না! না! থামাও! প্লিজ এটা থামাও!’
চকচকে স্যুট আর ব্যালে জুতা পরিহিত একটা লোক এগিয়ে এলো সমাপ্তি টানতে। ষাঁড়ের মেরুদণ্ডে আঘাত করল তরবারি দিয়ে। সূর্যের আলোয় দেখা গেল চিরে দু’ভাগ হয়ে গেছে হাঁড়। একপাশে হেলে গেল ষড়। আবারো উঠে দাঁড়ানোর আগে উগড়ে দিল মোটা রক্তের ধারা।
বালির উপর থেকে আবারো তরবারি তুলে নিল লোকগুলো তুলে দিল একজনের হাতে। মৃত্যুপথযাত্রী জন্তুটার দিকে তাকিয়ে আবারো আঘাত করল হাঁড়ের উপর। অবশেষে গলার স্বরে দৃঢ়তা খুঁজে পেল ডেভিড। চিৎকার করে উঠল:
‘থামাও! অসভ্য বর্বর কোথাকার।’
মাঝখানে দাঁড়িয়ে বারোবার তরবারি হাতে চেষ্টা করল লোকটা। প্রতিবার হাত থেকে ছুটে গেল সেটা। আর শেষ বার পড়ে গেল ষড়। ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ল রক্ত হারানোয় নির্যাতনে ভেঙ্গে পড়ে অবশেষে রণেভঙ্গ দিল। আবারো উঠে দাঁড়ানো দুর্বল চেষ্টা সত্ত্বেও শক্তি না থাকায় মেরে ফেলা হলো ষাড়টাকে। ঘাড়ের পেছনে ছুরি দিয়ে আঘাত করে বালির উপর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো–বালির উপর পড়ে রইল বাদামি রক্তের লম্বা ধারা।
এ ধরনের দানবীয় নিষ্ঠুরতায় বোবা হয়ে গেল ডেভিড। আস্তে করে পিছু ফিরে তাকাল মেয়েটার অবস্থা দেখতে। মেয়েটার সঙ্গী খুঁকে ফিসফিস করে কথা বলে চেষ্টা করছে ওকে শান্ত করতে।
আস্তে করে মাথা নাড়াল মেয়েটা, যেন বুঝতে পারছে না যে কী হচ্ছে চারপাশে আর মধু রঙা চোখ ভেসে যাচ্ছে পানিতে। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আছে, দুঃখের ভারে কাঁপছে আর গাল বেয়ে পড়ছে চকচকে চোখে জল।
মেয়েটার সঙ্গী তাকে সাবধানে ধরে দাঁড় করিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে আসল। এমনভাবে চলে যেতে লাগল যেন সদ্য বিধবা তার স্বাধীর কবর ছেড়ে যাচ্ছে।
চারপাশে ভিড়ের মানুষ রক্ত আর ব্যথা দেখে হাসছে, চিৎকার করে আনন্দ করছে আর এতসব কিছুর মাঝে নিজেকে ডেভিডের মনে হলো সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। মন চলে গেছে কান্নারত মেয়েটার কাছে, এত মানুষের মাঝে একমাত্র মেয়েটাকেই মনে হলো সত্যিকারের মানুষ। যথেষ্ট দেখা হয়েছে, বুঝতে পারল, পামপ্লোনায় যেতে পারবে না আর। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটার পিছু পিছু রিং থেকে বের হয়ে এলো ডেভিড। চাইল মেয়েটার সাথে কথা বলতে, বলতে চাইল সেও ব্যথিত। কিন্তু পার্কিংয়ে পৌঁছে দেখল তারা দুজনে ইতিমধ্যে একটা পুরোনো সিটরোন সিভি.১০০-তে চড়ে বসেছে। দৌড় দিল ডেভিড কিন্তু চলে গেল গাড়িটা। নীল ধোয়া ছেড়ে মিশে গেল উত্তরের পথে।
গাড়িটার চলে যাওয়া দেখে মনে হলো তার অনেক বড় কোন ক্ষতি হয়ে গেল। হারিয়ে গেল গত কয়েকদিনের সুখস্মৃতি। কিন্তু দুদিন পরে আবারে দেখা হলো পুরোনা সিটরোনটার সাথে, যখন যে পামপ্লোনা উৎসবের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে দক্ষিণে চলেছিল। আগের থেকে বৃদ্ধ মনে হলো সিটরোনটাকে। মোটা ধুলার আস্তরণে ঢেকে আছে গাড়িটা আর মাঝের টায়ারের উপর দেখা গেল ক্যানভাস। একপাশ এমন ভাবে হেলে আছে গাড়িটা যেন পাড় মাতাল।
বার্সেলোনা যাবার পথে জারাগোজার বাইরের দিকে একটা ফিলিং স্টেশনে পার্ক করা গাড়িটা নজরে এলো ডেভিডের। রাস্তা থেকে নেমে নিজের গাড়ি গ্যাসোলিন পাম্পের পিছনে পার্ক করল ডেভিড। তেল মাখা ওভারওল পরনে একটা অ্যাটেনড্যান্ট সিটরোনের ট্যাংক ভরছে, তত্ত্বাবধান করছে রিংয়ে দেখা সেই পেশীবহুল তরুণ ছেলেটা। তাড়াতাড়ি মেয়েটোর খোঁজে চোখ বুলালো ডেভিড। কিন্তু গাড়িতে ছিল না মেয়েটা। এরপরই তাকে দেখতে পেল ডেভিড।
রাস্তার ওপাশে একটা ক্যান্টিনে বসে আছে মেয়েটা। কাউন্টারের পেছনে থাকা বৃদ্ধ মহিলার পেছনে। যদিও ডেভিডের দিকে পিছু ফিরে বসে আছে, কিন্তু মাথা ভর্তি কালো চুলের রাশি দেখে চিনতে পারল ডেভিড। রাস্তা পার হয়ে তাড়াতাড়ি দোকানে মেয়েটার পিছনে গেল সে। নিশ্চিত ভাবে নিজেও জানে না সে সে কী করছে।
খাটো, ফুলের নকশা করা একটা ড্রেস পরে আছে মেয়েটা, কাঁধ আর পিঠ পুরো উন্মুক্ত। পায়ে খোলা স্যান্ডেল। কিন্তু বাতাসে তুষারকনা থাকায় কাঁধে শাল। কাছ থেকে দেখা গেল ত্বকে প্লাস্টিকের মসৃণতা। মনে হলো যেন হালকাভাবে তেল লাগিয়ে পালিশ করা হয়েছে। পিছনে উন্মুক্ত ঘাড়ে কোমল, সুন্দর চুল। মনে হল ডাটির উপর ফুল।
ডেভিড কাছে এগিয়ে গেল। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে শুকনো ফিগ কেনা শেষ করে খুচরো পয়সা নিচ্ছে মেয়েটা। বুক ভরে গন্ধ নিল ডেভিড। মনে হল মেয়েটার চুল থেকে ভেসে এলো গ্রীষ্মের গন্ধ। ইচ্ছে হলো মুখ ডুবিয়ে স্বাদ নিতে। বহু কষ্টে নিজেকে নিবারণ করল ডেভিড।
হাসিমুখে পেছনে ফিরতেই দাঁড়িয়ে থাকা ডেভিডকে দেখতে পেল মেয়েটা। চিনতে পারল সাথে সাথে, কেননা ডেভিডের চেহারা এমন যে চট করে ভুলে যাবে না কোন মেয়ে। অবাক হয়ে গেল মেয়েটা। হাসি মুছে ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে। অভিব্যক্তিতে কিছু বোঝ না গেলেও ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে রয়েছে আর চোখ জোড়া নরম উজ্জ্বল সোনালি এই অদ্ভুত নীরবতার সাথে ভবিষ্যৎ আরো বহুবার দেখা হবে ডেভিডের।
‘মাদ্রিদে দেখেছি তোমাকে। জানাল ডেভিড। ষাড়ের লড়াইয়ে।
হ্যাঁ, মাথা নাড়াল মেয়েটা। কণ্ঠে উচ্ছ্বাস বা বিরক্তি কিছুই নেই।