‘তুমি কাঁদছিলে।’
‘তুমিও’, নিচুস্বরে পরিষ্কার করে কথা বলছে মেয়েটা, উচ্চারণে কোন খামতি নেই। বিদেশী নয়।
‘না’, অগ্রাহ্য করল ডেভিড।
‘তুমি কাঁদছিলে। নরম স্বরে জোর দিয়ে বলল মেয়েটা, ভেতরে ভেতরে কাঁদছিলে। এবার সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়াল ডেভিড। হঠাৎ করেই ফিগের ব্যাগ এগিয়ে দিল মেয়েটা।
‘নাও একটা। হেসে ফেলল মেয়েটা। উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি। একটা নিয়ে মিষ্টি ফলে কামড় বসালো ডেভিড। মেয়েটা এগিয়ে গেল দরজার কাছে। মনে হলো একটা আমন্ত্রণ ভেসে এলো বাতাসে। পিছ নিল ডেভিড। একসাথে হেঁটে দরজার বাইরে গিয়ে রাস্তার ওধারে সিটরোনের দিকে তাকাল দু’জনে। অ্যাটেনড্যান্ট ট্যাংক ভরে দিয়েছে। মেয়েটার সঙ্গী অদ্ভুত পুরোন গাড়িটার বনেটের গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে। সিগারেট ধরাতে গিয়ে চোখ তুলেই দেখল তাদেরকে। সাথে সাথে বোঝা গেল চিনতে পেরেছে ডেভিডকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফেলে দিল জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি।
নরম হুস একটা আওয়াজ হয়েই বাতাসে ভাসলো ধোঁয়া। কংক্রিটের উপর পড়ে থাকা গ্যাসোলিনের উপর পড়েছে ম্যাচের কাঠি। মুহূর্তের মধ্যেই দাউদাউ আগুন। চোখের পলকে সিটরোনকে প্রায় ঢেকে ফেলল আগুন। ক্ষুধার্তের মতো এগিয়ে আসছে। মেয়েটাকে ছেড়ে রাস্তার উপর দিয়ে দৌড় দিল ডেভিড।
‘পাম্প থেকে সরে যাও গর্দভ কোথাকার।’ চিৎকার করে উঠল সে। ড্রাইভার যেন জমে আছে।
নভেম্বর হাসিখুশি পাঁচ তারিখে ঘটল এই ঘটনা–হ্যান্ডব্রেক বন্ধ করে গিয়ারবক্স নিউট্রালে নিয়ে আসল ডেভিড। এরপর ড্রাইভার আর ও দু’জনে মিলে জ্বলন্ত গাড়িটাকে ঠেলে ফিলিং স্টেশনের বাইরের পার্কিংয়ে নিয়ে এলো। মনে হলো মাটি ফুড়ে উদয় হলো মানুষ, ভিড় জমে গেল চারপাশে। চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে, উপদেশ দিচ্ছে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে।
ভেতরের সিট থেকে ব্যাগেজও উদ্ধার করা গেল শিখা গ্রাস করার আগেই তখনি পেট্রল অ্যাটেনড্যান্ট পৌঁছালো বিশাল বেগুনি রঙা আগুন নির্বাপক যন্ত্র নিয়ে। ভিড়ের জনতা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। ফেনার মেঘ ঢেকে ফেলল ছোট গাড়িটাকে, সাথে সাথে উত্তেজনা ও হারিয়ে গেল। মানুষজন চলে গেল যে যার পথে; তারপরেও হাসছে, কথা বলছে, নাস্তানাবুদ ফায়ার ফাইটারকে প্রশংসা করছে। অন্যদিকে নিজেদের পোড়া কালো সিটরোনের নিকে হতাশা দিয়ে তাকিয়ে রইছে তিনজন।
‘আমার মনে হয় ব্যাপারটা ভালোই হলো-বেচারা অনেক ক্লান্ত হয়ে। পড়েছিল। অবশেষে বলল মেয়েটা। যেন পা ভাঙা ঘোড়া নিয়ে শ্যাটং।
ইনস্যুরেন্স করা আছে? জানতে চাইল ডেভিড। হাসল মেয়েটার সঙ্গী।
মজা করছো–কে করবে এটার ইনস্যুরেন্স? আমি মাত্র একটা একশ ইউ এস ডলারের নোট দিয়েছি ওর জন্য।’
আগুনের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া জিনিসপত্রের ছোট্ট একটা স্তূপ জড়ো করল তিনজনে মিলে। মেয়েটা দ্রুত সঙ্গীর সাথে কোন এক বিদেশী ভাষায় কী যেন আলোচনা করে নিল। বুঝতে না পারলেও মর্মার্থ ঠিকই ধরতে পারল ডেভিড। তাই মেয়েটা যখন তার দিকে তাকাল একটুও অবাক হলো না সে।
‘আজ সন্ধ্যায় বার্সেলোনায় একজনের সাথে দেখা করতে হবে আমাদেরকে। জরুরি প্রয়োজন।’
‘চলো তাহলে। জানাল ডেভিড।
মুস্তাংয়ে এনে ভোলা হলো সব লাগেজ। মেয়েটার সঙ্গী লম্বা পা দু’খানা ভাঁজ করে বসল গিয়ে পেছনের সিটে। নাম যোসেফ–কিন্তু মেয়েটা ডেভিডকে জানাল ছেলেটাকে জো নামে ডাকতে। মেয়েটার নাম ডেবরা আর পদবী নিয়ে কেউই মাথা ঘামালো না। ডেভিডের পাশের আসনেই বসল ডেবরা। দুই হাঁটু পরস্পরের সাথে এঁটে কোলের উপর রেখেছে হাত। একবার নজর বুলিয়েই দেখে নিল মুস্তাং আর এর সব সম্পত্তি। ডেভিড দেখতে পেল ডেবরা দেখে নিল দামী লাগেজ, নাইকন ক্যামেরা, জিস বাইনোকুলার রাখা গ্লোভ কম্পার্টমেন্টে আর সিটের উপরে অনাদরে ফেলে রাখা দামী জ্যাকেট। এরপর আড়চোখে তাকাল ডেভিডের দিকে, মনে হলো প্রথমবারে মতো খেয়াল করল সিল্কের শার্ট আর কব্জিতে লাগান চিকন স্বর্ণের গয়না।
‘দরিদ্ররাই আর্শিবাদপ্রাপ্ত। বিড়বিড় করল ডেবরা, তারপরেও ধনী হওয়াটা এখনো আনন্দময়।
ব্যাপারটা উপভোগ করল ডেভিড। চাইল ডেবরা মুগ্ধ হোক, চাইল ডেভিড আর পিছনের সিটে বসা বড়সড় পেশীবহুল তরুণের মাঝে তুলনা করুক।
‘চলো তাহলে যাই বার্সেলোনা। হাসল ডেভিড।
নিঃশব্দে গাড়ি চালিয়ে শহরের বাইরে এলো। কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে জোর দিকে তাকাল ডেবরা।
“ঠিক আছে তুমি? আগের বারের মতেই অচেনা ভাষায় জিজ্ঞেস করল ডেবরা জোকে।
‘যদি তা না হয়—ও পেছনে পেছনে দৌড়াতে পারে। একই ভাষায় উত্তর দিল ডেভিড। বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাল ডেবরা। এরপরই খুশি হয়ে উঠল চেহারা।
‘এই! তুমি হিব্রু বলতে পারো!
‘বেশি একটা না।’ স্বীকার করল ডেভিড। বেশির ভাগটাই ভুলে গেছি। মনে পড়ে গেল দশ বছর বয়সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুদ্ধ করতে অদ্ভুত আর রহস্যময় একটা ভাষা নিয়ে। যেটা লিখতে হতো পিছনে থেকে সামনে, এমন একটা বর্ণমালা দেখতে মনে হয়–ব্যাঙাচি আর বেশির ভাগ উচ্চারণ গলার পেছন থেকে করতে হয়, অনেকটা গার্গল করার মতো।
‘তুমি ইহুদি? জানতে চাইল ডেবরা। সিট ঘুরিয়ে ডেভিডের মুখোমুখি হলো। হাসছে না, প্রশ্নের উত্তরটা যে ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বোঝা গেল তা।