‘তুমি এ ব্যাপারে পড়াশোনা করেছে, মন্তব্য করল বার্নি।
‘হ্যাঁ, স্যার।’ হেসে উত্তর দিল ডেভিড। দাঁতগুলো অদ্ভুত রকম সাদা আর সমান সারিতে বসানো। হাসি থেকে চোখ ফেরানো দায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বার্নি বুঝতে পারল যে সে ছেলেটাকে পছন্দ করা শুরু করেছে।
‘রাইট, চলো ঢুকে পড়ি।
ছোট্ট ককপিটে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসে বার্নি ব্যাখ্যা করল কন্ট্রোল আর ইনস্ট্রমেন্ট সম্পর্কে, এরপর চালানোর পালা।
‘মাস্টার, সুইচ অন করো।’ লাল বোতামে চাপ দিল সে। ঠিক আছে, এবার এই চাবি–ঠিক একটা গাড়ি চালানোর মতো।
সামনে ঝুঁকে নির্দেশ মতো কাজ করল ডেভিড। ইঞ্জিন চালু হয়ে খানিক লাফালাফি করে অবশেষে নিয়মিত স্বরে গর্জন শুরু করল। ধীরে চলা শুরু করতেই রাডারস্ আর ফাইনাল চেক্ করা শিখে নিল ডেভিড। এরপর রেডিওর কাজ দেখে রানওয়েতে চলা শুরু করল প্লেন।
‘রাইট, রানওয়ের শেষ মাথায় কোন কিছুর প্রতি মনোযোগ দাও। একে নিশানা করে থ্রটল খুলে দাও আস্তে করে।
মেশিনের গতি দ্রুত হয়ে উঠল। দূরে বেড়ার দাগ বরাবর এগিয়ে চলল দ্রুত।
আস্তে আস্তে হুইলে ফিরে এসো।’ আর উপরে উঠে গেল তারা। মাটি থেকে শূন্যে।
‘ধীরে বৎস, ধীরে’, জানাল বার্নি।
কন্ট্রোলে জমে যেও না। এভাবে তার সাথে আচরণ করো’থেমে গেল সে। এতদিন পর্যন্ত এয়ারক্রাফটকে একজন নারীর সমতুল্য মনে করতো। কিন্তু উপলব্ধি করল এবারের যাত্রায় এর অসামঞ্জস্য। মনে করো এটি একটি ঘোড়া। হালকা চালে দৌড়াও।
বুঝতে পারল হুইলের উপর থাকা ডেভিডের হাত আলগা হয়ে গেল। নিজের কন্ট্রোলেও একই কাজ করল সে।
‘এই, এই ডেভিড। আড়চোখে ডেভিডের দিকে তাকাল বার্নি। কিন্তু অসম্ভষ্টি দেখা দিল মনে। কেন যেন নিজের মাঝে একেবারে গভীরে মনে করেছিল যে এই ছেলেটা হয়তো একটা পাখি, ঠিক তার মতে, আকাশের নীল যার ঠিকানা। উড্ডয়নের প্রথম কয়েক মুহূর্ত জমোট বাঁধা ভয় লেপ্টে ছিল ছেলেটার চোখেমুখে। ঠোঁট আর নাকে সাদা মার্বেলের ছোঁয়া। গাঢ় নীল চোখে ছায়া; যেন নিচে গ্রীষ্মের সাগরে রয়েছে হাঙ্গরের দল।
‘বাম দিকের পাখা তুলে ফেলল। অসন্তুষ্ট বার্নি ডেভিডকে শান্ত করতে চাইল। উঠে এলো পাখা।
‘সমান করো তাকে’, নিজের হাত টেনে নিল বার্নি কন্ট্রোল থেকে। দিগন্ত বরাবর নাক সোজা করল প্লেন।
‘থ্রটল ব্যাক। ছেলেটা ডান হাতে টেনে দিল থ্রটল। আরো একবার তার দিকে তাকাল বার্নি। অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হয়নি। আর তখনই বার্নি বুঝতে পারল যে এটা ভয় নয়, আনন্দ। অত্যধিক আনন্দ।
‘ছেলেটা একটা পাখি, পাখিই। তৃপ্ত হলো বার্নি। কথাবার্তার মাঝে বার্নি ফিরে গেল ত্রিশ বছর আগে। মনে পড়ে গেল হলুদ একটা টাইগার মথের কথা, আর উড়ে যাবার জন্যে ছোট্ট একটা ছেলের আকুতির কথা।
কর্কশ নীল পর্বতমালার উপর দিয়ে উড়ে বেড়াল তারা। সূর্যের আলো পিছলে পড়ছে তুষারের গায়ে। পিছু ধাওয়া করল বন্য বাতাস।
বাতাস সমুদ্রেরই মতো, ডেভিড উপরে ঘুরে বেড়ায়–আর ভেঙ্গে পড়ে। এর দিকে খেয়াল রেখো। মাথা নাড়ল ডেভিড। কিন্তু পুরো মনোযোগ সামনের দিকে। অভিজ্ঞতার প্রতিটি মুহূর্ত আত্মস্থ করে নিচ্ছে সে।
উত্তরে শূন্য জমির উপর গিয়ে ঘুরে গেল এয়ারক্রাফট। ধরল ফিরতি পথ। নগ্ন গোলাপি জমি বাদামি ধোয়ায় আচ্ছন্ন। সোনালি শস্য কাটা হয়ে গেছে।
তাদের সামনে সাদা বালুতটে সমুদ্র ভেঙ্গে পড়েছে ক্রিমের সারি নিয়ে। আটলান্টিক এখানে ঠাণ্ডা সবুজ। বাতাসের তোড়ে ভাঁজ হয়ে সাদা হয়ে নৃত্যরত।
আবারো দক্ষিণে, উপকূলে সদ্য বালির উপর ছোট ছোট দেহ থেমে তাকিয়ে আছে উপরে তাদের দিকে, দক্ষিণে বিশাল পর্বতমালা, যেখানে থেমে গেছে ভূমি, এখান থেকে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে সবকিছু। বন্দরে গাদাগাদি ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে জাহাজের সারি। পর্বতমালার নিচে সাদা দালানগুলোর জানালার কাঁচে লেগে ঝলকাচ্ছে শীতের রোদ।
আরো একটা টার্ন। আত্মবিশ্বাসী আর নিশ্চিত হয়ে কোলের উপর হাত রেখে বসে রইল বার্নি। রাডার বার থেকে তুলে নিয়েছে পা। টাইগারবার্গের উপর দিয়ে এয়ারফিল্ডের দিকে এগিয়ে চলল প্লেন।
‘ও, কে। জানাল বার্নি। চলে এসেছি। টাচ ডাউনের পর ট্যাক্সিং করে হ্যাঙ্গারে এসে থামলো এয়ারক্রাফট। মিকস্কার কন্ট্রোলকে পুরো টেনে দিতেই ইঞ্জিন মরে গেল।
এক মুহূর্ত চুপচাপ বসে রইল দু’জনে। কেউই নড়লো না বা কথাও বলল না। দুজনেই বুঝতে পারল যে গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু ঘটেছে, যা একে অন্যকে বলা দরকার।
“ঠিক আছে? শেষপর্যন্ত জানতে চাইল বার্নি।
“ইয়েস, স্যার।’ মাথা নাড়ল ডেভিড। স্ট্র্যাপ খুলে দু’জনেই মাটিতে নেমে এসে দাঁড়াল। কোন কথা না বলে দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে হ্যাঁঙ্গার পার হয়ে অফিসে এলো। দরজার কাছে এসে থেমে গেল।
‘পরের বুধবার? জানতে চাইল বার্নি।
‘হ্যাঁ, স্যার।’ বার্নিকে ছেড়ে অপেক্ষারত ক্যাডিলাকের দিকে এগিয়ে গেল ডেভিড। কয়েক কদম গিয়ে থেমে গেল। খানিকটা দ্বিধা সত্ত্বেও ফিরে এলো আবার।
‘এর চেয়ে সুন্দর কোন কিছু এর আগে আর ঘটেনি আমার সাথে, লজ্জিত স্বরে জানাল ডেভিড। ধন্যবাদ, স্যার।’ তাড়াতাড়ি আবার চলে গেল সে। পিছনে তাকিয়ে রইল বার্নি।
গতির ঝড় তুলে চলে গেল ক্যাডিলাক। গাছের ভিড়ে শেষ দালানটার পেছনে বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল। খানিকটা শোকাভিভূত হয়ে মাথা নাড়ল বার্নি। ফিরে গেল অফিসে। প্রাচীন সুইভেল চেয়ারে ধপ করে বসে ডেস্কের উপর জোড়া পা তুলে দিল। প্যাকেট থেকে একটা দোমড়ানো সিগারেট বের করে সোজা করে জ্বালিয়ে নিল।