পূর্ব অথবা পশ্চিম, ঘরই হলো আসল।
উঁচুস্বরে বলে উঠল ডেভিড। মনশ্চক্ষে দেখতে পেল গ্লাস আর স্টিল দিয়ে ঘেরা উঁচু অফিসে বসে আছে পল মরগ্যান। ধৈর্য নিয়ে বসে আছে যেন একটা জেলে। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে তার জাল। ঠিক এই সময়ে এথেন্সে ছড়িয়ে থাকা জালটা গুটাতে শুরু করে দিল। পল মরগ্যানের চোখে মুখে ফুটে ওঠা তৃপ্তির ছাপটাও যেন স্পষ্ট দেখতে পেল ডেভিড। টেনে নিচ্ছে ডেভিডকে। ধুত্তোরি, আমি তো এখনো রিজার্ভ অফিসার হিসেবে ফ্লাই করতে পারি, মনে মনে ভাবল সে। আর সবসময়ের জন্য লিয়ার তো আছেই যদি বার্নির থেকে নেয়া যায়, তবেই।
গ্লাস রেখে দ্রুত উঠে দাঁড়াল ডেভিড। আত্মরক্ষার ক্ষীণ আশা জেগে উঠেছে মনের মাঝে। ক্যাব থামিয়ে ছুটে চলল সিনডাগমা স্কোয়ারে গ্রান্ডে ব্রেটাগনেতে নিজের রুমে।
অথচ সব সংকল্প উবে যেতে খুব বেশি একটা সময়ও লাগেনি। কেননা রাতের ডিনারে ডেভিডের সঙ্গী হয় জন ডিনোপোলাস, মরগ্যান গ্রুপের গ্রীস এজেন্ট। কৃশকায় রোদে পোড়া বলিরেখাহীন অভিজাত চেহারার জনের চুলে সাদার ছোঁয়া আর বেশভূষাতেও আড়ম্বরহীন।
ডেভিডের সাথে এক টেবিলে বসার জন্য জন নির্বাচন করল বেশ কয়েকটি ইটালিয় স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্সের নারী-তারকাকে। উদ্ধত যৌবন তরুণী নারীর চোখ দুটি ঘন কালো আর উজ্জ্বল। জন ডেভিডকে আফ্রিকা থেকে আগত একজন হীরক কোটিপতি হিসেবে প্রমাণ দেয়ার পর থেকে কালো চোখ দুটোতে রীতিমত আন্দোলন আর ব্যাকুলতা শুরু হয়ে গেল।
ডায়মন্ড যদিও সবচেয়ে সুন্দর, তথাপি মরগ্যান গ্রুপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কোমল সন্ধ্যায় ডায়োনি সিয়াসের ছাদে বসল তারা। লাইকা বেটাস-এর পাথর কেটে ধাপে ধাপে তৈরি করা হয়েছে রেস্টুরেন্টটি; সেন্ট পল গির্জার নিচে।
এঁকেবেঁকে পথ বেয়ে পাইন বনের মাঝখান দিয়ে শান্ত রাতের বাতাসে হাতে মোমবাতি নিয়ে মিষ্টি গান গেয়ে এগিয়ে চলেছে ইস্টার শোভাযাত্রাকারীদের দল। এর অনেক উপরে পাহাড়ের মাথায় অ্যাক্রোপলিসের সোজা কলামগুলো ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়। প্রাচীন আইভরির মতই মাখন রঙা হয়ে আছে এগুলো। এর নিচে মধ্যরাতের পানিতে আলোর মালা গলায় দিয়ে ভাসছে আমেরিকান রনপোত।
‘গ্রিসের বিজয়গাথা ছিল। বিড়বিড় করে উঠল ইটালিয় তারকা। মনে হল যেন প্রাচীন আমলের কোনো তাপসীর গলা। ভারী রত্ন পরা একটা হাত রাখল ডেভিডের উরুতে। আরেকটা হাত দিয়ে লাল সামোস ওয়াইন তুলে ধরল ডেভিডের উদ্দেশে আর এমন ভাবে তাকাল যে ঘন চোখের পাতার নিচের ভাষা বুঝতে সমস্যা হলো না ডেভিডের।
মহিলার ধৈৰ্যশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ডেভিড। ক্রিম দেয়া লেমন সসে ডুবিয়ে রাখা আঙুর পাতায় মোড়ানো মাংস দিয়ে মেইন কোর্স খাবার পরই কেবলমাত্র ইটালিয় তারকা পরামর্শ দিল যে ডেভিড হয়তো তার পরবর্তী ছবিতে অর্থলগ্নী করতে রাজি হয়ে যাবে। চলুন এমন কোন জায়গা খুঁজে বের করি যেখানে বসে এ ব্যাপারে কথা বলতে পারব আমরা। বিড়বিড় করে উঠল নারী তারকা আর তার স্যুইট ছাড়া ভালো জায়গা আর কোনটা হতে পারে?
জুন ডিনোপোলাস হাত নেড়ে বিদায় জানাল তাদেরকে। জনের মুখে হাসি আর বিরক্তিকর একটা ভঙ্গি থেকে পুরো ব্যাপারটার অসাড়তা টের পেল ডেভিড।
নারী তারকার সুইট বেশ চিত্তাকর্ষক। মোটা সাদা কার্পেট আর বড়সড় চামড়ার কালোসোফা। নিজের জন্য ড্রিংক নিল ডেভিড। এই ফাঁকে বেশ পরিবর্তন করতে গেল নারী তারকা। ড্রিংক মুখে নিয়েই ডেভিড বুঝতে পারল যে এটা তার পছন্দ নয়। বার কাউন্টার ছেড়ে চলে আসল সে।
বেডরুম থেকে বের হয়ে এলো নারী তারকা। পরনে সাদা সাটিনের বেডরোব। হাতা কাটা রোবের স্বচ্ছ কাপড় ভেদ করে গোলাপী উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে দেহত্বক। চুল খোলা, আবেদনময়ী ভঙ্গিতে কুঁকড়ে আছে কাঁধের চারপাশে হঠাৎ করেই পুরো ব্যাপারটাতে অসুস্থ বোধ করল ডেভিড।
‘আমি দুঃখিত। জানাল ডেভিড। জন মজা করছিল–আমি কোন মিলিয়নিয়ার নই আর ছেলেদের ক্ষেত্রেই আগ্রহী বোধ করি শুধু।
দরজা বন্ধ করে বের হয়ে এলো ডেভিড। সাথে সাথে শুনতে পেল দরজার গায়ে গ্লাস ভাঙার শব্দ।
নিজের হোটেলের রুমে ফিরে কফির অর্ডার দিল ডেভিড। কী মনে হতেই আবারো টেলিফোন তুলে নিয়ে কেপ টাউনে কল করল। অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে লাইন পেয়ে গেল সে। ঘুম জড়ানো মেয়েলি কণ্ঠ শোনা গেল অপর পাশ থেকে।
‘মিটজি? হেসে ফেলল ডেভিড। কেমন আছে মেয়েটা
? ‘তুমি কোথায় ওয়ারিওর? বাসায়?
‘আমি এথেন্সে, ডল।
‘এথেন্স–গড! যুদ্ধের খবর কী?
টানা হেচড়া করে এগোচ্ছে।
ইয়াহ! আমারই তাই মনে হয়। কাশি দিল মিটজি। গ্রিক গার্লস আর আগের মতো নেই–ডিয়ার।
কেমন আছো মিটজি?’
‘আই অ্যাম ইন লাভ, ডেভি। মানে সত্যিকারের প্রেম। অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি। অদ্ভুত না ব্যাপারটা?’
হঠাৎ করেই রেগে গেল ডেভিড। মিটজির গলার কণ্ঠে মনে হলো হিংসাও এলো ওর মাঝে।
‘দ্যাটস গ্রেট, ডল। আমি কি চিনি ওকে?
‘সিসিল ললি। তুমি চেনো। ড্যাডির অ্যাকাউন্ট্যান্টদের একজন।
বিশালদেহী, বিবর্ণ চেহারা, চশমা পরা আর সিরিয়াস টাইপের একটা মানুষের কথা মনে পড়ে গেল ডেভিডের।
কনগ্রাচুলেশনস,’ বলল ডেভিড। নিজেকে খুব একা মনে হলো। বাড়ি থেকে এত দূরে, তাকে ছাড়াও জীবন সেখানে ঠিকই এগিয়ে চলেছে।