমি তাকে শিক্ষার্থীদের রুমে নিয়ে যেতে পারি। এটাই হবে ভালো। আমি তাকে স্টুডেন্টদের রুমে নিয়ে যাবো। সত্যি কথা বলতে কী থিয়েটারে না থেকে সেখানে থাকলেই ও ভালো ভাবে সবকিছু দেখতে পাবে। ক্লোজ-সার্কিট টেলিভিশন দিয়ে সব দেখানো হয়। ডেভিড নির্বিঘ্নে সবকিছু দেখতে পাবে।’

‘ওহ প্লিজ। তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল ডেবরা। আমি জানতে চাই যে ও আশেপাশেই থাকবে। আমরা একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হতে চাই না। তাই না ডার্লিং? হাসল ডেবরা। যেখানে ভাবল যে ডেভিড দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে অন্য পাশে সরে গেছে। তাই হাসিটা দেখতে পেল না ডেভিড।

‘তুমি সেখানে থাকবে, ডেভিড তাই না? জানতে চাইল ডেবরা। যদিও ছুরির কাজ দেখার কোন ইচ্ছে হল না; তাও হালকাভাবে উত্তর দিল, “আমি থাকবো। আর আরেকটু হলেই যোগ করতে যাচ্ছিল যে সবসময় কিন্তু বলল না শব্দটা।

.

এত সকালবেলা লেকচাররুমে এলো আরো দু’জন। ছোট্ট রুমে অর্ধ-বৃত্তাকারে বসানো চেয়ারের সারি। ছোট একটা টেলিভিশন স্ক্রিন। সুন্দর মুখশ্রীওয়ালা মোটাসোটা এক ছাত্রী আর কুকুরের মতো চুলের ভঙ্গি, লম্বা একটা ছাত্র গাত্রবর্ণ ফ্যাকাশে, দাঁতগুলো একেবারে বিশ্রী।

সাদা লিনেনের জ্যাকেটের মাঝ থেকে ঝুলে আছে স্টেথোস্কোপ। একবার বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখেই আর কোন আগ্রহ দেখাল না ডেভিডের প্রতি। চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষার কথা বলতে লাগল পরস্পর।

‘পেরিয়েটালের মধ্যে দিয়ে বিশেষ কাজ করতে যাচ্ছে কুপ।’

‘এটাই আমি দেখতে চেয়েছি’

নীল রঙের সিগারেট জ্বালালো মেয়েটা। বদ্ধ রুমের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। রাতে কম ঘুমানোর ফলে চোখ জ্বলতে লাগল ডেভিডের। ধোয়ায় আরো খারাপ লাগল। নিজের ঘড়ির দিকে বারবার তাকাতে লাগল ডেভিড। ভাবতে চেষ্টা করলে এই শেষ মুহূর্তগুলোতে ডেবরার সাথে কী ঘটছে। শরীরকে পরিষ্কার করা, সিডেটিভের জন্য সুই ফোঁটানো আর অ্যান্টি সেপসিস।

অতি ধীরে কাটতে লাগল সময়। অবশেষে পর্দা জুড়ে আলো দেখা গেল। থিয়েটারের ছবি ভেসে উঠল। রঙিন সেট, সবুজ রঙের থিয়েটারের পোশাক পরিহিত শরীরগুলো নড়াচড়া করতে লাগল। সবুজ দেয়ালের সাথে মিশে গেছে অপারেটিং টেবিল। উচ্চতাতে খাটো দেখাতে লাগল রোব পরিহিত মানুষগুলোকে। মাইক্রোফোনে শোনা গেল সার্জন আর সহযোগীদের মাঝের কথা-বার্তা।

‘আমরা এখনো প্রস্তুতি নেইনি মাইক?’

নিজের পাকস্থলীতে গুড়গুড় করে উঠল টের পেল ডেভিড। মনে হল নাশতা করে আসা উচিৎ ছিল। তাহলে হয়তো পেট ভরা থাকতত।

“ঠিক আছে। মাইক্রোফোনের দিকে ফিরতেই শোনা গেল সার্জনের তিক্ষ গলা। আমরা টেলি-তে চলে এসেছি?’

‘হ্যাঁ ডাক্তার। থিয়েটারের সিস্টার উত্তর দিল। সার্জনের কণ্ঠস্বরে স্বস্তি ফুটে উঠিল। এরপর অদেখা দর্শনার্থীদের উদ্দেশে বলে উঠল,

‘ঠিক আছে। তাহলে শুরু করছি। রোগী, ছাব্বিশ বছর বয়সী নারী। উপসর্গ হচ্ছে উভয় চোখের দৃষ্টিহীনতা। কারণ হচ্ছে অপটিক চিয়াশমার পাশে বা ভেতরে অপটিক নার্ভের ক্ষতি বা কার্য প্রবাহে বাধা। সে স্থানের সার্জিকেল তদন্ত হবে এখন। সার্জনের নাম ডা, উইলিয়াম কুপার, সহযোগিতা করছেন ডা. রুবেন ফ্রাইডম্যান।

কথা বলতে বলতে ক্যামেরা ঘুরতে লাগল টেবিলের উপর। বিস্ময়ের সাথে ডেভিড উপলব্ধি করল যে সে না জেনেও ডেবরার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখমণ্ডল আর মাথার নিচের অংশে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। মাথা পুরোপুরি কামানো। গোল একটা বলের মতো খুলি। দেখতে অমানবিক। ডিমের মতো। স্যাভলন অ্যান্টিসেপটিক মাখিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে মাথার উপরের আলো পড়ে চকচকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

‘স্কালপেল প্লিজ, সিস্টার।

নিজের সিটে টেনশনে ঝুঁকে বসল ডেভিড। হাতলে শক্ত করে এঁটে রইল হাত দু’টো। ফলে আঙুলের মাথাগুলো হয়ে গেল সাদা। কুপার নরম চামড়ার উপর প্রথম আঁচড় দিল। মাংস খুলে গেল। তৎক্ষণাৎ ছোট্ট রক্তবাহী শিরা দেখা গেল। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল কাজ শুরু করেছে ডাক্তারের হাত। গ্লাভস পরা থাকায় মনে হল রাবারের হাত। কিন্তু হলুদ রঙের গ্লাভস পরা হাতগুলো নিশ্চিত ভঙ্গিতে করে চলেছে তাদের কাজ।

ডিম্বাকৃতির এক অংশ মাংস আর চামড়া খুলে ফেলা হল কেটে। দেখা গেল হাড়। আবারো নড়েচড়ে উঠল ডেভিড। হাতে ড্রিল মেশিন তুলে নিল সার্জন। একই সাথে ধারাভাষ্য দিয়ে চলেছে ডাক্তার। খুলির ভেতরে ফুটো করাশুরু করল ড্রিল মেশিন। হাড়ের ভেতরে দ্রুত ঢুকে গেল স্টিল। চারবার ফুটো করল খুলি। চৌকোণা ঢাকনা মতন কাটা হলো।

‘পেরি-অস্টিল এলিভেটর, প্লিজ সিস্টার।

আবারো পাকস্থলী মোচড় দিল ডেভিডের। স্টিলের ফলা দিয়ে প্রতিটি ফুটোর এক মাথা থেকে অপর মাথা পর্যন্ত কাটলো সার্জন। এরপর করাতের মতো একটা যন্ত্র দিয়ে চারবারে পুরো চৌকোণা জায়গাটা কেটে নিয়ে তুলে ফেলল পুরো অংশ। ফলে ডেবরার খুলিতে তৈরি হল গোপন দরজা।

কাজ দেখতে দেখতে গলায় বমি উঠে এলো ডেভিডের। অনুভব করল কপাল জুড়ে ঠাণ্ডা ঘামের ফোঁটা। কিন্তু যখন খুলির ভেতরে উঁকি দিল ক্যামেরার চোখ বিস্ময়ে ভয় ভুলে গেল সে। মেমব্রেন, ডিউরামেটার সব দেখতে পেল ডেভিড। ডেবরার ব্রেইন। ডিউরাতে ফুটো করল কুপার।

‘এখন আমরা সম্মুখ ভাগ উন্মুক্ত করব। আর খুলি উন্মুক্ত করার জন্য এ অংশকে সরিয়ে ফেলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’

দ্রুত কিন্তু দক্ষতা আর যত্নের সাথে কাজ করে চলল কুপার। ব্যবহার করল স্টেইনস্টিলের রিট্রাকটর, দেখতে জুতোর সোলের মতো। ব্রেইনের মাঝে ঢুকিয়ে একপাশে সরিয়ে নিল। ডেবরার ব্রেইনের দিকে তাকিয়ে ডেভিড যেন দেখতে পেল ডেবরাকে, ওর নিজস্বতাকে। এ সব কিছুই ওকে তৈরি করেছে। ঠিক কোন অংশটা ওকে লেখক হিসেবে তৈরি করেছে ভেবে অবাক হল ডেভিড। এর মাঝে থেকেই তৈরি হয়েছে ওর কল্পনাশক্তি। কোথায় লুকিয়ে আছে ডেভিডের জন্য ওর ভালোবাসা। কোন নরম জায়গাটা লুকিয়ে রেখেছে ওর হাসি আর কোনটাই বা দায়ী ওর কান্নার জন্যে?

রহস্য ঘেরা এই অংশ মনোযোগী করে তুলল ডেভিডকে। রিট্রাকটর যেতে লাগল গভীর থেকে গভীরে। আর ধীরে ধীরে ক্যামেরা উঁকি দিতে লাগল ওর খুলির ভেতর।

কুপার ডিউরামেটারের শেষপর্যন্ত উন্মুক্ত করে জানাতে লাগল তার অবস্থান।

‘এখানে আমরা স্ফেনয়েড সাইনাস দেখতে পাচ্ছি, নোট রাখো যে এই পথে আমরা চিয়াশমাতে পৌঁছাবো।

সার্জনের কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন লক্ষ্য করল ডেভিড। খানিকটা টেনশন আছে সেই স্বরে, যত কাছে এগিয়ে আসছে লক্ষ্যস্থল।

‘এখন দেখো এ ব্যাপারটা বেশ মজার। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে? ইয়েস! পরিষ্কারভাবে হাড়ের নবজন্ম দেখা যাচ্ছে এখানে–’

সম্ভষ্ট কণ্ঠে বলে উঠল সার্জন। ডেভিডের পাশে বসা শিক্ষার্থী দু’জন বিস্ময় সূচক শব্দ করে সামনে ঝুঁকে এলো। ডেভিড দেখতে পেল নরম ভেজা টিস আর শক্ত, উজ্জ্বল উপরিভাগ, ক্ষত স্থানের একেবারে নিচে। স্টিলের গলা কাজ শুরু করল এখানে। মনে হলো ধাতু দিয়ে তৈরি মৌমাছি। গ্রেনেড ফ্রাগমেন্টের ভেতরে স্টিলের ফলা ঢুকিয়ে দিল কুপার।

এখন এখানে পাওয়া গেছে অপরিচিত অংশটা। এক্স-রে প্লেটগুলো আরেকবার আমরা দেখতে পারি সিস্টার?

দ্রুত এক্স-রে স্ক্যানারের ছবি উঠল। আবারো উত্তেজিত হয়ে উঠল শিক্ষার্থী দু’জন। তাড়াতাড়ি নিজের সিগারেটে টান দিল মেয়েটা।

‘ধন্যবাদ।

আবারো অপারেশন টেবিলের চিত্র ভেসে উঠল। এবার ডেভিড দেখতে পেল সাদা হাড়ের মাঝে গেঁথে আছে কালো একটি অংশ।

‘আমার মনে হয় আমরা এটাই খুঁজছি। তাই না ডা, ফ্রাইডম্যান?

হ্যাঁ। আমার মনে হয় আপনি এটা নিয়ে আসুন।

খুব সাবধানে লম্বা স্লেনডার স্টিল গাঢ় রঙের ফ্রাগমেন্টের চারপাশে গর্ত করে অবশেষে তুলে আনল এটাকে। সাবধানে তুলে ফেলল কুপার। অপেক্ষায় থাকা ধাতব ডিশের উপরে টিং করে ফ্রাগমেন্ট ফেলার শব্দ শুনতে পেল ডেভিড।

‘গুড! গুডং’ নিজেকেই উৎসাহ দিল কুপার। তাড়াতাড়ি হেমারেজ ঠেকাবার ব্যবস্থা করল। এখন অপটিক নার্ভ খুঁজে বের করব আমরা।

এখানে দুইটা সাদা অংশ আছে। পরিষ্কারভাবে দেখতে পেল ডেভিড। পৃথকভাবে গিয়ে একটা খালের মতো জায়গায় মিশে গেছে।

এখানে পরিষ্কারভাবে নতুন ধরনের হাড় দেখা যাচ্ছে। এই অংশই খালের কাজ বন্ধ করে রেখেছিল। আর সংকুচিত করে রেখেছিল নার্ভের কাজ। কোন পরামর্শ ডাক্তার ফ্রাইডম্যান?

‘আমার মনে হয় এ অংশটুকু পরীক্ষা করে দেখা দরকার যে নার্ভের কতটা ক্ষতি হয়েছে।

‘গুড। ইয়েস। এ ব্যাপারে আমি একমত। আমি এ অংশে পৌঁছানোর জন্যে চমৎকার একটা বোন নিলার ব্যবহার করব।’

আবারো ডাক্তারের হাতে এগিয়ে দেয়া হল উজ্জ্বল স্টিলের একটা যন্ত্র। এরপর কুপার কাজ শুরু করল সাদা হাড়ের উপর। মনে হলো ট্রপিক্যাল সাগরের কোরাল পাথর। স্টিল দিয়ে খুঁচিয়ে সাবধানে সব অংশ পরিষ্কার করে ফেলল।

‘এখানে আমরা দেখতে পাই যে একটা স্পিনটার খালের কাছে আটকে গেছে। বেশ বড় অংশ। বেশ চাপের মাধ্যমে এখানে আবদ্ধ করে ফেলেছে নিজেকে–

সাবধানে কাজ করতে লাগল ডাক্তার। ধীরে ধীরে নার্ভ দেখা গেল।

এখন, এ ব্যাপারটা বেশ মজার। বদলে গেল কুপারের গলার স্বর। ‘ইয়েস, তাকাও এদিকে। এদিকে আরেকটু ভালো করে দেখা যায় প্লিজ? ক্যামেরা আরো একটু সামনে এগিয়ে গেল। ফোকাস উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নার্ভ উপরের দিকে চাপ খেয়ে সমান হয়ে গেছে। বাধা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। চাপ দিয়ে রাখা হয়েছে কিন্তু কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।’

কুপার আরো একটা হাড়ের বড় টুকরা সরালো একপাশে। এবার পুরো দেখা গেল অপটিক নার্ভ।

‘এটা সত্যিই মনে রাখার মতো। আমার মনে হচ্ছে এ ঘটনা বেশ দুর্লভ। হাজারে একবার বা কোটিতে একবার পাওয়া যায় এ সুযোগ। মনে হচ্ছে নার্ভের সত্যিকারের কোন ক্ষতি হয়নি। তারপরেও যেহেতু স্টিলের ফ্রাগমেন্ট খুব কাছ দিয়ে গেছে, তাই বলা যায় না কিছুই। নিদেনপক্ষে স্পর্শ তো করেছেই।

একটা প্রোবের মাথা দিয়ে আস্তে করে নার্ভ তুলে ধরল কুপার। পুরোপুরি অক্ষত, কিন্তু চাপ খেয়ে সোজা হয়ে গেছে। তারপরেও আমি কোন ক্ষয় দেখতে পাচ্ছি না ডা, ফ্রাইডম্যান।

‘আমার মনে হয় এ অংশের কাজ পুনরায় শুরু করার আশা করতে পারি আমরা।’

মাস্ক পরা থাকলেও ডাক্তার দু’জনের বিজয়ীর ভঙ্গিমা স্পষ্ট বুঝতে পারল ডেভিড। আর তাদের দিকে তাকিয়ে নিজের অনুভূতি বুঝতে পারল সে। তার আত্মার উপর চাপ ফেলে উঠে দাঁড়াতে দেখল কুপারকে। ঠিকভাবে লাগিয়ে রাখা হলো ডেবরার খুলির অংশ। আর কাটা অংশ যথাস্থানে লাগিয়ে সেলাই করে দেয়ার পর বাইরের দিক দেখে বোঝাই গেল না যে কী কাণ্ড ঘটে গেল এতক্ষণ। স্ক্রিনের ছবি বদলে চলে গেল অন্য একটা থিয়েটারে। এখানে ছোট একটা মেয়ে হার্নিয়ার অপারেশনের জন্য শুয়ে আছে। এর সাথে সাথে বসে থাকা স্টুডেন্টদের মনোযোগও পরিবর্তন হয়ে গেল।

উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসল ডেভিড। এলিভেটরে চড়ে ডেবরার ফ্লোরে এসে ভিজিটরস রুমে বসে রইল। এরপর আবার খুলে গেল এলিভেটরের দরজা। সাদা পোশাক পরা দু’জন পুরুষ নার্স ডেবরার স্ট্রেচার ঠেলে নিয়ে গেল রুমের দিকে। মড়ার মতো ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজের পাগড়ি। খানিকটা বাদামী রক্ত চাদরে আর চলে যাবার পর খানিকটা অ্যানেসথেশিয়ার গন্ধ ভেসে রইল বাতাসে।

এরপর এলো ডা. রুবি ফ্রাইডম্যান। থিয়েটারের পোশাক বদলে পরে এসেছে দামী একটা হালকা ওজনের ধূসর স্যুট আর বিশ গিনি ডিওর সিল্ক টাই। বেশ টানটান, সুস্থ দেখাচ্ছে তাকে। নিজের অর্জনে বেশ তৃপ্ত বোঝাই যাচ্ছে।

‘দেখেছো তুমি? জানতে চাইল সে। ডেভিড মাথা নাড়তেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল, “অসাধারণ কাজ হয়েছে। আনন্দে হাতে হাত ঘসলো।

‘মাই গড, এরকম কিছু একটা তোমাকে ভালো লাগার অনুভূতি দিবে। যদি আর কিছু সারা জীবনে নাও করো কোন সমস্যা নেই। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। ডেভিডের কাঁধে চাপড় মারলো। অসাধারণ। আবারো বলে উঠল ডাক্তার।

কখন জানতে পারবেন আপনি?’ নিস্তব্ধভাবে জানতে চাইল ডেভিড।

‘আমি জানি। বাজি ধরতে পারি আমার সব সুখ্যাতি।

‘অ্যানেসথেটিক থেকে বের হয়ে আসা মাত্রই সব দেখতে পাবে ও? জানতে চাইল ডেভিড।

‘গুড লর্ড, নাহ! কিড়মিড় করল রুবি। বছরের পর বছর ধরে চাপা পড়ে ছিল এ নার্ভ। সুস্থ হতে খানিকটা সময় লাগবে।

কত সময়?

‘এটা এমন যে ধরো তুমি যদি ঠিক ভাবে না বসো তাহলে ঝিঁঝি ধরবে পায়ে। এরপর রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হলে আরো খানিকক্ষণ কাটলে তারপর স্বাভাবিক হবে পুরোপুরি।

কতক্ষণ পরে?’ আবারো একই প্রশ্ন করল ডেভিড।

‘সে জেগে উঠার পরপরই। নার্ভ সচল হয়ে উঠবে। সব ধরনের সংকেত পাঠাতে থাকবে ব্রেইনের মাঝে। রং আর আকার দেখতে পাবে যেন নেশার ঘোরে দেখা। তারপর স্থির হতে সময় লাগবে দুই সপ্তাহ থেকে এক মাস আমার তাই ধারণা—এরপর পরিষ্কার হবে সবকিছু। নার্ভ পুরোপুরি সেরে উঠে নিজের কাজ করা শুরু করবে। এরও পরে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে সে।’

‘দুই সপ্তাহ। বলে উঠল ডেভিড। মনে হলো বন্দী দশা থেকে মুক্তি পেল

‘তুমি তাকে জানিয়ে দিও শুভ সংবাদটা। আবারো খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল রুবি। আবারো ডেভিডের কাঁধে চাপড় মারার জন্য উদ্যত হয়েও নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। কত সুন্দর একটা উপহার ওকে দিতে পারছো তুমি।

না।’ উত্তর দিল ডেভিড। আমি এখন তাকে জানাব না। পরে কোন এক উপযুক্ত সময়ে।

‘তোমাকে প্রথমে ওকে ব্যাখ্যা করে বলতে হবে প্রাথমিক ব্যাপারগুলো। নয়তো আঁতকে উঠবে ও।

‘আমরা ওকে শুধুমাত্র এটুকু বলব যে এটা অপারেশনের পরের এক ধরনের প্রভাব। এর সাথে মানিয়ে নেয়ার পরে পুরো ব্যাপারটা বলব তাকে।

‘ডেভিড, আমি–’ সিরিয়াস ভঙ্গিতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল রুবি। কিন্তু থেমে গেল বিভৎস মুখোশের আড়ালে নীল চোখ দুটো জ্বলে উঠতে দেখে।

‘আমি জানাবো ওকে! কণ্ঠস্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে এক পা পিছিয়ে গেল রুবি। আমিই জানাবো ওকে যখন সময় হবে। এটাই ছিল শর্ত।

.

অন্ধকারের মাঝে জ্বলে উঠল ছোট্ট হলুদ একটা আলো। মনে হল অনেক দূর থেকে দেখছে সে। এরপর আলোটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এরপর সেগুলো আবার ভেঙ্গে গেল। এভাবে পুরো পৃথিবী মনে হল তারায় ভরে গেল। উজ্জ্বল তারাগুলো জ্বলতে লাগল, নিভতে লাগল। এরপর হলুদ থেকে রং বদলে হয়ে গেল উজ্জ্বল সাদা। মনে হল দ্যুতি ছড়াতে লাগল হীরা। এরপর হয়ে গেল নীল সমুদ্রের বুকে সূর্যের মতো। এরপর নরম সবুজ, মরুভূমির মতো সোনালি-অন্তকালবিহীনভাবে একের পর এক দেখা দিতে লাগল রং। বদলে যাচ্ছে, বেঁকে-চুরে ভেঙ্গে যাচ্ছে, একে অন্যের সাথে মিশে যাচ্ছে।

এরপর—আকৃতি পেল রং। শক্তিশালী চাকার মতো ঘুরতে লাগল, এরপর মনে হল বিস্ফোরিত হয়ে ঝরে পড়তে লাগল নদীতে। এরপর আবারো মনে হল আলোর ঝরণা দেখা গেল।

আশ্বর্য হয়ে গেল ডেবরা রং আর আকৃতির খেলা দেখে। সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে গেল। এরপর যখন আর সহ্য করতে পারল না, চিৎকার করে উঠল।

সাথে সাথে অনুভব করল হাতের স্পর্শ। শক্তিশালী পরিচিত হাত। আর সেই কণ্ঠস্বর। ভরসা আর ভালোবাসার কেন্দ্র।

‘ডেভিড।’

‘আস্তে ডার্লিং, তোমার রেস্ট দরকার।’

‘ডেভিড। ডেভিড।’ কিছুই বলতে পারছে না ডেবরা। নিজের গলার মাঝে কী যেন দলা পাকিয়ে উঠে এলো বুঝতে পারল। এত রং, আকৃতি, বৈচিত্র্য দেখে অভিভূত হয়ে গেল সে।

‘আমি এখানে, ডার্লিং। এখানেই আছি।

কী হচ্ছে আমার সাথে, ডেভিড? কী হচ্ছে?

‘তুমি ঠিক আছে। অপারেশন সফল হয়েছে। তুমি একদম ঠিক আছে।

‘রং।’ আবারো চিৎকার করে উঠল ডেবরা। আমার পুরো মাথা ভরে গেছে। আমি কখনো আর এমনটা দেখিনি।’

‘এটা অপারেশনের প্রভাব। বোঝা যাচ্ছে সফল হয়েছে। ওরা সারিয়ে দিয়েছে সমস্যা।

‘আমার ভয় লাগছে ডেভিড।

না, ডার্লিং। ভয় পাবার কিছু নেই।

‘আমাকে ধরো ডেভিড। আমাকে ধরে রাখে। আস্তে আস্তে নির্ভার হল ডেবরা। সমুদ্রের মতো অন্তহীন ঢেউ আর রঙের মাঝে ভেসে বেড়াতে লাগল। এরপর বিস্ময় মেশানো আনন্দ নিয়ে মেনে নিল ব্যাপারটা।

‘এটা বেশ সুন্দর ডেভিড। আমার আর ভয় লাগছে না। তুমি ধরে রাখায় আর ভয় লাগছে না।’

‘আমাকে বলো কী দেখছো?

বলতে পারব না। বর্ণনা করা অসম্ভব। আমি শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘চেষ্টা করো।’ বলে উঠল ডেভিড।

.

স্যুইটে একা বসে আছে ডেভিড। মধ্যরাতের পর নিউইয়র্ক থেকে ফোন এলো। অনেক আগে থেকেই চেষ্টা করছিল সে।

‘রবার্ট ডগান বলছি।’ ব্যবসায়ীর মতো কণ্ঠস্বরে কথা বলে উঠল ববি

‘ডেভিড মরগ্যান।

‘কে?

‘ডেবরা মোরদেসাইয়ের পতি।’

‘ওয়েল, হ্যালো ডেভিড।’ বদলে গেল এজেন্টের গলার স্বর। ভাল লাগছে আপনার সাথে কথা বলে। কেমন আছে ডেবরা? স্পষ্ট বোঝা গেল যে ডেভিডের উপর ববির আগ্রহ শুরু ও শেষ হবে ডেবরাকে দিয়ে।

‘এই কারণেই আমি ফোন করছি। একটা অপারেশনের কারণে এখন হাসপাতালে আছে সে।

‘গড! তেমন সিরিয়াস নয় তো?’

‘ও ভালো হয়ে যাবে। কয়েকদিনের মাঝেই। আর কয়েক সপ্তাহের মাঝে কাজ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।’

‘শুনে ভালো লাগল ডেভিড।’

‘দ্যাটস গ্রেট!’

‘দেখুন আমি চাই আপনি এগিয়ে যান আর আ প্লেস অব আওয়ার ওন এর জন্য স্ক্রিপ্ট লেখার কাজের ব্যাপারে কথা-বার্তা শুরু করুন।

‘সে এটা করবে?’ ছয় হাজার মাইল দূরে বসেও ববির খুশি টের পেল ডেভিড।

‘ ও এটা করবে।

‘এটা তো বেশ ভালো খবর, ডেভিড।

‘একটা ভালো কন্ট্রাক্ট লিখে দেবেন।

‘এটা নির্ভর করে। আপনার এই লিটল গার্ল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি লক্ষ্য রাখবো যেন ওর কোন ক্ষতি না হয়। সত্যি!

কতদিন লাগবে এ কাজ শেষ হতে?

ছয় মাস। অনুমান করল ববি।

‘যে প্রযোজক এটা করবে তিনি এখন রোমে একটা ছবি নিয়ে ব্যস্ত।

‘সম্ভবত ওখানেই ডেবরাকে ডেকে নিতে পারেন। জানাল ডুগান।

‘ভালোই হলো। ও রোম পছন্দ করবে। উত্তরে জানাল ডেভিড।

‘ওর সাথে আপনিও আসবেন ডেভিড?’

না।’ সাবধানে উত্তর দিল ডেভিড। ও একাই আসবে।’

‘ও একা আসতে পারবে? চিন্তিত শোনাল ববির কণ্ঠস্বর।

‘এখন থেকে নিজের সব কাজ নিজেই করতে পারবে সে।

‘আশা করি আপনি ঠিক কথা বলছেন। দ্বিধায় পড়ে গেল ববি।

‘আমি ঠিক বলছি। তাড়াতাড়ি বলে উঠল ডেভিড। আরেকটা কথা। লেকচার টুর, সে ব্যাপারটা?

‘ওরা তো দরজায় কড়া নাড়ছে। যেমনটা আমি বলেছিলাম পিস্তলের চেয়েও হট হয়ে গেছে এখন সে।

‘স্ক্রিপ্ট হয়ে গেলে কাজে ঠিক করে দেবেন।

‘হেই, ডেভিড। এই হলো ব্যবসা। এখন আমরা সত্যি গ্যাস নিয়ে রান্না করছি। আমরা আপনার ছোট্ট মেয়েটাকে সম্পদ বানিয়ে ফেলবো।’

‘তাহলে তাই করুন। মন্তব্য করল ডেভিড। ওকে বড় করে তুলুন। ব্যস্ত করে ফেলুন। যেন চিন্তা করার অবসর না পায়।

‘আমি ব্যস্ত রাখবো ওকে। এরপর মনে হল যেন কিছু একটা আঁচ করতে পারল। বলে উঠল, ‘কোন সমস্যা হয়েছে ডেভিড? কোন ঘরোয়া সমস্যা? কথা বলতে চান এ ব্যাপারে?

‘না, আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না। আপনি শুধু ওর খেয়াল রাখবেন। ভালো ভাবে।

“ঠিক আছে। নম্র হয়ে গেল ববির গলা। আর ডেভিড’

কী?’

‘আমি দুঃখিত। যাই ঘটুক না কেন আমি দুঃখিত।

“ঠিক আছে। প্রায় সাথে সাথে আলোচনা থামিয়ে দিল ডেভিড। হাত কাঁপতে শুরু করায় টেলিফোনের রিসিভার পড়ে গেল হাত থেকে। চিড় ধরল প্লাস্টিকের গায়ে। এভাবেই সেটাকে ফেলে রেখে হোটেল থেকে বের হয়ে এলো ডেভিড। ঘুরে বেড়ালো ঘুমন্ত শহরের রাস্তায়। ভোর হবার আগে ফিরে এলো রুমে।

রঙের প্রবাহ ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আকৃতি নিতে লাগল। উজ্জ্বলতা দেখে প্রথমবার ভয় পাওয়ার মতো ব্যাপার আর ঘটল না। এরপর ধূসর অন্ধত্ব কেটে গিয়ে মাথা যেন ভরে গেল তুলোর বলে। নতুন ধরনের সৌন্দর্য আর উজ্জ্বলতা অনুভব করল ডেবরা। প্রথম কয়েকদিনের মাঝে মাথায় সার্জারির প্রাথমিক অস্বস্তি কেটে গেল। কেমন একটা ভালো থাকার মতো বোধ তৈরি হল তার মাঝে। কেমন একটা উচ্চাশা জেগে উঠল মনের মাঝে। মনে পড়ে গেল ছোটবেলাকার ছুটির দিনের জন্য অপেক্ষার কথা।

মনে হল মনের গহীনে কেউ একজন বলে উঠল যে তার দষ্টিশক্তি ফিরে আসছে। কিন্তু চেতন মনে পৌঁছালো না, এ সংবাদ। বুঝতে পারল পরিবর্তন ঘটেছে কোথায়। যাই হোক অন্ধকারের চেয়ে এই উজ্জ্বলতাকে স্বাগত জানাল সে।

কিন্তু সে জানে না রং আর কল্পনার পর আসবে আকৃতি আর বাস্তবতা।

প্রতিদিন ডেভিড অপেক্ষা করে থাকে যে ডেবরা এমন কিছু একটা বলবে যে বোঝা যাবে দৃষ্টি শক্তি ফিরে আসার ব্যাপারটা, বুঝতে পারছে সে। আশা আর সতর্কতা একসাথে দুলে ওঠে মনের মাঝে কিন্তু কিছুই বলে না ডেবরা।

হাসপাতাল যতটুকু মেনে নেয় ততটুকুর পুরো সময়টাই ডেবরার সাথে কাটায় ডেভিড। প্রতিটি মিনিট চেষ্টা করে ধরে রাখতে। যেমন করে কৃপণ গুণে। গুণে পয়সা খরচ করে। ডেবরার আনন্দ আর উত্তেজনা সঞ্চারিত তার মাঝে ও। একসাথে হাসে দু’জনে। কল্পনা করে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই একসাথে ফিরে যাবে জাবুলানিতে।

কোন দ্বিধা নেই ডেবরার মাঝে। খুশির উপর ছায়া ফেলল না কোন আশংকা। আস্তে আস্তে ডেভিডও ভাবতে লাগল যে বোধ হয় এটাই সত্যি। তাদের আনন্দে কেউ কখনো নজর দিবে না, ভালোবাসা কখনো কমে যাবে না। যত আঘাতই আসুক না কেন? একসাথে হলেই এ বোধ অনুভব করে ডেভিড।

এরপরেও ঠিক করতে পারে না সে যে কখন বলবে ডেবরাকে। মনে হয় এখনো সময় আছে হাতে। দুই সপ্তাহ, রুবি ফ্রাইডম্যানের কথা মতো দুই সপ্তাহ সময় লাগবে বুঝতে যে ডেবরা আদৌ পুরো দেখতে পাচ্ছে কিনা। তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ আনন্দটুকু। কাঙালের মতো এই সবটুকু নিয়ে নিতে চায় ডেভিড।

একাকী রাতগুলোতে ভয়ঙ্কর সব চিন্তা ঘুমাতে দেয় না তাকে। মনে পড়ে যায় প্লাস্টিক সার্জন একবার বলেছিল যে তারা তাকে খানিকটা সহনীয় করে দিতে পারবে সার্জারির মাধ্যমে। তাই ফিরে গিয়ে আবারো ছুরির নিচে শুয়ে পড়ার কথা মনে এলো। যদিও কেঁপে উঠল সারা শরীর এহেন সম্ভাবনায়। হতে পারে ডেবরা তাহলে আরেকটু কম ভয়ঙ্কর একটা চেহারা দেখবে।

পরের দিন আদারলী স্ট্রিটে শত শত আগ্রহী চোখ উপেক্ষা করে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেল ডেভিড। উইগ ডিপার্টমেন্টের মেয়েরা প্রাথমিক ভয় কাটিয়ে উঠে তাকে নিয়ে গেল গম্বুজাকৃতির মাথা ঢাকার জন্য উইগ খুঁজে দিতে।

নিজের ক্ষত-বিক্ষত জমে যাওয়া মুখের উপর পরার জন্য কোকড়া চুলের পরচুলা পছন্দ করে নিল ডেভিড। প্রথম বারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখে হেসে ফেলল সে। যদিও ব্যাপারটা হয়ে উঠল আরো ভয়ঙ্কর। ঠোঁট বিহীন মুখে মনে হল ফাঁদে আটকা পড়া পশু।

‘গড!’ হেসে ফেলল ডেভিড।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনও হার মেনে যাবে।

নিজের অনুভূতির সাথে যুদ্ধ করতে থাকা সেলস গার্ল হিমশিম খেল অস্বস্তি চাপতে গিয়ে।

ডেভিডের মনে হল একথা জানায় ডেবরাকে, কৌতুক করে বলে আর একই সাথে তাকে দেখার জন্য তৈরি করে নেয়। কিন্তু কেন যেন কোন শব্দ খুঁজে পেল না সে। আরো একটা দিন কেটে গেল। কিছুই ঘটল না। শুধুমাত্র ফুরিয়ে আসতে লাগল একসাথে থাকার কাল।

পরের দিন প্রথমবারের মতো অধৈৰ্য্যভাব দেখা গেল ডেবরার মাঝে। ‘ওরা আমাকে কখন ছাড়বে হাসপাতাল থেকে ডার্লিং? আমি পুরো সুস্থ আছি। এভাবে বিছানায় শুয়ে থাকাটা ভয়ঙ্কর। আমি জাবুলানিতে ফিরে যেতে চাই অনেক কিছু করতে হবে আমাকে, অনেক কাজ পড়ে আছে। এরপর হেসে উঠল খিকখিক করে, দশ দিন হয়ে গেছে এখানে বন্দী আমি। এভাবে সাধু জীবন কাটাতে অভ্যস্ত নই আমি। আর তোমাকে সত্যি বলছি, আমি পারছি না তোমাকে ছাড়া।

দরজা বন্ধ করে দেবো?’ পরামর্শ দিল ডেভিড।

‘গড, আমি একটা জিনিয়াসকে বিয়ে করেছি।’ হাসতে লাগল ডেবরা। এরপর বলল, ‘প্রথম বারের মতো টেকনিকালার কিছু ঘটল আমার সাথে। ভালোই লাগছে।’

সেই দিন সন্ধ্যাবেলা রুবি ফ্রাইডম্যান আর ব্রিগ স্যুইটে অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। ফেরার সাথে সাথে ধরল ডেভিডকে।

‘অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছ তুমি। ডেবরাকে আরো আগেই বলা উচিৎ ছিল। দৃঢ়ভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করল ব্রিগ। তিনি ঠিকই বলছেন, ডেভিড। তুমি ঠিক করছ না। ওকে জানানো উচিৎ। মানিয়ে নেয়ার ব্যাপারও আছে। জানাল ফ্রাইডম্যান। সুযোগ পেলেই ওকে জানাবো আমি।’ গোয়ার্তুমির স্বরে বলল ডেভিড।

‘কখন হবে সেটা?’ জানতে চাইল ব্রিগ। রাগের চোটে ঝিক করে উঠল স্বর্ণের দাঁত।

শীঘ্রই।

‘ডেভিড, বোঝাতে চাইল রুবি, এটা এখন যে কোন সময়ে ঘটতে পারে। ও বেশ উন্নতি করেছে এরই মাঝে। আমার আশার থেকেও শীঘ্ন ঘটছে। ব্যাপারটা।

‘আমি দেখবো কী করা যায়।’ বলে উঠল ডেভিড। প্লিজ আমাকে চাপ দিবেন না। আমি তো বলেছি আমি বলব। আর আমি তা করবও। শুধু আমাকে সময় দিন।

“ঠিক আছে। ক্ষেপে গেল ব্রিগ।

‘আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত সময় দেয়া হল তোমাকে। যদি এর ভেতরেও না বল, তাহলে পরবর্তী দায়িত্ব আমার।’

‘আপনি তো একটা নিষ্ঠুর, তাই না? তিক্ততা ঝরে পড়ল ডেভিডের কণ্ঠ দিয়ে। সবাই বুঝতে পারল কতটা রেগে গেছে ব্রিগ। বহু কষ্টে নিজেকে দমন করল সে।

‘আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা। সাবধানে বলে উঠল ব্রিগ। ‘আমিও সহানুভূতি প্রকাশ করছি এ ব্যাপারে। কিন্তু আমার প্রথম চিন্তা ডেবরাকে নিয়ে। তুমি তোমার কথাই ভাবছো। কিন্তু আমি চাই না ও আর আঘাত পাক। এমনিতেই যথেষ্ট সহ্য করেছে। আর নয়। তাকে জানিয়ে দাও এবার।’

হ্যাঁ।’ মাথা নাড়ল ডেভিড। সমস্ত যুদ্ধের মনোভাব চলে গেছে।

‘আমি জানাবো।

কখন?” আবারো চাপ দিল ব্রিগ।

কাল। জানাল ডেভিড। আগামীকাল সকালে ওকে জানাবো আমি।

দিনটা শুরু হলো বেশ উজ্জ্বলতা আর উষ্ণতা নিয়ে। তার রুমের নিচের বাগানে দেখা গেল রঙের খেলা। নিজের স্যুইটে নাশতা খেতে খেতে সকালের সব খবরের কাগজ পড়ে ফেলল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। এরপর যত্ন করে পোশাক পড়ল। গাঢ় রঙের স্যুট, লাইলাক শার্ট, এরপর যখন বের হতে যাবে, তখন আয়নায় দেখল নিজেকে।

‘অনেক দিন হয়ে গেছে–তারপরেও তোমার সাথে সহজ হতে পারছি। আমি।’ আয়নায় অবয়বকে বলে উঠল সে।

‘শুধু প্রার্থনা করি কেউ একজন যে তোমাকে ভালোবাসে সে পারবে।

পোর্টিকোর নিচে দারোয়ান ক্যাব ডেকে রেখেছে তার জন্য। পাকস্থলীতে গুড়গুড় ভাব নিয়ে পিছনের সিটে উঠে বসল ডেভিড। সকালবেলা দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে গেল গাড়ি। হাসপাতালের প্রধান প্রবেশ মুখে নামল সে। তাকাল ঘড়ির দিকে। এগারোটা বেজে কয়েক মিনিট। লবি পার হয়ে এলিভেটরে যাবার সময় আজ মনে হয় খেয়াল করল না উৎসাহী দৃষ্টিগুলোর প্রতি।

ডেবরার ফ্লোরের ভিজিটরস রুমে ওর জন্য অপেক্ষা করছে ব্রিগ। করিডোরে বের হয়ে এলো ব্রিগ। লম্বা, সিভিলিয়ান স্যুটে অচেনা লাগল তাকে।

‘আপনি কী করছেন এখানে? জানতে চাইল ডেভিড। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ব্রিগের এ সময় এখানে থাকাটা।

‘আমি ভাবলাম সাহায্য করি তোমাকে।

‘ভালোই ভেবেছেন!’ বিদ্রুপাত্মকভাবে বলে উঠল ডেভিড। নিজের রাগ লুকানোর কোন চেষ্টা করল না। এ ব্যাপারটাকে পাত্তা দিল না ব্রিগ। তুমি কী চাও আমি তোমার সাথে থাকি?”।

‘না। কথা বলতে বলতে অন্য দিকে চলে যেতে উদ্যত হল ডেভিড।

‘আমি সব ঠিক করে নেব। ধন্যবাদ। করিডোর ধরে হাঁটতে লাগল সে। ডেভিড! নরম স্বরে ডেকে উঠল ব্রিগ। একটু দোনোমোনো করে ফিরে তাকাল ডেভিড। কী? জানতে চাইল সে।

দীর্ঘক্ষণ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ল ব্রিগ। না, কিছু না। তাকিয়ে দেখল দীর্ঘদেহী তরুণ, দানবীয় মাথা নিয়ে গটগট করে হেঁটে ঢুকলো ডেবরার রুমে। খালি করিডোরে শোনা গেল পায়ের শব্দ।

সমুদ্রের দিক থেকে আসা হালকা বাতাসে আরামদায়ক উষ্ণ হয়ে আছে সকালবেলাটা। খোলা জানালার কাছে নিজের চেয়ারে বসে আছে ডেবরা। বাতাস বয়ে নিয়ে আসছে পাইনের সুগন্ধ। এর সাথে মিশে গেছে সমুদ্রের মৃদু গন্ধ। চুপচাপ আত্মমগ্ন হয়ে কিছু একটা ভাবছে মেয়েটা। অথচ আজ দেরি করে এসেছে ডেভিড। একটু আগেই রুবি ফ্রাইডম্যানের সাথে কথা হয়েছে। রাউন্ড দিতে এসেছিল ডাক্তার, ডেবরাকে জানিয়ে গেছে যে এক সপ্তাহের মাঝে রিলিজ দেয়া হবে তাকে।

সকালবেলায় উষ্ণতার সাথে কেমন একটা ঘুম ঘুম আবেশও জড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে আপন মনে কোকুনের মতো করে আলোর খেলা দেখছে। তদ্ৰামতো এলো চোখে।

এভাবেই দেখতে পেল ডেভিড। পাশে পা ছড়িয়ে বসে আছে ডেবরা চেয়ারে। জানালা দিয়ে আসা আলো পড়েছে চোখে মুখে। মাথার পাগড়ি পরিষ্কার আর গায়ের পোশাক বিয়ের গাউনের মতোই সাদা।

চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে ডেবরাকে দেখল ডেভিড। মুখটা পাণ্ডুর দেখাচ্ছে। কিন্তু চোখের ঘন পাপড়ি পরিষ্কার আর ঠোঁট দুটো শান্ত, সুন্দর।

স্নেহের বাৎসল্যে সামনে ঝুঁকে মেয়েটার গালে হাত দিল ডেভিড। ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকাল ডেবরা। মধুরঙা অনিন্দ্যসুন্দর সোনালি চোখ। কুয়াশা মাখা। দৃষ্টিহীন কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। এরপর হঠাৎ করেই বদলে গেল সবকিছু। পরিষ্কার দেখতে পেল ডেভিড। তীক্ষ্ণ, সজাগ হয়ে উঠল সে দৃষ্টি। স্থির হয়ে গেল। তার দিকে তাকিয়ে আছে ডেবরা; ডেভিডকে দেখছে

গালে স্পর্শ পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল, ডেবরা। এত হালকা যেন বসন্তের পাতার ছোঁয়া পেল। নরম সোনালি রঙা মেঘের মাঝে দিয়ে তাকাল যেন সে। এরপর হঠাৎ করেই মনে হলো সকালের বাতাস সরিয়ে নিয়ে গেল। কুয়াশা। মেঘ ভেসে গেল। তাকিয়েই দেখতে পেল দানবীয় একটা মাথা ঝুঁকে আছে তার দিকে। আকৃতিবিহীন মাথাটা মনে হল নরকের অংশ। চেয়ারে ধপ করে ধাক্কা খেলো ডেবরা। হাত তুলে মুখ ঢেকেই চিৎকার করে উঠল।

ঘুরে দৌড় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ডেভিড। পিছনে ঠাশ করে বাড়ি খেল দরজা। প্যাসেজ বেয়ে নেমে গেল পদশব্দ। শব্দ শুনে এগিয়ে এলো ব্রিগ।

‘ডেভিড! হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইল। ডাকতে চাইল। কিন্তু তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো ছিটকে চলে গেল ডেভিড। বুকের মাঝে কিছু একটার বাড়ি খেয়ে যেন দেয়ালে গিয়ে আছাড় খেল ব্রিগ। ভারসাম্য ফিরে পেয়ে বুকে হাত ঘসে এগিয়ে আসতে আসতে চলে গেছে ডেভিড। সিঁড়ির উপর থেকেও শোনা যাচ্ছে উন্মাদের মতো পায়ের আওয়াজ।

‘ডেভিড! গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে শুনতে পেল ব্রিগ। দাঁড়াও!’ কিন্তু চলে গেছে ছেলেটা। আর শোনা গেল না পদশব্দ। যেতে দিল ব্রিগ। এর পরিবর্তে তাড়াতাড়ি করিডোরের ওপারে হিস্টিরিয়ার মতো চিৎকার করতে থাকা কন্যার দিকে দৌড় লাগাল।

হাত থেকে মুখ তুলে তাকাল ডেবরা। দরজা খোলার আওয়াজ পেল। চোখে দেখা গেল ভয়।

‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি।’

তাড়াতাড়ি মেয়ের কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরল ব্রিগ।

“ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আশ্বস্ত করতে চাইল মেয়েকে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’

বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে থামাতে চাইল ডেবরা।

‘আমি দুঃস্বপ্ন দেখেছি। বিড়বিড় করতে লাগল ডেবরা। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। এরপর বাবাকে ধাক্কা দিল।

‘ডেভিড।’ চিৎকার করে উঠল সে। ডেভিড কোথায়? আমি ওকে দেখবো।

শক্ত হয়ে গেল ব্রিগ। বুঝতে পারল কিছুই বুঝতে পারেনি ডেবরা।

‘আমি ওকে দেখবো। বারবার একই কথা বলতে লাগল সে। ভারী কণ্ঠে উত্তর দিতে বাধ্য হল ব্রিগ, তোমার সাথে ওর দেখা হয়েছে, মাই চাইল্ড।’

কয়েক সেকেন্ড ধরে কিছুই বুঝতে পারল না ডেবরা। এরপর আস্তে করে বলে উঠল,

‘ডেভিড?’ ফিসফিস করে উঠল ডেবরা। ভেঙ্গে যাচ্ছে গলার স্বর, ডেভিড ছিল ওটা?’

মাথা নাড়ল ব্রিগ। দেখতে পেল ভয়ার্ত হয়ে গেল ডেবরার দৃষ্টি।

“ওহ্ ডিয়ার গড! কেঁদে উঠল ডেবরা। আমি কী করেছি? আমি ওকে দেখে চিৎকার করেছি। আমি কী করেছি এটা? আমি ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি।’

‘তো তুমি তাকে এখনো দেখতে চাও? জানতে চাইল ব্রিগ।

কী বলছো বাবা?’ ক্ষেপে উঠল ডেবরা। এই পৃথিবীর অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে বেশি। তুমি জানো এটা!

‘এমনকি ও এখন দেখতে যেমন তার পরেও?

‘যদি ভাবো যে এটা আমার মাঝে কোন পার্থক্য তৈরি করবে–তাহলে তুমি আমাকে চেনোই না। আবারো বদলে গেল ওর চেহারা। চিন্তিত হয়ে উঠল। ওকে খুঁজে বের করো। নির্দেশ দিল ডেবরা। তাড়াতাড়ি করো। নয়তো কিছু একটা করে বসবে।

‘আমি জানি না ও কোথায় গেছে। উত্তর দিল ব্রিগ। তার নিজের চিন্তা বেড়ে গেল ডেবরার কথা শুনে।

‘একটাই জায়গা আছে ওর যাবার। জানাল ডেবরা। ও আকাশে উড়ে গেছে।

‘হ্যাঁ, তাই হবে।’ একমত হলো ব্রিগ।

‘এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে জানাও। তাহলেই ওর সাথে কথা বলতে পারবে তুমি। দরজার দিকে এগোল ব্রিগ! আকুতি জানাল ডেবরা। ওকে খুঁজে আনো আমার জন্য, প্লিজ ড্যাডি।

.

নাভাজো উড়ে চলল দক্ষিণ দিকে। গোলাকার নাকটা কোর্সে স্থির হবার পর সোজা উঠে যেতে শুরু করল নীল স্বর্গের দিকে। ডেভিড জানে সে কোথায় যাচ্ছে।

পেছনে পর্বতপ্রমাণ মেঘের দল সরে গেছে দূরে। এখানেই ভূমি শেষ হয়ে গেছে। সামনে পড়ে আছে শুধুই বরফ আর ঠাণ্ডা সমুদ্র।

নিজের ফুয়েল গজ চেক করে দেখল ডেভিড। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আছে। তারপরেও দেখতে পেল কাটাটা অর্ধেকের একটু উপরে উঠে কাঁপছে।

তিন ঘণ্টা ধরে উড়ছে সম্ভবত। চনমনে ভাব এলো ডেভিডের মনে যে যন্ত্রণা শেষ হতে চলেছে। পরিষ্কাভাবে দেখতে পেল যে সামনে কীভাবে শেষ হবে সবকিছু। উপরে উঠে যাবে শুধু। তারপর এক সময় ইঞ্জিন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেবে। এরপর সে নাকটাকে নিচে নামিয়ে দ্রুত নেমে যাবে। যেমন ভাবে ঝাঁপ দেয় ঈগল। তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যাবে সবকিছু। ধাতব ফিউজিলাজ তাকে এত নিচে নিয়ে যাবে যেখানে সে ততটা একা হবে না, যতটা এখন আছে।

রেডিও কড়কড় করে উঠল। শুনতে পেল এয়ার ট্রাফিকের ঘোৎঘোৎ. আওয়াজ। যেই না সুইচ টিপে বন্ধ করতে যাবে–সেই সময় শুনতে পেল পরিচিত কণ্ঠস্বর।

‘ডেভিড, ব্রিগ বলছি। ঠিক এই গলাতেই কথাগুলো শুনেছে ডেভিড অন্য ককপিটে, অন্য দেশে বসে।

‘তুমি একবার আমার কথা অমান্য করেছিলে। এবার করো না। আর।

মুখ শক্ত হয়ে গেল ডেভিডের। সুইচ বন্ধ করতে যাবে সে, বুঝতে পারল তারা রাডারে দেখছে তাকে। ওর কোর্স জানে, ব্রিগ অনুমান করেছে সে কী করতে চলেছে। যাই হোক কিছুই করার নেই তাদের আর।

‘ডেভিড’, নরম হল ব্রিগের গলা। কয়েকটা শব্দ বেছে নিল যেন ডেভিড শোনে তার কথা।

‘আমি এইমাত্র ডেবরার সাথে কথা বলেছি। ও তোমাকে চায়। তোমাকে সর্বস্ব দিয়ে চায়।’

সুইচের উপরে হাত থেমে গেল।

‘আমার কথা শোন ডেভিড। তোমাকে ওর দরকার–সব সময় দরকার হবে।

চোখ পিটপিট করল ডেভিড। চোখ ভরে গেল পানিতে। দৃঢ়তা ভেঙ্গে যাচ্ছে।

‘ফিরে এসো ডেভিড। ওর জন্য ফিরে এসো।

বুকের ভেতরের অন্ধকার থেকে দেখা গেল ছোট্ট একটু আলো। আস্তে আস্তে উজ্জ্বলতা পেল এ বিন্দু। ভরে গেল ওর চারপাশ।

‘ডেভিড, ব্রিগ বলছি। আবারো শোনা গেল বৃদ্ধ সৈনিকের কর্কশ কণ্ঠস্বর।

‘এখনি বেসে ফিরে এসো।

হেসে ফেলল ডেভিড। মুখের কাছে ধরল মাইক্রোফোন। চাপ দিল ট্রান্সমিট বোতামে। পুরোন হিব্রু ভাষায় কথা বলে উঠল।

‘রিসেডার! ব্রাইট ল্যান্সের লিডার বলছি। ফিরে আসছি।’ খাড়া ভাবে ঘুরে গেল নাভাজো। দিগন্তের কাছে নীল হয়ে নেমে গেছে। পর্বতমালা। এর কাছে নাক নামিয়ে দিল ডেভিড। জানে এটা সহজ হবে না– সমস্ত সাহস আর ধৈর্য নিয়ে এ কাজ করতে হবে। আবার এও জানে যে সমাপ্তি অবশ্যই ভাল হবে। হঠাৎ করেই মনে হল জাবুলানিতে ফিরে গিয়ে ডেবরার সাথে একা হতে চায় সে।

Exit mobile version