এই মুহূর্তে জোড়া প্লেনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে, তার লোকেরা কন্ডিশন ব্রাভোর জন্যে ব্যস্ত দক্ষতার সাথে তৈরি করছে নিজেদের। দুটো প্লেনই কমার্শিয়াল এয়ারলাইন স্টাইলে রঙ করা হয়েছে, পেটের কাছে গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা, হোর কমিউনিকেশন। কোনো বাধা না পেয়ে পৃথিবীর যে কোনো এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে পারবে ওগুলো। থোর কমান্ডের কমান্ডোরা পাসপোর্ট ছাড়াই যে কোনো দেশে ভ্রমণ করতে পারবে, শুধু আইডেনটিটি কার্ডই যথেষ্ট। এ ব্যাপারে সদস্য দেশগুলো গঠনতন্ত্রে সই করার সময়ই অনুমতি দিয়ে রেখেছে।
কোথায় কি ঘটতে যাচ্ছে শুনি? ল্যান্ড-রোভারের দরজা বন্ধ করে কলিনের পাশাপাশি হাঁটা ধরল পিটার।
নিখোঁজ প্লেন, স্যার। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। ধেত্তেরি, খাবলা মেরে জান খারাপ করে দিল! প্রচণ্ড বাতাস কলিনের ওভারঅলের পায়া আর আস্তিন ধরে টান দিচ্ছে।
কোথায়?
ভারত মহাসাগরে।
কন্ডিশন ব্রাভোর জন্যে আমরা তৈরি? নিজের কমান্ড প্লেনে ওঠার সময় জিজ্ঞেস করল পিটার।
অল সেট, স্যার।
হেডকোয়ার্টার আর কমিউনিকেশন সেন্টারের উপযুক্ত করে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে হকারের ভেতরটা। ফ্লাইট ডেকের ঠিক পিছনেই আরামদায়ক চারটে সীট চারজন অফিসারের জন্যে। পরের জায়গাটুকু দুজন ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার আর তাদের ইকুইপমেন্টের জন্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সম্পূর্ণ আলাদা একটা কমপার্টমেন্ট। তারপর ছোট একটা টয়লেট, একেবারে পিছনে গ্যালি।
মাথা নিচু করে কেবিনে ঢুকতেই মাঝখানের দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল একজন টেকনিশিয়ান। গুড ইভনিং, জেনারেল-অ্যাটলাসের সাথে ডাইরেক্ট লাইনে রয়েছি আমরা।
ভদ্রলোককে স্ক্রীনে আনো, নির্দেশ দিল পিটার, ছোট ওয়ার্কিং ডেস্কের পিছনে প্যাড লাগানো চেয়ারে বসল আরাম করে।
সরাসরি পিটারের দিকে মুখে করে রয়েছে চৌদ্দ ইঞ্চি টিভিটা, তার ঠিক ওপরেই কনফারেন্স কমিউনিকেশনের জন্যে রয়েছে ছয় ইঞ্চি স্ক্রীন সহ চারটে সেট। চৌদ্দ ইঞ্চিটা মেইন স্ক্রীন, সেটা সচল হয়ে উঠল, সাথে সাথে বড়সড় একটা মাথা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠল স্ক্রীনে। প্রথম দর্শনেই শ্রদ্ধার ভাব জাগে মনে।
গুড আফটারনুন, পিটার। হাসিটা আন্তরিক, চুম্বকের মতো টানে।
গুড ইভনিং, স্যার।
ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে ডক্টর পার্কার বোঝাতে চাইলেন পিটারের মতো তিনিও যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের সময়ের ব্যবধান সম্পর্কে সচেতন।
ঠিক এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছি আমরা, পিটার। শুধু জানি, বি,এ, জিরো-সেভেন-জিরো চারশ একজন প্যাসেঞ্জার আর ষোলো জন ক্রু নিয়ে মাহে থেকে নাইরোবি আসছিল, বত্রিশ মিনিট হয়ে গেল ওটার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
ইন্টেলিজেন্স ওভারসাইট বোর্ডের সভাপতি ছিলেন ডক্টর পার্কার, তিনি শুধু আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে সরাসরি রিপোর্ট করে থাকেন। ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ডক্টর পার্কার দুজন তারা এক স্কুল এবং একই কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন।
ডক্টর পার্কার একজন শিল্পী, প্রতিভাবান সঙ্গীতজ্ঞ। দর্শন আর রাজনীতির ওপর সাড়া জাগানো চারটে বই আছে তাঁর। দাবায় তিনি গ্র্যান্ড মাস্টার। নানা বিষয়ে সুগভীর জ্ঞানের অধিকারী ভদ্রলোক, ভাবাবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে ক্ষুরধার বুদ্ধির সাহায্যে সমস্যা সমাধানে অভ্যস্ত, মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। অথচ তবু তাকে একজন রহস্যময় ব্যক্তি না বলে উপায় নেই, কারণ উৎসুক প্রচার মাধ্যমগুলোকে সব সময় এড়িয়ে থাকেন তিনি, গোপন করে রাখেন নিজের উচ্চাশা। অবশ্য তাঁর কোনো উচ্চাশা আছে কিনা বলা কঠিন। তাঁর মতো একজন মানুষের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবার স্বপ্ন দেখা অসঙ্গত বা অসম্ভব নয়। প্রচার-বিমুখ এই জ্ঞানসাধক চুপচাপ শুধু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, কাঁধে যত বোঝাই চাপানো হোক প্রতিবাদ করতে জানেন না।
থোর কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে পিটারের নাম প্রস্তাব করা হয় মাস কয়েক আগে, তারপর পাঁচ-ছয় মাস আগে ডক্টর পার্কারের সাথে দেখা হয়েছে ওর। ডক্টর পার্কারের নিউ ইয়র্কের বাড়িতে একবার পুরো একটা রোববার কাটিয়েছে পিটার। ভদ্রলোককে যতই দেখেছে পিটার, ততই শ্রদ্ধা জেগেছে মনে। কোনো সন্দেহ নেই অ্যাটলাসের প্রেসিডেন্ট হবার উপযুক্ততা একমাত্র তাঁরই আছে। ট্রেনিং পাওয়া একদল সৈনিকের ওপর একজন দার্শনিকের প্রভাব খুব কাজ দেবে। তার মতো একজন সফল কূটনীতিকের পক্ষে সরকার প্রধানদের সাথে যোগাযোগ রাখা খুব সহজ হবে। এবং সঙ্কটের সময় যখন শত শত নিরীহ মানুষের জীবন ধ্বংসের মুখোমুখি, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সৎসাহস এবং দৃঢ়তা শুধু তার কাছ থেকেই আশা করা যায়।
অল্প কথায় পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পিটারকে তিনি বললেন, মনে হচ্ছে এটা একটা পারফেক্ট টার্গেট। দুনিয়ার নামকরা প্রায় সব কজন সার্জেন রয়েছে প্লেনটায়, আঠারো মাস আগেই কনভেনশনের জায়গা আর দিন-তারিখ সবার জানা ছিল। ডাক্তারদের একটা চমৎকার ভাবমূর্তি আছে, পাবলিক সেন্টিমেন্টে ঘা দেয়ার জন্যে সেটা ভালো কাজ দেবে। আমেরিকান, ব্রিটিশ, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, জার্মান, ইটালিয়ান,সব দেশেরই লোক রয়েছে ওদের মধ্যে। চার-পাঁচটা দেশের আবার দুর্নাম রয়েছে, সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে তারা মোটেও কঠোর নয়। প্লেনটা ব্রিটিশ কিন্তু হাইজ্যাকাররা সম্ভবত এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবে সেটাকে, গোটা ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে উঠবে-পলিটিক্যালি। দেখা যাবে, আমরা হয়তো পাল্টা আঘাত হানার কোনো সুযোগই পাব না।