পাথরের গলির ভেতর সিরিয়ানটার পিছু নিল ডেভিড। দুই পাশের পাথরে ঘষা খাচ্ছে মিরেজের পাখার মাথা। তাড়াতাড়ি পাখা নামিয়ে অনুসরণ করে চলল ডেভিড। সতর্কবার্তা হিসেবে লাল আলো জ্বলে উঠল মিরেজের মাঝে।
অথচ সামনে ঠিকই পথ করে নিয়ে এগিয়ে পেছনে তাকাল পাইলট। দেখতে পেল অনুসরণ করে আসছে মিরেজ। ধীরে ধীরে প্রায় সিরিয়ানের ঘাড়ের উপর চলে এসেছে। আবারো কন্ট্রোলের উপর মনোযোগ দিল পাইলট। নিচে নামিয়ে আনল নিজের মেশিনকে পাথরের দেয়ালে প্রায় ঘষটে ঘষটে চলেছে পাখা।
পাহাড়ের ভিতর বাতাস ক্রমেই গরম আর দূষিত হয়ে উঠছে। এদিকে মিরেজও অস্থির হয়ে উঠেছে মুক্ত হবার জন্য। অন্যদিকে এখনো ডেভিডের গান সাইটের কেন্দ্রবিন্দুতে এদিক-ওদিক দুলছে সিরিয়ান মিগ।
আবারো মোড় এলো উপত্যকার মাঝে। হয়ে গেল আরো সরু। হঠাৎ করেই দেখা গেল সামনে পাথরের কঠিন কিন্তু মসৃণ দেয়ালে পথ হয়ে গেছে বন্ধু।
ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে সিরিয়ান প্লেন। চেষ্টা করল উপর দিকে উঠে যাবার। কিন্তু দু’পাশে আর সামনে সব দিকেই পথ আটকে ফেলেছে পাথরের দেয়াল।
থ্রটল টেনে আফটারবার্নারস জ্বালিয়ে দিল ডেভিড। গর্জে উঠল শক্তিশালী ইঞ্জিন; সামনে ঠেলে দিল ডেভিডকে। সিরিয়ান মিগের স্টার্নের দিকে এগিয়ে গেল মিরেজ।
মনে হলো অনন্তকাল ধরে চলতে লাগল এই মাইক্রো সেকেন্ড। অলস ভঙ্গিতে মিরেজের গান সাইটে উঠে এলো সিরিয়ান মিগ। কেন্দ্র দখল করে এমনভাবে মূর্ত হয়ে উঠল, মনে হলো মিরেজের নাকটা হয়তো মিগের লেজের মাঝে ঢুকে যাবে।
কামানের ট্রিগার চাপ দিল ডেভিড। কেঁপে উঠল মিরেজ। ফায়ারের সাথে সাথে ধোয়া আর শেল ছুটলো সামনের দিকে।
রূপালি ধোয়ার ভস্মীভূত হয়ে গেল সিরিয়ান মিগ। উজ্জ্বল সাদা আলো জ্বলে উঠল আকাশপানে। ফিউজিলাজ দিয়ে পরিষ্কার দেখা গেল পুড়ছে পাইলটের শরীর। এক মুহূর্তের জন্য স্পষ্ট করে সব দেখা দিল ডেভিডের স্ক্রিনে। হাত আর পাগুলো দুই পশে ছড়িয়ে দিল পাইলট। মনে হলো ক্রুশে দেয়া হচ্ছে তাকে। মাথায় হেলমেট আর পরনের কাপড় বেলুনের মতো উড়ছে বাতাস পেয়ে। এরপরই অদৃশ্য হয়ে গেল সব। কেননা দ্রুত উপত্যকা থেকে উপরে উঠে খোলা আকাশে বের হয়ে এলো মিরেজ।
নিজেদের গাড়ির মাঝে মাঝে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে সৈন্যরা। নিজেদের ক্ষত বেঁধে নিচ্ছে, মৃতদেহ ঢেকে দিচ্ছে। কিন্তু রাস্তার খুব নিচু দিয়ে ডেভিডকে উড়ে আসতে দেখে চোখ তুলে তাকাল সকলে। এত কাছ দিয়ে উড়ে গেল ডেভিড যে পরিষ্কার দেখতে পেল সবার চেহারা। রোদে পোড়া বাদামী ত্বক, কারো আছে দাড়ি, কারো মোচ, শক্তিশালী তরুণ চেহারা, হাত নেড়ে ডেভিডকে ধন্যবাদ জানিয়ে উল্লাসে চিৎকার করে উঠল সকলে।
এরা সবাই আমার আপনার লোক; ভাবল ডেভিড। ঝড়ের গতিতে এখনো রক্তে মিশে যাচ্ছে অ্যাড্রেনালিন। কেমন অদ্ভুত বোধ হলো নিজেকে তার। নিচে মানুষের দিকে তাকিয়ে হাসল সে ও। গ্লাভস পরা এক হাত তুলে স্যালুট জানাল তাদের উদ্দেশে। এরপর উঠে গেল উপরে ব্রিগ চক্রাকারে ঘুরে অপেক্ষা করছে ওর জন্য।
সূর্যের উজ্জ্বল আলোর তুলনায় স্নান দেখাল বাঙ্কারের কৃত্রিম আলো। একজন ইঞ্জিনিয়ার এগিয়ে এসে ককপিট থেকে নামতে সাহায্য করল ডেভিডকে। অন্যরা এসে মিরেজের রিফুয়েল আর বি-আর্মের কাজ শুরু করল। এই ছোট্ট এয়ারফোর্সের এটাই বড় গুণ, যুদ্ধের জন্য প্লেনকে প্রস্তুত করতে খানিকটা সময় লেগে যায়। কিন্তু এই মিরেজ ভগ্নাংশের মাঝে প্রস্তুত হয়ে যায়। তাই প্রয়োজনের সময় শক্রর বহু আগেই যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে যায় মিরেজ।
ককপিটের আড়ষ্টতা থেকে মুক্তি পেয়ে ডেভিড এগিয়ে গেল ব্রিগের দিকে। ফ্লাইট কন্ট্রোলারের নিচে হেলমেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিগ। হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে তাকিয়ে দেখল এগিয়ে আসছে ডেভিড। হাসল দ্বিগ। ঝিকঝিক করে উঠল স্বর্ণের দাঁত।
আস্তে করে চাপড় দিল ডেভিডের কাঁধে। কেন! ইয়েস!’ বলে উঠল জেনারেল জোশুয়া মোরদেসাই। তুমি পারবে।’
.
সন্ধ্যায় ডেবরার সাথে ডিনারে দেখা করতে দেরি করে ফেললো ডেভিড। যদিও আগেই বাবার কাছে কারণটা শুনতে পেয়েছে ডেবরা।
ডেভিডের টাওয়ারের পেছনে সিলেক্টে গেল তারা পুরোনো শহরের জাফো গেটের ভেতরে। এর আটপৌরে অন্দর সজ্জা, দেয়ালের উপর দড়ির সজ্জা কিছুই একটু পরে পরিবেশিত হওয়া সুস্বাদু খাবারের আভাস দিতে পারল না
ডেভিডকে। একটুও তেমন দেরী না করে খাবার দিয়ে গেল আরবীয় পরিবেশক—মৌশাখা চিকেন, কুসকুসের উপর ছড়ানো বাদাম আর মসলা।
প্রায় নিঃশব্দে খেতে লাগল দুজনে। ডেভিডের মড বুঝতে পেরে শ্রদ্ধা জাগলো ডেবরার মনে। যুদ্ধ পরবর্তী আবেশে মগ্ন হয়ে আছে ডেভিড। উদ্বেগ আর উত্তেজনায় বয়ে গেছে অ্যাড্রেনালিন। কিন্তু পেটে ভালো খাবার পড়ায় আর ভারী কামেল ওয়াইন সাহায্য করল রিল্যাক্স হতে। এরপর এলাচি দানার ঘ্রাণওয়ালা কালো, টার্কিশ কফি শেষ করার পরেই কেবল ডেবরা ফুরসত পেল কথা বলার।
‘আজ কী হয়েছে, ডেভিড?
উত্তর দেবার আগে এক চুমুক কফি খেল ডেভিড।
‘আমি একজন মানুষকে মেরে ফেলেছি। নিজের কাপ নামিয়ে রেখে মনোযোগ দিয়ে ডেভিডের চেহারা দেখতে লাগল ডেবরা। এরপর পুরো ঘটনা তাকে খুলে বলল ডেভিড। পিছু ধাওয়া করা, মেরে ফেলা; এরপর শেষ করল অনুতাপের স্বরে। ঐ সময়ে আমি কেবল তৃপ্তিই বোধ করেছি। কিছু একটা পেয়েছি মনে হয়েছিল। আমি জানি সে সময় যা করেছি সেটাই ছিল সঠিক।