বাইরের খালের ওপারে কোন পথে হাঁটা যায় এমন এক জায়গায় আরো তিনটা মেয়ের সাথে থাকার জায়গা শেয়ার করে গিলডা। সরু সিঁড়ি বেয়ে একটাইমাত্র স্যামসোনাইট স্যুটকেস নিয়ে ডেভিডকে উঠে আসতে দেখেও কোন বিস্ময় ফুটলো না তাদের চোখে। কেউ কোনরূপ বাধাও দিল না। যাই হোক নগরীর প্রাণচঞ্চল্য বলতে একের পর এক ডিসকো আর কফি বারে নিয়ে গেল তাকে গিল; যেখানে নেশায় বুঁদ হয়ে বিপ্লবের বাণী আওড়ায় ঘরপোড়া মানুষেরা। দু’দিনের মাঝেই ডেভিড আবিষ্কার করে ফেলল যে এ সব মদের স্বাদ কতটা বিস্বাদ, কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। আর গিলডার ভেতরটাও ঠিক তার বাইরেরটার মতই স্নিগ্ধ আর দাগহীন। ডেভিড শুনেছিল যে এ শহরের পুলিশ বাহিনী নাকি সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে করিঙ্কৰ্মা, মনে পড়ে অস্বস্তি হলো তার। প্রকৃতপক্ষে তাদের মাঝে নিজের মতোই দিশেহারা ভাব লক্ষ্য করল ডেভিড। মনে হলো তারই মতো কিছু একটার অন্বেষনে নেমেছে তারাও। এর সাথে আবার খালের উপর থেকে নিচু ভূমির স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া মনে হলো যেন শেষবিচারের দিনে মৃতদের আত্মা উঠে আসছে। এছাড়া তোমার জন্ম যদি হয় আফ্রিকার সূর্যের নিচে তাহলে উত্তরের শীতল জলবায়ু ধূসর লাগবে বৈকি।
বিদায় জানানোর সময় দৃশ্যত কোন অভিব্যক্তি ফুটলো না গিলডার মাঝে। মুস্তাং ক্যাবের হিটার চালু করে দক্ষিণে ছুটলো ডেভিড। নামুর-এর বাইরের দিকে রাস্তার পাশে দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। এত ঠাণ্ডাতেও তার পা উনুক্তি আর বাদামী। খাটো ফেডেড নীল ডেনিমের নিচে আকর্ষণীয়ই দেখাচ্ছে তা। সোনালি মাথা নাড়িয়ে বুড়ো আঙুল দেখাল মেয়েটা।
রাবার টায়ারের ঘর্ষণ তুলে ব্রেক করল ডেভিড। পিছিয়ে গেল মেয়েটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে। দেহাবয়ব পুরোপুরি স্লাভিক সমতল ভূমি। চুল সাদা সোনালি, মোটা হয়ে পিছনে ছড়িয়ে আছে, ডেভিড অনুমান করল মেয়েটার বয়স হতে পারে উনিশ।
ইংরেজি বলতে পারো?’ জানালা দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল ডেভিড। পাতলা ফ্যাব্রিকের শার্টের উপর দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে যৌবনের ছোঁয়া।
‘না’, জানাল মেয়েটা, কিন্তু আমি অ্যামেরিকান জানি–কাজ হবে এতে?
‘রাইট অন!’ প্যাসেঞ্জার ডোর খুলে দিল ডেভিড। ব্যাগ ছুঁড়ে দিয়ে স্লিপিং ব্যাগ ঠেলে দিল সীটের উপরে মেয়েটা। নাম জানাল ডেভিডকে।
‘আমি ফিলি।
‘ডেভিড।
“তুমি কি শোবিজে আছো?
‘গড, না–কেন মনে হলো এমনটা?
‘গাড়ি চেহারা-কাপড় চোপড়।
‘গাড়ি। ভাড়া নেয়া কাপড় চুরির মাল আর আমি মুখোশ পরে আছি।’
ফানি ম্যান।’ বলেই সিটের উপর গুটিসুটি মেরে একটা বিড়াল ছানার মতো ঘুমিয়ে পড়ল মেয়েটা।
আর্ডেনসের জঙ্গল যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেখানে একটা গ্রামে থামলো ডেভিড। কিনে আনল লম্বা মুচমুচে রুটি, ধোয়ায় ঝলসানো বন্য শুকরের মাংস আর মম্যাত শ্যাফনের বোতল। গাড়ির কাছে ফিরে আসতে–দেখল জেগে উঠেছে ফিলি।
‘ক্ষুধা পেয়েছে? জানতে চাইল ডেভিড।
হ্যাঁ, আড়ামোড়া ভাঙ্গলো ফিলি।
জঙ্গলের মধ্যে কাঠের গুঁড়ির একটা পথ চলে গেছে দেখতে পেল ডেভিড। অনুসরণ করতেই সবুজ রঙ ক্যাথেড্রালে পৌঁছে গেল তারা। সোনালি সূর্যের আলো চুঁইয়ে পড়ছে গম্বুজ থেকে।
চত্বরে উঠে চারপাশে তাকিয়ে দেখল ফিলি। আগ্রহে আর উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল, “খুব ভালো হয়েছে, ডেভি, বেশ সুন্দর চারপাশ!
পেপার কাপে দু’জনের জন্যে শ্যাম্পেন ঢেলে নিল ডেভিড। পেন নাইফ দিয়ে মাংসের ফালি কেটে নিল। এই ফাঁকে পাউরুটি টুকরো করল ফিলি। পড়ে থাকা একটা গাছের গুঁড়ির উপর পাশাপাশি বসে খেতে শুরু করল, দুজনে।
চারপাশ এতো নির্জন আর শান্ত–খুনোখুনির কোন চিহ্নই নেই। ‘এখানেই জার্মানিরা তাদের শেষ চেষ্টা করেছিল–জানো তুমি এটা?
মুখ ভর্তি রুটি আর মাংস নিয়েও উত্তর দিল ফিলি। আমি দেখেছি মুভিটা। হেনরি ফোল্ডা, রবার্ট রায়ান–পুরোপুরি ভোলামকুচির মতো আচরণ হয়েছে এখানে।
‘সমস্ত কুৎসিত আর মৃত্যুর স্মৃতি সরিয়ে আমাদের উচিৎ এখানে সুন্দর কিছু করা। স্বপ্নাতুর দৃষ্টিতে বলে উঠল ডেভিড। রুটি গলাধকরণ করে এক চুমুক ওয়াইন খেয়ে উঠে দাঁড়াল ফিলি। ফিরে গেল মুস্তাং-এর কাছে। স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে এসে কচি পাতার উপর পেতে নিল।
‘কিছু বিষয় নিয়ে শুধু কথা বলাই ভালো–অন্যগুলো কাজ করার জন্য। ডেভিডকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল ফিলি।
প্যারিসে গিয়ে কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছিল যে এটা হয়তো দরকার, হয়তো পরস্পরের জন্য তারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। গোঁয়ার সেন্ট লাজারের কাছে সুন্দর পরিষ্কার একটা রুম খুঁজে পেল শাওয়ার সহ। কনকডে থেকে ইটোলি পর্যন্ত সারাদিন হেঁটে বেড়ালো পথ থেকে পথে। এরপর আইফেল টাওয়ার পার হয়ে ফিরে এলো নটরডেমে। রাতের খাবার খেল রাস্তার পাশের ক্যাফে বাউল মিকে কিন্তু খাবার অর্ধেক পর্যায়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ল দু’জনে। হঠাৎ করেই ফুরিয়ে গেল কথা, একই মুহূর্তে টের পেল দুজনেই, একে অপরের পুরোপুরি অজানা হলেও উত্তেজনা কম হলো না। একসাথে রাত কাটিয়ে কেজো প্রেম আর শূন্য ভালোবাসার পরে সকালে শাওয়ার সেরে বের হতেই ডেভিডকে জানিয়ে দিল ফিলি, তুমি ভেঙ্গে চুরে যাচ্ছ। এটা কোন প্রশ্ন নয়, বক্তব্য, তাই কোন উত্তরও দরকার হলো না।