চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে ডেবরাকে দেখল ডেভিড। মুখটা পাণ্ডুর দেখাচ্ছে। কিন্তু চোখের ঘন পাপড়ি পরিষ্কার আর ঠোঁট দুটো শান্ত, সুন্দর।
স্নেহের বাৎসল্যে সামনে ঝুঁকে মেয়েটার গালে হাত দিল ডেভিড। ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকাল ডেবরা। মধুরঙা অনিন্দ্যসুন্দর সোনালি চোখ। কুয়াশা মাখা। দৃষ্টিহীন কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। এরপর হঠাৎ করেই বদলে গেল সবকিছু। পরিষ্কার দেখতে পেল ডেভিড। তীক্ষ্ণ, সজাগ হয়ে উঠল সে দৃষ্টি। স্থির হয়ে গেল। তার দিকে তাকিয়ে আছে ডেবরা; ডেভিডকে দেখছে
গালে স্পর্শ পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল, ডেবরা। এত হালকা যেন বসন্তের পাতার ছোঁয়া পেল। নরম সোনালি রঙা মেঘের মাঝে দিয়ে তাকাল যেন সে। এরপর হঠাৎ করেই মনে হলো সকালের বাতাস সরিয়ে নিয়ে গেল। কুয়াশা। মেঘ ভেসে গেল। তাকিয়েই দেখতে পেল দানবীয় একটা মাথা ঝুঁকে আছে তার দিকে। আকৃতিবিহীন মাথাটা মনে হল নরকের অংশ। চেয়ারে ধপ করে ধাক্কা খেলো ডেবরা। হাত তুলে মুখ ঢেকেই চিৎকার করে উঠল।
ঘুরে দৌড় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ডেভিড। পিছনে ঠাশ করে বাড়ি খেল দরজা। প্যাসেজ বেয়ে নেমে গেল পদশব্দ। শব্দ শুনে এগিয়ে এলো ব্রিগ।
‘ডেভিড! হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইল। ডাকতে চাইল। কিন্তু তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো ছিটকে চলে গেল ডেভিড। বুকের মাঝে কিছু একটার বাড়ি খেয়ে যেন দেয়ালে গিয়ে আছাড় খেল ব্রিগ। ভারসাম্য ফিরে পেয়ে বুকে হাত ঘসে এগিয়ে আসতে আসতে চলে গেছে ডেভিড। সিঁড়ির উপর থেকেও শোনা যাচ্ছে উন্মাদের মতো পায়ের আওয়াজ।
‘ডেভিড! গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে শুনতে পেল ব্রিগ। দাঁড়াও!’ কিন্তু চলে গেছে ছেলেটা। আর শোনা গেল না পদশব্দ। যেতে দিল ব্রিগ। এর পরিবর্তে তাড়াতাড়ি করিডোরের ওপারে হিস্টিরিয়ার মতো চিৎকার করতে থাকা কন্যার দিকে দৌড় লাগাল।
হাত থেকে মুখ তুলে তাকাল ডেবরা। দরজা খোলার আওয়াজ পেল। চোখে দেখা গেল ভয়।
‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি।’
তাড়াতাড়ি মেয়ের কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরল ব্রিগ।
“ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আশ্বস্ত করতে চাইল মেয়েকে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে থামাতে চাইল ডেবরা।
‘আমি দুঃস্বপ্ন দেখেছি। বিড়বিড় করতে লাগল ডেবরা। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। এরপর বাবাকে ধাক্কা দিল।
‘ডেভিড।’ চিৎকার করে উঠল সে। ডেভিড কোথায়? আমি ওকে দেখবো।
শক্ত হয়ে গেল ব্রিগ। বুঝতে পারল কিছুই বুঝতে পারেনি ডেবরা।
‘আমি ওকে দেখবো। বারবার একই কথা বলতে লাগল সে। ভারী কণ্ঠে উত্তর দিতে বাধ্য হল ব্রিগ, তোমার সাথে ওর দেখা হয়েছে, মাই চাইল্ড।’
কয়েক সেকেন্ড ধরে কিছুই বুঝতে পারল না ডেবরা। এরপর আস্তে করে বলে উঠল,
‘ডেভিড?’ ফিসফিস করে উঠল ডেবরা। ভেঙ্গে যাচ্ছে গলার স্বর, ডেভিড ছিল ওটা?’
মাথা নাড়ল ব্রিগ। দেখতে পেল ভয়ার্ত হয়ে গেল ডেবরার দৃষ্টি।
“ওহ্ ডিয়ার গড! কেঁদে উঠল ডেবরা। আমি কী করেছি? আমি ওকে দেখে চিৎকার করেছি। আমি কী করেছি এটা? আমি ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি।’
‘তো তুমি তাকে এখনো দেখতে চাও? জানতে চাইল ব্রিগ।
কী বলছো বাবা?’ ক্ষেপে উঠল ডেবরা। এই পৃথিবীর অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে বেশি। তুমি জানো এটা!
‘এমনকি ও এখন দেখতে যেমন তার পরেও?
‘যদি ভাবো যে এটা আমার মাঝে কোন পার্থক্য তৈরি করবে–তাহলে তুমি আমাকে চেনোই না। আবারো বদলে গেল ওর চেহারা। চিন্তিত হয়ে উঠল। ওকে খুঁজে বের করো। নির্দেশ দিল ডেবরা। তাড়াতাড়ি করো। নয়তো কিছু একটা করে বসবে।
‘আমি জানি না ও কোথায় গেছে। উত্তর দিল ব্রিগ। তার নিজের চিন্তা বেড়ে গেল ডেবরার কথা শুনে।
‘একটাই জায়গা আছে ওর যাবার। জানাল ডেবরা। ও আকাশে উড়ে গেছে।
‘হ্যাঁ, তাই হবে।’ একমত হলো ব্রিগ।
‘এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে জানাও। তাহলেই ওর সাথে কথা বলতে পারবে তুমি। দরজার দিকে এগোল ব্রিগ! আকুতি জানাল ডেবরা। ওকে খুঁজে আনো আমার জন্য, প্লিজ ড্যাডি।
.
নাভাজো উড়ে চলল দক্ষিণ দিকে। গোলাকার নাকটা কোর্সে স্থির হবার পর সোজা উঠে যেতে শুরু করল নীল স্বর্গের দিকে। ডেভিড জানে সে কোথায় যাচ্ছে।
পেছনে পর্বতপ্রমাণ মেঘের দল সরে গেছে দূরে। এখানেই ভূমি শেষ হয়ে গেছে। সামনে পড়ে আছে শুধুই বরফ আর ঠাণ্ডা সমুদ্র।
নিজের ফুয়েল গজ চেক করে দেখল ডেভিড। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আছে। তারপরেও দেখতে পেল কাটাটা অর্ধেকের একটু উপরে উঠে কাঁপছে।
তিন ঘণ্টা ধরে উড়ছে সম্ভবত। চনমনে ভাব এলো ডেভিডের মনে যে যন্ত্রণা শেষ হতে চলেছে। পরিষ্কাভাবে দেখতে পেল যে সামনে কীভাবে শেষ হবে সবকিছু। উপরে উঠে যাবে শুধু। তারপর এক সময় ইঞ্জিন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেবে। এরপর সে নাকটাকে নিচে নামিয়ে দ্রুত নেমে যাবে। যেমন ভাবে ঝাঁপ দেয় ঈগল। তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যাবে সবকিছু। ধাতব ফিউজিলাজ তাকে এত নিচে নিয়ে যাবে যেখানে সে ততটা একা হবে না, যতটা এখন আছে।
রেডিও কড়কড় করে উঠল। শুনতে পেল এয়ার ট্রাফিকের ঘোৎঘোৎ. আওয়াজ। যেই না সুইচ টিপে বন্ধ করতে যাবে–সেই সময় শুনতে পেল পরিচিত কণ্ঠস্বর।
‘ডেভিড, ব্রিগ বলছি। ঠিক এই গলাতেই কথাগুলো শুনেছে ডেভিড অন্য ককপিটে, অন্য দেশে বসে।