‘তুমি ওর, সাথে কথা বলতে চাও?’ জানতে চাইল মিটজি। আমি তাকে জাগিয়ে দিচ্ছি।’ বিড়বিড় শব্দে কিছু শোনা গেল অপরপাশে। তারপরই লাইনে এলো সিসিল।
‘নাইস ওয়ার্ক, সত্যি কথাই বলল ডেভিড। তার তুলনায় মিটজির শেয়ার নিঃসন্দেহে বেশি মরগ্যান গ্রুপে। নিজেকে তেলের কূপে ফেলে দিয়েছে সিসিল।
‘ধন্যবান, ডেভি। পাঁচ হাজার মাইল পার হয়েও টেলিফোনের তার বেয়ে ঠিকই ভেসে এলো সিসিলের কণ্ঠের অস্বস্তি।
‘শোন, লাভার যদি মেয়েটাকে তুমি একটুও আঘাত দাও, আমি নিজে তোমার কলজে ছিঁড়ে গলা দিয়ে ঢুকিয়ে দেবো, বুঝলে?
‘ঠিক আছে। নিজের কণ্ঠের সতর্কতা ভাব লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো সিসিল। আমি মিটজিকে ফোন দিচ্ছি।
রাখার আগে আরো বকবক করল মিটজি। পঞ্চাশ ডলার খরচ করিয়ে তবেই ছাড়লো সে। মাথার পেছনে হাত দিয়ে শুয়ে রইল ডেভিড। ভাবতে লাগল নরম মনের গাড়ল বোনটা আর নতুন পাওয়া খুশির কথা। এরপর হঠাৎ করেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল ডেভিড। স্পেন ছাড়ার পর থেকেই অবচেতন ভাবে কাজটা করতে চাইছে সে। আবারো ফোন তুলে নিয়ে পোর্টারের ডেস্কে ফোন করল।
‘এত সকালে তোমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু যত শীঘ্ন সম্ভব ইস্রায়েলের ফ্লাইট ধরতে চাই আমি। অ্যারেঞ্জ করতে পারবে প্লিজ?
.
মরুভূমি থেকে আসা মোলায়েম সোনালি কুয়াশায় ঢেকে আছে আকাশ। এর মাঝ দিয়েই উড়ে চলল বিশাল টি.ডব্লিউ.এ. ৭৪৭। টাচ্ ডাউনের ঝাঁকুনি খাবার আগে ঘন সবুজ সিটরাস বাগানের একঝলক দেখতে পেল ডেভিড। পৃথিবীর অন্য সব বিমানবন্দরের সাথে কোন পার্থক্য নেই লডের। কিন্তু এর দরজার বাইরের এমন জায়গা আর কখনো দেখেনি সে। বিশাল এক ভিড়ের সাথে যুদ্ধ করে বড়সড় কালো কন্যুনাল ট্রাক্সির মাঝে একটা সিট পেল ডেভিড। ট্রাক্সির গায়ে প্লাস্টার লাগান আর বিভিন্ন অলংকারও ঝুলছে। এমনকি ভদ্র-সভ্য ইটালিয়দের মাঝেও দেখা গেল উজ্জ্বলতা।
ট্যাক্সিতে উঠে বসার পর মনে হল পরিবারের সবাই মিলে মিশে ঘুরতে বের হয়েছে আর ডেভিডও এই পরিবারেরই সদস্য। তার একপাশে বসে আছে বুকে সেনাবাহিনীর চিহ্ন সম্বলিত প্যারাট্রুপার, গলা থেকে ঝুলছে উজি সাব-মেশিনগান; সিগারেট সাধলো লোকটা ডেভিডকে। অন্যপাশে বসেছে খাকি ইউনিফর্ম পরিহিত এক বালিকা। হরিণ চক্ষু ইস্রায়েলী বালিকার চোখ দুটো হয়ে উঠল আরো ঘন কালো আর সুন্দর, যখন ডেভিডের দিকে ঘুরে তাকাল। প্রায়ই স্যান্ডউইচ আর ভাজা মটরশুটির বল সাধলো ডেভিডকে। পিঠাও নিতে বলল সাথে। আবার নিজের ইংরেজিও ঝালাই করে নিতে লাগল ডেভিডের উপর। সামনের আসনে বসা সবাই ঘুরে তাকাল এই আলোচনায় অংশ নিতে। এদের মাঝে ড্রাইভারও অন্তর্ভূক্ত হলো। যদিও সে তার গতি এতটুকু কম হতে দিল না আর কথার ফাঁকে ফাঁকে যতিচিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করল বিকট শব্দের হর্ন আর পথচারী ও অন্য ড্রাইভারদের উপর গালি-গালাজ।
উপকূলীয় নিচু ভূমিতে কুয়াশার মতই ভারী হয়ে আছে কমলার সুগন্ধ। এরপর থেকে ইস্রায়েলের পরিচিতি হিসেবে এই গান্ধটাই পাবে ডেভিড।
জুদাইয়ান পাহাড়ে উঠে এলো ট্যাক্সি। নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসল ডেভিডকে। পাইনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাইওয়ে, শো শো বাতাস, চারপাশে উজ্জ্বল-ধূসর গড়ানে ভূমি পার হওয়া যেখানে সূর্যের আলোয় সাদা পাথর চকচক করে হাড়ের মতো রুপালি জলপাই গাছগুলো শাখা মেলে রেখেছে ছাদের উপর–যা স্বাক্ষী হয়ে আছে ছয় হাজার বছর ধরে মানুষের ধৈর্যশীল পরিশ্রমের। ডেভিডের মনে হচ্ছে সবকিছুই তার অনেক পরিচিত। যদিও দক্ষিণের অন্তরীপের যেসব পাহাড়ের চেয়ে একেবারে ভিন্ন, যাদেরকে সে ঘর বলে জানে। অনেক ধরনের ফুল দেখা গেল, ঠিক ভাবে নাম বলতে পারবে না সে। ক্রিমসন ফুটে ওঠে রক্তের মতো লাল হয়ে। হঠাৎ করেই ঝাঁকি খাওয়ায় মনে হলো শরীরে ব্যথা পেল সে। এমন সময় চোখ পড়ল গাছের ফাঁকে থাকা চকোলেট রঙের ঝটপটানি আর সাদা পাখা। চিনতে পারল আফ্রিকান হুপির নড়াচড়া–এমন একটা পাখি যার অর্থ ঘরে পৌঁছে গেছে সে।
ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা বোধ করল সে। নাম-ঠিকানাবিহীন এ উদ্বেগ বেড়েই চলল, যত সে পৌঁছে যাচ্ছে সেই নারীর কাছে যাকে দেখতে সে এসেছে–আর এমন কিছু যার ব্যাপারে সে এখনো সন্দিহান।
অবশেষে নিজের শিকড় খুঁজে পেয়েছে সে, এমন বোধ হল তার। কাছাকাছি বসে থাকা তরুণীর জন্য সমবেদনা জাগল।
‘দেখো, চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। ডেভিডের হাত ধরে দেখাতে লাগল রাস্তার পাশে পড়ে থাকা যুদ্ধের আবর্জনার দিকে, পোড়া ট্রাক আর সশস্ত্র বাহন, জেরুজালেমের পথে মারা যাওয়া মানুষের স্মরণার্থে সাজিয়ে রাখা। হয়েছে এগুলো। এখানে যুদ্ধ হয়েছিল।’
সিটের উপর ঘুরে বসে মেয়েটার চোখ-মুখ পরীক্ষা করতে লাগল ডেভিড। দেখতে পেল একই শক্তি আর নিশ্চিন্তের ভাব; ডেবরার যে গুণের প্রশংসা করে সে। এরা এমন মানুষ যারা পুরো দিনটাই উপভোগ করে আর এর কাছাকাছিটুকুই পরের দিন বলে বিবেচনা করে।
“আর যুদ্ধ হবে এখানে? জানতে চাইল ডেভিড।
‘হ্যাঁ। কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই উত্তর দিল মেয়েটা।
“কেন?”
‘কারণ–যদি এটা ভালো হয়–তুমি অবশ্যই এর জন্য লড়বে। এরপরে মেয়েটা হাত দুটো ছড়িয়ে এমন ভঙ্গি করল যেন ঢেকে ফেলবে পুরো ভূমি, আর এর মানুষকে।