‘রুটিতে কোন সমস্যা হবে তোমার? জানতে চাইল ডেভিড। মাথা নাড়াল ফিলি। হাজার ফ্রাংকের দু’টো নোট বের করে পাশের টেবিলে রাখল ডেভিড।
‘নিচে বিল পরিশোধ করে দেব আমি।’ ব্যাগ তুলে নিল ডেভিড।
প্যারিসের আকর্ষণ শেষ হয়ে গেছে তার জন্য। তাই আবারো দক্ষিণের পথ ধরল সূর্যের উদ্দেশে। আকাশ ভরে আছে কালো মেঘে ফন্টেন’তে যাবার আগেই বৃষ্টি শুরু হলো। এত বৃষ্টি হলো যে ওর ধারণা ছিল হয়তো গ্রীষ্ম মণ্ডলেই এমন ধারা বৃষ্টি হয়। কংক্রিটের হাইওয়ে ভেসে গেল বন্যায় আর গাড়ির উইন্ডস্কিন এতটাই ঝাপসা হয়ে গেল যে ওয়াইপার পর্যন্ত ব্যর্থ হলো স্বচ্ছ দৃষ্টির ব্যবস্থা করতে।
একাকী ডেভিড আর কোন জনমনিষ্যি সাথে না থাকায় বিমর্ষ বোধ করল। অন্যান্য গাড়িগুলো বৃষ্টিতে গতি ধীর করলেও দ্রুতগতিতে চলতে লাগল ডেভিড। ভেজা রাস্তায় পিছলে যেতে লাগল চাকা। এবার ব্যর্থ হলো গতির ঝড়। বৃষ্টি পিছনে রেখে দক্ষিণে বিউনিতে এসে মনে হলো একাকিত্বের দল নেকড়ের মতো ছুটে আসছে তার পিছনে।
যাই হোক, প্রথম সূর্যরশ্মি মন ভালো করে দিল তার। পাথরের দেয়ালের অনেক উপরে সবুজ আঙুরের ক্ষেতের ক্লান্তিকর সীমানা ছাড়িয়ে চোখ পড়ল সাদা-সবুজের মতো নরম বাতাস এগিয়ে আসছে মেরুপ্রান্তর থেকে। আরো আধা মাইল সামনে যাবার পর রাস্তা থেকে চোখে পড়ল সাইনবোর্ড। ক্লাব অ্যারোনোটিক দে প্রভেঙ্গে। অনুসরণ করতেই দেখতে পেল আঙুর ক্ষেতের মাঝখানে ছোট্ট পরিষ্কার একটা এয়ারফিল্ড। একটা এয়ারক্রাফট মারচেত্তি অ্যারোবেটিক একটু সিক্সটি মুস্তাং থেকে লাফ দিয়ে বের হলো ডেভিড। এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন মাতালের সামনে রাখা হয়েছে দিনের প্রথম ঢোক হুইস্কি।
ক্লাব অফিসে বসে থাকা ফরাসী লোকটাকে দেখে মনে হল অসফল সৎকারক। লগ বুক আর এক তোড়া লাইসেন্স দেখানোর পরেও কিছুতেই ডেভিডকে মারচেত্তি ভাড়া দিতে রাজি হলো না লোকটা। অন্যান্যগুলো থেকে ভাড়া দেয়া গেলেও মারচেত্তি কিছুতেই ভাড়া দেবে না। দলিলপত্রের উপর ৫০০ ফ্রাংকের নোট রাখল ডেভিড। মুহূর্তে এটা হাওয়া হয়ে গেল ফরাসীটার পকেটে। তারপরেও কিছুতেই শুধু মারচেত্তি একাকী দেবে না। উপরন্তু ডেভিডকে জোর দিল তার সাথে প্রশিক্ষকের আসনে বসতে।
সীমানার বেড়া টপকাবার আগে ধীরে ফোর পয়েন্ট রোল ঘুরালো ডেভিড। এটা হলো আদেশ লঙ্ঘন করার মতো। ফুরফুরে মেজাজের কাজটা করল সে। স্যাক্রেব্লিউ!’ বলে চিৎকার করে উঠল ফরাসি লোকটা; সিটে বসে জমে গেল যেন। কিন্তু বুদ্ধি খাঁটিয়ে কন্ট্রোলে হাত দিল না। কাজ শেষ করে তৎক্ষণাৎ উল্টো দিকে ঘুরে গেল মারচেত্তির পাখা। আঙুরের মাথা থেকে খুব বেশি হলে পঞ্চাশ ফুট উপরে। শব্দ করে শ্বাস ফেলল ফরাসি লোকটা, বুঝতে পারল দক্ষ লোকের পাল্লায় পড়েছে সে। এক ঘন্টা পড়ে মাটিতে নেমে এলে হাসল ডেভিডের দিকে তাকিয়ে।
‘অসাধারণ!’ ডেভিডের প্রশংসা করে তার সাথে লাঞ্চ শেয়ার করল। রসুনের চাটনি, রুটি আর এক বোতল লাল ওয়াইন। মাদ্রিদ পর্যন্ত ডেভিডের সঙ্গী হলো আবারো উড়তে পারার আনন্দ আর রসুনের সুস্বাদু গন্ধ।
মাদ্রিদে এসে হঠাৎ করেই ঘটতে লাগল সব। মনে হলো যেন বহুকাল আগে থেকে ঠিক করে রাখা হয়েছে সবকিছু। মনে হলো অর্ধেক ইউরোপ ঘুরে আসার অর্থ মাদ্রিদে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা অপেক্ষা করছে তার জন্য।
শহরে পৌঁছালো সন্ধ্যাবেলা। গত রাতে তাড়াহুড়া করেছে, কেননা এই সিজনে ষাড়ের দৌড়ের জন্য সময় মতো আসতে পারে যেন। এর উপরে হেমিংওয়ে, কনরাডসহ অন্যান্য রোমান্টিক সাহিত্যও পড়া আছে তার। বিস্মিত হয়ে ভাবে, জীবনের এই ক্ষেত্রেই কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য! বই পড়তে দারুণ লাগে-সৌন্দর্য, উত্তেজনা, সাহস আর সত্যের চরম ক্ষণ। ডেভিড চায় এই বিশাল প্লাজা ডে টরোসে বসে এটা দেখতে মূল্যায়ন করতে আর তারপরেও ইচ্ছে হলে পরে এই সিজনের পামপ্লোনা উৎসবে যাবে।
গ্রান ভিয়া’তে উঠল ডেভিড। পরের দিনের জন্যে টিকিট জোগাড় করে দিল পোর্টার। এত দীর্ঘ পথ ড্রাইভ করে আসায় ক্লান্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে চলে গেল। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে বেশ তাজা মনে হলো নিজেকে। রিংয়ের বাইরে এসে পার্কিং লটে এরই মাঝে ভিড় করে থাকা ট্যুরিস্ট বাসের মাঝে পার্ক করল মুস্তাংকে। এই সিজনে ভিড় জমে উঠেছে বেশ আগেভাগেই।
রিং বাইরেটা দেখে চমক লাগল। দেখে মনে হলো মূর্তি পূজারী বা বর্বর কোন ধর্মের মন্দির, কিন্তু ভেতরটা সম্পর্কে জানে সে। ফিল আর ছবিতে অনেক দেখেছে। বালির রিং মসৃণ আর পরিষ্কার, মেঘে ঢাকা আকাশে উড়ছে পতাকা, গান বেজে চলেছে অর্কেস্ট্রায়, মানুষের মাঝে চিৎকার, উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।
এই ভিড়ের মতো এত উত্তেজনা এর আগে কোন পুরস্কার বিতরণী বা আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলাতেও দেখেনি ডেভিড। সবাই মিলে চিৎকার করছে, সারির উপর সারি আগ্রহী সাদা সব চেহারা সুরের তালে যেন মাতাল হয়ে উঠেছে।
একদল তরুণ অস্ট্রোলিয়দের মাঝে বসেছে ডেভিড; যারা বিভিন্ন স্যুভেনির পোশাক পরে আছে আর মেয়েগুলো। পাখির ঝাঁকের মতই কিচিরমিচির করছে। তাদের একজন ডেভিডের উপর নজর দিল। সামনের দিকে ঝুঁকে তার কাঁধে টোকা দিয়ে নিজেদের মাঝে ছাগলের চামড়ার থলেতে রাখা ওয়াইন ভাগাভাগি সময়ে ডেভিডের দিকে এগিয়ে দিল একবার। একটা বিড়ালের মতই সুন্দরী মেয়েটা। চোখ দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল শুধুমাত্র ওয়াইন নয় অন্য আরো অনেক কিছুর আমন্ত্রণ জানালো ডেভিডকে। কিন্তু কোন নিমন্ত্রণই গ্রহণ করল না ডেভিড। উঠে গিয়ে এক ক্যান বিয়ার নিয়ে আসলো সে। প্যারিসের মেয়েটার সাথে কাটানো অভিজ্ঞতা এখনো বেশ চনমনে করে তুলল তাকে। সিটে ফিরে আসতেই অসি মেয়েটা তাকিয়ে রইল তার বিয়ারের ক্যানের দিকে। উজ্জ্বলভাবে হাসল ডেভিড।