দেরীতে আসা মানুষগুলো ভিড়ের মাঝে জায়গা খুঁজে নিচ্ছে আর উত্তেজনা একেবারে তুঙ্গস্পর্শী। দু’জন উঠে এলো ডেভিড যেখানে বসে সেখানকার কাছাকাছি। কমবয়সী একজোড়া বালক-বালিকা বয়স বোধ হয় বিশের গোড়ায়। কিন্তু যেটা ডেভিডের নজর কাড়লো তা হলো এই জোড়ার চারপাশে শুদ্ধ সম্পর্ক আর ভালোবাসার একটা আবেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হলো কোন স্বর্গীয় আভা তাদের পৃথক করে রেখেছে।
ডেভিড যেখানে বসে আছে তার পাশ দিয়ে হাত ধরাধরি করে উঠে গেল দু’জনে। পেছনে এক সারি উপরে গিয়ে বসল। উচ্চতা ভালো মেয়েটার লম্বা পা দু’খানায় খাটো কালো বুট। গাঢ় রঙের প্যান্টের উপরে আপেল সুবজ রঙা স্লয়েড জ্যাকেট, দামী না হলেও রুচির ছাপ আছে যথেষ্ট। সূর্যের আলোয় কয়লার মতো চকচক করছে চুল। কাঁধ ছাপিয়ে উপচে পড়ছে নরম ঝরনার মতো। চেহারা বেশ বড়সড় আর রোদে পোড়া বাদামী। মুখটা বড় হওয়ায় বেশি সুন্দরী না হলেও চোখ দুটো বেশ প্রশস্ত। গাঢ় বাদামী, বন্য মধুর রঙ তাতে, মনে হলো সোনা মিশিয়ে তৈরি করেছেন সৃষ্টিকর্তা। মেয়েটার মতই ছেলেটাও লম্বা। সোজা-সাপ্টা দেহাবয়ব, গাঢ় দেহতৃক আর শক্তিশালী। বাদামী পেশীবহুল হাত দিয়ে মেয়েটাকে তার আসন দেখিয়ে দিল। হঠাৎ করেই ছেলেটার উপর কেমন রাগ আর হিংসা হলো ডেভিডের।
‘সন অব আ গান মনে মনে ভাবল ডেভিড। মাথা ঝুঁকিয়ে গোপন কথা বলতে লাগল তরুণ জোড়া। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড। তার নিজের একাকিত্ব যেন বেড়ে গেল তাদের নৈকট্য দেখে।
ষাঁড়-চালকদের প্যারেড শুরু হলো। তাদের গায়ের স্যুটের সিকুইন আর অ্যামব্রয়ডারিতে সূর্যের আলো পড়ে চকচক করে উঠল, মনে হলো কোন বিশাল চকচেক সরীসৃপ এগিয়ে চলেছে। অর্কেস্ট্রী বেজে উঠতেই ষাড়দের খাঁচা খুলে দেয়া হলো।
একটু সুযোগ পেতেই তরুণ জোড়ার দিকে তাকাল ডেভিড। অবাক হয়ে দেখল যে ছেলে-মেয়ে দুটো তাকেই দেখছিল। মেয়েটা ঠোঁট প্রায় ছেলেটার কানের কাছে এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল কিছু একটা। ডেভিডের মনে হলো তার পাকস্থলীর নিচে কিছু একটা গুড়গুড় করে উঠল সোনালি চোখ জোড়া দেখে। এক মুহূর্তের জন্য মেয়েটা আর ডেভিড তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে। তারপরই অপরাধীর চোখ সরিয়ে নিল মেয়েটা। কিন্তু ছেলেটার সঙ্গী তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে, সহজভাবেই হাসল। এবার চোখ সরিয়ে নেবার পালা ডেভিডের।
তাদের নিচে রিংয়ে সবেগে বেরিয়ে এলো যড়। মাথা উঁচু করে ঘুরতে লাগল বালির উপর।
কালো চকচকে, সুন্দর ঘাড়টার ঘাড় আর কাঁধে পেশী নাচাতে লাগলে এক পাশ থেকে আরেক পাশে মাথা ঘোরানোর সময়। ষাঁড়ের গতি আর লাফালাফি দেখে ভিড়ের দর্শকেরা যেন পাগল হয়ে উঠল। পুরো রিং জুড়ে ঘুরে ঘুরে নিজের কসরত দেখাতে লাগল ষাড়টা। মাথায় শিংয়ের চমৎকার প্রদর্শনীর পর নিয়ে আসা হলো ঘোড়া।
ট্রাম্পেট বেজে উঠল ঘোড়ার আগমনে, এসব কিছুই হাস্যকর মনে হলে হতভাগ্য টাই ঘোড়াটার জন্য সাহসী অভ্যর্থনা, এক চোখ দিয়ে পিচুটি পড়ায় অবোধ জন্তুটা দেখতেই পারল না সামনে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে।
ক্লাউনের মতো দেখাতে লাগল ঘোড়াটাকে। পিঠে মস্ত বড় সশস্ত্র মানুষ নিয়ে বাইরে এলো ঘোড়াটা, পড়ল ষাঁড়ের সামনে আর এখানেই শেষ হয়ে গেল সমস্ত সৌন্দর্য।
মাথা নিচু করে সামনে ছুটে গেল ষাড়টা। কালো বিশাল পিঠের উপর কুজোতে চাবুকের বাড়ি দিয়ে শরীরের সমস্ত ওজন দিয়ে ষ্টিলের বাড়ি মারা হলো ষাড়ের পায়ে। সাথে সাথে বের হয়ে এলো রক্তের ধারা। কালো, কুড অয়েলের মতো ঝরে পড়ল বালির উপর।
লোহার বাড়ি খেয়ে রাগে উন্মত্ত ষাড় ঘোড়ার উপর রাখা আসনে গুতো মারল। মনে হলো থিয়েটারের পর্দা সরে গেল। এমন ভাবে ঘোড়ার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ষাড়। ভয়ঙ্কর শিংয়ের তো খেয়ে আর্তনাদ করে উঠল ঘোড়া। বেচারা পশুটার পেট চিরে বেগুনি আর গোলাপি নাড়িভূড়ি বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বালির উপর।
ঘটনার বিমর্ষতায় মুখ শুকিয়ে গেল ডেভিডের। চারপাশের ভিড় রক্ত হিম করা চিৎকার করে উঠল। গায়ের যন্ত্রপাতি আর নিজের অন্ত্রের উপর পড়ে গেল ঘোড়া।
ষাঁড়টাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। পড়ে যাওয়া ঘোড়াটার লেজ ধরে টেনে জোর করে শেষবারের মতো উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করা হলো। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো হতভাগ্য জটা। শরীরে আঘাত করে আবারো চলতে বাধ্য করা হলো। নিজের নাড়িভূড়ি থেকে টলতে টলতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘোড়া।
এরপর ষাঁড়ের দিকে এগিয়ে গেল লোকেরা। ধীরে ধীরে জমকালো পশুটা হয়ে গেল ঘর্মাক্ত, রক্ত বের হওয়া মাংসপিণ্ড মুমূর্ষ ফুসফুস থেকে বের হতে লাগল ক্রিম রঙা ফেনা।
ডেভিড চাইল চিৎকার করে তাদেরকে থামাতে। কিন্তু নিজেকে মনে হলো তার অসুস্থ। এ ধরনের প্রথায় নিজের উপস্থিতি নিয়ে জমে গেল যেন। বাকি সময় বসে রইল নীরবে। রিংয়ের মাঝখানে উঠে দাঁড়াল আঁড়টা। চারপাশে বালিতে মনে হলো জমি চাষ করা হয়েছে। নিজেকে নিয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করতে লাগল ষড়। উঠে দাঁড়াল মাথা নিচু করে, প্রায় বালির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে এমতাবস্থায় নাক আর ভোলা মুখ দিয়ে বের হতে লাগল ফেনা। ভিড়ের চিৎকার ছাপিয়েও ষাঁড়টার নিঃশ্বাসের যন্ত্রণার শব্দ কানে এলো ডেভিডের। পা হড়কাতে লাগল আঁড়টার। পিছনের পায়ের মাঝে থেকে বের হয়ে এলো হলুদ মল। এর থেকে বেশি আর কোন নির্যাতন হতে পারে না। উঁচু স্বরে ফিসফিস শুরু করে দিল ডেভিড।