মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের পাতা যেমন কাপে তেমনি কাঁপতে লাগল আরোহীরা, কাছেপিঠে কোথাও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল একজন মহিলা। চাপা গলার কান্না, কেউ এমনকি তার দিকে তাকাল না পর্যন্ত।
তবে দয়া করে কেউ উদ্বিগ্ন হবেন না। সে ধরনের কিছু ঘটতে যাচ্ছে না। কারণ আমি জানি আপনারা সবাই আমার নির্দেশগুলো মেনে চলবেন। তারপর সব যখন ভালোয় ভালোয় শেষ হবে, যে যার ঠিকানায় ফিরে যাবার সময় এই অপারেশনে ভূমিকা রাখার জন্যে সবাই আপনারা গর্ব অনুভব করবেন। আমরা সবাই মহান এবং গৌরবময় একটা মিশনে অংশগ্রহণ করছি। মানবকল্যাণ এবং স্বাধীনতার পক্ষে আমরা সবাই এক-একজন অকুতোভয় যোদ্ধা, বঞ্চিত মানুষের প্রাপ্য আদায়ে বদ্ধপরিকর। নতুন এক জগৎ সৃষ্টির কাজে আজ আমরা বড় একটা পদক্ষেপ নিয়েছি। সবাই মিলে ঝেটিয়ে দূর করব সব রকম অত্যাচার, বৈষম্য, দুর্নীতি, শোষণ আর অবিচার। আসুন, আমরা শপথ নেই অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায় এবং তাদের কল্যাণের জন্যে নিজেদের আমরা উৎসর্গ করব।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এখনো কাঁদছে মহিলা, তার সাথে পাল্লা দিতে শুরু করল ছোট একটা বাচ্চা।
কালোকেশী জার্মান মেয়েটা নিজের সীটে ফিরে এল, ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করল সে। এই ক্যামেরাটাই মাহে এয়ারপোর্টে ধরা পড়েছিল মেটাল ডিটেকটরে। নাইলনের স্ট্র্যাপটা মাথায় গলাল সে, গলায় ঝুলিয়ে নিল ক্যামেরা, তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে অবশিষ্ট পিস্তল দুটো জোড়া লাগাতে বসল।
দ্রুতহাতে কাজটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল সে, পিস্তল দুটো ছাড়াও হাতে কার্টিজ বেল্ট রয়েছে। গ্যালি এলাকার ভেতর দিয়ে সোজা ফ্লাইট ডেকে চলে এল সে। নির্লজ্জের মতো তার ঠোঁটে চুমো খেল ইনগ্রিড।
ক্যারেন–আই লাভ ইউ! ক্যামেরাটা নিয়ে নিজের গলায় ঝোলাল স্বর্ণকেশী। এটা, ক্যাপটেনকে ব্যাখ্যা করল সে, যা দেখছেন তা নয়। এটা একটা রিমোট রেডিও ডিটোনেটর, কেবিনের গ্রেনেডগুলো ফাটিয়ে দেবে।
কথা না বলে মাথা ঝাঁকাল ক্যাপটেন। চেহারায় প্রকাশ্যে স্বস্তির ভাব নিয়ে পিনটা আবার জায়গামতো ঢুকিয়ে দিয়ে গ্রেনেডটাকে ডিজআর্ম করল ইনগ্রিড, অনেকক্ষণ ধরে মুঠোর ভেতর রাখায় তালুর ঘামে ভিজে গেছে। বান্ধবীর হাতে গুঁজে দিল সেটা।
উপকূলে পৌঁছুতে আর কতক্ষণ লাগবে? কোমরে কার্লিজ বেল্ট জড়াতে জড়াতে জিজ্ঞেস করল সে।
বত্রিশ মিনিট, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার সাথে সাথে জবাব দিল।
পিস্তলের ব্রীজ খুলল ইনগ্রিড, লোড চেক করল, তারপর হাত-ঝাপটা দিয়ে বন্ধ করল আবার। তুমি আর হেনরি এবার বিশ্রাম নিতে পারো, ক্যারেনকে বলল সে। বিশ্রাম মানে ঘুমাতে হবে।
অপারেশনটা দীর্ঘ কয়েকদিন ধরে চলতে পারে, তখন ক্লান্তি ওদের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দেখা দেবে। সেজন্যেই ভেবেচিন্তে এত বড় করা হয়েছে দলটাকে। এখন থেকে, শুধু ইমার্জেন্সি ছাড়া, দুজন করে বিশ্রাম নেবে।
গোটা ব্যাপারটা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছেন আপনারা, পাইলট সিরিল ওয়াটকিংস প্রশংসার সুরে বলল,-এখনো পর্যন্ত।
ধন্যবাদ, সুরেলা কণ্ঠে হেসে উঠল ইনগ্রিড, তার একটা হাত সীটের পিঠ ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল, ক্যাপটেনের কাঁধে মৃদু চাপ দিল সে। আজকের এই দিনটার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করেছি আমরা।
.
সরু গলির শেষ মাথায় কম্পাউন্ডের গেট দেখা গেল, ল্যান্ড-রোভারের গতি না কমিয়ে পরপর তিনবার হেডলাইট জ্বালাল আর নেভাল পিটার। তাড়াহুড়ো করে ঠেলে গেট খুলে দিল সেন্ট্রি, পরমুহূর্তে সগর্জনে তাকে পাশ কাটাল গাড়ি।
কোথাও ফ্লাডলাইট জ্বলছে না, নেই কোনো ব্যস্ত ছুটোছুটি, প্রতিধ্বনিবহুল বিশাল গুহা আকৃতির হ্যাঙ্গারে শুধু পাশাপাশি একজোড়া প্লেন দাঁড়িয়ে রয়েছে।
গোটা হ্যাঙ্গার একা লকহীড হারকিউলিসটাই যেন দখল করে রেখেছে। হ্যাঙ্গারটা আসলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ছোট ছোট প্লেনের জন্যে তৈরি করা হয়েছিল। হারকিউলিসের লম্বা, খাড়া ফিন ছাদের কাছাকাছি মাচা প্রায় ছুঁইছুই করছে। তার পাশে হকার সিডলি এইচ-এস ওয়ান-টু-ফাইভ একজিকিউটিভ জেট খেলনার মতো লাগছে। থোর কমান্ড শুধু এই দু-দেশের বিমানই নয়, আরো কয়েকটা দেশের বিমান পেতে যাচ্ছে।
ভালো রাত বলতে হয়, কলিন এগিয়ে আসে। ল্যান্ডরোভারের ইঞ্জিন বন্ধ হতেই পাশে এসে দাঁড়াল সে, কথার সুরে মধ্য-পশ্চিম আমেরিকান টান। ইউ. এস. মেরিনসের মেজর হলেও, চেহারা দেখে মনে হবে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির সেলসম্যান।
নীল ওভারঅক্স আর সুতি কাপড়ের ক্যাপ পরেছে কলিন, দুটোতেই লেখা রয়েছে–থোর কমিউনিকেশনস। সৈনিক নয়, বরং টেকনিশিয়ান বলে মনে হচ্ছে। ওকে।
পিটারের সেকেন্ড ইন কমান্ড কলিন, থোর-এর কমান্ডার হিসেবে পিটার ছয় সপ্তাহ আগে যোগ দেয়ার পর প্রথম পরিচয়। খুব একটা লম্বা নয় কলিন, তবে শরীরটা বেশ ভারী। প্রথম দর্শনে তাকে মোটা বলে মনে হতে পারে, কারণ চওড়ায় একটু যেন বেশি সে। কিন্তু শরীরের কোথাও অতিরিক্ত মেদ নেই, সবটুকুই হাড় আর পেশি। সেনা বাহিনিতে হেভিওয়েট বক্সার হিসেবে খ্যাতি আছে তার, চওড়া হাশিখুশি মুখের ওপর নাকটা ব্রিজের ঠিক নিচে ভাঙা-সামান্য ফুলে গিয়ে দু-এক সুতো বেকে আছে। সবচেয়ে আগে দৃষ্টি কাড়ে পোড়া চকলেট রঙের চোখজোড়া, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সর্বভুক্ত। পিটারের প্রশংসা অর্জন করা সহজ কথা নয়, মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সফল হয়েছে কলিন।